পৌরাণিক কাহিনীর
আলোকে হযরত নুহ(আ)
এর মহাপ্লাবন এবং বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যা
প্রাচীন হিব্রুজাতির মধ্যে অনেক
রূপকথা-উপকথা বা পৌরাণিক কাহিনীর প্রচলন ছিল । এর কিছু পার্থিব এবং কিছু
অপার্থিব প্রণীদের কল্পিত কাহিনী, যা হিব্রুদের মুখে মুখে দীর্ঘকাল থেকে চলে
আসছিলো যা কালক্রমে ইহুদী পুরোহিত বা ‘ রাব্বি’গণ ঐ পৌরণিক কাহিনীগুলোকে সংকলন
করে বিরাট দুইখানা পুস্তক লেখেন । যার নাম
তালমুদ ও মিদ্রাস । ঐ গ্রন্থ দুটো রূপকথা-উপকথা ছাড়াও
কুসংস্কারের অফুরন্ত ভাণ্ডার।
বর্তমান জগতে যত কুসংস্কার প্রচলিত আছে,
ধরে নেয়া হয় ঐ গ্রন্থ দুটোই তার প্রধান কারণ । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
হলো ,ঐ তালমুদে বর্ণিত কাহিনীগুলোর মূল সূত্র অর্থাৎ ব্যক্তি বা স্বর্গদুতগণের
নাম বাইবেলে লিখিত থাকায় অনেকে ঐ সব কল্পিত কাহিনীগুলোকে ধর্মীয় কাহিনী হিসাবে
গ্রহন করেছেন , সত্য কাহিনী মনে করে । বিশেষ করে সিমিটিক তিনটি ধর্মের ধর্মীয়
গ্রন্থে। (সূত্র;-প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্রোপাধ্যায়, পৃ, ১১৩--১১৫ ) তা হলে সেমিটিক তিন ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণনা
কী মিথ্যা ? তার আগে
পৌরণিক কাহিনী গুলো কি তা জানা দরকার ।
জোসেফ ক্যাম্পবেল (১৯৪৯-১৮৮৮ খ্রিস্টপূর্ব)
তার সারা জীবন ব্যয় করেছেন, পৌরাণিক কাহিনী কী , তা জানতে এবং তার গবেষণায় বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিকভাবে মানুষের
কাছে ব্যাখ্যা করতে । তার মতে, মহাপ্লাবন সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে যে
ভাবে দেখা হয় তার থেকে অনেক গভীর মর্মার্থ রয়েছে । পৌরাণিক কাহিনী কোনো
ঐতিহাসিক সত্য কাহিনী নয় এটি হলো মানব সভ্যতার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সংগ্রাম
।
প্রতিটা মানুষের মনেই তার জন্মের উদ্দেশ্য,
সে কীভাবে এলো , কেমন করে এলো এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে তার মনে । আর এই প্রশ্ন থেকে
মুক্তি পেতে সে বিভিন্ন ঊত্তর দাঁড় করায় । আর তা থেকেই জন্ম নেয় পৌরাণিক কাহিনীর
। পৌরাণিক কাহিনীগলো ঐতিহাসিক সত্য কোনো কাহিনী নয় ৷ বিজ্ঞানের সাথেও
এর বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই । কিন্তু ধর্ম এসে এই শ্বাশত কাহিনীগুলোকে
সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে একে বিজ্ঞান বলেও অনেক সময় প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে । সৃষ্টিবাদীরা
পৌরাণিক কাহিনীর চমৎকার সব গল্পকে সত্য মনে করে তাকে বর্তমান রূপে রূপান্তরিত করেছে
৷ ( সূত্র;- Michael Shermer, Why people Believe Weird Things :
Pseudoscience, Superstition, and Other Confusions of our Time, W, H ,Freeman
& Company, 1998, পৃস্টা ১৩০ * )
হযরত নুহ(আ) এর মহাপ্লাবন সম্পর্কিত
পোরাণিক গল্পের সূচনা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে নয় । এর উৎপত্তি আরো অনেক
আগের । নিম্নে এ ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য অনুসন্ধান করে সংযোজিত করার চেষ্টা করা হলো
।
সুমেরীয় ‘ গিলগামেশ’ কাহিনী কী ? সুমেরীয়
সভ্যতায় কাদামাটির চাকতির উপর লিখে ঐ গুলোকে পোড়ায়ে শক্ত বা কঠিন হত ঐ সুমেরীয় দেশের এক বিদ্যোৎসহী সম্রাটের গ্রন্থাগারের জন্যে। কালক্রমে ঐ গ্রন্থাগারটা
ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যায় । অধুনা প্রত্নতাত্ত্বিকগণ উক্ত ভগ্নস্তুপটি
খনন করে উদ্ধার করেছেন ৷ আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটি
ও বহু মৃৎচাকতির গ্রন্থ ছিল । এর মধ্যে বারোটা মৃৎচাকতির উপর লিখিত তিনশত পঙক্তি সমন্বিত
গিলগামেশ নামক একখানা মহাকাব্য ও উদ্ধার করা হয়েছে । ( রামায়ণ মহাকাব্যের মত একটা
গ্রন্থও পরবর্তিকালে ধর্মগ্রন্থের অনুরূপ স্থান করে নিয়েছে, অনেকের কাছে,
)
উক্ত মহাকাব্য গ্রন্থের দ্বিতীয় স্তরে
লেখা আছে একটি মহাপ্লাবনের কাহিনী । ঐ কহিনীটিতে বলা হয়েছে- সুদূর অতীতে
দেবতারা মানব জাতিকে ধ্বংস করার সংকল্প করে পৃথিবীতে প্লাবন সৃষ্টির জন্য দেবসেনাপতি
এনলিনকে আদেশ দেয়া হয় । দৈবানুগ্রহে পূর্ব হতে সংবাদ পেয়ে আত্মরক্ষার জন্য উৎনা
পিসতিম একটা নৌকা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। অতঃপর বাত্যাদেবতা এনলিন যখন
প্লাবন দ্বারা পৃথিবী নিমজ্জিত করেন তখন উৎনা পিসতিম ও তাঁর পত্নী সেই বজরায় উঠে
প্রাণ রক্ষা করেছেন ৷ এবং তাঁরা জীবকুলের বংশরক্ষার জন্যে প্রত্যেক জাতীয় জীবের এক এক জোড়া সহ কিছু পশু-পাখি নৌকায় তুলে নিয়েছিলেন ৷ এর ফলে আর প্রাণীজাতি ধ্বংস পায় নাই । (সূত্র;-প্রাচীন
ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্রোপাধ্যায়, পৃ, ২৪-২৬ , ১৮৮-১৯৩,)
অন্য এক ভাষ্য বা বর্ণনা মতে খ্রিস্টপূর্ব
২৮০০ এর দিকে সুমিরিয়ান পুরাণে এমন এক বন্যার বর্ণনা পাওয়া যায় যার নায়ক ছিলেন রাজা
জিউশুদ্র ৷ যিনি একটি নৌকা তৈরির মাধ্যমে একটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজে
সহ অনেককে রক্ষা করেছেন । খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৮০০ এর মধ্য বিখ্যাত বেবেলনিয়ান
পৌরাণিক চরিত্র গিলগামেশ তার এক পুরুষের য়ুতনাপিসটিমের কাছ থেকে একই রকম এক বন্যার
কথা শুনতে পেয়েছেন বলে জানা যায় । সেই গল্পানুসারে পৃথিবীর দেবতা আ (Ea) রাগান্বিত হয়ে পৃথিবীর সকল জীবন ধ্বংস করে
ফেলার অভিপ্রায়ের কথা য়ুতনাপিসটিমকে জানান । তিনি তাকে ১৮০ ফুট লম্বা, সাততলা
বিশিষ্ট এবং প্রতিটি তলায় নয়টি কক্ষ থাকবে এমন একটি নৌকা তৈরি করে তাতে পৃথিবীর সকল
প্রজাতির এক জোড়া করে তুলে নেবার আদেশ দেন । (সূত্র ;*ঐ)
গিলগামেশের এই মহাপ্লাবন মিথটিই লোকেমুখে
সবচেয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর সেমিটিক ৩টি ধর্মের একক
ও অভিন্ন জনক হযরত ইব্রাহীম(আ) এর অনুসারীরা (পুজারি হিব্রুরা ) প্যালেস্টাইনে আসার
অনেক আগে থেকেই সেখানকার মানুষের কাছে এই গল্প প্রচলিত ছিল । আর সেই গল্পের প্রভাবই দেখতে পাওয়া যায় যে পরবর্তিকালের
হিব্রুদের আদি পিতা এবং সিমিটিক ৩ ধর্মের জনক আব্রাহামের পরবর্তী বিভিন্ন
ধর্মগ্রন্থ তৌরাত , ও বাইবেলে । আর
সম্ভবত এই তৌরাত, বাইবেলের গল্প থেকেই অনুপ্রানিত হয়েছে পরবর্তী সিমিটিক ধর্মের
শেষ ধর্মগ্রন্থ ইসলাম ধর্মের পবিত্র কোরানের নুহের মহাপ্লাবন কাহিনীর । সুরা
আল-ইমরান এর ৭নং আয়াতে বর্ণিত কোরানের রূপক বা অস্পষ্ট আয়াতে, যাকে কোনো কোনো মাহযাবের
ব্যাখ্যাকারিরা কোরানের এই রূপক অংশের আয়াতগূলোকে কেচ্ছা -কাহিনীর আয়াত হিসাবে অভিহিত
করেছেন ক্ষেত্র বিশেষে । তাই এই প্লাবনকে কেচ্ছা কাহিনী হিসাবে দেখা যেতে পারে ৷ তবে গিলগামেশ মহাকাব্যের প্লাবনের কাহিনীর সহিত অন্যান্য দেশের কাহিনী মিলিয়ে
দেখলে বুঝা যায় যে নানান ভঙ্গির কাহিনী সত্ত্বেও উহাদের মধ্যে কিছু না কিছু মিল
আছেই ।
সুমেরিয়া এবং ব্যবিলনিয়া জনপদ টাইগ্রিস
এবং ইউফ্রাটিস নদী দিয়ে আবৃত ছিল । এসব অঞ্চলে প্রায়ই বন্যা হতো । সমগ্র পৃথিবীতে
এক সঙ্গে প্লাবনের কোনো নজীর পাওয়া যায় না ইতিহাসে বা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ।
ভূ-তত্ত্ব বিদরা গবেষণায় দেখেছেন যে
পৃথিবীতে এমন কোনো মহাপ্লাবন হয় নি, যাতে করে বাড়ি-ঘর থেকে শুরু করে সকল উঁচু পর্বত
ডুবে গিয়েছিল । এছাড়া মহাপ্লাবন এর ফলে মৃত প্রাণীদের জীবাশ্মগুলো সব মাটির একই
স্তরে থাকার কথা ছিল, (যেহেতু তারা সবাই একই সময়ে মৃত বরণ করেছিলো) তেমন কোনো প্রমাণও খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা
। আর এব্যাপারে শুধু ভূ-তত্ত্ব বিদরাই নয় , জীবনবিজ্ঞানী সহ পদার্থবিজ্ঞান
,রাসায়ন ,ইতিহাস , ফসিল বিদ্যা , উদ্ভিদবিদ্যা , এবং প্রাণীবিদ্যা বিদগণ সবাই এ বিষয়ে
বিভিন্ন গবেষণার দ্বারা ঐক্যমতে পৌছেছেন যে ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণনা অনুসারে বা এমনকী
পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা মত কোনো মহাপ্লাবন সমস্ত পৃথিবীতে এক সঙ্গে হয় নি ।
সূত্র;-সৃষ্টি রহস্য, লেখক-আরজ আলী মাতুব্বর
,
অবিশ্বাসের দর্শন ,লেখক-অভিজিৎ
রায় ও রায়হান আবীর,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন