A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা - নাজিম উদ্দিন / সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮ / ( courtecy; nobogeg blog & nazim uddin )




নাজিম উদ্দিন

ধারাবাহিক অনুবাদ

(১ম পর্ব)

ভূমিকাঃ
একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ একটি প্রয়োজনীয় ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রণীত প্রথম সংবিধানে গণতন্ত্র, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ এর নিশ্চয়তা দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের ওপর কোন রকমের হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং একের পর এক সরকারগুলোর অনিচ্ছার কারণে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা অধরা থেকে যায়। তাছাড়া, নির্বাচিত সরকারগুলো, সেটা সামরিক স্বৈরাচার বা বেসামরিক সরকার যেই হোক না কেন, সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে ছিল উদাসীন। সরকারগুলো কোনভাবেই বিচার বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের অবৈধ হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা কমে আসুক এটা চাইত না। একইসাথে এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে গত চার দশকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ সময়ে বিচার বিভাগে উঁচু মাত্রার প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের আগমন ঘটে, তার সাথে নতুন প্রযুক্তির অন্তর্ভূক্তি, নাগরিকদের সমানভাবে দেখার প্রবণতা, যুদ্ধাপরাধী এবং জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ার বাধা অপসারণ, নাগরিকদের আইনী স্বাধীনতা রক্ষা করা ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

আমার জীবনে সেই ১৯৭৪ সালে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলার নিম্ন আদালতের আইনজীবী থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং বাধাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও সম্মান ঘটেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দেবার পরে বর্তমান সরকার কর্তৃক আমাকে পদত্যাগ ও জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এবং নেতৃত্ব নিয়ে পর্যবেক্ষণসহ সর্বোচ্চ আদালত থেকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকাশিত এ রায় দেশের আপামর জনগণ, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের দ্বারা আদৃত হয়। স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়ে এ রায় দেশে-বিদেশে নানা মিডিয়ারও নজর কাড়তে সক্ষম হয়। কিন্তু এটি ক্ষমতাসীন সরকারের রাগ আরো উসকে দেয়।
 বাংলাদেশে বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগের মধ্যকার বিভেদ এবং যার কারণে একজন গদীনসীন প্রধান বিচারপতিকে অবৈধভাবে সরিয়ে দেবার মত এমন অভূতপূর্ব ও দূর্ভাগ্যজনক অবস্থার শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন জাতীয় সংসদে সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের দ্বারা উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা দেয়া হয়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্যদের দ্বারা বিচারকদের অপসারণের ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অভিযুক্ত বিচারকের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে এবং বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ মুক্ত থেকে তাদের সেবা না করে জনগণের পক্ষে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত হয়। তাই ২০১৬ সালের ৫ মে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ থেকে বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হয়। এ রায় ঘোষণার পর পরই সংসদ সদস্যরা বিচারকদের হেনস্থা করে এবং আদালতের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন শুরু করেন। রাষ্ট্র এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে এবং সাত সদস্যের এক বেঞ্চে তার শুনানী হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে আদালত সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। সে বছর আগস্ট মাসের প্রথম দিন আদালতের সর্বসম্মত রায় এবং পর্যবেক্ষণ জনগণের জন্য উম্মুক্ত করা হয়।
গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সংসদে আদালতের রায় বাতিল করার জন্য আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী, তার দলের অন্যান্য সদস্যরা, মন্ত্রীরা আমাকে সংসদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় ভীষণভাবে তিরষ্কার করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্যরা আমাকে বিভিন্ন দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। আমাকে নিজের সরকারি বাসায় অন্তরীণ করে রাখা হয়, সে সময় আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার কাছে আসতে বাধা দেয়া হয়। মিডিয়াকে বলা হয় আমি অসুস্থ, আমি স্বাস্থ্যগত কারনে ছুটিতে আছি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী বলতে লাগলেন আমি নাকী সরকারী ছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব, এবং এমতাবস্থায় অক্টোবরের ১৪ তারিখে আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দেশ ছাড়ার আগে পরিস্থিতি কিছুটা পরিষ্কার করতে আমি জনগণকে জানাই যে, আমি মোটেও অসুস্থ নই এবং চিরতরে দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি তখন ভেবেছিলাম আমার শারীরিক অনুপস্থিতি ও কোর্টের নিয়মিত ছুটি কাটানোর পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হবে এবং সবার মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সরকারও বুঝতে পারবে যে এ রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত হবে এবং সেটা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভাল হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই (ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) এর মাধ্যমে আমার পরিবারকে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করার কারণে আমি বিদেশে অবস্থান করা অবস্থায় বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ থেকে অবসর নিতে বাধ্য হই।
এ বইয়ে আমি আমার জীবনের প্রথম দিককার অস্তিত্বের সংগ্রাম, বিচারকের জীবন ও অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জঃ এর স্বাধীনতার সংগ্রাম, বিচার ব্যবস্থা ও রাজনীতিকদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও গনতান্ত্রিক শৈশব; বিভিন্ন বিষয়ে আমার বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গী, পাবলিক কৌশলীদের (পিপি) মামলা পরিচালনার ধরন নিয়ে ভৎর্সনা, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, জরুরী অবস্থা এবং ডিজিএফআই কর্তৃক ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদাবাজি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছি। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে বার কাউন্সিল এর ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা দলীয় বিভেদের জন্য আদালতের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি যেটা বিচার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সমতুল্য।   
এ বইয়ে আমি বাংলাদেশের আইন এবং শাসন বিভাগের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের বিকাশের একটা ঘনিষ্ঠ বর্ণনা এবং বিচার বিভাগ থেকে আমাকে জোরপূর্বক অপসারণের বর্ণনা দিয়েছি। এ বর্ণনায় আমি আমার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ন্যায় পরায়ণতা থেকে বলার চেষ্টা করেছি, এতে দেশের সরকার ব্যবস্থা বা জাতির জন্য ভবিষ্যত কোন দিক-নির্দেশনা নেই। সেটা দেশের মানুষ ঠিক করবে, যারা স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও সাম্যের প্রশ্নে কখনও আত্মত্যাগ করতে পিছু হটেনি। এটা আমার অসমাপ্ত আত্মজীবনী যাতে আমি বলার চেষ্টা করেছি কীভাবে আমার মতো ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষ একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধান বিচারপতি হতে পেরেছি। এছাড়া এ বই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় আমি কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি তার বিবরণ। আমার এ ঝড়-ঝঞ্ঝাময় ভ্রমণ কাহিনী জাতীয় জীবনেরও ঘূর্ণাবর্তের কাহিনী। যার ফলে যারা সমসাময়িক বাংলাদেশ, এর কষ্ট ও দূর্দশাকে বুঝতে চান এ বই তাদের জন্য পাঠ্য। তাছাড়া যে কেউ উন্নয়নশীল দেশের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যকার সম্পর্ক এবং গণতান্ত্রিক শৈশবস্থায় বিচার বিভাগের চ্যালেঞ্জ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী এ বই তাদেরও কাজে আসবে। এ বই স্বার্থক হবে যদি এর দ্বারা পাঠক অনুপ্রাণিত হোন, তিনি হতে পারেন আইনজীবী বা আইনের শিক্ষক, অথবা একজন সাধারণ মানুষ। বইটি যদি পাঠকের মধ্যে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে পারে যে, আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা যাতে সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রয়োজন, যেটা রাজনীতিক বা বিচারকের জন্যেও প্রযোজ্য। বইয়ের রেফারেন্সে কিছু ভুল-ত্রুটি আছে, সেটা আমার বইয়ের স্বল্পতা এবং দেশ থেকে বই আনাতে অপারগতার জন্য হয়েছে। কিছু রেফারেন্স স্মৃতি থেকে দিয়েছি, আশা করছি পরের সংস্করণে সেগুলো সংশোধন করব।

নাজিম উদ্দিন
অধ্যায়: এক

প্রথম জীবন

আমার জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে, মৌলভীবাজার জেলার তিলকপুর গ্রামে। ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামটি সত্যিই চমৎকার একটা গ্রাম, যার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার শুরু ভারতে খুব ছোট্ট একটা ছড়া হিসেবে; যা গ্রীষ্মের সময় মাত্র ফুটখানেক গভীর থাকে।  কিন্তু বর্ষা মৌসুমে গ্রামে এই ছোট্ট নদীটির ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়, গ্রামের পর গ্রাম, অসংখ্য মানুষ হয় গৃহহীন। সেখানেই আমার বাবা স্বর্গত ললিত মোহন সিনহা পড়াশোনা করেন নরমাল হাই স্কুল ও কলেজে, যার অবস্থান শিলচর, ভারতের কাছাড় জেলায়। তিনি সেখানেই বাংলা সাহিত্যে নর্মাল ডিগ্রিতে অধ্যয়ন করেন যা আজকের দিনে আর্টস এ স্নাতকের সমতুল্য। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় তিনি স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন, স্কুলের নাম বাটুলী রাগানা উচ্চ বিদ্যালয়। আমার মা স্বর্গত ধনবতী সিনহা পড়াশোনা শুরু করেন কাছাড়ের করিমগঞ্জে, বড় বোনের বাড়িতে।
আমার মাসী প্রয়াত কোকিলা সিনহা স্বামীর সঙ্গে থাকতেন, যিনি ছিলেন একজন সাব-রেজিস্টার। যেহেতু মাসিমা ছিলেন খুব অল্পবয়স্ক, তাই তিনি খুব একাকী বোধ করতেন, আর আমার দাদা-দাদী তার সঙ্গী হবার জন্য মাকে পাঠালেন। তারা দুবোন ছিলেন পিঠাপিঠি আর তাই খুব ঘনিষ্ঠ। বাবা যখন রাগানা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত ছিলেন, তখন আমার মাকে বিয়ে করেন। মায়ের বয়স তখন ছিল খুব কম।
আমার বাবার দিকের আত্মীয়ের মধ্যে, তার এক ছোট ভাই ছিলেন প্রয়াত ভুবনেশ্বর সিনহা, যিনি ছয় ফুটেরও বেশী লম্বা এবং সুস্বাস্থ্য ও  পেটানো শরীরের অধিকারী ছিলেন। তিনি পড়াশোনার ব্যাপারে একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না এবং বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করেই সময় নষ্ট করতেন, আর ঠাকুরদার কাছ থেকে একধরণের প্রশ্রয় পেতেন। আমার ঠাকুরদা ধ্যানস সিনহা ছিলেন ‘টোলে’ (সংস্কৃত স্কুল) শিক্ষা লাভ করা ব্যক্তি আর উপনিষদ ও বেদ চর্চার মাধ্যমে তিনি বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ধর্মীয় দর্শন বিষয়ে। তিনি এই বিষয়ে বেশ কিছু পুস্তকও রচনা করেন।  আমার বাবা সেগুলো সযত্নে রক্ষা করেন এবং পাঠ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই, আমার পিতামহের দুনিয়াবি বিষয়গুলিতে কোন আগ্রহ ছিল না। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বড়সড় আমগাছ ছিল আর গাছের নিচে তিনি একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। যাকে তিনি বৃন্দাবন বলে অভিহিত করতেন, যেটা ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি তীর্থস্থান। তাঁর আশ্রমে, তিনি ‘রাখাল নাচ’ (ছেলেদের নাচের) শিক্ষা দিতেন এবং গ্রামবাসীদের প্রতি মাসে রাখাল নৃত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখতেন। এছাড়াও তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দীক্ষা দিতেন, শ্রী গীতা ও মহাভারত পাঠ হত নিয়মিত; আর ভক্তদের আপ্যায়ন করা হত ‘প্রসাদ’ দিয়ে—দেবতাদের নিবেদিত ফলে।
আমার চাচা, পিতার অনুপস্থিতি আর পিতামহের দুনিয়াবি বিষয়গুলোয় আগ্রহের অভাবের ফলশ্রুতিতে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী হননি। তিনি ফুটবল ও হকি নিয়েই  ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৪৭ এর শেষ দিকে বাবার বাড়ি ফিরে আসার পর আমার মা বাড়িতে চাচাকে শিক্ষাদান শুরু করেন আর পরবর্তীতে হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। আমার পিতা বাঙলা সাহিত্য, গণিতের শিক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তিনি গণিত বিশেষ করে পাটিগণিতে খুব দক্ষ ছিলেন।
আমদের ছিল খামার আর চষা জমি যা থেকে বিভিন্ন ধরণের ফসল ফলানো হত, যার দেখভাল করত স্থায়ী কামলারা। দুধের জন্য অনেকগুলো গরু ছাড়াও জমি চাষ দেবার জন্য ছিল দুটি মহিষ। আমার মাকে বেশ বড়সড় যৌথ পরিবারের জন্য রান্না করতে হত। আমাদের পরিবারে একটা রীতি ছিল যে কাজে যাওয়ার আগে বাড়ির পুরুষেরা গরুগুলোর যত্ন নিতেন।
বাবা এর মধ্যে মুন্সীবাজারে কালীপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন, যার অবস্থান আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে। পুরো বর্ষাকাল জুড়েই রাস্তাটা এত কাদাটে হয়ে থাকত যে, প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না; যদি তার একটি বাইসাইকেল ছিল। তাই, তিনি একটি বাড়ি ভাড়া করেন এবং আমার বড় ভাইকে নিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকেন, যাকে হাই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। অবশেষে বাবা থানা সদরে, কমলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন, যেখানে আমিও পড়ালেখা করেছিলাম। আমার পিতা উত্তরাধিকারসূত্রে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে কিছু গুণ অর্জন করেছিলেন এবং ঠাণ্ডা মেজাজের ধর্ম মনস্ক লোক ছিলেন। অন্যদিকে, মা ছিলেন তার সন্তানদের প্রতি বেশ কঠোর এবং সন্তানদের দৈনন্দিন যাপনের বিষয়গুলি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। পাঁচটি পুত্র ও এক কন্যা সামলাতেন তিনি। এর মাঝে একটা সন্তান কলেরায় মারা যায়, যখন সে ক্লাস সিক্সে অধ্যয়নরত ছিল।
ভাইবোনদের মধ্যে আমি দ্বিতীয়, আর আমার বড় ভাই প্রকৌশলী হিসেবে ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি লন্ডনে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন আর চট্টগ্রামের মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। আমার তৃতীয় ভাই একজন ব্যাংকার, চতুর্থ ভাই একজন ডেন্টিস্ট এবং বর্তমানে তারা মার্কিন নাগরিক। আমার একমাত্র বোন সত্যভামা সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষালাভ করেন। যেহেতু বাবা-মা আমাদের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ছিলেন, তাই আমরা সব ভাই-বোনই সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করি। বাবার দিনগুলো অনেক ভোরে শুরু হত যখন তিনি বাড়িতে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন। ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুধা নিবৃত্ত করার বেলায় তার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও তুখোড় মেধা সকলের কাছেই প্রশংসনীয় ছিল।
আমার মা পাঁচ সন্তানের লালন পালনের পাশাপাশি বেশিরভাগ গেরস্থালী কাজের দায়দায়িত্ব ভাগ করে নিতেন। আর পরবর্তীতে, চাচা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর, তার স্ত্রী মানে আমার কাকিমাও বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতেন। মা একজন জাঁদরেল মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং আমি বিশ্বাস করি যে তার প্রবৃত্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতাই  সন্তানদের যথাযথ শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেছে। শৈশব আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। দুপুরের দিকে খেলা করতাম আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম এবং প্রচুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললাম। আমার আরেকটি আগ্রহ ছিল যা নিবৃত্ত করতে পারিনি আর তা হল, গ্রামের ছোট নদীতে বন্ধুদের নিয়ে সাঁতার কাটা এমনকি যখন  বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হত তখনো। সবসময়ই আমার কিছু বন্ধু ছিল যারা বয়সের দিক থেকে ছিল আমার বড়।
যখন আমি বড় হলাম, বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে সাথে, পারিবারিক খামারের শ্রমিকদের সাহায্য করতে শুরু করি। চাষের জন্য মহিষগুলি ব্যবহারের পাশাপাশি আমরা অগুলোকে শরৎকালে আখ চাষের জন্য ব্যবহার করতাম; যা কিনা নদীর তীরে চাষ করা হত। বিপুল পরিমাণ জমি, প্রায় ২৫ বিঘা আখ চাষের জন্য ব্যবহৃত হত যা ধলাই নদীর জলে প্রায়ই প্লাবিত হত।
১৯৭০ সালে আমি মদনমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ভর্তি হই। যেহেতু কলেজে অর্থনীতিতে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল তাই অধ্যাপক আমাকে অর্থনীতিতে ভর্তির পরামর্শ দেন। তখন দেশের রাজনীতির হাওয়া খুব অস্থির ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাবা চট্টগ্রামে পড়াশোনা করতে দিতে চাননি এবং বাণিজ্য শিক্ষক হিসাবে তার স্কুলে যোগ দিতে বলেছিলেন। নিরাপত্তা জনিত কারণে চট্টগ্রামে শিক্ষার খরচ বহন করতে বাবা অনিচ্ছুক হওয়ায় আমি খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই, চট্টগ্রামে পড়াশোনা করব নাকি ফিরে যাব। তিনমাস পর সিলেট ফিরলাম আর বাবার অনুমতি না নিয়েই সিলেট ল’ কলেজে ভর্তি হলাম।
 বাবা যখন জানতে পারলেন, আমি আইনে ভর্তি হয়েছি  তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে ফিরতে আদেশ করেন। মূলত, তিনি স্কুলে আমার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আইনজীবীরা মিথ্যাবাদী এবং তারা মিথ্যা কথার উপর ভর করে টাকা উপার্জন করে। তার জন্য কল্পনা করাও কঠিন, যে একজন আদর্শ শিক্ষকের ছেলে আইনজীবী হতে পারে আর মিথ্যা বলার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতে পারে। ফলস্বরূপ, আইন বিষয়ে পড়াশোনা নিয়ে বাবার সাথে আমার সম্পর্কে ফাটল ধরে । আমি স্পষ্ট ভাষায়  তাঁকে বলে দিলাম যে, স্কুল শিক্ষক হিসাবে আমি আমার জীবন শেষ করতে পারিনা এবং তাকে এও জানিয়ে দিলাম, এমনকি আর্থিক সহায়তা না পেলেও আমি আইনে পড়া চালিয়ে যাব। তখন থেকে, ছাত্রদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে সিলেটে  খাইখরচ ও অন্যান্য মেটাতাম।
এদিকে আমার চাচা ভুবনেশ্বর সিনহা অল্প বয়স থেকেই কিডনি রোগে ভুগছিলেন। ষাটের দশকে কিডনি রোগের জন্য তাকে  অপারেশান করা হয় এবং তার কিডনি পাথরমুক্ত করা হয়। অস্ত্রোপচারটি হয় টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে, যেটি দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেশ বিখ্যাত হাসপাতাল। এরপর ১৯৭০ এর শেষ ভাগে তার প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও বাধার সৃষ্টি হয়। এ কারণে, আমি তাকে সিলেট নিয়ে এলাম আর ১৯৭১ এর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলাম। তিনি হাসপাতালের খাবার খেতে চাইতেন না আর তাই আমি যেখানে থাকতাম, সেই মাছিমপুর থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। অস্ত্রোপচার বিভাগের বিখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক শামসুদ্দীন আহমেদ ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের পাঁচ-ছয় দিন আগে তার কিডনির পাথর অপসারণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই ২৫  মার্চ সন্ধ্যায় আমি সাইকেলে করে তার খাবার আনলাম। খেয়াল করলাম তার গায়ের তাপমাত্রা খুব বেশি ছিল এবং রাতের বেলায় সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও তিনি বুঝতে পারছিলেন, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।
 পুরো শহর জুড়ে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল আর সেটা হাসপাতালেও দেখা গেল। প্রায় সব রোগী ও তাদের সাথে থাকা লোকেরা হাসপাতাল কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে বলতে লাগল, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আধা কী একঘণ্টার মধ্যেই আমরা শুনতে পাই নির্বিচারে গোলাগুলি আর অগ্নিসংযোগের শব্দ। সকল রোগী ও অন্যান্যরা হাসপাতালের ভেতরে আশ্রয় নিলেন আর তার ঘণ্টাখানেক পর রিকশা ও ভ্যানে করে গুলিবিদ্ধ লোকদের আনা হল একের পর এক। একঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন আহত লোককে হাসপাতালে আনা হয় এবং জরুরি বিভাগের রক্তে ডুবে যায়।
রোগীদের দেখভাল করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রফেসর শামসুদ্দীনকে নিয়ে আসার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। যেহেতু পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নিচ্ছিল, তাই চাচা আমাকে চলে যেতে আদেশ করলেন এই বলে যে, মাসিমা আমার সম্পর্কে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে পারে; কারণ আসবার আগে তাকে বলিনি, এখানে থাকব রাতে আর ঘর ছাড়ার আগে কিছু খেয়ে আসিনি।
তাই, কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে দাড়িয়াপাড়া হয়ে মাছিমপুরের দিকে আগাই। কিন্তু আমি জিন্দাবাজারের কাছে বড় রাস্তায় প্রবেশের আগেই দেখলাম গলির প্রান্তে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘরে ফিরতে পারছিল না, কারণ কারফিউ ছিল; কেউ কেউ বলেন, কারফিউ ছিল না। আমরা বিভ্রান্ত অবস্থায় কথা বলছিলাম আর তখন দেখতে পেলাম পুলিশের জিপ আসছে একটা। আর লামাবাজার থেকে জিন্দাবাজারের দিকে একজন ঘোষণা দিচ্ছে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ। একটু পরে কয়েকটা আর্মি জিপ এলো আর নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। আমি সাইকেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর হাসপাতালে ফিরে গেলাম। লক্ষ্য করলাম যারা আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের অনেকের শরীরেই বুলেটের ক্ষতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
হাসপাতালে ফিরে আমি হন্তদন্ত হয়ে চাচার কেবিনে ঢুকে মেঝেতে পড়ে গেলাম। জ্বরে আক্রান্ত আমার চাচার পেটে অস্ত্রোপচারের সেলাইগুলো ভালোভাবে শুকায়নি। তবুও তিনি বিছানা থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমিও কি আহত, যেহেতু আমার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল। তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি দিলেন। কয়েক মিনিট পর যখন আমি সম্বিৎ ফিরে পাই তখন দুঃখজনক ঘটনাটির বর্ণনা দিলাম। তাকে বললাম, আমার পাশে থাকা অন্য লোকগুলোকে গুলি করে মারা হয়েছে আর আমি বেঁচে গিয়েছি আমার এই সাইকেলের জন্য।
আর তারপর দেখলাম প্রফেসর শামসুদ্দীন আহমেদ সারাদিন ধরে কোন বিশ্রাম না নিয়ে আহতদের চিকিৎসা দিতে থাকেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না এবং হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহও ছিল কম, তাই আমাদের খাওয়ার মত কোনো খাবার ছিল না। অবস্থা দৃষ্টে, কিছু রুটি এবং অন্যান্য খাবার চাইতে আমি হাসপাতাল সুপারের কাছে গেলাম। তিনি উত্তর দিলেন যে রেশন সরবরাহ করা হয়নি এবং এমনকি নিয়মিত রোগীদের সকালের নাস্তা, দুপুর বা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। অতএব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত রোগীদের ‘খিচুড়ি’ সরবরাহ করা হবে।
আমাদের কাছে অল্প কটা টাকা ছিল আর আমি চাচাকে বললাম, রাস্তার বিক্রেতার কাছ থেকে রুটি আনব। ওরা হাসপাতালের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দাড়িয়াপাড়ার কাছাকাছি চা ও রুটি বিক্রি করে। পুরনো সিলেট মেডিক্যাল কলেজ ছিল পশ্চিম দিকে এবং হাসপাতালটি পূর্বের দিকে, একটি রাস্তায় বিভক্ত যা দাড়িয়াপাড়া থেকে যায় এবং লামাবাজার থেকে জিন্দাবাজার পর্যন্ত প্রধান রাস্তায় সংযোগ ঘটায়। মাত্র আধা পাউন্ড রুটি খুঁজে পেলাম এবং কিনলাম। এটি আনা। আমরা একটা অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হলাম: দুজন লোকের জন্য আমাদের ছিল মাত্র আধ-পাউন্ড রুটি। কোনও পানীয় ছিল না আমাদের আর তাই বাথরুম ট্যাপ থেকে পানি পান করা শুরু করতে হয়েছিল। ওই একটা রুটি খেয়ে আমরা দুইদিন ছিলাম! আমার চাচা রুটি খেতে আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন আর আমি তাকে অসুস্থ অবস্থায় রুটি খেতে অনুরোধ করছিলাম। সত্যি বলতে আমরা শুধু রুটি আর পানি খেয়েই ছিলাম। ৪৮ ঘণ্টা পর কারফিউ তুলে নেওয়া হলে, বিস্মিত হয়ে আমরা দেখি যে, রুটির অর্ধেক তখনও রয়ে গেছে। আমি চাচাকে বললাম যে পরিস্থিতি পুরোপুরি অনিশ্চিত, আর আমি কিছু খাবার ও টাকা আনতে যেতে চাই বাড়িতে, যেভাবেই হোক।
দুই দিন পর, হাসপাতালটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং চিকিৎসক ও নার্সরা চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। চাচার অবস্থার কেমন উন্নতি হয়েছে সেটা জানতে প্রফেসর শামসুদ্দীনের কাছে যাই, যাতে তার অনুমতি নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার এই সময়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। তিনি আমাদের অস্ত্রোপচার ক্ষত নিরাময়ে কিছু ঔষধ দিলেন, ব্যান্ডেজ বদলে দিলেন আর বাড়ি যাবার অনুমতি দিলেন। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পনেরো দিন পর তিনি চাচাকে আবার দেখবেন বলে জানালেন। তাই আমি তাকে আটদিন পর রিকশায় মাছিমপুরে নিয়ে এলাম। সম্ভবত কয়েক দিনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং কষ্টের কারণে আমি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলাম যা টাইফয়েডে পরিণত হয়েছিল।
গুজব শোনা যাচ্ছিল যে সিলেটের বাইরে যাবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অতএব, আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহর ত্যাগ করতে হবে নতুবা পরবর্তীতে শহর ত্যাগ খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমার জ্বর সামান্য হ্রাস পায় আর আমরা এক সকালে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করি আমাদের স্ত্রীর পরিবারের লোকসহ মোট চারজন। আমার স্ত্রীর ঠাকুরদা অর্জুন বাবু, সিলেট জেলা পরিষদের একাউন্টেন্ট জেনারেল, ছিলেন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। জেলা পরিষদের ঠিকাদারদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ঠিকাদারদের একজন সুরমা নদীর বিপরীত তীর থেকে আমাদের জন্য একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করলেন। নৌকায় সুরমা নদী অতিক্রম করে আমরা শহরের বাইরে পৌঁছতে পারলাম। আমি দুইজন লোকের ঘাড়ে ভর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম কারণ অসুস্থতা হেতু তখন পর্যন্ত মুখে কোন খাবার নিতে পারিনি। আমরা গোধূলিবেলায় তাজপুর ডাকবাংলোয় পৌঁছলাম। স্থানীয় লোকেরা আমাদের আপ্যায়ন করলেনে এবং ‘খিচুড়ি’ রান্নার জন্য চাল ও মুরগি সরবরাহ করলেন। দুই সপ্তাহ পর আমি এক বাটি খিচুড়ি খাই এবং শরীরে একটু বল পাই।
পরদিন সকালে আমরা হাঁটতে শুরু করি আর মাঝে মাঝে রিক্সা ভ্যানের সাহায্য নেই,  শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বহনের জন্য, যখনই পাওয়া যায়। এইভাবে আমরা শেরপুর ফেরিঘাটে পৌছাই। শেরপুর নদী পার হওয়ার পর, আমরা একটা ট্রাকের দেখা পাই। চালক আমাদের শ্রীমঙ্গল নিয়ে যেতে রাজি হয়। আমরা প্রায় ৩ টার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাই এবং সেখানে থেকে ১২ কিলোমিটারেরও বেশি শ্রীমঙ্গল-ভানুগাহ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে শুরু করি। এই যাত্রা ছিল অকল্পনীয় কষ্টের। শ্রীমঙ্গল ও ভানুগাহের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা ছিল, কিন্তু সেটা ছিল পুরোপুরি কর্দমাক্ত। এমন নয় যে খুব বেশী ক্ষুধার্ত বা অসুস্থ ছিলাম; বরং আমাদের মনের মধ্যে একমাত্র ভয় ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হতে হয়। আমরা আঁকাবাঁকা বা জিগজ্যাগ ফ্যাশনে ভ্রমণ করেছি এবং পদ্মচেরা চা এস্টেট অতিক্রমের পর, আমরা চিংগঙের মাধবপুর গ্রামের সর্ব পশ্চিমে আমাদের মামার (সোনাই মামার) বাড়ি পৌঁছাই। সোনাই মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে সেখানে আমাদের থাকার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা কিছু মুড়ি ও পানি নেই আর আমাদের গ্রামের দিকে শুরু করি, যা ধলাই নদী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে। আমরা দিন শেষ হবার আগেই বাড়িতে পৌঁছাবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম কারণ আমরা যদি রাতে মামার বাড়িতে থেকে যাই আর শরীরের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে বাড়িতে ফিরতে পারব না। অবশেষে, আমরা রাত পৌনে নয়টার দিকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম।
বাড়ীতে সাত দিন বিশ্রাম নেবার পরে আমি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হই। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তাটা মৌলভীবাজার শহর থেকে শেষ কুমরারছরা চা এস্টেটে চলে গেছে যার শেষমাথায় ত্রিপুরা, ভারতের সঙ্গে সীমান্তে। সড়কের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। রাস্তার অবস্থা ছিল শোচনীয়। কোথাও ভেজা কাদার গভীরতা ছিল এক ফুটেরও বেশি আর উপরে দিকে শুকিয়ে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শমশের নগর বিমান বন্দরে তাদের শিবির স্থাপন করে এবং থানা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। আর শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকার নিয়োগে শুরু করে দেয়। সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদেরকে শান্তি কমিটির সহায়তায় রাস্তা চলাচলের উপযোগী করে তৈরির নির্দেশ দেয়। কিছু মৌলবাদী মণিপুরি ইম্পালা, ভারত থেকে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয় যাদের নেতা ছিল মৈতৈ  মনিপুরী সুধীর। তারা হোমেরজান গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি মণিপুরি মৈতৈ দের মধ্য থেকে রাজাকার নিয়োগের কাজ শুরু করেন। রাস্তার মেরামত করতে গ্রামবাসীদের উপর চাপ দেয়া হচ্ছিল, কিন্তু রাস্তার গর্তগুলি ভরাট করার জন্য শুকনো মাটি ছিল না কারণ তখন ছিল বৃষ্টির সময়।
আমার এক বন্ধু অনিলের কাছ থেকে শুনেছি যে, সেনাবাহিনী রাজাকার বাহিনীর পরিবর্তে রাস্তা নির্মাণের কাজের দায়িত্ব দিতে স্থানীয় তরুণদেরকে খুঁজছিল। যখনই আমরা শুনি যে সেনাবাহিনী আমাদের এলাকায় চলে এসেছে, তখন আমরা পশ্চিম দিকের ধানক্ষেতে আশ্রয় নিতাম, যেখানে ধলাই নদীর তীরে একটি বিশাল এলাকায় কোন মনুষ্য বসতি ছিল না। কখনও কখনও সকালে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে যেত আর জোঁক আমাদের রক্ত চুষে নিত কিন্তু আমরা নড়াচড়া করতে পারতাম না। এটি ছিল এক নৃশংস পরিস্থিতি।
অবশেষে, সেনাবাহিনী গাছের শাখাগুলি স্থাপন করে এবং তার উপর মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণে সক্ষম হয়। যখন সড়কটি কার্যকর ছিল তখন সেনাবাহিনীর আসা যাওয়া নিয়মিত ছিল। কারণ দক্ষিণের সীমান্তটি আমাদের ঘর থেকে প্রায় বিষ কিলোমিটার দূরে। সম্ভবত সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসাবে রাস্তাটি ব্যবহার করার কথা ভেবেছিল, ভানুগাহ থেকে পত্রখোলা চা এস্টেটের বিকল্প সড়ক হিসেবে, যা কিনা যাতায়াতের বেশ উপযোগী ছিল। এই সময়ে, আমি বন্ধু গৌরমোহনের সাথে ভারতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেই এবং সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য মাধবপুর গ্রামে আশ্রয় নেই। আমরা তিন রাতের জন্য সেখানে থাকি, কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করতে পারিনি কারণ ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী দূরবর্তী এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার দল গঠন করেছিল এবং সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সীমান্তবর্তী পুরো এলাকাতেই জনসংখ্যার অধিকাংশই হিন্দু ও মুসলিম মৈতৈ  সম্প্রদায় থেকে। আমি যে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্গত , তার চেয়ে ওদের ভাষা ছিল পাকিস্তানিদের জন্য সহজ। এই মৈতৈ  হিন্দু ও মুসলমানরা পাকিস্তানের সমর্থক। ফলত, সীমান্ত অতিক্রম করা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। কিছু তথ্যদাতারা আমাদের জানান যে ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসাবে সীমান্ত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। তাই, তিনদিন পর আমি বাড়ি ফিরে যাই, কিন্তু গৌরমোহন মাধবপুরে তার বোন বাড়িতে থাকলেন।পরে আমি জানতে পারলাম তিনি পনের দিন পর সীমান্ত অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
আমি প্রায় সারাদিনই পশ্চিম দিকের ধানক্ষেতে বসে থাকতাম আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতাম। সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে খবর পাই এবং তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা পূর্বদিকের গভীর বন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সেনাবাহিনী ক্যাম্পের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। আমরা তাদের দরকারি তথ্য, খাদ্য এবং প্রয়োজন মাফিক আশ্রয় দিতে শুরু করি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধার প্রথম ব্যাচ আমাদের এলাকায় প্রবেশ করেছিল এবং আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। আমি অনিলের পাশাপাশি চাল, ডাল, আলু সংগ্রহ করেছিলাম এবং খিচুড়ি রান্না করেছিলাম রাজবাড়ী পুকুরের দক্ষিণ দিকে। একইরকম দ্বিতীয় ঘটনায় আমাদের বলা হয় বিশজন লোকের জন্য রান্না করতে। তখন প্রায় অপরাহ্ন দুটো ত্রিশ থেকে তিনটা হবে । আবদুল মান্নান নামে সিও (বিভাগীয়) অফিসের একজন ক্লার্ক, যে ছিল মুসলিম মৈতৈ সম্প্রদায়ের সদস্য এবং সম্ভবত তার সম্প্রদায়ের এক মাত্র এসএসসি পাশ সদস্য, পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খবর দিয়ে নিয়ে এলো পার্শ্ববর্তী ধলাই নদী পার করে। সেনারা নদী পার হয়ে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করে আর আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে। আমরা সবাই পূর্ব দিকে পালিয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মঙ্গলপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন আর আমি তিন কিলোমিটার পূর্বে চিতলিয়াতে ফাল্গুনি সিনহার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, যিনি  বয়সে আমার কাছাকাছিই, এবং ছিলেন মৈতৈ সম্প্রদায়ের। মৈতৈ সম্প্রদায়ের হলেও যেহেতু তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন, তাই আমাকে তিনি দুই দিন আশ্রয় দিলেন। যেহেতু আমার কাছে শীতের কাপড় ছিল না তাই তিনি আমাকে মণিপুরি মোড়ানো এক ধরণের পোশাক দিলেন। আমি দুই দিন পর দেশে ফিরে আসি। বাবা মা ধরে নিয়েছিলেন যে আমি সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছি, কারণ আমি দুদিন ধরে অনুপস্থিত ছিলাম আর তারা আমাকে অস্থির করে তুলছিলেন। আমি তাদেরকে বললাম যে, আমার সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে আর আমি তাদের জন্য তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করছি। আমি চিতলিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি ভীত ছিলাম যে সেনাবাহিনী আমাকে রাতে খুঁজতে পারে এবং সেজন্য সতর্কতা হিসাবে আমি ঘরে ফিরে আসিনি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, মুক্তিবাহিনী আমাদের গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামগুলি নিজেদের দখলে নিয়েছিল, তারপর তারা সমগ্র থানা দখল করে। ১২ ডিসেম্বর থেকে আমাদের সমগ্র এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। গৌরমোহন ও মুজিববাহিনী বাহিনী আমাদের গ্রামে আসার পর, আমরা আমাদের পদক্ষেপ বিষয় তথ্য পাচারের জন্য আব্দুল মান্নানকে হত্যা করতে গেলে, সে টিটিয়াগাঁও এর একটি মুসলিম মৈতৈ  গ্রামে আশ্রয় নিলো। তখন আমরা জানতে পারলাম যে এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধা নেতা যিনি ছিলেন আমার বন্ধু—তার বাড়িতে আব্দুল মান্নানকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার নাম উল্লেখ করে আমি তাকে বিব্রত করতে চাই না। আমি এমন আচরণের জন্য তাকে অভিযুক্ত করেছিলাম, বন্ধু আমাকে বলেছিলেন যে মান্নান সিও (বিভাগীয়) অফিসের ক্লার্ক এবং তার কাছ থেকে সে অনেক সাহায্য গ্রহণ করেছিল। তিনি আব্দুল মান্নানের বিয়ের অভ্যর্থনাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেই সময়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আমার বিদ্বেষ জেগে উঠল। জালালাবাদী, আমার কলেজের এক বন্ধু, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা ছিলেন তিনি থানা সদর দফতরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন। স্বাধীনতার পর আমার সকল বন্ধু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই একটি কারণেই আমি তা সংগ্রহ করার কোন চেষ্টাও করিনি।


চলবে…

==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই এটা পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। এই অধ্যায়টি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।


নাজিম উদ্দিন
অধ্যায়: দুই

জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পরই আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে এল এল বি পরীক্ষা পাস করি। আইন পড়ার কারনে আমার বাবা আমাকে সম্পূর্ণ রুপে ত্যাজ্য করেন এবং বলেন যে আমি আইন পেশায় যুক্ত হলে তাঁর  সন্তানের পরিচয় দিতে পারব না। আইন পাশ করার পরে আমি এমনিতেই অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথমত, সিলেটে আমার কোন থাকার জায়গা ছিল না; দ্বিতীয়ত, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল; তৃতীয়ত, পরিবারের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া আইন পেশা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব; এবং সবশেষে, একজন ভাল আইনজীবী হবার পূর্বশর্ত হলো অন্য একজন ভাল পসারের বয়োজ্যাষ্ঠ আইনজীবীর চেম্বারে যোগ দেয়া। এ সব কিছুর জন্য সাহায্য-সহযোগিতা দরকার এব এর কোনটাই আমার ছিল না। তখনকার সময়ে  আমার সব বন্ধু-বান্ধব আইন পাশ করার পরে টিকে থাকার জন্য স্থানীয় মহকুমা বারে যোগদান করে।  কিন্তু আমি সিলেটে থাকার সিদ্ধান্ত নেই কারন একজন ভাল আইনজীবী হতে হলে আমাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জেলা আদালতে থাকতে হবে। আমি তখন সিলেটের কোন ভাল আইনজীবীকে চিনতাম না। শুধু ছাত্র হিসেবে কিছু সিনিয়র আইনজীবীকে চিনতাম। সে সময় সব আইনজীবীর চেম্বার রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকত। নতুন পাশ করা কাউকে ভাল আইনজীবী হতে হলে তাকে  কোন  একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর চেম্বারে লেগে থেকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। আমিও তাই কোন একজন ভাল আইনজীবীর সাথে যোগ দিয়ে প্রমান করতে চাচ্ছিলাম যে আইনজীবী মানেই মিথ্যুক নয়,  ভাল আইনজীবী হলে তারা সমাজে একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে গন্য হন।
বন্ধুদের সাথে আলাপ করে আমি বিখ্যাত ফৌজদারী আইনজীবী এবং সামাজিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত উকিল সোলেমান রাজা চৌধুরীর চেম্বারে যোগ দিব বলে মনস্থির করলাম। সিলেট ল কলেজে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। এক বুক আশা নিয়ে, সাহস সঞ্চয় করে একদিন সন্ধ্যায় আমি চৌধুরীর চেম্বারে গেলাম। সেখানে আমি কিছু মক্কেল এবং তার সহকারী মুনিরুদ্দিন আহমেদকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে চৌধুরী আমার আসার কারন জানতে চাইলেন, আমি খুব বিনয়ের সাথে তাঁর কাছে আমার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কোন রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়া আমি তাঁকে বললাম যে, আমি যে জাতি থেকে উঠে এসেছি তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, তারা খুব সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ, বেশিরভাগই কৃষিকাজ বা শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের জীবন-যাত্রা খুবই সহজ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের তুলনায় এরা গরীব।  এমনকী কোটার কারনে আদিবাসী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সরকারী চাকরিতে ঢুকতে পারে, সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব আছে, তাদের মধ্য থেকে একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদারও অধিকারী হন। অপর দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জন্য মন্ত্রী পদমর্যাদা তো দূরের কথা সংসদেও কোন প্রতিনিধি নেই, সমারিক বাহিনী, পুলিশ বা সিভিল প্রশাসনে কোন অফিসার নেই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যায়নে মুসলিম এবং হিন্দুদের সাথে তুলনায় তাদেরকে তাই নীচু জাতের বলে গন্য করা হয়। এডভোকেট চৌধুরী আমাকে সরাসরি বলে দিলেন যে তিনি আমাকে তার জুনিয়র হিসেবে রাখতে পারবেন না, অন্য কোন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে যোগ দেবার পরামর্শ দিলেন। আমি এতে খুব মুষড়ে পড়ি কিন্তু মানসিকভাবে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি। আমার সাথে কথা শেষ করে তিনি তখন আবার কাজে মনোযোগ দিলেন, আমি তাঁকে আর কিছু না বলে সেখানেই মাথা নীচু করে বসে থাকি। তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও  আমি তার সাথে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম তাই ইতোমধ্যে চেম্বারে তার সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবার প্রক্রিয়ায় যে কোন ধরনের অপমান সহ্য করে নিব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি। কিছু সময় পরে আমি লক্ষ্য করলাম তার চাপরাশি এসে তাকে ড্রয়িং রুমে যেতে ইশারা করছে। তারপরে দেখলাম চৌধুরী তার সহকারী মুনিরুদ্দিনকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলেন। ড্রয়িং রুমটা ছিল তার চেম্বারের উত্তর পাশে, চেম্বার আর ড্রয়িং রুমের মাঝে আরেকটা রুম ছিল। আমি বুঝতে পারলাম তারা সেখানে চা পান করছেন। আমাকে তারা চায়ের জন্য বলেনি যদিও আমি এক সময় তার ছাত্র ছিলাম। আমি অপমানিত বোধ করছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করিনি।
পরদিন থেকে আমি নিয়মিত চেম্বারে যেতে শুরু করলাম। চৌধুরী আমাকে না দেখার ভান করলেন আর তার সহকারী আমার সাথে কথা বলত না। আমি মুনিরুদ্দিনের পাশে একটা চেয়ারে বসতাম।  কোন কোন সময় একসাথে বেশি মক্কেল আসলে চৌধুরী আমাকে সরে পেছনের বেঞ্চে মক্কেলদের চেয়ারে বসতে বলত। এতসব অবহেলা অপমান সত্ত্বেও আমি মাসের পর মাস চৌধুরীর চেম্বারে নিয়মিত যেতে থাকলাম।  আমার বিশ্বাস ছিল যদি একবার তাঁর কাছ থেকে মামলার খসড়ার জন্য শ্রুতিলিখন নেবার সুযোগ পাই তাহলে চৌধুরী আমাকে তাঁর সহযোগী হিসেবে নিতে বাধ্য হবেন। মুনিরুদ্দিনের হাতের লেখা এবং ডিক্টেশান নেবার ধরন দেখে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি মুনিরুদ্দিনের চেয়ে অনেক ভাল এবং সেটা জানতে পারলে চৌধুরী জুনিয়র হিসেবে আমাকেই প্রাধান্য দিবেন।  সোলেমান চৌধুরী ডান হাতে লিখতে পারতেন না, একটা একসিডেন্টের পর থেকে তার এ সমস্যা দেখা দেয় যার কারনে তিনি বাম হাতে সই করতেন। এদিকে প্রায় রুটিনের মত চৌধুরী আমাকে বাদ দিয়ে চা পান করতেন, কিন্তু তার আচরণে আমি মন খারাপ করতাম না, কারন তার সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার আমার একমাত্র স্বপ্ন ছিল।

শেষ পর্যন্ত এক ঝড়ের রাতে আমার ধৈর্য্য এবং লেগে থাকা স্বার্থক হয়। সেদিন ঝড়-বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চেম্বার আসার সময়ে আমি ভিজে সপসপে হয়ে পড়েছিলাম। এ সময় দরজা-জানালা বন্ধ ছিল তারপরেও আমি বারান্দায় অপেক্ষা করেছি। এক সময় আমি দরজার বেল টিপলে চাকর ছেলে এসে দরজা খুলে দেয়। চেম্বারে ঢুকে আমি ফ্যানের বাতাসে আমার জামা শুকাতে চেষ্টা করলাম। কিছু সময় পরে কয়েকজন মক্কেল আসল কিন্তু সে সন্ধ্যায় মুনিরুদ্দিন আসতে পারেনি। আমি চাকরকে বললাম চৌধুরী সাহেবকে বল যে মক্কেল এসেছেন। ঐদিন চৌধুরী সাহেব দ্বিতীয় বারের মত আমার সাথে কথা বলেন। তিনি আমার দিকে তাকালেন, দেখতে পেলেন আমার জামা-কাপড় সম্পূর্ণ ভিজা, তারপরে একটু আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করলেন এমন আবহাওয়ায় আমি ছাতা ছাড়া এসেছি। কাজের প্রতি আমার ভক্তি দেখে হয়ত তার মনে হয়ত দয়া হয়েছিল, চাকর ছেলেটাকে বললেন আমাকে একটা তোয়ালে দিতে, আর আমাকে বললেন যেহেতু আমি এসেছি এবং তারও মামলার জন্য কিছু জরুরী খসড়া  করার দরকার, তাই আমি শ্রুতিলিখন করতে পারি কিনা জানতে চাইলেন। আমি পজিটিভ জবাব দেবার সাথে সাথেই তিনি ডিক্টেশান দেয়া শুরু করলেন। তিনি দেখতে পেলেন আমি অনেক ভাল ও তাড়াতাড়ি শ্রুতিলিখন করতে পারি, তাছাড়া আমার হাতের লেখাও অনেক সুন্দর।  লেখা শেষ হলে তিনি আমার ইংরেজির প্রশংসা করলেন, আমার হাতের লেখাও ভাল বললেন, এবং বলতে চাইলেন কেন আমি তাকে আগেই  সেটা বলিনি। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে চা-নাশতা খেতে দিলেন। সে সন্ধ্যায় আমি এতটা অভিভূত হয়েছিলাম যে কোন রকমে আবেগ দমিয়ে রেখে এ সুযোগ দেয়ার জন্য মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলাম।
পরের দিন মুনিরুদ্দিন এবং আমি দুজনেই কাজ করতে আসলাম। যখন শ্রুতিলিখনের সময় আসল, মুনিরুদ্দিন তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কিন্তু চৌধুরী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি এখানে সিনিয়র, এবার সুরেনকে কিছু সুযোগ দেয়া উচিত। ” আমি বুঝতে পারলাম আমার কাজে সোলেমান রাজা চৌধুরী সন্তুষ্ট। সেদিন থেকে প্রত্যেকদিন যখনই শ্রুতিলিখনের প্রয়োজন পড়ত মুনিরুদ্দিনকে বাদ দিয়ে আমাকে সুযোগ দেয়া হত। আরেকটা ব্যাপার আমার অনুকূলে ছিল সেটা হল, প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে আমি চেম্বারে গিয়ে হাজির হতাম, মুনিরুদ্দিন সেটা পারত না কারন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার কিছু মক্কেল ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই চৌধুরী আমাকে পছন্দ করতে লাগল। কিন্তু আমি তখন আরেক সমস্যায় পড়লাম। টাকা-পয়সার ব্যাপারে চৌধুরী খুব কিপটে ছিল। তিনি মাসে দু’বার সর্বোচ্চ ১০০ টাকা করে দিতেন, কখনও একবার। তখনকার দিনে আমি খুব গরীবী হালতে থাকতাম কিন্তু তারপরেও ঐ টাকা দিয়ে সব খরচ মেটানো সম্ভব হত না। শেষে একদিন বার কাউন্সিলে হাজিরা দেয়ার দিন স্থির হল কিন্তু আমার কাছে ঢাকা গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেবার মত কোন টাকা ছিল না। আমি চৌধুরীর কাছে পরীক্ষায় অংশ নেবার জন্য ৫০০ টাকা চাইলাম এবং তিনি তৎক্ষণাত সেটা দিয়ে দিলেন। আমার তখন কোন কোট বা জুতা ছিল না। তাই সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে একটা কোট কিনে সেটা অল্টার করে কালো রঙ করে নিলাম। দেওয়ানী মামলা পরিচালনার জন্য বিখ্যাত আইনজীবী  বি এন চৌধুরী আমার বার কাউন্সিলের ভাইভা পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমি কোন বার থেকে এসেছি। আমি সিলেট বলায় তিনি বললেন, “ও সিলেট থেকে, পয়সাওয়ালাদের আদালত এবং সেখানকার ছাত্রেরাও ভাল পোষাক পরে থাকে”। তিনি আমাকে একটাই প্রশ্ন করলেন, সেটা ছিল চুরি, ডাকাতি এবং হাইজ্যাকিং এর মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে। আমি সঠিক উত্তর দেই এবং তিনি আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হন।

পরীক্ষার পরে আমি এডভোকেট হিসেবে যোগ দেই, কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হয়নি। আমি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি পড়লাম। আমি আমার বাবার কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে কোন সহযোগিতা পাইনি এবং আমার সিনিয়র আমাকে পর্যাপ্ত টাকা দিত না।  আমার সহকর্মীরা মহকুমার ফৌজদারী আদালতে ভাল পয়সা কামাচ্ছিল। তারা কেবল জামিনের বন্ডে সই করে টাকা পাচ্ছিল কিন্তু  চেম্বারে  আমার সিনিয়র আইনজীবীরা আমাকে জামিনের আইনজীবী হতে নিষেধ করল কারন সেটা সম্মানজনক কোন কাজ নয়। এদিকে আমি যেহেতু জামিনের বন্ডে সই করি নাই তাই আমার আয়-রোজগার ছিল খুব কম, নিজের খরচই জোগাতে পারতাম না। আমি বুঝতে পারলাম আগে আমাকে টিকে থাকতে হবে তারপরে আইনজীবী হওয়া। আমি যদি টিকেই থাকতে না পারি তাহলে কিভাবে আইনজীবী হব। আমি আরো  বুঝলাম মহকুমার আদালতে যোগ না দিলে আমি আমার জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারব না। আমি লক্ষ্য করলাম আমার সব বন্ধুরা ততোদিনে  অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল, অপরদিকে আমি এখনও নিজের খাওয়া-পরার সংস্থান করতে পারছি না।
তাই একদিন সাহস সঞ্চয় করে সিনিয়রকে বলেই ফেললাম যে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি তিনি অনুমতি দেন তাহলে মৌলভীবাজার বার এ যোগ দিব। তিনি বললেন, জেলার আইনজীবী হিসেবে  অবশ্যই তুমি মৌলভীবাজার বার এ যোগ দিতে পার, তোমার নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতাও তোমার আছে। তিনি আরো বললেন যেহেতু আমি ইতোমধ্যে  স্থানীয় বারে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তাই তাঁর আর আমাকে বাধা দেবার কোন অধিকার নেই।
পরের দিন আমি মৌলভীবাজার গিয়ে সেখানকার আদালতে হাজির হলাম। সেখানে সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল মুহিত চৌধুরী এবং সাইয়েদ আব্দুল মতিন আমাকে স্বাগত জানালেন, তারা দু’জনেই ছিলেন আমার সিনিয়র সোলেমান চৌধুরীর আত্মীয়। চৌধুরীর সাথে আমার সম্পর্কের কারনে তারা আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। মুহিত চৌধুরী ছিলেন একজন বিখ্যাত দেওয়ানী আইনজীবী, তিনি সিলেটের আদালতে চা বাগানের মামলা নিয়ে হাজির হতেন। মফস্বলের আদালতের হাল-চাল বুঝতে আমি মুহিত চৌধুরীর পাশে বসলাম। আমি দেখলাম যখনই কোন মামলা গ্রহন করা হয় তখন আইনজীবীরা খরচের একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দেয় যেমন, কাগজ, কেরানী, শমন জারি, নোটিশ, মামলা দাখিলের জন্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পিওনের ফি, ৫০ থেকে ৬০ টাকা আইনজীবীর ফি ইত্যাদি। আমি এতে খুব আশ্চর্য বোধ করলাম এবং মুহিত সাহেবকে জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না কেন সে একেবারে ২০০ অথবা ২৫০ টাকার বিল না ধরে এভাবে ভেঙে ভেঙে বিল ধরছে। তিনি বললেন যদি একেবারে ঐ টাকা চাওয়া হয় তাহলে মক্কেল সাথে সাথে ভাগবে। তাই তারা বাধ্য হয়ে এমন ভেঙে ভেঙে বিলের তালিকা ধরে দেয়। পুরো টাকাটা কিন্তু উকিল নিজের কাছেই রাখে। জেলা এবং মহকুমা আদালতের আইন চর্চার ধরনটাই আলাদা। আমি এ ধরনের কাজ করতে পারব না তাই একেবারে হতাশ হয়ে পড়লাম, সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি চলে গেলাম। বাড়িতে পৌঁছে  কারো সাথে কোন কথা না বলে একটানা সাতদিন ঘুমালাম।
এক সপ্তাহ পরে মৌলভীবাজার এসে আমার বন্ধু আখতারের কাছ থেকে চিঠি পেলাম। সে জানাল তাদের না জানিয়ে আমি সিলেট ছেড়ে চলে এসেছি এবং সোলেমান চৌধুরী তাকে বলেছে আমি তাকে যেভাবে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি তাতে সে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল।  চৌধুরী আখতারকে আরো বলেছে যে তিনি নাকি আমার মধ্যে ভবিষ্যতে একজন ভাল আইনজীবী হবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে আমি অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে ছিলাম, কিন্তু সেটা তো সাময়িক, এখন যেহেতু আমার আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস করার লাইসেন্স আছে তাই এখন হলো টাকা কামানোর সময়। তাছাড়া, আমার যেহেতু ভাল আইনজীবী হবার সম্ভাবনা আছে তাই সিলেটে থাকাটা আমার জন্য ভাল হবে।  চিঠিটা পড়া মাত্রই আমি সিলেটে ছুটে গেলাম এবং সেদিন সন্ধ্যায় চৌধুরী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার সিলেট ফেরত আসার কথা জানালাম। আমার সিদ্ধান্ত জেনে তার যে আনন্দ তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তিনি আমাকে বললেন, কেউ ভাল আইনজীবী হতে হলে তাকে অবশ্যই অর্থনৈতিক,শারীরিক ও মানসিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। আমি তখন সেখানে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু করলাম কিন্তু আয় স্বল্পতার কারনে আমি খরচ মেটাতে পারছিলাম না। আমি যেহেতু নিম্ন আদালতে জামিন নিয়ে কাজ করি না, একজন জুনিয়র আইনজীবীর সেটাই মূল রোজগার, তাই আমার স্থানীয় কোন মক্কেল ছিল না। কোন রকমে টিকে থাকার জন্য আমি রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলাম।
সে সময় একদিন দেওয়ানী মামলার জন্য বিখ্যাত আইনজীবী গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী আমাকে তার চেম্বারে যোগ দিতে বলল। সে সময় তার চেম্বারে ১২ জন সহকারী ছিল কিন্তু   প্রতিদিন এত পরিমান মামলা আসত যে তারা কূলাতে পারতেছিল না। গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী ছিলেন একজন মুক্তমনা, হাসি-খুশি, উদার মনের আইনজীবী।  তার অনেক কামাই-রোজগার ছিল আবার দু’হাতে খরচও করত। জুনিয়রদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অনেক উদার। আমি বুঝতে পারলাম তার চেম্বারে যোগ দিলে আমার অর্থকষ্ট দূর হবে। কিন্তু আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীর মত মর্যাদাবান, সৎ ও নীতিবান  আইনজীবীকে এড়িয়ে চলতে পারব না। তিনি আমার প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন, কারন সেশান মামলায় বিচার চলাকালীন সময়ে জেরা করার জন্য স্বাক্ষীদের বক্তব্য লিখে নিতে হয়, আমি সে কাজটা ভালভাবে করছিলাম। সেজন্য আমি গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীকে বললাম আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীকে ছেড়ে আসতে পারব না কারন তিনি সম্পূর্ণভাবে আমার উপর নির্ভর করেন।  তিনি যদি সোলেমান চৌধুরীর অনুমতি নিতে পারেন তাহলেই একমাত্র আমি তার সাথে যোগ দিতে পারব। গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর মতে ফৌজদারীর মামলায় ড্রাফটিং এর ঝামেলা কম কিন্তু দেওয়ানী মামলায় অনেক বেশি ড্রাফটিং করতে হয়, আমার যেহেতু ড্রাফটিং এর হাত ভাল তাই আমাকে তার চেম্বারে বেশি দরকার।
শেষ পর্যন্ত আমি সোলেমান রাজা চৌধুরীকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম যে তার চেম্বার ছাড়ব না। আমি প্রস্তাব দিলাম যে রাতে তার চেম্বারে কাজ করব, এদিকে ভোর ছয়টা থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত গোলাম কিবরিয়ার চেম্বারে কাজ করব। এভাবে কাজ শুরু করলাম, সকালে গোলাম কিবরিয়ার শ্রুতিলিখন করতাম, কখনও অভিযোগ আবার কখনও লিখিত স্টেইটমেন্ট। প্রতিদিন সকালে দু’তিনটা ড্রাফট শেষ করতাম এবং তার গাড়িতে করে তার সাথে আদালতে যেতাম। প্রত্যেকদিন তিনি আমাকে ২০ টাকা করে দিতেন, সে সময় সেটা অনেক পরিমান টাকা ছিল। সকালে তার বাসায় খালিপেটে যেতাম তারপরে ২০ টাকা হাতে পাবার পর কোর্টের ক্যান্টিনে নাশতা করতাম। এভাবে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কাটালাম। এ সময়ের মধ্যে আমি দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিষয়ে অনেক কিছু জানলাম, বিশেষ করে একই সাথে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার মূল বিষয়গুলো শিখলাম।  ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে এসে আমি বুঝতে পারলাম যে একজন বিখ্যাত আইনজীবী হতে হলে আমাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে।একমাত্র তাহলেই আমার পক্ষে একজন বড় আইনজীবী হবার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
এ সময়ে আমি তখনকার বাংলাদেশের সেরা আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল (এস আর পাল) এর সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলি।  আমি যেহেতু মামলার কাগজপত্র নিয়ে প্রায় ঢাকা যেতাম, সেখানে সবিতা পালের সাথে কাজের সূত্রে সম্পর্ক ছিল, যেটা আমাকে তার সাথে পরিচয় হতে সাহায্য করেছে। আমি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে একটু ইতঃস্তত করছিলাম কারন সেখানে বড় বড় আইনজীবীরা কাজ করেন এবং ভাল অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলে সেখানে আইনজীবী হিসেবে টিকে থাকাই মুশকিল। এ সময়টাতে আমি ঢাকায় অনেক সময় কাটাতাম যার ফলে গোলাম কিবরিয়া এবং সোলেমান চৌধুরীর দু’জনেরই চেম্বারে কাজের ক্ষতি হচ্ছিল।  ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসের কোন এক সকালে সোলেমান রাজা চৌধুরী আমাকে তিরষ্কার করে বললেন, একজন আইনজীবীকে তার পেশার ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে, কিন্তু একজন আইনজীবী যে কিনা টাউটের মত কখনও সিলেট আবার কখনও সুপ্রিম কোর্টের ব্রিফ নিয়ে ঢাকা যাচ্ছে  সে কখনও একজন ভাল আইনজীবী হতে পারবে না। তিনি পরামর্শ দিলেন আমি যেন হয় সিলেটে থাকি অথবা সিলেট ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে যাই। চার বছর আইন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত রেখে  আমি শেষ পর্যন্ত আমার বাবাকে বুঝাতে পারলাম যে আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা। তিনি আমার যুক্তি মেনে নিলেন আর আমার পেশাকেও মেনে নিলেন। সোলেমান রাজা চৌধুরীর সাথে কথা বলার পরেই তার মতের পরিবর্তন হয়। সোলেমান চৌধুরী এবং তার স্ত্রী সুরাইয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে আমার বিয়ে হয়, সুরাইয়া চৌধুরী একজন সম্মানিত ভদ্রমহিলা  ছিলেন। বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠানাদিও সোলেমান চৌধুরীর বাড়িতে সম্পন্ন হয়। সোলেমান চৌধুরীর মত আইনজীবীর মান-মর্যাদা দেখে আমার বাবা নিশ্চিত হন যে আইনজীবীরা মিথ্যুক নন। আমিও সোলেমান রাজা চৌধুরীর কড়া সমালোচনাকে আমলে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে সবিতা পালের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসলাম। আমি তাঁর কাছে আমাকে তাঁর সহকারী হিসেবে নেবার অনুরোধ জানালাম যেটা তিনি বলা মাত্র বাতিল করে দিলেন।  আমার জন্য একজন বিখ্যাত আইনজীবীর সাথে কাজ করে ভাল একজন আইনজীবী হবার উচ্চাশা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। আমি সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করতে এসেছি শুনে পাল বললেন সেটা একটা ভাল আইডিয়া, কিন্তু যখনই তাঁর চেম্বারে যোগ দেবার কথা বললাম তখন তিনি এমনভাবে নিতে অস্বীকার করলেন যেন আমাকে চিনেনই না। পাল ছিলেন খুবই স্পষ্টবাদী মানুষ যেটা ঠিক মনে করতেন সেটা প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেন না।  আমার দূরবস্থা নিয়ে আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ প্রয়াত এডভোকেট আব্দুল হান্নানের সাথে আলাপ করলাম। তিনি শুধু রাজস্ব বিষয়ক মামলা নিয়ে কাজ করতেন। সব কিছু শুনে তিনি বললেন, সুধীর চন্দ্র দাস (এস সি দাস) এর স্বাধীন প্রাকটিস আছে এবং সে পালের সাথে কাজ করে। হান্নান আমাকে বলল, দাস এবং পাল একই চেম্বারে বসে কাজ করে, তাই আমি যদি দাসের চেম্বারে যোগ দেই তাহলে পালের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য সহজ হবে। তার প্রস্তাব আমার মনোঃপুত হল এবং আব্দুল হান্নান আমাকে এস সি দাসের সাথে পরিচয় করিয়েদিল। আমি দাসের সাথে কাজ শুরু করলাম এবং যখনই সুযোগ পেতাম পালের সাথে দেখা করতাম। ফ্রি থাকলে তিনিও অন্যান্য আইনজীবীদের সাথে গল্প-সল্প করতে পছন্দ করতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদি আমি কোনভাবে পালের সাথে কাজ করার সুযোগ পাই তাহলে তিনি আমাকে ঠিকই সুযোগ দিবেন।  এভাবে আমি প্রায় ছয় মাস কাটিয়ে দিলাম, এস সি দাসের চেম্বারে থেকে পালের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতাম, মাঝে মাঝে  দাসের সাথে পালের চেম্বারে যেতাম। ধীরে ধীরে পালের সাথে আমার সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হল। এস আর পাল বড় বড় মামলা পরিচালনা করতেন এবং কে এম সাইফউদ্দিন তার সাথে কাজ করতেন। সাইফউদ্দিন একটু বাচাল ধরনের ছিলেন, তাকে সিরিয়াস মনে হত না। আমি বুঝতে পারলাম আইন বিষয়ে ওনার জ্ঞানের গভীরতা নেই এবং তার হাতের লেখাও ভাল ছিল না।
একদিন বিকেলে আমি দাসের চেম্বারে বসে ছিলাম, এস আর পাল সবেমাত্র আদালত থেকে ফিরে এসেছেন। আমাকে দাসের চেম্বারে একা বসে থাকতে দেখে জানতে চাইলেন আদালতে আমার আর কোন কাজ বাকী আছে কি না। আমি জবাবে না বলায় তিনি জানতে চাইলেন আমি কি তার সাথে তার বাসায় গিয়ে একটা জরুরী রীট পিটিশনের জন্য ড্রাফট করতে পারব।  আমি যেহেতু এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম তাই সাথে সাথে তার অফার লুফে নিলাম। তিনি আমাকে তার গাড়িতে করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন এবং পিটিশনের ডিকটেশান দিলেন।  পালের ড্রাফটিং খুবই স্বতঃস্ফূর্ত, সচল, গুরুত্বপূর্ণ এবং সংক্ষিপ্ত।  কোন রকমের বাধা ছাড়াই আমি ওনার ডিক্টেশান নিয়েছিলাম কারন বর্ণনায় তিনি ছিলেন তুখোড়। আমার ড্রাফটিং এ পাল এত সন্তুষ্ট  হয়েছেন যে সাথে সাথে আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। তিনি আমার প্রশংসা করলেন এবং বললেন আমি যদি তার চেম্বারে যোগ দিতাম তাহলে তার পক্ষে খুব সহজে মামলা তৈরি করা সম্ভব হত। তিনি আমাকে তার চেম্বারে যোগ দেবার অফার দিলেন কিন্তু একই সাথে বললেন যে সুধীর হয়ত বিষয়টা ভালভাবে নিবে না। মনে হল ব্যাপারটা তিনি আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি তাঁকে সরাসরি বললাম প্রথমদিকে আমি আপনার সাথেই কাজ করতে চেয়েছিলাম এবং সে চিন্তা মাথায় রেখেই আমি দাসের চেম্বারে যোগ দিয়েছি যাতে আমি তার চেম্বারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে সুযোগ পেলে আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারব। পরদিন থেকে আমি পালের সাথে কাজ শুরু করি, যেটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।  এর প্রধান কারন পাল ছিলেন তখনকার সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী এবং তার খ্যাতি এমন ছিল যে, প্রায় সব বিচারক কোন রকম ইতঃস্তত না করে আইনী ব্যাপারে তার পরামর্শ গ্রহণ করত। পালের চিন্তা-ভাবনা সব সময় খুব পরিষ্কার ছিল, এবং বই না খুলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মতামত দিতে পারত। যার ফলে সব সিনিয়র আইনজীবী, কোন কোন সময় বিচারক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদেরা তার কাছে পরামর্শের জন্য আসত। এভাবে আমার পরিচয়গত সংকট কাটিয়ে আমি দেশের বিখ্যাত মানুষদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এস আর  পাল কেবল একজন আইনজীবীই ছিলেন না, তিনি নিজে ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের মত। তার জ্ঞানের গভীরতা, আইন এবং ভাষা বিষয়ে তার দক্ষতা দেশের নানা স্তরের মানুষের কাছে প্রশংসনীয় ছিল।  তিনি আইনী বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত বা টীকাভাষ্যের দারস্থ হতেন না, যখনই কোন আইনী প্রশ্ন উঠত শুধু ধারা দিয়ে তিনি সেটা সমাধান করতেন। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন আইনটা ভালভাবে জান, কোন আইন একবারে না বুঝলে দুইবার, তিনবার পড় প্রয়োজনে একশত বার পড় তারপরেও আইনের মানে বুঝার চেষ্টা কর। তার মতে একবার আইনের বিষয়বস্তু বুঝতে পারলে তখন ঐ বিষয়ে আরো ভাল করে বুঝার জন্য আইনী সিদ্ধান্ত এবং টীকা-ভাষ্য ইত্যাদি পড়তে হবে। কখনই তাকে আইনী সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে হাজির হতে দেখিনি, কেবল ধারা দিয়ে তিনি যথোপযুক্ত আইনী যুক্তি দাঁড় করাতে পারতেন। তাঁর আইন এবং বিচার বিষয়ক সততা মানুষ বংশানুক্রমে মনে রাখবে। তিনি ছিলেন আমার পৃষ্ঠপোষক যিনি যে কোন মামলার তথ্য থেকে আইনী বিষয়গুলো ধরতে ও বুঝতে শিখিয়ে আমার জীবনকে পরিবর্তিত রুপে সাজিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল যার ফলে নিজের পেশার প্রতি আরো বেশি মনযোগী হয়েছি। তাঁর কাছ থেকে আমি জীবন ও আইন পেশার মানে বুঝেছিলাম। খুব সহজভাবে মাত্র একটি বা দু’টি উদাহরণ দিয়ে আইন ব্যাখ্যা করে মূল বিষয় ধরিয়ে দিতেন।  আমার জন্য দ্বিতীয় আরেকটা সুবিধা ছিল, যেসব মক্কেল তাকে নিতে পারত না তারা আমাকে ধরত, তারা ভাবত আমি হয়ত এস আর পালের সাথে মামলা নিয়ে আলাপ করতে পারব। আমি তখন চট্টগ্রাম এবং দেশের আরো নানা জায়গা থেকে মামলা পেতে শুরু করলাম। প্রথমদিকে আমি শুধু সিলেটের মামলা নিতাম কিন্তু পালের সাথে যোগ দেবার পরে আমি সারাদেশের প্রায় সকল বারে একজন আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি পেলাম। আমার তৃতীয় যে উপকার হয়েছিল যেটা আমাকে একজন ভাল আইনজীবীতে পরিণত করেছে সেটা হল, যখনই আমি কোন মামলা নিতাম তখন পালের সাথে একাকী সেটা নিয়ে আলাপ করার জন্য অপেক্ষা করতাম। এবং তাকে ভাল মুডে পেলে মামলার যুক্তিগুলো নোট করে নিতাম। যে কোন মামলায় আইনী কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে যুক্তি দেবার অথবা যেকোন বিষয়ে রায় পেতে এটা আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। সেসব দিনে কোন বিষয়ে শুনানি পাওয়াটা এমনকী সিনিয়র  আইনজীবীদের জন্যেও কঠিন ছিল।  আমার মাপের আইনজীবীরা সিনিয়র ছাড়া একাকী আদালতে হাজির হতে সাহস করত না। এমনকী পাঁচ দশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন আইনজীবীরাও সিনিয়রদের ছাড়া আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য কোন ইস্যু উপস্থাপনের সাহস পেত না। এর মধ্যে আমি ছিলাম ব্যতিক্রম।  এটা আমাকে সাহসী করে তোলে এবং আমি আদালতে মামলার সর্বশেষ শুনানিতে সবচেয়ে সিনিয়র আইনজীবী যেমন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আশরারুল হোসেইন, বি এন চৌধুরী, হামিদুল হক চৌধুরী, আব্দুল মালেক, জুলমত আলী খান, এম এইচ খন্দকার, খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, টি এইচ খান, এমনকী খোদ এস আর পাল এদের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতাম। বিচারকেরাও আমাকে সদয়ভাবে দেখতে শুরু করলেন কারন আইন বিষয়ে আমার জানা-শোনা  এবং মামলার খসড়া আবেদনপত্র তৈরিতে আমার দক্ষতাকে তারা ভাল চোখে দেখতেন।
এভাবে আমি তাঁর মাধ্যমে প্রখ্যাত সব বিচারক, আইনজীবী এবং সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেলাম। আমি মনে করি আমার আজকের অবস্থান এবং আইনের জ্ঞানের বেশির ভাগ আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারক হিসেবে উন্নীত হবার আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আমার খুবই ভাল পসার ছিল। আমার আন্তরিকতা, সততা, আইনজীবী হিসেবে দায়বদ্ধতা, সিলেটে আমার সিনিয়রদের সমর্থন ও সহযোগিতা এবং এস আর  পালের সাথে দীর্ঘ সম্পর্কের কারনে আইনী সমাজে আমি একজন খুবই আস্থাভাজন সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতাম। তার উপর, আইন এবং আইনশাস্ত্র বিষয়ে আমার অসামান্য আত্মনিয়োগ, মামলা পরিচালনায় নৈপুণ্য ও আইনী যুক্তি বিচার করে সেগুলো সাজিয়ে আদালতে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করা, এ বিষয়গুলো আইন পেশায় আমাকে একজন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে সাহায্য করে।

চলবে…

==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন।



নাজিম উদ্দিন
অধ্যায় ৩

বিচারক পদে উত্তরণ

সে সময় একজন আইনজীবী  ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে তাকে বিচারকের পদের জন্য বিবেচনা করা হত, যদিও সংবিধানে মাত্র ১০ বছরের আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার বিধান আছে।  আমার বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় ছিল তখন আমাকে পর পর দু’বার বিচারকের পদের জন্য মনোনয়ন দেয় হয় কিন্তু বয়সের কারনে আমার নাম বাদ পড়ে যায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমার বয়সটাই বিচারক পদে আমার জন্য বড় বাধা, যদিও তিনি আমাকে বিচারক পদে পদোন্নতি দিতে খুবই আগ্রহী ছিলেন।  ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তখনকার আইন মন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আমাকে ডেপুটি এটর্নী জেনারেল পদ অফার করেছিলেন। আমি সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানালে  তিনি আমার উপরে বিরক্ত হন। এটর্নি জেনারেলের অফিসে ফৌজদারী আইনে অভিজ্ঞ আইনজীবীর অভাব ছিল।  আমি তাঁকে বলেছিলাম অতিরিক্ত এটর্নী জেনারেল পদ দিলে আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি, তাতে তিনি বললেন সে পদ ইতোমধ্যে মাহবুবে আলমকে দেয়া হয়েছে। আমি তাঁকে বললাম, গত সরকারের সময় অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এর জন্য একের চেয়ে বেশি পদ ছিল। তিনি বললেন সেসব নিয়োগ আইনের পরিপন্থী। আমি বললাম, সেটা আমার সমস্যা নয়, তবে আমি অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেলের নীচের কোন পদে যোগ দিব না। যদিও তখন আমার নাম আগে থেকেই হাইকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের তালিকায় ছিল, কিন্তু আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর সাথে মতানৈক্যের ফলে আমার নাম প্রথম ব্যাচ থেকে বাদ পড়ে যায়। তখন সুপ্রিমকোর্টে আমার খুব সফল প্রাক্টিস থাকায় আমিও হাইকোর্টের বিচারক পদের জন্য অতোটা লালায়িত ছিলাম না। আমার সিনিয়র আইনজীবী এস আর পালও এটা চাইতেন না, তাঁর মতে একজন সফল আইনজীবীর জন্য এমন প্রস্তাব গ্রহণ করা ঠিক না। হাইকোর্টের জন্য দ্বিতীয় ব্যাচে বিচারক নিয়োগের সময় আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আমার বাসায় পরপর তিনবার ফোন করেন। প্রত্যেকবার আমার স্ত্রী ফোন ধরেন এবং আইনমন্ত্রী তাঁর সাথে চা পানের জন্য আমাকে বলতে বলেন। তৃতীয়বার ফোন পাবার পরে আমার স্ত্রী সুষমা কিছুটা রাগের সাথেই আমাকে বলল একজন মন্ত্রী যখন বার বার ফোন করছেন তখন আমার তার সাথে দেখা করা উচিত, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা আমার কর্তব্য।   আমার স্ত্রী আমাকে জানালেন এটা যদি বিচারক পদে নিয়োগের জন্য হয় তাহলে আমি তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারি কিন্তু তাঁর ফোনের জবাবে সাড়া না দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত আমি  বিকেলের দিকে শেরাটন হোটেলের উত্তর পাশে পথকলি ট্রাস্টের অফিস যেখানে তিনি সান্ধ্যকালীন অফিস করতেন সেখানে দেখা করতে যাই।  কিছুক্ষণ পরে আমি লক্ষ করলাম সেখানে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াও আছেন, সাথে এডভোকেট সাইয়েদ রেজা। আমি বুঝতে পারলাম খসরু বিচারক নির্বাচনের কাজ করছেন। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া যেহেতু কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা সাইয়েদ রেজার সাথে এসেছেন তার মানে সাইয়েদ রেজা আব্দুল ওয়াহাবের তদ্বির করতে এসেছেন। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পরে সাইয়েদ রেজা ওয়াহাব মিয়ার সিভি দিলেন। খসরু আমাকেও সিভি দিতে বললেন। তিনি জানালেন আমাদের মধ্যে যা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটা কবর দিয়ে দিতে। তিনি আমাকে আরো বললেন, দেশে প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিচারকের অভাব আছে তাই আমার উচিত তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করা। আমি তাঁকে বললাম, আমি এ নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা করব এবং আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ-আলোচনা করে দেখব। আমাদের আলাপের মধ্যে মাগরিবের নামাজের সময় হলে আমরা উঠে পড়ি। কিন্তু খসরু আমাকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে বললেন। নামাজ শেষে তিনি আমাকে অন্য আরেকটা রুমে নিয়ে যান এবং আমাকে হাতে ধরে অনুরোধ জানান যাতে আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে না দেই। আমি তখন আমার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে মন্ত্রীর ইচ্ছার ব্যাপারটা জানালাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলল, সে কোন মতামত দিবে না কেবল এটুকু বলবে যে বিচারক পদে কাজ করাটা খুবই সম্মানজনক একটা ব্যাপার হবে কিন্তু একই সাথে আমি যেন আর্থিক অবস্থাটাও বিবেচনায় রাখি।
সে সময় ঢাকার ধানমণ্ডির মধুবাজারে আমার একটা চারতলা বাড়ি ছিল।  আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে আমি আইনমন্ত্রীর প্রস্তাবটি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং তাঁকে আমার সিভি দিলাম। তিনি আমাকে এটর্নি জেনারেলের অফিস পুনর্বিন্যাস এবং বিচারক নির্বাচনে সহায়তা করার অনুরোধ জানান। আমরা কিছু সময় ধরে অন্তত দশজন বিচারক নির্বাচন নিয়ে আলোচন করেছি, কিন্তু উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন করা খুব কঠিন ছিল। তিনি আমাকে বললেন সাইয়েদ রেজা এবং আওয়ামী লীগের আরো কিছু নেতা মিলে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে নিয়োগ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। তিনি আরো জানালেন দু’জন জেলা জজকেও অন্তর্ভূক্ত করা হবে, এ ব্যাপারে তিনি আমার কাছে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে জানতে চান। আমি আব্দুর রশিদ উকিলের নাম সুপারিশ করি, তিনি প্রগতিশীল এবং ভাল আইনজীবী। তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।  তারপর আমি তাঁকে আরো দু’জন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল নিয়োগের পরামর্শ দেই যাদেরকে যথাসময়ে বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া যাবে। এদের একজন ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আরেকজন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।  আমি তাঁকে বললাম, এ দু’জন তরুণ আইনজীবী প্রতিশ্রুতিশীল এবং ভবিষ্যতে এদের ভাল বিচারক হবার সম্ভাবনা আছে। পরদিন সকালে তারা দুজনে আইনমন্ত্রী খসরুর সাথে দেখা করেন এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান। আমার নিয়োগ চুড়ান্ত হওয়ার পরে যখন গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় তখন আমি আমার জুনিয়র মাহবুব আলীকে ডাকি, যিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, এবং সে সময় সহকারী এটর্নি জেনারেল পদে কাজ করতেন। আমি তাকে বললাম যে সে আমার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে তাই আমি আমার মামলাগুলো (শেরেস্তা) তাকে দিতে চাই। যদি সে আমার চেম্বারের দায়িত্ব নিতে চায় তাহলে আমি বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করব। আর যদি সে সাত দিনের মধ্যে আমার অধীনস্থ মামলাগুলো গ্রহণ না করে তাহলে আমি শপথ নিব না। আমি ভেবে দেখলাম আমার শেরেস্তায় প্রায় ৪০০০ এর মত মামলা আছে, একজন বিশ্বস্ত আইনজীবী না পেলে আমি বিচারকের পদ গ্রহণ করব না। মাহবুব আলী বললেন তিনি সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চিন সফরে যাচ্ছেন, সেখান থেকে ফেরত আসার পরে মামলার দায়িত্ব বুঝে নিতে তার আরো একমাস সময় লাগবে। আমি তাকে বললাম যদি সে মামলাগুলো ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে সেগুলো থেকে যে টাকা আসবে তা দিয়ে প্রতিমাসে চিন সফর করতে পারবে। আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিলাম তাকে চিন যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে আমার মামলাগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে, নতুবা আমাকে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এডভোকেট মাহবুব আলী আমার প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং পরদিনই আইনমন্ত্রীর কাছে সহকারী এটর্নি জেনারেল পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। আব্দুল মতিন খসরু তার পদত্যাগপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন এটর্নি জেনারেলের অফিসে সৎ কর্মকর্তার অভাব আছে, তাই তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা উচিত। মাহবুব আইনমন্ত্রীর কথা শোনেনি এবং পরদিন আমার কাছে এসে তার পদত্যাগের কথা জানান। জুনিয়র আইনজীবী হলেও মাহবুব একজন সৎ আইনজীবী এবং খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি সততা ও মর্যাদা বজায় রেখে চলতেন, কিন্তু তার বাসায় ৪০০০ মামলার নথিপত্র রাখার মত জায়গা ছিল না। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যাতে ফাইলগুলি আমি দু’মাসের জন্য আমার বাসায় রাখি। আমি বললাম, পনের দিন সময় দিতে পারব, এরমধ্যে ফাইলগুলো সংরক্ষণের জন্য তাকে একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে হবে। তিনি যখন বললেন, পনের দিনের মধ্যে এতগুলো ফাইল স্থানান্তর করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না, তখন আমি তাকে বললাম সেগুলো আমার সুপ্রিম কোর্টের চেম্বারে নিয়ে রাখতে, যেটা আমি এডভোকেট এস এ রহিম এ সাথে শেয়ার করতাম, ভদ্রলোক কদাচিৎ আদালতে আসতেন। মাহবুব আলী তখন মাহবুবে আলমের সাথে একই চেম্বারে বসতেন কিন্তু চেম্বার আলমের ফাইলে ঠাসা ছিল। আমার পরামর্শ অনুযায়ী মাহবুব আলী ফাইলগুলো স্থানান্তর করল।
আরো সাতজন বিচারকের সাথে ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর আমি বিচারক হিসেবে শপথ নিলাম। পদোন্নতি সত্ত্বেও আমার মনে কোন পরিবর্তন আসেনি কারণ আমি এতদিন আইনজীবী এস আর পালের সাথে ছিলাম, পাল একজন সাধারণ বিচারকের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার অধিকারী। বিচারক হিসেবে আমার পদায়ন নিশ্চিত হবার মাত্র পনের দিন আগে সরকার পরিবর্তন হয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, যদি ক্ষমতাসীন দল আমার নিয়োগ নিশ্চিত না করে তাহলে আমি আবার আইন প্রাকটিসে ফেরত যাব। সেজন্য আমি তেমন উদ্বিগ্ন ছিলাম না। সে সময় মাহমুদুল আমিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি ছিলেন। দু’দিন পরে তিনি আমার মামলাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলেন, সেগুলো কোথায় কার জিম্মায় আছে। আমি তাঁকে বললাম, আমি সেগুলো মাহবুব আলীর কাছে দিয়েছি এবং টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলাম।  এর দিন চারেক পরে প্রধান বিচারপতি আবার আমাকে ফোন দিয়ে আবারো আমার মামলার অবস্থা জানতে চাইলেন। তার প্রশ্ন শুনে আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, যে আমি তাকে আগেই বলেছি আমার মামলাগুলো মাহবুব আলীর কাছে আছে।  বলেই আমি ফোন কেটে দিলাম।  এ ঘটনার পরে আমি ভাবছিলাম কেন প্রধান বিচারপতি (মামুন ভাই) আমার মামলা সম্পর্কে দু’বার জানতে চাইলেন, যদিও সিলেটে আমার আইন পেশার প্রথম থেকেই তিনি আমাকে চিনেন। সিলেটের আদালতে আমরা একই টেবিলে বসতাম। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। রাজনৈতিক কারণে আমার নিয়োগ নিশ্চিত করা না হলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু অন্য কোন কারণে হলে সেটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। আমার সততা, দক্ষতা এবং আমি ছিলাম বারের আইনজীবীদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য একজন ভাল বিচারক, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে আমি কানাঘুঁষা শুনতে লাগলাম যে আটজন বিচারকের মধ্যে তিনজনকে নিশ্চিত করা হবে না, আমি তখন ধরে নিলাম ঐ তিনজনের একজন অবশ্যই আমি। কেউ বলতে পারছিল না অন্য দু’জন কারা, কিন্তু বাদ যাওয়ার তালিকায় সবাই আমার নাম বলছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন ও চলমান গুজবের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। আমি পরে শুনলাম বারের সহ-সভাপতি এবং আরো কিছু আইনজীবী প্রতিনিধিত্ব করে বিচারক হিসেবে আমার নিশ্চিতকরণের বিপক্ষে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেন। পরদিন সকালে প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারী আমার চেম্বারে এসে জানাল,
“স্যার, আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে বিচারক হিসেবে আপনার নাম নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।”
আমি অন্য আর কে কে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন তাদের নাম জানতে আগ্রহী ছিলাম। সে আমাকে তার অপারগতা জানিয়ে বলল, আমাকে সে বাবার মত জানে তাই আমার নিশ্চিতকরণের খবরটা দিয়েছে। সেদিনই আদালতে সময় শেষে বিকেলের দিকে আমি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে বিচারক পদে তার নিয়োগ নিশ্চিতকরণের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে ফোন করি। ফোনের ইন্টারকমে ক্রস-কানেকশানের কারণে আমি আড়িপেতে ওয়াহাব মিয়া এবং মমতাজউদ্দিনের মধ্যে যা শুনতে পাই তাতে রীতিমত আশ্চর্যবোধ করি। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া তখন বিচারপতি মমতাজউদ্দিনকে খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছিলেন যে সিনহার নিয়োগ নিশ্চিত করা হবে না কারণ সে একজন দূর্নীতিবাজ বিচারক এবং তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তাদের আলাপ শোনার পরে, আমার বিরুদ্ধে ছড়ানো গুজব শুনে আমি পুরোপুরি হতবাক হয়ে পড়লাম। আমার আরো হতভম্ব লাগছিল কারণ এ গুজবে ছড়ানোর মূল হোতা আর কেউ নয় আমারই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
এর দুদিন পরে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। আমি প্রধান বিচারপতিকে কল করে তাঁর সাথে সংক্ষিপ্ত নোটিসে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে দেখা করার জন্য সময় দিলেন, কিন্তু আমি বললাম, আমি তাঁর সাথে বাসায় দেখা করতে চাই। তিনি আমাকে মাগরিবের নামাজের পরে আসতে বললেন। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তিনি আমাকে অনেকদিন থেকে চিনেন এবং বিখ্যাত আইনজীবীদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে এটা জানেন। প্রথমবার তিনি যখন আমার মামলাগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তখন আমি ভীত হইনি। কিন্তু দ্বিতীয়বারের সময় আমি একটু উদ্বিগ্ন হলাম কারণ পেশাগতভাবে আমাকে জানার পরেও তিনি যখন আমার মামলাগুলো নিয়ে জানতে চাচ্ছেন  এবং তিনি যেহেতু আমার বিচারক পদ নিশ্চিতকরণের সুপারিশ করার জন্য একমাত্র ব্যক্তি তাই আমি ভাবলাম আমাকে সঠিক জবাব দিতে হবে, এর বেশি বললে সেটা তাঁকে প্রভাবিত করবে এবং নিশ্চিতভাবেই সেটা নীতি বিরুদ্ধ হবে। প্রধান বিচারপতিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর বিচারে যাদের যোগ্য মনে হয় তাদেরকে বিচারক পদের জন্য সুপারিশ করেন। গেজেট প্রজ্ঞাপনের পরে আমি বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্যে তাঁর কাছে এসেছিলাম। তখন আমি মাহবুব আলীকে আমার মামলাগুলো হস্তান্তরের বিষয়টা খুলে বলি এবং প্রধান বিচারপতিকে বলি যদি তিনি কোন গরমিল খুঁজে পান তাহলে আমি গেজেট প্রকাশের পরেও শপথ নিব না। তিনি আব্দুর রহিমের কাছে ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে পারেন। সব শুনে প্রধান বিচারপতি অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বকাঝকা করলেন এবং বললেন আমার ওনাকে বিষয়টা আগেই বলা উচিত ছিল। তিনি বললেন, বেশিরভাগ আইনজীবী আমার নিশ্চিতকরণের বিপক্ষে ছিল এমনকী সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশানের সহ-সভাপতি (নামটা ভুলে গেছি, বরিশালের মানুষ) তাঁর কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন। আমার নাম সুপারিশ করার জন্য তাঁকে অনেক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি তাঁকে বলতে চাইছিলাম, যে তাঁর সুপারিশ অবশ্যই স্বাধীন এবং কোন রকমের প্রভাব ছাড়া হতে হবে। যদিও তাঁর সাথে আমাদের আইন পেশার প্রথম দিক থেকে ভাল সম্পর্ক ছিল, আমি তাঁকে বলিনি কারণ আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিলাম যে আমি কোন অনৈতিক কিছু করিনি। পরবর্তীতে তিনি আমাকে বললেন বিচারক পদে আমার পদোন্নতির ছয়মাসের মধ্যে জেষ্ঠ্য বিচারকেরা আমার বিচারকার্যে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিশ্চিতকরণের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু চাপের কারণে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন।
অধ্যায় ৪

জরুরী অবস্থা

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর, বেশকিছু মামলা দায়ের করা হয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতারাও এর বাইরে ছিলেন না। ছাত্রলীগের সভাপতি, সহসভাপতি ও সচিবকে আটক করা হয়। পরে তাদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয় এবং বিভিন্ন জেলায় ডজনেরও বেশী হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের হেফাজতে থাকা অপরাধীদের গ্রেফতার করার বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা প্রদান পূর্বক সুয়ো-মোটো ক্ষমতার অনুশীলন করার ক্ষেত্রে হাবাস কর্পস পিটিশনে আমি সব মামলা বাতিল করেছিলাম। এছাড়াও আমি জামিনে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তির ব্যবস্থা করি। এটা সরকারকে প্রচণ্ড ক্ষেপিয়ে তোলে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ আমাকে সংসদে ‘আওয়ামী সমর্থক বিচারক’ হিসাবে চিহ্নিত করে লীগ নেতাদের অযৌক্তিক অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্য সমালোচনা করেন। আব্দুর রশীদ নামে আমার এক বন্ধুর পরামর্শে চ্যানেল-১ এ সরাসরি সম্প্রচার কৃত সংসদ অধিবেশন দেখেছিলাম, আর তার এই সমালোচনায় আমি ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম।
এই চর্চা একটা প্রথার মত হয়ে উঠেছে যা দেশের দুটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলই অনুসরণ করতে থাকে; যখনই তারা অন্য দলকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে, তখনই রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মামলা দায়ের করে। যা হোক, বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগ দুর্নীতির একটা মনগড়া অভিযোগ এনে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট জমা দেয়, যা আমি দুর্নীতি দমন কমিশন তৎকালীন চেয়ারম্যান, প্রয়াত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের থেকে জানতে পেলাম। তাকে তদন্তের চালিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম এবং বললাম, আমি তদন্তের জন্য সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। তিনি বললেন, এটি খুব এক খারাপ বিষয় হবে জ্যেষ্ঠতার ক্রমের জন্য এবং সংবিধানও এমন পদ্ধতি অনুমোদন করে না। আমি তাকে বললাম যে, সংস্থাটি আমার মানহানি করবার জন্য তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা বন্ধ করবে না। অবশ্য আমি এও জানতাম, কেন এই বিভাগ দুর্নীতিবাজ বিচারক হিসাবে আমাকে নিন্দার্হ করার জন্য এত আগ্রহ দেখাচ্ছে।
(বি এন পি শাসনামল শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের) প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে একটি অচলাবস্থার সূত্রপাত হয়। আওয়ামী লীগ বিচারপতি কে এম হাসানের নিয়োগ বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় এবং শেষ পর্যন্ত হাসান সাহেব প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজুদ্দিন আহমেদ সংবিধানের বিধানগুলি পাস করে প্রধান উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে মোটের উপর এই সময়টাতে এক ধরনের অরাজকতা চলছিল। শেষমেশ সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি চাপ প্রয়োগ করে এই বলে যে, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের সাথে সরকার যদি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন না করে, তাহলে জাতিসংঘে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশী সদস্যদের ফেরত পাঠানো হবে। এই বিষয়টা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সেনাবাহিনীর চাপের কারণে ইয়াজুদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে খুশি হলেও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দল বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিল। এই সব ঘটন-অঘটনের সময় বিচারপতি বি কে দাশের স্ত্রী হঠাৎ মারা যান (২00৭ সালে) এবং খবর শুনে আমি তার বাসায় যাই তড়িৎ গতিতে। তার কিছুক্ষণ পরেই আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ও সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেখানে উপস্থিত হন। আমরা একে অপরের খুব কাছাকাছি বসেছিলাম সেখানে। সুরঞ্জিত তার উচ্ছ্বাস সামলে রাখতে পারছিলেন না এই জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে এবং তার দল আওয়ামী লীগই যেন ক্ষমতায় এসেছে, এইভাবে নিজের দলকে কৃতিত্বের বাহবা দিতে থাকেন। তিনি বলেন, তার দল পরবর্তী সরকার গঠন করবে, এটি একটি সময়ের বিষয়। মনে হচ্ছিল, তিনি এমনকি ভুলে বসেছেন যে, আমরা শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি আমাদের দুঃখপ্রকাশ করতে গিয়েছিলাম, বিশেষ করে বি কে দাসের প্রতি।
সুরঞ্জিত কিছু কাজে ব্যস্ততার কথা বলে চলে যেতে চাইলেন। আমি তাকে থামিয়ে বললাম, “হ্যালো লিডার, যাবার আগে আমার কিছু কথা বলার আছে, দয়া করে বসুন।” আমি বললাম যে, তার মতো নেতারা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক মূল্যায়ন না করে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় নাচছেন। তাকে বলেছিলাম যে দৃশ্যত, তিনি দেশে সৃষ্ট বিপদের আশঙ্কাজনক পরিণতি সম্পর্কে একদম ভুলে গেছেন। “আপনি নির্বোধভাবে সেনাবাহিনীর ইমপ্যাক্ট না বুঝে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আপনার দলই প্রথম টার্গেট হবে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন শীঘ্রই আপনারা কোনো নির্বাচন পাচ্ছেন না।” যখন আমি কারণগুলি ব্যাখ্যা করলাম, তখন মনে হল যেন সে একটু বিভ্রান্ত আর বললেন, “দেখা যাক।” আমার শঙ্কা দিন কয়েকের মধ্যেই সত্য প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী না হলেও দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা কিছু মামলায় তিনি অবিলম্বে  গ্রেফতার হন। এদিকে, সেনাবাহিনীর শক্তির একীভূতকরণের পর আরো রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এর প্রায় ছয় মাস পর, রেজিস্ট্রার সাহেব জানালেন যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমেদ আমাকে পরদিন বিকেলে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যখন তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম, তখন দেখলাম তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আমিনুল করিম হাতে একটি ফাইল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক ভাবে কোন সন্দেহ পোষণ করিনি, বরং মনে করছিলাম আমাকে বিশেষ নিয়োগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। যা হোক, আমার অনুমান মিনিটখানেকের মধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়। রাষ্ট্রপতি বললেন যে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। কেন প্রশ্ন করলে জবাবে বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে বললাম যে রিপোর্টটি মিথ্যা ছিল এবং বিষয়টি নিয়ে তার আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত। ওই সময় সামরিক বাহিনীর সচিব হাতের ফাইল দেখিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করছিলেন। আমি তাকে থামিয়ে বললাম যে তার আমার সাথে কথা বলা উচিত নয় কারণ আমি রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম।
আমি রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম, আমি এভাবে পদত্যাগ করব না আর তাকে এও স্মরণ করিয়ে দিলাম যে পদত্যাগ করলে এমনকি আমার পেনশন সুবিধাও পাব না। তারপর তিনি বললেন, যদি তার প্রস্তাবে রাজি হই তবে সরকার আমাকে পেনশনের দ্বিগুণ পরিমাণ দেবে। এমনকি যদি ভারতে যেতে চাই, তবে সরকার আমাকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেবে। ‘আমি দুঃখিত’ বললাম তাকে এবং এই বিষয়ে আবার চিন্তা করার জন্য অনুরোধ করলাম এবং আমাকে দেয়া চা না পান করেই আমি ফিরে আসি। প্রধান বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন তখন দেশের বাইরে ছিলেন এবং তিনি ফিরে আসার তিনদিন পর ঘটনাটি বর্ণনা করে আমি তার পরামর্শ চেয়েছিলাম। কোনরকম ঝুঁকি ও চাপ মাথায় না নিয়েই তিনি আমার বিচার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এরমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমীন, যিনি পরিচিত ছিলেন বিহারী আমিন নামে, ডিজিএফআই এ বদলি হলেন। তিনি আমার উপর চাপ বাড়াতে থাকলেন পদত্যাগের জন্য। একদিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব সুপ্রিম কোর্টের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। আমি তার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করি। ড. কামাল হোসেন তখন ইউ কে তে ছিলেন আর খবর পাওয়া মাত্র নিজের মেয়ে একটিভিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে আমার কাকরাইলের বাসভবনে পাঠালেন এই বার্তা দিয়ে যে, তার ফেরার আগ পর্যন্ত আমার কিছু করা উচিত হবে না। পরবর্তীতে আমার ও রাষ্ট্রপতির মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে মতামত জানাতে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে থেকে একটি চিঠি পাই। ইতোমধ্যেই ড. হোসেন বিদেশ থেকে ফিরে আসেন, চেম্বারে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং একটি লিখিত জবাব আমাকে দেন। আমি তাকে আমার নিজের প্রস্তুত করা প্রতি উত্তরটা দেখাই। উত্তর পড়ার পর, তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন যে, এটা তার লেখাটির চেয়ে চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। আমি সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে জবাব দিয়েছিলাম যে আমরা উভয়ই সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করেছি: সংবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আমাদের উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং সংবিধানের অধীনে শপথ লঙ্ঘন করে এমন কিছু করা থেকে তার বিরত হওয়া উচিত। এরপর ব্যাপারটা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৫

অসুস্থতা, চিকিৎসা ও আপিল বিভাগে উন্নতি

২০০৯ সালে আমি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুর্ভাগ্যবশত, ডাক্তারগণ নিশ্চিত করে রোগের বিষয়টি জানাবার আগে প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। চরম শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি, মানসিক যন্ত্রণাও বাড়তির দিকে যাচ্ছিল যেহেতু আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে আমার দিন শেষ হয়ে আসছে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। বেশ নিবিড় আলোচনার পর ডাক্তাররা রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে আমার চিকিত্সা করার সিদ্ধান্ত নেন। কেমোথেরাপি দ্বিতীয় দফা প্রদানের পরপর আমাকে এত ভয়াবহ অসুস্থতা সহ্য করতে হয়েছিল যে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন এত কষ্ট ও অশান্তির বদলে তিনি আমার জীবন নিয়ে নেন।
এমনতরো সময়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছ থেকে ফোন কল পাই। তিনি জানান সরকার আমাকে আপিলাত বিভাগে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার প্রস্তাব অস্বীকার করি এই বলে যে, আমার অবস্থা ভয়াবহ আর কতদিন বাঁচব তার সম্ভাবনা সম্পর্কেও কিছু জানি না। এমনকি চিকিৎসকেরাও ন্যূনতম ছয় সপ্তাহের শেষ হবার আগ পর্যন্ত চিকিত্সার ফলে উন্নতি হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি। তিনি বললেন সরকার ও বাংলাদেশের সকলে আশা করে, আমি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবো আর যদি আমি আপিল বিভাগে উন্নীত না হই, তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি সম্ভব হবে না।
আমি তাকে বললাম, স্বাস্থ্যগত কারণে দায়িত্বটি গ্রহণ আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ছয় বা সাত দিন পর তিনি আবার ফোন করে স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতে চাইলেন। সেই সময়ে আমাকে দেয়া কেমোথেরাপি প্রায় শেষ হয়ে যায়, মাত্র দুই বা তিনটি রেডিওথেরাপির সেশন বাদে। আমি তাকে জানাই আমার বমি বমি বোধ হওয়ার বিষয়টা প্রায় শেষ হয়ে গেছে ও মৌখিকভাবে কিছু তরল খাবার নিতে পারছিলাম। চিকিৎসার পর আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন আর জানালেন, প্রয়োজন হলে যাতায়াতের জন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমি ভাবলাম সিঙ্গাপুরে বিপুল অর্থ অপচয় করে আর থাকার কোন মানে হয় না আর তাই বাংলাদেশে ফিরবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী, জুনের মধ্যভাগে ঢাকায় ফিরে এলাম। ২০০৯ সালের ১৫ জুলাই তারিখে মোঃ আবদুল আজিজ, বি কে দাস ও এবিএম খায়রুল হক সহ আমি শপথ গ্রহণ করি। আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিচারক। শিকদার মকবুল হক টপকে আমি নিয়োগ পাই। এ ব্যাপারে সুপারিশের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না, কিন্তু দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক মীজানুর রহমান খান এর সমালোচনা করেছিলেন। সিকদার মকবুলের হাতে ছয় মাস বেশি সময় ছিল আর আমি ছয় মাস পরেও আপিল বিভাগে যুক্ত হতে পারতাম। যাই হোক, বিচারপতি সিকদার মকবুল ও তার পরিবার এই নিবর্তনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আমি জানতে পারলাম প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম, মোঃ আবদুল আজিজ, বি কে দাস, মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও আমাকে নিয়ে একটা বেঞ্চ গঠন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শেষের জন্য। যদিও প্রায় ছয়জন সিনিয়র বিচারক ছিলেন, তবুও সবাই বেঞ্চে ছিল না কারণ তাদের মধ্যে কয়েকজন বিব্রত বোধ করেছিলেন এবং ফজলুল করিম ও এবিএম খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের শুনানি করেন। কেন আমি সিকদার মকবুল হোসেনকে পরাজিত করেছিলাম তার সমীকরণ আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। যদিও সকল বিচারকই জ্যেষ্ঠ ও দক্ষ ছিলেন, তবুও ফৌজদারি আইন সম্পর্কে তাদের কিছুটা কম ধারণা ছিল আর আমি বাদে বেঞ্চের বাকি সব সদস্য সাধারণ নাগরিক (সিভিল অপরাধ) বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
শপথ গ্রহণের পর, চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমি সিঙ্গাপুরে যাই আর ডাক্তাররা মনে করছিলেন যে চিকিত্সার ফলাফল ইতিবাচক ছিল আর রোগটা পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা মাত্র ১০-১৫ শতাংশের মত। খবরটা যেদিন শুনি, সেদিন মনে প্রথম যে কথাটা মনে হয় সেটা হল, আমার নাতিকে আমি দেখতে পাবো, যে কিনা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর আলোয় এসেছে। সিঙ্গাপুরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে একজন ছিলেন সিদ্দিকী, যিনি আমাকে অযুত সাহায্য করেছিলেন, যদিও তার সাথে আগে পরিচিতি ছিল না। ঘরের নতুন সদস্য, নবীন প্রজন্মের একজনের জন্য স্বর্ণের চেইন কিনতে সাহায্য করার জন্য তাকে অনুরোধ করলাম…
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবার পর, অন্য আরেক ডাক্তারের মতামতের জন্য আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। মেডিকেল রেকর্ড দেখা আর রক্ত পরীক্ষার পর আমাকে তারা বললেন সব কাগজপত্র ফেলে দিতে আর সিঙ্গাপুরের ড. চ্যাং ছাড়া অন্য কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ না করতে। তারা জোর দিয়েই বললেন তিনি বিশ্বের সেরা ক্যান্সার চিকিৎসকদের একজন এবং আমাকে সঠিক চিকিৎসাই দিয়েছিলেন। তারা আরও জানায় আমি যদি সঠিক ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করতাম তবে আমার ভাগ্যে ভিন্ন কিছুও ও হতে পারত।
চলবে…

==============
নবযুগ সম্পাদকের নোট: তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস মাথায় রেখে যারা বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তারা আসলে কেউই মনে রাখেননা, দিনশেষে তারা সামরিক শাসক নন, জনগণের নির্বাচিত সরকার। পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে আসবার নজির খুব কম বলেই, আমরা সম্পূর্ণটা কখনো জানতে পাই না। তাই রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের বাস্তবতাগুলো, সেই জাদুবাস্তবতার বাংলাদেশের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র আত্মজীবনীমূলক বই ‘একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী: আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ একটি মোক্ষম চপেটাঘাত, আমাদের ঘুমন্ত নাগরিকদের জেগে ওঠার আহ্বান।
বইটি দ্রুত অনুবাদের জন্য ড. নাজিম উদ্দিন-এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী গবেষক ও লেখক আদিত্য রাহুলকে। আশাকরি অনেকেই বইটি পাঠ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটা ধারণা পাবেন। উল্লেখ্য, ৪র্থ পর্বে ৩টি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। ৩য় অধ্যায় ড. নাজিম উদ্দিন এবং ৪র্থ ও ৫ম অধ্যায় অনুবাদ করেছেন আদিত্য রাহুল।
এই বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে লেখকের শৈশব ও যুবক বয়সের কিছু গ্রাম ও মানুষের নাম ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হয়েছে তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করতে কিছুটা সংশয় হওয়ায়, আগ্রহী পাঠক ও জ্ঞাত ব্যক্তিদের এই বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ব্যক্তির নামগুলো কারো যদি জানা থাকে তবে সেগুলোর সঠিক বানান, জানাবার অনুরোধ রইল। সকলকে শুভেচ্ছা।






মন্তব্যসমূহ