মুসলিম সুন্নি বিশ্বে শিয়ারা কিভাবে আলাদা একটি শিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে তার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট সহ এর ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ণনা :
শিয়া ইসলাম : ইসলামের সংখ্যালঘু গোষ্ঠি যারা সুন্নি থেকে ধর্মতত্তীয় ভাবে ভিন্ন কিন্তু আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করে যে পয়গম্বর মুহাম্মদের ( সঃ ) একমাত্র বংশধরদেরই মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতূত্ব দেয়া উচিত ৷ এই চিন্তাধারার অনুসারীদেরকে শিয়া বা শিয়ামুসলিম নামে অভিহিত করা হয় ৷ শিয়ারা বিশ্বাস করে যে খলিফাদের নির্বাচনে পয়গম্বরের নিকট পুরুষ আত্মীয় আলীকে নির্বাচন করা উচিত ছিল ৷ শিয়ারা বেশ কয়েকজনকে ( ৬জন বা ১২ জন ) ঈমাম হিসেবে মানে,যারা আলী বা ফাতেমার প্রত্যক্ষ পুরুষ বংশধর বা তাদের মনোনিত কোনো ইমাম ৷ তবে সুন্নি ও শিয়াদের মত পার্থক্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক , ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো পার্থক্য নাই ৷
৬৩২ সালে পয়গম্বর মুহাম্মদ ( সঃ ) তাঁর কোনো উত্তরাধিকার নিযুক্ত করার আগেই পরলোক গমন করেন ৷ কি জন্যে কোনো উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা হয় নাই তার কারণ জানা না যায় নাই ৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন তাঁর ইন্তেকাল যে হঠাৎ হয়ে যাবে তা তখন তিনি ধারণা করতে হয়ত পারেন নাই ৷ এর একটি সম্ভবপর কারণ হতে পারে ৩/৪ বছর পূর্বে তিনি যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সে বিষক্রিয়া যে আবার তাঁকে আক্রান্ত হতে পারেন সে ধারণা তাঁর মন থেকে মুছে গিয়েছিল হয়ত ৷ আর তাঁর বিষে আক্রান্তের ব্যাপারেও ভিন্ন মত আছে ৷ অনেকে মনে করতেন নবীজী (সঃ) এর পর হযরত আলী (রাঃ) কেই তাঁর স্থলাবিষিক্ত করা নিশ্চিত ছিল তাই কোনো উত্তরাধীকার নিযোগের প্রয়োজন ছিল না ৷ এই ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট করা হয়েছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এবং ইসলামী স্কলারদের মতামত সংযুক্ত করে ৷ তাদের কিছু ইংরেজি মন্তব্য সরাসরি যুক্ত করা হলো ৷
এব্যাপারে কিছু তথ্য ইনটারনেটের বিভিন্ন লেখা থেকে সংগ্রহ করে এখানে সংযোজন করা হল পাঠকদেরকে একটি স্পষ্ট ধারনা দেয়ার জন্যে ৷
১ ) Prophet Mohammad SAW was poisoned by a Jewish woman who was living in Madina. She invited Prophet Mohammad to eat in her house. A companion of Prophet also accompanied Prophet SAW. He already had swallowed his one Mosul , when Angel Jibreel appeared and stopped hand of Prophet from putting a mosul in his mouth. The poison was very powerful. Prophet's companion died immediately. Prophet immediately walked out of her house . …..
Narrated 'Aisha: The Prophet in his ailment in which he died, used to say, "O 'Aisha! I still feel the pain caused by the food I ate at Khaibar, and at this time, I feel as if my aorta is being cut from that poison
২ ) Poisoned by a Jewess…]
Muhammad was poisoned by a Jewish woman, following the conquest of Khaibar, where he took Safiyah as a wife, and ordered the torture and beheading of her husband Kinana, the chief of the Jews at Khaibar.
Narrated Anas bin Malik: A Jewess brought a poisoned (cooked) sheep for the Prophet who ate from it. She was brought to the Prophet and he was asked, "Shall we kill her?" He said, "No." I continued to see the effect of the poison on the palate of the mouth of Allah's Apostle .
....Narrated 'Aisha: The Prophet in his ailment in which he died, used to say, "O 'Aisha! I still feel the pain caused by the food I ate at Khaibar, and at this time, I feel as if my aorta is being cut from that poison."
The reason behind her action was the killing of her people and family by Muhammad.
The apostle of Allah sent for Zaynab and said to her, "What induced you to do what you have done?" She replied, "You have done to my people what you have done. You have killed my father, my uncle and my husband, so I said to myself, "If you are a prophet, the foreleg will inform you; and others have said, "If you are a king we will get rid of you."
Ibn Sa'd p. 252
It was no secret among the wives, that Aisha was Muhammad's favorite, and he made this clear as death approached.
Narrated 'Aisha: that during his fatal ailment, Allah's Apostle, used to ask his wives, "Where shall I stay tomorrow? Where shall I stay tomorrow?" He was looking forward to Aisha's turn. So all his wives allowed him to stay where he wished....
....He came out with the help of two men and his legs were dragging on the ground. He was between Al-Abbas and another man [Ali Ibn Abi Talib]."....
Died in the Arms of Aisha[edit]
Even from his death-bed, Muhammad was issuing orders and cursing Christians and Jews.
....Then he [Muhammad] ordered them to do three things. He said, "Turn the pagans out of the 'Arabian Peninsula ; respect and give gifts to the foreign delegations as you have seen me dealing with them." (Said bin Jubair, the sub-narrator said that Ibn Abbas kept quiet as rewards the third order, or he said, "I forgot it.")
Narrated 'Aisha and Ibn 'Abbas: On his death-bed Allah's Apostle put a sheet over his-face and when he felt hot, he would remove it from his face. When in that state (of putting and removing the sheet) he said, "May Allah's Curse be on the Jews and the Christians for they build places of worship at the graves of their prophets." (By that) he intended to warn (the Muslim) from what they (i.e. Jews and Christians) had done.
On the 8th of June, 632 AD Aisha watched Muhammad finally die, slumped on her bosom.
Narrated Aisha:....In front of him there was a jug or a tin, (The sub-narrator, 'Umar is in doubt as to which was right) containing water. He started dipping his hand in the water and rubbing his face with it, he said, "None has the right to be worshipped except Allah. Death has its agonies." He then lifted his hands (towards the sky) and started saying, "With the highest companion," till he expired and his hand dropped down.
....'Aisha added: He died on the day of my usual turn at my house. Allah took him unto Him while his head was between my chest and my neck and his saliva was mixed with my saliva.s
৩ ) ইন্তেকালের পর যে কারণে নবীজীকে কবর দিতে দেরি করা হয়েছিল তার ও কিছু তথ্য যুক্ত করা হল ;
The time between the death and the burial of the Prophet (peace be upon him):
There is full consensus among Muslim scholars that the Prophet (peace be upon him) died on Monday afternoon, and in some reports specifically in the late afternoon. However, there is some dispute among scholars on the time of the Prophet’s burial. According to many scholars, the Prophet (peace be upon him) was buried on Tuesday afternoon (one day after his death). Some scholars even said that the burial of the Prophet (peace be upon him) took place on Wednesday afternoon (about two days delay).
The time between the death and the burial of the Prophet (peace be upon him):
There is full consensus among Muslim scholars that the Prophet (peace be upon him) died on Monday afternoon, and in some reports specifically in the late afternoon. However, there is some dispute among scholars on the time of the Prophet’s burial. According to many scholars, the Prophet (peace be upon him) was buried on Tuesday afternoon (one day after his death). Some scholars even said that the burial of the Prophet (peace be upon him) took place on Wednesday afternoon (about two days delay).
The delay of his burial was for many reasons. Some of them are: no one led the funeral prayer, so people entered in his room in small groups to perform the funeral prayer. They had different opinions before reaching a point of consensus concerning many matters, for instance the manner in which the Prophet , should be washed, the place he should be buried in and the leadership of the Ummah (Muslim nation) after his death, etc.
তাই রাজনৈতিক কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই পয়গম্বরের (সঃ) এর পরলোকগমনের পর মুসলিম উম্মাহ্ অর্থাৎ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে ঐক্যবদ্ধ সমাজ হিসেবে ধরে রাখতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আবুবকরকে (রা) পয়গম্বরের পর প্রথম ইসলামের খলিফাহ্ নির্বাচিত করা হয় ৷ অর্থাৎ তখন থেকেই রাজনীতি ও মুসলিম উম্মাহ্ র শাসন ব্যবস্থা ধর্মের ওপর স্থান করে নেয় ৷
তবে অনেকের বিশ্বাস ছিল যে মুহাম্মদের (সঃ) নিকট আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ পুরুষ আলী ইবনে আবি তালিবকে (রা: ) কে নবীজী (সঃ) এর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রথম ইসলামের খলিফাহ্ নিযুক্ত করা হবে ৷ কিন্তু আলী তখনও তরুণ এবং অনভিজ্ঞ থাকায় এবং মুসলিম উম্মাহ্ র বৃহত্তর স্বার্থ ও রাজনৈতিক কারণে এবং ভোটের মাধ্যমে আবুবকরকেই খলিফাহ্ নির্বাচিত করা হয় ৷৷ তখনই রাজনীতির স্থান ধর্মের উপরে নির্ধারিত হতে শুরু হয়ে যায় !
৬৩৪ সালে প্রথম খলিফাহ্ আবুবকর (রা) এর স্বাভাবিক ইন্তাকাল হয় ৷ তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফাহ্ নিবার্চিত হন উমর ইবনে আল-খাত্তাব ( ৬৩৪-৪৪ ) ৷ তিনি প্রায় ১০ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন মুসলিম উম্মাহ্ র ৷ এই সময়ে সামরিক অভিযানে নতুন গতি পায় ৷ শত শত বছর ধরে আরবরা তাদের সম্পদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসে ছিল অন্যের সম্পদের ওপর গাযু বা হামলা করে আনা লুণ্ঠনের মালামাল দ্বারা ৷ তখন বিভিন্ন গোত্রের ও সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি ও বিবাদে এবং যুদ্ধে নিজেদের যে শক্তি ও সময় ও সম্পদ ক্ষয় বা ব্যয় হত তা তখন কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবেশী দেশসমূহের অমুসলিম গোষ্ঠীগুলোর ওপর আক্রমনে ব্যয় করা আরম্ভ করা হয় ৷ ফলে মুসলিম উম্মাহ্ , অর্থাৎ তখনকার পেনিনসুলায় এক নয়া ইসলামী শক্তির আবির্ভাব ঘটে ৷ খলিফাহ্ উমর (রা) ধীরে ধীরে উম্মাহ্ র আইন ও শৃঙ্ঘলা নিয়ন্ত্রন করতে সমর্থ হন ৷ যা সম্ভব ছিলনা পূর্বে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ ও বিবাদের জন্যে ৷ তাই উম্মাহ্ র ঐক্যের সঙ্গে সঙ্গে খলিফাহ্ উমরের কর্তৃত্বও বৃদ্ধি পায় ৷ উমর তখন নিজকে আমির আল -মুমিনিন বা বিশ্বাসীদের নেতারূপে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন ৷
ইসলামের তৃতীয় খলিফাহ্ উসমান ইবনে আফফান ( ৬৪৪-৫৬ ) মুহাম্মদ(সঃ) এর মেয়ে জামাই এবং ধর্মগ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন ৷ তাঁর হত্যাকাণ্ডের ফলে ইসলামী উম্মাহয় প্রথম ফিৎনাহ্ যুদ্ধের সূচিত হয়েছিল ৷
উসমান ইবনে আফফান পয়গম্বরের সহচরদের ৬ জন দ্বারা খলিফাহ্ নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ এই নির্বাচন ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল ৷ তখন অনায়াসে নবীজীর (সঃ) এর বৈধ উত্তরাধীকার হযরত আলীক (রঃ) কে খলিফাহ্ নিযুক্ত কারা যেত ৷ এখানে ধর্মের থেকে গোত্রের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ৷ নতুন খলিফাহ্
তখন সাইপ্রাস , ত্রিপোলি ও আর্মেনিয়ার অনেক অংশ দখলের পর ককেশাস এবং ইরানের ওক্সাস নদী অবধি এবং আফগানিস্তানের হেরাত আর ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন ৷
এসব বিজয় সত্তেও সৈন্যরা অসন্ত্তষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে ৷ কারণ সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করেছিল এই সময়ে ৷ মাত্র এক দশক সময়কালের মধ্যে তারা একটি কঠিন যাযাবর জীবনধারার বিনিময়ে এক পেশাদার সেনাবাহিনীর একেবারে ভিন্ন জীবন ধারা বেছে নিতে হয়েছে ৷ সমস্ত গ্রীস্মকাল যুদ্ধ করে কাটে আর শীতকালে বাড়ি থেকে দূরে গ্যারিসন শহরে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে ৷অন্যদিকে অভিযান স্থানের দূরত্ব ও ব্যাপক হয়ে যাওয়ায় এ সব অভিযানগুলো অনেকের কাছে ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল ৷ আর আসল কারণ ছিল আগের তুলনায় লুণ্ঠিত মালের পরিমাণও কমে গিয়েছিল ৷ অন্যদিকে সেনাপ্রধান ও ধনী মক্কাবাসীকে ইরাকের মত দেশগুলোয় ব্যক্তিগত এস্টেট স্থাপনে বাধা দিচ্ছিলেন খলিফাহ্ ৷ ফলে কুফাহ্ এবং ফুস্ট্যাস্টে তাঁর জনপ্রিয়তা কমে যায় ৷ এক সময়কার ইসলামের শত্রু আবু সুফিয়ানের পূত্র মুয়াবিয়াহ্ কে সিরিয়ার গভর্নের নিয়োগ ও মদীনাবাসী ভালভাবে গ্রহণ করেনি ৷ অন্যদিকে কোরান যারা মুখস্থ করে রেখেছিল তাদেরকে কেবল কোরানের একটি পাঠ ব্যবহারে উসমানের জোর প্রযোগকে ও অনেকে মেনে নিতে না পেরে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ৷ আলী , খলিফাহ্ ও উমর এবং খলিফাহ্ উসমান উভয়ের নীতির বিরোধী ছিলেন ৷ তাই তাঁর প্রতি অসন্তোষ গোষ্ঠীটি আলীর মুখাপেক্ষী হতে শুরু করে : আলী আবার রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এবং সেনাদলের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ৷
ফলে ৬৫৬ সালে এসব অসন্তোষ স্পষ্ট বিদ্রোহের রূপ নেয় ৷ তখন আরব সেনাদের একটি অংশ , তাদের মতে , তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বুঝে নিতে ফুস্ট্যাট থেকে মদীনায় ফিরে এসেছিল ৷ উসমান তাদরকে খালিহাতে ফিরিয়ে দেন ৷ তখন তারা জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে উসমানকে হত্যা করে এবং পরে বিদ্রোহীরা আলীকে নতুন খলিফাহ্ হিসেবে ঘোষণা করে ৷
শান্তির ধর্ম ও আল্লাহ্ র কাছে আত্মসমর্থনের ধর্ম ইসলাম এক নতুন রাজনৈতিক ধর্ম রূপে আবির্ভূত হওয়া শুরু হয়ে যায় পয়গম্বর (সঃ) ইন্তেকালের মাত্র ২৪ / ২৫ বছর পূর্ণ হতে না হতেই ৷ ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই যে তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির একটা নতুন উপায় হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল , তা ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু হয়ে পড়ে নবীজীর ইন্তেকালের ২০ বছরের মধ্যেই ৷
আলী ইবনে আবি তালিব : পয়গম্বর মুহাম্মদের (সঃ ) চাচাত ভাই এবং মেয়ে-জামাই আর তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয় ছিলেন কিন্তু তাকে পূর্বের খলিফাহ্ নির্বাচনের নিয়ম ভেঙ্গে ৬৫৬ সালে অগণতান্ত্রিক ভাবে তাঁকে ইসলামের চতুর্থ খলিফাহ্ নিযুক্ত করা হয় ৷ শিয়ারা বিশ্বাস করে যে আলীই পয়গম্বরের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হওয়া উচিত ছিল তাই শিয়ারা আলীকে ইসলামী সমাজের প্রথম ইমাম হিসেবে শ্রদ্ধা করে ৷ ইরাকের নাজাফে তার সমাধি রয়েছে যা শিয়া তীর্থযাত্রীদের অন্যতম প্রধান স্থান ৷ কিন্তু ৬৬১ সালে জনৈক খারেজি চরমপন্থীর হাতে তিনি নিহত হন ৷ আলী খলিফাহ্ হিসেবে যোগতম ছিলেন এবং দক্ষ সৈনিকও ছিলেন ৷ সৈন্যদের উৎসাহ দিয়ে আলী যে সব পত্র লিখেছিলেন তা আজও ধ্রুপদী মুসলিম বিবরণ হিসেবে টিকে আছে ৷ তিনি ন্যায় বিচার এবং প্রজা সাধারণকে ভালোবাসার শিক্ষা মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন ৷ এরপরও তাঁর শাসন সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি ৷ তখন থেকেই ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধ থেকে ব্যক্তি স্বার্থ , সম্পদ আহোরণ এবং ক্ষমতা দখলের রাজনীতি অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হয় উঠে ৷ মদীনার আনসার এবং উমাইয়াহ্ দের উথ্থানে মক্কার অসন্তোষ্ট গোষ্ঠীর সমর্থন সহ ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনযাপনকারী ইরাকের মুসলিমরাও তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল ৷ তাই কুফাস্থ গ্যারিসন শহর ছিল আলীর শক্তঘাঁটি ৷ অন্যদিকে উসমানের বর্বর হত্যাকাণ্ড মুসলিম উম্মাহ্য় ৫ বছর মেয়াদী গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছে ৷ যাকে ইসলামের প্রথম ফিৎনাহ্ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ৷
সংক্ষিপ্ত সময় দিয়ে আলীর কাছে উসমানের হত্যাকারীদের বিচার না পেয়ে বিবি আয়েশা এবং সাহাবী যুবায়ের আলীর ওপর হামলা চালান ৷ আলী নিজেও এই হত্যার বিচার করতে চেয়েছিলেন ৷ কিন্তু তাঁর সমর্থকরা উসমান কোরানের আদর্শ অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গতভাবে শাসন করতে ব্যর্থ হয়েছেন , তাই মৃত্যু তাঁর প্রাপ্য ছিল এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিল ৷ আলী তাঁর পক্ষাবলম্বনকারীদের এই দাবী অগ্রায্য করতে না পেরে বিচার বিলম্বিত করছিলেন ৷ আলীর ওপর হামলার সময়ে সেনাবাহিনী বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিল , আর বিদ্রোহীরা বিবি আয়েশার পক্ষহয়ে মদীনা থেকে বসরাহ্ র দিকে এগোতে থাকলে আলী কুফাহ্য় আশ্রয় নিয়ে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন ৷ পরে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান বসরাহ্ র উদ্দেশ্যে এবং অতি সহজে উটের যুদ্ধে বিবি আয়েশা সহ বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন ৷ এই যুদ্ধে বিবি আয়েশা সেনাদলের সঙ্গে উটের পিঠে বসে যুদ্ধ অবলোকন করেছিলেন বলে একে উটের যুদ্ধ বলা হয় ৷ বিজয় অর্জনের পর আলী তাঁর সমর্থকদের উচ্চপদে আসীন করেন এবং সম্পদ ও তাদের মাঝে ভাগ করে দেন ৷ তবে খজনা যোগাত কুফাহ্ র যে কৃষি জমি তাতে সৈনিকের অধিকার প্রদান করেন নি ৷ তাই নিজ দলকে যেমন সন্ত্তষ্ট করতে পারছিলেন না , তেমনি উসমানের হত্যাকারীর বিচার না করতে পারায় ঘরে বাইরে তাঁর নিন্দুকের অভাব ছিল না ৷ সিরিয়াতে ও আলীর শাসন মেনে নেয়া হয়নি ৷ মুয়াবিয়াহ্ ছিলেন উসমানের আত্মীয় এবং উমাঈয়াহ্ গোত্রের , তাই একজন আরব গোত্রপ্রধান হিসেবে উসমানের হত্যার বদলা নেয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর ৷ মুয়াবিয়াহ্ , দামাস্কাসের তাঁর রাজধানী থেকে আলীর বিরোধী পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ৷ কিন্তু ইসলামের শিক্ষা ছিল মুসলিমদের মাঝে একতাবোধের বিস্তার করে উম্মাহকে সংগঠিত করে আল্লাহ্ র একত্ব প্রতিষ্ঠা করা ৷ কিন্তু ক্ষমতার যুদ্ধে তা অল্পদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে কিছু নিরপেক্ষ লোক আলী ও মুয়াবিয়াহ্ উভয় পক্ষকে নিয়ে একটি ফয়সালা করার ব্যবস্থা করেন ৷ এই লক্ষ্যে ৬৫৭ সালে ইউফ্রেটিসের সিফফিনের এক বসতিতে আপস আলোচনায় মিলিত হয়ে যখন কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়ে যায় ৷ তখন চতুর ও রাজনীতিক মুয়াবিয়হ্ ও তাঁর সমর্থকরা এই সময় বর্শার শীর্ষে কোরানের কপি বিঁধিয়ে উপস্থিত মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ্ র বাণী মোতাবেক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একটা ফয়সালা করার আহ্বান জানায় ৷ ইহাই বোধহয় ইসলামর ইতিহাসে ধর্মের প্রথম রাজনৈতিক ও ক্ষমতা দখলের সফল ব্যবহার ৷ হঠাৎ এ ঘোষণায় সবাই যখন নিরব হয়ে যায় তখন সুকৌশলে প্রচার করা হয় যে , সালিশের ফলাফল আলীর বিপক্ষে গিয়েছে, মুয়াবিয়াহ্ র জয় হয়েছে ৷ আর তখনই মুয়াবিয়াহ্ কাল বিলম্ব না করে খলিফাহ্ আলীকে পদচ্যুত করেন ও ইরাকে সেনা প্রেরণ করেন এবং জেরুজালেমে নিজকে খলিফাহ্ হিসেবে ঘোষণা দেন ৷ ইসলাম ও কোরানের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে অন্যায়করীরাও যে সফল হতে পারে , এ ঘটনা তারই স্পষ্ট প্রমান ৷
আলী এ অন্যায় রায় মেনে নিতে সম্মত হয়ে যাচ্ছেন দেখে আলীর কিছু চরমপন্থী সমর্থক সালিশের রায় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় ৷ কারণ তাদের দৃষ্টিতে উসমান কোরানের নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী চলতে ব্যর্থ হয়েছেন ৷ আলী ও কিন্তু উসমানের ভুল শোধরানোতে ব্যর্থ হয়ে অন্যায়ের সমর্থকদের সঙ্গে আপোস করেছেন , সুতরাং আলীও উসমানের মত এখন আর প্রকৃত মুসলিম নন ৷ তাদের মতে আল্লাহ্ মানবজাতিকে স্বাধীন ইচ্ছা দান করেছেন ৷ তারা তখন মুসলিমদের ভাবতে বাধ্য করেছিল যে কে প্রকৃত মুসলিম আর কে নয় সেটা বিবেচনা করতে ৷ এই পর্যায়ে তারা উম্মাহ্ থেকে নিজদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় এই যুক্তিতে যে , যারা কোরানের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতেছে তাদের সাথে তারা কিছুতেই একত্রে থাকতে পারে না ৷ তাই তারা একজন স্বাধীন কমান্ডারের অধীনে নিজস্ব শিবির স্থাপন করে আলাদা হয়ে যায় ৷ যাদেরকে পরে খারেজি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়ে থাকে ৷ খারেজিরা আগাগোড়া সংখ্যালঘু দল ছিল , কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে শিয়া ও সুন্নি ধারার পূর্বেই খারেজিরা একটি উপ-ধারার সৃষ্টি করেছিল ৷ তাদের মতে ইসলামী গোষ্ঠীর শাসককে সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক না হয়ে সবচেয়ে নিবেদিত মুসলিম হতে হবে ৷ খলিফাহ্ দের ও মুয়াবিয়াহ্ র মত রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী হওয়া উচিত নয় ৷
আলী এসব চরমপন্থীদের দমন করলেও গোটা সাম্রাজ্যে আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে ৷ খারেজিদের প্রতি আলীর কঠোর আচরণে কুফাহ্ সহ তাঁর বহু সমর্থক তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করায় মুয়াবিয়াহ্ ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন ৷ এই সময়ে বহু আরবরা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সালিশের দ্বিতীয় প্রয়াস চালান ৷ তাঁরা তৃতীয় পক্ষ থেকে একজন নতুন খলিফাহ্ নির্বাচন করতে গিয়েও ব্যর্থ হন ৷ ফলে মুয়াবিয়াহ্ র সেনাবাহিনী আরবে তাঁর শাসনের বিরোধিতাকারীদের পরস্ত করতে সমর্থ হওয়ায় পর ৬৬১ সলে জনৈক খারেজির হাতে প্রাণ হারান আলী ৷ কিন্তু তখনও কুফাহ্য় যারা আলীর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিল তারা আলীর পুত্র হাসানকে খলিফাহ্ হিসেবে ঘোষণা দেয় ৷ তবে হাসান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্য মুয়াবিয়াহ্ র সঙ্গে এক চুক্তিতে উপনীত হন এবং অর্থের বিনিময়ে মদীনায় ফিরে গিয়ে রজনীতে নিরপেক্ষ জীবনযাপন করে ৬৬৯ সালে পরলোকগমন করেন ৷
আলী একজন ভদ্র , ধার্মিক , এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ এবং পয়গম্বরের ব্যতিক্রমী গুণাবলীর কিছুটা ধারণ করতেন বলে সমাজে একটা ধারনা ছিল ৷ আলী তাঁর কিছু মিত্রসহ প্রতিপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন বলে অনেকের কাছে তাঁর জীবন দর্শন ও আদর্শ একটি প্রতিকে পরিণত হয়ে য়ায় ৷ অন্যদিকে এককালের ইসলামের শত্রুপরিবারের সদস্য শাসক ও রাজনৈতিক কুট-কৌশলে নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফাহ্ মুয়াবিয়াহ্ র অন্যায় অচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনকারী মুসলিমরা খারেজিদের মত নিজদের উম্মাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং প্রকৃত মুসলিমদের তারা এই বলে আহ্বান করে যে যারা আরো উন্নতর ইসলামী আদর্শে নিজদের উৎসর্গ করতে আগ্রহী তারা যেন তাদের আন্দোলনে ( জিহাদে ) যোগদান করে এবং তারা নিজদেরকে শিয়াহ-ই-আলী’র অংশ এবং আলীর পক্ষাবলম্বনকারী হিসেবে দাবী করে বসে ৷
এই পর্যায়ে যারা আলীর প্রতি অসন্তুষ্ঠ ছিলেন তারাও বুঝতে পারেন যে মুয়াবিয়াহ্ মোটেই ইসলামী আদর্শের উপযুক্ত শাসক নন ৷ তিনি এক ক্ষমতা লোভী রাজনৈতিক ব্যক্তি ৷ আর মুয়াবিয়াহ্ র দামাস্কাসে রাজধানী স্থাপন করাকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত বলে ধরে নেন তারা ৷ তাই তারা অর্থাৎ যারা অধিকতর ধার্মিক এবং ইসলামের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন , তারা মুসলিম উম্মাহ্য় আবার ইসলামী শাসন ফিরিয়ে আনার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং কিভাবে নতুন এক ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা করা যায় সে চিন্তা আরম্ভ করন ৷
এই পরিস্থিতিতে শিয়ারা আবার ক্রমবর্ধমান হারে সক্রিয় হয়ে ওঠে ৷ তাদের তখনকার নেতারা নিজেদেরকে আলীর বংশধর দাবী করে প্রচার আরম্ভ করেন এবং এই যুক্তি দেখান যে , এক মাত্র সঠিক ইলিম বা জ্ঞানই মুসলিমদের ন্যায়- বিচার ভিক্তিক ইসলামী সমাজ গঠনে সক্ষম করে তুলতে পারবে ৷ আর এই ইলিম বা জ্ঞান সম্পূর্ণ ভাবে রক্ষিত আছে কেবল মুহাম্মদ (সঃ) এর বংশধর ও পরিবার বর্গের কাছে ৷ তাই মুসলিম সাম্রাজ্যের কেবল তাদরই শাসন করার অধিকার আছে ৷
চরমপন্থী শিয়ারা বর্তমান উম্মাহ্ র সব সংকট আর সমস্যার জন্যে প্রথম তিন খলিফাহ্ আবুবকর , উমর ও উসমানকে দায়ী করে বলেন যে এই ৩ জনেরই উচিত ছিল প্রথমেই আলীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়া ৷ এইসব শিয়া চরমপন্থীদের বেশীরভাগই ছিল ধর্মান্তরিত মুসলিম যাদের ভেতরে তদের পূর্বের কিছু বিশ্বাস ও রয়ে গিয়েছিল ৷ সে হিসেবে আলীকে তারা জেসাসের মত আল্লাহ্ র এক অবতার ধরে নিয়েছিল ৷ তাদের আরো বিশ্বাস ছিল যে , বিভিন্ন ন্যায় যুদ্ধের বিদ্রোহে নিহিত শিয়া নেতৃবিন্দ ইন্তেকাল না করে জেসাসের মত এক অস্থায়ী গোপন স্থানে বা occultation এ অবস্থান নিয়েছেন এবং তারা শেষ জামানায় ন্যায়-বিচার ও শান্তির এক স্বপ্নরাজ্যের উদ্বোধন করতে আবার আবির্ভূত হবেন ৷
ধার্মিকরা সহ ধর্মান্তরিতরা এবং মাওয়ালিরাও এই রকম শাসনে আপত্তি উথ্থাপন করে ৷ ফলে ইসলামী সেন্টিমেন্টের বিস্তার এমন ব্যাপক হয়ে পড়ে যে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা সকলেই কোনও না কোনও ধর্মীয় আদর্শ বেঁচে নিয়ে তার অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে ৷ এই সুযোগ গ্রহণকরে , বহুদিন থেকে সুযোগ গ্রহণের চেষ্টায় রত আব্বাসীয় একটি উপদল ৷ এই উপদলটি সিংহাসনে পয়গম্বরের পরিবারের সদস্যদের এবং শিয়া চরমপন্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা করতে সমর্থ হয় এবং ৭৪৩ সালে ইরান সহ বিভিন্ন স্থানে তাদের আন্দোলনে সমর্থন আদায়ে সফল ও হয় ৷ এবং ৭৪৯ সালের আগষ্টে কুফাহ্ প্রথম অধিকার করে নেয় এবং পরের বছর ইরাকে উমাঈয়াহ্ খলিফাহ্ দ্বিতীয় মনসুরকে পরাস্ত করে আরব সাম্রাজ্য অধিকার করে নিতে সক্ষম হয় ৷ আর তখন মুসলিম উম্মাহ্ য় আব্বাসীহ খলিফাহ্গণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজ গঠন শুরু করে ৷
ফলে পরবর্তীতে পয়গম্বরের প্রচারিত ইসলাম ধর্মের ভিন্ন এক রাজনৈতিক রূপ পরিলক্ষীত হয় ৷ আমাদের পরের আলোচনায় যাহা সময় সময় শাসকদের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যার ও কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে ৷ কিন্তু মূলধারার কিছু ধার্মিক ও বিশ্বাসীরা সবসময়ে পয়গম্বরের প্রবর্তীত প্রকৃত ইসলামে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন ৷
আব্বাসীয় খলিফাহ্ দের শাসনকাল ছিল ৭৫০ সাল থেকে ৯৩৫ সাল পর্যন্ত ৷ প্রায় ১৮৫ বছর তাঁরা ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে পেরেছিলেন ৷ যদিও প্রথমে তাঁরা নিজেদের সযত্নে শিয়াদের ইমামী আলোয় তুলে ধরার মাধ্যমে শিয়াদের সমর্থন আদায় করেন ৷ কিন্তু ক্ষমতা আরোহণের পর পরই ধর্মীয় সব ক্যামফ্লাজ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাদের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে প্রতিপালিত করে দেখান যে তাঁরা কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতায় বসেন নি ৷ বরং তাঁরা প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজের উপযোগী এক চরম রাজতন্ত্র গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর ৷ ধর্মবিশ্বাস বা পয়গম্বের ইসলাম ইত্যাদি রাষ্ট্রপরিচালনার জন্যে যেটুকু অতি অবশ্যক তা ছাড়া এর অতিরিক্ত কিছু তাঁরা বাস্তবায়নে বিশ্বাসী ছিলেন না ৷ তবে প্রয়োজনে ইসলামকে তাঁরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন ৷
পয়গম্বরের ইসলাম ছিল একটা বাস্তববাদী ও বাস্তবমুখী ধর্ম বিশ্বাস যা সাধারণভাবে শহীদি চেতনা বা অর্থহীন ঝুঁকি গ্রহণ উৎসাহিত করে না ৷ ( বর্তমান মুসলিম বিশ্বে অবশ্য এই ধারার বিপরিতটাই প্রবল আকার ধারণ করছে ৷ ) তাই ধর্মীয় সংস্কারকদের পক্ষে এবং ইসলামের মূল নীতির বাস্তবতায় আব্বাসীয়দের প্রকাশ্যে মেনে নেয়া ছাডা অন্য উপায় ছিল না তাদের তখন অর্থাৎ শিয়াদের ৷
এই বাস্তববাদীতা শিয়াদের মাঝে বেশী দেখা যায় ৷ তাই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি পরিহার করে শিয়ারা কারবালাহ্ য় হুসেইনের দুঃখজনক মৃত্যুর পর তাঁর নিকট বংশধরেরা মদীনায় যথারীতি ধার্মিকের জীবনযাপন করে গেছেন ৷ যদিও তাদের অনেকেই উম্মাহ্ র সঠিক ইমাম হিসেবে দেখেছিল শিয়ারা ৷
আলী , হাসান এবং হুসেইনেন পরবর্তী চতুর্থ ইমাম হিসেবে শিয়ারা যাকে ঈমাম মানে , তিনি ছিলেন হুসেইনের জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী যায়েন আল-আবিদিন (মৃত্যুঃ ৭১৪ ) তিনি একজন সাধু ছিলেন এবং চমৎকার এক প্রার্থনার সংকলন রেখে গেছেন ৷
৫ম ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির ( মৃত্যু : ৭৩৫ ) কোরান পাঠের এক গূঢ় পদ্ধতির আবিষ্কার করেন : তার মতে কোরানের প্রতিটি শব্দ প্রতিটি আয়াতের একটি গোপন বা বতিনি অর্থ রয়েছে , যা কেবল মনোযোগ নিবদ্ধ করার অতীন্দ্রীয় কৌশলের সাহায্যেই উপলব্ধি করা সম্ভব ৷ তবে অনেকের মতে এপদ্ধতিটি আসলে অন্যান্য বিশ্ব ধর্মে বিকাশিত পরম সত্তার গভীরে প্রবেশ করার পদ্ধতির অনুরূপ ৷ তাঁর মতে প্রত্যেক ইমাম তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করেছেন এবং ঐশীগ্রন্থের গুপ্ত অর্থ আবিষ্কারে সক্ষম করার জন্য গুপ্তবিদ্যা তার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন ৷ তাই একমাত্র ইমাম তিনিই যে তাঁর পৃর্বসূরীদের কাছ থেকে বিশেষ খেতাব বা নাস লাভ করেছেন , তিনিই মুসলিমদের বৈধ নেতা ৷ আল- বকির- তার পিতার কাছ থকে নাস পেয়েছেন , তাঁর ভাই যায়েদ পাননি , অর্থাৎ যায়েদ নাস প্রাপ্ত ইমাম ছিলেন না ৷ তবুও আল-বকিরের থেকে যায়েদের সমর্থনকারীর সংখ্যা বেশী ছিল তার বিপ্লবী নীতিমালার জন্যে ৷ এবং এই পর্যায়ে শিয়া সপ্তবাদী বা ইসলায়েলি এবং দ্বাদশবাদী এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ৷ তাদের বিশ্বাস ও নীতিগত কিছু আলাদা বৈশিষ্ট ও তখন প্রকাশ হয়ে পড়ে ৷ তবে অধিকাংশ শিয়ারা এই দুই ভাইয়ের মধ্যের বিতর্কের জন্যে এবং তাদের ওপর আব্বাসীয়দের অত্যাচার বৃদ্ধি পেলে শিয়ারা তখন তাদের ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিকের ( মৃত্যু : ৭৬৫ )নির্দেশনা মানতে মানুষিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং তাঁর অপেক্ষা করতে আরম্ভ করে ৷
ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিক(মৃত্যু-৭৬৫) নাসের মতবাদকে উন্নত এবং নিশ্চিত করে ঘোষণা দেয়ে বলেন যে , নির্বাচিত ইমাম হিসাবে তিনিই উম্মাহ্র প্রকৃত নেতা ৷ তাই তিনি তাঁর প্রজন্মকে স্বর্গীয় ইলম্ শিক্ষা দেবেন এবং কোরানের বাতিন পাঠে পথনির্দেশনা যোগাবেন ৷ কিন্তু শিয়াদের অবশ্যই তাদের সব মতবাদ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস গোপন রাখতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমের আরও সহজগম্য ধার্মিকতার প্রয়োজন ছিল ৷ ফলে তারা এক নতুন ধরনের ভক্তি আবিস্কার করে যা ঐ আমলে ব্যাপকতা লাভ করে। এটা জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তিবাদের অনুরূপ,যেহেতু এখানে কোরানকে ঈশ্বরের অনির্মিত(uncreated word) হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে ৷ আর যা অনন্তকাল ধরে তাঁর সঙ্গে অস্তিত্ববান ছিল ইত্যাদি , এ বক্তব্য মুতাযিলাদের আতঙ্কিত করে তুলে ৷ এটা তাদের যুক্তিনির্ভর ধার্মিকতা এবং ঈশ্বরের একত্ব এবং পরম সরলতার ধারণাকে আক্রান্ত করে । কিন্তু গুপ্ত শিয়া ও মুতাযিলা মতবাদ সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের বিষয় ছিল । কোরানের প্রতি এই ভক্তির অনুসারীগণ আহ্লল আল-হাদিস বা হাদিসের জনগন নামে পরিচিতি পায় ৷ তারা জোর দিয়ে বলেছে মুসলিমদের আইনকে অবশ্যই পয়গম্বরের আদর্শ এবং সুন্নাহ্ এবং ‘প্রত্যক্ষদর্শীর’র ভিত্তিতে প্রণীত হতে হবে।
তারা আবু হানিফাহ্ র অনুসারীদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে ৷ যিনি মনে করেছিলেন যে জুরিস্টদের ‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের’ (ইজতিহাদ) ক্ষমতা ব্যবহার করা আবশ্যক । তাঁর যুক্তি ছিল যে তাঁদের অবশ্যই নতুন নতুন আইন নির্মাণের স্বাধীনতা থাকতে হবে যদি তারা কোন ও হাদিস বা কোরানের কোনও উচ্চারণের ওপর নির্ভর করতে না পারেন তবে ইজতিহাদের উপর নির্ভর করতে হবে তাদের ।
আহল আল-হাদিস’রা ছিল রক্ষণশীল ; সকল রাশিদুনকে বা প্রথম চার খলিফাহ্ এমনকি মুয়াবিয়াহ্ কে ও শ্রদ্ধা করত তারা ৷ মুতাযিলাদের বিপরিত কাজ ছিল এটা । যার ফলে তাদের প্রতি হারূন আল-রশিদেরও সমর্থন ছিল। তাই মুতাযিলারা খলিফাহ্ র সু- নজর থেকে বঞ্চিত হয়ে কারাগারেও যেতে হয়েছে মুতাযিলাদের । এর প্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যে এক ধরনের বিভেদ সৃষ্টি হয় । ফিকহ্’র বিকাশে উৎসাহিতরা উমাঈয়াদের অধীনে প্রত্যেক শহরে আলাদা নিজস্ব ফিকাহ্ কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং উলেমাদের মধ্যেও একটা আলাদা শ্রেণীও আবির্ভূত হতে শুরু করে তখন । তখন দু’জন অসাধারণ আলিম চিরন্তন অবদান রেখে গেছেন । এর একজন মদীনায় মালিক ইবন আনাস(মৃত্যু-৭৯৫) ৷এবং তাঁর সংকলিত গ্রন্থের নাম আল-মুতাওয়াত্তাব(The Beaten path) ৷ এটা ছিল মদীনার প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশীলনের বিস্তারিত বিবরণ ৷ যা পয়গম্বরের সমাজের মূল বা আদি সুন্নাহ্ ধরে রেখেছে বলে মালিকের বিশ্বাস ছিল । মালিকের অনুসারীরা তাঁর ধর্মতত্ত্বকে মালিকি মতবাদ(মাযহাব) হিসাবে পূর্ণাঙ্গ করে তুলেছিল ৷ যা মদীনা, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে। কিন্তু অন্যরা একথা মানেত চায়নি যে বর্তমান কালের মদীনা আদি ইসলামের পথে সত্যই নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক হতে পারে ।
শিয়াদের নিজস্ব জাফরি মাযহাব , ইসলামে সুফিবাদ , ফায়লাসুফরা দর্শন ,সপ্তবাদী বা ইসমাইলি শিয়া ও দ্বাদশবাদী শিয়া এবং গোপন ধর্মীয় আন্দোলন :-
সুন্নীদের ধার্মীকতা অবশ্য সকল মুসলিমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি , যদিও তা সংখ্যাগরিষ্ঠজনের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। তবে আব্বাসীয় আমলে আরও চারটি জটিল ধরনের ইসলামী দর্শন এবং আধ্যাত্নিকতার আবির্ভব ঘটেছিল , যাহা সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল ,ভুল বুঝাবুঝির আসংকায়। এই গোপনীতার আবার স্বয়ং-রক্ষক ব্যবস্থাও ছিল। শিয়াদের ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিক তাঁর অনুসারীদের আপন নিরাপত্তার স্বার্থেই তাক্বিয়াহ্ বা গোপনীয়তা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় পণ্ডিত ও উলেমাগণও এসব গুপ্ত সংগঠনের অর্থডক্সির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তবে নিগূঢ় বিদ্যাধারীরা তাদের ধারণাকে ধর্মদ্রোহী বলে ভাবেনি। তারা উলেমাদের তুলনায় অধিকতর গভীরভাবে প্রত্যাদেশ উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন বলে বিশ্বাস করত এবং তারা ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অনুশীলন বা পাঁচ “স্তম্ভ” (রুকন)মেনে চলেছে ।
তারা মুসলিম বিশ্বাসেরসংক্ষিপ্ত ঘোষণা শাহাদা: “আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই এবং মুহাম্মদ(সঃ) তাঁর পয়গম্বর” সম্পর্ণ মেনেছে । দৈনিক পাঁচবার সালাত প্রার্থনা করেছে, যাকাত দান করেছে,রমজান মাসে উপবাস পালন করেছে এবং হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় ও গেছে তারা । ইসলামের স্তম্ভসমুহের প্রতি বিশ্বস্ত যে কেউ অবশ্যই প্রকৃত মুসলিম, তাদের বিশ্বাস যাই হোক না কেন, এ বিশ্বাস তাদের ছিল।
শিয়ারা সুন্নীদের মতই শরিয়াহ্ ভিত্তিক ধার্মিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলতবে তা তাদের নিজস্ব মাযহাব (জাফর মতবাদ, স্বয়ং ইমাম আস-সাদিকের নামানুসারে তাদের তাদের মযহাবের নাম) অনুসারে, অবশ্যই। কিন্তু তারা প্রধানত দিক-নির্দেশনার জন্য বর্তমান ইমামের দিকে চেয়ে থাকত, যিনি তাঁর প্রজন্মের জন্য স্বর্গীয় ইলিমহ্ এর গ্রহিতা, নিস্পাপ আধ্যাত্মিক পরিচালক এবং আদর্শ কাজি। শিয়ারা মনে করে তাদের ইমামদের সকলেই তাঁর সময়কালের খলিফাহ্ র হা তে নিহত হয়েছেন । দশম শতাব্দী নাগাদ শিয়ারা আশুরার(১০মুহরম) উপবাসের দিন, মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রকাশ্যে হুসেইনের শোকে মাতম করা আরম্ভ করে। নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয় প্রশাসনের সঙ্গে শিয়াদের বৈরতা আবার বেড়ে যায় ।খলিফাহ্ আল-মুতাওয়াক্কিল(৮৪৭-৬১) দশম ইমাম আলী আল-হাদিকে গৃহবন্দী করে রাখেন । এর পর থেকে ইমামগণ কার্যত:শিয়াদের নাগালের বাইরে চলে যান এবং কেবল “প্রতিনিধি”র মাধ্যমেই বিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
৮৭৪-এ একাদশ ইমামের পরলোকগমনের পর বলা হয় যে তিনি একজন তরুণ পুত্র সন্তান রেখে গেছেন যিনি আত্মরক্ষার খাতিরে আত্মগোপন করেছেন। দ্বাদশ ইমামের কোনও সন্ধান আর মেলেনি। কিন্তু আজও প্রতিনিধিগণ তাঁর পক্ষে শিয়াদের শাসন করছেন, তাদের কোরানের গৃঢ়ার্থ পাঠে সাহায্য করছেন, যাকাত আদায় করছেন এবং আইনি রায় প্রদান করছেন।
৯৩৪-এ গোপন ইমাম স্বাভাবিক জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছালে “প্রতিনিধি” শিয়াদের জন্য তাঁর কাছ থেকে এক নতুন বাণী এনে হাজির করেন এবং প্রচার করেণ , তিনি “গোপন স্থানে” (occultation) চলে গেছেন এবং ঈশ্বর অলৌকিক উপায়ে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন; তিনি আর শিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। একদিন আবার ফিরে আসবেন তিনি, ন্যায় বিচারের যুগের উদ্বোধন করার জন্যে , কিন্তু সেটা দীর্ঘ কয়েক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর।
কেননা খলিফাহ্ গণ পৃথিবী হতে আলীর বংশধারা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং ইলম্ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এর পর থেকে শিয়া উলেমাগণ গুপ্ত ইমামের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়ে গেছেন । বার জন ইমামে বিশ্বাসী দ্বাদশবাদী (Twelver) শিয়ারা আর রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করেনি ৷ কেননা উম্মাহ্ র প্রকৃত নেতা গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকার বৈধ হতে পারে না ৷ তাই তারা ইমামের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন । কিন্তু শিয়াদের সবাই দ্বাদশবাদী ছিলেন না ৷ আর সবাই রাজনীতিও ত্যাগ করেন নাই ৷ তাদের মধ্যে অনেকে সপ্তবাদী (Seveners ) বা ইসলায়েলি ও ছিলেন ৷ ৯০৯ সালে এক ইসলায়েলি নেতা টিউনিসিয়ার এক প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করেছিলেন ৷ তখন নিজকে তিনি মেসিয়ানিক খেতাব আল-মাহ্ দি বা নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ৷ আর ৯৮৩ সালে ইসমায়েলিরা আব্বাসীয়দের কাছ থেকে মিশর ছিনিয়ে নিয়ে কায়রোয় পাল্টা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন যা প্রায় ২০০ বছর টিকে ছিল ৷ তখন সিরিয়া , ইরাক , এবং ইয়েমেনেও গোপন ইসমায়েলি সেল ছিল ৷ কোরান নিয়ে ইসমায়েলিদের অন্য এক আবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছিল ৷ তাই তারা ঈশ্বরের সঙ্গে শয়তানের বিরোধিতা ক্রমাবনতিশীল বলে বিশ্বাস করেছে ৷ তারা মোট ছয়জন পয়গম্বরে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ আদম , নোয়াহ . আব্রাহাম, মোজেস , জেসাস এবং মুহাম্মদ ( স:) কে তারা পয়গম্বর হিসেবে বিশ্বাস করছেন ৷ তবে তারা পয়গম্বরদের নিম্নমূখী প্রবণতা উল্টে দিয়ে বলেছেন যে প্রত্যেক পয়গম্বরের একজন করে "কর্মী" বা Executor ছিলেন ৷ যিনি তাঁর বাণীর গোপন অর্থ যোগ্যদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন ৷ যেমন অ্যারন ছিলেন মোজেসের কর্মী আর আলী ছিলেন মুহাম্মদ ( সঃ) এর কর্মী ৷ অর্থাৎ হারুন ছিলেন মুসা ( আ) ভাই তাই তাকে মুসা তাঁর বাণীর গোপন অর্থ বলে গেছেন , ঠিক তেমনি মুহাম্মদ ( সঃ) তাঁর চাচাতো ভাই ও মেয়ের স্বামী আলীকে কোরানের গোপন মানে বলেছেন ৷ তাই আলীর গুরুত্ব অসীম ছিল ৷ কিন্তু তিনি নষ্ট রাজনৈতিক কারণে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বা তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে ৷ এখন তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে এবং মুসলিম উম্মাহ্ র রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে ৷ ইসমায়েলিরা বিশ্বাস করত তাদের অনুসারিরা যখন তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রামে লিপ্ত হবে তখন তারা পৃথিবীকে চূড়ান্ত শান্তির পর্বের জন্যে মুসলিম বিশ্বকে প্রস্তুত করে তুলবে ৷ আর এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই কেবল সপ্তম ঈমাম মাহদি আবার আরবদের কাছে এসে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশের পূর্ণ তাৎপর্য মানুষের কাছে স্পষ্ট করে দেবেন ৷ তবে এই ধারণা সুন্নিদের কাছে ছিল উদ্বেগজনক ৷ অন্যদিকে সপ্তবাদী ঈমামে বিশ্বাসী ইসমায়েলি দর্শন মেজরিটি মুসলিমদের কাছেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ৷ তাই অনেক ঘটনা প্রবাহের পর এবং রক্তপাতের পর প্রায় ১৫০ পরে মঙ্গোল হানাদাররাই একে ধ্বংস করত পেরেছে ৷ যার পরিনাণে আবার দ্বাদশবাদী শিয়া রাষ্ট্র পত্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয় ৷ যাদের বিশ্বাস সপ্তবাদী বা সপ্তবাদী ইসলায়েলি থেকে ভিন্ন ৷
বিজয়ী ও রাজকীয় ইসলাম এবং সাফাভীয় সাম্রাজ্য ও ইসলামী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে এক শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ;-
দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদ গ্রহনকারী সাফাভীয় সুফি ধারার অনুসারীরা জর্জিয়া ও ককেসাসের ক্রিশ্চান অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘাযু (Ghazu) হামলা চালিয়ে আসছিল ৷ তারা আবার মেসোপটেমিয়া ও পশ্চিম ইরানের ক্রোধের ও শিকার হয়েছিল ।
১৫০০-তে ষোল বছর বয়স্ক ইসমায়েল এই ব্যবস্থায় পির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমিরদের হাতে নিহত পিতার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, ১৫০১-সলে তাব্রিয অধিকার করেন এবং পরবর্তী এক দশকে ইরানের বাকি অংশ দখল ক’রে দ্বাদশবাদী শিয়াদের জন্যে এক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন ৷ এবং তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে দ্বাদশবাদী শিয়া পন্থি রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দেন ।
এর আগ পর্যন্ত অধিকাংশ শিয়াই ছিল আরব । ইরানেই রাঈ, কাশান, খুরাসান ও কুম-এ শিয়া দের কেন্দ্র থাকলেও সিংহভাগ ইরানিই ছিল সুন্নী । তাই ইরান থেকে সুন্নীমতবাদ নিশ্চিহ্ন করতে নামেন ইসমায়েল ; সুফি তরিকাহ্ সমূহকে দমন ক’রে , উলেমাদের হত্যাকরা হয় নয়ত পাঠানো হত নির্বাসনে । অতীতে কখনও কোন শিয়া শাসক এমন ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহন করেননি । তবে একপর্যায়ে এসে, পরবর্তী দুশো বছর ধরে শিয়া ও সুন্নীদের মাঝে একটা আঁতাত গড়ে উঠে ছিল । “ রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদে” অতীন্দ্রিয়বাদী দ্বাদশবাদীদের আপত্তি ওতাঁদের নীতি বর্হিভূত হওয়া সত্ত্বেও শাহ্ ইসমায়েল হয়ত নিজকে গোপন ইমাম হিসাবে তুলে ধরেন ৷ তাই তাকে শেষ জমানায় যুদ্ধে অংশ নিতে ফিরে আসা মেহেদি বা ঈমাম হিসেবে তাঁর অনুসারীদের কেউ কেউ তখন মনে করেছেন । সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁর জিহাদ ইরানেই শেষ হয়নি । ১৫১০-এ সুন্নী উযবেকদের খুরাসান থেকে উত্তরে বিতাড়িত ক’রে ,সুন্নী অটোমানদেরও আক্রমণ করেন তিনি ৷ এবং ১৫১৪-সালে চ্যাল্ডিরানের যুদ্ধে সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পরাস্ত হওয়ায় আপন রাজ্যের বাইরে সুন্নীদের ধ্বংস করার তাঁর চেষ্টাও তখন ব্যর্থ হয় । কিন্তু ইরানের অভ্যন্তরে তাঁর আক্রমন সফল হয় এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ ইরানি প্রবলভাবে শিয়া হয়ে ওঠে এবং আজ পর্যন্তওতাই আছে ।
শাহ্ প্রথম আব্বাস(১৫৮৮-১৬২৯ ) ইসমায়েলের নীতি থেকে সরে এসে ঘুলুউ আদর্শর অনুপ্রাণিতদের বাদ দিয়ে জনগণকে দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদে অধিকতর অর্থোডক্স রূপ শিক্ষা দেয়ার জন্যে অন্যদেশ থেকে আরব শিয়া উলেমাদের আমদানি ক’রে তাদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মান করেন এবং তাদেরকে আর্থিক সমর্থন ও দেন । আব্বাসের অধীনেসাম্রাজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছে জাতি তখন ৷ ফলে তখন ইসফাহান পরিণত হয়েছিল আকর্ষণীয় মসজিদ মাদ্রাসাসহ , পার্ক, প্রাসাদ আরবিশাল সব খোলা ময়দানের এক অনন্য সাধারণ এবং আকর্ষনীয় নগরীতে ।
কিন্তু অভিবাসী নতুন উলেমাগণের নিজস্ব শিয়া মাদ্রাসা না থাকায় তারা গবেষণা ও আলোচনার জন্যে পরস্পরের বাড়িতে মিলিত হতেন । এক পর্যায়ে তাঁদেরকে ইরানের শিক্ষা ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব রাষ্ট্রিয় ভাবে অর্পণ করায় তাঁরা আর্থিক দিক দিয়েও স্বাধীন হয়ে যান ৷ এবং তাঁদের ধর্মবিশ্বাসকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে আরম্ভ করেন এবং,নিজদেরকে তারা অর্থাৎ উলেমাগণই গোপন ইমামের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি দাবী করতে আরম্ভ করেন । কিন্তু এই সময়ে সাফাভীয় শাহ্ রা উলেমাদের সামাল দিলেও মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃত্যু ১৭০০ ) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উলেমায় পরিণত হয়ে যান ৷ এবং তিনি এক নতুন শিয়া গোঁড়ামি মতবাদ প্রদর্শন করেন আর তা প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হন । তাঁর মতে উলেমাদের কেবল ফিকাহ’র ওপরই জোর দিতে হবে ৷ তিনি মজলিসি ইরানি শিয়াবাদের মধ্যে অতীন্দ্রিয়বাদ দর্শনের প্রতি এমন এক অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম দেন যা আজও ইরানে টিকে আছে ।
মজলসি জনগণকে সমবেত জিকীর ও হুসেইনের সম্মানে পালিত অচার অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেন , যা পরবর্তিতে ইরানের প্রধান ধর্মীয় পতিষ্ঠানে পরিণত হয়েউঠেছে ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে কারবালার করুণ ঘটনা তুলে ধরা আবেগময় নাটক ‘ তাজিয়াহ্’র জন্ম দেয়া হয় ৷ যেখানে জনগণ আবেগময় সাড়া প্রদান করে আর তারা বুক চাপড়ে কাঁদে এবং ইমাম হুসেইনের দুর্ভোগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তোলে ।
কিন্তু মজলিসি এবং শাহ্ গণ এই আচার অনুষ্ঠানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে যত্নের সঙ্গে চাপা দিতে সক্ষম হন ৷ শাসকগণ এর পরিবর্তে আপন গৃহে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার বদলে জনগণকে সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর শিক্ষা দেয়া হয়েছে । তাই ইরানি বিপ্লব (১৯৭৮-৭৯) অনুষ্ঠিত হবার আগে পর্যন্ত আর কাল্ট দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের উপায় হয়ে উঠতে পারেনি ।
কিন্তু উলেমাদের কিছু অংশ পুরনো শিয়া ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন ; তাই তাদের ধ্যান-ধারণা বর্তমান কালেও ইরান সহ সরা বিশ্বের সংস্কারক ও বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জোগায় ।
মির দিমাদ(মৃত্যু-১৬৩১) এবং তাঁর শিষ্য মোল্লা সদরা (মৃত্যু-১৬৪০) ইসফাহানে অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের এক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ মজলিসির বাধা সত্ত্বেও দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে একত্রিত করার সুহ্ রাওয়ার্দির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তাঁরা ৷ এবং তাদের অনুসারীদের তারা অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে তারা আলম আল-মিথাল এবং আধ্যাত্মিক জগতের অনুভূতি লাভে সফল হয়ে উঠতে পারে ।উলেমাদের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ঞুতার ব্যাপারে দু’জনই দারুণ বিরুপ ছিলেন ৷ তাঁরা এসব কাজকে ধর্মের বিকৃতি হিসাবে দেখেছেন । তাঁর মতে-বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতাবাদ (Intellectual Conformism) প্রকৃত ধর্মের সঙ্গে বেমানান । মোল্লা সদরা রাজনৈতিক সংস্কারকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হিসাবেই দেখেছেন । তাঁর প্রধান রচনা আল-আফসান আল-আরবাহ্ ( দ্য ফোরফোল্ড জার্নি- -The fourfold Journey ) তে তিনি জাগতিক পৃথিবীকেপরিবর্তনের করার আগে যে সব অতীন্দ্রিয়বাদী প্রশিক্ষণ নেয়া আবশ্যক তার বর্ণনা দিয়েছেন । তার বিশ্বাস ছিল এই পথে তাঁরা শিয়া ইমামদের মত প্রায় একই রকম আধ্যাত্মিকঅন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারবে ।
আয়াতোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মোল্লা সদরার শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং পরলোকগমনের আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া শেষ ভাষনে তিনি জনগণকে ইরফানের গবেষণা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছেন ৷ কেননা তার মতে আধ্যাত্মিক সংস্কার ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোনো ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না ।
