স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস by Yuval Noah Harari পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব – দ্বিতীয় অধ্যয় লিখেছেন: নুসরাত_জাহান

    

স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস by Yuval Noah Harari পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব – দ্বিতীয় অধ্যয়


জ্ঞানবৃক্ষ
আগের অধ্যায়ে আমরা জেনেছি যে যদিও হোমোস্যাপিয়েন্সরা দেড় লক্ষ বছর আগেই পূর্ব আফ্রিকায় বংশ বিস্তার করেছিল, তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটানো শুরু করেছিল বেশ পরে, মাত্র সত্তুর হাজার বছর আগে| এসব আদিম স্যাপিয়েন্সরা দেখতে একদম আমাদের মত ছিল আর তাদের মস্তিষ্কও ছিল আমাদের মত বড়| কিন্তু সত্তুর হাজার বছর আগে পর্যন্ত তারা অন্যান্য মানব প্রজাতির চেয়ে বিশেষ কোন সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না, তারা না পেরেছিল উন্নততর কোন অস্ত্র বানতে, না পেরেছিল অন্য কোন বিশেষ সাফল্য দেখাতে|
সত্যি বলতে কি, ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী স্যাপিয়েন্স আর নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাতে নিয়ান্ডার্থালরাই জিতেছিল| এক লক্ষ বছর আগে কিছু স্যাপিয়েন্স উত্তর দিকে যাত্রা করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী লেভান্ট অঞ্চলে এসে পৌছেছিল| কিন্তু সেটা ছিল নিয়ান্ডার্থালদের এলাকা| স্যাপিয়েন্সরা তাদের কাছে মার খেয়ে গেল| হতে পারে নিয়ান্ডার্থালরা তাদের খেদিয়ে দিয়েছিল, হতে পারে বিরূপ পরিবেশ বা অচেনা রোগ তাদের কাবু করেছিল| কারণ যেটাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, স্যাপিয়েন্সরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল, আর নিয়ান্ডার্থালরাই রয়ে গিয়েছিল লেভান্ট অঞ্চলের রাজা|
আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের এই দুরবস্থা দেখে অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করেন যে এদের মস্তিষ্কের গঠন আমাদের চেয়ে বেশ আলাদা ছিল| তারা বাইরে থেকে দেখতে আমাদের মত ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা, যেমন শেখা, মনে রাখা বা যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিল আমদের চেয়ে অনেক সীমিত| তাই এসব আদিম স্যাপিয়েন্সদের জন্য, আমারা যা যা করতে পারি, যেমন ইংরেজি শেখা, বিবর্তনবাদ বুঝতে পারা অথবা ক্রিস্টান ধর্মের অধ্যাত্বিক ধারণা হৃদয়ঙ্গম করা প্রায় অসম্ভব হত| একইভাবে আমাদের পক্ষে তাদের ভাষা বোঝা অথবা তাদের চিন্তাজগতে ঢোকাও হত ভীষণ কঠিন|
কিন্তু হঠাৎ করে সত্তুর হাজার বছর আগে থেকে স্যাপিয়েন্সরা দারুন দারুন সব কাজ দেখাতে শুরু করলো| তারা নতুন করে আফ্রিকার বাইরে যাত্রা শুরু করে দ্রুতগতিতে মধ্যপ্রাচ্য আর পূর্ব এশিয়ার ছড়িয়ে পড়ল| এবার তারা নিয়ান্ডার্থাল আর অন্যান্য সব মানব প্রজাতিকে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে নয়, একেবারে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে লাগল| পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে কি করে যেন তারা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌছে গেল, যেখানে আগে কখনো মানুষের পা পড়েনি| সত্তুর থেকে তিরিশ হাজার বছর আগের মধ্যবর্র্তি সময়টাতে স্যাপিয়েন্সরা আবিষ্কার করলো নৌকা, তেলের বাতি, তীর ধনুক আর সুই| এই সুই দিয়েই তারা পোষাক সেলাই শুরু করল| ধর্ম, বাণিজ্য আর সামাজিক শ্রেণীবিভাগের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও এই সময়কার। স্টডেল গুহায় খুঁজে পাওয়া আদিমতম ভাস্কর্য দুপেয়ে সিংহমানবের বয়সও ওরকমই|
জার্মানির স্টাডেল গুহায় আবিষ্কৃত সিংহ মানব বা মানবীর মূর্তি ( ৩০,০০০ বছর আগের)। এর দেহটা মানুষের কিন্তু মাথাটা সিংহের। এই মূর্তিটি মানুষের তৈরি শিল্পকলার প্রথম অব্যর্থ প্রমাণ, খুব সম্ভবত তাদের ধর্মে-কর্মেরও প্রমাণ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, স্যাপিয়েন্সরা যে পৃথিবীতে যা নেই এমন সব বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করতে পারত সে সময়ই, এটা তারই একটা বড় প্রমাণ।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন, এই যে মানুষ হঠাৎ করে এমন সব অভূতপূর্ব কৃতিত্ব দেখাতে শুরু করল, তার কারণ ছিল মানুষের বুদ্ধিমত্তার বৈপ্লবিক উন্নতি| তারা দাবি করেন, যেসব মানুষ নিয়ান্ডার্থালদের নিশ্চিহ্ন করেছিল, অস্ট্রেলিযায় বসতি গেড়েছিল আরে আর দুপেয়ে সিংহমানবের মত ভাস্কর্য বানাতে পেরেছিল, তারা ভেতরে বাহিরে আজকের আধুনিক মানুষের মতই ছিল – বুদ্ধিমান, সৃজনশীল এবং অনুভূতিসম্পন্ন| স্টডেল গুহার শিল্পীদের সাথে আমাদের মোলাকাত হলে তারা আমাদের ভাষা শিখে নিতে পারত আর আমরাও পারতাম তাদের ভাষা শিখতে| আমরা আমাদের দুনিয়ার সব কিছু তাদের বুঝিয়ে বলতে পারতাম, এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের যাদুর দুনিয়া থেকে থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ধাঁধাটুকু পর্যন্ত| তারাও আমাদের বোঝাতে পারত জীবন ও বিশ্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা|
সত্তুর থেকে তিরিশ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ে স্যাপিয়েন্সদের নতুনভাবে চিন্তা আর যোগাযোগ করার যে সূচনা হলো, তাকেই বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব বলা হয়| কি কারণে এই বিপ্লব ঘটল? আমরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নই| সবচেয়ে প্রচলিত ধারণাটি হচ্ছে কোনভাবে স্যাপিয়েন্সদের জিনে এমন একটা পরিবর্তন এসেছিলো যে এদের মস্তিস্কের কার্যপ্রক্রিয়া গেল অনেকখানি পালটে| এর ফলেই তারা পুরোপুরি নতুন ধরনের ভাষা আবিষ্কার করতে পারল আর এই ভাষা দিয়ে জটিল, বিমূর্ত সব ধারণা নিয়ে ভাবতে শিখল| স্যাপিয়েন্স জিনের এই পরিবর্তনকে বলা যেতে পারে জ্ঞানবৃক্ষের বিকাশ| কেন এটা স্যাপিয়েন্স জিনেই ঘটল, নিয়ান্ডার্থাল বা অন্য কোন মানব প্রজাতির জিনে ঘটল না? আমরা যতটুকু জানি, এটা নিতান্তই ভাগ্য| তবে কেন বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব ঘটল সেটা জানার চেয়ে এই বিপ্লবের ফলাফল কি হল তা জানাটা বেশি গুরুত্বপূর্ন|
এই ‘নতুন’ স্যাপিয়েন্সদের নতুন ভাষায় এমন কি ছিল যা দিয়ে তারা বিশ্বজয় করলো? নতুন এই ধরনের ভাষা কিন্তু স্যাপিয়েন্সদের প্রথম ভাষা না| আসলে প্রতিটা প্রাণীরই নিজস্ব ভাষা আছে| এমনকি তুচ্ছ পোকামাকড় আর পিঁপড়ে অবধি নিজেদের মধ্যে জটিল উপায়ে যোগাযোগ করতে পারে, জানান দিতে পারে সম্ভাব্য খাবারের হদিস| এমনকি এই ভাষা প্রথম মৌখিক ভাষাও নয়| এইপ আর বানর প্রজাতি সহ অনেক প্রাণীরই মৌখিক ভাষা আছে| যেমন, সবুজ বানর নামের এক প্রজাতির বানর বিভিন্ন ভাবে একে অপরকে ডাকে| বিজ্ঞানীরা বের করেছেন যে বিশেষ এক রকম ডাকের মানে হচ্ছে: সাবধান, একটা ঈগল আসছে| আবার আরেক ধরনের ডাকের মানে হচ্ছে: সাবধান, সিংহ দেখা যায়| বিজ্ঞানীরা যখন সবুজ বানরের সামনে প্রথম ডাকের রেকর্ড বাজালেন, তখন বানরগুলো ছুটোছুটি ফেলে আকাশের দিকে ভীত চোখে তাকালো| আর দ্বিতীয় ডাকের রেকর্ড বাজানোর সাথে সাথে বানরগুলো হাঁচোড়পাচোড় করে গাছে চড়ে বসল| প্রাগৈতিহাসিক স্যাপিয়েন্সদের সবুজ বানরের চেয়ে ডাকের ভান্ডার অবশ্যই অনেক বড় ছিল, কিন্তু হাতি বা তিমি মাছের ভান্ডারও কম বড় নয়| একটা টিয়ে পাখিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে সে আইনস্টাইনের তত্বও মুখস্থ বলতে পারবে| আইনস্টাইনের সাথে টিয়ে পাখির মূল পার্থক্য কিন্তু মুখে কথা বলতে পারাতেও নয়| এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব ভাষায়| কি আছে আমাদের এই ভাষায়?
সবচেয়ে সহজ উত্তরটা হচ্ছে, আমাদের ভাষা আশ্চর্য রকমের নমনীয়| খুব সীমিত সংখ্যক ধ্বনি এবং চিহ্নের নানা রকম বিন্যাস ঘটিয়ে আমরা স্বতন্ত্র অর্থের অসীম সংক্ষক শব্দ এবং বাক্য তৈরী করতে পারি| তাই আমরা আমাদের জগৎ সম্পর্কে অগণিত রকমের তথ্য, জ্ঞান বা ধারণা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি, সেগুলো লিখে সংরক্ষণ করতে পারি আর অন্যদের সেগুলো জানাতে পারি| একটা সবুজ বানর হয়ত সাবধান, বাঘ আসছে বলে চিৎকার করে তার সঙ্গীকে সতর্ক করতে পারবে| ব্যাস, এতটুকুই| কিন্তু সত্তুর হাজার বছর আগের একজন আধুনিক স্যাপিয়েন্স তার দলকে বুঝিয়ে বলতে পারত, সকালে নদীর অমুক বাঁকে সে একটা বাঘকে দেখেছে একদল হরিণ তাড়া করতে| কোন কোন পথে সে জায়গায় যাওয়া যায়, বাঘের ভাব গতিক কি, সবই বুঝিয়ে বলতে পারত| তারপর সবাই মিলে শলা-পরামর্শ করে ঠিক করতে পারত কোন পথে সেইখানে যেয়ে বাঘটাকে তাড়িয়ে হরিণগুলোর একটাকে কাবু করা যায়| কোন কোন বিজ্ঞানিদের ধারণা, এরকম প্রয়োজনীয় বিষয় জানতে এবং জানাতেই স্যাপিয়েন্সদের ভাষার বিবর্তন হয়েছে।
অনেক বিজ্ঞানী আবার মনে করেন তথ্যের আদান-প্রদান করতে গিয়েই স্যাপিয়েন্সদের ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছিল, তবে এর মূল প্রেরণা ছিল তারা নিজেরাই, বাঘ বা হরিণের ভূমিকা সেখানে ছিল গৌণ| মানে পাড়া-প্রতিবেশি আর আত্বীয়-স্বজনদের নিয়ে গালগল্প করতে করতেই আমাদের ভাষা বেড়ে উঠেছে| এই তত্ব অনুযায়ী, যেহেতু মানুষ মূলত সামাজিক জীব এবং পারস্পরিক সহযোগিতা মানুষের বেঁচে থাকা আর বংশবিস্তরের জন্য অপরিহার্য, সেহেতু একে অন্যের সম্পর্কে ভালোভাবে জানাটা খুব জরুরী| স্যাপিয়েন্সদের বাঘ বা হরিণ সম্পর্কে তো জানতে হতই| কিন্তু তাদের দলে কে কাকে দু'চোখে দেখতে পারে না, কে কার সাথে প্রেম করছে, কে সৎ আর কে ঠগ সেসব জানা ছিল অতি জরুরি|
মাত্র কয়েক ডজন মানুষের একটা দলের সবার চরিত্র আর সদা পরিবর্তনশীল সম্পর্কের হিসাব রাখতে একজন স্যাপিয়েন্সকে অবিশ্বাস্য পরিমান তথ্য সংগ্রহ করে মাথায় পুরে রাখতে হত| মাত্র পঞ্চাশ জনের একটা দলে শুধু দ্বৈত সম্পর্কই আছে বারশ’ পঁচিশ, আর জটিল বহুমাত্রিক সম্পর্কের তো কোন সীমাসংখ্যাই নেই। তাই উন্নত ভাষা তাদের ভীষণ কাজে লেগেছিল। সব ধরনের এইপ প্রজাতির প্রাণীরই এধরনের গল্পগুজবে চরম আগ্রহ আছে, কিন্তু আধুনিক স্যাপিয়েন্স ছাড়া অন্যদের এর জন্য উপযুক্ত ভাষা নেই| নিয়ান্ডার্থাল বা প্রাগৈতিহাসিক স্যাপিয়েন্সদের নিশ্চই ভাষার দারিদ্র্যের জন্য খুব অসুবিধা হত কাছের মানুষের আড়ালে তাদের দোষ-গুণ অন্যের কাছে বলে বেড়াতে, সোজা ভাষায় গসিপ করতে।
গসিপ করাটাকে আমরা খুব খারাপ চোখে দেখি। তবে দোষ হোক বা গুণ, এই বিশেষ ক্ষমতা ছিল স্যাপিয়েন্স সমাজে দলবদ্ধ হয়ে জটিল সব কাজ করতে পারার একটা বিরাট অনুঘটক। সদ্যপ্রাপ্ত এই ভাষা দিয়ে সত্তুর হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডাবাজির স্বাধীনতা পেয়ে গেল, আর আড্ডার মূল বিষয় ছিল তাদের আত্মীয়, বন্ধু আর সমাজের লোকজন। কথায় কথায় অন্যের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে লাগল তারা। নিজেদের এবং অন্যদের দলের কাকে কাকে বিশ্বাস করা যায়, এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তার বিশ্বস্ত লোকগুলোকে নিয়ে বড় বড় দল তৈরি করতে লাগল, বের করে ফেলতে পারল সঠিক দক্ষতার মানুষগুলোর সাথে একতাবদ্ধ হয়ে নানা রকম বিরাট আর জটিল সব কার্যসিদ্ধির উপায়।
ভাষার বিকাশে গসিপের ভূমিকার তত্বটা নিছক ফাজলামো মনে হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষনায় এই তত্বের যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়। এই আধুনিক যুগেও তো আমাদের যোগাযোগের বিরাট বিষয়বস্তু হচ্ছে গসিপ, তা মুখোমুখি আড্ডাতেই হোক, ইমেইলেই হোক আর দৈনিক কাগজেই হোক। গসিপ করাটা আমাদের চরিত্রের এত গভীরে প্রেথিত যে এই তাড়ণাতেই আমাদের ভাষা বিবর্তিত হয়েছিল, এমনটা ভাবা খুব অস্বাভাবিক না। ইতিহাসের অধ্যাপকরা কি দুপুরের খাবার খেতে খেতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনে করেন আর পদার্থবিজ্ঞানীরা কি কফি খেতে খেতে বোসন কণিকা নিয়ে আড্ডা দেন? ক্বচিৎ-কখনো। কোন অধ্যাপকের পরকীয়া তার বৌয়ের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে, কোন শিক্ষকের পদোন্নতি হয়েছে মামার জোরে আর কোন অধ্যাপক তার গবেষণার টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছে, এগুলোই থাকে তাদের আড্ডার মূল বিষয়। মানুষের আড্ডাবাজির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে অন্যের ভ্রষ্টাচার। পরচর্চাকারীরাই সমাজের আদিমতম সাংবাদিক, যারা সমাজের ঠগ-বাটপার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতো (যদি ধরে নেই তারা শুধু সত্যি কথা বলত)।
খুব সম্ভবত, বাঘ-হরিণ আর গসিপ, দুটো তত্বই কম বেশি সত্যি। তবে আমাদের ভাষা কিন্তু বাঘ হরিনের আর গসিপে সীমাবদ্ধ না, এর অতুলনীয় বৈশিষ্ট হচ্ছে অস্তিত্বহীন বিষয় আর বিমূর্ত ধারণা বুঝিয়ে বলতে পারা। আমাদের জানামতে স্যাপিয়েন্সরাই একমাত্র প্রাণী যারা এমন সব বিষয় নিয়ে পরিষ্কারভাবে ভাবতে আর বলতে পারে, যেগুলো তারা দেখেওনি, শোনেও নি, চাখেও নি, অনুভবও করেনি।
পুরাণ, রূপকথা, ইশ্বর আর ধর্মের প্রথম আগমন ঘটে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের সাথে সাথে। সাবধান, বাঘ আসছে! বহু প্রাণী আর প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এতটুকুই বলতে পারত। কিন্তু বাঘ আমাদের গোত্রের দেবতা, এরকম বিমূর্ত ধারণা আধুনিক মানুষ বোঝাতে পারল বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে। মূর্ত-বিমূর্ত যে কোন বিষয় নিয়ে গল্প করার ক্ষমতা আমাদের ভাষার একটা বিরাট গুণ।
এই বিষয়টা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? গল্প-কাহিনী ভয়ানক রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। মিথ্যা গল্প-কাহিনী বিশ্বাস করে গভীর জংগলে কেউ যদি সোনার হরিণ খুজতে যায়, তার অবস্থাটা কি হবে একবার ভাবুন তো। তেমনই যে লোক বাঘমামার বানোয়াট দেবত্বে বিশ্বাস করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তার পূজা করে, তার মূল্যবান সময় কি নষ্ট হয়না?
অলীক কিচ্ছা-কাহিনীগুলোতে যে শুধু দু-একজন মানুষ বিশ্বাস করত তা নয়, আমদের ভাষার কল্যাণে এসব হয়ে উঠতে লাগল সমষ্টিগত বিশ্বাস। যেমন, কথার যাদুতে আদম হাওয়ার কাহিনী একদিন সত্য হয়ে উঠল, সাধারণ মানুষ হয়ে উঠল অবতার বা নবী, আর জাতীয়তাবাদের বিমূর্ত ধারণা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নিরন্তর দামামা বাজতে শুরু করল। এরকম সমষ্টিগত বিশ্বাস স্যাপিয়েন্সদের হাতে এক অদ্ভুত ক্ষমতা এনে দিল আর তা হল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিরাট সংখ্যক মানুষকে যে কোন ভাবে চালিত করতে পারা। পিঁপড়ে আর মৌমাছিও দলগত ভাবে কাজ করে, কিন্তু তাদের কার্যকলাপ নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ। নিজের দলের বাইরে আর ছকে ফেলা কাজের বাইরে তারা কিছু করতে পারে না। নেকড়ে বাঘ আর শিম্পাঞ্জীদের দক্ষতা পিঁপড়ে বা মৌমাছির চেয়ে বেশি, তারা ছকের বাইরে যেয়ে নানা রকম কাজ করতে পারে। কিন্তু অন্তরঙ্গভাবে চেনা আত্বীয়, বন্ধু বা দলের সদস্যের বাইরে তারা সহযোগিতা করতে পারেনা। একমাত্র স্যাপিয়েন্সই পারে এইসব সীমাবদ্ধতাকে পায়ে ঠেলে অগণিত চেনা-অচেনা লোককে কথার যাদুতে বশ করে করে তাদের দিয়ে অবিশ্বাস্য রকমের বিশাল আর কঠিন সব কাজ করিয়ে নিতে। আর সেকারনেই আমরা বিশ্বের রাজা আর পিঁপড়ে আমাদের ঝুটো খায়, শিম্পাঞ্জী আমাদের খাঁচায় বন্দি জীবন কাটায় অথবা আমাদের গবেষণাগারে নিছক গবেষণার বস্তুতে পরিনত হয়।
কাল্পনিক-বাস্তবতার জগৎ
আমাদের খালাতো ভাই শিম্পাঞ্জিরা সাধারণত কয়েক ডজন সদস্যের সাথে একত্রে মিলেমিশে থাকে। দল অপেক্ষাকৃত ছোট হওয়ায় সেখানে সবার সাথে সবাই ঘনিষ্ট হয়ে যায়। তারা দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে। শিম্পাঞ্জি সমাজ হায়ারার্কিলাল (hierarchical), মানে সেখানে কার অধীনে কে কি কাজ করবে সেটা একদম ধরাবাঁধা। দলের সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ সদস্যকে বলা হয় ‘আলফা মেল’। দলের অন্য সব পুরুষ আর নারী সদস্য মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে আলফা মেলের বশ্যতা স্বীকার করে, ঠিক যেমন আমরা রাজার পায়ে মাথা ঠুকে তাকে প্রণাম করি। আলফা মেল সবসময় চেষ্টা করে দলে সম্প্রীতি বজায় রাখতে। দুই শিম্পাঞ্জির মাঝে লড়াই বাঁধলে আলফা মেল মধ্যস্থতা করে। আলফা মেল আবার নিজের অবস্থানের সুযোগও নেয়। ভাল খাবারটা প্রায়ই নিজের জন্য রেখে দেয়, নিচুস্তরের পুরুষ সদস্যদের নারীদের ধার ঘেসতে দেয় না।
আলফা মেল কে হবে এই নিয়ে প্রায়ই দুই শিম্পাঞ্জির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীরা নিজেদের রাজনৈতিক দলভারী করার জন্য নানা রকম কায়দা-কানুন করে। এই বিরোধীদলগুলোর নিজেদের ভেতর বেশ দহরম-মহরম থাকে, এরা নিজেরা কোলাকুলি করে, চুমু খায়া, একে অন্যের পিঠ চুলকে দেয়। নির্বাচনের আগে রাজনীতিবিদরা যেমন তেলতেলে মুখে আম-জনতার পিঠ চাপড়ে দেয়, ছোট্ট বাচ্চাদের গাল টিপে দেয়, আলফা মেল পদ প্রত্যাশী শিম্পাঞ্জিও একই ভাবে অন্য শিম্পাঞ্জিদের সাথে কোলাকুলি করে, বাচ্চা শিম্পাঞ্জিদের কোলে নিয়ে আদিখ্যেতা করে। শেষ পর্যন্ত আলফা মেল সেই হয়, যে সবচেয়ে বেশি শিম্পাঞ্জির মন জয় করতে পারে। শারীরিক শক্তি এখানে মুখ্য নয়। এই দলবাজী যে আলফা মেল নির্বাচন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে তা না। পরবর্তিতেও একই রাজনৈতিক দলের শিম্পাঞ্জিদের নিজেদের ভেতর ভ্রাত্তিত্ববোধ থাকে প্রবল। এরা নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি আড্ডা দেয়, খাবার ভাগ করে খায়, একে অন্যের উকুন বেছে দেয় আর বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করে।
তবে এই উপায়ে দল খুব একটা বড় করা যায় না, সেটাকে টিকিয়েও রাখা যায় না। দলের সবাই সবাইকে ঘনিষ্টভাবে চিনলে তবেই এরকম দল ঠিকমত কাজ করে। দুইটা শিম্পাঞ্জির মধ্যে যদি কখনো দেখাই না হয়, মারামারি আর বন্ধুতা না হয়, তারা কখনোই একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারবে না, জানতে পারবে না কে পদমর্যাদায় বড়। সাধারণত একজন আলফা মেলের অধীনস্থ একটা শিম্পাঞ্জি দলে বিশ থেকে পঞ্চশ জন সদস্য থাকে। দলের আকার যত বাড়তে থাকে, সেখানে অরাজকতা তত বাড়তে থাকে। অবশষে দল ভেঙ্গে পড়ে, কিছু শিম্পাঞ্জি আলাদা হয়ে নতুন আরেকটা দল তৈরি করে। প্রাণীবিজ্ঞানীরা মাত্র গুটিকয়েক শিম্পাঞ্জি দল খুঁজে পেয়েছেন যেখানে একশ’র বেশি সদস্য আছে। এক দল আরেকদলের প্রতি প্রায় কখনোই সহযোগিতার হাত বাড়ায় না, বরং খাবার আর জায়গা দখল নিয়ে মারামারি করে। প্রায়ই দেখা যায় দুই শিম্পাঞ্জি দল দীর্ঘ সময় ধরে মারামারি করছে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এরকম যুদ্ধে গণহত্যার নমুনাও পেয়েছেন যেখানে এক দলের শিম্পাঞ্জিরা অন্য দলের সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে একে একে খুন করেছে।
প্রাগৈতিহাসিক হোমো স্যাপিয়েন্সসহ অন্যান্য সব মানব সমাজের দশাও মোটামুটি একই রকম ছিল। শিম্পাঞ্জির মত সব মানব প্রজাতিই সহজাতভাবে সামাজিক জীব। এই সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই আদিম মানুষেরা বন্ধুত্ব করতে পারত, দল গঠন করতে পারত, দলবদ্ধ হয়ে শিকার আর যুদ্ধও করতে পারত। কিন্তু জাতভাই শিম্পাঞ্জিদের মতই, আদিম মানবসমাজে দল একটু বড় হলেই ভেঙ্গে পড়ত। এমনকি একটা দলের বিচরণক্ষত্রে যদি বহু লোকের খাদ্যের যোগান থাকলেও খুব বেশি লোক সেখানে কিছুতেই মিলেমিশে থাকতে পারত না। কে কোথায় শিকারে যাবে, কে দলের নেতা হবে, কে বা কার সাথে প্রেম করবে, এত লোকের গ্যাঞ্জামে কিছুতেই তার মিমাংসা হত না।
বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরুতে নতুন ধরনের ভাষা পেয়ে আলাপ আলোচনা আর গসিপের মাধ্যমে হোমো স্যাপিয়েন্সদের এই সমস্যা কিছুটা মিটল, তাদের দলের আকার আরেকটু বড় হল। কিন্তু গসিপের ক্ষমতার একটা সীমা আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, এরকম চেনাজানার মাধ্যমে যে দল তৈরি হয়, তাতে সর্বোচ্চ দেড়শ জন লোক থাকতে পারে। দেড়শ’র বেশি লোকের সম্পর্কে আলাপ করে বিষদভাবে জানা কারো কর্ম নয়।
এমনকি আধুনিক সমজেও আনুমানিক দেড়শ’র বেশি লোকের ভেতরে কোনরকম শক্ত সামাজিক বন্ধন বা বন্ধুত্বের ভিত গড়ে উঠতে পারে না। দেড়শ’র কম সদস্য থাকলে একটা গ্রাম, ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান বা সেনাবাহিনীর সদস্যারা ঘনিষ্ট ব্যাক্তিগত সম্পর্ক আর পরচর্চার মাধ্যমে একে অপরের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারে এবং একটা দল হিসাবে টিকে থাকতে পারে। শৃংখলা বজায় রাখতে সেক্ষেত্রে কোন আনুষ্ঠানিক পদ সৃষ্টি বা আইন-কানুন প্রণয়ন করার প্রয়োজন হয় না। একশ জন সৈন্যের দল কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে যেতে পারে। চরিত্রগুণে একজন সাধারণ লোক হয়ে উঠতে পারে একটা ছোট গ্রামের সর্দার। পারিবারিক ব্যবসা বোর্ড অফ ডিরেক্টর, সিইও বা একাউন্ট্যান্ট ছাড়াই আরামে ব্যবসা করে যেতে পারে।
কিন্তু দেড়শ’র এর বেশি হয়ে গেলেই সাধারণত এরকম স্বতস্ফূর্তভাবে তৈরি দল ভেঙ্গে পড়ে। হাজার হাজার সৈন্যের দল নিশ্চই কোন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম শৃঙ্খলা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পারিবারিক ব্যবসা বাড়তে বাড়তে একসময় এত ছড়িয়ে পড়ে যে ব্যবসার কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করতে হয়, আনুষ্ঠানিক পদ সৃষ্টি করতে হয়, লোকবল বৃদ্ধি করতে হয়। তা না হলে ব্যবসা লাটে ওঠে।
স্যাপিয়েন্সরা কিভাবে এই সীমা অতিক্রম করল? কি করে লক্ষ লক্ষ লোকের সমন্বয়ে গড়ে তুলল নগর, মহাদেশ ব্যাপী সাম্রাজ্য? শুনতে অবাক শোনালেও এর মূল কারণ খুব সম্ভবত কল্প-কাহিনী। একই কাহিনী বিশ্বাস করে অগণিত লোক একই লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে পারে।
স্যাপিয়েন্সদের যেকোন বিশাল কীর্তি, তা হোক আধুনিক রাষ্ট্র, মধ্যযুগীয় গির্জা, প্রাচীন শহর বা বিংশ শতাব্দীর বিশ্বযুদ্ধ, সাধারণত এসবের মূলে থাকে কোন সর্বজনীন বিশ্বাস, যার অস্তিত্ব শুধু মানুষের কল্পনায়, ধারণায়, বাস্তবে নয়। গির্জার মূলভিত্তি খৃষ্টধর্মের বিশ্বাসে। দুজন সম্পূর্ন অপরিচিত ক্যাথলিক খৃষ্টধর্মে বিশ্বাস করে একসাথে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে প্রাণ দিতে পারে। ঈশ্বর যিশুর শরীরে মূর্ত হয়ে আমাদের পাপ মোচন করতে গিয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, এই বিশ্বাসে তারা দলে দলে মানবসেবায় জীবন সমর্পন করতে পারে। সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন আইরিশও একে অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারে, কারণ তারা দুজনেই বিশ্বাস করে আইরিশ জাতিসত্বায়, আইরিশ জন্মভূমির অধিকারে আর আইরিশ পতাকায়। আমাদের আইন ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য নৈতিকতা আর আইনের ধারণা। দুজন অপরিচিত আইনজীবি অচেনা একজন আসামীকে বাঁচাতে একাট্টা হয়ে আইনি লড়াই লড়তে পারেন, কারণ তারা একই আইন, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকারের ধারণায় বিশ্বাস করেন।
মানুষ যে বৃত্তান্ত বা কাহিনী কল্পনা করে আর একে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়, তার বাইরে এসব ধারণার কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের সমস্টিগত কল্পনা জগতের বাইরে নেই কোন ঈশ্বর, না আছে জাতি, নেই মানবাধিকার, আইন অথবা ন্যায়বিচারের অস্তিত্ব।
আদিবাসী নৃগোষ্ঠিগুলো সূর্যদেব আর অশরিরী আত্মায় সমস্টিগতভাবে বিশ্বাস করে, পূর্ণিমা রাতে আগুনের চারপাশে নেচে গেয়ে তারা দেবতার পূজা করে। তারা তাদের শামান বা তথাকথিত ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত বৈদ্যের কথা বেদবাক্য বলে মানে। এই সামষ্টিক বিশ্বাসই তাদের সমাজের ভিত্তিকে দৃঢ় রাখে। এটা বুঝতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়না। আমরা যেটা বুঝতে পারিনা বা বুঝতে চাইনা সেটা হল আমাদের আধুনিক সমাজও ঠিক একইভাবে চলে। যেমন ধরুন আধুনিক সমাজের জনপ্রিয় রাজনিতীবিদের সাথে ওই সামানের খুব বেশি পার্থক্য নেই, তারা দুজনেই জাদুকর। পার্থক্য হচ্ছে আধুনিক রাজনিতীবিদের কথা আমাদের কাছে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয় ওই বুজরুক শামানের চেয়ে। ব্যবসায়ী বা আইনজিবীরাও কম যায়না। কিংবদন্তীসম পুসো (Peugeot) কম্পানি এখানে ভাল একটা উদাহরণ হতে পারে।
মানুষের আবিষ্কৃত সর্বপ্রাচীন শিল্পকর্ম স্টডেল গুহার সিংহমানব সদৃশ লোগো বিশিষ্ট পুসো কম্পানির গাড়ি আর মোটর সাইকেল বিশ্বের সব ধনী দেশেই কম বেশি দেখা যায়। পুসো ইওরোপের সবচে বনেদি আর বড় গাড়ি নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম। পারিবারিক পরিসরে পুসোর যাত্রা শুরু হয়েছিল স্টডেল গুহা থেকে মাত্র তিনশ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ভ্যালেন্টিগনে গ্রামে। আজ পুসো কম্পানিতে দুই লক্ষের বেশি লোক কাজ করে, যাদের বেশিরভাগই একে অন্যের নামও শোনেনি। এই বিশাল সংখ্যক লোকের কিন্তু অসুবিধা হয়না পুসো কম্পানির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে যেতে। প্রতি বছর পুসো লক্ষ লক্ষ গাড়ি বানায় আর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করে।
কিন্তু পুসো আসলে কে বা কি? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ পুসো গাড়ি আছে, কিন্তু সেগুলো তো পুসো কম্পানি নয়। পৃথিবীর সমস্ত পুসো গাড়ি যদি ভেঙ্গে চুরমার করে ভাঙ্গারীর কাছে বেচে দেওয়া হয়, তাহলেও পুসো কম্পানি মরে যাবে না। পুসোর অনেক কারখানা আছে, মেশিনপত্র আছে, আবার পুসোয় কাজ করে বহু ইঞ্জিনিয়ার আর একাউন্ট্যান্ট। কিন্তু এসব জিনিষ অথবা পুসোর কর্মী, কেউই কিন্তু পুসো নয়। একটা ভয়াবহ ঝড়ে পুসোর সব কর্মী মারা যেতে পারে, ধংস হয়ে যেতে পারে পুসোর সব কারখানা, যন্ত্রপাতি। তবুও পুসোর অস্তিত্ব থাকবে। পুসো টাকা ধার করে আবার সবকিছু নতুন করে গড়তে পারবে। কম্পানিটার ম্যানেজার আছে, শেয়ারহোল্ডার আছে। কিন্তু তারাও পুসো নয়। ম্যানেজারকে ছাঁটাই করা যাবে, সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া যাবে। তবু পুসো রয়ে যাবে।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে পুসো কম্পানিটি মৃত্যুঞ্জয়। বিচারপতি যদি আইন মোতাবেক পুসোর বিলুপ্তি ঘোষণা করেন, তাহলে পুসোর কারখানাগুলো দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকবে, এর কর্মীরা কাজ করে চলবে, কিন্তু পুসো আর থাকবে না। বোঝা যাচ্ছে যে বস্তুগত জগতের সাথে পুসোর কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে সত্যই কি পুসোর অস্তিত্ব আছে?
পুসোর অস্তিত্ব আছে আমদের সামস্টিক কল্পনায়। পুসোর মালিকরা পুসো ব্র্যান্ডের জন্ম দিয়েছে আর আইনজীবিরা একে দিয়েছেন ‘আইনগত অস্তিত্ব’। কোনকিছুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলা সম্ভব নয়, এই পুসো! এটা কোন জাগতিক বস্তু না। কিন্তু আইনি সত্বা হিসাবে পুসো ঠিকই বিরাজ করে। আমাদেরই মত পুসোকে দেশের আইন কানুন মেনে চলতে হয়, কর দিতে হয়। আমাদের মতই পুসো ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারে, সম্পত্তির মালিক হতে পারে। পুসোর বিরুদ্ধে মামলাও করা যায়। বিচারপতি চাইলে পুসোকে ‘সাজা’ও দিতে পারেন, পুসোর মালিক বা কর্মিদের সে সাজার ভাগিদার হতে হবে এমনও কোন কথা নেই।
পুসো এক বিশেষ ধরনের আইনি ‘গল্প’ বা আইনি ধারণার অন্তর্ভুক্ত, যাকে বলা হয় লিমিটেড লায়াবিলিটি। লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানির ধারণা আধুনিক মানুষের আবিষ্কৃত সবচেয়ে চতুর ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। স্যাপিয়েন্সরা লক্ষ লক্ষ বছর এই ধারণা ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছে। মাত্র কয়েকশ বছর আগেও শুধু রক্ত-মাংসের মানুষ সম্পত্তির মালিক হতে পারত। ধরুন তেরশ’ শতকের ফরাসি নাগরিক জ্যাঁ ঘোড়ার গাড়ি বানানোর ব্যবসা শুরু করল, জ্যাঁর বাইরে কিন্তু সে ব্যবসার কোন অস্তিত্ব থাকা সম্ভব ছিল না। জ্যাঁ তার কোন খরিদ্দদারকে ঠকালে রেগেমেগে সে খরিদ্দার কিন্তু জ্যাঁর বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দিতে পারত। জ্যাঁ যদি ব্যাবসা করার জন্য হাজার স্বর্ণমূদ্রা ধার করে ব্যবসায় ফেল করত, তাহলে ঘর-বাড়ি বা গরু বিক্রি করেও জ্যাঁকেই সে ঋণ শুধতে হত। এমনকি প্রয়োজনে নিজের ছেলেমেয়েকে দাস হিসাবে বিক্রি করে হলেও জ্যাঁকে ঋণ শোধ করতে হত। কোনমতেই ঋণ শোধ করতে না পারলে জ্যাঁকে হয় জেলে পচতে হত অথবা দাস হিসাবে কাজ করতে হত তার মহাজনের কাছে। জ্যাঁ তার ব্যবসার সবরকম বাধ্যবাধকতার জন্য ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী থাকত।
ওই পরিস্থিতিতে একটা ব্যবসা খোলারে আগে নিশ্চই যে কেউ দুবার ভাবত। এরকম আইন ব্যবস্থা উদ্যোক্তাদের জন্য খুব একটা সহায়ক ছিল না। লোকে নতুন ব্যবসা শুরু করার অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিতে ভয় পেত। ব্যবসায় সফল না হলেই যেখানে বিরাট পারিবারিক দূর্যোগ নেমে আসার সম্ভাবনা, সেখানে এই ঝুঁকি নেওয়ার যৌক্তিকতা আসলে খুব বেশি ছিল না।
সে কারণেই মানুষ লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানির ধারণাটা সমষ্টিগত ভাবে কল্পন করতে শুরু করে, এমন একটা কম্পনি যার আইনি অস্তিত্বের সাথে এর মালিক বা এখানে যারা কাজ করে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। গত কয়েক শতাব্দীতে লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানিগুলো বলতে গেলে পুরো পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়েছে। আমরা লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানির সাথে এত বেশি পরিচিত যে আমরা কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনা যে লিমিটেড লায়বিলিটি বিষয়টার বসবাস শুধুই আমাদের কল্পনায়। আমেরিকায় লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানিগুলোকে বলা হয় করপোরেশান। বিষয়টা একটু কৌতুকপূর্ণ, করপোরেশান শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ কর্পাস (Corpus) থেকে, যার অর্থ দেহ, যে জিনিষটা করপোরেশানের নেই। করপোরেশানের সত্যিকারের দেহ নেই তো কি, আমেরিকার আইন তাকে ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করে, যেন সে রক্তমাংসের একজন মানুষ। ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের আইনও একইভাবে পুসোকে গণ্য করেছিল। আরমান্ড পুসো যখন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সাইকেল কারখানা গুটিয়ে গাড়ির ব্যবসায় ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলেন, ফরাসী আইন অনুযায়ী তিনি একটা লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানি চালু করলেন। কোম্পানির নাম তিনি নিজের নামে রাখলেন ঠিকই, এর প্রতি ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। পুসোর কোন গাড়ি যদি অপ্রত্যাশিতভাবে নষ্ট হয়ে যায়, ক্রেতা পুসো কোম্পানিকে দায়ী করতে পারবে, কিন্তু আরমান্ড পুসো কে নয়। যদি কোটি কোটি টাকা ধার বাকী রেখে কোম্পানীটি বসে পড়ে, আরমান্ড পুসোর কোন দায় থাকবে না সে ধার শুধতে। কারণ ধারটা তো পুসো কম্পানি নিয়েছিল, রক্ত মাংসের স্যাপিয়েন্স আরমান্ড পুসো নয়। আরমান্ড পুসো প্রায় একশ বছর আগে দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু পুসো কোম্পানি এখনো দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে।
কি করে রক্ত মাংসের পুসো কোম্পানী পুসোর জন্ম দিয়েছিলেন? ঠিক যেভাবে যুগে যুগে ধর্মযাজকেরা জন্ম দিয়েছেন ইশ্বরের আর ওঝারা জন্ম দিয়েছেন ভূত-প্রেত আর শয়তানের। এসব কিছুর গুপ্ত কৌশল হল বিমূর্ত কল্পনাকে গল্পে-কথায় প্রকাশ করা আর সেই গল্প এমনভাবে বলা যে লোকে সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। ফরাসী পাদ্রীরা কি করে প্রতি রবিবার যিশুর দেহ সৃষ্টি করতেন, সে গল্পটা এখানে বেশ যুতসই। যিশুর জীবন-মৃত্যু নিয়ে ক্যাথলিক গির্জার অধিপতিরা যে গল্পটি বানিয়েছিলেন সেটাই এখানে মূল ভূমিকা পালন করেছে। এই গল্প অনুযায়ী, একজন ক্যাথলিক পাদ্রী যদি তার পবিত্র পোষাক পরিধান করে সঠিক লগ্নে মোক্ষম মন্ত্রটা উচ্চারণ করেন, তবে নাকি ওয়াইন আর রুটি ইশ্বরের দেহে রূপান্তরিত হয়। তাই প্রতি রবিবার ফরাসী পাদ্রীরা ওয়াইন আর রুটি হাতে নিয়ে খটোমটো লাতিন মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর তাতেই এই সামন্য খাদ্য পানীয় রূপ নিত ইশ্বরের দেহে। পাদ্রীরা যখন গম্ভীর মুখে সব ‘নিয়ম কানুন’ মেনে এই আচার পালন করতেন, অগণিত ফরাসী ক্যাথলিক তখন বিশ্বাস ঠিকই বিশ্বাস করতেন যে ওই মন্ত্রপড়া ওয়াইন রুটিতে ঈশ্বর আছে।
পুসোর ক্ষেত্রে ফরাসী সংসদ কোম্পানী আইনের আদলে গল্পটা তৈরি করেছিল। ফরাসী আইন অনুযায়ী, একজন আইনজীবী যদি ফরাসী সাংসদদের উদ্ভাবিত কিছু শর্ত পূরণ করতে একজন ব্যবসায়ীকে সাহায্য করতে পারেন, তাহলেই জন্ম হয়ে যায় একটা কোম্পানীর। ১৮৯৬ সালে আরমান্ড পুসোও একজন আইনজীবীর সাহায্য নিয়েছিলেন পুসো কম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে। সে আইনজীবী যখন নির্দিষ্ট কিছু ‘আচার’ পালন করে পুসোর অস্তিত্ব ঘোষণা করলেন, সাথে সাথে ফরাসী জনগণও স্বিকার করে নিল যে পুসো সত্যিই আছে!
বিশ্বাসযোগ্য গল্প বলা খুব কঠিন একটা কাজ। গল্প বলা হয়ত খুব সোজা, কিন্তু গল্পটাকে সত্য বলে চালানো তত সোজা না। তবু ইতিহাসের শুরু থেকেই কি করে স্যাপিয়েন্সরা গল্প দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে শিখল পুরো পৃথিবী, সেটা একটা রহস্যই বটে। কি করে ঈশ্বর, জাতীয়তা অথবা লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানির মত বিমূর্ত ধারণাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে সমগ্র স্যাপিয়েন্স সমাজ?
একটা গল্প যখন সত্যি হয়ে যায় তখন তার ক্ষমতা হয় সীমাহীন। সংক্ষ্যায় লক্ষ লক্ষই হোক আর কোটি কোটিই হোক, একটা গল্পের বিশ্বাসীরা একযোগে সেই গল্পের লক্ষ্য হাসিল করতে কাজ করে যেতে পারে। তাই গণবিশ্বাস স্যাপিয়েন্সের হাতে এনে দিতে পারে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ভাবুন তো আমরা যদি শুধু পার্থিব বস্তু, যেমন নদী, গাছ বা সিংহ নিয়ে গল্প সাজাতাম তাহলে কি সম্ভব হত রাষ্ট্র, গির্জা বা আইন ব্যবস্থার মত শক্তিশালী বিষয়গুলো দিয়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করা?
সময়ের সাথে স্যপিয়েন্সরা বিশ্বাসযোগ্য গল্পের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে করতে প্রকান্ড সব সত্যরূপী মহাকাব্য রচনা করে চলেছে। এসব মহাকাব্যের পটভূমিতে পুসোর মত বিমূর্ত ধারণা শুধু প্রাণই পায় না, দাপটের সাথে রাজত্ব করে চলে। এধরণের বিশ্বাসযোগ্য গল্পগুলোকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন ‘সোসাল কন্সট্রাক্ট’ (সমাজ ও জীবনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মনুষ্যসৃষ্ট প্রচলিত ধারণা) বা কল্পিত-বাস্তবতা। কল্পিত-বাস্তবতা কিন্তু মিথ্যা নয়। নদীর ধারে কোন বাঘ নেই, সেটা পরিষ্কার জানা সত্বেও আমি যদি বলি বাঘ আছে, সেটা হবে নির্জলা মিথ্যা। এরকম মিথ্যা বলাটা স্যাপিয়েন্সদের একার কৃতিত্বও নয়। যেমন সবুজ বানর বা শিম্পাঞ্জিও এরকম মিথ্যা ‘বলতে’ পারে। বিজ্ঞানীরা একবার দেখেছেন একটা সবুজ বানর আসে পাশে বাঘ না থাকা সত্যেও চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান, বাঘ! অন্য বানরগুলো সে ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে গাছে চড়ে বসল। সেই ফাঁকে মিথ্যাবাদী পাঁজী বানরটা সদ্য খুঁজে পাওয়া কলার ছড়ি একাই সাবড়ে দিল।
কিন্তু কল্পিত-বাস্ততার সাথে নির্জলা মিথ্যার পার্থক্য হল, কল্পিত-বাস্তবতা অনেক লোক একসাথে সত্য বলে বিশ্বাস করে, আর যতদিন সে গণবিশ্বাস অটুট থাকে, এর ক্ষমতা হয় অসীম। স্টেডেল গুহার শিল্পি হয়ত মনে মনে ঠিকই বিশ্বাস করতেন সিংহ মানবের অস্তিত্ব। ঠিক তেমনি স্যাপিয়েন্স সমাজের বেশিরভাগ লোক এখনো বিশ্বাস করে ঈশ্বর আর শয়তানে, দেবদেবী আর অবতারে। বড়লোকেরা বিশ্বাস করে লিমিটেড লায়াবিলিট কম্পানীতে। মানবাধিকার কর্মী বিশ্বাস করে মানবাধিকারের সত্য্যতা। জাতিসঙ্ঘ যখন অভিযোগ করেছিল যে লিবিয়ার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, সেটা কিন্তু মিথ্যা ছিল না, যদিও জাতিসঙ্ঘ, লিবিয়া বা মানবাধিকার, সবই আমাদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত ধারণা।
তাই বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরু থেকেই স্যাপিয়েন্সরা হয়ে গেল দুই জগতের বাসিন্দা। একদিকে গাছপালা, পাহাড়, নদী ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত বাস্তব জগত, আরেক দিকে ঈশ্বর, জাতিসত্বা, করপোরেশান ইত্যাদি -বিমূর্ত বিষয় নিয়ে গড়ে তোলা কল্পিত-বাস্তবতার জগত। স্যাপিয়েন্স সমাজ যত উন্নত হচ্ছে, এসব কল্পিত-বাস্তবতার শক্তি ততই বেড়ে চলেছে। তাই আজ বাস্তব জগৎ যেমন নদী, বন, সাগর আর প্রাণীজগৎ জিম্মি ঈশ্বর, রাষ্ট্র আর করপোরেশানের হাতে।
জিনকে পাশ কাটিয়ে
কথার যাদুতে তৈরি ইশ্বর এবং জাতিসত্বার মত কল্পিত-বাস্তব বিষয়গুলো ব্যবহার করে স্যাপিয়েন্স সমাজ বিপুলসংক্ষক মানুষের পারস্পরিক সহযোগীতায় নানা ধরনের কাজ করার সামর্থ অর্জন করল। কিন্তু কল্পিত বাস্তবতার শক্তি শুধু এতেই সীমাবদ্ধ না। যেহেতু এই ধরণের গণ-সহযোগীতার মূল অনুপ্রেরণা হল কল্পিত বৃত্তান্ত, তাই এই বৃত্তান্তটা পরিবর্তন করে গণ-সহযোগীতার ধরণও পালটে দেওয়া সম্ভব। আর সুবিধাজনক অবস্থায় কল্পিত বৃত্তান্ত খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জনগণ প্রায় রাতারাতি রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতার কল্পিত-বাস্তবতা থেকে সরে এসে জনগণের অধিকারের কল্পিত বাস্তবতায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের ফলে তাই প্রয়োজন মোতাবেক স্যাপিয়েন্স সমাজের আচরণ এবং মনোভাব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকল। এর ফলে ধীরগতির জিন বিবর্তনকে পাশ কাটিয়ে স্যাপিয়েন্স সমাজ দ্রুত-পরিবর্তনশীল সংস্কৃতির বিবর্তনের মুখোমুখি হল। তারা কঠিন থেকে কঠিনতর সহযোগীতার ভিত তৈরি করে লাগল। এই সংস্কৃতির বিবর্তনের ঘোড়ায় চেপে স্যাপিয়েন্সরা অন্য সব মানব প্রজাতি আর প্রাণী জগতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
আর দশটা সামাজিক জীব যেমন শিম্পাঞ্জি বা হাতির আচরণ নির্ভর করে জিনের ওপর। এটা ঠিক যে তাদের ব্যবহার পরিবেশের উপরেও নির্ভর করে। তবে একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে একই প্রজাতির প্রাণীরা সাধারণত একই রকম আচরণ করে। জিনের বিবর্তন ছাড়া এদের আচরণে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসা সম্ভব না। যেমন শিম্পাঞ্জি সমাজের আলফা মেলের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে থাকার তাড়ণাটা এদের জিন থেকেই এসেছে। আবার শিম্পাঞ্জিদের ঘনিষ্ট আত্মিয় বেবুন সমাজ হল সাম্যবাদী, সেখানে দলের নেতৃত্ব দেয় নারী বেবুনদের একটা কোয়ালিশান। নারী শিম্পাঞ্জিরা যতই বেবুন সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন দেখুক, তাদের মাথায় কখনো আন্দোলনের ভূত চাপবে না। পুরুষ শিম্পাজিরা কখনো পারবে না নিজেরা আলাপ আলোচনা করে আলফা মেলের গদি ধরে টান দিয়ে নিজেদের সমঅধিকার আদায় করতে। শুধুমাত্র জিনের পরিবর্তনে এধরণের ব্যাপক পরিবর্তন আসা সম্ভব।
একই কারনে প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজ কোন বিপ্লব শুরু করতে পারেনি। আমরা যতদূর জানি, তাদের সমাজে যেসব কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছিল, তারা যেসব নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল অথবা যে নতুন ভূখন্ডে বসতি স্থাপন করেছিল, তার পেছনে সংস্কৃতির বিবর্তনের চেয়ে জিনের বিবর্তন আর পরিবেশের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। তাই প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে উন্নয়নের গতি ছিল ভয়ংকর রকমের ধীর। হোম ইরেক্টাসরা বিশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীত এসেই পাথরের ধারালো অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল। প্রত্নতত্ববিদরা পাথরের অস্ত্রকে ইরেক্টাসদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট বলে মনে করেন। তবে এই পাথরের অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি পরবর্তী বিশ লক্ষ বছরে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।
অন্যদিকে, বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরু থেকেই স্যাপিয়েন্সারা সংস্কৃতির বিবর্তনের ফলে দ্রুত আচরণ পরিবর্তন করতে শুরু করল আর কোন রকম জিনের বিবর্তন ছাড়াই এই পরিবর্তিত আচরণ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে দিয়ে যেত সক্ষম হল ভাষার সাহায্যে। এমনকি সংস্কৃতির বিবর্তন জিনের প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত শুরু করল। এর মোক্ষম উদাহরণ হল ক্যাথলিক পাদ্রী আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। ভবিষ্যত প্রজন্ম রেখে যাওয়ার তাড়ণা মানুষসহ যেকোন প্রাণীর জিনে প্রচন্ড শক্তিশালী। বিবর্তনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বংশবিস্তার। কিন্তু লক্ষ কোটি পাদ্রী আর ভিক্ষু ধর্মের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে বিবর্তকে কাঁচকলা দেখিয়ে চিরকুমার থেকে যায়। পরিবেশগত বিষয় যেমন খাদ্যের অভাব কিন্তু তাদের এই সংযমের কারণ না। আবার এর পেছনে জিনের বিবর্তনেরও ভূমিকা নেই। ক্যাথলিক গির্জা শত-সহস্র বছর ধরে রাজত্ব করে চলেছে এর সংযমী পাদ্রীদের মাধ্যমে। ক্যাথলিক পাদ্রীদের যেহেতু বাচ্চাই হয়না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই সংযম কিন্তু জিনের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বাইবেলের গল্প আর ক্যাথলিক গির্জার আইন এখানে জিনের ভূমিকা পালন করেছে।
কাজেই যেখান প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আচরণ পরিবর্তন হতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছে, সেখানে স্যাপিয়েন্স সমাজে পরিবর্তন এসেছে খুব দ্রুত। কয়েক দশকের ভেতরেই সামাজিক সংগঠন, পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্যাপিয়েন্স সমাজে ব্যপক পরিবর্তন আসতে পারে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বার্লিনে জন্ম নেওয়া দীর্ঘজীবি একজন লোকের কথা ভাবুন। তার প্রথম জীবন কেটেছিল হোহেনযোলার্ন সম্রাজ্যের সম্রাট উইলহেম-২ এর অধীনে, তারুন্য কেটেছে ওয়াইমার প্রজাতন্ত্রে, মাঝবয়েসে এসে সে হয়ত নাৎসি সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেছে, তারপর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সবশেষে অখন্ড গণতান্ত্রিক জার্মানিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। সে কিন্তু কোন রকম জিনগত বিবর্তন ছাড়াই সম্পূর্ণ আলাদা পাঁচ রকম সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়েছে।
এটাই ছিল স্যাপিয়েন্স সাফল্যের মূলমন্ত্র। হাতাহাতি লড়াইয়ে নিয়ান্ডার্থালরা হয়ত সবসময়ই জিতত। কিন্তু স্যাপিয়েন্সরা যখন শত শত এমন কি হাজারে হাজার সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে কখনই সম্ভব হত না যুদ্ধে টিকে থাকা। নিয়ান্ডার্থালরা হয়ত সিংহ কোথায় আছে, এধরণের খবর আদান প্রদান করতে পারত, কিন্তু তারা না পারত স্যাপিয়েন্সদের মত কল্পিত-বাস্তবতার জন্ম দিয়ে বহু লোকের সমন্বয় করতে, না পারত কল্পিত বাস্তবতা পরিবর্তন করে নিজেদের সামাজিক আচরণ বা মানসিকতায় প্রভাব ফেলতে।
এটা সত্যি যে নিয়ান্ডার্থালদের মাথার ভেতরে ঢুকে আমরা দেখে আসতে পারব না তারা ঠিক কিভাবে চিন্তা করত, কিন্তু তাদের বুদ্ধিমত্তা যে স্যাপিয়েন্সদের তুলনায় একটু কম ছিল তার অনেক রকম পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ববিদরা ইউরোপের মাঝবরাবর খুঁজে পাওয়া তিরিশ হাজার বছর আগের স্যাপিয়েন্সদের আবাসস্থলে ভূমধ্যসাগর আর আটলান্টিকের সঙ্খ খুঁজে পেয়েছেন। খুব সম্ববত, বিভিন্ন স্যাপিয়েন্স দলের পারস্পরিক অর্থনৈতিক লেনদেনের ফলে বহু হাত ঘুরে দূর সাগরের শঙ্খ সেখানে পৌছেছিল। নিয়ান্ডার্থালদের আবাসস্থলে এধরণের লেনদেনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া নিয়ান্ডার্থালদের সমস্ত কিছুই ওই এলাকা থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছিল।
আরেকটা ভাল উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপ নিউ গিনির উত্তরে অবস্থিত নিউ আয়ারল্যান্ড দ্বীপ। ওখানকার প্রাচীন স্যপিয়েন্স অধিবাসীরা অবসিডিয়ান নামের প্রচন্ড শক্ত কাঁচ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্র বানাতো। তবে অবসিডিয়ায়ান কিন্তু নিউ আয়ারল্যান্ডে পাওয়া যায় না। গবেষোনাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে নিউ আয়ারল্যান্ডের অবসিডিয়ান এসেছে এই দ্বীপ থেকে চারশ’ কিলোমিটার দুরের নিউ ব্রিটেন দ্বীপ থেকে। তার মানে, এই অঞ্চলের আদিম লোকেরা নিশ্চই দক্ষ নাবিক ছিল, যারা অবসিডিয়ান দ্বীপ থেকে দ্বীপে ফেরি করে ফিরত, তা না হলে এত দুরের পাথর কি করে নিউ আয়ারল্যান্ডে এল?
ব্যাবসা-বাণিজ্য নিতান্তই পার্থিব একটা বিষয়, এর জন্য কোন কল্পিত-বাস্তবতার ভিত্তি প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্যাপিয়েন্স ছাড়া অন্য কোন মানব প্রজাতির বাণিজ্য করার নজির নেই। তাছাড়া প্রাচীন স্যাপিয়েন্সদের যেসব ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারিত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে তার সবগুলোই কল্পিত-বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। বিশ্বাস ছাড়া বাণিজ্য হয়না, আর অচেনা লোকের ওপর বিশ্বাসও রাখা যায়না। আধুনিক সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর করে আমরা কতটা বিশ্বাস রাখতে পারি বিভিন্ন কল্পিত ধারণায়, যেমন টাকার মূল্য, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আর যার কথা বললেই নয়, করপোরেশান। প্রাচীন স্যাপিয়েন্স সমাজে যখন দুজন অচেনা লোক বাণিজ্য করতে আসত, তারা হয়ত দিব্যি কাটত ব্যাঘ্র অথবা সূর্য দেবতার, অথবা এমন কোন দেবতার যাকে দুজনেই বিশ্বাস করত। আর আদিম মানুষেরা যেহেতু শঙ্খ বা অবসিডিয়ানের মত দ্রব্যের লেনদেন করত, খুব সম্ভব তারা তথ্য আর কল্পিত বাস্তবতার ধারণাও লেনদেন করত। এর ফলে স্যাপিয়েন্সদের জ্ঞান আর তথ্যের ভান্ডার জ্যামিতিক হারে বাড়তে লাগল, যেটা নিয়ান্ডার্থাল বা অন্য কোন মানব প্রজাতির ক্ষেত্রে হয়নি।
শিকারের কৌশল এখানে স্যাপ্যেন্সদের সাথে অন্য মানব প্রজাতির পার্থক্যের আরেকটা ভাল উদাহরণ হতে পারে। নিয়ান্ডার্থালরা সাধারণত একা বা ছোট দলে শিকার করত। কিন্তু স্যাপিয়েন্সরা ডজন ডজন লোকের দল এমনকি অন্য গোত্রের সদস্যদের সাথে মিলেও শিকার করত। একটা বিশেষ কায়দা ছিল, অনেকগুলো শিকার একসাথে ঘিরে ধরে পরিকল্পিতভাবে তাদের একটা ফাঁদ, যেমন দুই পাহাড়ের খাঁজের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয় আর তারপর ফাঁদে আটকা প্রাণীগুলোকে একসাথে জবাই করা। ভাগ্য ভাল থাকলে এই কায়দায় এক বিকেলেই মণকে-মণ মাংস, চর্বি আর চামড়া মিলে যেত। অতিরিক্ত খাবার শুকিয়ে রাখা যেত। ঠান্ডা এলাকা হলে জমিয়েও রাখা যেত। প্রত্নতত্ববিদরা এমন সব স্থান খুঁজে পেয়েছেন যেখানে নিয়মিত বন্য প্রাণির গণহত্যা হত। আবার এরকম অনেক জায়গায় বেড়া বানিয়ে কৃত্তিমভাবে ফাঁদ বানানোর নজিরও আছে। নিয়ান্ডার্থালরা যে তাদের আদি ভূমিতে স্যপিয়েন্সের এহেন দৌরাত্ম পছন্দ করেনি সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই দুই প্রজাতির মধ্যে যদি যুদ্ধ বাঁধত, নিয়ান্ডার্থালরা বুনো ঘোড়ার চেয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারত না। বড়জোর পঞ্চাশজন নিয়ান্ডার্থাল একত্র হয়ে যুদ্ধে নামতে পারত। কিন্তু শত শত বুদ্ধিমান স্যাপিয়েন্স যখন একতাবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তখন তাদের সাথে নিয়ান্ডার্থালরা পারবে কেন? এমনকি স্যাপিয়েন্সরা যদি প্রথম দফায় হেরেও যেত কোনোভাবে, দ্রুত নতুন কৌশল আবিষ্কার করে আবার পূর্নোদ্যমে মাঠে নেমে নিয়ান্ডার্থালদের একচোট দেখে নিতে পারত।
বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবে কি কি ঘটেছিল

১) নিজেদের ভেতর নিজেদের বস্তুজগৎ নিয়ে প্রচুর পরিমাণ তথ্যের আদান প্রদান করার ক্ষমতা, যার ফলে জটিল ধরণের পার্থিব কাজের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছল যেমন সিংহকে এড়িয়ে চলা, বাইসনের মত বড় প্রাণী শিকার করা।
২) সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের ভেতর প্রচুর পরিমানে তথ্যের আদান প্রদান করার ক্ষমতা, যার ফলে বড় কিন্তু শক্ত দল গঠন করা সম্ভব হয়েছিল, যে দলের সদস্য সংখ্যা দেড়শ’ পর্যন্ত হতে পারত।
৩) যেসব জিনিষের পার্থিব অস্তিত্ব নেই, যেমন ইশ্বর, মানবাধিকার লিমিটেড লায়বিলিটি কোম্পানি, এসব ধারণা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে পারা এবং এসব বিষয়ে তথ্যের আদান প্রদান করতে পারার ক্ষমতা যার ফলে বিপুল সংখ্যক স্যাপিয়েন্সের ভেতর একতা সৃষ্টি সম্বব হল এবং সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত পরিবর্তন সম্বব হল।
ইতিহাস ও জীববিজ্ঞান
স্যাপিয়েন্সদের সৃষ্টি অবিশ্বাস্য রকমের বৈচিত্রময় কল্পিত-বাস্তবতার ধারণা, এবং এসব ধারণার মাধ্যমে প্রভাবিত স্যাপিয়েন্স সমাজের বিচিত্র আচার-আচরণ, দুটোই মানব সংস্কৃতির মূল উপাদান। স্যাপিয়েন্সদের কল্পিত বাস্তবতার মত তাদের সংস্কৃতিও দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং বর্ধনশীল। সংস্কৃতির এই পরিবর্তন আর বর্ধনের কাহিনী নিয়েই রচিত ইতিহাস।
মূলত বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের সূচনালগ্নে জীববিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক গেল ঘুচে। এর আগের ইতিহাসের বিষয়বস্তু ছিল বিবর্তন আর পরিবেশের প্রভাবে মানুষসহ সমস্ত জীবজগতের ভেতরে ঘটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা ঘটনা, যেগুলোকে আমরা প্রাগৈতিহাসিক বিষয় বলে থাকি। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের পর থেকে জীববিজ্ঞানের তত্ব নয় বরং ঐতিহাসিক কার্যকারণ হয়ে উঠল স্যাপিয়েন্সদের উন্নয়ন ব্যাখ্যা করার মূলভিত্তি। মাথা কুটে মরলেও খৃষ্টধর্মের উত্থান বা ফরাসী বিপ্লবের ব্যাখ্যা জিনের বিবর্তনে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বিশ্বাস, আদর্শ, কল্পনার মিথষ্ক্রীয়া বুঝতে পারা এখানে বেশি প্রয়োজন।
তার মানে এই নয় যে স্যাপিয়েন্সদের মানব সংস্কৃতি জৈবিক বিধানগুলো অবজ্ঞা করার ঔধ্যত্ব অর্জন করল। আমরা এখনো মূলত প্রাণী, আমাদের জৈবিক, আবেগিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোর ওপর জিনের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমজের মূলভিত্তি নিয়ান্ডার্থাল বা শিম্পাঞ্জি সমাজের মতই। অনুভূতি, আবেগ পারিবারিক বন্ধন – এসব বিষয় যত নিবিড়ভাবে দেখব, ততই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে আমাদের জাতভাইদের সাথে আমাদের সাদৃশ্য।
তবে স্যাপিয়েন্সদের সাথে অন্য মানব বা এইপ প্রজাতির তুলনা পারিবারিক, এমনকি আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের পর্যায়ে করাটা হবে ভুল। এসব বিচারে এদের সাথে আমাদের মিলের পরিমাণ এত বেশি যে বিষয়টা আমদের মত নাকউঁচু প্রাজতির জন্য বিব্রতকরই বটে। আসল পার্থক্যটা শুরু হয়ে দেড়শ’ জনের বেশি লোকের ক্ষেত্রে, সংখ্যাটা হাজার দু’হাজার ছাড়িয়ে গেলে এই পার্থক্যটা হয়ে যায় অপরিসীম। আমরা যদি হাজার দুয়েক শিম্পাঞ্জি এক জায়গায় জড়ো করে তাদের ঘাড়ে তিয়ানানমেন স্কয়ারে আন্দোলন গড়ে তোলা অথবা জাতিসংঘের মত শিম্পাঞ্জি-সংঘ চালানোর দায়িত্ব তুলে দেই, তাহলে একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে না? অন্যদিকে স্যাপিইয়েন্সদের কাছে হাজার হাজার লোকের সুসংহত সমাবেশ কোন ব্যপারই নয়। European Organization for Nuclear Research বা সার্নে সারা পৃথিবীর ছয়শোর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বারো হাজারের মত পদার্থবিজ্ঞানীরা মিলেমিশে বিশাল সব বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে যাচ্ছেন। এক ধর্মে অনুসারীরা একযোগে একই ভাবে একই সময়ে সারা বিশ্বব্যপী ধর্মোৎসব পালন করে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে সব দেশের ব্যবসায়ীরা একই নিয়ম অনুসরণ করে, এরকম আরো কত কি। শিম্পাঞ্জি আর আমাদের পার্থক্যটা হচ্ছে কল্পিত-বাস্তবতার অদৃশ্য সূতোয়, যে সূতো বিপুল সংখ্যক লোক, পরিবার, গোষ্ঠি এমনকি জাতিকে একই বিমূর্ত ধারণার বাঁধনে বেঁধে রাখে। এই সূতোই আমাদের দিয়েছে পুরো জীবজগতের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের শক্তি।
এটা সত্যি যে আমাদের অন্যান্য অনেক দক্ষতাই দরকার ছিল, যেমন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি এবং ব্যবহার করার দক্ষতা। তবে এই দক্ষতা খুব বেশিদূর যেতে পারে না যদি না এর সাথে যুক্ত হয় বহু লোকের মাঝে সমন্বয় সাধনের যোগ্যতা। মাত্র তিরিশ হাজার বছর আগেই আমাদের সম্বল ছিল লাঠিসোটা আর তীর ধনূক, বর্তমানে পৃথিবীকে বার বার ধংস করে দেওয়ার মত আণবিক বোমার মজুদ আছে আমদের। শারিরীকভাবে আমাদের যন্ত্রপাতি তৈরির দক্ষতা তিরিশ হাজার বছর আগের তুলনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আইনস্টাইনের হাতের দক্ষতা খুব সম্ববত যেকোন আদিম শিকারী-সংগ্রাহকের চেয়ে কম ছিল। তাহলে এরকম অভূতপূর্ব পরিবর্তন কি করে সম্ভব হল? আগেই বলা হয়েছে, এর একটা বড় কারণ হল বহু লোকের সমন্বয়ে কাজ করতে পারার ক্রমবর্ধমাণ ক্ষমতা। তীরের ফলা সাধারণত একজনই বানাতো, হয়ত কাছের লোকেরা তাকে সহোযোগিতা করত বা বুদ্ধি পরামর্শ দিত। একটা আধুনিক আণবিক বোমা তৈরির পেছনে পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন ধরণের লোকের হাত থাকে। তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর যেকোন জায়গায় বসে জটিল সব গাণিতিক হিসাব করে বের করেন বোমা তৈরির মূল সূত্র, প্রকৌশলীদের কাজ সে সূত্র অনুযায়ী বোমাটার নকশা করা, আর খনি শ্রমিকের কাজ অতল গহবর থেকে দূস্প্রাপ্য ইউরেনিয়াম তুলে নিয়ে আসা। এছাড়া সমন্বিতভাবে আরো হাজারটা জটিল কাজ করতে হয় একটা বোমা বানাতে।
বুদ্ধিমত্তার বিপ্লোবোত্তর যুগে ইতিহাস আর জীববিজ্ঞানের সম্পর্কটা সংক্ষেপে এরকমঃ
১)জৈব প্রকৃয়া স্যাপিয়েন্সদের আচরণের মূলভিত্তি এবং ক্ষমতার সীমানা নির্থারণ করে। ইতিহাস এই ভিত্তি এবং সীমানার ভেতরে আবর্তিত হয়।
২) তবে এই মূলভিত্তি প্রচন্ড নমনীয় আর এই সক্ষমতার সীমানা দিগন্ত বিস্তৃত। যার ফলে স্যাপিয়েন্সরা এই সীমানার ভেতরে থেকেও অবিশ্বাস্যরকমের বিচিত্র সব খেলা খেলতে পারে। কল্পিত-বাস্তবতা সৃষ্টির সক্ষমতা ব্যবহার করে তারা জটিল থেকে জটিলতর খেলা উদ্ভাবন করে আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেসব খেলা আরো সমৃদ্ধ, আরো বিচিত্র হয়।
৩) তাই স্যাপিয়েন্সদের বুঝতে হলে আমদের বুঝতে হবে তাদের ঐতিহাসিক বিবর্তন। জৈবিক বিবর্তন এর প্রেক্ষাপট মাত্র। ঠিক যেমন খেলার মাঠ হল খেলার প্রেক্ষাপট, সে মাঠে খেলোয়াররা কি করছে সেটাই মূল বিষয়। আমাদের পাথর যুগের পূর্বসুরীরা কি খেলা খেলত? আমরা যতদূর জানি স্টাডেল গুয়ায় যে শিল্পী তিরিশ হাজার বছর আগে সিংহ মানবের মূর্তি গড়েছিলেন, সে ব্যাক্তির শারিরীক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলো আমাদেরই মত ছিল। তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে কি করত? তাদের সকালের নাস্তা কি ছিল, দুপুরেই বা তারা কি খেত? তাদের সমাজ ব্যবস্থা কেমন ছিল? তারা কি একগামী সম্পর্কে বিশ্বাস করত? কেমন ছিল তাদের আচার উৎসব, ধর্ম এবং নৈতিকতা?
বিভাগ: 
  

মন্তব্যসমূহ