কিরতাসের ঘটনা: ও কাবা ভাঙার ইতিহাস লিখেছেন: সুব্রত শুভ


ইসলামের রক্তাক্ত লড়াই ও কাবা ভাঙার ইতিহাস
লিখেছেন: সুব্রত শুভ — শনি, 11/05/2016 - 09:07

কাবা/ক্বাবা মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র ঘর। যদিও কাবার গুরুত্ব সবসময় ছিল অর্থনৈতিক নির্ভর। অর্থনৈতিক কারণে কাবা ও মক্কা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নবী মুহাম্মদের জন্মের পূর্বে ইয়েমেনের এক রাজা কাবা ধ্বংস করে কাবার অর্থনৈতিক স্রোত স্রোত ইয়েমেনের দিকে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি তখন ব্যর্থ হোন। কাবাকে কেন্দ্র করে মক্কায় নগরায়ন ঘটেছে, মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। ফলে মুহাম্মদ যখন হানিফদের মতন এক ঈশ্বরবাদ প্রচারে নামলেন প্রথমে কিছু না বললেও পরবর্তীতে কুরাইশরা এর বিরোধিতা করলেন। এর মূল কারণ ছিল কাবার অর্থনৈতিক সেক্টরের পতনের আশঙ্কা। প্রতিবছর আরবের আশ-পাশ থেকে হাজারো মানুষ কাবা প্রদক্ষিণ করতে আসতেন। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হতো।
মুহাম্মদ নবী হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ মুহাম্মদের বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কাবায় একবার আগুনের সূত্রপাত হয়। মক্কায় আক্রমণ, কাবা ধ্বংসের ইতিহাস সব কিছুই এই লেখায় আলোচনা করবো। সেই সাথে মৃত্যু-পরবর্তী মুসলিমদের হাতে কীভাবে মুসলিম খলিফারা ও নবী বংশ ধ্বংস হয়েছিল সেই ইতিহাসও আলোচনা করবো। ফলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে যে, এসব ইতিহাস আড়াল করে রাখার জন্যে ইসলামপন্থীরা ইহুদি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কেন প্রতিনিয়ত গালমন্দ অব্যাহত রাখে। মুসলিমদের হাতেই লেগে আছে নবী বংশ হত্যার রক্ত।
ইহুদিদের প্রতি ইসলামপন্থীরা একটা অভিযোগ করেন যে, তারা তাদের নবীকে কষ্ট দিয়েছেন। সন্তান ও স্বামী হারানো এক মা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে মুহাম্মদের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন। পরবর্তীতে মুহাম্মদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং মুহাম্মদ মহিলাকে ক্ষমা করেন। বিষের প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদের মাথার চুল পড়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে যতো হত্যা ও রক্তপাত সব নবীর উপদেষ্টা, সাহাবি ও আত্মীয়-স্বজনদের কারণেই সংঘটিত হয়েছে।
কিরতাসের ঘটনা:
ইসলামের ইতিহাস ও ক্ষমতার লড়াই বোঝার জন্যে কিরতাসের ঘটনা বোঝা খুবই জরুরী। কিরতাসের ঘটনার মধ্য দিয়েই ইসলামের প্রথম বিরোধ সংঘটিত হয়। কিরতাসের ঘটনায় হয়রত উমরকে অপরাধীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো অসম্ভব কিছু না। এছাড়া হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মুহাম্মদের বিরোধিতা, গনিমতের মাল বণ্টনের সময় মুহাম্মদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করার মতন অভিযোগ খলিফা উমরের বিরুদ্ধে আছে।
কিরতাসের ঘটনা সংঘটিত হয় বৃহস্পতি বারে। নবী মুহাম্মদ মারা যান এর চার দিন পর। ইসলামিক পণ্ডিতগণ সবসময় বলে থাকেন নবী মুহাম্মদ তাঁর উত্তরাধিক নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই। সুতরাং তিনি উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে চান নাই এমন কথা বলার কোন সুযোগ নেই। তিনি তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী উত্তরাধিকার নিয়োগ দিয়ে যেতে পারেন নাই। মুহাম্মদের যেহেতু কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিল না, এবং পালক পুত্র জায়েদের সাথে সম্পর্ক যেহেতু সম্পর্ক চুকে যায় সেহেতু উত্তরাধিকার সূত্রে আলি হয়তো খলিফা হতে পারতেন। তবে মুহাম্মদ যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই তাই কে হতে পারতো প্রথম খলিফা সেটি জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই।
মুহাম্মদ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সকলেই বুঝতে পারছে যে মুহাম্মদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। অন্যদিকে মুহাম্মদ যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্যে আরবে সংগ্রাম করেছেন সেই স্বপ্ন ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। এক ঈশ্বরবাদের তলে মানুষকে তিনি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। মুহাম্মদ যেহেতু অসুস্থ সেহেতু পরবর্তী উত্তরাধিকার নিয়ে সবার মধ্যেই আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যু শয্যায় তিনি ওসিয়ত করে যেতে চাইলেন। কিন্তু মুহাম্মদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না। মুহাম্মদ সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন-“লেখনীর উপকরণ আমার কাছে নিয়ে আস, আমি তোমাদের জন্যে ওসিয়াত লিখে যাই, যেন তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হয়ে যাও।” যদিও আহলে বাইত ও আহলে সুন্নাতপন্থীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কিরতাসের ঘটনা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, মুহাম্মদ ওসিয়াত লিখে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ঐ ঘরে থাকা সাহাবি ও আত্মীয়দের কোন্দলের কারণে তিনি লিখে যেতে পারেন নাই। উমর বললেন যে, “আমাদের নিকট কোরান আছে সেটাই যথেষ্ট। এমুহূর্তে রসুল চরম পীড়ায় আক্রান্ত সুতরাং কাগজ-কলম আসার কোন প্রয়োজন নেই।” একপক্ষ বললেন নবী যেহেতু কাগজ চেয়েছে সেহেতু কাগজ দেওয়া উচিত আরেক পক্ষ নবীর কষ্ট হবে বলে কাগজ আনার বিরোধী। এই হট্টগোলের মধ্যে মুহাম্মদ বললেন যে, “তোমরা আমার কাছ থেকে চলে যাও, কেননা পয়গম্বরদের সম্মুখে ঝগড়া-বিবাদ ও হট্টগোল করা সমীচীন নয়।” ফলে ওসিয়াত লেখা স্থগিত হয়ে গেল।
