গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী হয়ে উঠছে, ;- by মুনতাসীর মামুন ( সৌজন্য ; দৈনিক জনকণ্ঠ )



   
   গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী
    
  • মুনতাসীর মামুন
গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী হয়ে উঠছে, ৭ মার্চ সেটি আবার বোঝা গেল পাকিস্তানের প্রক্সি পার্টি [পিপিপি : একদিকে তাদেরই উত্তরসূরি] বা বাঙালী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানীদের দল বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে। তারা বলছেন, যার মর্মার্থ এই যে ৭ মার্চ কী এমন হয়েছিল। একটি বক্তৃতা হয়েছিল যে বক্তৃতায় এমন কোন দিক নির্দেশনা ছিল না। তাদের পিতা বলে তারা যাকে স্বীকার করেন, সেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পর্যন্ত ৭ মার্চের বক্তৃতায় দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন আর তার পুত্ররা কোন নির্দেশনা পায় না। কেমন পুত্র এরা? রাজনীতির এত নিম্নমান দেখে অধিকাংশ মানুষ এ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। আসলে আইয়ুব খান যে এত জারজপুত্রের সৃষ্টি করেছিলেন কে জানত।
৭ মার্চেরই যখন বিকৃতায়ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবে ২৫ ও ২৬ মার্চেরও বিকৃতায়ন হবে। আওয়ামী রাজনীতি এখন দক্ষিণপন্থীদের হাতে। সে কারণে, মুক্তিযুদ্ধের আরও বিকৃতায়ন হবে। এখন আর সে সব কারণে চিন্তিত নই। চিন্তিত, একটি জাতির উত্থান ও পতন দুটিই দেখে যেতে হবে। ২৫ মার্চ নানা ডামাডোলে গুরুত্ব না পাওয়ায় আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় যেমন তার সাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ইতিহাস দুমড়েমুচড়ে আইয়ুবের জারজপুত্ররা রাজনীতিতে বিতর্ক-বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সে জন্য আমরা ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস পালনের আন্দোলন করেছি। ধেড়েরা যখন ৭ মার্চ কি হয়েছিল জানে না, তখন নেংটিদের জ্ঞানের বহরের কথা চিন্তা করুন! আমাদের অবিমৃশ্যকারিতা, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের খালি আধিপত্য ও অর্থের চিন্তা, আমলাতন্ত্রের আইয়ুব-মোনায়েমদের প্রতি এখনও চিন চিনে ভালবাসা ৭, ২৫ ও ২৬ মার্চের গুরুত্ব, গুরুত্বহীন করে তুলছে। এটি বাঙালী পাকিস্তানীদের দূরদৃষ্টির প্রমাণ। তারা তাদের নীলনক্সা বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারের চেষ্টায় ঐক্যবদ্ধ। এবং এ কারণে রাজনীতিতে অন্ধতা, মূর্খতা আনতেও তারা রাজি। বিএনপির ধেড়েদের ৭ মার্চ সম্পর্কে মন্তব্য এর প্রমাণ। রাজনীতি যে ক্রমেই একশ্রেণীর হাতে পড়ে বিকৃত, রুচিহীনতায় পরিণত হচ্ছে এটি তারও প্রমাণ। আর এসব প্রতিরোধেই আমরা ২৫ ও ২৬ মার্চ, সংবিধান ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস প্রভৃতি যাতে জাতীয়ভাবে পালিত হয় তার আন্দোলন করছি। একইভাবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে, গুরুত্ব দিলে তার অপমান হবে, গুরুত্ব হ্রাস পাবে। সামগ্রিকভাবেই, অন্যান্য বিষয়কেও মর্যাদা দিয়ে তাকে তার সঙ্গে স্থাপন করলেই তিনিই যথাযথ সম্মান পাবেন। ধেড়ে বা নেংটিদের নিয়ে আর তেমন চিন্তা করতে হবে না। অবশেষে সরকার হয়ত বিষয়টি খানিকটা অনুধাবন করছে। আমি, ২৫ মার্চ দিবসটি পালন কেন জরুরী, এখানে শুধু সেটিই বিবৃত করব।
অবশেষে সরকারীভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবসপালিত হবে। গত ২৫ বছর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ দিনটি পালন করে আসছে। সরকারীভাবে না হলেও ঢাকার বাইরে ২৫ মার্চ পালিত হচ্ছে। নির্মূল কমিটি ২৫ মার্চ ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ মিনারে গণহত্যা দিবস পালনের সূচনা করে সন্ধ্যায়। তারপর আলোর মিছিল জগন্নাথ হল বধ্যভূমিতে গিয়ে শেষ হয়। নির্মূল কমিটির পক্ষে শাহরিয়ার কবির উদ্যোগ নেন সারাদেশে দিবসটি পালনের। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্নস্তরে শাহরিয়ার আলোচনা করেছিলেন। আমরা চাইছিলাম, ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ২৫ মার্চও আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হোক। কিন্তু যখনই ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই উদ্যোগ নিয়েছি তখনই প্রশ্ন উঠেছে, ‘আপনাদের সরকার কি তা জাতীয়ভাবে পালন করে’? এর উত্তর দেয়া যায়নি। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারী পর্যায়েও কথা বলেছি। কিন্তু, সরকার খুব প্রয়োজন না হলে বা বিপাকে না পড়লে আমাদের পাত্তা দেয় নাÑ এটি বাস্তব সত্য। কিন্তু, আমরা আমাদের কাজে ক্ষান্ত হইনি।
এখন আমরা দাবি জানিয়েছিলামÑ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালিত হোক। কারণ, ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। গণহত্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনের ঘোষণা ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। আমরা সতর্ক এবং আগ্রহী হলে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হতে পারত। এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনেক সুবিধা পেত।
ফিরে আসি পুরনো প্রসঙ্গে। গত ২৫ বছর এই দিন যাপনে বিএনপি-জামায়াত ও তথাকথিত ইসলামী দলবা ধর্মব্যবসায়ীদের দলের নেতাদের বাদে শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ পালনে আমরা সবদলের নীতিনির্ধারক, মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। সরকারী দলের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু সরকার থেকে কোন সাড়া পাইনি। আমরা সংবিধান দিবসও পালন করি। সরকারের কাছে এই দিবসটি পালনেরও অনুরোধ জানিয়েছি মন্ত্রীদের মাধ্যমে, তারা কেউ মন্ত্রিসভায় বা সংসদে সেটি বলেননি। ১ ডিসেম্বর যেহেতু বিজয়ের মাসের শুরু, সেজন্য ওই তারিখটিও মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি আমরা করেছি। নীতিনির্ধারকরা তাতেও সাড়া দেননি। আসলে নীতিনির্ধারক বা সরকার যে দিবসটি/গুলো জাতীয়ভাবে পালন করতে চায় না, তা নয়। আসলে কেউ বিষয়গুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে সংসদ বা মন্ত্রিসভায় আলোচনা করেননি। গত ২৫ বছর তারা আমাদের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন, ফিরে গেছেন, ফেরার পথে মন থেকে তা মুছে গেছে। কিন্তু, অবশেষে আমাদের ধৈর্য পুরস্কৃত হয়েছে। আসলে, অনেক সময় সামান্য অনেক ঘটনাও বড় ধরনের সংকল্প গ্রহণে প্রভাব ফেলে।
২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবসে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বই প্রকাশিত হয়। নামÑক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড। বইটি আমাদের হাতে এলে দেখি তা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্যের একটি গুদামবিশেষ। এ কারণে ২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস ঘোষণা ও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য নির্মূল কমিটি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ, যিনি আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীও। সভায় শাহরিয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে, সেøায়ান ও জুলিয়ান ফ্রানসিস এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা আন্তর্জাতিক হাতধোয়া [ টয়লেট সম্পর্কিত] দিবস পালন করি কিন্তু গণহত্যা দিবস পালন করতে চাই না। আমরা সেনাবাহিনী দিবস পালন করি জাঁকজমক করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করি না। কী এ্যাবসার্ড অবস্থা। আরও অনুরোধ জানিয়েছিলাম এই বলে যে, মন্ত্রী যখন সংসদে যাবেন, এ প্রসঙ্গটি সংসদে পারলে যেন তোলেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এতে সম্মতি দেবেন। সে বিশ্বাস থেকেই একথা বলছি।
তোফায়েল আহমেদ খুবই আন্তরিকভাবে উত্তর দিয়েছিলেন। আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমি কেন বিষয়টি এভাবে দেখিনি। আমি লজ্জিত। আমি সংসদে এ কথা তুলব বলে কথা দিচ্ছি। তোফায়েল আহমেদ কথা রেখেছিলেন। সংসদে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, অনেকে ভেবেছিলেন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। জুনায়েদ আহমদের বইয়ের প্রসঙ্গটিও তিনি এনেছিলেন এবং তার বইটি সংসদে দেখিয়েছিলেন। শাহরিয়ারের কাছে যে একটি কপি ছিল তা তিনি মন্ত্রীকে দিয়েছিলেন সংসদে প্রদর্শনের জন্য। এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আধঘণ্টার এক আবেগাপ্লুত বক্তব্য রাখলেন এবং ঘোষণা দিলেন, অবশ্যই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হবে। সংসদে একটি দিনও নির্ধারিত হয় বিশেষ আলোচনার জন্য। সংসদ সদস্যরাও সম্মতি জানান।
আর একটি ঘটনার উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। আমাদের ইতিহাস চর্চায় আমরা গণহত্যা-নির্যাতনকে গুরুত্ব দিইনি। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করব। তাই আমার গবেষণায় এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করি। খুলনায় এ কারণে ডাঃ শেখ বাহারুল আলম ও আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম গণহত্যা নির্যাতন বিষয়ক আর্কাইড ও জাদুঘর। শিল্পী হাসেম খান, শাহরিয়ার কবির, তারিক সুজাতও এটি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে আমরা একটি পরিত্যক্ত ভবনের জন্য আবেদন করি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে খুলনার দুই কমিশনার এক্ষেত্রে (মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হিসেবে সরকার কর্তৃক সমাদ্রিত ও প্রমোশন প্রাপ্ত) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও আগ্রহ দেখাননি। ঘুরে ঘুরে এখন আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরজাহির করা আমলাদের কার্যকলাপ দেখে বিরক্ত ও ক্লান্ত, তখন এই তোফায়েল আহমেদ ও পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত হয়। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কোন তদ্বির ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিনের মধ্যে সে ফাইল অনুমোদন করে ফেরত পাঠান। জনস্বার্থে দেয়া এসব ভবনের নামমাত্র মূল্য ধরা হয়।
..

     

প্রকাশিত : ১২ মার্চ ২০১৭

দ্বিতীয় কিস্তি ॥

আমরা আপ্লুত হয়ে বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের সম্মান দেখিয়েছেন, আমরাও তাকে সম্মান দেখাব। আমরা চাঁদা তুলে অন্যদের তুলনায় উচ্চমূল্য দিয়েছি। আমরা বধ্যভূমি চিহ্নিত করছি, গণহত্যা নির্ঘণ্ট প্রকাশ করছি, আরও অনেক কিছু। না, এসব বলার জন্য এ ঘটনার অবতারণা নয়। আমরা ৪০ বছর আন্দোলন করেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। প্রথম থেকেই তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন এবং বিরোধী দলের নেত্রী থাকার সময় চমৎকার এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা আমরা ছেপে প্রচার করেছি। এবং তিনিই এদের বিচার শুরু করেছেন। তিনি না থাকলে, আওয়ামী লীগ এতে রাজি হতো কিনা সন্দেহ। কারণ, এ দলের অনেক নেতা আত্মীয়তার বন্ধনে, ব্যবসার কারণে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে। ১০ বছর বা তারও আগে আমি ও শাহরিয়ার কবির লিখিতভাবে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করার জন্য। তখন অনেকে এ প্রস্তাব অবাস্তব ও হাস্যকর বলেছেন। শেখ হাসিনাই এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করেছেন। পুরনো হাইকোর্টকে জাদুঘর করার প্রস্তাবও রেখেছিলাম। তিনি তাতে সায় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুর সম্মাননা দেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তাও তিনি কার্যকর করেছেন। এখন ২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস তারই উদ্যোগে সংসদে পাস হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের আমরা সমালোচক বটে; কিন্তু এটি বলতে দ্বিধা নেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার কমিটমেন্টে কোন ঘাটতি নেই। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন যেসব মন্ত্রী তাদের অধিকাংশও মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়ে আমাদের ফেরাননি। আমরা তাই আশা রাখি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আমাদের আরও কয়েকটি প্রস্তাব কার্যকর করবেন-
১. মুক্তিযোদ্ধা ও সংবিধান দিবস পালন
২. প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন পাস
৩. জামায়াতে ইসলাম নিষিদ্ধকরণ।
২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অভিনন্দন।
এবার আলোচনা করব কেন ২৫ মার্চ বিশেষভাবে এবং জাতীয়ভাবে আমাদের পালন করা উচিত। গণহত্যা স্মরণ দিবস পালনে আমরা কেন গুরুত্ব দিয়েছিলাম? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় আমরা দেখেছি, গণহত্যা, নির্যাতন বা অবরুদ্ধ দেশ তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি। এখানে বলে রাখা ভাল, গণহত্যার সঙ্গে নির্যাতনের বিষয়টিও আসবে। নির্যাতনের ভেতর অন্তর্গত আবার বাস্তুচ্যুতি এবং নারী নির্যাতনও। গণহত্যা আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি বিষয়েও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের গুরুত্ব দেয়ার কারণ, এ বিষয়গুলো না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্ব হারায় ও বৈশিষ্ট্যহীন হয়ে যায়। আমরা জয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় এই ভারসাম্য না থাকায় জাতির বুননে (পলিটি) বিষয়টি গেঁথে যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলি, ভাষা আন্দোলন বা ২১ ফেব্রুয়ারির কথা কেন মুক্তিযুদ্ধ বা গণহত্যা বেশি জানে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের নেতা, ১৯৭১ সালের সরকার, গণহত্যা সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট। কয়েকদিন আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আনকোরা নতুন কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা শুনেছেন, জানেন, আমি ঢাকা নিয়ে লেখালেখি করি, ঢাকা শহর নিয়ে তাদের আগ্রহ আছে, তাই দেখা করতে আসা। আমি গণহত্যা-নির্যাতন (নারী ধর্ষণসহ) সম্পর্কে জানতে চাইলাম, দেখি মোটামুটি তারা কিছুই জানেন না। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন আমার মনে হলো, এ রকমটি এখানে হলো, ইউরোপে হলো না কেন?
এর প্রধান কারণ, পরম্পরা। ইউরোপে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা কেন মনে রাখে বা রাজনীতিতে কেন প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপে হিটলার মুসোলিনীর পরাজয়ের পর তারা বিজয় পালন করেছে, এখনও করে; কিন্তু গুরুত্ব দিয়েছে গণহত্যা-নির্যাতনের ওপর। শহীদ স্মৃতি পালনের ওপর। কেননা, বিজয়ের কথা মানুষ বেশি মনে রাখে না; কিন্তু হত্যা-নির্যাতন অপমানের কথা মনে রাখে। তা বংশ পরম্পরায় রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হয়। সেই থেকে ইউরোপে আজ পর্যন্ত অজস্র চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, উপন্যাস, গল্প, কবিতা লেখা হয়েছে, ইতিহাস রচিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। অর্থাৎ পরম্পরা আছে। সব বধ্যভূমি তারা সংরক্ষণ করেছে, শহীদদের সমাধি সুন্দর করে রেখেছে, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। জাদুঘর বিশেষ করে গণহত্যা জাদুঘর নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সেসব জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন প্রজন্মের কাউকে গণহত্যা-নির্যাতনের কথা ভুলতে দেয়া হয় না। এর পরিপূরক হিসেবে নাৎসি-ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এ থেকে বর্ণবাদের, জাতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। হলোকাস্ট আইন হয়েছে অনেক দেশে। continue :



    তৃতীয় কিস্তি ॥

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ মুসলমান গরিষ্ঠ দেশসমূহ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। আবার নিরপেক্ষতাবজায় রাখার চেষ্টা করেছে ইউরোপীয় দেশসমূহ। লুঙ্গি পরা, জীর্ণশীর্ণ বাঙালীরা জিতবে এ কথা কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু জিতে গেল। এই বিজয়ের পর সমীকরণও বদলে গেল। গণহত্যার সঙ্গে এরা জড়িত- এ প্রচার শুরু হলে তারা আরও বিপদে পড়বে। কেননা, ‘হলোকাস্টবা ইহুদী নিধন তারা মনে রাখে কিন্তু বাঙালী হলে তা মনে রাখে না- এটি একেবারে মনের গহিনে সুপ্ত বর্ণবাদ এখন ট্রাম্প বা ইউরোপের ডানপন্থীরা যা খুঁচিয়ে তুলছেন।
অন্যদিকে, মার্কিনী বা ইউরোপীয়রা নিজেদের গণতান্ত্রিক ও বর্ণবাদবিরোধী বলে প্রচার করে, তাই তারা এ বিষয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিশ্ব প্রচার মাধ্যম তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, বাংলাদেশের গণহত্যা বা ধর্ষণ প্রসঙ্গটি আর হলোকাস্টের মতো পরম্পরা পেল না। এভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা চলে গেল চোখের আড়ালে।
তিন ॥
গণহত্যার বিষয়টি আবার সামনে চলে আসে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করেন। এই অপরাধীদের অধিকাংশ ছিল জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে যুক্ত। ফলে, তারা গণহত্যা যে হয়নি, হত্যা কিছু হলেও সামান্য- এ বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চালাতে থাকে। অন্যদিকে, পাকিস্তান সরকার সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার নিয়ে বিষোদগার শুরু করে। ভাড়াটে লোকজন দিয়ে বই লেখাতে শুরু করে। এর সাম্প্রতিক দুটি উদাহরণ শর্মিলা বসু ও জুনায়েদ আহমদের বই। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু সাংবাদিক যার মধ্যে নিউএজের সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে খালেদা জিয়া, গয়েশ্বর রায় প্রমুখ। এখন গণহত্যা নিয়ে বাহাসে আমি যাব না। গণহত্যা হয়েছিল এই সত্য নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন মানে হয় না। কিন্তু, এরা কীভাবে বিতর্ক ছড়াচ্ছে, কী যুক্তিতেÑ সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করব। কারণ, এসব বিষয়কে ক্রমাগত উপেক্ষা করার কারণে, আজ গণহত্যা-মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আমাদের বলতে হয়।
গণহত্যা নির্যাতনকে গুরুত্ব না দেয়ায়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তান সমর্থক বাঙালী পাকিস্তানীরা এর সুযোগ নিতে চেয়েছে। জামায়াত গণহত্যা অস্বীকার নয়, তারা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালন শুরু করে। উল্লেখ্য, শাসন ক্ষমতায় থাকার পরও জামায়াতীরা শহীদ মিনার বা সাভারে স্মৃতিসৌধে কখনও যেতে পারেনি। শেখ হাসিনার সরকার যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে তখন হঠাৎ গণহত্যা অর্থাৎ ৩০ লাখ শহীদকে নিয়ে বিতর্ক তোলেন বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি বিভিন্ন কাগজে এ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। খালেদা জিয়াও ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে কয়েকবার প্রশ্ন তোলেন। ভাবা যায়, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ৩০ লাখ শহীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত সাভার স্মৃতিসৌধে প্রতিবছর পুষ্পস্তবক দিয়েছেন, এখনও দেন। তিনিও প্রশ্ন তোলেন গণহত্যা নিয়ে! কারণ, গণহত্যার কারণে ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়েছিল। গণহত্যা হয়নি বা তা বিতর্কিত করলে বিচারের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হয়। জামায়াত তখন প্রচুর টাকা ঢালছিল বলে সারাদেশে চাউর হয়ে গিয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল বন্ধে গণহত্যা নিয়ে বিতর্ক তোলার জন্য দেশে-বিদেশে এই টাকা বিতড়িত হয়েছিল। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান যখন যুদ্ধাপরাধী নিয়ে প্রথমে ডকুমেন্টারি করেন তখন তিনি বাংলাদেশের আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে বিয়ে করেননি। ডেভিডকে নিয়ে তখন আমরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে তখন আন্দোলন শুরু। লন্ডনেও তখন ড. কামালের কন্যা সারাহ ও বাঙালী তরুণ-তরুণীরা এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। ডেভিডকে তখন তাদের সঙ্গে দেখেছি। এরপর ডেভিড এসেছেন এ দেশে মাঝে মাঝে। যোগাযোগ হয়েছে বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে। তারপর এক সময় ড. কামাল হোসেনের জামাতা হিসেবে এ দেশেই ফিরে এসেছেন।
যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে ডেভিড বিভিন্ন প্রতিবেদন লেখা শুরু করলেন পত্রিকায় এবং এ প্রতিবেদনগুলোতে আমরা দেখলাম, আগের ডেভিড নেই। যে প্যাশন নিয়ে তিনি এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে নেমেছেন এখন দেখা যাচ্ছে, সেই একই প্যাশন নিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরুদ্ধে নেমেছেন। এর কারণটি কী তা আমরা বুঝতে অক্ষম। জামায়াতের লবিস্ট/আইনজীবীরা বিদেশে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যা বলছিল, ডেভিডের ভাষাও ক্রমে দেখা গেল সে রকম হয়ে যাচ্ছে। জামায়াত প্রচুর পয়সা দিয়েছে এবং দিচ্ছে লবিস্টদের। এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, মীর কাশেম আলী ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন লবিস্টদের। সত্য-মিথ্যা জানি না। ডেভিডের মতো একই রকমভাবে ইকোনমিস্ট ও আলজাজিরাও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচার করেছে। এক সময় আলজাজিরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বলেছিল। এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক নাকি কাতারের শেখ পরিবার। এসবের সঙ্গে ডেভিডের সম্পর্ক আছে কিনা জানি না, কিন্তু তার বক্তব্য তাদের মতোই।
যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করায় ডেভিডকে আদালত তলব করেছিল। ডেভিডকে দমানো যায়নি কারণ তার বোধহয় এই প্রতীতি জন্মেছে যে, দেশের সেরা আইনবিদ ও সুপরিচিত আইনবিদের তিনি পরিবারভুক্ত। তার কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। ট্রাইব্যুনাল আবারও ডেভিডকে তলব করেছিল আদালত অবমাননার জন্য। কোন একটি লেখায় ডেভিড মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে ভারতের দি হিন্দুপত্রিকায় ডেভিড একটি কলামও লিখেছেন। প্রথমে দেখা যাক ডেভিডের বক্তব্য কী?
বাংলাদেশ সরকার সবসময় বলে আসছে পাকিস্তানী ও তার সহযোগীরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এটি কি ঠিক? [তার ভাষায় এটি কি ফেয়ার এস্টিমেট’?] এটি মূল বক্তব্য এবং তারপর এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা তথ্য প্রমাণহাজির করেছেন। তার মতে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি এখনও স্পর্শকাতর। এ স্পর্শকাতরতার কারণ, জন্ম থেকেই একটি শিশু এ কথা শুনছে স্কুলে এটি পড়ানো হয়। দেশের কবিতা সংস্কৃতির বুননে তা ঢুকে গেছে। সুতরাং এ নিয়ে প্রশ্ন করা একটি গভীর বিশ্বাসকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা।
ডেভিডের মতে, যিনি এ কথা প্রথম বলেছেন তিনি এ দেশের স্বাধীনতার নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবে বাক্য বিন্যাসের কারণে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে তার খুব একটা পছন্দ নয়। কারণ পরবর্তী বাক্যে লিখেছেন, এ সংখ্যাটি বেশি বলে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকরা।
ডেভিড লিখেছেন, ১৯৭১ সাল নিয়ে রক্ষণশীল যে জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের অংশ বা বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিপরীত। এমনকি, তার মতে এ সংখ্যা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে অনেক আওয়ামী লীগার তাকে স্বাধীনতাবিরোধী বা অপজিশনাল মাইন্ডসেটবলে আখ্যা দেবে।
সুতরাং বাংলাদেশে ৩০ লাখ মৃত্যুকে নিয়ে যে প্রশ্ন করবে তার মাথা নিচু করে থাকতে হবে, ভীত থাকতে হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণের আশঙ্কায়।
ডেভিড বার্গম্যানের এ বক্তব্য নিয়ে প্রথম আলোচনা করা যাবে। এটি ঠিক, আমাদের হৃদয়ে এবং ১৯৭১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের মাথায় ৩০ লাখ শহীদ শব্দটি গেঁথে গেছে। কিন্তু এতে অস্বাভাবিক কী আছে? ডেভিডও নিশ্চয় বড় হয়েছেন হলোকাস্টশব্দটি শুনে। হলোকাস্ট বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার কর্তৃক ইহুদী ও নাজি বিরোধীদের নিধন হলো হলোকাস্ট। এটি বিশ্ববাসী বা ইউরোপীয়দের মধ্যে বিশ্বাস যে, ৩ লাখ মানুষ মারা গেছেন হলোকাস্টে। নাজি বা ক্যাসিবিরোধী ডিসকোর্সের তা অন্তর্গত এবং ইউরোপের যে কোন রাজনৈতিক দল হলোকাস্টে কথা বললে কি মনে হয় যে তা অর্থোডক্স ন্যাশনালিস্ট ডিসকোর্সের অংশ বা কোন দলের বিশ্বাস? হ্যাঁ, হলোকাস্টে মৃতের সংখ্যা নিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা হয়েছে, কিন্তু যারা এ প্রশ্ন তুলেছেন তারা কি মেইনস্ট্রিম একাডেমিকসে জায়গা পেয়েছেন? এবং জার্মানিতে, যে জার্মান সরকার এক সময় এ নিধন চালিয়েছে, সে জার্মানিতে কেউ এ প্রশ্ন করলে কি তাকে জার্মান সমাজ গ্রহণ করবে? তাকে কি নাজি সমর্থক মনে করবে না? সে মনে করাটি কি অপজিশনালমাইন্ডসেট? আমেরিকাতে ইহুদী বিদ্বেষী দুএকজন লেখক এ নিয়ে কথা তুলেছেন এবং খোদ আমেরিকাতে তাদের নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে, হাসি-ঠাট্টা করা হয়েছে তাদের পা-িত্যনিয়ে। তারা পরিশীলিত তাই এ ধরনের ব্যক্তিদের রিভিশনিস্ট বলেছেন। আমাদের দেশের মানুষজন অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, অতটা পরিশীলিত নয়, তাই যারা ৩০ লাখকে অস্বীকার করে তাদের হারামজাদা বলে। শব্দগত বা ভাবগত তফাত আর কি!
ডেভিড তার শ্বশুরের মতো আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না। সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন করলে কি শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়? না। ডেভিডের আওয়ামী লীগকে অপছন্দের কারণে মনে হয়েছে, খালি আওয়ামী লীগ-ই প্রতিক্রিয়া জানাবে। কমিউনিস্ট পার্টি তো ঘোর আওয়ামী লীগবিরোধী। ডেভিড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ৩০ লাখ শহীদের তিনি বিশ্বাস করেন কিনা? বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করে কিনা সেটি ডেভিড পর্যালোচনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করবেন না দেখেই আগে ভাগে জানিয়েছেন, এটি আমাদের সংস্কৃতির বুননে মিশে আছে। ডেভিড তার শ্বশুর ড. কামাল হোসেনকে একবার জিজ্ঞেস করলে পারতেন, তিনি এটা বিশ্বাস করেন কিনা? আওয়ামী লীগ করার সময় তো নিশ্চয় বিশ্বাস করতেন। না করলে কি প্রকাশ্যে তিনি তা বলবেন?
ডেভিডের নিবন্ধের প্রথম ভাগ দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে আওয়ামী লীগ করছে সে জন্য তিনি খানিকটা কুপিত। ডেভিড তার স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি আমরা সবাই এতে বিশ্বাস করতাম এখনও করি। ডেভিড এখন করেন না তার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস এখনও অটুট। ডেভিড কেন, আমাদের সবারই একটি বিষয় মনে রাখা উচিত, এ বিচারটা আওয়ামী লীগ না করলে তাদের অনেক নেতাকর্মী হয়ত খুশি হতেন। আওয়ামী লীগ সব সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে কিন্তু প্রথম আমলে তা করেনি। ২০০৮ সালে, তারা জনগণের ম্যান্ডেট চেয়েছে বিচারে এবং তা পেয়েছে। তারপরও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিচার কাজ শুরু হয়নি। পরে জনচাপে সেই ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগ কার্যকর করছে মাত্র। এটি দলীয় কোন সিদ্ধান্ত কার্যকরের মতো নয়।
নিবন্ধের দ্বিতীয় ভাগে ডেভিড বলছেন, সাংবাদিক বা গবেষকদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ এই যে আইকনিক ফিগারপর্যালোচনা করবেন। ডেভিড বুদ্ধিমান, পরের লাইনে লিখেছেন, এই পর্যালোচনা পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগীদের নিষ্ঠুরতা কম করে দেখানোর জন্য নয়। তার ভাষায়, This is not in order to minimi“e the extent of atrocities committed by the Pakistan military and its collaborators which were Indoubtedly very significant, but for the purposes of a more accurate representation of history that is not thrall to partisan interest. শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করুন, ইতিহাসের স্বার্থে এবং যা পক্ষপাতমূলক স্বার্থের পক্ষে [পড়ুন আওয়ামী লীগ] যাবে না। অর্থাৎ ৩০ লাখ নিয়ে প্রশ্ন ওঠালেই তা আওয়ামী লীগের স্বার্থের বাইরে যাবে। এ ধরনের বাক্য গঠন দেখেই বোঝা যায় একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই লেখাটি রচিত হয়েছে সেটি হচ্ছে অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু নয়, অভিযোগগুলো বিশেষ করে হত্যার, সুষ্ঠু নয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

চলবে...

    

চতুর্থ কিস্তি ॥

৩০ লাখ শহীদের ব্যাপারটি কিভাবে এলো তারপর তা ব্যাখ্যা করেছেন ডেভিড। ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারি ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘৩ সরষষরড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব যধাব নববহ শরষষবফ, রহপষঁফরহম পযরষফৎবহ, ড়িসবহ, রহঃবষষবপঃঁধষং, ঢ়বধংধহঃং, ড়িৎশবৎং, ংঃঁফবহঃং...ফ্রস্ট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সংখ্যাটি যে ৩ মিলিয়ন তিনি তা কিভাবে বুঝলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ফেরার আগেই আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরাখবর আসছে, এখনও সঠিক সংখ্যায় উপনীত হইনি তবে তা কিন্তু ৩ মিলিয়নের নিচে হবে না।এর আগে ১০ জানুয়ারিও তিনি একই সংখ্যার কথা বলেছিলেন।
এরপর ডেভিড এ প্রসঙ্গে কট্টর মুজিব ও আওয়ামী লীগবিরোধী মাহমুদুর রহমান মার্কা সাংবাদিক, বিবিসির এককালীন কর্মী সিরাজুর রহমানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। সিরাজ লিখেছেন, ৩ লাখকে শেখ মুজিব ইংরেজীতে ৩ মিলিয়ন বলেছেন। সিরাজ এ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী জ্ঞানের প্রতি কটাক্ষ করতে চেয়েছেন। সিরাজুর রহমানের বই পড়েছি। ইংরেজী নিশ্চয় ভাল জানেন লন্ডনে থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী ভাষণও পড়েছি। সিরাজুর রহমানের ইংরেজী এর চেয়ে উত্তম এমন দাবি করা যায় না। বাংলা গদ্য তো নয়ই। সিরাজুর রহমানের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে তিন লাখও তার কাছে বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক। সংখ্যাটি ৩০ হাজার হলে বোধহয় তিনি সন্তুষ্ট হতেন।
এস এ করিমের প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকেও ডেভিড উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনিও লিখেছেন, ৩০ লাখ হড় ফড়ঁনঃ ধ মৎড়ংং বীধমমবৎধঃরড়হ। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, প্রাভদায় সংবাদটি ছাপা হয়েছিল।
বার্গম্যান বলেছেন, প্রাভদার হিসাবটা গোলমেলে [কমিউনিস্টদের কাগজ সেজন্য; ইহুদী বা ইউরোপীয়দের হলে না হয় মানা যেত।] কারণ প্রাভদা লিখেছিল, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে [ফধুং রসসবফরধঃবষু] ৮০০ বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। আসলে ঠিক সংখ্যা হবে ২০।
বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে। এই বুদ্ধিজীবীর অন্তর্গত [দেখুন রশীদ হায়দার সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ] বিভিন্ন পেশার মানুষ। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২০ জন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে? জামায়াতীদের কাছেও অপমানজনক মনে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে সামান্য একটু প্রশংসা করেছেন ডেভিড। ফ্রস্টের সাক্ষাতকারের পরপরই তিনি দুটি কমিটি করেছিলেন মৃতের সংখ্যা জানার জন্য। কমিটি নাকি প্রাথমিক রিপোর্টও দিয়েছিল। সে রিপোর্টে নাকি ৫৭,০০০ জন মৃতের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। সেজন্য এরপর সরকার এ নিয়ে এগোয়নি। প্রশ্ন জাগে, নিয়াজী যে ১৫ লাখের কথা বলেছিলেন সেটি কী কারণে?
এরপর ডেভিড কলেরা হাসপাতাল, যা এখন আইসিডিডিআরবি নামে পরিচিত তাদের একটি জরিপের উল্লেখ করেছেন। মতলব থানা নিয়ে জরিপটি পরিচালিত হয়েছিল। ওই থানায় তাদের অনুমান ৮৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই হিসাবে মৃতের সংখ্যা তারা ৫ লাখ বলে অনুমান করেছে। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল অনুসারে, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা ১,২৫,০০০ থেকে ৫,০৫,০০০ জন। আর জে রুমেল বলছেন ১৫ লাখ আর শর্মিলা বোসের হিসাব অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ১০০,০০০।
এ রকম আরও কিছু হিসাব দিয়েছেন তিনি। উপসংহারে তিনি লিখেছেন, যে কোন সংঘাতে নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করা মুশকিল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য- এর পার্টিজান পলিটিকসেরকারণে এবং এ কারণে এ বিষয়ে স্বাধীন গবেষণা করা কঠিন। এটা ঠিক পাকিস্তানীরা অনেক হত্যা করেছে। মৃতের সংখ্যা যাই হোক সরকারের বর্তমান নীতি যে অপরাধীর বিচার তাতে [এ সংখ্যা] কোন অভিঘাত হানবে না। তার ভাষায় ‘This is pity- as the number of civilians who were killed in atrocities by the Pakistan military in 1971 was, without doubt, very high. Whatever might be the actual figure, it would not affect the governmentÕs current policy for the need for criminal accountability for these offences.’
বার্গম্যান যে সব যুক্তি দিয়েছেন এগুলো যে খুব নতুন তা নয়। আমরা এর বিপরীতে যেসব যুক্তি দেব তাও নতুন নয়। রবার্ট পেইন সেই ১৯৭২ সালে যেমন ম্যাসাকারে লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘৩০ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খাবে।এখন যদি বলি সামরিক বাহিনীর প্রধানের আদেশ তার সৈন্যরা মেনে ৩০ লাখ হত্যা করেছে তাহলে এ যুক্তি অসার এমন কথা কি বলা যাবে? প্রাভদা ইয়াহিয়ার কথার আলোকেও এই সংখ্যা উল্লেখ করে থাকতে পারে।
মুক্তমনা ওয়েবসাইটে আবুল কাসেম একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে লেখা হয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ মারা হয়েছে। গণহত্যার ইতিহাসে এই হার সবচেয়ে বেশি।
[ 'Among the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day... This is the highest daily average in the history of genocides.’]
জাতিসংঘের হিসাব ধরে আবুল কাসেম একটি হিসাব করেছেন। তার মতে, হত্যা হয়েছে ২৬০ দিন। সে হিসাবে জাতিসংঘের সর্বনিম্ন হিসাব ধরলে তা দাঁড়ায় ৬০০০২৬০= ১৫ লাখ ৬০ হাজার। আর সর্বোচ্চ মাত্রা ধরলে= ১২০০০২৬০= ৩১ লাখ ২০ হাজার। তার মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৪০% পরিবারের কেউ না কেউ মারা গেছেন এবং পাকিস্তানী প্রতিটি সৈন্য প্রতি ১০ দিনে ১ জন করে হত্যা করেছে। এখানে রাজাকার, আলবদর কর্তৃক হত্যার সংখ্যা ধরা হয়নি।
পাকিস্তানী সেনা অফিসার কর্নেল নাদের আলী যিনি ১৯৭১ সালে এখানে ছিলেন এবং গণহত্যা করে ও দেখে সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। লিখেছেন, তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল মুজিবের জেলায় [হোম ডিস্ট্রিক্ট] যত বেজন্মাকে পাওয়া যায় তাদের হত্যা কর এবং কোন হিন্দু যেন বাদ না যায়।এ ধরনের আদেশ যখন দেয়া হয় তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা কী পরিমাণ হত্যা করতে পারে তা অনুমেয়।
এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় এবং শরণার্থী শিবিরে কত মানুষ মারা গেছেন সে হিসাব কিন্তু গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সে হিসাবও কিন্তু গণহত্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ রকম অনেক তথ্য-উপাত্ত ৩০ লাখ শহীদের পক্ষে দেয়া যায়; কিন্তু আমি দেব না। কারণ, এগুলো কুতর্ক। বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব বিতর্ক উত্থাপন করা হয়। বলতে পারেন তাহলে আমি বিতর্কে যোগ দিচ্ছি কেন? না, যোগ দিতে চাইনি। কিন্তু বার্গম্যানের লেখা পড়ে অনেকে অনুরোধ করেছেন কিছু লিখতে এ কারণে যে, তা না হলে বার্গম্যানরা একই কথা বার বার বলবে। পুরনোরা না হোক, নতুনদের অনেকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। অন্তত তাদের যুক্তি যে উদ্দেশ্যমূলক এ বক্তব্যটি আসা উচিত।
নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নাতনি শর্মিলা বসু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে, আমি নিজেও লিখেছি। এখানে পুনরুক্তি করব না। তবে সর্বজনবিদিত যে, তিনি পাকিস্তানী জেনারেলদের নীল চোখের বালিকা। আর জেনারেলরাও তার নীল চোখের বালক। তাদের ভক্তি, ভালবাসা পরস্পরের প্রতি অটুট এবং এর ভিত্তি অর্থ তো বটেই। তার মিথ্যাচারের একটি নমুনা দিই। তিনি বাংলাদেশে ধর্ষিতার সংখ্যা উল্লেখ করেছেন মাত্র তিন হাজার।
চলবে...
প্রকাশিত : ১৪ মার্চ ২০১৭
পঞ্চম কিস্তি ॥
জুনায়েদের বইটি নিয়ে যেহেতু পার্লামেন্টেও কথা উঠেছে সে বইটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব। যে কোন দেশে যে কোন নাগরিক বাংলাদেশের বিষয়ে লিখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কারও কিছু বলার নেই। তার প্রতিবাদ জানানো যায়। কিন্তু সরকারীভাবে যদি অপপ্রচার চালানো হয় তাহলে সরকারীভাবেই তার কঠোর প্রতিবাদ জানানো উচিত।
ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে জুনায়েদ আহমদ একদল গবেষক নিয়ে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেন। ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টস নামে তার একটি কোম্পানি আছে। বইটি লেখা শেষ হলে ২০১৬ সালে এই কোম্পানির সাবসিডিয়ারি এজেএ বইটি প্রকাশ করে। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে করাচী কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এই সংস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এর পৃষ্ঠপোষক। তাদের এই অনুষ্ঠান দেখা যাবেÑ যঃঃঢ়:/িি.িধলধঢ়ঁনষরংযবৎং.পড়স-এ। এরপর পৃথিবীর একমাত্র আইনী সন্ত্রাসী সংস্থা আইএসআই ইসলামাবাদে সব বিদেশী দূতাবাস ও সংস্থার কাছে বইটি প্রেরণ করে। বাংলাদেশ দূতাবাসেও তা প্রেরণ করা হয়। সুতরাং ধরে নেয়া যায় পাকিস্তান সরকার পরিকল্পিতভাবে এ বই লিখেয়েছে এবং বিজয় দিবসকে ম্লান করার জন্য ওই দিনই বইটির প্রকাশনা উৎসব করেছে। জুনায়েদ একজন ম্যানেজমেন্ট পরামর্শক, যার সঙ্গে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই।
আমরা লক্ষ্য করেছি, যারা কূটনৈতিক সার্ভিসে আছেন তাদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের ব্যাপারে নমনীয়। এটি নাকি কূটনীতি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা নাকি দরকারি। সম্পর্ক বাতিল করা দূরে থাকুক ডাউনগ্রেডও করা যাবে না। ওই যে বলেছিলাম, বাঙালী পাকিস্তানীর সংখ্যা বেড়েছে এটি তার উদাহরণ। দেশের শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হলে পাকিস্তানের সংসদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক বিষোদ্গার করে কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সংসদের প্রতিক্রিয়া ছিল কড়ি ও কোমল। সব সময় ভয় এই বুঝি পাকিস্তান চটে গেল। এটা নাকি কূটনীতি।
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা আইএসআই বাংলাদেশের বিলুপ্তি চেয়েছে এবং চাইবে। বাংলাদেশ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সৃষ্টি এ তত্ত্ব তারা বিশ্বাস করে। এ কারণেই জামায়াত-বিএনপির উত্থানে তারা সব রকমের সহায়তা করেছে। এ কারণে ১৯৭১ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তারা সুসম্পর্ক তৈরি করেছিল, যে কারণে প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা এবং এ কারণেই বিএনপি-জামায়াত কখনও পাকিস্তানের সমালোচনা করেনি, পাকিস্তানের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করেছে।
জুনায়েদের বইটিতেই প্রথম মিথ্যাচার করা হয়েছে তা নয়। এ মিথ্যাচার শুরু হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর এ গ্রেট ট্র্যাজেডিপ্রকাশের মাধ্যমে। এরপর রচিত হয় কুতুবউদ্দিন আজিজের ব্লাড এ্যান্ড টিয়ার্স। তারপর হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় শর্মিলা বোসের ডেড রেকোনিং : মেমোরিস অব দি নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান।২০১৫ সালে মিয়া আফ্রাসিয়াবের ১৯৭১ : ফ্যাক্টস এ্যান্ড ফিকশন।সবগুলো বইয়েরই মূল চেষ্টা ছিল এ বক্তব্য দেয়া যে, ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে বলে রটেছে তা অতিরঞ্জিত। গণহত্যা তেমন হয়নি। ধর্ষণ সামান্য, শর্মিলার ভাষায় মাত্র তিন হাজার। এ বইগুলোর দুর্বলতা হলো, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ তারা ভালভাবে করতে পারেনি। বইগুলো যে লেখানো হয়েছে তাও বোঝা যায়। যেমন কুতুবউদ্দিনের বই। বর্ণনাগুলো অতিরঞ্জিত। শুনেছি এবং এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পাকিস্তানী কর্নেলরা শর্মিলাকে সব বিষয়ে তুষ্ট করেছে। তিনি তাদের পছন্দসই বালিকা। আর কর্নেলরাও বালিকার খুব পছন্দের। হামুদুর রহমান সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন যাতে এই গণহত্যার অভিযোগটি কম হয়। কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট কখনও সরকারীভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিছু অংশমাত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান লেখক জুনায়েদের বইয়ের দুর্বলতা এই যে, এটি একটি কমিশন ওয়ার্ক- তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি পাকি সেনাদের উপদেষ্টা। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কনসালটেন্সি ফার্ম, যারা ১৯২৫ সাল থেকে ১৩৫০টির বেশি কনসালটেন্সি করেছে এবং এর উৎস যে আইএসআই সেটিও বোঝা যায়। এ কথা বলাও সত্যের অপলাপ হবে না যে, বইটি আইএসআই কমিশনকৃত লোকজন লিখে দিয়েছে যা তার নামে ছাপা হয়েছে এবং তিনি তার বিনিময়ে মোটাসোটা ইনাম পেয়েছেন। বইয়ের প্রধান দুর্বলতা এর টপ টু বটম মিথ্যাচার। কোথাও কোথাও দুএক লাইন সত্য কথা আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব তথ্য সত্য হিসেবে বিবেচিত তাও সে বইয়ে মিথ্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জুনায়েদের ভাষায়, বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭১ সম্পর্কে যে ন্যারেটিভ প্রদান করে আসছে তা নস্যাতের জন্যই বইটি লেখা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ের নাম- ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ এমিড মিথস এ্যান্ড ফেবলস।অর্থাৎ উপকথা ও মিথ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ১৪টি মিথ কাজ করছে। বলা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করেছে পূর্ব পাকিস্তানকে। আসলে তা মিথ্যা। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়নি। দুই লাখ নারী ধর্ষিতও হয়নি। হিন্দুদের হত্যার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি। মুক্তিবাহিনীই হত্যা করেছে বিহারীদের। দ্বিতীয় অধ্যায় : ক্রিয়েশন অব পাকিস্তান বা পাকিস্তানের সৃষ্টি। হিন্দু জাতীয়তাবাদী, কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী মুসলিম রাজনীতি ও ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ চায়নি। তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল এবং তারই ফল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিভাগ। তৃতীয় অধ্যায় : ডিসমেম্বারমেন্ট স্টার্টসবা ভাগ হওয়ার প্রক্রিয়া। এ অধ্যায়ের যে বর্ণনা তা তার মিথেরসঙ্গে খাপ খায় না। এখানে প্রমাণ করতে পারেনি যে, পূর্বাঞ্চলে অসন্তোষ ছিল না। চতুর্থ অধ্যায় : ইন্ডিয়াস ম্যাকিনেশন বা ভারতের ষড়যন্ত্র।ভারতই বাংলাদেশকে ভাগ করেছে, সেই পুরনো তত্ত্ব আবার নতুন করে বলা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায় : দি নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান ইনসার্জেন্সি বা ১৯৭১ সালের বিদ্রোহ। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো

চলবে...
      
     
     

মন্তব্যসমূহ