সমর সেনের অপহরণ : লিখেছেন- টেলেমেকাস ( সৌজন্য ; সচলায়তন )


সমর সেনের অপহরণ :


 গণবাহিনীতে মারিগেল্লার গেরিলা দাওয়াই

অতিথি লেখক এর ছবি



বাংলাদেশের ইতিহাসে জাসদ এক বিপুল বিভ্রান্তির নাম ।
সত্তরের দশকে,জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী নিজেকে আরবান গেরিলার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছিল । সত্তরের দশক ছিল আক্ষরিক অর্থেই যেন প্রসব বেদনার দশক । একদিকে অসংখ্য নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রসব বেদনায় যাতনায় বিদীর্ণ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের অজস্র জনপদ । ষাটের বা সত্তরের দশকের উন্মাতাল সময়ে বিপ্লবী হওয়ার মরণ নেশায় কাতর হয়ে দেশে দেশে তরুণেরা নিজেদের চিরতরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল । সেই অদ্ভুত সময়ে, একের পর এক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল বঙ্গভূমির উর্বর উষর ।জাসদ ছিল সেই অদ্ভুত সময়েরই এক অদ্ভুততম চরিত্র ।
জাসদের রহস্যজনক অপারেশনগুলোর মধ্যে একটি ছিল, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনের অপহরনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা । সেই রহস্যের অনুসন্ধান শুরু করার আগে, আমাদের যেতে হবে ব্রাজিলে, ম্যানুয়েল মারিগেল্লার কাছে ।
সত্তরের দশকে অজস্র গেরিলা বাহিনীর পাঠ্য ছিল ম্যানুয়েল মারিগেল্লার ‘মিনিম্যানুয়েল অফ আরবান গেরিলা’ । ব্রাজিলিয়ান বিপ্লবী মারিগেল্লা তার বইতে শহরভিত্তিক গেরিলা কর্মকাণ্ডের এক ‘রেসিপি’ যেন লিখে রেখেছিলেন । দ্রুত এই পুস্তিকাটি পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবী দলগুলোর কাছে সংবিধান হয়ে উঠে ।
http://imgur.com/K0jv6cd
মারিগেল্লা তার বইতে অপহরণ কে শহরভিত্তিক গেরিলা অপারেশনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন । মারিগেল্লা ও তার অনুসারীরা ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ৭২ ঘন্টার জন্যে অপহরণ করে সারা বিশ্বে হই চই ফেলে দিয়েছিলেন । এই রাষ্ট্রদূত অপহরণের বিষয়টি এবার বিশ্বব্যাপী আরবান গেরিলাদের প্রিয় কৌশল হয়ে উঠে । ১৯৭২ সালে, কোস্তা গাভরাসের বিখ্যাত সিনেমা ‘State of Siege’ এ দেখা যায় উরুগুয়ের টুপামারো গেরিলারা এক মার্কিন কূটনীতিক কে অপহরণ করছে ।উল্লেখ্য, এই সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত । মারিগেল্লার অপহরণ কাণ্ড নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘Four Days in September’
জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ এইসময় মারিগেল্লার রচনাকর্মের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন । এবং তারা একই ধাঁচের অপহরণ-অভিযানের রোমাঞ্চে ভুগতে থাকেন বেশ কিছুদিন । শহরভিত্তিক সমরবাদের এডভেঞ্চারে তারা মশগুল হয়ে উঠেন । তিন বছর আগেই যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করেছে বিপুল বিক্রমে, তারাই এই গেরিলা আমেজ ছাড়তে পারলেন না দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ও ।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস । বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় মাস, সবচেয়ে ঘটনাবহুল তিরিশটি দিন । মাসের শুরুতেই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান । মাসের সপ্তম দিনেই আবার অভ্যুত্থান, এইবার জেনারেল জিয়াকে কাঁধে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসালেন কর্নেল তাহের । কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির অদ্ভুত চালে কর্নেল তাহের নিজেই বন্দী হয়ে গেলেন ২৪ নভেম্বর । জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সকলেই জিয়ার সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেছেন ততোদিনে । ঠিক এই সময়ই ঘটলো এই অপহরণের ঘটনাটি, যেটি জাসদের জন্যে দুর্ভাগ্য ব্যতীত আর কিছু বয়ে আনেনি ।
কর্নেল তাহেরের ভাই এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন ছিলেন এই অপহরণ কাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী । ছয় জনের সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করা হলো । দলের সদস্যরা হলেন, সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান , হারুনর রশীদ এবং সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ ।
উল্লেখ্য, এই ছয় জনের মাঝে দুইজন, বাহার ও বেলাল ছিলেন কর্নেল তাহের এবং আনোয়ার হোসেনের ভাই। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক ফিলিস্তিনে গিয়েও যুদ্ধ করেন ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে । বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ।
প্রথমে পরিকল্পনা হয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অপহরণ করা হবে । এই লক্ষ্যে মতিঝিলের আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের আশেপাশের এলাকা রেকি ও করা হয় । কিন্তু পরবর্তীতে, এই সিদ্ধান্ত পালটে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।
২৬ শে নভেম্বর, ১৯৭৬ । ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই করছে ।
ধানমণ্ডি দুই নাম্বার রোড । গাছপালায় ঢাকা, সুনসান আবাসিক এলাকা । এখন যেখানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঠিক সেখানেই একসময় ছিল ভারতীয় দূতাবাস । আশেপাশে ছয়জন নাম না জানা তরুণের চলাফেরা । মগবাজারের নয়াটোলার আস্তানা থেকে তারা ভোর বেলাতেই বের হয়েছে অপারেশনের জন্যে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় রাষ্ট্রদূত সমর সেন অফিসে আসেন ।
সমর সেন ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর সেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করেছিলেন । তিনি সেই সময় জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন, মার্কিন কূটনৈতিক চাপকে বেশ ভালোমতোই সামাল দিয়েছিলেন জাতিসংঘে । ’৭৪ এর জুলাইয়ে তাকে সেই কাজ থেকে ফিরে বাংলাদেশে চলে আসতে হয় , রাষ্ট্রদূত হিসেবে । ঢাকায় তার নিযুক্তির ঘটনাটিও বেশ অভিনব । বাংলাদেশে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন সুবিমল দত্ত । সুবিমল দত্ত ছিলেন ভারতের অন্যতম জ্যেষ্ঠ কূটনীতিবিদ । ঢাকায় নিয়োগ পাওয়ার ১৬ বছর আগেই, জওহরলাল নেহেরুর আমলেই তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন । এত জ্যেষ্ঠ একজন কূটনীতিবিদকে একটি সদ্য স্বাধীন দেশে নিযুক্তির বিষয়টি থেকেই প্রতীয়মান হয় যে ভারত এখানে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারটিকে কতোটুকু গুরুত্ব দিচ্ছিল । সুবিমল দত্ত এই পূর্ববঙ্গেরই মানুষ, চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ায় বড় হওয়া । ১৯৭৪ সালে ভুট্টোর ঢাকা সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে একটি কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয় । এইসময় সুবিমল দত্ত পদত্যাগ করেন, এবং পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন ,
“(বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে)ভুট্টোকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগতম জানানো এবং তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে আমি প্রস্তুত নই ।“
এর কিছুদিন পরে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে সমর সেনের আগমন ঘটে ঢাকায় । সমর সেনের উপর হামলার বিষয়টি নতুন নয় । প্রায় দশ দিন আগেই, ’৭৫ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ সমর সেনের বাড়ির আঙিনায় একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া যায় ।
আমরা আবার ফিরে যাই ’৭৫ এর ২৬ শে নভেম্বর তারিখে । সকাল ৯টা বেজে ৪০ মিনিট । সমর সেনের গাড়ি এসে দাঁড়ালো দূতাবাসের চৌকাঠে । গাড়ি থেকে নামতেই, গণবাহিনীর সেই ছয় তরুণের স্কোয়াড তাকে জিম্মি করে ফেলে । তাকে বলা হলো,
“আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি । আপনার ঘরে চলুন, আপনার সাথে আমাদের কথা আছে ।“
সমর সেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন । নিজের দূতাবাসের দরজার সামনে এভাবে তাকে অপহরণ করা হবে, ভাবতেও পারেননি ভদ্রলোক । ভাবতে পারেনি কেউই ।
সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার পথেই ওপর থেকে ব্রাশফায়ার শুরু হলো । রেকি করার সময় তারা খেয়াল করেনি, ভবনের দোতলায় নিরাপত্তারক্ষীদের একটি দল সর্বদা পাহাড়ায় থাকে ।
সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সবাই । অপহরণকারীদের মধ্যে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় । বেলাল ও সবুজ আহত বস্থায় কাতরাতে থাকে । সমর সেনের কাঁধে গুলি লেগেছিল, কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, আঘাত ততোটা মারাত্মক ছিলো না ।
পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে । পুলিশ চলে এলো, লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হলো ধানমণ্ডি থানায় । ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর তখন সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে । সেনাবাহিনী থেকে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন । আহত দুই জিম্মিকারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক । জাসদের অনেক নেতাই এত বড় ঘটনা সম্পর্কে একদমই অন্ধকারে ছিলেন । দলের ভেতরই প্রতিবাদ উঠতে থাকে, ফলস্বরূপ এর পরিকল্পনাকারী আনোয়ার হোসেনকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় । জাসদের পার্টি ফোরাম ঘোষণা দেয়,
“ এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা বিপ্লবীও নয়, প্রতিবিপ্লবী ও নয় । তারা অবিপ্লবী । “
কিন্তু জাসদের সবাই যে এমন মনোভাব পোষণ করতো, তা নয় । আশির দশকেও জাসদ ছাত্রলীগের স্লোগান ছিলো,
“বাহার-বাচ্চু-মাসুদ-হারুন! দিকে দিকে জ্বালাও আগুন!”
জাসদ কেন এই অপহরণের পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেই বিষয়টি এখনো ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে । কর্নেল তাহেরের আরেক ভাই আবু ইউসুফ, যিনি নিজেও জাসদের একজন শীর্ষ নেতা ছিলেন, তার ভাষ্যমতে,
“আসলে মার্কিন দূতাবাসের পরিবর্তে ভারতীয় দূতাবাসে আক্রমণ হয়ে যায় । এইসময় ফিলিস্তিনের বীর রমণী লায়লা খালেদ তরূণদের বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন । আমাদের পার্টিতে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকম চিন্তা-ভাবনা ছিল । যদি বিপ্লব হয় তাহলে ডানপন্থীরা তো সহজে মানবে না, একটা প্রতিক্রিয়া হবেই । সেক্ষেত্রে করণীয় কি হবে? একটা ভাবনা ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে । সে লক্ষ্যে গণবাহিনীর ছেলেরা মতিঝিলের আদমজী কোর্টে মার্কিন দূতাবাসের উপর বহুদিন নজরদারি করে । যখন আমরা সবাই এরেস্ট হয়ে গেলাম- তখন যারা এ কাজে জড়িত ছিল তাদের ভাবনা থেকে এ কাজটি( সমর সেনকে অপহরণ) হয়ে যায় ।“
বাংলাদেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তখন যেকোন সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নাজুক ছিল । ইন্দিরা গান্ধী এতোটাই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, যে তিনি সমর সেনকে উদ্ধার করে কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে আসতে বিমান বাহিনীর একটি দলকে পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমর সেন তাতে রাজি হননি । অবশেষে ইন্দিরা গান্ধী কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ঢাকায় পাঠান, সমর সেনের শারীরিক অবস্থা তদারকির জন্যে । ভারত সরকার একদমই প্রস্তুত ছিলো না এই ধরনের কোন ঘটনার জন্যে । বাংলাদেশ সরকার চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় । ঘটনার প্রতিক্রিয়া সামাল দিয়ে প্রেসিডেন্ট সায়েম ফোন করেন ইন্দিরা গান্ধী কে । তাতেও যখন সম্পর্কের শীতলতা কাটছিল না, বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কে ভারতে পাঠানো হয়, পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে ।
অপহরণকারীরা রায়েরবাজারের জয়নুল হক শিকদারের দুটি পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে ব্যবহার করেছিল তাদের ব্যর্থ অভিযানে । পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পিস্তলের সূত্র ধরে শিকদার কে গ্রেফতার করে । অস্ত্র হারানোর তথ্য পুলিশকে না জানানোর অভিযোগে তার জেল হয় । জয়নুল হক শিকদার ১৯৮২ তে আমেরিকায় পাড়ি দেন । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন । ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, নিজের নামে একটি খ্যাতনামা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন ।
চারজন অপহরণকারীকে হত্যা ও দুইজনকে জীবিত অবস্থায় গ্রেফতারের জন্যে পুলিশের পাঁচজন সদস্য কে পুরষ্কৃত করা হয় । আইজিপি তাদের প্রত্যেক কে দুই হাজার টাকার পুরষ্কার তুলে দেন ।
একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটে এইদিনই । নভেম্বরের ২৬ তারিখ সকাল ৯ টা ৪০ এ সমর সেন আক্রান্ত হন । উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তায় দেখা যাচ্ছে, সেইদিনই সকাল ১০টা থেকে কিছু সময়ের জন্যে ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল । কেন বন্ধ ছিল? মাত্র বিশ মিনিটের মাথায়? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি কোথাও । ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারির তারবার্তায় আরো দেখা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের সাথে আলোচনায় সমর সেন তার অপহরণ প্রচেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন । সমর সেনের মতে, কেউ তাকে অপহরণ করতে চাইলে অবশ্যই ভারতীয় দূতাবাসের সামনে থেকে অপহরণের চেষ্টা করতো না । সমর সেন এই ঘটনাকে হত্যাপ্রচেষ্টা বলেও মনে করছেন না, কারণ তার মতে, আক্রমণকারীরা সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে হত্যা করেনি ।
পুলিশ এই ঘটনার সূত্র ধরে খুঁজতে খুঁজতে জাসদ কর্মীদের বিপুল হারে গ্রেফতার করা শুরু করে । কেন্দ্রীয় নেতাদের হারিয়ে জাসদ তখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সেইসময় এই ঘটনা আরেকটি বড় ধাক্কা দেয় জাসদের কাঠামোতে । সেই ধাক্কা বোধহয় জাসদ আর কখনোই সামলে উঠতে পারেনি । কয়েক মাসের ভেতরই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়ে গেল । শীর্ষ নেতারাও সকলে জেলে । আস্তে আস্তে জাসদের শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠে ।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে কর্নেল তাহেরের পরিবারে । অদ্ভুত এক পরিবার । ৭ ভাই ২ বোনের সবাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন । এক ভাই বীরউত্তম, তিন ভাই বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত । কিন্তু জাসদের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে পরিবারের একজনের ফাঁসি হয়, একজনের হয় যাবজ্জীবন, সমর সেনের অপহরণকাণ্ডে একজন হয় নিহত, একজন আহত, আরেকজনের দশ বছরের কারাদণ্ড । এই পরিবারটি যেন যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেরই রূপক, যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধ্বারা একের পর এক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে নিজেরা হানাহানি করে, বিপ্লবের কোন এক অদ্ভুত নেশায় পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন । আর ক্ষমতার সেই শুন্যস্থান পূরণ করে নেয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী সেনা কর্মকর্তারা , যারা ইতিহাসের চাকা উলটো দিকে ঘুরিয়ে বাঙলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক গভীর অন্ধকার সময়ে !
রেফারেন্সঃ
১) আলতাফ পারভেজ, ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ’
২) মহিউদ্দিন আহমদ, ‘জাসদের উত্থানপতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি’
৩) দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ।
৪) দৈনিক বাংলা, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৫)দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৬) দ্য বাংলাদেশ টাইমস, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত
৭) Muchkund Dubey,’ A legend among diplomats’ , March 12, 2003 issue, ‘The Hindu’
৮) ডেভিস ইউজিন বোস্টারের পাঠানো তারবার্তা সমূহ (https://wikileaks.org/plusd/cables/1975NEWDE15781_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1975DACCA05708_b.html
https://wikileaks.org/plusd/cables/1976DACCA00272_b.html)
৯) আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের সাক্ষাৎকার, বিশেষজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার, পাঠক সমাবেশ, পৃ ১৫০
১০) J. N. Dixit, Liberation and Beyond: Indo Bangladesh Relations, P. 189
        

মন্তব্যসমূহ