রক্তাক্ত সিলেট: স্বাধীনতা দিবস ভাবনা
লেখক : রাজেশ পাল
হলি আর্টিজান ম্যাসাকারের পরে আবারো ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ঘটেছে হযরত শাহজালালের স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি সিলেটে।এর মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধ ডজন মানুষ। যার মধ্যে দুইজন কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। আহত অর্ধশতাধিক। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তলব করা হয়েছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিটকে। তিনদিন ধরে চলছে রুদ্ধশ্বাস “অপারেশন টোয়াইলাইট”।
বন্দুকের নলের মুখে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবিরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে বাংলাদেশে তাদের অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে দেয়ার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ মদদ ও আর্থিক আনুকূল্যে এদেশে জঙ্গিবাদের কার্যক্রম শুরু হয়, এবং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানকে ইসলামীকরণের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি বিরোধিতাকারী পরাজিত শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে প্রথম জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয় যা বর্তমানে পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে আমাদের সকল অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে।
জঙ্গিরা আবারও জামায়াত শিবিরের প্রত্যক্ষ মদদে বিভিন্ন নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা জানি যে জামায়াতের অংশীদারিত্বে ৪ দলীয় জোটের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। জামায়াতের আমির গোলাম আযমের সময় থেকেই জামায়াতের জঙ্গিবাদের কানেকশন শুরু। পরবর্তীতে চার দলীয় জোটের আর এক শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আজিজুল হক এবং অন্য অংশের ফজলুল হক আমিনীর তত্বাবধানে আফগান ফেরত যোদ্ধাদের দিয়ে ও জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানো হয়। আমিনীই প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘আমরা হবো তালেবান বাংলা হবে আফগান।' তার এ বক্তব্যের মাধ্যমেই এ দেশে আফগান ফেরত তালেবান যোদ্ধাদের স্বাগত জানানো হয়েছিল এবং ঐসব ইসলামী দলগুলির প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদ্রাসাসহ অন্যান্য মাদ্রাসায় তালেবান যোদ্ধাদের চাকুরী দিয়ে, অস্ত্র ও বোমাবাজির ট্রেনিং দিয়ে, ইসলামী শিক্ষার অন্তরালে জঙ্গিবাদ বিকাশের পথ সুগম হয়েছিল। দেশের নূতন প্রজন্মের একটা অংশকে বিভ্রান্ত করে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের নামে তাদের নিকট বেহেস্তের টিকিট বিক্রির মাধ্যমে ‘মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী' এই মন্ত্রে দীক্ষিত করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো শুরু করে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জামায়াতে ইসলামের সমর্থনে সরকার গঠন করে তারা। তখন জামায়াত, সরকারে যোগদান না করলেও নেপথ্যে সরকারের অঘোষিত চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। আর বিএনপিকে সমর্থন দানের বিনিময়ে পরোক্ষভাবে তাদেরকে চাপে রেখে জামায়াত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে থাকে। সেই সময়েই জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোটের সহযোগিতায় আফগান ফেরত যোদ্ধারা তাদের নিরাপদ চারণভূমি ও ট্রানজিট হিসাবে বেছে নেয় বাংলাদেশকে। আইএসআই, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি দেশ এদেশের জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। এদের সাথে যুক্ত হয় ভারতভিত্তিক ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন, আইএম ও উলফা এবং পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জয় ই মোহাম্মদ, আল কায়দা, এবং লস্করই তৈয়বা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠন। তখন তারা কোন একশনে না গেলেও নামে বেনামে বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপ তৈরি করে অভিষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেই জঙ্গিরা একশন শুরু করে এবং তারই অংশ হিসাবে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার করে দশজন সংস্কৃতি কর্মী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা, শতাধিক লোককে আহত করে জঙ্গিরা। তারপর রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে টাইম বোমা আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে দশজনকে। ফরিদপুরের নানিয়ার চর গির্জাও হামলার শিকারে পরিণত হয় জঙ্গিদের। কোটালিপাড়ায় হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন সমাবেশ স্থলে প্রায় পঞ্চাশ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা সে যাত্রায় বেঁচে যান। এ হামলা প্রচেষ্টার মাধ্যমে হরকাতুল জেহাদ নামের জঙ্গিবাদী দলটির চেহারা উন্মোচিত হয় দেশের মানুষের কাছে।
সেই সময় শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঢাকা সফরের সময় আমেরিকার গোয়েন্দারা সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে ক্লিনটনের শ্রদ্ধা জানানোর বিরোধিতা করে রিপোর্ট দেয় যে, ক্লিনটন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে ওসামা বিন লাদেন এর তালেবান জঙ্গিরা তার ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। এ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ক্লিনটনের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগ শাসনের একেবারে শেষ সময়ে চাষারায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের অফিসে নৃশংস বোমা হামলা চালিয়ে একুশজন নেতা কর্মীকে হত্যা করে তারা।
২০০১ এক সালে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে ফলাফল জালিয়াতির নির্বচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াতজোট সরকার। এবার আর জামায়াত বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে থেকে সমর্থন না জানিয়ে সরাসরি ক্ষমতার অংশীদার হয়। ওই সময় দরকষাকষি করে সমাজকল্যাণ, কৃষি মন্ত্রণালয় পরে শিল্প মন্ত্রণালয় এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পোর্টফলিও বাগিয়ে নেয় জামায়াত। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী প্রথমে কৃষি এবং পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে বাধাহীনভাবে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।
আলী আহসান মুজাহিদ তখন তাদের অনুসারী কয়েক হাজার এনজিওকে নিবন্ধন দিয়ে এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে টাকা পয়সা ছাড় করিয়ে তাদের কর্মী বাহিনীকে গায়ে গতরে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলেন। আর মতিউর রহমান নিজামী তার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জেটিতে দশট্রাক অস্ত্র খালাস করিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্র চোরাচালানের কাজটি করেন। সেই সময়ই বগুড়াতে কয়েক লক্ষ গুলি, অস্ত্রশস্ত্র ধরা পরে। কিন্তু অদৃশ্য এক সুতার টানে এত বড় দুইটি অস্ত্র চোরাচালান মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধান মন্ত্রীত্বকালে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে জঙ্গিরা। এই সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গিদের জন্য হয়ে ওঠে স্বর্ণযুগ। বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের আড়ালে বেড়ে ওঠা জঙ্গিরা। খালেদা জিয়ার এই মেয়াদে জঙ্গিরা বার বার আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার টার্গেট করে। তখন হরকাত-উল জিহাদ হুজির প্রধান মুফতি হান্নানের মার্সি পিটিশনে সুপারিশ করে তার মুক্তির সুপারিশ করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বিশেষ করে বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান ও দি টাইমস এ নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্ট করে। ২০০২ সালের ১৫ অক্টোবর দি টাইমস ম্যাগাজিনে এলেক্স পেরির এক এক্সক্লুসিভ নিবন্ধে বলা হয়, এমভি মক্কা নামক একটি জাহাজে চড়ে ১৫০ জন আফগান ফেরত সশস্ত্র যোদ্ধা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেই যোদ্ধারাই দেশের মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি তৈরিতে লিপ্ত হয়। এ জঙ্গিদের সহযোগিতায়ই তৎকালীন সরকার বেছে বেছে আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল নেতাদের খুন করার মিশনে নেমে পড়ে। এ খুনের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শেখ হাসিনা সরকারের সফল অর্থমন্ত্রী- এসএসএস কিবরিয়া, বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা- আহসান উল্লাহ মাস্টার, মমতাজ উদ্দিন, খুলনার- মনজুরুল হক এডভোকেট, সাংবাদিক শামসুর রহমান বালু প্রমুখ। তারপর থেকে সিনেমা হল, মাজার, উপাসনালয়ে বোমা হামলা করে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে থাকে।
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সন্ত্রাস বিরোধী জনসভায় এক জঘন্য কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী সমর্থককে হত্যা করে এবং এ হামলায় প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করে। সেই নৃশংসতম গ্রেনেড হামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ধামাচাপা দেয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করে।
২০০৭ সালে জরুরী শাসনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে এবং এ নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকায়। যার প্রধান আসামী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। একটা সময়ে এসে বিএনপি-জামায়াত জোটের সৃষ্ট জঙ্গিরা তাদের জন্যই ফ্রাঙ্কেস্টাইন হিসাবে আবির্ভূত হয়। ২০০৪ সালের ২১ মে বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশের নিজের মাতৃভূমি সিলেটে শাহজালাল (র) মাজার জিয়ারত করতে এসে জঙ্গিদের বোমা হামলার শিকার হন। তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই বোমা হামলায় তিন চারজন সাধারণ মানুষ নিহত ও শতাধিক লোক আহত হয়।
বিএনপির এই শাসনামলে জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় মহড়াটি দেয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের তেষট্টি জেলার ৫২৭ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে। এই বোমা হামলায় ২৫০টির মত মামলায় গ্রেফতারকৃত অধিকাংশ আসামী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদেরকে কোনো না কোনোভাবে জামায়াত রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বলে বলেছে। এ বোমা হামলার মাধ্যমে তারা তাদের শক্তি ও সামর্থ্য জানান দিয়ে দেশের ভেতর একটা আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে বাগে রাখার চেষ্টা করে। এই সময়ে জঙ্গিরা বিএনপি-জামায়াতের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামি, আজিজুল হক ও ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের তত্বাবধানে আফগান ফেরত যোদ্ধাদের দিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানো হয়। দেশব্যাপী এ নৃশংস কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ শুরু হলে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন দেশে বাংলা ভাইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই; তার সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুর রহমান বাবর (বাংরেজি নামে খ্যাত) ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন দেশে বাংলা ভাই বা ইংরেজি ভাই বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, স্বয়ং খালেদা জিয়া বলেছিলেন দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার জন্য আওয়ামী বাকশালীরা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইসহ যাদের ফাঁসি হয়েছে এদের সবাই এক সময় জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল।
এ ছাড়াও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এ সব জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম বিস্তার করে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে আরো বেগবান করা হয়েছে বলে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী জরিপে বেরিয়ে আসে।
এভাবেই এরে পর এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় ধীরে ধীরে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। সে সময় পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত অপরাধ সংক্রান্ত সভা থেকে ৩১টি জঙ্গি ও চরমপন্থি সংগঠনের তালিকা তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছিল। তার ওপর ভিত্তি করেই হুজি, জেএমবি, জেএমজেবি, শাহাদাৎ আল হিকমার বিভিন্ন উপগ্রুপের নাম সন্নিবেশিত আছে। পুলিশ তদন্তে আরো বেরিয়ে এসেছে যে, জেএমবি থেকে ইসলাম ও মুসলিম, মুসলিম শরিয়া কাউন্সিল, আল্লার দল প্রভৃতি এবং হুজি থেকে আইডিপি, হরকত উল মুজাহেদীন, তওহীদ জনতা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠনের উপদল সৃষ্টি হয়েছে। যা আসলেই জামায়াতেরই বিভিন্ন ফ্রন্ট।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আবুল বারাকাতের মতে ১২৫টি, আর কিছুদিন আগে একটি সহযোগীর এক অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে দেশে ১০০টি জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব আছে বলে উল্লেখ করেছিল। এ সব জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রাথমিক ভাবে ৪টিকে নিষিদ্ধ ও ১২পি সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগঠন গুলো হলো-হিজবুত তাওহীদ, আল্লার দল, তওহীদি ট্রাষ্ট, হিজবুত তাহরীর, তামির উদ দীন, বাংলাদেশ ইসলামী সমাজ, উলামা আঞ্জুমান, আল বাইয়্যানিয়াত, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি ইত্যাদি। এর বাইরেও তানজিম ইসলামী, ইসলাম ও হরকাতুল মুজাহেদীন, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী দাওয়াত ই কাফেলা, মুসলিম মিল্লাত, শাহাদাৎ ই নবুয়ত, হিজবুল্লা শরিয়া কাউন্সিল, জইশে মোস্তফা, তওহীদি জনতা ও আল তুরা সহ বেশ কিছু সংগঠন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে ওঠার পরে সেই আন্দোলনকে ঠেকাতে গড়ে ওঠে হেফাজতে ইসলাম। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি ইস্যুতে তাদের চরম উগ্রপন্থী অবস্থান ইতিমধ্যেই ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। এই হেফাজতে ইসলামের অনেকের বিরুদ্ধেই অতীতে জঙ্গিবাদী কানেকশনের অভিযোগ রয়েছে। এর মাঝে ভোটের রাজনীতির স্বার্থে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত বর্তমান সরকারের অনেকটা নমনীয় মনোভাব, ক্ষেত্রবিশেষে তোষণ নীতি ক্রমশই বেপরোয়া করে তুলছে তাদের। ফলে উৎসাহিত হচ্ছে জঙ্গিরা। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরে সুকৌশলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে মৌলবাদের প্রবেশ করানো হয়েছে, তার বিষময় ফলই এখন ফলতে শুরু করেছে।
বলা বাহুল্য যে, সমাজের একটি বিরাট অংশই এখন এই জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিভিন্ন নিউজ-পোর্টালের নীচের কমেন্টগুলো দেখলেই তা বোঝা যায় সহজে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু জ্ঞানপাপী মডারেট সুশীল সমাজ যারা মৌলবাদের অস্তিত্বই স্বীকার করেননা, উল্টো এসব ইহুদী, নাসারা, সাম্রাজ্যবাদের অপপ্রচার মনে করে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।
হলি আর্টিজানের ম্যাসাকারের স্মৃতি ম্লান না হতেই সিলেটের রক্তাক্ত মুখগুলো হাজির হয়েছে দুঃস্বপ্নের মতোই। প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে অভিসম্পাত এই অভিশপ্ত জাতিকে। স্বাধীনতার ৪৬তম বার্ষিকীতে এসে তাই অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে একাত্তরের চেতনা। পেছন পথে চলতে চলতে ক্রমশ খাদের কিনারে এস দাঁড়িয়েছি আমরা। একবার পতন হলেই হারিয়ে যেতে হবে কালের অন্ধকার ক্যানিয়নে চিরকালের মতোই।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থে, তাদের সুন্দর অনাবিল ভবিষ্যতের স্বার্থে আমাদের এখনই প্রয়োজন রুখে দাঁড়ানোর। মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে দুর্গে একাত্তরের মতোই। না হলে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের অন্ধকার জীবনের জন্য আমাদের ক্ষমা করবেনা কোনোদিন। যেমন ক্ষমা করবেন না ৩০ লক্ষ শহীদ তাদের রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতাকে এভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিদের হাতে ভূলুণ্ঠিত হতে দেওয়ার জন্য।
রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন