শরীরের ভেতরে গোপন ‘দেহঘড়ি’: ১২টি অজানা তথ্য and দেহ ঘড়িতে' গোলমাল হলেই খারাপ হবে মেজাজ ( cfourtecy;- bbc bangla )
শরীরের ভেতরে গোপন ‘দেহঘড়ি’: ১২টি অজানা তথ্য
আপনি কি 'সারকেডিয়ান রিদম' সম্পর্কে জানেন?
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মানবদেহ থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল জীবের ভেতরেই আছে এক অদৃশ্য ছন্দ। এটাকেই বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় 'সারকেডিয়ান রিদম'।
'সারকেডিয়ান রিদম' হলো একটি শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া যা প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার চক্র পূরণ করে এবং জীবিত বস্তুর অস্তিত্বকে এক অদৃশ্য ছন্দে বেঁধে দেয়। একেই বলা হয় দেহঘড়ি।
কিন্তু এটা সম্পর্কে আপনি কতটা জানেন? এটা আপনার জীবনকে কতটা প্রভাবিত করে তা কি আপনি জানেন?
১. 'সারকেডিয়ান রিদম': সৃষ্টির শুরু থেকে যেটা বিরাজমান
ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে প্রথম যখন থেকে সেল বা কোষ পাওয়া যায় তখন থেকেই ছিল এই সারকেডিয়ান রিদম। এছাড়া এটাও মনে করা হয় যে, সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে দিনের বেলায় যে কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো রাতে সেগুলো নিজেদের সারিয়ে নিতো।
২. 'দেহঘড়ি' সবারই আছে:
ধারণা করা হয়, যে কোনো জীবিত সত্বা— তা সেটির গঠন ও আকৃতি যাই হোক না কেন— যদি সূর্য থেকে নিজের শক্তি সংগ্রহ করে তাহলে এটির একটি দেহ ঘড়ি থাকবেই। আলো ও অন্ধকারের সূত্র মেনে এই ঘড়ি কাজ করবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, 'মিমোসা লিভস' বা লজ্জাবতী পাতা অন্ধকারেও নিজেকে গুঁটিয়ে নেয় এবং মেলে ধরে। অর্থাৎ সূর্যঘড়ি অনুসরণ না করে বরং লজ্জাবতী তার দেহঘড়ি মেনেই চলে।
৩. দেহঘড়ি জীবকে দেয় সীমানার বোধ:
দেহঘড়ি জীবকে নানা ধরনের সুবিধা দেয়। যেমন: দেহঘড়ির কারণে জীব টের পায় দিন-রাত ও শীত-গ্রীষ্মের ব্যবধান। আর সেই অনুযায়ী শরীর নিজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলোও নেয়।
৪. শরীরের ভেতরেই আছে এক 'মহাঘড়ি':
মস্তিষ্কের হাইপোথেলামাস অংশে এই মহাঘড়ির বাস। এটি অনেকটা 'কন্ডাক্টর' বা নেতা গোছের একটি বস্তু।
দিনজুড়ে সমস্ত শরীরে যে সকল সিগন্যাল বা নির্দেশাবলীর আদান-প্রদান চলতে থাকে এখান থেকেই তার সব নিয়ন্ত্রণ ঘটে।
৫. শরীরে আরেকটা প্রান্তীয় বা 'পেরিফেরাল' ঘড়িও আছে:
শরীরের প্রতিটি অঙ্গ এবং টিস্যুরও রয়েছে নিজস্ব ঘড়ি। এই সব ঘড়িগুলোকে একটি তাল ও লয়ে সমন্বয় করে রাখে হাইপোথেলামাসে থাকা সেই মহাঘড়ি।
৬. শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতরেও আছে স্বতন্ত্র ঘড়ি:
শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতরে রয়েছে একেকটি স্বতন্ত্র ঘড়ি। ২৪ ঘন্টায় যার চক্র পূরন হয়।
৭. সারক্যানুয়াল রিদম
রাত যত দীর্ঘ হয়, ঘুম যত প্রলম্বিত হয়, মস্তিষ্ক তত মেলাটোন নিষ্কাষন করে। এই হরমোনের কারণেই মানুষের ঘুম ও জেগে উঠা নিয়ন্ত্রিত হয়।
অনেক প্রাণী, যেমন হরিণ, এই ছন্দ মেনেই নিজেকে সঙ্গম ও হাইবারনেশানের জন্য প্রস্তুত করে।
আর এটিও মনে করা হয় যে, রোগ-বালাই ও অসুস্থতার সাথে লড়াই করার জন্য মানুষের শরীর শীতকালে বেশি মাত্রায় এন্টিবডি তৈরি করে।
৮. সূর্যালোক মানুষকে রাখে সুষম, সুস্থির
যদি কাউকে অন্ধকারে ফেলে রাখা হয় তাহলে তার দেহঘড়ি ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে পড়বে।
মানুষের চোখের ভেতর এক ধরণের সেন্সর রয়েছে। যেগুলো দিয়ে আলোকে সনাক্ত করা হয় এবং মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় অংশে সংকেত পাঠানো হয়। আর এভাবেই শরীরে ভেতরে গোপন দেহঘড়ি নিজের ছন্দ ধরে রাখে।
৯. এখন ঘুমের সময়
ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠার পর থেকেই শরীরে ঘুমের জন্য একটু-একটু করে চাপ তৈরি হতে থাকে।
কিন্তু সামান্য চাপেই কেউ ঘুমে তলিয়ে যায় না। বরং দেহঘড়ি যখন বলে, এখনই ঘুমের উপযুক্ত সময় তখনই শরীর ঘুমে ঢরে পড়ে।
১০. জেট লেগ
শরীর কখনো-কখনো বেতাল লাগে। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিলে এমন হয়। একদিকে ঝিমুনি-ঝিমুনি লাগে, অন্যদিকে ঘুমও ঠিক আসে না। সাধারণত শরীরের ভেতরে থাকা মহাঘড়িটি যখন একটা সময়ে থাকে কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন পাকস্থলি, মস্তিষ্ক বা এরকম অন্য অঙ্গগুলো যখন ভিন্ন-ভিন্ন ছন্দে থাকে তখনই এমনটা হয়।
একেকটি টাইম জোন পাড় হবার পর শরীরের মহাঘড়িটি তার নিজের ছন্দে ফিরে আসতে সাধরণত ২৪ ঘন্টা সময় লাগে।
১১. সামাজিক জেট লেগ
যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিফটের কাজ করে তাদের দেহঘড়িটি অনেক সময় এলোমেলো হয়ে যায়। এই দশাটিকে বলা হয় 'সোশাল জেট লেগ' বা সামাজিক পরিস্থিতির কারণে তৈরি হওয়া শারিরীক বিড়ম্বনা।
১২. ক্লান্ত টিনেজারদের সকালে কিছুক্ষণ বেশি ঘুমোতে দিন
বয়:সন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীরের ভেতর হরমোনের একটা বন্যা বয়ে যায়। এর ফলে, এই বয়সীদের দেহঘড়ি ঘন্টা দু'য়েক পেছানো থাকে।
তাই, অতি সাত সকালে তাদেরকে ঘুম থেকে ডেকে না তুলে আরো কিছু সময় ঘুমাতে দেয়া দরকার।
অবশ্য বয়স হলে পরে আবার এই দেহঘড়ি পাল্টে যায়। বয়:সন্ধিকালের আগে যেমন ছিল বয়সকালে শরীর আবার সেই অবস্থায় ফিরে যায়।
দেহ ঘড়িতে' গোলমাল হলেই খারাপ হবে মেজাজ
এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের 'দেহ ঘড়ির' ছন্দে কোন উল্টোপাল্টা হলেই তার 'মুড ডিজঅর্ডার' বা মেজাজ খারাপ হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর গবেষকরা ৯১ হাজার লোকের ওপর এক জরিপ চালানোর পর বলছেন, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ভীষণ রেগে যাওয়া, একাকীত্ব, অসুখী মনোভাব, আরো অনেক মানসিক সমস্যার সাথে মানবদেহের স্বাভাবিক ছন্দ বিঘ্নিত হবার সম্পর্ক আছে।
'দিনে জেগে থাকা আর রাতে ঘুম' - এই হচ্ছে মানবদেহের স্বাভাবিক ছন্দ - যা অনুযায়ী দেহের প্রতিটি কোষ, শারীরিক প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্র কাজ করে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষকরা বলছেন, কেউ যদি রাত জেগে বেশি কাজকর্ম করে বা সক্রিয় থাকে, বা দিনে নিষ্ক্রিয় থাকে তাদেরকেই দেহঘড়ির বিঘ্নের আওতায় ফেলা হয়েছে।
এদের মানসিক নানা সমস্যায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিক জীবনযাপনকারীদের চেয়ে ৬ থেকে ১০ শতাংশ বেশি।
গবেষকরা বলছেন, অনেক সমাজেই এই স্বাভাবিক মানুষের জীবনযাপনে এই স্বাভাবিক দিনরাতের চক্র বদলে যাচ্ছে এবং তাদের জন্য এই জরিপের ফলাফল একটি সতর্কবাণী।
তবে দেহঘড়ির এই ছন্দ-বিভ্রাটই কি মানসিক রোগের কারণ, নাকি এটা তার লক্ষণ মাত্র? জরিপটিএ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি। এ জন্য আরো গবেষণা দরকার হবে।
দেহঘড়ির এই ছন্দকে বলে সার্কেডিয়ান রিদম। মানুষের মনমেজাজ, হর্মোনের স্তর, শরীরের তাপমাত্রা, এবং দেহের বিপাক ক্রিয়া - এই সবকিছুর ওপরই এর প্রভাব ব্যাপক।
দিনের শুরুতে সকালবেলা যখন মানবদেহ জেগে ওঠার পর জোরেশোরে কাজ করতে শুরু হরে - ঠিক যেমন একটা গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার মতো - তখন এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। যা দেহঘড়ির গুরুত্বের আরো একটি দৃষ্টান্ত।
বিবিসিকে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল স্মিথ বলেন, এই জরিপে দেহঘড়ির সমস্যায় আক্রান্ত এমন যারা অংশ নিয়েছেন - তাদের কেউ কেউ হয়তো রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন - এটা হতে পারে।
তবে আমার জন্য কড়া নিয়ম - আমি রাত ১০টা বাজলেই আমার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেই - বলেন ড. স্মিথ।
"কারণ, বিবর্তন অনুযায়ী মানুষ এমন ভাবে তৈরি হয় নি যে যখন তার ঘুমিয়ে থাকার কথা, তখন সে মোবাইলের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকবে" - বলেন তিনি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন