»
‘শিক্ষার্থীদের প্রাথমিকভাবে জঙ্গিবাদের ধারণা দেয়া হয় কওমি মাদরাসাগুলোতে’
Sponsored by Revcontent
সময়ের কণ্ঠস্বর- বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদের প্রাথমিক ধারণা পায় উল্ল্যেখ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ হিসেবে মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিকভাবে জঙ্গিবাদের ধারণা দেয়া হয়।
রবিবার রাজধানীতে ১৪ দেশের পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্মেলনের প্রথম দিন ‘বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান’ শীর্ষক প্রবন্ধে মনিরুল এই মন্তব্য করেন।
মনিরুল বলেন, অভিজাত শ্রেণির সন্তানদের অর্থের প্রাচুর্যের কারণে তারা বিদেশি ও পশ্চিমা বিশ্বের সমাজকে অনুকরণ করছে। তারা দেশি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। এ সুযোগে জঙ্গিবার তাদের প্রভাবিত করে বিপথে ফেলে। আর অতিদরিদ্ররা সুযোগ নিয়েও নিজেদের পথে নিয়ে যায় জঙ্গিরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৯৯০ দশক থেকেও জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা শুরু। গত বছর পর্যন্ত জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে আটকদের বেশিরভাগই কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে এ নিয়ে মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারির দাবি উঠে। তবে মাদ্রাসার পক্ষ থেকে বরাবর বলা হয়েছে, তারা ইসলামের দীক্ষা দেন, জঙ্গিবাদের নয়। তবে সম্প্রতি ইংরেজি পড়ুয়া এবং উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যেও জঙ্গি তৎপরতায় জড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়।
মনিরুল আরও বলেন, বিশেষ করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত তিনজন ছিলেন ইংরেজি মাধ্যমপড়ুয়া। এদের একজন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসেছেন। এক সপ্তাহ পর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলাকারী দুইজনের একজনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এরপর নর্থ সাউথের আরও অনেকের জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়ও বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ এসেছে যাদের একটি বড় অংশই উচ্চবিত্ত শ্রেণির।
- হিন্দু ও নাস্তিকদের
বিরুদ্ধে জামায়াত-হেফাজতীদের জিহাদ ; by শাহরিয়ার কবির
- শাহরিয়ার
কবির
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রায় দু’শ’ বছর শাসনের পর ১৯৪৭
সালে বিদায় নেয়ার আগে ভারত ভেঙ্গে ধর্মের নামে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম ও
সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন-পীড়ন-শোষণের
বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহ হয়েছে,
আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছেÑ যার
ভেতর উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, ঔপনিবেশিক
শাসকরা যাকে আখ্যায়িত করেছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ হিসেবে, অন্যদিকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন
ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ।
ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে এসব বিদ্রোহ ও যুদ্ধ চরিত্রগতভাবে ছিল
অসাম্প্রাদয়িক। ধর্ম-ভাষা-জাতিসত্তা-বিত্ত-লিঙ্গ নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সর্বস্তরের
মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছে। নিজেদের শাসন-শোষণ-পীড়ন নির্বিঘœ করার জন্য ব্রিটিশরা সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি গ্রহণের পাশাপাশি
তল্পিবাহক ভারতীয় (ব্রাউন সাহিব) তৈরি করেছিল, যাদের
মনোজগতে প্রোথিত ছিল দাসত্বের তৃপ্তি। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সফল না হলেও
ঔপনিবেশিক শাসকরা বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষে প্রধান দুই ধর্মীয়
সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের পতন অনিবার্যÑ এ কারণেই তারা হিন্দুদের ভেতর হিন্দুত্ব এবং মুসলমানদের ভেতর ইসলামিত্ব
বিকাশের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের পর এই বিভাজন
প্রকট হতে থাকে, সংঘটিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং
অনিবার্য হয়ে ওঠে ধর্মের নামে দেশ ভাগ।
পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তি জীবনে কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ
ছিলেন। বিয়ে করেছেন অমুসলিম নারীকে এবং তার কন্যাও অমুসলিম বিয়ে করেছিলেন। লাল মদ
ও হ্যাম সসেজ তার খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য ছিল। নামাজ-রোজার তোয়াক্কা করেননি কখনও।
রাজনীতিও আরম্ভ করেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস থেকে। রক্ষণশীল খিলাফত আন্দোলনের
প্রতি গান্ধীর সমর্থন তিনি পছন্দ করেননি। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই জিন্নাহ
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক হয়েছেন। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী জিন্নাহ যখন দেখলেন
কংগ্রেসে গান্ধী, নেহরু,
প্যাটেলের মতো জাঁদরেল নেতারা থাকার কারণে স্বাধীন ভারতে তিনি
কখনও রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। সেজন্য তিনি কবি ইকবাল ও রহমত আলীর ধর্মীয়
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন এবং মুসলমানদের জন্য সাম্প্রদায়িক
রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আগ্রহী হয়েছিলেন। ভারতবর্ষের দশ লাখ নিরীহ
মানুষকে জীবন দিয়ে দেশ ভাগের মাসুল দিতে হয়েছিল।
সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ব বাংলার বাঙালীদের সন্দেহের
চোখে দেখেছে, যখন
বাঙালীরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। যদিও
আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে বিভ্রান্ত বাঙালী মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছে;
কিন্তু এই কৃত্রিম, সাম্প্রদায়িক
রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। ’৪৮
সালে সূচিত ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত
প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনা এ দেশের
মানুষের মনোজগতে বিস্তার লাভ করেছে এবং দুই যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বাংলাদেশের
মাটিতে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেছিল।
স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর
সহযোগী যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা দায়বদ্ধ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক
বাঙালিত্বের চেতনার প্রতি। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার
মূলনীতিতে বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাও যুক্ত হয়েছিল।
‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’,
‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আদর্শ সংবিধানে সীমাবদ্ধ না
রেখে সর্বস্তরের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার
কর্তৃক গঠিত ‘কুদরাত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন’। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আগেই জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর প্রধান সহযোগীÑ যাঁরা
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন
করেছেন তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বকে
হত্যা করেছিল পরাজিত পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, স্বাধীন বাংলাদেশে যাদের রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
১৯৭৫-এর পর থেকেই এই অপশক্তি বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ,
সংস্কৃতির পাশাপাশি শিক্ষানীতিরও ‘ইসলামীকরণ’
তথা পাকিস্তানীকরণ আরম্ভ করেÑ যার মাসুল এখনও আমাদের গুনতে হচ্ছে।
সংবিধানের মতো পাঠ্যপুস্তক থেকেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে
ফেলে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টির উদ্যোগ প্রথম নিয়েছিলেন বিএনপির
প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। এই উদ্যোগ আরও বিস্তৃত করেছেন তার রাজনৈতিক ও
পারিবারিক উত্তরাধিকারী জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া। তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে ’৭১-এ পরাজিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি
প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান সুদৃঢ় করেছে, মুক্তিযুদ্ধের
যাবতীয় অর্জন মুছে ফেলে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক
সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েও স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী,
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রশাসন মুক্ত করতে
পারেননি।
আমরা জানি ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ
করে শেখ হাসিনা ’৭১-এর
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছেন, সংবিধানের চার
মূলনীতি পুনর্¯’াপন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি নির্যাতিত
নারীদের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর সরকারের বিস্ময়কর
অগ্রগতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও মনোযোগ ও প্রশংসা অর্জন করেছে। এর পরও যখন আমরা
মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হুমকি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সামনে মহাজোট
সরকারের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখি তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হই।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের
সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীর ভেতর বিনামূল্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ বই বিতরণ করেছে অত্যন্ত
উৎসবমুখর পরিবেশে। এটি যে কোন দেশের সরকারের জন্য একটি বড় সাফল্য এতে কোন সন্দেহ
নেই। জাতীয় গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সরকারের এই সাফল্যের সংবাদ প্রকাশিত
হয়েছে। অথচ তিনদিন পর থেকেই ভয়ঙ্কর সব খবর পত্রিকায় বের হতে লাগল। বিভিন্ন শ্রেণীর
পাঠ্যপুস্তকে বানান ভুল, বিভ্রান্তিকর
ও বিকৃত তথ্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম লেখকদের রচনা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক
রচনার অন্তর্ভুক্তির সংবাদ বিশালতম এক অর্জন এক মুহূর্তে নস্যাত করে দিল।
পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পর্কে গণমাধ্যমে বলা হলো হেফাজতে ইসলাম এবং
তাদের সহযোগী অপরাপর মৌলবাদী গোষ্ঠী গত কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের
বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘হিন্দুত্ববাদী’
ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ আখ্যা দিয়ে আবহমান বাংলার খ্যাতিমান লেখকদের রচনা বাদ দিয়ে তাদের
পছন্দের তথাকথিত ইসলামী ভাবধারার রচনা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন করছিল।
হেফাজতীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ হয়ে গেছে
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে আরম্ভ করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল
নিদর্শনসমূহ। লেখকদের এই তালিকায় জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র,
লালন ফকির থেকে আরম্ভ করে হুমায়ুন আজাদের মতো বরেণ্য লেখকরা
রয়েছেন।
হিন্দু ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জামায়াত-হেফাজতীদের জিহাদ নতুন কোন
বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলনের নায়ক থেকে আরম্ভ করে ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারাÑ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ছিলেন পাকিস্তানীদের ভাষায় ‘হিন্দু’, ‘নাস্তিক’, ‘ভারতের চর’, ‘ইসলামের দুষমন’ ইত্যাদি। পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই আইনসভার
অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা
ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন তখন তাকে উপরোক্ত বিশেষণে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। একইভাবে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের মুখপত্রে দেশের সূর্যসন্তান
মুক্তিযোদ্ধাদেরও একই বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকরা উত্তরাধিকার
সূত্রেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিভাজন নীতি অর্জন করেছিল, যা প্রয়োগ করে তারা চব্বিশ বছরের প্রায় ঔপনিবেশিক শাসন বাংলাদেশে কায়েম
রাখতে পেরেছিল।
বাংলাদেশে ’৭৫
পরবর্তী পাকিস্তানপন্থী সরকারগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি অনুসরণ
করেছে। জামায়াত নেতা এবং ঘাতক আলবদর বাহিনীর অধিনায়ক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদরদের এক সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, এ
দেশের কোন পাঠাগারে বা বইয়ের দোকানে হিন্দু লেখকদের বই থাকতে পারবে না, পাঠ্যপুস্তক থেকেও হিন্দুদের লেখা বাদ দিতে হবে। এটি ছিল পাকিস্তানের
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
দিতে গিয়ে আমি এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছিলাম এভাবে জামায়াত নেতারা
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে গণহত্যার আদর্শিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ট্রাইব্যুনালে
মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। অথচ যে হেফাজত এখন ’৭১-এর
জামায়াতের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা বাদ দিতে বলছে এর জন্য দণ্ড
দেয়ার বদলে তাদের দাবি মেনে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ধর্মশিক্ষা
বাধ্যতামূলক ছিল না। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তর
থেকে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়েছে। পাকিস্তান আমলে স্কুলে আমরা বিবর্তনবাদ
পড়েছি। বাংলাদেশে স্কুলের বিজ্ঞান বইয়েও ডারউইন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
হেফাজত যাদের লেখা ইসলামবিরোধী বলে বাদ দিতে বলেছে এবং সরকারের
শিক্ষা বিভাগ তা অনুমোদন করেছেÑ এদের অন্যতম বরেণ্য কবি, কথাশিল্পী
ও গবেষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। তার ‘বই’ কবিতাটি হেফাজতের পরামর্শে বাদ দেয়া হয়েছে। এই কবিতার যে অংশ নিয়ে
হেফাজতের আপত্তি সেটি হচ্ছেÑ ‘যে বই
তোমায় দেখায় ভয় / সেগুলো কোনো বই-ই নয় / সে বই তুমি পড়বে না। / যে বই তোমায় অন্ধ
করে / যে বই তোমায় বন্ধ করে / সে বই তুমি ধরবে না।’ হেফাজতের
দাবি হচ্ছে ‘এখানে ধর্ম ও কোরানকে আক্রমণ করা হয়েছে।’
যদিও হুমায়ুন আজাদ এই কবিতায় কোথাও বলেননি কোরান ভয় দেখানো কিংবা
অন্ধ বানাবার বই।
প্রকাশিত : ১২ মার্চ ২০১৭
- শাহরিয়ার
কবির
(গতকালের পর)
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে ইসলাম ধর্মের বই বা কোরানকে হুমায়ুন আজাদ নয়-
হেফাজত মনে করছে ‘ভয়
দেখানো অন্ধকারের বই’! বাংলাদেশের ৯৯% মুসলমান কখনও বলবেন
না কোরান ভয় দেখানো অন্ধকারের বই। কোরানের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে তারা
বলবেন কোরান মানুষকে আলোকিত করে। শুধু ইসলাম ও কোরানবিদ্বেষী নাস্তিকরাই বলতে
পারেন ‘কোরান ভয় দেখানো অন্ধকারের বই’। হেফাজত কাদের নাস্তিক বলছে?
ইসলামের মহানবী তার উম্মতদের জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন
পর্যন্ত যেতে বলেছেন। জ্ঞানের যদি ধর্ম থাকে তাহলে মহানবীর উম্মতরা চীনে গিয়ে
ইসলামী জ্ঞান অর্জন করবেন না, বরং বৌদ্ধ-নাস্তিক-কনফুসিয়ান জ্ঞানপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু মহানবী জানতেন
এবং সবাই জানেন- জ্ঞানের বা ভাষার কোন ধর্ম নেই। ভাষার ওপর কিংবা জ্ঞানের ওপর
ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার।
পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে
শাসকরা আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করতে চেয়েছিল। তাদের বিবেচনায় আরবী আল্লাহর
ভাষা, মুসলমানদের ভাষা আর বাংলা
হিন্দুদের ভাষা! নজরুলের কবিতার ‘মহাশ্মশান’ কেটে তারা ‘গোরস্তান’ বানিয়েছিল, জসীম উদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার শিরোনাম পাল্টে ‘দাওয়াত’ লেখা হয়েছিল। এখন যেমন হেফাজতের আবদার
রাখতে গিয়ে একটি চরিত্রের ‘উত্তম’ নাম বাদ দিয়ে ‘অলিউল’ রাখা হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষের সরকারের ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হয়ে হেফাজতীরা বাংলাদেশকে
পাকিস্তান বানাবার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। ’৭৫-এর পর থেকেই
মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের জামায়াতীকরণ ও হেফাজতীকরণ হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে সাধারণ
পাঠক্রমের হেফাজতীকরণ। ‘উত্তম’কে
অলিউল বানাবার পর হেফাজত নিশ্চয় আবদার করবে ‘রবীন্দ্রনাথ’
না লিখে ‘শামস উদ্দীন’ লিখতে হবে! ‘মন্দির’ শব্দটি
থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’
কবিতাটি বাদ পড়েছে। তবে কি পাকিস্তানের মতো ‘মন্দির’কে ‘মসজিদ’
বানিয়ে আমাদের গাইতে হবে- তোমার দুয়ার আজি ভরে গেছে সোনার ‘মসজিদে’!? হেফাজতীরা ‘রামছাগল’কে কী বলবেন? আমরা কি কাউকে ‘রামধোলাই’ দিতে পারব না? হেফাজত যা করছে তা কখনও ইসলাম
সমর্থক হতে পারে না। এসব হচ্ছে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার সুদূরপ্রসারী
রাজনৈতিক চক্রান্তের অন্তর্গত। এভাবে পাকিস্তান তাদের এদেশীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের গণমাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের
সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রচ- সমালোচনা হলেও জামায়াত-হেফাজত সমর্থক গণমাধ্যমে সরকারের
ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ কোন মন্তব্য না
করলেও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর হেফাজতের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী
সাম্প্রদায়িক হুমকি ও সন্ত্রাসের সমালোচনা করেছেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি (২০১৭)
চট্টগ্রামে সংস্কৃতিকর্মীদের এক সমাবেশে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খোলাখুলি
হেফাজতের সমালোচনা করেছেন।
‘পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রতিক রদবদলে সাম্প্রদায়িক
দৃষ্টিভঙ্গির যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘একজন সরকারী কর্মকর্তা আমাকে বললেন, যে
পরিবর্তনগুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, আমি বিশদ পড়েছি কি-না।’
‘আমি বলেছি, আমার তো পড়ার
দরকার নেই। যে পরিবর্তনকে হেফাজত বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানায়, সেটি আমার না পড়লেও চলে।’
‘গত বছরের ডিসেম্বরে সুপ্রীমকোর্টের মূল ভবনের
সামনে রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’-এর আদলে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পর তা অপসারণের দাবিতে কর্মসূচী দেয়
হেফাজতে ইসলাম। ইসলামী সংগঠনটির একটি প্রতিনিধিদল গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রীমকোর্টে
গিয়ে প্রধান বিচারপতি বরাবরে একটি স্মারকলিপি দিয়ে আসে। সেখানে ওই ভাস্কর্যকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যায়িত করে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের আজ্ঞাবাহী এক শ্রেণীর পেইড ও
প্রপাগান্ডিস্ট মিডিয়া এবং ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার অপশক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ
বৃহত্তর তৌহিদি জনতার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইমান-আকিদার বিরুদ্ধে নানা ধরনের
সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় অপতৎপরতা
চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল, পাঠ্যপুস্তক
থেকে বাদ দেয়া নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজনের দাবিও করছে।’
(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮
ফেব্রুয়রি ২০১৭) ইসলামের নামে মহাতাণ্ডব ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী হেফাজতে ইসলাম গঠিত
হয়েছে ২০১০ সালে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আহমদ শফীর নেতৃত্বে
গঠিত কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের এই সংগঠনটি আলোচনার পাদপ্রদীপের নিচে এসেছে
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ
করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে সূচিত ছাত্র-জনতার মহাজাগরণের পর। এককালে
জামায়াতে ইসলামীর সমালোচক দেওবন্দি শফী হঠাৎ জামায়াতের পক্ষে খোলাখুলি মাঠে
নামলেন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বিশাল এক
খোলা চিঠি লিখে তিনি গণজাগরণ মঞ্চ ও নির্মূল কমিটির নেতাদের ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত
করে ফতোয়া জারি করলেন। এরপরই শুরু হলো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর হামলা ও
হত্যাকাণ্ড, যার প্রথম বলি ছিলেন শাহবাগের তরুণ ব্লগার
রাজীব হায়দার।
ব্লগার হত্যার পর ২০১৩ সালের এপ্রিল ও মে মাসে হেফাজত দুটি মহাসমাবেশ
করে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যে মহাতাণ্ডব এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছে তার ওপর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে আমরা প্রায় তেরো শ’ পৃষ্ঠার
শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি। হেফাজত দাবি করেছিল ৫ মে (২০১৩) মতিঝিলের শাপলা চত্বরে
সরকার তাদের মহাসমাবেশ ভাঙ্গতে গিয়ে রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা
করেছে। শ্বেতপত্রে হেফাজতের নেতাদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা ৪৬ জন নিহতের নাম
পেয়েছি, যারা শাপলা চত্বরে নয়, নিহত
হয়েছেন রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন এলাকায়, ৫ ও ৬ মে পুলিশের
সঙ্গে হেফাজত-জামায়াতের সশস্ত্র সংঘাতে। নিহতদের তালিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য,
আওয়ামী লীগের কর্মী এবং দলীয় পরিচয়হীন নিরীহ পথচারীও ছিলেন।
আমাদের শ্বেতপত্রে হেফাজতের মিথ্যাচার উন্মোচনের পর এ নিয়ে তারা টুঁ শব্দ উচ্চারণ
করেনি।
হেফাজত দাবি করে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা শ্বেতপত্রে হেফাজত
নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও তুলে ধরেছি। সংগঠনের আমির আহমদ শফীসহ হেফাজতের
শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা একদিকে ’৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ও
নেজামে ইসলাম এবং পরবর্তী সময়ের ইসলামী ঐক্যজোট প্রভৃতি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলের
সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও হেফাজতের শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধকালে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’-এর আদলে ‘মুজাহিদ বাহিনী’ গঠন করে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০১৩ সালের ৫ মের মহাতাণ্ডবের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, হেফাজত-জামায়াতকে আর ছাড় দেয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থানের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের বেশ কয়েকজন রাঘব
বোয়ালকে গ্রেফতার করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হেফাজতের নেতারা বলেছেন
জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতায় তারা কীভাবে সরকার উৎখাতের ‘জিহাদে’
অংশ নিয়েছিলেন। শাপলা চত্বরের মহাতাণ্ডব এবং শীর্ষ নেতাদের
স্বীকারোক্তির পর হেফাজতের রাজনৈতিক অভিলাষ গোপন কোন বিষয় নয়। তারা কী রকম সরকার ও
রাষ্ট্রব্যবস্থা চান সেটি বর্ণিত হয়েছে শাপলা চত্বরে ঘোষিত তাদের ১৩ দফা
কর্মসূচীতে।
হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পর কৌশলগত কারণে সংগঠনের নেতারা
সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রেলের জমি ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থের ভাগাভাগি
নিয়ে হেফাজত নেতাদের অন্তর্কলহের সংবাদ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। ঘুষ
দিয়ে সরকার হেফাজতকে রাজপথের আন্দোলন ও সন্ত্রাস থেকে বিরত রাখতে সাময়িকভাবে সফল
হয়েছে বটে- তাদের গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা কখনও বন্ধ হয়নি। হেফাজত-জামায়াত গ্রামে
গ্রামে ইসলামী দাওয়াতের নামে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কর্মীদের মনোবল
চাঙ্গা রাখার জন্য হেফাজত নেতারা মাঝে মাঝে হুঙ্কার দেন- তারা ১৩ দফা কর্মসূচী
থেকে এক চুলও সরে আসেননি। পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণ কর্মীদের আরও চাঙ্গা করবে।
জামায়াত-হেফাজতের বাধার কারণে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ
সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কওমী মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র ও শিক্ষক তাদের সনদের
সরকারী স্বীকৃতি এবং পাঠ্যসূচী যুগোপযোগী করার পক্ষে হলেও হেফাজত নেতাদের বাধার
কারণে সরকার কওমী মাদ্রাসার রক্ষণশীল, উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক পাঠ্যসূচীর গায়ে সামান্যতম আঁচড় কাটতে
পারেনি।
সরকারের প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন ২০১৪ সালে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচী
পর্যালোচনা করে জানিয়েছিল- এই সরকারের আমলেও মাদ্রাসায় মওদুদীবাদ পড়ানো হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’,
‘গণতন্ত্র’, ‘জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি ইসলামবিরোধী মতবাদ; যারা এ মতবাদের
অনুসারী তারা ‘মুরতাদ’, যার সহজ
অর্থÑ ‘হত্যার যোগ্য।’ জামায়াত-হেফাজত
মাদ্রাসার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এখন হাত দিয়েছে সাধারণ পাঠ্যসূচীর
ওপর। পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে হেফাজতের অযৌক্তিক দাবি খণ্ডন করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা
এক বছর আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিয়েছিল। তারপরও ২০১৭ সালে হেফাজতের
দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়েছে। এটিকে হেফাজত তাদের আন্দোলনের বিরাট
বিজয় হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে আমরা দেখছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর একটি আলোকিত
জাতির তমসযাত্রা হিসেবে। এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী
লীগের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে-
চলবে..
- শাহরিয়ার
কবির
(শেষাংশ)
তারা জাতিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আলোর পথে নিয়ে যাবেন, না পাকিস্তানপন্থীদের দাবি অনুযায়ী মধ্য-যুগীয়
তামসিকতায় নিক্ষেপ করবেন।
গত ১৯-২১ জানুয়ারি (২০১৭) ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ শহীদ
জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক
আন্দোলনের রজতজয়ন্তী পালনের পাশাপাশি সংগঠনের ৭ম জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করেছিল।
সম্মেলনের মূল অধিবেশনে এবং প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট অধিবেশনে পাঠ্যপুস্তকের
সাম্প্রদায়িকীকরণের কঠোর সমালোচনা হয়েছে। প্রতিনিধিদের দাবি অনুযায়ী সম্মেলনে
গৃহীত এক প্রস্তাবে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের
একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের
খুঁজে বের করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষানীতি গ্রহণের জন্য।
সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছে শুধু
মুদ্রণপ্রমাদ ও তথ্যবিভ্রাট অনুসন্ধানের জন্য। সরকারী কমিটির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য
করে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) সুপ্রীমকোর্টের আপীল
বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীকে চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট
শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে সদস্য সচিব করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট
নাগরিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের অন্যান্য সদস্য হচ্ছেন- ১. অধ্যাপক অজয় রায়, ২. বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ৩. অধ্যাপক অনুপম সেন, ৪. বিচারপতি শামসুল
হুদা, ৫. অধ্যাপক কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, ৬. বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ৭.
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ৮. অধ্যাপিকা ফরিদা মজিদ,
৯. অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, ১০.
শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ ও ১১. লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। কমিশনকে বলা হয়েছে ১০
মার্চের ভেতর এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য। কমিশনের সদস্যরা,
বিশেষভাবে সদস্য সচিব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কঠোর পরিশ্রম করে
নির্ধারিত সময়ের ভেতর প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রদান করেছেন। কমিশনের তদন্তের
ভিত্তি ছিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও বিজ্ঞজনদের লেখা, গোয়েন্দা প্রতিবেদন, নিজস্ব গবেষণা এবং
বিশেষজ্ঞদের অভিমত। জনবল, অর্থবল ও সময়ের অভাবে কমিশন
পর্যালোচনার জন্য ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের মাত্র কয়েকটি বেছে
নিয়েছিল, যেখানে অসঙ্গতি বেশি ধরা পড়েছে। কমিশনের
প্রতিবেদনের উপসংহারে বারোটি সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশগুলো হচ্ছেÑ
১. হেফাজতের দাবির কারণে স্কুলের পাঠ্যসূচীতে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ
হয়েছে তা থেকে সরে আসার ঘোষণা সরকারকে দিতে হবে।
২. ক্রমান্বয়ে একমুখী শিক্ষার দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং এ বিষয়ে
স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
গ্রহণ করতে হবে।
৩. মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় বাংলার
বদলে যেভাবে উর্দুকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তা রদ করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষালয়ে ও মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরে
(ইবতেদায়ি) একই ধরনের পাঠক্রম থাকতে হবে।
৪. শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কয়েকটি ভাগ করে শিক্ষার বিভিন্ন সেক্টরে
মনিটরিং ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
৫. এনসিটিবির সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। যিনি যে বিষয়ে দক্ষ তাকেই পদায়ন
করা বাঞ্ছনীয় এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সম্পাদনা বা সঙ্কলন কমিটি
প্রাথমিক/মাধ্যমিক পর্যায়ের কৃতী শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। যাদের জন্য
পাঠ্য তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না তা অবাস্তব।
৬. শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষককে দিয়ে বই লেখার প্রবণতা বাদ
দিয়ে যারা প্রাঞ্জল ভাষায় বই লিখতে পারেন তাদের দিয়ে স্কুল পাঠ্যপুস্তক লেখানোর
প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
৭. শিক্ষাক্ষেত্রের সব বিষয়ে বর্ণবাদ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করার প্রয়োজনে
প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন অবিলম্বে শুধু বাস্তবায়ন নয়, শিক্ষা আইন পাস করতে হবে।
৯. প্রতিবছর বইয়ে বানান ভুল থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। ভুলের দায়িত্ব
বোর্ডের বিশেষজ্ঞের। যারা এ ভুল করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০.সকল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বাঙালী জাতির
ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১১.যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না এবং জাতীয়
সঙ্গীত গাওয়া হয় না সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদকে সংবিধান লঙ্ঘনের
অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে।
১২.হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর মতো সকল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক
সন্ত্রাসী সংগঠন অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ
প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াত-হেফাজতীদের অপসারণ করতে হবে।
আমরা আশা করব সরকার এসব সুপারিশ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন
প্রজন্ম গড়ে তোলার অঙ্গীকার পূরণ করবে।
১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটির সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে মহামান্য
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ অত্যন্ত উদ্দীপনায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণের উপসংহারে
তিনি বলেছিলেন, ‘নির্মূল
কমিটির ৭ম জাতীয় সম্মেলনে আমি অনেক প্রতিভাবান তরুণ মুখ দেখতে পাচ্ছি। তরুণদের
প্রতি আমি আহ্বান জানাব, আপনারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
পড়ুন, বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ুন, আমাদের
গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানুন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেদের
উজ্জীবিত করুন। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে বহু অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম
অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক সমাজ
প্রতিষ্ঠার জন্য এত মূল্য বিশ্বের অন্য কোন জাতিকে দিতে হয়নি। বহু ত্যাগের বিনিময়ে
অর্জিত এ স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ আমাদের রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশপ্রেম কোন বিমূর্ত বিষয় নয়। দেশকে ভালবাসার অর্থ হচ্ছে দেশের
মানুষকে ভালবাসা, প্রকৃতিকে ভালবাসা। তরুণ প্রজন্মকে তাই
দেশপ্রেমের মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
‘একাত্তরে আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীর শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি অপরিসীম ত্যাগ
সমগ্র বিশ্বের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাংলাদেশকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে
অধিষ্ঠিত করেছিল। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে
উন্নতি ও অগ্রগতির পথে আমরা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি। এই সম্মেলনে বিশ্বের
বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব অতিথি এসেছেন, আপনাদের প্রতি আমার
আহ্বান, আপনারা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাস্প্রদায়িক
চেতনা এবং উন্নয়নের বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবেন।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক
সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে আগামী দিনগুলোতে ‘একাত্তরের
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে এই
প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আমি এই সংগঠনের রজতজয়ন্তী ও ৭ম জাতীয় সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন
ঘোষণা করছি।’
আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে চাই। মৌলবাদ ও
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
৯ মার্চ ২০১৭
প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০১৭
.
.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন