ব্লাড প্রেশার ॥ যেসব বিষয় জানা দরকার । লেখক- এনামুল হক ((সূত্র : রিভার্স ডাইজেস্ট )



 
  • এনামুল হক (সূত্র : রিভার্স ডাইজেস্ট ) (সৌজন্যে;-দৈনিক  জনকণ্ঠ )
আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় হাইপারটেনশন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ রেমন্ড টাউনসেন্ড সত্তরের দশকে যখন মেডিক্যাল ছাত্র ছিলেন তখন ডাক্তাররা শেখাতেন যে, ‘ব্লাড প্রেশারের ফমর্ূুলা বেশ সহজ। স্বাভাবিক ব্লাড প্রেশারের উপরের ভাগটা হচ্ছে ১০০ এর সঙ্গে সেই ব্যক্তির বয়স যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাই।’ ডাঃ টাউনসেন্ড বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা জানি যে বুড়িয়ে গেলে রক্তচাপ অত বেশি হওয়া এমনকি তার কাছাকাছি হওয়াও অতি বিপজ্জনক।’ রক্তচাপ নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। তবে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ মাত্রার রক্তচাপ কত হওয়া উচিত এবং কিভাবেই বা তা মাপা উচিত তা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। অবশ্য উচ্চ রক্তচাপ থেকে যে হাট এ্যাটাক, স্ট্রোক, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা এবং স্মৃতিলোপ হতে পারে, তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। তাই উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে ১৫টি বিষয় জানা থাকলে হয়ত আপনার জীবন রক্ষা পেতে পারে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে রক্তচাপও বাড়ে
রক্তচাপ মূলত একটা জিনঘটিত ব্যাপার। জিনের কারণেই কারোর রক্তচাপ বেশি থাকে। কারোর হয়ত কখনই বাড়ে না। তবে মানুষের বয়স চল্লিশের দিক থেকে বেশিরভাগ মানুষের রক্তচাপের উপরের দিকটা অর্থাৎ সিস্টোলিক চাপটা বাড়তে শুরু করে। এর একটা আংশিক কারণ হলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্টারি বা ধমনীগুলো কাঠিন্য আকার ধারণ করতে থাকে। রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০ এমএমএইচজি বা তার বেশি হয়, সেটাই হলো হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে থাকে না
আপনার রক্তচাপ অনেক বেশি হতে পারে অথচ আপনি হয়ত তা টেরই পাচ্ছেন না। আপনার তা জানার একমাত্র উপায় হলো রক্তচাপ পরীক্ষা। নির্ভরযোগ্য রিডিং পাওয়াটাও এক দারুণ ঝকমারি ব্যাপার। সারাদিনে আপনার রক্তচাপ ৩০ থেকে ৪০ পয়েন্ট কম-বেশি হতে পারে। রক্তচাপের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো এটা সকালে বেশি থাকে এবং রাতে কমে যায়। আপনি রক্তচাপ মাপাচ্ছেন ¯্র্েরফ এই কারণেও রক্তচাপ সহসা বেশ বেড়ে যেতে পারে। একে বলে ‘হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন।’ ব্লাড প্রেশার রেকর্ড করার আদর্শ পদ্ধতি হলো দিনের বেলায় ঘণ্টায় তিন চারবার মাপা এবং রাতে প্রতি আধঘণ্টা অন্তর মাপা।
৫০ এর বেশি হলে যা করবেন
বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গেলেই সিস্টোলিক প্রেশারের ওপর নজর রাখুন। সিস্টোলিক চাপ স্পন্দনের মুহূর্তটিকে হৃৎপি- যত জোরে রক্ত পাম্প করে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয় তার পরিমাপ বোঝায়। আর নিচের সংখ্যাটা বা ডায়াস্টলিক চাপ দুই স্পন্দনের মাঝখানে অর্থাৎ হৃৎপি-ের বিশ্রামের সময় রক্তের চাপ যা থাকে তা পরিমাপ করে। উপরের নম্বরটা বা সিস্টোলিক চাপটাই আসল ব্যাপার। কারণ সিস্টোলিক চাপটাই রক্তের সর্বোচ্চ চাপ যা প্রতিটি স্পন্দনের সময় আপনার ধমনী ও মৌলিক অঙ্গগুলো অনুভব করে। এই চাপ বেশি হলে আপনার কিডনি, আপনার চোখ, আপনার মস্তিষ্ক এমনকি আপনার রক্তবাহী নালীর গাত্রগুলোরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। বিচিত্র ব্যাপার হলো নিচের সংখ্যাটা অর্থাৎ ডায়াস্টোলিক চাপটা ৫৫ বছর বয়সের দিকে তুঙ্গে ওঠে এবং তারপর ধীরে ধীরে কমে আসে।
