সমর সেনের অপহরণ :
গণবাহিনীতে মারিগেল্লার গেরিলা দাওয়াই
বাংলাদেশের ইতিহাসে জাসদ এক বিপুল বিভ্রান্তির নাম ।
সত্তরের দশকে,জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী নিজেকে আরবান গেরিলার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছিল । সত্তরের দশক ছিল আক্ষরিক অর্থেই যেন প্রসব বেদনার দশক । একদিকে অসংখ্য নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রসব বেদনায় যাতনায় বিদীর্ণ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের অজস্র জনপদ । ষাটের বা সত্তরের দশকের উন্মাতাল সময়ে বিপ্লবী হওয়ার মরণ নেশায় কাতর হয়ে দেশে দেশে তরুণেরা নিজেদের চিরতরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল । সেই অদ্ভুত সময়ে, একের পর এক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল বঙ্গভূমির উর্বর উষর ।জাসদ ছিল সেই অদ্ভুত সময়েরই এক অদ্ভুততম চরিত্র ।
সত্তরের দশকে,জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী নিজেকে আরবান গেরিলার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছিল । সত্তরের দশক ছিল আক্ষরিক অর্থেই যেন প্রসব বেদনার দশক । একদিকে অসংখ্য নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রসব বেদনায় যাতনায় বিদীর্ণ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের অজস্র জনপদ । ষাটের বা সত্তরের দশকের উন্মাতাল সময়ে বিপ্লবী হওয়ার মরণ নেশায় কাতর হয়ে দেশে দেশে তরুণেরা নিজেদের চিরতরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল । সেই অদ্ভুত সময়ে, একের পর এক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল বঙ্গভূমির উর্বর উষর ।জাসদ ছিল সেই অদ্ভুত সময়েরই এক অদ্ভুততম চরিত্র ।
জাসদের রহস্যজনক অপারেশনগুলোর মধ্যে একটি ছিল, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনের অপহরনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা । সেই রহস্যের অনুসন্ধান শুরু করার আগে, আমাদের যেতে হবে ব্রাজিলে, ম্যানুয়েল মারিগেল্লার কাছে ।
সত্তরের দশকে অজস্র গেরিলা বাহিনীর পাঠ্য ছিল ম্যানুয়েল মারিগেল্লার ‘মিনিম্যানুয়েল অফ আরবান গেরিলা’ । ব্রাজিলিয়ান বিপ্লবী মারিগেল্লা তার বইতে শহরভিত্তিক গেরিলা কর্মকাণ্ডের এক ‘রেসিপি’ যেন লিখে রেখেছিলেন । দ্রুত এই পুস্তিকাটি পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবী দলগুলোর কাছে সংবিধান হয়ে উঠে ।
http://imgur.com/K0jv6cd
সত্তরের দশকে অজস্র গেরিলা বাহিনীর পাঠ্য ছিল ম্যানুয়েল মারিগেল্লার ‘মিনিম্যানুয়েল অফ আরবান গেরিলা’ । ব্রাজিলিয়ান বিপ্লবী মারিগেল্লা তার বইতে শহরভিত্তিক গেরিলা কর্মকাণ্ডের এক ‘রেসিপি’ যেন লিখে রেখেছিলেন । দ্রুত এই পুস্তিকাটি পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবী দলগুলোর কাছে সংবিধান হয়ে উঠে ।
http://imgur.com/K0jv6cd
মারিগেল্লা তার বইতে অপহরণ কে শহরভিত্তিক গেরিলা অপারেশনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন । মারিগেল্লা ও তার অনুসারীরা ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ৭২ ঘন্টার জন্যে অপহরণ করে সারা বিশ্বে হই চই ফেলে দিয়েছিলেন । এই রাষ্ট্রদূত অপহরণের বিষয়টি এবার বিশ্বব্যাপী আরবান গেরিলাদের প্রিয় কৌশল হয়ে উঠে । ১৯৭২ সালে, কোস্তা গাভরাসের বিখ্যাত সিনেমা ‘State of Siege’ এ দেখা যায় উরুগুয়ের টুপামারো গেরিলারা এক মার্কিন কূটনীতিক কে অপহরণ করছে ।উল্লেখ্য, এই সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত । মারিগেল্লার অপহরণ কাণ্ড নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘Four Days in September’
জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ এইসময় মারিগেল্লার রচনাকর্মের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন । এবং তারা একই ধাঁচের অপহরণ-অভিযানের রোমাঞ্চে ভুগতে থাকেন বেশ কিছুদিন । শহরভিত্তিক সমরবাদের এডভেঞ্চারে তারা মশগুল হয়ে উঠেন । তিন বছর আগেই যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করেছে বিপুল বিক্রমে, তারাই এই গেরিলা আমেজ ছাড়তে পারলেন না দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ও ।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস । বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় মাস, সবচেয়ে ঘটনাবহুল তিরিশটি দিন । মাসের শুরুতেই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান । মাসের সপ্তম দিনেই আবার অভ্যুত্থান, এইবার জেনারেল জিয়াকে কাঁধে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসালেন কর্নেল তাহের । কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির অদ্ভুত চালে কর্নেল তাহের নিজেই বন্দী হয়ে গেলেন ২৪ নভেম্বর । জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সকলেই জিয়ার সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেছেন ততোদিনে । ঠিক এই সময়ই ঘটলো এই অপহরণের ঘটনাটি, যেটি জাসদের জন্যে দুর্ভাগ্য ব্যতীত আর কিছু বয়ে আনেনি ।
কর্নেল তাহেরের ভাই এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন ছিলেন এই অপহরণ কাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী । ছয় জনের সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করা হলো । দলের সদস্যরা হলেন, সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান , হারুনর রশীদ এবং সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ ।
উল্লেখ্য, এই ছয় জনের মাঝে দুইজন, বাহার ও বেলাল ছিলেন কর্নেল তাহের এবং আনোয়ার হোসেনের ভাই। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক ফিলিস্তিনে গিয়েও যুদ্ধ করেন ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে । বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ।
উল্লেখ্য, এই ছয় জনের মাঝে দুইজন, বাহার ও বেলাল ছিলেন কর্নেল তাহের এবং আনোয়ার হোসেনের ভাই। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক ফিলিস্তিনে গিয়েও যুদ্ধ করেন ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে । বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ।
প্রথমে পরিকল্পনা হয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অপহরণ করা হবে । এই লক্ষ্যে মতিঝিলের আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের আশেপাশের এলাকা রেকি ও করা হয় । কিন্তু পরবর্তীতে, এই সিদ্ধান্ত পালটে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।
২৬ শে নভেম্বর, ১৯৭৬ । ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই করছে ।
ধানমণ্ডি দুই নাম্বার রোড । গাছপালায় ঢাকা, সুনসান আবাসিক এলাকা । এখন যেখানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঠিক সেখানেই একসময় ছিল ভারতীয় দূতাবাস । আশেপাশে ছয়জন নাম না জানা তরুণের চলাফেরা । মগবাজারের নয়াটোলার আস্তানা থেকে তারা ভোর বেলাতেই বের হয়েছে অপারেশনের জন্যে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় রাষ্ট্রদূত সমর সেন অফিসে আসেন ।
ধানমণ্ডি দুই নাম্বার রোড । গাছপালায় ঢাকা, সুনসান আবাসিক এলাকা । এখন যেখানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঠিক সেখানেই একসময় ছিল ভারতীয় দূতাবাস । আশেপাশে ছয়জন নাম না জানা তরুণের চলাফেরা । মগবাজারের নয়াটোলার আস্তানা থেকে তারা ভোর বেলাতেই বের হয়েছে অপারেশনের জন্যে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় রাষ্ট্রদূত সমর সেন অফিসে আসেন ।
সমর সেন ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর সেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করেছিলেন । তিনি সেই সময় জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন, মার্কিন কূটনৈতিক চাপকে বেশ ভালোমতোই সামাল দিয়েছিলেন জাতিসংঘে । ’৭৪ এর জুলাইয়ে তাকে সেই কাজ থেকে ফিরে বাংলাদেশে চলে আসতে হয় , রাষ্ট্রদূত হিসেবে । ঢাকায় তার নিযুক্তির ঘটনাটিও বেশ অভিনব । বাংলাদেশে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন সুবিমল দত্ত । সুবিমল দত্ত ছিলেন ভারতের অন্যতম জ্যেষ্ঠ কূটনীতিবিদ । ঢাকায় নিয়োগ পাওয়ার ১৬ বছর আগেই, জওহরলাল নেহেরুর আমলেই তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন । এত জ্যেষ্ঠ একজন কূটনীতিবিদকে একটি সদ্য স্বাধীন দেশে নিযুক্তির বিষয়টি থেকেই প্রতীয়মান হয় যে ভারত এখানে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারটিকে কতোটুকু গুরুত্ব দিচ্ছিল । সুবিমল দত্ত এই পূর্ববঙ্গেরই মানুষ, চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ায় বড় হওয়া । ১৯৭৪ সালে ভুট্টোর ঢাকা সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে একটি কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয় । এইসময় সুবিমল দত্ত পদত্যাগ করেন, এবং পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন ,
“(বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে)ভুট্টোকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগতম জানানো এবং তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে আমি প্রস্তুত নই ।“
এর কিছুদিন পরে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে সমর সেনের আগমন ঘটে ঢাকায় । সমর সেনের উপর হামলার বিষয়টি নতুন নয় । প্রায় দশ দিন আগেই, ’৭৫ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ সমর সেনের বাড়ির আঙিনায় একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া যায় ।
আমরা আবার ফিরে যাই ’৭৫ এর ২৬ শে নভেম্বর তারিখে । সকাল ৯টা বেজে ৪০ মিনিট । সমর সেনের গাড়ি এসে দাঁড়ালো দূতাবাসের চৌকাঠে । গাড়ি থেকে নামতেই, গণবাহিনীর সেই ছয় তরুণের স্কোয়াড তাকে জিম্মি করে ফেলে । তাকে বলা হলো,
“আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি । আপনার ঘরে চলুন, আপনার সাথে আমাদের কথা আছে ।“
সমর সেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন । নিজের দূতাবাসের দরজার সামনে এভাবে তাকে অপহরণ করা হবে, ভাবতেও পারেননি ভদ্রলোক । ভাবতে পারেনি কেউই ।
সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার পথেই ওপর থেকে ব্রাশফায়ার শুরু হলো । রেকি করার সময় তারা খেয়াল করেনি, ভবনের দোতলায় নিরাপত্তারক্ষীদের একটি দল সর্বদা পাহাড়ায় থাকে ।
সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সবাই । অপহরণকারীদের মধ্যে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় । বেলাল ও সবুজ আহত বস্থায় কাতরাতে থাকে । সমর সেনের কাঁধে গুলি লেগেছিল, কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, আঘাত ততোটা মারাত্মক ছিলো না ।
সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সবাই । অপহরণকারীদের মধ্যে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় । বেলাল ও সবুজ আহত বস্থায় কাতরাতে থাকে । সমর সেনের কাঁধে গুলি লেগেছিল, কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, আঘাত ততোটা মারাত্মক ছিলো না ।
পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে । পুলিশ চলে এলো, লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হলো ধানমণ্ডি থানায় । ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর তখন সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে । সেনাবাহিনী থেকে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন । আহত দুই জিম্মিকারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক । জাসদের অনেক নেতাই এত বড় ঘটনা সম্পর্কে একদমই অন্ধকারে ছিলেন । দলের ভেতরই প্রতিবাদ উঠতে থাকে, ফলস্বরূপ এর পরিকল্পনাকারী আনোয়ার হোসেনকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় । জাসদের পার্টি ফোরাম ঘোষণা দেয়,
“ এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা বিপ্লবীও নয়, প্রতিবিপ্লবী ও নয় । তারা অবিপ্লবী । “
কিন্তু জাসদের সবাই যে এমন মনোভাব পোষণ করতো, তা নয় । আশির দশকেও জাসদ ছাত্রলীগের স্লোগান ছিলো,
“বাহার-বাচ্চু-মাসুদ-হারুন! দিকে দিকে জ্বালাও আগুন!”
“বাহার-বাচ্চু-মাসুদ-হারুন! দিকে দিকে জ্বালাও আগুন!”
জাসদ কেন এই অপহরণের পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেই বিষয়টি এখনো ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে । কর্নেল তাহেরের আরেক ভাই আবু ইউসুফ, যিনি নিজেও জাসদের একজন শীর্ষ নেতা ছিলেন, তার ভাষ্যমতে,
“আসলে মার্কিন দূতাবাসের পরিবর্তে ভারতীয় দূতাবাসে আক্রমণ হয়ে যায় । এইসময় ফিলিস্তিনের বীর রমণী লায়লা খালেদ তরূণদের বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন । আমাদের পার্টিতে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকম চিন্তা-ভাবনা ছিল । যদি বিপ্লব হয় তাহলে ডানপন্থীরা তো সহজে মানবে না, একটা প্রতিক্রিয়া হবেই । সেক্ষেত্রে করণীয় কি হবে? একটা ভাবনা ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে । সে লক্ষ্যে গণবাহিনীর ছেলেরা মতিঝিলের আদমজী কোর্টে মার্কিন দূতাবাসের উপর বহুদিন নজরদারি করে । যখন আমরা সবাই এরেস্ট হয়ে গেলাম- তখন যারা এ কাজে জড়িত ছিল তাদের ভাবনা থেকে এ কাজটি( সমর সেনকে অপহরণ) হয়ে যায় ।“
বাংলাদেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তখন যেকোন সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নাজুক ছিল । ইন্দিরা গান্ধী এতোটাই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, যে তিনি সমর সেনকে উদ্ধার করে কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে আসতে বিমান বাহিনীর একটি দলকে পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমর সেন তাতে রাজি হননি । অবশেষে ইন্দিরা গান্ধী কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ঢাকায় পাঠান, সমর সেনের শারীরিক অবস্থা তদারকির জন্যে । ভারত সরকার একদমই প্রস্তুত ছিলো না এই ধরনের কোন ঘটনার জন্যে । বাংলাদেশ সরকার চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় । ঘটনার প্রতিক্রিয়া সামাল দিয়ে প্রেসিডেন্ট সায়েম ফোন করেন ইন্দিরা গান্ধী কে । তাতেও যখন সম্পর্কের শীতলতা কাটছিল না, বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কে ভারতে পাঠানো হয়, পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে ।
অপহরণকারীরা রায়েরবাজারের জয়নুল হক শিকদারের দুটি পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে ব্যবহার করেছিল তাদের ব্যর্থ অভিযানে । পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পিস্তলের সূত্র ধরে শিকদার কে গ্রেফতার করে । অস্ত্র হারানোর তথ্য পুলিশকে না জানানোর অভিযোগে তার জেল হয় । জয়নুল হক শিকদার ১৯৮২ তে আমেরিকায় পাড়ি দেন । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন । ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, নিজের নামে একটি খ্যাতনামা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন ।
চারজন অপহরণকারীকে হত্যা ও দুইজনকে জীবিত অবস্থায় গ্রেফতারের জন্যে পুলিশের পাঁচজন সদস্য কে পুরষ্কৃত করা হয় । আইজিপি তাদের প্রত্যেক কে দুই হাজার টাকার পুরষ্কার তুলে দেন ।
একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটে এইদিনই । নভেম্বরের ২৬ তারিখ সকাল ৯ টা ৪০ এ সমর সেন আক্রান্ত হন । উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তায় দেখা যাচ্ছে, সেইদিনই সকাল ১০টা থেকে কিছু সময়ের জন্যে ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল । কেন বন্ধ ছিল? মাত্র বিশ মিনিটের মাথায়? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি কোথাও । ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারির তারবার্তায় আরো দেখা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের সাথে আলোচনায় সমর সেন তার অপহরণ প্রচেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন । সমর সেনের মতে, কেউ তাকে অপহরণ করতে চাইলে অবশ্যই ভারতীয় দূতাবাসের সামনে থেকে অপহরণের চেষ্টা করতো না । সমর সেন এই ঘটনাকে হত্যাপ্রচেষ্টা বলেও মনে করছেন না, কারণ তার মতে, আক্রমণকারীরা সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে হত্যা করেনি ।
পুলিশ এই ঘটনার সূত্র ধরে খুঁজতে খুঁজতে জাসদ কর্মীদের বিপুল হারে গ্রেফতার করা শুরু করে । কেন্দ্রীয় নেতাদের হারিয়ে জাসদ তখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সেইসময় এই ঘটনা আরেকটি বড় ধাক্কা দেয় জাসদের কাঠামোতে । সেই ধাক্কা বোধহয় জাসদ আর কখনোই সামলে উঠতে পারেনি । কয়েক মাসের ভেতরই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়ে গেল । শীর্ষ নেতারাও সকলে জেলে । আস্তে আস্তে জাসদের শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠে ।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে কর্নেল তাহেরের পরিবারে । অদ্ভুত এক পরিবার । ৭ ভাই ২ বোনের সবাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন । এক ভাই বীরউত্তম, তিন ভাই বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত । কিন্তু জাসদের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে পরিবারের একজনের ফাঁসি হয়, একজনের হয় যাবজ্জীবন, সমর সেনের অপহরণকাণ্ডে একজন হয় নিহত, একজন আহত, আরেকজনের দশ বছরের কারাদণ্ড । এই পরিবারটি যেন যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেরই রূপক, যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধ্বারা একের পর এক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে নিজেরা হানাহানি করে, বিপ্লবের কোন এক অদ্ভুত নেশায় পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন । আর ক্ষমতার সেই শুন্যস্থান পূরণ করে নেয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী সেনা কর্মকর্তারা , যারা ইতিহাসের চাকা উলটো দিকে ঘুরিয়ে বাঙলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক গভীর অন্ধকার সময়ে !
রেফারেন্সঃ
১) আলতাফ পারভেজ, ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ’
২) মহিউদ্দিন আহমদ, ‘জাসদের উত্থানপতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি’
৩) দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ।
৪) দৈনিক বাংলা, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৫)দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৬) দ্য বাংলাদেশ টাইমস, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৭) Muchkund Dubey,’ A legend among diplomats’ , March 12, 2003 issue, ‘The Hindu’
৮) ডেভিস ইউজিন বোস্টারের পাঠানো তারবার্তা সমূহ (https://wikileaks.org/plusd/cables/1975NEWDE15781_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1975DACCA05708_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1976DACCA00272_b.html)
৯) আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের সাক্ষাৎকার, বিশেষজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার, পাঠক সমাবেশ, পৃ ১৫০
১০) J. N. Dixit, Liberation and Beyond: Indo Bangladesh Relations, P. 189
১) আলতাফ পারভেজ, ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ’
২) মহিউদ্দিন আহমদ, ‘জাসদের উত্থানপতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি’
৩) দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ।
৪) দৈনিক বাংলা, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৫)দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৬) দ্য বাংলাদেশ টাইমস, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৭) Muchkund Dubey,’ A legend among diplomats’ , March 12, 2003 issue, ‘The Hindu’
৮) ডেভিস ইউজিন বোস্টারের পাঠানো তারবার্তা সমূহ (https://wikileaks.org/plusd/cables/1975NEWDE15781_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1975DACCA05708_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1976DACCA00272_b.html)
৯) আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের সাক্ষাৎকার, বিশেষজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার, পাঠক সমাবেশ, পৃ ১৫০
১০) J. N. Dixit, Liberation and Beyond: Indo Bangladesh Relations, P. 189
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন