শরতের শিউলি এবার ফুটেছে শ্রাবণেই ; শিউলি ফুলের নামের পৌরাণিক কাহিনী । সৌজন্যে জনকণ্ঠের প্রতিবদক সমুদ্র হক ও দৈনিক জনকণ্ঠ
ক্যাপশন যোগ করুন |
সমুদ্র হক ॥ শরতের নিশুতি রাতের ফুল শিউলি ফুটেছে শ্রাবণের মধ্যভাগেই। এলোমেলো হয়ে পড়ছে ঋতুবৈচিত্র্য। প্রকৃতিও বিরূপ। শিউলি ফোটার আগাম শরত বলে দিচ্ছে যত বর্ষাই থাক আমি আসছি। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই শরত বর্ষাকে তার ঘরে বসতে দিয়েছে। সুযোগও পেয়েছে বর্ষা। এবার প্রকৃতির যা মতিগতি তাতে শরত বর্ষা এক হয়ে মাঠে নামবে। বর্ষা দীর্ঘায়িত হবে- এমনটিই বলছেন জলবায়ুর গবেষকগণ। একই কথা আবহাওয়া বিভাগের। মধ্য শরতে ভারি বৃষ্টিপাতে ফের পাহাড়ী ঢল নামতে পারে।
শরত এক অমল ধবল ঋতু। শরতের পূর্ণিমা মনোমুগ্ধকর।
শরত শশীর (চাঁদ) খ্যাতি আবহমানকালের। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর
হাওয়া...’। তবে এবারের শরত তার রূপ কতটা ধরে রাখতে পারবে
আকাশের মেঘ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই বুঝি সব বুঝতে পেরে শিউলি আগেভাগেই ফুটে
সাজিয়েছে শরতের বরণডালা।
ফুলের মধ্যে শিউলিকে নিয়ে পৌরাণিক উপাখ্যান আছে, যে বেদনা বয়ে বেড়ায় শিউলি।
একবার এক রাজকন্যা প্রভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে সূর্যের। সূর্য প্রত্যাখ্যান করে
মর্তবাসিনীর হৃদয়ের আবেগ। বঞ্চনায় আতœহনন
করে অভিমানী রাজকন্যা। তার চিতাভষ্ম থেকে জন্ম নেয় এক বৃক্ষ। দিনে দিনে বৃক্ষটি
বেড়ে ওঠে। শিশিরভেজা এক মৌসুমে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় ফুটল মিষ্টি সৌরভ ছড়ানো
শুভ্র ফুলের রাশি। তবে ফুলগুলো ফুটল রাতের নিভৃতে। ঝরে পড়ল দিনের আলো ফোটার আগেই।
যেন সূর্যের আলো তাকে স্পর্শ করতে না পারে। নিশুতি রাতের এ ফুলই শিউলি শেফালী
নামেও পরিচিত।
শিউলি উপমহাদেশের নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও
উত্তর ভারত। বৈজ্ঞানিক নাম নিকট্যানথিস এ্যারবরটরিস্ট। গাছ তেমন বড় নয়। প্রচুর
শাখা-প্রশাখা। বাকল পুরু। ফ্যাকাশে রঙের। সরু শাখার দুই পাশে বিপরীত দিক ঘন পাতার
বিন্যাস। পাতা কিছুটা খসখসে। কিনার খাঁজকাটা। ডগা সরু। শীত ও বসন্তে পাতা ঝরে যায়।
তারপর নতুন পাতায় শাখা ভরে ওঠে। শরতে ফুল ফোটা শুরু হয়। শিউলির তুষার ধবল
পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো। তাতে শিশিরবিন্দু। নিচে উজ্জ্বল হলুদ বা
প্রায় কমলা রঙের বৃন্ত। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। মন ভরে ওঠে। হৃদয়ে আসে নিসর্গের
অনুভূতি। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর হতে ফুল ফুটতে থাকে। তখন এ ফুল দেখা যায় না। তবে
বাতাসে ভেসে আসে মিষ্টি সুবাস। জানান দেয় শিউলির অস্তিত্ব। খুব স্বল্প আয়ু এ
ফুলের। নিশির শিশিরভেজা ফুলগুলো ঝরে পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই। গাছতলা ভরে ওঠে স্নিগ্ধ
ফুলের সমারোহে। ভোরে ঘুম থেকে জেগে শিউলি কুড়াতে যাওয়ার উৎসাহ আনন্দ চিরকালের। আজও
প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের অনেককে স্মৃতির পাতা মেলে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ফুল কুড়ানোর
ছোট্টবেলায়। কুলা-ডালায় শিউলি ফুল নিয়ে আজও মালা গাঁথতে বসে অনেকে।
সেই ফুল ফুটছে এবার কিছুটা আগেই। শিউলি না ফুটলে
শরতের শুভ্রতা অপূর্ণই রয়ে যায়। আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যে শরতের মতো এমন স্নিগ্ধ ঋতু
আর নেই। শান্ত স্বভাবের শরত নিসর্গের রূপ মেলে ধরে। নদীর বুকে রূপালী বালুর চর।
তার ওপর মাথা দোলানো ঘন কাশবন। বিলঝিলে অগুনতি শাপলার হাসি। সকাল-সন্ধ্যায় নাকে
এসে ঝাপটা দিয়ে যায় শেফালীর সুরভিত মৃদু হাওয়া।
শরতকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কত লিখেছেন- শরত প্রাতের
প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে... ওগো শেফালী বনের মনের কামনা... হৃদয় কুঞ্জবনে
মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা... আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা বেঁধেছি শেফালী মালা....
শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে... সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা...
কবিগুরুর এমন অজস্র পঙ্ক্তি বাংলা সাহিত্য সুবাসিত করেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের পাঠকদের মনে থাকার কথা- লবুটলিয়ার জঙ্গলে শিউলি বনের কথাটি।
কত উপাখ্যান রচিত হয়েছে শিউলিকে ঘিরে। প্রণয়ের মানব-মানবীর কাছে শিউলি ফুলের মালা
অপার রোমান্টিকতা এনে দেয়। যেন শরত ঋতুর মতো। সেই শরতের শিউলি এবার ফুটেছে আগেই।
ঋতুগুলো বুঝি এলোমেলোই হয়ে গেল।
প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন