১৯৭১ সালের আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচরণ :৷ ( ৬ষ্ট পর্ব )



                            ১৯৭১  সালের  আমার  ব্যক্তিগত  স্মৃতিচরণ : ( ৬ষ্ট  পর্ব )

             এই  লেখাটি  অনেকটা  প্রতিকী  একটি লেখা । কারণ  আমার  লেখায়  শুধু  অধ্যাপকদের  কথার  বর্ণনা  থাকলেও  সিলেট শহরে   প্রত্যেক  সিলেটের  বাহিরের  এবং সিলেটে শহরের  স্থানীয়  বাসিন্দাদের  শহর  ত্যাগের  ঘটনা  কমবেশী  একই  ধরনের । আমি  শুধু আমার জীবনের  তখনকার  বাস্তবতা  উল্লখের  চেষ্টা করছি ।

         এপ্রিল/৭১  সালের  ১৫  তারিখ  থেকে  সিলেট  ঢাকা  মহাসড়কে  আর্মির  যান  চলাচল  বৃদ্ধি  পায়  । আমি  ১৯  এপ্রিল  দুপুর  মামাদেরকে নিয়ে  দুই  রিস্কা  করে  সুনাতিতা  গ্রামে  রওয়ানা  দেই । ৩ মাইল  রাস্তা  অতিক্রম  করে  প্রায়  আমাদের  গন্তব্যের  রাস্তার  মুখে  পৌঁছে  রিস্কা  থেকে  নেমে  যাওয়ার  আগেই  আর্মিদের  একটি  ট্রাক  আমাদের  কাছে  থেমে  পড়ে । আমরা চিন্তায়  পড়ে যাই  কি  করব ভেবে । তখনি  আর্মি  অফিসারের  একটি  জিপ আসছে  দেখে  ট্রাকটি  চলতে  আরম্ভ  করে আর  আমরা  সঙ্গে সঙ্গে  মেইন  রাস্তা  ছেড়ে  গ্রামের  রাস্তায়  হাঁটতে  আরম্ভ  করি । সুনাতিতার ঐ  বাড়ী  মামাদের  পৌছে  দিয়ে  আমি  গ্রামের  রাস্তাদিয়ে  কুরুয়ার  বাড়ী  চলে  আসি । এই  দিন  থেকে  সিলেট 

শহরের  স্থানীয়রা  যারা  নিরাপদ  আশ্রয়ে  গ্রামে  চলে  গিয়েছেন  তারা  আবার   শহরে নিজদের  বাড়ী  ফেরা আরম্ভ  করেন শহরের অবস্থার  উন্নতি  হচ্ছে  খবর  পেয়ে । অতিরিক্ত  লোকজন  শহরে  প্রবেশ  করছে  দেখে  শহরের  বাইরের  সকল  শহরে  প্রবেশের  রাস্তায়  কারফিউ  জারী  করে  বেশীকরে  চেকপোষ্ট  বসানো  পর্যন্ত  সব  প্রাইভেট  ও  পাবলিক  যানবাহন  বন্ধ  করে দেয় । ১৯এপ্রিল  বিকালে  আমি  বাড়ীর  পেছনে  পুকুর  ঘাটে  বসে  রেডিওতে  নয়াদিল্লীর  হিন্দি  খবর  শুনছিলাম । তখন  বাড়ীর  পাশের  গ্রামের  রাস্তায়  আমার  পরিচিত  সিলেট  শহরের  রায়নগর  ও  চারাদিঘী পারের     শহরের  স্থায়ী  বাসিন্দা   ২জন  ব্যবসায়ীদের  দেখতে  পাই আমি  তাদের  কাছে যাই  এবং  তাদের  এইস্থানে  আসার  কারণ  জানতে  চাই । তারা  বলেন শহরে  ফিরছিলেন    হঠাৎ  করে  রাস্তায়  আমাদের  বাড়ীর কাছে  পৌঁছার পর  রাস্তা  বন্ধ  হয়ে  যায়  তখন  তারা  গ্রামের  ভিতরে  প্রবেশ  করে  একটি  নিরাপদে  রাত  কাটাতে একটি  আশ্রয়  খুঁজছেন । আমি  আমাদের  বাড়ী  চলে  আসতে  বলায়  তারা  রাজী  হয়ে  তাদের  সঙ্গের  ৭ জন  মহিলা ও আরো  ২জন  পুরুষ  মানুষ  যারা  অন্যত্র রাস্তায়  এক গাছের  নিচে  বসে  ছিলেন  তাদের  নিয়ে  আসেন । কিন্তু  পেছনদিক থেকে  আমাদের  বাড়ী  প্রবেশ  করতে  একটি  খাল  পার  হয়ে  বাড়ীতে  প্রবেশ  করতে  হত । ঐ  সময়ে  ঐ খালে  পানিছিল । তখন  আমাদের  এক  প্রতিবেশীর  সহায়তায়  বাড়ীর একটি  বড় বাঁশ  কেটে খালের  উপরে  একটি পুল  তৈরি  করে  মহিলাদের  বাড়ী  প্রবেশ  সহজ  করে  দেই।   

    তাদের  দলে  ৪ জন  পুরুষ  ও  ৭ জন  মহিলা  ছিলেন ।  মহিলাদের  দুইজন  নববিবাহিত  এবং  একজন  বিবাহযোগ্যা  ছিলেন ।  রাত্রে  আমরা  পুরুয়েরা  ড্রয়িং রুমে এবং  অন্যরা  বেডরুমে  রাত্রে  খাওয়ার  পর  ঘুমাবার   ব্যবস্থা  করে  দেয়া  হয়। পরেরদিন  ডালদিয়ে  নরম খিছুড়ি দিয়ে  চা নাস্তার  ব্যবস্থা  করে দেই ।  তাদের  সঙ্গে  রায়নগরের  ব্যবসায়ী  রেজ্জাদমিয়ার  এক  ভাড়াটে  ছিল । পুরুষটি  রেডিও   একজন  সিলেটের ষ্টাফ এবং  বিহারী  ছিল । সে  পরেরদিন  আমাদের কাছের  রসিদপুর  আর্মি  কেম্পে গিয়ে  তাদের  ১১ জনের  জন্যে  একটি  কারফিউ  পাশ  সংগ্রহ  করে  নিয়ে  আসে  এবং  কুরুয়া  বাজারে  সিলেট  কালীঘাটের  একটি  খালি  ৩ টনি  ট্রাক  আগেরদিন  আটকা  পড়েছিল । এই  ট্রাকটি  ভাড়া  করে  দুপুরে  আমাদের  বাড়ীতে  খাবার  সেরে  শহরে  চলে  যান সকলে  । পরে  ঐ  বিহারী  রেডিও  ষ্টেশনের  স্টাফ   চারাদিঘীর  যে  দুইজন ব্যবসায়ী  পুরুষ  মানুষ   আমদের  বাড়ীতে রাত্রিযাপন  করেছিলেন  তাদের  একজন  আমার  বয়সের  ছিলেন  এবং  রাত্রে  আমার  সঙ্গে  স্বাধীন  বাংলা  বেতারের  খবর  শুনে  ছিলেন । তখনই  বিহারি  লোকটি  আমাদের  এইসব  মিথ্যা  খবর  না  শুনতে  বলে এবং  শহরে  পৌঁছেই  ঐ    ছেলেটিকে  মুক্তিযুদ্ধাদের  পক্ষের  লোক  পরিচয়  দিয়ে  আর্মিদের  হাতে তুলে দিয়ে  সে  বদলী হয়ে  ঢাকায়  চলে  যায় । ঐ  ছেলেটির  আর  কোনো  খোঁজ  তার  পরিবার  পাননি । তাকে  হত্যাকরা  হয় মিথ্যা অভিযোগে ।
        ঐ দিকে  মামারাও  বাড়ী  চলে  আসেন ২৫/২৬ এপ্রিলে । সম্ভবত ২৭ এপ্রিল প্রিন্সিপাল  সাহেবের  খোঁজ  নিতে আমি ও মামা  পায়ে  হেঁটে  দেওকলস  গ্রামে  যাই । তখন প্রিন্সিপাল  সাহেব  আমাদের  বাড়ী  চলে  আসতে  ইচ্ছা  করেন । কারণ  ঐ  গ্রামের লোকজন  মনে  করতো  তাকে খুঁজে  আর্মিরা  তাদের গ্রামে  চলে  গিয়ে  তাকে  আশ্রয়  দেয়ায় তাদেকেও  ধরে নিয়ে  যাবে । তাই  আমরা  পরেরদিন  ভোরে  রওয়ানা  দিয়ে  আমাদের  বাড়ী  চলে  আসতে  বলে  আমরা  চলে  আসি । পরের  দিন সকাল  ১১টায়  তারা  আমাদের  বাড়ীতে  পৌঁছে  যান ।

       আমরা  প্রিন্সিপাল  ও ২ মেয়ে সহ  তার স্ত্রীকে  একটি  বেড রুম  ছেড়ে দেই  আর  তার  তিন  ছেলে  সহ  আমি  ড্রয়িং  রুমের  ফ্লোরে  রাতে  ঘুমাবার  ব্যবস্থা  করি । ঐ দিন  রাত  থেকে  তারা  আলাদা  রান্নার  ব্যবস্থা  করে ফেলেন । তখন  গ্রামের  বাজারগুলো  সাপ্তায় ২ বা ৩  দিন  বসতো যদিও  কিছু  স্থায়ী  দোকান সবসময়ই  খোলা  থাকতো । আমাকে  ঐ দিন  বাজারবার থাকায়  প্রিন্সিপাল  সাহেব   মাছ তরকারী  সহ  কিছু  বাজার  করে  দিতে  বলেন   কারণ  অপরিচিত  স্থানে  তার  ছেলেদের  পাঠাতে  চান নি। আমি   তাদের বাজারগুলো  বাড়ী  পোঁছে  দিয়ে আমাদের  কিছু  বাজারের  জন্যে  আবার  বাজারে  যাই । তখন  একটি  সৈন্যবাহী গাডি  বাজারে  থামে  সঙ্গে  জীপে একজন  অফিসারও  থামে । আর্মিদের  নামতে দেখে  দোকানদার  ছাড়া  বাজার করতে  আসা  লোকজন  বাজারের  পেছনের দিকে  পালিয়ে  যায় । আমি খাপনের  সীতাব আলী  নানার  হোমিও  ফার্মেসীতে  ঢুকে  তার  সহকারী  সেজে বসে  থাকি । আর্মিরা  কি খুঁজে  না  পেয়ে  ফিরে  গিয়ে সঙ্গের  অফিসারকে  কি  যেন বলে । তিনি হঠাৎ আমাকে  দেখতে পেয়ে ডেকে  নিয়ে  বলেন  আমি  কি  করি । আমি  ফার্মেসির  সহকারী  পরিচয় দেই । সে  এটি  প্রমাণের  জন্যে  সীতাব আলী  নানাকে  ডেকে নিয়ে আমার  পরিচয় জিজ্ঞাসা  করে  কনফার্ম হয়ে  আমাকে ৬ টি বড়  ব্যাটারী  ক্রয়  করে  দিতে  বলে । কারণ  সীতাবআলী  নানাকে  আমি  এই  পরিচয় দিব  বলে  গিয়েছিলাম , তাই  তিনিও  একই  পরিচয়  দেন  আমার । আমি  আমার পরিচিত  খাপনের  রফিকভাইয়ের  দোকানে  লুকিয়ে রাখা ৬ টি  চান্দা  ব্যাটিরী ৯ টাকা  দিয়ে  ক্রয়  করে  তাকে   নিয়ে দেই । তখন  সে তার  একটি  কার্ড  দিয়ে  আমার  নাম  ঐ  কার্ডে  লিখে  দিয়ে  বলে  কোনো  অসুবিদায়  পড়লে  এই  কার্ডটি  দেখাতে  বলে  সে  একজন বেলুচ আফিসার পরিচয় দিয়ে চলে যায় ।

        মে মাসের  ৫  তারিখে সব আফিসের হ্যাডদের  সিলেট  সার্কিট  হাউসে  ব্রিগ্রেডিয়ার  ইফ্তেকারের  নিকটে  ব্যাক্তিগত  ভাবে  হাজির হয়ে  চাকুরীতে  জয়েনিং  রিপোর্ট  জমা  দিতে  নির্দেশ দেয় । তখন  ঢাকা  সিলেট  সড়কের  চন্ডিপুলে   আর্মি  চেক পোষ্ট  আতিক্রম  করে  শহরে  প্রবেশ করতে হত । কিন্তু  চন্ডিপুলের একমাইল  আগে  তেড়াপুল  পর্যন্ত ৬ সিটের টেম্পু  চলাচল  করত । প্রিন্সিপাল  সাহেব আমার  আব্বাকে  সঙ্গে  নিয়ে  তেড়াপুলের কাছে গিয়ে ধরাধরপুর  ও  বরইকান্দি হয়ে পায়ে  হেঁটে কাজিরবাজারের খেয়া নৌকায় সুরমা নদী  পার  হয়ে সার্কিট হাউসে যান । আমার  আব্বাকে  কিন ব্রীজের পশ্চিমে অপেক্ষা  করতে  বলে সার্কিট হাউসে প্রবেশ  করেন এবং প্রায়  ১ ঘণ্টা পর বের হয়ে আসেন এবং  আমার  আব্বা  হাজি  আব্দুস সোবহানকে  বলে  দেন যে  তিনি  তার  অফিসের  হ্যাডক্লার্ক কাপ্তান  মিয়ার  রায়নগরের বাসায়  চলে  যাবেন  এবং  তার   পরিবারের  জন্যে  এমসি  কলেজের  ষ্টাপ  কোয়াটারে  একটি  বাসা  ঠিক  করে  তাদেরকে  নেয়ার  ব্যবস্থা  না  করা  পর্যন্ত তাদেরকে  আমাদের  বাড়ীতে থাকতে  হবে । প্রায় ২০ দিন পর তাদেরকে ও ষ্টাপ  কোয়াটারে নেয়ার  ব্যবস্থা  করেন ।

        মে মাসের  ১৫ তারিখে বাকি  অফিসের  সকলকে  তাদের  অফিসে গিয়ে চাকুরীতে  জয়েন  করতে নির্দেশ দেয়া হয় । তাই  ১৫ মে সকালে মামা অধ্যাপক আব্দুল আজিজ ও আব্বাকে নিয়ে একই ভাবে এমসি কলেজে গিয়ে  কাজে যোগদেন এবং  আব্বাকে বলে  দেন তিনি  আপাতত জেরজেরী  পাড়ায় তার  ভায়রা ভাই ডাক্তার  আব্দুল  মজিদ  বড় লস্করের
বাসায়  উঠবেন এবং এর ১০ /১৫ দিন পরে  সুমনা আজিজ ও মামীআম্মা  রওশন  আজিজকে  নিয়ে যান  জেরজেরী  পাড়ার  বাসায় এবং পরে জুলাই/৭১  মাসের প্রথমদিকে  তাদের  হোষ্টেলের  বাসায়  চলে যান । তখন বাসার সব জিনিষপত্র লোট হয়ে গিয়েছিল । সবকিছুই  নতুনভাবে  কিনতে হয় ।  স্টিলের  আলমিরার  হ্যান্ডুল  আর্মিরা গুলি করে  ভেঙ্গে  এটি  খুলেতে  চেষ্টা  করে  ব্যর্থ  হওয়ায়  আলমিরাতে  থাকা   জিনিষগুলো  রক্ষা  পায়  ।  বারুতখনায়  মালিক  মেটেল  ইন্ড্রাষ্টিতে  পাঠিয়ে  এটি  খোলে  নয়া  একটি  হ্যান্ডুল  লাগাতে  হয় । 

       আমি বাড়ীতে আগষ্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত  থেকে  গ্রামে  রজাকারদের  উৎপাত  বৃদ্ধি পাওয়ায় আগষ্টের ১৬ তারিখে মামার এমসি কলেজের  হোষ্টেলের  বাসায়  চলে  যেতে  বাধ্য হই। আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি । পরের পর্বে ডিসেম্বর ৭১ পর্যন্ত আমার জানা ঘটনার উল্লেখ  থাকবে । ( এই  লেখায়  যে  তারিখের উল্লেখকরা  হয়েছে তার কিছু  হেরফের  হতে  পারে কারণ এটি আমার স্মৃতি থেকে  কোনো  লিখিত  তথ্য ছাড়াই  লিখেছি , ঐ সব  অনিচ্ছাকৃত ভূলের  জন্যে  আমি দুঃখিত )


মন্তব্যসমূহ