শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি


sharat

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

আজি কি তোমার মধুর মুরতী হেরিণু শরৎ প্রভাতে
হে মাতা বঙ্গ-শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে।
গাঢ় নীল আকাশ। সোনা ঝরা রোদ। দক্ষিণ দিক হতে উত্তরে শিমুলের তুলোর মতো ভেসে চলেছে সাদা মেঘের ভেলা। নদীর ধারে ফুটেছে সাদা সাদা কাশফুল। মৃদু মন্দ বাতাসে দোল খায় কাশফুল। যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। সাদা বক, পাখ-পাখালির দল মহা কলরবে ডানা মেলে আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উড়ে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ে বাচ্চা তুলেছে কালো ডাহুক। বড় পুকুর ধারে জারুল গাছে বসে মাছ শিকার করছে মাছরাঙা।  বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ তুলে নদীতে নৌকা যায় পাল তুলে। শরতের চাঁদনী রাত সৃষ্টি করে মোহনীয় ও মায়াবী পরিবেশ। আঁধারের বুক চিরে উড়ে বেড়ায় জোনাকীরা। চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যায় মৃদুমন্দ বায়ু। শিউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা,  বেলী,  ছাতিম, বরই,  শাপলা, জারুল, রঙ্গন, টগর, রাধাচূড়া, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা, কল্কে, স্থলপদ্ম, কচুরী, সন্ধ্যামণি, জিঙে, জয়ন্তীসহ নাম না জানা নানা জাতের ফুলের গন্ধে  মৌ মৌ করে বাতাস।  এ দৃশ্য শুধু এক ঋতুতেই চোখে পড়ে। সে হল শরৎ।sharat-a  
“আমার নয়ন-ভুলানো এলে, আমি কি হেরিলাম ‍হৃদয় মেলে। শিউলি তলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে, শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুন রাঙা চরণ ফেলে, নয়ন-ভুলনো এলে।।।”
শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়। ভাদ্র-আশ্বিন এ দু’মাস শরৎ ঋতু। বর্ষার পরের ঋতু শরৎ। তাই শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি থাকে নির্মল স্নিগ্ধ।শরতের্ আকাশের মতো আকাশ আর কোন ঋতুতে দেখা যায় না। সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু। শরৎ কালের রাতে জ্যোৎস্নার রূপ অপরূপ। মেঘ মুক্ত আকাশে যেন জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় যেন আকাশ থেকে কল্পকথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। বলা যায় শরৎ বাংলার ঋতু পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু।  শরতের আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের সাথে শৈশবের স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায় লাটাই বাঁধা ছোট কাগজের তৈরি ঘুড়িরা। অপরূপ বিভাও সৌন্দর্যের কারনে শরৎ কাল কে বলা হয়ে থাকে ঋতু রাণী। মানুষ মাত্রই শরৎ কালে প্রকৃতির রূপ-লাবণ্য দেখে মোহিত না হয়ে পারেনা। তাইতো প্রকৃতির এমন রূপের বাহারে কবি-সাহিত্যিকের মনোজগত ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে ওঠে। প্রকৃতির অমেয় ধারা সাধারনে সঞ্চারিত করতে সৃষ্টি করেন নতুন নতুন সাহিত্য কর্ম।
তাই শারদসম্ভার নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম কবির রচনায় ও শরৎকাল তার নান্দনিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত। বৈষ্ণব সাহিত্যেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাদ্র মাস কে  নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর এই পদটি সম্ভবত বিদ্যাপতি রচিত রাধা বিরহের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ।
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।kash
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।
বাঙলা সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।  মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায় ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন—‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নব বধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ কাল সমাগত।’ কবি ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে শরৎ কাল বিষয়ে লিখেছেন—‘কাশ ফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নব বধূর মতো শরৎকাল আসে।’ কবি কল্পনায় শরতের সাথে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় কি।
আবার বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি, চণ্ডী দাস তার কবিতায় বলেন—
‘ভাদর মাঁসে অর্হোনিশি অন্ধকারে শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাতনা দেখি বোঁযঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ চিনিতে মোর ফুট জায়িবে বুক।’
বাংলা সাহিত্যের মহীরূহ প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা-গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন। তিনি বলেছেন—
‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি  ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে— বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশির ভাগ রচনায়  রয়েছে প্রকৃতির জয়গান।তিনি পদ্মায় বোটে ভ্রমণকালে শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশে শিমুল তুলার মতো শুভ্রমেঘেদের দল বেঁধে  ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন—  ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া-shewly দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরনী বাওয়া।
এরকম অসংখ্য কবিতায় গানে শরতকে উদ্ভাসিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলাযায়, রবীন্দ্রনাথের  হাতেই শরৎকালীন প্রকৃতির অমেয় রূপ কাব্য-সাহিত্যে চিরন্তন হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরই শরৎ বন্দনায় এগিয়ে রয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন।তার ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক ’সহ অনেক গানই শরৎ-প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে।শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এ সব রচনায়।
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।
দলি শাপলা শালুক শত দল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতে।’
বাঙলার প্রকৃতিতে শরৎ মানেই নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদাহাসির প্লাবন। মাঠে মাঠে সবুজের মেলা। সত্যিকার অর্থে শরতের মন মাতানো প্রকৃতি তেমন কি যে খুঁজে ফেরে, তা বোঝা বড়ই মুশকিল! প্রকৃতির মতো রোদ-বৃষ্টির দোদুল্য মানতায় মনের মধ্যেও যেন অভিমানের মেঘ জমে।আবার কখনও হয়ে ওঠে রৌদ্র করোজ্জ্বল। কবি জসীম উদ্দীন শরৎকে দেখেছেন ‘বিরহী নারী’ হিসেবে। তিনি বলেন—
‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেয়ে যায় বাসা।
তিরিশ সময় পর্বের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি, নির্জনতার কবি। আবার বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি হিসেবেও তিনি আখ্kash-1যায়িত।তার কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে বাঙলার প্রকৃতি, যেখানে শরতের সার্থক উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তিনি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘এখানে আকাশনীল’ কবিতায় বলেন—
‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;— বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;— দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল,’
শরতের আরেকটি উল্লেখ যোগ্য দিক হলো—এ সময় মাঠ জুড়ে থাকে সবুজ ধানের সমারোহ। ধানের কচিপাতায় জমা হওয়া শিশিরের ওপর প্রভাতের তরুণ আলো মুক্তার মতো দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের দেশের কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনে। আর বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব, হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দূর্গাউৎসবের কথা বলাই বাহুল্য। শরৎকাল শারদীয় আরাধনায় হিন্দুসম্প্রদায় ভুক্ত মানুষকে যেমন উৎসব মুখর করে, তেমনি বিজয়ার বেদনায়ও করে তোলে ব্যথিত। শরৎ বাঙলার প্রকৃতিতে আসে শুভেচ্ছা স্মারক হিশেবে, নানা মাত্রিক আনন্দের বারতা নিয়ে।  কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন—
‘শরতের দ্বিপ্রহরে সুধীর সমীর-পরে   জল-ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়;
ভাবি, এক দৃষ্টে চেয়ে, যদি ঊর্ধ্ব পথ বেয়ে  শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্র ভেদি ধায়!’
বাঙলার আরও অনেক কবি শরৎ ঋতুকে শব্দ সমবায়ে বন্দি করেছেন তাদের কবিতায়। যেমন  বাংলাদেশের নাগরিক কবি শামসুর রাহমান তার ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় লেখেন —
‘জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে  নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতি কণা।’   সৈয়দ শামসুল হক শরতের অপার বিস্ময়ের কথা লিখেছেন তার ‘ স্dhak-khetমৃতিময় শারদীয় হাওয়া’ কবিতায়—  ‘সে কি বিস্ময়! কি যে বিস্ময়! কি করে ভুলি!   আকাশের নীলঘন শাদা মেঘ, কবে কার গ্রাম পথে ডুলি!   নাইওরে যাচ্ছে বউ! একদিন চুল তার দেখি নাইকারও চুল দীর্ঘ এতটা  আজ এই নগরের অ্যাভেনিউয়ে এসে যেই দাঁড়ালাম সেদিনের কিশোর বেলাকার এই আমাকে বললাম  ওরে থাম! থাম!’
রফিক আজাদ ‘আমার শরৎ’ কবিতায় বলেন—‘শরৎ’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমার চোখের সামনে  অর্থাৎ দৃষ্টি সীমার মধ্যে শারদ-আকাশ কিংবা, কাশফুল এসে দাঁড়ায় না, বরং শরৎ চন্দ্র মূর্তিমান হননা, শরৎচন্দ্র, নীলাকাশে সমুজ্জ্বল কোনো চাঁদ নয়, মহামতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং।
আসাদ চৌধুরী আত্মবিবরণের আশ্রয় খুঁজেছেন কাশফুল আর জ্যোৎস্নায়—‘শাদা কাগজের ওপর রেগে যাই, সাড়ে চুয়াত্তরে এসে, ক্যালাপে মেতে ওঠে, অসমাপ্ত পদ্য গুলো, স্মৃতি রাশি শাদা মেঘমালার চেয়েও অধিক এলোমেলো।’ তবে শরৎকে কবি গুরু বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তিনি বলেছেন—‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ শেফালী ফুলের মালা/নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা / এসো হে শারদ লক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো চির নির্মল নীল পথে…’
পরিশেষে বলা যায়, শরত প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় যার আবেশে অতি সাধারন মানুষ ও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়।শরত অবসাদগ্রস্ত মনেও নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে।তাইতো রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়-
“শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে,   আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে

মন্তব্যসমূহ