ব্যক্তি, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সভ্যতার প্রাথমিক যুগে রাষ্ট্র সম্পর্কে মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল সে সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক।
গৌতম বুদ্ধ মহাজ্ঞান লাভের আগেই অনুভব করেছিলেন যে, ব্যক্তিসত্তা
বিকাশের পথে রাষ্ট্র একটি দূরতিক্রম্য বাধা, একটি জটিল বন্ধন ও একটি অনাসৃষ্টি। একটি সূত্রে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে
বাধাগ্রস্ত করে ক্রমে তাকে এর আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করা। গৌতম বুদ্ধ আরও উপলব্ধি করেন যে, মুক্ত মানুষকে অধীন করতে গিয়ে রাজা নিজেও অবশেষে পরিণত হয় আরেক ধরনের অধীন সত্তায়। রাষ্ট্রসত্তার
গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যেই গৌতম এক রাতে রাজ্য, স্ত্রী ও সন্তান পেছনে ফেলে বেরিয়ে পড়লেন মুক্তির সন্ধানে, সত্যের সন্ধানে।
মুক্ত জীবন ও সাধনার মাধ্যমে তিনি লাভ করেন আমাদের উদ্দেশ্য এখানে বুদ্ধের মহাজ্ঞানের সন্ধান নয়, বরং ইতিহাস থেকে কিছু উপাত্ত-উপমা তুলে ধরে যুক্তি প্রদান করা যে, ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে রাষ্ট্রসত্তার
বিরোধ চিরকালের।
সব ব্যক্তি মিলে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র তৈরি করেছে- এটা তত্ত্বের কথা, ইতিহাসে তা আদৌ ছিল কিনা তা বলা শক্ত। তবে ব্যক্তি সামষ্টিকভাবে
সতর্ক না হলে রাষ্ট্রের অধীনে সবাই যে এক সত্তাহীন খড়কুটোয় পরিণত হতে পারে তা উপলব্ধি একাধিক মহাজ্ঞানী করেছেন।
নিজের ব্যক্তিসত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র থেকে দূরত্ব বজায় রাখা বুদ্ধির কাজ বলে মনে করেছিলেন চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস। তার মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠা এমন একটি অস্তিত্ব যার প্রধান কাজ রাজ্যের মানুষকে বিবেক বুদ্ধি থেকে বের করে এনে তার আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস বানানো। অতএব, তিনি উপদেশ দেন যে, আপন স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য বুদ্ধিমানদের উচিত রাষ্ট্র থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সত্তা তৈরি করা।
জেরেমি বেনথাম, স্টুয়ার্ট মিল, হেনরি মেইন প্রমুখ রাজনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তার মধ্যে বারে বারে ফিরে এসেছে বৌদ্ধ ও কনফুসিয়াস-এর রাজনৈতিক দর্শন। জা পল সার্ত-এর অস্তিত্ববাদ বুদ্ধ ও কনফুসিয়াস-এর চিন্তাধারাকে
স্মরণ করিয়ে দেয়। সার্ত-এর মতে, ব্যক্তি একটি আদি ও স্বাধীনসত্তা, যা রাষ্ট্র বিনষ্ট করতে সব সময়ই তৎপর। তার মতে, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান বিরোধ এখানেই যে, রাষ্ট্রসত্তার প্রবণতা হচ্ছে ব্যক্তিসত্তাকে করায়ত্ত করা, ব্যক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এবং মিথ্যা দেশপ্রেম সৃষ্টি করে মানুষের অধিকার হরণ করা। তার মতে, রাষ্ট্র যত বড়,
ব্যক্তি তত ছোট।
প্রাচীন যুগে, জনপদের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই
অর্থাৎ আপন নিরাপত্তাবোধ
থেকেই সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সমাজ আগে, না রাষ্ট্র আগে এ প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র, কেননা সমাজেরই ভিন্ন রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র। সমাজের আদি কাঠামো অর্থাৎ আদিম স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্র।
রাষ্ট্র সৃষ্টির ব্যাপারে সমাজ উদ্যোগ নিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে মেলে না। বরং প্রমাণ আছে যে, রাষ্ট্র গঠনে সমাজসত্তা কোথাও কোথাও প্রতিরোধ রচনা করেছে, যদিও সে প্রতিরোধ কখনোই ফলপ্রসূ হয়নি। রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ ব্যর্থ হওয়ার একটি প্রধান কারণ হয়তো ধর্ম।
বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, সমাজ রাষ্ট্রের আগে ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়। যেহেতু ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয় সত্তাই সমাজের উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু প্রাথমিক পর্বে রাষ্ট্রের উত্থানকে ধর্ম একটি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে। অনুরূপভাবে রাজাও রাজধর্মের বাইরে অন্য ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করেছে। প্রাচীন ধর্ম পুস্তকগুলোতে
সমকালীন ধর্ম ও রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রচুর কাহিনী পাওয়া যায়। যেমন ফারাও রাজার বিরুদ্ধে ধর্মনেতা মুসা (আঃ)-এর প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করেন।
রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে ধর্মের বিরোধিতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিব্রু জাতির প্রতি ঈশ্বরের হুঁশিয়ারি। ব্যাবিলনিয়ার এক অঞ্চলের হিব্রুরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে ঈশ্বর এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। ওল্ড টেস্টামেন্টে (১ স্যামুয়েল ৮ : ১৭-১৮) উল্লেখ আছে যে, হিব্রুরা প্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন সমাজ বদল করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হলে ঈশ্বর ঐশীবাণীর মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ঈশ্বর বলেন, 'রাষ্ট্র গঠন করলে রাজা তোমাদের এক-দশমাংশ মেষ হাতিয়ে নেবে এবং তোমাদের শেষ পর্যন্ত দাসে পরিণত করবে। তখন হতাশ হয়ে তোমরা যখন আমার সাহায্য চাইবে, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব না।'তবে আন্দাজ করা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সর্বত্র শুরু হয়।
এ সময়ে সামাজিক স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যেমন, পারস্যের রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট (খ্রি. পূ. ৫৯০-৫২৯ অব্দ) ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার প্রদান করে একটি অলঙ্ঘনীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন। তারই সমকালীন রোমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও ব্যক্তিস্বাধীনতার
বিধান রাখা হয়, যদিও সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ ছিল কেবলই রোমান অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। সুমেরীয় অঞ্চলের লাগাস নামক নগর-রাষ্ট্রের নেতা উরুকাগিনা ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে আমরা সর্বপ্রথম উরুকাগিনার মুখেই শুনি 'আমা-গী' বা নাগরিক অধিকারের কথা।
পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসের তথ্যানুসারে উরুকাগিনাই মানব জাতির প্রথম দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক যিনি মানবাধিকার নিয়ে চিন্তা করেন এবং নিজ রাজ্যে তা প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হন। ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবী (খ্রি. পূ. ১৭৯২-১৭৫০ অব্দ) নারী-পুরুষ সব মানুষের সমান অধিকার এবং অর্থনৈতিক সাম্য ঘোষণা দিয়ে রাজ্যের একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করেন যার পবিত্রতা রক্ষার জন্য তিনি দলিলটি রাজ্যের প্রধান মন্দিরের দেয়ালে খচিত করেন।
এসব
দৃষ্টান্ত থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি যে, মানুষ তার আদি ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা হারাতে শুরু করেছে খ্রি. পূ. পাঁচ শতক থেকে। এ সময়ে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক কারণে সব রাজাকেই কোনো না কোনো ধর্মের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আবার বিদ্যমান ধর্মগুলোকেও দেখা যায় রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে আতাত করতে।এ প্রক্রিয়ায় ধর্ম ও রাষ্ট্র এক সময়ে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিকশিত হয় এবং ধর্ম দ্বারা সমর্থিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাশীল হয়ে উঠে।
এ চিত্র ভূমধ্যসাগরীয়
ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের চিত্র। এ সময়ে ভারতে কিভাবে রাষ্ট্র বিকশিত হলো তা দেখা দরকার। ভারতে জনপদ থেকে রাষ্ট্র নির্মাণপ্রক্রিয়া একটু ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। আরসি মজুমদার, হেনরি মেইন ও মেকক্রিনডিল মনে করেন যে, স্বাধীন গ্রাম সম্প্রদায়গুলো চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রি. পূ. ৩২১-২৯৭ অব্দ) ও তার উত্তরসূরি সম্রাট অশোক (খ্রি. পূ. ২৬৫-২৩৮ অব্দ), উভয় শাসকের আমলে প্রথম রাষ্ট্রাধীনে আসে। উভয় রাষ্ট্রনেতা মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। উভয় শাসকের নীতি ছিল কল্যাণমুখী। দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের প্রতি তাদের ছিল পরম শ্রদ্ধাবোধ।
দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ
চাণক্য (আরেক নাম কৌটিল্য) ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের
প্রধান উপদেষ্টা। চাণক্যের তত্ত্ব ছিল এই যে, রাজা হবেন কল্যাণমুখী। তার তত্ত্ব মতে, প্রজার প্রতি রাজার দায়িত্ব পালন শর্তেই তিনি রাজা। তার পবিত্র দায়িত্ব এবং সর্বপ্রথম ও সর্ব প্রধান দায়িত্ব প্রজা পালন। চাণক্যের রাষ্ট্রচিন্তা তার অর্থশাস্ত্রে
পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন যে, প্রজাকুলের ওপর রাজার কোনো ক্ষমতা নেই, আছে শুধু দায়িত্ব, সবার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব, দুর্বল অসহায় মানুষকে ভরণপোষণের দায়িত্ব। রাজার দণ্ড আইনের লক্ষ্য হবে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। রাজা তার দণ্ড আইন প্রয়োগ করবেন শুধু তস্কর ও কণ্টকদের বিরুদ্ধে, যারা সমাজের সাম্য ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে।চন্দ্রগুপ্তের মতো সম্রাট অশোকও চাণক্যের চিন্তাধারা অনুসরণ করেন। অশোকের শিলালিপিতে খোদাইকৃত নির্দেশাবলি
থেকে জানা যায় যে, তিনি মনে করেন রাজা হিসেবে তার দায়িত্ব শুধু ব্যক্তির জীবন, ধন-মান রক্ষা নয়, পশুপাখিসহ সব প্রাণীর মঙ্গল সাধন করাও। প্রজাকুল ও প্রাণিজগতের
ওপর তার নিজের দায়িত্ব এবং ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য লিপিবদ্ধ করে তিনি তা রাজ্যের জায়গায় জায়গায় প্রস্তর ও লৌহ খুঁটিতে খচিত করে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এসব রাষ্ট্রনায়ক
ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদের
দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুমান করা চলে যে, প্রাচীন জনপদ, বাজার-বন্দরকে কেন্দ্র করে যেসব রাষ্ট্র তৈরি হয় সেগুলো প্রাথমিক স্তরে ছিল- আরসি মজুমদারের ভাষায় 'গ্রাম-প্রজাতন্ত্র'; আর হেনরি মেইনের ভাষায় 'গ্রাম-সম্প্রদায়'। গ্রাম-প্রজাতন্ত্র
আর প্রজা যাই হোক, জনপদ থেকে রাজ্যে রূপান্তরকালে অন্তত কিছুকাল রাজন্যশ্রেণী প্রজাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
কিন্তু উত্তরকালে ভারতীয় রাজারা ভূমধ্যসাগরীয়
রাষ্ট্রের কর্তাদের মতোই স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এবং এ রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ধর্ম।প্রজাতন্ত্র
পতনের পর অধিকাংশ মানুষ রাষ্ট্র ও রাজন্যশ্রেণীর দাসে পরিণত হয়। পূর্বেকার সামাজিক সাম্যের বদলে সমাজ তখন বিভক্ত হলো রাষ্ট্রীয় আমলা-পুরোহিত শ্রেণী এবং দাসে।
ব্যক্তি ও সমাজসত্তাকে
পদদলিত করে কিভাবে স্বৈরতন্ত্রী রাজ্য তৈরি হলো তা নিয়ে তত্ত্বালোচনা প্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায়। ভারতীয় বৈদিক তত্ত্বে যেমন আছে যে, আলো ও অন্ধকারে মানুষকে চক্রাকারে ঘূর্ণি খেতে হবে, এটাই বিধি বা প্রকৃতির নিয়ম। বৈদিক তত্ত্বমতে প্রাকৃতিক মহাসময়ে মানুষ চারটি যুগের মধ্যে চির ঘূর্ণায়মান-সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ। সত্যযুগ হলো মানুষের জন্য সুন্দর ও স্বাধীন যুগ।
তার পরপরই পতনের পালা। সত্যযুগ থেকে ত্রেতা, দাসে পরিণত হয়ে কলিযুগে এসে মানুষ হারায় সব ধরনের ন্যায় বিচার ও শান্তি। এ সময় ব্রহ্মা সব ধ্বংস করে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেন সত্যযুগ।
মিসরীয় ও গ্রিক মিথলজিতেও অনুরূপ সমাজ বিবর্তনের তত্ত্ব রয়েছে। এটা ধর্মীয় তত্ত্ব এবং এমন তত্ত্ব সব ধর্মেই রয়েছে। ভালো ও মন্দ সময়ের জন্য ঐশী শক্তি ক্রিয়াশীল- এমন তত্ত্ব ব্যক্তি ও সমাজ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী অস্ত্র বটে।মানব ইতিহাসের এটা একটা করুণ দিক যে, সময়ের ব্যবধানে ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক স্বাধীনতা হারিয়ে পরিশেষে মানুষ তার নিজ দেহের ওপরও অধিকার হারায়। ফলে সে শাসকশ্রেণীর দাসে পরিণত হয় এবং দাস ও তার স্ত্রী-সন্তানাদি মালিকের হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
কিভাবে মানুষ তার আপন সত্তা হারিয়ে বিজয়ী শক্তির দাসে পরিণত হলো সে ইতিহাসের জের টেনে মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের তাত্তি্বক টমাস পেইন রাষ্ট্রের পক্ষে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রবণতার ইতিহাস তুলে ধরেন তার বিখ্যাত সেই আলোচনায়। তিনি যুক্তি দেখান যে, 'রাষ্ট্রকে ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে বাধ্য না রাখতে পারলে রাষ্ট্র উল্টো কাজটি করবে। রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকে
পদদলিত করে সবাইকে দাসে পরিণত করবে।
' পেইন-এর এ উক্তিই অন্যভাবে ব্যক্ত করেন লর্ড এ্যকটন। তার বিখ্যাত History of Liberty প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেন, Power corrupts and absolute
power corrupts absolutely.লর্ড এ্যকটন দেখিয়েছেন যে, আগ্রাসী রাজন্যশ্রেণী প্রথম পরাজিত করে রাষ্ট্রের জনগণকে এবং সৃষ্টি করে শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
শুরু হয় রাজ্য বিস্তার ও মানুষকে পদানত করে শোষণ করার নীতি। শুরু হয় মানুষকে সামন্ত প্রভুর দায়বদ্ধ কৃষকে পরিণত করার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু অধিকারহীন পরাজিত মানুষকে দাস, আধা দাস ও ভূমি দাসে পরিণত করার পালা।
এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সামন্ত যুগ। সামন্ত যুগ ব্যবস্থায় ব্যক্তি থাকে, কিন্তু তার সত্তা থাকে না, অধিকার থাকে না, থাকে না কোনো পরিচয়। সামন্ত ব্যবস্থায় সবাই একে অপরের অধীনস্থ, পরিশেষে সবাই শাসক শ্রেণীর সম্পত্তি। এ পর্যায়ে শাসক শ্রেণী দুটি শক্ত খুঁটির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই খুঁটি দুটি হচ্ছে ধর্ম ও শাসন। প্রাথমিক যুগে ধর্ম ও রাষ্ট্রর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব্ব ছিল তা এ পর্বে নিরসন হয়ে উভয় শক্তি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে আবিভর্ূত হয়, যদিও অনেক সময় কোনো কোনো শক্তিশালী শাসক নিজের ওপর দেবত্ব দাবি করে ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টায় অনেক শাসক সাময়িক সাফল্য অর্জন করলেও পরিশেষে কেউ শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ধর্মের ব্যাপারে যাজকশ্রেণীর একক এখতিয়ার তাকে মেনে নিতে হয়েছে।
কেবল জাপানের রাজা দীর্ঘকাল নিজেকে ঐশ্বরিক প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের পর শত্রুপক্ষের
নির্দেশে তাকে জনসমক্ষে ঘোষণা করতে হয়েছে- 'আমি একজন মানুষ, আর দেবোপম দাবি মিথ্যা'।
শাসক কর্তৃক ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা পতনের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, এশীয় সমাজের তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এখানেও ব্যক্তি ও সমাজসত্তাকে পদানত করে উত্থান ঘটে রাজতন্ত্রের।
স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট জনপদগুলোকে ধ্বংস করে স্থাপিত হয় রাজ্য, রাজ্য থেকে সাম্রাজ্য। একটি সাম্রাজ্যের শাসকশ্রেণী ছাড়া সবাই অধিকারহীন দাস।
ভারতে অশোকের শাসন পর্যন্ত ব্যক্তিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। গুপ্ত, পাল ও তুর্কি সাম্রাজ্য স্থাপনের মাধ্যমে
আবির্ভাব ঘটে ইউরোপীয় সামন্তশ্রেণীর সঙ্গে তুলনীয় স্থানীয় রাজন্য ও ভূস্বামীশ্রেণী যার অধীনে সাধারণ মানুষ হারায় তার সব সত্তা ও স্বাধীনতা। ইউরোপীয় সামন্তশ্রেণীর ও ভারতীয় ভূস্বামীশ্রেণীর মধ্যে মিল-অমিল দুটোই লক্ষণীয়।
পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়ে বিতর্ক আছে যে, ভারতীয় ভূস্বামীশ্রেণী ইউরোপীয় সামন্তশ্রেণীর
সঙ্গে তুলনীয় কিনা। কেউ বলেন উভয়ই একজাতের সামন্তবাদ, আবার কেউ বলেন ভারতীয় সামন্তশ্রেণী এক ভিন্ন জাতের সত্তা। মিল-অমিল যাই থাক না কেন, বাস্তব সত্য এই যে, ব্যক্তিসত্তা এখানে অনুপস্থিত। ইউরোপে সাধারণ কৃষক সামন্তের দাস। ভারতে তারা শূদ্র এবং দাস উভয়ই। চীনের বেলায়ও একই সত্য বিরাজমান।
ভারতের দাসত্বের এলাকাটা বহু গুণ বেড়ে যায় শিল্প বিপ্লবের পর যখন ইউরোপীয় মার্কেন্টেলিস্ট বা বণিকগোষ্ঠী ভারত মহাসগরীয় দ্বীপসমূহে ও আমেরিকায় কলোনি স্থাপন করে দাসশ্রমের ভিত্তিতে চাষাবাদ শুরু করে। এ সময়ে প্রায় পনের মিলিয়ন আফ্রিকান ও এশীয় ক্রীতদাস আমেরিকা ও সাগরদ্বীপসমূহে বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য ক্রীতদাসে পরিণত হয়। মার্কিন ক্রীতদাসের কাহিনী, সাগরদ্বীপের ক্রীতদাসের কাহিনী সবারই জানা। আধুনিক পুঁজিবাদের প্রভাবে বাণিজ্যিক চাষাবাদ পৃথিবীর সর্বত্র প্রাধান্য পায়।
প্লান্টেশন অর্থনীতি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক চাষাবাদের ফলে প্রায় সারা বিশ্ব-পুঁজিপতিশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে। ইউরোপের বাইরে এ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম ছিল ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।উনিশ
শতকের প্রথমভাগ থেকেই আইনগতভাবে দাসপ্রথা বিলোপ করার উদ্যোগ আসে ইউরোপ থেকেই। এর কারণ হিসেবে ইউরোপে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানববাদী ও উদারনৈতিক আন্দোলনগুলোকে অনেকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন।
কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে দার্শনিক তত্ত্ব আমরা প্রাচীনকাল থেকেই পাই। কিন্তু এতে শাসকশ্রেণী ব্যক্তিকে অধীনস্থ করার প্রচেষ্টায় বিরত থেকেছে এমন প্রমাণ নেই। কোনো ধর্মই দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়নি; যদিও কোনো ধর্মই দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধও করেনি। শাসক কর্তৃক মানুষকে অধীনস্থ করে প্রভু হওয়ার স্পৃহা যে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় সে সম্পর্কে প্রাচীনকালের হামুরাবী, উকারুগীনা, কনফুসিয়াস, কৌটিল্য থেকে আধুনিককালের টমাস পেইন প্রভৃতি মনীষী তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু তারপরও দাসপ্রথা বরং বেড়েছে, কমেনি। উনিশ শতক থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর্ব শুরু হওয়ার প্রধান কারণ প্রযৌক্তিক পরিবর্তন।দাসোত্তর
যুগে, বৈশ্বিকভাবে মানুষকে অধীনস্থ করে শাসন করার নতুন ধারা সৃষ্টি করল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ। প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বের পিছিয়ে-পড়া জাতিগুলোকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার অনেক ছুতো ছিল। প্রধান ছুতো ছিল সভ্যতার বিস্তার। সভ্যতার দাবিদার ছিল সাম্রাজ্যবাদীরা। বুঝিবা অন্যরা সবাই অসভ্য। অতএব সভ্যতার খাতিরে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সাম্রাজ্যবাদীদেরই
নৈতিক দায়িত্ব। উল্লেখ্য, এমন মনোভাব ছিল আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের আগেও। রোমান সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, তুর্কি সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য এবং চৈনিক সাম্রাজ্যগুলো প্রজাশ্রেণীর সংস্কৃতিকে অসভ্যতার প্রতীক হিসেবেই দেখেছে।
লেখক : প্রফেসর
এমিরেটাস, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন