লেখক ও গবেষক মজিদ মাহমুদের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের উপর একটি লেখা এবং সঙ্গে পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কিছু জবাব সহ একটি সুন্দর উপস্থাপনা :


 
   

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন : একটি তর্কিত উপস্থাপনা

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন : একটি তর্কিত উপস্থাপনা
চর্যাপদের পরে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ই বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আদি নিদর্শন। এই কাব্য রচনার সঠিক দিনক্ষণ জানা না গেলেও ধরে নেয়া হয়, পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে এটি রচিত হয়েছিল। যদিও এই গ্রন্থের অস্তিত্ব আমরা জানতে পেরেছি বিশ শতকের গোড়ার দিকে। বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ নামে বাংলা সাহিত্যের এক গবেষক বাঁকুড়া জেলার এক কৃষকের গোয়াল ঘর থেকে এই পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করেছিলেন। এটির আগে-পিছের কয়েকটি পৃষ্ঠা না-থাকায় লেখকের নাম-ধাম ও প্রকাশের তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না; তবে ভেতরের তখল্লুস দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, বড়ু চণ্ডীদাস নামের একজন কবি এই কাব্য রচনা করেছিলেন; তবে কাব্যমধ্যে আরো কিছু তখল্লুস থাকায় লেখকের নাম ‘বড়ু’ ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে বলে সাহিত্যের অধ্যাপকগণ মনে করেন। আর পাণ্ডুলিপির ভাষা, লিপি, কাগজ ও কালির জাত পরীক্ষা করে এর প্রাচীনতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটি বাংলা সাহিত্যের এক অমরগ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। একই সঙ্গে ভক্ত ও ভোগী এই কাব্যের সমঝদার। হিন্দুর পরম পূজনীয় ভগবান ‘শ্রীকৃষ্ণ’ স্বয়ং এই কাব্যের নায়ক পদে অধিষ্ঠিত; তার বিপরীতে রয়েছে ‘রাধা’ নাম্নী এক অবলা বালিকা; আর এই দুই চরিত্রের মাঝখানে সেতুবন্ধন হিসাবে ‘বড়ায়ি’ নামের এক ধাত্রীর অবস্থান। মাত্র তিনটি চরিত্রের সক্রিয় উপস্থিতি হলেও এর অন্তঃপ্রবাহে রয়েছে এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা। অসংখ্য গাভি, ষোল শো গোপিনী, মা যশোধা, হাট, বন ও নদী পারাপারের দৃশ্যের অংশগ্রহণমূলক উপস্থিতি ছাড়াও একটি সময়ের সরব জনপদ বুঝে নিতে এতে কষ্ট হয় না।
কাব্যটির বিরুদ্ধে একটি প্রধান অভিযোগ তার অশ্লীলতা নিয়ে। একই সঙ্গে আধুনিক বৈষ্ণব ভক্তের মনে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, তা হলো, উপাস্য ও উপাস্যের পবিত্রতা কি এই কাব্যে রক্ষিত হয়েছে? হিন্দুর পরম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার প্রেম-প্রণয়ী রাধার সঙ্গে যে বৈধ-অবৈধ আচরণে লিপ্ত হয়েছেন তা মানবিক বিবেচনায় ইতরতামুক্ত নয়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যদেব রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে যে ভক্তিবাদের প্রচার করেছিলেন; জীবাত্মা ও পরমাত্মার মহামিলনের প্রতীকায়নে তিনি এই দুটি চরিত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন; তা কিভাবে নারী-পুরুষের সম্ভোগের সীমাবদ্ধতায় বন্দি থাকতে পারে।
তের খণ্ডে বিস্তৃত এই কাব্যটি সম্পূর্ণ গান বা খণ্ড কবিতাকারে লিখিত হয়েছে। তখন বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার প্রবর্তন না হলেও বিচ্ছিন্নাকারে এগুলোকে গীতিকবিতা বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়। যদিও সম্পূর্ণ কাব্যের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের অনুপুঙ্খ সমাজ ও প্রেমধর্মের প্রকাশ ঘটেছে, তবু এর প্রতিটি গীতিকায় মানব-মানবীর জান্তব প্রেম-হাহাকারের প্রকাশ ঘটেছে। ঘোষজায়া বালিকা রাধার মন জয় করার জন্য রাখাল বালক শ্রীকৃষ্ণ বড়ায়িকে মাধ্যম করে সব ধরনের সাধনা করেছেন; রাধার মন না পাওয়াতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন; এমনকি ছলে-বলে-কৌশলে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কৃষ্ণের মিলনের তীব্রতার কাছে রাধাকে শেষপর্যন্ত সমর্পিত হতে হয়েছে। কৃষ্ণের এই বন্য-উদ্যাম ভালোবাসার স্রোতে রাধা যখন ভাসতে শুরু করল, তখনই কৃষ্ণের উদাসীনতা, গোপিনী-কামিতা রাধাকে বিবাগি করে তুলছে। কৃষ্ণদর্শনের জন্য তিনি জগতের সকল কালো বস্তুকে দয়িতের প্রতিমূর্তি হিসাবে বিবেচনা করে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। তার আহার-বিহার, জীবন-মরণ কৃষ্ণময় হয়ে গেছে। এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে পরবর্তী প্রায় চারশত বছর ধরে রাধা নাম্নী এই নারীর দুঃখের গাথা রচিত হয়ে আসছে; যার দৃষ্টান্ত বিশ্ব-সাহিত্যে আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে রাধাই একমাত্র নারী চরিত্র, যার কোনো লিঙ্গভেদ নাই; যে কোনো প্রেমিক পুরুষের হৃদয় রাধাদশা প্রাপ্ত হতে বাধা থাকে না।


তাহলে কি এই প্রশ্নের তাৎপর্য থাকে যে, বৈষ্ণবের ধর্মীয় সঙ্গীত হওয়ার জন্য এই কাহিনির অশ্লীলতা অন্তরায় কিনা? আমার তো মনে হয়, না; কারণ ইউরোপীয় শ্লীলতা শরীরে মোড়ানো থাকলেও গোপনে থাকে অশ্লীলতার ধারা। ঈশ্বরের কাছে কামনা গোপন রেখে কিভাবে ক্ষুদ্র মানুষ তার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। আমার মনে হয়, এই কাব্যগ্রন্থটির প্রতি সাহিত্যের অধ্যাপকগণ বরাবর অবিচার করেছেন; কারণ এ কথা কেউই বলতে পারেন নি, যে-সময়ে ইংরেজি সাহিত্যে রোমিও-জুলিয়েট লেখা হচ্ছে, সে সময়কার বাংলা সাহিত্যে রচিত আরেকটি কাব্যগ্রন্থ নানা দ্যোতানায় আরো গভীরভাবে মানবিক প্রেম-উপাখ্যান বর্ণনা করছে; যা প্রতিটি প্রেমিক হৃদয়ের প্রেম-প্রকাশের উপায় হিসাবে বর্ণিত হচ্ছে। প্রায় পাঁচশত বছর ধরে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়-যাতনা বোঝাতে রাধা-কৃষ্ণের মিথ এমন একটি দৃষ্টান্ত রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার বিকল্প অন্য কোনো সাহিত্যে নাই। রাধার চেয়ে গভীর গৌরবময় বিরহের প্রকাশ, এই ভবে আর কি কখনো হবে!
আজ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শুধু বড়–চন্ডীদাস রচিত একটি গ্রন্থ নয়; মধ্যযুগ হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল কবির প্রেম-বিরহের প্রকাশ রাধার কষ্টকে স্পর্শ করেছে; এবং সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে রাধাই একমাত্র নারী চরিত্র, যার কোনো লিঙ্গভেদ নাই; যে কোনো প্রেমিক পুরুষের হৃদয় রাধাদশা প্রাপ্ত হতে বাধা থাকে না। এই কাব্যের শুরুতে কৃষ্ণের মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা না থাকলে রাধার বিরহের মানবিক তাৎপর্য থাকত না। আর মানবিক তাৎপর্য না থাকলে উপাস্যের ফুল শুকিয়ে যেতে কতক্ষণ!
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিয়ে আমার একটি প্রস্তাবনা, আজকের কোনো কবি যদি এটি আধুনিক বাংলায় রূপান্তর করেন তাহলে পাঠকগণ সবিশেষ উপকৃত হবেন।

দুই. (প্রতিক্রিয়া)
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আর বৈষ্ণব-পদাবলির বৈপরীত্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডায়াগোনালি অপোজিট’, ঠিক সেরকম। আধুনিক কবিদের কেউ যদি ওই কাব্যটির বাংলা তর্জমা করেন, সেক্ষেত্রেও তার (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের) রগরগে যৌনতা আর তাতে আয়ান ঘোষের বালিকাবধূ রাধার  প্রতি শ্রীকৃষ্ণের তীব্র কাম-লালসাজনিত অনাচার কিভাবে আড়াল করবেন সেটা আমার মতো ক্ষুদ্র-বুদ্ধির মানুষের পক্ষে বোঝা সত্যি সম্ভব নয়। কেননা, নানান রকম ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাধাকে ভোগ করবার পর রাধার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের ঔদাসীন্যে আমাদের মনে হয়, রাধাকে সে কখনোই আত্যন্তিক ভালবাসার দরুন আকাঙ্ক্ষা করে নি, বালিকা রাধাকে কেবলই তীব্র কামাবেগজনিত বিহ্ববলতার দরুন এবং সে তীব্র কামাবেগ চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছে। সেই তীব্র কামাকাঙ্ক্ষা মিটে যাবার পর রাধাকে সে ছেঁড়া কাগজের মতো ছুড়ে ফেলেছে, মানে, রাধাকে সে কূলটা করে ছেড়ে দিয়েছে। রাধা তখন সমাজের চোখে কেবলই এক ভ্রষ্ট-নারী । কিন্তু ততদিনে আবার বালিকা রাধা স্বাভাবিক কাম-সুনিপুণা যুবতীও বটে; জীবধর্মের চিরায়ত আবেগে শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল; অথচ তখন আর শ্রীকৃষ্ণের রাধার প্রতি তিলমাত্র আবেগও অবশিষ্ট নেই। একদিকে রাধা ভ্রষ্ট-নারী, অপরদিকে কামতৃষ্ণায় জর্জরিত যুবতী। শ্রীকৃষ্ণ এভাবে রাধাকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে কলঙ্কময় ও কামজর্জর অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এমন অনাচার সমাজে আকসার দেখা যায় এখনও। কিন্তু রোমিও-জুলিয়েট দুজনই দুজনকে সমান আবেগে আকাঙ্ক্ষা করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কি ব্যাপারটা হুবহু সেরকম ? সুতরাং ওই দু’রচনার প্রতিতুলনাও বোঝা ভার।

তিন. (জবাব)
আপনার মন্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক, এ কাব্যগ্রন্থের বিষয়ানুগ; তবে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসকোর্সে আবদ্ধ। আমি রোমিও-জুলিয়েটের কথা বলেছি কেবল সময়কে বোঝাবার জন্য যে আমাদের সাহিত্যেও তখন কালজয়ী কাজ হচ্ছে। এটি খুব পুরনো কথা যে, মানব-সভ্যতা স্থান- ও কাল-নিরপেক্ষ নয়, এবং আমাদের চেতনার অধিক্ষেপ সর্বদা বিবর্তিত আচরণের ফল। এমনকি নারী পুরুষের সম্পর্ক, বিয়ে ও যৌনতার ইতিহাসও অপরিবর্তনীয় নয়। আমাদের আজকের রুচি দ্বারা নারীর প্রতি সহিংসতা আমরা পরিমাপ করতে পারব না। কেবল মানুষের সংগঠনযুগে রচিত সকল মহাকাব্যের নায়িকা নয়, ইতিহাসের যে-সব নারী স্মরণীয় হয়ে আছেন তারাও পুরুষের ইচ্ছের নির্মিতি। বাল্য-বিবাহ, স্বামীর সঙ্গে সহমরণ, যুদ্ধলব্ধা, গান্ধর্ব বিয়ে, অন্যের স্ত্রীকে অধিকারে আনা, নিজ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা—এসবই নারী-পুরুষের সম্পর্কের ইতিহাস হিশাবে আছে। আজকের বিচারে আমরা রবীন্দ্রনাথকেও নাবালিকা বিয়ের জন্য, নিজের অপ্রাপ্ত-বয়স্ক কন্যাদের বিয়ে, বৈধ-অবৈধ প্রেম; এমনকি ভ্রাতৃবধূসহ জানা-অজানা অসংখ্য আত্মাহূতির ঘটনা নিয়ে দূষতে পারি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি বিষয় আমরা মনে রাখতে পারি, ওই সমাজে এ ধরনের সম্পর্ক অস্বীকৃত হলে তৎকালীন সময়ের একজন শক্তিমান কবি বিষয়টির প্রতি এত গুরুত্ব দিতেন না। তাছাড়া এ ধরনের সম্পর্কের জন্য কাব্যগ্রন্থটি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং কাব্যটির রয়েছে একটি অভিযোজিত হওয়ার ক্ষমতা—যা কালের রুচি অনুযায়ী পরিমার্জিত হয়ে সবকালের রসগ্রাহী মনে পরিতৃপ্তি দান করেছে। এমনকি আমি আগেও বলেছি, রাধার আকুতি চূড়ান্ত বিচারে লিঙ্গভেদ অতিক্রম করতে পেরেছে; রাধার প্রতি অবিচারের তীব্রতার ফলেই হয়তো তার ক্রন্দন সবকালের বিরহ-তাপিত হৃদয়ের হাহাকার হিশাবে বিবেচিত হয়েছে। কাব্যটি যদি অশ্লীলতার উপাখ্যান হিসাবে হাজির হতো তাহলে শ্রীচৈতন্যদেব এই কাব্যকে অবলম্বন করতে পারতেন না। এই কাহিনির হয়তো একটি তীব্র আবেদন তৎকালীন সময়ের মধ্যে ছিল, যার ভাষিক ও পারিভাষিক আশ্রয় নিয়ে তিনি শ্রেণি-বিভাজিত সমাজে  প্রেমধর্ম প্রচার করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তবে বড়ু চণ্ডীদাসই এই কাব্যের উদ্গাতা নন, আগে-পরের অনেক কবি মিলে এই বৃত্ত সম্পন্ন করেছিলেন। নির্যাতিত সীতা, দ্রৌপদী, শকুন্তলা, মমতাজ কিংবা কাদম্বরীর প্রতি অবিচার হয়েছিল বলে আমরা তাদের মহান স্রষ্টাদের যেন আজকের যূপকাঠে প্রাণ-সংহার না করি। আর একটি কথা মনে রাখলে ভালো হয়, প্রেম-প্রস্তাবনা সব-কালেই মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ; এটি কালের ভাষা-বিকাশ ও ব্যবহার-বিধির ওপরে নির্ভরশীল। আমরা যদি ভাষায় ব্যবহৃত শব্দসমূহের বিকাশের পর্যায়ের প্রতি লক্ষ করি তাহলে দেখব নারী-পুরুষের মিলন-সংশ্লিষ্টতাকে কেন্দ্র করে বহু শব্দের উদ্ভব হয়েছে যা পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়ে অন্য অর্থ গ্রহণ করেছে। ফলে একটু পিছনে গেলে দেখা যাবে, প্রেম ও কামের প্রস্তাবনার মধ্যে খুব বেশি তফাত করা যাচ্ছে না।

কিন্তু আপনার মনে দ্বিধা রয়েছে যে, এই কাব্যের স্রষ্টা আসলে সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে যৌনতাকে বেশি ফেরি করেছে কিনা; আপনি সফোক্লিসের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।


আরেকটি প্রশ্ন, পাঁচ শত বছর আগের বাঙালি জীবনে নারী-পুরুষের প্রণয়কাহিনি কেমন হওয়া সম্ভব ছিল। শ্রেণিপাতে ক্লিষ্ট হিন্দুসমাজের রজঃস্বলা হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত বাবা বা দাদার বয়সী কোনো পুরুষের সাথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কনে যৌবনপ্রাপ্তির আগেই স্বামী পটল তুলতে যেতেন; এহেন সমাজে প্রাপ্তবয়স্ক রাখাল বালক কৃষ্ণের সাথে অন্যের স্ত্রী রাধার ভালোবাসা ছাড়া আর কী উপায়ে ভালোবাসা প্রকাশ করা যেত! তাছাড়া এ সময়ের কাব্যে বর্তমান কালের মতো প্রেম প্রকাশের কোনো উদাহরণও নেই।

চার. (প্রতিক্রিয়া)
সফোক্লেসের ইদিপাস নাটকের গল্প আমাদের কালের ভাষায় অজাচার। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যের গল্পও ওই একই শ্রেণিভুক্ত। কিন্তু পূর্বোক্ত ওই রচনাটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। নারীর বিরুদ্ধে নানান অন্যায়-অনাচারের গল্প তাবত বিশ্বের সাহিত্যেই রয়েছে। কিন্তু তার স্রষ্টাদের সেজন্যে নিন্দে-মন্দ করা হয় না, তাদের বরং মহৎ শিল্পী হিসেবে সম্মান করা হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বেলায় অভিযোগ করা হয়, হচ্ছে, হয়েছে তাহলে সঙ্গত কারণেই এই জিজ্ঞাসা দেখা দেবে, কেন? অজাচারের গল্প হলে সেটি অশ্লীল হবার তো কারণ নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ঘটনা একজন কামুক লম্পটের অনাচরের বিশ্বস্ত দলিল। যিনি যথার্থ শিল্পী তিনি ওই ধরনের ঘটনাকে ভিত্তি করে কাব্য-নাটক-গল্প-উপন্যাস রচনা করবেন, তাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু, যিনি ঘটনাটি কাব্য-নাটক কিংবা গল্প-উপন্যাস যে আকারেই আমাদের জানাচ্ছেন, তার উদ্দেশ্যই আমাদের বিবেচ্য; অর্থাৎ তিনি কি শিল্পীর মনোভাব নিয়ে বিষয়টি আমাদের জানাচ্ছেন, নাকি অজাচার ফেরি করছেন অজাচার-প্রবণ কামুক-লম্পটদের মনোরঞ্জনের জন্যে সেটাই প্রশ্ন। এবং এখানেই অজাচারের গল্পটি শিল্প নাকি পর্নো সেটা নির্ধারিত হয়ে যায়। আমার বলার কথাও এটুকুই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা যদি শিল্পী হন, তাহলে, তার রচনাকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করার কারণ আছে বলে মনে হয় না, আর যদি অজাচারের ফেরিওয়ালা হন, তাহলে, চর্যাপদের পরবর্তীকালের রচনা বলেই সাহিত্য হিসেবে তার কদর হতে পারে না।
পাঁচ. (জবাব)
আপনার বর্তমান মন্তব্যের মধ্যেও একটি দ্বিধা রয়েছে। এই দ্বিধার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি। এটা ঠিক, এতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে তা আমি মনে করি না। আমার আর্গুমেন্ট আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে, নিজ ঘরে আমাদের যে রতনের রাজি, তা যেন অবোধ হয়ে পরিত্যাগ না করি। পশ্চিমা সাহিত্যে যৌনতার ছড়াছড়ি সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারণে এগুলোকে আমরা বাস্তবতার নিরিখে গ্রহণ করতে শিখেছি; আবার একই সঙ্গে একই অভিযোগে নিজেদের বস্তুকে খারিজ করে দিচ্ছি।
আপনার মতে, যৌনতার জন্য সাহিত্যের স্রষ্টাকে যেহেতু অন্য ভাষার রচয়িতাদেরও অভিযুক্ত করা হচ্ছে না, সেহেতু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্রষ্টাকে শুধু এই অভিযোগে বলি করা ঠিক হবে না। কিন্তু আপনার মনে দ্বিধা রয়েছে যে, এই কাব্যের স্রষ্টা আসলে সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে যৌনতাকে বেশি ফেরি করেছে কিনা; আপনি সফোক্লিসের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। সফোক্লিস পুত্রকে আপন পিতৃহন্তা এবং গর্ভধারিণীর সঙ্গে বিয়ে ও সন্তান উৎপাদনের সাহিত্য রচনা করেও আপনার দৃৃষ্টিতে (ইউরোপীয় দৃষ্টিতে) মহান স্রষ্টা হিশাবে বিবেচিত হয়ে আসছেন; আপনি বলেছেন, তিনি যৌনতাকে ফেরি করেন নাই। আমি এ-সব ইউরোপীয় সিদ্ধান্ত অপনোদনের কোনো চেষ্টা করব না। তবে আপনি যে ‘অজারচার’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা মূলত অনৈতিক ও অপ্রাকৃতিক যৌনচারের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহার হয়; যেমন মায়ের সঙ্গে পুত্রের, পিতার সঙ্গে কন্যার, ভাই-বোনের কিংবা ইতর প্রাণীর সঙ্গে নিষিদ্ধ সম্পর্ক প্রায় আদিকাল থেকে মানব সমাজে স্বীকৃত হয় নি (বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া); কিন্তু আপনি দেখবেন ইউরোপীয় সাহিত্যে, এমনকি লেখকদের যৌনচারেও আকসার এ-সব ঘটছে।
একটি বিষয় আপনি লক্ষ করবেন, ইউরোপীয় সাহিত্য, চিত্রকলা কিংবা ফিল্মে যে অনিবার্য যৌনতাকে ব্যবহার করা হয়, তা কিন্তু নারী-পুরুষের শরীরের সৌন্দর্যের পাশাপাশি কামকলাগুলোকে উজ্জীবিত করার জন্যও; কেবল শরীরবিদ্যা বর্ণনার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রাচীন গ্রিকে কেবল সফোক্লিস নন, এমন অনেক কবি নাট্যকার ছিলেন, এমনকি দার্শনিকদের অনেকেই বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণের চেয়ে সমলিঙ্গের আকর্ষণের মাহাত্ম্য নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। এমনকি আধুনিক যুগে নভোকভের ‘ললিটা’ উপন্যাসে স্ত্রীর অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার সঙ্গে মিলনের অস্বাভাবিক যৌনচেতনা সত্ত্বেও উন্নত সাহিত্য হিসাবে তাদের কাছে বিবেচিত হয়েছে; লেডিচ্যাটার্লির কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। ইউরোপে কেবল মধ্যযুগে নয়, আধুনিক যুগের কাব্য-সাহিত্যেও এসব ভূরিভূরি; আধুনিক কবিতার ঈশ্বর লোরকা-বোদলেয়ারেও তার কমতি নেই। প্রাচীন আরবীয় কবিতায়, বিশেষ করে ইমরুল কায়েসের সাবায়ে মুয়াল্লাকায় অবৈধ মিলনের যে চিত্র রয়েছে, সখীদের কাপড় চুরি করবার ঘটনা—এ-সব কাব্য কিন্তু এখনও আমাদের এখানে মাদ্রসাগুলোয় পড়ানো হয়।

রাধাকে নানা ছলে-বলে-কৌশলে কৃষ্ণ কাছে পেতে চেয়েছেন, কিন্তু এর জন্য রাধার স্বামীকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় নি; ইউরোপে এটি ভাবা যেত না।


তাহলে আমরা একটা বিষয় লক্ষ করছি, ইউরোপীয় সাহিত্যে যে যৌনতা দেখানো হয়েছে তা কেবল নারী-পুরুষের সম্পর্কেরই বর্ণনা নয়; তা পাঠককে অতিরিক্ত লবণ সরবরাহের কাজও করেছে। দ্বিতীয়ত, এর অনেকগুলো চরিত্র নিষিদ্ধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে—মায়ে-পুত্রে, পিতা-কন্যায়, ভাই-বোনে। তৃতীয়ত, এসব সাহিত্যে হয় তারা তাদের পিতাদের কিংবা প্রেমিকার স্বামীদের হত্যা করে সম্ভোগের অধিকারী হয়েছে।
এবার শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ফিরে আসা যাক, সেখানে রাধাকে নানা ছলে-বলে-কৌশলে কৃষ্ণ কাছে পেতে চেয়েছেন, কিন্তু এর জন্য রাধার স্বামীকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় নি; ইউরোপে এটি ভাবা যেত না। দ্বিতীয়ত, একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে এই কাব্যে অন্যায়ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মিলনের বিষয় থাকলেও শরীরকে জাগাবার জন্য বিশেষ কিছু যত্ন পরিলক্ষিত হয় না। এই কবি যদি মহৎ শিল্পী না হতেন, তাহলে তো এটি কৃষ্ণ, যাকে কবি বাটপার বলেছেন, তার কাব্যে পরিণত হতো; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তা হয়েছে? এটি তো শেষপর্যন্ত রাধার বেদনার কাহিনিতে পর্যবসিত হয়েছে। রাধার বেদনা প্রকাশের জন্য যে কবি শতাধিক পদ রচনা করতে পারেন; তিনি কিভাবে ছোট শিল্পী হতে পারেন। কবি পুরুষ হয়েও কৃষ্ণচরিত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা তার ধাতে ছিল না; তিনি তো রাধাভাবে বিলুপ্ত হয়েছিলেন; রাধার কষ্টই তার হৃদয় মথিত করেছিল। রাধার কষ্টকে কখনো তিনি উপেক্ষা করেন নি।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব-পদাবলির বৈপরীত্যের কথা আপনি বলেছেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো, দেহধারী রাধা বা কৃষ্ণের উপস্থিতি ছাড়া কিভাবে তাদের নিয়ে রচিত গানের চিত্রকল্প আমাদের হৃদয়ে আবেদন তুলতে পারে। প্রাচীন সেমেটিক কাব্যে ইউসুফ-জুলেখার কথা জানা যায়। জুলেখা ইউসুফের আশ্রয়দাতা আমর্ত্যরে স্ত্রী ছিলেন। ইউসুফের সৌন্দর্যে প্রলুব্ধ হয়ে জুলেখা হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতায় ইউসুফকে মিলনের আহ্বান জানান; পিছন থেকে তার জামা টেনে ধরেন। আমরা দেখেছি এই কাহিনি পরবর্তীকালে পরিশীলিত হয়ে মুসলমানদের মধ্যেও ভক্তিভাবে উন্নীত হয়েছে। আমাদের বাঙালি কবিরাও ইউসুফ-জুলেখাকে নিয়ে প্রেমের কাব্য রচনা করেছেন। এতসব বিবেচনায় আমি শুধু বলতে চেয়েছি, যে কবি রাধার কষ্ট এত দরদ দিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন; তিনি কেন কেবল কৃষ্ণচরিত্রের সমাজ-বাস্তবতার জন্য রুচিগর্হিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন? অন্যভাবেও বলা যায়, যে কৃষ্ণ বালিকা রাধাকে বৃহন্নলা আয়ান ঘোষের কারাগার থেকে মুক্ত করে জীবনের পথে নিয়ে এসেছিলেন; যে রাধার জীবনের আনন্দের ও কষ্টের শ্রেষ্ঠত্বের সকল অনুভূতি দান করেছিলেন, সেই কৃষ্ণের প্রতিই বা কী করে এত নিষ্ঠুর হওয়া যায়! তাছাড়া গ্রন্থটির নাম তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রেখেছিলেন কিনা তাও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
সর্বদা নীতি প্রচার নিঃসন্দেহে সাহিত্যের কাজ নয়। আবার নৈরাজ্যসৃষ্টিও শিল্পের উদ্দেশ্য হতে পারে না। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর প্রেম মূলত ঘরবাঁধার সামাজিক আকাঙ্ক্ষা; সেখানে প্রেমযন্ত্রণা নির্ধারিত হয় সামাজিক শ্রেণি-বৈষম্যের নিরিখে। বিবাহিত জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মধ্যযুগে যেখানে গৌরীদানের অসমঞ্জস বিয়ে, বহুস্ত্রীর কৌলীন্যপ্রথা, সহমরণের অমানবিক চেতনা, সেখানে নারীর পক্ষে তার স্বামীর প্রেমিকা হওয়ার সুযোগ কোথায় ছিল? সেই সমাজে প্রেম অর্জনের কঠিন পথে রাধার রক্তাক্ত চলার ইতিহাস এই গ্রন্থে কিছুটা হলেও বর্ণিত হয়েছে।
    সৌজন্য ;-

মজিদ মাহমুদ

মজিদ মাহমুদ

মজিদ মাহমুদ

জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার চরগড়গড়ি গ্রামে। এম.এ (বাংলা), ১৯৮৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লেখালেখি ঠিক রেখে কখনো সাংবাদিকতা, কখনো শিক্ষকতা; আর পাশাপাশি সমাজসেবা।

মন্তব্যসমূহ