সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (৫ম পর্ব) - নাজিম উদ্দিন / সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮ Ccourtecy;- nobojug blog)

continued , pveously posted uo to 4th paragraph n


নাজিম উদ্দিন
অধ্যায় ছয়

 ফজলুল করিম এর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের অবসর নেবার নির্ধারিত সময় ছিল ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৯। তিনি জ্যেষ্ঠতার ক্রমে বিচারপতি মোঃ. তোফাজ্জল ইসলাম ও মোঃ. ফজলুল করিমকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। মোঃ. তোফাজ্জল ইসলাম ১৭ তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর শপথ গ্রহণ করেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এ অবসর গ্রহণ করেন। দুই মাসেরও কম সময়ের জন্য তিনি অফিসে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানিতে অংশ নেবার কারণেই মূলত তিনি প্রধান বিচারপতি হন। তিনিও মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়ে ওঠেন স্বাভাবিক নিয়মেই। তাঁর পক্ষে একমাত্র ইতিবাচক দিকটি ছিল, তিনি হাইকোর্ট বিভাগের তৃতীয় বিচারক ছিলেন যিনি মোঃ রুহুল আমিন ও খায়রুল হকের দেয়া বিতর্কিত রায়ের পর দুই বা তিনজন আসামীর প্রধান আপিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চিন্তাধারার লাইনের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য মোঃ. ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতির অফিস দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজনৈতিক পদ হয়ে ওঠে আর এটা মোটামুটি ভাবে কল্পনাতীত হয়ে যায় যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার বাইরে কেউ প্রধান বিচারপতি হতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও তার (মোঃ ফজলুল করিম) নাম বিবেচনা করা হয়নি কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার আপিল শুনানি করেন। এম. এম. রুহুল আমিন, যিনি বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন, তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়। ফজলুল করিমকে দুইবার জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে অতিক্রম করার পরও তিনি বিচার বিভাগীয় কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ় ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর একমাত্র ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হওয়া, কারণ তার শ্বশুর বিচারপতি ইমাম উদ্দিনও ছিলেন একজন প্রধান বিচারপতি। তিনি স্বর্গ-মর্ত্য এক করে ফেলেছিলেন আঠারোতম প্রধান বিচারপতি হবার জন্য। অন্য দিকে, বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলামের অবসর নেওয়ার পর এবিএম.  খায়রুল হকও প্রধান বিচারপতি হতে চাইলেন। তিনি আপিল বিভাগে মাত্র কয়েক মাস কাজ করেছিলেন কারণ ২০০৩ সালের জুলাই মাসে তিনি আমার মতই পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তার পক্ষে এই দিকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যে তিনি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় প্রদান করেছিলেন।
মোঃ. ফজলুল করিম ছিলেন ব্যারিস্টার, যেমনটা ছিলেন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তাদের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামান্য ক্ষমতা ছিল শফিক আহমেদের আর প্রধানমন্ত্রীর একারই এখতিয়ার ছিল এই বিষয়ে যদিও সংবিধানের মোতাবেক প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। এমনকি এক পর্যায়ে, মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার নির্বাচনে আমার সাহায্যের জন্য দুবার বাসায় এসেছিলেন। মোহাম্মদ ফজলুল করিমের পক্ষে যতটুকু প্রচারণা চালানো যায় তাই সবটাই হচ্ছিল।  অবশেষে, চট্টগ্রামের একজন শক্তিশালী সাংসদ প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবুকে তার পক্ষে তদবিরের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হন। চট্টলাবাসী বলে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সত্ত্বেও একই এলাকার লোক হিসেবে তাদের একে অপরের জন্য একটা বোঝাপড়া ছিল। মোঃ. ফজলুল করিমের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস অর্জনে আখতারুজ্জামান সফল হন। সরকার একটি দ্বিধা বিভক্ত অবস্থায় ছিল; একদিকে এবিএম. খায়রুল হক ছিলেন আপীল বিভাগের খুব কনিষ্ঠ একজন বিচারক এবং অন্যদিকে মোঃ. ফজলুল করিম তার তদবির নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছেন আখতারুজ্জামানের মাধ্যমে। যদিও খায়রুল হকের চেয়ে অন্য দুইজন বিচারক সিনিয়র ছিলেন তবে তারা বিবেচনায় ছিলেন না।
শেষমুহুর্তে আইনমন্ত্রী আর আমার টেলিফোনে আলোচনা হয়েছিল। সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি ফজলুল করিমকে বলেছিলাম যে রাতটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, আজই পরবর্তী প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাকে বললাম, রাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আমি তাকে জানাব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক আগেই শফিক আহমেদ আমাকে রাত প্রায় এগারোটার দিকে ফোন করেন, তিনি যদি প্রধান বিচারপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তবে সরকারকে বিব্রত করবেন না; এই বিষয়ে মোহাম্মদ ফজলুল করিমের কাছ থেকে আশ্বাস পাবার জন্য। তাড়াহুড়ো করে আমি ফজলুল করিমের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে এগারোটায় আর তাকে স্ত্রীর সাথে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখলাম। ইতিবাচক সংবাদ জেনে তিনি অবশ্যই খুব খুশি ছিলেন। আমি ফজলুল করিমকে আইনমন্ত্রী মেসেজের কথা জানিয়েছিলাম। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন কিন্তু আমার ঘরে ঢোকবার মুহূর্তে তিনি এত উদ্বিগ্ন ছিলেন যে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি তাকে দাঁড়াতে বলিনি। তিনি আমার ডান হাত ধরে বললেন, “সবসময় তোমাকে ছোট ভাইয়ের মত দেখতাম। তুমি যা করতে বলবে আমি তাই করব।” তার কথা শুনে অবাক হলাম আর উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, পদের জন্য নিজেকে ছোট করা তার মত একজন উচ্চ মর্যাদার লোকের পক্ষে শোভন নয়। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি ফজলুল করিমের উদ্দেশ্যে আইনমন্ত্রীর শঙ্কার কথা জানালাম আর আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে ফজলুল করিমের হাতে ফোনটা দিলাম।
এভাবে বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কয়েকজন আইনজীবীকে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে পদোন্নতি দেবার জন্য সুপারিশ করেন যাদের মধ্যে ছিলেন মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও খসরুজ্জামান। তবে নাম প্রকাশের পরপরই, পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকালে মোঃ রুহুল কুদ্দুস এবং খসরুজ্জামান উভয়েরই ফৌজদারি মামলা ছিল যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মূলত সেগুলো রাজনৈতিক ঘটনা ছিল। তারপরেও প্রধান বিচারপতি শপথ নেওয়ার জন্য এই বিচারকদের আমন্ত্রণ জানাননি। এটি ছিল এক বিব্রতকর পরিস্থিতি, আমার, আইনমন্ত্রী, সরকার ও অন্যান্যদের যারা তাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। সরকার এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয়। কয়েকদিন পরে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার গেলাম আমি ও প্রধান বিচারপতি করিম সহ বিচারপতিদের একটি দল। অনুষ্ঠানের পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানের পর, একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনার জন্য প্রধান বিচারপতিকে আমার ঘরে আমন্ত্রণ জানালাম। আমি প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে অনুরোধ জানাই এবং  ওই দুই বিচারককে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে যেন আমাদের উদ্ধার করেন। তাকে সেই রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম যখন তিনি কথা দিয়েছিলেন আর যেহেতু  কারণ ওই নাম দুটির প্রতি সুপারিশ তার তরফ থেকেই হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে অস্বীকার করেন। তারপরও, সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। তিনি প্রায় সাত মাস এবং একুশ দিনের জন্য অফিসে ছিলেন। ওই দুই বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর শপথ গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্বভার লাভ করেন ৩০ নভেম্বর, ২০১০ এ, বিচারপতি এম এ মতিন ও শাহ মমিনুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমে অতিক্রম করে। ১৭ মে, ২০১১ তারিখে খায়রুল হক অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত উভয়ই পদত্যাগ করার পরিবর্তে দীর্ঘ ছুটি গ্রহণ করেন। এরপর ১৮ মে, ২০১১ তারিখে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়, আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমে অতিক্রম করে। এর পরপরই, তিনি পদত্যাগ করেন।
খাইরুল হক যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তখন আপীল বিভাগের জনবল হ্রাস পেয়ে মাত্র তিন সদস্যে এসে ঠেকেছিল: প্রধান বিচারপতি ছাড়া মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও আমি ছিলাম। মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে এড়াতে সরকার এ পদ পূরণে বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব করে। আদালতে প্রচুর চাপ ছিল এবং কাজের ভার মাত্র তিনজন বিচারকের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ সময় আবদুল ওয়াহাব মিয়া হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন। সরকার তাকে আপিল বিভাগে উন্নীত করতে অনিচ্ছুক ছিল। এরকম একটা ধারণা ছিল যে, অন্য কনিষ্ঠ বিচারক নিয়োগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের বারে এক ধরণের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে পারে কারণ তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে যুক্ত ছিলেন না এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি বারের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট বার বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল ও মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়া তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বার সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন দুবার। পদোন্নতির জন্য তিনি দৃঢ়ভাবে তদবির করছিলেন। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি খোলা আদালতে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন আর সেটা বার অ্যাসোসিয়েশন ও বিচারকদের কক্ষে সেদিন আলাপের বিষয় হিসেবে ছিল তুঙ্গে।
তিনি এত উচ্চাভিলাষী ছিলেন যে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে উন্নীত হওয়ার দিন থেকে প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখতেন এবং তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতিতেই এই অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবীদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছিল। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। প্রাক্তন ও বর্তমান বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীগণ ক্লাস পরিচালনা করতেন। একদিন অমায়িক ও সুশৃঙ্খল স্বভাবের বিচারক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এম সাদেক অপেক্ষা করছিলেন বিচারকদের কক্ষে। সে সময় সাদেক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ও আমার কাছে বিচার সংক্রান্ত কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন এবং প্রশংসা করলেন এই বলে যে, আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে এবং বিচার বিভাগে আমরা আরও অবদান রাখতে সক্ষম হব। আবদুল ওয়াহাব মিয়া বলেন, যদি আল্লাহ না করেন, তবে বিচারপতি সিনহা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রধান বিচারপতি থাকবেন আর তিনি এগারো মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি হবেন। যদিও তিনি সুপ্রিম কোর্টে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু বয়সের জ্যেষ্ঠতার কারণে আমাকে পদোন্নতির সময় জ্যেষ্ঠতা দেয়া হয়। আমি  মোঃ আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে আগে থেকেই জানতাম, তাই সে যে ধারনা দিতে কথাটি বলেছিল, তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল আর আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি।
ওবায়দুল হাসান ও এম এনায়েতুর রহিম ছিলেন আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার চেয়ে কনিষ্ঠ, যখন তারা বারে অনুশীলন করতেন। সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে তারা জাতীয় আইনজীবী সমিতিতে যুক্ত ছিলেন, যা কিনা এডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিকল্প আইনজীবী ফোরাম। শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সমন্বিত আইনজীবী সমিতি ছিল এই ধরণের বৃহত্তম ফোরাম। স্বাভাবিকভাবেই ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিমের সাথে বোঝাপড়া ও ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার। এই দুই বিচারক আপিল বিভাগে তাদের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের কাছে বারবার ঘুরতে আসতেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও তারা আমার চেম্বারে আসতেন আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর, জিজ্ঞেস করতাম জরুরী কোন কাজ আছে কিনা। তাদের আসার উদ্দেশ্য জানতাম কিন্তু কিছুই না জানার ভান করতাম। তারা জানতেন যে আমি খুব কঠোর ব্যক্তিত্ব এবং কখনো তারা বিষয়টি উত্থাপনের সাহস দেখাননি। তারা অভ্যাসবশতই বলতেন; “স্যার, আমরা আপনাকে সালাম জানাতে এসেছি।”
এক সপ্তাহান্তের সকালে মাহবুবে আলম একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনার জন্য কাকরাইলে আমার সরকারি বাসভবনে আসেন। আমাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার কারণে তখন সম্পর্ক ভাল ছিল। তিনি একেবারেই প্রগতিশীল মানসিকতার লোক আর রবীন্দ্র সংগীতের ব্যাপারে দুর্বল। মাঝে মাঝে নির্বাচিত দর্শকদের জন্য ভারতীয় গায়কদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছেন। আবদুল ওয়াহাব মিয়া কল্পনাও করতে পারেননি যে অ্যাটর্নি জেনারেল আমার বাসভবনে থাকবেন এবং তাকে দেখে ওয়াহাব মিয়াকে কিছুটা বিব্রত বোধ করতে দেখলাম। মাহবুবে আলম ও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার মধ্যে সম্পর্ক ভালোই ছিল, কিন্তু তাদের ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার কারণে পরস্পরের মাঝে কিছুটা দূরত্ব থাকত। যদিও দেখা হলে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতই আচরণ করতেন। এই ধরনের দৃষ্টিবিনিময় আমার কাছে বেশ বিনম্র বলেই মনে হত আর আমি তাদের পরস্পরের সাথে দেখা যখন মুহূর্তটা উপভোগ করতাম। আগের বর্ণনা মতে, মাহবুবে আলম ছিলেন একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি, যদিও আব্দুল ওয়াহাব মিয়া নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করতেন, তবে তার কাজ ও আচরণ অন্যকিছুর প্রমাণ দিত। ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিম সবকিছু জানার পরও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন এবং তাঁর পদোন্নতির ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন।
যাই হোক, ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিম উভয়ই শক্ত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ পরিবার থেকে উঠে আসা ছিলেন। ওবায়দুল হাসানের ছোট ভাই সাজ্জাদ একজন অতিরিক্ত সচিব, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করছেন আর তার খুব ঘনিষ্ঠ। এনায়েতুর রহিমের ছোট ভাই ছিলেন আওয়ামী সংখ্যাধিক্যের সংসদে লীগ সরকারের হুইপ। আমার বাসভবনে আসার ব্যাপারে আবদুল ওয়াহাব মিয়ার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলাম আর তাকে আমাদের সাথে চা খেতে অনুরোধ করলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উপস্থিতিতে ইতস্তত হয়ে বললেন, আমরা গোপন কিছু আলোচনা করছি; এখন তার উপস্থিতি যথাযথ নয়। চা পানের পর, ওয়াহাব মিয়া চলে যেতে চাইলেন কিন্তু আমি চেম্বার থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কিছুক্ষণ অপেক্ষার অনুরোধ করলাম। বারান্দার বাইরে আবদুল ওয়াহাব মিয়া আমাকে ধরে বললেন, বন্ধু, আমাকে ক্ষমা করে দিন, যদি আপনাকে অসন্তুষ্ট করে থাকি। উচ্চতর বেঞ্চে উন্নীত হতে আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।”
এই প্রথমবার তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন আর ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি তাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেছি বললাম আর আপীল বিভাগে উন্নীত হলে খুশি হব ও তার পথে বাঁধা হব না। এই আশ্বাস পেয়ে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে ফিরলাম তখন মাহবুবে আলম স্বাভাবিক ভঙ্গীতে  জিজ্ঞেস করলেন আব্দুল ওয়াহাব মিয়া পদোন্নতির জন্য তদ্বিরে এসেছেন কিনা। আমি হাসলাম। তখন মাহবুবে আলম বলেন, “এই ভদ্রলোক হাইকোর্ট বিভাগকে দূষিত করে ভুল করেছে আর তাকে পদোন্নতি দেয়া হলে প্রশাসনের ন্যায়বিচারে গুরুতর জটিলতা থাকবে।”
অবশেষে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া তাঁর নাম নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মুহাম্মদ ইমাম আলী ও হাসান আব্দুল ফয়েজ সিদ্দিকীদের সাথে পদোন্নতির জন্য যুক্ত করতে সক্ষম হন। বাকি তিন বিচারক তার চেয়ে অনেক কম বয়সী ছিলেন। পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার একবার দেখা করার উপলক্ষ ছিল আর বিচার বিভাগ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কারণে মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে নিয়োগের জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। পরে জানতে পারলাম, ওয়াহাব মিয়া আইনমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলেন আর তাকে কোনভাবে পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদবির করতে সম্মত করতে পেরেছিলেন। আনিসুল হক পরবর্তীতে আমার কাছে স্বীকার করেন, তিনি ভুল করেছেন আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনেছেন।
অনেক সময়ই আমাকে প্রধান বিচারপতির কাজগুলো করতে হত যেহেতু প্রধান বিচারপতি কেবল ছুটির সময়ই নয় বরং নিয়মিত আদালতের সময়ও ভ্রমণ করতেন।  এরকমই এক সময়ে, যখন আমি ভারপ্রাপ্ত ছিলাম, তখন ফারুক আহমেদের দুর্নীতির বিষয়ে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ লক্ষ্য করি। রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে কেসের সংখ্যাও বলা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ফারুক আহমেদ বিশেষ জজ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। অভিযোগ করা হয়েছে, অবসর নেওয়ার আগে গত ছয় মাসে তিনি গুরুতর দুর্নীতি করেন। খবর পড়ার পরই আমি আদালত পরিদর্শন করতে গেলাম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা কিছু মামলার নথি পরিদর্শন করি এবং লক্ষ্য করি যে উক্ত বিচারক একদিনে দুই বা একাধিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন। তিনি সাক্ষীদের উপস্থিতির নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করেননি এবং অন্যের আগমনের অপেক্ষা না করে এক বা দুই সাক্ষীকে পরীক্ষা করেই  সাক্ষ্য নেয়া বন্ধ করেন, প্রসিকিউশন বন্ধ করেন আর অভিযুক্তদের খালাসের সিদ্ধান্ত দেন। আমি দুই মাসের বিচারিক রেকর্ড খুঁজে দেখেছি আর দুই মাসে তিনি প্রায় একশত মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন, যার বেশিরভাগই সোনা বা মূল্যবান পণ্যের চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়। বেঞ্চের সহকারী ও আইনজীবীদের তদন্তে প্রকাশ পায় পাবলিক প্রসিকিউটরদের কাজের অসংলগ্নতা। তাছাড়া, পাবলিক প্রসিকিউটরদের সহায়তা ছাড়া তিনি এধরণের রায় প্রদান করতে পারতেন না। আমি বেঞ্চ সহকারী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেই, মামলার রেকর্ড ছাপানোর জন্য একটা প্রিন্টার আনতে, যাতে সেদিনই রিপোর্টটা জমা দিতে পারি কারণ পরের দিন প্রধান বিচারপতি তার কাজ পুনরায় শুরু করবেন।
লক্ষ্য করলাম যে, শুনানির জন্য প্রস্তুত নয় এমন মামলার ক্ষেত্রে তিনি চার্জ গঠন করেন আর পরবর্তী দিনটি বিচারের জন্য স্থির করেন এবং একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেবার পরই তিনি মামলার শুনানি বন্ধ করে দেন আর রায় প্রদান করেন। সমস্ত দলিল দস্তাবেজ আনার পর, আমি রাতে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে বসেছিলাম এবং রিপোর্টটি লিখিয়ে নিচ্ছিলাম। রিপোর্টটি চূড়ান্ত করতে করতে প্রায় রাত দশটা বেজে যায় এবং আমার ফিরে আসা পর্যন্ত রেজিস্ট্রারকে অফিস খুলে রাখতে নির্দেশ দেই। বিপুল পরিমাণ চোরাচালান ও দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে কর্মকর্তারা অবিশ্বাস্য রকম দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে। অফিসার অবসর নেওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে এবং মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করি। আমি আরও উল্লেখ করেছিলাম যে সময়ের অভাবের কারণে অন্যান্য মামলাগুলির নথিপত্র দেখা সম্ভব হয়নি এবং গত দুই মাসে ফারুক আহমেদের শুনানি সম্পর্কিত বিষয়গুলো হাইকোর্ট বিভাগের অন্য আরেকজন বিচারককে দিয়ে তদন্ত করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ জানাই। এই সংবাদটি কোনভাবে প্রচার মাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরের দিন প্রকাশিত হয়। প্রধান বিচারপতি পরদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন, কেন তার জন্য অপেক্ষা না করে রিপোর্ট জমা দিয়েছি আর আমাকে তৎক্ষণাৎ রিপোর্টটি প্রত্যাহার করার জন্য বললেন। আমি তাকে জানালাম, আমি কেবলমাত্র যে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছি তা নির্দেশ করেছি আর এই ধরনের বিচারককে বরদাস্ত করা যায় না। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে মন্ত্রণালয় ও দুদকের সাথে যোগাযোগ না করে রিপোর্ট গোপন রাখতে পারেন বা অন্যথায় তার ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিবেদন প্রত্যাহার করতে পারেন। কিন্তু আমি জমা দেওয়ার পর রিপোর্ট প্রত্যাহার করতে পারিনি।
এই কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে পরিচিত ছিলেন আর তাঁর নাম তিনবার প্রস্তাব করা হয় মন্ত্রণালয় ও জিএ কমিটি কর্তৃক, যা কিনা প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগের তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে সর্বোচ্চ সংস্থা। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের স্থানান্তর ও পোস্টিং বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী দাবির কারণে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতি কমিটির সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও তারা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ওই কর্মকর্তা ব্যক্তিটি কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছিলেন এবং প্রধান বিচারপতিও একই এলাকার ছিলেন। কিন্তু বিচারকরা এই প্রস্তাব অনুমোদনকে প্রত্যাখ্যান করেন। এক পর্যায়ে ফারুক আহমেদকে ঢাকায় পোস্টিং করার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি জোর দেয়ায় এক বিচারক কমিটি থেকে পদত্যাগের হুমকি দেন। এরপর প্রধান বিচারপতি জিএ কমিটির পুনর্গঠন করেন এবং প্রস্তাব অনুমোদন করেন। যখন বিষয়টি আইনমন্ত্রীর নজরে আনা হয়, তখন তিনি কোন মন্তব্য করেননি। অন্য আরেকজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা রায় প্রদানের পর দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন আর কেমন করে বিদেশে ভালোভাবে থাকতে পারেন। তাকে বলেছিলাম এ বিষয়ে তার আইন সচিবকে জিজ্ঞাসা করা ভালো হবে কারণ বিষয়টা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে আনা হয়েছিল। এই ধরণের অসংখ্য ঘটনা ঘটে ছিল আদালতে।
সাধারণত আমি আইনজীবীদের অপ্রাসঙ্গিক নথিভুক্তি করবার অনুমতি দেই না আর কোনও বিষয়ে শুনানির সময়ে আইনজীবীদের সময়ক্ষেপণ একদম সহ্য করতে পারি না। আমি সবসময় আদালতের সময় নষ্ট না করে মামলা নিষ্পত্তি নিষ্পত্তি পছন্দ করি কিন্তু কিছু বিচারকের পরিষ্কার সারসংক্ষেপ করা নিবন্ধ তৈরিতে আগ্রহ নেই; বরং তারা যেন আইনজীবীদের সুখী করতে পারলেই আনন্দিত হন এবং অপ্রাসঙ্গিক নথিভুক্তির অনুমতি দেন। একবার যখন আমি বেঞ্চে সভাপতিত্ব করছিলাম, দেখেছি যে একজন আইনজীবী অপ্রাসঙ্গিক নথি জমা দেন এবং মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিয়া আইনজীবীর জমা দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলাপ দীর্ঘায়িত করার জন্য তা নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।
কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আমি হস্তক্ষেপ করলাম আর মামলার সাথে সম্পর্কিত আইন বিষয়ে প্রশ্ন উত্তর দিতে আইনজীবীকে আদেশ দিলাম। হঠাৎ বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া আদালত প্রাঙ্গণে চিৎকার করে ওঠেন, “আমি তাকে সহ্য করতে পারিনা আর তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সুযোগ দিচ্ছি না। আমি সবসময় তাকে দমিয়ে রাখি” এই ধরণের অনেক কথা বলছিলেন। প্রকৃতিগত ভাবেই, ওয়াহাব মিয়ার কণ্ঠ ছিল খুব উচ্চকিত। যখন তিনি কারো সাথে কথা বলেন তখন সাধারণ কেউ মনে করতে পারে যে তিনি ঝগড়া করছেন। যখনই বিচারপতি কোন শুনানির সময় কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, তখন অধস্তন বিচারকগণ কথা বলা বন্ধ করে দেন, এটা আদালতের চিরাচরিত প্রথা। সুতরাং, এভাবেই আদালতের ডেকোরাম রক্ষিত হয়। এটি এমন এক ঐতিহ্য যা শত শত বর্ষ ধরে অনুশীলন করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, মুক্ত আদালতে আবদুল ওয়াহাব মিয়ার দুর্ব্যবহারের কারণে বিব্রত বোধ করলাম। আমি আদালতে থেকে সরাসরি এসেছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই সব বিচারকগণ আমাকে অনুসরণ করছিলেন। চেম্বারে প্রবেশের পর, অন্য বিচারকদের সামনে হাতজোড় করে আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে অনুরোধ করলাম, “সব নিয়মকানুন ভঙ্গ করে খোলা আদালতে কোন ধরণের বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন না” এটি বারে ভুল বার্তা পাঠাবে আরও যোগ করলাম “যদি কোন ভুল করে থাকি তবে শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা করি। দয়া করে শান্ত হোন এবং আজকের কার্যদিবসে থাকা কাজ শেষ করতে আদালতে বসুন।” বিচারকদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা আর বিচারের স্বার্থে আমি পরিস্থিতি শান্ত করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও তা আমাদের বিচার কাজকে প্রভাবিত করা উচিত না।
ওই সময়টাতে, আমি প্রশাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মত যথেষ্ট সৌভাগ্যবান ছিলাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনি দিকগুলোতে আমার দ্রুত উপলব্ধির জন্য সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলাম এবং সেই অনুযায়ী নীতিগত বিষয়গুলিতে প্রধান বিচারপতিকে পাশ কাটিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।



নাজিম উদ্দিন
অধ্যায় সাত

বিচার বিভাগীয় সার্ভিস কমিশন


মোঃ মোজাম্মেল হোসেন  আমার জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আমি বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেলাম। বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কার্যালয়ের কিছু রুম নিয়ে বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের কাজ শুরু হয়। সেখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বসার জন্য জায়গার খুব সংকট ছিল। তাই কমিশনের কর্মকর্তাদের বসার স্থান সংকুলানের জন্য দেরী না করে আমি প্রশিক্ষণ কার্যালয়ের ওপরে আরো তিনতলা বানানোর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমি জানতাম সরকারি কাজ ধীরগতিতে চলে, কিন্তু আমার হাতে প্রকল্প শেষ করার জন্য খুব কম সময় ছিল, আশংকা ছিল তাড়াতাড়ি না করলে ভেস্তে যেতে পারে। তবে আমার একটা সুবিধা ছিল তখনকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব  ফজলে কবীর, একজন সজ্জন, অমায়িক ভদ্র বুদ্ধিমান মানুষ, তিনিও কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। একসময় তিনি নিজে বলেছেন, আমাকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিনেন ও আমার একজন গুণমুগ্ধ। আমি তাঁকে বললাম তিনি যদি আমাকে সমর্থন না দেন তাহলে আমার পক্ষে কমিশনের উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে না। আমার কথা শুনে তিনি নিজে থেকে আমার দিকে সাহায্যের হার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, যখনই কোন উন্নয়ন প্রয়োজন হবে তখন তিনি ফান্ড সরবরাহ করবেন।
আমার সেক্রেটারি ফরিদ আহমেদ সিবলি একজন চৌকস  কর্মকর্তা, তাকে দ্রুত ভবনের সম্প্রসারণের জন্য ড্রয়িং এবং অন্যান্য কাগজ-পত্র তৈরি করার নির্দেশ দিলাম। অন্যান্য অফিসারদের সাথে তার ভাল সম্পর্ক থাকায় ভবনের সম্প্রসারণের কাজ খুব দ্রুত শেষ হয়েছিল। তারপর আমি অর্থসচিবকে প্রয়োজনীয় ফান্ডের তাগাদা দিলাম। ফান্ড পাওয়ার পরে পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে আমি একজন কর্মকর্তাকে উন্নয়ন কাজ তদারকির জন্য নিয়োগ দিলাম। ইতোমধ্যে পুরাতন কিছু কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করে কমিশনে কিছু চৌকস কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হল। কর্মকর্তাদের ছাড়াও প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের সাথেও আমি কথা বলতাম। এক সময় আমি লক্ষ করলাম, ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় বছর শেষে ফান্ডের বাকি টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত দেয়া হয়েছে। এতে আমি খুব বিরক্ত হলাম কারন সরকারি টাকা ফেরত আনতে অনেক সময় লাগবে। আমি ঠিকাদারকে কাজ চালিয়ে যেতে বললাম, অর্থনৈতিক ব্যাপারটা আমি দেখব। আমার মনে কাজ শেষ করা নিয়ে আমার ক্রমাগত চাপ দেয়া দেখে ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যায়।
আমি অফিসকে ঠিকাদারের সিকিউরিটির টাকা বাজেয়াপ্ত করতে বললাম এবং অবিলম্বে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের নির্দেশ দিলাম। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয় কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমির কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফান্ড আসতে দেরি হচ্ছিল। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেই, যার ফলে দু’বছরের মাথায় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়।
আমি নিজে মেঝের টাইলস থেকে শুরু করে টয়লেট এবং ফার্নিচারের সবগুলো আইটেম বাছাই করে কিনি। সার্ভিস কমিশনে আমি একটি সভাকক্ষ, দু’টি মৌখিক পরীক্ষার কক্ষ, একটি লাইব্রেরি, অভ্যর্থনা কক্ষ এবং সবার ওপর তলায় আরেকটি সভাকক্ষের ব্যবস্থা রাখি। প্রথমদিকে সাধারণ গ্রিল এবং জানালা দিয়ে  মিলনায়তন তৈরি হচ্ছিল। আমি তাদের বললাম মিলনায়তনের পুরো দেয়াল রঙিন কাচের তৈরি হবে, বিদেশে যেমন হয়। ঠিকাদার এবং প্রকৌশলী দু’জনেই আমার কথা শুনে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু আমি তাদের বললাম যাতে মিলনায়তন থেকে ঢাকা শহরের সৌন্দর্য দেখা যায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা আমার কথা মেনে নিল। এখন এটি ঢাকা শহরে ভালভাবে তৈরি সুন্দর মিলনায়তনগুলোর অন্যতম। কমিশনে যখনই বিদেশী অতিথিরা আসেন তাদেরকে এ মিলনায়তনে আপ্যায়ন করা হয়। তারা সবাই এর স্থাপত্য এবং অাভন্তরীণ ডিজাইনের প্রশংসা করেন। এমনকী মেঝে এতো সুন্দরভাবে সাজানো যে তারা বলেন এটি ঢাকা শহরে তাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর ভবন। আমি সেখানে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ দিয়ে একটি আধুনিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করি, গ্রন্থাগারের মাঝে তিনটি কম্পিউটার স্থাপন করি যাতে ডিজিটালভাবে সারা দুনিয়ার অন্যান্য গ্রন্থাগারের সাহায্য নেয়া যায়। গ্রন্থাগারটি দেখাশোনার জন্য আমি একজন যোগ্য গ্রন্থাগারিককে নিয়োগ দিই।
মৌখিক পরীক্ষার কক্ষ দুটি বছরে মাত্র ১০-১৫ দিন ছাড়া তেমন ব্যবহার করা হয় না, অনেক সময় আরো বেশি সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। আমি অফিসকে বললাম, কক্ষ দুটোকে এমনভাবে সাজাতে যাতে সেগুলোকে সালিশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রত্যেকবার সালিশে বসার জন্য ৬০০০ হাজার টাকা ফি ধার্য করলাম। গ্রন্থাগার এবং সালিশ কেন্দ্র চালু হবার পরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা যারা সালিশি করতেন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন তাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা হয়ে পড়ল। আমি অন্যান্য ব্যক্তি মালিকানাধীন সালিশ কেন্দ্রের চেয়ে ভাড়া কিছুটা কম রাখলাম। সেখানে দুই শিফটে সালিশির কাজ চলত এবং  এর থেকে পাওয়া টাকা সরকারি ফান্ডে যোগ হত। বলতে গেলে সালিশ কেন্দ্র থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে কমিশনের খরচ মেটানো সম্ভব। এছাড়া আমি কমিশনে একটি মহাফেজখানা, ব্যায়ামাগার এবং দু’জন অতিথি থাকবার ব্যবস্থা করি। তখন আমার মাথায় ছিল দেশের বাইরে সব জায়গায় বিচার বিভাগে বিচারক অতিথিদের থাকার জন্য একটা বাড়ি থাকে। ভারতের সকল রাজ্যে বিচারকদের জন্য আলাদা গেস্ট হাউজ আছে। তাই যখন কোন বিচারক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসতে চান, প্রধান বিচারপতিকে তখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অতিথিকে কোন পাঁচ তারকা হোটেলে রাখার বন্দোবস্ত করতে তাঁকে তখন বাধ্য হয়ে আইনমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দারস্থ হতে হয়। কিন্তু কমিশনে স্যুইট চালু হবার পরে ভারত বা অন্যদেশ থেকে আসা বিচারকদের সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা গেছে। যেহেতু বিচারকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় থাকার ব্যবস্থা করার জন্য প্রধান বিচারপতিকে বলেন, তাঁকে সব সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত। এখন এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমি প্রধান বিচারপতি হবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কমপ্লেক্সের এক নম্বর বাসাকে পূননির্মাণ করে সেটিকে অতিথিশালা হিসেবে নির্ধারিত করি। যার ফলে সুপ্রিম কোর্টে এখন আন্তর্জাতিক মানের অতিথিশালা আছে।
এক সময় আমি দেখলাম বিচার বিভাগের সকল পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, আমি তখন আমার সকল কর্মকর্তাদেরকে এটা বন্ধ করার উপায় খুঁজতে বললাম। দুজন কর্মকর্তাকে একাজের দায়িত্ব দিলাম এবং কমিশনকে অনলাইনে আবেদনপত্র গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললাম। তখনকার নিয়মানুযায়ী যখনই কোন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হত তখন আবেদনকারীকে কেবলমাত্র সোনালী ব্যাংকের কিছু নির্দিষ্ট শাখা থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হত। তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল বা বিদেশে অবস্থানরত আবেদনকারীকে অনেক দূর ভ্রমণ করে আবেদন পত্র সংগ্রহ করতে হত। কমিশনের পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য বিদেশীরা কীভাবে করে তা জানতে আমি ভারত, যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেছি। আমাদের পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে আমি স্কটল্যান্ডের বিচার বিভাগের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের কাছ থেকে সেরকম প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করারা জন্য  আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতি মোট তিনধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে শতকরা ষাট ভাগ পরীক্ষার্থীকে বাদ দেয়া হয়।  ৫০০০ থেকে ৮০০০ প্রার্থীর মধ্য থেকে মাত্র ১০০ জন বা তারও কমসংখ্যক প্রার্থীকে বাছাই করা হয়। এটি খুবই জটিল কাজ। দু’জন পরীক্ষককে প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য বলা হয়, তারপর সেটা তৃতীয় আরেকজন চুড়ান্ত করেন। আমি সিদ্ধান্ত নিই, যে পদ্ধতি আছে তা চালু থাকবে কিন্তু চুড়ান্ত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষকবৃন্দ বা মডারেটর কারো প্রশ্ন থাকবে না। আমার সেক্রেটারির সাথে বসে প্রশ্ন চুড়ান্ত করতাম, প্রশ্নগুলোকে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে এমনভাবে করে দিতাম যাতে পরীক্ষকরা ভেবে পেতেন না প্রশ্ন কীভাবে এতোটা পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে তাদের পরীক্ষা পদ্ধতির মানোন্নয়নে আমাদের সাহায্য চেয়েছিল।
আমাদের সমস্যা হল কিছু আইন আছে আমরা যার বাইরে যেতে পারি না। আইনের বিধিমালায় পরীক্ষার সিলেবাস নিয়ন্ত্রিত। ফলে পরীক্ষকদের অনেক প্রশ্ন পুনঃপুন করতে হতো। বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনের সভায় আমরা অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন সচিবকে প্রশ্ন প্রণয়নের নিয়ম পরিবর্তন করে সেটা কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। প্রত্যেক সভায় আইন সচিব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবেন বলেন কিন্তু আমরা আশানুরূপ কোন ফল পাই নি। সভায় জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হয়নি। একসময় আমি আইন সচিবের কাছে এ বিষয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলাম। তাঁর জবাব শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। তাঁর জবাব ছিল, যদি বিএনপি-জামাতের কোন ব্যক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বসেন তাহলে তিনি এমনভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা অবহেলিত হবে। আমি তাঁকে বললাম, একই ঘটনা সরকারি কর্ম-কমিশনেও ঘটতে পারে। তাছাড়া তিনি যদি আইন পাল্টাতে পারেন তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে তারা পারবে না কেন?
আসল ঘটনা হল আইন সচিব বিচার বিভাগীয় কর্ম কমিশনকে অকার্যকর করে রাখলেন। একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা মনে আসছে। আইন অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে পরবর্তী বছরে নিয়োগের জন্য মোট প্রার্থীর চাহিদাপত্র দাখিল করবে। সম্ভবত ২০১৩ একাডেমিক সালে বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগের জন্য কোন চাহিদাপত্র দেয়া হয়নি। এপ্রিল মাসের কোন এক সময়ে তিনি আমাদের ২৪ জন প্রার্থী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেন। এদিকে আমাদের বিবেচনায় শতাধিক প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া দরকার ছিল। আমি আইন সচিবকে দেখানোর জন্য ১৫০ টি সম্ভাব্য খালি পদের তালিকা নিয়ে একজন কর্মকর্তাকে পাঠালাম। আমাদের যুক্তি ও ন্যায্যতায় তার কানের মাছিও নড়ল না। তিনি চাহিদাপত্রে কোন পরিবর্তন আনলেন না। আমরা ভাবলাম পরীক্ষা পদ্ধতি যেহেতু অনেক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার এবং মাত্র ২৪ জন্য প্রার্থীর জন্য এতো সময় ও শক্তি খরচ করার কোন মানে হয় না। কিন্তু আমরা আইন সচিবের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারলাম না। এক সময় তিনি বললেন, চাহিদাপত্র পরিবর্তন করলে তাকে জেলে যেতে হবে। আমি তাকে অবসরে যাওয়ার তালিকায় যেসব কর্মকর্তা আছেন তাদের দেখালাম এবং বললাম মাত্র দশ মিনিটে এ হিসাব করা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত আমরা তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যার ফলে তিনি ১৫০ টি ফাঁকা পদ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৫৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছিলেন।
পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই দীর্ঘ এবং এতে প্রায় এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে যায়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের পরে মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে ছয় মাস সময় লেগে যায়। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে  আমরা এমন স্থবির প্রক্রিয়ার খারাপ ফল ভোগ করি। তখন সারাদেশে সহকারি বিচারকের তীব্র সংকট চলছিল। একজন কর্মকর্তা নিয়োগ পাবার পরে দু’এক বছরে পুরোপুরি বিচারক হয়ে ওঠতে পারেন না। তার প্রশিক্ষণের দরকার হয়, তাকে নিয়োগের দু’বছরের মধ্যে বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। একজন প্রাজ্ঞ বিচারক হয়ে ওঠতে একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রায় ছয়-সাত বছর সময় লাগে। যার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে আদালতের স্বল্পতার কারণে মামলা-মোকদ্দমার সাথে জড়িত মানুষেরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন। যথাসময়ে নিয়োগে গাফিলতির কারণে ২০১৬ সালে কমিশনের চেয়ারম্যান ১০০ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেন কিন্তু তাঁকে ৩০০ জনের ফলাফল প্রকাশ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। কোন একটা ব্যাচে একসাথে একশো’র বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার অনেক সমস্যা আছে, কারণ নিয়োগের পরে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে একই ব্যাচের কেউ অতিরিক্ত জেলা জজের পদে পদোন্নতি পাবেন অপরদিকে তার সহকর্মীরা সিনিয়র সহকারি জজ হিসেবে পড়ে থাকবেন এটা তাদের জন্য বিব্রতকর।
পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আমি অনেক পরিবর্তন এনেছিলাম। আবেদন পত্র দাখিলের প্রথমেই প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে একটি গোপন কোড দিয়ে শনাক্ত করা এবং কমিশনের একজন বিশ্বস্ত সদস্য সে কোডের মানে বলতে পারবেন। তারপরে প্রাথমিক পর্যায়ের বাছাইয়ের মত করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রত্যেক বিষয়ে তিনজন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষকের দ্বারা প্রশ্ন তৈরি করে সেগুলো মডারেটর এবং চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হত, তারা সেগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পরিবর্তিত করে চুড়ান্ত রূপ দেন যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পুনঃপুন একই প্রশ্ন করা প্রতিরোধ করা যায়। আমরা আবিষ্কার করলাম বেশিরভাগ প্রশ্নপত্র বিজি প্রেস থেকে ফাঁস হয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু প্রশ্নপত্র নয় উত্তরপত্রও কমিশন নিজেরাই প্রস্তুত করবে যদিও কমিশনের যথেষ্ট লোকবল ছিল না। তা সত্ত্বেও আমরা তিনটি প্রিন্টিং মেশিন কিনলাম এবং তারপর থেকে সকল প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র আমরা নিজেরাই ছাপাতে লাগলাম, কমিশন স্বাবলম্বী হল। আমি কমিশন ছাড়ার সময় এটি একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরীক্ষা পদ্ধতি এতটা সুচারু হয়েছিল যে স্বয়ং পরিচালক চাইলেও তার পক্ষে কোন প্রার্থীকে পাশ করানো সম্ভব ছিল না। আমাদের নতুন পদ্ধতির স্বচ্ছতা বুঝাতে আমরা একটি ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করেছিলাম। ভিডিও দেখে দিল্লীর বিচার বিভাগীয় কমিশনের পরিচালক আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন দিল্লিতে পরবর্তী পরীক্ষার সময় তিনি অনুরূপ ব্যবস্থা চালু করবেন।
কমিশনের পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়া বুঝতে আমি নানা দেশভ্রমণ করেছি যেটা আমি আগেই বলেছি। ভারতে থাকাকালীন সময়ে আমি সেখানকার প্রধান বিচারক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সাথে সাক্ষাত করি এবং অফিসিয়াল সভায় তাদের সাথে মত বিনিময় করি। সভায় আমাদের হাই কমিশনারও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আমি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের জন্য ভারতের ভোপালে অবস্থিত জাতীয় জুডিশিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য সহযোগিতা চাই। প্রধান বিচারক আলতামাস কবির আমাকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার নিশ্চয়তা দেন, তিনি আরো জানান পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল এবং ভুটানের বিচারকেরা ইতোমধ্যে সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিচারকদের প্রথম ব্যাচ সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যান।
ইন্দোনেশিয়াতে আমি প্রধান বিচারক এবং বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশনের পরিচালকের সাথে সাক্ষাতের সময় আমি জানতে পারলাম তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশ করা আইনের মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করে তাদের বিচারক বানানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার একে বলেন ‘গ্রিন হার্ভেস্টিং’। একই প্রক্রিয়া সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও অনুসরণ করা হয়। আইন কর্মকর্তা হিসেবে সবচেয়ে ভাল ছাত্রগুলোকে নির্বাচিত করা হয়, তারপরের দিকের ভাল ছাত্রেরা পাবলিক কৌশলী হিসেবে নিয়োগ পায় আর তালিকার শেষের দিকে যারা থাকে তারা আদালতে উকিলের কাজ করে। আমি বিদেশের এটর্নি জেনারেলদের সাথেও কথা বলেছি যাদের পদমর্যাদা একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান। ইন্দোনেশিয়াতে আমি বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কার্যালয়ে গিয়েছি সেখানে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দেখেছি। সেখানকার কমিশনের পরিচালক ভদ্রমহিলার অনুরোধে উভয় প্রশিক্ষণ সূচিতে আমার কিছু কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি তাদেরকে আমাদের বিচার বিভাগ এবং আদালত পরিচালনার শক্ত, বুনিয়াদি উত্তরাধিকারের কথা বললাম। যুক্তরাজ্য এবং স্কটল্যান্ডে নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। সেখানে কমিশনের পরিচালক থাকেন একজন সাধারণ নাগরিক, অন্যান্য সদস্যরা হলেন উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের ব্যবহারিক জ্ঞান আছে এমন বিভিন্ন দল ও মতের অনুসারী মানুষ। এমনকী সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকও প্রার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে যাচাই করে নির্বাচন করা হয়। ইংল্যান্ডে এমনকী একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের জন্য সর্বনিম্ন যোগ্যতা ব্যারিস্টার হিসেবে কমপক্ষে দশ বছরের অভিজ্ঞতা।






চলবে…
=============
নাজিম উদ্দিন
অধ্যায় ৮

দাতব্য কাজ

বঙ্গবন্ধুর হত্যার আবেদন নিষ্পত্তি করার পর, আমি আমার দ্বিতীয় চেকআপের জন্য নিউইয়র্কে এসেছিলাম এবং সিঙ্গাপুরে আমার চিকিত্সা সঠিক ছিল এবং আবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে সিঙ্গাপুরে পরামর্শদাতা ব্যতীত অন্য কোনও অ্যানালোলজিস্টের সাথে আমার পরামর্শের প্রয়োজন নেই। এটি সত্যিই একটি জরুরী ত্রাণ এবং একটি জীবন হুমকি রোগ থেকে যন্ত্রণা অপসারণ। বিচার ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়ার জন্য আমি নতুন শক্তির সাথে উত্সাহিত হয়েছিলাম এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, যদি আমি একটি জীবন বিপদজনক রোগ অতিক্রম করতে পারি, আমি বিচার বিভাগে উদ্ভাবনী পরিবর্তন করার চেষ্টা করব। নিউইয়র্ক থেকে আমি আমার ছোট ভাই ড। আনতা কুমার সিনহাকে দেখা করতে বস্টন গিয়েছিলাম এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছু বই কেনার চিন্তা করছিলাম। আমার ভাই আমাকে দেখতে পেরে খুশি হল এবং আমার চিকিত্সার জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলাম। আমি তাদের কাছে সোনালী ব্যাংক, সুপ্রীম কোর্ট শাখার সাথে পরিচালিত আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বললাম।
আমি মনে করি যেহেতু আমি জীবনে দ্বিতীয় শট পেয়েছি তাই আমাকে দাতব্য উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যবহার করতে হবে এবং দাতব্যটি আমার পিতামাতার মেমরির জন্য উৎসর্গ করা হলে এটি সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। আমি “ললিত মোহন ও ধনবতী ট্রাস্ট” নিবন্ধিত এবং দাতব্য নামে একটি নির্দিষ্ট আমানত অ্যাকাউন্ট খুলি এবং সুদ থেকে খরচ পূরণের লক্ষ্যে এটি পঁচিশ লক্ষ টাকা রাখি, নির্দিষ্ট শর্তে যে কোন ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আমানত টাকা প্রত্যাহার করা হবে। আমার শ্বশুর ডা। নন্দ কিশোর সিনাহ এবং কিছু গ্রামবাসী সাহায্যে আমরা আমার বাবার স্মৃতিতে একটি গ্রন্থাগার ‘ললিত মোহন গনগরনগর’ (পাবলিক লাইব্রেরি) খুলে দিয়েছিলাম। ট্রাস্ট আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে লাইব্রেরীর দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং স্থায়ী গ্রন্থাগারের নিযুক্ত হন। এক পর্যায়ে, আমি লাইব্রেরির জন্য প্রায় 30 লাখ টাকার বই কিনেছিলাম।
লাইব্রেরী আমার বাইরের ঘরে এবং অন্য ঘরে একটি রুমে শুরু হয়
স্থানীয় ছেলেদের এবং মেয়েদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং কম্পিউটারে পাসপোর্টে ডিপ্লোমা প্রদানের জন্য প্রায় 15 টি কম্পিউটার সহ একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু হয়। আমি প্রশিক্ষণের জন্য দুই স্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলাম এবং কেন্দ্রটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাথে নিবন্ধিত হয়েছিল যাতে ছাত্ররা প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরে সার্টিফিকেটটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। ছাত্ররা তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স চলছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ শিক্ষার্থী সারা বছর ধরে প্রশিক্ষিত। বই সংখ্যা এবং ম্যানুয়াল সংখ্যা বৃদ্ধি হিসাবে ছাত্র সংখ্যা। অতএব, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বর্তমান অবস্থানে থাকতে পারে না কারণ দুইটি বাইরের ঘর আমার নিরাপত্তা বিস্তারিত দ্বারা দখল করা হয়। তাই, আমি লাইব্রেরী প্রসারিত করার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করার জন্য একটি চার-তলা ভবন নির্মাণের জন্য সাত দশমিক জমির একটি টুকরা আয়োজন করেছি। একটি দুই তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং গ্রাউন্ড মেঝের দুই কক্ষের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাথে প্রথম লাইব্রেরিতে পাঠাগারটি স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্যান্য কক্ষ গ্রন্থাগারের জন্য ব্যবহার করা হয়। আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার রয়েছে, বই, দর্শন, এবং পঞ্চাশ লক্ষ টাকায় মূল্যবান মহান ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস এবং সাহিত্যের আত্মজীবনী বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। আমি এই সময় দাতব্য আমার বই দান করেছেন।
আমাদের এলাকাটি প্রধানত আমাদের সম্প্রদায়ের জনগণের দ্বারা জনবহুল এবং আমার থানার প্রায় চল্লিশ শতাংশ জনসংখ্যা হিন্দু। নদী ও ছোট জলের তীরে হিন্দুদের সমাহিত করা হয়। কোন স্থায়ী বা আধুনিক শ্মশান স্থল পাওয়া যায় না এবং মৃত দেহ কাঠের সাথে সমাহিত করা হয়। বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যার জলে ভেসে যাওয়া এই ধমনীর মাঠগুলি ধুয়ে ফেলা হয়। যেহেতু এটি একটি বৃষ্টি-প্রবণ এলাকা, কখনও কখনও বৃষ্টি দুই দিনের জন্য চলতে থাকে। এ অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় তবে শোকপ্রাপ্ত পরিবারকে বৃষ্টি থামাতে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শুষ্ক কাঠ বৃষ্টি সময় পাওয়া যায় না। একটি শরীরের মোট সমাধি একটি বৃহৎ পরিমাণ কাঠ প্রয়োজন এবং অন্তত সাত থেকে আট ঘন্টা সম্পন্ন করা লাগে। কাঠ এবং বাঁশ ব্যবহার গভীর পরিবেশগত হ্রাস ঘটায়। সমস্যাগুলি দূর করার জন্য, আমি ধলাই নদীর কাছে প্রায় পঁচিশ দশমিকর জমি কিনেছিলাম, সুরক্ষার জন্য একটি সীমানা প্রাচীর গড়ে তুললাম, একটি আধা-গভীর নলকূপ স্থাপন করলাম, ভূমির চারপাশে গাছ লাগিয়েছিলাম এবং একটি আধুনিক সমাধি স্থল নির্মাণ শুরু করেছিলাম। আমি ইতোমধ্যে প্রায় 30 লাখ টাকায় ব্যয় করেছি এবং এটি আরও পঞ্চাশ লাখ টাকার বেশি পরিমাণের প্রয়োজন হবে। আমি আমার পেনশন বেনিফিট থেকে কাজটি সম্পন্ন করতে প্রত্যাশিত ছিলাম কিন্তু সরকার যে কারণে আমাকে চিনতে পারেনি তার কারণে আমার পেনশন তহবিল দেওয়া হয়নি যদিও পদত্যাগের পরেই পদত্যাগ করেছেন বিচারপতি মো। আবদুল ওয়াহাব মিয়া। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে, মৌলভীবাজার জেলার সকল মৃতদেহকে অল্প সময়ের মধ্যে বিনা খরচে সমাহিত করা যেতে পারে। আমাদের এলাকা যোগাযোগের মধ্যে এবং দূরবর্তী এলাকা থেকে একটি মৃত শরীর বহন করা হয় কমই ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট সময় নিতে হবে।
আমাদের এলাকায় প্রধানত আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজন জনবহুল এবং আমার থানা প্রায় চল্লিশ শতাংশ জনসংখ্যা হিন্দু। নদী ও ছোট জলের তীরে হিন্দুদের সমাহিত করা হয়। কোন স্থায়ী বা সাম্প্রতিক cremation স্থল পাওয়া যায় এবং মৃত দেহ কাঠের সঙ্গে সমাহিত করা হয়। বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যার জল ভেসে যাওয়া এই ধমনী মাঠ ধুয়ে ফেলা হয়। যেহেতু এটি একটি বৃষ্টি-প্রবণ এলাকা, কখনও কখনও বৃষ্টি দুই দিনের জন্য চলতে থাকে। এ অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় তবে শোকপ্রাপ্ত পরিবারকে বৃষ্টি থামাতে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শুষ্ক কাঠ বৃষ্টি সময় পাওয়া যায় না। একটি শরীর মোট সমাধি একটি বৃহৎ পরিমাণ কাঠ প্রয়োজন এবং অন্তত সাত থেকে আট ঘন্টা সম্পন্ন করা। কাঠ এবং বাঁশ ব্যবহার গভীর পরিবেশগত হ্রাস ঘটায়। সমস্যাগুলি দূর করার জন্য, আমি ধলাই নদী প্রায় পঁচিশ দশমিকর জমি কিনেছি, সুরক্ষার জন্য একটি সীমানা প্রাচীর গড়ে তুললাম, একটি অর্ধ-গভীর নলকূপ স্থাপন করা, ভূমির চারপাশে গাছ লাগিয়েছি এবং একটি আধুনিক সমাধি স্থল নির্মাণ শুরু করেছি। আমি ইতোমধ্যে প্রায় 30 লাখ টাকা ব্যয় করেছি এবং এটি আরও পঞ্চাশ লাখ টাকায় বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হবে। আমি আমার পেনশন বেনিফিট থেকে কাজ শেষ করতে প্রত্যাশিত ছিলাম কিন্তু সরকার যে কারণে আমাকে চিনতে পারেনি তার কারণে আমার পেনশন তহবিল দেওয়া হয়নি তবে পদত্যাগের পরেই পদত্যাগ করেছেন বিচারপতি মো। আবদুল ওয়াহাব মিয়া। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে, মৌলভীবাজার জেলার সকল মৃতদেহকে অল্প সময়ের মধ্যে বিনা খরচে সঞ্চিত করা যেতে পারে। আমাদের এলাকা যোগাযোগের মধ্যে এবং দূরবর্তী এলাকা থেকে একটি মৃত শরীর বহন করা হয় কমপক্ষে তের থেকে চল্লিশ মিনিট সময় নিতে হবে।

************************

অধ্যায় ৯

আইসিটি (ICT) গঠনে ভূমিকা

২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এজেন্ডাগুলির মধ্যে ছিল, যদি দলটি ক্ষমতায় আসে তবে সরকার যুদ্ধাপরাধের অপরাধী, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনবে। শেষমেশ, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছিল আর তার নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায়, পুরোনো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে চেয়েছিল। শফিক আহমেদ, বিচারপতি আব্দুর রশিদ এবং আমি এই বিষয়ে কাজ করছিলাম, কারণ শফিক আহমেদ প্রসিকিউটর ও বিচারকদের নির্বাচন করবার জন্য আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী রানা দাস গুপ্তকে ট্রাইব্যুনালে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ আমি দিয়েছি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসাবে মোঃ নিজামুল হককে নির্বাচিত করা হয়েছিল কারণ তিনি যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের বিচারমূলক প্রতীকী বিচার পদ্ধতি “গন-আদালত” (জনগণের আদালত) প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।
সবুজ সংকেত পাওয়ার পর, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রানা দাস গুপ্তকে ঢাকায় আসতে বললাম। আমি তাকে আব্দুর রশিদের বাসায় নিয়ে গেলাম এবং আমাদের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হল। রানা দাস গুপ্ত চট্টগ্রামে তার বিপুল পসার জমা লাভজনক প্র্যাকটিস ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তার পেশা উৎসর্গ করার জন্য আমরা তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের প্রস্তাব সম্মত হলেন। এটা আইনমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল। তারপর, অজ্ঞাত কোন কারণে আমরা জানতে পাই যে ট্রাইব্যুনালের সম্ভাব্য সদস্য তালিকা থেকে রানা দাস গুপ্তের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। তারপর আমরা তার নাম প্রধান প্রসিকিউটর হিসাবে প্রস্তাব করি। কিন্তু এই কাজে টিপু সুলতানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ আইনমন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যদিও তিনি বয়সে খুবই প্রবীণ ছিলেন। পরবর্তীতে আমি লক্ষ্য করি যে এমনকি প্রসিকিউটর হিসেবেও রানা দাস গুপ্তের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
উল্লেখ্য যে রানা দাস গুপ্তকে এই কাজে সম্মত করার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল আর সে অনুযায়ী আমি ঢাকায় আসার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। নিজামুল হকের সাথে সাথে আরও দুই সদস্য হিসেবে এটিএম ফজলে কবির এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদকে ট্রাইব্যুনালের অংশ হিসেবে মনোনীত করা হয়। রানা দাস গুপ্তের বদলে জহির আহমেদ নির্বাচিত হন। এটা যে একটা খারাপ মনোনয়ন সরকার পরে উপলব্ধি করে। কিন্তু ইতিমধ্যে, অনেক শঙ্কার উদ্ভব হয়। ট্রাইব্যুনালের কাজ সঠিকভাবে চলছিল না। মোঃ নিজামুল হক অপ্রত্যাশিত ভাবে দীর্ঘ আদেশ লিখে সময় নষ্ট করেছিলেন – এমনকি সামান্য আবেদন নিষ্পত্তির বেলাতেও। স্বাভাবিকভাবেই, অভিযুক্তরা মামলার বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছিল। ট্রাইব্যুনাল প্রশাসনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হিসেবেই দেখা হয়,  ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা আর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তার যথাযথ জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়।
প্রয়াত আমিনুল হকের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করার প্রেক্ষিতে সাধারণভাবেই নিজামুল হকের কাছে প্রত্যাশা করা হয়, মামলাগুলি পরিচালনায় তিনি পছন্দসই ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হবেন যেহেতু ফৌজদারি আইন বিষয়ে তার ভাল ধারনা ছিল।  সকলেই ভেবেছিলেন যে তিনি একজন ভাল নির্বাচন ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই নির্বাচন নেতিবাচক ফল দেয়। এক বছরের মধ্যে তিনি এমনকি একটি মামলাও শেষ করতে পারেননি। তিনি প্রায় সময়েই আমার পেছনে ধর্না দিতেন, আপিল বিভাগে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আর পরবর্তীতে তিনি আমার কাছে তদবির করতেন প্রধান বিচারপতি, বা অন্তত তার কাছাকাছি একটা পদে উন্নীত হবার আকাঙ্ক্ষা থেকে।
যখনই তিনি দেখা করতে আসতেন তখনই তাকে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে আর কমপক্ষে একটি বা দুটি ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছিলাম। আপিল বিভাগে উন্নীত করার জন্য তার নাম বিবেচনা করা যাবে না যতক্ষণ না তিনি অন্তত একটি মামলা নিষ্পত্তি করছেন। অবশেষে আইনমন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান, যিনি মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ ছিলেন, সেই এয়ার কমোডোর (অবসরপ্রাপ্ত) একে খন্দকার আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে চেয়েছিলেন, কারণ ট্রায়ালটি কাজের গতি খুঁজে পায়নি। যদিও সরকার একটি সংসদীয় সরকারের অধীনে কাজ করছিল, তবে এটি কেবল কাগজে ছিল। এমনকি ১৯৯১ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সরকার গঠন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতেই যেন রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হত। সাংবিধানিক ভাবে সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেয়া হয়, হোক সে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি সরকার। তাই আইনমন্ত্রীর নীতিগত কোন বিষয়ে বিবেচনা ও কাজের জন্য সামান্য ক্ষমতা ছিল। আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব নিয়ে শফিক আহমেদ ও এ কে খন্দকার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাফল্যের আর ফলাফল লাভের সুযোগ ছিল খুব সামান্য। পরে জানতে পেরেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তখন দুই সিনিয়র মন্ত্রী কোন কথা বলেননি আর ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে আসেন।
এরপর শফিক আহমেদ আমাকে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করার ব্যাপারে অনুরোধ করেন। তার মতে, যদি আমি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলি, তবে আমি তাকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হব। বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক ছিলাম কারণ আমি মনে করতাম, একজন বিচারক হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে নির্বাহী বিষয়ে কথা বলা বিধিসম্মত নয়। আমি আইনমন্ত্রীকে বললাম, দুইজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা প্রত্যাখ্যান হবার পর, আমি বিষয়টিতে যুক্ত হতে চাই না, যাতে তিনি আবার প্রত্যাখ্যান করেন, আর তাহলে আমি একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ব। তিনি আবারও বললেন, এটি তার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, তবে ধারণাটি বাস্তবায়িত হতে পারে। শফিক আহমেদ একজন সুন্দর, নম্র ভদ্রলোক। আমরা তাকে যথার্থই একজন ভদ্রলোক হিসেবে বিবেচনা করতাম। তার দৃঢ় বিশ্বাস আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। আমি তাকে বললাম, বিষয়টি নিয়ে আমি আবার চিন্তা করব।
তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, এটা অধিকাংশ মানুষেরই দাবি ছিল যারা জানত, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ কিরকম কষ্ট পেয়েছিল। আমরা ত্রিশ লক্ষ প্রাণ উৎসর্গ করেছি এবং একলক্ষেরও বেশি লোক পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করেছে পরিবর্তীতে যতদিন বেঁচে ছিল আর দু-লক্ষ নারী তাদের সতীত্ব হারিয়েছিল। বিচারকের পাশাপাশি, দেশের নাগরিক হিসাবে, জাতির প্রতি আমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উপলব্ধি করলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশটি যদি মুক্তি না পেত, তাহলে আমি স্কুল শিক্ষক বা বড়জোর উপ-বিভাগীয় আদালতের আইনজীবী হিসেবেই চাকরি জীবন শেষ করতাম। স্বাধীনতা শুধুমাত্র জাতির জন্য একটি পতাকাই দেয়নি, এটি যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনায় নতুন জীবন দিয়েছে যাতে অতীতে যারা দেশকে শাসন করেছে তাদের চেয়ে আরও ভালোভাবে লোকে নেতৃত্ব দিতে পারে। দেশের স্বাধীনতার কারণে আমি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হয়ে উঠি এবং শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে আমি দেশ থেকে আরো ক্ষমতা বা সম্মান পাওয়ার যোগ্য নই। এই যদি আমার বিশ্বাস হয়, তবে প্রধানমন্ত্রীকে আরেকবার প্ররোচিত করার চেষ্টা করা আমার জন্য একটা বাধ্যবাধকতার ব্যাপার ছিল আর আমার প্রচেষ্টায় অনুকূল ফলাফল পাওয়া গেলে, তা আমাদের সাহসী স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মত্যাগের প্রতি একটা বড় সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে। তাই, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই মোতাবেক একটি গোপন জায়গায় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করি। এ বিষয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনুকূল উত্তর পাই। এটা অনুপ্রাণিত করে যে আমি প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হব।
যখন সাক্ষাৎ পেলাম, আমি প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যটি জানালাম। যে মুহূর্তে আমি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলাম, তিনি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তারপর আবেগতাড়িত হয়ে ওঠেন আর পিতামাতা ও ছোট ভাইদের হত্যার বিচার পাওয়ার জন্য যে দুঃখভোগ করেন, তা ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি বললেন সাক্ষী সংগ্রহ ও তাদের সুরক্ষার জন্য কত টাকা ব্যয় করেন এবং বলছিলেন যে মানসিক চাপ সহ্য করেন তা ধারণার বাইরে ছিল। অপরাধীদের বিচারের জন্য তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তিনি মন্ত্রীদের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে স্বীকার করেছিলেন যে ভীষণরকম দুর্নীতি ছিল, অপরাধীদের অর্থ ও পেশীশক্তি ছিল আর তারা যে কোন কর্মকর্তা বা সাক্ষীকে প্রভাবিত করতে পারত এবং প্রশাসনের দ্বারা সর্বদা এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তদুপরি, চল্লিশ বছর সময় চলে গিয়েছিল আর সাক্ষী সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল কারণ তাদের অধিকাংশই এখন আর জীবিত নেই। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্য প্রধানত তিনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন আর এর বেশি কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন না। পনেরো থেকে বিশ মিনিট কথা বলার পরও তিনি অত্যন্ত আবেগতাড়িত ছিলেন আর আমি তার কথা শুনছিলাম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। বুঝতে পারলাম যদি কোনও মন্তব্য করি তবে তিনি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তার মত প্রকাশ সম্পন্ন করার পর খেয়াল করলাম তিনি একটু বিচলিত। আমি তখন সবিনয় নিবেদন শুরু করলাম। তাকে বললাম, তার বাবার হত্যা মামলার বিচারক ছিলাম আর মামলার শুনানির শেষে সবকিছুই জানতাম। বিচারের সময় অনেকগুলি ত্রুটি খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু তার কারণ ছিল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়া।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মামলা তার বাবা-মা হত্যা মামলার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল, আমি ব্যাখ্যা করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মামলাটি সাধারণ আইনের অধীনে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল আর সেটি ছিল একটি অপ্রচলিত আইন, যার জন্য তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু মানবতা বিরোধী অপরাধের বেলায়, বিচার পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিচারকার্য বা সেই উদ্দেশ্যে সরকারকে অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রমাণাদি সংগ্রহের লক্ষে তার বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রমাণ সংগ্রহের মতো এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না। সংক্ষিপ্তভাবে আমি আরও ব্যাখ্যা করলাম মামলার বিচার প্রক্রিয়া, সাক্ষ্য জমা রাখার পদ্ধতি এবং পূর্বের ট্রায়াল থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র প্রমাণাদি সম্পর্কে। নতুন ব্যবস্থার অধীনে, হলফনামা জাতীয় প্রমাণপত্র গ্রহণযোগ্য, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, ভিডিও রিপোর্ট ও ফটোগ্রাফগুলিও গ্রহণযোগ্য হয়, তা কোথা থেকে সংগ্রহ করা না করা, তা কোন ব্যাপার না। বেশিরভাগ প্রমাণই জাতীয় আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে এবং আরও কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের দখল থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। সরকার যদি পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান করে এবং সঠিক ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা হলে তা দ্রুত কার্যকর করা যেতে পারে। আমি তাকে বলেছিলাম যে প্রথম ট্রাইব্যুনাল নির্বাচন সঠিক ছিল না এবং তাতে ত্রুটি ছিল।
সাধারণ ও বিশেষ আইনের অধীনে বিচারের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আমার কথা শোনার পরে, প্রধানমন্ত্রীর আচরণে পরিবর্তন দেখতে পেলাম। তারপর ডায়েরিটি বের করলেন আর জানতে চাইলেন আরেকটি ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কী এবং কিভাবে বিচার প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানো যায়। তাকে বললাম, প্রথমত তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউটর এবং বিচারকদের কাছে ল্যাপটপের মত কিছু দিতে হবে। তারপর প্রসিকিউটর নির্বাচন সম্পর্কে কথা বললাম। তাকে বললাম শুধুমাত্র চারজন প্রসিকিউটর নিয়োগ করতে হবে। যদি আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় তবে তিনি ছয় মাসের মধ্যে ফলাফল পাবেন, আমি বললাম। প্রসিকিউটরদের তালিকা পাঠানো হলে আশ্বস্ত করেন, তিনি তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন এবং দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পদক্ষেপ নেবেন। পরবর্তীতে, পনের দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন।
আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে আইনমন্ত্রীকে জানালাম। তিনি খুব খুশি ছিলেন আর প্রক্রিয়াটি শুরু করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাকে দেয়া পরামর্শ মোতাবেক আইনজীবীদের ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। ইতিমধ্যে, নিজামুল হকের স্কাইপে বিতর্ক প্রকাশ হয়ে যায়। কথোপকথনে আমার নাম তিন থেকে চারবার উল্লেখ করেন। আপিল শুনানি শুরুর সময় আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় বিবাদীদের পক্ষ থেকে। আমি ঘোষণা করলাম যে আমি বিব্রত বোধ করছি না কারণ মামলার বিচারের বিষয়ে নিজামুল হকের সাথে কথা বলিনি বা মামলার যথার্থতা বা বিচার প্রক্রিয়ার কোন বিষয় নিয়েই তার সাথে আলাপ করিনি। যখনই তিনি উচ্চতর বেঞ্চে উন্নীত করার বিষয়ে আমার কাছে আসতেন, তখন বলেছিলাম যে নাম বিবেচনার আগে তাকে কমপক্ষে এক বা দুটি ক্ষেত্রে বিচার সমাপ্ত করতে হবে।
অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, আমি নিজামুল হককে নির্দেশ দিয়েছি এক বা দুই অভিযুক্তকে ফাঁসি দিতে। নিজামুল হক বলেন, ‘আমি সিনহা বাবুকে বলেছিলাম আমাকে আপীল বিভাগে নেবার জন্য, কিন্তু তিনি একটি বা দুটি মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য বলেছিলেন।’ বিবাদী তার বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, আমি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি, এক বা দুইজন অভিযুক্তের বেলায়। তাছাড়া যেহেতু তিনি বিচার শেষ করতে পারেননি, তাই আপিলের শুনানিও শুরু হয়নি বিচারপতি নিজামুল হকের দেয়া কোন রায়ে। আপিল শুনানির বিষয়ে বেঞ্চে বসার জন্য আমার জন্য কোন আইনি বারও ছিল না। সংবাদপত্রে স্কাইপে কথোপকথন প্রকাশের পর নিজামুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর প্রশ্ন ওঠে দুই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানদের নির্বাচন বিষয়ে। আমি ওবায়দুল হাসান ও এম এনায়েতুর রহিমের সাথে কথা বললাম। ওবায়দুল হাসান জানান, তাকে যদি কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে তিনি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু এনায়েতুর রহিম অনিচ্ছুক ছিলেন এই কারণে যে, তার বাবা এমপি ছিলেন এবং তার ভাইও এমপি। যদি তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন, তবে আপত্তি উত্থাপন করা হতে পারে। অবশেষে ফজলে কবির ট্রাইব্যুনালের-১ চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ওবায়দুল হাসানকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান করা হয়। ফজলে কবির অবসর নেওয়ার পর, এনায়েতুর রহিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। দুটি ট্রাইব্যুনাল বসানোর পর মামলার বিচার কিছুটা গতি অর্জন করে। প্রথম বিচারিক রায় দেয়া হয় আব্দুল কাদের মোল্লার ২ নং মামলায়।
তথ্যসূত্র:
১) বাংলাদেশ সংবিধান (XXII) সংশোধনী আইন, 1991
২) ২০১৩ সালের ২4 এবং ২5 নং ফৌজদারি আপীল
চলবে…

নাজিম উদ্দিন

অধ্যায় ১০

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ

বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন এর অবসরে যাবার তিন মাস আগে থেকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অনেক কানাঘুষা চলছিল। শামসুদ্দিন চৌধুরী পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হবার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এছাড়া সম্ভাব্য প্রধান বিচারকের পদে দেশের মুন্সেফ আদালতের প্রথম নারী জজ, জেলা জজ, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানার নামও শোনা যাচ্ছিল।  নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতি হলে তাঁর অবসরের পরে আমার প্রধান বিচারপতি হবার সম্ভাবনা থাকে। তার উপর দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্পীকার নারী হওয়ায়, প্রধানমন্ত্রী চাইলে সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারতেন যে বাংলাদেশে সরকারের তিনটি শাখার প্রধান নারী। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হতে পারত, কারণ গোটা দুনিয়ায় এমন কোন নজির ছিল না।  শামসুদ্দিন চৌধুরী তাকে নিয়োগের জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করছিলেন। তাঁকে নিয়োগ দেয়া হলেও আমার প্রধান বিচারপতি হবার সুযোগ থেকে যায়, কারণ তার অবসরের সময় নাজমুন আরা সুলতানারও আগে ছিল।
এদিকে এসব গুজবে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।। যদিও তিনি জানতেন যে তাঁকে এ পদের জন্য নির্বাচিত করা হবে না, কিন্তু তাঁর ভয় ছিল বাকি যে দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে তারা দুজনেই তার বয়োকনিষ্ঠ, সেক্ষেত্রে তাঁর জন্য পদত্যাগ ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে না। কিন্তু আমাকে নিয়োগ দেয়া হলে তিনি ৩১ জানুয়ারী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন।  সেজন্য তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন যাতে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য নীতি নির্ধারকদের বলে কয়ে আমার বয়োজ্যেষ্ঠতা টিকিয়ে রাখি। আমি তাঁকে বললাম, আমি জানি না আমাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হবে কি না, কিন্তু আমি জানি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে এ পদের জন্য বিবেচনা কর হবে না কারণ তিনি প্রধান বিচারপতি পদের জন্য মোটেই উপযুক্ত নন। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর ভাল-মন্দ বোঝার মত যোগ্যতা ও পরিপক্কতা আছে। তিনি আদালতের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে বসাবেন না। আমি ওনাকে আরো বললাম, প্রধান বিচারপতি পদে আমার নিজের জন্য সুপারিশ করতে আমি হব সর্বশেষ ব্যক্তি।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, হাইকোর্টে থাকাকালীন সময়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কয়েকবার তার বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয়েছিল তারপরেও তিনি কয়েকবার সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেছিলেন। কোন কারণ ছাড়া আদালত অবমাননার রায় দিয়ে তাদের স্বশরীরে আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালত চলাকালীন তিনি তাদেরকে পুরো সময় দাঁড়িয়ে রাখতেন তারপরে আদালত মুলতবি ঘোষণা করতেন। তার আচরণে সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিল। রীট বেঞ্চে থাকার সময়ে তিনি সাধারণ ফৌজদারি মামলায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন যেটা সাংবিধানিকভাবে তাঁর বেঞ্চে আওতা বহির্ভূত ছিল। তাকে ঠেকাতে এক সময় আমি প্রধান বিচারপতিকে বেঞ্চের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত গত্যন্তর নাই দেখে সরকার তাঁকে আপীল বিভাগে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যাতে করে তিনি সেখান থেকে কোন আদেশ না দিতে পারেন। কারণ আপীল বিভাগে তিনি হবেন সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ সদস্য। ফলে সেখানে তাঁর তেমন কর্তৃত্ব থাকবে না।  তাঁর নিয়োগ নিয়ে খুব মজার একটা গল্প আছে। যদিও প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, তা সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতি কিন্তু তাঁর নাম সুপারিশ করেননি। সংবিধানের নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে শলা-পরামর্শ করে বিচারকদের নিয়োগ দিবেন। রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সাথে সে ধরণের কোন শলা-পরামর্শ ছাড়াই তাঁকে বিচারক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী তখন লণ্ডনে অবস্থান করেছিলেন। টিভির স্ক্রলে তাঁর নিয়োগের খবর দেখিয়েছিল। সরকারের এমন কাজ দেখে প্রধান বিচারপতি আইনুমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম সরিয়ে নিতে  বলেছিলেন। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে চিন্তা না করতে বললাম, এর পরিবর্তে তিনি যেন প্রধান বিচারপতিকে বলেন যে, সরকার সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধনের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা-ভাবনা করছে যাতে করে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের ভোটে পাস করা সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিচারকের অসদাচারণ বা অযোগ্যতা প্রমাণিত হলে তাঁকে  বরখাস্ত করা যায়। আসলেই সেরকম কিছু একটা ঘটতেছিল, সাবেক প্রধান বিচারপতি খাইরুল হক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এম পি ও আরো কিছু সংসদ সদস্য মিলে সংবিধান সংশোধন করে এমন একটা বিধান রাখার ব্যাপারে  গুরুতর ভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন। তখন এটর্নি জেনারেলের অবর্তমানে অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা এটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে জানালেন, প্রধান বিচারপতি যদি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে মেনে নিতে রাজী না হন তাহলে খুবই মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হবে। আমি তাঁকে বললাম এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি এবং মুরাদ রেজা দু’জনেই লণ্ডনে  বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম যাতে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমরা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে পরবর্তী ফ্লাইট পাওয়ামাত্র দেশে ফেরত আসতে বললাম। মুরাদ রেজা এবং আমি মিলে তাঁকে দেশে ফেরার কারণ জানালাম এবং তিনি আমাদেরকে চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। ইতোমধ্যে আমরা খবর পেলাম প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রীর কাছ থেকে সংবিধানের সম্ভাব্য সংশোধনীর কথা শুনে ভীত হয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরীর নিয়োগ নিয়ে তাঁর কোন অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন।
আমি মনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম,  যদি প্রধানমন্ত্রী মুসলিম প্রধান দেশে একজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সদস্যকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে না চান তাহলে  নাজমুন আরা সুলতানা অথবা সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এদের যেকোন একজন প্রধান বিচারপতি হতে যাচ্ছেন। আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে আগ্রহী কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন সদস্যকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফলাফল খুব সাবধানতার সাথে বিবেচনা করে দেখছিলেন। দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ না দেবার কোন কারণ ছিল না। আমি এমন সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম, যদি আমাকে নির্বাচিত না করা হয় তবে আমি সাথে সাথে পদত্যাগ করব। কিন্তু আমি আমার অনুভূতির কথা কাউকে জানাইনি। ইতোমধ্যে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে তিনি আমাকে প্রতি একদিন অন্তর চাপ দিয়ে আসছিলেন, আমি যেন উপর মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলি যাতে করে আমার নাম সুপারিশ করা হয়।  আমি তাঁকে স্পষ্ট বলে দিলাম কোন উঁচু পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সুপারিশ করার জন্য আমি হলাম সর্বশেষ ব্যক্তি। কিন্তু আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, আর যাই হোক শামসুদ্দিন চৌধুরী নিয়োগ পাবেন না।
শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের অবসরে যাবার প্রায় সাত দিন আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমার সাথে গোপন কোন স্থানে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাঁকে আইন বিভাগীয় কর্মকমিশনের সভাকক্ষে আসতে বললাম, এ ধরণের কোন সভার জন্য সেটা ছিল উপযুক্ত জায়গা। কথামত সেদিন বিকেলে আইনমন্ত্রী এসে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানালেন। তিনি আমাকে জানালেন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর নিজের উপস্থিতিতে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আমি ব্যাপারটা গোপন রাখলাম, কিন্তু পরদিন ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে গেল শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। গুজব শুনে আমি  নিজে নিজে হাসলাম; কিন্তু যতই গুজব ছড়াচ্ছিল আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ততই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন।  আমি লক্ষ্য করলাম তিনি বিচারিক প্রশাসনিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। একদিন আমি তাঁকে খুব শক্তভাবে বললাম গুজবে কান না দিয়ে তাঁর কাজে মন দেয়া উচিত। ভাগ্য সহায় থাকলে আমি প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পাব, কিন্তু তাঁকে আশ্বস্ত করলাম যে শামসুদ্দিন চৌধুরীর একজন প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবার মত সুযোগও নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতানুযায়ী প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচিত করবেন ও নিয়োগ দিবেন। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতাই নেই। এটা শুধু তখনকার কথা নয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকেই এমন হয়ে আসছে। ওয়াহাব মিয়া ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে আমার চেম্বার ত্যাগ করলেন। রীতি অনুযায়ী, শপথ গ্রহণের একদিন বা দু’দিন আগে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হল যে আমাকে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি পদে মনোনীত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী জুলাই ১৫, ২০১৫ সালে আমি শপথ গ্রহণ করি। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত, কারণ গোটা দুনিয়াতে কোন মুসলিম প্রধান দেশে একজন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য আগে কখনও এমন উঁচু পদ অলংকৃত করেনি। প্রথা অনুযায়ী শপথ গ্রহণের দিন প্রধান বিচারপতিকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। আমি এর জন্য সকাল সাড়ে দশটায় সময় নির্ধারণ করলাম। এটি ছিল স্মরণীয় একটি ঘটনা।  আমি আরো চাইলাম রাজনৈতিক মত-পার্থক্য ভুলে সকল দলের আইনজীবীরা যাতে সংবর্ধনায় অংশ নিতে পারে, যদিও গত পাঁচ-ছয় টার্মে শুধু সরকারি দলের কিছু আইনজীবী অংশ নিয়েছিলেন। সেবারই প্রথম আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, গনতান্ত্রিক ফোরামের আইনজীবীরা যোগ দিয়েছিলেন। এক নম্বর আদালত কক্ষে তিল ধরার জায়গা ছিল না, অনেক আইনজীবী আদালত ভবনের পশ্চিম ও দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেজন্য আমি রেজিস্ট্রিকে বাড়তি চেয়ারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলাম যাতে সবাই বসতে পারেন এবং স্পীকারের ব্যবস্থা নিতে বললাম যাতে সবাই সভার কথা-বার্তা শুনতে পান। সংবর্ধনার জবাবে আমি আইনজীবীদের বললাম বিচার বিভাগের সংস্কার করাটা আমার অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে। প্রথম যেসব কাজ করব সেগুলো হলঃ
ক) বিচার বিভাগের সংস্কার;
খ) বিচার বিভাগের কাজে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত পূর্ণ সময় ব্যয় করব যেমন, সময় মত আদালতে বসা ও প্রস্থান করা;
গ) বিচার বিভাগকে ডিজিটালকরণ;
ঘ) নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিচার বিভাগ পরিচালনা করা;
ঙ) আদালতে কোন  দোষী বা নির্দোষী ‘মেনশান’ হবে না, কোন বিষয়ে অগ্রীম শুনানির জন্য কোন বরাদ্দ চলবে না, চেম্বারে উপস্থিত বিচারকের তালিকা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা সেদিনের মোকদ্দমার তালিকায় স্থান পাবে;
চ) সুপ্রিম কোর্টের ছুটির দিন হ্রাস করা হবে।
ছ) শুনানির পর থেকে শুরু করে ছয় মাসের মধ্যে দ্রুততার সাথে রায় এবং আদেশে সই করতে হবে;
জ) আদালতে সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় আমার পুর্ববর্তী বিচারকদের সময়ে প্রতিদিন আদালতের দেড় ঘন্টা সময় নষ্ট হত। সেটা হল, যদিও সকাল ৯টায় আদালত বসার কথা কিন্তু সেটা বসত সাড়ে নয়টা বা পৌনে দশটার সময়। তারপরে চা বিরতির পরে সকাল এগারটায় আবার বসার কথা কিন্তু আমরা সাধারণত সাড়ে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটার সময় বসতাম এবং দুপুর সোয়া একটার বদলে একটার সময়ে উঠে পড়তাম। প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন দেশের বাইরে থাকাকালীন সময়ে আমি অনেকবার তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। কিন্তু সে সময় আমি আদালতের সময় পরিবর্তন করতে চাইলে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আমাকে বাধা দিতেন, বলতেন, আমি প্রধান বিচারক হলে তখন আদালতের সময় পরিবর্তন করতে পারব, তার আগে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন যতদিন অবসরে না যাচ্ছেন ততোদিন আগের নিয়মে চলুক। অন্যান্য বিচারকরা চুপ থাকতেন তার মানে তারাও আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গীকে সমর্থন করেন, যার কারণে আমি নির্দিষ্ট সময় স্থির করতে পারিনি। আমি যখন আদালতে বসার সময়সীমা নিয়ে বিস্তারিত বললাম তখন বিচারকরা আমার সাথে সময়মত বসতে বাধ্য হলেন।
আরেকটা সমস্যা ছিল প্রতি রোববারে আদালতে প্রথমবারের মত মামলার শুনানিতে অনেক সময় নষ্ট হত। প্রতিদিন আইনজীবীদের একটা লম্বা লাইন পড়ে যেত। তারা বলত তাদের মামলাগুলো ততো জরুরী নয় সেজন্য তারা প্রধান বিচারপতির নির্দেশ মত চেম্বার জাজের সাথে বিষয়টা মিটমাট করছেন কিন্তু তাদের মামলাগুলো নথিবদ্ধ হয়নি। যখন আমি প্রধান বিচারপতির পাশে বসতাম তখন দেখেছি ে নিয়ে তাঁর অনেক সময় নষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। তখন বড়লোকেরা টাকার বিনিময়ে তাদের মামলাগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতেন এমন দূর্নীতির অভিযোগ ছিল। অনেক সময় কিছু চিহ্নিত মানুষ লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব করতেন, এটা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’।
এসবের অবশ্য কারণ ছিল। আগের প্রধান বিচারপতি বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারকদের সাথে দ্বিতীয় কোন বেঞ্চ গঠন করেননি, তিনি সাত জন বিচারকের সাথে বসে বিভিন্ন মামলার শুনানি শুনতেন। বড় বড় আইনজীবীরা এ নিয়ে হাসাহাসি করতেন, তারা আমাদের কাছে জানতে চাইতেন কেন আমরা দ্বিতীয় আরেকটা বেঞ্চ গঠন করিনি। আমি এতে বিব্রত বোধ করতাম বলতাম এটা সম্পূর্ণ রূপে প্রধান বিচারপতির বিশেষ অধিকার। প্রধান বিচারপতি যখন ১৯৭৩ সালের তথ্য ও যোগাযোগ আইনের অধীনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত দু’তিনটি আপীল আবেদনের সিদ্ধান্ত দিলেন তখন তিনি নাজমুন আরা সুলতানাকে প্রধান করে দ্বিতীয় আরেকটি বেঞ্চ গঠন করলেন। তাঁর দায়িত্বকালীন তিন বছর আট মাস সময়ে প্রধান বিচারপতি আমাকে কখনও স্বাধীন কোন বেঞ্চের দায়িত্ব দেননি। কেবল তিনি বিদেশ থাকাকালীন সময়ে আমি বেঞ্চ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলাম।
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাধারণত যখন নতুন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেন তখন তিনি পুষ্পস্তবক দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান। এমনকী বিদেশী সম্মানিত অতিথি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এদের ভ্রমণের সময় তাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময় প্রথম দিনে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কখনও কোন প্রধান বিচারপতি সম্মান প্রদর্শন করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান নি। তাই সম্বর্ধনা শেষে আমি বিচারকদের বললাম, আমি জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যাব। তাঁরা সবাই আমার সাথে যেতে চাইলেন। এটি ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রধান বিচারপতি এবং তার সহগামী বিচারকদের অভ্যর্থনা জানালেন। গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে আমি অফিসিয়ালি জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করলাম এবং ভিজিটর বইয়ে মন্তব্য লিখলাম। এ ঘটনা গণমাধ্যমে খুব আলোচিত হয়েছিল।
পরদিন আমি দুটি বেঞ্চ গঠন করলাম, একটায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শুধু আমি ছিলাম, আরেকটা পরিচালনার দায়িত্বে বিচারক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া, এবং দুটো আদালত একসাথে কাজ শুরু করেছিল। আমি অফিসে বললাম যেসব মামলা তালিকায় ঊঠেনি সেগুলো সব প্রতিদিনের মামলার তালিকায়  তুলতে যাতে আদালতে আইনজীবীদের দ্বারা প্রাথমিক শুনানীর জন্য সময় নষ্ট না হয়। আমি দায়িত্ব নেবার ছয় মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আবহাওয়া সম্পূর্ণ পালটে গেল এক সময় আমি দেখলাম বিরতির পরে তেমন বেশি আইনজীবীকে দেখা যাচ্ছে না।  আদালতে মামলার আনুষ্ঠানিক আবেদনের দিন আমি প্রায় একশত থেকে একশত বিশটির মত মামলার নিষ্পত্তি করতাম, আর আপীলের দিন আমি বার থেকে পনেরটি আপীল আবেদনের নিষ্পত্তি করতাম। শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মামলার আবেদন খোলা আদালতে আদেশ নিষ্পত্তি হত যেটা সুপ্রিম কোর্টে আগে কখনও হয়নি।  এক থেকে দু’ সপ্তাহের মধ্যে মামলার আদেশ বা রায় হত, কখনো এক বা দু’দিনে সেটা হত। ফলে মক্কেলরা দীর্ঘদিন ধরে আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করার হাত থেকে রেহাই পেল, আইনজীবীরাও এতে খুশি ছিল।
আরেকটা ব্যাপারে আমি কিছুটা উন্নয়ন করতে পেরেছিলাম সেটা হল যে কোন বিষয়ে আইনজীবীদের কালক্ষেপণ করাটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে আমি পয়েন্ট বের করে নিতাম। আমার জেরার মুখে মাঝেমধ্যে আইনজীবীদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হত। পাঁচ থেকে ছয় মিনিটে জটিল সব বিষয়াদির মীমাংসা করে দিতাম। যে কোন মামলার জন্য আমি দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে রাজী ছিলাম না। পূর্বে এসব মামলা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শোনা হত। এর ফলে যেটা হল মামলা নিষ্পত্তির হার শতকরা ষাট ভাগ বেড়ে গেল। এক বছরের মধ্যে এমন হল যে কিছু আইনজীবী তাদের মামলা খারিজ হোক এটা চাইত না, তারা তাদের মামলা তালিকায় তুলতেই অস্বস্তি বোধ করত।
আমি অফিসে বলে দিয়েছি বছর অনুযায়ী মামলাগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতে যাতে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ বা অবৈধ লেনদেন ছাড়া সেগুলো প্রতিদিনের মামলার তালিকায় উঠতে পারে। পুরাতন মামলা নিয়ে আমি কোন আইনজীবীকে হাজির হতে দেখতাম না।  অনেক সময় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সামনের ডেস্কে বসা আইনজীবীকে আপীলের জন্য পিটিশান করতে দিতাম। আদালতে আরেকটা রেওয়াজ ছিল কোন মামলা পরপর তিনটি আদালতে খারিজ হয়ে যাবার পরেও আপীলের আবেদন খারিজ করার সময় লম্বা রায় দেয়া হত। আমি এটা বন্ধ করে দিলাম এবং সংক্ষিপ্ত আদেশে সেগুলো বাতিল করে দিলাম। যে আবেদনের কোন মূল্য নেই সেটা খারিজ করে দেবার জন্য আদালতের সময় নষ্ট করে লম্বা রায় দেবার কোন প্রয়োজন নেই, এবং এ ব্যবস্থা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতেও সহায়ক হয়েছিল।   বিচারকেরাও অপ্রয়োজনীয় কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেলেন। আমি আমার সহকর্মী বিচারকদের সংক্ষিপ্ত আদেশ লিখতে উৎসাহিত করতাম এবং আপীলের জন্য আবেদন মঞ্জুর করার সময় অল্প সময় দিতে বলতাম যাতে করে তারা দ্রুত আদেশে সই করতে পারেন। আমি আগে দেখেছি কিছু আবেদনের আদেশপত্রে তিনি বছরেও সই করা হয়নি, যে সময়ে আপীল আবেদনও নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারত। কাজে কর্মে একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছিল যার ফলে উকিল, মক্কেল, বিচারক সবাই খুশি ছিলেন। কিন্তু বেঞ্চ রিডারদের অনেক বেশি মামলা সামলাতে হত তাই তারা বেশ কাজের চাপে থাকতেন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখে ‘এ গোল্ডেন এইজ’ বইয়ের লেখিকা, নৃতাত্ত্বিক তাহমিনা আনাম নিউইয়র্ক টাইমসের আন্তর্জাতিক ভার্সনে বাংলাদেশে তখন চলমান অবরোধ নিয়ে লিখেছিলেন, “ প্রায় প্রতিদিন পুলিশের সাথে সংঘর্ষ এবং হামলা চলছে, স্কুল-কারখানা বন্ধ, ব্যবসায় মন্দা চলছে, শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াটাও নিরাপদ নয়। এমন খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে মুসলিম প্রধান দেশে একজন হিন্দু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে  সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র নিয়োগ  একটি ছোট আলোকবর্তিকার মত। ”  সে আরো লিখেছিল, “ বিচারপতি সিনহা এরমধ্যে বিচার বিভাগকে আধুনিকায়ন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। শপথ নেবার পরে প্রথম জনসভায় তিনি ঔপনিবেশিক যুগের আইন সংস্কার করে আদালতের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তিনি বিচারবিভাগকেও নিজেদের কাজ কর্মের পর্যালোচনা করে, কঠোর পরিশ্রম ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আরো স্বচ্ছতা আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। বিচারপতি সিনহা যদি আরো দশ বছর আগে আসতেন, যখন বিচার ব্যবস্থা আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে উঠে পড়েছিল… বিচারপতি সিনহা বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুন করার প্রস্তাব করেন এবং আদালতের প্রশাসনিক কাজের আধুনিকায়ন করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রচলন করার আহবান জানান।” সে আরো বলেছিল, “আইন কোন প্রাচীন কৃৎসামগ্রী নয় যে তাক থেকে নামিয়ে সেটার সৌন্দর্য্য, মূল্য ইত্যাদির প্রশংসা করে আবার তাকে তুলে রাখা হবে। তিনি তাঁর আদলতকে সব ধরণের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা করে তুলতে চান। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে উদযাপন করার মত তেমন কোন বিষয় নেই। তাই বলে তাঁর নিয়োগ থেকে এটাও বলা যাবে না যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সাথে যে আচরণ করা হয় তার মৌলিক কোন পরিবর্তন হয়েছে।  বিচার ব্যবস্থাতেও দমনের সংস্কৃতি চালু আছে যেটা খুবই মারাত্মক। তাই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব খুব সহজ কাজ নয়, আমাদের আদালতগুলোর সততা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তাঁর দায়িত্বের অন্তর্গত। সেজন্য বিচারপতি সিনহার নিয়োগকে সর্বরোগ নিরাময়ক ভাবা যাবে না। কিন্তু তিনি যদি উদ্বোধনী বক্তব্যে অটল থাকতে পারেন তবে তিনিই হবেন সেই নেতা। ”
আন্তর্জাতিক আরো যেসব গণমাধ্যমে আমার নিয়োগ নিয়ে প্রশংসাসূচক কথা ছাপা হয়েছে তার মধ্যে  ‘দ্য ইকনমিক্স টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘জেনারেল নলেজ অফ ইন্ডিয়া’, ‘পাকিস্তান ডিফেন্স’, ‘জাগরণ জোস ওফ ইন্ডিয়া’র নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্রিটেইনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ থেকে শুরু করে  আমার আপীল বিভাগে  নিয়োগ, বিচার বিভাগীয় কর্ম-কমিশনের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন এবং বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে পেপার উপস্থাপনা ইত্যাদি বিস্তারিত ছেপেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমার নিয়োগকে প্রশংসা করে ১০০০০ এর বেশি মন্তব্য করা হয়েছে, এসব মন্তব্যে বিচার বিভাগে আমার দায়িত্ব পালনের সময় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল।
পূর্ববর্তী প্রধান বিচারপতির সময়কালে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এবং এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটির কারণে গুরুতর মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় যে তাঁরা একে অপরের সাথে কথা বলতেন না।  বিচারক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া মনে করতেন শামসুদ্দিন চৌধুরী তাঁকে পর্যাপ্ত সম্মান প্রদর্শন করছিলেন না এবং তার কথার মাঝে শামসুদ্দিন চৌধুরী হস্তক্ষেপ করেন। একজন ভাল বিচারক হবার জন্য তাঁর কোন সৌজন্যবোধ নেই, তাঁর মধ্যে ভাল আচার-ব্যবহারের অভাব আছে। শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতামত সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি  আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে হেয় করতেন।  উচ্চ আদালতের কোন বিচারক যখন অবসরে যাবেন তখন তাঁর সম্মানে অন্য বিচারকেরা মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করার একটা রেওয়াজ ছিল। সে রীতি অনুসারে মোজাম্মেল হোসেনের শেষ কর্মদিবসে তার সম্মানে বিদায়ী ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। মোজাম্মেল হোসেন এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী দু’জনে ব্যারিষ্টার হওয়ায় তাদের মধ্যে খুব খাতির ছিল। আমি প্রধান বিচারপতিকে শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার মধ্যেকার ঝামেলা মিটিয়ে তাদের মধ্যে মিটমাট করে দিতে বললাম, কারণ তাদের মধ্যে ঝামেলা থাকলে কাজ করার একটা সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা কষ্টকর হবে। তিনি কথা বলে তাদের মধ্যে মিল-মিশ করে দিলেন।
একদিন সকালে আব্দুল ওয়াহাব মিয়া খুব খারাপ মুডে আমার কাছে এসে বললেন বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে আমাকে বিচারকদের মান-মর্যাদার বিষয়টা দেখা উচিত। আমি তাঁকে বললাম, প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে যেকোন কিছু করতে আমি দ্বিধা করব না, তাঁর কি হয়েছে সেটা বলার জন্য বললাম।  তিনি আমাকে রূঢ়ভাবে বললেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামীকাল আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিবেন সেজন্য আমার অনুমতি নিতে এসেছেন। আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ঠিক কী হয়েছে, কেন তিনি আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমনভাবে ক্ষেপে আছেন?  আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর রাগের কারণ শুনে আমি খুবই বিব্রত বোধ করলাম। আসল ঘটনা ছিল আইনমন্ত্রী এর আগেরদিন কোন এক  সভায় মন্তব্য করেছিলেন যে বিচারকেরা রায় প্রস্তুত ও সই করতে অনেক সময় নিচ্ছেন যার ফলে মক্কেলরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।  আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আইনমন্ত্রীর কথাকে ব্যক্তিগতভাবে নিলেন, কারণ তিনি সব সময় রায় দিতে দেরী করতেন। আমি তাঁকে বললাম, তিনি যেহেতু সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারক তাই তাঁর পক্ষে এমন কিছু করা ঠিক হবে না। কারণ আইনমন্ত্রী কারো নাম উল্লেখ না করে একটি সাধারণ মন্তব্য করেছেন, এখন তিনি যদি তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন তাহলে এটা প্রমাণিত হবে যে তিনিই রায় দিতে দেরী করেন, যেটা আসলে সত্য ছিল; দ্বিতীয়ত, আমি বললাম, বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারক হয়ে তিনি যদি এমনটা করেন তাহলে জুনিয়র বিচারকেরা তাঁর কাছ থেকে কী শিখবে?
আমি তাঁকে বলেছি সামান্য কারণে হাইকোর্টের বিচারকদের আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার ব্যাপারে আমি বিব্রত বোধ করতাম এবং শামসুদ্দিন চৌধুরীর উদাহরণ দিলাম। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বিদায় নিলেন।  এটা স্মরণ করা যেতে পারে একজন বা দুজন বিচারক বাদে বেশির ভাগ বিচারক রায় লিখতে দেরী করতেন। আব্দুল ওয়াহাব মিয়া যখন আপীল বিভাগে উন্নীত হয়েছিলেন তখন আমার নজরে এসেছিল তাঁর কাছে তিন বছরের পুরনো রায় লেখা বাকী ছিল। শামসুদ্দিন চৌধুরীও যখন আপীল বিভাগে আসেন তখন তাঁর ৩০০ এর বেশী রায় বাকি ছিল। কিছু বিচারক ছিলেন তাঁদের অবসরের সময় তাদের কাছে দু’তিন বছরের পুরনো রায় সই না করা অবস্থায় পাওয়া যেত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন যদিও আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে আপীল বিভাগে উন্নীত করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, তিনি সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভর করতে পারতেন না। একটা ঘটনায় আমি তাঁর এ মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলাম। প্রধান বিচারপতি হবার পরে মোজাম্মেল হোসেন বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া শুরু করেন। যখনই কোন নিমন্ত্রণ আসত, সেটা প্রধান বিচারপতির জন্য শোভন কীনা তা নিয়ে তাঁর কোন চিন্তা ছিল না। ইউএনডিপি’র অর্থায়নে তিনি অন্যান্য বিচারকদের সাথে আমেরিকা ও কানাডার মামলা পরিচালনা ও এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি দেখতে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক ছুটিতে  বা  লম্বা কোন ছুটিতে মোজাম্মেল হোসেন বিদেশে এক বা একাধিক ভ্রমণে যেতেন। এক সময় আদালতের ছুটির পূর্বে আমি বিচার বিভাগীয় কর্ম-কমিশনের পরিচালক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা করি। আমার কাঙ্খিত ভ্রমণের কিছুদিন পূর্বে  আমি প্রধান বিচারপতির কাছে দেশ ছাড়ার অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত দিলাম। প্রধান বিচারপতি আমাকে বললেন, তিনিও সে সময় একটা সেমিনারে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে যাবেন। তিনি বিদেশ থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার ভ্রমণ পিছিয়ে দিতে বললেন। আমি তাঁকে বললাম, আমার ভ্রমণসূচী প্রায় ছয় মাস আগে চুড়ান্ত করা হয়েছে এবং আমি টিকেটও কিনে ফেলেছি, যার ফলে আমার ভ্রমণসূচী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি রেজিস্ট্রার এবং অন্যান্য বিচারকদের সাথে যাচ্ছিলেন।  পরে আমি জানতে পারলাম তিনি তাঁর সহযাত্রীদের নামের তালিকা  পরিবর্তন করে আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে যোগ করেছিলেন। তাঁরা ফেরৎ আসলে আমি আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কী সভায় কোন পেপার দিয়েছেন? তিনি আমাকে বললেন, যাওয়ার মাত্র দু’দিন আগে তাঁকে তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কোন ধরণের আলোচনায় অংশ না নিয়ে তিনি স্রেফ সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে এসেছেন। নাজমুন আরা সুলতানাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে মোজাম্মেল হোসেন তাঁকে ভ্রমণে সাথে করে নিয়ে গেছেন কারণ তিনি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে দায়িত্ব দিয়ে নিরাপদ বোধ করতেন না।  বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের ভ্রমণগুলো তদন্ত করা হলে এটা পরিষ্কার হবে। আমরা যদি আমাদের সহকর্মী বিচারকদের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাস না রাখতে পারি তাহলে সেটা বিচার বিভাগের জন্য অস্বাস্থ্যকর, এবং আমি কিছু বিচারককে দেখেছি তারা দ্বৈত নীতি অনুসরণ করতেন, তারা অন্যকে পছন্দ করে না কিন্তু সামনা সামনি আন্তরিকতার ভান করে।
রেফারেন্সঃ
১। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ
অধ্যায় ১১

জমে যাওয়া মামলার জট

উচ্চ ও নিম্ন বিচারালয়ে প্রচুর মামলা জমা হয়ে আছে। নিম্ন আদালতে প্রায় তিরিশ লক্ষ এবং হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় তিন লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। আপিল বিভাগে কাজের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও আমি মামলার সংখ্যা বাড়তে দিইনি। তারপরও সেখানে পনের হাজার মামলা ঝুলে আছে। এই বিশাল পরিমাণ মামলা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রচলিত সেকেলে ধরণের আইন দিয়ে ক্রমবর্ধমান মামলা জট সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধিত হবার পরও মামলা জট বৃদ্ধি পাবার কতগুলো কারণ আমি চিহ্নিত করেছিলাম। কিছু জরুরী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণেরও দরকার ছিল।
আমি বিশ্বাস করতাম যে এখন সময় এসেছে বিচার প্রশাসন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার কৌশলসমূহ প্রয়োগ করার এবং বিচার প্রশাসন সংস্কারের জন্য অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানোর। সকলেই স্বীকার করে যে বিচার বিভাগ হল গণতন্ত্রের একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বিশ্বায়নের এই যুগে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে দ্রুত বিচারিক সেবা প্রদান করা অপরিহার্য। যে সমস্ত দেশ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের জন্য একটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিচার বিভাগকে যদি উন্নততর অবস্থায় নিয়ে না যাওয়া যায় তাহলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কষ্টসাধ্য হবে। এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বিচার বিভাগের অবকাঠামো নিতান্তই দুর্বল। এটার জরুরী ভিত্তিতে উন্নয়ন ঘটানো দরকার। আমাদের বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ খুব সামান্য। এই অন্যায্য অবস্থা যদি অচিহ্নিত থেকে যায় তাহলে অপরাধ সংঘটিত হতেই থাকবে, এবং জনগণের মনে নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে অসহায়ত্ব, আতঙ্ক এবং ক্ষোভ তৈরী হবে। এমন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি সমাজের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদানের সৃষ্টি করে এবং পেশী ও অর্থ শক্তি দ্বারা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। সমাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাটাই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতিকল্পে যা কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার যেমন, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা, সমৃদ্ধ পাঠাগার, উন্নত তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামো এবং বিচারক, আইনজীবী এবং মোকদ্দমাকারীদের কার্যে সুবিধা হয় এমন সকল কিছুর অবিলম্বে ব্যবস্থা করা দরকার।
সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আমি নিয়োগ পাবার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করি।আমি হিসেব করে দেখি যে বেশকিছু আদালত কক্ষের স্বল্পতা রয়েছে যেগুলো তাড়াতাড়ি নির্মাণ করতে হবে। সেই সাথে ধাপে ধাপে বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনারও পরিকল্পনা করি। বিচার বিভাগের স্বার্থে আমি এসব পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করি এবং উল্লেখ করি যে দেশের সামগ্রিক উন্নতির সাথে বিচার বিভাগের উন্নতির এই বিষয়গুলো জড়িত। তার কিছুদিন পরে আমি বেদনার সাথে লক্ষ্য করলাম যে প্রধানমন্ত্রী আমার সেসব পরিকল্পনা আইন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন এবং তারা সেটা ধূলিসাৎ করেছে। জমে থাকা কাজগুলো সম্পাদন করাটাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং এই ভয়াবহ অবস্থার উন্নতির জন্যে  উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হবে আদালত কক্ষ এবং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। কারণ কেউ দুই বা তিন বছরের মধ্যে দক্ষ বিচারক হয়ে ওঠে না। পরিপক্ক বিচারক হবার জন্য অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। সেহেতু প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং শূন্যস্থান পূরণের জন্য অস্থায়ী সমাধান হিসেবে জেলা জজদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পাঁচশো বিচারক নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ শেষে বিচারকার্যে বসাতে হবে।একজন বিচারকের পরিপক্ক হবার পূর্বশর্ত হচ্ছে অভিজ্ঞতা।
পেশাগতভাবে দক্ষ বিচারকের ঘাটতির কয়েকটা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে বিরাট জনসংখ্যার দেশে প্রচুর সংখ্যক মামলা। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সম্ভবত সবচেয়ে কম সংখ্যক বিচারক রয়েছেন। এমনকি আমরা ভুটান ও নেপালের মতো ছোট দুটো দেশের তুলনায়ও পিছিয়ে আছি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দেশে প্রচলিত সেকেলে আইন। ঔপনিবেশিক শাসকেরা কার্যকরভাবে দেশ শাসন ও রাজস্ব সংগ্রহের জন্যই মূলত বেশিরভাগ আইন প্রণয়ন করেছিল। সেই উদ্দেশ্যেই তারা মূল আইনগুলো যথা দেওয়ানী কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি, স্বাক্ষ্য আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, তামাদি আইন, অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করেছিল। একটা সম্পূর্ণ সার্বভৌম দেশে রূপান্তরিত হবার পরও ওই আইনগুলো এখনো বহাল রয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেসব নীতি, উদ্দেশ্য এবং প্রেরণা থেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল, এই সমস্ত আইনের অধিকাংশই সেসবের সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া এগুলো আমাদের সংবিধানের মূল আদর্শের সাথেও যায়না। আমরা দাবী করতে পারিনা যে আমরা ১৯৪৭ সালেই স্বাধীন হয়েছি কারণ সেই সময়ে আমরা ভীনদেশী শাসকের অধীনস্থ ছিলাম। আমরা আসলে ১৯৭১ সালের আগে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। আমরা চিন্তার স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা, কর্মসংস্থানের স্বাধীনতা এবং ভাষার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। চলমান মামলাগুলো বিরাজমান আইনে এবং জনবল, অবকাঠামো এবং প্রাসঙ্গিক সুবিধার সল্পতার কারণে শুনানি এবং নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ঔপনিবেশিক আইনগুলো অবশ্যই বাতিল করতে হবে। দণ্ডবিধির কিছু আইন প্রণীত হয়েছিল শুধু “বিদ্রোহীদের ” নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তি দেবার জন্য। এসকল আইন আমাদের সংবিধানে বর্নিত মৌলিক অধিকারের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ফৌজদারি বিচার পদ্ধ‌তি একেবারেই সেকেলে এবং আঠারো ও একুশ অধ্যায় বাতিল করার পরে এই পদ্ধ‌তিটি কার্যকারিতা হারিয়েছে। সিআরপিসিতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা সিআরপিসির অন্য ধারার সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমান আইনে একজন অপরাধী যদি খুন বা ধর্ষণের পরে খুন, বা ডাকাতি ও খুনের মতো জঘন্য কাজও করে তবুও তাকে পনের দিনের বেশী জেলহাজতে রাখা যায়না। আমি একটা মামলায় পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম এবং এ্যটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীকে সতর্ক করেছিলাম আইনে সংশোধনী আনার জন্য, কিন্তু কোন ফল হয়নি।যদি ওই পনের দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পূর্ণ না হয় তাহলে অপরাধীকে জামিনে মুক্তি দিতে হয়। সিআরপিসির ৩৪৪ ধারা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যায়না কারণ এটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৮ তম অধ্যায়ের জন্য। আইনের ২০ ধারায় বাদী এবং পুলিশ বাদী মামলার বিষয়ে জগাখিচুরী ধারা রয়েছে।একইভাবে দেওয়ানী কার্যবিধিও সংশোধনীর পরে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।এর ২১ ধারার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিবর্তন আনা দরকার। ভারত যদিও ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি রেখে দিয়েছে, তবুও তারা এতে এমনভাবে সংশোধনী এনেছে যেন একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।আমরা যথপোযুক্ত সংশোধনী আনতে পারিনি যার ফল হচ্ছে কাজ বাড়ছে।
আইনের কিছু ধারা আছে যেগুলো লোন রিকভারি এ্যক্টের দ্বারা বকেয়া ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু এখানেও প্রচুর অসঙ্গতি আছে।আমি নিরপরাধ ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার রক্ষার জন্য একটা রায়ের মধ্যে এই অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা করেছিলাম যেখানে এক ব্যক্তির সম্পত্তিকে অবৈধভাবে ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আমার রায়ের মধ্যে সে অসঙ্গতি দূর করতে পারিনি। প্রত্যেক আইনি প্রক্রিয়ায় এরকম অনেক অসঙ্গতি রয়েছে যেগুলো বাতিল করে অভিজ্ঞ আইনজীবী, অধ্যাপক, সাধারণ মানুষ এবং বিচারকদের মধ্য থেকে লোক নিয়ে গঠিত শক্তিশালী আইন কমিশনের মাধ্যমে নতুন আইন প্রণীত হওয়া দরকার।
ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে মূল আইনগুলো অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের এবং সংবিধানের চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমান যে অবকাঠামো তা দিয়ে মামলার চাপ সামলানো যাবে না। জনবল তিনগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।প্রত্যেক জেলায় যথেষ্ট বিচার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং সকল পর্যায়ের বিচারকদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকাতে কেন্দ্রীয় বিচার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেখান মামলা ও আদালত ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমন একটা আইন থাকতে হবে যাতে করে মামলায় জড়িত পক্ষরা সালিসের মাধ্যমে সমাধানে আসতে বাধ্য হয় এবং যদি কোন পক্ষ সালিসের রায় মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মামলা দায়ের করে হেরে যায় তাহলে সেই পক্ষের ঘাড়ে মামলার যাবতীয় ব্যয়, আইনজীবীর ফিস, প্রতিপক্ষের হয়রানির দায় বর্তাবে। ফৌজদারি আইনের বিচারের বেলাতেও, কিছু জঘন্য অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ধরণের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এটা মূলত একটা বিচার-পূর্ব সমঝোতা যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাদী পক্ষ হতে কিছুটা ছাড় পাওয়ার বিনিময়ে বাদী পক্ষের সামনে অপরাধের দায় স্বীকার করে। সওয়াল জবাবের এরকম তিন ধরনের ব্যবস্থা আছে: অভিযুক্ত আসামীর ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তি কম দোষ স্বীকার করে, রায়ের ক্ষেত্রে আসামী কম সাজা পেতে দোষ স্বীকার করে। সত্য বলতে কি এসব দর কষাকষিতে একটা চুক্তির ভিত্তিতে কিছু নতুন তথ্য যোগ করা হয়,  বিনিময়ে অন্য কিছু তথ্য প্রমাণ হিসেবে যোগ করা হয় না। এ পদ্ধতি একট বড় সংখ্যক ফৌজদারী মামলায় বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
চলবে…

মন্তব্যসমূহ