মার্কিন আধিপত্যবাদীদের ঘুম হরণকারী মহাবীর ফিদেল ক্যাস্ট্রোর । লেখক ;বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী



     

ফিদেল ক্যাস্ট্রো ॥ মার্কিন আধিপত্যবাদীদের ঘুম হরণকারী



 
৯০ বছর বয়সে মৃত্যুকে কেউই অকাল মৃত্যু বলবে না। তদুপরি এ বয়সে কোন মানুষ থেকে নতুন কোন অবদানও আশা করা যায় না। কিন্তু তবুও মহাবীর ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যু কেন সারা বিশ্বের প্রগতিশীল মানবকুলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিল? তার জবাব একটাই, ক্যাস্ট্রো ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি যুদ্ধাস্ত্র এবং আর্থিক বাহুবলে বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে তার ক্ষুদ্র দ্বীপের দেশটির স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন।
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাস। স্কুলের গণ্ডি তখনও পার হইনি। চারদিকে এক অনিশ্চিত আতঙ্ক- কখন আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ধ্বংস করে দেবে গোটা বিশ্বকে। আর আতঙ্কের স্রষ্টা আর কেউ নয়- নব্য সাম্রাজ্যবাদের নায়ক স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র এবং তার রাষ্ট্রপতি জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি।
মাত্র ৮২ জন কমরেডকে নিয়ে শুরু করা গেরিলা যুদ্ধ শেষে ১৯৫৯ সালে মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী বাতিস্তার সরকার উৎখাত করে ক্ষমতায় যান ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা। এ যুদ্ধে ক্যাস্ট্রোর অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন ভগ্ন স্বাস্থ্যের বিপ্লবী আর্নেস্তো গোয়েভেরা, যিনি চে গোয়েভেরা নামেই বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। এই বিপ্লবীদের ক্ষমতা আরোহণের সময়ও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরে যখন ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা তাদের সমাজতান্ত্রিক পরিচয় উন্মোচন করলেন, ঠিক তখনই মাথা খারাপ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের প্রতিবেশী একটি দ্বীপে, যে অঞ্চলকে তারা তাদের বেক-ইয়ার্ড বলে দাবি করে, সেখানেই একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ থাকবে এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে! কিভাবে অঙ্কুরেই এ সমাজতান্ত্রিক দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায় এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হলো খোদ হোয়াইট হাউসে। এতে শরিক হলেন জন কেনেডির উপদেষ্টাবৃন্দ অর্থাৎ একজিকিউটিভ কমিটির সদস্যগণ যথা জর্জ বান্ডি, জর্জ বল, ডগলাস ডিলন, রোজযয়েল গিলেপেট্রিক, লিন্ডন বি জনসন, এলেক্সিস জনসন, জন মেককোন, রবার্ট মেকনেমারা, পল নিটজ, ডিন রাস্ক থিউডর সরেনসেন, জেনারেল মেক্সওয়েল টেইলার, লেলউইন থম্পসন এবং প্রেসিডেন্টের সহোদর রবার্ট কেনেডিও। যুক্তরাষ্ট্রের উক্ত সিদ্ধান্তের কথা অচিরেই কিউবা এবং কিউবার বিপ্লবী সরকারের বিশেষ বুন্ধ মস্কোতে পৌঁছে। কিউবা তথা কিউবার ন্যায়সঙ্গত সরকারকে রক্ষা করার প্রয়াসে দু’দেশেই বিভিন্ন চিন্তাভাবনার পর যা স্থির হলো তা এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের ললুপ দৃষ্টি এবং আগ্রাসনী কর্ম থেকে কিউবাকে রক্ষা করতে হবে এবং কিউবাতে বিভিন্ন ধরনের আণবিক বোমা বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন ছাড়া মার্কিন আগ্রাসন থেকে কিউবাকে রক্ষা করা যাবে না। ধরে নেয়া হয়, এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা বসানো হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করবে এবং আগ্রাসনের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত রাখবে।
এ পরিকল্পনা নিয়েই সোভিয়েত রাশিয়া, কিউবাতে পারমাণবিক বোমা বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন শুরু করে যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা, আগ্রাসন নয়।
ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ কার্যাদি মার্কিন গোয়েন্দা বিমান ইউ-২র ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগন আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যায়। কিউবার এত বড় স্পর্ধা সহ্য করতে না পেরে ক্যাস্ট্রোকে উচিত শিক্ষা দেয়ার উন্মাদনায় মেতে ওঠে মার্কিন প্রশাসন এবং সমর নায়করা। শুরু হয় হোয়াইট হাউসে একজিকিউটিভ কমিটির একের পর এক বৈঠক।
সে সময়ে টেপ রেকর্ড করা কথাবার্তা থেকে যা জানা গেছে তা এমনÑ
’৬২ সালের ১৬ অক্টোবরের সকালের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বলেন, মস্কো থেকে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এসে যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত করা আর ৯০ মাইল দূরত্বে কিউবা থেকে উড়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য হবে না। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিসমূহে সীমিত বিমান আক্রমণের। একই দিন বৈকালিক বৈঠকে অবশ্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠেÑ কিউবায় কোন ধরনের আক্রমণ, তা যত ছোটই হোক না কেন, চালানো হলে তার প্রতিক্রিয়া এবং পরিণতি কি হতে পারে।
১৭ অক্টোবরের বৈঠক, যা সংঘটিত হয় স্টেট ডিপার্টমেন্টে, তা হয় প্রেসিডেন্ট কেনেডির অনুপস্থিতিতে। ওই সভায় অংশগ্রহণকারীদের মনোভাব ছিল বিমান আক্রমণ ছাড়া কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ অবস্থা সৃষ্টি করা এবং একই সঙ্গে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা। ওই সভায় প্রেসিডেন্টের বিশেষ নিমন্ত্রণে হাজির থাকা প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডিন এচেসন কিউবার স্থাপিত পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ সমূলে বিনষ্ট করার জন্য সত্বর বিমান আক্রমণের তাগাদা দেন। তিনি বলেন, এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির এবং দ্ব্যর্থহীন অবস্থানের কথা জেনে যাবে।
১৮ অক্টোবরের বৈঠকে ইউ-২ বিমান থেকে তোলা ছবিতে কিউবায় স্থাপিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ছবি দেখানো হয়। আরও দেখানো হয় সোভিয়েত বোমারু বিমান। তখন একটি পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পক্ষে যুক্তি তোলা হয় এবং আকস্মিক বিমান আক্রমণের চিন্তা পরিহার করার কথা বলা হয়। তবে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এর বিরুদ্ধে মত দেন এই বলে যে, সে ধরনের পরিস্থিতিতে রাশা পশ্চিম জার্মানি আক্রমণ করতে পারে। তিনি তুরস্কে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের উপস্থিতিও একটি ইস্যু হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেন এবং এ মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরাসরি আক্রমণের ফলে একটি পারমাণবিক যুদ্ধও শুরু হতে পারে। প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের পর কিউবা অবরোধ করার প্রস্তাবই জোরালো হয়।
১৯ অক্টোবর মাঝ রাতে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ওভাল অফিসে গমন করেন এবং জানান, অবরোধের সিদ্ধান্তই বেশি সমর্থনযোগ্য, তবে এর মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা হবে না। শুক্রবার ১৯ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট কেনেডি সামরিক বাহিনীসমূহের যুগ্ম প্রধানের কাছে তার ঘেরাও প্রস্তাবের কথা বললে সকলেই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বলেন, তাহলে একটি আণবিক যুদ্ধই বেঁধে যাবে যার ফলে রাশিয়ান বোমার আঘাতে ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন লোক প্রাণ হারাবে। সোজা কথায় একটি দেশ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। একই দিন বিকেলের বৈঠকে একজিকিউটি সদস্যগণ সম্পূর্ণ বিভক্ত আঙ্গিক থেকে মত দেন।
২০ অক্টোবর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট মেকনেমারা ঘেরাওয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। সামরিক বাহিনীর যুগ্ম প্রধানদের চেয়ারম্যন জেনারেল মেক্সওয়েল টেইলার বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো আক্রমণই বেশি কার্যকর হবে। একই সময় এ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি বলেন যে, ক্যাস্ট্রোকে শেষ করার এটাই মোক্ষম সময়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি অবশেষে কিউবা অবরোধের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রয়োজনে তুরস্ক থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র তুলে ফেলার কথাও বলেন। উনি আশা করেছিলেন এর ফলে রাশিয়া তাদের কিউবাগামী জাহাজসমূহ ফিরিয়ে নেবে। তবে অন্যটাও হতে পারে, অর্থাৎ রাশিয়াও ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করতে পারে।
২২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন ঘেরাও সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মানসে। তিনি বলেন, এর ফলে রাশিয়া প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চভ বার্লিন বা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও আক্রমণ চালাতে পারে।
একই দিন কয়েক সাংসদ, বিশেষ করে সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি প্রধান সিনেটর উইলিয়াম ফুলব্রাইট কঠোর ভাষায় অবরোধ কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন এবং পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পক্ষে মত দেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, তা হলে আণবিক যুদ্ধ বেঁধে যাবে। তিনি বলেন, পুরো ভবিষ্যতই অনিশ্চিত, কে জানে কি হবে।
২৪ অক্টোবর ঘেরাও কর্মসূচী শুরু হয় এবং মার্কিন সেনাদের ব্রিফ করা হয়। এদিকে ক্রুশ্চেভ নির্ভয়ে সতর্ক করে বলেন, কোন সোভিয়েত জাহাজ আটক করতে দেয়া হবে না। তার উক্তি মার্কিনীদের সংশয় বাড়িয়ে দেয়। কেনেডি বলেন, আনন্দিত হওয়ার কোন কারণ নেই- ক্রুশ্চেভের ভাষা অনেক কঠোর।
২৫ অক্টোবর মার্কিন গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেন যে, কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্রে ঘাঁটি নির্মাণ দ্রুত এগুচ্ছে। এ অবস্থায় রবার্ট কেনেডির উপদেশে প্রেসিডেন্ট কেনেডি সিদ্ধান্ত নেন- প্রয়োজনে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো হবে।
২৬ অক্টোবর সিআইএ প্রধান সতর্ক করে বলেন, যেহেতু কিউবায় বহু মারাত্মক অস্ত্র রয়েছে সেহেতু কিউবা আক্রমণের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।
২৬ অক্টোবর দিন শেষে ক্রুশ্চেভের চিঠি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে যাতে ক্রুশ্চেভ প্রস্তাব করেন যে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা আক্রমণের সিদ্ধান্ত পাল্টালে, রাশিয়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করবে। পরদিন সোভিয়েত নেতা বেতার ভাষণে বলেন, তুরস্ক থেকেও মার্কিন মিসাইল সরাতে হবে।
প্রেসিডেন্ট কেনেডি ২৬ অক্টোবরের একজিকিউটিভ কমিটির বৈঠকে বলেন, সোভিয়েত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ভুল হবে। তিনি একই সঙ্গে এ ধরনের প্রস্তাবকে গুরুত্ব না দেয়ায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কঠোর সমালোচনা করেন।
এর মধ্যে ২৬ অক্টোবর একটি মার্কিন ইউ-২ বিমানকে কিউবায় ভূপাতিত করা হয় সোভিয়েত স্যাম ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে। ফলে পাইলটেরও মৃত্যু হয়। এরপর আরও একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমানকে আঘাত করা হয়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি প্রস্তাব করেন যথাশীঘ্র সম্ভব কিউবায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং তুরস্কে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। একই সঙ্গে তিনি কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিসমূহ নিশ্চিহ্ন করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি অবশেষে ক্রুশ্চেভের প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ভাই রবার্ট কেনেডিকে গোপনে সোভিয়েত দূতাবাসে পাঠান।
এভাবে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোপন সমঝোতায় রাজি হলে, ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট দূর হয়েছে বলে ওয়াশিংটনে দাবি তোলা হয় ২৭ অক্টোবর।
২৭ অক্টোবর রাত ৮.০০ ঘটিকায় প্রেসিডেন্ট তার উপদেষ্টাদের জানান, রবার্ট কেনেডি সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে প্রেসিডেন্ট কেনেডির চিঠি হস্তান্তর করবেন, যার মধ্যে সমঝোতার অঙ্গীকার রয়েছে। বৈঠকে এটাও নির্ধারিত হয় যে, কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট দূর হলে তুরস্ক থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র সরানো হবে।
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব নস্যাত করবে না এবং তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র তুলে নেবে এ প্রস্তাব দুটির ভিত্তিতে যে সমঝোতা হয় তা একদিকে যেমন বিশ্বকে আণবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে, অন্যদিকে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে কিউবার বেঁচে থাকার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়। কিউবান বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার সময় ক্যাস্ট্রো যেমন অনড় এবং অটল ছিলেন, তেমনি অটল ছিলেন ১৩ দিনের ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময় কোন অবস্থায়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী দাবির কাছে নত হবেন না এটাই ছিল তার দৃঢ় প্রত্যয়। যার কারণে মার্কিনীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়, এই অঙ্গীকার করে যে, তারা কিউবা আক্রমণ করবে না।
মার্কিনীরা ১৫১ বার ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কোনটাই সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক অবরোধ, বিশেষ করে কিউবান চিনি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের মাধ্যমে সঙ্কট সৃষ্টি করেও সুবিধা করতে পারেনি। কিউবাতে গড়ে উঠেছে তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে সফল চিকিৎসা সার্ভিস। তবে আশির দশকের শেষ দিকে পেরেস্ত্রয়কা এবং গ্লাসনস্তের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে ক্যাস্ট্রো কিছুটা হলেও নিরাশ হয়ে পড়েন যে বিপ্লবকে তিনি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
১৯৮৯ সালের ২ এপ্রিল মিখায়েল গর্বাচেভ হাভানা গিয়ে ক্যাস্ট্রোকে বোঝাতে চাইলে ক্যাস্ট্রো বুঝতে পারেন গর্বাচেভ সিআইয়ের ফাঁদে পা দিয়েছেন। গর্বাচেভ মাইকে কিছু ছবক দেয়ার চেষ্টা করলে ক্যাস্ট্রো মাইক ছাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।
ক্যাস্ট্রোর প্রভাবে দক্ষিণ আমেরিকায় বেশকিছু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা গড়ে উঠেছিলেন যাদের মধ্যে নিকারাগুয়ার ডানিয়েল অর্তেগা, চিলির সালভাদর আয়েন্দে এবং হিওগো সেভেজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভঙ্গুর অবস্থায় তখন যুক্তরাষ্ট্র অন্য একটি দ্বীপরাষ্ট্র দখল করে সেখানকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সরকার উৎখাত করেছিল, দেশটির নাম গ্রানাডা। ঠিক একইভাবে তারা কিউবাও দখল করতে চেয়েছিল, পারেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বীরত্বগাথা নেতা হিসেবে, মার্কিন আগ্রাসনকে দাঁত ভাঙ্গা জবাবের মাধ্যমে স্তব্ধ করার ক্ষমতা রাখা নেতা হিসেবে, ক্যাস্ট্রো শ্রদ্ধাভরে বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল। ক্যাস্ট্রো যেমন নির্ভয় বীর ছিলেন তেমনি বীর ছিলেন আমাদের জাতির পিতাও। তাই এক বীর অন্যজনকে তুলনা করেছিলেন হিমালয় পর্বতের সঙ্গে।
লেখক : সাবেক বিচারপতি, আপীল বিভাগ
বাংলাদেশ সুপ্রীমকোট

  (সৌজন্য ;  দৈনিক জনক্ঠ )


মন্তব্যসমূহ