আদর্শ রক্তচাপ নিয়ে ঐকমত্য নেই
৫০ এর বেশি বয়সী লোকদের জন্য আদর্শ রক্তচাপ কোন্টি তা নিয়ে এখনও চলছে গবেষকদের বিতর্ক। এই সেদিনের আগ পর্যন্ত সর্বোত্তম তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হতো যে, রক্তচাপের যৌক্তিক টার্গেট হলো সিস্টোলিক চাপ ১৪০ এর নিচে থাকবে এবং ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১৫০ এর নিচে থাকবে। কিন্তু ২০১৫ সালে এক গবেষণার ফলাফল এই পরামর্শকে পাল্টে দিয়েছে। হৃদরোগের অতি ঝুঁকিতে থাকা কিংবা ইতোমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে এমন ৯ হাজার ৩শ’ জনেরও বেশি লোকের ওপর এক সমীক্ষা চালানো হয় যাদের ৩০ শতাংশের বয়স ছিল ৭৫ বছর কি তারও বেশি। এদের দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপের টার্গেট ছিল সিস্টোলিক চাপকে কমিয়ে ১২০ এর নিচে রাখা এবং অন্য গ্রুপটির টার্গেট ছিল এই চাপকে ১৪০ এর নিচে রাখা। তিন বছর মেয়াদি এই পরীক্ষায় দেখা যায়, যে গ্রুপটির লোকদের সিস্টোলিক চাপ ১২০ এর নিচে ছিল তাদের হৃদরোগ বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ কম ছিল।
আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন
আপনার সর্বোচ্চ সিস্টোলিক চাপ কত হওয়া উচিত তা আপনার ডাক্তারই বলতে পারেন। প্রত্যেক রোগীই একজন থেকে একজন ভিন্ন। যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কম তাদের সিস্টোলিক টার্গেট বেশি হলে তা মেনে নেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন ডাঃ টাউনসেন্ড। অতি ঝুঁকিপূর্ণ কিছু রোগী যারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এগ্রোসিভ থেরাপি সহ্য করতে পারে না তাদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে। এক্ষেত্রে সব থেকে ভাল পরামর্শ হলো আপনার সিস্টোলিক টার্গেট সঠিক কোনটি তা আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন।
জীবনাভ্যাস বদলান
লবণ খাওয়া কমিয়ে দিলে এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ প্রচুর ফলমূল ও শাক-সবজি খেলে রক্তচাপ প্রায় ৩ পয়েন্ট কমতে পারে। ওজন কমালেও কাজ হয়। ৪ কিলো ওজন কমলে আপনার সিস্টোলিক চাপ ৪ পয়েন্টেরও বেশি কমবে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে। সুইডিশ গবেষকরা দেখিয়েছেন, যাদের হাইপারটেনকশন আছে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের কারণে তাদের রক্তচাপ গড়ে ১১ পয়েন্ট হ্রাস পেতে পারে।
কফিতে রক্তচাপ বাড়ে
এক কাপ হাই-অকটেন কফিতে রক্তচাপ লাফ মেরে বেড়ে যায়। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ২০০-৩০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন বা দেড় থেকে তিন ২৩৫ মিলিলিটার কফিতে সিস্টোলিক চাপ গড়ে ৮ পয়েন্ট বাড়ে। এই বৃদ্ধি প্রায় ৩ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি।
কিছু ওষুধে প্রেশার বাড়ে
অনেক সর্দি-কাশির ওষুধে সিউডোত্রফিড্রিন থাকে যা রক্তবাহী ধমনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। আইবুপ্রোফেন ও ন্যাপ্রোক্সেন এর মতো প্রদাহনাশক ওষুধেও রক্তচাপ গড়ে ৩ পয়েন্ট বাড়তে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট তারতম্যও ঘটতে পারে।
লবণ দূরে রাখুন
লবণাক্ত খাবারে ব্লাড প্রেশার বাড়ে। তবে লবণ খাওয়া কমিয়ে দেয়ার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। তার একটি কারণ লবণ খেলে সবারই যে ব্লাড প্রেশার বাড়ে তা নয়। অবশ্য বয়স যত বাড়ে স্বাদের অনুভূতিটা তত কমতে থাকে বলে বেশি বয়সীদের অধিক লবণ খাওয়ার প্রবণতা থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণের অনুমোদিত মাত্রা হলো অনধিক ১৬০০ মিলিগ্রাম যা ৪ গ্রাম বা এক চা চামচ লবণের সমান। প্রসেস করা খাদ্যসামগ্রীতে বেশিরভাগ লবণ লুকিয়ে থাকে। তাই কম সোডিয়ামযুক্ত আইটেম বেছে নিন।
নতুন ওষুধমাত্রই ভাল তা নয়
ডাক্তাররা সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা শুরু করেন ডাইডারেটিক বা ‘ওয়াটার পিল’ দিয়ে। সারা বিশ্বে হাইপারটেনশনের প্রাচীনতম যেসব ওষুধ আছে এগুলো তার অন্যতম। এর কাজ হচ্ছে শরীর থেকে বাড়তি সোডিয়াম ও পানি বের করে দেয়া। এসিই (এঞ্জিও টেনসিন কনভার্টিং এনজাইম) ইনহিবিটর নামে নবতর কিছু ওষুধ বেরিয়েছে যা শরীরকে রক্তচাপ বর্ধক একটি হরমোন এঞ্জিও টেনসিন ২ উৎপাদনে বাধা দেয়। এঞ্জিও টেনসিন ২ রিসেপটর ব্লকার বা এআরবিগুলো আবার একই হরমোনের কাজে বাধা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চ রক্তচাপের একক কোন ওষুধ অন্যটির চেয়ে উন্নততর নয়। ওষুধের সত্যিকার মূল্য বা কার্যকরিতা একেক রোগীর ভিত্তিতে বিচার করা হয়।
হ্যান্ডগ্রিপ ব্যায়ামে কাজ হয়
গবেষণায় স্বপ্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ হ্যান্ডগ্রিপ ব্যায়ামে উচ্চ রক্তচাপ প্রায় ১০ শতাংশ পয়েন্ট কমতে পারে। এগুলোর দাম বেশি নয় এবং স্পোর্টস গুডসের দোকানে পাওয়া যায়। গ্রিপার চাপ দিয়ে এক একবার দুই মিনিট করে ধরে রাখুন। এভাবে মোট ১২ থেকে ১৫ মিনিট করুন। সপ্তাহে এভাবে তিনবার করুন।
একটা ওষুধই যথেষ্ট নয়
আপনার রক্তচাপ মোটামুটি বেশি থাকলে শুধু একটা পিল খেলেই তা কমে যেতে পারে। কিন্তু অনেককে আবার বেশ কয়েকটি ওষুধ খেতে হয়। এক একটি ব্লাড প্রেশারের ওষুধে রক্তচাপ মাত্র কয়েক পয়েন্ট কমতে পারে। রোগীর ওপর নির্ভর করে ডাক্তাররা সর্বাধিক ফল পাওয়ার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর ওষুধ যুক্তভাবে দিয়ে থাকেন।
রক্তচাপ খুব বেশি কমতে পারে
বিপদটা তখনই হয় সর্বাধিক যখন কেউ উঠে দাঁড়ায় অথচ মস্তিষ্কে রক্ত পাম্প করে পাঠানোর জন্য রক্তচাপ যথেষ্ট মাত্রায় থাকে না। এ অবস্থাকে বলে ‘অরথোস্ট্যাটিক হাইপারটেনশন।’ বয়স্ক লোকেরা এ অবস্থায় পড়ে গিয়ে হারগোর ভেঙ্গে যাওয়ার বিশেষ ঝুঁকিতে থাকে।
ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসে রক্তচাপ কমে
শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমিয়ে এনে ৩০ সেকেন্ডে ৬ বার করলে সিস্টোলিক চাপ অন্তত সাময়িকভাবে হলেও কমে যায়।
ওষুধ বাদ দিতে নেই
জীবনধারার পরিবর্তন ও নিয়মিত ওষুধ সেবন এ দুটো কাজ যুগপৎ করা হলে সাধারণত রক্তচাপ কমে ডেঞ্জার জোন থেকে বেরিয়ে আসা যায়। কিন্তু একবার শুরু করা হলে ওষুধ সেবন করে চলা ও স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাসগুলো অনুসরণ করা অপরিহার্য। উচ্চ রক্তচাপের বেশিরভাগ রোগীর মাঝে ওষুধের ডোজের রদবদল করা দরকার হতে পারে।
সূত্র : রিভার্স ডাইজেস্ট

মন্তব্যসমূহ