নারীজাতির অবরোধ প্রথা ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


           সমাজবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ থেকে নারীজাতির অবরোধ প্রথা ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা  :
                                ( প্রথম  পর্ব  )

            নারীদের গৃহে আবদ্ধ থাকা  বা  নারীদের  ঘরে  আবদ্ধ  করে  রাখাকে   তাদের কোনো সহজাত প্রবৃত্তির  জন্যে  নয় বা কোনো  শারীরিক   অযোগ্যতার  কারণে    ও নয়  ৷    ইহা শুধু    পরিস্থিতিগত কারণের  জন্যে নয়  ৷  ইহা    পুরুষতন্ত্রের এক সুপরিকল্পিত  ষড়যন্ত্রের  ফসল মাত্র ।

           পৃথিবীতে    কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না  পুরুষই ক্রমশ তাকে নারী করে তোলে । যার কথা ছিলো স্বায়ত্তশাসিত মানুষ হয়ে ওঠার    ;   কিন্তু পুরুষতন্ত্রই  তাকে করে তুলেছে  বর্তমান  পর্যায়ের  নারী  হিসেবে । পুরুষ  সৃষ্টি করেছে নারী নামক এক আলাদা  ধারনা  ;  রচনা করেছে তার সংজ্ঞা  ; নির্দেশ করেছে তার সামাজিক অবস্থান , আর  তার জন্যে তৈরি করেছে নৃশংস বিধিও  বিধান ৷  এবং নিযুক্ত করেছে নিজের কামসঙ্গী রূপে  ৷   আর  তারপর পুরুষ  সমাজই  নারীকে  রূপান্তরিত করেছে  উত্তরাধিকার তেরির যন্ত্র   হিসেবে  ৷  এবং সর্বশেষে   নিয়োজিত করেছে  নারীকে   বিশ্বস্থ্য    গৃহ  ও   সংসারের    পরিচারিকার   পদে ।        
           ইহুদি ,   খ্রিস্টান ও মুসলমানের চেতনায় নারী   পুরুষের  এক অশ্লীল  বক্র হাড় থেকে সৃষ্ট প্রাণী । হিন্দুর চেতনায় নারী আরো নিকৃষ্ট । ধর্মগ্রন্থগুলোতে হাওয়া বা ইভের আগেই আদমকে তেরি করে উল্টে দেয়া হয়েছে জন্মের স্বাভাবিক রীতি ; নারীকে জন্ম দেয়া হয়েছে পুরুষের দেহ থেকে, তাই পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীজাতির মাতা । 

        তাই পুরুষ নারীকে সাজিয়েছে অসংখ্য কুৎসিত অভিধায় ;   নারীকে বন্দী করার জন্যে তৈরি করেছে পরিবার  , সমাজ  , ও রাষ্ট্র  ;  উদ্ভাবন করেছে   ঈশ্বর  বিশ্বাসের  ৷   আর  এই  ধারণা  সমাজে  প্রতিষ্ঠা করতে   নিয়ে  এসেছে   ঈশ্বর  কর্তৃক  প্ররিত  পুরুষ  ৷   লিখতে  হয়েছে   ধর্মগ্রন্ত্র ,অজস্র দর্শন  ,কাব্য  ,মহাকাব্য   ৷    সৃষ্টি   করতে   হয়েছে   বিজ্ঞান , সমাজবিজ্ঞান ,মনোবিজ্ঞান সহ  আরো  অসংখ্য শাস্ত্র । নারীর কোনো স্বাধীনতা স্বীকার করেনি পুরুষ । যার  জন্যে এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে   পুরুষ  ,  যা নারীকে সম্পূর্ণ বন্দী  করতে না পারলে যেন  ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষ  সৃষ্ট সেই সভ্যতা  ৷ এই ভয় থেকেই   নারীকে  পুরুষ করেছে গৃহে অবরোধ ও বন্দী । এর নাম পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা । এই সভ্যতার প্রথম শোষকশ্রেণী পুরুষ    ৷  আর প্রথম শোষিত শ্রেণী হচ্ছে নারী । এ সভ্যতার সব কেন্দ্রেই রয়েছে পুরুষ । তাই পুরুষ একে সৃষ্টি করেছে তার স্বার্থ ও স্বপ্ন অনুসারে   ৷   এবং কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে  পুরুষ  নিজকে । পুরুষতন্ত্রের সৌরলোকের সূর্য  হিসেবে  প্রতিষ্ঠা  করেছে  পুরুষকে    আর নারীকে  তৈরি  করেছে    সূর্যলোকের অন্ধকার  রূপে  পুরুষেরা  ৷

       পুরুষ সব কিছু তৈরি করেছে নিজের  স্বার্থের  এব  হিসেবের   কাঠামোতে ৷   তাই   তার  বিধাতাকে     পুরুষরূপে  তৈরি  করতে  হয়েছে  ৷     প্রেরিত পুরুষ ও  তাই  হয়েছে পুরুষ  মধ্যে  থেকে  ৷    প্রথম সৃষ্টিও  তাই   পুরুষ    ৷  আর নারী ওই পুরুষের সংখ্যাতিরিক্ত অস্থিতে তৈরি পুতুল  এক নারী   মাত্র  । পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় পুরুষ মুখ্য   , নারী গৌণ   ; পুরুষ   শরীর  বা  কায়া  ,   নারী  শুধু   ছায়া   ৷   তাই পুরুষ প্রভু   আর নারী  পুরুষের   দাসী ।  পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় শয়তানের চেয়েও বেশি  করে  নিন্দিত করা হয় নারীকে  । 

       সামাজিক কোনো বিপ্লবের ফলে পুরুষ মুক্তি পেলেও নারী মুক্তি পায় না । সর্বহারার  একনায়কত্ব  ও  সৃষ্টি   করছে   পুরুষতন্ত্রকে  ৷  প্রতিষ্ঠিত  করছে  পুরুষের  কর্তৃত্ব  । তাই নারীরা রয়ে  গেছে  সর্বহারার শাসনেও বিশুদ্ধ শোষিত নারী  সম্প্রদায় ।

       পুরুষতন্ত্র আবার নিজেদের স্বার্থে নারীর পালনীয় ভূমিকাগুলোকে ভদ্র ও সুভাষিত করেছে রেখেছে ৷ তারা নারীদের নিয়োগ করেছে অনেক দায়িত্বশীল ভূমিকায় । তাই  তারা নারীকে দেখতে চায় সুকন্যারূপে  , সুমাতারূপে  , ও সুগৃহিনী  হিসেবে । অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র শুধু শক্তি বা বল প্রয়োগ ক’রেই অধীনে রাখতে চায়নি  নারীকে   ৷   পুরুষেরা প্রয়োজন মতো স্তব-সুতিও সহ ভাল  ভাল মিষ্টি সূখ্যাতি  এ কথা  পান করিয়েছে নারীকে। সেই সঙ্গে তাকে গৃহে বন্দী করে তাকে সতীত্ব  রক্ষা  করা শিখিয়েছে নারীকে  ৷এবং সতীত্বকে নারী জীবনের মুকুট করে তুলেছে   ,  আর  এই  ধারণা  প্রতিষ্ঠিত  করতে নারীকে  কখনও  বলেছে দেবী ,  কখনও  বলেছে  শ্বাশ্বতী ,  কখনও  বলেছে কল্যাণী   ৷  পুরুষের  প্রয়োজনে  নারীকে  আখ্যা  দিয়েছে   গৃহলক্ষীরূপে  ৷   এর  পর  অভীধা  যোগ  করে  নারীকে  নিজের  স্বার্থ  রক্ষার্থে  বলেছে  ,   হে  নারী  , তুমি  অর্ধেক কল্পনা   আর  অর্ধেক নারী ,   পুরুষ  গড়েছে   তোমাকে  ......এ রকম আরো কত কী ।  কিন্তু  পুরুষ  একজন  নারীকে   ‘  চিরন্তনী  নারী  ’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে   নারীকে পুরুষেরা করে তুলেছে চিরন্তরী দাসী রূপে ।  
         পশ্চিমে নারীমুক্তির যে আন্দোলন চলছে  , তার ঢেউ এখানে এসে এখনো ভালভাবে লাগে  নি । উনিশশতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাঙলায় নারীদের শিক্ষার যে-ধারা শুরু হয়েছে   তার উদ্দেশ্য ছিল  নারীকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত করা নয়    তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল উন্নতজাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন  করা  ৷  পুরুষ  নির্ভরশীল  এক  শিক্ষিত  নারীসমাজের  সৃষ্টি  করা  ৷  যার  পুরুষের  উপর  নির্ভরশীল  থেকে  পুরুষের  কথায়  উঠ বস  করবে  ৷

        তাই  নারীশিক্ষাও ছিল প্রভু পুরুষের স্বার্থে । বাংলাদেশে যারা নারীদের কল্যাণ চান   তারা মনে করেন নারীর কল্যাণ   আর্থিকভাবে  সচ্ছল  পরিবারে   শুভবিবাহে  ৷  সুখী গৃহেই  নারীর    সূখ   ৷   তাই এখানকার শিক্ষিত নারীবাদীরাও আসলে পুরুষতন্ত্রের  ষড়যন্ত্রের  শিকার ।  তারা  ও নারীকে দেখতে চান সচ্ছল দাসীরূপে তারা ।( যদিও  মূখে  সূ-গৃহিণী  বলা  হয়  তাদের   তাঁদের ) তাই   নিরীবাদীদের  আন্দোলন হচ্ছে  স্বামীতন্ত্রের কাছে স্ত্রীতন্ত্রের আবেদন-নিবেদন করে কিছু সূবিধা আদায় করা মাত্র । ভাল বিয়ে ,ভাল স্বামী ,সন্তান ,গৃহ  ,স্বামী-স্ত্রীর প্রেম মধুর সম্পর্ক ইত্যাদি  বানানো ও   বাজে কথা ;  এগুলোতে নারীর সত্যিকার  মুক্তি নেই ।কিন্তু  বর্তমানে  এগুলোতেই বন্দী নারী । পশ্চিমের নারীবাদীরা অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে এসব । তাঁরা পশ্চমের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে দিয়েছে  একটা বড়ো নাড়া ফলে পশ্চিমে  বদলে  গেয়েছে  অনেকটা   ৷ যদিও তাদের চূড়ান্ত সাফল্য আজো অনেক দূরে রয়ে  গেছে  এখনও  ৷  তাই  পশ্চিমের  নারীদের  এখন  তাদের  সমাজকে  বলতে  হয়  স্টিল  ইট ইজ  মেনস্  ওয়ার্ল্ড  ৷ 

        তাই বলে পুরুষতন্ত্রই শাশ্বত ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ এটা ভাবার কারণ নেই   ৷ এখন আর  বাংলার এক অবরুদ্ধ সুলতানা নারীস্থানের বা নারীতন্ত্রের যে-স্বপ্ন দেখেছিলো   তা যে ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে না বা নারীপুরুষের সাম্যভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না ,  এমন ধারণা করা  অযৌক্তিক এখন ।  পশ্চিমের নারীবাদীরা গত চার দশকে নারীবিষয়ক যে-সব গ্রন্থ লিখেছেন , সেগুলোর অসাধারণত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই । পশ্চিমের নারীদের মূল বক্তব্য এখনো আমাদের এখানে এসে হয়তো পৌঁছেনি হয়ত ; তাই  মধ্যযুগের অধিবাসী মন ও মানষিকতায়   আমরা  অবস্থান  করছি  এখনও  ৷    তাই আমরা , নারী  ও  পুরুষেরা  পশ্চিমের মত এতটা সাহসী হতে পারছি না এখনো ।   আর নারী-অধিকারবাদীরাও এখানে নারীবাদী কে সম্মান করতে পারেন না  তাদের  সীমিত  কুসংষ্করপূর্ণ  ও  সামন্তবাদী  মানুসিকতার  জন্যে । তাদের কাছে নারীবাদী এক কামুক নারী  মাত্র  ৷ যার কাজ পুরুষ থেকে পুরুষের  পেছন  পেছন  ছোটা । বাস্তবে কিন্তু এটা সত্যের চরম অপলাপ ৷   নারীবাদের বিরুদ্ধে যা পুরুষতন্ত্রের অশ্লীল অপপ্রচারের  এক  ধারা  মাত্র । যিনি নারীপুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারে বিশ্বাস করেন  তিনিই প্রকৃত নারীবাদী   ৷  তাই তাকে নারী পুরুষের সাম্যে নীতিতে ও বিশ্বাস স্থাপন  করতে  হবে  ৷  

          আমরা আজ ও বাস করছি বিভিন্ন  প্রথা  ও  মধ্যযুগীয়  নানা    নির্মম  বিধিবিধানের   মধ্যে । এই  বিধিবিধান ও প্রথাই নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সবচেয়ে নিষিদ্ধ সপ্রাণ বস্তুতে পরিনত করেছে ।  এই প্রথা ও বিধিবিধানের নির্মম প্রয়োগে নারী উপভোগ্যতম বস্তু বলেই গণ্য হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ।  
             আমরা এক উগ্র পিতৃতন্ত্রের মধ্যে বাস করতেছি ৷    যেখানে নারী এখনও অতি নিষিদ্ধ বস্তু  ৷  নারীর  অধিকার দাবি করাকে ও যেখানে দ্রোহিতা হিসাবে গণ্য হয়    সেখানে নারী এখনো  দাসী ও ভোগসামগ্রী   হিসেবেই  গণ্য  হচ্ছে  ৷  আর  কুসংষ্কার ও  বিভিন্ন  প্রথা এবং সমাজের  প্রচলিত বিধিবিধানই এর  জন্য দায়ী ।  প্রথা মানুষকে পশুস্তরে আটকে রাখে   ৷  প্রথা ও বিধিবিধান মানুষকে বিকশিত হতে দেয় না  ৷ সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন-মানুষ নিরন্তর ভাবে বিকশিত হতে পারলেই সে তখন মানুষ্যত্ব অর্জণ করতে পারে । কিন্তু  আজ আবার নতুন ক’রে এবং প্রচণ্ডভাবে প্রথার প্রত্যাবর্তন ঘটানো হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে ; প্রথার পক্ষে কথা বললে বা প্রথার পক্ষে কাজ করলে অনেক সম্মান ও অর্থ-প্রাপ্তি ঘটে ৷  কিন্তু প্রথার বা অন্যায় ভাবে আরোপিত মধ্যযুগীয় বিধিবিধানের বিরুদ্ধে কথা বললে বা কাজ করলে জোটে জেল ও দণ্ড এমনকী অপমৃত্যু পর্যন্ত ভোগ করতে হয় ক্ষেত্রবিশেষে  ।  ক্ষমতালোভী এবং রাষ্ট্রলিপ্সু রাজনীতিকেরা মানুষকে আজ উৎসর্গ করে দিচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও বিভিন্ন প্রথার পায়ে ৷   ক্ষমতার জন্য রাজনীতিকেরা  আজকাল মানুষকে পশুস্তরে নিয়ে যেতেও প্রস্তুত । তবে প্রথা চিরজীবী নয় এবং প্রথা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে বলে তা সত্য ও শাশ্বত নয়   ৷  কারণ এইসব প্রথা বা বিধিবিধান কোনো মহাকাশ থেকে ও নেমে আসেনি । পুরুষতন্ত্রই তাদের স্বার্থে এ সব বিধিবিধান ও প্রথা সৃষ্টি করেছে ।  কিন্তু এ সবের কোনো স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটবে না  কোনোদিন  ৷  তবে  প্রগতিশীল মানুষেরা , বিশেষ করে আমাদের আলোকিত উত্তরপুরুষ নারী ও পুরুষেরা  যৌথভাবে  একদিন এর সমাপ্তি ঘোষণা করবে , আমরা নিশ্চয় এই আশায়ই থাকবো ।  
           
    এই  লেখাটির  সঙ্গে  প্রাসঙ্গিক  হওয়ায়  নন্দিনী  হোসেনের  একটি  লেখা  সংযুক্ত  করা  হল  আগ্রহীদের  জন্যে  ;- সৌজন্য  নন্দিনী  হোসেন

                পুরুষ রচিত ধর্মে বিকলাঙ্গ নারী
                        নন্দিনী হোসেন


 ধর্মের স্রষ্টা পুরুষ। তাই দেখি ঈশ্বর’ ভাবনাতেও পুরুষালী ছায়া। পুরুষের জন্য সব আরাম-আয়েশ স্ত্রীদাসীবাদী কতো কী। নারীর জন্য কিছুই নেইজীবনে-মরণে একই পুরুষ । মরেও তার শান্তি নেই-বেহেস্তে গেলেও যেতে হবেহাড়মাংস জ্বালানো সেই মিনষেটার সাথে! কিন্তু বেহেস্তে যাবেন কিভাবেপবিত্র আল কোরানে ইসলামের জন্য জিহাদ (সংগ্রাম) করলে,মহান আল্লাহতায়ালা জান্নাতে (স্বর্গ) প্রবেশের নিশ্চয়তা দিয়েছেন (সুরা ইমরান৩:১৪২সুরা মোহাম্মদ৪৭:৪-৬সুরা ফাতাহ৪৮:৫)তা জান্নাতে গিয়ে জীবনবাজি রেখে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করা জিহাদিরা কী পাবেন?পাবেন-যতখুশি ফলমূলসুরা ভর্তি পেয়ালা আর মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র পরিধানরত আনতনয়না-পরমাসুন্দরী চিরকুমারীদের (সুরা সোয়াদ,৩৮:৫১-৫২সুরা আদ দোখান৪৪:৫১-৫৭)যারা চিরকুমারীপ্রেমময়যেন এক একটি ঢেকে রাখা মুক্তা (সুরা আল ওয়াক্বেয়া৫৬:১০-৪০)যাদের এর আগে কোন মানুষ বা জিন কখনো স্পর্শ করে নি (সুরা আর রহমান৫৫:৫৬);এ হুরেরদল (জার্মান ভাষায় হুর’ শব্দের অর্থ গণিকা!) জান্নাতের তাঁবুতে রয়েছে অপেক্ষমাণ অবস্থায় (সুরা আর রহমান৫৫:৭২)। কিন্তু এগুলো তো পুরুষদের জন্যআর নারীর জন্যকিছুই নয়। কেউ কেউ বলেন নারীর জন্য রয়েছে তার পূন্যবান স্বামী! ভালো করে বিভিন্ন ধর্মের কেতাব লক্ষ্য করলে দেখা যায়জান্নাত বা স্বর্গ হচ্ছে এক একটি গণিকালয়যেখানে মদ-নারীর ছড়াছড়ি। আর এই গণিকালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! দুঃখের কথাএরপরও আমাদের এ সমাজের বেশিরভাগ নারীই এই ধরণের ঈশ্বরেবিশ্বাস করেন এবং বিপদের দিনে তাঁর কাছেই আশ্রয় খোঁজেন!

সোজা কথায় নারীর স্বার্থ কখনও পুরুষের ধর্ম দেখেনিদেখার কথাও নয়তাই প্রচলিত সবগুলো ধর্মগ্রন্থ আতিপাতি করে খুঁজেও পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে এমন একটা শব্দও পাওয়া যাবে না। আসলে পুরুষের চোখ নারীকে যেভাবে দেখেদেখতে ভালোবাসেযেমন করে নারীকে পেতে চায় ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঠিক সেভাবেই সাজানো হয়েছেঅবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক আল্লাহ/ঈশ্বর/গড ভয়ানক এক চোখা! ভয়ানক রকম পুরুষতান্ত্রিক নারীলোভী; আবার আর সেই পরিমাণ-ই নারী বিদ্বেষী! নিচের হাদিস দেখলে নারীর অবস্থান ধর্মের মগজে কোথায় কিছুটা ধারণা করা যায়:

হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত : নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন : আমি যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তির সামনে সিজদা করার নির্দেশ দান করতাম তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য’’ (তিরমিযী)

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার ইমাম গাজ্জালি (রঃ) বিখ্যাত ইয়াহ্ইয়া উলুমেদ্দিন’ ( পৃ-২৩৫)গ্রন্থে লিখেছেন -

স্ত্রীর উচি স্বামীকে তার নিজ সত্ত্বার চেয়েও উপরে স্থান দেয়া,এমনকি তার সকল আত্মীয়স্বজনের উপরে স্থান দেয়া। সে স্বামীর জন্যে নিজকে সদা-সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে যেন স্বামী যখন ইচ্ছা তাকে ভোগ করতে পারে..

যেহেতু ধর্ম এনেছিল পুরুষ তাদের স্বার্থে - পুরুষের ধর্মে নারীর স্থানতাই তাদেরই পদতলে হবে তাতে আর আশ্চর্য কী। নারী তার প্রয়োজন মেটাবে,খুব বেশি হলে সহচরী সেজে সময়ে সময়ে মিষ্টি দুটো কথা শুনে বর্তে যাবে -এই তো নারী। খ্রিস্টান ধর্মে আছে : এ্যাডাম-এর প্রয়োজন হয়েছিল বলেই ইভের সৃষ্টি। ক্রিস্টিয়ান লেখক-শিল্পীরাও তাদের কর্মে প্রচার করতে ভালোবাসেন, ‘Women are subordinate to men because they are created after men and from men and for men. (Drury, 1994, 34)’

তাছাড়া সেন্ট পলের দু-একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে; বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা যায়:"...I permit no women to teach or to have authority over a man; she is to keep silent. For Adam was formed first, then Eve; and Adam was not deceived, but the women was deceived and became a transgressor. Yet she will be saved through childbearing, provided they continue in faith and love and holiness with modesty." (1 Timothy 2:8-15)

সেন্ট পলের আরেকটি উদ্ধৃতি, "Indeed, man was not made from women, but women from man. Neither was man created for the sake of woman, but women for the sake of man." (1 Corinthians 11:3-10)

কি চমকার! তাহলে তো আর কোন কথাই থাকে না। ধর্মীয় মগজ থেকে উসারিত এই রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। এখানে ইসলাম ধর্মের আরও কিছু নারী সম্পর্কীত হাদিস নিচে উল্লেখ করা হল :

হযরত মোহাম্মদ বলেন আমার অনুপস্থিতিতে আমি পুরুষের জন্য মেয়েদের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর ফিতনা ও বিপর্যয় রেখে যাইনি’’ (বোখারি ও মুসলিম)

নারী (জাতির মূল অর্থা সর্ব্বপ্রথম নারীআদি মাতা হাওয়া) পাঁজরের (উর্দ্ধতম হাড় হইতে সৃষ্ট। পাঁজরের হাড় সমূহের মধ্যে উর্দ্ধতম হাড় খানাই সর্ব্বয়াধিক বাঁকা। তুমি যদি উহাকে পূর্ণ সোজা করিতে তপর হও যেতুমি তোমার মন মত  পূর্ণ সোজা না করিয়া ছাড়িবে না) তবে উহা ভাঙ্গিয়া যাইবে। আর যদি উহাকে তোমার মন মত পূর্ণ সোজা করায় তপর হওতবে অবশ্য উহার মধ্যে একটু বক্রতা থাকিবে,কিন্তু ভাঙ্গিবে নাআস্ত থাকিবেতুমি উহার দ্বারা সাহায্যসহায়তা লাভ করিয়া নিজের অনেক কল্যাণ সাধন করিতে পারিবে’’ (বোখারি শরিফ২০৫)


স্বামী তাহার স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় আসিবার জন্য ডাকিলে যদি স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় (এবং স্বামী তাহার প্রতি অসন্ত্তষ্ট হয়) তবে ভোর পর্য্যন্ত সারা রাত্র ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর প্রতি লান ও অভিশাপ করিতে থাকেন’’ (বোখারি ও মুসলিম)

আরেকটি হাদিস এরকম,

‘....নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন দোযখ পরিদর্শন-কালে আমি দোযখের দ্বারে দাঁড়াইলাম এবং জানিতে পারিলাম যেদোযখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে‘ (বোখারি শরিফ২১১)

আমরা জানিনারীদের নির্দিষ্ট বয়সে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বকোষ বেরিয়ে ফ্যালোপিয়ন টিউবে এসে শুক্রকীটের জন্য অপেক্ষা করেশুক্রকীট না পেলে ওই ডিম্বকোষের মৃত্যু ঘটে এবং ঋতুস্রাব হিসেব বেরিয়ে আসে। এই ঋতুস্রাবের মেয়াদ প্রত্যেক নারীরই নির্দির্ষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে চার-পাঁচ দিন স্থায়ী হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে - এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ব্যাপারশুচি-অশূচির কোনো ব্যাপার নয়। তবে এই সময় নারীদের প্রয়োজন একটু বিশ্রামের । অথচ আল কোরানের দৃষ্টিতে রজঃস্বলা নারী অশূচি-দূষিত,তাই এ সময় স্ত্রীসঙ্গ বর্জনীয় (সূরা বাকারা২:২২২)। কিন্তু হাদিস থেকে জানা যায়, ‘রজস্বঃলা স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষ সংগত হলে তাকে এই কাজের জন্যে এক দিরহাম সদকা দিতে হবে। রক্তের রং কিছুটা হলদেটে হলে সদকার পরিমাণ হবে অর্ধ দিনার আর সম্পূর্ণ লাল হলে এক দিনার (মিশকাত : ৫৫৩৫৫৪)’’- তাহলে দেখা যায়কোরান যা বাতিল করেছে,হাদিস তা সামান্য সদকার বিনিময়ে হালাল করে দিয়েছে!

উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক নারী আসলে ধর্মের দৃষ্টিতে মনুষ্য পদবাচ্যই নয়! তাকে কিভাবে কোন কৌশল অবলম্বন করে দমিয়ে রাখা যাবে এবং তার থেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করা যাবে তার-ই  যেন সব ফন্দি-ফিকির বের করা হয়েছে। পবিত্র ধর্মের নামে নারীকে পুরুষতান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পেষণ করা সহজ। যুগ যুগ ধরে এই ধুরন্ধর কৌশলেই নারীর বাঁকা চলনকে বশে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীও খুশী। ধর্ম বলে কথা। পবিত্র’ জ্ঞানে পিপড়ের সারির মত পিলপিল করে ধর্মের পিছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এছাড়া নারীর শিক্ষা-দীক্ষাও নারীর নিজস্ব নয়পুরুষের-ই মনোনীত তথাকথিত শিক্ষা নিয়ে তার বড়জোর চাকুরি জুটেতাতে হূদয়ের অর্গল খুললেও মগজের ভিতরে পাকানো জঁট আর খুলে নানারীর ভিতর শতাব্দীর অন্ধকার দূর হওয়ার গতিতাই বড় ধীর। যার জন্য আজও দেখি ধর্মের নামে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়ার রমরমা ব্যবসা চলে। নারী কি চাইবেনা-চাইবেকিভাবে চাইবেহাসবেকাঁদবেকিভাবে মরবে সব-ই বলে দেয় পুরুষ। হয়ত তাই দাবি দাওয়ার ছিটে ফোঁটা পেলেও বর্তে যায় নারী!

এবার একটা কেস স্টাডি দেখা যাক। তাতে আধুনিক নারীর প্রাত্যহিক জীবন যাপনের একটা খন্ডচিত্র পাওয়া যাবে। ফলে আমাদের ধারণা পেতে সুবিধা হব্ণেদুই হাজার আট সালের একজন মুসলিম বঙ্গনারীর জীবনে মধ্যযুগের আরবে রচিত ধর্ম গ্রন্থের’ আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা। নীলা (ছদ্মনাম) একজন প্রবাসী কর্মজীবী নারী। নিজ কথনেই শুনা যাক তার জীবন যাপনের প্রাত্যহিক চালচিত্র : আমাকে সকাল সাতটায় কাজে দৌঁড়াতে হয়তাই নাস্তাটুকুও সারার উপায় থাকে না বাসায়। ছেলেমেয়ে তখনও ঘুমিয়ে। ওদের স্কুল কিছুটা দেরিতে। নয়টার দিকে। বিকেল পাঁচটায় যখন কাজ শেষ হয়,তখন শরীর মন অনেকটা বিধস্ত। ফেরার পথে প্রায় দিনই টুকটাক বাজার সারতে হয়। তবে আজকাল বাজার-সদাই প্রায় সবই অনলাইনে করিসময় বাঁচানোর জন্য। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়দিনই বিকেল ছয়টা। সন্তানদের সামন্য খোঁজ খবর নিয়েই দৌঁড়াতে হয় কিচেনে। নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে পাত্তা দেওয়ার অবসরটুকুও মেলে না। বিকেলের চারাতের খাবাররান্নার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়েদের হোমওয়ার্কের খোজখবর করা এর মধ্যেই আবার টুকটাক জরুরি ফোনগুলোও সেরে নিতে হয়। তারপর ঘরদোর গুছানোর পালা শেষ করে রাতের খাবার সেরেশুরু করতে হয় পর দিনের প্রয়োজনীয় কাজ গুছিয়ে রাখার পালা। এতসব করতে করতে রাত এগারটা সারে এগারটা বেজে যায়। এরপর কিছুটা সময় নিজেকে দেই। যেমন কিছু পড়াশুনা করার চেষ্টা করি। বই আমার প্রাণচেষ্টা করি প্রতি রাতে অন্তত দুই পাতা হলেও পড়ারতারপর বিভিন্ন নিউজ সাইটগুলো ঘেটে খবরাখবর গুলো জেনে নেই। ই-মেইল পড়িদরকার হলে দুএকটার উত্তর দেই। এ সব শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুইটা-আড়াইটা বেজে যায়। জন্মসূত্রে আমি যেহেতু একজন মুসলিম নারীআজ দুই হাজার আট সালে দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় পরিপূর্ণ ইসলামিক রীতিনীতিগুলো মেনে জীবন যাপন করা। আমাকে যেভাবে উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াতে হয় সাত সকালে,সারাদিন প্রায় দৌঁড়ের উপর থাকতে হয়্ণসেখানে আমার পায়ের আঘাতেমাটি কাঁপল’ কি-না তা দেখার সময় কোথায় আমারঘরের ভিতর নীরবে চলাফেরা করার-ই বা সুযোগ কোথায়আর বেহেস্তে যাওয়ার জন্য স্বামীর সন্তুষ্টি আদায়ের নানা তরিকা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মত এত অলস সময়ও আমার হাতে নেই। দুজন মানুষ একসাথে থাকতে গেলে ঠুকাঠুকি কিছুটা লেগেই থাকবে। আমার জীবনযাপনের সাথে তাই মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোহীনঅন্ধকার গৃহকোণে পরে থাকা নারীর জীবনযাপনকে মিলাতে চাইলে কি সেটা বাস্তব-সম্মত হবেতাছাড়া আমি মনে করি ভালো-মন্দের পার্থক্যটা ঠিক কোথায় তার শতভাগ পরিস্কার কোন সীমারেখা টানা না গেলেও আমার বিবেকবুদ্ধি এবং শিক্ষা অনুযায়ী আমি নিজেকে চালিত করি। নীতিবোধ শেখার জন্য মধ্যযোগীয় ধর্মের কোন প্রয়োজন দেখি নাকারণ সেসময়কার  নৈতিকতাবোধ আর আজকের নৈতিকতাবোধ এক নয়মধ্যযুগে সামান্য চুরি করার জন্য হাত কেটে ফেলা হত। আজকের সভ্য দুনিয়ায় তা (অসভ্যদের কথা বাদ) কল্পনাই করা যায় না

উপরে উল্লেখিত চিত্র শুধু এই একজন নীলার নয়বরং প্রায় প্রতিটি ঘরে একই চিত্র। কী দেশেকী প্রবাসে। তবে পার্থক্য এইনীলা জানেন তিনি কি করছেনতার অবস্থান পরিস্কার। অন্যেরা দুই নৌকায় চড়তে গিয়ে খাবি খাচ্ছেন। এবার চোখ ফেরানো যাক ঐশি’ গ্রন্থ কোরানের দিকে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখি সেখানে নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে কি বলা আছে। বিষয়টা সবচেয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে যে সূরাটির মাধ্যমেতা হচ্ছে সুরা নিসা৩৪ নম্বর আয়াত

(সুরা নিসা : ৩৪) পুরুষেরা নারীদের উপর কতৃত্বশীল এ জন্য যেআল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যেতারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে ও তারা হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্ক্ষা কর তাদের সদুপদেশ দাও,তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ

এখানে আল কোরান নারী-পুরুষের প্রতি নিরপেক্ষতা দেখিয়ে স্ত্রীকে অধিকার বা অনুমতি দেয়নি অবাধ্য স্বামীকে প্রহার করার। কেনহায়! নারীদের প্রহার করার ব্যাপারে পবিত্র কোরান শরিফের সাথে মিল পাওয়া যায় সনাতন হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৬/৪/৭১/৯/২/১৪) এবং শতপথ ব্রাক্ষ্মণের (৪/৪/২/১৩)

একই সুরার অন্যান্য আয়াতে যা পাই তা হচ্ছে :- (সুরা নিসা৪:৩) আর যদি তোমরা ভয় কর যেএতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পুরণ করতে পারবে নাতবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুইতিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্ক্ষা কর যেতাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে নাতবেএকটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকেএতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হয়ার অধিকার সম্ভাবনা মানে পুরুষেরা (যদি সকলের সাথে সমান ইনসাফ করতে পারে) সর্বোচ্চ চারজন নারীকে একসাথে বিবাহ করতে পারবে। কিন্তু নারী-পুরুষের প্রতি নিরপেক্ষতা দেখিয়ে কোরানে কোথাও নারীদের একসাথে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়া হয় নাই (বর্তমানে প্রচারিত কোনো ধর্মেই এরকম নির্দেশ বা অনুমতি পাওয়া যায় নাকেনমাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নেই বলে?); এছাড়া আল্লাহর বান্দারা যে তাদের স্ত্রীদের প্রতি এই সমান ইনসাফকরতে পারবে নাসেটি মহান আল্লাহতায়ালা মনে হয় আগেই জানতেন;তাই পরবর্তীতে এ বাধা তুলে দিয়েছেন (সূরা নিসা৪:১২৯)। তাহলে আর থাকলো কীপুরুষেরা বিয়ে একসাথে চারটি স্ত্রী রাখতে পারবেতবে উপপত্নীদাসী সম্ভোগের সংখ্যা অনুল্লেখিত (সূরা আহযাব৩৩:৫০৫২)

মহান আল্লাহতায়ালার কাছেপুরুষের অবস্থান নারীদের কিছুটা উপরে (সুরা বাকারা২:২২৮)সাক্ষী হিসেবে একজন পুরুষ সমান দুজন নারী (সুরা বাকারা২:২৮২)।  আমি সুরা বাকারা থেকে উদ্ধৃত করছি-

হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান করতখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবেলেখক লিখতে অস্বীকার করবে নাআল্লাহ্ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেনতার উচিত তা লিখে দেয়া এবং ঋন গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে|অত:পর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দূর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়তবে তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখাবে। দুজন সাক্ষী কর,তোমাদের পুরুষদের মধ্যে থেকে যদি দুজন পুরুষ না হয়,তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর যাতে একজন যদি ভুলে যায়তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়...।


এখানে লক্ষ্যনীয় যে সাক্ষী সাবুদের ক্ষেত্রে দুজন পুরুষ সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। যদি দুজন পুরুষ না পাওয়া যায়  তা হলে মহিলাদের দিয়ে কাজ চলতে পারে, তবে একজন পুরুষের বদলে দুজন নারীর সাক্ষ্য নেওয়া যেতেপারে। শুধুমাত্র মহিলাদের সাক্ষী গ্রহনযোগ্য নয়।  সাথে অন্ততঃ একজন পুরুষ থাকতেই হবে।   যারা কোরানের মধ্যে সব সময় নারী-পুরুষের সাম্য খুঁজে পান, যারা বৈষম্যের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেন, তারা এর কি জবাব দেবেন?  নারীরা চিন্তায় চেতনায় পুরুষদের থেকে হীন, তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল, তাদের বিচার বুদ্ধি কম, তারা ঠিকমত সাক্ষ্য দিতে পারবে না এই ভাবনা থেকেই মূলত  দুজন নারীর সাক্ষ্যকে একজন পুরুষের সমতুল্য করা হয়েছে।

নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও।  সুরা নিসা অনুযায়ী উত্তরাধিকার সুত্রে বাবা-মার কাছ থেকে একজন পুরুষ সন্তান যা পাবে, মেয়ে সন্তান পাবে তার অর্ধেক।  আল্লাহ বলেন, (৪:১১),

আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান। অত:পর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিকতবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগযদি মৃতের পুত্র থাকেযদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ।অত:পর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকেতবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যেেতর পরযা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না।  এটা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞরহস্যবিদ।  

মুসলিম স্কলাররা বলতে চান, মেয়ে বড় হয়ে যেহেতু স্বামীর সম্পত্তি পায়, তাই পিতার সম্পত্তি তাকে কম দেওয়া হয়েছে। এগুলো আসলে ছেলে ভুলানো ছড়া। আধুনিক বিশ্বে বহু নারী উপার্যনক্ষম। অনেকেই স্বামীদের থেকেও বেশী রোজগার করেন, তাদের অনেককেই স্বামীর উপার্যনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয় না।  মেয়েদের অনেকেই আজ বহুজাতিক কোম্পানির সিইও, এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতার-ও শীর্ষে ছিলেন, কিংবাএখনো আছেন।  এদের কাছে ওই আয়াতগুলো বোকা বোকাই লাগবে। আর তা ছাড়া এমন অনেক নারীই আছেন যারা পরে বিয়েই করেননি, কিংবা করবেন না।  মেয়েদের বড় হয়ে স্বামী থাকতেই হবে  এটা কি ধ্রুব সত্য নাকি?  

পবিত্র আল কোরানের দৃষ্টিতে বহুগামী পুরুষের কাছে নারী শুধুই সম্ভোগের বস্তুসে জন্য দেখা যায় ইসলামী সৈনিকদের জন্য যুদ্ধবন্দি সধবা, বিধবা, বিবাহিত, অবিবাহিত সব নারীকে হালাল করা হয়েছে (৪: ২৪)।  ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের মহানবী থেকে শুরু করে হজরত আলী, হজরত ওসমান, হজরত ওমর সবাই যুদ্ধবন্দী নারী উপভোগ করেছেন, কখনোবা উপপত্নি বানিয়েছেন।  কোরানে বলা আছে  তোমাদের দক্ষিন হস্ত যাদের অধিকারী (দাস, দাসী এবং যুদ্ধবন্দিনী)- আলাহ তোমাদের জন্যে তাদেরকে বৈধ করেছেন (৪:২৪)[*]! কোরানে মেয়েদের সংজ্ঞায়িতই করা হয়েছে শস্যক্ষেত্র হিসেবে -তোমাদের স্ত্রীরা  হচ্ছে তোমাদের জন্যে (সন্তান উপাদনের) ফসলক্ষেত্রতোমরা তোমাদের এই ফসলক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই গমন করো ...‘ (সূরা আল বাকারা২:২২৩)। এরপর কি আর কিছু বলার থাকতে পারেযৌন কর্ষণের ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের সকল ক্ষমতা পুরুষের হাতে দিয়ে দিলেন মহান আল্লাহতালা!

উপরের একটি সুরায়ও নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া তো দূরে থাক,মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয়নি। এখন কথা হলউপরে উল্লেখিত কোরানের নির্দেশ অনুসারে নারীরা পুরুষদের সমান ক্ষমতা দাবী করলে বিশাসীদের'ধর্মীয় অনুভুতি’ আঘাত পাবেই! কারণ তারা দাবি করতেই পারে, তাদের আচরণ কোরান অনুযায়ী সঠিক-ই আছে!  আমরা দেখেছি এ সরকারের আমলে ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ননীতির বিরুদ্ধে মোল্লাদের বিক্ষোভ। দেখেছি কিভাবে উত্তরাধিকার আইনে নারীদের পুরুষদের সাথে সমতা দিতে গিয়ে সরকার কিভাবে মোল্লাদের কাছে মাথা নত করে পিছু হটে গেলো।

ইসলামি আইনে জেনা’ হলোব্যভিচারবিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলনধর্ষণ ও পতিতাবৃত্তি। অর্থা পরস্পরের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নেই এমন দুজন নর-নারীর মধ্যে যৌনমিলন হলো জেনা। ইসলামি শরিয়তী আইনে জেনার জন্য চরম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছেতবে নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে শাস্তি দুরকম। জেনার জন্য অবিবাহিত পুরুষের শাস্তি ১০০ ঘা বেত্রদ¨, বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে ৮০ ঘা বেত্র¨। কিন্তু নারীদের বেলায় প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ডআর এই 'জেনা’ সংক্রান্ত অপরাধ প্রমাণ করতে চারজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজনকোনোভাবেই নারীর সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামি আইনের এই ধরনের কঠোর-ভয়ঙ্কর বিধান থেকে বিশ্ববাসীর মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কতিপয় ইসলাম-দরদীরা আল কোরানের (সুরা নিসা৪:১৬) এই আয়াতটি উল্লেখ করেন- আর তোমাদের মধ্যে যে দুজন (নর-নারী) এ (ব্যভিচারের) কাজ করবেতাদের দুজনকেই তোমরা শাস্তি দিবে, (হাঁ) তারা যদি তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়তাহলে তাদের (শাস্তি দেয়া) থেকে তোমরা সরে দাঁড়াও...। হঠা করে এই আয়াত নজরে আসলে অনেকে ভাবতে পারেনব্যাভিচারে অভিযুক্ত দুজন নারী-পুরুষেরই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছেতাহলে অপরাধীদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সমান দৃষ্টিপাত করা হয়েছেএরকম দাবিও করেন অনেকে। কিন্তু আসলেই কী তাইসত্যি কী এখানে দুজন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হলে সমান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে? এই আয়াতে কিন্তু কখনোই সমান শাস্তি’ কথাটি বলা হয়নিভালো করে লক্ষ্য করুন।  পূর্বের আয়াতটি (সুরা নিসা৪:১৫) আগে দেখিতাহলেই বুঝা যাবে-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অপরাধীদের জন্য কী আল্লাহতায়ালার সমান দৃষ্টিভঙ্গি- তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা (ব্যভিচারের) দুষ্কর্ম নিয়ে আসবেতাদের (বিচারের) ওপর তোমরা নিজেদের মধ্যে থেকে চারজন সাক্ষী যোগাড় করবেঅতপর সে চারজন লোক যদি ইতিবাচক সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে সে নারীদের তোমরা ঘরের ভেতর অবরুদ্ধ করে রাখবেযতোদিন না,মৃত্যু এসে তাদের সমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়অথবা আল্লাহতায়ালা তাদের জন্যে অন্য কোনো ব্যবস্থা না করেন

পুরুষ ব্যভিচার করলে তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আটক রাখার বিধান কোরানের কোথাও দেয়া নেইকোরান থেকে কেউ দেখাতেও পারবে না। কিন্তু নারীকে (নারী বলেই কী?) নিয়ে এমন কঠোর বৈষম্যপূর্ণ বিধান থাকার পরেও আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা যখন দাবি করেনআল কোরান বা আল্লাহতায়ালার কাছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানতখন আর বলার কিছু থাকে না!

বাস্তব ক্ষেত্রে জেনা এবং হুদুদ আইন যে ধর্ষনকারীদের রক্ষা কবচ হিসবে ব্যবহৃত হয় তা আমরা পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব সহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে দেখেছি।  ধর্ষন প্রমান করার জন্য চারজন সাক্ষী প্রায় কোন ক্ষেত্রেই মেয়েটির পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব হয় না, ফলে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়,  ধর্ষণকারীর ঘটে মুক্তি, আর মেয়েটা জেনা করার দায়ে কপালে জুটে শারিয়ার রজম।  অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েটির পরিবারই হতভাগ্য মেয়েটিকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয় পরিবারের সম্মানরক্ষার জন্য। এর যে কত ডকুমেন্টেড কেস আছে তার ইয়ত্তা নেই।

কোরানের দৃষ্টিতে পুরুষ চাইলেই তার স্ত্রীকে তালাক’ দিতে পারেশুধুমাত্র পরপর তিনবার অথবা আলাদা আলাদাভাবে শব্দটি উচ্চারণ করলেই হয়ে যায় (সূরা বাকারা২:২২৭-২২৯)কিন্তু এক্ষেত্রেও কোরান শরিফ নারীকে তালাক দেবার অধিকার দেয়নি (যদিও ১৯৬১ সালের তকালীন আইয়ুব খান সরকার মুসলিম পারিবারিক আইন’-এ পবিত্র কোরানকে ডিঙিয়ে গিয়ে স্ত্রীদের তালাক দেয়ার অধিকার দিয়েছেএ জন্য সেসময় মোল্লা-মৌলভীরা অনেক চিল্লা-ফাল্লা করেছিলযা হোকবর্তমানে বাংলাদেশে এ আইনই কার্যকর রয়েছে)। আরেকটি আয়াত দেখুন- যদি সে (পুরুষ) তাকে তালাক দিয়েই দেয়তাহলে তারপর (এ) স্ত্রী তার জন্যে (আর) বৈধ হবে না, (হ্যাঁ) যদি তাকে অপর কোনো স্বামী বিয়ে করে এবং (নিয়মমাফিক তাকে) তালাক দেয় এবং (পরবর্তী পর্যায়ে) তারা যদিই (সত্যিই) মনে করেতারা (এখন স্বামী স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে) আল্লাহর সীমারেখা মেনে চলতে পারবেতাহলে পুনরায় (বিয়ে বন্ধনে) ফিরে আসতে তাদের ওপর কোন দোষ নেইএটা হচ্ছে আল্লাহর (বেঁধে দেয়া) সীমারেখা...‘ (সুরা বাকারা২:২৩০)। এই আয়াত থেকে দেখা যাচ্ছে যেকোনো পুরুষ যদি তালাক দেয় (ইসলামিতাত্ত্বিকদের মতেভুলক্রমে হলেও) এবং পরে তার স্ত্রীকে ফেরত চায়তবে সহজভাবে ফেরত নেয়া যাবে না। নারীটিকে আবার বিয়ে দিতে হবে অন্য পুরুষের সাথে,যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এই দ্বিতীয় স্বামীর সাথেএরপর এই দ্বিতীয় স্বামী নামক পরিত্রাতার ইচ্ছা হলে তাকে তালাক দিবেতারপরই নারীটি যথাবিহিত ইদ্দত পালনের পর প্রথম স্বামীর কাছে যেতে পারবেনচে নয়এই আয়াতে তালাক দিবে পুরুষঅথচ এর ফল ভোগ (ধর্ষিত হতে হবে) করবে নারী। ভুল করবে একজনশাস্তি পাবে অন্যজনএকেই কী বলে সমানাধিকার! (কোন কোন তফসিরকাররা বা ইসলামি চিন্তাবিদরা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলে থাকেন, ‘তালাককে নিরুসাহিত করার জন্যই এতো কঠিন বিধি করা হয়েছে‘- ওনাদের এ যুক্তি শুনলে বড়ই খেলো মনে হয়! যে পুরুষ ভুল করে তাকে কিছু দিতে হয় নাহারাতে হয় নাশাস্তি পেতে হয় না;অথচ নিরাপরাধ নারীটিকে সব মূল্য দিতে হয়উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে ইক্যুয়াল ডিস্ট্রিবিউশন!) ইসলামের পরিভাষায় এই দ্বিতীয় স্বামীকে বলা হয় মুহাল্লিল। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলে গেছেন- মুহাল্লিলের সাথে বিয়ে তখনই বৈধ হবেযখন তাদের দুজনের মধ্যে যৌন-মিলন হবে‘ (বোখারি হাদিস২০৭৮২০৭৯)

যাকএসব সুরা এবং হাদিস নিয়ে  মুসলিম ফেমিনিষ্ট এবং স্কলারদের বক্তব্য কীএবার চোখ ফেরাই সেদিকে। আমেরিকান ফেমিনিষ্ট এবং মুসলিম স্কলারAmina Wadud Muhsin যিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং বর্তমান ইসলামিক স্কলারদের ইন্টারপ্রিটেশনগুলো অনুসন্ধান করে যে মতামত প্রকাশ করেছেন,সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াত এর ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল-বাক্যটি আসলে সেই সময়কার প্রেক্ষিতে রচিত। প্রেক্ষাপট এবং সময়’ এই বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। তখনকার আর্থ-সামাজিক বিষয়টিই এই সুরার মাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। যেহেতু তখন পুরুষরাই ছিল পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমিনা মনে করেন বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই সূরাটির ব্যাপারে আরও উদার (লবিরোল) রিইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ আছে

আরেক মুসলিম ফেমিনিস্ট মরোক্কান Fatema Mernissi  এবং ইজিপশিয়ান আমেরিকান Leila Ahmed দুজনেই মোটামুটি তাদের বিভিন্ন লেখায় যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা হলইসলামে যে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে তা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে পরস্পরবিরোধী। নারীর উপর ধর্মের নামে নানা বিধি নিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে নারীর অবস্থা দিনে দিনে শোচনীয় হয়েছেপুরূষের অধীনতাবশ্যতা স্বীকার-ই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। Leila Ahmed আরও উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদের সময়েঅর্থা প্রথম যুগের মুসলমান সমাজ নারীর প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল। মূলতঃ আব্বাসীয় সময় থেকেই নারীর প্রতি চরম বৈষম্যমুলক ব্যবস্থা চালু হয় ধর্মের নামে। ইসলামের নামে না হলেও আব্বাসীয় যুগে-ই উপপত্নী গ্রহণকে আইনানুগ করা হয়। যা ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। যার ফল হয় নারীর জন্য ভয়াবহ। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফলে এদের মান-মর্যাদা বলতেও কিছু ছিল নাছিল না কোন অধিকার। Leila Ahmed যে আইনকে উল্লেখ করেছেন,'extreme androcentric bias' বলে। মুসলিম নৈতিকতার কন্ঠটি কিন্তু এক্ষেত্রে ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। উপপত্নী এবং দাসীদের ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকার পাওয়ার ফলে নারীদের অবস্থা দাঁড়াল ঘরের কোনে পরে থাকা ব্যবহার্য্য কোন বস্তুর চেয়েও করুন। অধিকার বিহীন। অন্ধকারে দিন-রাত্রি পার করা শুধু। সমাজের উপর তলার নারী সমাজের অবস্থাও সুখকর ছিল না। কারণ এরা  ছিল একেবারেই প্রান্তিক- যে কারণে আসলে তাদের কোনোভয়েস’-ই ছিল না

Mrnissiও প্রায় একই কথা উল্লেখ করেছেনতিনিও দাবি করেছেন তুলনামুলকভাবে মোহাম্মদের সময় নারী কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করত। যেমন ঘরের বাইরে তাদের উপস্থিতির প্রমান পাওয়া যায়। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে না হলেও তিনি লিখেছেন - They were active in the early Islamic movement.” মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী। তাছাড়া মোহাম্মদের প্রিয় পত্নী আয়শা ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের অন্যতম প্রধান উ

Mernissi ভাষায় -... She was a major political actor in the civil war or strife (fitna) following the assassination of the third caliph 'Uthman in 656. Her role as a source of hadiths is so important that in one tradition the Prophet is supposed to have told the Muslims that they ' received half their religion from a woman. এছাড়াও ইসলামে অনেক নারী বিদ্বেষী হাদিসের উস আবু হুরায়রার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেনযেমনFatema Mernissi সহ অনেকেই মনে করেন আয়েশার সাথে সাহাবী আবু হুরায়রার দ্বন্ধের কারণেই বহু নারী বিদ্বেষী হাদিস সৃষ্টির মূল কারণ

যাই হোক। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে পবিত্র ধর্মের নামে পিতৃতান্ত্রিকতার ভয়াবহ মিশেল দিয়ে উদ্ভট এক খিচুড়ি পাকানো হয়েছে। ল্ড টেস্টামেন্ট থেকে জেনেসিসের মিথ সামান্য অদল-বদল করে নিজেদের বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে ইসলামে। তাই আদম হাওয়া আর  গন্দম ফলের কথা পাওয়া যায় লোকমুখে। দম এর প্রয়োজনে এখানেও দেখা যায় হাওয়ার জন্মঅর্থা ধর্মে নারী চরিত্রের সৃষ্টি পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। বেহেস্তে যেতে হলেও নারীর জন্য প্রয়োজন হয় পুরুষের সার্টিফিকেট। প্রভু-স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট হলেই কেবল তিনি বেহেস্তে যাওয়ার সার্টিফিকেট পাননাহলে নয়যেমন হাদিস আছেযে পর্যন্ত স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট নয় সে বেহেস্তে যেতে পারিবে না...

এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার। মুসলিম নারীবাদী এবং স্কলারদের দৃষ্টিতে সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে- কোরান অপরিবর্তনীয়-এই বদ্ধমূল বিশ্বাস। মুসলিমদের মধ্যে এই বিশ্বাসের ফলেই কোরানকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য সামান্য পরিবর্তন সাধন করাও এক কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে পুরুষতন্ত্র কোরানের আক্ষরিক অর্থ ধরে রাখায় অতি উসাহী। বিশেষ করে কোরানের যে সব আয়াতে জেন্ডার ইস্যু পরিস্কারভাবে উল্লেখিত আছেসেগুলো নিয়ে আসলে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে। বর্তমান সভ্যতায় ইসমিক রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার সাথে যা খাপ খায় না মোটেই। বরং ন্যায় এবং সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে মধ্যযুগের আইনকে ধর্মের নামে আঁকড়ে পরে থাকা মানে সমাজ-সভ্যতাকে উটের যুগে ফিরিয়ে নেওয়া। আজকের সমাজ-বাস্তবতার সাথে যার দ্বন্দ্বঅনিবার্য। যেমন ইসলামিক ষ্টাডিজ এবং কম্পেরাটিভ রিলিজিয়ন-এর অধ্যাপকইতিহাসবিদএবং ইসলামসহ বহু গ্রন্থের লেখক Malise Ruthven লেখায় কিছুটা ফুটে উঠছে। আমি Ruthven -এর Islam’ থেকে সম্পূর্ণ লাইনগুলো এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি :

"The argument that a woman giving evidence on a business matter might need assistance from her friend might make sense under pre-modern conditions when most women were illiterate, but as the Quranic rules stand, the testimony of a woman with a higher degree in business administration is only worth half that of an illiterate male. Beyond such textual sticking points, however, there are areas where masculine or andocentric interpretations are being contested, particularly in the field of hadith, where the questioning of sources belongs to a time honoured methodology and is less controversial than taking issue with the text of the Quran. The biggest obstacles facing Muslim feminists are cultural and historical: feminism is perceived as coming from a hostile source." (Malise Ruthven: Islam, 113)

অবশেষে বলার কথা একটাইযদিও মুসলিম নারীবাদীরা মনে করেন, ‘ইসলাম’ নয়প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতন্ত্রই ধর্মের নামে নারী পুরুষের বৈষম্য টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক একইভাবে খ্রিস্টান ধর্মেও দেখি খ্রিস্টান নারীবাদীরা যে উস থেকে গরলের উপত্তিতাকে মাফ করে দেন আবলীলায়খালি পুরুষতন্ত্রের উপর ঝাল ঝাড়েন। বিষয়টা কিছুটা হাস্যকরও। গোড়ায় গলদ রেখে মাথায় জল ঢেলে কি হবেপুরুষ রচিত ধর্মে নারীর জন্য যসামান্য দয়া দাক্ষিণ্য আছে হয়ততাও তাদেরই স্বার্থে। নারীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যকে পূরুষের তুলনায় নিম্নশ্রেণীর আখ্যা দিয়ে তাকে `ধর্মেরপ্রলেপ মিশিয়ে মহিমান্নিত করা হয়েছেএই বলে যেনারী বাঁক্ণাকারণ তার সৃষ্টিই বাঁকা হাঁড় থেকে। বিস্তারিত পরিসরে না গিয়েও হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়হিন্দুধর্মে ক্ষেত্রবিশেষে নারীর অবস্থা মুসলিম নারীর চেয়েও অনেক বেশি শোচনীয় ছিল। বিধবা বিবাহ ছিল এক অসম্ভব ব্যাপারসতীদাহের মত জঘণ্য এক প্রথা চালু ছিল ধর্মের নামে। এই ধর্মে কয়েকজন যোগপুরুষের আবির্ভাবে আগের অবস্থার কিছুটা অবসান হলেওএখনও নারী সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। নারী-শিশুদের তো এখনও সেখানে জন্মাতেই দেওয়া হচ্ছে না। সে আরেক ভয়াবহ চিত্রঅন্য প্রসঙ্গ

মোদ্দা কথা হচ্ছে কোন ধর্মই যেহেতু নারীর প্রয়োজনে বা নারীর কল্যাণে সৃষ্টি হয়নিনারীর ধর্ম-কাতরতা তাই দূর করা প্রয়োজনতাদের নিজেদের-ই কল্যাণের জন্য।  ধর্ম রচিত হয়েছে পুরুষদের দ্বারা, পুরুষদের জন্য, নারীর কল্যানের জন্য নয়। বেগম রোকেয়া এ প্রসঙ্গে 'আমাদের অবনতি' প্রবন্ধেদ্বিধাহীন কন্ঠে বলেন 

যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেনঅমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।  আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাইতাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে  অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।  এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে

ধর্মে থাকবেনআবার পুরুষের সমান অধিকারও দাবি করবেনএটা আসলে অনেকটা সোনার পাথরবাটি’ যেমনতেমনি। ধর্ম আকঁড়ে থাকতে গেলে এর চেয়ে বিপরীত চিত্র আশা করা যায় না। কারণ ধর্ম নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়নি। মোল্লাপুরোহিতরা কোত্থেকে দেবেখোদ ধর্মবিষয়টাই উপড়ে ফেলতে পারলেমানব সভ্যতা রক্ষা পেলেও পেতে পারে


তথ্যসূত্র :
Drury, C. (1994) 'Christianity' in J. Holm with J. Boker (eds) Women in Religion, London, Printer Publishers, 30.

Ruthven, M. (2000) Islam, 2nd edn, Oxford, Oxford University Press.

Wadud-Muhsin, A. (1999) Qur'an and Woman: Re-reading the Sacred Text from a Women's Perspective, Oxford, Oxford University Press (first published 1992).

Linda Woodhead, Christianity, Oxford University Press (2004)

Leila Ahmed, Women and Gender in Islam (1992)

http://www.islamdharma.

                                
   
      সূত্র ;-এই লেখাটি হুমায়ুন আজাদের নারী গ্রন্থের অনুকরণে লেখা হয়েছে ।
  
        (বি : দ্র : এই লেখাটায় কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে বা অন্য কোনোভাবে
            কাউকে আঘাত দেয়ার জন্যে লেখা হয় নাই ,কোনো গণমাধ্যমে
            ও ইহা প্রকাশ করা যাবে না, লেখকের অনুমতি ছাড়া ,ধন্যবাদ )

মন্তব্যসমূহ