শিয়া-পন্থীদের একাংশের বক্তব্য হলো রসুল যদি ওসিয়াত লিখে যেতে পারতেন তাহলে মুসলিমদের মধ্যে এমন রক্তপাত হতো না, উমাইয়ারা (উমর, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ) হাশেমী বংশকে (মুহাম্মদ, আলি, ইমাম হোসেন) ধ্বংস করে দিতে পারতো নাহ। ফলে কিরতাসের ঘটনার জন্যে খলিফা উমরকে তারা দায়ী করেন। যদিও সেই দিন উমরের কারণেই মূলত কিরতাস লেখা স্থগিত হয়ে যায়। বৃহস্পতি বার রাতে উমর মন্তব্য করেন যে, “পয়গম্বর তো প্রলাপ বকছেন”। “প্রলাপ বকার” অপবাদ দেওয়ায় অনেকে উমরকে দোষী ভাবেন। এর কারণ, মুহাম্মদ যখন মক্কায় তার এক ঈশ্বরবাদ প্রচার করতেন তখন সাধারণ মানুষ মুহাম্মদকে পাগল ডাকতো। সালমান রুশদি তার বিতর্কিত উপন্যাস “স্যাটানিক ভার্সেস”-এ এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয় রসুলের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবর্ধ হওয়ার বাসনাও সে সময়কার আরব পুরুষদের ছিল। সে সময় এটি কোন অপরাধ মূলক ইচ্ছা ছিল না। তাই তো আয়েশাকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করতে এক যুবককে দেখা যায়। এই বিষয়গুলো স্যাটানিক ভার্সেস-এ সালমান রুশদি তুলে ধরেছিলেন। যদিও কোনটি মিথ্যে নয় বরং সেই সময়কার সাধারণ মানুষের মনোভাব তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল মাত্র।
যাই হোক, ফিরে যাই পূর্বের প্রসঙ্গে। উমরের বাঁধার কারণে শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের পক্ষে উত্তরাধিকার নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। সেই সময় সাহাবিদের সাথে মুহাম্মদের কয়েকজন স্ত্রী’ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের কেউ কেউ কাগজ পর্দার আড়াল থেকে মুহাম্মদের আদেশ পালনের কথা অন্যদের স্মরণ করিয়ে দিলে উমরের জবাব (পরবর্তীতে এই জবাব উমর স্বীকারও করেন) ছিল- “তোমরা হলে নবী ইউসুফের সংগীনিদের মত। রসুলে খোদা যখন অসুস্থ হোন তখন তোমরা বিলাপ কর এবং সুস্থ অবস্থায় তাঁর ঘাড়ে সোয়ার হয়ে থাক।” এ কথা শোনার পর মুহাম্মদ বললেন, “তাদেরকে ছেড়ে দাও তারা তোমার চেয়ে উত্তম।” যদিও সালাফিবাদ ও আইএসপন্থীদের গুরু ইবনে তাইমিয়াসহ সুন্নি-পন্থীরা উমরের পক্ষে অনেক যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তবে উমরের কারণেই সেই দিন আর ওসিয়াত লেখা সম্ভব হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজার বিষয় হল; মুহাম্মদ (সা.) মারা যাওয়ার পর উমর প্রথমে তা বিশ্বাস করতে চান নি।মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং বলেন যে মুহাম্মদ (সা.) মারা যান নি বরং মুসা (আ.) যেমন চল্লিশ দিন পর ফিরে এসেছিলেন মুহাম্মদ (সা.)ও তদ্রূপ ফিরে আসবেন। উমর এতোটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, তিনি তার তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়েন। এসময় আবু বকর এসে উমরকে শান্ত করেন।
ক্ষমতার লড়াই:
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। নবী মুহাম্মদের লাশ ফেলে রেখে চলে খলিফা নির্বাচনের লড়াই! আলী যখন নবী মুহাম্মদের লাশের গোসল করাচ্ছিলেন এই ফাঁকে ওমর গ্রুপ খলিফা নির্বাচন করে ফেলে। বিরোধের শুরু এখান থেকেই। খলিফা হোন আবু বকর। অনেক ইসলামপন্থীরা বলার চেষ্টা করেন যে, প্রতিটি খলিফা নির্বাচন হয়েছে গণতান্ত্রিক উপায়ে। যদিও কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আবু বকরকে খলিফা হিসেবে বনু হাশিম ও আনসাররা মেনে নিতে চাননি। এমনকি আলি আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন ৬ মাস পর। আবু বকর খলিফা হওয়ায় আরবে ইসলাম ত্যাগের সাথে সাথে রাজ্যে বিদ্রোহ চলতে থাকে। আবু বকর শক্ত হাতে এসব বিদ্রোহ দমন করে। আবু বকরের শাসনামল ছিল ২ বছর। আবু বকর খলিফা হওয়ায় উমাইয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে আসার সুযোগ তৈরি হয়। উমর ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি। যিনি ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এবং পার্সিয়ান এক দাসের হাতে শেষ পর্যন্ত নিহত হোন। ইসলামের চার খলিফার তিন জনকেই হত্যা করা হয়। এছাড়া প্রথম খলিফা আবু বকরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় এমন একটি গুজব বাজারে চালু আছে।
ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার লোভে আরবের গোত্র দ্বন্দ্ব মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠে। সেই দ্বন্দ্বে আহত হয়ে গর্ভাবস্থায় মারা যান নবী মুহাম্মদের কন্যা হযরত ফাতেমা। ওমর ফাতেমার ঘরে ঢোকার জন্যে দরজায় জোরে লাথি মারেন। দুর্ভাগ্যবশত এই লাথিতে আহত হোন ফাতেমা। পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্বামী’কে বলে যান-তিনি মারা গেলে তাঁর দাফন যেন অতি গোপনে করা হয় তাতে ওমরের মতন লোক তাঁর জানাজায় অংশ নিতে না পারে। পরবর্তীতে তার নির্দেশ অনুসারেই রাতের আঁধারেই তাঁকে দাফন করা হয়। বনু হাশেমের গোত্রের মানুষ ছাড়া খুব কম সংখ্যক সাহাবী জানাজায় শরীক হোন। এখানে পয়েন্ট করর বিষয় হল; অন্য খলিফাদের দাফন নবীর কবরের পাশে হলেও ফাতেমার কবর হয় অন্যত্র। (রাতের আঁধারে কবর দেওয়ার প্রসঙ্গে ভিন্ন মত আছে অনেকেই বলেন যে; তিনি লজ্জাবতী ছিলেন তাই ওনার কবরে যাতে বেশি মানুষ না আসে তার জন্যে রাতের আঁধারে করব দেওয়া হয়।) এছাড়াও আবু বকরকে খলিফা করায় আলি, ফাতেমা অসন্তুষ্ট হোন। পরবর্তীতে পিতার সম্পত্তির ভাগ চাইলে আবু বকর ফাতেমাকে বলে দেন যে, এই সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় ভাবে দান করা হয়েছে। সুতরাং এই সম্পত্তির ভাগ তিনি ফাতেমাকে দিতে পারেন না।
উমর মারা যাওয়ার আগে নিজের স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার জন্যে ওমর খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আব্দুর রহমান বিন আউফ ও তার ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ হাতে। তারা যখন ষড়যন্ত্র করে নবী মুহাম্মদের দুই কন্যার স্বামী সত্তর বয়স্ক ওসমানের (উমাইয়া গোত্র) নাম ঘোষণা করেন তখন হযরত আলি চিৎকার করে বললেন-নাহ আমি মানি না, এটা প্রহসন, ধর্মের নামে মিথ্যাচার, অন্যায়, এটা প্রতারণা। ওসমানের শাসন আমলে আরবে বিদ্রোহ মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠতে থাকে। স্বজনপ্রীতি, দুঃশাসনের কারণে সাধারণ জনতা ওসমানের বাড়িও ঘেরাও করে। এতো কিছু পরও ওসমান ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা ক্ষমতা ছাড়ার জন্য রাজি হয় নাই। ফলে আততায়ীর হাতেই নিজ ঘরে খুন হোন ওসমান। ফলে ওসমানের বার বছরের শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে।
ওসমান খুন হওয়ার পর গুজব কিংবা লোক কানাকানি ছড়িয়ে পড়ে যে এই হত্যায় আলির হাত রয়েছে। আলি-পন্থীরা যে সিংহাসন দখলের জন্যে ২৫ বছর সংগ্রাম করল নির্যাতন সহ্য করল তাদের সেই ক্ষমতা দখলের সময় খুব সুখকর ছিল না। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তখন আর মক্কা কিংবা মদিনা কেন্দ্রী ছিল না। কারণ একদিনে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ অন্যদিকে ওসমানের বিচারের দাবী। আবার ওসমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের একটা বড় অংশ আলির সাথে যোগ দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আলি ক্ষমতা আরোহণ খুব সুখকর ছিল না।
এখানে স্মরণ রাখা উচিত যে, ইতোমধ্যে আরবের আশে পাশের সব জায়গা, এছাড়া রাজ্য পরিচালনার বড় বড় পদ সবগুলো মক্কার উমাইয়া গোত্র দখল করে নেয়। ফলে মদিনার মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এছাড়া হাশিমী গোত্রের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আলি। সিরিয়ার শাসন মুয়াবিয়া ছিলেন যেমন চতুর তেমনি ক্ষমতাধর মানুষ। তার পরামর্শেই মূলত ওসমান শাসন কাজ পরিচালন করতেন। মুয়াবিয়া ছিলেন আবু সুফিয়ানের সন্তান। মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর এক প্রকার বাধ্য হয়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।এছাড়া নবী মুহাম্মদের দলের হাতেই খুন হোন সুফিয়ানদের অন্য সদস্যরা। মুহাম্মদের দলের হাতে আবু সুফিয়ান গোত্রের পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো ভোলেনি। এই কারণেই নবী বংশ ধ্বংস না করা পর্যন্ত মুয়াবিয়া বংশ শান্ত হয় নাই। মুয়াবিয়া সুদর্শন, চতুর, বুদ্ধিমান ছিলেন ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন। মুয়াবিয়া ঠিকই জানতেন পৃথিবীর সবাই মুয়াবিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেও আলি কখনো মেনে নেবে না। অন্য দিকে আলিও জানতেন মুয়াবিয়া তাকে ছেড়ে দেবে না। বনু হাশিম ও উমাইয়াদের মধ্যে কীরূপ দ্বন্দ্ব ছিল তা জানার জানা প্রয়োজন-আবু সুফিয়ানের জোয়ান ছেলে নবী মুহাম্মদের বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ায় সেই খুনের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পুত্রহারা মা হিন্দা। উহুদ যুদ্ধে নবী মোহাম্মদের চাচা আমীর হামজার লাশ কেটে কলিজা বের করে চিবিয়ে খেয়েছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা হিন্দা। তাই আলি জানত ষড়যন্ত্র করে হোক কিংবা যুদ্ধ করে হোক সে আলিতে পরাজিত করতে চাইবে। অনেকে প্রশ্ন করে যে; ওসমান খুনের বদলা নেওয়াকে কেন্দ্র করে হযরত আয়েশা ও হযরত আলীর মধ্যে যে যুদ্ধ (জামাল যুদ্ধ) হল তখন মুয়াবিয়া নীরব ভূমিকা পালন করল কেন? এর উত্তর খুন সহজ। কারণ যুদ্ধটা হচ্ছে নবীর পরিবারের মধ্যে তাই মুয়াবিয়া তাদের হানাহানিতে না জড়িয়ে রক্তপাত দেখেছিলেন মাত্র। আলি ও আয়েশার যুদ্ধ ইতিহাসে উঠের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। সেই যুদ্ধে আয়েশা পরাজিত হোন এবং নিজের কর্মের জন্যে আলির কাছে ক্ষমা চান। সেই যুদ্ধে সাহাবিরা অংশগ্রহণ করেন এবং নিহত হোন। তবে জামাল যুদ্ধের দায় নিতে হয় শেষ পর্যন্ত আলিকেই। ইসলামের ইতিহাসে জামাল যুদ্ধ প্রথম যুদ্ধ যেখানে একজন নারীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল আরব পুরুষরা।
৬৫৭ সালের জুলাই মাসে সিরিয়ার সিফফিনের ময়দানে আলির বিপরীতে যুদ্ধে নামে মুয়াবিয়া। সেই যুদ্ধে আলি থেকে কুট কৌশল ও সামরিক সৈন্যে আলি থেকে মুয়াবিয়ার শক্তি বেশি হলেও সেই যুদ্ধে আলি জয়ের পথেই ছিলেন। আলি মুয়াবিয়া থেকে বড় যোদ্ধা হলেও কূটকৌশলে তিনি দক্ষ ছিলেন না। তিনি বড় যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু বড় রাজনৈতিক নেতা নন। ফলে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে মুয়াবিয়া তার শেষ অস্ত্র ধর্মের আশ্রয় নিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরানের পাতা লাগিয়ে যুদ্ধ করতে নামলো। এতে আলীর বাহিনীর মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী কুরান সামনে রেখে যুদ্ধ করতে নামায় আলীর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তারা মুয়াবিয়ার কথা ফাঁদে পড়ে মুয়াবিয়ার সুরে যুদ্ধ বন্ধ করে কোরানের মাধ্যমে সমাধানের পথে এগুতে বলেন। মুয়াবিয়াও তখন নিজের কিছু লোক আলির শিবিরে পাঠিয়ে ওসমান হত্যাকারীদের বিচারেরও দাবী তোলেন। কারণ মুয়াবিয়া জানতেন এই খুনে আলির হাত না থাকলেও বর্তমানে আলির শিবিরের অনেকেই ওসমান হত্যায় জড়িত। একদিনে ওসমান হত্যার দাবী অন্যদিকে কোরানের মাধ্যমে সমাধানের দাবী সব কিছু মিলিয়ে আলি বুঝে গেছেন তিনি ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন। তিনি তার লোকদের যতোই বোঝেতে চেষ্টা করছেন যে আর কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলে আমরা জিতে যাব। মুয়াবিয়া একটা শয়তান। সে ছলনা করে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছে কিন্তু সে সময় কেউ আলির কথা শুনল না। আলি মুয়াবিয়ার অতীত ইতিহাস সবাইকে স্মরণ করতে অনুরোধ জানান। তারপরও তার সৈন্যরা যুদ্ধ করতে আর রাজা হল না। ফলে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন আলি। এবং এই কারণে পরবর্তীতে আলীর রাজনৈতিক ও ক্ষমতার পরাজয় ঘটে। সিফফিনের ময়দানে মুয়াবিয়ার হাতেই হয় প্রথম কোরানের রাজনৈতিক ব্যবহার। মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধির কারণে আলির পক্ষ অনেকেই ত্যাগ করেন তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাব অন্যতম। আলি মুহাম্মদ ও খাদিজার প্রিয় পাত্র ছিলেন, ইসলাম প্রচারের শুরুতে আলি মুহাম্মদের জন্যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আলি বড় মাপের যোদ্ধা হলেও তিনি রাজনৈতিক বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন না।
ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দল খারিজি:
ওসমান কে পছন্দ না করলেও ওসমান হত্যায় আলির সমর্থন ছিল না, এমনকি ওসমানকে রক্ষা করার জন্যে একসময় আলি নিজের ছেলেদের ওসমানের কাছে পাঠান। কিন্তু ওসমান হত্যা পরবর্তীতে ওসমানের হত্যাকারীদের অধিকাংশ আলিকে সমর্থন করে থাকায় ওসমান হত্যায় আলি জড়িত এমনই একটা ধারনা মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়। যদিও আলি ক্ষমতায় বসার ইচ্ছুক ছিলেন না কারণ তিনি জানতেন তিনি ক্ষমতায় বসলে ওসমান হত্যায় তাঁকে পরোক্ষভাবে জড়িত করা হবে তাই তিনি প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে সবার চাপে পড়ে ক্ষমতা গ্রহণে সম্মত হোন। মুয়াবিয়া নিজের স্বার্থে আলির বিরুদ্ধে নিজের পক্ষে মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্যে নিহত ওসমানের রক্তাক্ত পাঞ্জাবী ও তার স্ত্রীর কাটা আঙ্গুলের অংশ জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখেন। মুয়াবিয়ার কৌশলের কাছে আলি পরাজিত হোন এবং নিজের দলের লোকদের চাপে পড়ে তিনি সন্ধি করতে সম্মত হোন। সেই সময় আলি পক্ষের একটি অংশ আলি ভুল করেছেন বলে আলির দল থেকে বেরিয়ে যান। তারাই খারিজি (Those who go out) নামে পরিচিত। হযরত আলি ভুল করেছেন এটাই ছিল তাদের যুক্তি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এমন ধারণা জন্মায় যে; পাপী ব্যক্তি শাসক হওয়ার অযোগ্য। আলি যেহেতু মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেছেন সেহেতু আলি নিজেও অযোগ্য হয়ে গেছেন। তারা এতোটাই চরমপন্থী অবস্থায় চলে গেছে যে তারা অন্য মুসলিমদের কাফের হিসেবেও আখ্যায়িত করা শুরু করে। তারা মনে করতো যে পাপ হল কুফর অর্থাৎ আল্লাহকে অবিশ্বাস করা। সুতরাং কেউ পাপ করলে পাপের ফলে সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এই ধরণের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে এদের হত্যা করা যাবে। এমনকি এরা যদি নবীজির সাহাবিও হোন তারপরও এদের হত্যা করা যাবে। এরা এতোটাই উগ্র ছিল যে এদের সাথে কেউ যদি একমত না হতো তাহলে তাদের কাফের এবং তাদের হত্যার করতে এদের একটুও বাঁধত না। বলা হয়ে থাকে এসব খারিজিরা বেশির ভাগ ছিল বেদুইন ও অশিক্ষিত। এরা কোরান হাদিস সম্পর্কে খুব একটা বুঝত না। কিন্তু এরা সংখ্যায় কম হলেও চেতনায় এতোটাই উন্মাদ ছিল যে এদের অগ্রাহ্য করা কোন শাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে আলি এদেরকে নিজের দলে আনার চেষ্টা করেন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লেখেন। খারিজিরা উল্টো আলিকে জবাব দেয়; আলি আপনি নিজেই কোরান বোঝেন না।
খারিজিদের হারুবিয়াহ নামেও উল্লেখ করা হয়। কারণ আলির বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের আওয়াজ তোলা হয় হারুবা নামক স্থানে তাই তাদেরকে অনেকে হারুবিয়া নামেও অভিহিত করা হয়। আলির দল ত্যাগ করে খারিজিরা আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাবকে তাদের দলপতি নির্বাচিত করে। এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে নাহরাওয়ান নামক স্থানে তারা শিবির স্থাপন করে। তারা সেখান থেকে আলির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে খারিজিদের সাথে আলিকে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধে খারিজিদের দলপতি সহ অনেক খারিজি নিহত হয়। প্রাণে বাঁচে মাত্র ৪’শ জন। বর্তমানে জঙ্গিরা যেভাবে বেহেস্তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শরীরে বোমা নিয়ে হামলা করে খারিজিরা ঠিক একই ভাবে যুদ্ধের ময়দানে উচ্চারণ করেছিল- Hasten to Paradise! To Paradise! পরবর্তীতে খারিজিরা সিরিয়ার শাসক মুয়াবিয়া, ও তার উপদেষ্টা মিশরের শাসনকর্তা আমর ইবন আস কে হত্যার চেষ্টা চালায়। সৌভাগ্যক্রমে তারা দুইজন নিহত না হলেও হযরত আলী মসজিদ থেকে আসার পথে খারিজি আব্দুর রহমান ইবন মুলযিমের হাতে নিহত হোন। আলি ক্ষমতায় ছিলেন পাঁচ বছর।
খারিজিরা এতোটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে, পরবর্তীতে উমাইয়া, আব্বাসিয় শাসকরা এদের যন্ত্রণায় অস্থির ছিলেন। তারা মেসোপটেমিয়া পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলে অশান্তির সৃষ্টি করে। অবশেষে মিসরের ফাতেমি শাসনগণ খারিজিদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে রাজনৈতিক প্রচারণা বর্জন করে তারা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
কারবালার হত্যাকাণ্ড:
চুক্তি ভঙ্গ করে মুয়াবিয়া নিজের পুত্র ইয়াজিদকে সিংহাসনে বসান। সিংহাসনে বাসার পর পিতা মুয়াবিয়ার মতন ইয়াজিদও হাশেমী বংশের কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। তারই ধারাবাহিকতায়, ১০ মহরমে কারবালা নামক স্থানে নবী পরিবারের ৭২ জন খুন হোন। যাদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। শিশু পুত্র আলী আজগরকে কোলে নিয়ে যখন তার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে সামান্য পানি প্রার্থনা করা হচ্ছিল তখন একটি তীর শিশু বক্ষকে ছেদ করে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, নবী মুহাম্মদের নাতী শেরে খোদা আলীর পুত্র হোসেনকে যখন ঘিরে ধরা হয় তখন সেই সৈন্যদের মাঝে বহু হাফেজ জুব্বাধারী, লম্বা চুল ও পাগড়ীধারী সৈন্যও ছিল। আর তাদের সেনাপতি সা’দ ছিলেন মোফাচ্ছিরে কোরান। সেই স্থানে আনুষ্ঠানিক নামাজিরাও ছিল যারা বলেছিল-"তাড়াতাড়ি হোসেন এর শিরশ্ছেদ করতে হবে যেন আছরের নামাজ কাজা না হয়।"
ইয়াজিদ ও ইমাম হোসেনের মধ্যে যে বিরোধী তা মূলত আরবের হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের বিরোধের ধারাবাহিক মাত্র। এই দুই গোত্রের মধ্যে যে বিরোধ তা নবী মুহাম্মদের জন্মের অনেক আগ থেকে শুরু। তাই তো লোকমুখে প্রচলিত আছে, কারবালার যুদ্ধের পর ইয়াজিদ এক পঙক্তি কবিতাও লিখে ফেলেন:
”হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে,
কিন্তু কোন শব্দ আসলো না, কোন দৈববাণীও নামলো না।”
শুধু এটাই নয়, এর আগে আলির মৃত্যুর পর খলিফা মতাওয়াক্কিল নিজের দরবারে উপস্থিত গণ্যমান্যদের চিত্তবিনোদনের জন্যে তিনি এক ভাঁড়কে নিয়োজিত করেন যে আলির বেশ ধারণ করে নর্তন-কুর্দন করতো। এছাড়া নামাজের যে খুৎবার নিয়ম তা ছিল নামাজের পর। ৮৫ বছর উমাইয়ারা খুৎবায় আলির নামে গালাগাজ করতো এজন্যে মানুষ উঠে চলে যেত। পরবর্তীতে খুৎবাকে নামাজের আগে আনা হয়। উমাইয়ারা মুতাওয়াক্কিল ইমাম হোসেন (নবীর নাতি) এর সমাধিতে লাঙ্গল চালিয়ে দেন এবং সেচ করতে থাকেন যাতে ওই সমাধির কোন চিহ্ন না পাওয়া যায়; মানুষের মন থেকে যেন ইমাম হোসেন এর স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

সৌদি ওহাবীবাদের উত্থান:
পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে সৌদি আরবের পার্থক্য হল ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রক্ত দিয়ে নিজেরা রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। অন্যদিকে সৌদি রাষ্ট্রের ইতিহাস হল সৌদির রাজ বংশ হেজাজ অঞ্চলের অসংখ্য সাধারণ মুসলিমকে অমুসলিম জ্ঞান করে তাদেরকে হত্যা করে সৌদি রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেছে। সৌদি রাজ বংশের হাত ধরে যে ওহাবীবাদের প্রসার হয়েছে তা ইসলামের কোন সংস্কার নয় বরং ইসলামের নামে এক উগ্রবাদী জিহাদ। যারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে মুসলিম জ্ঞান করে না, এবং অমুসলিমদের প্রতি যাদের আছে তীব্র ঘৃণা। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর হাত ধরেই সৌদি রাজ বংশের উত্থান।
১৭৯০ সালের মধ্যে ইবনে সউদ এবং আবদুল ওয়াহাব জোট আরবের অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে নিলো এবং ক্যান্সারের মত হামলে পড়ল মদিনা, সিরিয়া এবং ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ১৮০১ এই জোট ইরাকের পবিত্র নগরী কারবালা আক্রমণ করে নির্বিচারে হাজার হাজার শিয়া পুরুষ, নারী ও শিশু হত্যা করে। ধ্বংস করে দেয়া হয় অসংখ্য শিয়া মসজিদ। এমনকি নবী মুহম্মদের প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মসজিদটিকেও ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়। ঐ সময়কার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একজন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ফ্রানসিস ওয়ার্ডেন লিখেছিলেন, ইবনে সউদ এবং আবদুল ওয়াহাবের বাহিনী পুরো কারবালা ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হননি, ইমাম হোসেনের কবর পর্যন্ত মাটিতে মিশিয়ে দেয়। গা শিউরে ওঠা অদ্ভুত নৃশংসতায় খুন করা হয় পাঁচ হাজার মানুষ।
সৌদি আরবের প্রথম ইতিহাসবিদ ওসমান ইবনে বসির নাজদি লিখেছেন, ১৮০১ সালে ইবনে সউদ কারবালায় গণহত্যা করেছেন। ইতিহাসে লেখা আছে, ইবনে সউদ গর্বের সাথে বলছেন, আমরা কারবালার দখল নিলাম এবং এর অধিবাসীদের দাস করে নিলাম তারপর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নামাজ আদায় করলাম। ঐ দিনের জন্য আমরা দুঃখিত নই, কারণ বিধর্মীদের জন্য এটাই প্রাপ্য ছিল। ১৮০৩ সালে আবদুল আজিজ মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন, ভীষণ সন্ত্রাস ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ঠিক একইভাবে মদিনারও পতন ঘটে। বিজয়ের মুহূর্তে আবদুল ওয়াহাবের যোদ্ধা-বাহিনী মক্কা মদিনার যাবতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপনা, মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় কাবা শরিফের কাছেই কালের সাক্ষী শত বছরের পুরনো ইসলামিক স্থাপত্য শিল্পকলা। কিন্তু ১৮০৩ সালে হঠাৎ একদিন কারবালা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে একজন শিয়া আততায়ীর হাতে খুন হন বাদশাহ আবদুল আজিজ। তার ছেলে সউদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব দখল বজায় রাখেন।
বর্তমান আইএস ও সৌদি ওহাবীদের মধ্যে আদর্শিক-গত তেমন কোন পার্থক্য নেই। সিরিয়ার ঐতিহাসিক পালমিরা নগরী আইএসের দখল করে তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমরা আফগানিস্তানের আল-কায়দার বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের কথা স্মরণ রাখতে পারি। তাদের আদর্শ হল; বিধর্মীদের এমন কোন কিছু রাখা যাবে না যা মুসলমানের মনে শিরকের জন্ম দেয় ফলে এসব ওহাবী সালাফিদের হাতে কোন ঐতিহাসিক স্থাপনাও নিরাপদ নয়। ওহাবী/সালাফি মতবাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে সৌদি আরব। এই রাজবংশের হাতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের যেসব স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস হয়েছে তার মধ্যে নবী মুহাম্মদের চাচা হামজার কবর, কন্যা ফাতিমার মসজিদ, মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজার বসতভিটা, মুহাম্মদের মদিনার বসতভিটা, মুহাম্মদের তৈরি করা প্রথম বিদ্যালয়, তার মা আমিনার কবর, আলীর বসতভিটা, সাহাবি সালমান আল ফারসির মসজিদ অন্যতম। শিরকের জন্ম দিতে পারে এই ফতোয়া দিয়ে এসব ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। শিরকের নামে এগুলো ধ্বংস শুরু হলেও বর্তমানে এরকম আরো স্থাপনা ধ্বংস করা হচ্ছে শুধু হজ্জ ব্যবসাকে মাথায় রেখে। এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে নির্মাণ করা হচ্ছে হাজীদের জন্যে হোটেল। নবী মুহাম্মদের করব রাখার পক্ষেও ওহাবীরা নয়। তারা বলে-ইসলাম বলেছে কবরের কোন চিহ্ন থাকবে না। আর এই কারণে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ওহাবী সেনাবাহিনী মদিনায় হামলা চালিয়ে নবীর পরিবার সদস্যদের ও অনেক সাহাবীর কবর গুড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত তারা যখন নবীর কবর ভাঙ্গার উদ্যোগ নেয় তখন বিশ্বের মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে এই কবর ভাঙা তারা ক্ষান্ত দেয়। ওহাবী/সালাফিরা বলে-ইসলাম অনুসারে কবরের কোন চিহ্ন থাকবে না। সুতরাং সকল কবরের চিহ্ন গুড়িয়ে দিতে হবে।
হজ্জ সৌদি আরবের কাছে একটি বড় ব্যবসা ছাড়া কিছুই নয়। গ্র্যান্ড মসজিদ কমপ্লেক্সের অপর প্রান্তে নবীর প্রথম স্ত্রীর বাড়িকে টয়লেট-ব্লক বানানো হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য পুরাতন মসজিদসহ পুরাতন স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়ে হাশেমী বংশের সকল স্মৃতি চিহ্ন তারা মেছে ফেলেছে। যে রমণীর অর্থে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে সেই বিবি খাদিজার বাড়ি এখন পাবলিক টয়লেট।

কাবা ধ্বংসের ইতিহাস:
কাবা ধ্বংস কিংবা কাবায় হামলা আরব অঞ্চলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। যে উমাইয়াদের হাতে ইসলামের প্রসার ঘটেছে সেই উমাইয়াদের হাতেই প্রথম দুইবার কাবা আক্রান্ত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাবা মুসলিমদের কাছে পবিত্র বস্তু। তবে এই কাবা যখন আক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ পাক মাটির দেবতার মতনই অসহায় থাকেন। কামানের গোলা, কাবায় আগুন, বন্যায় কাবার দেওয়ার ভেঙ্গে পড়া থেকে শুরু করে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যা কাবায় ঘটেনি। জীবন বাঁচাতে কাবা ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার পরও সেই কাবা থেকে বের করে হত্যা করার মতন ঘটনাও ইসলামের ইতিহাসে ঘটেছে। ইসলামের কাবার ইতিহাস বেশির ভাগ মুসলিম জানে না বিধায়, কাবা সম্পর্কে তাদের হৃদয়ে এক কাল্পনিক শক্তি অবস্থান করে।
ক) প্রথম মক্কা অবরোধ (৬৮৩) ও কাবায় আগুন
৬৮৩ সালে দ্বিতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়। এসময় মক্কার প্রধান ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। উমাইয়া খলিফা প্রথম ইয়াজিদের বিপক্ষে সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। মদিনার পর ইসলামের আরেক পবিত্র শহর মক্কা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। উমাইয়া কর্তৃপক্ষ আরবের বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনা প্রেরণ করে। উমাইয়া সেনারা মদিনার লোকদের পরাজিত করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু মক্কা মাসব্যাপী অবরোধের মুখে পড়ে। এসময় কাবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াজিদের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পৌছার পর অবরোধ সমাপ্ত হয়।ইবনে জুবাইর ক্ষতিগ্রস্ত ক্বাবা পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না, এই ভয়ে যে, যে ক্বাবা ভাঙতে এগিয়ে আসবে তাঁর উপর আসমানি গজব পড়বে। একজন সাহস করে একটা পাথর ছুড়ে মারল। কিন্তু তাঁর উপর কোন গজব আসল না। এটা দেখে বাকিরা সাহস পেয়ে ভাঙ্গা শুরু করল। একদম পুরোপুরি মিশিয়ে দেবার পর আবার গোড়া থেকে বানানো শুরু হলো। কালো পাথর টুকরা টুকরা হয়ে যায় এই আক্রমণে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর একটা রুপার লিগামেন্ট ব্যবহার করে সেগুলো জোড়া লাগান।

খ) দ্বিতীয় মক্কা অবরোধ ৬৯২ ও কাবা ক্ষতিগ্রস্ত
৬৯২ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময় সংঘটিত হয়। তিনি তার সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে বড় আকারের সেনাদলসহ মক্কায় প্রেরণ করে। উমাইয়া খিলাফতের প্রতি বিদ্রোহী আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে দমন করা সেনা পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল। অবরোধ ছিল ভয়াবহ এবং প্রায় ছয় মাস পর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের মৃত্যুর পর অবরোধ সমাপ্ত হয়।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের অন্যতম সফল সেনাপতি ও প্রশাসক। হেজাজের শাসক আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ছিলেন আবদুল মালিকের শক্ত প্রতিপক্ষ। সফল হওয়ার পূর্বে হাজ্জাজকে কয়েকবার মক্কা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাঠানো হয়। ৬৮৯ সালে তাকে একটি বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করার জন্য দামেস্কে ফিরে আসতে হয়। ৬৯০ সালে তিনি ব্যর্থ হন। তবে ৬৯১ সাল উত্তরের বিদ্রোহী গোত্রগুলোকে দমন করা হয় এবং তিনি বসরার গভর্নর মুসাব ইবনে জুবায়েরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এরপর হাজ্জাজ মক্কার আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের দিকে নজর দেন। ৬৯২ সালে তিনি প্রায় ১২,০০০ সিরিয়ান সৈনিক নিয়ে মক্কা অবরোধ করেন। জন্মস্থান তাইফ পর্যন্ত তিনি কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। বিনাযুদ্ধে তিনি তাইফের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং একে মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে প্রথমে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সাথে আলোচনা করা হয় এবং আত্মসমর্পণ করলে তাকে ক্ষমার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়। তবে বিরোধিতা চালু থাকলে অবরোধ আরোপ করা হবে কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই রক্তপাত হবে না। আলোচনা ব্যর্থ হলে হাজ্জাজ ধৈর্য হারিয়ে আবদুল মালিকের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি দেন এবং বলপ্রয়োগ করে মক্কা দখলের অনুমতির আবেদন করেন। আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর মক্কার উপর কেটাপুল্টের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করা শুরু হয়। পরে কাবার কাছে এক লড়াইয়ে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের তার এক সন্তানসহ নিহত। এই আক্রমণের সময় পাথর নিক্ষেপ করে ক্বাবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইবের বানানো অতিরিক্ত অংশ ধ্বংস করে কাবার পূর্বের আকৃতি আনা হয়।
গ) কারামাতিয়দের হামলা (৯৩০)
কারামাতিয় সম্প্রদায়ের ধর্ম ছিল একটা মিশ্র ধর্ম। মূল শিয়াদের থেকে সৃষ্ট ইসমাইলি গ্রুপ আর পারস্যের কিছু আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে গড়ে ওঠে এদের ধর্ম। তারা ৮৯৯ সালে পূর্ব আরবে একটি ধর্মীয় স্বাধীন সরকার ঘোষণা করে। এরা আব্বাসিয় খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আব্বাসিয় খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কারামাতিয়রা মনে করতো হজ্জ হলো কুসংস্কার এবং অনৈসলামিক। ৯৩০ সালে হজ্জের সময় মক্কায় হামলা চালিয়ে তারা বহু হাজিকে হত্যা করে তাদের লাশ জমজম কূপে ফেলে দিয়েছিল। জমজমের পানি অপবিত্র হয়েছে বলে তখন মুসলিম দুনিয়ায় রব উঠেছিল। যাওয়ার সময় তারা কাবার কালো পাথর চুরি করে নিয়ে যায়।এর মূল হোতা ছিল তাদের নেতা আবু তাহির। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মক্কা থেকে হজ বাতিল করা। কিন্তু সফল হয়নি। হজ চলতে থাকে কালো পাথর ছাড়াই।
২৩ বছর পর, ৯৫২ সালে আব্বসীয় খলিফা বিশাল টাকা দিয়ে সেই পাথর ফিরিয়ে আনেন। যে কারামাতিয়রা ফিরিয়ে দিয়ে যায়, সে কুফা-র এক মসজিদে শুক্রবার দিন ছুড়ে মেরে যায় পাথরটা বস্তাবন্দী করে। সাথে একটা চিরকুট, “ক্ষমতা দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, ক্ষমতা দেখিয়েই ফেরত দিলাম আমরা।”
এই ছুঁড়ে মারাতে সাত টুকরা হয়ে যায় পাথর। বলা হয়, আবু তাহিরের মৃত্যু হয় শোচনীয়তম, তাঁর দেহ পোকায় খেয়ে নেয় যেই রোগ তাঁর হয়েছিল। একাদশ শতকে ফাতিমিয় খলিফা আল হাকিম এর পাঠানো এক লোক কাবার সামনে এসে কালো পাথর ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর আগেই সে মারা পড়ে।
ঘ) ১৬২৯ সালের মক্কার বন্যা
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ১৬২৯ সালে বন্যা হয়ে যায় মক্কায়, তখন ক্বাবার দেয়াল ধ্বসে যায়। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে কাবা বানানো হয়। ওসমানি সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন মসজিদ পুরাটা সুন্দর করে আবার বানানো হয়।
ঙ) ১৯৭৯ সালে মসজিদ আল-হারাম অবরোধ
১৯৭৯ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে ইসলামী চরমপন্থিরা সৌদি আরবের, মক্কা শহরে অবস্থিত মুসলমানদের পবিত্র স্থান মসজিদ আল-হারাম দখল করে, যা ছিল মূলত সউদ রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করে যে, ‘মাহাদি’র হিসেবে তাদের নেতা চলে এসেছে এবং মুসলমানরা তাকে মেনে চলবে।
এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বকে বিস্মিত করে কারণ হজব্রত পালনরত হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করা হয়। মসজিদের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াইয়ে মারা যায় ২৫৫ জন আর ৫৬০ জন আহত। মিলিটারি থেকে মারা যায় ১২৭ জন আর ৪৫১ জন আহত। এ ঘটনার পুরেই সৌদি রাষ্ট্রে অধিকতর ইসলামী অনুশাসন কায়েম করা হয়।
মসজিদ আল-হারামের খবর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এটাকে ইহুদী নাসারার চক্রান্ত বলে দাবি করেন, “সন্দেহ নেই, এটা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকান ক্রিমিনাল আর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদিদের ষড়যন্ত্র।” ফলে সারা বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে আমেরিকা-বিদ্বেষ গড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানের ইউ এস এমব্যাসি পুড়িয়ে দেয়া হয়। লিবিয়ার ত্রিপোলিতেও ইউ এস এম্বাসী ভেঙে পুড়িয়ে দেয়।
চ) ১৯৮৭ সালের সংঘর্ষ
১৯৮১ সালের ৩১ জুলাই ইরানী শিয়া হাজিদের সাথে সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ইসরাইল ও মার্কিন বিরোধী এক সমাবেশকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এতে মোট ৪০২ জন মারা যায়। যাদের মধ্যে ২৭৫ জন ছিল ইরানি হাজি। এর ঘটনার কারণে সৌদি ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেউ কেউ এটিকে সৌদি পুলিশ কর্তৃক হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
এছাড়া প্রতি বছর হজ্জে শয়তানকে পাথর বাড়তে গিয়ে অসংখ্য হাজির মৃত্যু ঘটে। হজ্জ মৃত্যু হওয়া তাই নতুন কিছু নয়। যদিও বিশ্বাসী মন বিশ্বাস করতে চায় পায়ের তলে পড়ে প্রাণ হারালেও মক্কা যেহেতু পবিত্র জায়গা সেহেতু সরাসরি বেহেস্ত লাভ হয়। বর্তমানে মক্কার হজ্জ ছাড়া মুসলিমদের ধর্মীয় আচার শুদ্ধ হয় না। তবে যতদিন মক্কায় ইবনে জুবায়ের রাজত্ব ছিল ততদিন উমাইয়ারা মক্কার বদলে জেরুজালেমে হজ্জ করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। সৌদি রাজ বংশ উপলব্ধি করতে পারছে যে তার অবস্থান আগের মতন শক্ত অবস্থানে নেই। তাই সৌদি প্রশাসন এখন মক্কাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী এক রাজনৈতিক সমীকরণ করতে চাচ্ছে। মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে তারা সারা বিশ্বে ওহাবী আগ্রাসন চালাচ্ছে। যেমনটি চালাচ্ছে ইয়ামেনে। ইমায়েনের বিদ্রোহী গ্রুপ জেদ্দা বিমানবন্দরে রকেট নিক্ষেপ করলে সৌদি প্রশাসন মুসলিমদের অনুভূতিকে পুঁজি করার জন্যে মিডিয়ায় বলে-ইয়েমেনের বিদ্রোহী গ্রুপ মক্কায় রকেট ছুটেছে। মক্কা যতদিন পর্যন্ত ভ্যাটিকান সিটির মতন না হচ্ছে, যতদিন সৌদির কবজা থেকে বের হতে না পারছে ততদিন সৌদি আরব মক্কাকে কব্জা করে মুসলিমদের নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করবে। সৌদি রাজ পরিবার যেহেতু মক্কার রক্ষক ও ভক্ষক সেহেতু সারা পৃথিবীতে মুসলিমদের একটি বড় অংশ সৌদি রাজ প্রশাসনের মানসিক দাসে পরিণত হয়েছে। সৌদি রাজ পরিবার ব্যবসা ভালো বোঝে। তাই তো গত বছর দেখা গেল জার্মানি সিরিয়ার ১০ লক্ষ শরণার্থী গ্রহণ করলেও সৌদি আরব কোন শরণার্থী গ্রহণ করে নাই। তবে জার্মানিতে তারা ২০০ মসজিদ তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। যাতে ওহাবীবাদ প্রসার ও সৌদিতে বারে বারে হজ্জ করতে আসতে মানুষকে উদ্বুগ্ধ করতে সক্ষম হয়। মুসলিমদের অজ্ঞতা ও অন্ধ অনুভূতিকে কব্জা করে সৌদি রাজ পরিবার ক্ষমতার জুয়া খেলে যাবে। মুসলিম সমাজের রেনেসাঁস না আসা পর্যন্ত সৌদি আরবের আগ্রাসনে সহজিয়া মুসলিমসহ উদার ধর্মীয় মতবাদ বিলীন হয়ে যাবে।
সহায়তায়:
মক্কাঃ ক্বাবার অজানা ইতিহাস-আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ




You Can’t Understand ISIS If You Don’t Know the History of Wahhabism in Saudi Arabia 
After The Phophet-The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam by Lesley Hazleton
মুসলিম দুনিয়ার ক্ষমতার সম্পর্কের ইতিহাস: জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা-পারভেজ আলম
----------------------------------

মন্তব্যসমূহ