১৯৭১ সালের আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ (৫ম পর্ব )

                        ১৯৭১  সালের  আমার  ব্যক্তিগত  স্মৃতিচারণ ( ৫ম পর্ব )

      ৮ মার্চ /৭১  সাল  বিকালে  আমাদের  গ্রামের  বাড়ি  সিলেট  শহর থেকে ঠিক দশ মাইল বা ১৬ কিলোমিটার ঢাকা সিলেট মহাসড়কের খুব  কাছে  অবস্থিত  বাড়িতে  পৌঁছাই । কিছু  চা নাস্তা ও রাতের  খাবার  শেষে ঘুমবার  আয়োজন  করি । আমাদের  পাকা ফ্লোর ও দেয়াল পাকা  ও টিনের চালের ঘরটিতে ৩ টি   বড় বেডরুম এবং  একটি  ড্রয়িং  রুম  ছিল । আমরা পুরুষেরা  ২ রুমের ফ্লোর  ও  পালঙ্গে  শুয়ে রাত  কাটাই আর মহিলারা বাকি দুই  রুমে  একই ভাবে ঘুমান । আমার  মা ,বাবা এবং  ১ ছোটবোন  বাড়িতে  আমার  চাচার ঘরের একরুমে  রাত  কাটান । পরদিন  সকলে  ডাল  ও  আলুর  ভুনা  খিছুড়ি দিয়ে  নান্তার পর আমরা নিকটভর্তি  কুরুয়া  বাজারে  গিয়ে  আমাদের  বাড়ি  থেকে  ১০  দূরের  শেরপুরে  যাওয়ার  রাস্তা  নিরাপদ  কি না    জানতে  চেষ্টা  করতেছিলাম। কারণ  কয়েকজন  অধ্যাপকের  বাড়ী কুমিল্লা , ব্রাহ্মণবাড়ীয়া  ও ভৈরবের    দিকে  ছিল  । তারা  শেরপুর  থেকে  লঞ্চযোগে নদী  পথে  ভৈরব পর্যন্ত  যেতে  পারলেই  নিরাপদে  বাড়ি  যেতে  পারবেন ।

         আমরা  যখন  বাজারের  মেইনরোডে  ছিলাম  তখন  একটি  বাস বা  টেম্পযোগে  হোষ্টেলের  ৫ম  ব্লকের  এক  ছাত্রনেতা    সুনামগন্জের  দিরাই  থানায় বাড়ী  তোফায়েল  আহমেদ এই  রাস্তা  দিয়ে  যাচ্ছিলেন । তিনি  রাস্তায়  তার  স্যারদের দেখে  গাড়ী  থেকে  নেমে  যান ।  তার ব্লকের  সুপার অধ্যাপক  গনী  সাহেব  ও  ছিলেন তখন  আমাদের  সঙ্গে ।  সিলেট  শহরের  অনেক ভালমন্দ  খবর   তার কাছ  থেকে  জানা  যায় । তিনি  তখন মুক্তিযুদ্ধাদের  সংগোঠনের  কাজে  নিযুক্ত  ছিল । তাকে গনী  সাহেব  দায়িত্ব  দেন তাদেরকে  লঞ্চ বা অন্য কোনো  জলযানে ভৈরব পর্যন্ত  পৌছাঁর  ব্যাবস্থা  করে  দিতে ।

        এই  সময়ে  মেজর চিত্তরঞ্জণ দাস  এবং  মুক্তিযুদ্ধা  হবিগন্জের  ছাত্রলীগ  নেতা  মাহবুবুর  রব  সাদী  ও তার বড়ভাই  বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডেন্ট  মানিক চৌধুরী….শেরপুর দিয়ে যাওয়া    কুশিয়ারা  নদীর তীর    যাতে   পাকিস্তানী  সৈন্যরা অতিক্রম   করতে  না  পারে  তার  প্রতিরোধের  ব্যবস্থা  করছিলেন । 

       এমসি  কলেজের অধ্যাপকদের  কথা  শুনে  পরের দিন  সকালে  ভৈরব  পর্যন্ত  একটি  লঞ্চের  ব্যবস্থা  করে  দেন   । রাত্রে  আবার তোফায়েল  আহমেদ  ফিরে    এসে   তার স্যারদের খুশীর এই  সংবাদ  দিয়ে  চলে  যান ।  পরের  দিন  সকালে  ছাত্রলীগের  নেতা  এবং  মুক্তিযোদ্ধা  আখতার আহমেদ  ও  মখসুদুল  আজিজ  ইবনে লামা  সহ  তোফায়েল  আহমেদ  আমাদের  বাড়ি  থেকে  প্রিন্সিপাল  ডঃ  হারুনুর রসিদ  এবং  একজন  এরাবিকের  অধ্যাপক  ছাড়া  বাকি  সকলদের  শেরপুরে  নিয়ে  যান  এবং  তাদের  তাদের  গন্তব্যে   পৌঁছার  ব্যবস্থা  করে  দিয়ে ফিরে  আসার  সময়ে এই  খবরটি    আমাদের  বাড়ি  এসে  জানিয়ে  দিয়ে যান ।  তোফায়েল  আহমেদ  মুক্তিযুদ্ধ  থেকে  ফিরে  এসে  আওয়ামী  লীগের  নেতৃত্বে  নিজকে  প্রতিষ্ঠিত  করেন । বর্তমানে  আমেরিকায়  স্থায়ীভাবে  বসবাস  করছেন ।   

      তখন  মুক্তিযুদ্ধাদের  ঢাকা  সিলেট  মাহাসড়কে  আমাদের বাড়ি পর্যন্ত  দুইটি মুক্তিযুদ্ধা কেম্প ছিল  । একটি  চণ্ডিপুলের কাছে  অন্যটি  স্থাপন করা হয়   আমাদের  বাড়ি থেকে  প্রায়  ১ কিলোমিটার  উত্তরে  বর্তমানে  সিলেট  মেট্রোপলিটান  প্রাইভেট  বিশ্ববিদ্যালয়ের  চেয়ারম্যান  তৌফিক  আহমেদ চৌধুরীর  খালি  দুইটা  সেমিপাকা  ঘরে ।   তার  বাবা  মুজিবুর রহমান  বিলাতে  প্রবাসী  ছিলেন  তার  মা ও  ভাই বোন সহ তারা তখন  সিলেট শহরে  তাদের  সদ্যক্রয়কৃত  শেখঘাট কুলিয়ার পারের  বাসায়  বসবাস  করতেন । মুক্তিযুদ্ধের  ৩য়  কেম্প ছিল  শেরপুরে । তখন  সিলেট  এমসি  কলেজের  অধ্যাপকদের  খুব  সম্মানের  চোখে  দেখা  হত  অন্যান্য  সরকারী  চাকুরীদের  থেকে । অন্যদিকে  ভাইস প্রিন্সিপ্যাল   মতিন  সাহের  ছাড়াও  অন্য একজন  শিক্ষক  জনাব  …মজুমদার  তখনকার   এম সি কলেজের  হোষ্টেলের   ৪ নং ব্লকের    সুপার  অধ্যাপক  আকবর  আলি সহ আরো  কয়েকজন  অধ্যাপককে  নিয়ে  ভাদেশ্বর  গ্রামে  চলে  যান । তখন  সিলেটে  শিক্ষায় দীক্ষায়  অন্যসব  গ্রাম  থেকে  ভাদেশ্বর  গ্রামটি  অনেক  উন্নত  গ্রাম  ছিল । আকবর  আলি  সাহেবের  একছেলে  বর্তমানে  আলী আকবর  রাসেল  বুয়েটের  একজন  নামকরা  অধ্যাপক । বাংলাদেশ  স্বাধীন  হওয়ার  পরে  ২য়  ব্লকের  সুপার  শামসুর রহমান  সাহেব  বদলী  হয়ে  গেলে  আকবর  সাহেব  তার  ভাড়াটে  বাসা  ছেড়ে  ঐ হোষ্টেল  সুপারের  বাসায়  চলে  আসেন  এবং ২ নং ও ৪ নং  ব্লকের  সুপারের  দায়িত্বে ও কিছুদিন  ছিলেন  এবং পরে ২য়  ব্লকের  একক  দায়িত্বে  অনেকদিন  থেকেছেন ।