ইরানে নিজেদের উসুলি বলে দাবীকারীদের ব্যাপারে মোল্লাসদরা গভীরভাবে উদ্বগ্ন ছিলেন ।উসুলিদের বিশ্বাস ছিল সাধরণ মুসলমরা নিজেরা ধর্মবিশ্বাসের মৌল নীতিমালা(উসুল) ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে না ৷ তাই জ্ঞানী শিক্ষিত উলেমাদের সন্ধান করে তাঁদের আইনি বিধান অনুসরণ করা কর্তব্য ৷ যেহেতু তাঁরাই গোপন ইমামের কর্তৃত্ব ধারণ করেন । শিয়া উলেমাগণ কখনওই সুন্নীদের মত “ ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ করতে রাজি হননি। তাদের মতে মুজতাহিত-যিনি ইসলামী আইন প্রণয়নর ক্ষেত্রে “ স্বাধীন বিচার বুদ্ধি” প্রয়োগের অধিকার লাভ করেছেন তাই নেতৃস্থানীয় জুরিস্টকেই তারা মুজতাহিদ বলে অভিহিত করেন ।
১৭২২-এ আফগান গোত্রগুলো ইসফাহান দখল করার পর নিষ্ঠুর কমান্ডার নাদির খানের সহায়তায় হানাদারদের বিতাড়িত করা হয় । এরপর বিশ বছর ধরে নাদির খান নিজকে শাহ্ ঘোষণা করে ইরানকে একত্রিত করে সামরিক বিজয় অর্জন করলেও ১৭৪৮-এ আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান তিনি । নাদির খান ইরানে অসফলভাবে ইরানে সুন্নী ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন ৷, তখন উলেমাগণ নাজাফ ও কারবালা য় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা ইরানের জাগতিক শাসকের নাগালের বাইরে থেকে জনগণকে নির্দেশনা দিতে পারতেন । এরপর ইরানে যখন কেন্দ্রিয় কর্তৃত্ব বলে কিছুই ছিলনা তখন উলেমাগণক্ষমতার শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন ।
১৭৭৯-এ কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রনভার গ্রহন করে কাজার বংশ প্রতিষ্ঠাকরলে ইরানে আবার কেন্দ্রিয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উসুলিদের অবস্থান অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় ৷ তখন উলেমাগণও যে কোনো শাহ্ র চেয়ে কার্যকরভাবে ইরানি জনগণের ভক্তি আর আনুগত্য আদায় করতে সফল হয়েছেন ।
;
;
·
বিজয়ী ও রাজকীয় ইসলাম এবং সাফাভীয় সাম্রাজ্য ও ইসলামী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ;-
মঙ্গোল রাজ্যসমূহের পতন ঘটার পর সমগ্র আনাতোলিয়ায় ছোট ছোট স্বাধীন গাজী রাজ্যে ভাগ হয়ে য়ায ৷ এই রাজ্যগুলোর অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য শাসিত হচ্ছিল ওসমানলিপরিবারের হাতে ৷ যা চতুদর্শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৩২৬-এ ওসমানলি বা অটোমানরা বাসরাহ্ দখল করে নেয় যা পরে তাদেররাজধানীতে পরিণত হয় । ১৩২৯-এ তারা ইয্ নিক ছিনিয়ে নেয় এবং ১৩৭২-এবাইযানটিয়ামের বৃহত্তর এলাকা দখল করে ফেলে । এডিরনে (এড্রিয়ানোপল) এ নতুনরাজধানী প্রতিষ্ঠা করে বাইযানটাইন সম্রাটকে মিত্রে পরিণত করে । তখন প্রথম মুরাদ (১৩৬০-৮৯) শক্তিশালী পশ্চিমা মুসলিম শাসকে পরিণত হন । কিন্তু ১৩৮৯-এ অটোমানরা মধ্য সার্বিয়ায় কসোভো যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বীয় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ফেললে মুরাদ নিহত হয় এবং সারবীয় যুবরাজ Hrevlbejan0vic Lazar (হ্রেলবেলিয়ানোভিচ লাযার )কে বন্দীকরে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে সারবিয়ার স্বাধীনতার । অটোমানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে ৷ তবে ১৪০২-এ আঙরায় টিমুরের কাছে বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও টিমুরের মৃত্যুর পর তারা আবার শক্তি সংহত করে এবং ১৪৫৩-সালে দ্বিতীয় মেহমেদ(১৪৫১-৮১ ) খোদ কনসট্যান্টিনোপলই অধিকার করে নিতে সক্ষম হন-নতুন প্রযুক্তি ও গান পাউডার অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ৷
মঙ্গোল-বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে নতুন এক শক্তির সন্ধান পেল তারা এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইসলামী জগত বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ৷ নৌপথ ও মহাসাগরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও অনেকটা মুসলিমদের দখলে চলে যায় সে সময় ।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি প্রধান ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে ; ইরানে সাফাভীয় সাম্যাজ্য , ভারতে মোঘুল সাম্রাজ্য এবং আনাতোলিয়া ,সিরিয়া,উত্তর আফ্রিকা ও আরবে অটোমান সাম্যাজ্য । তখন উযবেকিস্তানে এক বিরাট মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর মরোক্কোয় গঠিত হয়েছিল শিয়া প্রধান্য বিশিষ্ট আরেকটি রাজ্য । ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলমানরাই আধিপত্য বিস্তার করে ৷ সুতরাং বিজয়ের একটা পর্ব ছিল এটা । তবে তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যই ইসলামের সাম্যবাদী ঐতিহ্যের দিক থেকে সরে এসে পরম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলো ৷ আব্বাসীয় খলিফাহ্ গণ শরীয়াহ্ আইনের আওতাভূক্ত ছিলেন না কিন্তু নতুন সাম্রাজ্যগুলো শক্ত ইসলাম মুখী ছিল । সাফাভীয় ইরানে শিয়া মতবাদ রাষ্ট্র-ধর্মে পরিণত হয় এবং মোঘুল নীতিমালায়ও ফালসাফাহ্ ও সুফিবাদের প্রবল প্রভাব ছিল প্রবল । অন্য দিকে অটোমান সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়েছে সম্পূর্ণও শরিয়াহ্ অনুযায়ী ।
শিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হলে সুন্নী ও শিয়াদের মাঝে এক নতুন ও অনতিক্রম্য ভাঙন সৃষ্টি করে আর জন্ম দেয় এক অসহিষ্ঞুতা আর আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িকতাবাদের যা ইসলামী জগতে ছিল নজীরবিহীন ।
রাশানরা এই সময় (১৫৫২-৫৬) মুসলিম কাযান ও অস্ত্রাখানে আক্রমন চালিয়ে খ্রিষ্টধর্মচাপিয়ে দেয় । ১৪৯২-সালে আমেরিকা আবিস্কার ও পর্তুগিজ বণিকদের সাগরে মুসলিমবাণিজ্য ধ্বংস করার চেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামী জগতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি তখন ।
ইরানে শিয়া সাম্যাজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারেই মুসলিমরা বেশী আগ্রহ ছিল প্রাথমিকসাফাভীয়দের অসাধারণ সাফল্য সুন্নী প্রত্যাশার ওপর এক বিরাট আঘাত ছিল । কয়েকশতাব্দী সময়কালের মধ্যে প্রথমবারের মত ইসলামী রাজ্যের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এক স্থিতিশীল ও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে ।
সূত্র; ইসলাম ; সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ; ক্যারেন আর্মস্ট্রং :
অনুবাদ ; শওকত হোসেন ৷
এই ব্লগের অন্য কিছু লেখা থেকে এই লেখাটি সংকলন
করা হয়েছে কিছু পরিবর্তীত রূপে ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন