বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: চার্লস ডারউইন - একটি ধারণার বিজয় ( সৌজন্য -মূল লেখাটির লেখক কাজী হাসান এবং স্টেশন ব্লগ )


বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: 

চার্লস ডারউইন - 

একটি ধারণার বিজয় 




(ছবি: তরুণ ডারউইন, বিগলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্র যাত্রা শেষে তিনি রুপান্তরিত হন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ বিজ্ঞানী হিসাবে; এই প্রতিকৃতির শিল্পী জর্জ রিচমন্ড)
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী চার্লস ডারউইনের জন্মদিনে (দিনটি আন্তর্জাতিক ডারউইন দিবসও) লেখাটি লিখেছিলাম নিজস্ব ব্লগের জন্য। এই লেখাটি তারই সম্পাদিত রুপ। ১৮০৯ সালে ইংল্যান্ডে এই দিনে তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন; দিনটি আন্তর্জাতিক ডারউইন দিবসও; বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলোয় কুসংস্কারমুক্ত জীবন উদযাপনের দিন হিসাবে চার্লস ডারউইনের জন্মদিন, ১২ ফেব্রুয়ারীকে বেছে নেয়া হয়েছিল নব্বই দশকের শুরুতে,আন্তর্জাতিক ডারউইন দিবস হিসাবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী আর বৈপ্লবিক ধারণাটির জন্ম দিয়েছিলেন প্রতিভাবান বৃটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন: প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন। জীববিজ্ঞান তো বটেই বিজ্ঞানের নানা শাখায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তার মাষ্টারপিস On the Origin of Species বইটি, পৃথিবী এবং তার মধ্যে আমাদের নিজেদের অবস্থান সম্বন্ধে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটিকে চিরকালের মত বদলে দিয়েছে; খুব সরল এই ধারণার মাধ্যমে, ডারউইন পেরেছিলেন জীবের সকল জটিলতা আর বৈচিত্রের সাধারণ একটি ব্যাখ্যা দিতে। গত দেড় শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা তার এই ধারণাটির স্বপক্ষে প্রমাণ জুগিয়েছে, যা এখনও অব্যাহত আছে। বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধীতার কারণ কখনোই এর প্রমাণের স্বল্পতা নয়, বরং এর সম্বন্ধে অজ্ঞতা। ডারউইনকে নিয়ে ধারাবাহিক এই লেখাটি কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে ডারউইনের জীবনে সেই গুরুত্বপুর্ণ সময়ে কাহিনী; লেখাটির মূল সূত্র: Carl Zimmer এর Evolution, the triumph of an idea র প্রথম দুটি অধ্যায়; এছাড়াও বেশ কিছু বাড়তি তথ্য এসেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে - কাজী মাহবুব হাসান)
ডারউইন এবং দ্য বিগল
১৮৩১ সাল, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ।
ইংল্যান্ডের প্লীমথ (Plymouth) বন্দরে দাড়িয়ে আছে প্রায় নব্বই ফুট দীর্ঘ একটি কোষ্টার এইচ এম এস বীগল (HMS Beagle); উই ঢিবির উইপোকার মত এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ব্যস্ত খালাসী আর নাবিকরা, যতটুকু করা সম্ভব,ততটুকুই বোঝাই করা হচ্ছে জাহাজটিকে; কারণ বীগল প্রস্তুত হচ্ছে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার সমুদ্রযাত্রায়, স্থায়ী হতে পারে প্রায় পাঁচ বছর। জাহাজের হোল্ড বা খোলের মধ্যে তারা ঠেসে রাখছে আটা আর রাম এ ভরা পিপাগুলো, আর জাহাজের ডেক জুড়ে নানা আকারের কাঠের বাক্স, যাদের ভিতরে করাতের কাঠের গুড়ার উপর বসানো পরীক্ষামুলক বেশ কিছু ঘড়ি; বীগলের এই সমুদ্র যাত্রার মূল কারণ ছিল বৈজ্ঞানিক, বৃটিশ নৌবাহিনীর জন্য এই ঘড়িগুলো বিশেষভাবে পরীক্ষা করবে সার্ভেয়াররা, যাদের সমূদ্রযাত্রার জন্য সূক্ষ্ম সময়ের পরিমাপ বিশেষভাবে গুরুত্বপুর্ণ; এছাড়াও বীগলের আরেকটি কাজ হচ্ছে বিস্তারিতভাবে মানচিত্র তৈরী করা; নানা ধরনের নেভিগেশন চার্টগুলোর রাখার জন্য কেবিনগুলোয় বিশেষ মেহগনি কাঠের সিন্দুকও তৈরী করা হয়েছে; জাহাজের ১০টি লোহার কামান সরিয়ে তামার কামান বসানো হয়েছে, যেন তারা বিগলের কম্পাসের সাথে সামান্যতম কোনো সমস্যা না করে।

(ছবি: এইচ এম এস বিগল,HMS Beagle in the Straits of Magellan at Monte Sarmiento, reproduction of R. T. Pritchett's frontispiece from the 1890 illustrated edition of The Voyage of the Beagle.)
এই ব্যস্ত প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে হাটতে দেখা যায় বাইশ বছরের একজন তরুণকে; বেশ বিব্রত, ইতস্তত হয়েই তাকে জাহাজের এদিক সেদিক হাটতে দেখা যায়, অপরিসর কেবিন, সরু করিডোর বা জাহাজের বিভিন্ন জায়গায়; তার ছয় ফুট কাঠামোই শুধুই একমাত্র কারণ নয় বরং সেখানে নিজেকেই যেন তার মনে হচ্ছিল বেমানান; জাহাজে তার কোনো আনুষ্ঠানিক পদবী নেই, শুধু মাত্র জাহাজের ক্যাপ্টেনকে এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় সঙ্গ এবং অনানুষ্ঠনিকভাবে একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে তাকে বিগলে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল; সাধারণত জাহাজের সার্জন এই প্রকৃতি বিজ্ঞানীর দায়িত্বটি পালন করে থাকেন, কিন্তু এই অপ্রতিভ আনাড়ী তরুণটির তেমন কেন ব্যবহারিক দক্ষতাও নেই। মেডিকেল স্কুলের পড়া শেষ না করা, এই তরুণটি, এই অভিযান শেষে অন্য কোনো সন্মান জনক পেশা খুজতে গিয়ে অবশেষে গ্রামের যাজক হবার কথা ভাবছেন; তার নিজের সঙ্গে আনা নানা ধরনের কাচের জার, মাইক্রোস্কোপ এবং তার বাকী যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে রাখার পর, তার আসলে আর কিছুই করার ছিল না; সে চেষ্টা করলো সহকারী সার্ভেয়ার কে কয়েকটি ঘড়ি ক্যালিব্রেট করার জন্য, কিন্তু সাধারন কিছু মৌলিক গণনা করার মত অংকও তার জানা ছিল না।

(ছবি: Young Darwin Statue by Anthony Smith, Christ's College, University of Cambridge)
এই অপ্রতিভ, তার কি কাজ করা উচিৎ সেটি নিয়ে বিব্রত তরুণটির নাম চার্লস ডারউইন; পাঁচ বছর পরে যখন বিগল তার সমুদ্র যাত্রা শেষ করে ফিরে আসবে, বৃটেনের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ বিজ্ঞানী হিসাবে এই মানুষটি সুপরিচিত হয়ে উঠবে, আর এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা সমুদ্রযাত্রায় সংগৃহীত অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি উদঘাটন করবেন, চিরকালের জন্য যা প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত সব ধারণাকে আমূল বদলে দেবে। বীগলের সমুদ্রযাত্রায় তার সংগ্রহ করা নমুনাগুলো দিয়ে এই তরুণ ডারউইন একদিন প্রমাণ করবেন, আমরা আজ প্রকৃতিকে যে রুপে দেখছি, সৃষ্টির সময় এটি এরকম ছিল না, জীবন বিবর্তিত হয়েছে: ধীরে ধীরে এবং নিরন্তর একটি প্রক্রিয়ায় জীবন পরিবর্তিত হয়েছে অকল্পনীয় বিশাল সময় জুড়ে বংশগতির সুত্রের কল্যাণেই, কোনো স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই; আর আমরা মানুষরা…. ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ চুড়ান্ত রুপ হওয়া তো দুরের কথা, অনেক প্রজাতির মধ্যে সে কেবলই একটি প্রজাতি, বিবর্তনেরই আরেকটি সৃষ্টি মাত্র।
ভিক্টোরীয় যুগের ইংল্যাণ্ডকে ডারউইন তার তত্ত্ব দিয়ে বিশাল একটি সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জীবন, যা নিজেই এই অসাধারণ বৈচিত্রময়তার সৃষ্টি করেছে, তার একটি বিকল্প ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন; আজ স্পষ্ট যে বিবর্তন আমাদেরকে যুক্ত করেছে পৃথিবীর উষালগ্নের সাথে, উল্কাপাত আর নক্ষত্রদের মরণ বিস্ফোরণের সাথে; বিবর্তনই ফসল উৎপাদন করে যা আমরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করছি আবার বিবর্তনই পোকামাকড়দের সাহায্য করেছে তা ধ্বংস করার জন্য; এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা রহস্যকে উন্মোচিত করেছে, যেমন কেমন করে একটি বুদ্ধিমত্তাহীন কোনো ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানের সেরা গবেষকদের বোকা বানাতে পারে; এটি তাদের জন্য সেই সতর্কবানীও প্রদান করেছে যারা সীমাহীন ভোগে পৃথিবী থেকে শুধুই নেয়, এটি উন্মোচন করেছে, কেমন করে আমাদের মন গড়ে উঠেছিল নরবানর বা এইপদের নির্জন একাকী দলগুলোতে; মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান নিয়ে বিবর্তন আমাদের কি বলছে, তা গ্রহন করা নিয়ে আমাদের এখনও সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সেকারণেই মহাবিশ্ব আরো বেশী অনন্য অসাধারণ।
বৃটিশ নৌবাহিনীর এইচ এম এস বিগলকে আজ পৃথিবী মনে রেখেছে তার কারণ শুধুমাত্র সেই জাহাজে এই তরুণ ডারউইনেরই অভিজ্ঞতা; কিন্ত সেই মুহুর্তে জাহাজের মাল বোঝাই করছে এমন কোনো ব্যস্ত খালাসী আর নাবিকেদের তা বলার চেষ্টা করেন, তারা এই বেমানান, নিজের কি কাজ সেটা বুঝতে পারার ভান করা তরুণের দিকে হয়তো না তাকিয়েই হেসে উড়িয়ে দেবে।
প্লীমথ থেকে নিজের পরিবারের কাছে চিঠিতে ডারউইন লিখেছিলেন: “আমার প্রধান কাজ হচ্ছে বিগলে আরোহন করা, এবং আমার পক্ষে যতদুর সম্ভব নাবিকের মত আচরণ করা, আমাকে পুরুষ, নারী কিংবা শিশু হিসাবে কিছু মনে করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।”

(ছবি: সাত বছর বয়সী ডারউইন ১৮১৬ সালে, এর পরের বছরই হঠাৎ করে মা‘কে হারান ডারউইন।)
গুবরে পোকা আর সন্মানের সন্ধানে

(ছবি:ডারউইন জন্মগ্রহন করেছিলেন এখানে; দ্য মাউন্ট ( Shrewsbury, Shropshire, England);
ডারউইনের স্বাচ্ছন্দময় আর সুখের শৈশব কেটেছিল ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারের সেভেয়ার্ন নদীর পাড়ে পাখি আর নুড়ী পাথর সংগ্রহ করে; তার মা সুজানা এসেছিলেন বিত্তশালী ওয়েজউড পরিবার থেকে, যারা এই নামে চীনা মাটির বাসন পত্র আর পটারী তৈরী করার ব্যবসায়ী হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন ইংল্যাণ্ডে। যদিও তার বাবা রবার্ট (Robert Darwin) ওয়েজউডদের মত এতটা বিত্তশালী পরিবার থেকে আসেননি ঠিকই, তবে তিনি তার সম্পদ গড়েছিলেন ডাক্তার হিসাবে কাজ করে এবং গোপনে তার রোগীদের টাকা ধার দেবার মাধ্যমে, এবং ধীরে ধীরে তিনি যথেষ্ট পরিমান বিত্তেরও মালিক হয়েছিলেন যে, তার পরিবারের জন্য একটি বিশাল বাড়ি তৈরী করেন, দ্য মাউন্ট, সেভেয়ার্ন নদীর পারে একটি ছোট পাহাড়ের উপর।

(ছবি: ছবি: ডারউইনের বাবা রবার্ট ডারউইন, পেশায় চিকিৎসক রবার্ট ডারউইন চেয়েছিলেন ডারউইনও চিকিৎসা পেশা বেছে নিক; যদিও ছেলেকে একসময় বলেছিলেন বংশের কলঙ্ক হবে, রবার্ট বেঁচে থাকতেই ডারউইনকে নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন; এবং ছেলেকে স্বাধীন একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে গবেষণা করার সব সুযোগ এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে কোনো কার্পণ্য করেননি।)

(ছবি: সুজানা ডারউইন, চার্লস ডারউইনের মা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জশুয়া ওয়েজউডের মেয়ে; জশুয়া ওয়েজউড ছিলেন রবার্ট ডারউইনের বাবা ইরাসমাস ডারউইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; খুব ছোটবেলা থেকেই রবার্ট আর সুজানার সখ্যতা ছিল; বাগান করতে ভীষণ ভালোবাসতেন সুজানা, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রথম হাতে খড়ি হয় ডারউইনের তার মায়ের কাছে, মায়ের বাগান করার নেশাটা তারও ছিল; সুজানা আর রবার্ট তাদের বাড়ি মাউন্টে একটা হাটার পথ তৈরী করেছিলেন, থিংকিং পাথ, সেই পথে ডারউইন আর তার ভাইকে রোজ সকালে হাটতে বলতেন, পরে ডারউইন তার ডাউন হাউসেও একই রকম একটি থিংকিং পাথ তৈরী করেছিলেন, যা পরিচিত বিখ্যাত স্যান্ড ওয়াক নামে; ডারউইন শৈশবেই তার মাকে হারিয়েছিলেন।)
চার্লস এবং তার বড় ভাই ইরাসমাস ছিলেন খুব ঘনিষ্ঠ, বলা যায় যেন আসলেই টেলিপ্যাথিক সংযোগ ছিল দুই ভাইয়ের মধ্যে; কৈশোরেই দুই ভাই মাউন্টে তাদের জন্য একটি ল্যাবরেটরী বানিয়েছিলেন, যেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর কাচের পাত্র ভেঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষাও করতেন তারা দুজন; চার্লস এর বয়স যখন ১৬, বাবা ইচ্ছায় বড় ভাই ইরাসমাসকে স্কটল্যাণ্ডের এডিনবরায় পাঠানো হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে; তাদের বাবা অবশ্য ইরাসমাসকে সঙ্গ দেবার জন্য চার্লসকেও সঙ্গে পাঠান, উদ্দেশ্য ভাইয়ের মত সেও ডাক্তারী পড়বে ভবিষ্যতে।

ছবি: ইরাসমাস অ্যালভে ডারউইন, চার্লস ডারউইনের বড় ভাই; পাঁচ বছরের বড় ছিলেন তিনি;
ভাইয়ের সাথে যেতে চার্লস এর অবশ্যই কোনো আপত্তি ছিলনা, বরং খুশী হয়েছিল ভাইকে সাথে নিয়ে নতুন কোনো অভিযানের সুযোগ পাওয়ায়।

(ছবি:মাউন্টের সামনে দিয়ে বয়ে চলা সেভয়ার্ণ নদী; ভাই ইরাসমাসকে নিয়ে এখানে অনেক অভিযান করেছেন ডারউইন।)

(ছবি: বাড়ীর কাছে গীর্জার মুখোমখি ডিংগল বলে পরিচিত এই বাগান আর ছোট পুকুরের এই পার্কটিতে নানা ধরনের পোকামাকড় সংগ্রহ করতেন ডারউইন তার শৈশবে।)

(ছবি: রেভারেন্ড কেস এর গ্রামার স্কুল, ডারউইনের প্রথম স্কুল , ১৮১৭ খেকে ১৮১৮ পর্যন্ত ডারউইন এখানে পড়েছিলেন।)

(ছবি:Shrewsbury School: এখানে ডারউইন পড়েছিলেন ১৮১৮ থেকে ১৮২৫ সালে পর্যন্ত; স্কুলের কোর্ট ইয়ার্ডে ডারউইনের একটি ভাস্কর্য।)
চার্লস আর ইরাসমাস এডিনবরায় এসে বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলেন, অপরিচ্ছন্ন ঘনবসতি আর ব্যস্ত শহুরে জীবন দেখে; গ্রামীন শান্ত পরিবেশে, সাধারণত যে পরিবেশে জেন অস্টেন তার উপন্যাসের পটভূমি রচনা করেছিলেন, সেখানে বড় হওয়া এই দুই ভাই প্রথমবারের মত শহরে এসে বস্তি দেখেছিলেন, এছাড়া এডিনবরায় তখন স্কটিশদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মাতাল সময়, সেই সাথে জ্যাকোবাইট আর ক্যালভিনিস্টরা চার্চ আর রাষ্ট্র নিয়ে সংঘর্ষের লিপ্ত।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই তাদের মুখোমুখি হতে হতো উগ্র কিছু ছাত্রদের সাথে, যারা লেকচারের মধ্যে চিৎকার বা পিস্তল উচিয়ে গুলি করতে দ্বিধা করতো না; এ ধরনের অপরিচিত আর ভিন্ন একটি পরিবেশ চার্লস আর ইরাসমাস দুজনকে দুজনের সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছিল আরো গভীরভাবে, যেমন সাগর পাড়ে হেটে বেড়িয়ে সময় কাটানো, একসাথে নাটক দেখতে যাওয়া, খবরের কাগজ পড়া ইত্যাদি নানা কাজে ;
চার্লস বেশ তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেখাপড়া তিনি ঘৃণা করেন, রস কষহীন লেকচার, শব ব্যবচ্ছেদ তার জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের মত, আর অপারেশন যেখানে প্রায়শই রোগীকে অজ্ঞান না করেই করতে হতো, সেগুলো ডারউইনের জন্য ছিল আরো ভীতিকর ; তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন তার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা পছন্দের বিষয়গুলো নিয়েই। কিন্তু যদিও চার্লস ডারউইন জানতেন তিনি ডাক্তার হতে পারবেন না কখনোই, কিন্তু তার বাবার সামনে দাড়িয়ে সেটা নিয়ে আলোচনা করার সাহস আর ইচ্ছা তার দুটোই তখন ছিলনা; যখনই ছুটিতে তার বাড়ি মাউন্টে বেড়াতে এসেছে, তখনই তার পুরোনো পাখি সংগ্রহ করার কাজ নিয়ে মেতে থেকেছেন তিনি, বাবার সামনে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বারবার; সরাসরি কোনো তর্ক বা দ্বন্দ এড়িয়ে যাবার এই অভ্যাসটি তার আমৃত্যু ছিল।
১৮২৬ এর গ্রীষ্মে খানিকটা পরিবর্তন আসে যখন রবার্ট ডারউইন ঠিক করেন তার বড় ছেলে ইরাসমাসকে এবার লন্ডনে পাঠাবেন তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়াশুনো শেষ করার জন্য; অতএব সে বছর অক্টোবরে বিষন্ন ডারউইনকে অবশেষে একাই ফিরতে হয় এডিনবরায়; ভাই ইরাসমাসের সঙ্গ ছাড়া কষ্টকর ডাক্তারী পড়ার তার অপছন্দের জীবনে তার স্বান্তনা ছিল কেবল প্রিয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়গুলো ; সেই সূত্রে এডিনবরায় সমমনা প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে চলে আসেন চার্লস, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রানীবিজ্ঞানী রবার্ট গ্রান্ট; যিনি ডারউইনকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের নানা ব্যবহারিক দিকগুলো শেখানোর জন্য তার শিষ্য করে নিয়েছিলেন।

(ছবি: রবার্ট ই গ্রান্ট; পেশায় চিকিৎসক গ্রান্ট তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জীববিজ্ঞানে, ফরাসী বিজ্ঞানী জিওফরয় এর বিবর্তনের ধারনা Unity of Plan এর একনিষ্ট সমর্থক ছিলেন; প্রকৃতি বিজ্ঞানের নানা ব্যবহারিক কৌশল তিনি শিখিয়েছিলেন ডারউইনকে, যখন ডারউইন এডিনবরায় প্লিনিয়ান সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন; যদিও ডারউইনের বিবর্তনের ধারনায় তেমন ভরসা ছিলনা তখন, তাস্বত্ত্বেও গ্রান্টকে তার সামুদ্রিক প্রানীদের নমুনা খুজতে সাহায্য করার সময়, গ্রান্ট তাকে আধুনিক চিন্তাধারাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন; এছাড়া ডারউইনের পিতামহ ইরাসমাস ডারউইনের একজন ভক্ত ছিলেন তিনি।)
রবার্ট গ্রান্টও ডাক্তারী পড়েছিলেন, কিন্তু সেই পেশা ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশের সেরা একজন প্রানী বিজ্ঞানী হিসাবে সুপরিচিত হয়েছিলেন, তার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল সি পেনস (Sea pens), স্পন্জ (Sponge); তিনি এছাড়াও আরো অনেক সামুদ্রিক প্রাণিদের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যাদের সম্বন্ধে তৎকালীন বিজ্ঞানীদের কোনো কিছু জানা ছিল না; গ্রান্ট খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন কোনো সন্দেহ নেই, ’আপাতদৃষ্টিতে রসকষহীন, আচরনে কেতাবী হলেও তার বাইরের আবরনের নীচে উৎসাহের কোনো অভাব নেই’, ডারউইন পরে লিখেছিলেন তার সম্বন্ধে; প্রাণি বিজ্ঞানের নানা কৌশল তিনি ডারউইনকে শিখিয়েছিলেন, যেমন কিভাবে সামুদ্রিক প্রাণিদের মাইক্রোস্কোপের নীচের সমুদ্রের লবনাক্ত পানিতে ব্যবচ্ছেদ করতে হয়, এবং স্পষ্টতই ডারউইনও বুদ্ধিমান ছাত্র ছিল গ্রান্টের; ডারউইনই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সমুদ্র শৈবালের স্ত্রী এবং পুরুষ জনন কোষ একই সাথে দেখেছিলেন মাইক্রোস্কোপের নীচে।
১৮২৮ সালে, এডিনবরায় তার দ্বিতীয় বর্ষের শেষে, বাড়ী ফেরার পর তার বাবাকে এড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল ডারউইনের জন্য, অবশেষে বাধ্য হয়েই বাবার কাছে স্বীকার করতে হয়, সে কিছুতেই ডাক্তার হতে পারবে না; রবার্ট ডারউইন যথারীতি খুবই রাগ করেছিলেন। চার্লসকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি পাখি মারা, ককুর আর ইদুর ধরা ছাড়া আর কিছুই করো না, আর তোমার নিজের জন্যতো বটেই, এই পরিবার জন্য তুমি একটা কলঙ্ক।’
রবার্ট ডারউইন একেবারে দয়ামায়াহীন বাবা ছিলেন না, উত্তরাধিকার সূত্রেই তার ছেলে বেশ বিত্তশালী হবে সেটা তিনি জানতেন, তবে সে কোনো অলস ধনী হোক সেটা তার কাম্য ছিলনা, যদি চার্লস ডাক্তারী না হতে পারে, তার এই ছোট ছেলের জন্য রবার্টের পক্ষে সম্মানজনক পেশা হিসাবে যাজকের পেশা ছাড়া আর কিছু কল্পনা করা কঠিন ছিল; ডারউইনরা পুরো পরিবারই বিশেষভাবে ধার্মিক ছিলেন না, রবার্ট ডারউইন ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নিজেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন; কিন্তু ব্রিটেনের সমাজে ধর্ম সামাজিক নিরাপত্তা আর সম্মানের একটি বাহন ছিল সেসময়; যদিও ডারউইনের চার্চ সম্বন্ধে কোনো বিশেষ আগ্রহ ছিল না, তবে তিনি সম্মত হয়েছিলেন, তাই পরের বছর তার গন্তব্য হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বের উপর পড়াশুনা করার জন্য।

(ছবি:Christ College, কেমব্রিজ, এখানে ডারউইন পাদ্রী হবার জন্য পড়তে এসেছিলেন)
পড়াশুনার জন্য বিশেষ পরিশ্রম করার মত ছাত্র ছিলেন না ডারউইন, বাইবেল পড়ার চেয়ে তাকে বেশী সময় দেখা যেত বীটল বা গুবরে পোকা সংগ্রহ করতে, তিনি বনে জঙ্গলে পোকামাকড়ের সন্ধান করতেন; একজন সহকারীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন গাছের গায়ে মস বা শৈবাল ছেচে ছেচে বা নলখাগড়ায় ঢাকা জলাভূমির কাঁদা ঘেটে তোলার জন্য, যেন তিনি দুষ্প্রাপ্য বা দূর্লভ কোনো প্রজাতি খুজে পান; আর ভবিষ্যতের জন্য, নাহ ডারউইন কোনো গীর্জার দায়িত্ব নেবার কথা কল্পনা করছিলেন না, তার স্বপ্ন ছিল পুরো ইংল্যান্ড ছেড়েই পাড়ি দেবার।

(ছবি:Christ College এর মাষ্টার গার্ডেন এ ডারউইনের একটি মেমোরিয়াল।)
ডারউইন হামবোল্ট (Alexander von Humboldt) এর কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, ব্রাজিলের ক্রান্তীয় অঞ্চলের জঙ্গলে আর আন্দীজ পর্বত মালায় তার দু:সাহসিক বিচিত্র অভিযান কাহিনী, তাকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রকৃতি কিভাবে কাজ করে সেই রহস্যটা সরাসরি প্রকৃতিতে গিয়ে খুজে বের করার জন্য; ক্যানারী দ্বীপপুন্জের বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন হামবোল্ট, বিশেষ করে ঘন জঙ্গলে ঢাকা আগ্নেয়শিলার পাথুরে উচু নীচু জমি, ডারউইন এরকম একটি অভিযানের পরিকল্পনাই করছিলেন মনে মনে; কেমব্রিজের একজন শিক্ষক, মারমাডিউক রামসে (Marmaduke Ramsay) কে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন; মারমাডিউক রামসে, যিনি তার সাথে ক্যানারী যাওয়ার জন্য রাজীও হয়েছিলেন, ভূতত্ত্ব বিষয়ে তার নিজের জ্ঞানকে ঝালাই করে নেবার জন্য কেমব্রিজের ভুতত্ত্ববিদ অ্যাডাম সেজউইক এর সহকারী হিসাবে ওয়েলস এ কয়েক সপ্তাহ কাজও করেছিলেন; ফিল্ড ওয়ার্ক থেকে ফিরে বেশ ভালোভাবেই ক্যানারী দ্বীপপুন্জে তার অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তখন তিনি একটা খবর পেয়েছিলেন..মারমাডিউক রামসে আর বেঁচে নেই।

(ছবি: আলেক্সজান্ডার ভন হামবোল্ট; অত্যন্ত বিখ্যাত এই প্রুশিয়ান ভূগোলবিদ, প্রকৃতিবিদ এবং অভিযাত্রী পরবর্তীতে তার মত অভিযানে যেতে বহু তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছিলে, যাদের মধ্যে ডারউইন অন্যতম; দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশে তিনি ব্যপকভাবে অভিযান করেন এবং প্রথম বারের মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তার অভিযানের বর্ণনা দিয়েছিলেন প্রায় ২১ বছর ধরে ধারাবাহিক খণ্ডে প্রকাশিত হওয়া একটি বিশাল ভ্রমন কাহিনীতে; ১৮৪৫ সালে তার প্রকাশিত Kosmos এ তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখাকে একটি ‍সূত্রে বাধতে চেয়েছিলেন।)
ডারউইন ভীষন হতাশ হয়েছিলেন, মাউন্টে ফিরে যাবার যাত্রা শুরু করেন ডারউইন, কি করবেন সে সম্বন্ধে কোন ধারনাই তার ছিলনা, কিন্তু যখন তিনি বাসায় পৌছান, তার জন্য সেখানে তখন অপেক্ষা করছিলো কেমব্রিজের তার অন্য আরেক প্রফেসর জন স্টিভেন্স হেনসলো (Stevens Henslow) র জরুরী একটি চিঠি: হেনসলো জানতে চেয়েছেন, পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার একটি সমুদ্র যাত্রার অংশ নিতে চান কিনা ডারউইন?



(ছবি: ১৮৬০ সালে ডারউইন, তখন তার বয়স ৫১, এর আগের বছর নভেম্বরে তার On the Origin of Species through Natural Selection বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ১৫ শিলিং দামের এই বইটি প্রকাশের প্রথম দুই দিনেই ১২৫০ কপির প্রত্যেকটি বিক্রি হয়ে যায়। পরের মাসে দ্বিতীয় সংস্করণ এর পুরো ৩০০০ কপিও বিক্রি হয় দ্রুত। পরবর্তীতে বইটির আরো অনেক সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছিল।)
নিঃসঙ্গ এক ক্যাপ্টেন:
আসলে প্রস্তাবটা এসেছিল এইচএমএস বিগলের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিটজরয়ের কাছ থেকে; ফিটজরয় উপর এই মিশনে দুটি দ্বায়িত্ব ছিল: নতুন প্রজন্মের সূক্ষ্মভাবে তৈরী করা একট ঘড়ি তাকে ব্যবহার করতে হবে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার সময় এবং দক্ষিণ আমেরিকার উপকুল অঞ্চলের একটি সঠিক ম্যাপ তৈরী করতে হবে; আর্জেন্টিনা এবং কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ তখন কেবলই স্বাধীন হয়েছে স্পেন এর নিয়ন্ত্রণ থেকে, এবং ব্রিটেনের নতুন বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করার জন্য এই এলাকার একটি সঠিক মানচিত্র প্রয়োজন।
বিগলের ক্যাপ্টেন হিসাবে, যদিও ফিটজরয়ের জন্য এটি দ্বিতীয় মিশন, তবে তার বয়স ছিল তখন মাত্র ২৭ বছর , ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডে বিশাল ভুসম্পত্তির মালিক এমন একটি অভিজাত পরিবারে তার জন্ম; রয়্যাল নেভাল কলেজে তিনি অংক আর বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রও ছিলেন, তিনি ভুমধ্যসাগর এবং বুয়েনোস আয়ার্স এ কিছু সময় দ্বায়িত্ব পালন করার পর, মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিগলের ক্যাপ্টেন হিসাবে দ্বায়িত্ব পান; বিগলের এর আগে ক্যাপ্টেন এর কাহিনীটা একটু ট্রাজিক, টিয়েরা দেল ফুয়েগোর ভীষণ অশান্ত সমুদ্রের ম্যাপ তৈরী করতে গিয়ে মূলত তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন.. তার কাছে থাকা ভুল ম্যাপ তাকে বার বার ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল, জাহাজের নাবিকদের স্কার্ভির প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত ক্যাপ্টেন তার লগ বুকে লিখেছিলেন, তার ‘আত্মা মরে গেছে’, তারপর তিনি নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

(ছবি: রবার্ট ফিটজরয়, এইচ এম এস বিগলের ক্যাপ্টেন, যার আমন্ত্রনে ডারউইন বিগলের সমুদ্র যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন; এছাড়াও তিনি প্রথম দিক কার আবহাওয়াবিদ ছিলেন, কিভাবে আবহাওয়া আগে থেকেই অনুমান করা যেতে পারে এব্যাপারে তিনি অগ্রণী ভুমিকা রেখেছিলেন; ডারউইনের সাথে পরবর্তীতে তার সম্পর্ক অবনতি ঘটেছিল, বিশেষ করে অরিজিন অব স্পিসিস প্রকাশনার পর; গোড়া ধার্মিক ছিলেন তিনি; পরর্ব্তীতে পরবর্তীতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, ডিপ্রেশন জনিত কারণে। ডারউইন বিপদগ্রস্থ ফিটজরয় পরিবারকে বাচাতে ফিটজরয় এর বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।)
ফিটজরয় মানুষ হিসাবে বলা যায় অভিজাত শ্রেণীর ঐতিহ্য আর আধুনিক বিজ্ঞান মনস্কতা, মিশনারীদের মত উদ্যম আর একাকীত্বের হতাশার একটি অসম মিশ্রন; বিগলে তার প্রথম মিশনে টিয়েরা দেল ফুয়েগো জরিপ করার সময় স্থানীয় অধিবাসীরা তার একটি নৌকা চুরি করেছিল; ফিটজরয় এর বদলা হিসাবে কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের বন্দী করেছিলেন, যাদের বেশীর ভাগই অবশ্য পালিয়ে যায় কেবল তিন জন ছাড়া, যারা রয়ে গিয়েছিল, দুজন পুরুষ এবং একজন নারী, এই তিনজন জাহাজে থাকতেই যেন বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল, ফেরার পথে আরো একজন আদিবাসী সহ মোট চারজনকে ফিটজরয় তার সাথে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন, তার পরিকল্পনা ছিল তিনি তাদের লেখাপড়া শেখাবেন এবং আবার পরে ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন একজন মিশনারীসহ, যেন তারা বাকীদের খ্রিস্ট ধর্মে রুপান্তরিত ও শিক্ষিত করে তুলতে পারে।
ফিটজরয়ের মনে হয়েছিল এই আসন্ন সমুদ্রযাত্রায় তার আসলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন; যেহেতু ক্যাপ্টেনরা জাহাজের নাবিকদের সাথে সামাজিক ভাবে মেলামেশা করেন না, এই চাপিয়ে দেয়া নির্জনতা যে কাউকে পাগল করে দেবার জন্য যথেষ্ঠ; আর এছাড়া এর আগে আত্মহত্যা করা বিগল ক্যাপ্টেন এর অশরীরি আত্মার ভয়টাতো আছেই, উপরন্তু ফিটজরয়ের আরো একটি বাড়তি চিন্তা ছিল, তার নিজের চাচাও, একজন রাজনীতিবিদ, সমস্ত ক্যারিয়ার ভেস্তে যাবার পর নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেছিলেন।’
হয়তো ফিটজরয়েরও সেই ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হবার আশঙ্কা ছিল ( তার আশঙ্কা অমুলক ছিল না, কারন এর তিন দশক পর নিজের ব্যর্থ হতে থাকা নৌবাহিনীর ক্যারিয়ারে ভীষন হতাশ হয়ে ফিটজরয় নিজেও তার গলা কেটে আত্মহত্যা করেছিলেন), তাই ফিটজরয় এই অভিযানের সংগঠক ফ্রান্সিস বোফোর্টকে অনুরোধ করেছিলেন, তাকে সঙ্গ দেবার মত কাউকে খুজে দিতে; তারা রাজী হয়েছিলেন যে, তার এই সঙ্গীটি অভিযানে প্রকৃতি বিজ্ঞানীর দ্বায়িত্বটাও পালন করবেন, যিনি নানা ধরনের প্রাণি আর উদ্ভিদের নমুনা, যা বীগলের এই সমুদ্রযাত্রা চোখে পড়বে তার একটি তথ্য সংগ্রহ করবেন; ফিটজরয় শুধু চাইছিলেন, সে যেন একজন অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ভদ্রলোক হয়, যেন তার সাথে তিনি কথা বলতে পারবেন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার একাকীত্বকে ঠেকাতে।
বোফোর্ট কেমব্রিজে তার বন্ধু হেনসলোর সাথে যোগাযোগ করেন; যদিও এই পদটি লোভনীয়, তাসত্ত্বেও হেনসলো ঠিক করেন এতদিনের জন্য তিনি তার পরিবার ফেলে যেতে পারবেন না, তাই তিনি সম্প্রতি কেমব্রিজ থেকে পাশ করা লিওনার্ড জেনইনসকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন প্রথমে, আর লিওনার্ডও তার কাপড় গুছিয়ে প্রায় প্রস্তুতও হয়েছিলেন, তবে শেষ মুহুর্তে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন যখন একটি গ্রামের প্যারিশে যাজকের নিয়োগ পান তিনি, হঠাৎ করে গীর্জা ছেড়ে দেওয়াটা তার সমীচিন মনে হয়নি। সুতরাং হেনসলো অবশেষে প্রস্তাবটি দিলেন ডারউইনকে, ক্যানারী দ্বীপপুন্জে ভেস্তে যাওয়া অভিযানের বদলে এমন সুযোগ ডারউইন কল্পনাও করেননি, কোনো পরিবার বা চাকরীর পিছুটান ছাড়া ডারউইন এমন একটি দূর্লভ সুযোগ পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত।
ডারউইনের বাবার উৎসাহ অবশ্য তার মত এত তীব্র ছিল না, তিনি সমুদ্র গামী জাহাজের কষ্টকর এবং নোংরা পরিবেশে তার ছেলে কিভাবে থাকতে পারবেন সে ব্যাপারে প্রথমত চিন্তিত ছিলেন, এছাড়া ছেলের পানিতে ডুবে মারা যাবার কল্পনাও তাকে শঙ্কিত করে তুলেছিল; রবার্ট ডারউইন মনে করতেন নৌবাহিনীর চাকরীতে ভদ্রলোকের জায়গা নেই, আর ভবিষ্যতের যে পাদ্রী হবে তার জন্য এধরনের জাহাজে করে অচেনা বনে বাদাড়ে অভিযানের বিষয়টি ভবিষ্যতে সন্মানজনক হিসাবে না দেখারও সম্ভবনা আছে। এবং যদি চার্লস এই অভিযানে যায়, তাহলে তার ভালো কোন সম্মানজনক (তার বাবার মতে) জীবনে থিতু হবার সুযোগ আর নাও আসতে পারে।
অত্এব বিষন্ন চার্লস তার শিক্ষক হেনসলোকে চিঠি জানালেন, তার বাবা তাকে অনুমতি দেননি; কিন্তু বাস্তব হলো রবার্ট ডারউইন আসলে তার মনস্থির করতে পারেননি তখনও; যখন মনক্ষুন্ন চার্লস নানা বাড়ি বেড়াতে গেলেন এসব ভুলে থাকার জন্য, রবার্ট তার শ্যালক জোসেফ ওয়েজউডকে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি পাঠান তার পরামর্শ চেয়ে; চিঠিতে তিনি এই অভিযানের বিরুদ্ধে তার মতামতগুলো ব্যাখ্যা করে জোসেফকে লেখেন, ‘যদি তুমি আমার চেয়ে ভিন্নভাবে ব্যাপারটা ভাবো, আমি চাই সে যেন তোমার উপদেশ মেনে কাজটা করে’।

(ছবি:জশিয়া ওয়েজউড দ্বিতীয়, যার মতামত ডারউনের বাবাকে রাজি করিয়েছিল তার ছেলে সমুদ্রযাত্রার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য। ডারউইন তার মেয়ে এমাকে বিয়ে করেছিলেন পরে। বাবার ওয়েজউড পটারী কারখানা দেখা ছাড়াও তিনি একজন সংসদ সদস্য ছিলেন, দাস প্রথা বিলোপে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।)
ডারউইনও ওয়েজউডকে পুরো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন এবং জোসিয়া ওয়েজউড ( জোসিয়া ওয়েজউড দ্বিতীয় ) তার ভাগ্নেকে বেশ উৎসাহ দেন, তারপর রবার্টকে চিঠিতে লেখেন, ‘একজন পাদ্রীর জন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণা করা খুবই সন্মানজনক কাজ, এবং এটি একটি দুর্লভ সুযোগ, এভাবে অনেক কিছু দেখার সুযোগ খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে।’ ভোরবেলা চিঠিটি পাঠিয়ে জোসেফ তার ভাগ্নেকে নিয়ে পাখি শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু সকাল দশটায় দুজনকেই দেখা যায় মাউন্টের উদ্দেশ্যে ঘোড়া গাড়িতে, কারণ রবার্ট ডারউইনের সাথে মুখোমুখি ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মাউন্টে পৌছে দেখেন, রবার্ট ইতিমধ্যেই তার পাঠানো চিঠিটি পেয়েছেন এবং আগের মত তেমন দৃঢ় নন আর তার পূর্ব সিদ্ধান্তে।
তিনি এই সমুদ্রযাত্রার জন্য ডারউইনকে প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করে দেন, ডারউইনের বোনরা ভাইকে উপহার দেয় বেশ কিছু নতুন কাপড়; ফ্রান্সিস বোফোর্টকে ডারউইন চিঠি পাঠান দ্রুত, যেন তিনি হেনসলোকে লেখা তার আগের চিঠি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না নেন, কারণ বিগলের সমুদ্র যাত্রায় যোগ দিচ্ছেন তিনি। যদিও তখনও তার ফিটজরয়ের সাথে দেখা হয়নি এবং শীঘ্রই ডারউইন শুনতে পেলেন ক্যাপ্টেন বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবছেন।ফিটজরয়ের স্বভাবসূচক বীপরিত দিকে ঘুরে দাড়ানোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাকে বিভিন্ন জায়গায় বলতে শোনা গেল, বিগলের সেই পদটা ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে তার এক বন্ধুর দ্বারা এবং ডারউইনের কাছেও সেই সংবাদটি এসে পৌছায়; ভীষন মুষড়ে পড়লেন ডারউইন, কিন্তু গুজব সত্ত্বেও তিনি লন্ডনে ফিটজরয়ের সাথে তার দেখা করার বিষয়টি অপরিবর্তিত রেখেছিলেন।
মাউন্ট থেকে তার যাত্রা শুরুর সময় তিনি চিন্তিত ছিলেন তার সমুদ্রযাত্রার এই স্বপ্নটা না আবার যেন খুব দ্রুত উড়ে যায়; যখন ডারউইন এবং ফিটজরয়ের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল, শুরুতেই ফিটজরয় এমন একটি সমুদ্রযাত্রায় ভয়ঙ্কর কি কি সব হতে পারে সেটা দিয়েই শুরু করেছিলেন, কষ্টকর, ব্যয়সাধ্য এবং হয়তো পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণও না হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু ডারউইনকে তা কিছুই দমাতে পারেনি, বরং উল্টো তিনি তার আন্তরিক যাজকের মতে ব্যবহার, তার যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ, তার সযত্নে গড়ে তোলা কেমব্রিজ সূলভ আচরণ আর কৌশলগত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ফিটজরয়ের মন জয় করে নিলেন অনায়াসে।
ঠিক হলো ডারউইনই হবেন তার যাত্রার সঙ্গী; আর ডারউইন মনে মনে বললেন… ’দক্ষিন আমেরিকার গুবরে পোকারা সাবধান আমি আসছি’।
পৃথিবীর গড়ে ওঠা…
অক্টোবর ১৮৩১ সালে যখন ডারউইন প্লীমথ পৌছেছিলেন তার ট্রাঙ্ক ভর্তি বই আর বৈজ্ঞানিক সরন্জাম নিয়ে, তিনি পৃথিবী এবং জীব জগত সম্বন্ধে তৎকালীন ধারণাকে তার সাথে নিয়ে এসেছিলেন; কেমব্রিজে তার শিক্ষকরা শিখিয়েছিলেন, পৃথিবী সম্বন্ধে জানার মাধ্যমেই আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা জানতে পারি; কিন্তু তাসত্ত্বেও বৃটিশ বিজ্ঞানীরা যতই আবিষ্কার করতে লাগলেন, ততই বাইবেলকে নির্ভুল একটি গাইড হিসাবে তাদের বিশ্বাস করাও কঠিন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বৃটিশ ভূতত্ত্ববিদরা যেমন, আর মেনে নিতে রাজী ছিলেন না যে, পৃথিবী মাত্র কয়েক হাজার বছর প্রাচীন; কোনো এক সময় হয়তো যথেষ্ট ছিল বাইবেল এর কথা আক্ষরিক অর্থে মেনে নেয়া, যেমন মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম সপ্তাহে; ১৬৫৮ সালে জেমস আশার, আরমাঘের আর্চ বিশপ বাইবেল এবং কিছু ঐতিহাসিক রেকর্ড ঘেটে গ্রহের বয়স নির্দিষ্ট করেন। তিনি দাবী করেছিলেন, ঈশ্বর নাকি ৪০০৪ খৃষ্টপুর্বাব্দে অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন।

(ছবি:জেমস আশার (James Ussher: 1581 –1656); আয়ারল্যান্ডের এই আর্চ বিশপ পৃথিবীর বয়স মেপেছিলেন, তার মতে ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ২২ অক্টোবর ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন; বিস্ময়কর হলে সত্য এখনও অনেকে ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিষ্ট আছেন, যারা জেনেসিসে বর্ণিত সময়কাল অনুযায়ী পৃথিবীর বয়স মনে করেন মাত্র কয়েক হাজার বছর।)
কিন্তু খুব শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে যায় সৃষ্টির শুরুর সেই সময় থেকে পৃথিবী বদলে গেছে অনেকটাই, ভুতত্ত্ববিদরা সামুদ্রিক মোলাস্কদের শেলস বা খোলস এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রানীদের জীবাশ্ম খুজে পান খাড়া পাহাড়ের উন্মুক্ত মুখের পাথরের স্তরে স্তরে; নিশ্চয়ই ঈশ্বর তাদের সেখানে রেখে দেননি পৃথিবী সৃষ্টির সময়, আগের ভুতত্ত্ববিদরা এধরনের জীবাশ্মকে ব্যাখ্যা করতেন বাইবেলে বর্ণিত নোয়ার (নুহ নবী) সময়কালে ঘটা পৃথিবী ব্যাপী প্লাবণে মৃত প্রাণিদের অবশিষ্টাংশ হিসাবে, যখন সমুদ্র পুরো পৃথিবীকে ঢেকে রেখেছিল, তারা কাদার নীচে ডুবে গিয়েছিল সমুদ্র তলে, এই কাদার স্তরই সমুদ্রের তলদেশে পাথরের স্তর তৈরী করেছিল এবং যখন বন্যার পানি সরে গিয়েছিল, বেশ কিছু স্তর ভেঙ্গে পরে, যে প্রক্রিয়ায় জীবাশ্ম পূর্ণ খাড়া পাহাড় আর নানা পর্বতমালা সৃষ্টি করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষেও, যদিও বেশীর ভাগ ভূতত্ত্ববিদই পৃথিবীর ইতিহাসকে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে, এমন পৃথিবীর পরির্বতন হবার একমাত্র সুযোগ হিসাবে একটি সর্বব্যাপী বিশাল বন্যার ধারণায় সব কিছুকে ব্যাখা করার প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করেন; কেউ কেউ প্রস্তাব করেন যখন এই গ্রহটি সৃষ্টি হয়েছিল পুরোটাই নিমজ্জিত ছিল বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে, যা ধীরে ধীরে গ্রানাইট এবং তার উপর স্তরে স্তরে অন্য পাথরেরও স্তর সৃষ্টি করেছিল, পরে যখন সমুদ্র সরে যেতে থাকে, এটি সেই পাথরের কিছু অংশ উম্মোচিত করে, যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে আরো স্তরের সৃষ্টি করে;
অন্য ভুতত্ববিদরা দাবী করেন, পৃথিবীর ভুত্বককে পরিবর্তন করার মূল শক্তি এসছে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকেই, জেমস হাটন, স্কটল্যাণ্ডেে একজন কৃষিবিদ ও ভূতত্ত্ববিদ প্রস্তাব করেন পৃথিবীর কেন্দ্রের গলিত লাভাই নীচ থেকে গ্রানাইটদের উপরে ঠেলে দেয়, কোনো জায়গায় তা আগ্নেয় গিরির সৃষ্টি করে, কোথাও তা পৃথিবী পৃষ্ঠের বিশাল অংশকে অনেক উপরে ঠেলে উঠিয়ে দিয়ে সৃষ্টি করে পর্বতমালা; বৃষ্টি এবং বাতাস পর্বত আর অন্যান্য উচু জায়গাগুলোকে ক্ষয় করে, এবং এই তলানীগুলোই সমুদ্রে বয়ে নিয়ে যায় পানি, যেখানে আবার সে পাথর তৈরী করে এবং পরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে সৃষ্টি আর ধ্বংশর বিশ্বব্যাপী একটি চক্রে; হাটন পৃথিবীকে দেখেছিল চমৎকার ভাবে তৈরী করা ক্রমশ চলতে থাকা গতিময় একটি যন্ত্র হিসাবে, যা সবসময় মানুষের জন্য একে বাসযোগ্য রাখে।

(ছবি:জেমস হাটন James Hutton (1726-1797); যার গবেষণা আধুনিক ভুতত্ত্ববিদ্যার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল; জিওলজিকাল টাইম বা ডিপ টাইমের ধারণাটিও তার)
হাটন তার তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণও খুজে পেয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের শিলাস্তরের গঠনেই; তিনি দেখেছিলেন গ্রানাইট পাথরের ভেইন বা শিরা কিভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে উপরের পাললিক শিলার স্তরের ভিতরে; তিনি ভুপৃষ্ঠের কিছু খোলা জায়গায় দেখতে পান উপরের পাললিক শিলার স্তর সঠিক আনুভুমিকভাবে একের পর এক সাজানো রয়েছে কিন্তু ঠিক এর নীচেই অন্য স্তরগুলো সাজানো আসলেই উল্লম্ব ভাবে, সবচেয়ে নীচের স্তরটি ,হাটন যুক্তি দেন, হয়তো সৃষ্টি হয়েছিল প্রাচীন কোনো জলাশয়ে, এবং এরপর এটি একপাশে হেলে বা কাৎ হয়ে যায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে একে ঠেলে উঠিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর ভিতরের কিছু শক্তি, এবং পরে তা ধীরে ধীরে বৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষয় হতে থাকে; পরে এই হেলানো স্তরগুলো আবার পানির নীচে ঢাকা পড়ে, এবং এর উপর নতুন এক সেট আণুভূমিক পাললিক শিলার স্তর সৃষ্টি হয় এবং অবশেষে আবারো পুরো স্তরটি পানির উপরে উঠে আসে এমন একটি ভুতাত্ত্বিক কাঠামোর সৃষ্টি করেছিল।

(ছবি:স্কটল্যান্ডে হাটনের বর্ণিত শিলাস্তরের Unconformity)
‘একটা প্রশ্ন এখানে স্বাভাবিকভাবেই আসে, সেটি এরকম কিছু হবার জন্য প্রয়োজনীয় সময়কাল নিয়ে’.. হাটন মন্তব্য করেছিলেন যখন তিনি তার এই তত্ত্বটি সর্বসাধারণের জন্য প্রস্তাব করেন, কতটুকু সময়কালের প্রয়োজন ছিল এই বিশাল কাজটি করার জন্য? তার উত্তর ছিল, অনেক..অনেক দীর্ঘ সময়; বাস্তবিকভাবে তিনি কল্পনা করেছিলে, অসীম সময়ের।
কিভাবে পৃথিবীর পরিবর্তন হচ্ছে সে বিষয়ে হাটন একটি মৌলিক নীতি আবিষ্কার করেছিলেন: আমাদের বোধগম্যতার বাইরে ধীর সেই শক্তি আজো কাজ যা করে যাচ্ছে এই গ্রহকে এর পুরো ইতিহাস জুড়ে নতুন রুপ দিতে; সেকারণেই আজকের যুগে অনেক ভূতত্ত্ববিদের কাছে তিনি স্মরণীয়; কিন্তু তার সময়ে তাকে সরাসরি বিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে হয়েছিল সবক্ষেত্রেই; তার কিছু সমালোচক অভিযোগ করেছিলেন, তার তত্ত্ব বাইবেলে বর্ণিত জেনেসিস এর ব্যাখ্যা বিরোধী; কিন্তু বেশীর ভাগ ভূতত্ত্ববিদই তার সেই ধারাণটি, পৃথিবীর ইতিহাসের যে কোনো দিক নির্দেশনা নেই, এবং এটি স্বয়ংসম্পুর্ণ সৃষ্টি আর ধ্বংসের একটি চক্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় যার কোন শুরু বা শেষ নেই… এই বিষয়টির বিরোধীতা করেছিলেন; কিন্তু তারা যত মনোযোগ দিয়ে ভুতাত্ত্বিক রেকর্ড দেখতে শুরু করেন, স্পষ্টতই তারা দেখতে পেলেন পৃথিবী সবসময় একই রকম ছিল না।

(ছবি:কুভিয়ের (Jean Léopold Nicolas Frédéric Cuvier (1769 – 1832) , যিনি পরিচিত ছিলেন জর্জ কুভিয়ের হিসাবে; ফরাসী কুভিয়ের উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অত্যন্ত বিখ্যাত একজন প্রাণিবিজ্ঞানী ছিলেন; তুলনামুলক অ্যানাটোমী ও জীবাশ্মবিদ্যা তার দেখানো পথে শুরু হয়েছিল; তিনি প্রথম জীবাশ্ম কংকালের সাথে জীবিত প্রাণির কংকালের তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন; তিনি প্রমাণ করেছিলেন প্রজাতির বিলুপ্তি একটি ফ্যাক্ট এবং পৃথিবী ব্যাপী মহাদূর্যোগ ঘটেছিল, যা বহু প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ (Catastrophism); জীবাশ্মবিদ হলেও তিনি বিবর্তনের ধারণার বিরোধী ছিলেন; লামার্ক ও পরে জিওফরয় সন্ত ইলিয়ারের বিবর্তনের ধারণাকে বিরোধিতায় নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন)
আর এর সবচেয়ে ভালো প্রমান এসেছিল পাথর থেকে না, পাথরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা জীবাশ্মদের কাছ থেকে; ফ্রান্সে যেমন একজন তরুন প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ কুভিয়ের জীবিত হাতিদের মাথার খুলির সাথে সাইবেরিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা (যেখানে এখন আর কোনো হাতি দেখতে পাওয়া যায় না) থেকে উদ্ধার করা জীবাশ্ম হাতির খুলির সাথে একটি তুলনামুলক আলোচনা করেন; কুভিয়ের তাদের বিশাল চোয়ালের রেখাচিত্র আকেন, তাদের দাত একটার সাথে একটা মিশে আছে করুগেটেড স্ল্যাবের বা ঢেউ খেলানো পাথরের টুকরোর মত; তিনি প্রমান করে দেখান যে এই জীবাশ্ম হাতি ( যাদের ম্যামথ বলা হয়) বর্তমানে জীবিত হাতিদের দিয়ে থকে মৌলিকভাবে ভিন্ন;
”যেমনটা কুকুর ভিন্ন শিয়াল বা হায়েনা থেকে, বা তারো বেশী”; তিনি লিখেছিলেন; খুবই কঠিন হবে এমনটা দাবী করা যে এই সুস্পষ্ট সুবিশাল প্রানীটি ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ কারো চোখে পড়েনি; প্রথম বারের মত একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা দেখালেন অতীতে কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে।’ কুইভিয়ের পরে আরো প্রমান করে দেখিয়েছিলেন যে, অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণিও বিলুপ্ত হয়েছে; তার আবিষ্কার সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ”আমার মনে হয় তারা প্রমান করে আমাদের আগে অন্য এক পৃথিবীর অস্তিত্ত্ব ছিল, যা ধ্বংশ হয়েছে কোন ধরনের মহাদুর্যোগের কারনে; কিন্তু এই কি ছিল সেই প্রাচীন পৃথিবী? কি সেই প্রকৃতি যা মানুষের কর্তৃত্ত্বের বাইরে? এবং এটি বিলুপ্ত করার মত বৈপ্লবিক ঘটনাটাই বা কি, যা কিছু ক্ষয়ে যাওয়া হাড় ছাড়া আর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট রাখেনি?”।
কুভিয়ের এমন কি আরো বলেছিলেন যে, কেবল মাত্র একটিই মহাদুর্যোগ হয়নি, যেখানে মামথ আর স্তন্যপায়ী বিলুপ্ত হয়েছে, বরং ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো এমন ঘটনা ঘটেছে; বিভিন্ন যুগের জীবাশ্মগুলোও এত বেশী বৈশিষ্ট্যসূচক যে কুভিয়ের এমনকি তাদের ব্যবহার করতে পারতেন কোন পাথরের ফরমেশনে তারা পাওয়া গেছে তা চিহ্নিত করতে; মহাদুর্যোগের সঠিক কারনটি কি ছিল তা নিশ্চয়ই কুভিয়ের এর জানা ছিল না; তিনি ধারনা করেছিলেন, হঠাৎ করে বেড়ে ওঠা সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বা কোন হঠাৎ তুষার যুগ হয়তো বা এর কারণ হতে পারে; পরবর্তীতে নতুন প্রাণী আর উদ্ভিদ আবির্ভূত হয়েছিল গ্রহের অন্য কোন স্থান থেকে সেখানে অভিপ্রয়ানের মাধ্যমে বা কোন না কোন ভাবে সেখানেই সৃষ্টি হয়েছিল তাদেরনতুন করে; কিন্তু কুভিয়ের একটা ব্যপারে নিশ্চিত ছিলেন, এধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা; যদি নোয়ার প্লাবন সত্যি হয়ে থাকে, সেটি ছিল এধরনের ধারাবাহিক ভাবে ঘটে আসা দুর্যোগের সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা মাত্র ; প্রতিটি দুর্যোগই অসংখ্য প্রজাতির বিলুপ্তির কারন ছিল, এবং বেশীর ভাগ এধরনের ঘটনাগুলো ঘটেছে মানুষের আবির্ভাবের বহু আগেই।

(ছবি: ১৮৫৪ সালে ডারউইন -অরিজিন অব স্পিসিস তখনও লেখা হয়নি। ছবিটা নিয়ে বন্ধু জোসেফ হুকারকে লিখেছিলেন : if I really have as bad an expression, as my photograph gives me, how I can have one single friend is surprising.)
জীবনের ইতিহাসের সত্যিকারের গতিটা নির্ণয়ের জন্য, বৃটিশ ভূতত্ত্ববিদরা যেমন, অ্যাডাম সেজউইক সমস্ত গ্রহের ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড তৈরীর একটি কাজ হাতে নেন, স্তর বিন্যাস অনুযায়ী, তারা শিলা স্তরের ফরমেশনকে যে নাম দিয়ে গিয়েছিলেন, তার কিছু এখনও প্রচলিত আছে, যেমন ডেভোনিয়ান এবং ক্যামব্রিয়ান, যদিও বৃটিশ ভূতত্ত্ববিদরা ১৮০০ র শুরু দিকে আক্ষরিকভাবে বাইবেল থেকে বহু দূরে অবস্থান নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে তারা তাদের কাজকে দেখতেন ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে;তারা বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানই ঈশ্বরের সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করবে, এমনকি তার উদ্দেশ্যগুলোকে; সেজউইক নিজে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতেন, ঈশ্বরের শক্তি, জ্ঞান এবং মাহাত্মের প্রতিচ্ছবি হিসাবে।



(ছবি: ১৮৪৯ এ তার চল্লিশ বছর বয়সে চার্লস ডারউইন, প্রতিকৃতি: Thomas Herbert Maguire)

ঐশ্বরিক পরিকল্পনা বা ডিজাইনের প্রকাশ
বৃটিশ গবেষকরা যেমন, অ্যাডাম সেজউইক, ভাবতেন ঈশ্বরের মহত্ব দৃশ্যমান শুধু কিভাবে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং আমরা সেটি দেখতে পাই কিভাবে তিনি জীবন সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটি প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে পৃথক প্রথক ভাবে, এবং সৃষ্টির পর থেকেই তারা অপরিবর্তিত আছে, তারপরও সব প্রজাতিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা সম্ভব –যেমন প্রাণি এবং উদ্ভিদ এবং তার মধ্যেই আরো অনেক ক্ষুদ্র উপশ্রেণীতে যেমন, কোনো ওক গাছ এবং স্তন্যপায়ী; এই বিন্যাস বৃটিশ প্রকৃতবিদরা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীতে এটি ঈশ্বরের কল্যাণময় পরিকল্পনারই একটি রুপ; এটি বিন্যস্ত একটি ক্রমাণুসারে, যা শুরুর নির্জীব বস্তু এবং জীবনের আঠালো বা স্লাইমী নানা রুপ থেকে বিস্তৃত আরো জটিল এবং উচ্চমানের সংগঠনের জীবদের দিকে। তাদের ধারণায় সেই ‘উচ্চমানে’র অর্থ অবশ্যই বোঝাচ্ছে মানুষের সদৃশ হয়ে ওঠাকে। আর এই জীবনের মহাশৃঙ্খলের একটি সংযোগও সৃষ্টির আদি থেকে পরিবর্তিত হতে পারেনা কখনোও; কারণ তেমন কোনো পরিবর্তনের অর্থই হবে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিঁখুত ছিল না। আলেক্সান্ডার পোপ যেমন লিখেছিলেন,” প্রকৃতির শৃঙ্খলে যে সংযোগেই আঘাত করুন না কেন/ দশ বা হাজার টুকরোই হোক না কেন সেটি, সবই একই হবে”; এই জীবনের মহা-শৃঙ্খল শুধু ঈশ্বরের কল্যাণময় সৃজনশীলতাকেই প্রকাশ করেনা, প্রতিটি প্রজাতির অতুলনীয় নিঁখুত সূক্ষ্ম ডিজাইনও প্রকাশ করে; মানুষের চোখ বলুন কিংবা পাখির ডানা; উইলিয়াম প্যালি, একজন ইংরেজ যাজক, এই যুক্তিটাই তার বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন, যা ডারউইন বা প্রকৃতিবিদ বা ধর্মতাত্ত্বিক হবার ইচ্ছা পোষণনকারী যে কারোর জনই বাধ্যতামূলক একটি পাঠ্য ছিল।

(ছবি: অ্যাডাম সেজউইক, Adam Sedgwick (785 – 1873); আধুনিক ভুতত্ত্ববিদ্যার অন্যতম অগ্রদুত; ‍যিনি দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক সময়পর্ব ডেভোনিয়ান ও ক্যামব্রিয়ান পর্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন; ডারউইনের শিক্ষক ছিলেন ভূতত্ত্ব বিষয়ে। ওয়েলস এ তার অধীনে হাতে কলমে ভূতত্ত্ববিদ্যার কাজ শিখেছিলেন ডারউইন; ঐশ্বরিক ভাবে প্রজাতি সৃষ্টি হচ্ছে ধাপে ধাপে এমন ধারণায় তার বিশ্বাস ছিল দৃঢ়।পরবর্তী তার ছাত্র ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটির তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। অরিজিন অব স্পিসিস প্রকাশ করার সময় তার মতামত নিয়ে আগে থেকেই চিন্তিত ছিলেন ডারউইন।)
প্যালির যুক্তি একটি আকর্ষণীয়, সহজে প্ররোচিত করতে পারে এমন একটি তুলনার উপর মূলত ভিত্তি করে দাড়িয়ে ছিল। তিনি লিখেছিলেন ‘কোনো জঙ্গলের পথে হাটার সময়, ধরুন একটি পাথরের টুকরোর সাথে আমার পা হোচট খেলো আর প্রশ্ন করা হয় কেমন করে পাথরটা সেখানে এলো?’, প্যালি যতটুকু জানেন, হয়তো সেই পাথরের টুকরোটি সেখানে চিরকািই পড়েছিল, ‘কিন্তু ধরুন আমি মাটিতে পড়ে থাকা একটি ঘড়ি খুঁজে পেলাম, এবং তখন জিজ্ঞাসা করা উচিৎ কেমন করে সেটা সেখানে আসলো?, সেক্ষেত্রে প্যালি যুক্তি দেন তিনি খুবই ভিন্ন একটি উপসংহারে উপনীত হবেন, পাথরের ব্যতিক্রম, কোনো একটি ঘড়ি তৈরী হয় বেশ কয়েকটি যন্ত্রাংশের সন্মিলনে, যারা সম্মিলিতভাবে কাজ করে একটি উদ্দেশ্যে : তা হলো সময় নির্ণয়। এবং এই সব অংশগুলো কেবল কাজ করতে পারে যদি তারা সবাই একসাথে কাজ করে, অর্ধেক ঘড়ি তো আর কোনো সময় নির্ণয় করতে পারে না। প্যালি যুক্তি দেন, সেকারণে এই ঘড়িটি অবশ্যই কোনো পরিকল্পনাকারী বা ডিজাইনারের সৃষ্টি। প্যালি এমনকি যদি নাও জানেন কেমন করে একটি ঘড়ি বানাতে হয়, আর এমনকি যে ঘড়িটি তিনি পেয়েছেন সেটি যদি কাজ নাও করে, তারপরও তিনি একই কথা বলবেন। তার মতে এটাকে অসংখ্য ধাতব টুকরার নানা সম্ভাব্য বিন্যাস সন্নিবেশের শুধুমাত্র একটি সৃষ্টি বলা অর্থহীন হবে ।

(ছবি:উইলিয়াম প্যালি; William Paley (1743 –1805); প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের এই প্রণেতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে টেলিওলজিক বা ডিজাইন আর্গুমেন্টটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ঘড়ি নির্মাতার রুপক ব্যবহার করার মাধ্যমে।)
প্যালি যুক্তি দিয়েছিলেন, আমরা যখন প্রকৃতির দিকে তাকাই, আমরা এই ঘড়ির তুলনায় অগনিত আরো জটিল ও সূক্ষ্মভাবে তৈরী নানা সৃষ্টি দেখতে পাই; দূর বীক্ষণ যন্ত্র আর চোখ একই মূলনীতি অনুযায়ী বানানো হয়েছে, যেখানে লেন্সটি আলোক রশ্মিদের বাঁকা করে একটি ইমেজ বা দৃশ্য তৈরী করে; পানিতে আলোকে বাঁকা করতে আরো বেশী উত্তলাকার লেন্সের প্রয়োজন, বাতাসের তুলনায়; একারণে দেখুন, সামুদ্রিক প্রাণিদের চোখের লেন্স আরো গোলাকার থাকে স্থলবাসী প্রাণিদের তুলনায়; প্যালী তাই জিজ্ঞাসা করেন. ‘এই পার্থক্যের তুলনার চেয়ে আর কি কোনো সহজতর উদহারন আছে যা কিনা প্রমাণ করে স্বর্গীয় একজন ডিজাইনারের উপস্থিতির’?
একটি ঝিনুক, স্পুনবিল বা একটি কিডনী, যা কিছু প্যালি পরীক্ষা করে দেখেছেন তাই তাকে বিশ্বাস যুগিয়েছে প্রকৃতির সবকিছুরই একটি ডিজাইনার বা পরিকল্পক আছে; পদার্থবিদ্যার নানা সূত্র, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ১৭০০ এর শেষ দিকে, গ্রহের কক্ষপথকে ব্যাখ্যা করতে, তা হয়তো ঈশ্বরের মহিমা খানিকটা হ্রাস করেছিল (‘জ্যোতির্বিজ্ঞান’, প্যালি স্বীকার করেছিলেন, ‘খুব ভালো কোন মাধ্যম নয়, যা দিয়ে বুদ্ধিমান কোনো সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি প্রমান করা যায়’); কিন্তু ধর্মতত্ত্ব এই ক্ষেত্রে এখনও খুবই উর্বর ক্ষেত্র।
প্রকৃতি থেকে, প্যালি তার সিদ্ধান্তে আসেন যে, কোনো স্রষ্টা ডিজাইনারের অস্তিত্ব আছে তাই শুধু না, তিনি কল্যাণময়; তিনি যুক্তি দেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সৃষ্ট সব কিছুই উপকারী; পৃথিবীতে যা খারাপ কিছু আছে তা দূর্ভাগ্যজনক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। একজন মানুষ তার দাঁত ব্যবহার করতেই পারেন কাউকে কামড়ানোর জন্য, কিন্তু দাঁত পরিকল্পনা করা হয়েছে মূলত খাদ্য খাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করার জন্য। যদি ঈশ্বর চাইতেন আমরা একে অপরের ক্ষতি করি, তাহলে তিনি এর চেয়ে আরো ভালো অস্ত্র ডিজাইন করে আমাদের মুখের মধ্যে দিতেন। এধরনের কোনো কালো ছায়া জীবনের সূর্যালোক থেকে প্যালীর মনোযোগ নষ্ট করতে পারেনি, ‘সর্বোপরি অবশ্যই আনন্দের পৃথিবী এটি, বাতাস, মাটি এবং পানি পরিপূর্ণ হয়ে আছে তৃপ্ত জীবনের অস্তিত্বে’।
কেমন করে জিরাফ তার লম্বা ঘাড় পেল
ডারউইনও মুগ্ধ হয়েছিলেন প্যালীর যুক্তির বাঙময়তায়, কিন্তু একই সাথে জীবনের বর্তমান রুপ কিভাবে পেল, সে সম্বন্ধে বিদ্যমান অপেক্ষাকৃত কম সম্মানজনক কিছু ধারণা সম্বন্ধেও তিনি কিছুটা জানতেন। এর কয়েকটি এসেছিল তার নিজের পরিবার থেকেই, তার দাদা ইরাসমাস ডারউইন, চার্লস জন্ম নেবার সাত বছর আগেই যিনি মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু এমনকি তার মৃত্যুতে তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। পেশায় চিকিৎসক ইরাসমাস একজন প্রকৃতিবিদও ছিলেন, এছাড়া ছিলেন একজন আবিষ্কারক, উদ্ভিদবিদ এবং বেশ জনপ্রিয় একজন কবি; তারই একটি কবিতায়, দ্য টেম্পল অব নেচার, এ তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বর্তমানে জীবিত সব প্রাণি এবং উদ্ভিদ বিবর্তিত হয়েছে আণুবীক্ষণীক রুপ থেকে:
Organic Life beneath the shoreless waves
Was born and nurs’d in Ocean’s pearly caves;
First forms minute, unseen by spheric glass,
Move on the mud, or pierce the watery mass;
Then as successive generations bloom,
New powers acquire and larger limbs assume.
((জৈব জীবন সীমাহীন ঢেউ এর নীচে জন্ম নিয়েছিল,
যা সাগরের মুক্তোখচিত গুহায় প্রতিপালিত হয়েছে;
খুবই ক্ষুদ্র প্রথম সেই রুপগুলো, আতশ কাচের নীচেও যারা অদৃশ্য;
কাদায় পাড়ি জমিয়েছিল বা ছিদ্র করেছিল পানির আবরণ;
এর পর এসেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর,
নতুন শক্তি অর্জন আর দীর্ঘাকার হাতপা ধারন করে))
তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর মতই ইরাসমাস ডারউইনের ব্যাক্তিগত জীবনও বেশ আলোচিত ছিল; তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর, বিবাহ বহির্ভুত দুটি সন্তানের পিতা হন; তার ছেলে রবার্টের কাছে তার বাবা খানিকটা বিব্রতকর একটি চরিত্র ছিলেন এবং দৌহিত্র চার্লস, শান্ত ভদ্র মাউন্টে বেড়ে ওঠার সময় তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানতে পারেননি। কিন্তু চার্লস ডারউইন যখন এডিনবরায় গিয়েছিলেন, যে শহরে সব ধরনের বৈপ্লবিক ধারণাগুলো তাদের অনুকুল পরিবেশ পেয়েছিল, সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন তারা পিতামহের অনেক ভক্ত আছে।

((ছবি: চার্লস ডারউইনের দাদা ইরাসমাস ডারউইন (Erasmus Darwin) (১৭৩১-১৮০২).. চার্লস ডারউইনের পিতামহ, তার জন্মের সাত বছর আগে তিনি মারা যান; ভীষন বর্ণিল চরিত্রের এই মানুষটিকে নিয়ে ডারউইনের বাবা রবার্ট ডারউইন বেশ বিব্রত ছিলেন সবসময়, আর ডারউইনও তার সম্বন্ধে তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণাও পাননি শৈশবে; কিন্তু এডিনবরাতে ডাক্তারী পড়ার সময় ডারউইন যখন পালাবার উপায় খুজছিলেন এই অপছন্দের বিষয় থেকে, তখন প্রকৃতি বিজ্ঞানে তাকে মেন্টরিং এর দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রাণী বিজ্ঞানী রবার্ট গ্রান্ট; গ্রান্ট ইরাসমাস ডারউইনকে শ্রদ্ধা করতেন, তার নানা লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন; তার কাছ থেকেই দাদার কথা শুনেছিলেন ডারউইন; ইরাসমাস ডারউইন পেশায় চিকিৎসক ছিলেন, কিন্তু তার আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল ব্যপক, তিনি ছিলেন দার্শনিক, কবি, প্রকৃতি বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, অনুবাদক, সমাজ সংস্কারক; তার কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ট্রান্সমিউটেশন বা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভবের তার নিজস্ব ধারনাগুলো, যা ল্যামার্ক এবং পরবর্তীতে ডারউইনের বিবর্তনের ধারনারই পুর্বসূরি; তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজটি ছিল Zoomania (১৭৯৪-১৭৯৬), চার্লস ডারউইন পরবর্তীতে বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন আরেকটু বড় পরিসরে; এই বইটিতে ইরাসমাস বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সারভাইভাল অব দ্য ফিটেষ্ট সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন; বইটিতে স্পষ্টভাবে তিনি এর আগের বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণার উৎস হিসাবে স্কটিশ দার্শনিক James Burnett এর লেখার কথাও উল্লেখ করেছিলেন; এছাড়া ক্যারোলাস লিনিয়াস এর লেখা তিনি ল্যাটিন থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন প্রায় সাত বছর ধরে; ইরাসমাস ডারউইনের কবিতার মূল বিষয় ছিল প্রকৃতি বিজ্ঞান ; তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি দীর্ঘ কবিতা দ্য টেম্পল অব নেচার প্রকাশিত হয়, সেখানে তিনি অণুজীব থেকে সভ্য সমাজের উদ্ভবের ব্যাপারে তার নিজস্ব ধারণাটি উল্লেখ করেছিলেন; এছাড়াও বিবর্তনের ধারণা নিয়ে তার আরো একটি দীর্ঘ কবিতা যেমন : The Loves of the Plants (১৭৮৯) ; ১৭৯১ সালে তার The Botanic Garden, A Poem in Two Parts: Part 1, The Economy of Vegetation এ বিগ ব্যাঙ সম্বন্ধে একটি কল্পনার কথা আছে, যে ধারনাটি মূলত দানা বেধেছিল উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীতে; নারী শিক্ষার সমর্থনকারী, দাস বাণিজ্য বিলুপ্ত করার স্বপক্ষে আন্দোলনকারী ইরাসমাস ডারউইন বেশ কিছু আবিষ্কারও করেছিলেন, তার ১৭৭৯ সালের নোটবুকে প্রথম হাইড্রোজেন অক্সিজেন মিশ্রনের গ্যাস চেম্বার সহ একটি সম্ভাব্য রকেট ইন্জিনের ধারনার কথা লিখেছিলেন; স্ট্যাফোর্ডশায়ারের লিচফিল্ডের বীকন স্ট্রীটে বিবর্তন তত্ত্ব এবং ডারউইনের পিতামহ হিসাবে পরিচিত ইরাসমাস ডারউইনের বাসাটি এখন তার সন্মানে একটি মিউজিয়াম।)
যাদের একজন ছিলেন রবার্ট গ্রান্ট, চিকিৎসক এবং প্রাণিবিজ্ঞানী যিনি ডারউইনের শিক্ষক ছিলেন; গ্রান্ট স্পন্জ কিংবা সি পেন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন কোনো অলস কৌতুহল থেকে না, বরং তিনি ভাবতেন তারা জীবজগতের একেবারে শিকড়ের দিকে অবস্থান করছে, তাদের মত প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে উদ্ভব হয়েছে পৃথিবীর সকল প্রানী; যখন গ্রান্ট এবং ডারউইন সমুদ্র পারের ‘টাইড পুল’ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে যেতেন, গ্রান্ট তার তরুন শিষ্য ডারউইনকে ব্যাখ্যা করতেন কেন তিনি ইরাসমাস ডারউইন ও তার ট্রান্সমিউটেশন বা প্রজাতির বিবর্তনের বা যে প্রক্রিয়ায় এক প্রজাতির প্রানী অন্য প্রজাতির প্রানীতে রুপান্তরিত হয় এমন ধারণার ভক্ত ছিলেন। এছাড়া গ্রান্ট ইরাসমাসের দৌহিত্রকে ফরাসী প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের কথা বলতেন, যারা ভাববার সাহস পেয়েছিল, যে জীবন অপরিবর্তনশীল না হবার সম্ভাবনা আছে, জীবন বিবর্তিত হয়েছে।
গ্রান্ট প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে কুভিয়ের এর একজন সহকর্মীর কথা বলেছিলেন, যার নাম জাঁ ব্যাপ্টিস্ট পিয়ের আন্তোয়ান দ্য মনেট, শেভালিয়ার দ্য লামার্ক; ১৮০০ সালে লামার্ক, কুভিয়ের এবং পুরো ইউরোপকে চমকে দিয়েছিলেন প্রস্তাব করেন যে, প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতার ধারণাটি একটি বিভ্রম মাত্র, সময়ের সুচনায় প্রজাতিরা আদৌ তাদের বর্তমান রুপে সৃষ্ট হয়নি; পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস জুড়ে, স্বতঃস্ফুর্ত সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রজাতির জন্ম হয়েছে ‘নার্ভাস ফ্লুইড’ সহ যা তাদের ধীরে ধীরে রুপান্তরিত করেছে, প্রজন্মান্তরে নতুন রুপে, অন্য প্রজাতিতে। প্রজাতি যখন রুপান্তরিত হয়, তারা ধীরে ধীরে আরো বেশী জটিল হতে থাকে; এই নিরন্তর প্রজাতির আবির্ভাব এবং তাদের ক্রমশ চলমান রুপান্তর প্রক্রিয়া জীবনের মহান সেই চেইন বা শৃঙ্খলটি সৃষ্টি করে: এই শৃঙ্খলের নীম্ন স্তরের সদস্যরা শুধুমাত্র তাদের উচু স্তরের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল উচ্চশ্রেণীর সদস্যদের থেকে বিলম্বে।

(ছবি: পরিচিত ছিলেন লামার্ক নামে, Jean-Baptiste Pierre Antoine de Monet, Chevalier de Lamarck (1744 – 1829); ফরাসী এই প্রকৃতি বিজ্ঞানী প্রাকৃতিক নিয়মে বিবর্তন হয়েছে এমন ধারণার প্রথম দিককার একজন প্রস্তাবক ছিলেন।)
জীবন পরিবর্তিত হতে পারে অন্য আরেকটি উপায়ে, লামার্ক দাবী করেন: একটি প্রজাতি তার নিজের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, জিরাফ, যেমন, এমন একটি জায়গায় বাস করে সেখানে তাদের খাদ্য, গাছের পাতার অবস্থান মাটি থেকে বেশ উপরে; বর্তমান জীরাফদের আদি পুর্বসূরীদের হয়তো খাটো ঘাড় ছিল, যারা তাদের ঘাড় উচু করে পাতা খাবার চেষ্টা করতো; আর যত বেশী একটি জিরাফ এমন ঘাড় টান টান করেছে পাতা খাবার জন্য, তার সেই ‘নার্ভাস ফ্লুইড’ ঘাড়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে, এবং ফলাফলে তার ঘাড়টিও লম্বা হতে থাকে, এবং যখন এটি বাচ্চা জিরাফের জন্ম দেয়, এটিও তার লম্বা ঘাড়ের বৈশিষ্ট্যও তার মধ্যে হস্তান্তর করে। ল্যামার্ক প্রস্তাব করেন মানুষও হয়তো কোন নরবানর বা এইপদের থেকে বিবর্তিত হয়েছিল, যারা সোজা হয়ে দাড়িয়ে সমতলের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল গাছ থেকে নেমে, দুই পায়ে হাটার সেই প্রচেষ্টাটি ধীরে ধীরে তাদের শরীরের কাঠামোটাকে বদলে দিয়েছিল আমাদের মত করে।

ছবি: লামার্ক প্রস্তাব করেছিলেন সদস্যরা তাদের জীবনে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, যে বৈশিষ্ট্যগুলো তারা অর্জন করে সেটি তাদের উত্তরসূরিদের হস্তান্তরিত করে।)
ফ্রান্স এবং প্রবাসে বেশীর ভাগ প্রকৃতিবিদরা ল্যামার্কের ধারণায় আৎকে উঠেছিলেন বিতৃষ্ণায়। আক্রমনের নেতৃত্বে ছিলেন কুভিয়ের, যিনি ল্যামার্ককে তার ধারণার স্বপক্ষে প্রমাণ দেবার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন; যে ‘নার্ভাস ফ্লুইড’ যা কিনা বিবর্তনকে সম্ভব করছে, হচ্ছে সম্পুর্ণ কাল্পনিক একটি ধারণা, এবং কোনো জীবাশ্ম রেকর্ড তাকে এ বিষয়ে সহায়তা করবে না; যদি ল্যামার্ক সঠিক হন.. তাহলে সবচেয়ে প্রাচীনতম জীবাশ্মকে অবশ্যই অপেক্ষাকৃত অনেক কম জটিলতর হতে হবে বর্তমানে জীবিত প্রজাতির তুলনায়; কারণ আর যাই হোক তারা তো অনেক কম সময় পেয়েছে তাদর সাংগঠনিক জটিলতা বাড়ানোর এই ধারাবাহিকতায়; কিন্তু তাসত্ত্বে ১৮০০ র সেই সময়ে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন জীবাশ্মও বর্তমানে জীবিত প্রানীদের মতই জটিলতা প্রদর্শন করেছিল; কুভিয়ের আরো একটা সুযোগ পেলেন ল্যামার্ককে আক্রমন করার জন্য, যখন নেপোলিয়নের সৈন্যরা মিসরে প্রবেশ করে এবং ফারাওদের কবরে সমাহিত করা মমিকৃত নানা প্রানীদের আবিষ্কার করা হয়; সেখানে পাওয়া পবিত্র আইবিস এর কংকাল, যা বহু হাজার বছর পুরোনো, সেটি মিসরে বর্তমানে পাওয়া আইবিসের মতই দেখতে।
গ্রেট বৃটেনের বেশীর ভাগ প্রকৃতিবিদ, মজে ছিলেন প্যালির প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বে, এবং তারা কুভিয়ের এর চেয়ে আরো বেশী বিতৃষ্ণা প্রকাশ করছিলেন লামার্কের প্রস্তাবের প্রতি। কারণ লামার্ক মানুষকে একবারে প্রকৃতির বাকী সদস্যদের স্তরে নামিয়ে দিয়েছিলেন, অনিয়ন্ত্রিত কোনো নির্দেশনাহীন জাগতিক শক্তির সৃষ্ট একটি সৃষ্টি হিসাবে; অল্প কিছু মূলধারার বীপরিত বিজ্ঞানী, যেমন গ্রান্ট, ল্যামার্ক এবং তার বিবর্তনের ধারণাকে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন, এবং এই বিরুদ্ধাচারণের কারনেই তারা বৃটেনের বিজ্ঞানীদের মূল বলয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
লামার্কের প্রতি গ্রান্টের বিশেষ প্রশংসা বেশ অবাক করেছিলে তরুণ ডারউইনকে, ‘তিনি একদিন, আমরা যখন একসাথে হাটছিলাম, হঠাৎ করেই লামার্ক ও বিবর্তন সংক্রান্ত তার ধারণার প্রতি উচ্ছসিত প্রশংসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন’। পরে ডারউইন তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন; ‘আমি নীরব বিস্ময়ে তার কথা শুনেছিলাম, যতদুর আমি মনে করতে পারি, আমার মনে সে বিষয়ে কোনো রেখাপাত করা ছাড়াই’।

ছবি: শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের Biological Sciences Learning Center (BSLC) ভবনের লবিতে ডারউইনের এই ভাষ্কর্যটি দান করেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তারকা ছাত্র, জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিক ক্রিকের সাথে যিনি ডিএনএ কাঠামোটি আবিষ্কার করেছিলেন।)
এর চার বছর পর যখন ডারউইন বিগল জাহাজে ওঠার করার জন্য প্লীমথ বন্দরে আসেন, তার সমুদ্র যাত্রা শুরু করতে, বিবর্তনবিষয়টির উপস্থিতি তার চিন্তায় আদৌ ছিল না। শুধুমাত্র সমুদ্র যাত্রা থেকে তার ফিরে আসার পর, বিষয়টি তার চিন্তার স্তরে উঠে এসেছিল সম্পুর্ণ ভিন্ন আর বৈপ্লবিক একটি রুপ নিয়ে।



(ছবি: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের সান ক্রিস্টোবাল দ্বীপে ( ইকুয়েডর) তিহেরেতা কোভ এর উপর চার্লস ডারউইনের স্মারক ভাস্কর্য, এখানে প্রথম নেমেছিলেন তিনি ১৮৩৫ সালে)

একজন ভূতাত্ত্বিকের আত্মপ্রকাশ
বিগলের সমুদ্রযাত্রার শুরুটা ভালোভাবে হয়নি। ১৮৩১ এর অক্টোবরে প্লীমথ বন্দরে এসেছিলেন ডারউইন জাহাজে চড়তে, কিন্তু বেশ কিছু সংস্কার, মেরামত, কয়েকবার যাত্রা শুরুর প্রচেষ্টার পর অবশেষে ডিসেম্বর মাসের সাত তারিখের আগে বিগলের তার পাল খুলে দেয় তার ঐতিহাসিক সমুদ্র যাত্রায়। বন্দর ছাড়ার পর পরই ডারউইন সি সিকনেসে কাবু হয়ে পড়েন, যা কিছু খাচ্ছিলেন , সবই তাকেই জাহাজের রেলিং এর উপর থেকে সমূদ্রে উগরে দিতে হয়েছে; যদিও ডারউইন পাঁচ বছর এই জাহাজেই ছিলেন, তারপরও সমুদ্রযাত্রায় পুরোপুরি ভাবে অভ্যস্ত হতে পারেননি কখনোই।
খুব তাড়াতাড়ি ডারউইন আবিষ্কার করলেন, ফিটজরয়কে সঙ্গ দেবার ব্যাপারটা খুব সহজ কাজ না, বিষয়টি বেশ কৌশলেরই মনে হয়েছে তার; ক্যাপ্টেন এর মেজাজ খুব রগচটা, এবং আগে থেকে তা আচ করার কোনো উপায় নেই এবং তার অতিমাত্রায় শৃঙ্ক্ষলা আর কঠোরতা ডারউইনকে হতবাক করেছিল; যেমন, ক্রিসমাসের দিন কয়েকজন নাবিক মাতাল হয়েছিল, ফিটজরয় তাদের পরেরদিন সকালে চাবুক দিয়ে তাদের পেটানোর নির্দেশ দেন; প্রতিদিন ফিটজরয় এর সাথে সকালের খাবার খেয়ে বের হলে, জুনিয়র অফিসাররা তার কাছে জানতে চাইতো, ‘আজ কি বেশী কফি কাপ থেকে ছিটকে পড়েছে?’ এটি ছিল ক্যাপ্টেন এর মেজাজের অবস্থা বোঝার জন্য তাদের সাংকেতিক বার্তা; কিন্তু ডারউইন ফিটজয়ের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, তার কর্মস্পৃহা, বিজ্ঞানের প্রতি তার আন্তরিকতা, এবং খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিষ্ঠাকেও শ্রদ্ধা করতেন; প্রতি রবিবার ক্যাপ্টেনের বক্তৃতার সময় তিনি উপস্থিত থাকতেন।
ডারউইন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন, কখন জাহাজের কোনো বন্দরে ভিড়বে, তিনি শুকনো মাটিতে পা রাখবেন; কিন্তু বহু সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাকে সেটি করার জন্য। ম্যাদেইরাতে স্রোতের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে ফিটজরয় সেখানে জাহাজ নোঙ্গর না করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং এর পরের বন্দর, ক্যানারী দ্বীপে, কলেরা মহামারীর জন্য জাহাজ ভিড়িয়ে কোয়রানটাইনে আটকে থাকার জন্য আদৌ রাজী হলেন না ফিটজরয়।
বহুদিন পর প্রথম বারের মত বিগল এসে থামলো কেপ ভারদে দীপপুঞ্জে। সেইন্ট ইয়াগোতে (এখন যার নাম সান্টিয়াগো) ডারইউইন জাহাজ থেকে নামলেন, নারিকেল গাছের নীচে ইতস্তত ঘোরাফেরা, পাথর, গাছ আর প্রাণিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন; এখানে তিনি একটি অক্টোপাস খুজে পেয়েছিলেন যে তার রঙ বদলাতে পারে, বেগুনী থেকে ফরাসী ধুসর রঙ; এবং যখন তিনি এটি একটি কাচের জারে ভরে জাহাজের হোল্ডে রাখেন, তখন এটি অন্ধকারে আলোর আভা ছড়াচ্ছিল। কিন্তু দ্বীপের ভূতাত্ত্বিক গঠন, সেটাই ডারউইন বেশী করে দেখতে চাইছিলেন।
ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু হবার পর থেকেই ডারউইন পুরোপুরি মজে ছিলেন চার্লস লাইয়েল নামের একজন ইংলিশ আইনজীবির লেখা একটি নতুন বইয়ে, বইটির নাম Principles of Geology; এই বইটি ডারউইনের এই গ্রহ সম্বন্ধে এতদিনের ভাবনাটি চিরতরে বদলে দেয়, এবং একসময় যা চুড়ান্ত পরিণতি লাভ করে তার বিবর্তন তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করার মধ্যে। লাইয়েল মহাদুর্যোগ বা ক্যাটাস্ট্রোফি কেন্দ্রিক ভূতত্ত্ববিদ্যাকে আক্রমন করেন, যা সেই সময় জনপ্রিয় ছিল, তিনি নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করেছিল হাটনের ৫০ বছর পুরোনো সমানভাবে পরিবর্তিত পৃথিবীর তত্ত্বটিকে।

(ছবি: চার্লস লাইয়েল (Charles Lyell: 1797 – 1875) পেশায় আইনজীবি লাইয়েল তার সময়ে একজন সেরা ভূতত্ত্ববিদ ছিলেন; জীববিজ্ঞানে গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কারটির আগে ডারউইন তার সুখ্যাতি পান ভূতত্ত্ববিদ হিসাবে; চার্লস লাইলের Principles of Geology বেশ প্রভাব ফেলেছিল ডারউইনের উপর, চার্লস লাইয়েল পরবর্তীতে ডারউইনের একজন বিশ্বস্ত এবং প্রভাবশালী সুহৃদ ছিলেন আমৃত্যু।)
Principles of Geology শুধু হাটনের সেই ধারণাটির নতুন করে জাগিয়ে তোলায় মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, লাইয়েল আরো বৈজ্ঞানিকভাবে বিস্তারিত, সমৃদ্ধ একটি দৃশ্য রচনা করেন, কেমন করে যে পরিবর্তনগুলোর স্বাক্ষী হতে পারে মানুষ, সেগুলো ধীরে ধীরে এই গ্রহের আকৃতি দিয়েছে; তিনি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে দ্বীপ সৃষ্টি বা কিভাবে ভুমিকম্প কোনো একটি ভূত্বকের অংশ উপরে ঠেলে উঠিয়ে দেয় ইত্যাদি বাস্তব উদহারণ দিয়েছিলেন; এর পর তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ক্ষয়ীভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রকাশ্যে উন্মোচিত এই ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যগুলো আবারো মিশে যায়; ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছে ধীরে, আমাদের বোধের আড়ালে, লাইয়েল যুক্তি দেন, এমন কি আমাদের মানব ইতিহাসের সময় জুড়েও।

ছবি: চার খণ্ডের PRINCIPLES OF GEOLOGY, প্রথম সংস্করণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি ডারউইনকে প্রভাবিত করেছিল)
Principles of Geology বইটির একটি মূল ছবি ছিল ইতালীতে অবস্থিত প্রাচীন সেরাপিসের রোমান মন্দিরের একটি রেখাচিত্র; যেখানে এর পিলারগুলোর উপরের প্রান্ত দাগাঙ্কিত ছিল গাঢ় নীল মোটা একটি ব্যান্ডের মত দাগ দিয়ে, যার কারণ হচ্ছে মোলাস্ক জাতীয় প্রাণিরা, যারা কোনো একসময় এখানে ছিদ্র করেছিল; এই মন্দিরটি এর জীবদ্দশায় পুরোপুরিভাবে নিমজ্জিত হয়েছিল পানির নীচে এবং পরে আবার সমুদ্র থেকে এটি উপরে উঠে এসেছিল; হাটনের ব্যতিক্রম, লাইয়েল পৃথিবী সৃষ্টি আর ধ্বংসের একটি নিরন্তর বিশ্বব্যাপী কোনো চক্রের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে এমনটি ভাবেননি; বরং গ্রহটি পরিবর্তিত হয়েছে স্থানীয়ভাবে, কোথাও ক্ষয়, কোথাও আবার উদগীরনের মাধ্যমে জেগে উঠেছে, একটি নিরন্তর, নির্দেশনাহীন প্রবাহে, অকল্পনীয় দীর্ঘ একটি সময়ের পরিক্রমায়।

ছবি: ইতালীর সেরাপিস এর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ; এর কলামগুলোর উপরের অংশে নীলচে দাগগুলো করেছে সামুদ্রিক মোলাস্করা, চার্লস লাইয়েল তার বইতে এই বিষয়টি উল্লেখ করে দাবী করেন, পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে, কোনো একসময় এটি পানিতে নিমজ্জিত ছিল, পরে এটি আবারো পানির উপরে উঠে আসে ভূত্বকের পরিবর্তনের কারণে)
প্রিন্সিপল অব জিওলজী বইটি ডারউইনকে ভীষণ মুগ্ধ করেছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই বইটি পৃথিবী ইতিহাসের শুধু একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাই দেয়নি, উপরন্তু একটি সুযোগ করে দিয়েছে এটিকে বাস্তব পৃথিবীতে পরীক্ষা করে দেখার জন্য; যখন তিনি সেন্ট ইয়াগো তে এসে নামেন, ঠিক সেটাই করার জন্য তার সুযোগটি এসেছিল; দ্বীপের আগ্নেয় শিলার স্তর ঘেটে ঘুটে, তিনি প্রমান পেয়েছিলেন লাভা আসলে পানির নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছে, প্রবাল এবং মোলাস্কদের শেল বা খোলশ পুড়িয়ে এটি অগ্রসর হয়েছে, বের হয়েছে পৃষ্ঠে; পৃথিবীর ভিতরে কোনো শক্তি নিশ্চয়ই এই পাথরগুলোকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে ঠেলে উঠিয়ে দিয়েছে; কিন্তু তারা অবশ্যই আবার পানিতে নিমজ্জিতও হয়েছে এবং আবার এটিকে উপরে তুলে দিয়েছে; আর ডারউইন বুঝতে পারলেন, কিছু এই ওঠা নামার ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক কোনো সময়েই; কারণ পাহাড়ের ঢালে একটি ব্যান্ডে তিনি কিছু সামুদ্রিক প্রাণির খোলশ বা শেল এর জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছিলেন, যা সেই দ্বীপে এখন বসবাস করছে এমন প্রজাতিদের সদৃশ; তাহলে পৃথিবী এমনকি পরিবর্তিত হচ্ছে ১৮৩২ সালে, যেমনটা হয়েছে বহু বহু যুগ ধরে..
ডারউইন তার আত্মজীবনীতে পরে লিখেছিলেন, ‘মূলত সেন্ট ইয়াগো, কেপ ভার্দে দ্বীপপুন্জের প্রথম যে জায়গাটাকেই আমি পরীক্ষা করেছিলাম, সেটি স্পষ্ট এবং চমৎকারভাবে আমাকে প্রমাণ করে দিয়েছে অন্য যে কোনো লেখকের তুলনায় লাইয়েল এর ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনা এবং তার প্রস্তাবগুলোর তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বকে, যাদের অনেকের কাজ আমার কাছে ছিল, বা এমন কি পরে আমি যা পড়েছিলাম’। তিনি লাইয়েল পদ্ধতি ব্যবহার করার চেষ্টা করেন, এবং সেটি চমৎকারভাবে কাজ করেছিল; আর সেই মুহূর্তে ডারউইনই রুপান্তরিত হয়েছিলেন একজন লাইয়েলিয়ান হিসাবে।
নিরাপত্তাহীনতার একটি অদ্ভুত অনুভূতি
১৮৩২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে বিগল দক্ষিণ আমেরিকায় পৌছায়; ফিটজরয় তিন মাসের জন্য জাহাজটি রিও ডি জেনেরিও তে নোঙর করে রাখেন, এরপর যাত্রা শুরু করেন দক্ষিন আমেরিকার উপকুল ধরে যা স্থায়ী হয়েছিল পরবর্তী তিন বছর; এই সময়টার বেশীর ভাগ অংশই ডারউইন কাটিয়েছিলেন মূলত স্থলে, ব্রাজিলে থাকার সময়, জঙ্গলের মধ্যে একটি কটেজে থাকতেন ডারউইন, চারপাশে বিস্তৃত বিশাল জৈববৈজ্ঞানিক ইডেন তাকে অভিভুত করে রেখেছিল, পাতাগোনিয়ায় তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে মাঝে মাঝে কয়েক সপ্তাহের জন্য আরো গভীরে চলে যেতেন মহাদেশের, এবং বিগলের পরের পর্যায়ে যাত্রা শুরু হবার আগে সবসময়ই ফিরে এসেছেন সময় মতন; যা কিছু তিনি দেখেছিলেন, সব কিছুই তার নোটবুকে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, নদী, পর্বতমালা, ক্রীতদাস, খামারীদের; তার খালি কাচের নমুনা রাখার পাত্রগুলো ক্রমেই পুর্ণ হতে থাকে বিচিত্র সব নমুনায়।
আর্জেন্টিনার উপকুলে পুন্টা আল্টায় এরকম একটা অভিযানে, ডারউইন একটি ছোট টিলা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তার একপাশে কিছু জীবাশ্ম হাড় খুজে পান; বালি আর পাথর থেকে তাদের আলাদা করার , ডারউইন দেখেন সেগুলো আসলে বিশাল দাঁত আর উরুর হাড়, যা বিলুপ্ত বিশালাকৃতির কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণির শরীরে ছিল; পরপর কয়েকদিন তিনি আবার সেখানে ফিরে জায়গাটা ভালোভাবে খণন করেন, সেই সময় পর্যন্ত, পুরো ইংল্যান্ডে সংগ্রহে মাত্র একটি বিলুপ্ত স্তন্যপায়ীর প্রাণীর জীবাশ্মের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু পুন্টা আল্টাতে তিনি বেশ কয়েক টন জীবাশ্ম অস্থি খুজে পান; তখনও তিনি জানতেন না এগুলোর কি অর্থ হতে পারে, তবে তার অনুমান ছিল সেগুলো খুব সম্ভবত বিশালাকৃতির গন্ডার বা স্লথদের; কিন্তু তখনও পর্যন্ত ডারউইন কিন্তু শুধু একজন সংগ্রাহক; তিনি শুধু জীবাশ্মগুলো সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
এই জীবাশ্মগুলোর মধ্যে একটা ধাঁধাঁ ছিল, এই সমুদ্রযাত্রায় ডারউইনের মনে জন্ম দেয়া অনেকগুলো ধাঁধাঁর প্রথমটি; কুভিয়ের এর একনিষ্ঠ ছাত্র হিসাবে, ডারউইন ধরে নিয়ে ছিলেন এগুলো অ্যান্টেডিল্যুভিয়ান পর্বের ( বাইবেলে বর্ণিত জেনেসিস বা সৃষ্টি এবং মহাপ্লাবনের পূর্ববর্তী সময়কাল, শব্দটি ভিক্টোরিয়ার যুগের বিজ্ঞান এবং আদি ভূতত্ত্ববিদ্যায় প্রবেশ করেছিল) কোনো দানবাকৃতির প্রজাতির চিহ্ন; কিন্তু তাদের হাড়গুলোর সাথে মিশে ছিল সামুদ্রিক প্রাণিদের জীবাশ্ম খোলশদের সাথে, যারা প্রায় হুবুহু আর্জেন্টিনার উপকুলে তখনও জীবিত প্রজাতিদের মত; এই পাথরগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে এই দানবাকৃতির প্রাণিগুলো যতটা প্রাচীন বলে মনে হচ্ছে, ততটা প্রাচীন নয় অবশ্যই;
ডিসেম্বর, ১৮৩২ এ বিগল তিয়েরা দেল ফুয়েগোর চারপাশে তার প্রদক্ষিণ শেষ করে, ফিটজরয়ের জন্য এই মিশনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা হবার কথা ছিল; কারণ তিনি এর আগে তার বন্দী করা নিয়ে যাওয়া তিন আদিবাসীদের তাদের গোত্রে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য সভ্যতার পরিবর্তন করার শক্তি প্রদর্শন করা; কিন্তু টিয়েরা ডেল ফুয়েগো তাকে আবার পরাজিত করে; ওলইয়া বে তে একটা মিশন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন ফিটজরয়, তিনি তিনটি উইগওয়াম (আমেরিকার আদীবাসীদের বানানো তাবুর মত ঘর) আর দুটি বাগান তৈরী করেন মিশনের জন্য; মিশনের জন্য লন্ডন থেকে নিয়ে আসা নানা দান করা জিনিস: পান করার পাত্র, চায়ের ট্রে, সুপ বানানোর টুরিন, সাদা কাপড় দিয়ে সেগুলো সাজান; কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পার যখন বিগল আবার সেখানে পরিদর্শন করতে আসে, মিশনারীদের প্রাণ ভয়ে দৌড়ে জাহাজের দিকে আসতে দেখেন তিনি; ফুয়েগাবাসীরা মিশনের সবকিছু চুরি করে ধ্বংস করে দিয়েছে জাহাজের ফিরে আসার সময় ফুয়েগাবাসীরা যাজকের দাড়ী ঝিনুকের খোলশ দিয়ে কেটে কেটে মজা করছিল তখন।

ছবি: তিয়েরা দেল ফুয়েগোতে বিগল, কনরাড মার্টেনস এর আঁকা, যিনি বিগলে শিল্পী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ১৮৩৩ এ)
মনক্ষুন্ন বিষন্ন ফিটজরয় কেপ হর্ণ অতিক্রম করে দক্ষিন আমেরিকার পশ্চিম উপকুল বরাবর যাত্রা শুরু করেন; ডারউইন এই সুযোগে আন্দিজ পর্বতমালায় আরোহন করেছিলেন, লাইয়েল এর কথা ভেবে, তিনি কল্পনা করার চেষ্টা করেন এর উচু শৃঙ্গগুলোর সমুদ্রের মধ্য থেকে উপরে উঠে আসার সেই দৃশ্যটি; ভালপারাইসোতে তিনি বিগলে উঠেন আবার এর উত্তর অভিমুখে যাত্রায়; পূর্বদিকে মাউন্ট ওসোরনোকে রেখে, এর নিখুঁত কোণের মতো চুড়া; নাবিকরা যখন বৃষ্টির মধ্যে ঘড়ি ঠিক করছিলে তারা মাঝে মাঝে দেখছিলেন দেখছিলেন এর চুড়া থেকে ধোয়ার কুন্ডলী বের হবার দৃশ্য; জানুয়ারী এক রাতে ওসোরনো বিস্ফোরিত হয়েছিল অগ্ন্যুৎপাতে; পাথরের বিশাল টুকরো আর আগুনের শিখা ছড়িয়ে, এমনকি লাইয়েল নিজেও কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত কখনো দেখেননি।
এই প্রচন্ড দুর্যোগে পৃথিবী শেষ হয়ে যায়নি, যদিও; ভালডিভিয়া শহরে বিগল নোঙ্গর করে কয়েক সপ্তাহ পর, এবং ২০ ফেব্রুয়ারী ১৮৩৫ এ, সমস্ত পৃথিবী কেপে উঠে ডারউইনের চোখের সামনে, তখন কাছাকাছি একটি জঙ্গলে তিনি হাটছিলেন, হঠাৎ করে ঠিক করেন একটু বিশ্রাম নেবেন, আর যখন তিনি মাটিতে শুয়ে পড়েছিলেন, মাটিকে অনঢ় আর শক্ত মনে হচ্ছিল, কিন্তু কিছুক্ষন পর এটি কেপে ওঠে: ‘খুবই হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটেছিল এবং মাত্র দুই মিনিট স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু মনে হয়েছিল যেন এর স্থায়ীত্ব ছিল আরো দীর্ঘ সময়’, পরে ডারউইন লিখেছিলেন। ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে শান্ত ইংল্যান্ডে অভ্যস্ত ডারউইন এর কখনই ভুমিকম্প দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি, ‘সোজা হয়ে দাড়ানোর জন্য কোন সমস্যা ছিল না, তবে এই কম্পন আমাকে খানিকটা ভারসাম্যহীন করে ফেলেছিল; এটা অনেকটা কোনো বীপরিত দিকে আসা ঢেউ এর সাথে জাহাজের নড়াচড়ার মত, বা আরো বলা যেতে পারে পাতলা বরফের উপর কেউ স্কেট করার সময় যেমন অনুভুতি হয়, যখন মনে হয় শরীরের ভারে তা ডেবে যাচ্ছে’। বাতাসে গাছে নড়ে উঠেছিল, ভূ কম্পন শেষ হয়ে যায়; এই অভিজ্ঞতা তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি. ‘একটি ভয়ঙ্কর ভুমিকম্প এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দেয় পৃথিবী সব প্রাচীনতম সম্পর্ককে : এই পৃথিবী, যা কিছু দৃঢ় এমন সব কিছুর প্রতীক নড়ে উঠে আমাদের পায়ের নীচে, যেন তরলের উপর ভাসা কোনো স্তরের মত; সময়ের মাত্র একটা সেকেন্ডে তা আমাদের মনে জানান দিয়ে যায় নিরাপত্তাহীনতার একটি অদ্ভুত অনুভূতি, যা বহু ঘন্টার গভীর চিন্তা হয়তো কখনো সৃষ্টি করতে পারেনা’।

(ছবি: বিগলে লেখা ডারউইনের ১৪ টি অমূল্য নোটবুক)

(ছবি: ডারউইনের নোটবুক)
ভুমিকম্প শেষ হবার পর, ডারউইন দ্রুত শহরে ফিরে আসেন, যা মোটামুটি অক্ষতই ছিল, কিন্তু কিছুটা দূরে কনসেপসিয়ন শহরটি পুরোপুরি ইট, কাঠের স্তুপে পরিণত হয়; শুধু ভূমিকম্প না এর ফলে সৃষ্ট সুনামীও আঘাত হেনেছিল, শহরের মুখের ক্যাথিড্রালটি ভেঙ্গে যায়, যেন কেউ ছেনী দিয়ে দালানগুলো ভেঙ্গেছে, ‘খুব তিক্ত আর অপমানজনক একটি ব্যাপার, যখন দেখতে হয়, যা কিছু তৈরী করতে মানুষের এত কষ্ট আর সময় ব্যয় হয়েছে, তা এক মিনিটের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে’। মাটিতে দীর্ঘ ফাটল ধরেছে, পাথর দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, দুই মিনিটে, ভুমিকম্প অনেক বেশী ক্ষতি করেছে। ডারউইন অনুমান করতে পারলেন, এক শতাব্দীর সাধারণ ভাঙ্গাগড়া আর ক্ষয় যা করতে পারে।
ভুমিকম্প এর উপকুল রেখা বরাবর আরো ব্যপক কিছু পরিবর্তন করেছিল, ভেঙ্গে পড়া সব বাড়ী ঘর বা ডুবে যাওয়া গবাদী পশুর ধ্বংসাবশেষ দেখে আমরা যত অনায়াসে বুঝতে পারি তার চেয়ে এই পরিবর্তনগুলো বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য; অনেক জায়গা আগে কিনা যা পানির নীচে ছিল, এখন সেটি পানির উপরে উঠে উঠেছে, যা উপরে আবরণ করে আছে মরে যেতে থাকা সামুদ্রিক শেলফিশ দিয়ে; ফিটজরয় তার সার্ভে করার যন্ত্র দিয়ে পরিমাপ করে দেখিয়েছিলেন, উপকুলের কিছু অংশ ভুমিকম্পের সময় প্রায় আট ফুট ‍উপরে উঠে গেছে; দুমাস পরে আবার যখন তিনি কনসেপসিওনে ফিরে আসেন, তখনও দেখেছিলেন মাটি উপরে উঠে আছে ।

(ছবি: ডারউইন যখন ভূতাত্ত্বিক)
ডারউইন বুঝতে পারলেন যে, তিনি যা চাক্ষুষ দেখছেন তার ব্যাখ্যা তাকে লাইয়েল ইতিমধ্যেই দিয়েছেন; গলিত পাথরের চাপ নিশ্চয়ই ওসারনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণ, যা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল একটি ভূমিকম্পের সূচনা করার মত। নতুন গলিত লাভার এই বের হয়ে আসাটা সমুদ্র থেকে নতুন ভূমির সৃষ্টি করেছে; এবং যথেষ্ট পরিমান সময়ের ব্যবধানে এটি পুরো একটি পর্বতমালাকে অনেক উপরের দিকে তুলে দিতে পারে। এর কিছুদিন পর ডারউইন তার সবচেয়ে শেষ বড় কোনো অভিযানে মহাদেশের ভিতরে যান, আন্দীজ পর্বতমালার ভিতরে আবারো; পর্বতের চুড়ায় যা উসপালাটা গিরিপথকে ঘিরে ছিল, ডারউইন সেখানে একই পাথরের স্তরকে শনাক্ত করেন যা তিনি কয়েকমাস আগে আরো পূর্বে সমতল এলাকায় দেখেছিলেন, যে পাথরগুলেো মূলত সৃষ্টি হয়েছে সাগরের সেডিমেন্ট বা পলি জমা হবার মাধ্যমে। তিনি একটি প্রস্তরীভুত হওয়া একটি বনাঞ্চল যা এখন দাড়িয়ে আছে ঋজু হয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন, পাতাগোনিয়ায় তার খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মগুলোর মত. ‘এই গাছগুলো’, তিনি তার বোন সুসানকে লিখেছিলেন, ‘ঢেকে ছিল অন্য বালি, পাথর এবং গলিত লাভার স্তরের নীচে যার পুরুত্ব কয়েক হাজার ফুট; এই পাথরগুলো জমা হয়েছে পানির নীচে, অথচ স্পষ্ট যে জায়গাগুলোয় এই গাছগুলো বেড়ে উঠেছিল সেটি ছিল সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে , সুতরাং এটা নিশ্চিৎ এই ভুমি নিশ্চয়ই সেরকমই কয়েক হাজার ফুট পানির নীচে ছিল কোনো একসময়, যেকারণে এর উপর জমা পাথরের স্তর এত পুরু’।

(ছবি: Darwin in the Galapagos Islands, শিল্পী John Harrold এর আঁকা)
স্মৃতিতে সাম্প্রতিক ভুমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনার অভিজ্ঞতাসহ, ডারউইনের উপসংহার ছিল আন্দিজ পর্বতমালা অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কোনো সময়ের সৃষ্টি, কোনো এক সময় এই ১৪,০০০ ফুট উচু চুড়া পুর্ব দিকের পাম্পাস এর মতই সমতল ছিল, যেখানে দানবাকৃতির স্তন্যপায়ীদের তিনি খুজে পেয়েছিলেন, তারা একসময় এখানেও বাস করতো, এবং তারপর এই জায়গাটা পানির নীচে ডুবে যায় এবং আবার পানির উপরে উঠে আসে, এর এর নীচের প্রবল শক্তি এটিকে এত উপরে ঠেলে দেয়; ডারউইন বুঝতে পারেন এই পর্বতমালা হয়তো স্তন্যপায়ীদের চেয়েও কম প্রাচীন, হয়তো এখনও তার পায়ের নীচে এটি আরো উচু হচ্ছে।


     



(ছবি: গালাপাগোসে পুয়ের্তো আয়োরাতে চার্লস ডারউইন রিসার্চ সেন্টারে ডারউইনের একটি ভাস্কর্য ( ক্লোস আপ), এর শিল্পী ইকুয়েডরে প্যাট্রিসিও রুয়ালেস)

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রয়োজনীয় জরিপ শেষ করার পর বিগল উত্তরে প্রথমে লিমায় (পেরু) এবং এরপর পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করে, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে পেছনে ফেলে; টিয়েরা দেল ফুয়েগো প্রবল বাতাস আর আন্দিজের তীব্র ঠাণ্ডার পর, ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণতার জন্য ডারউইন অধীর আ্গ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন; সেখানে যাবার পথে তার প্রথম যাত্রা বিরতি হয়েছিল একটি অদ্ভুত দ্বীপপুন্জে : যার নাম গালাপাগোস।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সূতিকাগার হিসাবে গালাপোগোস দ্বীপপুন্জের খ্যাতি আছে, কিন্তু এর গুরুত্বটা ডারউইন বুঝতে পেরেছিলেন ইংল্যাণ্ডে ফেরার প্রায় দুই বছর পর; তিনি যখন গালাপোগোসে প্রথম পা রাখেন, তার চিন্তায় ছিল মূলত জীববিজ্ঞান নয়, বরং প্রাধান্য ছিল ভূতত্ত্ব বিষয়ক তার কৌতুহলগুলো, কারণ তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, এখানেই হয়তো এমন কোনো জায়গা তিনি খুজে পাবেন, যেখানে লাইয়েল যেভাবে প্রস্তাব করেছেন, নতুন ভূমি সৃষ্টির সেই প্রক্রিয়াটি তিনি স্বচক্ষে দেখতে পাবেন।
প্রথম যে দ্বীপে ডারউইন পা রাখেন, সেটি চ্যাটহাম দ্বীপ ( এখন পরিচিত সান ক্রিস্টোবাল নামে), একটি সদ্য সৃষ্ট আগ্নেয়শিলার স্তুপ যেখানে তখনও মাটি বা কোনো উদ্ভিদ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে উঠতে পারেনি; কুৎসিত দর্শন ইগুয়ানা আর অসংখ্যা কাকড়া ‍তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানায়; ডারউইন পরে লিখেছিলেন, ‘এই দ্বীপপুন্জের প্রাকৃতিক ইতিহাস খুবই চোখে পড়ার মত, মনে হয় যেন এর নিজের মধ্যেই একটি ছোট জগত’। জগত বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, আমাদের বড় পৃথিবীটা থেকে ব্যতিক্রম।

(ছবি: এইচ এম এস বিগল এর ১৮৩৫ সালে গালাপাগোস দ্বীপপুন্জ সার্ভে করার রুট; ইংল্যান্ডে ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর ডারউইন এখান থেকে সংগ্রহ করা কিছু নমুনায় তার তত্ত্বের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা খুজে পান; গালাপাগোস সম্বন্ধে তিনি তার ডায়রীতে লিখেছিলেন: “The natural history of this archipelago is very remarkable: it seems to be a little world within itself; the greater number of its inhabitants, both vegetable and animal, being found nowhere else.”)
সেখানে ছিল বিশাল আকারের কচ্ছপ, যা উপরের খোলস বা কারাপেইস এর ব্যাস প্রায় ৭ ফুট, এবং তাদের খাদ্য ছিল প্রিকলী পিয়ার (ক্যাকটাসের ফল), এবং ডারউইন যদি এদের পিঠেও চড়ে বসতেন তাহলেও এরা কিছু মনে করতো না, মানুষকে নিয়ে তার কোনো ভয়ই ছিলনা। এছাড়াও সেখানে খুবই কুৎসিৎ দুটি প্রজাতির ইগুয়ানারও বসবাস করে, একটি দ্বীপের মধ্যে স্থলেই তাদের খাওয়া খুঁজতো আর অন্যটি সাগরে ডুব দিয়ে সমুদ্র শৈবাল খেতো; গালাপাগোস এর পাখিরা এত শান্ত প্রকৃতির যে, ডারউইন তাদের খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারতেন, তারা ভয়ে উড়ে যেতনা।

(ছবি: ডারউইনের ফিঞ্চ.. ঠোটের প্রকরণ)
ডারউইন নিয়মমাফিক তাদের সম্বন্ধে সামান্য কিছু নোট নেয়া সহ এই পাখিদের নানা প্রজাতিগুলোকে তার জন্য সংগ্রহ করতে থাকেন; কারো কারো লম্বা ঠোট, বড় বীজ ভেঙ্গে খাবার উপযোগী; কারো কারো আবার ঠোট দেখতে সরু বাঁকানো নিডল নোজ প্লায়ারস এর মত, যারা ছোট এবং সহজে নাগাল পাওয়া যায় না এমন বীজ খেতে পারদর্শী; তাদের ঠোট দেখে ডারউইন ধারণা করেন, তাদের কোনোটি হয়তো রেন, কোনোটি ফিন্চ বা ওয়ার্বলার এবং ব্ল্যাক বার্ড; তবে তিনি কোন পাখিটি কোন দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, সেটি নোট করে রাখার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি তখন; কারণ তিনি ধারণা করেই নিয়েছিলেন এই পাখিগুলো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশেরই কোনো প্রজাতি, যারা কোনো একসময় এই দ্বীপপুন্জে তাদের বসতি স্থাপন করে।

(ছবি: গালাপাগোসের মেরিন ইগুয়ানা)

ছবি: গালাপাগোসের জায়ান্ট টরটয়েস)
প্রাণিদের নমুনা সংগ্রহ শেষ হবার পর, গালাপাগোস দ্বীপ ছেড়ে বিগলের যাত্রা শুরু করার অল্প কিছু দিন আগে ডারউইনের মনে হয়েছিল, তার প্রজাতিদের নমুনা সংগ্রহ আর নোট নেবার ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল; এ সময়ে তার পরিচয় হয়েছিল নিকোলাস লসনের সাথে, যিরি চার্লস দ্বীপ ( এখন যেটি সান্টা মারিয়া) একটি পেনাল কলোনীর পরিচালক ছিলেন; লসন কচ্ছপের খোলস তার ফুলের বাগানে টব হিসাবে ব্যবহার করতেন; তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, প্রতিটি দ্বীপের কচ্ছপ একে অপরের থেকে এত ভিন্ন বৈশিষ্ট সম্পন্ন যে তিনি খোলসের দাগ আর গড়ন দেখেই বলে দিতে পারবেন সেটির উৎপত্তি কোন দ্বীপে; অন্য ভাবে বললে বলা যায়, প্রতিটি দ্বীপের কচ্ছপগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অথবা তারা হয়তোবা এমনকি স্বতন্ত্র কোনো প্রজাতির সদস্য; আর বিভিন্ন দ্বীপের উদ্ভিদগুলো, ডারউইন পরে বুঝতে পেরেছিলেন, একইভাবে স্বতন্ত্র।

(ছবি: গালাপাগোস থেকে ডারউইনের সংগ্রহ করা ফিঞ্চ)
হয়তো পাখীরাও সেরকম, কিন্তু যেহেতু ঠিক কোথা থেকে তার বেশীর ভাগ সংগ্রহ করা পাখিগুলো এসেছে (তার সঠিক নোট না নেবার কারণে), ডারউইনেরও সেটা জানার উপায় ছিল না; এবং তিনি সেটা বোঝেননি, যখন ইংল্যান্ডে ফেরার বহু দিন পর তিনি তার সংগ্রহ করে আনা পাখীগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, কেবল তখনই তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন, কিভাবে জীবনের একটি রুপ অন্য একটি রুপে পরিবর্তিত হয়।
জীবন নিজেকে নিজেই তৈরী করে

(ছবি:HMS Beagle Ship Bell Chime - artist: Anton Hasell, City of Darwin, Australia)
যখন বিগল গালাপাগোস এ তার কাজ শেষ করে, এটি যাত্রা শুরু করে শান্ত প্রশান্ত মহাসাগরে; বেশ দ্রুত, মাত্র তিন সপ্তাহে বিগল পৌছে যায় তাহিতিতে; আরো চার সপ্তাহ পর নিউজিল্যান্ড এবং তার দুই সপ্তাহ পর অষ্ট্রেলিয়ায়; যখন বিগল ভারত মহাসাগর অতিক্রম করছে, তখন তার মিশন ছিল প্রবাল প্রাচীর বা কোরাল রিফগুলো জরিপ করা। প্রবাল প্রাচীর নিজেই একটি জীবন্ত ভূগোল, যার মানচিত্র প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, ক্ষুদ্রকায় প্রবাল পলিপের কলোনী দিয়ে তৈরী প্রাচীর গড়ে ওঠে যখন তারা তাদের শরীরের চারপাশে বহিঃকঙ্কাল বা এক্সোস্কেলিটন তৈরী করে। পলিপরা মুলত বাঁচতে পারে সমুদ্র পৃষ্ঠের কাছাকাছি, যা পরবর্তীতে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, কারণ তারা একটি সালোকসংশ্লেষী শৈবালের উপর নির্ভর করে যারা তাদের শরীরে বসবাস করে; ভারত মহাসাগরে প্রবাল প্রাচীর অতিক্রম করার সময়, ডারউইন বিস্ময়ের সাথে ভাবছিলেন, কিভাবে তারা এরকম নিখুত গোলকার রীফ তৈরী করে; কখনো কোনো দ্বীপের চারপাশে, বা কখনো শুধু সমুদ্রে; এবং কেনই এই প্রবাল প্রাচীর পানির উপরের পৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি অবস্থান করতে দেখা যায়, যেখানেই কিনা ঠিক তাদের থাকা প্রয়োজন তাদের সঠিকভাবে বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সুর্যালোক পেতে?
লাইয়েল এর প্রিন্সিপল অব জিওলজীতে ডারউইন প্রবাল প্রাচীর নিয়ে তিনি লাইয়েল এর হাইপোথিসিসটি পড়েছিলেন: তাদের শুধু পানিতে নিমজ্জিত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে জন্ম হয়; প্রথমবারের মত ডারউইনের মনে হলো, এখানে লাইয়েল ভুল বলেছেন; জ্বালামুখের অনুকল্পটি ঠিক খাপ খায় না, কারণ এর জন্য প্রতিটি প্রাচীরকে ঠিক এমন জ্বালামুখের উপর হতে হবে এবং সেই জ্বালামুখগুলো ঘটনাচক্রে ঠিক সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কাছেই, বেশ অগভীরে অবস্থান করবে; ফলে ডারউইন ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা দিলেন:
যদি লাইয়েল এর ভূত্ত্ত্ব অনুযায়ী আন্দিজ পর্বতমালা এখনও উপরে ‌উঠতে থাকে, ডারউইনের যুক্তি দেন গ্রহের অন্য কোন অংশকে অবশ্যই নীচে নেমে যেতে হবে, ভারত মহাসাগরের মত এমন কোনো জায়গায় এটি অবশ্যই হতে পারে; প্রবাল হয়তো তৈরী হয় অগভীর পানিতে, নতুন সৃষ্ট দ্বীপের চারপাশে অথবা মূল ভূখণ্ডের উপকুলের কাছাকাছি কোথাও, তারপর এটি নিমজ্জিত হতে থাকে, ধীরে ধীরে যখন নীচের ভূমিটি আরো পানির নীচে ডুবে যেতে থাকে, প্রবালও তাদের সাথে নীচে নেমে যায় কিন্তু তারা হারিয়ে যায় না; ডারউইন যুক্তি দেন, যেহেতু নতুন প্রবাল প্রাচীরের উপরে পৃষ্ঠে ক্রমাগত সৃষ্টি হতে থাকে যখন এর নীচের মাটি অরো ডুবে যেতে থাকে; যখন প্রাচীন প্রবাল অন্ধকারে মারা যায়, প্রাচীর ঠিকই টিকে থাকে; এর কিছু কাল পরে যখন দ্বীপটি যখন নিজেই পুরোপুরি নীচ থেকে সরে যায় কিন্তু প্রাচীরটি পানির পৃষ্ঠের কাছাকাছি নিজেদের ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
প্রতিটি প্রবাল প্রাচীর যাদের বিগল সার্ভে করেছে, তারা এর কোন না একটি পর্যায়ে আছে; কিলিং দ্বীপপুন্জে ( এখন যেটি কোকোস দ্বীপপুন্জ) বিগলের সার্ভেয়ররা দেখলেন প্রবাল প্রাচীরের সমুদ্রমুখী প্রান্তে সাগর তল হঠাৎ করে খাড়া ভাবে গভীর হয়ে আছে; তারা যখন একেবারে নীচের থেকে প্রবাল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেন, তারা দেখেন সেগুলো আসলে মৃত প্রবাল; ঠিক যেমনটা ডারউইন আগেই ধারণা করেছিলেন।

(ছবি: প্রবাল প্রাচীর কিভাবে তৈরী হতে পারে সেই সংক্রান্ত ডারউইনের প্রস্তাবিত হাইপোথিসিস; দেশে ফেরার আগেই ডারউইনের সুখ্যাতি পৌছেছিল লন্ডনে, একজন প্রতিশ্রুতিশীল ভূতত্ত্ববিদ হিসাবে।)
ডারউইন আর লাইয়েল এর শুধু অনুসারী রইলেন না বরং তিনি এখন একজন স্বতন্ত্র, পূর্ণবিকশিত চিন্তাবিদ; তিনি লাইয়েল এর মুলনীতি ব্যবহার করেই লাইয়েল এর চেয়ে আরো ভালো একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন প্রবাল প্রাচীর সম্বন্ধে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি সেই পন্থাটাও বের করেছিলেন কিভাবে তার এই ধারণাটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করা যেতে পারে; বৈজ্ঞানিকভাবে কিভাবে ইতিহাস পড়তে হয় ডারউইন সেটা শিখছিলেন, এই ক্ষেত্রে পৃথিবীতে জীবনের ইতিহাস; তার পক্ষে হাজার বছর ধরে প্রবাল প্রাচীরে গড়ে ওঠা পুণরাবৃত্তি করে দেখানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু যদি তার প্রস্তাব মতই ইতিহাস ঘটে থাকে, তিনি তার প্রাক ধারণাটি পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন; তিনি পরে লিখেছিলেন, ‘একবার তাকালেই এই প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ হয়ে উঠে, যেভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠ ভেঙ্গে যায় এমন ভাবে যা কিছুটা সদৃশ্য তবে অবশ্যই নিখুত নয়, যেমনটি কোন ভূতত্ত্ববিদ হয়তো দেখতে পেতেন, যদি তিনি ১০,০০০ বছর বেঁচে থাকতেন এবং যিনি এই সময়ের পরিক্রমায় সকল পরিবর্তন লিপিবদ্ধ করে রাখতেন’।

(ছবি: ডারউইনের নিজের হাতে রঙ করা কোকোস দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরের প্রস্থচ্ছেদ দৃশ্য)
মনে হতে পারে এই গ্রহটি অপরিবর্তনীয় কিন্তু ডারউইন সময়কে মিলিয়ন বছরের মাত্রায় দেখতে শিখছিলেন এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহটি জীবন্ত কম্পমান গোলকের মত, কোথাও এটি ফুলে উঠছে, কোথাও ডেবে যাচ্ছে ভিতরে, এর উপরের পৃষ্ঠ ছিড়ে যাচ্ছে এই পরিবর্তনের চাপে; ডারউইন আরো শিখতে শুরু করেছিলেন, তাহলে জীবনও এই সময়ের মাত্রায় পরিবর্তিত হতে পারে; যথেষ্ট পরিমান সময়ে, প্রবাল প্রাচীর তাদের নীচে সমুদ্রের তলদেশের পুরো ডুবে যাওয়া থেকে নিজেদের ঠেকাতে পারে; তারা বিশাল দুর্গ তৈরী করতে পারে তাদের পুর্বসুরীদের শরীরের ধ্বংসা্বশেষ বা কঙ্কালের উপর।

(ছবি: ডারউইন তিন ধরনের প্রাবল প্রাচীর শনাক্ত করেছিলেন - atolls, barrier reefs আর fringing reefs)
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে অ্যাজোরেস হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বিগলের সময় লাগে আরো ছয় মাস; তবে ডারউইনের সুখ্যাতি তার আগেই ইংল্যান্ড পৌছে গিয়েছিল; কেমব্রিজে তার শিক্ষক হেনসলো, তার কাছে লেখা ডারউইনের বেশ কিছু চিঠি থেকে তথ্য বাছাই করে একটি বৈজ্ঞানিক পেপার ও একটি প্যাম্ফলেট প্রকাশ করেছিলেন; তার পাঠানো স্তন্যপায়ী প্রাণির জীবাশ্ম নিরাপদে ইংল্যান্ডে পৌছেছিল, এবং তাদের বেশ কিছু বৃটেন এর সেরা বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছে ইতিমধ্যেই; এমনকি ডারউইনের আইডল, লাইয়েলও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ডারউইনের ফিরে আসার।

(ছবি: 1849 John Stevens Henslow,উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে অ্যাজোরেস হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বীগলের সময় লাগে আরো ছয় মাস; তবে ডারউইনের সুখ্যাতি তার আগেই ইংল্যান্ড পৌছে গিয়েছিল; কেমব্রিজে তার শিক্ষক হেনসলো, তার কাছে লেখা ডারউইনের বেশ কিছু চিঠি থেকে তথ্য বাছাই করে একটি বৈজ্ঞানিক পেপার ও একটি প্যাম্ফলেট প্রকাশ করেছিলেন।)
প্লীমাউথ বন্দর ছেড়ে যাবার পাঁচ বছর পর একদিন প্রবল বৃষ্টির দিনে ইংলিশ চ্যানেল এ প্রবেশ করে বিগল; ১৮৩৬ সালে অক্টোবর মাসের দুই তারিখে ফিটজরয় তার শেষ সার্ভিসটি পরিচালনা করলেন, সেদিন দিনের শেষে বিগল ছেড়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দেন ডারউইন; এরপরে আর কখনোই তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে বের হননি, এমনকি তার নিজের বাসা ছেড়েই বের হয়েছিলেন কদাচিৎ।
ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রেখেই ডারউইন বুঝেছিলেন, তিনি গভীরভাবে, হয়তো আমূল বদলে গিয়েছেন; গ্রামের পাদ্রী হিসাবে এমন কোনো জীবন তিনি যে আর সহ্য করতে পারবেন না সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তিনি একজন পেশাজীবি প্রকৃতি বিজ্ঞানী হয়েছিলেন এবং তার বাকী জীবনে তিনি শুধু তাই ছিলেন; এছাড়াও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা চেয়ে বরং শুধুমাত্র একজন স্বাধীন গবেষক হিসাবে, যেমন, লাইয়েল। কাজ না করতে পারলে তিনি কোনদিন সুখী হতেও পারবেন না; কিন্তু তাকে যদি লাইয়েল এর মত কোন জীবন কাটাতে হয়, তাহলে তার বাবাকে কিছু অর্থ সাহায্য দিতে হবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য; এবং চিরকালের মতই ডারউইন চিন্তিত ছিলেন, তার এই পরিকল্পনা তার বাবা কিভাবে নেবেন।
অক্টোবরের চার তারিখ তার বাবার বাড়ি শ্রিউসবারী র দ্য মাউন্টে এসে পৌছান; পরিবারের সবাইকে দেখার জন্য উদগ্রীব ডারউইন, যথেষ্ট ভদ্র ছিলেন মধ্যরাতে সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বিরক্ত না করার জন্য, সেই রাতটি তিনি স্থানীয় একটি সরাইখানায় কাটান, পরদিন সকালে যখন কেবল তার বাবা এবং বোনরা সকালের নাস্তার জন্য টেবিলে বসেছেন, তিনি কাউকে না জানিয়ে মাউন্টে প্রবেশ করেন; তাকে দেখে তারা বোনেরা আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন, আর তার বাবা শুধু বললেন, ‘বেশ, তার মাথার আকারতো পুরো বদলে গেছে’। তার কুকুরগুলো এমন আচরণ করলো যেন ডারউইন মাত্র একদিনের জন্য বাড়ি ছেড়েছিল, এবং এখন তারা প্রস্তুত তার সকালে হাটার সঙ্গী হতে।
পরে তার বাবার রেগে যাওয়ার ব্যপারে ডারউইনের শঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছিল; যখন ডারউইন প্রবাসে, তার ভাই ইরাসমাসও চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে একজন স্বাধীন গবেষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বড়ভাই তার ছোট ভাই এর জন্য পথটা সুগম করে দিয়েছিলেন, ডারউইনের পরিকল্পনায় তারা বাবা কোন বাধা দিলেন না; যখন রবার্ট চার্লস এর প্যাম্ফলেটটি পড়েছিলেন, তিনি বেশ গর্বিত হয়েছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে শুধু খরগোস শিকার করে ডারউই্ন তার সময় নষ্ট করবেন না; তিনি তার ছেলের জন্য স্টক এবং বছরে ৪০০ পাউন্ড এর ভাতার ব্যবস্থা করে দিলেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা ছিল যথেষ্ট।

(ছবি: ২০০৯ সালে জন্ম দ্বিশত বার্ষিকীতে ডারউইন স্মারক ডাকটিকিট)
এরপর চার্লস ডারউইন তার বাবাকে আর কোনদিনও ভয় পাননি, কিন্তু তার বাবার নিজের সন্মান রক্ষা করার ব্যাপারে বিশেষ নজর দেবার রুচিটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন, এবং যখনই সম্ভব হয়েছে তিনি যে কোন ধরণের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেছেন; কোনোদিনই তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, এবং কখনো তা হতে চাননি; কিন্ত তাসত্ত্বে বাড়ী ফেরার কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নিজেকেই শঙ্কিত করেছিলেন একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সুচনা করে।


   



(ছবি: চার্লস ডারউইন এর ১৮৩৭ সালের নোট বুকে আকা প্রথম জীবন বৃক্ষের রেখাচিত্র, যা প্রতিটি জীব সম্পর্কযুক্ত এবং ট্রান্সমিউটেশনের এই বিষয়টি নিয়ে তার ভাবনাকে ইঙ্গিত করেছিল)
বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: চার্লস ডারউইন - একটি ধারণার বিজয়:
(আগের পর্বগুলো: প্রথম | দ্বিতীয় | তৃতীয় | চতুর্থ পঞ্চম | ষষ্ঠ )

সংশয় আর ভিন্নমত যেন ধর্মদ্রোহিতা
বিগল ফিরে আসার পার চার মাস পর, ডারউইন তার সংগ্রহ করে আনা জীবাশ্ম ও প্রাণীদের নমুনাগুলোর বিষয়ে নানা বিশেষজ্ঞদের মতামত পেতে শুরু করেন; শুরুতেই তাদের বক্তব্যগুলো মূলত তাকে সংশয়াচ্ছন্ন করেছিল; ওয়েন তার জীবাশ্ম স্তন্যপায়ীর নমুনাগুলো পরীক্ষা করে প্রস্তাব করেন এগুলো দক্ষিন আমেরিকায় বসবাসকারী কিছু প্রাণীরই দানবীয় সংস্করণ; ইদুর জাতীয় প্রাণীর আকার প্রায় জলহস্তির মত আর পিপাড়া খেকো অ্যান্ট ইটার আকারে প্রায় ঘোড়ার সমতুল্য; কেন, ডারউইন ভাবতে শুরু করেন, একই ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারী জীবিত প্রাণীদের সাথে এইসব বিলুপ্ত প্রানীদের মধ্যে কেন এই যোগসূত্র বা একটি সম্পর্ক বিদ্যমান; তাহলে কি হতে পারে সব জীবিত প্রানীরা বিলুপ্ত প্রানীদের থেকে আকারে পরিবর্তিত হয়ে উদ্ভব হয়েছে?
ডারউইন তার গালাপাগোস থেকে আনা পাখিগুলো দিয়েছিলেন জন গ্যুল্ডকে, যিনি ছিলেন বৃটেনের একজন প্রথম সারির পক্ষীবিশারদ, ডারউইন যখন তাদের সংগ্রহ করেছিলেন, তখন তাদের বিষয়ে আলাদা করে তিনি কিছু ভাবেননি; কিন্তু যখন গ্যুল্ডকে জুওলজিক্যাল সোসাইটির একটি সভায় কথা বলতে শোনেন তিনি, সঠিকভাবে নোট না নেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছিলেন তিনি; তাদের ঠোট দেখে ডারউইন এই পাখিদের শনাক্ত করেছিলেন ফিন্চ, রেন আর ব্ল্যাক বার্ড হিসাবে, কিন্তু গ্যুল্ড তার পরীক্ষার পর ঘোষনা দেন এগুলো সবই আসলে ফিন্চ; শুধু তাদের ঠোটগুলো কারো রেন দের মত , কারো ব্ল্যাক বার্ড দের মত দেখতে, যা তাদের কোন নির্দিষ্ট ধরনের খাওয়া খেতে সহায়তা করে।
এবং পরে ডারউইন গ্যুল্ড এর সাথে দেখা করতে যান, গ্যুল্ড তাকে দেখান যে তিনি আরো বড় কিছু ভুল করেছিলেন, ডারউইন ঠিক মতো উল্লেখ করেননি কোন দ্বীপ থেকে তাদের বেশীর ভাগ সংগ্রহ করেছিলেন, কারণ তখন তার কাছে এটা গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়নি; ঘটনাক্রমে তিনি শুধু নোট করেছিলেন, তিনটি মকিং বার্ড এসেছে তিনটি ভিন্ন দ্বীপ থেকে; এবং গ্যুল্ড তাকে দেখালেন, যে এই মকিংবার্ডগুলো আসলে তিনটি নতুন এবং ভিন্ন প্রজাতির সদস্য; ডারউইন অনুধাবন করতে পারলেন, নিশ্চয়ই কোনো একটি ব্যাপার আছে; তার ভাবনায় তখন প্রশ্ন, এত কাছাকাছি একটি জায়গায় কেন তিনটি ভিন্ন প্রজাতির মকিং বার্ড থাকবে?

(ছবি:John Gould, ডারউইন গালাপাগোস থেকে আনা পাখিগুলো দিয়েছিলেন জন গ্যুল্ডকে, যিনি ছিলেন বৃটেনের একজন প্রথম সারির পক্ষীবিশারদ, ডারউইন যখন তাদের সংগ্রহ করেছিলেন, তখন তাদের বিষয়ে তিনি আলাদা করে কিছু ভাবেননি; কিন্তু যখন গ্যুল্ডকে জুওলজিক্যাল সোসাইটির একটি সভায় কথা বলতে শোনেন তিনি, সঠিকভাবে নোট না নেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছিলেন তিনি; তাদের ঠোট দেখে ডারউইন এই পাখিদের শনাক্ত করেছিলেন ফিন্চ, রেন আর ব্ল্যাক বার্ড হিসাবে, কিন্তু গ্যুল্ড তার পরীক্ষার পর ঘোষনা দেন এগুলো সবই আসলে ফিন্চ; শুধু তাদের ঠোটগুলো কারো রেন দের মত , কারো ব্ল্যাক বার্ড দের মত দেখতে, যা তাদের কোন নির্দিষ্ট ধরনের খাওয়া খেতে সহায়তা করে।)
তাহলে কি ভিন্ন প্রজাতির ফিন্চরাও ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী ছিল? ডারউইন ফিটজরয়ের সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেন, জাহাজের অন্যান্য নাবিকরা যে পাখিগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তাদের কিছু নমুনা যেন গ্যুল্ডের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়; সৌভাগ্যক্রমে জাহাজের অন্যান্যরা ডারউইনের চেয়ে সতর্ক ছিলেন নমুনার বিবরণ নোট করার ব্যাপারে, তারা লিখে রেখেছিলেন কোন দ্বীপ থেকে তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে; এবং ঠিক মকিং বার্ডের মতই বিভিন্ন দ্বীপের ফিন্চগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্য।

(ছবি: গালাপাগোসের ফিন্চরা..তারা ভিন্ন তাদের ঠোটে বা বীকের আকার, নীড় বানাবার জায়গা, খাদ্যাভাস দ্বারা।)
বিষয়টি ডারউইন অনুধাবন করতে পারলেন - একটি খটকার বিষয়, কেন এতগুলো স্বতন্ত্র প্রজাতির অস্তিত্ব থাকবে একই ধরনের দ্বীপগুলোতে; তিনি তার নোটবুক খুললেন এবং গালাপাগোসদের ফিন্চ সম্বন্ধে একটি ব্যাখ্যা খোজার চেষ্টা করতে শুরু করেন; তার চারপাশের মানুষগুলোর কাছে, ভূতত্ত্ব বিষয়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা ডারউইনের কোন পরিবর্তন কারো নজরে পড়ে নি; তিনি একনিষ্ঠ মনে প্রবাল প্রাচীর, উত্থিত সমতল আর আগ্নেয়গিরির কোণাকৃতি শৃঙ্গ নিয়েই লিখছিলেন, কিন্তু তার গোপন ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আচ্ছন্ন হয়েছিলেন একটি অসাধারণ ধারণায়; হয়তো ফিন্চগুলো বর্তমান এই রুপে সৃষ্টি হয়নি, হয়তো তারা বিবর্তিত হয়েছে।

(ছবি: ফিন্চ (চার্লস ডারউইনের 1839 Journal of Researches Into the Natural History and Geology of the Countries Visited During the Voyage of HMS Beagle Round the World, Under the Command of Captn. FitzRoy, R.N. থেকে)
যে ভূমিতে প্রজাতিদের বসবাস, সেই ভূখণ্ডে অবশ্যই চিরন্তনভাবে অপরিবর্তনীয় নয়; ডারউইনের ফিন্চরা এখন এমন কোনো দ্বীপে বাস করে যা কোনো একসময় সমুদ্রের মধ্যে জেগে উঠেছিল প্রাকৃতিক শক্তিতে, যখনই গালাপাগোস সাগর পৃষ্ঠের উপরে উঠে এসেছে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সাধারণ ফিন্চরা হয়তো এই দ্বীপে বসতি গেড়েছিল তারপর কোনো এক সময় এবং সময়ের পরিক্রমায় এদের বংশধররাই বিবর্তিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে, তাদের বৈশিষ্ট্যসূচক শরীর সহ, যা এখন খাপ খাইয়ে নিয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্যমূলক জীবনাচরণের সাথে; আদি নিবাসীদের বংশধররাই পৃথক পৃথক বংশধারায় শাখা প্রশাখার সূচনা করেছে; এই একই ভিন্ন ভিন্ন বংশধারায় শাখা প্রশাখা সৃষ্টি হবার ঘটনাও হয়তো ঘটেছে পাতাগোনিয়াতেও, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে? ডারউইন যে দানবাকৃতির স্তন্যপায়ীদের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন, তারাই সেখানকার বর্তমান ক্ষুদ্রকায় শরীরের স্তন্যপায়ীদের উদ্ভবের কারণ।

(ছবি: ডারউইনের B নোটবুকের ৩৬ তম পাতায় আকা জীবন বৃক্ষ, উপরে এক কোনে লেখা সতর্ক ডারউইনের মন্তব্য I think….)
তার নোটবুকে, ডারউইন একটি গাছের রেখাচিত্র আকেন, যেখানে পুরোনো প্রজাতি শাখা বিভক্ত হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টির করছে; তার নিজের ধারণাই তাকে রীতিমত শঙ্কিত করে তোলে, তার এই একাগ্র চিন্তা তার দ্রুত হৃদস্পন্দন আর পেটের ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়, অজানা আশঙ্কায় তিনি ভুগতে থাকেন; মাঝে মাঝে অদ্ভুত স্বপ্নে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত মাঝরাতে; তিনি জানতেন যে প্রাকৃতিক আইন ফিন্চ এবং স্তন্যপায়ীদের উপর কাজ করছে, সেই প্রাকৃতিক আইন অবশ্যই মানুষের উপরেরও কাজ করছে একইভাবে; তিনি মানুষকে জীবজগতে শুধু আরো একটি প্রজাতি সদস্য হিসাবে ভাবতে শুরু করেন, যদিও তাদের বাড়তি কিছু মানসিক দক্ষতা আছে।

(ছবি: গালাপাগোস এর ফিন্চরা, মুল দক্ষিন আমেরিকার ফিন্চ থেকেই বিবর্তিত হয়েছে গালাপাগোসের ফিন্চরা)
তার নোটবইতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোন একটি প্রাণীকে অন্য প্রাণী থেকে বিশেষ কোন উচ্চ অবস্থানে ভাবা বা এমনভাবে কিছু বলা আসলেই অর্থহীন, মানুষ প্রায়ই বুদ্ধিমান মানুষের আবির্ভাব হবার অসাধারণ চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলে থাকেন – কিন্তু পতঙ্গদের আবির্ভাব অন্যার্থে আরো বেশী বিস্ময়কর, সারা পৃথিবীর ভরা অপুর্ব সুন্দর সাভানা আর জঙ্গল দেখে কে বলতে সাহস পায় বুদ্ধিমত্তাই হচ্ছে এই পৃথিবীর একমাত্র লক্ষ্য ? হয়তো মানুষও, ঠিক ফিন্চদের মতই বিবর্তন প্রক্রিয়ারই ফসল’।
জেনী নামে সদ্য সংগ্রহ করাএকটি ওরাং উটানকে দেখতে ডারউইন লন্ডন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে তার মুখে ঠিক সেই অভিব্যক্তিগুলো লক্ষ্য করেছিলেন যা তিনি শিশুদের মধ্যেও দেখেছিলেন;
তার নোট বইয়ে তিনি লেখেন, এইপ থেকে মানুষ?
যদিও তার সমস্ত ধারণা তখনও ভ্রুণ পর্যায়ে, ডারউইন জানতেন তারা যথেষ্ট বিপদজ্জনক; মানুষ বিবর্তিত হয়েছে এমন কোন একটি ঘোষণা তাকে হয়তো চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে লাইয়েল এবং অন্যান্য প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে, যাদের তিনি শ্রদ্ধা করেন এবং যাদের উপর তার পেশাগত ভবিষ্যত নির্ভর করছে; তাসত্ত্বেও ডারউইন তার নোটবুকে লিখে যেতে থাকেন তার ভাবনাগুলো, ধীরে ধীরে বুনতে থাকেন তার তত্ত্বটিকে, এর স্বপক্ষে জমা করতে থাকেন প্রয়োজনীয় স্বাক্ষ্য প্রমাণগুলো।
ডারউইন সেই চিহ্নগুলো খুজতে থাকেন, কিভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় এবং কিভাবে তারা পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়; যারা বাগান করেন, চিড়িয়াখানার পশুপাখি সংরক্ষক, কবুতরের নানা জাত তৈরী করেন আর পালেন, তিনি এমন সবার সাথেই কথা বলেন; এমনকি তার চুল কাটতেন যিনি, তার কাছে কুকুরের নানা জাতের প্রজনন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন । যদিও তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন প্রজাতি অপরিবর্তনশীল কোনো একটি অবস্থা না; তবে তার তখনও পর্যন্ত জানা ছিল না কি উপায়ে একটি প্রজাতি নতুন একটি রুপ নিতে পারে বিবর্তনের মাধ্যমে; লামার্ক দাবী করেছিলেন যে কোনো প্রানী তার জীবনকালে বদলে যেতে পারে, এবং তার অর্জিত নানা বৈশিষ্ট্যাবলী তার পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে পারে, কিন্তু তেমন কোনো স্বাক্ষ্য প্রমাণ ছিল না এটা আসলেই ঘটছে কিনা?
১৭৯৮ সালে থমাস মালথাস, গ্রামের একজন পাদ্রী, জনসংখ্যার মূলনীতি নিয়ে একটি রচনা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, কোন একটি দেশের জনসংখ্যা, যদি তা কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা না পায়, যেমন অনাহার বা ব্যাধি,কয়েক বছরের মধ্যেই তা বহু গুণে বেড়ে যাবে; যদি প্রতিটি দম্পতি চারটি করে সন্তান লালন করেন, তাহলে জনসংখ্যা খুবই সহজে দ্বিগুণ হবে ২৫ বছরে এবং এর পর থেকে এটি তার দ্বিগুণ হতে থাকবে, এটি ৩,৪,৫ এবং এভাবে গাণিতিক হারে বাড়বে না বরং বাড়বে, ৪,৮,১৬ এভাবে দ্বিগুন হারে।

(ছবি: থমাস রবার্ট মালথাস , Reverend Thomas Robert Malthus,1766 – 1834); জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর একটি লেখা An Essay on the Principle of Population ডারউইনকে অনুপ্রাণিত করেছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারনাটিতে পৌছাতে… পরে একই প্রবন্ধ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসকেও অনুপ্রাণিত করেছিল একই উপসংহারে পৌছাতে।)
যদি কোনো দেশের জনসংখ্যা এভাবে বিস্ফোরিত হয়, মালথাস সতর্ক করেন, কোনো আশা করার উপায় নেই যে সেখানে খাদ্য সরবরাহ একই হারে বাড়বে, নতুন জায়গা পরিষ্কার করে হয়তো চাষাবাদও করা যেতে পারে, বা ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে, তবে এই বৃদ্ধি গাণিতিক, জ্যামিতিক না; আর অনিয়ন্ত্রিত কোনো বাধাহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই দুর্ভিক্ষ আর দুর্ভোগের কারণ হবে; মানবতা যে এখনও বিরামহীন দুর্ভিক্ষাবস্থায় নেই এক একটিমাত্র কারণ হচ্ছে এর বৃদ্ধি সবসময় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে বেশ কিছু শক্তি যেমন, নানা অসুখ, শিশ মৃত্যু এবং এমনকি শুধুমাত্র মাঝ বয়স অবধি বিবাহ ঠেকিয়ে রেখে।
মালথাস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, যে শক্তি বা প্রজনন উর্বরতা এবং অনাহার কিংবা খাদ্য ঘাটতির যে নিয়ামকগুলো মানব জাতিকে প্রভাবিত করে, তারা প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপর একই ভাবে প্রভাব ফেলে; যদি মাছিদের লার্ভা বা ম্যাগট উৎপাদন কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া অব্যাহত থাকে, কিছুদিনের মধ্যে সারা পৃথিবী আমাদের হাটু অবধি মাছির ম্যাগটে ভরে যাবে; বেশীর ভাগ মাছি ( এবং প্রতিটি প্রজাতির বেশীর ভাগ সদস্য) অবশ্যই কোন উত্তরসূরি না রেখেই মারা যায়।
ম্যালথাসেই এই উৎকন্ঠা উদ্রেককারী রচনাটিতে, ডারউইন তার বিবর্তন প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে পরিচালনাকারী শক্তি বা ইন্জিনটিকে খুজে পেলেন; সৌভাগ্যবান অল্প কিছু সদস্য যারা প্রজননে সফল হয়, তারা শুধুমাত্র ভাগ্য দ্বারা চিহ্নিত হয়নি; কোনো কোনো সদস্যদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট থাকে যা তাদের বিশেষ কোনো অবস্থায় ভালোভাবে টিকে থাকতে ( বাঁচা এবং প্রজনন) সহায়তা করে; হতে পারে এরা প্রাণী বিশেষে আকারে বড় হতে পারে, কিংবা কোনো পাখির ক্ষেত্রে তাদের হয়তো বিশেষভাবে সরু ঠোট থাকে, বা অন্য কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে যার গায়ে বাড়তি মোটা লোমের স্তর আছে; এবং এই সব ক্ষেত্র গুলোতে প্রজাতির যে সদস্যরা এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে জন্ম নেবে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বা বংশধর রেখে যাবার সম্ভাবনা প্রজাতির অন্যান্য দুর্বল সদস্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী, এবং যেহেতু বংশধররা তাদের পিতামাতার মত হয়, তারাও তাদের টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মেও হস্তান্তর করবে।
এই ভারসাম্যহীনতা সম্ভবত খুব সামান্য হতে পারে, যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সহজে চোখে পড়েনা; কিন্তু সহজে বোঝা যায় না এধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন যা পর্বত তৈরী করতে পারে, তা ডারউইন ইতিমধ্যেই স্বাচ্ছন্দের সাথে বুঝতে পেরেছিলেন; এখানে সেই সুবিশাল পর্বতই তৈরী হচ্ছে তবে তার প্রকৃতি হচ্ছে জৈববৈজ্ঞানিক; যদি পাখিদের কোনো একটি জনগোষ্ঠী গালাপাগোস দ্বীপে এসে বসতি গড়ে, সেই গোষ্ঠীর যে সদস্যরা সেই বিশেষ দ্বীপের পরিবেশের জীবনের সাথে সবচে বেশী মানানসই তারাই টিকে থাকবে এবং পরবর্তী বংশধর প্রজননে সক্ষম হবে; এবং যথেষ্ট পরিমান সময়ের পরিক্রমায় এই পরিবর্তনগুলোই সৃষ্টি করতে পারে নতুন কোন প্রজাতি।
কৃষকরা যেভাবে তাদের ফসলের রক্ষণা বেক্ষণ করেন সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে ডারউইন একটি ভালো অ্যানালোজী বা তুলনা খুজে পেলেন; কৃষকরা তাদের ফসল ব্রীড বা চাষ করেন প্রতিটি শস্যবাহী গাছ কেমন হয় তাদের পরস্পরের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে, তারপর তারা সবচেয়ে ভালো গাছগুলো থেকেই বীজ সংগ্রহ করেন পরবর্তী প্রজন্মের চাষের সময়; এবং এই ভাবে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমান ধারাবাহিক ব্রীডিং করার প্রক্রিয়ায় একটি সময় অন্যান্য প্রকারের ফসলের চেয়ে এটি একটি স্বতন্ত্র ফসলে পরিণত হয়; কিন্তু প্রকৃতিতে কোন খামারী বা চাষী নেই; সেখানে শুধু প্রানী আর উদ্ভিদের প্রজাতির নানা সদস্যরা আছে, যারা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বরত টিকে থাকার জন্য, আলো বা পানি বা খাদ্যের জন্য; এই পক্রিয়ায় তারা একটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়েও অতিক্রম করে; যে নির্বাচন হয় কোনো একক নির্বাচক ছাড়াই; ফলাফলে, ডারউইন শনাক্ত করেছিলেন, জীবিত সব জীবের মধ্য দৃশ্যমান সব ডিজাইন সৃষ্টি হতে পারে প্রাকৃতিকভাবেই, যেখানে কোন একক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির জন্য কলকাঠি নাড়ার কোন প্রয়োজন নেই;
এ যেন হত্যার অপরাধ স্বীকার করার মত:
নোট বইয়ে নিজের বৈপ্লবিক আর হেরেসি বা বৈধর্মের মত ধারণাগুলো লিখে রাখার ফাকে ফাকে ডারউইন কিছুটা সময় নিয়েছিলেন তার জীবনসঙ্গীনি খোঁজার জন্য; তার বিগল যাত্রার বেশ আগে ডারউইন তার কৈশোরে একজনের প্রেমে পড়েছিলেন, তার নাম ছিল ফ্যানি ওয়েন (ফ্যানি ওয়েন ডারউইনের স্কুলের সহপাঠী উইলিয়াম ওয়েন এর বোন); কিন্তু ডারউইনের সমুদ্রযাত্রার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফ্যানী অন্য একজনের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহন করেছিলেন; ইংল্যাণ্ডে ফিরে ডারউইন ভাবতে শুরু করেন, তার কি আদৌ বিয়ে করা উচিৎ হবে কিনা; নিয়ম মানা বিজ্ঞানীদের মত তিনি একটি কাগজে বিয়ে করার পক্ষে বিপক্ষে একটি তালিকা তৈরী করেন, উপরে বা দিকে বিয়ে করার সুবিধা ( বা টু ম্যারী), ডান দিকে অসুবিধা ( নট টু ম্যারী) এবং মাঝখানে লেখেন, দিস ইস দ্য কোয়েশ্চেন, তালিকা সহ একটি ব্যালান্স শীট তৈরী করেন ডারউইন; এই তালিকায় দেখায় যায় ডারউইন বিয়ের বিপক্ষে যুক্তি হিসাবে লিখেছেন, একা থাকলে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার বেশী সময় পাবেন, ক্লাবে পুরুষ সহকর্মীদের সাথে বেশী সময় আলোচনা করে কাটাতে পারবেন, এছাড়া সন্তান প্রতিপালন করার মত অর্থ সামর্থ্য তার নেই; অন্যদিকে বিয়ের স্বপক্ষে যুক্তি হলো, একজন স্ত্রী তার বৃদ্ধ বয়সে সারাক্ষণ সঙ্গী হবে; এধরনের তালিকার নীচে সব যোগ বিয়োগ করে তিনি তার উপসংহারে পৌছান: বিয়ে –বিয়ে –বিয়ে অতঃসিদ্ধ।

(ছবি: ফ্যানি ওয়েন, ডারউইনের প্রথম ভালোবাসা, স্কুলের এক সহপাঠীর বোন, উচ্ছল, চঞ্চল ফ্যানি ডারউইনকে তার মা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন; ডারউইনের দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার সময় তিনি অন্য আরেকজনের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহন করেন, সেকথা অবশ্য ডারউইনকে প্রথম জানিয়েছিলেন তিনি একটি চিঠিতে : “Believe me Charles that no change of name or condition can ever alter or diminish the feelings of sincere regard and affection I have for years had for you… ; ডারউইন পরবর্তীতে তারা মামাতো বোন এমাকে বিয়ে করেছিলেন ১৮৩৯ সালে।)
জীবন সঙ্গীনি হিসাবে ডারউইন নির্বাচন করেন তার মামাতো বোন এমা ওয়েজউডকে; তার কোনই ইচ্ছা ছিল লণ্ডনে পরিচিত হওয়া অভিজাত হাল ফ্যাশনের কোনো নারীকে তার জীবনে আনার, বরং তিনি তার মায়ের ভাইঝির দিকেই নজর দিয়েছিলেন, যে তার মত গ্রাম্য পরিবেশেই বড় হয়েছে; এমা ইতিমধ্যেই ডারউইনকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন, যখন ওয়েজউড হাউসে প্রায়ই ডারউইন বেড়াতে যেতেন; তার প্রতি ডারউইনের এই বিশেষ মনোযোগে এমাও খুশী হতেন, যদি ডারউইন পরোক্ষভাবে উচ্চারিত নানা অস্পষ্ট শব্দমালা বা বিব্রত ইতস্তত কিছু আচরণ ছাড়া তেমন কিছু করতে সক্ষম হননি এমার মন জয় করার প্রক্রিয়ায়; সে কারনেই এমা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিলেন, যখন নার্ভাস ডারউইন একদিন কোনো মতে সাহস করে বলে ফেলেন যে তিনি তাকে বিয়ে করতে চান, এমা হ্যা বলেছিলেন কিন্তু তিনি এতই অবাক হয়েছিলেন, এর পর কোন কথা না বলেই তিনি তার রোববারের স্কুলে ক্লাস নিতে উঠে যান।
কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি এমা ডারউইনের মত পুরোপুরি ‘ভদ্র আর মিষ্টি স্বভাব’ এর একটি মানুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন সেই আনন্দটা অনুভব করতে শুরু করেন; অন্যদিকে ডারউইন চিন্তিত ছিলেন বিগলে তার সেই সময়টা তাকে কতটা অসামাজিক করে দিয়েছে বিয়ের মতো কোন সামাজিক আচারণের জন্য, কিন্তু এমাকে বিয়ে করছেন এই বোধটি তাকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল; তিনি এমাকে লিখেছিলেন, ’আমি মনে করি তুমি আমাকে মানুষে রুপান্তরিত করতে পারবে এবং শীঘ্রই আমাকে শেখাবে পারবে নীরবে এবং একাকীত্বে কোনো তত্ত্ব নির্মাণ ও তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ একত্রিত করার চেয়ে বড় অন্য কোনো সুখও আছে।’

(ছবি: এমা ওয়েজউড, ডারউইনের জীবন সঙ্গীনি (Emma Darwin (née Wedgwood) (2 May 1808 – 7 October 1896); ১৮৩৯ সালে ২৯ জানুয়ারী তাদের বিয়ে হয়েছিল; ডারউইন এবং এমা মোট দশটি সন্তানের জনক জননী ছিলেন, যাদের তিন জন শৈশবে মারা গিয়েছিলেন।)
এমার চিন্তা শুধু একটাই যখন ডারউইন প্রকৃতি নিয়ে এবং এটিকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভাব্য নিয়মাবলী বা সূত্র নিয়ে কথা বলেন; এমা একজন নিবেদিত প্রাণ ধার্মিক অ্যাঙলিকান, সহজেই বুঝতে পারেন যে বাইবেল নিয়ে চার্লস এর সন্দেহ আছে; তিনি ডারউইনকে লিখেছিলেন, ‘আমার জন্য একটি কাজ করবে?’ তিনি তাকে জনের গসপেল থেকে খানিকটা অংশ পড়তে বলেন: ‘আমি একটি নতুন আদেশ তোমাদের উপর ন্যস্ত করছি, তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে; যেমন আমি তোমাদের ভালোবেসেছি, তেমন তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে,’ যদি ভালোবাসা দিয়ে শুরু করে, ডারউইন হয়তো সত্যিকারের খ্রিস্টান হতে পারবেন।
তিনি এমাকে প্রতিজ্ঞা করেন এবং বলেন যে আসলেই বিষয়টিকে তিনি বেশ আন্তরিকভাবেই অনুভব করেছন; কিন্তু সেই সময়ে তার নোটবুকে চোখ রাখলেই বলা সম্ভব তিনি বিষয়টি নিয়ে ঠিক পুরোপুরি সততার সাথে তার সত্যিকারের মনোভাব ব্যক্ত করেননি এমার কাছে; তিনি ভাবছিলেন, সত্যিকার কোনো ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা চেয়ে বরং ধর্ম কি আসলেই প্রবৃত্তিগত কোনো ব্যাপার যাকে আমরা বলি ইন্সটিংক্ট ? এমার জন্য তার ভালোবাসাই তাকে বাধা দিয়েছিল তার সব চিন্তার কথা এমাকে বিস্তারিত জানানোর ক্ষেত্রে।
বিয়ের পর চার্লস এমাকে নিয়ে লন্ডনে চলে আসেন, এবং একটি স্বাচ্ছন্দময় একঘেয়েমীর দাম্পত্য জীবনে তারা অবশেষে স্থির হয়েছিলেন; তার স্বামীর আত্মা নিয়ে এমার চিন্তা অবশ্য অব্যাহত থাকে; এবং এসময় তিনি আরো চিঠি লিখেছিলেন; ১৮৩৯ সালে একটি চিঠিতে তিনি তার উৎকন্ঠা প্রকাশ করেন যে, ‘চার্লস প্রকৃতির সেই অন্তর্গত সত্যটাকে খোজার জন্য এত বেশী মোহাবিষ্ট ও আচ্ছন্ন হয়ে আছেন যে তিনি অন্য কোন সত্যকে দেখতে পাচ্ছেন না, যে সত্য শুধুমাত্র ধর্মই পারে উন্মোচন করতে’; আর শুধু যা কিছু প্রমাণ করা যায় শুধু সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবার কারনে তিনি, ‘সেই সব বিষয়গুলো মেনে নিতে পারছেন যেগুলো কিনা একইভাবে প্রমাণ করা সম্ভব না কিংবা যদি তা সত্য হয়, সেগুলো আসলেই আমাদের বোঝার ক্ষমতারও বাইরে।’তিনি চার্লসের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন, তিনি যেন ভুলে না যান, যীশু খিস্ট্র তার জন্য এবং পৃথিবীর বাকী সবার জন্য কি করেছিলেন; কোনো উ্ত্তর ছাড়াই ডারউইন এমার এই সেই চিঠিটাকে সরিয়ে রাখেন, যদিও চিঠিটির কথা তিনি তার সারা জীবন মনে রেখেছিলেন।
১৮৩৯ সালে ডারউইন ”জার্নাল অব রিসার্চেস ইনটু ন্যাচারাল হিস্টোরী অ্যান্ড জিওলজি অব দ্য কান্ট্রিস ভিসিটেড ডিউরিং দ্য ভয়েজ অব এইচএমএস বিগল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্লড,আন্ডার দ্য কমান্ড অব ক্যাপ্টেন ফিটজরয়, আর এন (Journal of Researches into the Natural History and Geology of the Countries Visited During the Voyage of HMS Beagle Round the World, Under the Command of Captn. FitzRoy, R.N) প্রকাশ করেন;
ডারউইনের এই বইটি খুবই আলোচিত ও সফল হয়েছিল প্রকাশের সাথে সাথেই, এবং এটি ব্রিটেনে অন্যতম সেরা একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে ডারউইনের সুনামকে করেছিল নিশ্চিৎ; ততদিনে চার্লস এবং এমা বিবাহিত জীবন কেটেছে প্রায় তিন বছর এবং তাদের দুটি সন্তানও আছে, এবং এসময়টাতেই তারা সিদ্ধান্ত নেন, এবার লন্ডন ছেড়ে শহরের বাইরে কোথাও চলে যাবেন; লন্ডনের শহুরে ব্যস্ততা, হ্ট্টগোল, অপরাধ, কয়লার ধুলা যা তাদের কাপড়কে কালো করে দিত, বা ঘোড়ার গোবর যা তাদের জুতার সাথে লেগে যেত, কোনটাই তাদের আর সহ্য হচ্ছিল না, নিজেরা যেমন গ্রামের অকলুষিত পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন, তাদের সন্তানদেরও সেই পরিবেশে মানুষ করার সিদ্ধান্ত নেন ডারউইন দম্পতি; লন্ডন থেকে ১৬ মাইল দুরে কেন্টে ১৮ একরের একটি ফার্ম, ডাউন হাউসকে বেছে নেন তারা; এখানে এসেই ডারউইন পুরোদস্তুর খামারী হয়ে যান, ফসলের চাষ করেন, গরু এবং ঘোড়া কেনেন; বৈজ্ঞানিক সমাজে মেলামেশা পুরোপুরি তিনি বন্ধ করে দেন।

(ছবি:ডাউন হাউস, কেন্ট, এখানে ডারউইন তার জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছিলেন, বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়াম।)

(ছবি: ডাউন হাউসে ডারউইনের স্টাডি)
খুব সাবধানে বাছাই করা সপ্তাহ অন্তের কয়েকজন অতিথি ছিল তার লন্ডনে ফেলে আসা বৈজ্ঞানিক সমাজের সাথে একমাত্র যোগসূত্র, এধরনের ঘনিষ্ট কিছু মানুষের মাধ্যমেই তিনি বিজ্ঞানের নতুন বিষয়গুলোর খবরাখবর পেতেন; কাছের মানুষ প্রিয় বড় ভাই ইরাসমাস লন্ডন ছেড়ে তার ছোট ভাই এর সাথে দেখা করাটা কাজটি একেবারেই পছন্দ করতো না, তিনি ডারউইনের প্রিয় ডাউন হাউসকে বাসাটিকে ঠাট্টা করে বলতেন Down at the Mouth; এই পুরো সময় জুড়ে বিবর্তনের তত্ত্বটি নিয়ে তার ভাবনাগুলো গোপনে অব্যহত ছিল কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে; প্রাকৃতিক নির্বাচনের স্বপক্ষে একটি যুক্তি তর্ক সম্বলিত একটি প্রস্তাবনাও তিনি লেখা শুরু করেন, ১৮৪৪ সালে সেটি শেষ হবার পর, তিনি বুঝতে পারছিলেন না এর পর কি করবেন তিনি; বিষয়টি নিয়ে তিনি কারো সাথেই আলাপও করতে চাইছিলেন না কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে কিভাবে কথা বলবেন ; তার তত্ত্বটির সমর্থনে তিনি বহু মানুষর কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাদের কাউকে জানাননি কেন এসব তথ্য তার আসলে দরকার;

(ছবি: ডাউন হাউসের পাশেই ডারউইনের বানানো হাটা ও চিন্তা করার পথ, স্যান্ড ওয়াক, এখানে হাটতে বের হয়ে তিনি ভাবতেন। এই রাস্তাটি তৈরী করা অনুপ্রেরণা ছিল তার মা, যাকে খুব শৈশবেই তিনি হারিয়েছিলেন।)

(ছবি: ডাউন হাউসে জোসেফ হুকার, চার্লস লাইয়েল এবং চার্লস ডারউইন, ডারউইনের খুব ঘনিষ্ঠ দুজন বৈজ্ঞানিক সহযাত্রী;)
যে বালকটি এক সময় তার বাবাকে ভীষণ ভয় পেত বলতে যে, সে কখনো ডাক্তার হতে পারবে না, সেই ছেলেটি তখন রুপান্তরিত হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষে, যিনি তার বিপদজ্জনক ধারণাটিকে কাউকে জানাতে শঙ্কা বোধ করতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু অবশেষে কাউকে না কাউকে তো তাকে বলতেই হবে, আর সেটা করতে গেলে তাকে এমন বৈজ্ঞানিক মনস্ক কাউকে খুজে বের করতে হবে যারা তার কাজ সম্বন্ধে যোগ্য মন্তব্য করতে পারবেন, আর যদি তিনি কোন বড় ভুল থাকেন যা অবশ্য তাদের চোখ এড়াবে না; তিনি জোসেফ হুকার নামের একজন তরুন উদ্ভিদবিদকে প্রথমে নির্বাচন করলেন, যিনি এর আগে বিগল অভিযানের সময় তার নিয়ে আসা উদ্ভিদের নমুনা গুলো পরীক্ষা করেছিলেন, এবং যাকে ডারউইনের যথেষ্ট খোলা মনের একজনই মনে হয়েছিল, যে তাকে অন্তত ব্লাসফেমার বা ধর্ম নিন্দাকারী মনে করবেন না; তিনি হুকারকে চিঠি লেখেন:
‘ফিরে আসার পর থেকেই আজ অবধি আমি খুব বড় একটি সাহসী বা বলা যায় ধৃষ্ঠতাপুর্ণ কাজের সূচনা করেছিলাম এবং আমার আসলেই এমন আর কাউকে জানা নেই, সব শুনবার পর যিনি বলবেন না, কাজটি খুব বেশী নির্বোধতুল্য হয়ে গেছে; গালাপাগোসে জীবজন্তুদের বিস্তারের বিষয়টিতে আমার দৃষ্টি এতবেশী আকর্ষণ করেছিল যে, আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম একনিষ্ঠভাবে দৃঢ়চিত্তে আমি যাবতীয় সব তথ্য সংগ্রহ করবো যা প্রজাতি আসলে কি সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিতে পারে আমাদের; আমি অসংখ্য কৃষিবিদ্যা এবং উদ্যানবিদ্যার বই পড়েছি এবং কখনোই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা স্তগিত করিনি; অবশেষে আমি কিছুটা আলোর দেখা পেয়েছি এবং প্রায় স্থির একটি সিদ্ধ‍ান্তে পৌছাতে পেরেছি ( যা শুরুর সময়কালীন আমার ধারণার সম্পুর্ণ বীপরিত প্রমাণিত হয়েছে) যে, প্রজাতিরা ( এটি অনেকটা কোন হত্যার দায় স্বীকার করার মত) অপরিবর্তনীয় নয়, আমি মনে করি আমি একটি সহজ উপায় ( আর এখানেই মনে হতে পারে আমার প্রধৃষ্ঠতা!) খুজে পেয়েছি কিভাবে প্রজাতিগুলো এত অসাধারণ সুচারুভাবে নানা পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়; আপনি হয়তো হতাশায় আর্তনাদ করে উঠবেন এবং নিজের মনে ভাববেন, ’হায় কি এক মানুষের জন্য আমি সময় আর লেখা অপচয় করছি;’ পাঁচ বছর আগে এমনকি আমি যেমনটা ভাবতাম; ডারউইন যেমন আশা করেছিলেন, হুকারও ঠিক তেমনই একজন খোলা মনের মানুষই ছিলেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত হবো কিভাবে পরিবর্তন ঘটেছে প্রজাতিতে সে বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন তা যদি আমি শুনতে পারি’ তিনি প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন,‘যেহেতু বর্তমান প্রস্তাবিত কোন ধারণাই এ বিষয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।’

(ছবি: চার্লস ডারউইন এবং এমা ওয়েজউড.. বার্ধক্যে; ডাউন হাউসে ডারউইন দম্পতির এই প্রতিকৃতিটি একেছেন অজানা একজন শিল্পী; ছবিটি আরো কিছু প্রতিকৃতির সাথে সংরক্ষিত আছে Bridgeman Art Library তে)
ডারউইনের জন্য হুকার এর এই উত্তরটি যথেষ্ট ছিল এর কয়েক মাস পরে এমাকে তার প্রবন্ধটি প্রথম দেখানোর জন্য সকল ইতস্ততা কাটিয়ে উঠতে; তিনি জানতেন এটি পড়ে এমা বেশ অস্থির হয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু তিনি চাইছিলেন যদি তার মৃত্যু হঠাৎ করে কিংবা তাড়াতাড়ি ঘটে যায়, তাহলে যেন এমা তার মৃত্যুর পর যেন এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেন। এমা প্রবন্ধটি পড়েছিলেন, এবং পড়ে তিনি আবেগ তাড়িতও হননি, শুধু যে জায়গাগুলোতে ডারউইনের লেখা খানিকটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে জায়গাগুলো তাকে চিহ্নিত করে দেন; পান্ডুলিপির যেখানে ডারউইন লিখেছিলেন, তিনি কল্পনা করতে পারেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন এমনকি চোখের মত জটিল কিছু তৈরী করতে পারে, সেখানে এমা লিখেছিলেন, ‘বেশ বড় একটি অনুমান’।



(ছবি: চার্লস ডারউইনের স্মারক ভাস্কর্য তার স্কুলের প্রাঙ্গণে - Shrewsbury, Shropshire)
বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: চার্লস ডারউইন - একটি ধারণার বিজয়:
(আগের পর্বগুলো: প্রথম | দ্বিতীয় | তৃতীয় | চতুর্থ পঞ্চম)
Origin of Species এর উদ্ভব
লন্ডনে, ডারউইন আবিষ্কার করলেন তার ভাই ইরাসমাস যথেষ্ঠ পরিমানে নিবেদিত কোনো প্রকৃতি বিজ্ঞানী ছিলেন না; গবেষণার ল্যাবরেটরীর বাইরে ইরাসমাস বরং সাবলীল ছিলেন লন্ডনের নানা ডিনারের পার্টিতে, ভদ্রলোকদের ক্লাবে; তবে তিনি ডারউইনকে তার সামাজিক বলয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর ডারউইনও তাদের সাথে ভালোভাবে মিশে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইরাসমাসের ব্যতিক্রম, ডারউইন অনেক বেশী পরিশ্রমী ছিলেন তার কাজে, তিনি ভূতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লিখেছিলেন, এছাড়া তার বিগল ভ্রমন নিয়ে একটি বইও তৈরী করে ফেলেন খুব দ্রুত; তার সংগ্রহ করে আনা নানা নমুনা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করেন -যেমন জীবাশ্ম, উদ্ভিদ, পাখি এবং ফ্ল্যাট ওয়ার্ম ইত্যাদি।
কয়েক মাসের মধ্যেই ডারউইন তার কঠোর পরিশ্রমের ফলও পেতে শুরু করেন, বৃটেনের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ভূতত্ত্ববিদ হিসাবে তার সুনাম ছড়াতে থাকে; কিন্তু একই সাথে তিনি একটি গোপন বিষয় তার নিজের মধ্যে লালন করাও শুরু করেছিলেন তখন, তার ব্যক্তিগত ছোট নোটবুকগুলোতে তিনি লিখতে শুরু করেন, না তার প্রিয় বিষয় ভূতত্ত্ব নিয়ে না, বরং জীববিজ্ঞান নিয়ে। তিনি চমকে দেবার মত মনোযোগ বিঘ্নকারী একটি সম্ভাবনা নিয়ে ভীষণ আচ্ছন্ন ছিলেন খুবই ব্যক্তিগত ভাবে: হয়তো তার পিতামহ সঠিকই বলেছিলেন।
বৃটেনে তার অনুপস্থিতির পাঁচ বছরে জীববিজ্ঞানও বহু দূর অগ্রসর হয়েছিল। নতুন প্রজাতির আবিষ্কার হয়েছে ধারাবাহিকভাবে এবং শ্রেণীবিন্যাসের ‍প্রাচীন রীতিকে যা চ্যালেঞ্জ করেছে এবং মাইক্রোস্কোপের নীচে বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করেছেন কিভাবে ডিম্বাণু থেকে প্রাণীর সৃষ্টি হয়; বৃটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আর প্যালির প্রতিটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ডিজাইনকে প্রশস্তি করে যাওয়া যুক্তিতে আর সন্তুষ্ট ছিলেন না; কারণ তাদেরকে এটি জীবন সংক্রান্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ ছিল; যদি ঈশ্বর স্বর্গীয়ভাবে জীবনের পরিকল্পনা করে থাকেন, ঠিক কিভাবে তিনি কাজটি করেছিলেন, কিছু প্রজাতির মধ্যে সদৃশ্য আর অন্যদের সাথে তাদের বৈসাদৃশ্যের কারণটাই বা কি? সব প্রজাতি কি একই সাথে পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই অস্তিত্বশীল ছিল? নাকি সময় অতিক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে তাদের ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন?
বৃটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জন্য ঈশ্বর আর কোনো মাইক্রোম্যানেজার ছিলেন না, বরং তার দ্বায়িত্ব ছিল প্রকৃতির নিয়ম সৃষ্টি করা এবং সেগুলোর সূচনা করে দেয়া, এমন কোনো ঈশ্বর যাকে তার সৃষ্টিতে প্রতিটি মুহুর্তে নাক গলাতে হয়, তাকে যে ঈশ্বর যিনি একেবারে শুরুতে সবকিছু নিখুঁতভাবে এবং নির্ভূলভাবে সূচনা করে দিয়েছিলেন, তার চেয়ে মনে হয়েছে যথেষ্ট অযোগ্য; অনেক বৃটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী মেনে নিয়েছিলেন যে এই গ্রহের ইতিহাসে জীবন পরিবর্তিত হয়েছে; অপেক্ষাকৃত সরল গ্রুপের প্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়েছে এবং তাদের জায়গা নিয়েছে জটিলতর গ্রুপগুলো; কিন্তু তারা বিষয়টি দেখতেন একটি সুশৃঙ্খল, স্বর্গীয় নির্দেশনায় পরিচালিত একটি প্রক্রিয়া হিসাবে; কোন পার্থিব বিবর্তন না, যা লামার্ক প্রস্তাব করেছিলেন ১৮০০ সালে, ১৮৩০ এর দশকে আবারো প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের আরো একবার বড় ধাক্কা দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন, প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়ামের আরেক প্রাণিবিজ্ঞানী এতিয়েন জিওফ্রে সঁতিলিয়ার (Etienne Geof roy Saint-Hilaire), একটি নতুন বিবর্তনের তত্ত্ব প্রস্তাব করার মাধ্যমে।

(ছবি: এতিয়েন জিওফরয় সন্তয়িলেয়ার ( Étienne Geoffroy Saint-Hilaire: 1772 – 1844); লামার্কের বিবর্তন ধারণা প্রস্তাবের পরে ফরাসী এই প্রকৃতিবিদ তার নিজের গবেষনার উপর ভিত্তি করেই প্রস্তাব করেন তার নিজের বিবর্তন তত্ত্ব, তুলনামুলক অ্যানাটোমি এবং জার্মান ভ্রুণতাত্ত্বিকদের ভিত্তি করে তিনি দাবী করেন, সকল প্রানীদের শারীরিক গঠনে সদৃশ্যতা, যা সুযোগ করে দেয় এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির রুপান্তর প্রক্রিয়ায়।)
লামার্ক এবং জিওফরয় প্যারিসে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন কয়েক দশক ধরে; কিন্তু জিওফরয় বিবর্তনের ধারণাটিকে গ্রহন করেছিলেন মূলত তার নিজের বিভিন্ন প্রাণীর অ্যানাটমি বা শারীরিক গঠনগত বৈশিষ্টগুলো নিয়ে তুলনামূলক গবেষণর উপর ভিত্তি করেই; সেই সময়কার প্রচলিত ধারণা ছিল, যে প্রাণীরা সদৃশ্য হয় তখনই যখন তারা একই রকমভাবে কাজ করে; কিন্তু জিওফরয় এর নজরে পড়েছিল এই প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম কিছু উদহারণ; যেমন অস্ট্রিচদের উড়তে সক্ষম এমন পাখিদের মতই হাড় আছে অথচ তারা উড়তে পারেনা; এবং জিওফরয় আরো দেখান যে কোনো প্রজাতির বিশেষ একগুচ্ছ মূল বৈশিষ্ট্য যা তাদের জন্য অনন্য একটি বিশেষ চিহ্ন হিসাবে শনাক্ত করা হয়, তারা আসলে একক ভাগে অনন্য কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয় শুধু মাত্র সেই প্রজাতির জন্য; যেমন গন্ডারে শিঙ তাকে বিশেষ অনন্যতা প্রদান করছে বলে মনে হয় ঠিকই, কিন্তু আসলে এটি ঘণ চুলের একটি গোছা মাত্র;
জিওফরয় যখন বিভিন্ন প্রাণিদের মধ্যে গোপন সংযোগটি উদঘাটন করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি জার্মান জীববিজ্ঞানীদের কাজ দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তারা বিজ্ঞানকে দেখেছিলেন জীবনের গোপন ঐক্যতার খোজার একটি অতীন্দ্রিয় প্রচেষ্টা হিসাবে। কবি ( এবং বিজ্ঞানী) গ্যেটে প্রস্তাব করেছিলেন কোনো উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ – এর পাপড়ি থেকে কাটা, সবই একটি মৌলিক ফর্ম বা গঠনেরই নানা রুপ: পাতা; এই সব জার্মান জীববিজ্ঞানীদের জন্য, জীবনের সকল জটিলতা লুকিয়ে আছে কিছু নির্দিষ্ট চিরন্তন ফর্ম বা মডেল এ, যাদের তারা নাম দিয়েছিলেন আর্কিটাইপ বা আদিরুপ; জিওফরয় সকল মেরুদন্ডী প্রাণিদের সেই আদিরুপটি সন্ধান করার প্রচেষ্ঠা করেছিলেন।

(ছবি:জিওফরয় এর প্রস্তাবিত বিবর্তনের ধারণায় ইউনিফর্মিটি অব ডিজাইন একটি উদহারণ; তিনি প্রস্তাব করেছিলেন প্রতিটি প্রানীরই গঠনগত মৌলিক সাদৃশ্য আছে, সেটাই বিবর্তনের কারন হবার সম্ভাবনা আছে।)
জিওফরয় প্রস্তাব করেছিলেন, প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণির কংকাল কাঠামোর প্রতিটি অস্থি হচ্ছে একটি আদিরুপের মেরুদণ্ডী প্রাণির একটি ভিন্ন ভিন্ন রুপ বা প্রকরণ; তিনি এরপর তার ধারণাটি আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে নেন, দাবী করেন যে অমেরুদণ্ডী প্রাণিরা এই সুবিশাল পরিকল্পনারই অংশ; একটি লবস্টার এবং একটি হাস, তার যুক্তি অনুযায়ী একটি মুল পরিকল্পনা বা থিমেরই ভ্যারিয়েশন বা ভিন্নরুপ মাত্র; লবস্টাররা হচ্ছে সন্ধীপদী প্রানী, যে গ্রুপে আছে কীট পতঙ্গ, চিংড়ী এবং হর্স সু ক্র্যাব বা কাকড়া ইত্যাদি প্রাণিরা; সন্ধীপদীরা মেরুদন্ডীদের সাথে খুব হালকা একটি সদৃশ্য বহন করে: তাদের শরীর এর দীর্ঘতম অক্ষ বরাবর প্রতিসম, তাদের চোখ আর মুখ সহ একটি মাথা আছে; কিন্তু পার্থক্য বরং আরো অনেক বেশী, সন্ধীপদীরা তাদের শরীরের বাইরে একটি শক্ত খোলস বা শেল তৈরী করে, আর মেরুদন্ডীরা করে তাদের শরীরের অভ্যন্তরে; মেরুদন্ডীদের একটি স্নায়ুরজ্জু আছে যা তাদের শরীরের ঠিক পেছন বা পিঠ বরাবর থাকে, এবং পরিপাকতন্ত্র যা তাদের শরীরের সামনে থেকে পেছনে বিস্তৃত; লবস্টার কিংবা যেকোন সন্ধীপদী প্রাণিদের ক্ষেত্রে এই প্যাটার্ণটি ঠিক উল্টো হয়ে যায়; পেছন বা পিঠ বরাবর তাদের পরিপাক তন্ত্র থাকে, এবং তাদের স্নায়ুতন্ত্র থাকে পরিপাকতন্ত্রের সামনে পেট বরাবর; যা দেখে মনে হতে পারে সন্ধীপদীদের সাথে মেরুদন্ডীদের তুলনা করা সম্ভব না, কিন্তু জিওফরয় কিন্তু তেমন করে ভাবলেন না; তিনি দাবী করেন যে সন্ধীপদীরা একটি একক মেরুদন্ডের মধ্যে বাস করে, এবং খুব সাধারণ ব্যপার এদের পেটকে পিঠের পরিবর্তন করা আর এভাবে একটি লবস্টারকে হাসের প্যাট্যার্নে নেয়া যায়; সন্ধীপদীদের মেরুদন্ডীদের মতই একই ডিজাইন আছে শুধু উল্টো, ‘দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বললে, শুধুমাত্র একটি মাত্র প্রাণি আছে’ জিওফরয় দাবী করেছিলেন।
১৮৩০ সালে জিওফরয় তার তত্ত্বটিকে আরো একধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যান; এই রুপান্তরগুলো শুধু মাত্র জ্যামিতিক আর বিমূর্ত ধারণা না, তিনি দা্বী করেন, সময়ের সাথে সাথে প্রাণিরাও তাদের আকারও পরিবর্তন করে থাকে; জিওফরয় তার বিবর্তন তত্ত্বে কিন্তু লামার্ককে পুনরুজ্জীবিত করেননি, তিনি লামার্কের ধারণা যে, কোনো একটি বৈশিষ্ট্য যা কোনো প্রাণি তার জীবদ্দশায় অর্জন করে, সেটি ‍তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও বিস্তার লাভ করতে পারে, এমন হাইপোথিসিসটি গ্রহন করেননি, তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, কোনো প্রাণির পরিবেশের কোনো পরিবর্তনই একটি ডিম থেকে কিভাবে এটি বেড়ে উঠছে সেটিকে পরিবর্তন করতে পারে এবং এভাবে ভিন্ন কোনো রুপের বিচিত্র প্রাণির জন্ম হতে পারে, এবং তারাই নতুন প্রজাতি হয়।
জিওফরয় দাবী করেন, আপনারা এই বিবর্তনের ইতিহাস দেখতে পারবেন, যদি লক্ষ্য করেন কিভাবে খুব সরল একটি আকার বা ফর্মের ভ্রুণ থেকে ধীরে ধীরে জটিলতর প্রাণির উদ্ভব হয়। জার্মান বিজ্ঞানীরা তখন আবিষ্কার করছিলেন কিভাবে ভ্রুণগুলো মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানেই একটি বিচিত্র ফর্ম থেকে অন্য একটি বিচিত্র ফর্মে রুপান্তরিত হতে পারে; কখনও যে রুপটি এই ভ্রুণ থেকে সৃষ্ট হওয়া পুর্ণ বয়স্ক কোনো প্রাণীর সাথে কোন সাদৃশ্যই বহন করেনা; গবেষকরা যত্নের সাথে তাদের বিভিন্ন ‍অংশ এবং আকৃতির রুপান্তর লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, এবং যতই তারা লক্ষ্য করেন ততই তারা একটি সুশৃঙ্খল ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করেন এই সংশয়ের মধ্যে; বিশেষ করে তারা মুগ্ধ হন দেখে যে কিভাবে একটি ভ্রুণ খুব সাধারণ রুপ ও সরল একটি গঠন থেকে তার যাত্রা শুরু করার পরে ধীরে ধীরে আরো জটিলতর হয়ে উঠে।
তারা এমনকি দাবী করেন যে এই প্রতিটি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকা জটিল রুপ তার এই ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে একটি নুতন ধাপ সংযুক্ত করছে; লরেন্জ ওকেন, একজন জার্মান বিজ্ঞানী এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে; ‘ ভ্রূণ ক্রমবিকাশের সময় কোন একটি প্রাণি, প্রাণি জগতের সব পর্বগুলোই অতিক্রম করে, এবং নতুন অঙ্গ ধারণ করার মাধ্যমে এটি ভিন্ন ভিন্ন রুপে নতুন ধাপে বের হয়ে আসে; গর্ভের ভ্রুণ হচ্ছে সময়ের প্ররিক্রমায় সকল প্রাণি শ্রেণীরই প্রতিনিধি।’ প্রথমে এটি দেখতে নলের মত, যেন কোনো কেঁচো বা ওয়ার্ম; এরপর এটি একটি যকৃত, রক্ত পরিসঞ্চালন তন্ত্র গঠন করে এবং একটি মোলাস্ক জাতীয় প্রানীতে পরিণত হয়, এরপর হৃৎপিন্ড এবং একটি জননাঙ্গ সহ এটি রুপান্তরিত হয় একটি শামুকে; এরপর যখন এর হাত পা বা লিম্ব বের হয়ে আসে, এটি পরিণত হয় একটি পতঙ্গে, এরপর যখন তার অস্থি তৈরী হয়, এটি রুপান্তরিত হয় মাছে; মাংসের সাথে সরীসৃপে এবং এভাবে মানব জাতি অবধি; ওকেন ঘোষণা করেন, ‘মানুষ হচ্ছে সেই চুড়ান্ত শিখর, প্রকৃতির ক্রমবিকাশের রাজ মুকূট।’

(ছবি: লরেন্জ ওকেন, জার্মান জীববিজ্ঞানী)
জিওফরয় প্রস্তাব করেন, ভ্রুণরা শুধুমাত্র প্রকৃতির এই ধারাবাহিক ক্রমোন্নতির ধাপ বেয়ে উপরেই উঠে আসে না; তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও বা এর বিবর্তনের নানা ধাপের পুনরাবৃত্তিও প্রদর্শন করে; মানুষের পূর্বসূরি প্রাণি আসলে মাছ, যার প্রমাণ ভ্রুণ ক্রমবিকাশের একটি আদি পর্বে আমাদের ফুলকা সদৃশ উপাঙ্গ থাকে।
যখন জিওফরয় এভাবে বিবর্তনের পক্ষে তার যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন, ইউরোপীয় অভিযানকারীরা নানা নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে চলেছেন যা তিনি দাবী করেন তার প্রস্তাবিত তত্ত্বের সাথে মানানসই; অষ্ট্রেলিয়ার প্লাটিপ্যাস যেমন, একটি স্তন্যপায়ী, এর ঠোঁট হাসের মতো এবং এটি ডিম পাড়ে, যা জিওফরয়কে অনুপ্রাণিত করেছিল এটিকে স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপের মধ্যবর্তী একটি ক্রান্তিকালীর অবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করতে; এছাড়া ব্রাজিলে অভিযানকারীরা খুজে পেয়েছিলেন লাঙ ফিশ, যারা ফুলকার বদলে ফুসফুসের মাধ্যমে শ্বাস নিতে পারে, তারা হয়তো বা পানিতে বসবাসকারী মেরুদন্ডী প্রাণিদের সাথে স্থলে বসবাসকারী মেরুদণ্ডী সংযোগকে প্রতিনিধিত্ব করে।
তবে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত সব বিজ্ঞানীরা লামার্কে মতবাদের মতই জিওফরয় এর প্রস্তাবকে আদৌ গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচনা করেননি; অ্যাডাম সেজউইক, কেমব্রিজের ধর্ম নিবেদিত প্রাণ ভূতাত্বিক, দুই ফরাসীর কাজকে উল্লেখ করেছিলেন, ‘উদ্ভট রকম জঘন্য (আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি নোংরা) শারীরবৃত্তীয় বা ফিজিওলজির দৃষ্টিভঙ্গি’। কিন্তু যদিও বৃটিশ বিজ্ঞানীরা গড়পড়তা সবাই বিবর্তনের ধারণাটিকে প্রকাশ্যেই অপছন্দ করতেন, তবে এটিকে সরাসরি আক্রমন করার দ্বায়িত্ব পড়েছিল একজন মানুষের উপরে: তিনি ছিলেন দুর্দান্ত মেধাবী একজন তরুণ অ্যানাটোমিষ্ট রিচার্ড ওয়েন।
প্রায়শই ওয়েন ই হতেন প্রথম বৃটিশ অ্যানাটোমিষ্ট যিনি নতুন প্রজাতি পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পেতেন, যেমন লাঙ ফিশ বা প্ল্যাটিপাস; এবং তিনি এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়েছিলেন জিওফরয় এর বিবর্তনের স্বপক্ষে দেয়া দাবীগুলো খন্ডানোর জন্য; ওয়েন দেখান যে প্লাটিপাসরা দুধ নিঃসরণ করে, যা স্তন্যপায়ী প্রানীদের একটি বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন; আর লাঙ ফিস, যদিও তাদের ফুসফুস আছে, কিন্তু তাদের নাকের কোন ছিদ্র নেই; যা সকল স্থলবাসী মেরুদন্ডীদের মধ্যে বিদ্যমান; এবং তাদেরকে সাধারণ মাছ হিসাবে বিবেচনা করার জন্য ওয়েন এর জন্য এটুকই যথেষ্ট।

(ছবি: প্ল্যাটিপাস, (Ornithorhynchus anatinus), duck-billed platypus নামেও পরিচিত)

(ছবি: Spotted African lungfish (Protopterus dolloi) এর ফুসফুস)
তারপরও ওয়েন নিজে কিন্তু মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না শুধুমাত্র এটুকু বলে যে ঈশ্বর জীবন সৃষ্টি করেছেন এবং এর ডিজাইন তার মহিমাকে প্রতিফলিত করে; ওয়েন এই সৃষ্টির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন; বিবর্তন সম্বন্ধে জিওফরয় এর এধরনের লাগাম ছাড়া কল্পনাকে ওয়েন এর জন্য সহ্য করা কঠিন ছিল, কিন্তু তিনি যথেষ্ট ভালো মাপের একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী ছিলেন, সুতরাং অস্বীকার করার উপায় ছিল না, তিনি কিছু কিছু বিষয়ে ঠিকই ধারনা করেছিলেন; বিভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে সদৃশ্যতা এবং যেভাবে তাদের পরিবর্তনের নানা ধাপের একটি ক্রমবিন্যাসে শ্রেণীভুক্ত করা যায় সেই বিষয়টা খুব স্পষ্ট যা অস্বীকার করা কঠিন।

(ছবি: অত্যন্ত প্রভাবশালী বৃটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন (Sir Richard Owen, 1804 – 1892); অন্তত দুটো কারনে তাকে কেউই ভুলতে পারবেন না, প্রথমত তিনি ডায়নোসরদের নামকরণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয়ত তিনি তার স্বর্বস্ব দিয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধীতা করেছিলেন; বিবর্তন হচ্ছে একমত হলেও ডারউইনের প্রস্তাবিত মতে বিবর্তনের বিরোধী ছিলেন; সাম্প্রতিক কালে evolutionary developmental biology র গুরুত্বপুর্ণ কিছু আবিষ্কার রিচার্ড ওয়েন এর প্রস্তাবটিকে নতুন আলোকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে; ১৮৮১ সালে তিনি মুল চালিকা শক্তি ছিলেন লন্ডনের অসাধারণ British Museum of Natural History প্রতিষ্ঠা করার জন্য।)
ওয়েন এর ধারণা জিওফরয় এই প্রমাণগুলোর ব্যাখ্যায় একটু বেশী লাফ দিয়ে ফেলেছেন তার অনুসিদ্ধান্তে; যেমন ওয়েন জানতেন, একটি ভ্রুণ কিভাবে গড়ে ওঠে সে বিষয়ে জিওফরয় এর ধারণা নতুন কিছু গবেষণা লব্ধ তথ্য ইতিমধ্যে প্রতিস্থাপিত করেছে;একজন প্রুশিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ভন বায়ের যেমন তার গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে জীবন কোনো সাধারণ মই এর মত না, যেখানে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রাণিদের ভ্রুণ ক্রমবিকাশের সময় অপেক্ষাকৃত আদি প্রাণিদের ক্রমবিকাশের ধাপগুলোর রিক্যাপিচুলেট বা সংক্ষিপ্ত আকারে পুনরাবৃত্তি করে; ভ্রুণের সবচেয়ে পুরোনো স্তরে মেরুদন্ডীরা সাধারণত একে অপরের মত দেখতে হয়, এরকারন শুধুমাত্র তারা তখন একগুচ্ছ কোষ ছাড়া আর কিছু না, সময় যত অতিক্রান্ত হয়, এদের রুপও বৈশিষ্ট্যসূচক হতে থাকে।
মাছ,পাখি এবং স্তন্যপায়ীদের লিম্ব বা হাত পা গুলো সবকটি ভ্রূণে লিম্ব বাড হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু সময়ের সাথে সেই লিম্ব বাডগুলোই পরিণত হয় হাত, ক্ষুর, ডানা এবং অন্যান্য নানা ধরনের লিম্ব এ, যা সেই মেরুদন্ডী প্রাণিদের জন্য বৈশিষ্ট্যসূচক; কোন এক ধরনের কিছু অন্য কোন ধরনের কিছু তৈরী করেনা, ‘নিখুঁত কিংবা জটিলতম হবার ধারাবাহিকতায় একটি সরলরৈখিক বিন্যাস অসম্ভব’ ভন ব্যায়ের লিখেছিলেন; ওয়েন এর উচ্চাকাঙ্খা ছিল ভন বায়ের,জিওফরয় এবং তার সময়ের আরো বিখ্যাত জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা লব্ধ তত্ত্বগুলোকে একটি সুতোয় বেধে জীবনের একটি মহান তত্ত্ব প্রস্তাব করার। তিনি বিবর্তনের ধারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা করার জন্য প্রাকৃতিক সূত্র বা নিয়ম খোজার চেষ্টা করেছিলেন যা জীবাশ্ম এবং ভ্রুণে প্রাপ্ত সব প্রমানের ব্যাখ্যা দিতে পারে;
বিগল ফিরে আসবার তিন সপ্তাহ পর ডারউইনের সাথে তার দেখা হয়, তারা দুজনেই লাইয়েলের বাসায় একটি নৈশভোজের নিমন্ত্রণে এসেছিলেন, যেখানে ডারউইন চিলিতে তার ভুমিকম্পের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে সবাইকে বিস্মিত করেছিলেন; নৈশভোজের পর লাইয়েল এই দুই তরুণকে ( ওয়েন ডারউইনের চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরে বড় ছিলেন) পরিচয় করিয়ে দেন, দুজনে বেশ চমৎকার বোঝাপড়াও হয়, এবং ডারউইন বুঝতে পারেন ওয়েন যথেষ্ঠ পরিমান বিখ্যাত যিনি তার জীবাশ্মগুলোকে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা নিয়ে আসতে পারবেন; তিনি ওয়েনকে সেই রাতে তার জীবাশ্মগুলো পরীক্ষা করে দেখার আহবান জানান, ওয়েনও আনন্দের সাথে রাজী হন, কারণ এটাই তার সুযোগ তার ধারাণাগুলো কেউ কোনোদিন দেখেনি এমন জীবাশ্মের উপর পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
অবশ্য সেদিন তার জানা ছিল না ডারউইন একদিন তাকেও জীবাশ্মে পরিণত করবে।

(ছবি: Charles Darwin, ভাস্কর: Léon-Joseph Chavalliaud (c.1858-1921),The Palm House, Sefton Park, Liverpool)
................



(ছবি: চার্লস ডারউইন এর ১৮৩৭ সালের নোট বুকে আকা প্রথম জীবন বৃক্ষের রেখাচিত্র, যা প্রতিটি জীব সম্পর্কযুক্ত এবং ট্রান্সমিউটেশনের এই বিষয়টি নিয়ে তার ভাবনাকে ইঙ্গিত করেছিল)


সংশয় আর ভিন্নমত যেন ধর্মদ্রোহিতা
বিগল ফিরে আসার পার চার মাস পর, ডারউইন তার সংগ্রহ করে আনা জীবাশ্ম ও প্রাণীদের নমুনাগুলোর বিষয়ে নানা বিশেষজ্ঞদের মতামত পেতে শুরু করেন; শুরুতেই তাদের বক্তব্যগুলো মূলত তাকে সংশয়াচ্ছন্ন করেছিল; ওয়েন তার জীবাশ্ম স্তন্যপায়ীর নমুনাগুলো পরীক্ষা করে প্রস্তাব করেন এগুলো দক্ষিন আমেরিকায় বসবাসকারী কিছু প্রাণীরই দানবীয় সংস্করণ; ইদুর জাতীয় প্রাণীর আকার প্রায় জলহস্তির মত আর পিপাড়া খেকো অ্যান্ট ইটার আকারে প্রায় ঘোড়ার সমতুল্য; কেন, ডারউইন ভাবতে শুরু করেন, একই ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারী জীবিত প্রাণীদের সাথে এইসব বিলুপ্ত প্রানীদের মধ্যে কেন এই যোগসূত্র বা একটি সম্পর্ক বিদ্যমান; তাহলে কি হতে পারে সব জীবিত প্রানীরা বিলুপ্ত প্রানীদের থেকে আকারে পরিবর্তিত হয়ে উদ্ভব হয়েছে?
ডারউইন তার গালাপাগোস থেকে আনা পাখিগুলো দিয়েছিলেন জন গ্যুল্ডকে, যিনি ছিলেন বৃটেনের একজন প্রথম সারির পক্ষীবিশারদ, ডারউইন যখন তাদের সংগ্রহ করেছিলেন, তখন তাদের বিষয়ে আলাদা করে তিনি কিছু ভাবেননি; কিন্তু যখন গ্যুল্ডকে জুওলজিক্যাল সোসাইটির একটি সভায় কথা বলতে শোনেন তিনি, সঠিকভাবে নোট না নেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছিলেন তিনি; তাদের ঠোট দেখে ডারউইন এই পাখিদের শনাক্ত করেছিলেন ফিন্চ, রেন আর ব্ল্যাক বার্ড হিসাবে, কিন্তু গ্যুল্ড তার পরীক্ষার পর ঘোষনা দেন এগুলো সবই আসলে ফিন্চ; শুধু তাদের ঠোটগুলো কারো রেন দের মত , কারো ব্ল্যাক বার্ড দের মত দেখতে, যা তাদের কোন নির্দিষ্ট ধরনের খাওয়া খেতে সহায়তা করে।
এবং পরে ডারউইন গ্যুল্ড এর সাথে দেখা করতে যান, গ্যুল্ড তাকে দেখান যে তিনি আরো বড় কিছু ভুল করেছিলেন, ডারউইন ঠিক মতো উল্লেখ করেননি কোন দ্বীপ থেকে তাদের বেশীর ভাগ সংগ্রহ করেছিলেন, কারণ তখন তার কাছে এটা গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়নি; ঘটনাক্রমে তিনি শুধু নোট করেছিলেন, তিনটি মকিং বার্ড এসেছে তিনটি ভিন্ন দ্বীপ থেকে; এবং গ্যুল্ড তাকে দেখালেন, যে এই মকিংবার্ডগুলো আসলে তিনটি নতুন এবং ভিন্ন প্রজাতির সদস্য; ডারউইন অনুধাবন করতে পারলেন, নিশ্চয়ই কোনো একটি ব্যাপার আছে; তার ভাবনায় তখন প্রশ্ন, এত কাছাকাছি একটি জায়গায় কেন তিনটি ভিন্ন প্রজাতির মকিং বার্ড থাকবে?

(ছবি:John Gould, ডারউইন গালাপাগোস থেকে আনা পাখিগুলো দিয়েছিলেন জন গ্যুল্ডকে, যিনি ছিলেন বৃটেনের একজন প্রথম সারির পক্ষীবিশারদ, ডারউইন যখন তাদের সংগ্রহ করেছিলেন, তখন তাদের বিষয়ে তিনি আলাদা করে কিছু ভাবেননি; কিন্তু যখন গ্যুল্ডকে জুওলজিক্যাল সোসাইটির একটি সভায় কথা বলতে শোনেন তিনি, সঠিকভাবে নোট না নেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছিলেন তিনি; তাদের ঠোট দেখে ডারউইন এই পাখিদের শনাক্ত করেছিলেন ফিন্চ, রেন আর ব্ল্যাক বার্ড হিসাবে, কিন্তু গ্যুল্ড তার পরীক্ষার পর ঘোষনা দেন এগুলো সবই আসলে ফিন্চ; শুধু তাদের ঠোটগুলো কারো রেন দের মত , কারো ব্ল্যাক বার্ড দের মত দেখতে, যা তাদের কোন নির্দিষ্ট ধরনের খাওয়া খেতে সহায়তা করে।)
তাহলে কি ভিন্ন প্রজাতির ফিন্চরাও ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী ছিল? ডারউইন ফিটজরয়ের সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেন, জাহাজের অন্যান্য নাবিকরা যে পাখিগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তাদের কিছু নমুনা যেন গ্যুল্ডের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়; সৌভাগ্যক্রমে জাহাজের অন্যান্যরা ডারউইনের চেয়ে সতর্ক ছিলেন নমুনার বিবরণ নোট করার ব্যাপারে, তারা লিখে রেখেছিলেন কোন দ্বীপ থেকে তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে; এবং ঠিক মকিং বার্ডের মতই বিভিন্ন দ্বীপের ফিন্চগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্য।

(ছবি: গালাপাগোসের ফিন্চরা..তারা ভিন্ন তাদের ঠোটে বা বীকের আকার, নীড় বানাবার জায়গা, খাদ্যাভাস দ্বারা।)
বিষয়টি ডারউইন অনুধাবন করতে পারলেন - একটি খটকার বিষয়, কেন এতগুলো স্বতন্ত্র প্রজাতির অস্তিত্ব থাকবে একই ধরনের দ্বীপগুলোতে; তিনি তার নোটবুক খুললেন এবং গালাপাগোসদের ফিন্চ সম্বন্ধে একটি ব্যাখ্যা খোজার চেষ্টা করতে শুরু করেন; তার চারপাশের মানুষগুলোর কাছে, ভূতত্ত্ব বিষয়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা ডারউইনের কোন পরিবর্তন কারো নজরে পড়ে নি; তিনি একনিষ্ঠ মনে প্রবাল প্রাচীর, উত্থিত সমতল আর আগ্নেয়গিরির কোণাকৃতি শৃঙ্গ নিয়েই লিখছিলেন, কিন্তু তার গোপন ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আচ্ছন্ন হয়েছিলেন একটি অসাধারণ ধারণায়; হয়তো ফিন্চগুলো বর্তমান এই রুপে সৃষ্টি হয়নি, হয়তো তারা বিবর্তিত হয়েছে।

(ছবি: ফিন্চ (চার্লস ডারউইনের 1839 Journal of Researches Into the Natural History and Geology of the Countries Visited During the Voyage of HMS Beagle Round the World, Under the Command of Captn. FitzRoy, R.N. থেকে)
যে ভূমিতে প্রজাতিদের বসবাস, সেই ভূখণ্ডে অবশ্যই চিরন্তনভাবে অপরিবর্তনীয় নয়; ডারউইনের ফিন্চরা এখন এমন কোনো দ্বীপে বাস করে যা কোনো একসময় সমুদ্রের মধ্যে জেগে উঠেছিল প্রাকৃতিক শক্তিতে, যখনই গালাপাগোস সাগর পৃষ্ঠের উপরে উঠে এসেছে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সাধারণ ফিন্চরা হয়তো এই দ্বীপে বসতি গেড়েছিল তারপর কোনো এক সময় এবং সময়ের পরিক্রমায় এদের বংশধররাই বিবর্তিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে, তাদের বৈশিষ্ট্যসূচক শরীর সহ, যা এখন খাপ খাইয়ে নিয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্যমূলক জীবনাচরণের সাথে; আদি নিবাসীদের বংশধররাই পৃথক পৃথক বংশধারায় শাখা প্রশাখার সূচনা করেছে; এই একই ভিন্ন ভিন্ন বংশধারায় শাখা প্রশাখা সৃষ্টি হবার ঘটনাও হয়তো ঘটেছে পাতাগোনিয়াতেও, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে? ডারউইন যে দানবাকৃতির স্তন্যপায়ীদের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন, তারাই সেখানকার বর্তমান ক্ষুদ্রকায় শরীরের স্তন্যপায়ীদের উদ্ভবের কারণ।

(ছবি: ডারউইনের B নোটবুকের ৩৬ তম পাতায় আকা জীবন বৃক্ষ, উপরে এক কোনে লেখা সতর্ক ডারউইনের মন্তব্য I think….)
তার নোটবুকে, ডারউইন একটি গাছের রেখাচিত্র আকেন, যেখানে পুরোনো প্রজাতি শাখা বিভক্ত হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টির করছে; তার নিজের ধারণাই তাকে রীতিমত শঙ্কিত করে তোলে, তার এই একাগ্র চিন্তা তার দ্রুত হৃদস্পন্দন আর পেটের ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়, অজানা আশঙ্কায় তিনি ভুগতে থাকেন; মাঝে মাঝে অদ্ভুত স্বপ্নে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত মাঝরাতে; তিনি জানতেন যে প্রাকৃতিক আইন ফিন্চ এবং স্তন্যপায়ীদের উপর কাজ করছে, সেই প্রাকৃতিক আইন অবশ্যই মানুষের উপরেরও কাজ করছে একইভাবে; তিনি মানুষকে জীবজগতে শুধু আরো একটি প্রজাতি সদস্য হিসাবে ভাবতে শুরু করেন, যদিও তাদের বাড়তি কিছু মানসিক দক্ষতা আছে।

(ছবি: গালাপাগোস এর ফিন্চরা, মুল দক্ষিন আমেরিকার ফিন্চ থেকেই বিবর্তিত হয়েছে গালাপাগোসের ফিন্চরা)
তার নোটবইতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোন একটি প্রাণীকে অন্য প্রাণী থেকে বিশেষ কোন উচ্চ অবস্থানে ভাবা বা এমনভাবে কিছু বলা আসলেই অর্থহীন, মানুষ প্রায়ই বুদ্ধিমান মানুষের আবির্ভাব হবার অসাধারণ চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলে থাকেন – কিন্তু পতঙ্গদের আবির্ভাব অন্যার্থে আরো বেশী বিস্ময়কর, সারা পৃথিবীর ভরা অপুর্ব সুন্দর সাভানা আর জঙ্গল দেখে কে বলতে সাহস পায় বুদ্ধিমত্তাই হচ্ছে এই পৃথিবীর একমাত্র লক্ষ্য ? হয়তো মানুষও, ঠিক ফিন্চদের মতই বিবর্তন প্রক্রিয়ারই ফসল’।
জেনী নামে সদ্য সংগ্রহ করাএকটি ওরাং উটানকে দেখতে ডারউইন লন্ডন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে তার মুখে ঠিক সেই অভিব্যক্তিগুলো লক্ষ্য করেছিলেন যা তিনি শিশুদের মধ্যেও দেখেছিলেন;
তার নোট বইয়ে তিনি লেখেন, এইপ থেকে মানুষ?
যদিও তার সমস্ত ধারণা তখনও ভ্রুণ পর্যায়ে, ডারউইন জানতেন তারা যথেষ্ট বিপদজ্জনক; মানুষ বিবর্তিত হয়েছে এমন কোন একটি ঘোষণা তাকে হয়তো চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে লাইয়েল এবং অন্যান্য প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে, যাদের তিনি শ্রদ্ধা করেন এবং যাদের উপর তার পেশাগত ভবিষ্যত নির্ভর করছে; তাসত্ত্বেও ডারউইন তার নোটবুকে লিখে যেতে থাকেন তার ভাবনাগুলো, ধীরে ধীরে বুনতে থাকেন তার তত্ত্বটিকে, এর স্বপক্ষে জমা করতে থাকেন প্রয়োজনীয় স্বাক্ষ্য প্রমাণগুলো।
ডারউইন সেই চিহ্নগুলো খুজতে থাকেন, কিভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় এবং কিভাবে তারা পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়; যারা বাগান করেন, চিড়িয়াখানার পশুপাখি সংরক্ষক, কবুতরের নানা জাত তৈরী করেন আর পালেন, তিনি এমন সবার সাথেই কথা বলেন; এমনকি তার চুল কাটতেন যিনি, তার কাছে কুকুরের নানা জাতের প্রজনন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন । যদিও তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন প্রজাতি অপরিবর্তনশীল কোনো একটি অবস্থা না; তবে তার তখনও পর্যন্ত জানা ছিল না কি উপায়ে একটি প্রজাতি নতুন একটি রুপ নিতে পারে বিবর্তনের মাধ্যমে; লামার্ক দাবী করেছিলেন যে কোনো প্রানী তার জীবনকালে বদলে যেতে পারে, এবং তার অর্জিত নানা বৈশিষ্ট্যাবলী তার পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে পারে, কিন্তু তেমন কোনো স্বাক্ষ্য প্রমাণ ছিল না এটা আসলেই ঘটছে কিনা?
১৭৯৮ সালে থমাস মালথাস, গ্রামের একজন পাদ্রী, জনসংখ্যার মূলনীতি নিয়ে একটি রচনা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, কোন একটি দেশের জনসংখ্যা, যদি তা কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা না পায়, যেমন অনাহার বা ব্যাধি,কয়েক বছরের মধ্যেই তা বহু গুণে বেড়ে যাবে; যদি প্রতিটি দম্পতি চারটি করে সন্তান লালন করেন, তাহলে জনসংখ্যা খুবই সহজে দ্বিগুণ হবে ২৫ বছরে এবং এর পর থেকে এটি তার দ্বিগুণ হতে থাকবে, এটি ৩,৪,৫ এবং এভাবে গাণিতিক হারে বাড়বে না বরং বাড়বে, ৪,৮,১৬ এভাবে দ্বিগুন হারে।

(ছবি: থমাস রবার্ট মালথাস , Reverend Thomas Robert Malthus,1766 – 1834); জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর একটি লেখা An Essay on the Principle of Population ডারউইনকে অনুপ্রাণিত করেছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারনাটিতে পৌছাতে… পরে একই প্রবন্ধ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসকেও অনুপ্রাণিত করেছিল একই উপসংহারে পৌছাতে।)
যদি কোনো দেশের জনসংখ্যা এভাবে বিস্ফোরিত হয়, মালথাস সতর্ক করেন, কোনো আশা করার উপায় নেই যে সেখানে খাদ্য সরবরাহ একই হারে বাড়বে, নতুন জায়গা পরিষ্কার করে হয়তো চাষাবাদও করা যেতে পারে, বা ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে, তবে এই বৃদ্ধি গাণিতিক, জ্যামিতিক না; আর অনিয়ন্ত্রিত কোনো বাধাহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই দুর্ভিক্ষ আর দুর্ভোগের কারণ হবে; মানবতা যে এখনও বিরামহীন দুর্ভিক্ষাবস্থায় নেই এক একটিমাত্র কারণ হচ্ছে এর বৃদ্ধি সবসময় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে বেশ কিছু শক্তি যেমন, নানা অসুখ, শিশ মৃত্যু এবং এমনকি শুধুমাত্র মাঝ বয়স অবধি বিবাহ ঠেকিয়ে রেখে।
মালথাস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, যে শক্তি বা প্রজনন উর্বরতা এবং অনাহার কিংবা খাদ্য ঘাটতির যে নিয়ামকগুলো মানব জাতিকে প্রভাবিত করে, তারা প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপর একই ভাবে প্রভাব ফেলে; যদি মাছিদের লার্ভা বা ম্যাগট উৎপাদন কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া অব্যাহত থাকে, কিছুদিনের মধ্যে সারা পৃথিবী আমাদের হাটু অবধি মাছির ম্যাগটে ভরে যাবে; বেশীর ভাগ মাছি ( এবং প্রতিটি প্রজাতির বেশীর ভাগ সদস্য) অবশ্যই কোন উত্তরসূরি না রেখেই মারা যায়।
ম্যালথাসেই এই উৎকন্ঠা উদ্রেককারী রচনাটিতে, ডারউইন তার বিবর্তন প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে পরিচালনাকারী শক্তি বা ইন্জিনটিকে খুজে পেলেন; সৌভাগ্যবান অল্প কিছু সদস্য যারা প্রজননে সফল হয়, তারা শুধুমাত্র ভাগ্য দ্বারা চিহ্নিত হয়নি; কোনো কোনো সদস্যদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট থাকে যা তাদের বিশেষ কোনো অবস্থায় ভালোভাবে টিকে থাকতে ( বাঁচা এবং প্রজনন) সহায়তা করে; হতে পারে এরা প্রাণী বিশেষে আকারে বড় হতে পারে, কিংবা কোনো পাখির ক্ষেত্রে তাদের হয়তো বিশেষভাবে সরু ঠোট থাকে, বা অন্য কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে যার গায়ে বাড়তি মোটা লোমের স্তর আছে; এবং এই সব ক্ষেত্র গুলোতে প্রজাতির যে সদস্যরা এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে জন্ম নেবে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বা বংশধর রেখে যাবার সম্ভাবনা প্রজাতির অন্যান্য দুর্বল সদস্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী, এবং যেহেতু বংশধররা তাদের পিতামাতার মত হয়, তারাও তাদের টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মেও হস্তান্তর করবে।
এই ভারসাম্যহীনতা সম্ভবত খুব সামান্য হতে পারে, যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সহজে চোখে পড়েনা; কিন্তু সহজে বোঝা যায় না এধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন যা পর্বত তৈরী করতে পারে, তা ডারউইন ইতিমধ্যেই স্বাচ্ছন্দের সাথে বুঝতে পেরেছিলেন; এখানে সেই সুবিশাল পর্বতই তৈরী হচ্ছে তবে তার প্রকৃতি হচ্ছে জৈববৈজ্ঞানিক; যদি পাখিদের কোনো একটি জনগোষ্ঠী গালাপাগোস দ্বীপে এসে বসতি গড়ে, সেই গোষ্ঠীর যে সদস্যরা সেই বিশেষ দ্বীপের পরিবেশের জীবনের সাথে সবচে বেশী মানানসই তারাই টিকে থাকবে এবং পরবর্তী বংশধর প্রজননে সক্ষম হবে; এবং যথেষ্ট পরিমান সময়ের পরিক্রমায় এই পরিবর্তনগুলোই সৃষ্টি করতে পারে নতুন কোন প্রজাতি।
কৃষকরা যেভাবে তাদের ফসলের রক্ষণা বেক্ষণ করেন সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে ডারউইন একটি ভালো অ্যানালোজী বা তুলনা খুজে পেলেন; কৃষকরা তাদের ফসল ব্রীড বা চাষ করেন প্রতিটি শস্যবাহী গাছ কেমন হয় তাদের পরস্পরের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে, তারপর তারা সবচেয়ে ভালো গাছগুলো থেকেই বীজ সংগ্রহ করেন পরবর্তী প্রজন্মের চাষের সময়; এবং এই ভাবে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমান ধারাবাহিক ব্রীডিং করার প্রক্রিয়ায় একটি সময় অন্যান্য প্রকারের ফসলের চেয়ে এটি একটি স্বতন্ত্র ফসলে পরিণত হয়; কিন্তু প্রকৃতিতে কোন খামারী বা চাষী নেই; সেখানে শুধু প্রানী আর উদ্ভিদের প্রজাতির নানা সদস্যরা আছে, যারা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বরত টিকে থাকার জন্য, আলো বা পানি বা খাদ্যের জন্য; এই পক্রিয়ায় তারা একটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়েও অতিক্রম করে; যে নির্বাচন হয় কোনো একক নির্বাচক ছাড়াই; ফলাফলে, ডারউইন শনাক্ত করেছিলেন, জীবিত সব জীবের মধ্য দৃশ্যমান সব ডিজাইন সৃষ্টি হতে পারে প্রাকৃতিকভাবেই, যেখানে কোন একক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির জন্য কলকাঠি নাড়ার কোন প্রয়োজন নেই;
এ যেন হত্যার অপরাধ স্বীকার করার মত:
নোট বইয়ে নিজের বৈপ্লবিক আর হেরেসি বা বৈধর্মের মত ধারণাগুলো লিখে রাখার ফাকে ফাকে ডারউইন কিছুটা সময় নিয়েছিলেন তার জীবনসঙ্গীনি খোঁজার জন্য; তার বিগল যাত্রার বেশ আগে ডারউইন তার কৈশোরে একজনের প্রেমে পড়েছিলেন, তার নাম ছিল ফ্যানি ওয়েন (ফ্যানি ওয়েন ডারউইনের স্কুলের সহপাঠী উইলিয়াম ওয়েন এর বোন); কিন্তু ডারউইনের সমুদ্রযাত্রার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফ্যানী অন্য একজনের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহন করেছিলেন; ইংল্যাণ্ডে ফিরে ডারউইন ভাবতে শুরু করেন, তার কি আদৌ বিয়ে করা উচিৎ হবে কিনা; নিয়ম মানা বিজ্ঞানীদের মত তিনি একটি কাগজে বিয়ে করার পক্ষে বিপক্ষে একটি তালিকা তৈরী করেন, উপরে বা দিকে বিয়ে করার সুবিধা ( বা টু ম্যারী), ডান দিকে অসুবিধা ( নট টু ম্যারী) এবং মাঝখানে লেখেন, দিস ইস দ্য কোয়েশ্চেন, তালিকা সহ একটি ব্যালান্স শীট তৈরী করেন ডারউইন; এই তালিকায় দেখায় যায় ডারউইন বিয়ের বিপক্ষে যুক্তি হিসাবে লিখেছেন, একা থাকলে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার বেশী সময় পাবেন, ক্লাবে পুরুষ সহকর্মীদের সাথে বেশী সময় আলোচনা করে কাটাতে পারবেন, এছাড়া সন্তান প্রতিপালন করার মত অর্থ সামর্থ্য তার নেই; অন্যদিকে বিয়ের স্বপক্ষে যুক্তি হলো, একজন স্ত্রী তার বৃদ্ধ বয়সে সারাক্ষণ সঙ্গী হবে; এধরনের তালিকার নীচে সব যোগ বিয়োগ করে তিনি তার উপসংহারে পৌছান: বিয়ে –বিয়ে –বিয়ে অতঃসিদ্ধ।

(ছবি: ফ্যানি ওয়েন, ডারউইনের প্রথম ভালোবাসা, স্কুলের এক সহপাঠীর বোন, উচ্ছল, চঞ্চল ফ্যানি ডারউইনকে তার মা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন; ডারউইনের দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার সময় তিনি অন্য আরেকজনের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহন করেন, সেকথা অবশ্য ডারউইনকে প্রথম জানিয়েছিলেন তিনি একটি চিঠিতে : “Believe me Charles that no change of name or condition can ever alter or diminish the feelings of sincere regard and affection I have for years had for you… ; ডারউইন পরবর্তীতে তারা মামাতো বোন এমাকে বিয়ে করেছিলেন ১৮৩৯ সালে।)
জীবন সঙ্গীনি হিসাবে ডারউইন নির্বাচন করেন তার মামাতো বোন এমা ওয়েজউডকে; তার কোনই ইচ্ছা ছিল লণ্ডনে পরিচিত হওয়া অভিজাত হাল ফ্যাশনের কোনো নারীকে তার জীবনে আনার, বরং তিনি তার মায়ের ভাইঝির দিকেই নজর দিয়েছিলেন, যে তার মত গ্রাম্য পরিবেশেই বড় হয়েছে; এমা ইতিমধ্যেই ডারউইনকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন, যখন ওয়েজউড হাউসে প্রায়ই ডারউইন বেড়াতে যেতেন; তার প্রতি ডারউইনের এই বিশেষ মনোযোগে এমাও খুশী হতেন, যদি ডারউইন পরোক্ষভাবে উচ্চারিত নানা অস্পষ্ট শব্দমালা বা বিব্রত ইতস্তত কিছু আচরণ ছাড়া তেমন কিছু করতে সক্ষম হননি এমার মন জয় করার প্রক্রিয়ায়; সে কারনেই এমা পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিলেন, যখন নার্ভাস ডারউইন একদিন কোনো মতে সাহস করে বলে ফেলেন যে তিনি তাকে বিয়ে করতে চান, এমা হ্যা বলেছিলেন কিন্তু তিনি এতই অবাক হয়েছিলেন, এর পর কোন কথা না বলেই তিনি তার রোববারের স্কুলে ক্লাস নিতে উঠে যান।
কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি এমা ডারউইনের মত পুরোপুরি ‘ভদ্র আর মিষ্টি স্বভাব’ এর একটি মানুষকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন সেই আনন্দটা অনুভব করতে শুরু করেন; অন্যদিকে ডারউইন চিন্তিত ছিলেন বিগলে তার সেই সময়টা তাকে কতটা অসামাজিক করে দিয়েছে বিয়ের মতো কোন সামাজিক আচারণের জন্য, কিন্তু এমাকে বিয়ে করছেন এই বোধটি তাকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল; তিনি এমাকে লিখেছিলেন, ’আমি মনে করি তুমি আমাকে মানুষে রুপান্তরিত করতে পারবে এবং শীঘ্রই আমাকে শেখাবে পারবে নীরবে এবং একাকীত্বে কোনো তত্ত্ব নির্মাণ ও তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ একত্রিত করার চেয়ে বড় অন্য কোনো সুখও আছে।’

(ছবি: এমা ওয়েজউড, ডারউইনের জীবন সঙ্গীনি (Emma Darwin (née Wedgwood) (2 May 1808 – 7 October 1896); ১৮৩৯ সালে ২৯ জানুয়ারী তাদের বিয়ে হয়েছিল; ডারউইন এবং এমা মোট দশটি সন্তানের জনক জননী ছিলেন, যাদের তিন জন শৈশবে মারা গিয়েছিলেন।)
এমার চিন্তা শুধু একটাই যখন ডারউইন প্রকৃতি নিয়ে এবং এটিকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভাব্য নিয়মাবলী বা সূত্র নিয়ে কথা বলেন; এমা একজন নিবেদিত প্রাণ ধার্মিক অ্যাঙলিকান, সহজেই বুঝতে পারেন যে বাইবেল নিয়ে চার্লস এর সন্দেহ আছে; তিনি ডারউইনকে লিখেছিলেন, ‘আমার জন্য একটি কাজ করবে?’ তিনি তাকে জনের গসপেল থেকে খানিকটা অংশ পড়তে বলেন: ‘আমি একটি নতুন আদেশ তোমাদের উপর ন্যস্ত করছি, তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে; যেমন আমি তোমাদের ভালোবেসেছি, তেমন তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে,’ যদি ভালোবাসা দিয়ে শুরু করে, ডারউইন হয়তো সত্যিকারের খ্রিস্টান হতে পারবেন।
তিনি এমাকে প্রতিজ্ঞা করেন এবং বলেন যে আসলেই বিষয়টিকে তিনি বেশ আন্তরিকভাবেই অনুভব করেছন; কিন্তু সেই সময়ে তার নোটবুকে চোখ রাখলেই বলা সম্ভব তিনি বিষয়টি নিয়ে ঠিক পুরোপুরি সততার সাথে তার সত্যিকারের মনোভাব ব্যক্ত করেননি এমার কাছে; তিনি ভাবছিলেন, সত্যিকার কোনো ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা চেয়ে বরং ধর্ম কি আসলেই প্রবৃত্তিগত কোনো ব্যাপার যাকে আমরা বলি ইন্সটিংক্ট ? এমার জন্য তার ভালোবাসাই তাকে বাধা দিয়েছিল তার সব চিন্তার কথা এমাকে বিস্তারিত জানানোর ক্ষেত্রে।
বিয়ের পর চার্লস এমাকে নিয়ে লন্ডনে চলে আসেন, এবং একটি স্বাচ্ছন্দময় একঘেয়েমীর দাম্পত্য জীবনে তারা অবশেষে স্থির হয়েছিলেন; তার স্বামীর আত্মা নিয়ে এমার চিন্তা অবশ্য অব্যাহত থাকে; এবং এসময় তিনি আরো চিঠি লিখেছিলেন; ১৮৩৯ সালে একটি চিঠিতে তিনি তার উৎকন্ঠা প্রকাশ করেন যে, ‘চার্লস প্রকৃতির সেই অন্তর্গত সত্যটাকে খোজার জন্য এত বেশী মোহাবিষ্ট ও আচ্ছন্ন হয়ে আছেন যে তিনি অন্য কোন সত্যকে দেখতে পাচ্ছেন না, যে সত্য শুধুমাত্র ধর্মই পারে উন্মোচন করতে’; আর শুধু যা কিছু প্রমাণ করা যায় শুধু সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবার কারনে তিনি, ‘সেই সব বিষয়গুলো মেনে নিতে পারছেন যেগুলো কিনা একইভাবে প্রমাণ করা সম্ভব না কিংবা যদি তা সত্য হয়, সেগুলো আসলেই আমাদের বোঝার ক্ষমতারও বাইরে।’তিনি চার্লসের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন, তিনি যেন ভুলে না যান, যীশু খিস্ট্র তার জন্য এবং পৃথিবীর বাকী সবার জন্য কি করেছিলেন; কোনো উ্ত্তর ছাড়াই ডারউইন এমার এই সেই চিঠিটাকে সরিয়ে রাখেন, যদিও চিঠিটির কথা তিনি তার সারা জীবন মনে রেখেছিলেন।
১৮৩৯ সালে ডারউইন ”জার্নাল অব রিসার্চেস ইনটু ন্যাচারাল হিস্টোরী অ্যান্ড জিওলজি অব দ্য কান্ট্রিস ভিসিটেড ডিউরিং দ্য ভয়েজ অব এইচএমএস বিগল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্লড,আন্ডার দ্য কমান্ড অব ক্যাপ্টেন ফিটজরয়, আর এন (Journal of Researches into the Natural History and Geology of the Countries Visited During the Voyage of HMS Beagle Round the World, Under the Command of Captn. FitzRoy, R.N) প্রকাশ করেন;
ডারউইনের এই বইটি খুবই আলোচিত ও সফল হয়েছিল প্রকাশের সাথে সাথেই, এবং এটি ব্রিটেনে অন্যতম সেরা একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে ডারউইনের সুনামকে করেছিল নিশ্চিৎ; ততদিনে চার্লস এবং এমা বিবাহিত জীবন কেটেছে প্রায় তিন বছর এবং তাদের দুটি সন্তানও আছে, এবং এসময়টাতেই তারা সিদ্ধান্ত নেন, এবার লন্ডন ছেড়ে শহরের বাইরে কোথাও চলে যাবেন; লন্ডনের শহুরে ব্যস্ততা, হ্ট্টগোল, অপরাধ, কয়লার ধুলা যা তাদের কাপড়কে কালো করে দিত, বা ঘোড়ার গোবর যা তাদের জুতার সাথে লেগে যেত, কোনটাই তাদের আর সহ্য হচ্ছিল না, নিজেরা যেমন গ্রামের অকলুষিত পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন, তাদের সন্তানদেরও সেই পরিবেশে মানুষ করার সিদ্ধান্ত নেন ডারউইন দম্পতি; লন্ডন থেকে ১৬ মাইল দুরে কেন্টে ১৮ একরের একটি ফার্ম, ডাউন হাউসকে বেছে নেন তারা; এখানে এসেই ডারউইন পুরোদস্তুর খামারী হয়ে যান, ফসলের চাষ করেন, গরু এবং ঘোড়া কেনেন; বৈজ্ঞানিক সমাজে মেলামেশা পুরোপুরি তিনি বন্ধ করে দেন।

(ছবি:ডাউন হাউস, কেন্ট, এখানে ডারউইন তার জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছিলেন, বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়াম।)

(ছবি: ডাউন হাউসে ডারউইনের স্টাডি)
খুব সাবধানে বাছাই করা সপ্তাহ অন্তের কয়েকজন অতিথি ছিল তার লন্ডনে ফেলে আসা বৈজ্ঞানিক সমাজের সাথে একমাত্র যোগসূত্র, এধরনের ঘনিষ্ট কিছু মানুষের মাধ্যমেই তিনি বিজ্ঞানের নতুন বিষয়গুলোর খবরাখবর পেতেন; কাছের মানুষ প্রিয় বড় ভাই ইরাসমাস লন্ডন ছেড়ে তার ছোট ভাই এর সাথে দেখা করাটা কাজটি একেবারেই পছন্দ করতো না, তিনি ডারউইনের প্রিয় ডাউন হাউসকে বাসাটিকে ঠাট্টা করে বলতেন Down at the Mouth; এই পুরো সময় জুড়ে বিবর্তনের তত্ত্বটি নিয়ে তার ভাবনাগুলো গোপনে অব্যহত ছিল কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে; প্রাকৃতিক নির্বাচনের স্বপক্ষে একটি যুক্তি তর্ক সম্বলিত একটি প্রস্তাবনাও তিনি লেখা শুরু করেন, ১৮৪৪ সালে সেটি শেষ হবার পর, তিনি বুঝতে পারছিলেন না এর পর কি করবেন তিনি; বিষয়টি নিয়ে তিনি কারো সাথেই আলাপও করতে চাইছিলেন না কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে কিভাবে কথা বলবেন ; তার তত্ত্বটির সমর্থনে তিনি বহু মানুষর কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাদের কাউকে জানাননি কেন এসব তথ্য তার আসলে দরকার;

(ছবি: ডাউন হাউসের পাশেই ডারউইনের বানানো হাটা ও চিন্তা করার পথ, স্যান্ড ওয়াক, এখানে হাটতে বের হয়ে তিনি ভাবতেন। এই রাস্তাটি তৈরী করা অনুপ্রেরণা ছিল তার মা, যাকে খুব শৈশবেই তিনি হারিয়েছিলেন।)

(ছবি: ডাউন হাউসে জোসেফ হুকার, চার্লস লাইয়েল এবং চার্লস ডারউইন, ডারউইনের খুব ঘনিষ্ঠ দুজন বৈজ্ঞানিক সহযাত্রী;)
যে বালকটি এক সময় তার বাবাকে ভীষণ ভয় পেত বলতে যে, সে কখনো ডাক্তার হতে পারবে না, সেই ছেলেটি তখন রুপান্তরিত হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষে, যিনি তার বিপদজ্জনক ধারণাটিকে কাউকে জানাতে শঙ্কা বোধ করতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু অবশেষে কাউকে না কাউকে তো তাকে বলতেই হবে, আর সেটা করতে গেলে তাকে এমন বৈজ্ঞানিক মনস্ক কাউকে খুজে বের করতে হবে যারা তার কাজ সম্বন্ধে যোগ্য মন্তব্য করতে পারবেন, আর যদি তিনি কোন বড় ভুল থাকেন যা অবশ্য তাদের চোখ এড়াবে না; তিনি জোসেফ হুকার নামের একজন তরুন উদ্ভিদবিদকে প্রথমে নির্বাচন করলেন, যিনি এর আগে বিগল অভিযানের সময় তার নিয়ে আসা উদ্ভিদের নমুনা গুলো পরীক্ষা করেছিলেন, এবং যাকে ডারউইনের যথেষ্ট খোলা মনের একজনই মনে হয়েছিল, যে তাকে অন্তত ব্লাসফেমার বা ধর্ম নিন্দাকারী মনে করবেন না; তিনি হুকারকে চিঠি লেখেন:
‘ফিরে আসার পর থেকেই আজ অবধি আমি খুব বড় একটি সাহসী বা বলা যায় ধৃষ্ঠতাপুর্ণ কাজের সূচনা করেছিলাম এবং আমার আসলেই এমন আর কাউকে জানা নেই, সব শুনবার পর যিনি বলবেন না, কাজটি খুব বেশী নির্বোধতুল্য হয়ে গেছে; গালাপাগোসে জীবজন্তুদের বিস্তারের বিষয়টিতে আমার দৃষ্টি এতবেশী আকর্ষণ করেছিল যে, আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম একনিষ্ঠভাবে দৃঢ়চিত্তে আমি যাবতীয় সব তথ্য সংগ্রহ করবো যা প্রজাতি আসলে কি সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিতে পারে আমাদের; আমি অসংখ্য কৃষিবিদ্যা এবং উদ্যানবিদ্যার বই পড়েছি এবং কখনোই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা স্তগিত করিনি; অবশেষে আমি কিছুটা আলোর দেখা পেয়েছি এবং প্রায় স্থির একটি সিদ্ধ‍ান্তে পৌছাতে পেরেছি ( যা শুরুর সময়কালীন আমার ধারণার সম্পুর্ণ বীপরিত প্রমাণিত হয়েছে) যে, প্রজাতিরা ( এটি অনেকটা কোন হত্যার দায় স্বীকার করার মত) অপরিবর্তনীয় নয়, আমি মনে করি আমি একটি সহজ উপায় ( আর এখানেই মনে হতে পারে আমার প্রধৃষ্ঠতা!) খুজে পেয়েছি কিভাবে প্রজাতিগুলো এত অসাধারণ সুচারুভাবে নানা পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়; আপনি হয়তো হতাশায় আর্তনাদ করে উঠবেন এবং নিজের মনে ভাববেন, ’হায় কি এক মানুষের জন্য আমি সময় আর লেখা অপচয় করছি;’ পাঁচ বছর আগে এমনকি আমি যেমনটা ভাবতাম; ডারউইন যেমন আশা করেছিলেন, হুকারও ঠিক তেমনই একজন খোলা মনের মানুষই ছিলেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত হবো কিভাবে পরিবর্তন ঘটেছে প্রজাতিতে সে বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন তা যদি আমি শুনতে পারি’ তিনি প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন,‘যেহেতু বর্তমান প্রস্তাবিত কোন ধারণাই এ বিষয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।’

(ছবি: চার্লস ডারউইন এবং এমা ওয়েজউড.. বার্ধক্যে; ডাউন হাউসে ডারউইন দম্পতির এই প্রতিকৃতিটি একেছেন অজানা একজন শিল্পী; ছবিটি আরো কিছু প্রতিকৃতির সাথে সংরক্ষিত আছে Bridgeman Art Library তে)
ডারউইনের জন্য হুকার এর এই উত্তরটি যথেষ্ট ছিল এর কয়েক মাস পরে এমাকে তার প্রবন্ধটি প্রথম দেখানোর জন্য সকল ইতস্ততা কাটিয়ে উঠতে; তিনি জানতেন এটি পড়ে এমা বেশ অস্থির হয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু তিনি চাইছিলেন যদি তার মৃত্যু হঠাৎ করে কিংবা তাড়াতাড়ি ঘটে যায়, তাহলে যেন এমা তার মৃত্যুর পর যেন এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেন। এমা প্রবন্ধটি পড়েছিলেন, এবং পড়ে তিনি আবেগ তাড়িতও হননি, শুধু যে জায়গাগুলোতে ডারউইনের লেখা খানিকটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে জায়গাগুলো তাকে চিহ্নিত করে দেন; পান্ডুলিপির যেখানে ডারউইন লিখেছিলেন, তিনি কল্পনা করতে পারেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন এমনকি চোখের মত জটিল কিছু তৈরী করতে পারে, সেখানে এমা লিখেছিলেন, ‘বেশ বড় একটি অনুমান’।

   



(ছবি: লণ্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে ডারউইন স্মারক ভাস্কর্য, ১৮৮৫ সালে ৯ জুন শিল্পী স্যার জোসেফ বোয়েম এর এই শিল্পকর্মটি উন্মোচন করা হয়েছিল।)


আবারো আত্মগোপন
তার গোপনীয়তার দুজন স্বাক্ষী সহ, ডারউইন ধীরে ধীরে যথেষ্ঠ পরিমান আত্মবিশ্বাস অর্জন করছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণাটি প্রকাশ করার জন্য; কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস পুরোটাই হারিয়ে গিয়েছিল এর একমাস পরে; এর কারণ ১৮৪৪ সালের অক্টোবর মাসে Vestiges of the Natural History of Creation নামের একটি বই ছাপাখানা থেকে হয়ে এসেছিল, যার লেখক একজন স্কটিশ সাংবাদিক, রবার্ট চেম্বারস, সেই মুহূর্তে যিনি অজ্ঞাত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন, এবং নিজের পরিচয় গোপন রাখার জন্য এতটাই চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রকাশক কোথায় তাকে সন্মানী পাঠাবেন এমনকি সেই ঠিকানাটিও তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন, অবশ্য এত সতর্কতা অবলম্বন করে তিনি যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন কোনো সন্দেহ নেই তাতে।

(ছবি: রবার্ট চেম্বারস (Robert Chambers, 1802 – 1871) স্কটিশ ভূতত্ত্ববিদ, প্রকাশক; চেম্বারস ১৮৪৪ সালে Vestiges of the Natural History of Creation বইটি প্রকাশ করেন; যদিও তিনি তার নামে এটি প্রকাশ করেননি, তার মৃত্যুর পরেই কেবল লেখকের মূল পরিচয় জানা গিয়েছিল। যদিও প্রস্তাবিত বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে চেম্বারস এর যুক্তির দুর্বলতা ছিল তা সত্ত্বেও বিতর্কিত বহুল পঠিত এই বইটি প্রথম বারের মত বিবর্তন বা ট্রান্সমিউটেশন আর সৃষ্টির সাথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যোগসূত্রের ধারণাটি সাধারণ পাঠকদের কাছে পৌছে দিয়েছিল।)
Vestiges of the Natural History of Creation বইটি কোনো সমস্যা ছাড়াই তার যাত্রা শুরু করেছিল, সৌরজগত ও তার নিকটবর্তী নক্ষত্রগুলো বর্ণনা করে ও কিভাবে একটি গ্যাসপূর্ণ ডিস্ক থেকে পদার্থবিদ্যা আর রসায়নের সুত্র মোতাবেক পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলো সেগুলো পর্যালোচনা করার মাধ্যমে; সেই সময়ের আলোকে যতটুকু তথ্য জানা ছিল, সেই আলোকে তিনি ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড এবং ইতিহাসে পরিক্রমায় নানা ফসিলের উত্থানের কথা উল্লেখ করেন। সরল জীবাশ্মগুলো প্রথমে এবং পরে জটিলতর জীবাশ্মগুলোর আবির্ভাবে কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সময়ের পরিক্রমায় ক্রমান্বয়ে জটিল ও উচ্চ ফর্মের জীবনের আবির্ভাব হয়েছিল যারা তাদের চিহ্ন রেখে গেছে জীবাশ্ম রেকর্ডে’; এরপর চেম্বারস একটি বিতর্কিত দাবী করে বসেন: ‘যদি মানুষ মেনে নেয় ঈশ্বর মহাজাগতিক সব বস্তুগুলোকে নিজ হাতে সাজিয়েছেন প্রাকৃতিক সূত্র মেনেই, তাহলে জৈব সকল সৃষ্টিও প্রাকৃতিক নিয়মেরই ফসল, যা ঠিক তার মনের ইচ্ছারই প্রতিফলন, এমনভাবে ভাবতে আমাদের আসলে বাধাটা কোথায়? প্রতিটি প্রজাতি আলাদা আলাদা ভাবে তার সৃষ্টি করতে হয়েছে এমন ভাবার চেয়ে এটাই বরং যুক্তিযুক্ত, নিশ্চয়ই এই ধারণাটি খুব বেশী হাস্যকর নয় অবশ্যই খানিকটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার জন্য।’

(ছবি: Vestiges of the Natural History of Creation বইটি)
আর কিভাবে এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলো কাজ করে সে বিষয়ে চেম্বারস একটি মিশ্র ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, রসায়ন আর ভ্রুণতত্ত্ববিদ্যা থেকে পরোক্ষ ‍উপায়ে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে তিনি প্রস্তাব করেন, হয়তো বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ কোনো নির্জীব পদার্থকে প্রথমে সরল অণুজীবে রুপান্তরিত করেছিল; এরপর জীবন বিবর্তিত হয়েছে এর ক্রমবিকাশকে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; চেম্বারস এখানে নির্ভর করেছিলেন জার্মান জীববিজ্ঞানীদের পরিত্যক্ত পুরোনো কিছু ধারণাকে; তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, যে জন্মগত ক্রটির কারণ হচ্ছে ভ্রূণের ক্রমবিকাশের প্রতিটি পর্যায় বা ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হওয়া; একটি শিশুর হয়তো জন্ম হতে পারে হৃৎপিন্ডে চারটির বদলে মাত্র দুটি প্রকোষ্ট নিয়ে, যেমন মাছের মত; ধারণা করা হতো যে এই ক্রটিগুলো হবার কারণ, ‘মায়ের শরীরের এই ভ্রূণের ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ায় কোনো ক্রটির জন্য, যা প্রভাবিত হতে পারে মায়ের দুর্বল স্বাস্থ্য বা অন্য কোন দুর্ভোগের কারণে।’ কিন্তু যদি এর বিপরীত ঘটনা ঘটে, কোন মা হয়তো এমন শিশু প্রসব করে যে কিনা ক্রমবিকাশের আরো একটি নতুন ধাপ অতিক্রম করতে পারে; কোন হাস হয়তো এমন কোন ছানা দিতে পারে যার শরীর ইদুরের মত,এভাবে হাসের ঠোট যুক্ত প্ল্যাটিপাসের সৃষ্টি হতে পারে’, এভাবে নতুন ফর্মের নতুন সৃষ্টি, যেমনটা দেখা গেছে ভুতাত্ত্বিক রেকর্ডের পাতায়, আসলেই কখনোই গর্ভাবস্থায় একটি নতুন ধাপের অগ্রগতি ছাড়া আর কিছু নয়।’
চেম্বারস আদৌ ভাবেননি, তার পাঠকদের কিছু মনে করা উচিৎ হবে যদি তারা মাছ থেকে ‘বিবর্তিত’ হয়েছে এমন কিছু তাদের বলা হয়; ঘটনার যে ধারাবাহিকতা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন: ‘সবচেয়ে বড় মাপের বিস্ময়গুলো, তাদের প্রত্যেকটির মধ্যে আমরা একজন সর্বশক্তিমানের ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাই, প্রতিটি প্রাণীর পরিবেশের সাথে সামঞ্জষ্য রেখেই তাদের তিনি নিখুতভাবেই সাজিয়েছেন’; Vestiges of the Natural History of Creation এর মধ্যবিত্ত বৃটিশ পাঠকরা তাদের জীবন আগের মতই কাটিয়ে যেতে পারেন সেই একই নৈতিকতার কম্পাস ব্যবহার করে, ‘এভাবে আমরা শ্রদ্ধাময় একটি অভ্যর্থনা জানাই যা কিছু প্রকৃতির মাধ্যমে উন্মোচিত হয়; এবং একই সাথে আমরা পুরোপুরি শ্রদ্ধাও বজায় রাখি যা কিছু আমরা পবিত্র হিসাবে মনে করে থাকি, যার কোনো কিছুই শেষ অবধি পরিবর্তন করারও কোন আবশ্যিকতা প্রশ্ন হয়েতো কখনোই উঠবে না।’
Vestiges of the Natural History of Creation খুবই ব্যবসা সফল একটি প্রকাশনা হয়েছিল, সেই সময় প্রায় দশ হাজারের বেশী কপি বিক্রী হয়েছিল বইটির। প্রথম বারের মত ইংল্যাণ্ডের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে বিবর্তনের ধারণার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বইটি। কিন্তু বইটি সম্বন্ধে সামনের সারির সব বৃটিশ বিজ্ঞানীদের মন্তব্য ছিল অত্যন্ত্য বিরুপ, তারা অনেকেই বইটিকে অত্যন্ত্য তিক্ত আর কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন, বিখ্যাত অ্যাডাম সেজউইক লেখেন, আমার মনে হয় এর লেখক একজন মহিলা, আংশিকভাবে এর কারণ হচ্ছে, বইটি মজবুত সব যুক্তিগুলো সম্বন্ধে যে পরিমান অজ্ঞতা প্রকাশ করছে সে জন্য। সেজউইক আরো সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেন, কিভাবে জীবনের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গী সব শ্লীলতা আর শোভনতাকে অবমুল্যায়ন করতে পারে; ‘যদি এই বইটা সত্যি হয়ে থাকে’, তিনি ঘোষণা করেন,‘তাহলে ধর্ম হচ্ছে মিথ্যা, মানুষের আইনকানুন পাগলামো আর মনের খেয়াল আর অত্যন্ত নিম্নমানের অবিচার, নৈতিকতা হচ্ছে পাগলের প্রলাপ।’
বইটির প্রতি বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিকদের হিংস্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ডারউইন আবার নিজেকে গুটিয়ে নেন তার নিজস্ব বিজ্ঞানের জগতে; ‍তার আসলে ধারণাই ছিলনা যে, অ্যাডাম সেজউইক সহ তার অন্যান্য শিক্ষকরা বিবর্তন সম্বন্ধে এত দৃঢ় আর প্রবল একটি বিরুদ্ধ ধারণা পোষণ করেন; তবে নিজের গড়ে তোলা তত্ত্বটিকে তিনি পরিত্যাগ করেননি, বরং ডারউইনের তখন একটাই চিন্তা ছিল, চেম্বারের সাথে যা হয়েছে, সেই নিয়তিটাকে কিভাবে এড়ানো যায় যখন তিনি তার প্রস্তাবটিকে জনসমক্ষে আনবেন।
ডারউইন বুঝতে পেরেছিলেন যুক্তি প্রমানের দিক থেকে চেম্বারস এর বইটির ভুল এবং দূর্বলতাগুলো আসলে কোথায়; চেম্বারস শুধু অন্য বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত ধারণাগুলো পড়েছেন এবং সেই সব ধারণাগুলো একসাথে মিশিয়ে একটি অস্পষ্ট আর দূর্বল যুক্তির উপর ভিত্তি করে তার প্রস্তাবগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন; ডারউইন বুঝতে পারলেন, খানিক ভিন্নভাবে তিনিও কিন্ত কিছুটা একই দোষে দোষী -তার ধারণার ভিত্তি বেশ কিছু বিজ্ঞানী আর অবিজ্ঞানীদের ধারণা যা তিনি তাদের কাছ থেকে শুনেছেন বা পড়েছেন – লাইয়েল, মালথাস এমনকি তার নাপিতও সেই তালিকায় আছেন; যদিও ভুত্ত্ত্ববিদ্যার একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু ডারউইন ভাবছিলেন জীববিজ্ঞান বিষয়ে তার কোন প্রস্তাব প্রকাশ করলে তাকে একজন বহিরাগত আনাড়ী বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিবেচনা করা হতে পারে; তাকে যেন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় এমন একটি অবস্থা নিশ্চিৎ করতে হলে ‍তার নিজেকে প্রমান করতে হবে প্রথম সারির একজন প্রকৃতিবিদ হিসাবে, যার প্রকৃতির নানা জটিলতাকে সহজে সামাল দেবার যোগ্যতা আছে।
এরপর তিনি বিগলের সমুদ্রযাত্রার সময় সংগ্রহ করা নানা নমুনা, যা তিনি নিজে পরীক্ষা করেননি গত ৮ বছরে তার ফিরে আসার পর, সেগুলোর দিকে নজর দিলেন; তার সংগ্রহের নমুনার একটি কাচের বোতলে ছিল একটি বার্নাকল এর নমুনা। যদিও বেশীর ভাগ মানুষ এটি মনে করেন জাহাজের হাল বা নীচের যে কাঠামোর উপর নৌকা ‍বা জাহাজ তৈরী হয়, সেগুলোর গায়ে লেগে থাকা এমন কিছু যা চেছে পরিষ্কার করার উপাদান ছাড়া বার্নাকল এর আর কোনো গুরুত্ব নেই; কিন্তু আসলই তারা সমুদ্রের সম্ভবত সবচেয়ে বিচিত্রতম একটি প্রাণী; প্রথম দিকে প্রাণীবিজ্ঞানীরা ভাবতেন বার্নাকল আসলে এক ধরনের মোলাস্ক, যেমন ক্ল্যাম বা ঝিনুক বা অয়েষ্টার, যাদের শক্ত খোলসটা আটকে থাকে কোন একটি পৃষ্ঠের উপর, কিন্ত আসলে এরা ক্রাষ্টাসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত, যেমন লবস্টার এবং চিংড়ী; ১৮৩০ সালেই বিজ্ঞানীরা কেবল তাদের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য খানিকটা আবিষ্কার করেছিলেন, বিশেষ করে যখন একজন বৃটিশ আর্মি সার্জন তাদের লার্ভা লক্ষ্য করে আবিষ্কার করেছিলেন তারা আসলে অল্পবয়সী চিংড়ীর মত; যখন বার্নাকল লার্ভাগুলোকে সমুদ্রের পানিতে ছেড়ে দেয়া হয়, তারা কোন একটি জায়গা খুজতে থাকে যেখানে তারা স্থির হতে পারবে, সেটা জাহাজের ‍হাল বা কোন ক্ল্যামের খোলশ যাই হোক না কেন; এবং পছন্দ মত কোন কিছুর উপরে তারা প্রথমে মাথা দিয়ে থিতু হয়; এরপরই তারা তাদের ক্রাষ্টাশিয়ান শারীরিক কাঠামোটি হারিয়ে ফেলে, তার বদলে চারপাশে তৈরী করে কোনাকৃতির একটি খোলস, তার ভিতর থেকে তারা তাদের পালকের মত পাগুলো বের করে রাখে খাদ্য ছাকাই করার জন্য।

(ছবি: রক বার্নাকল)
১৮৩৫ সালে চিলির উপকুলে ডারউইন আলপিনের মাথার সমান একটি বার্ণাকল প্রজাতি সংগ্রহ করেন যা একটি কঙ্খ বা সামুদ্রিক শামুকের (Conch) খোলসের ভিতরে আটকে ছিল; এখন তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে তা দেখে ডারউইন বুঝতে পারলেন যে প্রতিটি বার্নাকলে আছে দুটি বার্নাকল সদস্য – একটি আকারে বড় স্ত্রী বার্ণাকল সাথে খুবই ক্ষুদ্র পুরুষ, যে তার সাথে আটকে আছে; সেই সময় বিজ্ঞানীরা পরিচিত ছিলেন শুধু উভলিঙ্গ বার্ণাকলের সাথে যাদের স্ত্রী ও পুরুষ দুটি জননাঙ্গই থাকে; পিনহেড বার্নাকল এত অদ্ভুত যে ডারউইন নিশ্চিৎ ছিলেন এরা হয়তো ভিন্ন নতুন কোন জিনাসের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

(ছবি: বার্নাকল লার্ভা)
বার্নাকলদের নিয়ে ডারউইন আরো একটি দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক যাত্রা শুরু করলেন, প্রথমে তিনি শুধু একটি ছোট নিবন্ধ লিখতে চেয়েছিলেন তার আবিষ্কারের বর্ণনা দিয়ে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, তাকে আগে নির্ধারণ করতে হবে অনেকগুলো বার্ণাকল প্রজাতির মধ্যে এই পিন হেড বার্ণাকলের অবস্থানটা কোথায় হবে যদি এর শ্রেণীবিন্যাস করতে চান; তিনি ওয়েন এর কাছে অনুরোধ করেন তাকে যেন কিছু বার্ণাকলের নমুনা ধার দেয়া হয়, এবং কাজটা ভালোভাবে কিভাবে করা যায় এ বিষয়ে তাকে যেন তিনি কিছু উপদেশ দেন; ওয়েন ডারউইনকে জানান যে তার আবিষ্কৃত বার্ণাকলটিকে, সেটা যতই অদ্ভুত হোক না কেন, মুল ক্রাষ্টাসিয়ান আদিরুপ বা আর্কিটাইপের সাথে একটি সংযোগ খুজে বের করার চেষ্টা তাকে অবশ্যই করতে হবে; কারণ ১৮৪০ নাগাদ ওয়েন সিদ্ধান্ত নেন আর্কিটাইপ বা আদিরুপই হচ্ছে প্রাণীবিজ্ঞানের মূল চাবিকাঠি।
ওয়েন নিজেও মেরুদন্ডী প্রানীদের একটি আর্কিটাইপ তৈরী করা চেষ্টা করেছিলেন, যা তিনি কল্পনা করেছিলেন মেরুদন্ড, পাজর, মুখ সহ সামান্য কিছু বেশী; এই শারীরিক গঠনের কোন অস্তিত্ব প্রকৃতিতে নেই, ওয়েন দা্বী করেন, এটি শুধু মাত্র ঈশ্বরের মনে বিদ্যমান একটি নীল নকশা , যার উপরে নির্ভর করে তিনি আরো বিস্তারিত শারীরিক গঠন তৈরী করেছেন; কেউ যদি ভিন্ন ভিন্ন মেরুদন্ডী প্রানীদের তুলনা করেন তাহলে এই আর্কিটাইপের সাথে সম্পর্ক এবং সদৃশ্যতা স্পষ্ট হবে।
যেমন, উদহারণ সরুপ একটি বাদুড়, একটি ম্যানাতি এবং একটি পাখি তুলনা করেন, বাদুড়ের ডানা তৈরী হয়েছে তার দীর্ঘায়িত হওয়া আঙ্গুলগুলো যুক্ত করা একটি চামড়ার পর্দা দিয়ে, ম্যানাতির আছে একটি প্যাডেল এর মত অঙ্গ যা তাদের পানিতে সাতার কাটতে সহায়তা করে; পাখীদের আছে ডানা, কিন্তু সেটা তৈরী হাতের হাড়ের মধ্যে আটকে থাকা পালক সহ, যারা একীভুত হয়ে তৈরী করেছে একটি হিন্জ বা কবজার সহ দীর্ঘ একটি দন্ড; প্রত্যেকটি মেরুদন্ডী প্রানীর হাত পা আছে যারা তাদের জীবনের প্রয়োজনে খাপ খাইয়ে নিয়েছে গঠনে ও কাজে ; এবং তারা একের অপরের সাথে সমরুপী বিস্ময়করভাবেই, প্রতিটি অস্থির ক্ষেত্রে; তাদের সবার আঙ্গুল আছে মার্বেল সদৃশ একটি কব্জির হাড়ের সাথে যুক্ত হয়ে, যারা সংযুক্ত আবার দুটি লম্বা হাড়ের সাথে যার কনুইতে এসে একটি মাত্র লম্বা হাড়ের সাথে যুক্ত হচ্ছে; এই সদৃশ্যতাই ওয়েন এর একটি সাধারণ শারীরিক কাঠামোর পরিকল্পনার বিষয়টি প্রমাণ করে (বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন হোমোলগ বা সমরুপতা)।
ওয়েন ডারউইনকে তাড়া দেন বার্নাকল এবং অন্যান্য ক্রাষ্টাসিয়ানদের মধ্যে এমন কোনো হোমোলজি খুজে বের করতে; ব্যাক্তিগত ভাবে ডারউইন ওয়েন এর আর্কিটাইপের ধারণাটিকে অর্থহীনই মনে করতেন; তিনি ভাবতেন বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রানীদের মধ্যে সদৃশ্যতাগুলো একটি কমন বা সাধারণ পূর্বসূরি প্রাণীদের বংশধর হিসাবে তাদের বিবর্তনের মাধ্যমেই উদ্ভবেরই চিহ্ন; কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম অদ্ভুত ক্রাষ্টাশিয়ানদের থেকে বার্ণাকলদের বিবর্তন বুঝতে হলে ডারউইনকে অনেকগুলো আসলে বার্ণাকল নিয়ে গবেষণা করতে হবে ( প্রায় ১২০০ প্রজাতি আজ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে); তিনি অন্য প্রকৃতিবিদদের সংগ্রহ থেকে আরো বার্ণাকল জোগাড় করলেন, তিনি জীবাশ্ম বার্নাকল নিয়ে গবেষনা করেন এমনকি বৃটিশ মিউজিয়ামের পুরো সংগ্রহ তিনি কোনো না কোনোভাবে যোগাড় করেছিলেন তার গবেষণার জন্য; প্রায় ৮ বছর ধরে ডারউইন বার্নাকল নিয়ে গবেষণা করেন, এই পুরোটা সময় বিবর্তনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত তার তত্ত্বটি যা কোপার্নিকাসের সুর্য কেন্দ্রীক কসমোলজীর ধারণার মতই বৈপ্লবিক, তার বুক শেলফের তাকেই বসে ছিল সিল করা একটি খামে।
কেন এত দেরী করেছিলেন ডারউইন? ভয় হয়তো ডারউইনের দীর্ঘসূত্রিতার একটি কারণ হতে পারে, বিশেষ করে তার শিক্ষকদের সাথে সরাসরি দ্বন্দে যাবার সুস্পষ্ট সম্ভাবনা ছিল, যা তিনি এড়াতে চেয়েছিলেন; অন্য একটা কারণ হয়তো হতে পারে ডারউইন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন; পাঁচ বছরের একটি কষ্টকর সমুদ্র যাত্রা, এর পরে বই আর প্রবন্ধ লেখার ব্যস্ত হয়ে আটটি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডে আসার পর থেকে তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, প্রায়ই তিনি আক্রান্ত হতে্ন ক্রমাগত হতে থাকা বমির দ্বারা; কেবল মধ্য তিরিশে ডারউইন হয়তো কিছুটা শান্তি খুজছিলেন কোনো অস্থিরতা ছাড়া; এবং আরো একটি দীর্ঘসূত্রিতার কারণের অংশ তার শোক; তার প্রিয় মেয়ে অ্যানী, মাত্র ১০ বছর বয়সে ১৮৫১ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তার এই নিষ্পাপ কন্যাটির মৃত্যু যন্ত্রণা তিনি নিজ চোখে দেখেছিলেন. তার ভেঙ্গে চুরে যাওয়া বিশ্বাস নিয়ে তিনি এমার সাথে কোনো কথা বলারও সুযোগ পাননি; বার্ণাকল নিয়ে কষ্টসাধ্য গবেষণা তার সেই তীব্র কষ্টকে ঢাকার একটি উপায় হিসাবে হয়তো বেছে নিয়েছিলেন।

(ছবি: অ্যানী , ডারউইন ও এমার দ্বিতীয় সন্তান এবং বড় মেয়ে (Anne Elizabeth “Annie” Darwin 1841 – 1851); দশ বছর বয়সে তিনি মারা যান স্কারলেট ফিভার এ; ডারউইনের খুবই আদরের মেয়ে ছিল অ্যানী; অ্যানীর কষ্টকর মৃত্যু ডারউইনকে বিধ্বস্ত করেছিল; তার ডায়রীতে ডারউইন লিখেছিলেন We have lost the joy of the household, and the solace of our old age…. Oh that she could now know how deeply, how tenderly we do still & and shall ever love her dear joyous face. ক্ষীণ হয়ে আসা তার ধর্মবিশ্বাসকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেন ডারউইন অ্যানীর মৃত্যুর পর।)
কিন্তু ভয়, ক্লান্তি আর শোক বাদ দিয়েও, বার্নাকল ডারউইনকে পুরোপুরি মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল; পরবর্তীতে দেখা গেল কিভাবে বিবর্তন কাজ করে সেটা বোঝার জন্য এই গ্রুপের প্রানীরা আসলেই উপযোগী; ডারউইন যেমন দেখতে পেলেন, কিভাবে তার চিলিতে আবিষ্কৃত বার্নাকলরা উদ্ভব হয়েছে তাদের উভলিঙ্গ পূর্বসূরিদের থেকে; তারা বিবর্তিত হয়েছিল অন্তর্বতীকালীন কিছু ফর্মের মধ্য দিয়ে, যতক্ষন পর্যন্ত তারা স্ত্রী এবং পুরুষ লিঙ্গের আলাদা বার্নাকল সৃষ্টি না করে; প্রতিটি প্রজাতির বার্নাকলদের মধ্যে প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশনও ডারউইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বার্নাকল অ্যানাটোমির কোন অংশই সুষম নয়, এখানে ডারউইন বুঝতে পেরেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করার জন্য প্রচুর কাঁচা মাল আছে; প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো কোন একটি নির্দিষ্ট সময়েই কেবল প্রজাতির উপর কাজ করে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি, যেমন যখন কোন দ্বীপের উত্থান বা মহাদেশ পানিতে ডুবে যেতে শুরু করে, যেমন; কিন্তু এত ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ থাকার কারণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন আসলেই কাজ করতে পারে সবসময়ই।

(ছবি: The Quantum Leap, an abstract sculpture erected in 2009 in Darwin's birthplace, Shrewsbury, for the bi-centennial of his birth.)
কিন্তু এসব কোনো ধারণাই ডারউইন তার বার্ণাকল বিষয়ক কোনো লেখায় সরাসরি নিয়ে আসেননি, তিনি প্রায় ১০০০ পাতার বিশাল একটি একটি বিশাল বই (A monograph on the sub-class Cirripedia, with figures of all the species 1854) লেখেন, যার জন্য তিনি প্রশংসা, পুরষ্কার এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসাবে যে শ্রদ্ধা তিনি আশা করেছিলেন সেটা পেয়েছিলেন;
১৮৫৪ সলে, ডারউইন আবার প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে তার চিন্তায় ফিরে যান।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মোড়ক ‍উন্মোচন
জোসেফ হুকার এর উত্থাপিত কিছু সন্দেহ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ডারউইন; ডারউইনের একটি দাবী ছিল, উদ্ভিদ এবং প্রাণী যারা কোনো দ্বীপে বসবাস করে, তারা সেখানেই সৃষ্ট হয়নি, তারা হচ্ছে আদিতে এখানে বসতি স্থাপনকারীদের পরিবর্তিত বংশধর; যদি তাই সত্যি হয়, তাহলে সেই দ্বীপে তাদের পৌছানোর জন্য একটি উপায়ের প্রয়োজন আছে; হুকার একজন অভিজ্ঞ উদ্ভিদবিজ্ঞানী, তিনি জানেন বীজ বাতাসে বা পানিতে ভেসে বহু মাইল অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু ডারউইন যে পরিমান দূরত্বের কথা বলেছেন, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন। হুকারের সন্দেহ মোকাবেলা করতে ডারউইন একটি চৌবাচ্চা ভর্তি লবন পানিতে বীজ ছড়িয়ে দেন, এবং পরে পরীক্ষা করে দেখেন যে চার মাস পরও বীজগুলো সক্রিয় থাকে এবং মাটিতে রোপন করলে তাদের অঙ্কুরোদগমও হয়; তিনি আবিষ্কার করেন পাখিরা তাদের পায়ের সাথে বীজ বহন করতে পারে এবং পেচাদের অন্ত্রনালীতে খাওয়া ও তাদের মলের সাথে বেরিয়ে আসা বীজও সক্রিয় থাকে।

(ছবি: জোসেফ ডাল্টন হুকার (Sir Joseph Dalton Hooker 1817 – 1911), বৃটেনের অন্যতম সেরা উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যিনি ভৌগলিক উদ্ভিদবিদ্যার জনক ছিলেন; প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটি প্রথম ডারউইন এমা এবং জোসেফ হুকারকে জানিয়েছিলেন; ডারউইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হুকার কিউ রয়্যাল বোটানিক্যালগার্ডেনের পরিচালক ছিলেন দীর্ঘ সময়কাল।)
ডারউইনের তত্ত্ব একটি হাইপোথিসিস সৃষ্টি করেছিল এবং পরীক্ষার মাধ্যমেই হাইপোথিসিসটি সত্য প্রমাণিত হয়; ডারউইন আবারো তার ব্রীডিং বা কৃত্রিম প্রজননের গবেষণাও শুরু করেন; তার কিছু বন্ধু ছিলো যাদের সাথে তিনি জিন খেতেন মাঝে মাঝে, তাদের কেউ কেউ কবুতরের প্রজননের সাথে জড়িত ছিলেন, তারাই তাকে জানিয়েছিল কিভাবে ছোট ছোট প্রকরণ বা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টাবলী ব্যবহার করে একেবারে নতুন জাতের কবুতর প্রজনন করা সম্ভব; ডারউইন নিজেই কবুতর পালতে শুরু করেন তাদের কৃত্রিম প্রজননের পরীক্ষার জন্য এবং তাদের গঠন দেখতে তাদের মেরে গরমপানিতে সিদ্ধ করে কংকালটি আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখেন কি পরিমান ভিন্নতা আছে ভিন্ন ভিন্ন এই জাতগুলোর মধ্যে; তিনি দেখেন যে প্রতিটি কৃত্রিম প্রজননেনর মাধ্যমে সৃষ্ট ব্রীড এত বেশী ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টসুচক, যদি তারা বন্য হতো তাহলে তাদের আলাদা আলাদা প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হতো; কবুতরের অ্যানাটোমির প্রতিটি অংশই অন্য ভ্যারাইটি বা প্রকরণের থেকে আলাদা, তাদের নাকের ছিদ্র থেকে তাদের বুকের পাজর, ডিমের আকৃতি; কিন্তু সবার জানা প্রতিটি কবুতরের জাত হচ্ছে একটি প্রজাতির রক ডোভের বংশধর।
১৮৫৬ সাল নাগাদ ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের স্বপক্ষে এত বেশী প্রমাণ জড়ো করেছিলেন, যে তিনি আবারো তার সীল গালা করা ১৮৪৪ সালের সেই প্রবন্ধটির খাম খোলেন এবং নতুন করে লেখা শুরু করেন, খুব দ্রুতই ছোট সেই রচনাটি বিশাল আকারের লক্ষাধিক শব্দ সম্বলিত একটি পুর্ণাঙ্গ গবেষনা গ্রন্থে রুপান্তরিত হয়; এতগুলো বছরের তার সমস্ত অভিজ্ঞতা- তার সমুদ্রযাত্রা, তার পড়াশুনা, বিভিন্ন জনের সাথে তার আলোচনা, বার্ণাকল আর বীজ নিয়ে তার গবেষণা সবকিছু তিনি বিস্তারিতভাবে সাজালেন তার তত্ত্বটির স্বপক্ষে; তিনি দৃঢ়সঙ্কল্প ছিলেন তার তত্ত্বের বিরুদ্ধবাদীতাকে তিনি অসংখ্য বাস্তব স্বাক্ষ্য প্রমানের বন্যায় ভাসিয়ে দেবেন। ১৮৪৪ সানে এমাকে যখন চার্লস তার পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দিয়েছিলেন, তারপর থেকে তিনি তার তত্ত্ব বিষয়ে খুব সামান্যই কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখন তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী আরো কিছু মানুষের কাছে বিষয়টি উন্মোচন করতে, বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের কিছু বিজ্ঞানী, যারা নতুন কোনো সম্ভাবনার প্রতি অনেক বেশী মুক্তমনা ও সংস্কারমুক্ত; এরকম একজন ছিলেন তার সাম্প্রতিক বন্ধু .. যার নাম থমাস হাক্সলী।

(ছবি: থমাস হেনরী হাক্সলী; (Thomas Henry Huxley 1825 – 29 June 1895), বৃটিশ জীববিজ্ঞানী , ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতি তার জোরালো সমর্থনের জন্য তাকে বলা হতো ডারউইনের বুল ডগ; ১৮৬০ সালে স্যামুয়েল উলবারফোর্সের সাথে অক্সফোর্ডে তার বিতর্কটি বিবর্তন তত্ত্বের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত ছিল।)
ডারউইনের মত সম্ভ্রান্ত সচ্ছল পরিবারের বিজ্ঞান চর্চা হাক্সলীর ভাগ্যে জোটেনি; কসাইখানার উপরের ছোট একটি ঘরে তার জন্ম হয়েছিল, তার বাবা, একজন ব্যর্থ স্কুলের টিচার এবং তারপর একটি ব্যর্থ ব্যাঙ্কের পরিচালক; হাক্সলীকে পড়ানোর মত তেমন কোন অর্থ তার ছিল না; ১৩ বছর বয়সে একজন ডাক্তারের সহকারী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি, তিন বছর পর সেই ডাক্তারের সাথে লন্ডনে আসেন হাক্সলী, যেখানে তার সুযোগ হয় সার্জন হিসাবে একটি প্রশিক্ষণ নেবার, শ্বশুর বাড়ী থেকে কিছু ধার, সামান্য বৃত্তির টাকা নিয়ে কষ্টে সৃষ্ঠে তাকে তার প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয়; তার ধার করা টাকা শোধ দেবার তখন একটাই উপায় ছিল, তাহলো নিউ গিনি অভিমূখে সমুদ্র যাত্রা করা এইচ এম এস র‌্যাটলস্নেক নামের একটি জাহাজে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসাবে যোগ দেয়া; হাক্সলী সেই সময় প্রাণিবিজ্ঞান সম্বন্ধে খানিক আগ্রহী হতে শুরু করেছিলেন, এই সুযোগটা তাকে তার মনের মত যত খুশী বিচিত্র নমুনা সংগ্রহ করার সুযোগ করে দিয়েছিল।
১৮৫০ সালে প্রায় ৪ বছর পর হাক্সলী দেশে ফিরে আসেন এবং ডারউইনের মত এই সমূদ্র যাত্রা তাকেও একজন বিজ্ঞানীতে রুপান্তরিত করেছিল; এবং ডারউইনের মতই, তার সুনামও দেশে ফেরার আগেই ইংল্যান্ডে পৌছে যায়, বিশেষ করে পর্তুগীজ মান ও য়ার (Portuguese man o’ war) নামের একটি অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণি সম্বন্ধে তার প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের কারণে, যে প্রাণিটি আসলে অনেকগুলো একক প্রাণির একটি কলোনী; হাস্কলী রয়্যাল নেভীর সাথে একটি বিশেষ সমঝোতায় আসেন, যারা তাকে বেতন সহ তিন বছরের ছুটি দেয়, তার গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন।
এর মধ্যে অবশ্য নেভী থেকে আরো তিন বার সমুদ্র অভিযানে ডাকা হয়, তিনবার প্রত্যাখ্যান করার পর নেভীর চাকরীটি তিনি হারান, লন্ডনে অন্য কাজ খোজার জন্য তার কঠিন সংগ্রাম শুরু হয় এই সময়, একটি স্কুল অব মাইনস এ খন্ডকালীন চাকরী জোটে তার; পাশাপাশি পত্রিকায় নিবন্ধ আর রিভিউ লেখার কাজ শুরু করেন; সংসার চালানো তার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে যেত; হাক্সলী যারা বিজ্ঞানের নানা শাখায় আধিপাত্য বিস্তার করতেন শুধুমাত্র তাদের সম্পদ থাকার কারনে, তাদের প্রতি খানিকটা তিক্ততার অনুভূতি পোষণ করতেন; তারপরও তার সীমিত সামর্থের মধ্যে নিজের জন্য কিছু সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সাহসী হাক্সলী তখন ইংরেজ জীববিজ্ঞানীদের পুরোধা রিচার্ড ওয়েনকে আক্রমন করতে দ্বিধা বোধ করতেন না।
ওয়েন সে সময় একটি স্বর্গীয় বিবর্তনের ধারণা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন, তার প্রস্তাব ছিল, সময়ের প্ররিক্রমায় ঈশ্বর নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করেন, তবে সবসময়ই তার মুল পরিকল্পনার আদিরুপ বা একটি আর্কিটাইপের উপর ভিত্তি করে, ওয়েন জীবনকে দেখতেন ধাপে ধাপে সুন্দর একটি স্বর্গীয় পরিকল্পনার ক্রমশ উন্মোচন হিসাবে, যা সাধারণ থেকে ধীরে ধীরে বিশেষায়িত আর জটিলতর সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হতে থাকে: একটি ‘ঐশ্বরিক নির্দেশায়িত নিরন্তন পরিবর্তন (ordained continuous becoming) ; ওয়েন তার অর্থবান পৃষ্ঠপোষকদের শান্ত করার জন্য, যারা এখনও স্বাচ্ছন্দবোধ করে প্রজাতির জটিলতা ব্যাখ্যা করার জন্য ধর্মতত্ত্বের আশ্রয় নিতে, আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, ”জীববিজ্ঞান এখনও সর্ব্বোচ্চ নৈতিক ধারণাগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত।’
নানা বক্তৃতা আর পত্রিকার কলামে হাক্সলী ওয়েনকে উপহাস করেন ঈশ্বরকে একজন ড্রাফটসম্যান বা নকশা কারিগরে রুপান্তর এবং জীবাশ্ম রেকর্ডকে ঈশ্বরের বার বার পুণরাবৃত্তি বা রিভিশন হিসাবে দেখানো এই প্রচেষ্ঠাকে; হাক্সলী কোন ধরনের বিবর্তনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা মেনে নেননি, তা স্বর্গীয় হোক বা সাধারণ প্রাকৃতিকই হোক না কেন; তিনি পৃথিবীর বা জীবনের ইতিহাসের কোন অগ্রগতি দেখেননি তখন পর্যন্ত, তবে তার ধারণাটি বদলে যায় ১৮৫৬ সালে এক সপ্তাহন্তে, যখণ ডারউইন হাক্সলীকে তার ডাউন হাউসে নিমন্ত্রন জানান।
ডারউইন তাকে বিবর্তন সংক্রান্ত তার নিজস্ব সংস্করণটি বর্ণনা করেন, যা প্রকৃতির নানা প্যাটার্ণকে ব্যাখ্যা করেতে পারে ঐশ্বরিক বা বিশেষ কোন সত্ত্বার হস্তক্ষেপ ছাড়াই; তিনি হাক্সলীকে তার কবুতর আর বীজ দেখান, এবং বেশ তাড়াতাড়ি হাক্সলী ডারউইনের ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন, এবং পরবর্তীতে তিনিই ছিলেন ডারউইনের সবচেয়ে কাছের এবং শক্তিশালী একজন মিত্র।
ডারউইনের এই ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে তার তত্ত্বকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রক্রিয়া ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল, একটি চিঠি আসার আগ পর্যন্ত, জুন ১৮,১৮৫৮ সালে ডাউন হাউসে সএকটি চিঠি এসে পৌছায়, ডারউইন চিঠিটা পান পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে সুদুর মালয় দ্বীপপুন্জ থেকে একজন ভ্রমণরত প্রকৃতি বিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এর কাছ থেকে; ওয়ালেস তখন দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায়, নানা ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে পাঠাতেন তার খরচ চালানেরা জন্য এবং প্রজাতির বিবর্তনের ব্যাখ্যা খুজতেন তার কাজের ফাকে; তার ২১ বছর বয়সে তিনি রবার্ট চেম্বারস এর Vestiges of the Natural History of Creation বইটি পড়েছিলেন, এবং সময়ের পরিক্রমায় প্রকৃতির পরিবর্তনের এবং ক্রমান্বয়ে উর্ধমুখী সরল থেকে জটিলতর সৃষ্টির ধারণাটি তাকে মুগ্ধ করেছিল; ডারউইনের বীগল ভ্রমনের কাহিনী পড়ে তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, তাকেও যেভাবে হোক এমন সমুদ্র যাত্রায় যেতে হবে।
১৮৪৮ সালে তার প্রথম যাত্রা ছিল আমাজন জঙ্গল অভিমুখে; এরপর তিনি যান ডাচ উপনিবেশ বাটাভিয়ায়, যা এখন ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিত; তার উদ্দেশ্য ওরাঙ উটান সম্বন্ধে জানা, ও সেই সাথে মানুষের বংশধারা সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান অর্জন করা; সাধারণ পরিবারের ছেলে ওয়ালেস তার এই যাত্রার ব্যয়ভার মেটাতেন নানা ধরনের প্রানী বা উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করে লন্ডনে তার নানা খদ্দের এবং দোকানে পাঠানোর মাধ্যমে; তার নমুনার এরকম একজন খদ্দের ছিলেন ডারউইন, ডারউইন তার কাছ থেকে পাখি সংগ্রহ করতেন, এভাবে দুই প্রকৃতিবিদের সাথে চিঠি আদান প্রদান শুরু হয়।

(ছবি: অালফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, (ছবিতে তার জীবনের শেষে). ১৮৫৮ সালে ডারউইনকে তার রচনাটা পাঠানোর জন্য কোনদিনও মনস্তাপে ভুগেছিলেন কিনা, তা কখনো প্রকাশ করেননি।)
ডারউইন ওয়ালেসকে আরো ব্যাপকভাবে এবং তাত্ত্বিকভাবে বিবর্তন সম্বন্ধে ভাবতে পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাকে জানান কিভাবে প্রজাতির সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে তার নিজেরও একটি তত্ত্ব আছে; পরে প্রজাতির বিবর্তন সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে প্রায় একই ধারণায় উপনীত হওয়া ওয়ালেস সিদ্ধান্ত নেন ডারউইনকে ‍তিনি তার নিজের তত্ত্ব জানিয়ে একটি চিঠি লেখার; আর যখন ডারউইন চিঠি পড়লেন তিনি হতবাক হয়ে গেলেন; ওয়ালেস মালথাস ভালো করে পড়েছেন, এবং তার মত ওয়ালেসও প্রকৃতির উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রভাব কি হতে পারে সেটা ভেবেছিলেন; এবং ডারউইনের মত তিনিও উপসংহার টানেন এটিও সময়ের পরিক্রমায় প্রজাতিকে পরিবর্তন করে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে।
যখন তিনি ওয়ালেসের চিঠি পেয়েছিলেন, তখনও তারা নিজের লেখাটি আরো কয়েক বছর পর তার তত্ত্বটি প্রকাশের কথা ভাবছিলেন; কিন্তু তার এখন চোখের সামনেই আরেকজন বিজ্ঞানীর হাতে লেখা তার নিজের আবিষ্কৃত তত্ত্বের অনেকটুকু, যদিও হুবুহু নয় : ওয়ালেস একই প্রজাতির সদস্যদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি, তিনি শুধু প্রস্তাব করেছিলেন, অযোগ্য বা আনফিট সদস্যদের বাছাই করে বাদ দিয়ে দেয় পরিবেশ; কিন্তু ডারউইন ওয়ালেস এর প্রাপ্য স্বীকৃতি কেড়ে নেননি, ওয়ালেস এখন স্বীকৃত প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটি সহ-উদ্ভাবক হিসাবে; তার ভদ্রতা আর সন্মানবোধ অনেক গভীর, তিনি তার নিজের বই পুড়িয়ে ফেলবেন তবে এমন কিছু করবেন না যেন কেউ তার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারে, তিনি ওয়ালেস এর সাথে প্রতারণা করেছেন; সুতরাং ডারউইন লাইয়েল সাথে আলোচনা করে লীনিয়ান সোসাইটিতে দুটো গবেষনাপত্রই পাঠ করে শোনানো উদ্যোগ নেন।

(ছবি: আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (বায়ে) বিবর্তন কেমন করে কাজ করছে সে বিষয়েই শুধুমাত্র ডারউইনের মত একই উপসংহারেই পৌছাননি,এমনকি তিনি একই বাক্য ব্যবহার করেছিলেন তার তত্ত্বাটকে ব্যাখা করতে..)
১৮৫৮ সালে জুন ৩০, সোসাইটির সদস্যরা প্রথম বারের মত ডারউইনের ১৮৪৪ সালে লেখা প্রবন্ধটির সার সংক্ষেপ, এবং ১৮৫৭ সালে তার তত্ত্বের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে হুকারকে লেখা একটি চিঠির কিছু অংশ এবং ডারউইনকে পাঠানো ওয়ালেস এর প্রবন্ধটি শোনেন; তার বিশ বছরের সতর্ক গবেষনা আর এটি প্রকাশ করার বিষয়ে তার ইতস্ততার ইতি হয় হঠাৎ করে; এখন সারা পৃথিবী বিচার করার পালা। কিন্তু তেমন কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া শুরুতে আসেনি; ডারউইন এবং ওয়ালেস এর পেপারটি পড়া হয়েছিল লীনিয়ান সোসিইটির দীর্ঘ একটি অধিবেশনে প্রায় তাড়াহুড়ো করেই..এবং নীরবতাই পেপার দুটির ভাগ্যে জুটেছিল সেই মুহুর্তে; হয়তো সেগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত, বা সদস্যরা যথেষ্ট নম্র ছিল যে তারা অনুধাবন করতে পারেননি সেমুহুর্তে ডারউইন এবং ওয়ালেস আসলে কি প্রস্তাব করেছেন তাদের যুগান্তকারী দুটি প্রবন্ধে।

(ছবি: লিনিয়ান সোসাইটিতে ডারউইন রাসেল যৌথ পেপার পড়ার শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মারক প্লেক)
এর পর ডারউইন সিদ্ধান্ত নিলেন একটি বৈজ্ঞানিক জার্ণালে এ বিষয়ে তার মূল যুক্তিগুলো তুলে ধরবেন বিস্তারিতভাবে; এর পরের মাসে ডারউইন অনেক চেষ্টা করলেন তার সুবিশাল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে ছোট একটি সারসংক্ষেপ আকারে নিয়ে আসার, যেন তিনি তা জার্ণালে প্রকাশ করতে পারেন; কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো তার সেই সার সংক্ষেপই আবারো আকার নিতে শুরু করলো একটি পুর্ণাঙ্গ বইয়ের; কিছু করার ছিল না তার, ডারউইনের কাছে অনেক বেশী যুক্তি তর্ক প্রস্তাব এবং প্রমান ছিল যা যে কোন সম্ভাব্য প্রতি আক্রমন যা তিনি জানতেন অবশ্যই আসবে, তাদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে; তিনি জন মারে র সাথে যোগাযোগ করেন, তার আগের বইটির লন্ডন ভিত্তিক প্রকাশক, এবং জিজ্ঞাসা করেন তিনি তার আরেকটি নতুন বই প্রকাশ করতে আগ্রহী কিনা ;তার Journal of Researches বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, সুতরাং মারে ডারউইনের নতুন বই প্রকাশে রাজী হলেন সাথে সাথেই; এই বইটি নামই On the Origin of Species by Means of Natural Selection;

(ছবি: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাডক্লিফ সায়েন্স লাইব্রেরীতে দ্য অরিজিন অব স্পিসিস এর প্রথম সংস্করণের সাথে প্রাণিবিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স)
বইটি লেখার সময়ই ডারউইন বেশ গুরুতর অসুস্থ্ হয়ে পড়েছিলেন তবে, রাজকীয় সবুজ রঙের কাপড়ে বাধাই প্রথম কপিটি তার হাতে এসে পৌছায়, ১৮৫৯ সালের নভেম্বর মাসে; ইয়র্কশায়ারের একটি বিশ্রামাগারে তিনি আরোগ্য লাভ করছিলেন, এর পরপরই তার জন্য সৌজন্য কপিগুলো আসে, ডারউইন সবার প্রথমেই ওয়ালেসকে একটি কপি তার ইন্দোনেশিয়ার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন; এবং বইটির সাথে ছোট একটি চিরকুট লিখে দিয়েছিলেন, ‘ঈশ্বরই জানেন, মানুষ কি ভাববে’।



(ছবি: চিহুয়াহুয়া (Chihuahua) এবং গ্রেট ডেন (Great Dane): দুজনেই চামড়ার নীচে আসলে নেকড়ে।মাত্র কয়েক শতাব্দীর কৃত্রিম নির্বাচন বা সিলেকটিভ ব্রিডিং এর ফলে সৃষ্ট এই দুই জাতের কুকুরের ব্যাহ্যিক চেহারা দেখে তা কি অনুমান করা সম্ভব? গ্রে উলফ (Canis lupus) এর একটি উপপ্রাজাতি মানুষের প্রিয় প্রাণি সহচর কুকুর ( Canis lupus familiaris); বর্তমান সব জাতের কুকুরের বংশধারা ধারণা করা হয় ১৫,০০০ বছর আগে গ্রে উলফ প্রজাতিকে গৃহপালিত করন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল। যদিও ৩৩,০০০ হাজার বছর আগেও গৃহপালিত কুকুরের চিহ্ন মিলেছে, তবে আগের লিনিয়েজগুলো টেকেনি।)


এভাবে দেখা জীবনকে দেখার মধ্যে আছে আরো বেশী আসাধারণত্ব আর মাহাত্ম্য
Origin of Species বইটির মুল যে যুক্তি তর্কটি এসেছে, সেটি বিবর্তিত হয়েছিলো ১৮৪৪ সালের ডারউইনের সেই আগের লেখাটির আদিরুপ থেকেই, তবে এখন এটির ব্যপ্তি আরো বর্ধিত হয়েছে, যা পৃথিবীর সব জীবনের একটি সর্বব্যাপী ব্যাখ্যা। বহুদূরের সেই গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ কিংবা প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা সমুদ্রের সেই বিষন্ন গভীরতা থেকে কিন্তু ডারউইন তার প্রস্তাবিত তত্ত্বের পক্ষের যুক্তিগুলো শুরু করেননি; তার যুক্তিগুলোর সূচনা ভিত্তি ছিল খুব সাধারণ কিছু অভিজ্ঞতা, স্বাচ্ছন্দ্যময় ইংলিশ জীবনযাত্রায়। তিনি অসংখ্য আকার আকৃতির প্রাণি এবং উদ্ভিদের কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন, যাদের বৈশিষ্ট্যসুচক সেই বহু বিচিত্র রুপ গড়ে উঠেছে মানুষ ‍খামারী বা ব্রীডারদের হাতের ছোঁয়ায় ; যারা কবুতরের প্রজনন করান, তারাই ফ্যানটেইল জাতের কবুতরে লেজে সাধারণত যতটুকু পালক থাকে তা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বহুগুনে, কিংবা জাকোবিন জাতের কবুতরে গলার পালককে রুপান্তরিত করেছিলেন একটি বেশ বড় একটি আচ্ছাদনী বা হুডে; এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকৃতিতে যথেষ্ঠ হবে কোনো পাখিকে একটি একক প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য, অথচ ব্রীডাররা তাদের সৃষ্টি করেছেন মাত্র কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে ও তারা একই প্রজাতি।

(ছবি: ইংলিশ ফ্যানটেইল পিজিওন)

(ছবি: jacobin pigeon)
ডারউইন তার সময়ের বিদ্যমান তথ্যে বন্দী ছিলেন, তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, আসলে কেউ বুঝতে পারেননি কিভাবে বংশগতি এই ব্রীডারদের এই অত্যাশ্চর্য বিচিত্র রুপের সৃষ্টি করতে অনুমতি দিচ্ছে। ব্রীডাররা তাদের অভিজ্ঞতায় শুধু বুঝতে পারতেন এবং জানতেন কোন কোন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রবণতা আছে একই সাথে বা একগুচ্ছ হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার ; নীল চোখের বিড়াল, যেমন অবশ্যই কানে শোনে না বা বধির হয়।

(ছবি: ছবি: কয়েকটি ব্রীডের কুকুর (উপরে বা দিক থেকে): বুলডগ, বক্সার, ডাখশুন্ড;( মধ্যে বা দিক থেকে): ব্যাসেট হাউন্ড, বরজোয়, ল্যাব্রাডর রিট্রিভার,(নীচে: বা দিক থেকে): পুডল, ল্যাবরাডুডল, স্কটি)

(ছবি: কয়েকটি ব্রীডের কুকুর (উপরে বা দিক থেকে: পেকিনেস, ডালমেশিয়ান,পোমেরানিয়ান, নীচে বা দিক থেকে: হুইপেট, স্প্যানিয়েল, সেন্ট বার্ণাড)
যদিও বংশগতি তখনও রহস্যময়, তারপরও এটা সবার কাছে স্পষ্ট ছিলো, পিতা মাতা এমন সন্তানের জন্ম দেন, তারা সাধারণত তাদের মতই হবার প্রবণতা থাকে, যদি প্রতিটি প্রজন্মই তার নিজস্ব কিছু না কিছু প্রকরন বা ভ্যারিয়েশন নিয়েই জন্ম গ্রহন করে; আপনার যদি প্রকৃতিতে বা কোন বনে ফ্যানটেইল বা জাকোবিন জাতের কবুতর নজরে পড়ে, আপনি ভাবতেই পারেন যে তারা হয়তো ভিন্ন দুটি প্রজাতি, কিন্তু বিস্ময়করভাবে তারা একে অপরের সাথে প্রজননক্ষম এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে; আসলেই ডারউইনই দেখিয়েছিলেন, প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রজাতি এবং নানা প্রকারের মধ্যে পার্থক্য করা খুবই কঠিন; যেমন জীববিজ্ঞানীরা তর্ক করেন বেশ কিছু ধরনের ওক গাছ কি আসলে আদৌ একই প্রজাতির সদস্য কিনা।
ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন যে এই ভ্যারাইটি বা প্রকরণগুলো নিয়ে উদ্ভুত সংশয়ের কারণ হচ্ছে প্রজাতি হিসাবে এই সব বিভিন্ন প্রকারের প্রকরণের মধ্যে কিছু মৌলিক সদৃশ্যতা বিদ্যমান; এবং এর কারণ হচ্ছে এই ভ্যারাইটি বা নানা প্রকারের সদস্যরা নিজেই ভবিষ্যত প্রজাতির শুরুর প্রাথমিক একটি অবস্থা যারা এখনও বৈশিষ্ট্য সূচক ভিন্ন প্রজাতিতে পুরোপুরি বিবর্তিত হয়নি ; তাহলে কিভাবে একটি এখনও পুরোপুরি হয়নি এমন কোনো প্রজাতি, একটি বৈশিষ্ট্যসূচক পূর্ণ প্রজাতিতে রুপান্তরিত হয়?
এখানে ডারউইন মালথাসকে তার যুক্তিতে নিয়ে আসেন; এমনকি খুব ধীরে প্রজনন করা প্রজাতি যেমন মানুষ কিংবা কনডরাও( পাখি) তাদের সংখ্যা দ্বিগুন করে ফেলতে পারে ২০ বা ৩০ বছরের ব্যবধানে; এবং কয়েক হাজার বছরে সারা পৃথিবী তারা পুর্ণ করতে পারে তাদের সদস্য দিয়ে। কিন্তু বৃক্ষ আর প্রাণিরা নিয়মিত ভাবে মারা যাচ্ছে অকল্পনীয় বিশাল বড় একটি সংখ্যায়, ডারউইন তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানতেন কিভাবে এক বছরেই ডাউন হাউসের চারপাশে একবার তীব্র শীতে পাখির সংখ্যা কমে গিয়েছিল প্রায় ৮০ শতাংশ; আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে প্রকৃতির শান্ত প্রতিচ্ছবির পেছনের লুকানো আছে বিশাল নিরন্তর ভাবে ঘটতে থাকা হত্যাযজ্ঞ; প্রজাতির কিছু সদস্য বেঁচে থাকে নানা চ্যালেন্জ মোকাবেলা করে, তার কিছু কারণ হচ্ছে ভাগ্য, আর অন্যরা, যাদের কিছু বৈশিষ্ট্যই হয়তো থাকে যা তাদের মৃত্যুর উচ্চ প্রবণতার কারণ হয়ে দাড়ায়; যারা বেঁচে থাকে তারাই প্রজননক্ষম হবার সময় আর প্রজনন করার সুযোগ পায়, অন্যদিকে যারা ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না, তারা মারা যায়, তাদের প্রজননক্ষম হয়ে উঠে প্রজনন করার সম্ভাবনাও থাকে খুব কম।
প্রকৃতি, অন্যভাবে যদি বলা হয়, আসলে নিজেই একজন ব্রীডার বা প্রজনন নিয়ন্ত্রনকারী এবং মানব কোনো ব্রীডারের চেয়ে অবশ্যই যার ক্ষমতা আর দক্ষতা অনেক বেশী; একজন মানুষ ব্রীডার হয়তো কোন বিশেষ জাতের কবুতর ব্রীড করে শুধু একটি বা গুটিকয়েক বৈশিষ্ট্যের জন্য, যেমন তার লেজের বেশী সংখ্যক পালকে, কিন্তু প্রকৃতি ব্রীড করে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, শুধু রক্ত মাংশ শরীরের বৈশিষ্ট্যই না, তাদের অন্তর্গত প্রবৃত্তিও: ‘প্রকৃতি আভ্যন্তরীণ সকল অঙ্গ, গঠনগত বৈশিষ্ট্যের যে কোনো পার্থক্য, পুরো জীবনের যন্ত্রের উপর কাজ করে।’ ডারউইন লিখেছিলেন,‘মানুষ নির্বাচন করে শুধু তার নিজের স্বার্থে, আর প্রকৃতি কাজটি করে যে জীবনকে সে লালন করছে শুধু তার স্বার্থেই;’ আর মানুষ ব্রীডাররা কাজ করেন বছর বা দশকের সময়কালে, প্রকৃতির হাতে আছে অকল্পনীয় আর অপরিসীম সময়: ‘বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক নির্বাচন সারা বিশ্ব জুড়ে প্রত্যহ , প্রতিটি ঘন্টায় বাছাই করে প্রতিটি প্রকরণকে, এমনকি সামান্যতম।’ ডারউইন লিখেছিলেন; ‘আমরা এই ধীর পরিবর্তনের গতি কিছুই দেখতে পাইনা, যতক্ষণ পর্যন্ত সময়ে ঘড়ির কাটা বহু যুগের সময় অতিক্রম না করে; যদি প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো একটি প্রকরণের উপর কাজ করে যথেষ্ঠ পরিমান সময়ব্যাপী, এটি ‌একে রুপান্তরিত করতে পারে একটি নতুন প্রজাতিতে; প্রায় এক হাজার প্রজন্মান্তরে একটি একক প্রজাতির পাখি দুটি ভিন্ন প্রকারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রুপান্তরিত হতে পারে দুটি স্বতন্ত্র প্রজাতিতে; যেমন করে কোনো একটি প্রজাতির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দীতা করে টিকে থাকার জন্য, তারা অন্য প্রজাতিদের সাথেও সংগ্রাম করে একই কারণে; এবং দুটি সমতুল্য প্রজাতির মধ্যে সংগ্রামটি আরো বেশী তীব্র; ধীরে ধীরে এদের একটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়, এটাই ডারউইন যুক্তি দেন সেই সকল জীবাশ্ম প্রাণীদের অনুপস্থিতির কারণ যাদের অস্তিত্ব ‍আর এই পৃথিবীতে পাওয়া যায় না; তারা শুধু অদৃশ্যই হয়নি, তারা অন্য প্রাণিদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল।

(ছবি: আপনি কি জানেন, Brassica oleracea বা ওয়াইল্ড ক্যাবেজ বা ওয়াইল্ড মাষ্টার্ড নামে পরিচিত এই উদ্ভিদটি আমাদের পরিচিত প্রিয় অনেক সব্জীর পূর্বসূরি। হাজার বছর ধরে কৃষকরা এর উপর তাদের আর্টিফিসিয়াল বা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছে আমাদের পরিচিত বাধাকপি, ফুলকপি আর ব্রকলী। (নীচের ছবি দেখুন) কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটি বুনো প্রজাতি থেকে পেয়েছি একগুচ্ছ সব্জী)

(ছবি: কৃষকরা এই সব্জীর বৈচিত্র সৃষ্টি করেছেন কয়েক হাজার বছল ধরে, এবার ভাবুন কয়েকশ মিলিয়ন বছর ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন কেন পারবেনা জীবজগতের এত বৈচিত্রময়তার জন্ম দিতে।

(ছবি: বুনো সূর্যমুখী থেকে শস্য সূর্যমুখী (Helianthus annus); খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ বছর আগে মধ্য আমেরিকার (মেক্সিকো) আদিবাসীরা এই ফুলটি প্রথম গৃহপালিতকরণ করেছিল।)
তার পাঠকদের সেই প্রক্রিয়াটি বোঝাতে ডারউইন একটি রেখাচিত্র একেছিলেন যা তার বইতে জায়গা পেয়েছিল, সবচেয়ে নীচে অল্প কিছু মুল প্রজাতি, যা কোন গাছের মূল কাণ্ডের মত উঠে এসেছে, এবং সময়ের পরিক্রমায় এটি বিভক্ত হয়েছে নতুন শাখা প্রশাখায়, এই শাখা প্রশাখার অনেকগুলোই সামান্য একটি ডাল মাত্র, যারা প্রতিনিধিত্ব করছে সেই নানা প্রজাতি বা প্রকরনের বা ভ্যারাইটির যারা বিলুপ্ত হয়েছে; কিন্তু তাদের কিছু পৃষ্ঠার উপর পর্যন্ত অতিক্রম করেছে নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে; জীবন কোন বিশাল জীবিত প্রানীর ক্রমান্বয়ে সাজানো শৃঙ্খল বা চেইন না, ডারউইন বললেন, জীবন একটি একটি অসংখ্য ডালপালা ছড়ানো ঝোপের মত একটি গাছ।
Origin of Species অত্যন্ত গভীর একটি তত্ত্বকে সমর্থন করে লেখা মূলত আত্মরক্ষামূলক একটি বই, যা লিখেছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি বহুদিন ধরেই অন্য বিজ্ঞানীদের বিবর্তন সম্বন্ধে তীর্যক মন্তব্য শুনে এসেছেন, তার প্রতি সেই একই মন্তব্য হবে সেটা যেন তিনি আগে থেকে কল্পনা করেই নিয়েছিলেন ; তিন এক একটি করে তাদের সম্ভাব্য সব প্রতিযুক্তি খণ্ডন করেন; যদি পুরোনো প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে, তাহলে কেন প্রাণিরা একে অপরের চেয়ে এত বেশী আলাদা দেখতে হবে: ‘এর উত্তর হচ্ছে দুটি পরস্পর সদৃশ প্রাণিদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দীতা তাদের যে কোনো একটিকে বিলুপ্ত করে’, সুতরাং এই মুহুর্তে জীবিত সকল প্রাণি আসলে সকল প্রজাতি যারা একসময় বেঁচে ছিল তাদের একটি নির্বাচিত বিচ্ছিন্ন ছড়ানো ছিটানো সংগ্রহ মাত্র।
কিন্তু তাহলে আমাদের কি জীবাশ্ম হিসাবে অন্তবর্তী বা মাঝামাঝি ফর্মগুলো দেখা উচিৎ না? ডারউইন তার পাঠকদের মনে করিয়ে দেন যে, জীবাশ্ম এর প্রকৃতি অনুযায়ী জীবনের ইতিহাসের অল্প কিছু অংশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে শুধু; কারণ জীবাশ্মতে রুপান্তরিত হতে হলে, কোন প্রানীর মৃতদেহ পাললিক শিলা বা পলির নীচে সঠিকভাবে সমাহিত হতে হবে, যা রুপান্তরিত হবে পাথরে এবং যা ধ্বংস হবে না ভুমিকম্পে বা অগ্ন্যুৎপাতে কিংবা ক্ষয়ীভবনের মাধ্যমে; এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত বেশী মাত্রায় ধীর,এবং প্রজাতিও তাই, যে প্রজাতির একসময় লক্ষ লক্ষ একক প্রাণি সদস্য ছিল, তাদের আমরা জানতে পারি শুধু মাত্র একটি বা গুটিকয়েক জীবাশ্ম থেকে; জীবাশ্ম রেকর্ডে তাই শূন্যস্থান থাকা আদৌ কোনো বিস্ময়কর কিছু মনে করা উচিৎ না, সেটাই বরং নিয়ম হওয়া উচিৎ: ‘ভূপৃষ্ঠ হচ্ছে বিশাল একটি মিউজিয়াম’, ডারউইন লিখেছিলেন, ‘কিন্তু প্রাকৃতিক সংগ্রহগুলো সেখানে তৈরী হয় শুধুমাত্র অকল্পনীয় সময়ের ব্যবধানে।’
কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন জটিল অঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে কিংবা সমস্ত শরীর, যার অসংখ্য স্বতন্ত্র অংশ বিদ্যমান? কেমন করে, যেমন এটি একটি বাদুড় বা কোন চোখের মত একটি অঙ্গ তৈরী করে? পুরো কাহিনী জীবাশ্ম বলবে এমন আশা করা ঠিক না, বরং ডারউইন জীবন্ত প্রানীদের উদহারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, নিদেনপক্ষে এমন কোন রুপান্তর আদৌ যে অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়; বাদুড়ের ক্ষেত্রে, তিনি কাঠবিড়ালীর উদহারণ দেন, অনেক গাছবাসী কাঠবিড়ালী চারটি সাধারণ পা এবং একটি পাতলা লেজ আছে, কিন্তু এমন প্রজাতিও আছে যাদের সরু লেজ ও পাতলা চামড়াও আছে, আবার এমনও কাঠবিড়ালী আছে তাদের লেজ আর পায়ের মাঝে চওড়া চামড়ার পর্দাও আছে; এবং তারা পারাস্যুটের মত তাদের ব্যবহার করে গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে ভেসে যেতে; এর পর ডারউইন আরো এমন বাতাসে গ্লাইড করা স্তন্যপায়ীদের কথা বলেন, যেমন ফ্লাইং লেমুর, যাদের শরীরের দুইপাশে বেশ চওড়া চামড়ার উপাঙ্গ আছে, যা চোয়াল থেকে শুরু হয় লেজ অবধি; চার পেয়ে স্তন্যপায়ীর এটি একটি হালকা ধাপে ধাপে নানা স্তরের বৈশিষ্ট্যর একটি উদহারন যার এক প্রান্তে আছে বাদুড়ের মত অ্যানাটোমি সহ প্রানী; সম্ভব হতে পারে যে বাদুড়দের পূর্বসূরি প্রাণিরাও বিবর্তনের এমন ধারাবাহিক ধাপগুলো অতিক্রম করেছিল এবং আরো কিছু ধাপ অতিক্রম করেছিল যেখানে তাদের সত্যিকারের ওড়ার জন্য তাদের মাংশপেশীর বিবর্তন হয়েছিল।
একই ভাবে কোনো প্রাণির মাথায় একবারে হঠাৎ করেই চোখের উদয় হবার কোনো প্রয়োজন নেই; অমেরুদণ্ডী যেমন, ফ্ল্যাট ওয়ার্ম দের আলোক সংবেদী পিগমেন্ট দিয়ে স্নায়ুর শেষ প্রান্ত আচ্ছাদন করে রাখা স্তর ছাড়া আর কিছু নেই, কিছু ক্রাষ্টাশিয়ানদের চোখ আছে, যা শুধুমাত্র একটি আলোক সংবেদী পিগমেন্ট স্তর যার উপর একটি পর্দা আছে; সময়ের সাথে সাথে এই পর্দাই পিগমেন্ট স্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্থুল গঠনের লেন্স হিসাবে কাজ করতে শুরু করে; ছোট ছোট পরিবর্তনের দ্বারা, এমন একটি চোখ রুপান্তরিত হতে পারে জটিল একটি সূক্ষ্ম টেলিস্কোপের মতো চোখে যা পাখি এবং স্তন্যপায়ীদের ব্যবহার করে; কারণ সামান্য দৃষ্টি শক্তি কোনো দৃষ্টিশক্তি না থাকার চেয়ে উত্তম; এবং এই উত্তরণের প্রতিটি নতুন ধাপকে টিকিয়ে রেখে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরের সুযোগ করে দিয়ে পুরষ্কৃত করে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়টি আবিষ্কারের পর, ডার‌উইন অন্য বিজ্ঞানীদের ধারণার দিকে নজর ফেরান এবং প্রমাণ করে দেখান তাদের প্রস্তাবগুলো তার নিজের তত্ত্বের কাঠামোতে ব্যাখ্যা করলে কত অর্থবহ হয়ে ওঠে; তারুণ্যে ডারউইন উইলিয়াম প্যালির ভক্ত ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি দেখালেন কিভাবে প্রাকৃতিক ডিজাইন কোনো স্বর্গীয় ডিজাইনার এর নিয়ন্ত্রন, প্রভাব আর উপস্থিতি ছাড়াই সৃষ্টি হতে পারে; কার্ল ভন বায়ের দেখিয়েছিলেন কিভাবে বিভিন্ন প্রাণীদের ভ্রুণ পরস্পর সদৃশ্যতা বহন করে একেবারে সূচনা লগ্নে এবং ধীরে ধীরে যারা ক্রমবিকশিত হয় বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্ন প্রাণির আকারে আরো নির্দিষ্ট হয়ে; ডারউইনের জন্য এটি সকল জীবের একটি সাধারণ বা কমন বংশ ঐতিহ্যের চিহ্ন; এবং ক্রমবিকাশের পর্যায়ে তাদের এই পার্থক্য আবির্ভূত হয়েছে তাদের সাধারণ পূর্বসূরি প্রাণি থেকে তাদের বিভাজনের পরে।

(ছবি: মলিক্যুলার বায়োলজির অগ্রগতি..ডারউইনের সেই কমন বংশধারার ব্যাপারটি বহু আগেই প্রমাণিত করেছিল। বর্তমানে জীবন বৃক্ষ দেখতে এরকম; এটি তৈরী করেছে ২০০৬ সালে ইউরোপীয় মলিকিউলার বায়োলজী ল্যাব… এখানে মানুষকে খুজে বের করুন।)
ডারউইন এমনকি ওয়েন এর আর্কিটাইপ বা আদিরুপের ধারণাটিও তার ব্যাখ্যায় আত্মীকরণ করতে সক্ষম হলেন; ‘আমি ওয়েন এর আদিরুপ বা আর্কিটাইপদের দেখি আদর্শের চেয়ে আরো বেশী কিছু , সবচেয়ে নিবেদিত শক্তি আর সবচেয়ে ব্যাপ্তিময় সাধারণীকরনের যত দুর সম্ভব তত বাস্তব একটি প্রতিফলন, যা প্রতিনিধিত্ব করে সকল মেরুদন্ডী প্রাণিদের পিতামাতাকে।’ এভাবে তিনি একবার তার এক সহকর্মীকে লিখেছিলেন; ওয়েন এর কাছে, বাদুড়ের ডানা এবং ম্যানাতির প্যাডেল এর সমরুপতা বা হোমোলজী প্রমাণ করে কিভাবে ঈশ্বরের মন কাজ করে, কিন্তু ডারউইনের কাছে এই সমরুপতা একটি কমন বংশধারার ঐতিহ্যের চিহ্ন; ডারউইন খুব সতকর্তার সাথে তার তত্ত্ব মানব জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে কি বলে সে বিষয়টি নিয়ে বেশী কোনো বক্তব্যকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন; ‘আমি দূর ভবিষ্যতে দেখতে পাচ্ছি আরো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। মনোবিজ্ঞান একটি নতুন ভিত্তির উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে যা হলো ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মানসিক শক্তি আর ক্ষমতা অর্জন করার উপর; এবং সেই সাথে মানুষের উৎপত্তি এবং তার ইতিহাসের বিষয়ে আমরা জানতে পারবো’।
রবার্ট চেম্বারস তার ভেস্টিজ বইটিতে যে ভুল করেছিলেন, ডারউইন সেই ভুল করবেন না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; তার যুক্তি ছিল জোরালো, এবং সেখানে তিনি আবেগের কোনো জায়গা রাখেন নি; কিন্তু ডারউইন চেষ্টা করেছিলেন তার বই পড়ে কারো মনে জেগে ওঠা কিছু সম্ভাব্য হতাশাকে দুর করতে, তার বইয়ের শেষ পংক্তিগুলোতে তিনি তার অসাধারণ লেখণীতে লেখেন:
‘এইভাবে, প্রকৃতির যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যু থেকেই আমাদের পক্ষে ভাবা সম্ভব এমন সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন বস্তু, যেমন উন্নত প্রাণির সৃষ্টি, সরাসরি জড়িত। জীবনকে এইভাবে দেখার মধ্যে আছে একধরনের বিশালতা, ‍(জীবন) তার বহুমূখী ক্ষমতা দিয়ে সে সূচনা করেছিল এক কিংবা কয়েকটি আকার নিয়ে; খুব সাধারণ সেই সূচনা থেকে সেটাই, এই গ্রহটি যখন মাধ্যাকর্ষণের ধরাবাধা নিয়ম মেনে মহাকাশে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে, বিবর্তিত হয়েছে যা কিছু ছিল আর বর্তমানে আছে এমন অগনিত সুন্দর আর বিস্ময়কর নানা আকার আর প্রকৃতির জীবনে’।

নরবানর বনাম বিশপ এবং একটি ধারণার বিজয়
সেবার শীতে বেশ প্রবল তুষার ঝড়ে ইংল্যান্ড যখন গৃহ বন্দী, অন্তত হাজার খানেক মানুষ ডারউইনের বইয়েই উষ্ণতা খুজে পেলেন, বইটির প্রথম সংস্করণের ১২৫০ কপি একদিনে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, জানুয়ারী ৩ তারিখে, আরো ৩০০০ কপি ছাপা হলো, হাক্সলী ডারউইনকে চিঠি লিখলেন প্রশংসা করে এবং সেই সাথে তাকে সতর্ক করে দিলেন, আসন্ন যুদ্ধেরও, ‘আমি আমার নোখ আর ঠোট শানাচ্ছি প্রস্তুতিতে..’, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন। বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সংবাদপত্র কেবল সংক্ষিপ্ত একটি প্রবন্ধ ছাপিয়েছিল বইটির বিষয়ে কিন্তু রিভিউ বা পর্যালোচনা, যার মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীতে নানা বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতো বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক সমাজে, সেখানে ডারউইনের বইটি নিয়ে আরেকটু গভীরে আলোচনা করা হয়; হাক্সলী এবং অন্য মিত্ররা ডারউইনকে সমর্থন করেন প্রশংসা করে, কিন্তু অনেক রিভিউ এটিকে ব্লাসফেমী বা ধর্মদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে; দ্য কোয়ার্টালী রিভিউ দাবী করে ডারউইনের তত্ত্ব ‘সৃষ্টির সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক যা উন্মোচিত হয়েছে ধর্মগ্রন্থে’ সেই বিষয়কে চ্যালেন্জ করেছে এবং বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেছে এবং এটি তার ”মহান মহিমার সাথে অসামন্জষ্যপূর্ণ।’

(ছবি: বিবর্তন তত্ত্বের সেই শুরুর দিকে যে মানুষটি একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়েছিলেন তিনি হাক্সলী; ডারউইন কখনোই সরাসরি কারো সাথে বিতর্ক বা দ্বন্দে যাননি, তার হয়ে সেই কাজটি করেছিল তার বন্ধুরা, বিশেষ করে হাক্সলী; লন্ডনের ন্যাচারল হিস্টি মিউজিয়ামে হাক্সলীর ভাস্কর্য।)
কিন্তু যে রিভিউটি ডারউইনকে সবচেয়ে ক্ষুদ্ধ করেছিল সেটি প্রকাশ করেছিল দি এডিনবরা রিভিউ, ১৮৬০ সালের এপ্রিল মাসে, সেখানে কোন নাম ছিল লেখকের, কিন্তু যারা ইংল্যান্ডের জীববিজ্ঞানের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রিচার্ড ওয়েন এর লেখনূীর সাথে পরিচিত ছিলেন তারা বুঝতে পেরেছিলেন, আসলে বেনামে এই লেখাটি তিনি লিখেছেন, লেখাটির মধ্যে শক্রতাপূর্ণ মনোভাব ছিল চমকে দেবার মত; ওয়েন ডারউইনের বইটিকে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের একটি চুড়ান্ত অপব্যবহার’, তিনি অভিযোগ করেন, ‘ডারউইন ও তার শিষ্যরা এমন একটা ভান করছেন যেন প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে একমাত্র সম্ভাব্য প্রাকৃতিক সৃষ্টির আইন’। ওয়েন নিজে কিন্তু আসলে বিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন না কখনোই, তিনি শুধু যা পছন্দ করেননি তা হলো ডারউইনের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ার, যা তার কাছে মনে হয়েছে অন্ধ বস্তুবাদিতা; কিন্তু তারপরও ডারউইন যা করতে পেরেছিলেন,ওয়েন সেটা পারেননি, ওয়েন চেষ্টা করেছিলে জীববিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারকে সংশ্লেষণ করতে, কিন্তু তার ফলাফল হয়েছিল অস্পষ্ট ঘোলাটে আদিরুপ এবং ঈশ্বরের নিরন্তর সৃষ্টি ধারণাটি; কিন্তু অন্যদিকে ডারউইন সফল হয়েছিলেন প্রজাতিদের মধ্যে সদৃশ্যতাকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে যা কাজ করে যাচ্ছে প্রতিটি জীবিত প্রজন্মে; ওয়েন আসলেই ক্রোধান্বিত হয়ে লিখেছিলেন তার রিভিউটি, তার রাগ ছিল ডারউইন এবং হাক্সলী, দুজনের উপরেই।

(ছবি: ওয়েন ডারউইনের বইটিকে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের একটি চুড়ান্ত অপব্যবহার’; তিনি অভিযোগ করেন, ‘ডারউইন ও তার শিষ্যরা এমন একটা ভান করছেন যেন প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে একমাত্র সম্ভাব্য প্রাকৃতিক সৃষ্টির আইন;’ ওয়েন নিজে কিন্ত আসলে বিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন না কখনোই, তিনি শুধু যা পছন্দ করেননি তা হলো ডারউইনের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ার, যা তার কাছে মনে হয়েছে অন্ধ বস্তুবাদিতা; কিন্তু তারপরও ডারউইন যা করতে পেরেছিলেন,ওয়েন সেটা পারেননি, ওয়েন চেষ্টা করেছিলে জীববিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারকে সংশ্লেষণ করতে, কিন্তু তার ফলাফল হয়েছিল অস্পষ্ট ঘোলাটে আদিরুপ এবং ঈশ্বরের নিরন্তর সৃষ্টি ধারনাটি; কিন্তু অন্যদিকে ডারউইন সফল হয়েছিলেন প্রজাতিদের মধ্যে সদৃশ্যতাকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে যা কাজ করে যাচ্ছে প্রতিটি জীবিত প্রজন্মে; ওয়েন আসলেই ক্রোধান্বিত হয়ে লিখেছিলেন তার রিভিউটি, তার রাগ ছিল ডারউইন এবং হাক্সলী, দুজনের উপরেই।)
হাক্সলী ওয়েনকে তার উন্মুক্ত বক্তৃতার সময় এমন তীব্রভাবে আক্রমন করতেন যে তিনি হতবাক হয়ে যেতেন; হাক্সলী ওয়েনকে তীব্র অপছন্দ করতেন, বিশেষ করে অভিজাত বিত্তবান শ্রেণীর একজন প্রতিনিধি হিসাবে সমাজের সেই শ্রেণীর মধ্যে ওয়েন যেভাবে তার নানা কাজের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ আর পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন মুলত তার জন্য। হাক্সলী একে রদ্দি মার্কা বিজ্ঞান বলতেন; তিনি ওয়েন এর নিরন্তর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে অবাস্তব গালগপ্প বলে ঠাট্টা করতেন, ওয়েন এত বেশী রেগে গিয়েছিলেন তার ঠাট্টায় যে একবার একটি পাবলিক বক্তৃতা চলাকালীন সময় তিনি ক্রদ্ধ হয়ে হাক্সলীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কিনা জীবাশ্ম রেকর্ডে ধারাবাহিক ভাবে স্বর্গীয় বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ দেখতে পারেন না, তার অবশ্যই কোনকিছু , হয়তো জন্মগত, সমস্যা আছে তার মানসিক ক্ষমতায়।’
সবচেয়ে হিংস্র দ্বন্দ্বটি ঘটে Origin of Species প্রকাশের ঠিক এক ব্ছর আগে, যখন ওয়েন প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন মানুষরা অন্য প্রাণিদের থেকে বিশেষভাবে আলাদা, ১৮৫০ এর দশকেই ওরাঙ উটান, শিম্পান্জি,গরিলা ইত্যাদি প্রাণিদের বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং ওয়েন তাদের শরীর ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন, তাদের কংকাল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, বেশ পরিশ্রম করেছিলেন সেই সব চিহ্ন খুজে বের করতে যা মানুষ থেকে তাদেরকে আলাদা করতে পারে; যদি আমরা নরবানর বা এইপদের একটি ভ্যারিয়েশন হয়ে থাকি তাহলে নৈতিকতার ধারণাটির পরিণতি কি হবে?
অন্য প্রাণীদের থেকে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী মানুষকে আলাদা করে, ওয়েন মনে করেন সেটি আমাদের মানসিক দক্ষতা, আমাদের কথা বলা এবং যুক্তি প্রদান করার ক্ষমতা; সেকারণে ওয়েন ‌এইপদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন দুটি মস্তিষ্কের গঠনগত কি মৌলিক পার্থক্য আছে; ১৮৫৭ সালে তিনি দাবী করেন তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য খুজে পেয়েছেন: এইপদের মস্তিষ্কের ব্যতিক্রম মানুষের ব্রেনে তার উপরের সেরিব্রাল হেমস্ফেয়ারটি পেছনদিনে বেশ খানিকটা সম্প্রসারিত হয়ে তৃতীয় একটি লোব তৈরী করে, যার নাম ওয়েন দিয়েছিলেন হিপপোকাম্পাস মাইনর; ওয়েন দাবী করেন এই বৈশিষ্ট্যর অনন্যতাই মানুষের জন্য্ একটি আলাদা উপশ্রেণী সৃষ্টি করার দাবী রাখে; আমাদের মস্তিষ্ক শিম্পান্জি থেকে আলাদা, যেমনটা শিম্পান্জির মস্তিষ্ক আলাদা প্লাটিপাস থেকে;
হাক্সলে সন্দেহ করেছিলেন যে ওয়েন তার এই ধারণায় পৌছেছেন খারাপভাবে সংরক্ষণ করা কোনো মস্তিষ্কের নমুনা নিয়ে গবেষণা করার কারণে; তার এই বিস্তারিত শ্রেনীবিন্যাস গড়ে উঠেছে একটি মৌলিক ভ্রান্তির উপর নির্ভর করে (হাক্সলীর ভাষায় তারা দৃষ্টিকটু, যেমন গোবরের মধ্যে করিন্থিয়ান পোর্টিকো যেন দাড়িয়ে আছে); আসলেই, হাক্সলী যুক্তি দেন যে, গরিলার মস্তিষ্ক বেবুনের মস্তিষ্কের তুলনায় যতটুকু ভিন্ন, মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় গরিলার মস্তিষ্ক তার চেয়ে বেশী ভিন্ন নয়, ‘না আমি না, যে কিনা ‍মানুষের অবস্থানকে মর্যাদাকে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের উপর স্থাপন করার চেষ্ট‍া করছে বা বলতে চাইছেন যে আমাদের কোনো ‍গতি নেই যদি কোনো এইপদের একটি হিপপোকাম্পাস মাইনর থাকে’, হাক্সলী লিখেছিলেন, ‘বরং আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি মিথ্যা অহংকারকে বিদায় করতে।’
ডারউইনের বইটি নিয়ে ওয়েন এর হিংসাত্মক রিভিউটি হাক্সলীর সাথে তার চলমান দ্বন্দটাকে আরো উসকে দিয়েছিল এবং অবশেষে এর কয়েকমাস পর, ১৮৬০ এর জুন মাসে এই দ্বন্দ চুড়ান্ত রুপ ধারণ করে; সেবছর British Association for the Advancement of Science অক্সফোর্ডে তাদের বার্ষিক সভার আয়োজন করেছিল,যেখানে জমায়েত হন কয়েক হাজার মানুষ; এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হবার সুবাদে ওয়েন, জুনের ২৮ তারিখ একটি বক্তৃতা দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং উদ্দেশ্য সেখানে আবারো ব্যাখ্যা করবেন কিভাবে মানুষের ব্রেইন এইপদের থেকে আলাদা; এখানে একটি আকস্মিক প্রতি আক্রমনের পরিকল্পনা আটেন হাক্সলী; ওয়েন এর বক্তৃতা শেষ পর্যায়ে তিনি উঠে দাড়িয়ে ঘোষনা করেন যে, তিনি সম্প্রতি স্কটিশ একজন অ্যানাটোমী বিশেষজ্ঞর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন, যিনি শিম্পান্জির ব্রেইন ব্যবচ্ছেদ করেছেন, এবং সেই অ্যানাটোমি বিশেষজ্ঞ দেখেছেন, সেটি দেখতে বিস্ময়করভাবে মানুষের ব্রেইনের মত, যেখানে হিপপোকাম্পাস মাইনরও আছে; ঘর ভর্তি দর্শকসহ মানুষের সামনে ওয়েন এর আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলার উপায় ছিল না, তাকে সবার সামনে অপমান করার জন্য হাক্সলী এর চেয়ে কোনো জায়গা আর কোথাও খুজে পেতেন না।
সেই ব্রেইন এর যুদ্ধে জয় লাভ করার পর হাক্সলী পরের দিন অক্সফোর্ড মিটিং ছেড়ে লন্ডনে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন; কিন্তু তখনই তার সাথে দেখা হয় রবার্ট চেম্বারস এর সাথে, তখনও তিনি ভেস্টিজের বেনামী লেখক; হাক্সলীর মিটিং ছেড়ে চলে যাবার কথা শুনে চেম্বারস রীতিমত শঙ্কিত হলেন, কারণ তার ধারণা নেই আগামীকাল ওয়েন কি করে বসেন; গুজব ছিল অক্সফোর্ড বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ডারউইনকে আক্রমন করবেন; বহু বছর ধরেই উইলবারফোর্স বিবর্তনের বিরুদ্ধে ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী সবচেয়ে উচ্চ কণ্ঠ ছিলেন; ১৮৪৪ সালে তিনি চেম্বারস এর লেখা ভেস্টিজ বইটিকেও ক্রমন করেছিলেন, এখন বিশপের চোখে ডারউইনের এই নতুন বইটি তার ব্যতিক্রম কিছু নয়; পরের দিন একজন আমেরিকার বিজ্ঞানীর, জন উইলিয়াম ড্রেপার এর বক্তৃতা দেবার কথা, তার বিষয় ছিল, ডারউইনবাদ ও সমাজে তার সম্ভাব্য প্রভাব; উইলবারফোর্স এই সুযোগটাই নিতে চাইলেন জনস্বমক্ষে ডারউইনকে আক্রমন করার জন্য, ব্রিটেন এর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বৈজ্ঞানিক সভায়; আর ওয়েনও অতিথি হিসাবে উঠেছিলেন এই উইলবারফোর্সের বাসায়, এবং কোনো সন্দেহ নেই তিনি বিশপকে কোচিং দিচ্ছেন কিভাবে আক্রমন করতে হবে; চেম্বারস সহজেই হাক্সলীকে রাজী করালেন ড্র্যাপারের ভাষনের পর পর্যন্ত থাকতে এবং ডারউইনের বিরুদ্ধে আক্রমন প্রতিরোধ করার জন্য।
পরের দিন সভার সূচনা করেন ওয়েন, পুরো অডিটোরিয়াম ভর্তি মানুষ, তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি ঘোষণা দেন: ‘আসুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজে আমরা আমাদের সঠিকভাবে নিবেদন করি, এভাবে আমরা যতই অনুশীলন করতে পারবো ততই আমরা নিশ্চিৎ হতে পারবো, এবং এই অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষ করতে পারবো, এবং আমরা এভাবে যত বেশী যোগ্য হয়ে উঠতে পারবো, আমরা তত বেশী উপযুক্ত হবো আমাদের ঈশ্বরের কাছাকাছি আসার’। ড্রেপারের বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, On the Intel ectual Development of Europe, Considered with Reference to the Views of Mr. Darwin and Others, That the Progression of Organisms Is Determined by Law; যে বক্তৃতাটি যথেষ্ট নিরস, দীর্ঘ আর ভালো যুক্তি সম্পন্নও ছিল না; দর্শকের আসনে সেদিন জোসেফ হুকারও ছিলেন, যিনি ড্রেপারের ভাষণটিকে বর্ণনা করেছিলেন, মজাদার স্টু হিসাবে; ভাষণটি মিলনায়তনের দর্শকদের খানিকটা উষ্ণ আর তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তুলেছিল ঠিকই, তা সত্ত্বে কেউই হল ছেড়ে বের হননি; তারা বিশপের ভাষণ শুনতে চান।
ড্র্যাপার শেষ করলে, উইলবারফোর্স উঠে দাড়িয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন; তিনি সম্প্রতি ডারউইনের বই নিয়ে একটি রিভিউ লিখেছিলেন, এই ভাষণটা সেই লেখাটাকে গড়ে পিটে তৈরী করে নেয়া হয়েছে বক্তৃতা হিসাবে ব্যবহার করার জন্য; তিনি কোনো ভনিতা করলেন না এই বলে যে, বাইবেলকে বিজ্ঞানের কোন কিছুর মানদণ্ড হিসাবে নেয়া উচিৎ, কিন্তু রিভিউতে তিনি লিখেছিলেন, ‘তার মানে এই না যে, বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভুলগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপুর্ণ , যখন সেই ভুলগুলো সৃষ্টিতে ঈশ্বরের মহিমাকে খর্ব করে; ডারউইন এমন কিছু ভুলই করেছেন, বেশ কিছু লাগামহীন কল্পনা আর ধারণার উপর ভিত্তি করেই তার বইটি বর্নিত; তার সমস্ত যুক্তির ভারসাম্যটি নির্ভর করে আছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নতুন ধারণাটির উপর’। এবং তাসত্ত্বেও উইলবারফোর্স লেখেন, ‘এমন কোনো উদহারণ কি কখনো পাওয়া গেছে? আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি, একটিও না।’ বরং উলবারফোর্স প্যালি এবং ওয়েন একটি হালকা মিশ্রণ প্রস্তাব করেন, সব সৃষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে শ্রেষ্ট এবং সর্বোচ্চ মহান ঈশ্বরের মনের চিরন্তন বিদ্যমান ধারণারই অনুলিপি –এবং যার সুশৃঙ্খল বিন্যাসে প্রতীয়মান এর নিখুঁততা যা তার সব সৃষ্টিতেও দৃশ্যমান, কারণ এটির অস্তিত্ব সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ এবং সব কিছুর প্রভুকে কেন্দ্র করেই’। যখন উইলবারফোর্স তার ভাষণ শেষ করেন, তিনি হাক্সলীর দিকে তাকান, খানিকটা উপহাস করে, তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তার পিতামহ নাকি পিতামহী, কোন দিকে, তিনি এইপদের বংশধারায় জন্ম নিয়েছেন’।

(ছবি:অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাচারাল হিস্ট্রী মিউজিয়ামে হাক্সলি এবং উইলবারফোর্সের এই বিতর্কটির স্মারক স্তম্ভ, বিতর্কটি ডারউইনের তত্ত্বের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেই সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রেখেছিল।)
পরে হাক্সলী ডারউইন ও অন্যদের বলেছিলেন, সেই মুহুর্তে তিনি তার পাশে বসা বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তার হাটুর উপর হালকা আঘাত করে বললেন, ‘প্রভু অবশেষে আমার হাতে তাকে তুলে দিয়েছেন’। তিনি উঠে দাড়িয়ে, উইলবারফোর্সকে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, তিনি বলেন, ‘এই বিশপ এমন কিছু বলেননি যা আদৌ নতুন কিছু, শুধুমাত্র হাক্সলীর বংশপরিচয়ের বিষয়ে তার প্রশ্নটি ছাড়া’; এমনকি তাসত্ত্বেও, আমি বলেছিলাম, ‘যদি আমাকে এই প্রশ্ন করা হয় যে, আমি কি কোনো হতভাগ্য নরবানর বা এইপকে আমার পিতামহ হিসাবে বেছে নেবো, নাকি এমন কোনো মানুষকে, যাকে প্রকৃতি নানা ক্ষমতায় বিশেষায়িত করেছে, তার অনেক কিছু করার এবং প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে কিন্তু তারপরও সে তার সেই যোগ্যতাগুলো ব্যবহার এবং প্রভাবিত করে কোনো গুরুত্বপুর্ণ বৈজ্ঞানিক আলোচনায় শুধুমাত্র কাউকে পরিহাস করতে, আমি কোনো ইতস্ততাই ছাড়াই আমার পিতামহ হিসাবে বেছে নেবো সেই নরবানকে’। উপস্থিত সবাই হাক্সলীর ‍উত্তরে হেসে উঠেন, হাসি দীর্ঘায়িত হয়, যতক্ষণ ‍না পর্যন্ত্ একজন ব্যক্তি, যাকে হুকার বর্ণনা করেছিলেন, ধুসর চুলের রোমানদের মতো নাক বিশিষ্ট এক বয়স্ক ভদ্রলোক, দর্শকের সারিতে উঠে দাড়ালেন ক্রোধে কাপতে কাপতে, মানুষটি ডারউইনের বীগলের সহযাত্রী সেই ক্যাপ্টেন ফিটজরয়।
দেশে ফেরার পর থেকে ক্যাপ্টেন ফিটজরয়ের সাথে ডারউইনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে; ক্যাপ্টেন ভাবতেন বিগলের সমুদ্রযাত্রার যে বইটি ডারউইন লিখেছিলেন সেটা বেশী আত্মকেন্দ্রীক, ডারউইন তাকে কিংবা জাহাজের নাবিকদের যারা তাকে বেশ সাহায্য করেছিল,তাদের যথেষ্ট পরিমান স্বীকৃতি দেননি, যদি ফিটজরয় লাইয়েল এর ancient geology খানিকটা হালকা ভাবে পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি পরে কঠোরভাবে বাইবেলে ফিরে গিয়েছিলেন, সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে তার নিজের বইয়ে তিনি ডারউইন ও তার, নোয়ার সেই মহাপ্লাবনের চিহ্ন দেখার কথা বর্ণনা করার চেষ্টা করেন; কিন্তু তিনি খুবই বিতৃষ্ণার সাথে দেখেছিলেন কিভাবে ডারউইন আরো বেশী বৈধর্মের বা হেরেসির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, শুধু প্লাবনের চিহ্নই না এমনকি ঈশ্বরের কাজ থেকেও।
ক্যাপ্টেন অক্সফোর্ডে এসেছিলেন, ঝড় নিয়ে একটি বক্তৃতা দেবার জন্য ( তিনি আবহাওয়বিদ্যা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান রেখেছিলেন); কিন্তু তিনি ড্র্যাপারের ভাষণের কথাটি জানতে পারেন কোনোভাবে; হাক্সলী কথা শেষ করার পর ফিটজরয় উঠে দাড়িয়ে বলতে শুরু করেন, কিভাবে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত এবং অসন্তুষ্ট হয়েছেন যে ডারউইন বাইবেল বিরোধী চিন্তাধারা পোষণ করেছেন তার বইতে ; তিনি বলেন অরিজিন অব স্পিসিস পড়তে গিয়ে তার তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়েছে, তিনি মাথার উপর বাইবেল আকড়ে ধরা দুই হাত তুলে উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ করেন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে, মানুষকে না; এটা বলার পর সবাই তাকে চিৎকার করে থামিয়ে দেয় সেখানে।
পরিশেষে জোসেফ হুকারের পালা আসে, তিনি মঞ্চে উঠে উইলবারফোর্সকে আক্রমন করেন; পরে তিনি ডারউইনকে লিখেছিলেন তার ভাষণটির বিষয়ে, ‘আমি এমন ভাবে অগ্রসর হলাম যেন সবাইকে দেখাতে পারি, ১) তিনি আপনার লেখা বইটি কখনোই পড়েননি ২) তিনি উদ্ভিদবিদ্যার সামান্যতম কোন বিষয়ে কোন জ্ঞান রাখেন না; এরপর সভার পরিসমাপ্তি হয়, এই ক্ষেত্রে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার মাধ্যমে।’

(ছবি: পরিশেষে জোসেফ হুকারের পালা আসে, তিনি মঞ্চে উঠে উইলবারফোর্সকে আক্রমন করেন; পরে তিনি ডারউইনকে লিখেছিলেন তার ভাষনটির বিষয়ে, ‘আমি এমন ভাবে অগ্রসর হলাম যেন সবাইকে দেখাতে পারি, ১) তিনি আপনার লেখা বইটি কখনোই পড়েননি ২) তিনি উদ্ভিদবিদ্যার সামান্যতম কোন বিষয়ে কোন জ্ঞান রাখেন না; এরপর সভার পরিসমাপ্তি হয়, এই ক্ষেত্রে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার মাধ্যমে’।)
যদি ডারউইন সেই দিন বিজয়ী হয়ে থাকেন, তবে তিনি ছিলেন অনুপস্থিত বিজয়ী; ৫০ বছর বয়সে নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি, অক্সফোর্ড মিটিং থেকেও দুরে ছিলেন, যখন তার পক্ষে লড়েছিলেন, হাক্সলী এবং হুকার; তিনি তখন কয়েক সপ্তাহের জন্য রিচমন্ডে, তার দুরারোগ্য পেটের ব্যাধির জন্য তার সেখানে চিকিৎসা চলছিল, সেখানেই তিনি তার বন্ধুদের চিঠি পান বিস্তারিত বিবরণসহ, তাদের বক্তৃতা এবং তর্ক বিতর্কের কথা; অসুস্থ ডারউইন বিস্ময় প্রকাশ করে হুকারকে জানান, ‘এরকম কোন সভায় বিশপ এর প্রত্যুত্তর করার চেষ্টায় আমি হয়তো দ্রুত মরেই যেতাম’।

(ছবি: John Collier’s 1883 portrait of Darwin (National Portrait Gallery, London)
অক্সফোর্ড এর সেই সভাটি খু্ব দ্রুতই কিংবদন্তীতে রুপান্তরিত হয়; সেখানে কি আসলে ঘটেছিল, তা সবই অতিকথনের কুয়াশার দেয়ালের পিছনে দ্রুত হারিয়েও যায়; এই নাটকের প্রতিটি পাত্র তাদের নিজেদের মত করে এর কাহিনী রচনা করেন, যেখান সবাই তাদের নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করেছিল; উইলবারফোর্স দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি বিতর্কে জিতেছেন, অন্যদিকে হাক্সলী এবং হুকার প্রত্যেকের ভেবেছেন বিশপকে চুড়ান্ত আঘাত তিনিই দিয়েছিলেন; আজও অবধি, স্পষ্ট না আসলে কি ঘটেছিল সেদিন; এবং ডারউইনের নিজেরও বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে বুঝতে যে কি হয়েছে জুন মাসের সেই দিনটিতে; তবে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার মনে, তার বিশ বছরের এই লুকিয়ে থাকার অবসান ঘটেছে চিরতরে; ডারউইনের নিজের জীবদ্দশায়, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন; ১৮৭০ এর দশকে বৃটেনের প্রায় সকল গুরুত্বপুর্ণ বিজ্ঞানী বিবর্তনকে গ্রহন করে নিয়েছিলেন তাদের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে ও চিন্তায়, যদিও হয়তো কিভাবে এটি ঘটছে তা নিয়ে ডারউইনের সাথে দ্বিমত থাকতে পারে; লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টরী মিউজিয়ামে মুল হল ঘরে উচু সিড়ির বেদীর তার একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে, আর নিউটনের কবরের কাছে, ওয়েষ্ট মিনিষ্টার অ্যাবীতে তাকে সমাহিত করা হয়।

(ছবি: ওয়েষ্ট মিনিষ্টার অ্যাবেতে ডারউইনের সমাধি। ১৮৮২ সালে ১৯ এপ্রিল ৭৩ বছর বয়সে ডারউইন মারা গিয়েছিলেন।)
কিন্তু Origin of Species এর ক্ষেত্রে অদৃষ্টের সবচেয়ে বড় পরিহাস হচ্ছে শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীতে এসেই কেবল বিজ্ঞানীরা ডার‌উইনের যুগান্তকারী ধারণাগুলোর প্রকৃত ক্ষমতাটিকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, আর তখনই কেবল জীবাশ্মবিদ এবং ভূতত্ত্ববিদরা সাজাতে পেরেছেন পৃথিবীতে জীবনের সময়পন্জীর ধারাবাহিক বিন্যাসটিকে; শুধুমাত্র তখনই জীববিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পেরেছিলেন সেই অণুকে, যা বংশগতি আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভিত্তি, এবং শুধুমাত্র তারপরই বিজ্ঞানীরা সত্যিকারভাবে বুঝতে শুরু করেছিলেন, সাধারণ একটি সর্দি জ্বরের ভাইরাস থেকে অকল্পনীয় জটিল মানুষের মস্তিষ্ক, কিভাবে পৃথিবীর সবকিছুকে প্রভাবিত করে তাদের রুপ দেয় শক্তিশালী এই বিবর্তন প্রক্রিয়াটি।




(ছবি: (বা দিক থেকে) স্যার রোনাল্ড ফিশার ( ১৮৯০-১৯৬২), ইংলিশ পরিসংখ্যানবিদ ও জীববিজ্ঞানী। যিনি গণিতের ব্যবহার করেছিলেন মেণ্ডেলিয় জিনতত্ত্ব আর ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে সংশ্লেষণ করার জন্য , যা সাহায্য করেছিল বিবর্তনের ডারউইনবাদী সংশ্লেষণের, যা এখন পরিচিত modern evolutionary synthesis নামে; এছাড়া আধুনিক পরিসংখ্যাণ বিদ্যারও ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। (২) জে বি এস হলডেন (১৮৯২-১৯৬৪), বৃটিশ জিনবিজ্ঞানী, পরিসংখ্যাবিদ পরে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। জীববিজ্ঞানে তার অসংখ্য অবদান আছে, ১৯১৫ সালে জেনেটিক লিংকেজ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ ও অন্যান্য জিন গবেষণা ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল পপুলেশন জেনেটিক্স ও পরে modern evolutionary synthesis এর। (৩) সেওয়াল রাইট (১৮৮৯-১৯৮৮) আমেরিকার জিনতাত্ত্বিক, ফিশার ও হ্যালডেনের সাথে পপুলেশন জেনেটিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা, যা ডারউইনীয় বিবর্তনকে মেণ্ডেলিয় জিনতত্ত্বের সাথে সংশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: চার্লস ডারউইন - একটি ধারণার বিজয়:
(আগের পর্বগুলো: প্রথম | দ্বিতীয় | তৃতীয় | চতুর্থ পঞ্চম | ষষ্ঠসপ্তম | অষ্টম)|নবম)
বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণ:
যখন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বইটি লিখেছিলেন, ডারউইন সেই সময়ের জ্ঞানেই বন্দী ছিলেন। বলাবাহুল্য ১৮৫৯ সালে বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। আর ডারউইন তেমন প্রত্যাশাও করেছিলেন। তবে তিনি ধর্মীয় সমালোচনার নিয়ে তিনি খুব বেশী চিন্তিত ছিলেন না, তার ভাবনা মূলত ছিল তার প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হতে পারে এমন সব বৈজ্ঞানিক সমালোচনাগুলো নিয়ে, কারণ তিনি জানতেন ঠিক সেই মুহূর্তে যা তথ্য তার জানা আছে ( আর ডারউইন সেই সময়ে তার পক্ষে জানা যা কিছু সম্ভব তা জেনেছিলেন, প্রায় দুই দশক ধরে তিনি তার যুক্তিটি সাজিয়েছিলেন) আর তিনি যে প্রমাণগুলো জড়ো করেছেন, সেগুলো ছাড়াও তার প্রস্তাবিত তত্ত্বটির বৈজ্ঞানিকভাবে দুটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে, সেই সময় যার কোনো সঠিক উত্তর তার জানা ছিল না।
প্রথমটি ছিল পৃথিবীর বয়স। সেই সময়ের পদার্থবিদরা তেজষ্ক্রিয় ক্ষয় হবার প্রক্রিয়ায় পৃথিবী উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি সম্বন্ধে জানতেন না, সুতরাং তারা মনে করেছিলেন পৃথিবীর বয়স একশ মিলিয়ন বছর মাত্র, খুব বেশী সময় না ডারউইনের প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মন্থর প্রক্রিয়ার জন্য। আর এমন বিরোধীতার উত্তরে তার সত্যিকারভাবে কিছু বলার উপায়ও ছিলনা। কিন্তু এখন আমরা জানি পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি বছর। দ্বিতীয় বড় সমস্যাটি ছিল বংশগতির প্রকৃতি, কিভাবে জীবরা তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করে। যদি প্রাকৃতিক নির্বাচন বা অন্য কোনো প্রক্রিয়াকে কাজ করতে হয় কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের জন্য, তাহলে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে কোনো না কোনো উপায়ে সংরক্ষিত হতে হবে এবং প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হতে হবে। দূঃখজনকভাবে ডারউইনের কাছে এই বিষয়টি সম্বন্ধে ভালো কোনো ধারণা ছিলনা; সেই সময়ে বিদ্যমান প্রস্তাবনা ছিল ব্লেন্ডিং বা মিশ্রণের বা Blending inheritance; কিন্তু ধারণাটি আদৌ ব্যাখ্যা করতে পারেনি বংশগতির প্রকৃতিটি। ডারউইনের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ ছিল, উপরন্তু এটি তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করতে পারতো না। তিনি তার খানিকটা ল্যামার্ক নির্ভর ধারণা প্যানজেনেসিস তত্ত্বটি প্রস্তাব করেন। এই তত্ত্বটির ইতিহাস সেই হিপোক্রাতিসের সময় অবধি বিস্তৃত। ডারউইনের এই প্রস্তাবনার মূলে ছিল gemmules এর ধারণাটি, অতি ক্ষুদ্র বংশগতির যে কণা (পার্টিকল) যা পিতামাতা থেকে তার সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তরিত হয় প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো বহন করে। তার এই ধারণাটিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল মেণ্ডেলের laws of inheritance, যখন বিজ্ঞানীরা নতুন করে মেণ্ডেলের গবেষণাটির পুনরাবৃত্তি করতে পেরেছিলেন।

(ছবি: অগাস্ট ভাইসমান - August Friedrich Leopold Weismann (17 January 1834 – 5 November 1914)) জার্মান বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, যিনি জার্ম প্লাজম তত্ত্বটি প্রস্তাব করেছিলেন বহুকোষী জীবদের ক্ষেত্রে। উনবিংশ শতাব্দীতে ডারউইনের পর তাকেই সবচেয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন তাত্ত্বিক মনে করা হয়।)
মেণ্ডেলীয় জেনেটিক্স এর সাথে ডারউইনীয় বিবর্তনের প্রথম সংশ্লেষণ ঘটে Neo-Darwinism এর ভাবনায়। ১৮৯৫ সালে কানাডীয়-ইংলিশ জীববিজ্ঞানী জর্জ রোমানেস নব্য ডারউইনবাদ নামটি প্রস্তাব করেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস আর অগাস্ট ভাইসমান (August Weismann) এর বিবর্তন সংক্রান্ত ধারণাটিকে চিহ্নিত করতে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বিবর্তনের ধারণার উপর নির্ভরশীল ছিল। ভাইসম্যান ও ওয়ালেস ল্যামার্কীয় ধারণাটি প্রত্যাখান করেছিলেন (inheritance of acquired characteristics), যার প্রতি ডারউইন ভুল ভাবে খানিকটা ঝুকে পড়েছিলেন। নব্য ডারউইনবাদ প্রস্তাব করেছিল যে, বিবর্তন ঘটছে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, কোনো অর্জিত বৈশিষ্ট্য ব্যবহার বা কম ব্যবহার করার মাধ্যমে না। আর এই সম্পুর্ণ প্রত্যাখানের ভিত্তি ছিল ভাইসম্যানের জার্ম প্লাজম তত্ত্বটি। ভাইজম্যান অনুধাবন করেছিলেন যে কোষগুলো জার্ম প্লাজম বা গ্যামেট ( শুক্রাণু বা ডিম্বাণু) সেগুলো সোমাটিক ( যে কোষগুলো জীবের শরীর গঠন করে) কোষ থেকে আলাদা হয়ে যায় ভ্রুণ বিকাশ প্রক্রিয়ার শুরুতে। যেহেতু এই দুটি কোষের মধ্যে যোগাযোগের সুস্পষ্ট কোনো উপায় তিনি দেখেননি, তিনি প্রস্তাব করেন সেকারণে কোনো অর্জিত বৈশিষ্ট্যের প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর অসম্ভব, যা পরিচিত ছিল ভাইজম্যান ব্যারিয়ার Weismann barrier হিসাবে।
প্রায় ১৯৩০ এর দশক অবধি এটাই ছিল প্যানসিলেকশনিষ্ট চিন্তার ধারা, যা দাবী করেছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনই সব বিবর্তনের একমাত্র কারণ। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ সালে বেশ কিছু অগ্রগতি সূচনা করে modern evolutionary synthesis ( যদিও বর্তমান বিবর্তন তত্ত্বকে নিও-ডারউইনিজম বলা হলেও সেটি ঠিক না বলে দাবি করেছিলেন বিখ্যাত বিবর্তন জীববিজ্ঞানী আর্নস্ট মায়ার, কারণ তিনি দাবী করেছিলেন শব্দটি রোমানেস ব্যবহার করেছিল শুধু ভাইসম্যানের তত্ত্বটিকে চিহ্নিত করতে), এটি এখন পরিচিত synthetic view of evolution বা শুধুমাত্র modern synthesis, (new synthesis, the modern synthesis, the evolutionary synthesis, millennium synthesis) , এটি বিংশ শতাব্দীর একটি সংশ্লেষণ, যা জীববিজ্ঞানের বেশ কিছু ক্ষেত্র থেকে আসা ধারণাকে সংশ্লেষণ করেছিল, বিবর্তনের যে ব্যাখ্যটি এখন ব্যপকভাবে স্বীকৃত। বিবর্তন জীববিজ্ঞানের এটি বর্তমান প্যারাডাইম।
চার্লস ডারউইন আর মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স এর ধারণাগুলো সমন্বয় করেন বিখ্যাত গাণিতিক জীববিজ্ঞানী রোন্যাল্ড ফিশার, যিনি জে বি এস হলডেন, সেওয়াল রাইট এর পপুলেশন জেনেটিক্স এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯১৮ থেকে ১৯৩২ এর মধ্যে। পপুলেশন জেনেটিক্সই মূলত সূচনা করেছিল মডার্ণ সিনথেসিসের। আধুনিক সংশ্লেষণ বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বের জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে তাদের বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে দূর্বল সংযোগ আর বোঝাপড়ার সমস্যাগুলোকে সমাধান করেছিল। প্রধাণ সমস্যাটি ছিল মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্সকে কি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ধীর বিবর্তনের ধারণার সাথে সমন্বয় করা যায় কিনা, আর দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল ম্যাক্রোইভোল্যুলেশনের বড় পরিবর্তনগুলো কি ব্যাখ্যা করা যায় কোনো স্হানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাইক্রোইভোল্যুশনের মাধ্যমে। প্রমাণগুলো এসেছিল জেনেটিক্স এর প্রশিক্ষিত জীববিজ্ঞানীদের কাছ থেকে, যারা ল্যাবরেটরী ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছিলেন (যেমন রুশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী থিওডোসিয়াস ডোবঝানস্কি, তার গবেষণা নিয়ে লেখা ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত বই Genetics and the Origin of Species পপুলেশন জেনেটিক্স আর ফিল্ড ন্যাচারালিষ্টদের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করেচিল। আর্নস্ট মায়ারের অবদান ছিল Systematics and the Origin of Species নামের অসাধারণ একটি বই । জুলিয়ান হাক্সলী তার ১৯৪২ সালের বই Evolution: The Modern Synthesis এ প্রথম শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন। আধুনিক সংশ্লেষণ বা modern synthesis এর প্রধাণ ব্যক্তিরা হলেন Theodosius Dobzhansky, E. B. Ford, Ernst Mayr, Bernhard Rensch, Sergei Chetverikov, George Gaylord Simpson, ও G. Ledyard Stebbins প্রমূখ বিজ্ঞানীরা।

ছবি: মডার্ণ সিনথেসিসের স্থপতিরা। (বা দিক থেকে: রোনাল্ড ফিশার ও তার সহকর্মীরা ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে মেণ্ডেলীয় জিনতত্ত্বের ভিত্তি দিয়েছিলেন গাণিতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে।পরের প্রজন্মের জীববিজ্ঞানীদের জন্য তারা যে প্রশ্নটি রেখে গিয়েছিলেন, সেটি হলো জিনের ভাষাটি উদ্ভাবন করা, প্রজাতি কি এবং কিভাবে প্রজাতির সৃষ্টি হয় সেটি সমাধান করার জন্য। ১৯৩০ এর দশক থেকেই কেবল এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসতে শুরু করেছিল।আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের একটি সিংহভাগ এসেছিল (১) থিওডসিয়াস ডোবঝানস্কির গবেষণা থেকে। সেই সময়ে বেশীর ভাগ বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে কোনো একটি প্রজাতির সব সদস্য হুবুহু একই ধরনের জিন বহন করে। কিন্তু তাদের এই ধারণার ভিত্তি ছিল ল্যাবরেটরী গবেষণা। কিন্তু ডোবঝানস্কি মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন, তিনি দেখেছিলেন একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে হুবুহু এই ধরনের জিন থাকে না।ফ্রুট ফ্লাইয়ের (D. pseudoobscura) উপর গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই ক্রোমোজোমের ভিন্ন সংস্করণ থাকতে পারে। তাহলে প্রশ্ন আসে, যদি কোনো স্ট্যান্ডার্ড সেট জিন না থাকে যা দিয়ে আমরা কোনো প্রজাতি শনাক্ত করতে পারি, তাহলে প্রজাতিদের পৃথক রাখছে কোন বিষয়টি,ডোবঝানস্কি এর সঠিক উত্তরটি জানাতে পেরেছিলেন, যৌন প্রজনন।১৯৩৭ সালে তিনি তার এই গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন Genetics and the Origin of Species, সেখানে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন কিভাবে প্রজাতির উদ্ভব হয়। জিনতত্ত্ব আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে সামঞ্জষ্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে তিনি বহু জীববিজ্ঞানীকে উৎসাহিত করেছিলেন বিবর্তন কিভাবে হচ্ছে তার একটি একীভূত ব্যাখ্যা খোঁজার জন্য। তাদের সেই সম্মিলিত গবেষণাই পরিচিত The Modern Synthesis নামে। যে ব্যাখ্যা জীববিজ্ঞানের নানা শাখা থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রস্তাবনা করেছিলেন বিবর্তনের একটি শক্তিশালী ব্যাখ্যা, যা দেখিয়েছে কিভাবে মিউটেশন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন বড় মাপের বিবর্তনীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পরবর্তীতে এই ব্যাখ্যাটি বিবর্তন জীববিজ্ঞানের মূল ভিত্তি রচনা করেছে। ডোবঝানস্কির Genetics and the Origin of Species বহু জীববিজ্ঞানীকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, এমন জিনতত্ত্বে বাইরের ক্ষেত্রে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে, তাদের একজন (২) আর্নস্ট মায়ার, মূলত পাখি বিশেষজ্ঞ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই বইটির দ্বারা।মায়ারের গবেষণার ক্ষেত্রে ছিল নতুন প্রজাতি শনাক্ত ও তাদের ভৌগলিক সীমনা নির্ধারণ। কিন্তু পাখিদের প্রজাতি হিসাবে ভাগ করা কঠিন একটি কাজ। কোন একটি বার্ড অব প্যারাডাইসকে হয়তো তাদের পালকের রঙ দেখে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু তাদের অন্য অনেক বৈশিষ্ট্যে নানা বিচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়।মায়ার চিহ্নিত করেছিলেন কোনো প্রজাতির মধ্যে এই ভিন্নতা আসলে বিবর্তন প্রক্রিয়া যে কাজ করছে তারই প্রমাণ। প্রজাতির মধ্যে এই প্রকরণগুলোর উদ্ভব হয়, যা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতা সৃষ্টি করে।আর কোনো একটি পাখির বা যেকোনো জীব জনগোষ্ঠীর প্রজাতি হিসাবে আবির্ভুত হতে পারে যদি প্রতিবেশী থেকে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৪২ সালে তার Systematics and the Origin of Species মায়ার যুক্তি দেন, কোনো একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির করার একটি উপায় হচ্ছে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা, যেমন কোনো হিমবাহ একটি উপত্যাকাকে ভাগ করতে পারে, আর এই দুই পাশে দুটি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে বা কোনো উপদ্বীপ রুপান্তরিত হতে পারে একগুচ্ছ দ্বীপে, এই ধরনের বিচ্ছিন্নতা চিরকাল থাকার দরকার সেই, শুধু প্রতিবন্ধকতাটি সেই পরিমান সময় অবধি থাকলে হবে যখন তারা জিনগতভাবে অসামঞ্জষ্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, পরে তারা ভৌগলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন কোনো পরিস্থিতিতে মিলিত হলেও আর প্রজনন করতে পারবে না। তারা পাশাপাশি থাকবে, তবে ভিন্ন প্রজাতি হিসাবে। এখন বিজ্ঞানীরা জিন বিশ্লেষণ করেই বলতে পারেন ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি ছাড়াও প্রজাতি অন্যভাবে সৃষ্টি হতে পারে। মায়ার বায়োলজিকাল স্পেসিস কনসেপ্টটি গড়ে উঠতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। (৩) ই বি ফোর্ড (১৯০১-১৯৮৮) বৃটিশ ইকোলজিকাল জিনতাত্ত্বিক। যিনি প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রমাণ খুজেছিলেন প্রথম, বিশেষ করে মথ ও প্রজাপতিদের মধ্যে। ecological genetics ক্ষেত্রেটি তার প্রতিষ্ঠা করা। (৪) বার্ণার্ড রেনশ (১৯০০-১৯৯০) জার্মান বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও পাখি বিশেষজ্ঞ। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে পরিবেশের নানা নিয়ামক বিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী, প্রজাতির উপরের স্তরে। (৫) জুলিয়ান হাক্সলি (১৮৮৭-১৯৭৫) ছিলেন ডারউইনের বুল ডগ নামে খ্যাত টি এইচ হাক্সলির দৌহিত্র। অগাস্ট ভাইসম্যানের পর তিনি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জীববিজ্ঞানী বিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমর্থক ছিলেন। (৬) জন গেলর্ড সিম্পসন (১৯০২-১৯৮৪) মডার্ন সিনথেসিসে আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা সিম্পসন জীবাশ্ববিদ ছিলেন। তিনি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন জীবাশ্ম রেকর্ড ডারউেইনের প্রাকৃতিক ধারণাকে সমর্থন করে।জীবাশ্মবিদ্যায় গণিতের ব্যবহারে তিনি ছিলেন অগ্রদূত, তিনি বিশ্বাস করতে জীবাশ্মবিদ্যা পৃথিবীতে জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস উন্মোচন করবে যার মাধ্যমে আমরা বিবর্তনের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে পারি। (৭) জর্জ লেডইয়ার্ড স্টেবিন্স ( ১৯০৬-২০০০) যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও জিনতাত্ত্বিক জিনতত্ত্ব আর ডারউইনী প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাকে সমন্বয় করেছিলেন উদ্ভিদের প্রজাতিকরণ ব্যাখ্যা করার জন্য, তার বিখ্যাত বই Variation and Evolution in Plants; (৮) সের্গেই চেটভেরিকভ (১৮৮০-১৯৫৯), অসাধারণ এই রুশ বিজ্ঞানী প্রথম দিককার একজন জিন বিজ্ঞানী। তিনি ডোবঝানস্কিকে প্রভাবিত করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন প্রাকৃতিক পরিবেশে জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনতাত্ত্বিক বিষয়গুলো কিভাবে কাজ করে। স্তালিনের সময় সোভিয়েত বিজ্ঞানের কুখ্যাত চরিত্র লিসেঙ্কোর দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন।)
এই ধারণাটি আরো বিকশিত হয় পরের দশকে, W. D. Hamilton, George C. Williams, John Maynard Smith, Robert Trivers এর কাজ বিবর্তনের জিন কেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গিটি গড়ে তোলো ষাট ও সত্তরের দশকে। বর্তমান সংশ্লেষণটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে সম্প্রসারিত করে এর পরে আসা বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর সাথে সমন্বিত করা হয়েছে, যে ধারণাগুরো ডারউইনের জানার কোনো উপায় ছিল না, যেমন ডিএনএ ও জেনেটিক্স, এর ভিত্তি মজবুত করেছে kin selection, altruism, আর speciation এর ধারণাগুলোর গাণিতিক ব্যাখ্যা।

ছবি: (বা দিক থেকে ) (১) জর্জ সি উইলিয়ামস (১৯২৬-২০১০) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, যিনি গ্রুপ সিলেকশন ধারণার বিরোধী ছিলেন। মেনার্ড স্মিথ ও বিল হ্যামিলটনের সাথে জিন কেন্দ্রীক বিবর্তনের ধারণাটির সূচনা করেন। (২)বিল হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) বৃটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দী শ্রেষ্ঠতম তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী হিসাবে মনে করা হয়। তিনি সুপরিচিত ছিলেন altruism বা পরার্থবাদীতার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রস্তাবনা করার জন্য, যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল gene-centric view of evolution, বিবর্তনের জিন কেন্দ্রীক ধারণাটিকে পরিচিত করে তুলতে, তিনি লিঙ্গ অনুপাত ও যৌন প্রজনন বিবর্তনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। (৩) জন মেনার্ড স্মিথ (১৯২০-২০০৪) বৃটিশ তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী ও জিনতাত্ত্বিক, তার বিখ্যাত অবদান বিবর্তনের ক্ষেত্রে গেম থিওরী প্রয়োগ, এছাড়াও যৌন প্রজননের বিবর্তন ও সিগনালিং থিওরীর তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেছিলেন, যেখান evolutionarily stable strategy ধারণাটি এসেছে। (৪) রবার্ট টিভার্স (১৯৪৩-) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, তিনি reciprocal altruism (1971), parental investment (1972), facultative sex ratio determination (1973), আর parent–offspring conflict (1974) সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বিবর্তনীয় কৌশল হিসাবে self-deception ও intragenomic conflict ধারণাটিও ব্যাখ্যা করেছেন।

(ছবি: রিচার্ড ডকিন্স, ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত দ্য সেলফিশ জিনের প্রথম সংস্করণ, ৩০ তম বার্ষিকী ও সম্প্রতি ৪০ তম সংস্করণ)
১৯৭৬ সালে রিচার্ড ডকিন্স তার দ্য সেলফিশ জিন বইটিতে এইসব গানিতিক ব্যাখ্যাগুলোকে সমন্বিত করেছিলেন গাণিতিক কোনো ভাষা ব্যবহার করা ছাড়াই - সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, জিনই হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের একমাত্র একক, যার উপরেরই শুধুমাত্র কাজ করে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
(* এ বিষয়ে আপাতত এটুকু থাক)
ডারউইনের কিছু অনুমান
সময়ের তুলনায় চার্লস ডারউইন অনেক এগিয়ে ছিলেন ভাবনায়, শুধুমাত্র এই কথাটা বললে তাঁর প্রতি খুব একটা সুবিচার করা হবে না। ডারউইন বেশ কিছু পূর্বধারণা করেছিলেন।বিবর্তনবাদের এই জনকের অনেক অনুমানই ১৮৮২ সালে তার মৃত্যুর অনেক বছর পর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্প্রতি, প্রমাণিতও হয়েছে, আর বিজ্ঞানীরা তাঁর ধারণাগুলোর স্বপক্ষে খুজে পেয়েছেন পর্যাপ্ত পরিমান সব স্বাক্ষ্যপ্রমাণ। বর্তমানে প্রাপ্ত সকল প্রমাণ – যা সুষ্পষ্টভাবে তার প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়া এবং তাঁর আরো কিছু অনুমানকেই সমর্থন করে – এসেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে, যেমন জীবাশ্মবিদ্যা,ভূতত্ত্ব, জৈবরসায়ন, জিনতত্ত্ব, অণুজীববিজ্ঞান এবং ইভোল্যুশনারী ডেভোলপমেন্টাল বায়োলজী বা ‘ইভো ডেভো’, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী কেনেথ মিলার’এর মতে ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি এই প্রশ্নের একটি সাধারণ উত্তর দেবার জন্য এতোগুলো ক্ষেত্র থেকে আসা সব প্রমাণ যে একটি সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারছে, এই বিষয়টাই তো অত্যন্ত শক্তিশালী। একারনেই বিবর্তন তত্ত্বের স্বপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমানের পরিমান অনেক বেশী।’
বিবর্তন ঘটছে

(ছবি: ডারউইনের নোটবুকে জীবন বৃক্ষ স্কেচ 1837 First Notebook on Transmutation of Species by Charles Darwin থেকে)
ডারউইন কিন্তু সর্বপ্রথম বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করেননি - অর্থাৎ পৃথিবীর সকল জীবিত প্রাণির উৎপত্তি হয়েছে আদি পূর্বসূরি রুপ থেকে আর তাদের মধ্যে শনাক্তযোগ্য সকল পার্থক্যগুলোর কারণ প্রজন্মান্তরে ঘটা পরিবর্তনগুলো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাঁর মত করে কেউই এত ভাবেননি কিংবা এর স্বপক্ষে এত প্রমাণও সংগ্রহ করেননি বা আমাদের সমষ্ঠিগত চেতনায় চার্লস ডারউইনের মত করে আর কেউই বিষয়টিকে একটি স্থায়ী জায়গা করে দিতে পারেননি। বর্তমানে গবেষকরা ইভো ডেভোর জিনতাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের জীবের বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন, ডারউইন তার আঁকা জীবন বৃক্ষে যাদের জায়গা করে দিয়েছিলেন (উপরের ছবিটি ১৮৩৭ সালের তার একটি নোটবুক থেকে নেয়া, তার হাতে আকা বিবর্তনের আলোকে এধরনের একটি প্রথম জীবন বৃক্ষ। নোটবই এর ৩৬ নং পাতায় বিবর্তনীয় জীবন বৃক্ষের উপরে তার লেখা ‘I think’ বাক্যটি লক্ষ্য করুন), জিনতাত্ত্বিক থিওডোসিয়াস ডোবঝানস্কি লিখেছিলেন,‘বিবর্তনের আলোকে ব্যাখ্যা ছাড়া জীববিজ্ঞানে কোনো কিছুরই অর্থ হয়না’।
বিবর্তন প্রক্রিয়া ঘটছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে

(ছবি: ফিন্চ (চার্লস ডারউইনের 1839 Journal of Researches Into the Natural History and Geology of the Countries Visited During the Voyage of HMS Beagle Round the World, Under the Command of Captn. FitzRoy, R.N. থেকে)
জীবরা যে বিবর্তিত হয় শুধু সে কথা বলেই ডারউইন সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিবর্তন তত্ত্বের দৃঢ় ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও এটি সন্তোষজনক হবে না, যদি না তা দেখাতে পারে, ‘কিভাবে’ পৃথিবীতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতির জীব পরিবর্তিত হয় এমনভাবে যেন তারা তাদের আকার ও আকৃতিতে আর সহঅভিযোজনের সর্বোত্তম রুপ অর্জন করে, যা খুব সঙ্গত কারণে আমাদের প্রশংসার দাবী রাখে।’, যাকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ধারণা’ - সেখানে ডারউইন এই পরিবর্তনগুলোর কারণ হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন একটি প্রক্রিয়াকে, যার নামকরণ করেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। যার মুল বক্তব্য হচ্ছে, কোনো প্রজাতির মধ্যে যে সদস্যরা তাদের পরিবেশের সাথে বেশী সফলতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তারা, প্রজাতির অপেক্ষাকৃত কম সফল সদস্যদের তুলনায় বেশী দিন বাঁচবে এবং প্রজননের সুযোগও পাবে বেশী এবং এভাবে তারা তাদের উপযোগী সব বৈশিষ্ট্য এবং জিনগত গুণাবলী তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিস্তারে অপেক্ষাকৃতভাবে সফল হবে। ডারউইন এই তত্ত্ব প্রস্তাবের সময় থেকে আজ, এই মধ্যবর্তী সময়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জীবাশ্মবিদ নীল এল্ডরেজ লিখেছেন, ‘এই অর্ন্তবর্তীকালীন ১৭৫ বছরে আমরা এমন নতুন কিছুই শিখিনি, যা কিনা প্রাকৃতিক নির্বাচন কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে ডারউইনের এর মুল বিবরনের সাথে অসঙ্গতিপুর্ন’।
যথোচিতভাবে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কিভাবে কাজ করছে তার সবচেয়ে সেরা ও আকর্ষণীয় উদহারণগুলোর একটি : গালাপাগোসের ফিঞ্চ পাখীরা, যারা একসময় ডারউইনকে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ১৯৭৩ সাল থেকে, জীববিজ্ঞানী পিটার এবং রোজমেরী গ্রান্ট গালাপাগোস দ্বীপপুন্জ্ঞের ছোট একটা দ্বীপ ডাফনে মেজরে কাজ করছেন। তারা একটি স্থানীয় ফিঞ্চ, Geospiza fortis নিয়ে গবেষেণা করে আসছিলেন। (উপরের ছবিটি, ১৮৩৯ সালে ডারউইনের বিগল সমুদ্রযাত্রার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত একটি বইয়ে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল)। ১৯৭৭ সালের একটি অনাবৃষ্টিতে ছোট বীজ তৈরী করে এমন অনেক উদ্ভিদ ধ্বংস হয়েছিল এই দ্বীপে, ফলে খাদ্য হিসাবে এর উপর নির্ভরশীল ১২০০ জিওস্পিজা ফর্টিস ফিন্চের ১০০০ ই মরে যায় সেখানে । গ্রান্ট যুগল আবিষ্কার করেন যে, অপেক্ষাকৃত বড় আকারের জিওস্পিজা ফর্টিস, যারা বড় বীজ ভেঙ্গে খেতে সক্ষম তারা আকারে ছোট জিওস্পিজা ফর্টিস, অপেক্ষা সংখ্যায় বেশী ‍বেঁচে যায়। ১৯৭৮ এ যারা বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রজনন হয়। এবং এদের প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায় তাদের ঠোট পূর্ববর্তী প্রজন্ম অপেক্ষা শতকরা ৪ ভাগ বড়। ২০০৩ আরো একটি অনাবৃষ্টিতে দেখা যায় ছোট ঠোটের জিওস্পিজা ফর্টিস ফিন্চরাই ‍বড় ঠোটের ফিন্চদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী বেঁচে ছিল। আংশিকভাবে এর কারণ ঐ দ্বীপে বসবাস স্থাপনকারী আরেকটি বড় আকারের ফিন্চ প্রজাতি জিওস্পিজা ম্যাগনিরসট্রিসের (G. magnirostris) সাথে খাদ্য হিসাবে বড় বীজের জন্য বড় ঠোটের জিওস্পিজা ফর্টিস ফিঞ্চদের কঠিন প্রতিযোগিতা। ২০০৩ থেকে ২০০৫, গ্রান্টস যুগল আবার আবিষ্কার করলেন, জিওস্পিজা ফর্টিস এর ঠোটের আকার শতকরা ৫ ভাগ কমে গেছে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের অবশ্যই কোনো প্রক্রিয়া আছে:

(ছবি: ফ্রান্সিস ক্রিকের হাতে আকা ডিএনএ ডাবল হেলিক্সের প্রথম ডায়াগ্রাম।)
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যে বিবর্তন হচ্ছে ডারউইন তা খুব ভালো করে জানতেন, যে প্রশ্নটার উত্তর তাঁর জানা ছিল না তা হল, কেমন করে সেই প্রক্রিয়াটি কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি এর ব্যাখা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন বংশগতি বা হেরেডিটির একটা পদ্ধতিকে, যার নাম দিয়েছিলেন প্যানজেনেসিস। ভূল প্রমাণিত হয়েছিল তার এই প্যানজেনেসিসের ধারণাটি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটা হলো, বংশগতির আসল প্রক্রিয়াটি -জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স -কিন্তু ডারউইনের জীবদ্দশায় আবিষ্কৃত হয়েছিল, যদিও তিনি তা জেনে যেতে পারেননি। ১৮৬৫ সালে মটরশুটি গাছ নিয়ে গবেষনা করে অষ্ট্রিয়ীয় পাদ্রী গ্রেগর মেন্ডেল কিন্তু জিনতত্ত্বের মৌলিক নিয়মগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু মেন্ডেলের গবেষণা ১৯০০ সাল পর্যন্ত্য অবহেলিত হয়েছে, তার কাজ প্রকৃত মূল্য পেয়েছে ১৯৪০ এর দশকে যখন বিজ্ঞানীরা জিনের আসল উপাদান ‍ডিএনএ’কে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ( ছবিতে ফ্রান্সিস ক্রিকের আকা ডিএনএ ডাবল হেলিক্স এর প্রথম স্কেচ); বর্তমানে জীবিত প্রাণির জিনোমই হলো জিনতত্ত্ব, ‍চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই জিনতত্ত্বের বৈপ্লবিক সব গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন, তা অবশ্যই প্রাকৃতিক, কোনো ভাবেই অতিপ্রাকৃত না:

(ছবি: ওক গাছের চারা)
ডারউউন তার বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছেন প্রায় ২০ বছর, যতক্ষণ না পর্যন্ত আরেকজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, সম্পুর্ন স্বতন্ত্রভাবে প্রজাতির বিবর্তন সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় ঠিক একই ধারণায় উপনীত হন। তার দেরী করার অন্তত একটা কারণ ছিল, তিনি জানতেন ধর্মপরায়ন খ্রিস্টানদের বিশ্বাসের উপর তার তত্ত্ব কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। আর এদের মধ্যে একজন ছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী এমা, যিনি বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীর সমস্ত জীবিত জীবকে সম্পুর্ন রুপে আর পরস্পরের থেকে পৃথক করে সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। বলাবাহুল্য ডারউইনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ভিন্ন। বন্ধু টি. এইচ. হাক্সলী ছিলেন একই মতের, ‘একই ধরনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় যেভাবে বীজ থেকে বৃক্ষ বেড়ে ওঠে, বা ডিম থেকে জন্ম নেয় মুরগী,’ হাক্সলী লিখেছিলেন, ‘বিবর্তন প্রক্রিয়া বিশেষ সৃষ্টিসহ সব ধরনের অতিপ্রাকৃত হস্তক্ষেপের ধারণাকে পরিত্যাগ করে।’ অবশ্যই সারা পৃথিবী বহু মানুষ আজো বিশ্বাস করেন সৃষ্টির পেছনে রয়েছে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ।
ভ্রূণতত্ত্ববিদ্যা বা এমব্রায়োলজী হচ্ছে ‘আকৃতির পরিবর্তনের স্বপক্ষে এককভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রেণীর তথ্যসম্ভার’:

(ছবি: মানব ভ্রূণ)
ডারউইনের মতে নিষিক্ত একটি ডিম্বাণু যে পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বহু সহস্র কোটি কোষের একটি পুর্ণবয়স্ক প্রাণিতে পরিণত হয়ে এ বিষয়টি, বিবর্তনের সময়ে কিভাবে প্রাণী এবং উদ্ভিদের মূল অঙ্গ কিভাবে পরিবর্তিত হয়, তা বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের নতুন শাখা ইভোল্যুশনারী ডেভেলপমেন্ট বায়োলজী বা সংক্ষেপে যা ‘ইভো ডেভো’ নামে পরিচিত, আজ ডারউইনের এই ধারণার পিছনে সত্যকে দ্রুততার সাথে উন্মোচন করে চলেছে। অতি সম্প্রতিকাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কেবল বলতে পারতো আকারের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কিভাবে হচ্ছে, সেটি তাদের সঠিক জানা ছিল না। তবে এখন তারা সেটা জানেন, বিস্ময়কর একটা ব্যাপার যদিও, পৃথিবীর সকল জীব, অণুজীব থেকে মানুষ (ছবিতে মানুষের ভ্রূণ) সবাই একই ধরনের ‘টুল-কিট’ বা মাষ্টার জিন ব্যবহার করে, যা নিয়ন্ত্রন করে শরীর এবং অন্যান্য অঙ্গ কিভাবে তৈরী হবে এবং ভ্রুণাবস্থায় কখন কোনো জিনটা সক্রিয় /নিষ্ক্রিয় বা সুইচ অন/অফ হবে বা কেমন করে তৈরী হবে প্রাণীর শরীর।
যৌন নির্বাচনও বিবর্তন প্রক্রিয়ার একটি চালিকা শক্তি

( ছবি: পেখম সহ পুরুষ ময়ুর)
ডারউইনের কাছে ময়ূর ছিল একটা ধাঁধার মত। কেমন করে অতিআড়ম্বর সম্পন্ন এমন পেখমের উৎপত্তি হলো। কেমন করে এই পেখম প্রজাতির সবচেয়ে সুযোগ্য সদস্যদের বেঁচে থাকার সংগ্রামে (survival of the fittest বাক্যটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার) অবদান রাখতে পারে। ডারউইন এই পশ্নের উত্তর প্রস্তাব করেছিলেন তার The Descent of Man বইটিতে, যেখানে তিনি একটি নতুন ধারণার প্রস্তাবনা করেন: যৌন নির্বাচন, যা ব্যাখ্যা করে প্রাণিদের নানা বৈশিষ্ট্যের বিবর্তনে প্রজাতির বীপরিত লিঙ্গের সদস্যরা কিধরনের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ডারউইন বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে কোনো ছেলে ময়ূরের পেখম সবচেয়ে সুন্দর, এ বিষয়ে মেয়ে ময়ূরের পছন্দ বা অপছন্দই সম্ভবত ছেলে ময়ূরদের এমন জমকালো পেখমের কারণ। ১৯৯০ এর দশকে নিউক্যাসল-আপন-টাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মারিওন পেট্রি প্রমাণ করেন যে, আসলেই ডারউইনের অনুমান সঠিক। গড়পড়তায় ছেলে ময়ুরের পেখমে প্রায় ১৫০ টা মত চোখ থাকে, সেখান থেকে কিছু চোখ সরিয়ে ফেললেই ঐ পুরুষ ময়ুরের প্রজনন সুযোগ অনেকাংশে কমে যায়। ১৩০ টা চোখের নীচের পুরুষ কমই পারে প্রজনন সঙ্গী হিসাবে মেয়ে ময়ুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সফল হতে। পেট্রির যুক্তি হলো, যতই একটা পুরুষ ময়ুর স্বাস্থ্যবান হবে ততই সে পেখমের চোখ তৈরীর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শক্তি বিনিয়োগ করতে পারবে – যে বিষয়টা মেয়ে ময়ুররা নিজেরাই ভালো বুঝতে পারে।
মানুষ সহ প্রত্যেকটি জীব একটি সাধারণ পূর্বসূরির বংশধর

(ছবি: অমর জীন ( ছবি: Sean B. Carroll এর The Making of the Fittest: DNA and the Ultimate Forensic Record of Evolution (Norton)থেকে পুনঃঅঙ্কিত)
ডারউইন জানতেন, মানুষ একটি প্রাণি মাত্র, তাঁর এমন বক্তব্যে তৎকালীন ভিক্টোরিয় সমাজে ‍‍‍ তেমন কোনো গ্রহনযোগ্যতা না পাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু তাঁর Origin of species এ তিনি কিন্তু এই বক্তব্যটাকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে, ‘আমি সাদৃশ্য থেকে অনুমান করতে পারি যে, সম্ভবত পৃথিবীর সকল জীব, যারা এই পৃথিবীতে কোনোদিনও বেঁচে ছিল, তারা প্রত্যেকে আদিম কোনো জীব থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যেখানে জীবনের প্রথম শুরু হয়েছিল।’ তখন থেকেই তার এই ধারণার পক্ষে অনেক স্বাক্ষ্য প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ এসেছে ইভো ডেভো থেকে। জীবনের তিনটি ডোমেন – আরকীয়া, ব্যাকটেরিয়া এবং ইউক্যারিওট ( প্রাণি,উদ্ভিদ, ছত্রাক এবং প্রোটিষ্টরা)- দের জিনোম তুলনামূলক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, মোটামুটি ৫০০ জিন জীবিত সকল প্রাণিদের মধ্যে পাওয়া যায়, সৃষ্টির শুরু থেকে সেই অমর জিনগুলো টিকে গেছে অপরিবর্তিত রুপে প্রায় ২ বিলিয়ন বছর ( ছবিতে সেরকমই বিভিন্ন জীবের মধ্যে বিদ্যমান একটা প্রোটিন অনুক্রমের অংশ বিশেষ দেখানো হয়েছে, একই অ্যামাইনো এসিডগুলোকে হাইলাইট করা হয়েছে)। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন মিলারের ভাষায় ‘অসাধারণ জীববৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও, প্রত্যেকটা জীবিত প্রাণিদের মধ্যে প্রায় একই ধরনের অত্যাবশ্যকীয় জিনগুলো বিদ্যমান, যা সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে তাদের উৎপত্তি হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে একটি সাধারণ পূর্বসূরি প্রাণি থেকে।’
এইপ’দের (Ape) মত পূর্বপুরুষদের থেকে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ

(ছবি: ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত Evidence as to Man’s Place in Nature (Thomas Henry Huxley) থেকে মানুষ, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাং উটান ও গিবনের কংকাল)
ডারউইনের মনে আশঙ্কা ছিল, যদি তিনি প্রস্তাব করে মানুষ এবং এইপ’দের আদি পূর্বপুরুষ ছিল এক, তাহলে তার সমকালীন সমাজে অনেকেই গভীরভাবে মর্মাহত হতে পারে। স্বভাবতই ডারউইন তার ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত Origin of species এ মানব বিবর্তনের বিষয়টিকে বলতে গেলে প্রায় এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু ১৮৭১ এ Descent of Man এ তিনি এ বিষয়ে তার ধারণাগুলো স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। কোনো রাখ ঢাক না করে লিখেছিলেন, ‘লোমশ, চতুর্পদী,লে জযুক্ত, স্বভাবে সম্ভবত বৃক্ষচারী কোনো প্রাণির বংশধর হলো মানুষ।’; তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মনের সাথে শিম্পান্জ্ঞি বা গরিলার মনের পার্থক্য প্রকারে না বরং প্রকৃতিতে’; তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার যা মনে হয় তা হলো, আমাদের অবশ্যই স্বীকার করা উচিৎ, সকল মহান গুণে গুণান্বিত মানুষ, তার শারীরিক কাঠামোতে খুব সাধারণ উৎপত্তির অমোচনীয় চিহ্ন বহন করে বেড়ায়’। আজ অনেক স্কুলের ছেলে মেয়েরাই সেই পরিসংখ্যানটি বলতে পারবে, ‍‍যেটি উল্লেখ করা হয় এই মতবাদের স্বপক্ষে জোরালো একটি যুক্তি হিসাবে- বিবর্তনের ধারায় আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী জীবিত প্রাণি শিম্পাঞ্জির ডিএনএ‘র সাথে আমাদের ডিএনএ’র প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগই মিল (উপরের ছবিটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল টি এইচ হাক্সলি’র ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত Man’s Place in Nature এ ছবিটিকে সর্ববামে গিবন ছাড়া সব প্রাণিদের কাঠামো আনুপাতিক আকারে আঁকা, গিবনের ছবিটি তার তার আকারের দ্বিগুন অনুপাতে আকা হয়েছে)
আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকায়

ছবি: বিবর্তন বৃক্ষ ( ছবি: Pascal Gagneux et al. 1999. “Mitochondrial Sequences Show Diverse Evolutionary Histories of African Hominoids.” Proc. Natl. Acad. Sci. USA ,Vol. 96, pp. 5077-5082, 27 April থেকে পুনঅঙ্কিত)
ডারউইন জীবিত থাকাকালীন সময়ে আদি মানুষের তেমন কোনো জীবাশ্ম খুজে পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ১৮৫৬ সালে জার্মানীর নিয়ানডার উপত্যকায় খুজে পাওয়া নিয়ানডার্থাল মানুষের জীবাশ্ম । এছাড়াও তখন কেউই সুনিশ্চিৎভাবে সেগুলো কত বছরের পুরোনো তা পরিমাপ করতে পারেনি। কিন্তু শিম্পান্জ্ঞি বা গরিলাদের সাথে আমাদের শারীরিক গঠনের সাদৃশ্য লক্ষ্য করে তিনি অনুমান করেছিলেন যে, Homo spaiens রা বিবর্তিত হয়েছে আফ্রিকায়। তার স্বভাবসুলভ সর্তকতার সাথে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের পু্র্বপুরুষদের উৎপত্তি, অন্য কোনো স্থান থেকে আফ্রিকা মহাদেশেই হবার সম্ভাবনাই বেশী’; বর্তমানে সুপরিচিত লুসি শুধুমাত্র, মানুষ বা মানুষের মত প্রজাতিদের অসংখ্য আবিষ্কৃত জীবাশ্মদের একটি মাত্র, যাদের বেঁচে থাকার সময়কাল এবং বৈশিষ্ট্য তার ধারণাকে প্রমাণ করেছে, মানুষের প্রথম আবির্ভাব হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। (উপরের ছবিতে ১৯৯৯ সালের ডিএনএ সাদৃশ্যর উপর ভিত্তি করে আঁকা একটি বিবর্তন বৃক্ষ যা প্রমাণ করেছে আমরা মানুষসহ পাচটি গ্রেট এইপ পরিবার একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভব হয়েছিল। ডায়াগ্রামে শাখার দৈর্ঘ্য নির্দেশ করে প্রত্যেকটি প্রাণিদের জনগোষ্ঠী তাদের নিকটবর্তী স্বজনদের থেকে কতটুকু আলাদা হয়েছে তাদের মাইটোকাইন্ড্রয়াল জিনের অনুক্রমে)।
পৃথিবীর বয়স কম করে হলেও কয়েকশ মিলিয়ন বছর

(ছবি: পৃথিবী)
১৬৫৮ সালে আইরিশ পাদ্রী জেমস আশার, বাইবেল এবং তার পঠিত ঐতিহাসিক রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে ঘোষনা দেন, খৃষ্টপূর্ব ৪০০৪ এর অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। ডারউইনের সমসাময়িক ভুতত্ত্ববিদরা এর তীব্র বিরোধীতা করে বললেন, প্রমাণ সহ যুক্তি দিলেন যে পৃথিবীর বয়স আরো অনেক বেশী। ডারউইন, বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মাত্র ছয় হাজার বছরের চেয়ে আরো অনেক বেশী পরিমানএকটা যে সময় দরকার, এই বিষয়টি জানতেন, এবং ভুতত্ত্ববিদদের সাথে বিষয়টি সম্বন্ধে এক মত পোষন করেন। Origin of Species এর প্রথম সংস্করণে তিনি আমাদের গ্রহটি বয়স কমপক্ষে কয়েকশ মিলিয়ন বছর হবে বলে দাবী করেছিলেন। আসলে, এখন আমরা সবাই জানি পৃথিবী আরো বেশী প্রাচীন। ১৯০০’র দশকে, মারি এবং পিয়ের কুরী তেজক্রিয়তা আবিষ্কার করার পর, পদার্থবিদরা ইউরনিয়ামের হাফ লাইফ এবং আরো কয়েকটি তেজষ্ক্রিয় মৌল উপাদান ব্যবহার করে পাথরের বয়স নির্ণয়ের কৌশলও উদ্ভাবন করেন। পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীনতম খনিজ পদার্থের বয়স প্রায় ৪.১ থেকে ৪.২ বিলিয়ন বছর, যা প্রমাণ করে পৃথিবীর বয়স এর চেয়ে কম হতে পারে না। কিন্তু উল্কাপিন্ড, বিজ্ঞানীরা যাদের মনে করেন পৃথিবী সৃষ্টির সমসাময়িক সময়ে সৃষ্ট হয়েছিল, কিন্তু ভুতাত্ত্বিকভাবে যারা নিষ্ক্রিয়, ফলে তারা তাদের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রমাণ এখনও বিদ্যমান, সেই উল্কাপিন্ডের উপরে বয়স পরিমাপের বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে বার বার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মোটামুটি একই বয়স পরিমাপ করেছেন – তা হলো প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর। বর্তমানে এটাই পৃথিবীর বয়স হিসাবে বেশী স্বীকৃত।
জীবাশ্ম রেকর্ডের ফাকা জায়গাগুলো পুরণ করবে গুরুত্বপুর্ণ ট্রান্জিশনাল (অন্তর্বর্তীকালীন) জীবাশ্মগুলো

(ছবি: আর্কিওপটেরিক্স)
তার নোটবুকে, সেই সময়ে জীবাশ্ম রেকর্ডের মধ্যে বিদ্যমান ফাকা জায়গাগুলো নিয়ে ডারউইন চিন্তার কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘যেন কোনো বই থেকে পাতা ছিড়ে ফেলা হয়েছে’; সম্ভবত সবচেয়ে বড় ফাকা জায়গাটা ছিলো ক্যামব্রিয়ান পিরিওডের (৫৪৪-৫১৪ মিলিয়ন বছর আগে) আগে কোনো জীবাশ্ম খুজে না পাওয়ার ব্যাপারটা, ‘কেন আমরা ক্যামব্রিয়ান সিস্টেমেরও আরো আগের পিরিওডের জীবাশ্ম সমৃদ্ধ ডিপোসিট খুজে পাচ্ছিনা, এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর আমার জানা নেই’ তিনি লিখেছিলেন; যদি তার তত্ত্ব সঠিক হয়,তিনি জানতেন এই সব ফাকা জায়গাগুলো ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পুর্ণ হয়ে যাবে। গত অর্ধ শতাব্দীতে কেবল মাত্র জীবাশ্মবিদরা প্রি-ক্যামব্রিয়ান পর্বেও জীবাশ্ম খুজে পেতে শুরু করেছেন এবং এই জীবাশ্ম’র পরিমান বিশাল এবং ক্রমাগতই তা বাড়ছে। বর্তমানে সবচেয়ে প্রাচীন জীবাশ্মর বয়স প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর। এছাড়াও জীবাশ্মবিদরা একের পর এক খুজে বের করছেন গুরুত্বপুর্ন সেই সব ট্রান্জিশনাল ফসিল গুলো যা গুরুত্বপুর্ন বিবর্তনের নানা পর্বগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী করেছে এবং ডারউইনের সময়ে যাদের অনুপস্থিতি তাকে চিন্তিত করেছিল (যেমন: ছবিতে এখানে একটি আর্কিওপটেরিক্স এর জীবাশ্ম)।
এক ফুট লম্বা কোনো পতঙ্গ নিশ্চয়ই আছে এই অর্কিডের পরাগায়ন করার জন্য

(ছবি: অ্যানগ্রেকাম সেসকিপেডালী (Angraecum sesquipedale, মাদাগাস্কার স্টার অর্কিড)
ডারউইনের ধারণাগুলোর মধ্যে সবগুলোই যে বড় পরিসরের বা পৃথিবী কাপানো, তা কিন্তু না, কিছু কিছু ছিল খুব সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী। মাদাগাস্কারের অ্যানগ্রেকাম সেসকিপেডালী (Angraecum sesquipedale) নামের অর্কিড প্রজাতির কথাই ধরুন ( যা মাদাগাস্কার স্টার অর্কিড নামেও পরিচিত)। ১৮৬২ সালে তিনি যখন এই অর্কিডটি প্রথম দেখেন, আর সবার মত এর স্পারটির দৈর্ঘ্য দেখে অবাক হয়ে যান (ছবিতে পেছনে সরু সবুজ নালীটিকে দেখুন); এই অর্কিডটি তার ফুলের পেছনে একটা লম্বা স্পার বা মধুথলি তৈরী করে যার দৈর্ঘ্য এক ফুটেরও বেশী (২০-৩৫ সেমি) (ল্যাটিন ভাষায় সেসকিপেডাল মানে দেড় ফুট) এবং এই স্পারের একেবারে তলদেশে এটি নেক্টার বা ফুলের মধু তৈরী করে। ‘আশ্চর্য্য’, তিনি লিখেছিলেন, ‘কোন পতঙ্গ এই মধুথলীর মধু পান করতে পারে?’ মন্তব্য করেন, ‘এখনো আবিষ্কার হয়নি এমন কোনো পতঙ্গ নিশ্চই আছে যার এক ফুট দীর্ঘ জিহবা আছে, যা দিয়ে এই লম্বা মধুথলীর মধু খেতে পারে’। তার সমসাময়িক কীটপতঙ্গবিদরা সন্দিহান ছিলেন বিষয়টি নিয়ে, কারণ ‍সেরকম কোনো পতঙ্গতো পাওয়া যায়নি। ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে ফুলের অতিআড়ম্বরপুর্ণ রং কিংবা আকার বিবর্তিত হয়েছে মানুষের সন্তুষ্টির জন্য না বরং পরাগায়নের জন্য পতঙ্গদের আকর্ষণ এবং তাদের নিজেদের সফল বংশবিস্তারের কৌশল হিসাবে। যে পরিচিত কৌশল ডারউইন শনাক্ত করেছিলেন, তা হলো ফুলের মধু খাওয়ার সময় ফুল পতঙ্গের পায়ে ফুলের আঠালো রেণু লাগিয়ে দেয়া। সুতরাং ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন, মাদাগাস্কারের জঙ্গলে কোথাও না কোথাও কোনো এমন কোনো পতঙ্গ বাস করে যার জিহবা যথেষ্ট পরিমান দীর্ঘ,অ্যানগ্রেকাম সেসকিপেডালী’ এর লুকোনো মধু পান করার জন্য। যখনই এই রহস্যময় পতঙ্গটি তার দীর্ঘ জিহবা প্রবেশ করে ফুলের গায়ে চেপে বসে মধু পান করে, ফুলের রেণু তখন তার শরীরে মেখে যায়, যা ফুলটি পরাগায়নে সহায়তা করে। তার মৃত্যুর একুশ বছর পর তার ভবিষ্যদ্বানী সফল হয়, যখন মাদাকাস্কারের জঙ্গলে বিজ্ঞানীরা খুজে পান দীর্ঘ জিহবার সেই পতঙ্গ, ডারউইনের ভবিষ্যদ্বানীকে সন্মান করে এটির নামকরন করা হয় জ্যানথোপ্যান মরগানী প্রেডিক্টা (ছবি ), একমাত্র এই মথটি পারে এই অর্কিডের পরাগায়ন করতে। আরো একবার তার কথা সঠিক প্রমাণিত হলো।

(ছবি: জ্যানথোপ্যান মরগানী প্রেডিক্টা মথ,অর্কিডটির পরাগায়নের জন্য একমাত্র এই প্রাণীটি সক্ষম।)



(ছবি: চার্লস ডারউইনের জীবন বৃক্ষ (২০১৫), কাপড়ে শিল্পীর নিজের চুল দিয়ে সেলাই করা, আসমা সুলতানা।):
বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে: চার্লস ডারউইন - একটি ধারণার বিজয়:
(আগের পর্বগুলো: প্রথম | দ্বিতীয় | তৃতীয় | চতুর্থ পঞ্চম | ষষ্ঠসপ্তম | অষ্টমনবম|শেষ পর্ব - ১)

ডারউইনের লিগেসি
১৮৮২ সালের ডারউইন ১৯ এপ্রিল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ডারউইন। স্ত্রী এমাকে বলা তার শেষ বাক্যটি ছিল, ‘আমি মৃত্যুকে একটুও ভয় করছিনা, মনে রেখো তুমি আমার আদর্শ সহধর্মিনী ছিলে, আমার ছেলে মেয়েদের বলো তারা সবসময় আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে’। বাসার কাছে সেইন্ট মেরী চার্চের সমাধিক্ষেত্রে তার সমাহিত করার কথা ছিল, কিন্তু ডারউইনের সহকর্মী বিজ্ঞানীরা ও রয়্যাল সোসাইটির সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম স্পটিসউড এর উদ্যোগে ডারউইনকে সন্মানিত করা হয় ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবিতে সমাহিত করার মাধ্যমে। ২৬ এপ্রিল তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাকে বিদায় জানাতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার শুভানুধ্যায়ী।
ডারউইন প্রায় সব বিজ্ঞানীকে তার বিবর্তনের ধারণাটি বোঝাতে পেরেছিলেন, আর আজ তাকে স্মরণ করা হয় আমাদের ধারণাকে বৈপ্লবিকভাবে বদলে দেয়া মহান একজন বিজ্ঞানী হিসাবে। ১৯০৯ সালে, ২২ থেকে ২৪ জুন ডারউইনের জন্মশত বার্ষিকী ও অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইটির প্রকাশনা পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ১৬৭ দেশ থেকে কেমব্রিজে জড়ো হয়েছিলেন ৪০০ বিজ্ঞানী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। কোনো একজন বিজ্ঞানীকে সন্মান করে আয়োজিত এত বড় অনুষ্ঠান এর আগে কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি পৃথিবীতে। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ, যে কলেজে ডারউইন একদিন ধর্মতত্ত্ব পড়তে এসেছিলেন। এছাড়া ডারউইনের নানা বই, নোটবুক, চিঠি নিয়ে পুরোনো লাইব্রেরীতে একটি প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার ক্যাটালগে প্রদর্শিত স্মারকগুলোর তালিকাই ছিল ২৫৭ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। মডার্ন সিনথেসিসের আগের পর্বটিকে জুলিয়ান হাক্সলী বলেছিলেন the eclipse of Darwinism, এই সময় বহু বিজ্ঞানী বিবর্তনের বহু বিকল্প প্রস্তাবও করেছিলেন, যার প্রত্যেকটি ব্যর্থ হয়েছিল বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু গানিতিক জীববিজ্ঞানী রোনাল্ড ফিশার মেণ্ডেলিয় জিনতত্ত্ব ও প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সমন্বয় করেছিলেন ১৯১৮ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে, যার অসাধারণ প্রেক্ষাপট আর বিবরণটি আমরা পাই তার যুগান্তকারী The Genetical Theory of Natural Selection বইটিতে। ফিশার, হলডেন আর রাইটের গবেষণা ডারউইনের ধারণাটি বিংশ শতাব্দীতে নিয়ে আসার পথটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, আজ অসংখ্য প্রমাণ আর অব্যহত গবেষণা বিবর্তনের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় মূলনীতি হিসাবে।

(ছবি: রোনাল্ড ফিশারের কালজয়ী সেই বইটি)
ডারউইনের যুগান্তকারী ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশনার দেড়শ বছর (১৮৫৯-২০০৯) পূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে এখানে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে গত কয়েক দশকের উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতির একটি তালিকার উল্লেখ করা হয়েছিল -অবশ্যই তালিকাটি কোনোভাবেই সম্পুর্ন নয় । এই অগ্রগতির তালিকায় শুধুমাত্র কোনো বিশেষ ধরনের প্রজাতির উদ্ভব সম্বন্ধে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এই তালিকায় অর্ন্তভুক্ত আছে মূল বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমাদের অর্ন্তদৃষ্টির কিছু মৌলিক অগ্রগতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এইসব অর্ন্তদৃষ্টিগুলো ডারউইনকেই বিস্ময়ের আনন্দময় ধাক্কা দিতে পারতো।
বিবর্তন প্রক্রিয়া যে কাজ করছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ

(ছবি: বেঁচে থাকলে ডারউইন অবশ্যই অবাক হতেন, প্রত্যক্ষভাবে বিবর্তন প্রক্রিয়াকে কাজ করতে দেখা সহ বিবর্তন জীববিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলোর দ্রুততা আর তাদের ধরন দেখে, ১৮৮১ সালে তোলা একটি ফটোগ্রাফে। Charles Darwin photograph by Herbert Rose Barraud, 1881)
ডারউইন ভাবতেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এতই মন্হরগতিতে কাজ করে যে, এর প্রভাব মানুষের জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেই বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা মুষ্টিমেয় কিছু প্রজাতির মধ্যে ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন শনাক্ত করতে শুরু করেন। গত দশকেই আরো অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবের। বিজ্ঞানীরাও বর্তমানে বুঝতে পেরেছেন যে, বিভিন্ন ধরনের প্রজাতিরা খুব দ্রুতই তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আসলে, তারা প্রমাণ পেয়েছেন বর্তমানে আমরা মানুষরাই নিজেদের অজান্তে কিছু কিছু দ্রুত বিবর্তনের ঘটনা ঘটানোর জন্য দায়ী। যেমন, গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি যখন আমাদের গ্রহের গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এই পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে কিছু কিছু প্রজাতি। ক্যালিফোর্নিয়ায়, টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আর্থার ওয়েইস এবং তার সহকর্মীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, সাত বছরের অনাবৃষ্টি ফিল্ড মাষ্টার্ড বা সরিষা প্রজাতির উদ্ভিদের বিবর্তন ঘটিয়েছে। ২০০৭ সালে তারা তাদের গবেষণার তথ্যে প্রকাশ করেন যে, এই প্রজাতির উদ্ভিদটিতে এখন জিন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়েছে বসন্তে আটদিন আগেই ফুল ফোটার জন্য।
শক্তিশালী আর অপেক্ষাকৃত সুলভ ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির কল্যাণে, বিজ্ঞানীরা বর্তমানে দ্রুত বিবর্তনের কারণ যে কোনো জিন পর্যায়ের পরিবর্তনকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম। সান দিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ণার্ড প্যালসন ও তার সহকর্মীরা তাদের ল্যাবে ব্যাক্টেরিয়ার বিবর্তন দেখেছেন প্রত্যক্ষভাবে। তাদের ল্যাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহর মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ারে কলোনী সম্পুর্ন একটি নতুন ধরনের খাদ্য (গ্লিসারল নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ) গ্রহনে প্রয়োজনীয় অভিযোজন করতে সফল হয়। বিজ্ঞানীরা আদি ব্যাকটেরিয়া এবং তার থেকে আগত সকল উত্তরসূরি ব্যাকটেরিয়ার জিন সিকোয়েন্স করে তাদের ‍ডিএনএ র মধ্যে পার্থক্য খুজেছেন। ব্যক্টেরিয়ার জিনের মধ্যে মধ্যে উদ্ভব হয়েছে এমন হাতে গোনা কিছু ‘মিউটেশন’ বা পরিবর্তন শনাক্ত করতে তারা সফল হন যা পরীক্ষাধীন সমস্ত ব্যাক্টেরিয়ার জনসংখ্যায় বিস্তার লাভ করেছে। যখন বিজ্ঞানীরা সেই ‘মিউটেশন’ গুলোকে পূর্বসূরি বা আদি ব্যাক্টেরিয়ার জিনে সন্নিবেশ করিয়েছেন, তারাও তখন তাদের উত্তরসূরিদের মত নতুন খাদ্য ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করে।
ক্রান্তিকালীন জীবাশ্ম

(ছবি: টিকটালিকের জীবাশ্মসহ নিল শুবিন)
ডারউইন যুক্তি দিয়েছিলেন, যদিও বর্তমানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য মনে হতে পারে খুবই বিশাল, কিন্ত তারা পরস্পর সংযুক্ত তাদের বংশগত উৎপত্তির দিক থেকে। তার এই তত্ত্ব পূর্বাভাস দিয়েছিল, এমন ধরনের কোনো প্রজাতির অস্তিত্বের ব্যাপারে, যা দুটি আপাতদৃষ্টিতে পৃথক প্রজাতি গোষ্ঠির মধ্যে বংশগত যোগসুত্রের বাহক। ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশের এক বছরের মাথায় ‘আর্কিওপটেরিক্স’ নামের একটা পাখির আবিষ্কার ডারউইনকে তৃপ্ত করেছিল, কারণ সেটি তার পূর্বাভাষ অনুযায়ী ঠিকই দুটি পৃথক প্রজাতির গোষ্ঠির মধ্যে বংশগত যোগসুত্রের বাহক। ‘আর্কিওপটেরিক্স’ এর পাখিদের মত যেমন পালক ছিল তেমনই মত কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল সরিসৃপের মত এবং কোনো কোনো জীবিত পাখি প্রজাতির মধ্যে যা দেখা যায় না, যেমন লম্বা লেজ আর এর ‘হাতের’ সুতীক্ষ্ম নোখ। দুর্ভাগ্য যে ডারউইন গত দশকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ক্রান্তিকালীন জীবাশ্মদের আবিষ্কারগুলো দেখে যেতে পারেননি, যাদের প্রত্যেকটাই আর্কিওপটেরিক্স এর চেয়ে বেশী না হলেও কোনো অংশেই কম বিস্ময়কর না।

(ছবি: টিকটালিক (Tiktaalik), কার্ল বুয়েলের আঁকা ছবিতে, স্থলচর এবং জলজ প্রাণিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালীন প্রাণি)
যেমন, ২০০৪ সালে আর্কটিক (উত্তর মেরু) অঞ্চলে খনন করার সময় বিজ্ঞানীরা মানুষসহ সকল স্থলচর মেরুদন্ডী প্রাণিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি মাছ জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্ম অস্থি খুজে পান। যার নাম দেয়া হয় টিকটালিক (এর অর্থ ‘সুপেয় পানির বড় মাছ’, স্থানীয় এলেসমেয়ার দ্বীপের আদিবাসীদের ইনুকটিটাট ভাষার একটি শব্দ) । ৩৭৫ মিলিয়ন বছর প্রাচীন এই প্রাণিটির ছিল কনুই কব্জিসহ পুর্ণ হাত, নমনীয় ও স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করা যায় এমন একটি ঘাড় , যেহেতু পানির নীচে ছিল এদের বসবাস, তখনও ফুলকা ব্যবহার করে নিঃশ্বাস নিতে হত তাদের।
ডারউইন বিশেষ আগ্রহী ছিলেন তিমি’র ব্যাপারে, কারণ তিমি ভেতরে স্পষ্টতই স্তন্যপায়ী অথচ বাইরে থেকে দেখতে মাছের মত। ১৯৯৪ সালে জীবাশ্মবিদরা প্রথম পা সহ একটি তিমি’র জীবাশ্ম খুজে পান, ঠিক ডারউইন যেমনটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এভাবে গত দশকে তারা আবিষ্কার করেছেন আরো নতুন কিছু জীবাশ্ম, যে জীবাশ্মগুলো বিজ্ঞানীদের অনেকটুকুই বুঝতে সাহায্য করেছে,কেমন করে ৫০ আর ৪০ মিলিয়ন বছর আগের মাঝামাঝি কোনো এক সময় তিমি স্থলচর প্রাণি থেকে সাগরের প্রাণিতে রুপান্তরিত হয়েছিল।
যেমন, ২০০১ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিপ জিনজেরিখ তার সহকর্মীরা প্রথমবারের মত তিমি‘র গোড়ালীর হাড়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিমির উৎপত্তি জানার জন্য এই হাড়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপুর্ণ, কারণ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগত আকৃতির সাথে মিল পাওয়া যায় শুধু মাত্র একটি গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণিদের সাথে: ইভেন-টোড (Even-toed) খুর- যুক্ত পায়ের স্তন্যপায়ী প্রাণি যারা আর্টিওডাকটাইলস হিসাবে পরিচিত। তিমি‘র ডিএনএ নিয়েও গবেষণা যা শেষ হয়েছে গত দশকে, সেগুলোও বারবার ইঙ্গিত দিয়েছে আর্টিওডাকটাইলস এর দিকে – বিশেষ করে হিপপো বা জলহস্তিদের সাথে- যারা স্থলে তিমি’র সবচেয়ে ঘনিষ্ট আত্মীয়।
জটিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি
ডিএনএ নিয়ে গবেষণা শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের সাহায্যই করেনি, কোনো একটি প্রজাতি সাথে অন্য একটি প্রজাতির সম্পর্ক কত কাছের বা দূরের তা খুজে বের করার জন্য। তারা আরো উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন কেমন করে জিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্মাণ করে বিভিন্ন প্রজাতির শরীরে । এই তুলনামূলক আলোচনা, গত দশকে বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্ন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে, যেমন কেমন করে এসব জটিল অঙ্গগুলো বিবর্তিত হয়েছে। জটিল চোখ বিবর্তিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভিন্ন ধরনের প্রাণির বংশানুক্রমে, যেমন, আমাদের মত মেরুদন্ডী প্রাণী, অক্টোপি আর অন্যান্য সেফালোপড এবং কীট পতঙ্গ। দীর্ঘ সময় ধরে, প্রাপ্ত সব প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, জটিল চোখ এই প্রত্যেকটি প্রাণিদের গোত্রে বংশানুক্রমে বিবর্তিত হয়েছে স্বতন্ত্রভাবে। কিন্ত বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করছেন অনেক বেশী একটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ইতিহাস।

(ছবি: জটিল চোখের উৎপত্তি ঘটেছে বেশ কয়েকটি প্রাণীর বংশানুক্রমে, কিন্তু প্রত্যেক ধরনের চোখে আছে ক্রিস্টালিন, যা আগত আলোকরশ্মিকে জড়ো করে অপসিনের কাছে নিয়ে যায় ধরার জন্য।)
যেমন, ২০০৭ সালে, সান্তা বারবারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টড ওকলে আর সহযোগীরা দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন ধরনে আলোক-সংবেদী কোষ বিবর্তিত হয়েছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে আমাদের দুরবর্তী পূর্বসূরি প্রাণিদের খুব সাধারণ সংকেত শনাক্ত করতে সক্ষম কয়েক ধরনের প্রোটিন অনু থেকে। প্রথম প্রাণিরা যখন বিবর্তিত হয়েছে, সেই সময়ে এই সংকেত শনাক্তক্ষম অনুগুলোও বিবর্তিত হয়েছে ‍দুটি ভিন্ন ধরনের আলোক সংবেদী কোষে বা রিসেপটরে। ঐসব আদিম প্রাণিগুলোর চোখ ছিল সম্ভবত খুব সাধারণ আলোক সংবেদী স্পট ছাড়া আর বেশী কিছু না। অনেক পরে জটিল চোখের আবির্ভাব ঘটে বিবর্তন প্রক্রিয়ায়, এবং দৃশ্যকে ধারণ করতে বিভিন্ন গোত্রের প্রজাতির প্রাণিরা বেছে নেয় পৃথক পৃথক আলোক সংবেদী কোষ বা রিসেপটর। ওকলের এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, জটিল চোখ প্রকৃতপক্ষে পৃথক ভাবে বিবর্তিত হলেও, তারা একই রকম কতগুলো আদি জেনেটিক বা বংশতগতির টুলকে ব্যবহার করেছে তাদের বিবর্তনের লক্ষ্যে। পাখির পালক থেকে গুবরে পোকার শিং পর্যন্ত্য, গত দশকে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এই প্যাটার্ণ বা কৌশলটা খুব বিস্ময়করভাবে একই রকম: বিবর্তন আসলেই খুবই দক্ষ পুনর্ব্যবহারকারী।
জিনোমের অরণ্যে
ডারউইন যেমন বুঝতে পেরেছিলেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন হলো বিবর্তনের একটি গুরুত্বপুর্ণ শক্তি এবং গত শতাব্দীতে জিন নিয়ে গবেষণা করার সময় বিজ্ঞানীরা এই শক্তির অসংখ্য উদহারনও পেয়েছেন। যখন কোনো মিউটেশন প্রোটিন-কোডকারী কোনো জিন যেভাবে কাজ করে তা পরিবর্তন করে -প্রোটিনের গঠনও পরিবর্তিত হয়, উদহারণ সরুপ, যে সিগনাল বা সংকেত সুইচের মত জিনকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করে দেয় -এধরনের মিউটেশন কোনো প্রাণির প্রজনন সাফল্যের উপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উপকারী মিউটেশন তার পর বিস্তার লাভ করে আর ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হলে তারা প্রজাতিকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করে।

(ছবি: ডিএনএ তে কিন্তু বেশ কয়েক ধরনের পরিবর্তন বা মিউটেশন হয় এখানে তার কয়েকটা দেখানো হল।)
কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন কিন্তু বিবর্তনের একমাত্র কাহিনী না। অনেক মিউটেশনই সমস্ত প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে বিস্তার লাভ করে তা কিন্তু শুধূ প্রাকৃতিক নির্বাচনের কল্যানেই না বরং অনেকটাই জেনেটিক জুয়ার গুটির ভাগ্যবান দানের মাধ্যমে। এই তথাকথিত নিরপেক্ষ বা `নিউট্রাল’ বিবর্তন বিশেষ করে গুরুত্বপুর্ণ আমাদের জেনোমের সেই অংশগুলোর বিন্যাসে যেখানে প্রোটিনের সংকেতবাহী কোনো জিন নেই। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন প্রোটিন সংকেত না করা অংশ নিশ্চই খুব তেমন বড় কোনো অংশ হওয়ার কথা না।ঠিক এর বীপরিতটাই কিন্তু সত্যি। আমাদের জিনোমের প্রায় শতকরা ৯৮.৮ ভাগই আসলে নন-কোডিং বা প্রোটিন-কোড না করা অংশ।

(ছবি: প্রতিটা কোষের মধ্যে জিনের কিছু অংশ, এই ছবিতে যেমন লোহিত রক্ত কনিকা, কাজ করে একধরনের সুইচ হিসাবে, যা অন্যান্য জিনকে বলে কখনও সক্রিয় হতে আবার কখন নিষ্ক্রিয় হতে।
কেবল গত কয়েক বছর ধবে বিজ্ঞানীরা জিনের এই অজানা অংশ নিয়ে বিস্তারিত গবেষনা করছেন এবং বিবর্তনকেই তারা তাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহন করেছে, যেমন, আমাদের ডিএনএ তে প্রায় ১১,০০০ তথাকথিত ‘সিউডোজিন’ বা মিথ্যা জিন আছে -এরা ডিএনএ’র সেই অংশ যা কোনো এক সময় কোনো প্রোটিনকে কোড করতো, কিন্তু কোনো মিউটেশনের মাধ্যমে অক্ষম হয়ে যাবার কারনে এখন সেটা আর করে না । এইসব অক্ষম জিনগুলো কোনো এক সময় গুরুত্বপুর্ন কাজ করতো, যেমন, ভিটামিন তৈরী অথবা কোনো বিশেষ রাসায়নিক অণুর গন্ধ নেবার ক্ষমতা। বিজ্ঞানীরা জানেন এই সব সিউডোজিনরা কোনো একসময় পূর্ণাঙ্গ প্রোটিন কোড করা জিন ছিল, কারণ আমাদের প্রাইমেট আত্মীয়দের মধ্যে এদের সমতুল্য এবং কার্য্যক্ষম জিন পাওয়া গেছে।
যদিও আমাদের কিছু ননকোডিং ডিএনএ নিজস্ব জিন হিসাবে যাত্রা শরু করেছিল, কিন্তু বেশীর ভাগই শুরু হয়েছিল আগ্রাসী ভাইরাস হিসাবে। কিছু কিছু ভাইরাস তাদের ডিএনএ কে পোষক কোষের ডিএনএর সাথে এমনভাবে সন্নিবেশ করাতে পারে যে, পোষকের এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সেটি বিস্তার করতে পারে। এবং ধীরে ধীরে এই আমাদের ভিতরের এই ভাইরাসে এতই মিউটেশন হয় যে তারা আর নতুন কোনো পোষককে সংক্রমন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু অপরিবর্তিত থাকে তাদের নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষমতা, যা পুরাতন পোষকের জেনোমে যুক্ত হতে থাকে।মানুষের জেনোমের প্রায় ৪০ শতাংশ এধরনের ভাইরাস উদ্ভুত ডিএনএ দিয়ে তৈরী। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাস ডিএনএ’র উৎপত্তি ইতিহাস আবিষ্কার করেছেন আমাদের আর প্রাইমেটদের জেনোমে তাদের অবশিষ্টাংশর তুলনামুলক গবেষণা করে।
এইসব ভাইরাল ডিএনএ বর্তমানে এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে, জিনোমের মধ্যে প্যাডিং ছাড়া তা খুব বেশী কিছু না, তাসত্ত্বেও এই সব নিষ্ক্রিয় ধ্বংশাবশেষের মধ্যে তাদের অতীত সুপ্ত আছে। সব মানুষই তাদের জেনোমে প্রাচীন একটি ভাইরাসের বিভিন্ন সংস্করন বহন করে, যার নাম এইচইআরভি-কে (HERV-K) বা হিউম্যান এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস -কে। সংস্করণগুলোর মধ্যে পার্থক্যগুলো বিবর্তিত হয়েছে মুল ভাইরাসটি প্রথম একজন মানুষকে সংক্রমন করার পর এবং পরবর্তীতে বংশানুক্রমে সেই মানুষটির পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত হয়েছে । ফরাসী বিজ্ঞানীরা এই ‘এইচইআরভি-কে’ এর বিভিন্ন সংস্করণগুলো তুলনা করে খুজে বের করেছেন সংস্করণ প্রতি সর্বমোট মিউটেশনের সংখ্যা। এইসব নতুন মিউটেশনগুলোর উপরে ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিৎ হয়েছেন যে, এই ভাইরাসটি প্রথম মানুষের পূর্বসূরিকে সংক্রমন করেছে কয়েক মিলিয়ন বছর আগে।
এটি যে আসলে কোনো এক সময় একটি পূর্নাঙ্গ ভাইরাস ছিল তা প্রমাণ করতে বিজ্ঞানীরা এর ডিএনএর বিভিন্ন সংস্করণ করে, এর মূল জিনের ক্রমবিন্যাস কি রকম ছিল এমন একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তারা ঠিক সেই ডিএনএটিকে সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরী করে মানব কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন। এই সংশ্লেষিত ডিএনএটি ভাইরাসের মত কোষের দখল নিয়ে কোষটি রুপান্তরিত করে ফেলে অনুরুপ ভাইরাস তৈরীর কারখানায়। অন্য ভাবে বলতে গেলে, মৃত ভাইরাসকে জীবন্ত করে তুললেন বিজ্ঞানীরা।
মৃত ভাইরাসের ডিএনএ এবং নিষ্ক্রিয় সিউডোজিন এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু গুরুত্বপুর্ণ ননকোডিং ডিএনএ’র কিছু অংশ। এর কোনো কোনো অংশ কাজ করে, ‘সুইচ’ ‍হিসাবে, যেখানে নির্দিষ্ট প্রোটিন সংযুক্ত হয়ে নিকটে অবস্থিত জিনকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করার কাজটি করে। আমাদের জেনোমে ডিএনএ’র কিছু অংশ আছে আরএনএ অনু তৈরী করতে সক্ষম। এই আরএনএ অনু আমাদের দেহে তাদের নিজেদের কিছু গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে, যেমন, সংকেত শনাক্তকারী এবং জিন নিয়ন্ত্রনে।
বিজ্ঞানীরা কিন্তু বিবর্তনের উপর নির্ভর করে এই বিষয়গুলো আবিষ্কার করেছেন। যদি জিনোমে ননকোডিং ডিএনএ’ অংশের কোনো গুরুত্বপুর্ণ কাজ না থাকতো, সেক্ষেত্রে এর মিউটেশন, বহনকারী জীবের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সামান্যই প্রভাব ফেলতো। কিন্তু যদি এটির অপরিহার্য কোনো কাজ থাকে, যে কোনো ধরনের মিউটেশন অনায়াসেই ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। ফলাফলে, এধরনের ক্ষতিকর মিউটেশন বহনকারী প্রাণী অনেক কম পরিমান পরবর্তী প্রজন্ম উৎপাদন করবে, সুতরাং খুব সহজে এই ডিএনএ’র পরিবর্তন হয় না। বিভিন্ন ধরনের প্রজাতির মধ্যে তুলনামুলক গবেষনা এবং তাদের ননকোডিং ডিএনএ’র যে অংশগুলো বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে অস্বাভাবিক রকম সদৃশ, সেগুলো খোজার মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা এই সব কার্য্যকরী অংশগুলো খুজে বের করেছেন। এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রমাণ করে দেখাতে পেরেছেন, এই অংশগুলো আসলে জীবের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। বিবর্তন এভাবে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করেছে জেনোমের খড়ের গাদায় সূঁচ খুজে বের করতে।
যৌন নির্বাচনের শক্তি
ডারউইন নিজেই শনাক্ত করেছিলেন, যৌন নির্বাচন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতই বিবর্তনের আরেকটি শক্তি। কোনো প্রাণীদের যদি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য থাকে, যা বীপরিত লিঙ্গের প্রাণিদের কাছে মনে হয় আকর্ষণীয়, সেটা তাদের মাথার শিং হোক না কেন আর পালক বা উজ্জ্বল নীল রঙের পেখম হোক না কেন – এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো বংশানুক্রমে পরবর্তী প্রজন্মের আরো অধিক পরিমানে দৃশ্যমান হয়।

(ছবি: ডারউইন যৌন নির্বাচনের তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন পুরুষ ময়ুরের পেখম সহ বিভিন্ন প্রাণিদের মধ্যে দেখা যায় অতি আড়ম্বরপূর্ণ কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে।)
গত দশকের গবেষণা প্রমাণ করেছে যৌন নির্বাচন আসলেই বিবর্তন প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম কার্য্যকরী একটি শক্তি। কিন্ত এর শক্তি প্রদর্শনের উপায়টা কিন্তু ডারউইন পক্ষে পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব ছিল না সে সময়। গত কয়েক বছরের গবেষনায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রজাতির অন্যান্য সক্ষম পুরুষ সদস্যদের চেয়ে, কোনো নির্দিষ্ট ধরনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পুরুষ সদস্যেদেরকে প্রজাতির স্ত্রী সদস্যদের যৌন সঙ্গী হিসাবে পাবার ইচ্ছা বা অভিরুচি যথেষ্ট শক্তিশালী, কোনো একটি প্রজাতি থেকে কয়েকটি নতুন প্রজাতির উৎপত্তির জন্য। উদহারণ সরুপ, পূর্ব আফ্রিকার হ্রদগুলোতে, যৌন নির্বাচন সম্ভব করেছে পাশাপাশি বসবাস ও বংশবিস্তাররত মাছ থেকে শত শত নতুন প্রজাতির মাছের উৎপত্তি ।
যৌন নির্বাচন কিন্তু কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রাণিদের উপকার ছাড়াও আরো অতিরিক্ত অনেক কিছু করছে। যে কোনো অভিযোজন, যা কিনা প্রজাতির কোনো লিঙ্গের সদস্যকে সাহায্য করে সমলিঙ্গ অন্য কোনো সদস্যদের তুলনায় বেশী পরিমান সন্তান উৎপাদন করতে, সেই সব ধরনের অভিযোজন, বিশেষ অগ্রাধিকার পায় যৌন নির্বাচনের ক্ষেত্রে । যেমন: পুরুষ মাছি মিলনের সময় তাদের শুক্রাণুর সাথে আরেকটি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরন করে স্ত্রী মাছির শরীরে, যা তাদেরকে অন্য কোনো পুরুষ মাছির সাথে মিলনে অনুৎসাহিত করে। দুভার্গ্যজনকভাবে এই পদার্থটি স্ত্রী মাছির জন্য বিষাক্ত। এর প্রত্যুত্তরে স্ত্রী মাছিরা এই রাসায়নিক পদার্থের বিরুদ্ধে বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর আবার পুরুষ মাছিরাও পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়েছে সেই প্রতিরোধকে নিষ্ক্রিয় করতে। গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা এমন অনেক তথাকথিত যৌন দ্বন্দ বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং কত দ্রুত বিভিন্ন জিন পরিবর্তিত হয় তা পরিমাপ করে তারা এর সুষ্পষ্ট মিলিয়ন বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়ায়। দ্রুত বিবর্তিত জিনগুলোর মধ্যে কয়েকটি অনেক প্রজাতিরই (মানুষ সহ) শুক্ররসের প্রোটিন তৈরী করে।
তালা ও চাবির সহবিবর্তন
ডারউইন তার সবচেয়ে সাহসী ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন, যখন তিনি মাদাগাস্কারের অ্যানগ্রেকাম সেসকিপেডালী (কমেট / মাদাগাস্কার স্টার অর্কিড) নামের একটা অদ্ভুত অর্কিডের কথা শোনেন। এই অর্কিডটি তার ফুলের পেছনে একটা লম্বা স্পার বা মধুথলি তৈরী করে যার দৈর্ঘ্য এক ফুটেরও বেশী (২০-৩৫ সেমি) (ল্যাটিন ভাষায় সেসকিপেডাল মানে দেড় ফুট), এই স্পারের একেবারে তলদেশে এটি নেক্টার বা ফুলের মধু তৈরী করে। ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে ফুলের অতিআড়ম্বরপুর্ণ রং কিংবা আকার বিবর্তিত হয়েছে মানুষের সন্তুষ্টির জন্য না বরং পরাগায়নের জন্য পতঙ্গদের আকর্ষণ এবং তাদের নিজেদের সফল বংশবিস্তারের কৌশল হিসাবে। একটি পরিচিত কৌশল যা ডারউইন শনাক্ত করেছিলেন, তা হলো ফুলের মধু খাওয়ার সময় পতঙ্গের পায়ে ফুলের আঠালো রেণু লাগিয়ে দেয়া। সুতরাং ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন, মাদাগাস্কারের জঙ্গলে কোথাও না কোথাও কোনো এমন কোনো পতঙ্গ বাস করে যার জিহবা যথেষ্ট পরিমান দীর্ঘ অ্যানগ্রেকাম সেসকিপেডালী’ এর লুকোনো মধু পান করার জন্য। যখনই এই রহস্যময় পতঙ্গটি তার দীর্ঘ জিহবা প্রবেশ করে ফুলের গায়ে চেপে বসে মধু পান করে, ফুলের রেণু তখন তার শরীরে মেখে যায়, যা ফুলটি পরাগায়নে সহায়তা করে। তার মৃত্যুর একুশ বছর পর তার ভবিষ্যদ্বানী সফল হয়, যখন মাদাকাস্কারের জঙ্গলে বিজ্ঞানীরা খুজে পান দীর্ঘ জিহবার সেই পতঙ্গ, জ্যানথোপ্যান মরগানী প্রেডিক্টা নামের একটি মথকে (ছবি), একমাত্র এই মথটি পারে এই অর্কিডের পরাগায়ন করতে।
তারপর থেকে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে এরকম অনেক চুড়ান্ত মানানসই সহবিবর্তনের নজির আবিষ্কার করেছেন। যদি তাদের অনেকগুলোই অর্কিড আর তার দীর্ঘ জিহবার পরাগায়নকারীর মত সৌহার্দ্যপূর্ন না। পশ্চিম উত্তর আমেরিকার রাফ স্কিন্ড বা অমসৃন চামড়ার নিউট তাদের চামড়ায় এমন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরী করে যা একদল মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। বিষাক্ত পদার্থটি কাজ করে স্নায়ু কোষের একটি নির্দিষ্ট রিসেপটরে সংযুক্ত হয়ে কোষটিকে নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে। নিউটদের এই অতি বিষাক্ততার কারণ তার শত্রু, ‘গার্টার সাপ’, এর প্রত্যুত্তরে গার্টার সাপ আবার এর বিরুদ্ধে তৈরী করেছে এক ভিন্ন ধরনের রিসেপটর, যেখানে বিষাক্ত পদার্থটি সংযুক্ত হতে পারে না, ফলাফলে নির্বিচারে রাফ স্কিন্ড নিউট খেতে গার্টার সাপের কোনো সমস্যাই হয়না।

(ছবি: রাফ স্কিন্ড নিউট, গার্টার সাপের সাথে একটা দীর্ঘমেয়াদী বিবর্তনীয় অস্ত্রযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ফলাফলে তাদের চামড়া হয়ে গেছে ভয়ানক বিষাক্ত)
গত দশকে এধরনের সামনে আগানো আর পেছনে ফেরার বিবর্তন যা সহবিবর্তন নামে পরিচিত বিজ্ঞানীদের বিশেষ নজর কেড়েছে। যেমন বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই একটা ধাঁধার মধ্যে ছিলেন ঠিক কেমন করে দুটি পৃথক প্রজাতির মধ্যে একটি ঘনিষ্ট মিথোজীবি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেমন ডারউইনের মথ আর অর্কিড। ২০০৫ সালে সান্টা ক্রজের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন থমসন এর উৎপত্তির কারণ হিসাবে একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, তিনি এর নাম দেন সহবিবর্তনের জিওগ্রাফিক মোজাইক মডেল। থমসন প্রস্তাব করেন যে, কোনো কোনো জায়গায়, দুটি প্রজাতি একে অপরের বিবর্তনকে প্রভাবিত করে চরম অভিযোজনের লক্ষ্যে, আবার কোনো কোনো জায়গায় তাদের বিবর্তনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক প্রভাব নগন্য বা একেবারে নাই বললেই চলে। আবার একই সঙ্গে, এক জনগোষ্ঠী থেকে অন্য জনগোষ্ঠীতে তাদের সহবিবর্তিত জিন নিয়ে সরে যায় প্রজাতির সদস্যরা। শুধুমাত্র একে অন্যের অনুগামী হয়ে বিবর্তিত না হয়ে বরং সহবিবর্তনের সঙ্গী প্রজাতিগুলো আসলে আরো জটিল পদ্ধতির মাধ্যমে বিবর্তিত হয়, যাকে থমসন বলছেন জিওগ্রাফিক মোজাইক।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপারটা হলো থমসনের এই মডেলটিকে পরীক্ষা এবং এর স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের করার জন্য বিজ্ঞানীদের খুব একটা বেশী সময় লাগেনি। তাদের কেউ এই মডেল পর্যবেক্ষণ করলেন পাইন গাছ আর পাখিদের মধ্যে, যারা তার বীজ বিস্তারে সহায়তা করে, অন্যরা, ব্যাক্টেরিয়া আর তাদের সংক্রমনকারী ভাইরাসদের মধ্যে, আবার কেউ অমসৃন-চামড়ার নিউট এবং তাদের শিকারী গার্টার সাপের মধ্যে গবেষণা করে। এবং তারা আবিষ্কার করলেন সহবিবর্তনের হটস্পট আর কোল্ডস্পটের একটা জটিল দৃশ্য। বিবর্তনের ক্ষেত্রে এধরনের অর্ন্তদৃষ্টি খুবই গুরুত্বপুর্ণ বিশেষ করে আমাদের মানবজাতির কল্যানের জন্য। আমাদের অনেক উপকারী কাজের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট পরিবেশের উপর নির্ভরশীল এবং অনেকক্ষেত্রে প্রকৃতি থেকে নেয়া সেই সব উপযোগী সেবাগুলো সম্ভবপর হয় সহবিবর্তনের কল্যাণে। যেমন আমরা নির্ভর করি এমন অনেক উদ্ভিদ যারা আমাদের খাদ্য বা নির্মাণ সামগ্রীর যোগান দেয়, তারা সহবিবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাকের সাথে, যারা তাদের সাহায্য করে মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করতে। উপরন্তু তারা প্রজননের জন্য তারা নির্ভর করে পরাগায়নকারী নানা প্রজাতির প্রাণীর উপর। আমরা নিজেরাও সহবিবর্তিত হয়েছি অসংখ্য উপকারী আর অপকারী অনুজীবদের সঙ্গে (বিবর্তনীয় চিকিৎসা দ্রষ্টব্য)।
মহাবিলুপ্তির পদচিহ্ন
দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত দশকে এটা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য যে মাত্রায় বিপদাপন্ন তা গত মিলিয়ন বছরেও দেখা যায়নি। বনভূমি হয়েছে শূন্য, সাগরের পানিতে বৃদ্ধি পেয়েছে অম্লতার পরিমান, বিস্তার পাচ্ছে নানা রোগব্যাধি, তাপমাত্রা বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের, আর এসব কিছুই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে অনেক প্রজাতির অস্তিত্ত্ব। যদিও এই বিলুপ্তিটির প্রাদুর্ভাব নতুন, কিন্ত পৃথিবী জীবনের উৎপত্তির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত্য অনেকগুলো মহাবিলুপ্তির ঘটনার স্বাক্ষ্য বহন করে আসছে, যার প্রতিটি ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে অগনিত প্রজাতি। মহাবিলুপ্তির ঘটনা নিয়ে করা গবেষনায় প্রমাণ হয়েছে, প্রজাতির বিবর্তন প্রক্রিয়ার উপর এসব মহাবিলুপ্তির ঘটনার প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। বিলুপ্তি ঘটনা সমস্ত প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নতুন করে সংগঠিত করে, সুযোগ করে দেয় জীবিত প্রজাতিদের বিলুপ্ত প্রজাতির শূন্যস্থান দখল করে নিতে।

(ছবি: আনুমানিক তিন বিলিয়ন বছর আগে জীবনের উৎপত্তি থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত্ আমাদের পৃথিবীতে এ পর্যন্ত্ ৫টি মহাবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন বর্তমানে ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তি চলছে, যার কারণ আমরা মানুষরা।)
বিশেষ করে আগ্নেয়গিরি, এসব বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ, পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলেছে তাপমাত্রা শোষনকারী গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে, এছাড়া সমদ্রের রাসায়নিক বৈশিষ্টে নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ আগ্নেয় গিরির অগ্ন্যুৎপাত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এধরনের ঘটনা সূচনা করে পরিবেশ বিপর্যয়।
মহাবিলুপ্তির মত কোনো বিপর্যয় সামলে উঠতে পৃথিবীর লেগে যায় অনেক মিলিয়ন বছর এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়না। অনেক ধরনের প্রজাতি যারা পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল সম্পুর্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এধরনের মহাবিপর্যয়ে। পৃথিবীর পরিবেশ বা ইকোসিস্টেমে ইতিমধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা -বিশেষকরে সমুদ্রে -যা ইঙ্গিত করে আমরা বর্তমানে আরেকটি পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। যেভাবে ‘প্রবাল রীফ’ ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে আর সমুদ্র থেকে জোর করে তোলা হচ্ছে মাছ, ফলাফলে, কম পরিচিত প্রজাতি যেমন জেলী ফিস অথবা এমনকি সালফার নিঃসরণ করা ব্যাকটেরিয়া সমুদ্রে প্রাধান্য বিস্তার করার সম্ভাবনা আছে।
জীবন বৃক্ষ এবং জাল
বর্তমানে আমরা বাস করছি জেনোমের যুগে। বিজ্ঞানীর অভূতপূর্ব সুযোগ পেয়েছেন পর্যবেক্ষণ করার, কেমন করে সাধারণ আদি পূর্বপুরুষ থেকে প্রজাতির উৎপত্তি হয়েছে। এর কারণ সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে তাদের আবির্ভাব লিপিবদ্ধ আছে তাদের ডিএনএ তে। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিস্তারিত হয়। সুপার-কম্পিউটার এবং উন্নত পরিসংখ্যানীয় মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে ডিএনএ বিশ্লেষন করার ফলে বিজ্ঞানীরা প্রজাতিদের মধ্যে আন্তসম্পর্কের স্বরুপ সংক্রান্ত পুরোনো হাইপোথেসিসগুলো পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছেন। ইতিমধ্যেই তারা সক্ষম হয়েছেন কিছু পুরোনো প্রশ্নের সমাধানে যা আমাদের আগের প্রজন্মের পক্ষে কাছে সমাধান করা ছিল প্রায় অসম্ভব । প্রত্নতত্ত্ববিদরা বহুদিন ধরেই বিতর্ক করছেন, যেমন, বিবর্তনের দিক থেকে আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী সম্পর্কযুক্ত জীবিত জলজ প্রাণী হলো লাংফিস আর সিলোকান্থ, যে উপসংহারটি সত্যতা জিনতত্ত্ববিদরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে। আমাদের প্রাইমেট জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শিম্পান্জ্ঞী আর বনোবোসকে শনাক্ত করা হয়েছে আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী জীবিত আত্মীয় হিসাবে।

(ছবি: জীবন বৃক্ষ যা আঁকা হয়েছে ‍ডিএনএ গবেষণা মাধ্যমে, যার দৈর্ঘ্য ইঙ্গিত করছে মিউটেশনের সংখ্যা। লক্ষ্য করুন প্রাণিরা কত ক্ষুদ্র অংশ দখল করে আছে পৃথিবীর সকল জীবের জিন বৈচিত্রের।)
যদিও ডিএনএ কোনো যাদুর কাঠি না যা মুহুর্তের মধ্যে আমাদের সব প্রশ্নের সমাধান দেবে। জীবনের বিবর্তনের কোনো একটা পর্যায়ে, অনেকগুলো বংশধারা বিবর্তিত হয়েছে অপেক্ষাকৃতভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। অনেক প্রধান প্রধান গোত্রের প্রাণি যা বর্তমানে জীবিত আছে তারা মোটামুটি ৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে, প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীতে জীবনে’র ইতিহাসে এই সময়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া বেশ কঠিন, যেমন টেলিস্কোপ দিয়ে দুর দ্বীপে দাড়ানো কোনো মানুষের চেহারা সহজে বোঝা যায়না।
একই সঙ্গে ডিএনএ জীবনের ইতিহাসে নতুন রুপ উন্মোচন করছে। ডারউইনই প্রথম ভেবেছিলেন বিবর্তন একটা গাছের মতন, নতুন প্রজাতির জন্ম হয় যেমন গাছের নতুন শাখার জন্ম হয় পুরাতন শাখা থেকে। বর্তমানেও এই রুপক অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে এখনও শক্তিশালী। প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে শিম্পান্জ্ঞী আর বনোবো, এই দুটি শাখা তাদের মুলে সংযুক্ত ছিল একটি আদি সাধারণ বা কমন পূর্বপুরুষের মাধ্যমে। এদের বংশধারা থেকে আমাদের শাখা বিছিন্ন হয়েছিল আরো আগে, প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর আগে। আরো বৃহৎ ক্ষেত্রে উদ্ভিদের সাথে প্রাণি কিংবা ছত্রাক যে সম্পর্ক রাখে তা অপেক্ষা তারা নিজেরাই আরো বেশী সম্পর্কযুক্ত।
কিন্তু জিন সবসময়ই প্রজাতির সীমানা গ্রাহ্য করে না। এটি বেশী প্রযোজ্য ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অনুজীবের ক্ষেত্রে, যেখানে জিন এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে অনায়াসে যাতায়াত করে। এককোষী প্রাণীদের বিবর্তন বোঝার জন্য, বিজ্ঞানীরা কোনো একটি নির্দিষ্ট জীনের প্রতি বেশী করে নজর দিচ্ছেন, সময়ের সাথে এবং প্রজাতিদের মধ্যে এসব জীনের যাত্রাকে অনুসরন করার উদ্দেশ্যে। তাদের যাত্রাপথ অনেকটাই জালের মত। আর যেহেতু সকল জীবনের গঠন, তার উৎপত্তির প্রথম ২ বিলিয়ন বছর ইতিহাসে প্রায় সম্পুর্নটাই এককোষী ছিলো, আমরা অবশ্যই আমাদের জীববিজ্ঞানীয় ইতিহাসের শুরুর অধ্যায় গাছের মতন না দেখে, বরং দেখতে হবে একটা ট্যাপেষ্ট্রী হিসাবে।
মানুষের রেসিপি
গত দশকে বিজ্ঞানীরা শুধু মানুষের জিনোমের অনুক্রমই সমাপ্ত করেনি, সম্পন্ন করা হয়েছে বা শিম্পান্জ্ঞি, বানর সহ অনেক প্রাণি ও উদ্ভিদের জিনোমের অনুক্রম। সুতরাং বিজ্ঞানীরা এখন জিনের এই আর্কাইভে চীরুনী অনুসন্ধান করতে সক্ষম, এবং তারা ইতিমধ্যে শুরু করেছেন কেমন করে আমাদের পূর্বপুরুষদের জিনোম পরিবর্তিত হয়েছে, যখন তারা প্রাইমেট থেকে ভিন্ন বংশধারায় বিবর্তিত হতে শুরু করেছিল। কাজটা শুরু হয়েছে প্রথমত ক্যাটালগের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা গণনা করেছেন সেই সব জিনগুলো যা দুর্ঘটনাবশত অনুরুপ সদৃশ প্রতিলিপি হিসাবে মানুষের বংশধারায় বিস্তার করেছে, অর্থাৎ প্রাইমেটদের জিনোমের তুলনায় আমাদের জিনোমে যে জিনগুলোর বর্তমানে একাধিক অনুলিপি বিদ্যমান। তারা আরো শনাক্ত করেছেন সেইসব জিনগুলোকে যা পরিবর্তিত হয়েছে ‘সিউডোজিনে’ এবং মানুষের কিছু জিন যার শুরু প্রাইমেটদের জেনোমে ননকোডিং অংশ হিসাবে। সম্প্রতি ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের স্মারফিট জেনেটিক ইন্সস্টিটিউটে আওয়াফ ম্যাকলিসট এবং তার সহযোগী ডেভিড নোলস খুজে পেয়েছেন তিনটি প্রোটিন যা মানুষ তৈরী করে কিন্তু আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয় শিম্পান্জ্ঞীর মধ্যে যা অনুপস্থিত। ম্যাকলিসট এর পর এই তিনটি প্রোটিনকে কোড করা জিনকে খুজে বের করেন যা প্রায় হুবুহু শিম্পান্জ্ঞীর জেনোমের ননকোডিং ডিএনএ অনুক্রমের কিছু অংশের সাথে মিলে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোনো মিউটেশনই এই ননকোডিং ডিএনএ অংশকে প্রোটিন তৈরীতে সক্ষম সক্রিয় জিনে রুপান্তরিত করেছে।

(ছবি: মানুষের ফাইলোজেনি)
আমাদের জিনোম আরো অন্যভাবেও অনেক স্বতন্ত্র, যদিও খুব সূক্ষ্ম, তাসত্ত্বেও এই স্বতন্ত্রতা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আমাদের প্রোটিন তৈরীর প্রায় সকল জিন আর শিম্পান্জ্ঞীদের অনুরুপ জিনের কোনো পার্থক্য নেই (আমাদের পুরো জিনোমের সাথে শিম্পান্জ্ঞীদের জিনোমের পার্থক্য মাত্র আনুমানিক শতকরা ১.৩ ভাগের কাছাকাছি), কিছু ক্ষেত্রে তাদের মূল ডিএনএ বেসের অনুক্রমের মথ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য। অনেক ক্ষেত্রেই এই পার্থক্য জৈববৈজ্ঞানিক দিক থেকে অর্থহীন। জিনের দুটি সংস্করণকে সংকেত করা প্রোটিন সমানভাবেই কার্য্যকরী দুই প্রজাতির ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন তার কাজ করে যায়। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছেন জিনের একটা লম্বা তালিকা যেখানে তারা সুষ্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনো মিউটেশনগুলো তাদের প্রজনন সাফল্যকে তরান্বিত করেছে। প্রাইমেট থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন থেকে পৃথক শাখায় বিবর্তিত হতে শুরু করেছিল তখন থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচন তার চিহ্ন রেখে গেছে ননকোডিং ডিএনএ অংশেও।
অবশ্যই আমরা কোনো স্বতন্ত্র জিন উপাদানের কোনো ক্যাটালগের চেয়ে বেশী, বিজ্ঞানীরা ইদানীং কেবল খুজে শুরু করেছেন আমাদের প্রজাতির জন্য অনন্য ডিএনএর অংশগুলোর অর্থ বুঝতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অনন্য অংশগুলো বিবর্তিত হয়েছে বিশেষ ধরনের ভাইরাস বা রোগজীবানু যা আমাদের মুখোমুখি হয়েছে। এই সব পার্থক্যগুলোই প্রকাশিত হয় যখন আমরা বিবর্তনের মাধ্যমে অর্জন করি মানব প্রজাতির সফলতার গোপন সুত্র: আমাদের প্রতিদ্বন্দীহীন মানসিক বহুমুখিতা। বিজ্ঞানীরা ভাষা এবং মানুষের অনন্য কিছু আচার, যা গত কয়েক মিলিয়ন বছরে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে সেই সব জিনগুলো শনাক্ত করতে শুরু করেছেন। আজ অরিজিন অব স্পেসিস প্রকাশের প্রায় ১৫০ বছর পর আমরা আমাদের নিজেদের বিবর্তনকে কেবল বুঝতে শুরু করেছি।
বিবর্তন চিকিৎসাবিজ্ঞান
১৯৯৬ সালে, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ‍র‌্যানডোলফ নেসে এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞানী জর্জ উইলিয়ামস, ‘হোয়াই উই গেট সিক’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তারা যুক্তি দেন স্বাস্থ্য আর অসুস্থ্যতাকে সামগ্রিক অর্থে বুঝতে হলে, বিজ্ঞানীদের অবশ্যই আমাদের বিবর্তনীয় ঐতিহ্যটাকে বুঝতে হবে। তাদের এই বইটি বেশ কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছে একটি নতুন অনুসন্ধানী ক্ষেত্রের সূচনা করতে, যার নাম বিবর্তন চিকিৎসাবিজ্ঞান।
এক অর্থে বলতে গেলে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে অনেকদিন ধরেই গবেষণা করে আসছেন। যেমন, ১৯৫০ এর শেষের দিকে জর্জ উইলিয়ামস প্রথম ভাবতে শুরু করেছিলেন, কেন আমরা বা অন্য প্রাণীরা বৃদ্ধ হই। তিনি যুক্তি দেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন জীবনের শুরুর দিকে প্রজনন ও বংশবিস্তার সংক্রান্ত অভিযোজনগুলোকে নির্বাচন করে, যদিও পরবর্তীতে এই অভিযোজনগুলোর প্রভাব অনেক সময়ই ক্ষতিকর । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা জোট বেধেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাথে এই সব ধারণাগুলোর ব্যপক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে। বয়োবৃদ্ধির এবং বার্ধক্যে নিয়ে উপর আণবিক জীববিজ্ঞানের অনেক সাম্প্রতিক গবেষণাই উইলিয়ামসের মৌলিক ধারণার সত্যতা প্রমাণ করেছে। বয়োবৃদ্ধি এবং বার্ধক্য যে উচ্ছল এবং প্রাণচঞ্চল তারুণ্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সেটা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা বর্তমানে গবেষকদের সাহায্য করছে নতুন কোনো পথ খুজে বের করান জন্য যা বার্ধক্যের মূল প্রক্রিয়াকে মন্থর করবে।

(ছবি: ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তার নিরন্তর বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের বাধ্য করে প্রতি বছর নতুন ধরনের ফ্লু-ভাইরাস স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক তৈরী করতে। ছবিতে এইচ১এন১ (H1N1) সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস যা ২০০৯ এর প্যানডেমিকের কারণ।)
বিবর্তন প্রক্রিয়া ভাইরাস এবং অন্যান্য রোগজীবানুকে আরো বেশী শক্তিশালী করে তোলে, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি, এমনকি এমন একটা যুগেও, যখন তাদের জেনোমের ডিএনএ’র অনুক্রম আমাদের নোখদর্পনে । এর কারণ আসলে তাদের ডিএনএ একধরনের চলমান নিশানা, স্বতত পরিবর্তনশীল এবং কিভাবে আমাদেরকে তাদের পোষক আর রোগব্যাধির প্রজনন ক্ষেত্রে রুপান্তরিত করবে, সেই অতি পুরোনো প্রশ্নের সমাধান খুজে বের করার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। কিন্ত আমাদের আণুবীক্ষণীক শত্রুদের বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা কিন্তু তাদের দূর্বলতাগুলোকেও উন্মোচিত করে -সেই সব পথগুলোকে আমরা জানতে পারি কিভাবে এবং কখন তারা সঠিকভাবে বিবর্তিত হয়না। এই দুর্বল জায়গাগুলোই ক্রমান্বয়ে প্রতিরোধ আর চিকিৎসার নতুন নিশানা হয়ে উঠছে। আমরা তাদের বিবর্তনকে থামাতে হয়তো পারবো না, কিন্ত অন্ততপক্ষে আমরা শিখতে পারবো, কেমন করে তা আমাদের পক্ষে কাজে লাগানো যায়।


    
    
 



    

     
      

মন্তব্যসমূহ