স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস by Yuval Noah Harari পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব- প্রথম অধ্যায় লিখেছেন: নুসরাত_জাহান



     

স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস by Yuval Noah Harari পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব- প্রথম অধ্যায়


পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব- প্রথম অধ্যায়
গুরুত্বহীন একটি প্রাণী
তেরোশো পঞ্চাশ কোটি বছর আগে Big Bang বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নিল বস্তু, শক্তি, সময় এবং স্থান। পদার্থবিজ্ঞানীরা আমাদের বিশ্বব্রহ্মহান্ডের এসব মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেন।
এর তিন লক্ষ বছর পর পদার্থ এবং শক্তির মিলনে জন্ম নিতে শুরু করলো বিভিন্ন পরমাণু এবং এসব পরমাণুর পারস্পরিক বিক্রিয়ায় ফলে অণু। রসায়ন এসব অণু পরমাণুর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করে।
তারপর, আজ থেকে তিনশ আশি কোটি বছর আগে, পৃথিবী নামের এক গ্রহে বিশেষ কিছু অণুর সমন্বয়ে খুব জটিল ধরনের বস্তু তৈরি হতে লাগল, যেগুলোকে বলা চলে জীব বা প্রাণ, ইংরেজিতে যাকে বলে organism। এই জীব অথবা organism এর বিজ্ঞান হচ্ছে জীববিজ্ঞান।
আর মাত্র সত্তুর হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens) প্রজাতির জীবেরা তৈরী করতে শুরু করলো আরো জটিল ধরনের সংগঠন, যাকে বলা হয় সংস্কৃতি। মানব সংস্কৃতির উত্তরোত্তর বিকাশের কাহিনিই হল ইতিহাস।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব এই ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব সত্তুর হাজার বছর আগে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে, কৃষি বিপ্লব বারো হাজার বছর আগে একে গতিময় করেছে আর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব আজ থেকে মাত্র পাঁচশ’ বছর আগে শুরু হয়ে অকল্পনীয় সব নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি করছে। এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবই হয়ত অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাসের মৃত্যু ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর জন্ম দেবে। কিভাবে এই তিন বিপ্লব মানুষ এবং মানুষের সহযাত্রী অন্য সব প্রাণীর জীবন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, এই বইয়ে সেটাই বলা হবে।
ইতিহাস শুরুর বহুকাল আগেও মানুষ ছিল। আসলে প্রায় মানুষের মত জীব পৃথিবীতে এসেছে পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। কিন্তু মাত্র সত্তুর হাজার বছর আগে পর্যন্ত এরা অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বিশেষ কিছুই ছিল না। বিশ লক্ষ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকায় আমরা যদি ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে খুব সম্ভবত দেখা পেয়ে যেতাম এসব আদিম মানুষের। আমরা দেখতে পেতাম যে তাদের চরিত্রও আমাদের থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। এই আদিম মানবসন্তানেরা ভালবাসত, খেলত, বন্ধুত্ব করত, আবার ক্ষমতা আর পদমর্যাদার লোভে প্রতিযোগিতাও করত। কিন্তু এসব তো শিম্পাঞ্জি, বেবুন অথবা হাতিও করত! তাই একে মানবজাতির একক কৃতিত্ব মোটেই বলা যায়না।
তখনকার মানুষ স্বপ্নেও ভাবেনি যে তাদেরই বংশধর একদিন চাঁদে পা রাখবে, পরমানু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করবে, genetic code পড়তে পারবে অথবা ইতিহাসের বই লিখবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ সম্পর্কে সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে তারা ছিল নিতান্তই নগণ্য। পৃথিবীর ওপর তাদের প্রভাব গরিলা, জোনাকিপোকা অথবা জেলিফিসের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।
জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীজগতকে (এবং উদ্ভিদজগতকেও) বিভিন্ন প্রজাতিতে (Species) ভাগ করেন। যেসব প্রাণী পারস্পরিক দৈহিক মিলনে উর্বর বংশধর জন্ম দিতে পারে, তাদের একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঘোড়া আর গাধা একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে এবং সেটা খুব বেশি আগের কথাও নয়। তাই তাদের অনেক শারীরিক বৈশিষ্ট একই রকম। কিন্তু ঘোড়া এবং গাধাকে নিজের ইচ্ছায় কখনো মিলিত হতে দেখা যায়না। যদিও এদের পারস্পরিক মিলনে বাচ্চার জন্ম হয়, কিন্তু বাচ্চাটি ঘোড়াও হয়না গাধাও হয়না, হয় খচ্চর। খচ্চর কখনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। তাই গাধার ডিএনএতে সময়ের সাথে যে পরিবর্তন (mutation) হয়, তা কখনো ঘোড়ার দেহে স্থানান্তরিত হতে পারে না। একই ভাবে ঘোড়ার দেহ থেকে গাধার দেহেও তা আসতে পারে না। এই দুটি প্রাণী বিবর্তনের দুই ভিন্ন পথে হেঁটে চলছে, তাই এদেরকে দুটি ভিন্ন প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে, বুলডগ এবং স্প্যানিয়েল দেখতে একদম আলাদা হলেও তারা কুকুর প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত, কারণ তারা একই ডিএনএ ভান্ডারের এর শরিক। বুলডগ আর স্প্যানিয়েলের মিলনে যে কুকুরছানার জন্ম হয় তারা বড় হয়ে অন্য কুকুরের সাথে মিলিত হয়ে আরো কুকুরছানার জন্ম দিতে পারে।
যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে তাদের জীববিজ্ঞানীরা একই গণ(Genera) এ ফেলেন। সিংহ, বাঘ, চিতা এবং জাগুয়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি তবে তারা একই গণ প্যান্থেরার (Panthera) অন্তর্ভুক্ত। জীববিজ্ঞানে জীবের নামকরণ হয় লাতিন ভাষায়, যার দুটি অংশ থাকে। প্রথম অংশ হলো গণ আর পরের অংশ হলো প্রজাতি। যেমন, সিংহের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Panthera Leo – Panthera গণের অন্তর্ভুক্ত Leo প্রজাতির প্রাণী। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এই বই যারা পড়ছেন তারা সবাই হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo Sapience), হোমো (দ্বিপদী)গণের অন্তর্ভুক্ত স্যাপিয়েন্স (প্রাজ্ঞ)প্রজাতির প্রাণী।
একই ধরনের গণগুলোকে আবার একটি নির্র্দিষ্ট গোত্র(Family) এর সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়, যেমন বেড়াল (Felidae) গোত্র, যার ভেতরে আছে সিংহ, চিতা, বেড়াল, ইত্যাদি, কুকুর (Canidae) গোত্র, যার ভেতরে আছে নেকড়ে, শেয়াল, কুকুর, ইত্যাদি, এবং হাতি (Elephantidae) গোত্র, যার সদস্য হচ্ছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যামথ এবং মাস্টাডন আর হাতি। একটা গোত্রের সব সদস্যের পূর্বপুরুষ একই। যেমন ঘরের ছোট্ট মিনি বেড়াল থেকে শুরু করে ভয়ংকর সিংহ, সবার পূর্বপুরুষ এক ধরনের আদিম বেড়াল, যারা আজ থেকে পঁচিশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াত|
হোমো স্যাপিয়েন্সও একটা গোত্রের সদস্য। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়টিই এতদিন ধরে ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গোপন কথা। হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি এতদিন পর্যন্ত নিজেদের পুরো প্রাণীজগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক বিশেষ জাতিসত্বা বলে ভাবতে ভালবাসত, যেন এমন এক অনাথ যার কোন পরিবার নেই, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন আর সবচেয়ে বড় বিষয়, যার কোন পূর্বপুরুষও নেই। কিন্তু সেটা একেবারই ঠিক নয়। আমাদের শুনতে ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, হোমো স্যাপিয়েন্স হলো বিরাট এক গোত্র উল্লুক বা গ্রেট এইপস (Great Apes) এর সদস্য। আমাদের সবচে কাছের জীবিত আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আছে গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং ওরাংওটাং। এদের মধ্যে শিম্পাঞ্জি আবার ঘনিষ্টতম আত্মীয়। মাত্র ষাট লক্ষ বছর আগে এক এইপ জননীর দুই মেয়ে হলো, তাদের একজন হলেন শিম্পাঞ্জিদের মা আরে আরেকজন হলেন আমাদের মাতামহ।
মানুষের গুপ্ত ইতিহাস
আমরা, হোম স্যাপিয়েন্সরা, আসলে এর চেয়েও অস্বস্তিকর আরেকটা কথা এতদিন গোপন রেখেছি। আমাদের যে শুধু দূর সম্পর্কের বুনো আত্মীয়-স্বজন আছে তাই নয়, এক সময় আমাদের বেশ কয়েকজন আপন ভাইবোনও ছিল। আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরাই পৃথিবীর একমাত্র মানবজাতি (human)। তার কারণ হচ্ছে গত হাজার দশেক বছর ধরে আমরা আসলেই তাই। কিন্তু ইংরেজীতে human শব্দের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা হচ্ছে হোমো গণের অন্তর্ভূক্ত যে কোন প্রাণী। এক সময় এই গণের ভেতরে আরো অনেক প্রাণী ছিল।এমনকি অদূর ভবিষ্যেতে হয়ত আমাদের অ-স্যাপিয়েন্স (non-sapience) প্রজাতির ‘মানুষের’ মুখোমুখিও হতে হবে। এই বিষয়টা এই বইয়ের একদম শেষের দিকে আসবে। এখন থেকে আধুনিক মানুষ বোঝাতে আমি সবসময় হোমো স্যাপিয়েন্স শব্দটি ব্যাবহার করব। আর মানুষ বা মানবজাতি শব্দটি রেখে দেব হোমো স্যাপিয়েন্স সহ বর্তমানে বিলুপ্ত হোমো গণের সব প্রজাতির কথা বোঝাতে।
প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) নামের এক এইপ গণের বিবর্তনে প্রথম মানুষের আবির্ভাব। অস্ট্রালোপিথেকাসের অর্থ হচ্ছে দক্ষিনদেশীয়(আফ্রিকার)এইপ। বিশ লক্ষ বছর আগে এই আদিম মানব-মানবীদের কেউ কেউ তাদের আদি নিবাস ছেড়ে যাত্রা শুরু করে ছড়িয়ে পড়ে উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে। উত্তর ইউরোপের তুষারঢাকা প্রকৃতিতে বেঁচে থাকতে হলে যে ধরনের শারিরীক বৈশিষ্ট প্রয়োজন, ইন্দোনেশিয়ার উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশে তার থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম বৈশিষ্টের প্রয়োজন। তাই এই দুই অঞ্চলের মানুষের বিবর্তন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হয়েছে। একইভাবে পৃথিবির বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া মানুষের বিবর্তন হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। এর ফলে কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা মানব প্রজাতির জন্ম হয়েছিল, বিজ্ঞানীরীরা যাদের নানারকম গালভরা লাতিন নাম দিয়েছেন।
ইওরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার মানুষেরা বিবর্তিত হয়ে হলো হোমো নিয়ান্ডারথালেসিস (Homo neanderthalensis), নিয়ান্ডার (Neander) উপত্যকার মানুষ, সাধারনভাবে যাদের আমরা নিয়ান্ডার্থাল বলে থাকি। নিয়ান্ডার্থাল মানুষের দেহ ছিল আমাদের চেয়ে পেশীবহুল এবং সুগঠিত। তারা এভাবে অভিযোজিত হয়েছিল ইউরেসিয়ার বরফযুগ মোকাবেলা করতে করতে। আর এশিয়ার পূব দিকে যে মানব প্রজাতির আবির্ভাব হল, তাদের বলা হয় হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) বা ‘খাঁড়া মানব’। মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে হোমো ইরেক্টাসরা সবচে দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে টিকে ছিল, প্রায় বিশ লক্ষ বছর। এই রেকর্ড খুব সম্ভবত আমদের প্রজাতিও ভাংতে পারব না। হোমো স্যাপিয়েন্স আগামী এক হাজার বছর বেঁচে থাকবে কি না, সে বিষয়েই যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বিশ লক্ষ বছর তো অনেক দূরের ব্যাপার।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে বাস করত হোম সোলোন্সিস (Homo soloensis), সোলো উপত্যকার মানুষ। এরা গৃষ্মমন্ডলীয় এলাকায় বসবাসের উপযোগী হিসাবে অভিযোজিত হয়েছিল। ফ্লোরেস নামের ইন্দেনেশিয়ার আরেকটি ছোট দ্বীপে প্রাচীন মানুষেরা বিবর্তনের ফলে খাটো হয়ে গিয়েছিল। বরফযুগে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ অস্বাভাবিকভাবে নীচে নেমে এসেছিল, তখন এই দ্বীপে মানুষের সহজ যাতায়ত ছিল। তারপর সমুদ্রপৃষ্ঠ যখন ওপরে উঠে এল, তখন কিছু মানুষ এখানে আটকা পড়ে গেল। এই দ্বীপে খাবার খুব কম ছিল। বড়সড় মানুষের খাদ্যের চাহিদা থাকে বেশি, তাই তারা না খেয়ে মারা পরল। বেঁচে রইল ছোটখাট মানুষেরা। এভাবে বংশানুক্রমে ফ্লোরেসের মানুষেরা অনেকটা বেঁটে হয়ে গেল। বিজ্ঞানীদের কাছে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস(Homo floresiensis) নামে পরিচিত ব্যাতিক্রমী এই প্রজাতির মানুষদের উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ মাত্র এক মিটার (৩.৩ ফিট)এবং সর্বোচ্চ ওজন ছিল মাত্র পঁচিশ কেজি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পাথরের বিভিন্ন সরঞ্জাম বানাতো। এমনকি মাঝেসাঝে তারা হাতিও শিকার করে ফেলত, যদিও বলতে হবে যে ফ্লোরেসের হাতীগুলোও সেখানকার লোকেদের মত ছোটখাটই ছিল।
মাত্র ২০১০ সালে আরেকটি হারিয়ে যাওয়া মানব প্রজাতির খবর পাওয়া গেল। সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা খনন কাজের সময় বিজ্ঞানীরা একটা আঙ্গুলের ফসিল খুজে পান। এর জিন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে এই আঙ্গুলটি একদম ভিন্ন কোন মানব প্রজাতির, যাদের সন্ধান আমরা আগে পাইনি। এই প্রজাতির নাম দেওয়া হল হোমো দেনিসোভা (Homo denisova)। কে জানে আমদের এরকম হারিয়ে যাওয়া আরো আত্মীয়-স্বজন কোন গুহায় বা কোন দ্বীপে আমাদের অপেক্ষায় আছে?
যখন ইউরোপ আর এশিয়ার মানুষেরা বিবর্তিত হচ্ছিল, তখন যে পূর্ব আফ্রিকার মানুষেরা বসে ছিল তা নয়। আদি মানবের জন্মভূমি একের পর এক নতুন প্রজন্মের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মাঝে আছে হোমো রুডলফেন্সিস(Homo rudolfensis) বা লেক রুডলফের মানুষ এবং হোমো এর্গাষ্টার (Homo ergaster) বা কাজের মানুষ। এদের কেউ কেউ ছিল বিশালদেহী, কেউ কেউ ছিল ছোটখাটো। কেউ ছিল চৌকস শিকারী আবার কেউবা ছিল নিরীহ, নিরামিশাষী। কোন কোন প্রজাতি একটা দ্বীপেই সীমাবদ্ধ ছিল, আবার কোনটা ছড়িয়ে পড়েছিল মহাদেশ থেকে মহাদেশে। শেষ পর্যন্ত আফ্রিকাতেই এলাম আমরা, আর বেহায়ার মত নিজেদের নাম দিলাম হোমো স্যাপিয়েন্সে বা প্রাজ্ঞ মানুষ। তবে হোমো স্যাপিয়েন্স হোক আর হোমো এর্গাষ্টার হোক, আমরা সবাই হোম গনের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি, আমরা সবাই হিউমান বা মানুষ।
বিবর্তন নিয়ে আমাদের বেশিরভাগের একটা ভীষণ রকম ভুল ধারণা আছে। আমরা ভাবি যে বিবর্তন একটা সরলরেখায় চলে। ইন্টারনেটে ‘মানুষের বিবর্তন’ লিখে খোঁজ করলেই যে ছবিটা চলে আসে, সেটা দেখলে মনে হয় যে এরগাষ্টার মায়ের কোলে জন্ম নিল ইরেক্টাস, ইরেক্টাস প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে জন্মাল নিয়ান্ডার্থাল আর নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির বিবর্তনে স্যাপিয়েন্স। এই সরলরৈখিক বিবর্তনের ধারণার কারণে আমরা ভাবি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুধু এক প্রজাতির মানুষ এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল। বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের সহাবস্থান আমরা কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু আসলে বিশ লক্ষ থেকে মাত্র দশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ এই পৃথিবীতে একই সময়ে বসবাস করেছে। সেটা অসম্ভবই বা হবে কেন? আজকের দিনেও কি আমরা একই গণের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সহাবস্থান দেখতে পাই না, যেমন নেকড়ে আর কুকুর? মাত্র এক লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীতে অন্তত ছয় প্রজাতির মানুষ একই সময় হেঁটে বেড়িয়েছে। আসলে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের সহাবস্থানটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির একক রাজত্বটাই অস্বাভাবিক। এমনকি এই একক রাজত্বটা ন্যায়সংগত কি না সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। একটু পরেই আমরা জানব যে অন্যান্য মানব প্রজাতির ইতিহাস মুছে ফেলার যথেষ্ট কারণ হোম স্যাপিয়েন্সদের ছিল। হয়ত একারণেই তাদের সম্পর্কে আমরা এতদিন অজ্ঞ ছিলাম?
বুদ্ধিমত্তার মূল্য
বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের মাঝে অনেক পার্থক্য আছে সত্যি। আবার এদের মধ্যে অনেক মিলও আছে যা অন্য কোন প্রাণীর সাথে মেলে না। প্রথমত, সব প্রজাতির মানুষের মস্তিষ্কের আকার অন্যান্য যে কোন প্রাণীর তুলনায় অস্বাভাবিক রকমের বড়। কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওজন যদি ষাট কিলোগ্রাম হয়, তবে এর মস্তিষ্কের আকার হয় সাধারাণত দু’শ ঘন সেন্টিমিটার। সেখানে পঁচিশ লক্ষ বছর আগের আদিমতম মানব-মানবীর মস্তিষ্ক ছিল ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার। আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্ক হয় ১২০০ থেকে ১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার। আমাদের জাতভাই নিয়ান্ডার্থালদের মস্তিষ্ক ছিল আরও বড়।
আমাদের কাছে মনে হতে পারে বিবর্তন যে বড় মস্তিষ্কের প্রজাতিগুলোকেই সুবিধা দেবে সে আর আশ্চর্য কি। আমরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় এতই মুগ্ধ যে আমদের কাছে মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক যে মস্তিষ্ক যত বড় ততই ভাল। কিন্তু বিশাল মস্তিষ্ক একটা বিশাল বোঝাও বটে। এত বড় মস্তিষ্ক বয়ে বেড়ানো খুব সোজা ব্যাপার না, বিশেষত যেখানে খুলিটা আরো বড় এবং ভারী। মস্তিষ্কের প্রচুর শক্তিও দরকার হয়। যদিও হোমো স্যাপিয়েন্সের মস্তিষ্কের ওজন এর দেহের মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ, স্বাভাবিক অবস্থায় শরীর যখন বিশ্রামে থাকে তখন সমস্ত দেহে যে পরিমান শক্তি ব্যবহৃত হয়, তার চার ভাগের এক ভাগই ব্যবহার করে মস্তিষ্ক। অন্যদিকে এইপ বা শিম্পাঞ্জী জাতের প্রাণীর ক্ষেত্রে এই ব্যবহারের হার মাত্র আট শতাংশ। আদিম মানুষ দুইভাবে এই বিশাল মস্তিষ্কের মূল্য দিয়েছে। প্রথমত, এরা বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থেকেছে খাবারের সন্ধানে এবং দ্বিতীয়ত, এদের দেহের পেশী ধীরে ধীরে ক্ষয় পেয়েছে। গরীব সরকার যেমন শিক্ষা খাত থেকে টাকা সরিয়ে সামরিক খাতে নিয়ে যায়, তেমনি মানুষের শক্তি তাদের পেশি থেকে মস্তিষ্কে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাজেই আদিমযুগে মানুষের বড় মস্তিষ্ক যে খুব কাজের কিছু ছিল, তা বলা যায় না। তখন তো আর গ্রাম বা শহর ছিল না। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জি হয়ত তর্কে হেরে যেত, কিন্তু শিম্পাঞ্জি চাইলেই মানুষকে কাপড়ের পুতুলের মত ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত। বাঘ সিংহের কথা নাহয় বাদই দিলাম।
আজকের দিনে আমাদের মস্তিষ্ক অবশ্যই আমাদের সম্পদ। আমাদের বানানো গাড়ি পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণীকে অবলীলায় টেক্কা দিয়ে যায়। আমাদের বানানো বন্দুক দিয়ে আমরা হাতীর মত প্রাণীকেও গুলি করে মারতে পারি নিরাপদ দুরত্ব থেকে। আমাদের এখন আর বন্য জন্তুর সাথে কুস্তি করতে হয়না। কিন্তু গাড়ি, বন্দুক এসব হল একেবারেই ইদানিংকার বিষয়। বলতে গেলে গত পঁচিশ লক্ষ বছর ধরেই মানুষের দৌড় ধারালো পাথরের বা কাঠের অস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তা সত্বেও মানুষের মস্তিষ্কের আকার ক্রমাগত বেড়েছে। বিবর্তন কেন মানুষের এই বিশাল ‘বোঝা’ বাড়তে দিয়েছে? সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কাছে এর ভাল কোন উত্তর নেই।
মানব প্রজাতিগুলোর আরেকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট হল, দুই পায়ে হাঁটতে পারা। দাঁড়াতে পারার বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। দাঁড়িয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। হাঁটার কাজ থেকে নিস্তার পাওয়া হাতগুলো অন্য অনেক কাজে, যেমন পাথর ছুঁড়ে মারতে অথবা নিজেদের মাঝে সংকেত আদান প্রদান করতে ব্যবহার করা যায়। তাই দুর্বল প্রাচীন মানুষ হাতের ব্যবহার যত ভালভাবে করতে পারত, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও তত বাড়ত। ফলে বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের হাতের পেশী এবং স্নায়ুগুলো ধীরে ধীরে জটিল এবং সুক্ষ কাজের উপযোগী হয়ে উঠলে লাগল। মানুষ হাত দিয়ে অস্ত্র বানাতে পারত সৃষ্টির প্রায় শুরু থেকেই। প্রত্নতত্ববিদরা প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে তৈরি পাথরের অস্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। প্রাচীন অস্ত্র এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং এসব ব্যবহারের নিদর্শনগুলোকে প্রত্নতত্ববিদরা সম্ভাব্য আদি মানবের অস্তিত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে মনে করেন।
তবে দুপায়ে হাঁটার অসুবিধাও আছে। আমদের পুর্বপুরুষদের মেরুদন্ড লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অভিযোজিত হয়েছিল চার পায়ে হাঁটার জন্য। তাদের মাথার আকার এবং ওজনও ছিল আমাদের চেয়ে অনেক কম। তাই দুপায়ে হাঁটতে শেখাটা মানুষের জন্য বেশ কঠিন ছিল, বিশেষত এত বড় একটা মুণ্ডু কাঁধে করে। মানবজাতির ‘দূরদৃষ্টি’ আর দক্ষ হাতের মূল্য হচ্ছে তাদের কোমর, পিঠ আর ঘাড়ে যখন তখন অযাচিত ব্যথা।
দুপায়ে হাঁটার মূল্য নারীরা দিয়েছে আরো বেশি। স্বভাবতই! দুপায়ে হাঁটার সুবিধার্থে তাদের নিতম্ব সরু হয়ে গেল আর এতে তাদের যোনিপথ সংকুচিত হয়ে পড়ল। অন্যদিকে মানবশিশুর মাথার আকার ক্রমাগত বাড়ছিল। মরার ওপর খাড়ার ঘা। শিশু জন্মকালীন মাতৃমৃত্যু তখন মহামারীর আকার ধারণ করল। শুধু যেসব মায়ের প্রসব হয়ে যেত গর্ভের শিশু পূর্ণতাপ্রাপ্তির আগেই, সেসব ক্ষেত্রে এরকম মৃত্যুর হার ছিল কম। আগে আগে জন্মানোর কারণে সেসব শিশুর দেহ, বিশেষত মাথার আকার হত ছোট। অন্যন্য নারীর তুলনায় তাই এসব মায়েরা বেশি হারে বাঁচতে লাগল এবং আরো সন্তানের জন্ম দিতে লাগল। অদ্ভুত হলেও প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) অপূর্ণাঙ্গ জন্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাল। বিবর্তনের ফলে তাই মানবশিশুর জন্মের সময় এগিয়ে এল অনেকটা। জন্মের পর পর আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংগই পুরোপুরিভাবে বিকশিত হয়না। জন্মের বহু বছর পর পর্যন্ত আমরা পরনির্ভরশীল থাকি। অন্য যেকোন প্রাণীর শিশু মানুষের তুলনায় অনেক দ্রুত স্বনির্ভর হয়। বাছুর জন্মেই তিড়িং বিড়িং করে লাফায়, বেড়ালছানা জন্মের দুই তিন সপ্তাহ পরেই নিজে নিজে খাবার খুঁজে নেয়। কিন্তু আমরা পারি না, আমাদের খাইয়ে পরিয়ে, শিক্ষা দিয়ে তিল তিল করে বড় করতে হয়।
শিশুর এই অসহায়ত্ব একই সাথে মানবজাতি অতুলনীয় সামাজিক দক্ষতা এবং দুর্দশার একটা বিরাট কারণ। আদিমযুগে (এখনো এটা বেশ সত্যি) একা একজন মায়ের পক্ষে নিজের আর সন্তানের খাবার যোগাড় করা ছিল প্রায় অসম্ভব। সন্তান লালন পালনে তাই সর্বক্ষন মাকে আত্বিয়-স্বজন আর প্রতিবেশির সাহায্য নিতে হত। কথায় বলে একটা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য পুরো একটা গ্রাম প্রয়োজন। একদম সত্যি। তাই যেসব মানুষ একটা শক্ত সামাজিক ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছিল, বিবর্তনে তারাই টিকে গেল।
আবার শারিরীক ও মানসিকভাবে অপরিপক্ক অবস্থায় জন্ম নেয়ার ফলে মানবশিশুকে শিক্ষা দিয়ে গড়েপিটে নেওয়াও সম্ভব হল, নানারকম ছাঁচে ফেলাও সম্ভব হল। এটা অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযোজ্য নয়। কুমারের মাটির জিনিষ গড়ার তুলনাটা এখানে বেশ যুতসই। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাচ্চা হল শুকানো পোড়ানো মাটির ঘড়া, যাকে নতুন করে ছাঁচে ফেলা অসম্ভব। আর মানবশিশু হচ্ছে নরম এঁটেল মাটি যা কুমার স্বাধীন হাতের যত্নে আর চাকার ঘুর্নিতে যেমন খুশি তেমন আকার দিতে পারে, নিখুঁতভাবে পালিশ করতে পারে। সে কারনেই আমরা আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিতে পারি, তাদেরকে যেমন চাই তেমন করে গড়ে তুলতে পারি, তাদের বানাতে পারি খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধ, সমাজতন্ত্রী অথবা পুঁজিবাদী, যুদ্ধংদেহী অথবা শান্তিপ্রিয়।
আমরা ভাবি যে বড় মস্তিষ্ক, যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতা, শিখতে পারার অস্বাভাবিক ক্ষমতা আর উন্নত সমাজব্যবস্থা আমাদের জন্য আশির্বাদ। এই কারনেই যে মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে এটা প্রায় দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। কিন্তু এতসব গুণ থাকা সত্যেও আদিম মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মাত্র সত্তুর হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষ পৃথিবীর দুর্বল এবং নগণ্য প্রাণীর কাতারেই রয়ে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বছর আগের মানুষ তাদের বিরাট মস্তিষ্ক নিয়ে, যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, তাদের জ্ঞান দক্ষতা কাজে লাগিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। তারা সবসময় হিংস্র প্রাণীর ভয়ে কাবু থেকেছে, বহু কষ্টে ছোট ছোট প্রাণী শিকার করেছে, বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে বেড়িয়েছে, মাটি থেকে পোকামাকড় খুঁটে খেয়েছে আর বাঘ সিংহের ফেলে যাওয়া উচ্ছিস্ট দিয়ে ভুরিভোজ করেছে।
পাথরের অস্ত্রের একটা প্রাচীনতম ব্যবহার হল হিংস্র প্রাণীর খাওয়ার পর ফেলে যাওয়া শিকারের হাড় ভেংগে মজ্জা বের করা। অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন, হাড় ভেংগে মজ্জা খেতে পারাটা ছিল মানুবজাতির একন্ত নিজস্ব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দক্ষতা। কাঠঠোকরার বিশেষ বৈশিষ্ট যেমন শক্ত কাঠ ঠুকে ঠুকে পুষ্টিকর পোকা বের করে খাওয়া, মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাড় ভেঙ্গে মজ্জা বের করে খাওয়া। কিন্তু কেন শুধু মজ্জা? ধরুন আপনি ক্ষুধার্ত অবস্থায় বনে ঘুরছেন। দূর থেকে দেখতে পেলেন, একদল সিংহ একটা হরিনকে কাবু করে ফেলেছে। আপনি তখন কি করবেন? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন কখন সিংহগুলো খাওয় শেষ করে সেখান থেকে যাবে। আপনি ভাবছেন যে তারপর আপনি এগিয়ে যাবেন? ভুল। এরপর ছুটে আসবে হায়েনা আর শেয়ালের দল। এদের সাথে লাগতে যাওয়ার শারিরীক বল কি আপনার আছে? নেই। তাই এদের যাওয়া পর্যন্ত আপনি ঘাপটি মেরে থাকবেন। তো যখন আপনার পালা, তখন কিন্তু শুধু হাড়টাই পড়ে আছে। তাই আপনাকে শিখতে হবে কি করে হাড় ভেংগে তার সারটুকু খাওয়া যায়। ঠিক সেটাই ঘটেছিল আদিম মানবসমাজে।
এই বিষয়টা মানুষের ইতিহাস এবং মানসিক গঠন বুঝতে খুব সাহায্য করে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ খাদ্য শৃঙ্খলের (food chain) মোটামুটি মাঝামাঝি একটা অবস্থানে ছিল। মানুষ ছোট ছোট জীব জন্তু শিকার করত আর বড় হিংস্র প্রাণীর শিকার হত। মাত্র চার লক্ষ বছর আগে মানুষ নিয়মিতভাবে বড় প্রাণী শিকার করা শুরু করল। আর গত এক লক্ষ বছরে হোমো স্যাপিয়েন্সের উত্থানের ফলে মানুষ এক লাফে খাদ্য শৃঙ্খলের চূড়ায় উঠে এল।
এই অভূতপূর্ব উত্থানের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। অন্য যেসব প্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের শিখরে আছে, যেমন শিংহ বা হাঙ্গর, তারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে এই অবস্থানে এসেছে। এই ধীর প্রকৃয়া প্রকৃতিকে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। যেমন, সিংহ যত শক্তিশালি আর হিংস্র হয়েছে, হরিন তত দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়েছে, জলহস্তি তত বদমেজাজী হয়েছে। কিন্তু হোমো স্যপিয়েন্সের এই উত্থান এত দ্রুত হয়েছে যে প্রকৃতি এর সাথে তাল মিলিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা হল, স্যাপিয়েন্সরা নিজেরাও নিজেদের এই পরিবর্তনের সাথে ভাল মত খাপ খাওয়াতে পারেনি। পৃথিবীর বেশিরভাগ শিকারী প্রাণীর মধ্যে একটা রাজকীয় ব্যপার আছে। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে এসব প্রাণী শুধু শারিরীকভাবেই শক্তিশালী হয়নি, এদের মানসিক মনোবল, নিজের প্রতি আস্থা সবকিছুই বেড়েছে। সে তুলনায় হোমো স্যাপিয়েন্সের এই দ্রুত উত্থান যেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। প্রায় সারা জীবন প্রাণীজগতের প্রায় নিম্নস্তরে থেকে হঠাৎ রাজা হলেও এরা রাজসিক মনোভাব অর্জন করতে পারে নি। বরং সদ্যপ্রাপ্ত মর্যাদা হারিয়ে ফেলার ভয়ে মানুষ হয়ে উঠল সদা উৎকণ্ঠ। আর এই উৎকণ্ঠা থেকেই মানুষ অন্য যে কোন হিংস্র প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র আর বিপদজনক হয়ে উঠল। ইতিহাসের অনেক ভয়াবহ ঘটনা, যেমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অথবা প্রকৃতির ওপর ধংসযজ্ঞ মানুষের এই নিরাপত্তাহীনতার ফল।
রাধুনে জাতি
শিখরে ওঠার একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল আগুনকে পোষ মানানো। কোন কোন মানব প্রজাতি প্রায় আট লক্ষ বছর আগেও মাঝে সাঝে আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু তিন লক্ষ বছর আগে থেকে হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডার্থাল আর হোমো স্যাপিয়েন্সের পূর্ব পুরুষেরা নিয়মিতভাবে আগুনের ব্যবহার শুরু করল। আগুনকে বশ মানাতে পেরে মানুষ এক লাফে অনেকটা এগিয়ে গেল। আগুন হয়ে উঠল আলো আর উষ্ণতার এক নির্ভরযোগ্য উৎস, চারপাশে ঘুরে বেড়ানো হিংস্র জানোয়ারদের বিরুদ্ধে এক মরনঘাতি অস্ত্র। কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ পরিকল্পিতভাবে দুর্গম বন পুড়িয়ে তৃণভুমি তৈরি করা শুরু করল, যে তৃণভূমিতে অবাধে বিচরণ করত হরিন, বাইসনসহ নানা রকম লোভনীয় শিকার। আবার বনের আগুন নিভে যাওয়ার পর মানুষ কুড়িয়ে আনত পুড়ে যাওয়া জন্তুর দেহাবশেষ, ভাজা বাদাম আর মূলজাতীয় সব্জী।
কিন্তু রান্না করতে পারাটা ছিল আগুনের সর্বোত্তম ব্যবহার। অনেক খাবার মানুষ কাঁচা খেয়ে হজম করতে পারে না, যেমন গম, চাল বা আলু। রান্নার গুণে এসব হয়ে উঠল মানুষের প্রধান খাদ্য। আবার যেসব খাবার দীর্ঘ সময় ধরে চিবিয়ে খেতে মানুষ সময় আরে দৈহিক শক্তি ক্ষয় করত, যেমন ফলমূল, বাদাম, পোকামাকড়, কাঁচা মাংস, সেসব খাবার রান্নার গুনে হয়ে উঠল নরম, সহজপাচ্য এবং মুখোরোচোক। শিম্পাঞ্জী যেখানে দৈনিক পাঁচ ছয় ঘন্টা ধরে লতাপাতা চিবায়, সেখানে রান্না করা খাবার খেতে সারাদিনে মাত্র ঘন্টাখানেক হলেই মানুষের চলে। আগুন যে শুধু এসব খাবারে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে এগুলোকে সহজপাচ্য করে তুলেছিল তা নয়। খাবারে জৈবিক পরিবর্তন এনেও আগুন মানুষের বিরাট উপকার করেছিল। যেমন, খাবারে নানা রকম ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস হয়ে যেত রান্নার ফলে।
রান্নার প্রবর্তনে তাই মানুষ খাবারে বৈচিত্র আনতে পারল, খাওয়ার পেছনে সময়ের অপচয় কমাতে পারল। তাছাড়া অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর তুলনায় ছোট দাঁত আর অপেক্ষাকৃত ছোট অন্ত্রই যথেষ্ট হল মানুষের জন্য। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মানুষের রান্না করা খাবার খাওয়ার সাথে অন্ত্রের দৈর্ঘ কমে আসা আর মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পাওয়ার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে। লম্বা অন্ত্র আর বড় মস্তিষ্ক, দুটোরি প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। তাই দুটো একসাথে পাওয়া একটু দুঃসাধ্য। রান্নার ফলে যেহেতু অপেক্ষাকৃত ছোট অন্ত্র দিয়েই কাজ চলত, তাই বিবর্তনে মানব অন্ত্রের আকার এবং শক্তির ব্যবহার ক্রমাগত কমতে থাকল। আর অন্ত্রের অব্যবহৃত শক্তি ব্যবহার করে মস্তিষ্কের আকার ক্রমাগত বাড়তে থাকল, বিশেষত নিয়ান্ডার্থাল আর হোমো স্যাপিয়েন্সদের।
তাছাড়া আগুন অন্য যেকোন প্রাণী আর মানুষের মধ্যে এক অনতিক্রম্য ব্যবধান ঘটিয়ে দিল। যে কোন প্রাণীর ক্ষমতা নির্ভর করে তার দৈহিক সম্পদের ওপর, যেমন পেশীর শক্তি, দাঁতের ধার আর পাখার বিস্তার। অন্যান্য প্রাণী প্রাকৃতিক শক্তি যেমন বাতাস বা পানির স্রোত ব্যবহার করে নিজেদের শক্তি বাড়াতে পারে নিশ্চই, কিন্তু এসব শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এসব প্রাণীর ক্ষমতা বলতে গেলে সম্পুর্নভাবে তাদের শারিরীক ক্ষমতার ভেতর সীমাবদ্ধ। যেমন ধরুন মাটির ওপর বিভিন্ন কারনে সাময়িকভাব গরম বাতাসের স্তম্ভ তৈরি হয়। ঈগল পাখি সেটা বুঝতে পারে আর ভারি শিকার নখে করে উড়ে যাওয়া সহজ করতে এই গরম বাতাসে পাখা ছড়িয়ে দেয়। বাতাসের স্তম্ভ কখন বা কোথায় হবে সেটা কিন্তু ঈগল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবার ছড়িয়ে দেওয়া পাখার ক্ষেত্রফল যতটুকু, ঈগল এই বায়ুস্তম্ভের ঠিক ততটুকুই ফায়দা নিতে পারবে, তার বেশি কিছুতেই নয়।
মানুষ যখন আগুন বশ মানালো, তখন বস্তুত মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে এল প্রচন্ড শক্তিশালি অন্তহীন এক ক্ষমতা। ঈগল যেটা পারেনি মানুষ সেটা পারল। কোথায় কখন কতটুকু আগুন জ্বালতে হবে, মানুষ নিজেই তা ঠিক করতে পারত। আগুন ব্যবহার করে মানুষ নানারকম কাজও করতে শিখল। সবচেয় গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে, এই আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষকে তার শারীরিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে বহুদূর চলে যাওয়ার ঔদ্ধত্য দিল। একা একজন মানুষ সামান্য চকমকি পাথরের ঘষায় কয়েক ঘণ্টার ভেতরে একটা বিশাল বন পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারত। মানুষের কাছে আগুনের দাসত্ব তাই মানুষের ভবিষ্যত একক রাজত্বের আগাম বার্তা নিয়ে এসেছিল।
আমাদের ভাই বোনেরা
কিন্তু আগুন বশে আনার দেড় লক্ষ বছর পরও মানুষ পৃথিবীতে নিতান্ত নগন্য প্রাণী হয়েই ছিল। হ্যা, তারা আগুন দিয়ে বাঘ সিংহকে ভয় দেখাতে পারত, শীতের রাতে দেহ উষ্ণ রাখতে পারত, বন জংগল পুড়িয়ে সাফ করতে পারত। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপূঞ্জ থেকে শুরু করে ইউরোপের দঃক্ষিন-পশ্চিম সীমান্তের ইবেরিয়ান উপদ্বীপ পর্যন্ত মোটের ওপর লাখ দশেক মানুষ ছিল। সেই সময়কার জীবজগতের বৈচিত্র আর আকার চিন্তা করলে মানুষের উপস্থিতি ছিল বিশাল সাগরে এক ফোঁটা পানির মত।
আমাদের প্রজাতি, মানে হোমো স্যাপিয়েন্স, ততদিনে পৃথিবীর মঞ্চে পদার্পন করেছে ঠিকই, কিন্তু তখনো তারা আফ্রিকা মহাদেশের এক কোনায় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত। হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঠিক কবে বা কোথায় হয়েছে এই বিষয়ে নিশ্চিত করে এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা একমত যে দেড় লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে যে মানবপ্রজাতি বংশবিস্তার করেছিল, তারা দেখতে ছিল একদম আমাদেরই মত। এসব মানুষের কোন একজনের শবদেহ যদি কোনভাবে আজকের দিনের মর্গে চলে আসে, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাবেন না। আগুনের বদৌলতে ততদিনে তাদের দাঁত এবং মস্তিষ্কের আকার আমাদের মতই হয়ে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা এ বিষয়েও মোটামুটি একমত যে সত্তুর হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সরা প্রথমে আরব এবং পরে দ্রুত ইওরোপ আর এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্স যখন আরবে এল, তখন ইওরেশিয়ায় অন্যান্য আরো মানব প্রজাতির বসবাস ছিল। তাদের কি হল? এবিষয়ে দুটি পরস্পরবিরোধী তত্ব আছে।
“আন্তঃপ্রজনন” তত্বটি হল প্রেম আর শারিরিক আকর্ষণের। আফ্রিকার হোমো স্যাপিয়েন্সরা ইওরেশিয়ার অন্যান্য মানব প্রজাতির সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে আর আমরা হচ্ছি সেই সন্তান।
আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে এসে স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারর্থালদের দেখা পেল। নিয়ান্ডার্থালদের ছিল স্যাপিয়েন্সদের চেয়ে বড় মস্তিষ্ক আর পেশীবহুল দেহ। তারা বিশেষত ইউরোপের ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতেও পারতো স্যাপিয়েন্সদের চেয়ে বেশি। তারা যন্ত্রপাতির ব্যবহার জানতো, ভাল শিকার করতে পারতো, আবার অসহায় দুর্বল আত্মীয় বন্ধুর সেবাও করত। সমর্থ নিয়ানডার্থালরা অনেকদিন যাবৎ শারিরীকভাবে অক্ষম নিয়ান্ডার্থালদের সাথে বাস করেছে এমন প্রত্নতাত্বিক নজির পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা যায়, নিয়ান্ডার্থালরা যথেষ্ঠ মানবিক ছিল। নিয়ান্ডার্থালদের নিয়ে আধুনিক সমাজে অন্যায়রকম ভুল ধারণা আছে। নিয়ানডার্থাল বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বর্বর নির্বোধ গুহাবাসী আদিম মানুষাকৃতির প্রাণী। কিন্তু অধুনা আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ সে কথা বলে না।
যাই হোক, আন্তঃপ্রজনন তত্ব অনুযায়ী স্যাপিয়েন্সরা ইউরোপের নিয়ান্ডার্থালদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান ইউরোপিয়ানরা খাঁটি স্যাপিয়ন্স নয়, তারা হল স্যাপিয়েন্স অরে নিয়ান্ডার্থালদের মিলিত বংশধর। এই যুক্তি অনুযায়ী, যেসব স্যাপিয়েন্স পূর্ব এশিয়ায় এসেছিল, তারা হোমো ইরেক্টাসদের সাথে মিশে গিয়েছিল, তাই পুর্ব এশিয়ার লোকেরা আসলে স্যাপিয়েন্স আর ইরেক্টাসদের সংকর।
“প্রতিস্থাপন তত্ব” আবার সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। এই তত্বটা হলো অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা এবং গণহত্যার। এই তত্ব অনুযায়ী স্যাপিয়েন্সদের শারীরিক গঠন এমনকি গন্ধ অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোকে চেয়ে আলাদা ছিল। এদের প্রতি স্যাপিয়েন্সদের শারীরিক আকর্ষণ বোধ করাটা তাই একটু অস্বাভাবিক। আবার যদি নিয়ানডার্থাল রোমিও আর স্যাপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেম হয়েও যেত কোনভাবে, এদের জিনগত পার্থক্য এতো বেশি ছিল যে এদের মিলনে উর্বর সন্তান জন্মের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এই তত্ব অনুযায়ী স্যাপিয়েন্সেদের সাথে নিয়ান্ডার্থালদের কোন জিনগত সংমিশ্রণ হয়নি। তাই নিয়ান্ডার্থালরা যখন মরে সাফ হয়ে গেল, অথবা তাদের মেরে ফেলা হল, নিয়ানডার্থাল জিনেও সেখানে মৃত্যু হলো । এই তত্ব অনুযায়ী স্যাপিয়েন্সদের সাথে অন্য কোন মানব প্রজাতির কোনরকম সংমিশ্রণ হয়নি। স্যাপিন্সরা শুধুমাত্র অন্য মানব প্রজাতিগুলোর জায়গা দখল করেছে। সেক্ষেত্রে বলা যায় সত্তুর হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার স্যাপিয়েন্সরাই আমাদের আদি পুর্বপুরুষ। আমরা একশ ভাগ স্যাপিয়েন্স।
এই দুই তত্বের কোনটা সত্য তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিবর্তনের সময়ক্রমে সত্তুর হাজার বছর কিছুই না। প্রতিস্থাপন তত্ত্ব যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সব আধুনিক মানুষের জিনের গঠন মোটামুটি একই রকম, সেক্ষেত্রে সাদা, কালো, ভারতীয় বা চীনাদের ভেতরে সত্যিকারে খুব বেশি তফাৎ নেই। কিন্তু যদি আন্তঃপ্রজনন তত্ব ঠিক হয় তাহলে এসব জাতির মধ্যে গত সত্তুর হাজার বছরে অনেক জিনগত পার্থক্য চলে এসেছে। বৈশ্বিক এবং ঘরোয়া রাজনীতির দরবারে এটা হবে একটা ডিনামাইট। এই তত্বকে ব্যবহার করে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
গত কয়েক দশক ধরে প্রতিস্থাপন তত্ব বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই তত্বের পেছনে জোরালো প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ আছে। তাছাড়া বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির মধ্যে জিনগত পার্থক্যের মত অস্বস্তিকর একটা কথা প্রমাণ করে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদের বিষবাস্প ছড়ানোর দায় ঘাড়ে নেয়ার কোন শখ বিজ্ঞানীদের নেই। কিন্তু যখন দীর্ঘ চার বছরের প্রচেষ্টার পর ২০১০ সালে নিয়ান্ডার্থালদের জিনের সম্পূর্ণ নকশা প্রকাশিত হল, তখন এই ছাই চাপা আগুন হঠাত বেরিয়ে এল। নিয়ান্ডার্থালদের ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট ডি এন এ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এবং এর মাধ্যমে তাঁরা এই প্রজাতি এবং হোমো স্যাপিয়েন্সের জিন নকশার তুলনা করতে পারলেন। এবং বিজ্ঞানীরা স্তম্ভিত হলেন।
বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে ইওরোপিয়ান এবং আরবজাতির ১-৪% স্বকীয় জিন, যেগুলো অন্য নৃগোষ্ঠীর মধ্যে নেই, সেগুলো নিয়ান্ডার্থালদের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। ১-৪% হয়ত খুব বেশি কিছু নয়, কিন্তু যথেষ্ট। এর মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই ডেনিসোভায় প্রাপ্ত সদ্য আবিষ্কৃত মানবপ্রাজাতির আঙ্গুলের জিননকশা করা হল। দেখা গেল যে হোমো ডেসিনোভা প্রজাতির ৬% জিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপূঞ্জের বর্তমান অধিবাসি মেলানেশিয়ান আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসি এবরিজিনদের স্বতন্ত্র জিনের সাথে মিলে যায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিভিন্ন মানব প্রজাতির জিননকশা নিয়ে গবেষণার শুরু হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে হয়ত এমন তথ্য বেরিয়ে আসবে যেগুলো আন্তঃপ্রজনন তত্বকে আরো শক্তিশালি করবে অথবা সম্পূর্ণ নতুন রকমের প্রমাণ উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই দুই আবিষ্কার আন্তঃপ্রজনন তত্বকে কিছুটা হলেও বৈধতা দিয়েছে। তাই বলে এরকম ভাবাটা ঠিক হবে না যে প্রতিস্থাপন তত্ব সম্পূর্ণ ভুল। যেহেতু নিয়ান্ডার্থাল আর ডেসিনোভান ডিএনএর পরিমান আধুনিক মানুষের ভেতরে খুব বেশি না, তাই এসব প্রজাতির সাথে স্যাপিয়েন্স সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়েছিল, সেটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
যদিও এদের জিনের সাথে স্যাপিয়েন্স জিনের পার্থক্য এত বেশি না যে তাদের মিলনে উর্বর সন্তান জন্ম নেয়া অসম্ভব, তবে এতটুকু পার্থক্যই এরকম মিলনের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় অনেকখানি। তাহলে স্যাপিয়েন্স আর অন্যান্য মানব প্রজাতির মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কিরকম ছিল? এটা পরিষ্কার যে এরা গাধা আর ঘোড়ার মত সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি ছিল না। আবার তারা একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জাত, যেমন বুলডগ আর স্প্যানিয়েলের মতও ছিল না।
জীববিজ্ঞান অংকের সুত্র না, তাই নির্দিষ্ট কোন একটা উত্তর এখানে সাধারানত খাটে না। তাছাড়া অনেক অস্পষ্টতাও আছে। দুটি প্রজাতি, যেমন ঘোড়া আর গাধা, যদি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসে থাকে, তাহলে কোন না কোন একসময় তারা একই প্রজাতির ভিন্ন দুটো জাত ছিল, যেমন বুলডগ আর স্প্যানিয়েল। ধীরে ধীরে তারা বিবর্তিত হয়ে ভিন্ন প্রজাতি হয়েছে। কিন্তু এই বিবর্তনের ধারায় নিশ্চই এমন একটা পর্যায় ছিল, যখন এই দুই জাত অনেকটাই আলাদা হয়ে গেছে, কিন্তু তখনো তারা ক্বচিৎ কখনো মিলিত হয়ে উর্বর সন্তান জন্ম দিতে পারত। তার পরের পর্যায়েই হয়ত এই দুই জাতের পার্থক্য এতই বেশি হয়ে গেল যে সেটা আর সম্ভব হল না, ফলে দুই জাতের সম্পর্ক পুরোপুরি ঘুচে গেল।
ধারনা করা হয়, পঞ্চাশ হাজার বছর আগে স্যাপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল আর ডেসিনোভানরা পুরোপুরিভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগের পর্যায়ে ছিল, প্রায় সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু একশ ভাগ না। অবশ্য হোমো স্যাপিয়েন্সরা ততদিনে যথেষ্ঠই আলাদা হয়ে গেছে, শুধু ডিএনএ বা শারিরিক বৈশিষ্টের দিক থেকেই না, বুদ্ধিমত্তা আর সামাজিক দক্ষতার দিক থেকেও। তারপরও হয়ত হঠাৎ হঠাৎ স্যাপিয়েন্সদের সাথে অন্য প্রজাতির আন্তঃপ্রজননে উর্বর সন্তান জন্ম নিত। তাই স্যাপিয়েন্সের সাথে নিয়ান্ডার্থাল বা ডেসিনোভানদের পুরোপুরি সংমিশ্রণ হল না, শুধু এদের মধ্যে ভাগ্যবান কারো কারো জিন স্যাপিয়েন্স দেহে ভর করে বেঁচে রইল। এক সময় যে আমরা, মানে স্যাপিয়েন্সরা, অন্য ‘প্রাণীর’ সাথে শারিরিকভাবে মিলিত হয়ে বাচ্চা জন্ম দিতে পারতাম, এ বিষয়টা খুব অস্বস্তিকর, আবার অন্যভাবে ভেবে দেখলে বেশ রোমাঞ্চকরও বটে।
কিন্তু নিয়ান্ডার্থাল ও ডেসিনোভানদের যদি স্যাপিয়েন্সদের সাথে পুরোপুরি সংমিশ্রন না হয়ে থাকে, তাহলে তারা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? একটা সম্ভাবনা হচ্ছে স্যাপিয়েন্সরা এদের হারিয়ে দিয়েছে সম্পদের প্রতিযোগিতায়। ভেবে দেখুন, স্যাপিয়েন্সরা যখন দক্ষিন পশ্চিম ইওরোপের বলকান উপত্যকায় প্রথম এল, তখন সেখানে নিয়ান্ডার্থালরা হাজার হাজার বছর ধরে বাস করছে। স্যাপিয়েন্সরা এসে ভাগ বসাল তাদের শিকার এবং খাদ্যে। যেহেতু স্যাপিয়েন্সদের কাছে উন্নত প্রযুক্তি আর সামাজিক দক্ষতা ছিল, তাই নিয়ান্ডার্থালরা প্রতিযোগিতায় স্যাপিয়েন্সদের কাছে হারতে লাগল। ফলস্রুতিতে স্যাপিয়েন্সের বংশবিস্তার হতে লাগল এবং নিয়ান্ডার্থালদের জীবন ধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল। তাদের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকল এবং এক সময় তারা পুরোপুরি হারিয়ে গেলে পৃথিবীর মাটি থেকে।
আরেকটা সম্ভাবনা হচ্ছে, স্যাপিয়েন্সরা যুদ্ধ করে এদের ধ্বংস করেছে। স্যাপিয়েন্স প্রজাতির সহনশীলতার সুনাম এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। সামান্য গায়ের রং, ধর্ম আর মতবাদের অমিলের কারনে পৃথিবীতে তারা বারে বারে যুদ্ধ করেছে, গণহত্যা করেছে, সীমাহীন নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে। তাই আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে, সেরকমটা ভাবা ঠিক যুক্তিযুক্ত না। হয়ত স্যাপিয়েন্সরা প্রথম যখন নিয়ান্ডার্থালদের মুখোমুখি হয়েছিল, সে মুহূর্তেই প্রথম রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গা আর গণহত্যার ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
সত্য যেটাই হোক, নিয়ান্ডার্থাল আর অন্যন্য মানব প্রজাতি যদি ধ্বংস না হত, তাহলে কি হত সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। ভাবুন তো একবার আজকের দুনিয়ায় শুধু আমরা নেই, নিয়ান্ডার্থাল, ডেসিনোভান সহ আরো অন্যান্য প্রজাতি আছে পাশাপাশি। কেমন হত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি অথবা রাস্ট্রব্যবস্থা? ধর্মীয় মতবাদই বা কেমন হত? বুক অফ জেনেসিস কি নিয়ান্ডার্থালকে আদম হাওয়ার বৈধ বংশধরের স্বিকৃতি দিত? যিশু কি ডেসিনোভানদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে মারা যেতেন? আর মুসলমানদের বেহেশতে কি সব প্রজাতির পূণ্যবান মানুষের জায়গা হত? নিয়ান্ডার্থালরা কি রোমান সেনাবাহিনীর অংশ হতে পারত? আমেরিকার স্বাধিনতার ঘোষনাপত্রে (Declaration of Independence) কি প্রজাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান মর্যাদার কথা বলা থাকত? কার্ল মার্ক্স কি সব প্রজাতির নিপীড়িত মানুষেকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানাতেন?
গত দশ হাজার বছর ধরে আমরা আমাদের একক আধিপত্যে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এসব সম্ভাবনা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে কঠিন। আমাদের ‘ভাই বোন’ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কারনে আমাদের মনে হয় আমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম জীব, অন্যান্য যেকোন প্রাণীর সাথে আমাদের আকাশ পাতাল তফাৎ। চার্লস ডারউইন যখন প্রথম মানুষকে শুধুমাত্র একটা ‘প্রাণী’ হিসাবে অভিহিত করলেন, তখন সবাই খুব রেগে গিয়েছিল। এমনকি আজ পর্যন্ত মানুষের বিরাট একটা অংশ এটা বিশ্বাস করে না। নিয়ান্ডার্থালরা বেঁচে থাকলে কি আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে পারতাম? কে জানে হয়ত একারনেই আমরা তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তারা এতটাই আমাদের মত ছিল যে তাদের উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, আবার এতটাই আলাদা ছিল যে তাদের সহ্য করাও সম্ভব ছিল না।
স্যাপিয়েন্সদের দোষী সাব্যস্ত করা যাবে কি যাবে না, সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর নেই।। কিন্তু স্যাপিয়েন্সরা যখনই নতুন কোন এলাকায় পা রেখেছে, অন্যান্য মানব প্রজাতি সেখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সোলেন্সিসরা পঞ্চাশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত বেঁচে ছিল। তার পর পরই গেছে হোমো ডেনিসোভানরা। নিয়ান্ডার্থালরা তিরিশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত বাঁচতে পেরেছিল। আর সর্বশেষ গেছে ফ্লোরেস দ্বীপের অধিবাসী বামন প্রজাতির মানুষ, তাও প্রায় বারো হাজার বছর আগে। তারা ফেলে গেছে কিছু ফসিল, পাথরের যন্ত্রাংশ, আমাদের দেহে তাদের কিছু জিন আর অনেক অনেক প্রশ্ন।
স্যাপিয়েন্সের সফলতার মূলমন্ত্র কি ছিল? কিভাবে তারা এত দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল? কিভাবে বিভিন্ন জায়গার চরম প্রতিকূল জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়েছিল? কিভাবে তারা অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করেছিল? শক্তিশালি, বুদ্ধিমান আর ঠান্ডা জলবায়ুতে অভ্যস্ত নিয়ান্ডার্থালরা পর্যন্তও আমাদের কাছে টিকতে পারল না? এই বিতর্কের কোন শেষ নেই। কিন্তু এই বিতর্কের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সূত্র হল স্যাপিয়েন্সদের একান্ত নিজস্ব ভাষা।
বিভাগ: 

মন্তব্যসমূহ