১৯৭১ সালে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি চারণ : (৪র্থ পর্ব



                                             ১৯৭১ সালে  আমার  ব্যক্তিগত  স্মৃতি  চারণ : (৪র্থ  পর্ব

         ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মীরক্রেক ডাউন অপারেশন  সার্চলাইট আরম্ভের পূর্বে  বাংলাদেশে  অবস্থানরত সকল  বিদেশী  সংবাদিক কে হোটেল ইনটারকনে ধরে নিয়ে হোটেলে আটকিয়ে রাখা  হয়। কিন্তু  রয়টার সংবাদ সংস্থার  একজন  সাহসী সংবাদিক হোটেলের  ষ্টোররুমে আত্মগোপন  করেন  এবং পরদিন খুবভোরে  একজন খৃষ্টান  পাদ্রীর  বেশে একটি  ছোট ক্যামেরা তার পরিচ্ছেদের ভিতরে লুকিয়ে  ঢাকা ভার্সিটি সহ আক্রান্ত  স্থানে গিয়ে অনেক লাশের ফটো তুলে সরাসরি বিভিন্ন যানে করে আখাউড়াতে পৌঁছেন ।  পরে পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম  করে ভারতের  আগরতলায় পৌঁছাতে  সক্ষম হন । এবং ২৫ মার্চ  রাতের পাকিস্তান  আর্মীর ক্রেকডাউনের  অনেকগুলো  সংবাদ  রয়টারে ছবি  সহ  প্রচারের  ব্যবস্থা  করেন । 

       পরে   ২৭ তারিখের  বিবসির  রাতের  খবরে  মার্কটালি তা বিস্তারিত  ভাবে  প্রচার  করেন । অন্যদিক  ক্যালকাটা বেতারের  সংবাদ  পাঠক দেবদুলার বন্দোপদ্যায় তা রাত  সাড়ে ১০টার  খবরে মিডিয়াম  ওয়েবে  প্রচার  করলে  বাংলাদেশের  সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । এই দুই  সংবাদ  সহ  ভয়েস অব  আমেরিকার বাংলা  সংবাদ  প্রচারের পর বাংলাদেশের  আনাচে কানাচে   এ সব  সংবাদ  ছড়িয়ে  পড়ে । এবং মুক্তিযুদ্ধের  পক্ষে জামাত  ছাড়া  সব  রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের  জন্য  প্রস্তুতি শুরু  করেন  ।

       এপ্রিলের  ২/৩  তারিখের  মধ্যে  জীবিত  সব  ইপিআর  সদস্যরাও  সিলেটের  মেজর টিলা ও  টিলাগড়  অঞ্চল সহ  অন্যান্য  নিরাপদ  স্থানে জড়ো হয়ে  স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধাদের  সঙ্গে  যোগাযোগ  স্থাপন  করে  সিলেট  শহরে  ব্যাপকভাবে যুদ্ধের  প্রস্তুতি  গ্রহণ  করেন ।

  
            এপ্রিলের ৩     তারিখে বিকালে হোষ্টেলের  সামনের  রাস্তায় 
ইপিআর এর  চলাচল  বৃদ্ধিপায় এবং সিলেট শহর  থেকে  আর্মীরা  চেকপোষ্ট  গুটিয়ে  ক্যান্টনমেন্টের  ভিতরে চলে যায় এবং হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে আরো সৈন্য আসা  আরম্ভ হয়  সেলেটে ।  তখন সিলেটে  কারফিউ  বলোবত  থাকলেও কোনো সৈন্য  শহরে না  থাকায়  শহরের  স্থানীয়  লোকজন  গ্রামে  চলে  যাওয়া আরম্ভ  করে এবং ৪/৫ এপ্রিলের  দিকে  সিলেট  শহর  প্রায় জনশুন্য হয়ে  পড়ে ।  

        শুধু বাহিরের সরকারি চাকুরিজীবি ছাড়া এবং প্রয়োজনে  মুক্তিযুদ্ধাদের  আশ্রয় দিতে  বা সাহায্য করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু লোক শহরে  থেকে  যান ,  মুক্তিযুদ্ধাদের  অনুরোধে । এমসি  ( সরকারী ) কলেজের হোষ্টেলের  সব  ছাত্র  ও  কর্মচারি  আগেই  হোষ্টেল  ছেড়ে  গ্রামে  চলে গিয়েছিলেন ।  শুধু  হোষ্টেলের ৫ ব্লকের ৫ দারোয়ান ছাড়া ।

        হিন্দু  হোষ্টেল  সুপার  হোষ্টেলের  বাহিরে  থাকতেন । বাকি ৪ জন তাদের  পরিবারের  সদস্য  সহ হোষ্টেলেই ছিলেন । ছাত্রদের  হোষ্টেল  আক্রমনের  টার্গেট  হতে  পারে ভাবে  হোষ্টেল  সুপাররা  ৫ এপ্রিল ভোরে প্রায়  এক কাপড়ে  হোষ্টেল  ছেড়ে   কাছের গাভীর  দুধের  ক্যাটেল  ফার্মে  আশ্রয়ের  আশায়  চলে  যান । এই  সংবাদ  শুনে  কলেজের  ষ্টাফূর্তি কোয়াটারের  আরো  ১২ পরিবারের সব  সদস্য এবং  কলেজের  প্রিন্সিপাল  ডঃ  হারুনুর রসিদ  ও  বন জঙ্গলের  ভিতরে  অবস্থিত  ক্যাটেল  ফার্মে  চলে যান । ফার্মের  ভিতরে  লোকের  আনাগুনা  লক্ষ্য  করে  পাকিস্তান  আর্মিরা হেলিকপ্টারে   মেসিনগান ফিট করে শেলিং  করা  আরম্ভ  করে । 

           তাই আমরা ১৫  পরিবারের  সদস্যরা  ঐ স্থানটি  নিরাপদ নয়  মনে  করে পরের দিন ৬ এ্রপ্রিল ভোরে   কলেজের  স্টাপ  কোয়াটারে  প্রিন্সিপাল  সহ সকলে চলে এসে  আশ্রয়  নেই । ৬ ও ৭ এপ্রিল এখানে রাত  কাটাই । ৮ এপ্রিল  সকালে  কিছু  ছাত্রনেতা ও মুক্তিযুদ্ধা  সিলেটে  ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষ করে ৯ এপ্রিল থেকে যুদ্ধের  পরিকল্পনা  গ্রহণ  করেন । কয়েকজন  ছাত্রনেতা  কলেজের  ষ্টাপ  কোয়াটার খালি  করে  আমাদের গ্রামে  চলে  যেতে অনুরোধ  করেন । এই  সময়ে আমার আব্বা আরএকজন লোক নিয়ে  আমাদের  বাড়ি  নিতে    স্টাফ কোয়াটারে আসেন । তখন সিলেটের  স্থানীয়দের  মধ্যে  অধ্যাপক  আব্দুল  আজিজ  এবং ৩নং ব্লকের হোষ্টেল সুপার এবং  সরকারী ( এমসি )কলেজের  ভাইসপ্রিন্সিপাল  আব্দুল  মতিন  চৌধুরীর  শশুড়বাড়ি  সব থেকে  কাছে  ছিল  । তাই এই  দুই জনের  সঙ্গে বাকি ১৩  পরিবারের  সবাইকে ভাগাভাগি করে  আমাদের  সঙ্গে নিয়ে গ্রামের  বাড়ির  পথে রওয়ানা দেই । তখন  রিস্কা সহ অন্যান  যানবহন চলাচল রাস্তায় সীমিত ছিল । মাত্র ২টি রিস্কা শিবগন্জের মেইনরোড যাওয়া পর্যন্ত পাওয়া যায় । আমার নানি সহ  বয়স্ক ৪ মহিলা এবং ২জন  বাচ্ছা  সহ তাদেরকে সিলেট ষ্টেশন রোড়ের ভুইয়ার পেট্রোল পাম্পে  পাঠিয়ে দিয়ে বাকিরা পায়ে হেঁটে  শিবগন্জের মেইন রোডে পৌছেঁ কয়েকটি রিস্কায় শুধু  ছোটদের সহ  মহিলাদের  তুলে ঐ পেট্রোল পাম্পে আমরা পুরুষেরা  পায়ে হেঁটে না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে দেই ।এবং সঙ্গে মামীআম্মার সঙ্গে আমার  আব্বাকে পাঠিয়ে দেই সবাইকে দেখে রাখতে । প্রায় ১ ঘণ্টায় ৪ মাইল পথ  পায়ে হেঁটে  বাকিরা ঐ স্থানে পৌঁছে যাই ।     ঐ সময়ে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল ।                                                       ,       


          ষ্টাফ কোয়াটার থেকে শিবগন্জের রাস্তায় খুব বৃষ্টির মাঝে আমান উল্লা সাহের  স্ত্রীর কোলে তোয়ালি পেছানো বাচ্ছাটি  মেঘে ভিজতেছে দেখে   ঐ রাস্তা দিয়ে একজন লোক  যাচ্ছিলেন তখন  তিনি  তার মাথার ছাতাটি  তাদের দিয়ে নিজে ভিজে চলেযান  ।

          আমাদের সাথে ২  হোষ্টেল সুপার ৫নং ব্লকের গনী  সাহেব আর ২নং ব্লকের  শামসুর রহমান  সাহেব এবং ষ্টাফ কোয়াটারের  জুনাব  শওকত আলি .আমান উল্লা  সাহেব  এবং এরাবিকের পরিবারের ৫ সদস্য সহ আরো একজন অধ্যাপক ছিলেন । আর প্রিন্সিপাল ডঃ হারুনুর রসিদ সাহেব ও তার স্ত্রী ও  ৫ ছেলেমেয়ে সহ আমাদের  সঙ্গে যান । আরো একজন ভাড়াতে বাসা থেকে আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন পরিবারের সদস্য সহ ।   তার সঙ্গে  আমার পরিচয় না  থাকায়  তার  নাম ভূলে গেছি  । ষ্টেশন রোড থেকে মুক্তিযুদ্ধাদের সংগঠনের কাজে নিয়োজিত  আওয়ামী  লীগের  নেতা লাল তজ্জমুল আলি সাহেব   আমাদের বাড়ি ১০ মাইল দূরে  কুরুয়াতে পোঁছাতে  একটি  বাসের  ব্যবস্থা  করে দেন প্রায় ৪ গুণ অতিরিক্ত  ভাড়ায় । আমাদের বাড়ি ঢাকা সিলেট  মহাসড়কের খুব কাছে । আমরা সকলে বিকেল প্রায় ৫ টায় আমাদের  বাড়ির সামনে পৌঁছে প্রায় ১০০ গজ পায়ে হেঁটে বাড়িতে পোঁছাই । আমার আব্বা আমাদের  কিছু আগে বাড়ি পোঁছে  সকলের  জন্যে বিকালের  চা  নাস্তা এবং রাতের  খাবারের  ব্যবস্থা   করে ফেলেছিলেন এই অল্প সময়ের  মধ্যেই ।  চলবে--- ( এই  লেখায়  যে  তারিখের উল্লেখকরা  হয়েছে তার কিছু  হেরফের  হতে  পারে কারণ এটি আমার স্মৃতি থেকে  কোনো  লিখিত  তথ্য ছাড়াই  লিখেছি , ঐ সব  অনিচ্ছাকৃত ভূলের  জন্যে  আমি দুঃখিত )


,





   





মন্তব্যসমূহ