হুমায়ুন আজাদের নির্বাচিত কিছু কবিতা ; ( new update )

      
             

হুমায়ন আজাদের নির্বাচিত কিছু কবিতা

 

সামাজিক অচলায়তন 

আমাদের সামাজিক বিকাশ, অচলায়তনে পরিণত হওয়া প্রসঙ্গে; 

একজন বহুদর্শী ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল , আমাদের সমাজটা কেমন ?
কী তার বৈশিষ্ট্য, কেমন তার চরিত্র ? কতটা সে মানবিক ? 

তাঁর জবাবটা গ্রহনযোগ্য মনে হওয়ায়, এখানে প্রকাশ করা হলো ; 

আমাদের বর্তমান সমাজটা মানব কল্যাণমুখী নয় জীবনের সুস্থ বিকাশের পথ দেখাতে সে অপারগপ্রতারণার কলাকৌশলে তার সর্বাঙ্গ সুসজ্জিতদমনমুলক কানুনের নিগড়ে সে শৃঙ্খলিততার যাবতীয় বিধিব্যবস্থা মানুষের কল্যাণবিমুখসর্বহিতকর ব্যবস্থা এখানে স্থবিরসমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের জন্য ভরসা জোগায় নামানবিক বোধ বুদ্ধি বিবেক এখানে অনুপস্থিতমানবতা এখানে লান্ঞ্ছিত হয়মানবিক চেতনা পরিচর্যা পায় না, হয়না বিকশিতবরং প্রবলভাবে নৈতিকতাহীনতার চর্চা হয়অকল্যাণ উপাদানগুলো বিস্তারলাভ করে 
মানবীয় সুকুমার বৃত্তি কোণঠাসা হয়ে বিপর্যস্ত হয়অশিক্ষা, কুশিক্ষা, মূর্খতা, মূড়তা, অন্ধকার মানুষকে বিপজ্জনকভাবে গ্রাস করে আছেজ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের দ্বার অর্গল আঁটাঅধিকাংশ মানুষ প্রশ্নহীন, জিঞ্জাসাবিমুখপ্রজন্ম পরস্পরায় পাওয়া মূল্যবোধ নিয়েই সন্ত্তষ্ট একেই চুড়ান্ত ধন- জ্ঞান ভেবে চিন্তার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রাখে  
একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষ যদি চিন্তায় স্থবির হয়, হয় জিজ্ঞাসাবিমুখ, তাহলে নিশ্চিত তার সামগ্রিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে অচলায়তনে পরিণত হওয়া  


সমাজ পরিবর্তনের আভাস অগ্রীম পান কবিরা 

কবিরা সমাজ পরিবর্তেনের অগ্রিম খরর পেয়ে থাকেন, তাদের উপলব্ধিতে ও কল্পনায়; এ রকম একটি ঘঠনার বর্ণনা , ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন দুই কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্তরা সব সময় সমাজ পরিবর্তনে বা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় পরাধীন বাঙলায় ও এর ব্যতিক্রম ছিলো না
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন উপায়ে মধ্যবিত্তের হাতে টাকা পয়সা , হঠাৎ করে জমতে থাকলে, তাদের যে পরিবর্তন আরম্ভ হয়, তা উপলব্ধি করে পরাধীন বাঙলার বিপ্লবী কবি সুকান্ত যে কবিতা লেখেন, তা হলো ;  ( কিছু  অংশ )

মধ্যবিত্ত ৪২ 

পৃথিবীময় যে সংক্রামন রোগে, আজকে সকলে ভুগছে একযোগে, 
এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস পাচ্ছি, এখন বইছে পুব- বাতাস
উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল, হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল,……
……….
সহসা নেতারা রুদ্ধ- দেশ জুড়ে দেশপ্রেমিকউদিত ভুঁই ফুঁড়ে …….”

ঠিক এর প্রায় ৫০ বছর পর, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দু-দশক পর, সাম্রাজ্যবাদ, মৌলোবাদ,ব্যবসা বনিজ্য,আরো বিভিন্ন উপায়ে মধ্যবিত্তের হাতে অর্থের আগমন ঘঠলে, তাদের ও যে পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ হয়, তা উপলব্ধি করে ,বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ ও যে কবিতা লেখেন, এখানে তা উল্লেখিত হলো, আগ্রহীদের জন্যে  

আমার চোখের সামনে

আমার চোখের সামনে পচে গলে নষ্ট হলো কতো শব্দ, 
কিংবদন্তি, আদর্শ, বিশ্বাস কতো রঙিন গোলাপ
কখনোবা ধীরে ধীরে, কখনো অত্যন্ত দ্রুত, পরিণত হলো ,নোংরা আবর্জনায়
আমার বাল্যে বিপ্লবশব্দটি প্রগতির উথ্থান বোঝাতো
যৌবনে পা দিতে- না-দিতেই দেখলাম শব্দটি পচে যাচ্ছে-
ষড়যন্ত্র, বুটের আওয়াজ,পেছনের দরোজা দিয়ে ,প্রতিক্রিয়ার প্রবেশ বোঝাচ্ছে 

সংঘশব্দটি গত এক দশকেই কেমন অশ্লীল হয়ে উঠেছে
এখন সংঘবদ্ধ দেখি নষ্টদের, ঘাতক ডাকাত ভন্ড আর 
প্রতারকেরাই উদ্দীপনাভরে নিচ্ছে সংঘের শরণ যারা 
মানবিক, তারা কেমন নিঃসঙ্গ আর নিঃসংঘ ও 
অসহায় উঠছে দিনদিন
আমার চোখর সামনে শহরের সবচেয়ে রূপসী মেয়েটি 
প্রথমে অভিনেত্রী, তারপর রক্ষিতা, অবশেষে 
বিখ্যাত পতিতা হয়ে উঠলো

এক দশকে যেতে- না যেতেই আমি দেখলাম 
বাঙলার দিকে দিকে একদা মাথা- ছোঁয়া মুক্তিযোদ্ধারা 
কী চমৎকার হয়ে উঠলো রাজাকার

আর আমার চোখের সামনেই রক্তের দাগ - লাগা সবুজ রঙের
বাঙলাদেশ দিন দিন হয়ে উঠলো বাঙলাস্তান

হুমায়ুন আজাদ, 


বেশী কাজ বাকি নেই মানুষ কম বেশী আশাবাদী হয়েই জন্মায় কবি , সাহিত্যিক, ও দার্শনিকরা তো সমাজের ভবিষ্যত দ্রষ্টা; তারা সব সময়ই আশাবাদী, এবং অন্যকে ও আশার আলো দেখাতে ভালোবাসেন ৫০ বছর আগের পরাধীন বাংলার বিপ্লবী কবি সুকান্ত ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না , তার বিখ্যাত আগামী কবিতায় লিখেছেন ;

আগামী (সংক্ষিপ্ত রূপ )

 জড় নই , মৃত নই , নই অন্ধকারের খনিজ , আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে …………. দেখেছি আলোর আনাগোনা, শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা……………অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে জানি তারা মুখবিত হবে নব অরণ্যের গানে আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে ;………. মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি …… একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন

 তার ৫০ বছর পর, স্বাধীন বাঙলার অন্যতম প্রধান কবি, হুমায়ুন আজাদ ,যার কাব্যসমগ্রে পাওয়া যায় তার সময়ের শ্রেষ্ঠ আবেগ, উপলব্ধি, কামনা, বসনা, ও সৌন্দর্য্যবোধ; তিনি দেশ ও সমাজের বর্তমান অবস্থায় ,তার হৃদয় তিক্ততায় ভরে ওঠেছিলো, তবু তিনি নিরাশ না হয়ে, আশাবাদ ব্যক্ত করে ,যে কবিতা লেখেছিলন ভবিষ্যত প্রজন্মে জন্যে, তার কিছু অংশ প্রকাশ করা হলো

 বেশী কাজ বাকি নেই বেশী কাজ বাকি নেই;

যতোটুকু বাকি বেলা পড়ার আগেই শেষ করে উঠতে হবে
তবে খুব তাড়া নেই, যদি শেষ করেউঠতে না পারি,
থেকে যাবে, ওরা আমার বা নিজেদের হয়ে সম্পন্ন করবে,
 ওদের যতোই বকি তবু ভার দিয়ে যেতে হবে ওদের ওপরই
নিজের সমস্ত কাজ কখনোই কেউ শেষ করে উঠতে পারেনা
 যদি শেষ করেউঠতে না পারি ভারি হয়ে উঠবে না বুক;
দুপুর পর্যন্ত যতোই অসন্তোষ, তারপর শুধু নিরুদ্বেগে কাজ করে যাওয়া

………………..আমাকে থাকবে ঘিরে গোধুলির খুরের শব্দ পাখিদের স্বর উত্তরের জমির
গন্ধ রাতের আকাশ অসমাপ্ত অশেষ সুন্দর

 হুমায়ুন আজাদ 

 হুমায়ুন আজাদ 
আগুনের ছুঁয়া 

আজ থেকে শত বছর আগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , তার পরশ মনি কবিতায়;
মানব জীবনকে ধন্য ও পবিত্র করতে চেয়ে, মানুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে, মানুষকে দেবালয়ের প্রদীপ করতেও চেয়েছিলেনতখন মানব সভ্যতা ও সমাজ এত সংকটে পড়েনি;
তাই হয়তো মানুষ্যত্বকেই বড়ো করে দেখেছেন ? 

