ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখতে করণীয়
           
ডাঃ শাহজাদা সেলিম

সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

  (সৌজন্য;জনকণ্ঠ )


পৃথিবীতে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান আছে যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬%। বর্তমানে পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন। ২০৪০ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৪২ মিলিয়ন-এ। এর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মানুষরা রোজা রাখে সাধারণত। পৃথিবীর মোট প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের ৩৬% ডায়াবেটিসে ভুগছে। সে হিসেবে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি রমজান মাসে ৯-১২ কোটি ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ৪৩% এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭৯% রমজান মাসে রোজা রাখে। রোজার সময় একজন মানুষকে ভোররাত হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুম ভেদে এ সময়কাল ১৪ ঘণ্টা থেকে শুরু“করে সর্বোচ্চ ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা হতে পারে। এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিস রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কী না তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর হবে। কুরআন শরীফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে (সুরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫) আর অন্য যে কোন ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিস রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। কোন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডায়াবেটিস রোগীকে রোজা রাখার পরামর্শ দেবেন না। কিন্তু কোন ডায়বেটিস রোগী যদি ধর্মীয় প্রচ- আগ্রহের কারণে রোজা রাখতে চান তবে তাকে নিষেধ করাও কারও পক্ষে সম্ভব না। এখানে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার কারণে যে সব সমস্যা হতে পারে এবং তা থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।

রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিস

রোগীর ঝুঁকিসমূহ

* রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

* রক্তে গ্লুুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)

* ডায়াবেটিস কিটোএ্যাসিডোসিস

* পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম

ব্যবস্থাপনা

ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং তার চিকিৎসকের জন্যও তা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রেখে কম বেশি ঝুঁকির আওতায় চলে আসেন।

এ ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়সমূহ হলো-

* প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্রসহ বিবেচনা করতে হবে।

* ঘন ঘন রক্তের গুøকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন বেশ ক’বার (কমপক্ষে তিনবার) রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে।

* প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা যায় ২০%-২৫% ডায়াবেটিস রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা এসব হজম হতে সময় লাগবে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ইফতারের পর পরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহরির সময় খেতে হবে। আর ইফতারিতে সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক পূর্বে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্ছনীয়।

* শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকা- চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভাল। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকেল বেলায় তো করা যাবেই না। আর তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিস রোগী (বিশেষত টাইপ-১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিকমতো রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়ই মারাত্মক হয়।

* প্রতিটি ডায়াবেটিস রোজাদারকে এ কথাটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোন লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তারপর যতটা সম্ভব দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোন খাদ্য/সরবত ইত্যাদি যে কোন একটি খেয়ে নিতে হবে। যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা তো খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবে। আর যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক ধড়ফরানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দেবে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হয়েছে ধরে নিতে হবে। আবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেয়া জরুরী। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইন ইউরিয়া মেগ্লিটিনইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশি। আবার রক্তের গ্লুকোজ ১৬৭ মিলিমোল/লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।

প্রাক রমজান মূল্যায়ন

যেসব ডায়াবেটিস রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজা শুরুর কমপক্ষে ১ মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার কিডনি ও হৃদপিন্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা, এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

সকলকেই তার নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসগণ এক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবেন।

বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন

* ডায়াবেটিস রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন। তবে ৩ মাস আগে থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুতি নিতে হবে।

* রোজার সময় নিজে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।

* সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের কিছু আগে খাওয়া উচিত। ইফতারের সময় বেশি চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।

* রোজার সময় দিনের বেলায় অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।

* রোজার সময় রাতের বেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি (সম্ভব হলে ডাবের জল), কম মিষ্টি রসালো ফল এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।

মন্তব্যসমূহ