মক্কাঃ ক্বাবার অজানা ইতিহাস লেখক ; ABDULLAH IBN MAHMUD·



     মক্কাঃ ক্বাবার অজানা ইতিহাস


    ( সৌজন্য ;        ABDULLAH IBN MAHMUD·)


ক্বাবা। 

পৃথিবী জুড়ে মুসলিমদের কাছে পবিত্রতম স্থান। যার পেছনে আছে সহস্র বছরের ইতিহাস। 
কিন্তু এই ইতিহাসের বেশিরভাগই আসলে অনেক মানুষের কাছে অজানা। কেবল হজ বা ওমরা করতে এই পবিত্র তীর্থস্থানে যান মুসলিমরা, নবী মুহাম্মাদ (স) এর জন্মস্থান আর বেড়ে ওঠা এ শহরে- এটুকুই সবার সাধারণভাবে জানা। কিন্তু এই কাবা নিয়ে যে রক্তাক্ত অজানা ইতিহাস আছে সেটা অনেকে শুনলেই কেন যেন আঁতকে ওঠেন। এরকম পবিত্র স্থানেও কেউ রক্ত ঝরাতে পারে? 
বর্তমান সময়ের বিশ্বজুড়ে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রাণহানির পর পবিত্র জায়গাও যে অক্ষত থাকতে পারে এমনটা আশা করা অলীক মনে হয়। যুগে যুগে অনেকবারই কাবাতেও হয়েছে রক্তপাত। আজকে চলুন মক্কা বা কাবার ইতিহাস জেনে আসা যাক। হয়ত এর বেশিরভাগ আপনার অজানা। 





সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ হলেও মুসলিমদের কাছে পবিত্র নগরী দুটো হল মক্কা আর মদিনা। তৃতীয় পবিত্র নগরী ইজরাইলের জেরুজালেম।  
মক্কা মূলত পবিত্র কাবার শরিফের কারণেই পরিচিত। ক্বাবা শব্দের অর্থ ঘনক, কিউব। কালো ঘরটার ঘনক-আকৃতির কারণেই এই নাম। চার হাজার বছর আগে এই মক্কার আশপাশের অঞ্চল ছিল জনবিরল মরুভূমি।
ইসলামিক স্ক্রিপচারসমূহ অনুযায়ী, আনুমানিক প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২১৩০ সালের দিকে, ইহুদী খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের পিতা নবী আব্রাহাম/ইব্রাহিম (আ) স্ত্রী সারাহর চাপে পড়ে তাঁর পুত্র ইসমাইলকে তাঁর মা হাজেরা সহ এই মক্কার বিরান ভূমিতে রেখে আসেন। সেখানে অলৌকিক উপায়ে শিশু ইসমাইলের পদাঘাতে "জমজম" কূপ আবিষ্কৃত হয়। বিরান মরুর বুকে পানির সন্ধান পেয়ে ঐ এলাকায় লোক জড়ো হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এই জায়জায় লোকালয় গড়ে ওঠে। ইসমাইলের নামানুসারে এই জনগোষ্ঠীকে বলা হত ইস্মাইলাইট/ইসমাইলি। ইসমাইল তাদের কাছেই আরবি শেখেন, যেহেতু তাঁর মাতৃভাষা আরবি ছিল না। 

ইসমাইল বড় হবার পর ইব্রাহীম (আ) মক্কায় আসেন এবং আল্লাহ্‌র আদেশে এখানে কাবার নির্মাণ শুরু করেন পুত্রের সাথে। [মক্কার প্রাচীন নাম ছিল বাক্কা, আর মদিনার আগের নাম ইয়াসরিব।] কথিত আছে, কাবার প্রাথমিক স্ট্রাকচার নির্মাণ শেষে একজন ফেরেশতা তার কাছে অপার্থিব *সাদা* পাথর নিয়ে আসেন, যেটা কাছের আবু-কুবাইস পর্বতের উপর আকাশ থেকে পতিত হয়েছিল। সেটা কাবার পূর্ব কোণে স্থাপন করে দেয়া হল। কালের বিবর্তনে সেই সাদা পাথর কালো হতে থাকে, এবং এটা এখন ইসলাম ধর্মের খুব গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র বস্তু। সত্যি বলতে, বর্তমান ক্বাবাঘরে সেই আদি ক্বাবার কিছুই অবশিষ্ট নেই, কেবল দুটো পাথর ছাড়া। একটা হলো সেই পাথর যাকে হাজ্রে আসওয়াদ বলে। অর্থ, কালো পাথর। আরেকটা হল সেই পাথর যেটাতে ইব্রাহীম (আ) এর পায়ের ছাপ আছে, যেটার উপর দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ কাজ পরিচালনা করতেন বলে বর্ণিত। এটার নাম এখন "মাকামে ইব্রাহীম"। 



৬০৫ সালে নবী হবার ৫ বছর আগে মুহাম্মাদ (স) এই কালো পাথর নিয়ে একটা কোন্দল সমাধান করে দেন যখন আগুনে ক্বাবা পুড়ে যায়, এবং নিজের হাতে পুনস্থাপন করেন ক্বাবাতে। তবে এই কাহিনীর বিস্তারিত লিখা হবে অন্য এক নোটে ইনশাল্লাহ। 
এখন সেই কালো পাথর রুপালি ফ্রেমে আবদ্ধ করে ক্বাবার কোণে লাগানো আছে। এখান থেকে একটি দীর্ঘ লাইন মেঝেতে দাগ কাটা আছে অনেক দূর পর্যন্ত; এ লাইন থেকে শুরু করে একবার Anti-Clockwise ঘুরে আবার ঐ লাইনে আসা হলো একবার তাওয়াফ। এভাবে সাতবার তাওয়াফ করতে হয়। এটা হজের একটি অংশ। এবং হজ মৌসুম বাদে ওমরাতেও। 

মুসলিমরা বিশ্বাস করে, এই পাথরে চুমু খেলে পাপমোচন হয়। তাই এই পাথরের সামনে সবসময়ই জটলা থাকে, কিংবা থাকে লম্বা লাইন, সবাই চুমু খাওয়ার জন্য উদগ্রীব। [আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলা যায়। আমি যখন যাই তখন খুব ছোট ছিলাম, দুবার। একবার হজ আরেকবার ওমরাতে। হজে অবশ্যই পাথরের ধারে কাছেও যেতে পারিনি আমরা। কিন্তু ওমরাতে সুযোগ হয়েছিল। সে সময়ও প্রচণ্ড ভীড় ছিল, কিন্তু একজন আমাদের জানায় যে, দিনে চারবার ঐ পাথরটা ধোয়া হয়, তখন উপরে থেকে একটা রশি সার্কেল করে ফেলা হয়, ঐ রশির মধ্যে যারা পড়ে যায় তারা চুমু খেলে পরে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না, তখন পরিস্কার করা হয় পানি দিয়ে। বলতে না বলতেই রশি ফেলার টাইম হয়ে যায়। এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই এই রশির ভিতরে আমরা পড়ে যাই। ফলে চুমু খাবার সুযোগ হয়।]



ক্বাবার এই কালো পাথরের অরিজিন নিয়ে ননমুসলিমরা যে গবেষণা করে নি তা না, কেউ বলেছেন এটা বিরল প্রজাতির পাথর, কেউ বলেছেন উল্কাপিণ্ড। কিন্তু এই পাথরের পানিতে ভাসতে পারা বৈশিষ্ট্য এরকম অনেক হাইপোথিসিস বাতিল করে দিয়েছে। এখনও এটার অরিজিন শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। কেউ কেউ আরবের আটলান্টিস বলে পরিচিত বালির নিচে ডুবে থাকা মিথিকাল ইরাম নগরীর সাথে এই পাথরের সম্পর্ক খুঁজতে চেয়েছেন। ইরাম নগরীর মিথ নিয়ে অন্য কোন নোটে আলোচনা করা যাবে, বাই দা ওয়ে।

প্রাচীনকালে বনী ইস্রাঈলের লোকেরাও হুবহু এভাবে সার্কুলেট করে জেরুজালেমে তাওাফ করত বলে ইহুদী স্কলাররা বলেছেন। 

"হারাম" শব্দের অর্থ "অবৈধ" এবং "পবিত্র" দুটোই হয়। পবিত্র অর্থে মসজিদুল হারাম অর্থ পবিত্র মসজিদ। আবার অন্য অর্থে, এখানে যুদ্ধ আর রক্তপাত নিষিদ্ধ বিধায় একে মসজিদুল হারাম বলে। মক্কা বিজয়ের সময় কয়েকজন অপরাধী এ কারণে মসজিদুল হারামে লুকিয়ে পড়েছিল বলে জানা যায়, কারণ সেখানে কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না, নিষিদ্ধ।

ক্বাবাকে অনেক নামেই কুরআন হাদিসে ডাকা হয়েছে, বাইতুল হারাম (Sacred House), বাইতুল্লাহ (House of Allah), বাইতাল আতিক্ব (Ancient House) এবং আওাল উল বাইত (First House)। এর দিকে ফিরেই মুসলিমরা নামাজ পড়ে ("কিবলা"), তবে এর আগে জেরুজালেমের পবিত্র ঘরের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা হত। ক্বাবা সম্পর্কে কিছু মিথ প্রচলিত ছিল যে, ক্বাবার উপর দিয়ে কোন পাখি বা কিছুই উড়ে যেতে পারে না, কিংবা, ক্বাবা পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত, কিংবা, ক্বাবা বরাবর সোজা আকাশেই স্বর্গদ্বার। 
ইসমাইল এর সময় সেখানে একত্ববাদ প্রচলিত থাকলেও কালক্রমে মক্কার মানুষেরা মূর্তিপূজা শুরু করে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ (স) এর জন্মের সময় সেখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল। পরে ইব্রাহীম/ইসমাইল (আ) এর অনুসরণ করা একত্ববাদ ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় ৬২৯ সালে মুহাম্মাদ (স) সেসকল মূর্তি অপসারণ করেন। এবং ইসমাইল (আ) এর আমল থেকে চলে আসা হজপ্রথা বহাল রাখা হয়। এজন্য অনেকে এটা প্যাগান প্রথা মনে করলেও, আসলে এর অরিজিন ছিল আরো আগে।
উত্তর আরবের নাবতীয়দের দেবতা হুবাল, উজ্জা এরা জায়গা পায় মক্কার ক্বাবাতে, এবং এক পর্যায়ে মক্কাবাসীদের প্রধান দেবতা হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো ক্বাবাকে কিংবা কালো পাথরকে নারীত্বের উর্বরতার প্রতীক অর্থেই দেখা হত বলে কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, প্রাচীন কিছু বায়োগ্রাফিতে ক্বাবাকে ব্যাকরণে স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে রেফার করা হয়। তাছাড়া প্রাচীন আরবের Fertility Rite (নারী বা পুরুষের উর্বরতা নিশ্চিত করতে যে উপাসনা/rituals করা হত) খুবই প্রচলিত ছিল। যৌনতা যে আরব সমাজের একটা বড় অংশ ছিল সেটা বলতে অপেক্ষা রাখে না। এরকম একটা Fertility Rite ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করা। বিশ্বাস করা হত, এতে নারীদের সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা আর পুরুষদের সক্ষমতা আরো বাড়বে।    
তবে, দূর দূরান্ত থেকে সকল ধর্মের মানুষ ক্বাবা প্রদক্ষিণ করতে আসত। এই প্রথা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, এখনও আছে। আর যেহেতু মক্কায় রক্তপাত নিষিদ্ধ বলে একটা অলিখিত নিয়ম ছিলই, তাই বিনা দাঙ্গায় ব্যবসা করার জন্য খুব আদর্শ জায়গা ছিল সেটা। আর হজের মৌসুমে আগতদের সাথে ব্যবসা করে ফুলে ফেপে ধনী হয়ে যেত মক্কার ব্যবসায়ীরা। 


মুহাম্মাদ (স) এর মৃত্যুর পর অনেকবার ক্বাবা পুনর্নির্মাণ হয়। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্বাবা আক্রমণের মত ঘৃণ্য কারণে। এখন সেই ক্বাবা নিগ্রহের ইতিহাস শুরু করা যাক।

First Siege of Mecca (683)

খলিফার পদ নিয়ে যুদ্ধের ফসল্ল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্বাবা। ৬৮৩ সালে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ সম্ভাব্য বিদ্রোহ/গৃহযুদ্ধ দমন করতে আরবে সৈন্য পাঠায়। মদিনা দখল করে মদিনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সেই আর্মি। কিন্তু মক্কাবাসীরা আত্মসমর্পণ করেনি। এক বাস Siege করে রাখা হয় মক্কা। এ সময়টাতেই আগুনে ক্বাবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াজিদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর Siege শেষ হয়ে যায়। মক্কাতে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর, যিনি ছিলেন পরবর্তী সম্ভাব্য খলিফা। 

ইবনে জুবাইর ক্ষতিগ্রস্ত ক্বাবা পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না, এই ভয়ে যে, যে ক্বাবা ভাঙতে এগিয়ে আসবে তাঁর উপর আসমানি গজব পড়বে। একজন সাহস করে একটা পাথর ছুড়ে মারল। কিন্তু তাঁর উপর কোন গজব আসল না। এটা দেখে বাকিরা সাহস পেয়ে ভাঙ্গা শুরু করল। একদম পুরোপুরি মিশিয়ে দেবার পর আবার গোড়া থেকে বানানো শুরু হলো। তবে এবার আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর নবী (স) এর কাছ থেকে শোনা একটা হাদিসের ভিত্তিতে ক্বাবার পরিধি বারিয়ে হাতিম জায়গাটাকে অন্তর্ভুক্ত করলেন, ফলে জায়গা অনেক বেড়ে গেল, দেখতে আর কিউব রইল না। এটা ছিল ইব্রাহিমের বানানো ফাউন্ডেশনের মত। 
কালো পাথর টুকরা টুকরা হয়ে যায় এই আক্রমণে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর একটা রুপার লিগামেন্ট ব্যবহার করে সেগুলো জোড়া লাগান। 

Second Siege of Mecca (692)

উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তখন জেনেরাল হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠান সেই মক্কার শাসক আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরকে পরাজিত করে খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী নিশ্চিহ্ন করতে। খুব নৃশংস এই মক্কার Siege স্থায়ী হয় ছয় মাস! আব্দুল্লাহ মারা যাবার পর Siege শেষ হয়। আব্দুল্লাহর দুই পুত্র ক্বাবার পাশেই লড়াইরত অবস্থায় মারা যান। এই আক্রমণের সময় পাথর নিক্ষেপ করে ক্বাবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
এরপর আব্দুল মালিক ক্বাবা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের বানানো অতিরিক্ত অংশ ধ্বংস করে ক্বাবার অরিজিনাল কিউব আকৃতি ফিরিয়ে আনেন। অরিজিনাল বলতে কুরাইশদের অরিজিনাল কিউব ফাউন্ডেশন। 



Qarmatian Attack (930)

কার্মাতিয় সম্প্রদায়ের ধর্ম ছিল একটা মিশ্র ধর্ম, মূল শিয়াদের থেকে ভ্রষ্ট ইসমাইলি গ্রুপ আর পারস্যের কিছু আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে গড়ে ওঠে তাদের ধর্ম। তারা ৮৯৯ সালে পূর্ব আরবে একটি ধর্মীয় স্বাধীন সরকার ঘোষণা করে। এরা আব্বাসিয় খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। 
৯৩০ সালের হজের সময় কার্মাতীয়রা মক্কায় সন্ত্রাসী আক্রমণ করে। হজ করতে আসাদের খুন করে লাশ জমজম কুপে ফেলে দেয়। এরপর কালো পাথর চুরি করে নিয়ে যায়। 

সেখানে তারা একটা উপাসনালয় বানায় ("মসজিদ আল দিরার") যেখানে কালো পাথর স্থাপন করা হয়। এর মূল হোতা ছিল তাদের নেতা আবু তাহির। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মক্কা থেকে হজ বাতিল করা। কিন্তু সফল হয়নি। হজ চলতে থাকে কালো পাথর ছাড়াই।
২৩ বছর পর, ৯৫২ সালে আব্বসীয় খলিফা বিশাল টাকা দিয়ে সেই পাথর ফিরিয়ে আনেন। যে কার্মাতীয় ফিরিয়ে দিয়ে যায়, সে কুফা-র এক মসজিদে শুক্রবার দিন ছুড়ে মেরে যায় পাথরটা বস্তাবনদি করে। সাথে একটা চিরকুট, "ক্ষমতা দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, ক্ষমতা দেখিয়েই ফেরত দিলাম আমরা।" 

এই ছুঁড়ে মারাতে সাত টুকরা হয়ে যায় পাথর। বলা হয়, আবু তাহিরের মৃত্যু হয় শোচনীয়তম, তাঁর দেহ পোকায় খেয়ে নেয় যেই রোগ তাঁর হয়েছিল।
একাদশ শতকে ফাতিমিয় খলিফা আল হাকিম এর পাঠানো এক লোক ক্বাবার সামনে এসে কালো পাথর ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর আগেই সে মারা পড়ে। 
এই পাথরের প্রতি এত ক্ষোভের কারণ বোধগম্য না।  

১৬২৯ সালের বন্যা

প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ১৬২৯ সালে বন্যা হয়ে যায় মক্কায়, তখন ক্বাবার দেয়াল ধ্বসে যায়। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে ক্বাবা বানানো হয়। ওসমানি সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন মসজিদ পুরাটা সুন্দর করে আবার বানানো হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই একই বেসিক স্ট্রাকচার আছে। 

Grand Mosque seizure (1979)

এটা ছিল সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা। এবং খুবই কনফিউজিং। এ ঘটনাটা বুঝতে হলে আগে কিছু ব্যাকস্টোরি জানা লাগবে...
ইসলামে বর্ণিত কিছু ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, শেষ সময়ের দিকে মুসলিম জাতিকে ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্ব দিতে আবির্ভাব হবেন মুহাম্মাদ নামের এক ব্যক্তির, যাকে বলা হবে ইমাম মাহদি (ইমাম=নেতা, মাহদি=The Guided One)

কোন এক হজের সময় তাওাফ এর সময় মানুষ তাকে চিনে ফেলবে, এবং তাকে জোর করেই জাতির নেতা বানিয়ে দেবে। এ ঘটনার পরেই ঈসা (আ) বা যীশু খ্রিস্ট পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন।

এবার ফিরে আসা যাক ১৯৭৯ সালের ঘটনায়। নভেম্বর ডিসেম্বরের ঘটনা। 

ঘটনার হোতা ছিল জুহাইমান আল-ওতাইবি। নাজদের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। সে হঠাত করেই তাঁর শালা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-কাহতানিকে ঘোষণা করে বসে ইমাম মাহদি হিসেবে!

বলা হলো, এই লোকের নাম মুহাম্মাদ, বাবার নাম আব্দুল্লাহ, ঠিক যেমনটা নবী মুহাম্মাদ (স) এর ছিল। আরও বলা হল, তিনি মক্কার উত্তর থেকে এসেছেন। আর দিনটা ছিল, ২০ নভেম্বর, ১৯৭৯, হিজরি ১৪০০ সালের প্রথম দিন! কোন এক বর্ণনা মতে, এই শতকে একজন ধর্ম সংস্কারক আসবেন। দাবি করা হলো, ইনিই তিনি। 
জুহাইমান এর সাথে কাহতানির দেখা হয় এক জেলে বন্দী থাকা অবস্থায়। জুহাইমান বলল, আল্লাহ্‌ তো আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন তুমি হলে মাহদি। এরপর শুরু হয় ব্রেইনওয়াশ করা। এক পর্যায়ে কাহতানি নিজেই বিশ্বাস করা শুরু করে সে মাহদি। [নাকি করত না?]
তারা পরিকল্পনা করল, সাউদ পরিবারকে হটিয়ে নতুন শাসনতন্ত্র কায়েম করবে। তারা তাদের প্ল্যান মাফিক প্রচার করা শুরু করল, খুব এক্সট্রিম কিছু বিশ্বাস, মসজিদে মসজিদে প্রচার করলেও তখন তারা ধরা পড়ে নি। মাস্টারমাইন্ড জুহাইমান যোগদান করে একটা মদিনার স্থানীয় সালাফি গ্রুপে, যার নেতৃত্বে ছিলেন  প্রখ্যাত শেখ এবং শিক্ষক আব্দুল আজিজ বিন বাজ, ফতোয়া কমিটির প্রধান। সরকার তেমন পাত্তা দেয়নি। তারা একবার ধরা পড়েছিল বটে, কিন্তু ফাঁক ফোকরে ছাড়া পড়ে যায়, সেই ১৯৭৮ সালে। তারা অনেক পরিমানে অনুসারী যোগাড় করে ফেলে।


Juhayman al-Otaybi in captivity

অনেক ধনী মানুষের কাছ থেকে ডোনেশন পাওয়ায়, এই গ্রুপটা খুবই সশস্ত্র আর প্রশিক্ষিত ছিল। জুহাইমান নিজেই ছিল প্রাক্তন আর্মি সদস্য। তারা প্রচুর অস্ত্র, গুলি, গ্যাস মাস্ক আর খাবার দাবার নিয়ে জমিয়ে রাখে নতুন বছরের এক সপ্তাহ আগে থেকে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মসজিদের নিচের শত শত ছোট্ট রুমে। 
২০ নম্ভেম্বর ফজরের সময়, ইমাম মুহাম্মাদ আল সুবাইল নামাজের ইমামতি করবেন। ৫০ হাজার মানুষ সেখানে। ঠিক তখন আলখাল্লার নিচ থেকে অস্ত্র বের করে সন্ত্রাসীরা। বেশ কটি গুলি করে।

ইমাম থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে জুহাইমান বর্তমান সৌদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে বলা শুরু করল। এরপর কিছু হাদিস আর ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়ে "ইমাম মাহদি"কে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর বলে সবাইকে এখন তাঁর অনুগত হতে হবে। [এখানেই গলদ ছিল তাঁর, ভবিষ্যৎবাণী মাফিক ইমাম মাহদি রাজি হবার কথা না নেতৃত্ব নিতে, কিন্তু এক্ষেত্রে সে নিজেই রাজি।]
গেট আটকে দেয় সন্ত্রাসীরা। দুই পুলিশকে খুন করে। পুলিশের কাছে কেবল ছিল দুটো কাঠের বেত। আর কিছুই না। আর সন্ত্রাসীরা ছিল প্রায় ৪০০-৫০০ জন! মহিলা সদস্যাও ছিল!
তখন বিন লাদেন গ্রুপের দ্বারা মসজিদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছিল। বিন লাদেন গ্রুপের একজন এই কাহিনী দেখে ফোন করে বাইরে জানিয়ে দেয়, ঠিক এরপরই সন্ত্রাসীরা কেটে দেয় টেলিফোন তার। কিন্তু বিশ্ব জেনে যায় কিছু একটা হচ্ছে। 

সন্ত্রাসীরা অনেক হোস্টেজ ছেড়ে দেয় বটে, কিন্তু অনেককে আটকে রাখে। মসজিদের উপরে ডিফেন্সিভ পজিশনে চলে যায় তারা, মিনারে মিনারে স্নাইপার রাখে। আর বাকি সবাই আশ্রয় নেয় আন্ডারগ্রাউণ্ডে। বাইরের কেউ জানত না ভেতরে কয়জন হোস্টেজ। কেউ জানত না ভিতরে কী হচ্ছে, কেমন ক্ষয়ক্ষতি। এরা কারা, কী চায়, কী করবে। 

প্রিন্স ফাহাদ তখন তিউনিসিয়াতে মিটিং এ তছিলেন, আর ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ ছিলেন মরক্কো। তাই কিং খালিদ এই মিশনের দায়িত্ব দিলেন প্রিন্স সুলতানের উপর, যিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। এবং প্রিন্স নায়েফ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। 

একশো পুলিশ মসজিদ রিটেক করতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রচুর প্রাণ হারায়। পড়ে সৌদি আর্মি আর ন্যাশনাল গার্ড জয়েন করে তাদের সাথে। রাতের মধ্যে পুরো মক্কা খালি করে ফেলা হয়! শুন্য মক্কা নগরী। 

এখানে এসে ধর্মীয় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যতটুকু বাইরে খবর গেছে, তা থেকে ফতোয়া কমিটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল, এটা কি আসলেই ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাচ্ছে? নাকি বানোয়াট? অনেক কিছুই মিলছে, আবার মিলছেও না। তাছাড়া হারাম শরিফে রক্তপাতের আদেশ কি দেয়া উচিৎ হবে? ইত্যাদি... [উল্লেখ্য, এমনকি সাধারণ অবস্থায় গাছও উপড়ে ফেলা যায় না মক্কাতে, গাছের প্রাণ নিধনও হারাম।] 

ফতোয়া কমিটির প্রধান ইবনে বাজ এর কথা একটু আগে বললাম। তিনি অবাক হলেন যে তারই ছাত্র এ কাজ করছে! তিনি এজন্য আরো সংশয়ে পড়ে যান এসব কী হচ্ছে!

যে ইমাম নামাজ পড়িয়েছিলেন, তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলেন এরা যে সন্ত্রাসী গ্রুপ। তিনি কায়দা করে নারী পোশাক পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন হারাম শরীফ থেকে। এরপর পুরো ব্যাপার বুঝিয়ে বলেন। 

শেষ পর্যন্ত অবশ্য, আর্মিকে গোলাগুলিতে অনুমতি আর নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত আর্মি ছিল দোটানায়, তারাও জানে, ভবিষ্যৎবাণী মাফিক, ইমাম মাহদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর্মি ধ্বসে মারা যাবে। 

আর্মি গেট ভেঙে ভেতরে চলে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু একজন একজন করে মারা পড়তে থাকে স্নাইপারের গুলিতে। লাউডস্পিকারে সন্ত্রাসীরা দাবি জানায়, আমেরিকাকে তেল সাপোর্ট আর দেয়া যাবে না, বাইরের রাষ্ট্রের আর্মি বহিষ্কার করতে হবে- ইত্যাদি। 

কিছু না পেরে, সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিল, সন্ত্রাসীদের ভাতে মারবে। কিন্তু বুঝা গেল, তারা প্রচুর খেজুর নিয়ে ঢুকেছে, আর জমজম কূপ থাকায় পানিরও সমস্যা নাই তাদের। 
তারপরেও কয়েকবার আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল দিয়ে মিশনের চেষ্টা করা হয়। 
লুকিয়ে থাকা জায়গায় জায়গায় গ্রেনেড মেরে মেরে সন্ত্রাসীদের খোলা জায়গায় আনা হয়। 


Saudi soldiers fighting their way into the Ka'aba Underground beneath the Grand Mosque of Mecca, 1979

এরপর সকল পানির পাইপ খুলে দেয় যেন ক্বাবার ভেতরে বন্যার মতন হয়ে যায়। ফলে সন্ত্রাসীরা সিক্ত অবস্থায় পানিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর পুরো পানিকে ইলেক্ট্রিফাই করে ফেলা হয়। বাকি যারা রইল তাদেরকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে কাবু করা হয়। 

দুই সপ্তাহ শেষে, তারা সকলে আত্মসমর্পণ করে। দুই সপ্তাহ হারাম শরিফে কোন নামাজ হয়নি, মক্কা ছিল ফাঁকা।

মারা যায় ২৫৫ জন আর ৫৬০ জন আহত। মিলিটারি থেকে মারা যায় ১২৭ জন আর ৪৫১ জন আহত। এ ঘটনার পুরেই মূলত বর্তমান সৌদি স্টেটের আইন এখনকার মতো অবস্থায় আসে। এর আগে ছিল শিথিল।

খবর ছড়িয়ে যাবার পর ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এটাকে ইহুদী নাসারার চক্রান্ত বলে দাবি করেন, "সন্দেহ নেই, এটা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকান ক্রিমিনাল আর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদিদের ষড়যন্ত্র।"

 ফলে সারা বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে আমেরিকাবিদ্বেষ গড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানের ইউ এস এমব্যাসি পুড়িয়ে দেয়া হয়। লিবিয়ার ত্রিপোলিতেও ইউ এস এম্ব্যাসি ভেঙে পুড়িয়ে দেয়। 

তথাকথিত ইমাম মাহদি সেই ঘটনাতে নিহত হয়। মাস্টারমাইন্ড জুহাইমান আর তাঁর ৬৭ ফলোয়ার আরেস্ট হয়। তাদেরকে পড়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মারা যাবার আগে জুহাইমিনকে জিজ্ঞেস করা হয়, সে কেন এটা করল। সে বলেছিল, এটা করেছিল যেন, একটা ভবিষ্যৎবাণী সে ফলাতে পারলে, বাকিগুলাও ঘটতে শুরু করবে। 
এটা ছিল হারাম শরিফে ঘটানো সবচেয়ে বড় টেররিস্ট অ্যাটাক। এখন পর্যন্ত।




1987 Mecca incident  

এটা কোন আক্রমণ না। সংঘর্ষ। 

৩১ জুলাই ১৯৮৭ তারিখে ইরানি হাজিরা সেখানে ইজরায়েল আমেরিকা বিরোধী একটা বার্ষিক ডেমনস্ট্রেশন করছিল। কিন্তু সৌদি পুলিশ আর ন্যাশনাল গার্ড বাধা দেয়। এটা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এরপর Stampede শুরু হয়ে যায়। চাপা পড়ে মারা যায় নাকি পুলিশের হাতে মারা যায় সেটা নিয়ে ইরান আর সৌদির মধ্যে সবসময়ই লেগে যায়, কিন্তু প্রাণহানি হয় ২৭৫ ইরানি হাজির, ৮৫ পুলিশ আর অন্য দেশের ৪২ হাজির। এটা শিয়া হাজি বনাম সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ নামে পরিচিত।   


অনেক রক্তারক্তির কাহিনী শেষে ভিন্ন কিছু একটা দিয়ে নোটটা শেষ করি। 

বছরে দুবার ক্বাবার চাবি খোলা হয় ভেতরটা ধোবার জন্য। ক্বাবার ভিতরে যেকোনো দিকে ফিরে নামাজ পড়া যায়। এই দুবার হলো, রমজান শুরুর এক মাস আগে, আর কুরবানির ঈদের এক মাস আগে। ট্র্যাডিশন মাফিক, ক্বাবার চাবি থাকে বনি শায়বা গোত্রের কাছে। মক্কার গভর্নর সাধারণ একটা ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করার কাজ শুরু করেন, এবং তাঁর আমন্ত্রণে গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এ কাজে অংশ নেন। জমজম পানির, তাইফের গোলাপজল আর ঊদ সুগন্ধি তেলের সংমিশ্রণ দিয়ে ভেতরটা পরিষ্কার করা হয়। 



যাই হোক, যে হারে আক্রমণ চলছে, এরকম তীর্থস্থানগুলো কতদিন নিরাপদ থাকবে সেটাই দেখার বিষয়। :

মন্তব্যসমূহ