আজ তার ১০০ বছর পর, বাঙলাদেশের প্রধান বহুমাত্রিক লেখক, হূমায়ুন আজাদ, যার কাছে কবিতা ;সৌন্দর্য্যের বিরামহীন বিস্তার, ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, তিনি বর্তমান নষ্ট , ভ্রষ্ট , সমাজ ও সভ্যতাকে জ্বেলে, পুড়ে সংশুদ্ব ও মুক্ত করতে , নিজকে প্রতিকী আগুনে রূপান্তরিত করে যে কবিতা লিখেছেন,

 আগ্রহীদের জন্য তা প্রকাশ করা হলো  

আগুনের ছোঁয়া 

আমি ছুঁলে বরফের টুকরোও জ্বলে ওঠে দপ করে  
আমি ছুঁলে গোলাপের কুঁড়ি জ্বলে ,
সারা রাত জ্বলতে থাকে আগুন-গোলাপ  
বনে গেলে শুরু হয় লাল দাবানল
পায়ের ঘষায় বারুদস্ত্তপের মতো লেলিহান 
হয়ে ওঠে সুসজ্জিত মন্ঞ্চ
আমি ছুঁলে তোমার শরীর জুড়ে 
দাউদাউ জ্বলে প্রাচীনতম ঘাসের আগুন
ছুঁয়েছি গোলাপ - কুঁড়ি, বরফটুকরো. 
বনের সবুজ ত্বক, সাজানো মঞ্চ, 
আর স্বপ্ন তোমাকে ছুঁয়েছি  
সাধ আছে ছুঁয়ে যাব নষ্ট সভ্যতাকে, 
যাতে এই ভেজাল বস্ত্ত 
পেট্রলপাম্পের মতো ভয়াবহভাবে জ্বলে ওঠে
                                      
হুমায়ুন  আজাদ
                     

 “ 
এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না আকাশশব্দটার মানে
চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোন বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না
তারা গর্জন বিলাসী … ’সুনীল.....







তারা বলে পৃথিবী ভরে গেছে পাপে, আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহ্য় 
তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধু প্রার্থনা 

উনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ কবি, ইলিঅট তার বিখ্যাত কবিতা , 

“ THE ROCK”

কবিতায় লিখেছিলেন;
I journeyed to London ……where I was told ; we have too many Churches, and too few Chop Houses, কবি তার কবিতায় উপাসনালয়ের একটা স্থান নির্দ্ধারণ করে লিখেছিলেন; 

……. “ The country (side) now is only fit for Picnics,……and in Town only for important Wedding ;”

উপাসনালয়ের দরকার যেখানে তারা রোববর কাটায়; 

বর্তমানে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে যে ভাবে ধর্ম ও মৌলোবাদের প্রসার ঘটেছে, আজ থেকে প্রায় ১৫ বৎসর পূর্বেই দুরদৃস্টি সম্পূর্ণ ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ উপরের লাইনগুলো তার যে কবিতায় লেখেছিলেন, আগ্রহী পাঠকদের জন্য নিম্নে প্রকাশ করা হলো  

প্রার্থনালয়

ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম 
তিরিশ বছর পর দেখি সেখানে একটি মসজিদ উঠেছে 
আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে কোথায় ? 
তারা বলে ছেলেরা এখন খেলে না, মসজিদে পাঁচবেলা নামাজ পড়ে 
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুড়িগঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে 
যেখানে একঘন্টা পরস্পরের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিলাম আমি আর মরিয়ম, 
গিয়ে দেখি সৌদি সাহায্যে সেখানে একটা লাল ইটের মসজিদ উঠেছে
কোথাও নিস্পলক দৃষ্টি নেই চারদিকে জোব্বা আর আলখাল্লা   
  পঁচিশ বছর আগে বোম্বাই সমুদ্র পারে এক সেমিনারে গিয়ে 
যেখানে আমরা সারা রাত নেচেছিলাম আর পান করেছিলাম আর নেচেছিলাম,
১৯৯৫- এ গিয়ে দেখি সেখানে এক মস্ত মন্দির উঠেছে  
দিকে দিকে নগ্ন সন্ন্যাসী, রাম আর সীতা, সংখ্যাহীন হনুমান ;
নাচ আর পান সম্পূর্ণ নাষিদ্ধ
ফার্থ অফ ফোর্থের তীরের বনভূমিতে যেখানে সজ্যান আমাকে 
জড়িয়ে ধরে বাড়িয়ে দিয়েছিলো লাল ঠোঁট, 
সেখানে গিয়ে দেখি মাথা তুলেছে এক গগনভেদি গির্জা 
বনভূমি ঢেকে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলেছে এক ক্রুদ্ধ ক্রুশকাঠ  
আমি জিজ্ঞেস করি কেনো দিকে দিকে এতো প্রার্থনালয় ?
কেন খেলার মাঠ নেই গ্রামে ?
কেন নদীর ধারে নিস্পলক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার স্থান নেই ? 
কেন জায়গা নেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের ? 
কেন জায়গা নেই নাচ গানের ? 
তারা বলে পৃথিবী ভরে গেছে পাপে,আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহ্য় 
তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধু প্রর্থনা

চারদকে তকিয়ে আমি অজস্র শক্তীশালী মুখমন্ডল দেখতে পাই, 
তখন আর একথা অস্বীকার করতে পারি না  
                                                   
হুমায়ুন   আজাদ




রাজনীতিবিদগন 


বহুমাত্রিক লেখক , হুমায়ুন আজাদ, সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী, তার লেখার বিষয়বস্তু ও ব্যাপক; তিনি প্রকৃতি , দেশ, সমাজ, জাতি ধর্ম, বর্ন, ও মুক্তিযুদ্ধা সহ সব বিষয়েই কলম ধরেছেন, তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, এমনকি কবি শামসুর রহমানকে নিয়ে ও লিখেছেন এখানে রাজনীতিকদের নিয়ে তার লেখা একটি কবিতা; -

রাজনীতিবিদগন 


যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ  
ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায় 
মেঘ পাতা সবুজ শিশির আমার সামনে থেকে মুছে যায় 
গাছপালা রোদ শিশু,জোনাকির সামান্য আলোক  
চর পড়ে নদী জুড়ে ,ছাইয়ে ঢাকে ধানক্ষেত মধুমতি মেঘনার তীর 
যখন তাদের দেখি মনে হয় কোনো দিন 
জড়িয়ে ধরি নি কাউকে, চিরকাল দিকে দিকে খুঁড়েছি কবর, 
শুধু খুলি উঠে আসে দুই হাতে অঢেল মাটির তলদেশ থেকে, 
পাই নি ফুলের গন্ধ অন্ধকারে; পরিচিত শুধু ঘৃণা, মহামারী, জ্বর 
লেলিহান লাল রক্তে চাপা পড়ে চাঁদ আর সূর্যের আকাশ 
যখন তাদের দেখি অবিরাম বজ্রপাত হয় নিল থেকে 
পোকা জন্মে আম্রফলে, শবরিতে; ইক্ষুর শরীর ভরে কালান্তর বিষে,
চে ওঠে পাকা ধান,পঙ্গপাল মেতে ওঠে আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে, 
ভেসে ওঠে মরা মাছ , বিছানায় বিষাক্ত সাপ ওঠে এঁকেবেঁকে 
স্বপ্নাতুর দুই ঠোঁট ভরে ওঠে মরারক্তে- ঘনীভূত পুজে 
যখন তাদের দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চষীদের মেয়েদের 
বিব্রত আচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয় খুন, লুঠ,সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ, 
ভেঙ্গে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্টা সমস্ত গ্রন্থের; 
ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল, 
আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনিতিবিদগন  



সে তুমি কেমন করে, বাঙলা, সে তুমি কেমন করে 
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োরকুকুর ?” 

না , এ কথাগুলো অন্য কারো নয়, সমাজের ও দেশের নস্ট পরিবর্তন গুলো উপলব্ধি করে , ১৯৯০ সালেই কবি হুমায়ুন আজাদ, প্রৃকৃতির কাছে, বঙ্গমাতার কাছে , প্রশ্ন রেখেছিলেন, যে কবিতায়, তা ;-
 
যে তুমি ফোটাও ফুল 


যে তুমি ফোটাও ও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ 
জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ 
কুমডোর সুস্বাদ , যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম 
কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলায় গুচ্ছগুচ্ছ জাম ,
যে তুমি বহাও নদী , পাললিক নদীর ভেতরে 
লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে ,
যে তুমি উঠাও চাঁদ মেঘ ছিড়ে নীলাকাশ জুড়ে 
বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকির অজস্র নুপুরে , 
যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে 
বলিকার সারা দেহ ভরে দাও তলেতিলে রূপে 
আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে ,
যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভীর ওলানে 
খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী 
আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ- করে তোলো কবি, 
যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-
সে তুমি কেমন করে, বাঙলা , সে তুমি কেমন করে 
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োরকুকুর ?









 


আমি আর কিছুই বলবো না 

যা ইচ্ছে করো তোমরা আমি আর কিছুই বলবো না ,
রক্তে সাজাও উঠোন, শিরশ্ছেদ করো জনকের, 
কন্যাকে পীড়ন করো, আমি আর কিছুই বলবো না  
বাইরে বাগান করে অভ্যন্তরে কুটিল গোখরা ছাড়ো, 
বান্ধবের পানীয়তে মেশাও বিষ,সৌন্দর্য ধর্ষণ করো, 
আমি আর কিছুই বলবো নাসত্যের বন্দনা করো দিবালোকে, 
মিথ্যার মন্দিরে গিয়ে পড়ে থাকো নষ্ট আঁধারের নিপুণ আশয়ে, 
মন্ঞ্চে স্তব করো মানুষের আর শাণাও কুঠার সংগোপন ষড়যন্ত্রে ,
আমি আর কছুই বলবো না  
পাঠ করো কপটতা , দিনে দানবকে দুয়ো দাও , রাতে বসো পদোতলে, 
আমি আর কিছুই বলবোনাদেখবো শিশুর মুখ বৃষ্টিধারা পাখির উড়াল 
আথবা দু-চোখ উপড়ে মুখ ঘষবো সুগন্ধী মাটিতে হুমায়ুন আজাদ 
আমি বেঁচে ছিলাম আন্যদের সময়ে , থেকে

কাব্যগ্রন্থ
কথা দিয়েছিলাম তোমাকে থেকে 
, হুমায়ুন আজাদ 

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে 

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাব 
পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণচাঁদ ভাটিয়ালি 
গান উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধের ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম 
জলের অনন্ত বেগ রুইমাছ পথপাশে শাদা ফুল অবনত গাছ 
আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি 
তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি নষ্ট ফলে দুষ্ট কীট 
ধানের ভেতরে পুঁজ টায়ারের পোড়া গন্ধ পম্কিল তরমুজ 
দুঃস্বপ্নআক্রান্ত রাত আলকাতরার ঘ্রাণ ভাঙা জলজান অধঃপাত 
সড়কে ময়লা রক্ত পরিত্যক্ত ভ্রুণ পথনারি বিবস্ত্র ভিকারি 
শুকনো নদী হন্তারক বিষ আবর্জনা পরাক্রান্ত সিফিলিস 
কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাবো 
নিকোনো শহর গলি লোকোত্তর পদাবলি রঙের প্রতিভা 
মানবিক গূঢ় সোনা অসম্ভব সুত্রে বোনা স্বাধীনতা শুভ্র স্বাধিকার 
অন্তরঙ্গ অক্ষরবূত্ত দ্যুতিময় মিল লয় জীবনের আনন্দনিকিল 
গাঢ় আলিঙ্গন সুবাতাস সময়ের অমল নিশ্বাস 

তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি নোংরা বস্তি সৈন্যাবাস 
বর্বর চিৎকার বুট রাস্ট্রধর্ম তেলাপোকা মধ্যযুগ অন্ধ শিরস্ত্রান 
মৌলবাদ রেখে যাচ্ছি মরণাস্ত্র আততায়ীর উল্লাস পোড়া ঘাস সন্ত্রাস 
মরছে-পড়া মাংস রেখে যাচ্ছি কালরাত্রি সান্ধ্য আইন অনধিকার 
সমুহ পতন খাদ তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি অসংখ্য জল্লাদ 

তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষির প্রশ্ন 


হুয়ায়ুন আজাদের কাব্য সমগ্র এর একটি কবিতা তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন 

আগাছা ছাড়াই, আল বাধি, জমি চাষি, মই দেই, 
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনা আকাশের দিকে 
ঘাম ঢালি খেত ভরে, আসলে রক্ত ই ঢেলে দেই নোনা পানি রূপে; 
অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলে খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন 
খরা ,বৃষ্টি, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে প্রকৃতির কৃপা হলে এক সময় 
মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের  
এতো ঘামে , নিজকে ধানের মতোই সেদ্ধ করে ফলাই সামান্য এক মুঠো, 
গরিব শষ্যমুর্খ মানুষ, দুরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে 
দিনরাত লেফ-রাইট লেফ- রাইট করলে কমন শষ্য ফলে এক গণ্ডা জমিতে 

মন্তব্যসমূহ