বাংলাদেশে চিন্তাচর্চা ॥ শরিফ খোকন ( সৌজন্য;-চিন্তাসূত্র )



                        বাংলাদেশে চিন্তাচর্চা ॥

                             লেখক  শরিফ খোকন

                                                    ( সৌজন্য;-চিন্তাসূত্র )

     

            উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় চিন্তাচর্চার ব্যাপকতা দেখা দেয়। এ সময় চিন্তামূলক রচনার বিষয়বৈচিত্র্য, পরিমাণ ও সংখ্যাগত বৃদ্ধি এবং রচনার ঔৎকর্ষ বা গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য চিন্তার প্রসার ঘটেছে আগেই। দ্বিতীয় ভাগে এসে মুসলমানদের মধ্যেও তার সাড়া পড়ে। বর্তমান আলোচনায় দ্বিতীয়ার্ধ বলতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় আলোচিত হবে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সিপাহী বিপ্লব বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৮৫৭), ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনক্ষমতা ব্রিটেনের মহারানীর হাতে অর্পণ— অর্থাৎ কোম্পানি আমল থেকে ব্রিটিশ আমলের শুরু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাংলা রচনা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তাচর্চা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য চর্চা, ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, সৈয়দ আমীর আলী, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলমান সমাজ সংস্কারকের কর্মকা-, মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি ইত্যাদি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা, আলীগড়ে সৈয়দ আহমদ খানের কর্মকা-ের বিস্তৃতি, মীর মশাররফ হোসেন এবং বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যচর্চা, বিজ্ঞানের নানারূপ অগ্রগতি ও প্রযুক্তির নতুন আবিষ্কার ও ব্যবহার, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান ও ব্রাহ্ম সমাজের চতুর্মুখী সাম্প্রদায়িকতা, বড় বড় সম্প্রদায়গুলোর ভেতরকার উপসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দুর পুনর্জাগরণ, মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্রভাবনা, বঙ্গভঙ্গ, সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

           এ সময়ের মধ্যে বাংলা ও বাঙালির সার্বিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।

          নানা বিষয়ের চিন্তাস্রোতে চলমান হয়।  যেমন,

১.       সাহিত্যচিন্তা

২.      শিল্পচিন্তা

৩.      সমাজচিন্তা

৪.      ধর্মচিন্তা

৫.      দর্শন চিন্তা

৬.      রাজনীতি ও জাতীয় চিন্তা ইত্যাদি

          এ ছাড়াও আছে ভাষাচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা ইত্যাদি। তবে আলোচ্য সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থগুলো আলোচনার জন্য এখানে যেভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে তাকেই চূড়ান্ত বলে মনে করার কারণ নেই। কারণ সাহিত্যচিন্তার গ্রন্থে সমাজচিন্তা, সমাজচিন্তার গ্রন্থে জাতীয় ও রাজনৈতিক চিন্তা, ধর্মচিন্তার গ্রন্থে দর্শনচিন্তা বা দর্শনচিন্তার গ্রন্থে বিজ্ঞানচিন্তাও স্থান পায় এবং পেয়েছে। তাই বর্তমান আলোচনার সুবিধার জন্যই শুধু এই সরল শ্রেণীকরণকে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে হয়।

               সাহিত্যচিন্তা

          ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বেই বলা যায় বাংলা গদ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। তবে এই গদ্যরীতি ব্রিটিশ ও অন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে গড়া গদ্যেরই ধারাবাহিকতা। এ সময় চিন্তামূলক বা তত্ত্বপ্রধান রচনাগুলো গদ্যে লেখা হয়। এ সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষিত বা গ্রাজুয়েট লেখকদের আবির্ভাব ঘটে। তারা পাশ্চাত্য চিন্তা ও শিল্পরীতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ কারণে তাদের রচনায় দেখা যায় নতুনত্ব। যা নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণীর পাঠকের কাছে পরিচিতি লাভ করে।

          এ শতকের প্রথমার্র্ধে যারা লেখালেখি শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই নতুন প্রজন্মের আবির্ভাবে কিছুটা হোঁচট খান। প্রথম চিন্তাশীল গদ্য লেখক রামমোহন রায় এর আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাহিত্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রবন্ধগ্রন্থ বা চিন্তাশীল রচনা লেখেননি। তিনি প্রধানত সমাজতত্ত্বের লেখক। তাই বর্তমান অনুচ্ছেদে তার উপস্থিতি দেখা যাবে না। এ সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেখকদের অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি মূলত ঔপন্যাসিক হলেও বাংলা প্রবন্ধ-সমালোচনা ইত্যাদি তার হাতেই নিজস্ব রূপ লাভ করে। তাকেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের সমালোচক বলা যায়। তার চিন্তাশীল সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা:  লোক রহস্য (১৮৭৪), বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), বিবিধ-সমালোচনা (১৮৭৬), সাম্য (১৮৭৯), বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম খণ্ড (১৮৮৭) এবং দ্বিতীয় খণ্ড (১৮৯২) ইত্যাদি।

              বঙ্কিমচন্দ্রের আগে অক্ষয়চন্দ্র সরকারও চিন্তাশীল সাহিত্য রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনা: সনাতনী (?)। তিনি পূর্ণিমা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘পূর্ণিমা’র মাঘ ১৩০২— অগ্রহায়ণ ১৩০৬) সংখ্যায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ নামে প্রবন্ধ লেখেন। প্রথম কোনো বাঙালি মুসলমান লেখকের এটি গবেষণাধর্মী উল্লেখযোগ্য রচনা। অবশ্য এর অনেক বছর আগে খোন্দকার শামসুদ্দীন মোহাম্মদ সিদ্দিকী (১৮০৮-৭০) উচিত শ্রবণ (১৮৬০) নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। মুসলমানদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম গদ্য লেখক।

         এ সময়ের আরো যারা চিন্তাপ্রধান গদ্য রচনা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: রাজনারায়ণ বসুর বাংলা ভাষা ও ‘সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ (১৮৭৮), চন্দ্রনাথ বসুর ‘শকুন্তলাতত্ত্ব’  (১২৮৮), হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বাল্মীকির জয়’ (১৮৮১), ‘মেঘদূত ব্যাখ্যা’ (১৯০২), বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্র ও কাব্য’ (১৮৯৪), দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (১৮৯৬), কেদারনাথ মজুমদারের ‘গদ্যসাহিত্য’ (১৯০১), ‘চিত্র’ (১৩১৩), প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯০২), ‘তেল-নুন-লকড়ি ’ (১৯০৬), মোহাম্মদ নজিবর রহমানের ‘বিলাতি বর্জন রহস্য, সাহিত্য প্রসঙ্গ’ (১৯০৪) ইত্যাদি।

         এসব রচনার মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রচনাগুলোকে সাহিত্য-সমালোচনা বলা যায়। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ।

              সমাজচিন্তা

         ঊনিশ শতকের শেষার্র্ধে বাঙালি সমাজের যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে তাকে অনেকে ‘বাঙালি রেনেসাঁ’ বলেন। অনেকে অবশ্য এ বিষয়ে একমত হতে পারেন না। তাদের মতে কলকাতাকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবারের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াকে পুরো জাতির জন্য রেনেসাঁ বলা যায় না। যাই হোক এ সময়টা নতুন সমাজ গড়ার। পাশ্চাত্যশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে অবশ্য এ শতকের প্রথমার্ধেই বিরাট পরিবর্তন দেখা গেছে। ডিরোজিও-প্রভাবিত তরুণরা সমাজকে নাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আন্দোলন নতুন করে ধাক্কা খায় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে। কলকাতাকেন্দ্রিক আজকের বুদ্ধিজীবীদের অনেকে সিপাহী বিদ্রোহকে ‘বিপ্লব’ বা ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বললেও সে সময় কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টাকে এতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেননি।

         তবে এই বিদ্রোহের পরে ভারতের শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটেনের রানীর হাতে চলে যায়। অবসান ঘটে কোম্পানির শাসনের এবং একইসঙ্গে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনের। বিশাল ভারতবর্ষের শাসনভার ব্রিটিশদের কাছে কঠিন মনে হওয়াতে তারা তাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি এদেশে কিছু কেরানি বানানোর কাজে প্রয়োগ করে। সেই সুযোগ নিয়ে উঠতি কিছু পরিবার ইংরেজি শিখে ব্রিটিশ সরকারের কাজে সহযোগিতা করে। সে সময় যারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের মধ্যে তিনটি প্রবণতা ছিল। প্রথমত, যারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতেন, দ্বিতীয়ত, তারা ব্রিটিশদের দুঃশাসনের কাজে সহযোগিতা করেছেন, এবং তৃতীয়ত, তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে সহযোগিতা করে নিজেদের পারিবারিক ও বৈষয়িক উন্নতিবিধান করেছেন। এসব কারণে এই শ্রেণীটিকে হিন্দু বা মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কৃষক শ্রেণী এবং দরিদ্র শ্রমিক লোকেরা আপন বলে মেনে নিতে পারেননি।

         এই নব্য উঠতি শ্রেণীটির উদ্ভব অবশ্য আগের শতাব্দীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৮৯৩) ফল। নব্য জমিদার ও জোতদার ভূস্বামীদের সন্তানরা ইংরেজদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের খুব সুখী ভাবতেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ভাবতে পারেননি যে, এর ফলে ইংরেজরা এদেশে আরো দীর্ঘদিন থাকতে পারবে। অবশ্য সেই ভাবনা হয়তো তাদের মগজে ছিলই না। সিপাহী বিদ্রোহের পরে উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তার চেতনা জাগ্রত হয়। সেই জাতীয়তা কিন্তু আজকের মতো অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা ছিল না; ছিল ধর্মীয় ঐতিহ্যকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক জাতীয়তা। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-সীতারাম-দেবী চৌধুরারী’ ত্রয়ী উপন্যাসে সেই প্রাচীন আর্য সংস্কৃতির হিন্দু-পুরাণের যুগে ফিরে যাওয়ার ঘোর চেতনা প্রচারিত হয়। ড. আহমদ শরীফের মতে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী বাঙালি লেখকদের মধ্যে প্রধান হলেন, হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র-রঙ্গলাল-বিহারীলাল-দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ।

        হিন্দু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীদের এই অতীতমুখিতা প্রতিবেশী মুসলমানদেরও অতীতমুখি করে তোলে। দেখা দেয় সাম্পদ্রায়িক অসহিষ্ণুতা। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। বঙ্কিমচন্দ্রসহ অনেকের উপন্যাসে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় কয়েক বছর পরে ইসমাইল হোসেন শিরাজির কয়েকটি উপন্যাসে হিন্দুদের যথেষ্ট অবজ্ঞা করে উপস্থাপন করা হয়।

          হিন্দু পুনর্জাগরণের জোয়ার কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারকেও ভাসিয়ে দেয়। ইংরেজদের সুবিধাভোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইংরেজপ্রীতি তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্যাগান হিন্দুত্ব থেকে কিছুটা সরিয়ে দেয়। তিনি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তিনি হিন্দুঐতিহ্য থেকে সরেননি। ফলে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি-নাতনীরা আধুনিক বিদ্যাচর্চার অনুরাগী হলেও তাদের বাড়িতে ‘হিন্দুমেলা’ ও ‘শিবাজী-উৎসবে’র মতো অনুষ্ঠান হয়েছে। ব্রাহ্ম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে ‘ব্রাহ্মমেলা’ বা ‘রামমোহন-উৎসব’ আয়োজিত হতে পারত; আর তাই ছিল স্বাভাবিক।

         হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক দিনে দিনে বিপরীতমুখি হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা বুকে বুকে কাছাকাছি নয়; পিঠে পিঠে কাছাকাছি” এ ধরনের একটি উক্তি করেছেন। এর শুরুটা বোধ হয় উনিশ শতকে।

         মুসলমানেরা ইংরেজদেরকে খ্রিস্টান ভেবে কিছুদিন ফতোয়া দিয়ে, অভিমান করে দূরে সরে থাকার পরে উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলন এবং এর ফল দেখে বাংলায় কয়েকজন নবাব এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে নবাব আবদুল লতিফ, নবাব আলী চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হুদা, সৈয়দ আমির আলীর মতো কয়েকজন বাঙালি মুসলমান তাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা মুসলমানদের গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। নানা ধরনের সহযোগিতাও করেন। ধীরে ধীরে মুসলমানরাও ইংরেজদের ফাঁদে পা রাখতে শুরু করে। বিদেশী শাসকশক্তির চেয়ে প্রতিবেশী হিন্দুদের প্রবল প্রতিপক্ষ ভাবনারই ফল এটা। যেমন আগের শতক থেকে হিন্দুরা অনুরূপ ভাবত— বিদেশী শাসকেরা নয়; প্রতিবেশী মুসলমনারাই প্রধান প্রতিপক্ষ।

          এ সময় সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে; আবার উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কারও চলতে থাকে। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা প্রকার উপসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতও দেখা দেয়। এ সময়ের হিন্দু ও মুসলমান সমাজে নানা ধরনের চিন্তার উদ্রেক হয় নতুন করে। সে সব নিয়ে লেখালেখি হতে থাকে। এ সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার প্রথম খণ্ড’ (জুলাই ১৮৭১) ও দ্বিতীয় খণ্ড (মার্চ ১৮৭৩), অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘সমাজ সমালোচনা’ (১৮৭৪), কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘প্রভাতচিন্তা’ (১৮৭৭), ‘নিভৃতচিন্তা’ (১৮৮৩), ‘ভক্তির জয়’ (১৮৯৫), ‘নিশীথচিন্তা’ (১৮৯৬), ‘জানকীর অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯০৫), প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা’ (১৮৭৮), ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২), ‘আচার প্রবন্ধ’ (১৮৯৮), ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) ইত্যাদি।

          রেয়াজউদ্দিন মাশহাদীর ‘সমাজ ও সংস্কারক’, ‘অগ্নিকুক্কুট’, ‘কৌমুদী’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘বক্তৃতা স্তবক’ (১৮৮৮), রামতনু লাহিড়ীর ‘তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ (১৯০৪), ‘প্রবন্ধাবলী’ ১ম খণ্ড- (১৯০৪), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বোম্বাইচিত্র’ (১২৯৫), সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘কল্কিপুরাণ’ (১৮৮৬), এবং হামিদুল্লাহ খাঁর ‘ত্রাণপথ’ ইত্যাদি।

          এ সময় নারীর সমস্যা শিক্ষা নিয়ে মানকুমারী বসু বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেন। মুসলমান নারীর সমস্যা নিয়ে লেখন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। এ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ মতিচুর-১ম খণ্ড (১৯০৪), সরলাদেবী চৌধুরানীর বাঙালির পিতৃধনও এসময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়।

                 ধর্মচিন্তা

          আগেই বলা হয়েছে যে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির ধর্মে নানা প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। এসময় রামকৃষ্ণ পরমহংস তার বাণী প্রচার করেন। তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে পাশ্চাত্যের আধুনিক এবং প্যাগানবিরোধী সমাজে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি শিকাগোতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে যে বক্তৃতা প্রদান করেন তা শুধু হিন্দু-ধর্মেরই নয় প্রাচ্য-সভ্যতার পক্ষে এক বিরাট বিজয় বলে গণ্য করা হয়। হিন্দু সমাজের কিছু মানুষের ঐতিহ্যপ্রীতি কিছু মানুষকে বিরক্ত করে। তারা আর্য, গুপ্ত এবং সেনযুগের প্যাগানিজম থেকে কিছুটা সরে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং প্রচার করেন। এই হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের নতুন মতবাদের সহাবস্থান সর্বদা শান্তিপূর্ণ ছিল না। দুটি সমাজের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রচলিত ছিল। সে সব বিষয় থেকে প্রকাশিত কিছু বাণী বা বক্তব্য লিখিত আকারে, পত্রিকায় ও গ্রন্থাকারে সংগৃহীত আছে। এ সময় কলকাতা ও ঢাকা থেকে হিন্দুত্ববাদী এবং ব্রাহ্মবাদী পত্র-পত্রিকা এবং গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

          এ সময়ের মুসলমান সমাজে ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের ফলে দেশীয় প্যাগানিজমের ও পারস্যের আর্যসভ্যতার প্রভাবমুক্ত এবং আরবের দ্বারা প্রভাবিত বিশুদ্ধ ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়। অনেকে নতুন এই পথ গ্রহণ করেন। এর ফলে প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে যেমন দূরত্ব বাড়ে; শাসকশ্রেণীর সঙ্গেও তিক্ত সম্পর্ক রচিত হয়। শাসকশ্রেণীর ধর্ম-দর্শন-চিন্তা ও শিক্ষাকে শত্রুর বিষয়বস্তু গণ্য করে তারা ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত বজায় রাখেন।

           ইউরোপের খ্রিস্টানদের সঙ্গে এশিয়ার মুসলমানদের দ্বন্দ্ব শুধু সাম্প্রদায়িক বিষয় না। বিষয়টা রাজনৈতিক এবং আর্থ-বাণিজ্যিকও। এশিয়ার তুর্কি মুসলমানরা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো কয়েক শতাব্দী শাসন করেছে। সেখানে শাসক মুসলমানদের সঙ্গে শাসিত খ্রিস্টানদের সঙ্গে বৈরীতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টানদেশগুলো এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলমান দেশগুলো শাসন করেছে। এখানে শাসক ইউরোপের খ্রিস্টানরা আর শাসিত আফ্রিকা ও এশিয়ার মুসলমানরা। এভাবে তাদের সম্পর্ক শত্রুতামূলক হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে আরেকটি পুরনো বিষয় যুক্ত হয়েছে। আরব মুসলমানরা কয়েক শত বছর স্পেন শাসন করেছে। প্রতিবেশী পর্তুগাল সেখানে দাঁত বসাতে পারেনি। ভূমধ্য, লোহিত, আরব, পারস্য, ভারত, বঙ্গ প্রভৃতি সাগর-উপসাগর এবং মহাসাগরে পর্তুগিজরা নৌবাণিজ্যে আরবদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। এর ফলে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভাস্কো-দা-গামা আটলান্টিক মহাসাগর ঘুরে ভারতে এসে বাণিজ্য করার সুযোগ খোঁজেন। তার ডায়রি এবং স্মৃতিকথায় এবং পরবর্তী পর্তুগিজ নাবিক-ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের রচনায় ভারত ও বাংলার মুসলমান শাসকদের এবং আরব বণিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য মমতাজুর রহমান তরফদারের হোসেন শাহী আমলে বাংলা গ্রন্থটি)

           পর্তুগিজরা হোসেন শাহী আমলে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। কোনো কোনো অঞ্চলে কৃষি কাজ করার এবং খাজনা আদায় করারও অধিকার লাভ করে। দেশীয় সুলতানরা ইউরোপের এই ফিরিঙ্গিদের কাছ থেকে যুদ্ধবিদ্যা এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য সভ্যতার সুবিধা লাভ করেন। পরবর্তীকালে পর্তুগিজদের দস্যুবৃত্তি এবং যাজকবৃত্তি বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

           পলাশি যুদ্ধের পরে পর্তুগিজরা বাংলায় একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন থেকে পর্তুগিজ মিশনারিদের স্থলে ব্রিটিশ মিশনারিদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ খ্রিস্টান যাজকরা প্রকাশ্যে খ্রিস্টানধর্ম প্রচারের কাজে নামেন। সাপ্তাহিক হাটবারে হাটে গিয়ে ইসলাম ধর্ম এবং হিন্দুধর্মের এবং ধর্মীয় শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবং দেব-দেবীর নামে কুৎসা রটাতে থাকেন। খ্রিস্টান ধর্মকে জগতের একমাত্র সেরা ধর্ম বলে প্রচার করেন। তারা মনে করে যেহেতু এটা ঈশ্বরের পুত্রের ধর্ম। এসব প্রচারণা নিয়ে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে হাটে-বাজারে ছোটখাটো দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়। খ্রিস্টান যাজকরা শাসকশ্রেণীর পক্ষের বলে বিশেষ সুবিধা লাভ করেন। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে ‘বাহাস’ বা বিতর্ক শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে খ্রিস্টান যাজকের সঙ্গে মুসলমান ইমাম বা আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক হয়। এ সময় হিন্দুদের মধ্যে যেমন অনেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, তেমনি মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে ক্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে এখানে উল্লেখযোগ্য মুন্সী জমিরুদ্দীনের নাম। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছুদিন লেখালেখি করেন। পরে আরো বেশি পড়াশোনা করে খ্রিস্টানধর্ম সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ হয়ে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসেন। এর পরে তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর নামকরণ থেকেই কিছুটা অনুমান করা যায়। আমার জীবনী ও ইসলাম গ্রহণ বৃত্তান্ত (১৩০৪), হজরত ঈশা কে? (১৩০৬), ইসলামী বক্তৃতা (১৩১৪), মেহের চরিত (১৩১৫) ইত্যাদি।

         খ্রিস্টানরা নানরূপ চতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা বাইবেলকে ‘ইঞ্জিল শরীফ’ নামে সরল ভাষায় অনুবাদ করেন। আরবি শব্দ ও ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করে বাক-চাতুরি সৃষ্টি করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সব বিষয় নিয়ে গ্রন্থরচনা, পাঠ এবং তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে।

          অনুরূপ হিন্দু সম্পদ্রায়ের লোকেরাও খ্রিস্টান যাজকদের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করতে থাকেন। (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ডক্টর ওয়াকিল আহমদের উনিশ শতকের বাঙালী মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা গ্রন্থটি দেখুন।)

         প্রচারমূলক খ্রিস্টধর্ম-ওয়াহাবি ও ফরায়েজিপন্থী বিশুদ্ধ ইসলামপন্থী-সৈয়দ আহমদপন্থী উদার মুসলমান-ঐতিহ্যানুসারী পুনর্জাগরণবাদী হিন্দু এবং একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে চতুর্মুখী একটি সাম্প্রদায়িক ও উপসাম্প্রদায়িক দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সব ধরনেরই ধর্মতত্ত্বের গ্রন্থ তখন রচিত হতে থাকে। যেমন:

         অক্ষয়কুমার দত্তের ধর্মচিন্তা (১৮৫৫), ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় প্রথম ভাগ (১৮৭০), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৩) কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান-প্রকৃত বিধান, বিধান ভারত, নব সংহিতা, চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারের কাতন্ত্রছন্দঃপ্রক্রিয়া (১৮৯৬), উদ্বাহচন্দ্রালোক (১৮৯৭), শুদ্ধিচন্দ্রালোক (১৯০৩), ঔর্ধ্বদেহিচন্দ্রালোক (১৯০৬), চন্দ্রনাথ বসুর পশুপতিসম্বাদ (১২৯৪), হিন্দুত (১৮৯২), হিন্দু বিবাহ (১২৯৪), ত্রিধারা (১২৯৭), বর্তমান (১৩০৬), বতালে বহু রহস্য (১৯০৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ব্রাহ্মবিবাহ প্রণালী (১৮৬৪), জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মজ্ঞান ও ব্রাহ্মসাধন (১৯০০), প্যারীচাঁদ মিত্রের আধ্যাত্মিকা (১৮৮০), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬), ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮), মুন্সী মেহেরুল্লাহর খ্রিস্টানধর্মের অসারতা (১৮৮৬), মেহেরুল ইসলাম, ইসলামী বক্তৃতামালা, বিধবা গঞ্জনা, মোজাম্মেল হকের মহর্ষি মনসুর (১৩০৩), রাজনারায়ণ বসুর রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা-২ (১৮৭০), ব্রাহ্মসাধন (১৮৬৫), ধর্মতত্ত্বদীপিকা-১ম খণ্ড (১৮৬৬), ২য় খণ্ড (১৮৬৭), আত্মীসভার সদস্যদের বৃত্তান্ত (১৮৬৭), হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা (১৮৭৩), প্রকৃত অসাম্প্রদায়িকতা কাহাকে বলে (১৮৭৩), সেকাল আর একাল (১৮৭৪), ব্রাহ্মধর্মের উচ্চ আদর্শ ও আমাদিগের আধ্যাত্মিকতার অভাব (১৮৭৫), হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত (১৮৭৬), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮), বিবিধ প্রবন্ধ-১ম (১৮৮২), রামচন্দ্র বড়–য়ার চট্টগ্রামের মগের ইতিহাস, শ্রমণ কর্তব্য, নির্বাণ দর্শন, শেখ আবদুর রহিমের হজরত মহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৮), ইসলামতত্ত্ব (১৯৯৮), হজবিধি (১৯০৩), শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোহংতত্ত্ব, সোহংসংহিতা, বিবেক গাথা, ভগবৎগীতার সমালোচনা, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদ্ধধর্ম (১৩০৮), স্বামী বিবেকানন্দের পরিব্রাজক (১৯০৩), ভাববার কথা (১৯০৫), বর্তমান ভারত (১৯০৫), প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইত্যাদি। এ সব গ্রন্থের মধ্যে বেশির ভাগই নি¤œমানের চিন্তায় ভরা। কিন্তু ধর্মতত্ত্বের প্রথম দিকের গদ্যগ্রন্থ হিসাবে পাঠকসমাজে গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এবং ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট স্থান আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের অন্য শাখার মতো ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থও সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু হিন্দু সমাজেই না। মুসলমান সমাজেও তিনি প্রভাবশালী ছিলেন। তার কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থটিতে কৃষ্ণকে মানুষ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এগ্রন্থের অনুসরণে পরে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী মানুষ মোহাম্মদ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সৈয়দ এমদাদ আলী মানব মুকুট গ্রন্থ রচনা করেন। এরও পরে গোলাম মোস্তফা বিশ্বনবী লেখেন। মানব মুকুট সম্পর্কে ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন,

         “মানব মুকুট রচনার প্রেরণা এয়াকুব আলী লাভ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র পাঠ করে। কৃষ্ণকে বঙ্কিমচন্দ্র অবতার রূপে না দেখিয়ে মানুষ রূপে এবং মানুষের মহত্তম বিকাশ রূপে দেখিয়েছেন।”

          এসময় দার্শনিকচিন্তারও অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তুগতভাবে এগুলোতে ধর্ম, সমাজ এবং সাহিত্য ভাবনাও মিশে আছে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের দূরাকাক্সেক্ষর বৃথা ভ্রম, ‘বিচিত্রবীর্য (১৮৬২), রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়দর্শন সংবাদ, যোগেশচন্দ্র রায়ের সিদ্ধান্ত দর্পণ (১৮৯৯), আমাদের জ্যেতিষ ও জ্যোতিষিী-(১৯০৩) ইত্যাদি। নব্য জার্মান ও ভারতীয় দর্শন গবেষণাকাল (১৯০২Ñ১৯০৫) নামে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন নিয়ে সম্ভবত প্রথম বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তার গ্রন্থে আধুনিক জার্মান দর্শনের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মুলনামূলক আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের রিসার্চ স্কলার হিসাবে এই গ্রন্থ রচনা করেন।

              বিজ্ঞানচিন্তা


         উনিশ শতকে আধুনিক বিজ্ঞান নিয়েও বাঙালি বিদ্বৎসমাজে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। শতাব্দীর প্রথমার্ধে অক্ষয়কুমার দত্ত বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার প্রথম ভাগ (১৮৫২), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৩), পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬) ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বিতীয়ার্ধে এসে  আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানচিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখি করেন ইংরেজিতে। কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলায় রচনা করেন দুটি গ্রন্থ- প্রকৃতি (১৩০৩), জিজ্ঞাসা (১৩১০)। ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান-১ম ভাগ (১৮৫৮), ২য় ভাগ (১৮৫৯), ক্ষেত্রতত্ত্ব (১৮৬২), পাটীগণিত (১৮৯০) গ্রন্থগুলো রচনা করেন। অবশ্য তাদের আগেই বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭২ সালে বিজ্ঞান রহস্য গ্রন্থটি রচনা করেন।

          চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী ইংরেজিগ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮২ সালে পৃথিবী নামে একটি বিজ্ঞানগ্রন্থ রচনা করেন।


               রাজনীতি ও জাতীয় চিন্তা


         উনিশ শতকের শেষের অর্ধেক সময়েই ভারতবর্ষের শাসনকাজে ইংরেজরা ভারতীয়দের কাজে লাগানোর জন্য দলীয় রাজনীতির প্রবর্তন ঘটায়। ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এর জন্ম হয়। এর পরে ভারতের বিশেষ করে বাংলার, মহারাষ্ট্রের, পাঞ্জাবের এবং বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির মধ্য থেকে বিজ্ঞ ও যোগ্যতম লোকেরা দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হন। তারা সরাসরি রাজনীতিতে আসেন। তখন কংগ্রেস মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবেই গণ্য হতো। পরে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীদের আধিপত্যে দলটি মুসলমানদের দূরে ঠেলে দেন। মুসলমানরা তখন থেকেই পৃথকরাষ্ট্রের কথা ভাবতে থাকেন। শুরুর দিকে উপমহাদেশের অনেক মুসলমান নেতাই কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। মাওলানা আজাদ সোবহানি, হাসরত মোহানি, খাজা আজমল, মুহম্মদ আলি জিন্না, আবুল কাসেম ফজলুল হকসহ অনেকেই। পরে বিভিন্ন সময়ে মুসলমান নেতারা বেরিয়ে আসেন। শুধু মুসলমানরই নন, বাঙালি হিন্দু নেতাদের মধ্যেও যারা প্রকৃত নিরপেক্ষ এবং পরমতে সহিষ্ণু ছিলেন তারাও কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন, বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন বা পৃথক দর গঠন করে ভিন্ন পথ রচনা করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মানবেন্দ্রনাথ রায়, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ।

          এ সময় শিক্ষিত জনগণ রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রাজনীতি নিয়ে অনেক বাংলা এবং ইংরেজি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যাই বেশি ছিল। বাংলায় লেখা রচনাগুলো সাহিত্য এবং সমাজচিন্তার সঙ্গে মিশে আছে। আসলে তখন সমাজ-সাহিত্য ও রাজনীতি পৃথক বিষয় ছিলও না। তাই সমাজচিন্তা ও সাহিত্যচিন্তামূলক গ্রন্থগুলোতেই রাজনীতিচিন্তা অনুসন্ধান করা কর্তব্য। তবে দুটি গ্রন্থের কথা বলা যায় যেগুলো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

         নওশের আলী খান ইউসুফজয়ীর বঙ্গীয় মুসলমান (১৮৯১) এবং সখারাম গণেশ দেউস্করের দেশের কথা। সখারাম গণেশ দেউস্কর সরাসরি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি তাদের তাত্ত্বিক গুরু বলে অভিিিহত হতেন।

              ইতিহাস


         জাতীয়বাদী চেতনার যুগেই মানুষ ইতিহাস সচেতন হয়। বাংলায় তাই হয়েছে। আমাদের আলোচ্য সময়ে ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। আগে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পুরাণ-গল্পকেই ইতিহাস বলে গণ্য করা হতো। এ সময় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত গবেষকগণ ইতিহাসতত্ত্বের আলোকে বিজ্ঞাননির্ভর পদ্ধতিতে ইতিহাস রচনা শুরু করেন। কোথাও কোথাও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাও দেখা যায়। তখন পর্যন্ত সবাই আধুনিক ইতিহাসতত্ত্ব মেনে গ্রন্থগুলো রচিত হয়নি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ নাম দেওয়া যেতে পারে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পুরাবৃত্ত সার (১৮৫৮), ইংল্যান্ডের ইতিহাস (১৮৬২), কেদারনাথ মজুমদারের ময়মনসিংহের ইতিহাস (১৩১২), ময়মনসিংহের বিবরণ (১৩১১), সতীশচন্দ্র মিত্রের প্রাথমিক বাঙ্গালার ইতিহাস (১৯০২), ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৯০৩), হরচন্দ্র বিদ্যাবিনোদের শেরপুরের বিবরণ (১২৭৯), বংশানুচরিত, শেরপুরের বংশাবলী, ভারতবর্ষীয় আর্যজাতির কর্মকা- ইত্যাদি।


              শিক্ষাচিন্তা

         শিক্ষা নিয়ে ইংরেজরাই প্রথম চিন্তাভাবনা শুরু করে। পরে দেশীয় শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদগণ তাদের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেন। স্যার কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়: এ ফিউ থটস অন এডুকেশন, চণ্ডীচরণ সেন- শিক্ষা গ্রন্থে স্ত্রীশিক্ষায় গুরুত্বারোপ করেন। অবশ্য তার আগে  মদন মোহন তর্কালঙ্কার: ১৮৫০-এ সর্ব শুভঙ্করী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় শিক্ষা দর্পণ ১২৭১, এডুকেশন গেজেট-১৮৬৮ সম্পাদনা করেন সে সব কাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো শিক্ষাবিষয়ক প্রস্তাব-(১৮৫৬) গ্রন্থে স্থান পায়। মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদের বোধোদয় তত্ত্ব, নওশের আলী খান ইউসুফজয়ীর উচ্চ বাংলা শিক্ষা বিধি (১৯০১), মীর মশাররফ হোসেনের মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা-১ম খণ্ড (১৯০৩) ইত্যাদি মুসলমানের শিক্ষাসমস্যা নিয়ে লেখা গ্রন্থ।

          এছাড়া ভূগোল ও প্রকৃতিকিজ্ঞান বিষয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত রচনা করেন প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা বাণিজ্যবিস্তার (১৮৫২) এবং প্যারীচাঁদ মিত্র কৃষিবিষয়ক চিন্তাশীল গ্রন্থ রচনা করেন ভারতবর্ষীয় কৃষি-বিষয়ক বিবিধ সংগ্রহ, কৃষি পাঠ-(১৮৬১)।

          ইংরেজি: ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজিতে কোনো কোনো বাঙালি চিন্তাশীল গ্রন্থ রচনা করেন। তারা ইংরেজদের কাছে নিজেদের চিন্তা প্রকাশ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। ইংরেজিতে নানা বিষয়ের গ্রন্থই তারা রচনা করেছিলেন। যেমন,  ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দীর Makhaj-E-Ulum or Treaties on the Science (1867), Mohamedan Education on the Bengal (1867), কিশোরীচাঁদ মিত্রের The Mutiny (1858), The Hindu College (1862), The Government and the People, Memoirs of Dwarkanath Tagore (1870) Orissa: past and Presents, কৃষ্ণদাস পাল The Mutiny and the People or statement of Native Feudality (1859) গ্রন্থে সিপাহী বিদ্রোহের বিপক্ষে এবং ইংরেজদের পক্ষ হয়ে বিদ্রোহের অসারতা প্রমাণ করেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রেভারেন্ডের Encyclopidea of Bengaliansis (1845Ñ46), The Aryan Witness (1875),  কে. পি. বসুর  How to Teach Arethmetics (1902), জগদীসচন্দ্র বসুর Response in Living and Non-living (1902), Plant Responses As aMeans ofPhysiological Investigations (1906), প্যারীচাঁদ মিত্রের The Jaminder and Riots, The Agriculture in Bengali ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের Aurangzeb: Topography Statistics and Road (1901), ড. রমেশচন্দ্র দত্তের The Lake of Palms: A History of Indian Domestic Life (লন্ডন-1902), The Economic History of India:1757-1837 (1902), India in the Victorian Age: An Economic History of the People: 1837-1900 (1904), রাজন্দ্রেলাল মিত্রের Anitquitis of Urissa, Buddha Gaya, Lalit Bistar, Patanjali, Nepalese Buddhist Literature, Indo Aryan, রেভারেন্ড লালবিহাীল দে’র Primary Education of Bengal (1858), Varnacular Education of Bangla (1859), English Education in Bangla (1859), Teaching of English Literature in the Colleges of Bangla (1874), Compulsory Education in Bangla (1869), The History of Bengal Riots, Bengal Peasant Life, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের  Bengal Riots: Their Rights and Liabilities (1864), হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর  Varnacular Literature of Bengal befor the Introductin of English Education (1891), Discovery of Living Buddhism in Bengal (1897) উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের Indian Politics, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের  History of Hindu Chemistry: vol-1(1902), Life and Experience of Bengali Chemist, সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। তার গ্রন্থের নাম  Polular Lectures on Subjects of Indian Interest (1890), মুসলমান সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইতিহাস লেখক সৈয়দ আমির আলীর A Critical Examinalian of lite and Teaching of Mohammad (1873),  The Personal Law of Mohammedans (1886), The Spirit of Islam (1891), Ethics of Islam (1893) A Short History of Saracens (1898), শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের Truth, স্বামী বিবেকানন্দের Kramayoga, Rajayoga, Jnanayoga  ইত্যাদি এ সময়ের আলোচিত গ্রন্থ|

             উর্দু: 

        উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যারা নিজেদের অভিজাত বা আশরাফ ভাবতেন, নবাবজাদা মনে করতেন, আরব-ইরানের বংশধর বলে আত্মপরিচয় দানে উৎসাহিত হতেন তারা তখনো উর্দুভাষায় তাদের মতামত এবং চিন্তা প্রকাশ করতেন। অবশ্য কারো কারো পারিবারিক ভাষাই ছিল উর্দু। তারা অবাঙালি হলেও রাজধানী কলকাতায় বাস করে গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের মধ্যে কিছু লেখক ও গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়। যেমন, ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দীর তদরিতুল্লাব কি ছিয়াগিল আবওয়াব, তরাকুল আজহার ফি সিয়ারিল ফালাসিফাতিল কিবার (গ্রিক দার্শনিদের ইতিহাস), দবিস্তান ই দানিশ (পদার্থবিদ্যা), নবাব ওয়াজদ আলী শাহের তারিখ ই পরীখানা, তারিখ ই মুমতাজ, ‘নাজু, বাজি ও দুলহন’ (সঙ্গীততত্ত্ব), হামিদুল্লাহ খাঁর আহাদিসুল খাওয়ানিন প্রথমখণ্ড-(১৯৭০), দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড, আনোয়ারুন্না রাইন ফি আখবারুল খাইরাইন, আজায়েবুল মুলুকাত, হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকার একজন ইউনানি চিকিৎক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তবে তার কয়েকটি বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থও রয়েছে। সেগুলো আমাদের আলোচ্য সময়ের পরে লেখা। এসময়ের মধ্যে তার বিখ্যাতগ্রন্থ : আল ফারিক (১৯১৪), হায়াত ই সুকরাত (সক্রেটিসের জীবন ও কর্ম) ইত্যাদি।

         পরিশিষ্ট: ক


          পত্রিকা: বর্তমান রচনায় আলোচিত সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের সাময়িক পত্র এবং অনিয়মিত পত্র-পত্রিকা চিন্তাচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ সময় অনেক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয় কলকাতা, ঢাকা এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকার নামগুলো: অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী (১৮৪৩), রাজশাহী থেকে ত্রৈমাসিক ঐতিহাসিক চিত্র ১৩০৫—১৩০৬, অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত সাধারণী-(১৮৭৩), এ কাগজটি তিনি সতের বছর পর্যন্ত সম্পাদনা করেন। পরে ১৮৮৪—৮৯  থেকে নবজীবন সম্পাদনা করেন। অরবিন্দ ঘোষ সম্পাদিত বন্দে মাতরম (১৯০৬), ব্যারিস্টার আবদুর রসুল সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা দ্য মুসলমান-(১৯০৬), আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক বালক-(১৯০১), কালীপ্রসন্ন ঘোষ সম্পাদিত সাপ্তাহিক শুভ-সাধিনী (১২৭৭), তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনের অনুকরণে ঢাকা থেকে ‘বান্ধব’ (১৮৭৪) এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র, সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা ইন্ডিয়ান ফিল্ড-(১৮৬৫)। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত মাসিক মনোরঞ্জিকা (১৮৬০), ঢাকা প্রকাশ (১৮৬১), সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী (১৮৬৫), কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য হিতবাদী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন; পরে এটি সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাইয়েরা। কৃষ্ণদাস পাল ১৮৬১ থেকে হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রেভারেন্ড সম্পাদনা করেন একাধিক ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকা, যেমন: এনকোয়ারার (১৮৩১), হিন্দু ইউথ (১৮৩১), গভর্নমেন্ট গেজেট (১৮৪০), সংবাদ-সুধাংশু-(১৮৫০), ইভানজেলিস্ট। কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত নববিধান-(১৮৮১), গিরীশচন্দ্র সেন, সুলভ সমাচার, বঙ্গবন্ধু ও মহিলা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদনা করেন তত্ত্ববোধিনী (১৮৮৪Ñ১৯০৯), ভারতী (১৮৭৭Ñ১৮৮৪), হিতবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। প্যারীচাঁদ সরকার দি ওয়েল উইশার’ (১৮৬৫), হিতসাধক (১২৭৪) ও এডুকেশন গেজেট, আলোচ্যকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২), মরিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত সাপ্তাহিক সুলতান (১৯০৪), ব্যোমকেশ মুস্তফী সম্পাদিত ভারত (১৮৮৫), তিনি ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ নিয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা করেন। এছাড়া বঙ্গনিবাসী, ভারত সংবাদ, সাপ্তাহিক বসুমতী ও মালা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত আজিজননেহার-(১৮৭৪), হিতকরী (১৮৯০), মুজীবুর রহমান সম্পাদিত ইসলাম রবি, মিহির ও সুধাকর (১৮৮৫), ইংরেজি সাপ্তাহিক দি মুসলমান ৩০ বছর সম্পাদনা করেন, মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত মুসলমান (১৮৮৪), সাপ্তাহিক নব সুধাকর (১৮৮৬), মাসিক ইসলাম (১৮৮৫), সুধাকর-(১২৯৬), ইসলাম প্রচারক (১৮৯১), সাপ্তাহিক সোলতান (১৯০৬), মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী ও রওশন আলী চৌধুরী সম্পাদিত কোহিনুর-(১৩০৫), মোজাম্মের হক সম্পাদিত লহরী-(১৩০৬), রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত মাসিক সচিত্র বিবিধার্থ সংগ্রহ (১৮৫১), মাসিক রহস্য সন্দর্ভ (১৮৬৩), উইকলি হিন্দু প্যাট্রিয়ট (১৮৫৩), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত দাসী-(১৮৯২), মুকুল-(১৮৯৫), প্রদীপ-(১৮৯৭) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি ১৯০১ সাল থেকে এলাহাবাদ থেকে বিখ্যাত পত্রিকা মাসিক প্রবাসী সম্পাদনা করেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পাদিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা-(১৩০৬-১০), রেভারেন্ড লালবিহারী দে সম্পাদিত বেঙ্গলি ম্যাগাজিন, ফ্রাইডে রিভিউ, ইনডিয়ান রিফরমার, শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত প্রথম কিশোর পত্রিকা সখা-(১৮৮৩), তত্ত্বকৌমুদী, ইন্ডিয়ান মেসেজ, শেখ আবদুর রহিম সম্পাদিত সাপ্তাহিক সুধাকর-(১৮৯৪), মাসিক হাফেজ-(১৮৯৬), মাসিক মোসলেম ভারত-(১৯০০), সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন-সম্পাদনা করেন ১২৮৪-৮৯ পর্যন্ত, এ ছাড়া তিনি মাসিক ভ্রমর সম্পাদনা করেন ১২৮০-৮২ সন পর্যন্ত। সতীশচন্দ্র মিত্র সম্পাদিত শিল্প ও সাহিত্য-(১৯০৪), সত্যব্রত সামশ্রমী সম্পাদিত প্রত্নকার্রনন্দিনী (১৮৬৭-৭৪), ঊষা (১৮৮৯-১৯০৫), সরলা দেবী চৌধুরানী সম্পাদিত লাহোর থেকে উর্দু পত্রিকা হিন্দুস্থান, সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর-(১৯০৩), স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ভারতী (১৮৭৪-৮৪), তিনি বালকও সম্পাদনা করেন। হরচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত বিদ্যোন্নতি সাধিনী-(১৮৬৫), সাপ্তাহিক চারুবার্তা (১২৮৮), জলধর সেন সালে সাপ্তাহিক বঙ্গবাসী (১৮৯৯) সম্পাদনা করেন। হাকিম হাবিবুর রহমান সম্পাদিত উর্দু মাসিক আল মাশরিক-(১৯০৬), ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত পূর্ণিমা (১৩০০), সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সাহিত্য (১৮৯০), সাহিত্য কল্পদ্রুম-(১২৯৬), বসুমতী, সন্ধ্যা, নায়ক, বাঙালি  ইত্যাদি সম্পাদনা করেন।

পরিশিষ্ট: খ


          সংগঠন: উনিশ শতকের বাঙালির চিন্তাচর্চায় সাংগঠনিক রূপ ছিল। তখন অনেকগুলো সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও  রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। হিন্দু এবং মুসলমান ছাড়াও বাহ্মসমাজের সংগঠন ছিল। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার হিন্দু সমাজের নব্য জমিদার, ও পুঁজিপতিরা গড়ে তোলেন ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি। বিশ বছর পরে গড়ে ওঠে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন। এরও পঁচিশ বছর পরে গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। এসব সংগঠনের কর্মকা- হিন্দু সমাজকে অনেকদূর এগিয়ে নিলেও বাংলার মুসলমানদের তেমন কাজে রাগেনি; বরং তাদের দূরেই সরিয়ে দিয়েছে। তাই তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে জন্ম নেয় ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন (১৮৭৮), মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি (২ এপ্রিল ১৮৬৩) র মতো নানা সংগঠন এবং সব শেষে ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটির মতো মুসলমান নবাব-খান বাহাদুর- ও জোতদার-জমিদারদের সংগঠন মুসলিম লিগ (১৯০৬)। এসব সংগঠন একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে অপর সম্প্রদায়ের দূরত্ব বাড়ালেও নিজেদের সংগঠিত, সচেতন হওয়ায় এবং চিন্তার বিকাশে নতুন নতুন দিগন্তু উন্মোচন করেছে।

এখানে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উল্লেখযোগ্য কিছু সংগঠনের নাম এখানে দেওয়া যেতে পারে। নবাবআবদুল লতিফ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি (১৮৬৩), ভারতীয় বিজ্ঞান অনুশীলন সমিতি, কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হিন্দুথিয়োফিলানথ্রফিক  সোসাইটি (১৮৪৩), সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদসভা (১৮৫৪), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি করেন দীর্ঘকাল, তিনি ন্যাশনাল সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বিদ্বজ্জন-সমাগম এর উদ্যোক্তা, থিওসফিক্যাল সোসাইটির বঙ্গীয় শাখার সহকারী সভাপতিও ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন পূর্ণিমা সম্মীলন এর প্রতিষ্ঠাতা (১৯০৫)।

           
  বাংলাদেশে চিন্তাচর্চা ॥ 

                             লেখক  শরিফ খোকন

                                                    ( সৌজন্য;-চিন্তাসূত্র )

তথ্য সহায়ক:

১.       আহমদ শরীফ: কালের দর্পণে স্বদেশ-মুক্তধারা, ঢাকা

২.      বদরুদ্দীন উমর: সামপ্রদায়িকতা, মুক্তধারা, ঢাকা

৩.      রবীন্দ্ররচনাবলী: পঞ্চমখণ্ড, কলকাতা-

৪.      ওয়াকিল আহমদ: উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা- বাংলা একাডেমী, ঢাকা-

৫.      ভাষা ও সাহিত্য: এশিয়াটিক সোসাইটি: ঢাকা-

৬.      অমলেন্দু দে: বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা-

৭.       মুসলিম বাংলা সাময়িক পত্র: পাকিস্তান পাবলিকেশন, ঢাকা-

৮.      আবুল কাসেম ফজলুল হক: সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে,  গ্লোব লাইব্রেরী (প্রাইভেট) লিমিটেড, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল-২০১০

৯.      মমতাজুর রহমান তরফদার: হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪—১৫৩৮ একটি সামাজিক পর্যেষণা: অনুবাদ: মোকাদ্দেসুর রহমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা-২০০১,

১০.    মমতাজুর রহমান তরফদার: ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতা: বাংলা একাডেমী, ঢাকা-

১১.     ড. শ্যামাপ্রসাদ বসু: ওয়াহাবী থেকে খেলাফত: নবজাতক প্রকাশ, কলকাতা- দ্বিতীয় প্রকাশ-১৯৮২

১২.    আবদুল করিম: মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য: বাংলা একাডেমী, ঢাকা-১৯৯৪

১৩.    দেশ: সাহিত্য সংখ্যা: ১৩৯৭, কলকাতা।

মন্তব্যসমূহ