বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহাজগত এবং গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদির সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ইতিহাস প্রসঙ্গে কিছু কথা ;-



        বিজ্ঞানের  দৃষ্টিতে  মানুষের  বিশ্বাস  ও  মহাজাগতিক  ভাবনা  প্রসঙ্গে  ;-

  বিজ্ঞানের এই অসাধারণ যুগে মানুষ যখন সৌরলোক পেরিয়ে ঢুকতে চলেছে মহাজগতে , তখন বিশ্বের কিছু মানুষ মেতে উঠেছে মধ্যযুগীয় বিশ্বাসে ; শক্তিলোভী কিছু ভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং ভ্রষ্ট রাজনীতিকেরা মানুষকে আক্রান্ত ক’রে তুলছে  মহাজাগতিক     বিশ্বাসের রোগে ।

      এখন  এক বড়ো অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে , যারা অন্ধ তারা চোখে সবচেয়ে বেশী দেখতে তো পাচ্ছেই , তারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের মহামারী । আর এই বিশ্বাস শুধু অতিমানবিক সত্তায়ই সীমাবদ্ধ নয় : হাজার হাজার বছরের শূন্য প্রথা  বিশ্বাস ক’রে চলেছে তারা , যা সমাজ ও সভ্যতা বিকাশের জন্যে খূবই ক্ষতিকর । বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ও সব পেশার মানুষই বিশ্বাসী । তারা যেমন বিধাতায় বিশ্বাস করেন ,তেমনি প্রথায় বিশ্বাস করেন । আবার ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন ,পদে ও অর্থে বিশ্বাস করেন , তারা কোনো কিছু অবিশ্বাস করার মতো প্রতিভা ধারণ করেন না । যারা পারেন তাদেরকে নাস্তিকে পরিনত করে তাদের মূখ বন্ধ করে দেওয়া হয় চিরতরে ,এই জগত থেকে সরিয়ে দিয়ে হলেও । যারা অবিশ্বাসী , তাদের অবিশ্বাস শুধু অতিমানবিক সত্তায় অবিশ্বাস নয় ,তাদের অবিশ্বাস এর থেকে অনেক গভীরে ; তারা অবিশ্বাস করেন এ-সভ্যতার প্রায় সমস্ত প্রচারে , সব কিছুকে তারা বিচার বিবেচনা করে গ্রহন করতে চান । মানুষ সমাজে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেই, সমাজ ও সভ্যতা  ‘ আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন’ থেকে মুক্তি পাবে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন ।

       তবে বিশ্বজগত এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর । গত তিন শতকে বিজ্ঞান পৃথিবীকে মহাজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে  দিয়েছে এক গৌণ এলাকায় , মানব সভ্যতা মহাজগতকে  এখন এক বদ্ধ  এলাকায়  বদলে ক’রে তুলেছে অনন্ত ; মানুষ এখন আর কড়কড়ে মাটি থেকে তৈরি নয় । মানুষের তৈরি হয়েছে দীর্ঘ এক প্রাকৃতিক  প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, বিবর্তনের  ফলে । যা বিজ্ঞান তার দীর্ঘ গবেষণায় আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে ।

       কিন্তু মানুষের চেতনার বিশেষ বদল ঘটে নি । মানুষ আজো আদিম । মানুষের চোখে আজো সব কিছুই অলৌকিক রহস্যে পরিপূর্ণ ; আকাশে আজো তারা অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ বা নিরন্তর বিস্ফোরিত গ্যাসকুণ্ডের বদলে দেখতে পায় বিভিন্ন বিধাতা ; দেখতে পায় মনোরম স্বর্গ আর ভীতিকর নরক ।  সভ্যতার কয়েক হাজার বছরে মানুষ মহাজগতকে উদঘাটিত করার বদলে তাকে পরিপূর্ণ করেছে অজস্র রহস্যে , আর ধারাবাহিকভাবে ক’রে চলছে বিশ্বের রহস্যীকরণ ; বা সত্যের অসত্যীকরণ । মহাজগতের রহস্যীকরণে অংশ নিয়েছে মানুষের প্রতিভার সব কিছু ; পুরাণ , ধর্ম , দর্শন , সাহিত্য , শিল্পকলা ,এবং আর যা কিছু আছে । তার শক্তির সব কিছুই মানুষ ব্যবহার করেছে মহাজগতকে রহস্যে ভ’রে তুলতে ;তাকে পরিচিত করার বদলে করেছে অপরিচিত , আলোকিত করার বদলে করেছে তমসাচ্ছন্ন । আদিম মানুষ রহস্যীকরণ শুরু করেছিলো না বুঝে, তাদের কোনো দুরভিসন্ধি ছিলো না , তারা তখন ভূল পথে গিয়েছিল । মহাজগতের রহস্যীকরণে ধর্ম নেয় প্রধান ভূমিকা ; তার কাজ হয়ে ওঠে রহস্যবিধিবদ্ধকরণ ,আলো সরিয়ে অন্ধকার ছড়ানো, মানুষের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করা সে-সব সম্বন্ধে, যা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন । যা মানুষের জন্যে এখন সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে প্রমানিত হয়েছে  । এখন  এই অন্ধ বিশ্বাস  ও অলৌকিক রহস্য থেকে মানব সমাজকে উদ্ধার করা  অর্থাৎ দরকার মহাজগতের বিরহস্যীকরণের , যা মানুষের জন্যে অত্যধিক ক্ষতিকর হিসাবে প্রমানিত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য । বিশ্বাস থেকে কখনো জ্ঞানের বিকাশ ঘটে না ; জ্ঞানের বিকাশ ঘটে অবিশ্বাস থেকে , প্রথাগত সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীনভাবে না মেনে  তা  পরীক্ষা করার উৎসাহ থেকে । রাজনীতিবিদেরা আজ মেতে উঠেছে বিশ্বাস ও মিথ্যের প্রতিযোগিতায় ; তারা বাংলাদেশ সহ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর মানবগোত্র ৷

          প্রসঙ্গক্রমে উল্লখযোগ্য যে বৌদ্ধরা বলেন যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কেহ নেই ;জগত অনন্ত কাল থেকে বিদ্যমান আছে এবং থাকবে । চিরকালই বিশ্বের আকৃতি
একরূপ আছে এবং থাকবে ….তাই অন্যান্য ধর্ম প্রবর্তকের থেকে তার চিন্তা চেতনার তফাৎ ছিল, বলেই হয়তো নিম্নের কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন ,গৌতম বৌদ্ধ ?

Do not believe in anything simply because you have heard it. Do not believe in anything simply because it is spoken and rumored by many. Do not believe in anything simply because it is found written in your religious books. Do not believe in anything merely on the authority of your teachers and elders. Do not believe in traditions because they have been handed down for many generations. But after observation and analysis, when you find that anything agrees with reason and is conducive to the good and benefit of one and all, then accept it and live up to it.

- Siddhartha Goutama Buddha.
     
     মানুষ কোন মহাপরিকল্পনার অংশ নয় । কেউ মানুষকে মহাপরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করে নি । একরাশ প্রাকৃতির ক্রিয়ার ফলে মানুষের জন্ম হয়েছে ,আবার অন্য একরাশ প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে আমাদের একের জনের মৃত্যু হবে প্রাকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে অনুসারেই।
এ তে সন্দেহের কোনো কারণ নেই । মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলার জন্যে পূর্ব নির্ধারিত কোনো উপায় নেই , কোন পবিত্র গ্রন্থ বা কোন মহাপূরুষ বা কোন প্রবর্তক মানুষকে কোন সঠিক পথ দেখাতে পারেন না । তবে তারা নিজেরা নিজেদের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার পথ খুঁজেছেন মাত্র ।
          ধর্মীয় বিশ্বাস বা বিধাতায় বিশ্বাস আদিম মানুষের কল্পনার ফল । ঐ বিশ্বাস মানুষকে কোন সাহায্য করতে পারে না , তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে পারেনা জীবনকে ; বরং জীবনকে ক’রে তোলে মিথ্যায় পূর্ণ । নির্বোধ/ অন্ধ / লোভী / কপট / ভীতরাই শুধু তাতে শান্তি পেতে পারে ; ভাবতে পারে ,নিজদের জীবন অর্থপূর্ণ বলে । পরলোকে বাস্তবে কোন দুর্দান্ত কামনাঘন বিলাসপূর্ণ  জীবন তাদের জন্যে অপেক্ষা করে নেই । মানুষ তার সমস্যার সমাধান চাইতে গিয়ে জাগিয়ে তোলে নিরর্থকতার । তাই এই নিরর্থকতাকে এড়াতে পারে না মানুষ, যতোদিন সে জীবিত থাকে । ফলে মানুষ এই নিরর্থকতাকে অতিক্রম করার কোন উপায় দেখে না , কেননা বেঁচে থাকাই হচ্ছে নিরর্থকতা; আর দার্শনিক কামু একথা তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছেন ।  তার মতে মানুষের অস্তিত্ব হচ্ছে      ‘চূড়ান্ত  আশাহীনতা’ ।

    জন্ম নিয়েই মানুষ দেখেছে তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে পৃর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন বিশ্বাসের জগত । বিশ্বাসী হওয়া প্রশংসিত ব্যাপার ; প্রথাগতভাবে ভালো মানুষ , সৎ মানুষ বলতেই বোঝায় বিশ্বাসী মানুষ ।  তাই বিশ্বাসী মানুষরা ভালো , সৎ , এমনকি মহৎ । 

      পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী মহামারীর নাম বিশ্বাস ,আর এই বিশ্বাস কয়েক হাজার বছর ধ’রে দেখা দিয়েছে মহামারীরূপে । মানুষের বিশ্বাষের শেষ নেই ,কোটি কোটি বিশ্বাস পোষণ করে মানুষ , তবে সেগুলো চিরকাল ধ’রে চলছে ,তা কিন্তু ঠিক নয় , এখনকার বিশ্বাসগুলোর বয়স খুব বেশি নয় , এগুলোর আগে লাখ লাখ বিশ্বাসের উদ্ভব  ও  বিনাশ  ঘটেছে ;  দেবতা  বা  ঈশ্বর  বা  বিধাতা  বা  কোনো  বিশেষ  স্রষ্টায় বিশ্বাস মাত্র চার/পাঁচ হাজার বছরের ,  কিন্তু মানুষের বয়স তাদের বিভিন্ন ধরনের দেবতার বা বিধাতাদের বয়সের থেকে অনেক বেশি । বিশ্বাসের সাথে অন্ধকারের সম্পর্ক গভীর ,বিশ্বাস অন্ধকারের আত্মজ ; আলোর সাথে তার সম্পর্ক কম বা একবারেই নেই ।  বিশ্ব জগত মানুষের কাছে অন্ধকার ঘর বা রহস্যময় রাতের মতো । বিশ্বাসের কোনো শেষ নেই । এবং বিশ্বাসগুলো পরস্পরবিরোধী । আর এই বিশ্বাসের এবং এই মহাবিশ্বের রহস্যীকরণে সরচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে ধর্ম ; এবং ধর্ম সব কিছুকে গ্রাস ক’রে মানবপ্রতিভার সব কিছুকে বাধ্য ও উৎসাহিত করেছে বিশ্বের রহস্যীকরণে অংশ নিতে ।  বিশ্বাসের সম্পর্ক ইন্দ্রজালের সাথে ,বিজ্ঞানের সাথে নয় ; এখনও মানুষ বিজ্ঞান দিয়ে আলোকিত নয় । পুরোনো মহাপুরুষেরা তুচ্ছ যাদুর বেশি কিছু করতে পারেন নি ,প্রকূত বিস্ময়কর কাজ করেছে আধুনিক মানুষ, বিজ্ঞানের  জ্ঞান সম্পন্ন  আধুনিক মানুষ । এর কারণ-পবিত্র ব’লে বিখ্যাত গ্রন্থগুলোতে আলো বা জ্ঞান নেই , আলো আর জ্ঞান আছে সে-বইগুলোতে , বিশ্বাসীদের চোখে যেগুলো আজও অপবিত্র ।

      পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আজো  বাসকরে মহাজাগতিক অন্ধকারে । আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবে স্বর্গ আর নরকের কথা ; তখন তারা কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে , আর সুখীহয় স্বর্গের আরাম ও বিলাসের কথা ভেবে । আর এর সবটাই ঘটেছে পৃথিবী ও মহাজগত সম্পর্কে ভূল ধারণার ফলে ।

      ১৬৩৩ সালে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে-এই সত্য কথাটি বলার অপরাধে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা  হয়েছিল , বাইবেল তথা ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করার অপরাধে ।  এই ভাবে আরো অনেক জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী ও দার্শনিক  তাদের সত্য বক্তব্য প্রকাশ করায় ,ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মূত্যুদণ্ড সহ অন্যান্য শাস্তি প্রদান করা হয়েছে । তবু জ্ঞান বিজ্ঞানের আবিষ্কার থেমে থাকেনি । ফলে আমরা এই আধুনিক পৃথিবীর সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারছি ।  

     মহাজগতের সৃষ্টি নিয়ে ধর্মের ব্যাখ্যাসমূহ অস্বীকার করে মহাবিজ্ঞানীরা তাদের     সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে বলেছেন যে , পূর্বের ধারণা বিগব্যাঙ দিয়ে মহাবিশ্বের শুরু নয়, বরং মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে ইনফ্লেশন দিয়ে ।  অর্থাৎ ইনফ্লেশনের ফলশ্রুতিতেই কিন্তু বিগব্যাঙ হয়েছে ,তার পর সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই মহাবিশ্ব । Andrei  Linde তার Self Reproducing Inflationery Universe গ্রন্থে (1998 ) লিখেছেন-‘ Inflation is not a part of big- bang theory as we thought 15 years ago . On the contrary , the big-bang is the part of inflationary model’  আর্থাৎ এতদিন আমরা ‘ অন্ধের হস্তি দর্শন’ গল্পের মতো মহাজগতকে কল্পনা করেছি বিভিন্ন ভাবে , ধর্ম গুরুদের বর্নণা অনুসারে। 
            
           এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুসারে মহাজগত বা মহাবিশ্ব অনন্ত । আর এই অনন্ত মহাজগতের বিশাল এলাকায় আমাদের পৃথিবী একটি ছোট্র চর বা দ্বীপ মাত্র । যার নাম রেখেছি  আমরা পৃথিবী । এটা তারা নয় , এটি একটি গ্রহ , তবে এটি একটি তারাকে ঘিরে ঘুরছে ,  যে তারাটির নাম সূর্য । এই সূর্যকে ঘিরে যে এলাকাটুকু , সেখানে ঘুরছে কয়েকটি  গ্রহ , আর তার নাম সৌরজগত ।  

       গত কয়েক শতকের জ্যোর্তিবিজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে পূর্বেকার রহস্যময় মহাজগতের রূপ আমূল বদলে গেছে মানুষের চোখে । আজ বিজ্ঞানীরা মহাজগতের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে  সমর্থ্য হয়েছেন ।  পূর্বে বিভিন্ন দেশের ধর্মের বইগুলোতে মহাজগতের উৎপত্তির যে গল্প পাওয়া যায় , তা বিশ্ব সৃষ্টি সম্বন্ধে আদিম মানুষের  অবিকশিত চিন্তা ও কল্পনার রূপ কথা মাত্র । তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই । কেননা তাদের কল্পনার ও সীমা ছিল সীমিত, তারা তখনও তাদের কল্পনায় বৈজ্ঞানিক কল্পনার রীতির বিকাশ ঘটতে পারেনি। তাই  তারা আকাশে বিচিত্র রকমের দেবদেবীর উপস্থিতি কল্পনা করে সেগুলোকেই সত্য বলে প্রচার করেছেন এবং তা চাপিয়ে দিয়ে গেছেন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ মানুষের উপর । 
    
         মহাজগত এতো বিশাল যে আমাদের প্রতিদিনের মানদণ্ডে , মাইল বা কিলোমিটারে তার আয়তন পরিমাপ করা সম্ভব নয় । মহাজগতকে পরিমাপ করা হয় আলোর গতির মানদণ্ডে ।  আলো এক সেকেন্ডে যায় ১৮৬০০০ মাইল বা প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার । সে হিসাবে  সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে আট মিনিট সময় ; অর্থাৎ সূর্য থেকে পৃথিবীর দুরত্ব আট আলোক মিনিট ।  এক বছরে আলো যায় ছয় ট্রিলিঅন মাইল । ট্রিলিঅন হচ্ছে একলক্ষ কোটি ; তাই আলো বছরে যায় ছয় লক্ষ কোটি মাইল । অর্থাৎ আলো এক বছরে যে দুরত্ব ভ্রমণ করে , সে একককে বলা হয় আলোকবর্য । আলোকবর্ষের সাহায্যে মাপা হয় দূরত্ব, সময় নয় । 

       মহাজগতে পৃথিবীর মত অনেক স্থান রয়েছে । সে স্থানগুলো আবার বায়ু শূন্য, মহাজগত এক বিশাল শীতল আর অনন্ত মহাশূন্যতা, যার এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আরেক  নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানে বিরাজ করেছে চিরঅমারাত্রী,  ওই শূন্যস্থানে অন্ধকার শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই । নক্ষত্রপুঞ্জ গঠিত - গ্যাস , ধুলো , আর নক্ষত্র বা তারায় । প্রতিটি নক্ষত্রপুঞ্জে রয়েছে কোটি কোটি তারকা । সূর্য একটি তারা বা নক্ষত্র । নক্ষত্রপুঞ্জের কোটি কোটি তারার প্রত্যেকটির থাকতে পারে গ্রহ  ; আর ওই গ্রহের কাছে প্রতিটি তারাই সূর্য ।  আবার ওই সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে কয়েকটি গ্রহ , গড়ে উঠেছে সৌরলোক ; প্রতিটি নক্ষত্র বা সূর্যকে ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে এমন আরো সৌরলোক ।

      মহাজগতে নক্ষত্রপুঞ্জের সংখ্যা কয়েকশো বিলিঅন , আর প্রত্যেক নক্ষত্রপুক্ষে আছে গড়ে ১০০ বিলিঅন নক্ষত্র । প্রত্যেক নক্ষত্রপুঞ্জে যতোগুলো তারা আছে ,অন্তত ততোগুলো গ্রহ থাকার কথা । মহাজগতে থাকার কথা দশ বিলিঅন  ট্রিলিঅন গ্রহ । এমন অসংখ্য সৌরলোকের একটি সৌরলোকের একটি গ্রহেই শুধু রয়েছে মানষ । অন্য গ্রহে ও থাকতে পারে কোন বুদ্ধিমান প্রাণী যার আবিষ্কার এখন ও মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি । তাই পৃথিবী একটি মহাজাগতিক চর বা দ্বীপ । যেখানে উৎপত্তি হয়েছে এক বুদ্ধিমান প্রাণীর , আর এ প্রাণীর নাম মানুষ । এটা কোনো রহস্য নয় , এখানে ঘটেছে এমন কিছু মহাজগতিক ঘঠনা ,যার ফলে পৃথিবীতে ই উদ্ভূত হ’তে পেরেছে পশু , সরীসৃপ আর উদ্ভিত ইত্যাদির ।


        নক্ষত্রপুঞ্জগুলো একই রকমের নয় ,আকৃতি অনুসারে এগুলো তিন রকম ;  ১ .কুণ্ডলপাকানো নক্ষত্রপুঞ্জ  , ২ . উপবৃত্তকার নক্ষত্রপুঞ্জ  , এবং  ৩ . এলোমেলো নক্ষত্রপুঞ্জ ।   আমরা কুণ্ডলপাকানো নক্ষত্রপুঞ্জের অন্তর্ভূক্ত , যার কুণ্ডল ধীরেধীরে নড়ছে । আর তার নাম   মিল্কি  ওয়ে  গ্যালাক্সি । আমাদের নিকটবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জগুলো আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আট বিলিঅন আলোকবর্ষ দূরে আছে । আর প্রায় বিশটি নক্ষত্রপুঞ্জের সমষ্টি এগুলো , আর ছড়িয়ে আছে মিলিঅন আলোকবর্ষব্যাপী । এদের একটির নাম এম৩১ ।আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জে কোটি কোটি তারা আছে , এর মধ্যে কোনো   কোনোটি ছোটো, আবার কোনো কোনোটি কয়েক হাজার সূর্যের সমান । খুব ছোটোগুসো আবার সীসার থেকেও শত ট্রিলিঅন গুণ ঘনীভূত । আমাদের সূর্যের মত কোনো কোনো নক্ষত্র একলা ,তবে অধিকাংশ নক্ষত্রই যুগলবন্দী-একটি নক্ষত্র ঘুরছে আরেকটিকে ঘিরে । এর মধ্যে সুপারনোভা নামক তারাগুলো অত্যন্ত উজ্জ্বল ; ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর নামেরগুলো অন্ধকার । কোনোটি জ্বলে একই উজ্জ্বলতা নিয়ে , কোনোটা ঝিকিমিকি করে ; কোনো কোনোটি ঘোরে ধীরশান্তভাবে , কোনোটি ঘোরে পাগলের মতো । তারাদের রঙ অনুসারে শ্রেণী ভাগ করা হয় । যেমন নীল রঙয়ের তারা তরুণ ও গরম ; হলদে তারা মাঝবয়সী ; লাল তারা বুড়ো ও মুমূর্ষু ; আর ছোটো শাদা আর কালো তারাগুলো শিগগিরই মরবে । আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জে ঘোরাঘুরি করছে নানা ধরনের ৪০০ বিলিঅন তারা । তার মধ্যে আমাদের ভালো ক’রে চেনা  তারাটির নাম রেখেছি আমরা সূর্য ।

        আমাদের  সূর্যের সবচেয়ে দুর কক্ষপথে , সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে  বরফ ও শিলায় গঠিত বিশাল বিশাল  তুষারগোলক । যা ধূমকেতুর অন্তর্ভাগ হিসাবে পরিচিত । চলারপথে এগুলোর কোনো কোনোটি  কোনো কারণে সৌরলোকে ঢুকে পড়লে  সূর্যের তাপে বরফ উবে গিয়ে দেখা দেয় ধুমকেতু । তুষারগোলক থেকে একটু ভেতরে আছে গ্রহগুলো । গ্রহগুলো সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে অনেকটা বৃত্তাকার পথে । সূর্য থেকে সবচেয়ে দুরে  প্লুটো ,তার থেকে একটু ভেতরে, সূর্যের আরেকটুক কাছে আছে নেপটুন ,ইউরেনাস, স্যাটার্ন বা শনি ,এবং জুপিটার বা বৃহস্পতি । এগুলো গ্যাসের বিশ্ব , আর এগুলোকে ঘিরে ঘুরছে এদের তুষারিত চাঁদ বা উপগ্রহগুলো । সূর্যের আরো কাছাকাছি আছে লালগ্রহ মঙ্গল ,যাতে সারাক্ষণ চলছে অগ্ন্যুৎপাত । এর থেকে সূর্যের আরেকটুকু কাছে আমাদের নীল-শাদা পৃথিবী । বিশাল অনন্ত মহাবিশ্বে শুধু এখানেই বিকাশ ঘটেছে প্রাণের । পৃথিবীর আগে, সূর্যের কাছাকাছি ,আছে ভেনাস বা শুক্র ,আর মারকিউরি বা বুধ । 

             সূর্য একটি নক্ষত্র বা তারা ; এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র । সূর্য হাইড্রোজেন ও হেলিয়াম গ্যাসের এক বিশাল গোলক , এর ভেতরটি প্রচণ্ডভাবে জ্বলছে ; এর ভেতরের তাপ চার কোটি ডিগ্রি , আর বাইরের তাপ ছ-হাজার  ডিগ্রি । মহাজাগতিক গাস ও ধুলোর মহামেঘের বিপর্যয়ের ফলেই জন্ম নেয় নক্ষত্র ও গ্রহ । মেঘের ভেতরের গ্যাসের অনুরাশির সংঘর্যের ফলে তাপ বাড়ে ,হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে হেলিয়ামে পরিনত হতে থাকে ,এবং কোটি কোটি বছরে একেকটি তারার জন্ম হয় । দলে দলে তারা জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাজগতের দিকে দিকে । একই মেঘ থেকে জন্ম হয়েছিল সূর্য ও আরো কয়েকটি নক্ষত্রের , মহাজগতের অন্য কোথাও এখন আছে সূর্যের সহোদর নক্ষত্রগুলো । সূর্যের ভেতরে সারাক্ষণ চলছে বিস্ফোরণ , তার ফলে হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হচ্ছে হেলিয়ামে ; এজন্যেই সূর্য এতো উজ্জ্বল ।

            তবে হাইড্রোজেনের এই বিস্ফোরণ চিরকাল চলবে না , এক সময় তা ফুরিয়ে আসবেই । সূর্য ও অন্যান্য তারা কত কাল বাঁচবে, তা নির্ভর করে সেগুলোর উদ্ভবের সময়ের ভর বা বস্তুপরিমাপের ওপর । আজ থেকে পাঁচ বা ছয় বিলিঅন বছরের মধ্যে সূর্যের ভেতরের সব হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে যাবে  হেলিয়ামে , থাকবেনা কোনো হাইড্রোজেন ; তখন সূর্যের মাধ্যাকর্ষণে সূর্যের ভেতর ভাগের হেলিয়ামপূর্ণ এলাকাটি আরো ঘনীভূত হবে , তখন সূর্যের ভেতরের তাপ বেড়ে যাবে বহুগুণে ,সূর্যে দেখা দেবে তীব্র বিকিরণ । এর ফলে সূর্য আরো কিছুকাল , কয়েক লক্ষ বছর, ধ’রে জ্বলবে ।
            তখন সূর্যের এক বড়ো পরিবর্তন ঘটবে ।  তার বাইরের দিকটা প্রসারিত হয়ে শীতল হয়ে আসতে থাকবে । সূর্য তখন এক বিশাল লাল দানব নক্ষত্র হয়ে উঠবে । তার বাইরের এলাকাটি ভেতরের এলাকা থেকে এতো দূরবর্তী হবে যে বাইরের দিকে মাধ্যাকর্ষণ অত্যন্ত ক’মে যাবে । এর ফলে বাইরের অংশটি  বিভিন্ন দিকে প্লাবনের মতো বয়ে চলবে । তখন সূর্যের এই প্লাবনের ভেতরে হারিয়ে  যাবে বুধ ও শুক্র গ্রহ ; হয়তো পৃথিবীও। তখন সৌরজগতের শুরুর এলাকাটি ঢুকে যাবে সূর্যের ভেতর । অর্থাৎ আজ থেকে কয়েক বিলিঅন বছর পর পৃথিবীর শেষ দিনটির দেখা মিলবে এবং সেদিনই হবে পৃথিবীর শেষ বিশুদ্ধ দিন হয়তোবা । 
      
           সেদিনের পর সৃর্য লাল হবে ধীরেধীরে , ফেঁপে কাছাকাছি এসে যাবে পৃথিবীর । মেরু অজ্ঞলের বরফ গলে পৃথিবী জুড়ে বয়ে যাবে প্রবল বন্যা । প্রচণ্ড তাপে ওই জলরাশি পরিনত হবে বাষ্পে ,পৃথিবী ঘিরে দেখা দেবেঘন মেঘমণ্ডল ,যাতে বাধা পাবে সূর্যের রশ্মি । একটু বিলম্বিত হবে পৃথিবীর ধ্বংসের । তবে তাপে সব জল বাষ্পে পরিণত হবে এক সময় , পৃথিবীর জলবায়ু নিংশেষিত হয়ে মিশে যাবে মহাশূন্যে ,মহাপ্রলয় শুরু হবে । সূর্য ও পৃথিবী ধ্বংস হবে । তবে তখনো সূর্যের ভেতরে ও বাইরে ঘ’টে চলবে নানা বদল ;থেমে যাবে তার ভেতরের পারমাণবক বিক্রিয়া,  এবং বাড়বে সূর্যের আয়তন । সূর্য তারপর কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকবে মুমূর্ষ অবস্থায় ;  এরপর সূর্য হয়ে উঠবে একটি ছোটো তারা ,চরমরূপে ঘনীভূত হয়ে হবে প্রথমে হোয়াইট ডোআর্ফ বা শাদা বামন । এরপর শীতল হতে হতে শেষে এক মৃত কালো বামনে পরিণত হবে ।

      সূর্য ও পৃথিবী ধ্বংস হবে ,তবে মানুষ হয়ত ধ্বংস হবে না । তখন হয়তো মানুষেরও এতো বিবর্তন ঘটবে ,এত বিকশিত হবে তাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা যে তারা পৃথিবী ধ্বংসের অনেক আগেই হয়তো পাড়ি জমাবে অন্য কোনো গ্রহে ,বা নিজেদের জন্যে তৈরি ক’রে নেবে কোনো মহাজাগতিক বাসভূমি ।

        পৃথিবীর সব প্রাণীই গঠিত জৈব অণুতে ,যাতে কার্বনপরমাণু পালন করে কেন্দ্রীয় ভূমিকা । পৃথিবীতে যেসব প্রাণ দেখা দিয়েছে ,তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক । পৃথিবীতে আমাদের সকলের রয়েছে একই সাধারণ জৈবরসায়ন ; আমরা বহন করি একই সাধারণ বিবর্তনমূলক উত্তরাধিকার । আমরা ,সব প্রাণী , উদ্ভূত হয়েছি বিবর্তনের ফলে । তাই মানুষ কোনো স্বর্গচ্যুত অভিশপ্ত প্রাণী নয় । কড়কড়ে মাটি দিয়ে তৈরি ও নয় । মানুষ বিকশিত প্রাণী ;  বিবর্তন এখন প্রমাণিত সত্য । 

       মোটামুটি ৪.৬ বিলিঅন বছর আগে মহাজাগতিক গ্যাস ও ধুলো জমাট বেঁধে উৎপত্তি হয়েছিল পৃথিবীর । আর  চার বিলিঅন বছর আগে আদিম পৃথিবীর সমুদ্রে ও জলাশয়ে দেখা দিয়েছিল প্রাণ। নানা বিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কোটি কোটি বছরে বিকাশ ঘটেছে প্রাণের । প্রাণের মূলবীজ হচ্ছে ডিএনএ ,বা ডিঅক্সিরিবোনিউক্লেয়িক এসিড । ডিএনএ অণু দেখতে মুচড়ে কুণ্ডলিপাকানো মইয়ের মতো, যার ধাপগুলোর রয়েছে চারটি অংশ । ওগুলোতে রয়েছে জৈবসংকেত । একেক প্রাণীর জৈবসংকেত ভিন্ন অন্যটির থেকে। চার বিলিঅন বছর আগে পৃথিবী ভ’রে উঠেছিলো জীবন-অণুতে, শুরু হয়েছিল প্রাণের বিবর্তন  ; তারপর কোটি কোটি বছরে দেখা দিয়েছে এবং বিলীন হয়ে গেছে বহু ধরনের প্রাণ।   এক সময় পৃথিবীতে এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখা দিয়েছিল ,যা আজ নেই । এক সময় পৃথিবীতে ঘটে এক মহাবিস্ফোরণ ,তারপর থেকে প্রাণের বিকাশ ঘটতে থাকে দ্রুত । দেখা দিতে থাকে মাছ ,মেরুদণ্ডী প্রাণী ; ভূমিতে জন্ম নিতে থাকে গাছপালা ; জন্মে সরীসৃপ , ডাইনোসর ,স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি ,এবং ফোটে ফুল । এক সময় লোপ পায় ডাইনোসররা ; দেখা দেয় প্রইমেট বা উচ্চ মেরুদণ্ডী প্রাণীরা ,   যারা বানর আর মানুষের পূর্বপুরুষ । আজ থেকে এক কোটি বছরের মতো সময় আগে উদ্ভূত হয় মানুষের পূর্ব-পূর্ব পূর্ব- পূর্বপুরুষের, তাদের মস্তিষ্কও হয় বিকশিত ; আর কয়েক মিলিঅন(৩০ থকে ৫০ হাজার বছর ) বছর আগে দেখা দেয় আদিমানুষেরা । ধর্মের বইগুলোতে মানুষ সৃষ্টির কাহিনি অত্যন্ত সরল ;অতো সরলভাবে অতো অল্প সময়ে মানুষ সৃষ্টি হয় নি । প্রাণ থেকে প্রণী সৃষ্টি করতে প্রকৃতির লেগেছে দীর্ঘ সময় ; আর এটাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। ৷
   সূত্র;-হুমায়ুন  আজাদ 
     আমার অবিশ্বাস ,

মন্তব্যসমূহ