  ১২ এপ্রিল /৭১  সালে  মুক্তিযুদ্ধাদের   সুরমা  নদীর  কিন  ব্রীজ এবং  বর্তমান  সিলেট  সুনামগন্জের  বাইপাশ  রাস্তার  মুখের মেইন  রোডের  তেড়া পুলের কাছের  মুক্তিযুদ্ধাদের  প্রতিরোধ  ভেঙ্গে  আমাদের  বাড়ির  ২ মাইল উত্তরে রসিদপুরে  এসে  পাকিস্তান  আর্মিরা একটি কেম্প  স্থাপন  করে ।

      তখন  প্রিন্সিপাল  সাহেব এবং  এরাবিকের  অধ্যাপক  মেইন  রাস্তার কাছের  বাড়ীতে  থাকা  তাদের  জন্যে  নিরাপদ  হবে না মনে  করে  ভিতরে  কোনো  স্থানে  চলে  যেতে  চান । তখন  আমার  সঙ্গে  রাস্তায়  বিশ্বনাথ  থানার দেওকলস  গ্রামের  এমসি  কলেজের  ছাত্র  আব্দুল  হাইয়ের  সঙ্গে  দেখা  হয় । আমি  তাকে  আমাদের  বাড়ি নিয়ে  এসে  তাদের  সঙ্গে  কথা  বলতে  বলি ।   তাদের  সঙ্গে  কথা  বলে তিনি  পরেরদিন  ভোরে  এসে  তাদের  ১২  সদস্যের পরিবারের  সকলকে  তার  গ্রামে   নিয়ে  যান ।  এবং তার  নিজের  বাড়ীতে  প্রিন্সিপাল   সাহেবকে  এবং অন্য  এক বাড়ীতে  অপর জনকে থাকার  ব্যবস্থা  করে  দেন । তিনি  পরে  এডভোকেট  হয়ে  সিলেট  কোর্টে  প্রাকটিস  আরম্ভ  করেন ।
      মামা  অধ্যপক  আবদুল  আজিজকে ও মামীআম্মা ও ২ বছরের  সুমনা  আজিজকে সহ মামার  খালার  বাড়ি  আমাদের  বাড়ি  থেকে  ৩ মাইল  দক্ষিনে  সূনাতিতা  গ্রামে  পৌঁছে  দেয়া  হয়  তদের  নিরাপত্তা  বিবেচনা  করে  ।  আর  আমাকে  বাড়ী  ছেড়ে  যেতে  দেয়া  হয়নি  যদি  আমি  ভারতে  চলে  যাই  এই  ভয়ে    । তবে মামার  খালার   বাড়ীটি  ও  মেইন  সড়কের  ১ কিলোমিটারে  মধ্যে  ছিল ।  শিশু  সুমনা  আজিজের  গরুর  দুধের  ব্যবস্থা  না  থাকায় ৭/৮ দিন পরে  আবার তারা  নিজের   বাড়িতে রিস্ক নিয়েই চলে  আসেন ।তারা  যতদিন ঐ সুনাতাতার   বাড়িতে   থেকেছেন তখন আমি  একদিন  পর পর গ্রামের  রাস্তা দিয়ে  হেঁটে গিয়ে দুধ  পৌঁছে  দিতাম   সুমনা  আজিজের  জন্যে । কারণ  তাদের  হোষ্টেলের  বাসায়  তাদের  নিজেদের  একটি  গাভী  ছিল । তাই তার গরুর দুধ  খাওয়ার  অভ্যাস  হয়ে যায় ।

         ১১ /১২ এপ্রিল বিকালে  এম এ জি  উসমানী  দয়ামীর  বাজারে  এবং  পাশেই  তার  বাড়ীতে কিছু  বলে  যেতে  আসেন । আমার পরিচয়  ছিল তার  সঙ্গে ।  আমি  এই  সংবাদ  শুনে  তাকে  দেখতে  দয়ামীর  বাজারে  সঙ্গে  সঙ্গে  চলে  যাই ।  তখন  মুক্তিযুদ্ধারা  তাদের  পরবর্তী  করণীয়  কি  জানতে ও  সেখানে যান । তিনি  তাদেরকে  সবপ্রতিরোধ  বন্ধ  করে  শমসের নগর দিয়ে  এবং তেলিয়াপাড়া  চা  বাগান  হয়ে  নিরাপদে  আগরতলার  বর্ডার দিয়ে  ভারতে প্রবেশ  করতে  নির্দেশ প্রদান  করেন । 

     যাওয়ার  আগে  আমি  সহ  তার  পরিচিত  কয়েকজনকে আলাদা ভাবে  ঢেকে  নিয়ে  বলেন  এপ্রিলের ১৭   তারিখে  কুষ্টিয়া  জেলার   মেহেরপুরের  এক  নিরাপদ  এলাকায়  অস্থায়ী  প্রবাসী  সরকারের  স্বাধীনতার  ইস্তেহার ঘোষণা করা  হবে  এবং একটি  অস্থায়ী  মন্ত্রীসভা  গঠিত  হবে এবং  স্বাধীনবাংলা  বেতারকেন্দ্র তার  সরাসরি  প্রচার  করবে    ।  এবং  তাকে  সি এন সি  করে  মুক্তিযুদ্ধ  পরিচালনার  সব  দায়িত্ব  তাকে  দেয়া  হবে । আর একটি  খবর দেন যে ১৩ এপ্রিল  রাত  থেকে  ক্যালকাটা  থেকে  শক্তিশালী  মিডিয়াম  ওয়েভ  ট্রেন্সমিটারে  স্বাধীনবাংলা  বেতার কেন্দের প্রচার  নতুন ভাবে আরম্ভ  হবে এবং সমস্ত  বাংলাদেশে  তা  শুনা যাবে । এ দিকে ১৫ এপ্রিলের  মধ্যে  পাকিস্তান  আর্মিরা  সিলেট ও  মৌলবী  বাজার  শহর এবং  মেইন রোডে  তাদের  নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় । মুক্তিযুদ্ধারা  শেরপুরে কুশিয়ারা  নদীর তীরে পাকিস্তান আর্মিদের  প্রতিরোধ যুদ্ধে ঠিকতে না পেরে  অনেক  ক্ষয় ক্ষতির পরে শমসের নগর ও তেলিয়াপাড়া       চা বাগান হয়ে  আাগর তলা  চলে যান । সেখান থেকে  তারা  ট্রেনিং  গ্রহণ  করেন  এবং  আবার মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রস্তুতি শুরু করেন  আঞ্চলিক  কমন্ডারের  নেতৃত্বে  । আজকে এই পর্যন্ত ।  (এই  লেখায়  যে  তারিখের উল্লেখকরা  হয়েছে তার কিছু  হেরফের  হতে  পারে কারণ এটি আমার স্মৃতি থেকে  কোনো  লিখিত  তথ্য ছাড়াই  লিখেছি , ঐ সব  অনিচ্ছাকৃত ভূলের  জন্যে  আমি দুঃখিত )


মন্তব্যসমূহ