শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
-সংক্ষিপ্ত জীবনী- ( সূত্র ইনটারনেট থেকে সংগ্রহ )
হুগলী জেলায় দেবানন্দপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামটি ইষ্টার্ন রেলওয়ের ব্যান্ডেল রেল স্টেশন থেকে মাইল-দুই উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত। এই গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে(বাংলা ১২৮৩ সালের ৩১শে ভাদ্র) শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়।তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে শরৎচন্দ্রের আরও দুই ছোটভাই এবং অনিলা দেবী ও সুশীলা দেবী নামে দুই বোনও ছিলেন। অনিলা দেবী ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় আর সুশীলা দেবী ছিলেন সবার ছোট।
শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল এন্ট্রান্স পাস করে কিছুদিন এফ.এ. পড়েছিলেন। তিনি অস্থিরচিত্ত, ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই অল্প কিছুদিন চাকরি করা ছাড়া আর কখনও কিছুই করেন নি। গল্প-উপন্যাস লিখতেন; কিন্তু ঐ অস্থিরচিত্ততার জন্যই কোন লেখা সম্পূর্ণ করতেন না। অভাব অনটনের জন্য তিনি বেশীর ভাগ সময় স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাই শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার অনেক গুলো বছর কেটেছিল ভাগলপুরে মামার বাড়িতে।
শরৎচন্দ্রের মাতামহ কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ২৪-পরগনা জেলার হালিশহরে। কেদার বাবু ভাগলপুরে কালেকটারি অফিসের কেরানি ছিলেন। তিনি ভাগলপুরেই সপরিবারে বাস করতেন। কেদারবাবুর ছোট চার ভাই পরিবারসহ তাঁর কাছেই থাকতেন।
শরৎচন্দ্রের বয়স যখন পাঁচ বছর সেই সময় তাঁর পিতা তাঁকে গ্রামের (দেবানন্দপুরের) প্যারী পন্ডিতের (বন্দ্যোপাধ্যায়ের) পাঠশালায় ভর্তি করে দেন।শরৎচন্দ্র এখানে দু-তিন বছর পড়েন। পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুরন্ত।
শরৎচন্দ্র যখন প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় পড়ছিলেন, সেই সময় স্থানীয় সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য দেবানন্দপুরে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুল স্থাপিত হলে শরৎচন্দ্রের পিতা শরৎচন্দ্রকে প্যারী পন্ডিতের পাঠশালা থেকে এনে সিদ্ধেশ্বর মাস্টারের স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলেও শরৎচন্দ্র বছর তিনেক পড়েন।
এই সময় শরৎচন্দ্রের পিতা বিহারের ডিহিরিতে একটা চাকরি পান। চাকরি পেয়ে তিনি ডিহিরিতে চলে যান। যাবার সময় তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান। পরে তিনি পরিবার ডিহিরিতে নিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পড়বার জন্য ভাগলপুরেই থেকে গেলেন। তবে ছুটিতে অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে ডিহিরিতে বাবা মার কাছে যেতেন।
শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুরে এলে তাঁর মাতামহ তাঁকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি করে দেন।ঐ ক্লাসে শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মণীন্দ্রনাথও পড়তেন। সে বছরে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে শরৎচন্দ্র এবং মণীন্দ্রনাথ উভয়েই পাস করেছিলেন।
ছাত্রবৃত্তি পাস করে শরৎচন্দ্র ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ভাগলপুরের জেলা স্কুলে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাসে অর্থাৎ বর্তমানের ক্লাস ফোর বা চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
ছাত্রবৃত্তিতে তখন ইংরাজী পড়ানো হত না। তবে বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় একটু বেশী করেই পড়ানো হত। শরৎচন্দ্র ছাত্রবৃত্তি পাস করার ফলে জেলা স্কুলের সেভেন্থ্ ক্লাসের বাংলা অঙ্ক ইত্যাদি তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। তাঁকে কেবল ইংরাজীই যা পড়তে হত। ফলে সে বছরের শেষে পরীক্ষায় ইংরাজী এবং অন্যান্য বিষয়েও শরৎচন্দ্র এত বেশী নম্বর পেয়েছিলেন যে, শিক্ষকমশায়রা তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শরৎচন্দ্র ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাস থেকে সিকস্থ্ ক্লাস টপকে একেবারে ফিপ্থ্ ক্লাসে উঠেছিলেন। তখনকার দিনে স্কুলের নীচের দিক থেকে এইভাবে ক্লাস গণনা হত-নাইন্থ্ ক্লাস, এইট্থ্ ক্লাস, সেভেন্থ্ ক্লাস, সিকস্থ্ ক্লাস, ফিফ্থ্ ক্লাস, ফোরথ্ ক্লাস, থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস হল বর্তমানের ক্লাস টেন বা দশম শ্রেণী।
১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে উঠলেন, সেই সময় তাঁর পিতার ডিহিরির চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্রের পিতা তখন পরিবারবর্গকে নিয়ে আবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্র বাবা-মা’র সঙ্গে দেবানন্দপুরে এসে ঐ বছরই অর্থাৎ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দেই জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় তাঁর পিতা অভাবের জন্য আর স্কুলের মাহিনা দিতে পারলেন না, ফলে শরৎচন্দ্র পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে রইলেন।
শরৎচন্দ্র এই সময় সতের বছর বয়সে সর্বপ্রথম পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নাম নিয়ে ‘কাশীনাথ’ নামে একটি গল্প লেখেন। এছাড়া ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে আরও একটি গল্প লিখেছিলেন। ব্রহ্মদৈত্য গল্পটি পাওয়া যায় না।
দেবানন্দপুরে মতিলালের অভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠায় তিনি তখন বাধ্য হয়ে আবার সপরিবারে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেলেন। সেটা তখন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিক। শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে গিয়েই আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহান্বিত হলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের আগ্রহ হলে কি হবে! হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের বকেয়া মাহিনা মিটিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনার টাকা কোথায়? ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তাঁর মাতামহের মৃত্যু হওয়ায় মামার বাড়ির একান্নবর্তী সংসার ভেঙ্গে যায়। শরৎচন্দ্রের নিজের দুই মামার মধ্যে বড়মামা ঠাকুর দাসের তখন চাকরি ছিল না। ছোটমামা বিপ্রদাস সামান্য বেতনে সেই সবে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন। তাঁকে একাই তাঁর নিজের, তাঁর দাদা ঠাকুরদাসের এবং ভগ্নীপতি মতিলালের সংসার চালাতে হয়।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময় ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের মামাদের প্রতিবেশী ছিলেন। পাঁচকড়িবাবুর পিতা বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের মাতামহের বন্ধু ছিলেন। তাই শরৎচন্দ্র পাঁচকড়িবাবুকে মামা বলতেন। শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে পাঁচকড়িবাবুই অবশেষে শরৎচন্দ্রকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র এই তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকেই পর বৎসর অর্থাৎ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরীক্ষার আগে স্কুলে পরীক্ষার ফি এবং ঐ সঙ্গে দেয় ক’ মাসের মাহিনার টাকা জমা দেবার সময়ও শরৎচন্দ্রের ছোটমামা বিপ্রদাসকে স্থানীয় মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার করতে হয়েছিল।
শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মনীন্দ্রনাথও ঐ বছর এন্ট্রান্স পাস করেন। এন্ট্রান্স পাস করে মণীন্দ্রনাথ তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু টাকার অভাবে শরৎচন্দ্রের আর ভর্তি হওয়া হল না। অভাবের জন্যই বিপ্রদাস শরৎচন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে পারলেন না।
শরৎচন্দ্রের পড়া হবে না দেখে মণীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর বড় মায়া হল। তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁদের দুই ছোট ছেলেকে পড়াবার বিনিময়ে শরৎচন্দ্রের কলেজে ভর্তি হওয়ার এবং কলেজে প্রতি মাসে মাহিনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হলেন। শরৎচন্দ্র রাত্রে মণীন্দ্রনাথের ছোট দু ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন। এরাঁ তখন স্কুলের নীচের ক্লাসে পড়তেন। এরাঁ ছাড়া বাড়ির অন্য ছোট ছেলেরাও তাঁর কাছে অমনি পড়ত।
কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্য বইও কিনতে পারেন নি। তিনি মণীন্দ্রনাথের এবং সহপাঠী অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালেই বই ফেরৎ দিয়ে আসতেন। কলেজে এইভাবে দু বছর পড়েও টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফ.এ.পরীক্ষার ফি মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারায়, শরৎচন্দ্র আর এফ.এ. পরীক্ষাই দিতে পারলেন না। ঠিক এই সময়টায় শরৎচন্দ্র অবশ্য মামার বাড়িতে ছিলেন না। কারণ ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শরৎচন্দ্রের মাতার মৃত্যু হওয়ায় তার কিছুদিন পরেই শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল শ্বশুরালয় ছেড়ে পুত্রকন্যাদের নিয়ে মাইল খানেক দূরে ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লীতে এসেছিলেন। এখানে মতিলাল খোলার ছাওয়া একটা মাটির ঘরে পুত্রকন্যাদের নিয়ে থাকতেন।জ্যেষ্ঠা কন্যা অনিলা দেবীর ইতিপূর্বে হাওড়া জেলায় বাগনান থানার গোবিন্দপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল।অনিলা দেবী তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।
শরৎচন্দ্র কলেজের পড়া ছেড়ে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে মিশে অভিনয় ও খেলাধূলা করে কাটাতে লাগলেন। এবং ভাগলপুরের নির্ভীক, পরোপকারী, মহাপ্রান এক আদর্শ যুবক রাজেন মজুমদারের সঙ্গে মিশে তাঁর পরোপকারমূলক কাজের সঙ্গী হলেন। (শরৎচন্দ্র পরে তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এঁকেই ইন্দ্রনাথরূপে চিত্রিত করে গেছেন) শরৎচন্দ্র এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টদের বাড়িতে মিশে সেখানে নিজের একটা আস্তানা করেছিলেন এবং সেই আস্তানায় বসে দিন-রাত অজস্র গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। শরৎচন্দ্র এই সময় মাতুল সুরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ (মাতামহের তৃতীয় ভ্রতার পুত্র), এঁদের বন্ধু যোগেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্ট ও তাঁর ছোট বোন নিরুপমা দেবী প্রভৃতিকে নিয়ে একটা সাহিত্য সভাও গঠন করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন করে সাহিত্য সভার অধিবেশন হত।সেদিন সভায় সভ্যরা যে যাঁর লেখা পড়তেন। নিরুপমা দেবী সভায় যেতেন না। তিনি তাঁর দাদা বিভূতিবাবুর হাত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দিতেন। সাহিত্য সভার ‘ছায়া’ নামে হাতে-লেখা একটা মুখপত্রও ছিল। শরৎচন্দ্র এই সময়েই তাঁর বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ প্রভৃতি গল্পগুলি রচনা করেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের পিতা দেবানন্দপুরের ঘরবাড়ি সমস্ত বিক্রি করে এর-ওর কাছে চেয়ে চিন্তে কোন রকমে সংসার চালাতেন । শরৎচন্দ্র এই সময় বনেলী রাজ এস্টেটে অল্প কিছু-দিনের জন্য একটা চাকরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন পিতার উপর অভিমান করে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন এবং সন্ন্যাসী সেজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এই ঘুরে বেড়াবার সময় যখন তিনি মজঃফরপুরে আসেন, তখন একদিন তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।এই জেনেই তিনি ভাগলপুরে এলেন। এসে কোন রকমে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে ছোটভাই-দুটিকে আত্মীয়দের কাছে এবং ছোট বোনটিকে বাড়ির মালিক মহিলাটির কাছে রেখে (শরৎচন্দ্রের ছোটমামা পরে একে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনিই এঁর বিয়েও দিয়েছিলেন) ভাগ্য অন্বেষণে কলকাতায় এলেন।
কলকাতায় এসে তিনি উপেন মামার দাদা কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছেই ৩০ টাকা মাহিনায় হিন্দী পেপার বুকের ইংরাজী তর্জমা করার একটা চাকরি পান। শরৎচন্দ্র লালমোহনবাবুর বাড়িতে মাস-ছয়েক ছিলেন। এর পর (জানুয়ারী ১৯০৩) এখান থেকে বর্মায় চলে যান। বর্মায় গিয়ে লালমোহনবাবুর ভগ্নীপতি রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন যাওয়ার দু-একদিন আগে কলকাতার বৌবাজারে সুরেন মামা ও গিরীন মামার সঙ্গে দেখা করতে গেলে (এঁরা দুজনেই কলকাতায় কলেজে পড়তেন) গিরীন মামার অনুরোধে বসে সঙ্গে সঙ্গেই একটা গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটিতে নিজের নাম না দিয়ে সুরেনবাবুর নাম দিয়েছিলেন। গল্পটির নাম ‘মন্দির’। দেড়শ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গেলে কিছুদিন পরে মেসোমশায় অঘোরবাবু বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে তাঁর একটা অস্থায়ী চাকরি করে দেন। বছর দুই পরে হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর পরিবারবর্গ রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসেন। এই সময় শরৎচন্দ্রের রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্র তখন তাঁর রেঙ্গুনের এক বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগুতে যান। পেগু রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল উত্তরে। পেগুতে গিয়ে তিনি গিরীনবাবুর বন্ধু অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। তাই অবিনাশবাবু সেই বিদেশে শরৎচন্দ্রকে নিজের দেশের লোক হিসাবে খুবই আদর-যত্নে রেখেছিলেন।
অবিনাশবাবুর বাড়িতে থাকাকালে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস একাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। মণিবাবু শরৎচন্দ্রকে বেকার জেনে পরে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নিজের অফিসে তাঁর একটা চাকরি করে দেন।শরৎচন্দ্র এই চাকরি পেয়েই পেগু থেকে রেঙ্গুনে চলে আসেন। এই চাকরি পাওয়ার আগে শরৎচন্দ্র মাঝে নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র মণিবাবুর দেওয়া এই চাকরিই ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত করেছিলেন।১৯১২-তে শরৎচন্দ্রের অফিস বর্মার একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থাকার সময় বেশির ভাগ সময়টাই থেকেছেন শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এখানে শহরের কলকারখানার মিস্ত্রীরাই প্রধানত থাকত। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতেন। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে দিতেন, অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, বিপদে সাহায্যও করতেন। মিস্ত্রীরা শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করত এবং দাদাঠাকুর বলে ডাকত। শরৎচন্দ্র এদের নিয়ে একটা সঙ্কীর্তনের দলও করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় তাঁর বাসার নীচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রী থাকত। ঐ মিস্ত্রীর শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রোঢ় ও মাতাল মিস্ত্রীর সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যাবস্থা করে। চক্রবর্তীর কন্যার কিন্তু এই বিবাহে ঘোর আপত্তি থাকে, তাই চক্রবর্তীর কন্যা একদিন তাকে ঐ বিপদে রক্ষা করবার জন্য শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে তাঁকে অনুরোধ করে। তখন শরৎচন্দ্র বাধ্য হয়ে নিজেই তাকে বিয়ে করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র স্ত্রী শান্তি দেবীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন।
শান্তি দেবীর মৃত্যুর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র ঐ রেঙ্গুনেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। বিবাহের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম ছিল মোক্ষদা। বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর মোক্ষদা নাম বদলে হিরণ্ময়ী নাম দিয়েছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর এই নামই প্রচলিত হয়। বিয়ের সময় হিরণ্ময়ী দেবীর বয়স ছিল ১৪।
হিরণ্ময়ী দেবীর বাবার নাম কৃষ্ণদাস অধিকারী। তাঁর মূল বাড়ি মেদনীপুর জেলায় শালবনীর নিকটে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। কৃষ্ণবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আট বছরের কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এক মিস্ত্রী বন্ধুর কাছে রেঙ্গুনে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিল না। ক্ষীরোদা, সুখদা ও অপর একটি কন্যার আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন।
হিরণ্ময়ী দেবী যখন রেঙ্গুনের মিস্ত্রীপল্লীতে তাঁর বাবার কাছে থাকতেন, সেই সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বাবার বিশেষ পরিচয় হয়। এই বিশেষ পরিচয়ের জোরেই হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে করে বলেন-আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি! আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহন করে আমায় দায়মুক্ত করেন তো বড় উপকার হয়। আর একান্তই যদি না নিতে চান তো, আমায় কিছু টাকা দিন। আমি মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই। দেশে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দিই।
কৃষ্ণবাবু শেষে শরৎচন্দ্রের কাছে টাকার কথা বললেও, তিনি বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন, যেন তিনিই তাঁর কন্যাটিকে গ্রহণ করেন।
শরৎচন্দ্র প্রথমে অরাজী হলেও কৃষ্ণবাবুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন।
শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল এন্ট্রান্স পাস করে কিছুদিন এফ.এ. পড়েছিলেন। তিনি অস্থিরচিত্ত, ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই অল্প কিছুদিন চাকরি করা ছাড়া আর কখনও কিছুই করেন নি। গল্প-উপন্যাস লিখতেন; কিন্তু ঐ অস্থিরচিত্ততার জন্যই কোন লেখা সম্পূর্ণ করতেন না। অভাব অনটনের জন্য তিনি বেশীর ভাগ সময় স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাই শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার অনেক গুলো বছর কেটেছিল ভাগলপুরে মামার বাড়িতে।
শরৎচন্দ্রের মাতামহ কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ২৪-পরগনা জেলার হালিশহরে। কেদার বাবু ভাগলপুরে কালেকটারি অফিসের কেরানি ছিলেন। তিনি ভাগলপুরেই সপরিবারে বাস করতেন। কেদারবাবুর ছোট চার ভাই পরিবারসহ তাঁর কাছেই থাকতেন।
শরৎচন্দ্রের বয়স যখন পাঁচ বছর সেই সময় তাঁর পিতা তাঁকে গ্রামের (দেবানন্দপুরের) প্যারী পন্ডিতের (বন্দ্যোপাধ্যায়ের) পাঠশালায় ভর্তি করে দেন।শরৎচন্দ্র এখানে দু-তিন বছর পড়েন। পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুরন্ত।
শরৎচন্দ্র যখন প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় পড়ছিলেন, সেই সময় স্থানীয় সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য দেবানন্দপুরে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুল স্থাপিত হলে শরৎচন্দ্রের পিতা শরৎচন্দ্রকে প্যারী পন্ডিতের পাঠশালা থেকে এনে সিদ্ধেশ্বর মাস্টারের স্কুলে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলেও শরৎচন্দ্র বছর তিনেক পড়েন।
এই সময় শরৎচন্দ্রের পিতা বিহারের ডিহিরিতে একটা চাকরি পান। চাকরি পেয়ে তিনি ডিহিরিতে চলে যান। যাবার সময় তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যান। পরে তিনি পরিবার ডিহিরিতে নিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পড়বার জন্য ভাগলপুরেই থেকে গেলেন। তবে ছুটিতে অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে ডিহিরিতে বাবা মার কাছে যেতেন।
শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুরে এলে তাঁর মাতামহ তাঁকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি করে দেন।ঐ ক্লাসে শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মণীন্দ্রনাথও পড়তেন। সে বছরে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে শরৎচন্দ্র এবং মণীন্দ্রনাথ উভয়েই পাস করেছিলেন।
ছাত্রবৃত্তি পাস করে শরৎচন্দ্র ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ভাগলপুরের জেলা স্কুলে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাসে অর্থাৎ বর্তমানের ক্লাস ফোর বা চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
ছাত্রবৃত্তিতে তখন ইংরাজী পড়ানো হত না। তবে বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় একটু বেশী করেই পড়ানো হত। শরৎচন্দ্র ছাত্রবৃত্তি পাস করার ফলে জেলা স্কুলের সেভেন্থ্ ক্লাসের বাংলা অঙ্ক ইত্যাদি তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। তাঁকে কেবল ইংরাজীই যা পড়তে হত। ফলে সে বছরের শেষে পরীক্ষায় ইংরাজী এবং অন্যান্য বিষয়েও শরৎচন্দ্র এত বেশী নম্বর পেয়েছিলেন যে, শিক্ষকমশায়রা তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শরৎচন্দ্র ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সেকালের সেভেন্থ্ ক্লাস থেকে সিকস্থ্ ক্লাস টপকে একেবারে ফিপ্থ্ ক্লাসে উঠেছিলেন। তখনকার দিনে স্কুলের নীচের দিক থেকে এইভাবে ক্লাস গণনা হত-নাইন্থ্ ক্লাস, এইট্থ্ ক্লাস, সেভেন্থ্ ক্লাস, সিকস্থ্ ক্লাস, ফিফ্থ্ ক্লাস, ফোরথ্ ক্লাস, থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস হল বর্তমানের ক্লাস টেন বা দশম শ্রেণী।
১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে উঠলেন, সেই সময় তাঁর পিতার ডিহিরির চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্রের পিতা তখন পরিবারবর্গকে নিয়ে আবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্র বাবা-মা’র সঙ্গে দেবানন্দপুরে এসে ঐ বছরই অর্থাৎ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দেই জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় তাঁর পিতা অভাবের জন্য আর স্কুলের মাহিনা দিতে পারলেন না, ফলে শরৎচন্দ্র পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে রইলেন।
শরৎচন্দ্র এই সময় সতের বছর বয়সে সর্বপ্রথম পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নাম নিয়ে ‘কাশীনাথ’ নামে একটি গল্প লেখেন। এছাড়া ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে আরও একটি গল্প লিখেছিলেন। ব্রহ্মদৈত্য গল্পটি পাওয়া যায় না।
দেবানন্দপুরে মতিলালের অভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠায় তিনি তখন বাধ্য হয়ে আবার সপরিবারে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেলেন। সেটা তখন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিক। শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে গিয়েই আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহান্বিত হলেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের আগ্রহ হলে কি হবে! হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের বকেয়া মাহিনা মিটিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনার টাকা কোথায়? ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তাঁর মাতামহের মৃত্যু হওয়ায় মামার বাড়ির একান্নবর্তী সংসার ভেঙ্গে যায়। শরৎচন্দ্রের নিজের দুই মামার মধ্যে বড়মামা ঠাকুর দাসের তখন চাকরি ছিল না। ছোটমামা বিপ্রদাস সামান্য বেতনে সেই সবে একটা চাকরিতে ঢুকেছেন। তাঁকে একাই তাঁর নিজের, তাঁর দাদা ঠাকুরদাসের এবং ভগ্নীপতি মতিলালের সংসার চালাতে হয়।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময় ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের মামাদের প্রতিবেশী ছিলেন। পাঁচকড়িবাবুর পিতা বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের মাতামহের বন্ধু ছিলেন। তাই শরৎচন্দ্র পাঁচকড়িবাবুকে মামা বলতেন। শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে পাঁচকড়িবাবুই অবশেষে শরৎচন্দ্রকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র এই তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকেই পর বৎসর অর্থাৎ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরীক্ষার আগে স্কুলে পরীক্ষার ফি এবং ঐ সঙ্গে দেয় ক’ মাসের মাহিনার টাকা জমা দেবার সময়ও শরৎচন্দ্রের ছোটমামা বিপ্রদাসকে স্থানীয় মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার করতে হয়েছিল।
শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র মনীন্দ্রনাথও ঐ বছর এন্ট্রান্স পাস করেন। এন্ট্রান্স পাস করে মণীন্দ্রনাথ তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু টাকার অভাবে শরৎচন্দ্রের আর ভর্তি হওয়া হল না। অভাবের জন্যই বিপ্রদাস শরৎচন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে পারলেন না।
শরৎচন্দ্রের পড়া হবে না দেখে মণীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর বড় মায়া হল। তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁদের দুই ছোট ছেলেকে পড়াবার বিনিময়ে শরৎচন্দ্রের কলেজে ভর্তি হওয়ার এবং কলেজে প্রতি মাসে মাহিনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হলেন। শরৎচন্দ্র রাত্রে মণীন্দ্রনাথের ছোট দু ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন। এরাঁ তখন স্কুলের নীচের ক্লাসে পড়তেন। এরাঁ ছাড়া বাড়ির অন্য ছোট ছেলেরাও তাঁর কাছে অমনি পড়ত।
কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্য বইও কিনতে পারেন নি। তিনি মণীন্দ্রনাথের এবং সহপাঠী অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালেই বই ফেরৎ দিয়ে আসতেন। কলেজে এইভাবে দু বছর পড়েও টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফ.এ.পরীক্ষার ফি মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারায়, শরৎচন্দ্র আর এফ.এ. পরীক্ষাই দিতে পারলেন না। ঠিক এই সময়টায় শরৎচন্দ্র অবশ্য মামার বাড়িতে ছিলেন না। কারণ ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শরৎচন্দ্রের মাতার মৃত্যু হওয়ায় তার কিছুদিন পরেই শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল শ্বশুরালয় ছেড়ে পুত্রকন্যাদের নিয়ে মাইল খানেক দূরে ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লীতে এসেছিলেন। এখানে মতিলাল খোলার ছাওয়া একটা মাটির ঘরে পুত্রকন্যাদের নিয়ে থাকতেন।জ্যেষ্ঠা কন্যা অনিলা দেবীর ইতিপূর্বে হাওড়া জেলায় বাগনান থানার গোবিন্দপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল।অনিলা দেবী তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।
শরৎচন্দ্র কলেজের পড়া ছেড়ে ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে মিশে অভিনয় ও খেলাধূলা করে কাটাতে লাগলেন। এবং ভাগলপুরের নির্ভীক, পরোপকারী, মহাপ্রান এক আদর্শ যুবক রাজেন মজুমদারের সঙ্গে মিশে তাঁর পরোপকারমূলক কাজের সঙ্গী হলেন। (শরৎচন্দ্র পরে তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এঁকেই ইন্দ্রনাথরূপে চিত্রিত করে গেছেন) শরৎচন্দ্র এই সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টদের বাড়িতে মিশে সেখানে নিজের একটা আস্তানা করেছিলেন এবং সেই আস্তানায় বসে দিন-রাত অজস্র গল্প-উপন্যাস লিখতেন এবং পড়তেন। শরৎচন্দ্র এই সময় মাতুল সুরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ (মাতামহের তৃতীয় ভ্রতার পুত্র), এঁদের বন্ধু যোগেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্ট ও তাঁর ছোট বোন নিরুপমা দেবী প্রভৃতিকে নিয়ে একটা সাহিত্য সভাও গঠন করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন করে সাহিত্য সভার অধিবেশন হত।সেদিন সভায় সভ্যরা যে যাঁর লেখা পড়তেন। নিরুপমা দেবী সভায় যেতেন না। তিনি তাঁর দাদা বিভূতিবাবুর হাত দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দিতেন। সাহিত্য সভার ‘ছায়া’ নামে হাতে-লেখা একটা মুখপত্রও ছিল। শরৎচন্দ্র এই সময়েই তাঁর বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ প্রভৃতি গল্পগুলি রচনা করেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের পিতা দেবানন্দপুরের ঘরবাড়ি সমস্ত বিক্রি করে এর-ওর কাছে চেয়ে চিন্তে কোন রকমে সংসার চালাতেন । শরৎচন্দ্র এই সময় বনেলী রাজ এস্টেটে অল্প কিছু-দিনের জন্য একটা চাকরি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন পিতার উপর অভিমান করে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন এবং সন্ন্যাসী সেজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এই ঘুরে বেড়াবার সময় যখন তিনি মজঃফরপুরে আসেন, তখন একদিন তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।এই জেনেই তিনি ভাগলপুরে এলেন। এসে কোন রকমে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে ছোটভাই-দুটিকে আত্মীয়দের কাছে এবং ছোট বোনটিকে বাড়ির মালিক মহিলাটির কাছে রেখে (শরৎচন্দ্রের ছোটমামা পরে একে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনিই এঁর বিয়েও দিয়েছিলেন) ভাগ্য অন্বেষণে কলকাতায় এলেন।
কলকাতায় এসে তিনি উপেন মামার দাদা কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছেই ৩০ টাকা মাহিনায় হিন্দী পেপার বুকের ইংরাজী তর্জমা করার একটা চাকরি পান। শরৎচন্দ্র লালমোহনবাবুর বাড়িতে মাস-ছয়েক ছিলেন। এর পর (জানুয়ারী ১৯০৩) এখান থেকে বর্মায় চলে যান। বর্মায় গিয়ে লালমোহনবাবুর ভগ্নীপতি রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন যাওয়ার দু-একদিন আগে কলকাতার বৌবাজারে সুরেন মামা ও গিরীন মামার সঙ্গে দেখা করতে গেলে (এঁরা দুজনেই কলকাতায় কলেজে পড়তেন) গিরীন মামার অনুরোধে বসে সঙ্গে সঙ্গেই একটা গল্প লিখে কুন্তলীন প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটিতে নিজের নাম না দিয়ে সুরেনবাবুর নাম দিয়েছিলেন। গল্পটির নাম ‘মন্দির’। দেড়শ গল্পের মধ্যে ‘মন্দির’ সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গেলে কিছুদিন পরে মেসোমশায় অঘোরবাবু বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে তাঁর একটা অস্থায়ী চাকরি করে দেন। বছর দুই পরে হঠাৎ অঘোরবাবুর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর পরিবারবর্গ রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসেন। এই সময় শরৎচন্দ্রের রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও চলে যায়। শরৎচন্দ্র তখন তাঁর রেঙ্গুনের এক বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগুতে যান। পেগু রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল উত্তরে। পেগুতে গিয়ে তিনি গিরীনবাবুর বন্ধু অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন। অবিনাশবাবুর বাড়ি ছিল শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরের অদূরে বৈদ্যবাটীতে। তাই অবিনাশবাবু সেই বিদেশে শরৎচন্দ্রকে নিজের দেশের লোক হিসাবে খুবই আদর-যত্নে রেখেছিলেন।
অবিনাশবাবুর বাড়িতে থাকাকালে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস একাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একদিন পরিচয় হয়। মণিবাবু শরৎচন্দ্রকে বেকার জেনে পরে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নিজের অফিসে তাঁর একটা চাকরি করে দেন।শরৎচন্দ্র এই চাকরি পেয়েই পেগু থেকে রেঙ্গুনে চলে আসেন। এই চাকরি পাওয়ার আগে শরৎচন্দ্র মাঝে নাঙ্গলবিনে কিছুদিন এক ধানের ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র মণিবাবুর দেওয়া এই চাকরিই ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত করেছিলেন।১৯১২-তে শরৎচন্দ্রের অফিস বর্মার একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থাকার সময় বেশির ভাগ সময়টাই থেকেছেন শহরের উপকণ্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এখানে শহরের কলকারখানার মিস্ত্রীরাই প্রধানত থাকত। শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতেন। তিনি তাদের চাকরির দরখাস্ত লিখে দিতেন, বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে দিতেন, অসুখে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, বিপদে সাহায্যও করতেন। মিস্ত্রীরা শরৎচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করত এবং দাদাঠাকুর বলে ডাকত। শরৎচন্দ্র এদের নিয়ে একটা সঙ্কীর্তনের দলও করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় তাঁর বাসার নীচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রী থাকত। ঐ মিস্ত্রীর শান্তি নামে একটি কন্যা ছিল। চক্রবর্তী এক প্রোঢ় ও মাতাল মিস্ত্রীর সঙ্গে তার কন্যার বিয়ের ব্যাবস্থা করে। চক্রবর্তীর কন্যার কিন্তু এই বিবাহে ঘোর আপত্তি থাকে, তাই চক্রবর্তীর কন্যা একদিন তাকে ঐ বিপদে রক্ষা করবার জন্য শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে তাঁকে অনুরোধ করে। তখন শরৎচন্দ্র বাধ্য হয়ে নিজেই তাকে বিয়ে করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র স্ত্রী শান্তি দেবীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন।
শান্তি দেবীর মৃত্যুর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র ঐ রেঙ্গুনেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। বিবাহের সময় পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের এই দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম ছিল মোক্ষদা। বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর মোক্ষদা নাম বদলে হিরণ্ময়ী নাম দিয়েছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর এই নামই প্রচলিত হয়। বিয়ের সময় হিরণ্ময়ী দেবীর বয়স ছিল ১৪।
হিরণ্ময়ী দেবীর বাবার নাম কৃষ্ণদাস অধিকারী। তাঁর মূল বাড়ি মেদনীপুর জেলায় শালবনীর নিকটে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। কৃষ্ণবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আট বছরের কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এক মিস্ত্রী বন্ধুর কাছে রেঙ্গুনে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র ছিল না। ক্ষীরোদা, সুখদা ও অপর একটি কন্যার আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন।
হিরণ্ময়ী দেবী যখন রেঙ্গুনের মিস্ত্রীপল্লীতে তাঁর বাবার কাছে থাকতেন, সেই সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বাবার বিশেষ পরিচয় হয়। এই বিশেষ পরিচয়ের জোরেই হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে করে বলেন-আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি! আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহন করে আমায় দায়মুক্ত করেন তো বড় উপকার হয়। আর একান্তই যদি না নিতে চান তো, আমায় কিছু টাকা দিন। আমি মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই। দেশে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দিই।
কৃষ্ণবাবু শেষে শরৎচন্দ্রের কাছে টাকার কথা বললেও, তিনি বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন, যেন তিনিই তাঁর কন্যাটিকে গ্রহণ করেন।
শরৎচন্দ্র প্রথমে অরাজী হলেও কৃষ্ণবাবুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন।
হিরণ্ময়ী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। বিয়ের সময় পর্যন্ত হিরণ্ময়ী দেবী লেখাপড়া জানতেন না। পরে শরৎচন্দ্র তাঁকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী ছেলেবেলা থেকেই শান্তস্বভাবা, সেবাপরায়ন ও ধর্মশীলা ছিলেন। শরৎচন্দ্র তাঁকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখে শান্তিতেই কাটিয়ে গেছেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা, গান-বাজনা এবং সাহিত্য-চর্চাও করতেন। প্রথম দিকে অনেক দিন ছবিও এঁকেছেন। মিস্ত্রী-পল্লীতে বোটাটং-এর ল্যান্সডাউন স্ট্রীটে যখন তিনি একটা কাঠের বাড়ির দুতলায় থাকতেন, সেই সময় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁর বাসার নীচের তলায় আগুন লাগে। সেই আগুনে তাঁর কয়েটি বইয়ের পান্ডুলিপি, কিছু অয়েল পেন্টিং এবং এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা একটি লাইব্রেরী-সমেত তাঁর বাসাটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রেঙ্গুনে থাকাকালে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র একবার অফিসে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। এই সময় মাতুল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারফত যমুনা-সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে একদিন তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় হলে ফণীবাবু তাঁর কাগজে লিখবার জন্য শরৎচন্দ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেবেন বলে কথা দেন।
ঐ কথা অনুযায়ী শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। ফণীবাবু এই গল্প তাঁর কাগজে ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করেন। রামের সুমতি যমুনায় প্রকাশিত হলে শরৎচন্দ্র এক গল্প লিখেই একজন মহাশক্তিশালী লেখক হিসাবে সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে পরিচিত হন।
ইতিপূর্বে ১৩১৪ সালে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অনেকের মত রবীন্দ্রনাথও এই লেখা পড়ে শরৎচন্দ্রকে প্রতিভাবান লেখক বলে বুঝেছিলেন। বিভূতিভূষণ ভট্টর সতীর্থ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের লেখার খাতা থেকে ‘বড়দিদি’ নকল করে এনেছিলেন এবং পরে শরৎচন্দ্রকে না জানিয়ে এটি ভারতীতে প্রকাশ করেছিলেন।
‘রামের সুমতি’ প্রকাশিত হলে তখন নবপ্রকাশিত ভারতবর্ষ এবং সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার কর্তৃপক্ষও তাঁদের কাগজের জন্য শরৎচন্দ্রের কাছে লেখা চাইতে থাকেন। শরৎচন্দ্র যমুনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেও লিখতে আরম্ভ করেন।শেষে যমুনা ছেড়ে কেবল ভারতবর্ষেই লিখতে থাকেন এবং ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তাঁর বইও প্রকাশ করতে শুরু করেন। যমুনা-সম্পাদক ফণী পালই অবশ্য প্রথম তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। ঐ সময় ফণীবাবুর বন্ধু সুধীর চন্দ্র সরকারও তাঁদের দোকান এম.সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে শরৎচন্দ্রের পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই প্রভৃতি কয়েকটি বই প্রকাশ করেন।
১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র হঠাৎ দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি স্থির করেন অফিসে এক বছরের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে কবিরাজী চিকিৎসা করাবেন। অফিসে শেষ দিনে ছুটি চাইতে যাওয়ায় উপরওয়ালা সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হয়। ফলে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই বরাবরের জন্য রেঙ্গুনে ছেড়ে দেশে চলে আসেন।
শরৎচন্দ্র তাঁর রেঙ্গুন-জীবনের শেষ দিকে আর মিস্ত্রীপল্লীতে থাকতেন না। এই সময় প্রথমে কিছুদিন ছিলেন ৫৭/৯ লুইস স্ট্রীটে। তারপর ছিলেন ৫৪/৩৬ স্ট্রীটে ।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে সস্ত্রীক এসে প্রথমে হাওড়া শহরে ৬নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে ওঠেন। এ বাড়িতে তিনি প্রায় ৮ মাস ছিলেন। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে তিনি পাশেই ৪নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে যান। ঐ বাড়িতে তিনি প্রায় ৯ বছর ছিলেন। তারপর এখান থেকে শিবপুর ট্রাম ডিপোর কাছে ৪৯/৪ কালীকুমার মুখার্জী লেনে গৌরীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বছরখানেক ছিলেন। এইখানে থাকার সময়েই তিনি তাঁর দিদিদের গ্রাম হাওড়া জেলার বাগনান থানার গোবিন্দপুরের পাশেই সামতাবেড়েয় জায়গা কিনে একটা সুন্দর মাটির বাড়ি তৈরি করান। বাড়িটি একেবারেই রূপনারায়ণের গায়েই। শরৎচন্দ্র ১৯২৬ খ্রীস্টব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে হাওড়া শহর ছেড়ে তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িতে চলে যান।
শরৎচন্দ্রের মেজভাই প্রভাস রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাস জীবনে তাঁর নাম হয়েছিল স্বামী বেদানন্দ। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ফিরে ছোটভাই প্রকাশকে এনে কাছে রাখেন। পরে বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করে দেন। প্রকাশবাবুর এক কন্যা ও এক পুত্র।
হাওড়ায় বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই শরৎচন্দ্র তাঁর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাই ঐ সময়টাকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।
এই বাজে শিবপুরে থাকাকালেই ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তখন দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং তিনি হাওড়ায় থাকতেন বলে দেশবন্ধু তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করেন । ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছ র তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। মাঝে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি একবার হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাইলে দেশবন্ধু তা করতে দেননি।
শরৎচন্দ্র অহিংস কংগ্রসের একজন ছোটখাট নেতা হলেও বরাবরই কিন্তু ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা সংক্ষেপে বি ভি দলের সর্বাধিনায়ক প্রখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার আসামী বিপ্লবী শচীন সান্যাল প্রমুখ ছাড়াও বারীন ঘোষ, উপেন বন্দোপাধ্যায়, চারু রায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী প্রমুখ খ্যাতনামা বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বিপিনবাবু সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মামা হতেন। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে নিজের রিভলবার, বন্দুকের গুলী এবং অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মহাবিপ্লবী সূর্য সেনকেও তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র হাওড়ার বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে বিচিত্রার আসরে। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু ঔপন্যাসিক চারু বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিচিত্রার আসরে ১৩২৪ সালের ১৪ই চৈত্র তারিখে তাঁর বিলাসী গল্পটি পড়েছিলেন।
পরে নানা সূত্রে এঁদের উভয়ের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। শরৎচন্দ্র নানা প্রয়োজনে একাধিকবার শান্তিনিকেতনে ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গেছেন। শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে কলকাতায় বাড়ি করলে সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় কবি একবার শরৎচন্দ্রের বাড়িতেও গিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা, গান-বাজনা এবং সাহিত্য-চর্চাও করতেন। প্রথম দিকে অনেক দিন ছবিও এঁকেছেন। মিস্ত্রী-পল্লীতে বোটাটং-এর ল্যান্সডাউন স্ট্রীটে যখন তিনি একটা কাঠের বাড়ির দুতলায় থাকতেন, সেই সময় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁর বাসার নীচের তলায় আগুন লাগে। সেই আগুনে তাঁর কয়েটি বইয়ের পান্ডুলিপি, কিছু অয়েল পেন্টিং এবং এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা একটি লাইব্রেরী-সমেত তাঁর বাসাটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রেঙ্গুনে থাকাকালে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র একবার অফিসে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। এই সময় মাতুল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারফত যমুনা-সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালের সঙ্গে একদিন তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় হলে ফণীবাবু তাঁর কাগজে লিখবার জন্য শরৎচন্দ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেবেন বলে কথা দেন।
ঐ কথা অনুযায়ী শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে গিয়ে তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি পাঠিয়ে দেন। ফণীবাবু এই গল্প তাঁর কাগজে ১৩১৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করেন। রামের সুমতি যমুনায় প্রকাশিত হলে শরৎচন্দ্র এক গল্প লিখেই একজন মহাশক্তিশালী লেখক হিসাবে সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে পরিচিত হন।
ইতিপূর্বে ১৩১৪ সালে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অনেকের মত রবীন্দ্রনাথও এই লেখা পড়ে শরৎচন্দ্রকে প্রতিভাবান লেখক বলে বুঝেছিলেন। বিভূতিভূষণ ভট্টর সতীর্থ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুরে শরৎচন্দ্রের লেখার খাতা থেকে ‘বড়দিদি’ নকল করে এনেছিলেন এবং পরে শরৎচন্দ্রকে না জানিয়ে এটি ভারতীতে প্রকাশ করেছিলেন।
‘রামের সুমতি’ প্রকাশিত হলে তখন নবপ্রকাশিত ভারতবর্ষ এবং সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার কর্তৃপক্ষও তাঁদের কাগজের জন্য শরৎচন্দ্রের কাছে লেখা চাইতে থাকেন। শরৎচন্দ্র যমুনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেও লিখতে আরম্ভ করেন।শেষে যমুনা ছেড়ে কেবল ভারতবর্ষেই লিখতে থাকেন এবং ভারতবর্ষ পত্রিকার মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তাঁর বইও প্রকাশ করতে শুরু করেন। যমুনা-সম্পাদক ফণী পালই অবশ্য প্রথম তাঁর ‘বড়দিদি’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। ঐ সময় ফণীবাবুর বন্ধু সুধীর চন্দ্র সরকারও তাঁদের দোকান এম.সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে শরৎচন্দ্রের পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই প্রভৃতি কয়েকটি বই প্রকাশ করেন।
১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র হঠাৎ দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি স্থির করেন অফিসে এক বছরের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে কবিরাজী চিকিৎসা করাবেন। অফিসে শেষ দিনে ছুটি চাইতে যাওয়ায় উপরওয়ালা সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হয়। ফলে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই বরাবরের জন্য রেঙ্গুনে ছেড়ে দেশে চলে আসেন।
শরৎচন্দ্র তাঁর রেঙ্গুন-জীবনের শেষ দিকে আর মিস্ত্রীপল্লীতে থাকতেন না। এই সময় প্রথমে কিছুদিন ছিলেন ৫৭/৯ লুইস স্ট্রীটে। তারপর ছিলেন ৫৪/৩৬ স্ট্রীটে ।
শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে সস্ত্রীক এসে প্রথমে হাওড়া শহরে ৬নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে ওঠেন। এ বাড়িতে তিনি প্রায় ৮ মাস ছিলেন। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে তিনি পাশেই ৪নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনে যান। ঐ বাড়িতে তিনি প্রায় ৯ বছর ছিলেন। তারপর এখান থেকে শিবপুর ট্রাম ডিপোর কাছে ৪৯/৪ কালীকুমার মুখার্জী লেনে গৌরীনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বছরখানেক ছিলেন। এইখানে থাকার সময়েই তিনি তাঁর দিদিদের গ্রাম হাওড়া জেলার বাগনান থানার গোবিন্দপুরের পাশেই সামতাবেড়েয় জায়গা কিনে একটা সুন্দর মাটির বাড়ি তৈরি করান। বাড়িটি একেবারেই রূপনারায়ণের গায়েই। শরৎচন্দ্র ১৯২৬ খ্রীস্টব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে হাওড়া শহর ছেড়ে তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িতে চলে যান।
শরৎচন্দ্রের মেজভাই প্রভাস রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাস জীবনে তাঁর নাম হয়েছিল স্বামী বেদানন্দ। শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ফিরে ছোটভাই প্রকাশকে এনে কাছে রাখেন। পরে বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করে দেন। প্রকাশবাবুর এক কন্যা ও এক পুত্র।
হাওড়ায় বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই শরৎচন্দ্র তাঁর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাই ঐ সময়টাকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে।
এই বাজে শিবপুরে থাকাকালেই ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তখন দেশবন্ধুর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং তিনি হাওড়ায় থাকতেন বলে দেশবন্ধু তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করেন । ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছ র তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। মাঝে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি একবার হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাইলে দেশবন্ধু তা করতে দেননি।
শরৎচন্দ্র অহিংস কংগ্রসের একজন ছোটখাট নেতা হলেও বরাবরই কিন্তু ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা সংক্ষেপে বি ভি দলের সর্বাধিনায়ক প্রখ্যাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলার আসামী বিপ্লবী শচীন সান্যাল প্রমুখ ছাড়াও বারীন ঘোষ, উপেন বন্দোপাধ্যায়, চারু রায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী প্রমুখ খ্যাতনামা বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বিপিনবাবু সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মামা হতেন। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে নিজের রিভলবার, বন্দুকের গুলী এবং অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মহাবিপ্লবী সূর্য সেনকেও তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
শরৎচন্দ্র হাওড়ার বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে বিচিত্রার আসরে। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু ঔপন্যাসিক চারু বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিচিত্রার আসরে ১৩২৪ সালের ১৪ই চৈত্র তারিখে তাঁর বিলাসী গল্পটি পড়েছিলেন।
পরে নানা সূত্রে এঁদের উভয়ের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। শরৎচন্দ্র নানা প্রয়োজনে একাধিকবার শান্তিনিকেতনে ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গেছেন। শরৎচন্দ্র শেষ বয়সে কলকাতায় বাড়ি করলে সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় কবি একবার শরৎচন্দ্রের বাড়িতেও গিয়েছিলেন।
কবির সত্তর বছর বয়সের সময় দেশবাসী যখন কলকাতার টাউন হলে তাঁকে অভিনন্দন জানায় সেই অভিনন্দন সভার বিখ্যাত মানপত্রটি রচনা করেছিলেন শরৎচন্দ্র। কবিও নিজে একবার শরৎচন্দ্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন।
শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প তিন-চারটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে একটা বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে। বাড়িটি দোতালা এবং দেখতে সুন্দর। এই বাড়ির ঠিকানা হল – ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোড।
কলকাতায় বাড়ি হলে তিনি কখন কলকাতায়, আবার কখন সামতাবেড়ে – এইভাবে কাটাতেন। কলকাতায় থাকাকালে কলকাতার তখনকার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের দুটি নাম-করা প্রতিষ্ঠান রবিবাসর ও রসচক্রের সদস্যরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। এঁরা কখন কখন শরৎচন্দ্রকে সম্বর্ধনাও জানিয়েছেন। রসচক্রের সদস্যরা শরৎচন্দ্রকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করেছিলেন।
১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক উপহার দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একবার বি.এ. পরীক্ষায় বাংলার পেপারসেটার বা প্রশ্নকর্তাও নিযুক্ত করেছিলেন। এসব ছাড়া, দেশবাসীও তাঁকে তখন ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী,’ ‘সাহিত্য সম্রাট’ এই আখ্যায় বিভূষিত করেছিলেন।বৈদ্যবাটী যুব সংঘ, শিবপুর সাহিত্য সংসদ, যশোহর সাহিত্য সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ও সাধারণভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে একাধিকবার তাঁকে সম্বর্ধনা জানান হয়।
শরৎচন্দ্র কেবল গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকই ছিলেন না, তাঁর চরিত্রে আরও অনেকগুলি গুণ ছিল। তাঁর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল- মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কি জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত।
পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ ছিল বেশী। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।
জীবজন্তুর প্রতি স্নেহবশতঃ শরৎচন্দ্র বহু বছর সি.এস.পি.সি.এ. অর্থাৎ কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন।
এক সময় অবশ্য তিনি একজন ছোটখাট শিকারীও ছিলেন। তখন ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এবং বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতে তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। পরে এসব ছেড়ে দেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মত অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন।
আর তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল পত্নীপ্রেমিক।বিলাসী না হলেও কিছুটা সৌখিন ছিলেন- বিশেষ করে বেশভূষায় ও লেখার ব্যাপারে। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ পরিহাস-রসিকতা করতেন। আত্ম-প্রচারে সর্বদাই বিমুখ ছিলেন এবং নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখন পছন্দ করতেন না।
শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ ক’বছর শরীর আদৌ ভাল যাচ্ছিল না। একটা-না-একটা রোগে ভুগছিলেনই। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনি কিছুদিন জ্বরে ভোগেন। জ্বর ছাড়লে ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থাকেন।
দেওঘর থেকে এসে কিছুদিন সুস্থ থাকার পর শরৎচন্দ্র সেপ্টেম্বর মাসে আবার অসুখে পড়লেন। এবার তাঁর পাকাশয়ের পীড়া দেখা দেয় এবং দেখতে দেখতে এই রোগ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। যা খান আদৌ হজম হয় না। তার উপর পেটেও যন্ত্রণা দেখা দেয়।
শরৎচন্দ্র এই সময় সামতাবেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।চিকিৎসা করাবার জন্য কলকাতার বাড়িতে এলেন। কলকাতায় ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখলেন, শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার ত হয়েইছে, অধিকন্তু এই ব্যাধি তাঁর পাকস্থলীও আক্রমণ করেছে।
এই সময় শরৎচন্দ্র একটি উইল করেন। উইলে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে জীবনস্তত্বে দান করেন। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকাশচন্দ্রের পুত্র বা পুত্ররা সমস্থ সম্পতির অধিকারী হবেন, উইলে এ কথাও লেখা হয়।(হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীর মৃত্যর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্য তারিখ ১৫ই ভাদ্র, ১৩৬৭।)
কলকাতার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগন-ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায় প্রভৃতি শরৎচন্দ্রকে দেখে স্থির করলেন যে, শরৎচন্দ্রের পেটে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
ডাঃ ম্যাকে সাহেবের সুপারিশে শরৎচন্দ্রের চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার ৫নং সুবার্বন হস্পিটাল রোডে একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু এখানে শরৎচন্দ্রকে তাঁর নেশার জিনিস সিগারেট খেতে না দেওয়ায়, তিনি কষ্ট বোধ করতে লাগলেন।
এই নার্সিং হোমে সকালে ও বিকালে দেখা করবার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময় কাকেও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে দিত না। তাছাড়া ইউরোপীয় নার্সরা এদেশীয় লোক বলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নাকি ভাল ব্যাবহার করতেন না। এই সব কারনে শরৎচন্দ্র দুদিন পরে সেখান থেকে চলে এসে তাঁর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ডাঃ সুশীল চ্যাটার্জীর ৪ নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত ‘পার্ক নার্সিং হোমে’ ভর্তি হলেন।
শরৎচন্দ্রের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন এক পত্রে লিখেছিলেন-
কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১।১২।৩৭
সেই সময়কার বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অপারেশন করেছিলেন।
অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হল না।
অপারেশন হয়েছিল ১২।১।৩৮ তারিখে। এর পর শরৎচন্দ্র মাত্র আর চারদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটা ছিল রবিবার, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী(বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা মাঘ)। এই দিনই বেলা দশটা দশ মিনিটের সময় শরৎচন্দ্র সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বৎসর ৪ মাস।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন-‘ যিনি বাঙালীর জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি’।
এর কয়েকদিন পরে ১২ই মাঘ তারিখে কবি আবার শরৎচন্দ্রের মৃত্যু সম্পর্কে এই কবিতাটি লিখেছিলেন-
যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।
সব শেষে শরৎচন্দ্রের রচিত গ্রন্থগুলি প্রকাশের একটা কালানুক্রমিক তালিকা এখানে দেওয়া গেল। এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, এই গ্রন্থগুলি ছাড়া শরৎচন্দ্রের কিছু অসামাপ্ত এবং টুকরো লেখাও আছে-
১৯১৩ সেপ্টেম্বর ... বড়দিদি (উপন্যাস)
১৯১৪ মে ... বিরাজ বৌ (উপন্যাস)
জুলাই ... বিন্দুর ছেলে (গল্প-সমষ্টি)
আগষ্ট ... পরিণীতা (গল্প)
সেপ্টেম্বর ... পণ্ডিতমশাই (উপন্যাস)
১৯১৫ ডিসেম্বর ... মেজদিদি (গল্প-সমষ্টি)
১৯১৬ জানুয়ারী ... পল্লী-সমাজ (উপন্যাস)
মার্চ ... চন্দ্রনাথ (উপন্যাস)
আগষ্ট ... বৈকুন্ঠের উইল (গল্প)
নভেম্বর ... অরক্ষণীয়া (গল্প)
১৯১৭ ফেব্রুয়ারী ... শ্রীকান্ত ১ম পর্ব (উপন্যাস)
জুন ... দেবদাস (উপন্যাস)
জুলাই ... নিষ্কৃতি (গল্প)
সেপ্টেম্বর ... কাশীনাথ (গল্প-সমষ্টি)
নভেম্বর ... চরিত্রহীন (উপন্যাস)
১৯১৮ ফেব্রুয়ারী ... স্বামী (গল্প-সমষ্টি)
সেপ্টেম্বর ... দত্তা (উপন্যাস)
সেপ্টেম্বর ... শ্রীকান্ত ২য় পর্ব (উপন্যাস)
১৯২০ জানুয়ারী ... ছবি(গল্প-সমষ্টি)
মার্চ ... গৃহদাহ (উপন্যাস)
অক্টোবর ... বামুনের মেয়ে (উপন্যাস)
১৯২৩ এপ্রিল ... নারীর মূল্য (প্রবন্ধ)
আগষ্ট ... দেনা-পাওনা (উপন্যাস)
১৯২৪ অক্টোবর ... নব-বিধান (উপন্যাস)
১৯২৬ মার্চ ... হরিলক্ষ্মী (গল্প-সমষ্টি)
আগস্ট ... পথের দাবী (উপন্যাস)
১৯২৭ এপ্রিল ... শ্রীকান্ত ৩য় পর্ব (উপন্যাস)
আগস্ট ... ষোড়শী (‘দেনা-পাওয়ানার’ নাট্যরূপ)
১৯২৮ আগস্ট ... রমা (‘পল্লী-সমাজে’র নাট্যরূপ)
১৯২৯ এপ্রিল ... তরুণের বিদ্রোহ (প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩১ মে ... শেষ প্রশ্ন (উপন্যাস)
১৯৩২ আগস্ট ... স্বদেশ ও সাহিত্য প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩৩ মার্চ ... শ্রীকান্ত ৪র্থ পর্ব (উপন্যাস)
১৯৩৪ মার্চ ... অনুরাধা, সতী ও পরেশ (গল্প-সমষ্টি)
ডিসেম্বর ... বিজয়া (‘দত্তা’র নাট্যরূপ)
১৯৩৫ ফেব্রুয়ারী ... বিপ্রদাস (উপন্যাস)
[মৃত্যুর পরে প্রকাশিত]
১৯৩৮ এপ্রিল ... ছেলেবেলার গল্প (তরুণপাঠ্য গল্প-সমষ্টি)
জুন ... শুভদা (উপন্যাস)
শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন।
শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প তিন-চারটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে একটা বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে। বাড়িটি দোতালা এবং দেখতে সুন্দর। এই বাড়ির ঠিকানা হল – ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোড।
কলকাতায় বাড়ি হলে তিনি কখন কলকাতায়, আবার কখন সামতাবেড়ে – এইভাবে কাটাতেন। কলকাতায় থাকাকালে কলকাতার তখনকার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের দুটি নাম-করা প্রতিষ্ঠান রবিবাসর ও রসচক্রের সদস্যরা তাঁকে আমন্ত্রণ করে তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। এঁরা কখন কখন শরৎচন্দ্রকে সম্বর্ধনাও জানিয়েছেন। রসচক্রের সদস্যরা শরৎচন্দ্রকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করেছিলেন।
১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক উপহার দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একবার বি.এ. পরীক্ষায় বাংলার পেপারসেটার বা প্রশ্নকর্তাও নিযুক্ত করেছিলেন। এসব ছাড়া, দেশবাসীও তাঁকে তখন ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী,’ ‘সাহিত্য সম্রাট’ এই আখ্যায় বিভূষিত করেছিলেন।বৈদ্যবাটী যুব সংঘ, শিবপুর সাহিত্য সংসদ, যশোহর সাহিত্য সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ও সাধারণভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে একাধিকবার তাঁকে সম্বর্ধনা জানান হয়।
শরৎচন্দ্র কেবল গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকই ছিলেন না, তাঁর চরিত্রে আরও অনেকগুলি গুণ ছিল। তাঁর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল- মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কি জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত।
পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ ছিল বেশী। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।
জীবজন্তুর প্রতি স্নেহবশতঃ শরৎচন্দ্র বহু বছর সি.এস.পি.সি.এ. অর্থাৎ কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন।
এক সময় অবশ্য তিনি একজন ছোটখাট শিকারীও ছিলেন। তখন ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এবং বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতে তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। পরে এসব ছেড়ে দেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মত অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন।
আর তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল পত্নীপ্রেমিক।বিলাসী না হলেও কিছুটা সৌখিন ছিলেন- বিশেষ করে বেশভূষায় ও লেখার ব্যাপারে। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ পরিহাস-রসিকতা করতেন। আত্ম-প্রচারে সর্বদাই বিমুখ ছিলেন এবং নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখন পছন্দ করতেন না।
শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ ক’বছর শরীর আদৌ ভাল যাচ্ছিল না। একটা-না-একটা রোগে ভুগছিলেনই। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনি কিছুদিন জ্বরে ভোগেন। জ্বর ছাড়লে ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থাকেন।
দেওঘর থেকে এসে কিছুদিন সুস্থ থাকার পর শরৎচন্দ্র সেপ্টেম্বর মাসে আবার অসুখে পড়লেন। এবার তাঁর পাকাশয়ের পীড়া দেখা দেয় এবং দেখতে দেখতে এই রোগ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। যা খান আদৌ হজম হয় না। তার উপর পেটেও যন্ত্রণা দেখা দেয়।
শরৎচন্দ্র এই সময় সামতাবেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।চিকিৎসা করাবার জন্য কলকাতার বাড়িতে এলেন। কলকাতায় ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখলেন, শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার ত হয়েইছে, অধিকন্তু এই ব্যাধি তাঁর পাকস্থলীও আক্রমণ করেছে।
এই সময় শরৎচন্দ্র একটি উইল করেন। উইলে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে জীবনস্তত্বে দান করেন। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যর পর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকাশচন্দ্রের পুত্র বা পুত্ররা সমস্থ সম্পতির অধিকারী হবেন, উইলে এ কথাও লেখা হয়।(হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীর মৃত্যর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্য তারিখ ১৫ই ভাদ্র, ১৩৬৭।)
কলকাতার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগন-ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায় প্রভৃতি শরৎচন্দ্রকে দেখে স্থির করলেন যে, শরৎচন্দ্রের পেটে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
ডাঃ ম্যাকে সাহেবের সুপারিশে শরৎচন্দ্রের চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার ৫নং সুবার্বন হস্পিটাল রোডে একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু এখানে শরৎচন্দ্রকে তাঁর নেশার জিনিস সিগারেট খেতে না দেওয়ায়, তিনি কষ্ট বোধ করতে লাগলেন।
এই নার্সিং হোমে সকালে ও বিকালে দেখা করবার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময় কাকেও শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে দিত না। তাছাড়া ইউরোপীয় নার্সরা এদেশীয় লোক বলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নাকি ভাল ব্যাবহার করতেন না। এই সব কারনে শরৎচন্দ্র দুদিন পরে সেখান থেকে চলে এসে তাঁর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ডাঃ সুশীল চ্যাটার্জীর ৪ নং ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত ‘পার্ক নার্সিং হোমে’ ভর্তি হলেন।
শরৎচন্দ্রের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন এক পত্রে লিখেছিলেন-
কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১।১২।৩৭
সেই সময়কার বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অপারেশন করেছিলেন।
অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হল না।
অপারেশন হয়েছিল ১২।১।৩৮ তারিখে। এর পর শরৎচন্দ্র মাত্র আর চারদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটা ছিল রবিবার, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী(বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা মাঘ)। এই দিনই বেলা দশটা দশ মিনিটের সময় শরৎচন্দ্র সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বৎসর ৪ মাস।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন-‘ যিনি বাঙালীর জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি’।
এর কয়েকদিন পরে ১২ই মাঘ তারিখে কবি আবার শরৎচন্দ্রের মৃত্যু সম্পর্কে এই কবিতাটি লিখেছিলেন-
যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।
সব শেষে শরৎচন্দ্রের রচিত গ্রন্থগুলি প্রকাশের একটা কালানুক্রমিক তালিকা এখানে দেওয়া গেল। এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, এই গ্রন্থগুলি ছাড়া শরৎচন্দ্রের কিছু অসামাপ্ত এবং টুকরো লেখাও আছে-
১৯১৩ সেপ্টেম্বর ... বড়দিদি (উপন্যাস)
১৯১৪ মে ... বিরাজ বৌ (উপন্যাস)
জুলাই ... বিন্দুর ছেলে (গল্প-সমষ্টি)
আগষ্ট ... পরিণীতা (গল্প)
সেপ্টেম্বর ... পণ্ডিতমশাই (উপন্যাস)
১৯১৫ ডিসেম্বর ... মেজদিদি (গল্প-সমষ্টি)
১৯১৬ জানুয়ারী ... পল্লী-সমাজ (উপন্যাস)
মার্চ ... চন্দ্রনাথ (উপন্যাস)
আগষ্ট ... বৈকুন্ঠের উইল (গল্প)
নভেম্বর ... অরক্ষণীয়া (গল্প)
১৯১৭ ফেব্রুয়ারী ... শ্রীকান্ত ১ম পর্ব (উপন্যাস)
জুন ... দেবদাস (উপন্যাস)
জুলাই ... নিষ্কৃতি (গল্প)
সেপ্টেম্বর ... কাশীনাথ (গল্প-সমষ্টি)
নভেম্বর ... চরিত্রহীন (উপন্যাস)
১৯১৮ ফেব্রুয়ারী ... স্বামী (গল্প-সমষ্টি)
সেপ্টেম্বর ... দত্তা (উপন্যাস)
সেপ্টেম্বর ... শ্রীকান্ত ২য় পর্ব (উপন্যাস)
১৯২০ জানুয়ারী ... ছবি(গল্প-সমষ্টি)
মার্চ ... গৃহদাহ (উপন্যাস)
অক্টোবর ... বামুনের মেয়ে (উপন্যাস)
১৯২৩ এপ্রিল ... নারীর মূল্য (প্রবন্ধ)
আগষ্ট ... দেনা-পাওনা (উপন্যাস)
১৯২৪ অক্টোবর ... নব-বিধান (উপন্যাস)
১৯২৬ মার্চ ... হরিলক্ষ্মী (গল্প-সমষ্টি)
আগস্ট ... পথের দাবী (উপন্যাস)
১৯২৭ এপ্রিল ... শ্রীকান্ত ৩য় পর্ব (উপন্যাস)
আগস্ট ... ষোড়শী (‘দেনা-পাওয়ানার’ নাট্যরূপ)
১৯২৮ আগস্ট ... রমা (‘পল্লী-সমাজে’র নাট্যরূপ)
১৯২৯ এপ্রিল ... তরুণের বিদ্রোহ (প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩১ মে ... শেষ প্রশ্ন (উপন্যাস)
১৯৩২ আগস্ট ... স্বদেশ ও সাহিত্য প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩৩ মার্চ ... শ্রীকান্ত ৪র্থ পর্ব (উপন্যাস)
১৯৩৪ মার্চ ... অনুরাধা, সতী ও পরেশ (গল্প-সমষ্টি)
ডিসেম্বর ... বিজয়া (‘দত্তা’র নাট্যরূপ)
১৯৩৫ ফেব্রুয়ারী ... বিপ্রদাস (উপন্যাস)
[মৃত্যুর পরে প্রকাশিত]
১৯৩৮ এপ্রিল ... ছেলেবেলার গল্প (তরুণপাঠ্য গল্প-সমষ্টি)
জুন ... শুভদা (উপন্যাস)
কাজী মহম্মদ
আশরাফ
প্রবন্ধ সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(সৌজন্য ; চিন্তা সূত্র )
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (১৮৭৬-১৯৩৮) নানা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যায়। তার সাহিত্যের
জনপ্রিয়তা তাকে উপমহাদেশের ভিনভাষী, ভিনজাতির ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। সমগ্র
উপমহাদেশে তিন ‘চন্দ্র’ই কথাসাহিত্যে রাজত্ব করেন। বাঙলা
সাহিত্যে শরৎচন্দ্র, হিন্দি সাহিত্যে প্রেমচন্দ (১৮৮০-১৯৩৬)১ ও উর্দু সাহিত্যে কৃষণ
চন্দর (১৯১৩-১৯৭৮)২। তিনজনই সমান জনপ্রিয়। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় এবং রাজ্যভাষায় তাদের সাহিত্য
অনূদিত হয়েছে। তাদের কারও জনপ্রিয়তাই সস্তার প্রতিশব্দ হিসেবে আসেনি। তাদের
সাহিত্যমান উঁচুদরের। পাশ্চাত্যে তাদের পাঠক, সমালোচক, গবেষক
ও ভক্ত-অনুরাগী রয়েছে।
আবার দেখা যায়,
তিনি বাঙলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রধান ছয়জন কথাসাহিত্যিকের অন্যতম। বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১),
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়;
তাঁদের মধ্যে কালক্রমে শরৎচন্দ্রের অবস্থান তৃতীয়, আর জনপ্রিয়তায় প্রথম। অবশ্য সাহিত্যমানের বিষয়ে নানা
মুনির নানা মত।
উত্তর-আধুনিক শিল্প সাহিত্যকে লেখক-শিল্পী নয়,
দর্শক-শ্রোতা-পাঠক নির্ভর গণ্য করা হয় পাশ্চাত্যে। কিন্তু
আমাদের দেশের বেশির ভাগ পাঠক সেই মানে পৌঁছে গেছে, এমন ভাবা যায় না।
আর যেহেতু শরৎচন্দ্র আধুনিক যুগের লেখক,
তাই তাঁকেও আধুনিক বিচারভঙ্গিতে বিচার করা উচিত। আধুনিক
যুগে সাহিত্যসমালোচনার যতগুলো পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই লেখককে জানার প্রয়োজনীয়তা ছিল। ক্রিয়া
এবং কর্ম কর্তারই অনুসারী, তাই সাহিত্যিককে জানতে পারলে
তাঁর সাহিত্যকর্মকে ভালোভাবে জানা সম্ভব।
সাহিত্যিককে জানার দুটি পথ আছে। প্রথমটি,
লেখকের জীবনী, আলোচনা, সমালোচনা, বিচার বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠ
করা।
দ্বিতীয়টি, লেখকের
আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী,
সমালোচনা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার পাঠ করা।
বাঙলা সাহিত্যের প্রধান ছয়জন (পূর্বে উল্লিখিত)
কথাসাহিত্যিকের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪),
‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫), ‘কমলাকান্তের দপ্তর’
(১৮৭৫), ‘বিবিধ সমালোচনা’ (১৮৭৬), ‘সাম্য’ (১৮৭৯), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮৭),
এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮) লেখকের চিন্তাধারা বোঝার জন্য উল্লেখযোগ্য
সাক্ষ্য বহন করে।
৩
রবীন্দ্রনাথের ‘আলোচনা’ (১৮৮৫),
‘সমালোচনা’ (১৮৮৮), ‘পঞ্চভূত’ (১৮৯৭),
‘প্রাচীনসাহিত্য’ (১৯০৭), ‘লোকসাহিত্য’
(১৯০৭), ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘আধুনিক
সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘শিক্ষা’ (১৯০৮), ‘ছন্দ’ (১৯৩৬), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬),
‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩), প্রভৃতি তার
সাহিত্য চিন্তাধারা বহন করার মতো প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২),
‘ছেলেবেলা’ (১৯৪০) প্রভৃতি আত্মজীবনী। আরও
আছে নয়টি ভ্রমণকাহিনী ও বারোটি পত্রসংকলন। এক রবীন্দ্রনাথকে জানা ও বোঝার
জন্য অজস্র উপাদান।
বিভূতিভূষণ গল্প-উপন্যাস ছাড়াও লিখেছেন ‘বিচিত্র
জগৎ’ (১৯৩৭), ‘আমার লেখা’ (১৯৬১), ‘স্মৃতির রেখা’ (১৯৪১), ‘তৃণাঙ্কুর’ (১৯৪৩),
‘উৎকর্ণ’ (১৯৪৬), ‘অন্তরঙ্গ দিনলিপি’ (১৯৭৬)
প্রভৃতি।
এগুলো ছাড়া আরও কিছু স্মৃতিকথা,
প্রবন্ধগ্রন্থ ও ভ্রমণকাহিনী আছে। যেমন,
‘অভিযাত্রিক’ (১৯৪১), ‘বনে পাহাড়ে’ (১৯৪৫)
ও ‘হে অরণ্য কথা কও’ (১৯৪৮)।
এ তিনটি ভ্রমণকাহিনী পড়লে তাঁর প্রকৃতিপ্রেম এবং পরিবেশজ্ঞান
সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ব্যক্তিজীবনের সরলতার উৎস এবং ‘আরণ্যক’ (১৯৪৯) উপন্যাসের
চরিত্রদের বোঝা যায়।
৬
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ষাটটি উপন্যাস আর অনেক
গল্প,
৬টি নাটক ও অনেক গান লিখেছেন। স্মৃতিকথা
লিখেছেন ‘আমার কালের কথা’ (১৯৫১), ‘আমার সাহিত্য জীবন’-
প্রথম খণ্ড (১৯৫৩), দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬২)। এছাড়া
‘লেখার কথা’ (?), ‘যে বই লিখতে চাই’ (?), ‘আমার চোখে কপালকুণ্ডলা’ (?), ‘আমি যদি আমার সমালোচক
হতাম’ (?), ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ (?), ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী’ (?) ইত্যাদি প্রবন্ধ-সমালোচনাগ্রন্থ
রয়েছে।
‘মস্কোতে কয়েকদিন’ নামে আছে ভ্রমণ কাহিনীও। বিপুল পরিমাণ গল্প-উপন্যাস-নাটক
ও গান ভালোভাবে বুঝতে হলে তারাশঙ্করের এসব রচনা পাঠ করা প্রয়োজন।৭
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অল্পসময়ে অনেক বেশি লিখেছেন। তবে
তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ মাত্র একটি, ‘লেখকের কথা’ (১৯৫৭)৮। প্রবন্ধ-নিবন্ধ
কম লেখা এবং তাঁর সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল বেশি থাকার কারণে বইটি বহুল আলোচিত। ওই
গ্রন্থভুক্ত ষোলোটি প্রবন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ
অগ্রন্থিত রয়ে গেছে।৮
এবার আমাদের আলোচ্য লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সম্পর্কে আসি।
তাঁর রচনার পরিমাণ অনেক। তবে
প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র তিনটি।
‘নারীর মূল্য’ (১৯২৪), ‘তরুণের বিদ্রোহ’ (১৯৩০)
ও ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ (১৯৩২)।৯
তাঁরও অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা, সমালোচনা, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ভাষণ-অভিভাষণ, শোকপ্রস্তাব, মানপত্র, পুস্তক সমালোচনা এবং চিঠিপত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে,
গ্রন্থভুক্ত হয়নি। নারীর মূল্যের মতো ‘মূল্য’
সিরিজে অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা ছিল, বেঁচে থাকলে
হয়তো লিখতেন।১০
তবে শরতের প্রবন্ধসাহিত্য অনালোচিত এবং অবহেলিত রয়ে গেছে।
নারীর মূল্য
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ
নারীর মূল্য প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২০ সনের বৈশাখ থেকে আষাঢ় এবং ভাদ্র থেকে আশ্বিন সংখ্যা
‘যমুনা’ পত্রিকায়।
যমুনা ফণীন্দ্রনাথ পাল সম্পাদিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। প্রবন্ধটি
শরৎচন্দ্রের বড়দিদি অনিলা দেবীর নামে প্রকাশিত হয়। ‘যমুনা’ এ যুগের লিটল ম্যাগাজিন। এর
প্রকাশনা বার বার বিঘ্নিত হয়েছে।
প্রথম যখন ধীরেন্দ্রনাথ পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এর
পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬।
আকার ২৩X১৫ সেমি। দ্বিতীয়বার
প্রকাশিত হয় ধীরেন্দ্রনাথ পালের মৃত্যুর পরে ফণীন্দ্রনাথ পালের সম্পাদনায় ৩২ পৃষ্ঠায়। আকার
২৩X১৮
সেমি। শরৎচন্দ্রও
কয়েক মাস কাগজটি সম্পাদনা করেছেন।
তিনি এটিকে ছোটকাগজই বলেছেন।১১
নারীর মূল্য
পত্রিকা ছোট, লেখক কম, তাই পত্রিকার স্বার্থে শরৎচন্দ্রকে তিনটি
নামে লিখতে হয়েছে।
১৯১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে রেঙ্গুন থেকে ফণীন্দ্রনাথ পালকে
এক চিঠিতে লিখেছেন,
‘আমার
তিনটে নাম
সমালোচনা প্রবন্ধ প্রভৃতি- অনিলা দেবী
ছোটগল্প- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বড়গল্প- অনুপমা।
সমস্তই এক নামে হলে লোকে মনে করবে,
এই লোকটি ছাড়া আর বুঝি এদের কেউ নেই।’ ১২
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে,
নারীবাদী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিখ্যাত ‘নারী’ গ্রন্থে জানিয়েছেন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমকালীন নারী লেখকদের প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে
নারীর নাম ধারণ করে ‘নারীর লেখা’ নামে একটি নারীবিদ্বেষী প্রবন্ধ লেখেন। নারীর
লেখা প্রবন্ধটিতে যাই লেখা থাক না কেন, শরৎচন্দ্র
কেন অনিলা দেবী নামে লিখতেন এ তথ্যটুকু ড. হুমায়ুন আজাদের অজানা থাকাটা দুঃখজনক।
নারীর মূল্য প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় চৈত্র
১৩৩০ বঙ্গাব্দে, ১৮ মার্চ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। মাঝখানের
দশ বছরে এ রচনা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। শরৎচন্দ্রের
লেখা চিঠিপত্র থেকে জানা যায়।
‘নারীর
মূল্য’ মূলত সাহিত্যগ্রন্থ না কি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণাগ্রন্থ বইটি পড়ার সময় মনে বারবার
এ প্রশ্ন ওঠে।
কোনও সাহিত্যগ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়নি এ গ্রন্থে,
অথচ সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের অজস্র উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে।
‘নারীর
মূল্য’ যদিও ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের ঢংয়ে লিখিত (তখনকার বেশিরভাগ প্রবন্ধেই লেখকের
আমিত্ব নিয়ে অনুপ্রবেশ ছিল স্বাভাবিক।
তবু এটিকে সাহিত্যিক প্রবন্ধ না বলে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা
প্রবন্ধই বলা ভালো।
দেশ-বিদেশের অজস্র তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। প্রবন্ধটি
একটানা এবং দীর্ঘ- পঞ্চাশ পৃষ্ঠারও বেশি। পরিচ্ছেদ বিভাগ নেই। পাঠকের
অখণ্ড মনোযোগ দাবি করে।
প্রবন্ধের সর্বশেষ অনুচ্ছেদটি হারবার্ট স্পেনসারের
বিশাল উদ্ধৃতি।
এর আগের অনুচ্ছেদটিতে লেখকের প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য প্রকাশ
করা হয়েছে।
‘নারীর
মূল্য কেন হ্রাস পাইয়াছে এবং বাস্তবিক পাইয়াছে কিনা এবং মূল্য হ্রাস পাইলে সমাজে কি
অমঙ্গল প্রবেশ করে এবং নারীর উপর পুরুষের কাল্পনিক অধিকারের মাত্রা বাড়াইয়া তুলিলে
কি অনিষ্ট ঘটে, তাহা নিজের কথায় ও পরের কথায় বলিবার চেষ্টা
করিয়াছি- এই মাত্র।’
শরৎচন্দ্র একেবারে তরুণ বয়সে লেখালেখির জগতে
আসেননি;
এসেছেন মধ্য তিরিশের পরে। তবে
লেখক জীবনের শুরুর দিকের রচনা বলে এখানে বেশ সাহস দেখিয়েছেন। যে
উদ্দেশ্য নিয়ে প্রবন্ধটি রচনা করেছেন, তা করতে
গিয়ে শাস্ত্রের অসম্মান করা হয়েছে কি না, দেশাচারের ওপর কটাক্ষ
করা হয়েছে কি না তা ভেবে কোথাও থামেননি। লিখেছেন,
‘যাহা সত্য তাহাই বলিব এবং বলিয়াছিও, অবশ্য
ফলাফলের ভার পাঠকের ওপর।’
প্রবন্ধটির তথ্য ও বক্তব্য চারটি সূত্রে গৃহীত
হয়েছে দেখা যায়।
১.
লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ধারণা ও
বক্তব্য।
২.
লেখকের জানা, শোনা ঘটনা, বক্তব্য এবং আলোচনা।
৩.
দেশের বিভিন্ন লেখকের রচনা থেকে গৃহীত ধারণা ও উদ্ধৃতি।
৪.
বিদেশী লেখকদের গ্রন্থ থেকে আহরিত ধারণা, মন্তব্য এবং উদ্ধৃতি।
শরৎচন্দ্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাই থাকনা
কেন,
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনা বিপুল। তাঁর
বাবার লেখালেখির হাত ছিল।
বন্ধু-বান্ধবী, মামা ও
দিদিরও লেখালেখির অভ্যাস ছিল।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি,
এজন্য ব্যক্তিগত জীবনে বিপুল পড়াশোনা করে সে ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা
করেছেন।
প্রমথ চৌধুরীর কথা তাঁর ক্ষেত্রেও সত্য;
‘শিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।’
কানপুর প্রবাসী ‘মিলন’ উপন্যাস-খ্যাত লীলারাণী
বন্দ্যোপাধ্যায়কে শরৎচন্দ্র ছোটবোনের মতো স্নেহ করতেন। ২৪
আগস্ট ১৯১৯ তারিখে তাঁকে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছেন, ‘আমার বিদ্যেসিদ্যে কিছু নেই। বড়
দরিদ্র ছিলাম- ২০ টি টাকার জন্য একজামিন দিতে পাইনি। এমন
দিন গেছে যখন ভগবানকে জানাতাম, হে ভগবান, আমার কিছুদিনের জন্য জ্বর দাও তা’হলে দু’বেলা খাবার ভাবনা ভাবতে হবে না,
উপবাস করেই দিন কাটবে। অবশ্য
বেশিদিনের জন্য এ অবস্থা ছিল না।
মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা পাগলের মতো হয়ে যা কিছু ছিল সমস্ত
বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে স্বর্গগত হন।
তারপরে পড়তে শুরু করি। ১৪
বছর ১৪ ঘণ্টা ধরে পড়ি।
সেই যে একজামিন দিতে পারিনি,
কেবল সেই রাগে।’ ১৩
সেই ১৪ বছর পর্যন্ত দৈনিক ১৪ ঘণ্টা করে পড়ার
কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায় ‘নারীর মূল্য’তেই। এত তথ্যের সম্ভার আর কোনও রচনায়
নেই। ব্যক্তিগত
চিঠিপত্রে কিছুটা আছে।
শরৎচন্দ্রের বহুভাষিতাও সমৃদ্ধ। ভবঘুরের
মতো ঘুরে বেড়ানোর ফলে ভারতের বিভিন্ন ভাষা জানা ছিল। বার্মিজ
ভাষা জানতেন রেঙ্গুন থাকার ফলে।
বার্মিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভালোভাবে না জানলে ‘ছবি’র মতো গল্প
তার হাত দিয়ে রচিত হতো না।
পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে জানার জন্য
অতি প্রয়োজনীয় ইংরেজি তো জানতেনই ফরাসিও শিখেছিলেন। জোড়াসাঁকোর
ঠাকুর পরিবারে অভিজাত ফরাসি ভাষার চর্চা ছিল। ছিল
প্রমথ চৌধুরীদের বাড়িতেও।
ইন্দিরা দেবী ছিলেন এ বাড়ির বউ। তিনি
কাকা রবীন্দ্রনাথকে ফরাসি শেখাতেন।
২০ শে বৈশাখ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে রাধারাণী দেবীকে লেখা এক চিঠিতে
শরৎচন্দ্র ফরাসি বর্ণমালায় দুই লাইনের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গক্রমে ফরাসি ভাষার
কথা জানান।
১৪
কাজেই শরৎচন্দ্রের উচ্চতর জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে
কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তিনি প্রমথ চৌধুরীর ভক্ত। তাঁকে
বোধহয় শ্রদ্ধা করতেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি। শরৎচন্দ্রের
হালকা কথায় ভারী বিষয় লেখার অভ্যাসটা বোধ হয় প্রমথ চৌধুরীর কাছ থেকে পাওয়া। তবে
কথাসাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্র অনেক বড় এ লক্ষণটা তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যেও দেখা যায়।
‘নারীর
মূল্য’ প্রবন্ধটি তিনি শুরু করেছেন নারীর উপযোগ মূল্য নির্ণয়ের ভঙ্গি দিয়ে। শরৎসাহিত্যে
হিউমার ও স্যাটায়ার উভয়ই আছে।
তিনি হিউমার বেশি ব্যবহার করেছেন বলে স্যাটায়ার হয়ে উঠেছে
খুবই সূক্ষ্ম।
গভীর মনোযোগ দিয়ে না পড়লে অনেক সময় ধরা যায় না। এ
প্রবন্ধের শুরুটাও অনেকটা এমন, ‘মণি-মাণিক্য মহামূল্যবান
বস্তু, কেননা তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই
হিসাবে নারীর মূল্য বেশি নয়, কারণ সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্যা
নহেন।’
আবার অন্যত্র লিখেছেন,
‘সুসভ্য মানবের সংযত শুভবুদ্ধি যে অধিকার রমণীজাতিকে সমর্পণ করতে
বলে, তাহাই মানবের সামাজিক নীতি এবং তাহাতেই সমাজের কল্যাণ
হয়।
কোন একটা জাতির ধর্মপুস্তকে কি আছে না আছে,
তাহাতে হয় না।
নারীর মূল্য বলিতে আমি এই নীতি ও অধিকারের কথাই এতদূর পর্যন্ত
বলিয়া আসিতেছি।
Supply Ges
Demand-এর কথাও বলি নাই।
এ প্রবন্ধে নারী সম্পর্কে দশটি দিকে আলোকপাত
করেছেন লেখক।
দিকগুলো নিম্নরূপ:
১.
এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর
ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন জাতির
প্রাচীন সমাজে নারীর অবস্থান।
২.
বিভিন্ন মহাদেশে, বিভিন্ন রাষ্ট্রে নারীর সমকালীন
অবস্থা।
৩.
বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে নারীর অবস্থান।
৪.
বিভিন্ন ধর্ম বা শাস্ত্রে নারীর অবস্থান।
৫.
দেশ-বিদেশের মনীষীদের মতামত।
৬.
সিংহ এবং অন্যান্য ইতর প্রাণীর মধ্যে স্ত্রী প্রজাতির প্রতি পুরুষ প্রজাতির
আচরণ এবং মানব (সভ্য) সমাজে তার প্রভাব।
৭.
নারী নির্যাতনের ইতিহাস।
৮.
নারীর অবমূল্যায়নে লিঙ্গ নির্বিশেষে সব শিশুর প্রতি অবহেলা দেখা দেওয়া।
৯.
নারী পুরুষ সম্পর্কের চারটি সূত্র নির্ণয় ও বিশ্লেষণ (স্ত্রী,
ভগিনী, কন্যা ও জননী)।
১০.
অ্যাডাম স্মিথের মূল্যতত্ত্বের মাধ্যমে দেখিয়েছেন চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে
নয়,
নারীর মূল্য প্রাকৃতিক কারণে।
এ যুগের নারীবাদীরা শরৎচন্দ্রের এ গ্রন্থের মতো
তথ্যবহুল গ্রন্থ খুব বেশি রচনা করতে পারেননি আজ পর্যন্ত। তবে
তারা লেখকের সঙ্গে দুটি বিষয়ে সম্ভবত একমত হবেন না।
প্রথম বিষয়: পুরুষের সমস্ত কাজ নারী করতে পারে
না এবং নারীর সমস্ত কাজও পুরুষ করতে পারে না।
দ্বিতীয় বিষয়: লেখকের ভাষায়,
‘নারীর মূল্য নির্ভর করে পুরুষের স্নেহ, সহানুভূতি ও ন্যায়ধর্মের উপরে। ভগবান
তাহাকে দুর্বল করিয়াই গড়িয়াছেন।’
তরুণের বিদ্রোহ
তরুণের বিদ্রোহ : প্রবন্ধটি ১৯২৯ সালের ৩০ মার্চ
রংপুর বঙ্গীয় যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণ। পরে
এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সে বছরই পরের মাসে। ১৮
এপ্রিল ১৯২৯ সারে কলকাতার সরস্বতী লাইব্রেরি এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। ১৬
আরেক সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রবন্ধটি
১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যা ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৫
১৯৩২ সালের ২৩ আগস্ট প্রবন্ধটি পরিবর্তিত আকারে
২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
এবং এ গ্রন্থে ‘সত্য ও মিথ্যা’ নামে আরও একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত
করা হয়।১৬
উল্লেখ্য, ‘নারায়ণ’ সে সময় চিত্তরঞ্জন দাশ (তখনও দেশবন্ধু হননি) সম্পাদিত রবীন্দ্রবিরোধী
মাসিক পত্রিকা হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯ বাইরে যত সামাজিকতা এবং
বিনয় থাকুক না কেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্কে এক ধরনের দূরত্ব ছিল। তা
ছিল শিল্পাদর্শ, রাজনৈতিক মতাদর্শ এমনকি ব্যক্তিগত কারণেও। শরৎচন্দ্রের
প্রবন্ধ এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে তার অজস্র প্রমাণ আছে।
অন্যদিকে চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন শরৎচন্দ্রের প্রিয়
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
তাঁরই আহ্বানে শরৎচন্দ্র প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেন। ১৯২১
সালে তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। এক
যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো,
রবীন্দ্রবিরোধী কাগজে ছাপা হলেও এ রচনায় রবীন্দ্রনাথ, তাঁর লেখা কিংবা তাঁর মতাদর্শের বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয়নি। বরং
চিন্তার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতোই মত প্রকাশ করেছেন ‘চরকা’ নিয়ে। যদিও
তখন তিনি গান্ধীবাদী কংগ্রেসের জেলা পর্যায়ের নেতা। অবশ্য
রবীন্দ্রনাথের ‘কালান্তর’র প্রবন্ধ অনেক পরের রচনা। উভয়েরই
‘চরকা’বিরোধিতা অনেক দিক দিয়ে কাছাকাছি। শরৎচন্দ্র করেছেন এভাবে,
‘আমাদের ওদিকে চাষাভূষো দরিদ্র ঘরের মেয়েদের উদয়াস্ত খাটুনি। তারই
ফাঁকে আধঘণ্টা যদি সময় পায়, মহাত্মার আদেশ জানিয়ে চরকার
হাতল হাতে তার গুঁজে দিলেও ঘুমিয়ে পড়ে। দোষ
দিতে পারিনে।
বোধ হয় সত্যিকার প্রয়োজন নেই বললেই এমনি ঘটে।’
কাজী নজরুল ইসলামের ওপর এ প্রবন্ধের যথেষ্ট প্রভাব
লক্ষ্য করা যায়।
নজরুলের ‘তরুণের সাধনা’ প্রবন্ধটি নামকরণ এবং বিষয়বস্তুর
দিক দিয়ে এ প্রবন্ধের নিকটবর্তী।
শুধু স্বভাবগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়,
নামকরণ হয়েছে বিপরীত। শরৎচন্দ্র
তাঁর প্রবন্ধ পাঠ করেন ১৯২৯ সালে ৩০ মার্চ রংপুরে। আর
নজরুল তাঁর প্রবন্ধ পাঠ করেন ১৯৩২ সালের ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে। স্থান
ও কাল দু’দিক থেকেই কাছাকাছি।
বিষয়বস্তুর মিলও লক্ষণীয়। শরৎচন্দ্র
লিখেছেন,
‘তরুণেরা তরুণ জাতি- তাদের আর কোনো নাম নেই।’১৭
আর নজরুল লিখেছেন,
‘ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের- তাহারাই তরুণ। আমাদের
দেশ নাই,
জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই।’১৮
একই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র এবং নজরুলের চেতনাগত
মিল থাকার এটাও একটা কারণ হতে পারে যে, চিত্তরঞ্জন
১৯২৫ সালে মৃত্যুবরণ করার কয়েক বছর আগের কয়েকটি বছর রাজনীতিতে এত বেশি ব্যস্ত ছিলেন
সাহিত্যচর্চা করার সময় পাননি।
‘নারায়ণ’ একটি রুচিশীল পত্রিকা, কিন্তু সম্পাদকের রাজনৈতিক
ব্যস্ততার কারণে এটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে; এ সময় পত্রিকাটি
বাঁচাতে এগিয়ে আসেন জনপ্রিয় এই দুই লেখক। ‘নারায়ণ’কে কেন্দ্র করে তাদের
দুজনের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে।১৯
এ প্রবন্ধে সাহিত্য নয়,
রাজনীতিই মুখ্য আলোচ্যবিষয়। মূলকথাগুলো
নিম্নরূপ:
১.
তরুণ শক্তি প্রস্তুত না থাকলে শুধু শুধু বিপ্লবের জন্য বিপ্লব আনা যায় না। অর্থহীন
অকারণ বিপ্লবের চেষ্টায় কেবল রক্তপাতই ঘটে, আর কোনও
ফল লাভ হয় না।
লেখকের ভাষায়, ‘বিপ্লবের
সৃষ্টি মানুষের মনে, অহেতুক রক্তপাতে নয়। তাই
ধৈর্য ধরে তার প্রতীক্ষা করতে হয়।
ক্ষমাহীন সমাজ, প্রীতিহীন
ধর্ম, জাতিগত ঘৃণা অর্থনৈতিক বৈষম্য, মেয়েদের প্রতি চিত্তহীন কঠোরতা এর আমূল প্রতিকারে বিপ্লব-পন্থাতেই শুধু
রাজনৈতিক বিপ্লব সম্ভবপর হবে।
নইলে অসহিষ্ণু অভিলাষ ও কল্পনার আতিশয্যে তোমাদের ব্যর্থতা
ছাড়া আর কিছুই দেবে না।
এ কথায় মনে হয়,
শরৎচন্দ্র মনে করতেন স্বাধীনতার সংগ্রামে বিপ্লবই অপরিহার্য এবং একমাত্র
পন্থা নয়।
২. বিপ্লবী রাজনীতিবিদগণের নয় শুধু,
গান্ধীবাদীদেরও সমালোচনা করেছেন লেখক।
সত্যমিথ্যা: এ প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে শরৎচন্দ্রের
একটি প্রবাদপ্রতিম বিখ্যাত উক্তি দিয়ে, ‘পিতলকে
সোনা বলিয়া চালাইলে সোনার গৌরব ত বাড়েই না, পিতলটারও জাত যায়।’ প্রবন্ধটি অভিনয় নিয়ন্ত্রণ
আইন,
সাহিত্যকর্মে নিষেধাজ্ঞা ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের হয়রানির প্রতিবাদে
রচিত।
এর প্রথম অংশ ‘বাংলার কথা’ পত্রিকায় ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে
প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয় অংশ প্রকাশিত হয় একই পত্রিকায় ২০ মাঘ ও ৫ ফাল্গুন
১৩২৮ বঙ্গাব্দে।
ব্রিটিশ সরকারের রাজরোষ কিভাবে শিল্পী-সাহিত্যিকের
জিভ কেটে,
হাত-মুখ বেঁধে রেখেছে। কী
এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দিন যাপন করেছেন এ দেশের লেখকেরা তার ইতিহাস এ প্রবন্ধ। বঙ্কিমচন্দ্রের
‘চন্দ্রশেখর’ মঞ্চস্থ করার সময় রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ইংরেজ চরিত্রের নাম ও জাতি বদলে
দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবৃত্তি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের
বিখ্যাত কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’র বিশেষ-বিশেষ অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে ইংরেজ সরকারের ভয়ে। কিভাবে
লেখকের সত্যকে সরকার মিথ্যা বলে পরিত্যাগ করেছে। আর
সরকারের মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছে তার প্রতিক্রিয়া এ প্রবন্ধ। লেখকের
বক্তব্য,
‘ভাষা যেখানে দুর্বল, শঙ্কিত, সত্য যে দেশে মুখোশ না পরিয়া মুখ বাড়াইতে পারেনা, যে রাজ্যে লেখকের এত বড় উঞ্ছবৃত্তি করিতে বাধ্য হয়, সে দেশে রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি সমস্তই যদি হাত ধরাধরি করিয়া কেবল নীচের দিকে নামিতে থাকে,
তাহাতে আশ্চর্য হইবার কী আছে?’২০
স্বদেশ ও সাহিত্য
‘স্বদেশ
ও সাহিত্য’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে। প্রকাশক
: আর্য পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা। এ
গ্রন্থে চারটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়।
প্রবন্ধগুলো:
১.
ভবিষ্যৎ বঙ্গসাহিত্য ( বরিশালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় প্রদত্ত অভিভাষণ-১৯২৩)
২.
সাহিত্য ও নীতি (নদীয়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণ-১৯৩৫)
৩.
সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি (মুন্সীগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভার সভাপতির
অভিভাষণ-১৯২৪)
৪.
আধুনিক সাহিত্যের কৈফিয়ত (শিবপুর ইন্সস্টিটিউটের সাহিত্যসভায় সভাপতির অভিভাষণ
১৩৩০)
বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে চারটি প্রবন্ধই কাছাকাছি। এ
গ্রন্থের বাইরের আরেকটি প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের রীতি ও নীতি’,
সেটিও বিষয়ের দিক দিয়ে নিকটতম। এ
প্রবন্ধটি ১৩৪৪ সনের আশ্বিন সংখ্যা ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর
মাত্র দুই মাস আগে প্রকাশিত এটিই সম্ভবত শেষ পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ।
ভবিষ্যৎ বঙ্গসাহিত্য প্রবন্ধে লেখক প্রধানত সাহিত্যিক
পরিবেশের কথা বলেছন।
‘সত্য ও মিথ্যা’য় যে কথা বিশ্লেষণ করেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। এখানে
সেই কথাটিই ভবিষ্যৎ সাহিত্য রচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির পূর্বশর্ত বিবেচনা করেছেন। লেখকের
মতে,
‘আমাদের সাহিত্যে নতুন জিনিস দেবার জো নেই। ইউরোপের
কথা ধরুন।
ওদের Church আছে, Navy আছে,
Army আছে। ওদের
অবাধ মেলামেশা আছে, আনন্দ আছে। আমাদের
এদিকে যাওয়ার জো নেই, ওদিকে যাওয়ার জো নেই।
এদেশে রাজদ্রোহী হওয়ার আশঙ্কা মাথা রেখে সাহিত্যচর্চা
করতে হতো।
লেখকের ধারণা, ‘তাই আমার
মনে হয়, বড় সাহিত্যিক আমাদের দেশে তখন আর জন্মাবে না। রাজনীতিতে,
ধর্মে, সামাজিক আচার-ব্যবহারে যেদিন আমাদের
হাত বাঁধা, পা গুটানো থাকবে না, যেদিন
আনন্দের ভেতর দিয়ে লিখতে পারা যাবে, সেই দিন আবার সাহিত্য
সৃষ্টির দিন ফিরে আসবে।’
‘সাহিত্য
ও নীতি’ প্রবন্ধের নামকরণেই বিষয়বস্তু অনুমান করা যায়। শরৎচন্দ্র
এ প্রবন্ধে তাঁর জীবনদর্শন প্রকাশ করেছেন মূল্যতত্ত্বের মিশ্রণে। পরকাল
তার জানা নেই, তাই আলোচ্য নয় বলে জানিয়েছেন। কিন্তু
ইহলোকে বিশ্বমানব যে লক্ষ্যের দিকে নিরন্তর চলেছে তার তিনটি অংশ- Art, Morality এবং
Religion. তাঁর
মতে যা কিছু অসুন্দর, অকল্যাণকর তা Art হতে
পারে না তিনি Art for
art’s sake তত্ত্বে সরাসরি অবিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
Idealistic এবং
Realistic তত্ত্বের
দ্বন্দ্বও তিনি অস্বীকার করেছেন।
এ দু’টিকে পৃথক করার পক্ষপাতী নন তিনি। এ
প্রসঙ্গে তাঁর মত এমন, ‘Art জিনিসটা
মানুষের সৃষ্টি।
সে nature নয়। সংসারে
যা কিছু ঘটে এবং অনেক নোংরা জিনিসই ঘটে- তা কিছুতেই সাহিত্যের উপাদান নয়। প্রকৃতি
বা স্বভাবের হুবহু নকল করা Photography হতে পারে,
কিন্তু সে কি ছবি হবে? দৈনিক খবরের কাগজে
অনেক কিছু রোমহর্ষক ভয়ানক ঘটনা ছাপা থাকে, সে কি সাহিত্য?’
সাহিত্যের সঙ্গে নীতির পার্থক্য আলোচনা করতে
গিয়ে লেখক এ প্রবন্ধের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। বিশেষ
করে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে গোবিন্দ লালের পিস্তলের গুলিতে রোহিণীর মৃত্যু হওয়াটা
তিনি কখনই মেনে নিতে পারেননি।
মৃত্যুর জন্য তিনি আক্ষেপ করেননা,
করেন, অকারণ অহেতুক জবরদস্তির অপমৃত্যুতে। হতভাগিনীর
মরণে পাঠক-পাঠিকার সুশিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সমাজের বিধি ও নীতির কনভেনশন সমস্তই বেঁচে
গেল সন্দেহ নেই, কিন্তু তার মৃত্যু হয়েছে সত্য সুন্দর
আর্ট এর।
লেখকের মতে, ‘উপন্যাসের
চরিত্র শুধু উপন্যাসের আইনেই মরতে পারে, নীতির চোখ রাঙানিতে
তার মরা চলে না ।’
লেখক তাঁর নিজের পল্লীসমাজ উপন্যাসেরও প্রসঙ্গ
টেনেছেন।
এ উপন্যাসে বিধবা রমা তার বাল্যবন্ধু রমেশকে ভালোবাসে,
এটা নীতিবাদীদের কাছে ভালো লাগেনি। যতীন্দ্র
মোহন সিংহ এ উপন্যাসের বিরুদ্ধে ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা’ নামে প্রবন্ধ লিখে তীব্র
ধিক্কার জানান।
বিষয়টি নীতিগত কিন্তু শিল্পসম্মত নয়। শরৎচন্দ্র
মনে করেন,
দুনিয়ায় যা কিছু সত্য ঘটে, নির্বিচারে তাকেই
সাহিত্যের উপকরণ করলে সত্য হতে পারে, সত্য-সাহিত্য হয় না। এভাবে
তিনি ধর্ম, নীতি ও সত্যের সঙ্গে শিল্পের পার্থক্য
নিরূপণ করেছেন।
‘সাহিত্যে
আর্ট ও দুর্নীতি’ প্রবন্ধটি পূর্বোক্ত প্রবন্ধের অংশ বলেই মনে হয়। যদিও
এর রচনাকাল এগারো বছর আগের।
তবে বিষয়বস্তুর প্রায় অভিন্নতার কারণেই এটা মনে হয়। এখানেও
তাঁর ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ আছে, আছে বঙ্কিম-সাহিত্যের
সমালোচনাও।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের সমালোচনা আছে আধুনিক সাহিত্যের
কৈফিয়ত প্রবন্ধেও।
ওখানেও তিনি সেই রোহিণীকে গুলি করে হত্যা করার তীব্র সমালোচনা
করেছেন।
‘চন্দ্রশেখর’-এর শৈবলিনী ও প্রতাপ চরিত্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেও বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনা
করেছেন।
প্রসঙ্গত, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘সুলভ শরৎসমগ্র’-এর ভূমিকায় শরৎচন্দ্রকে
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যরসে জারিত বলেছেন সুকুমার সেন। তাঁর
ওপর সাহিত্যগুরু বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব, প্রভাব
ইত্যাদি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে অবশ্য
কোনও প্রকার প্রমাণ দেননি।
অথচ শরৎচন্দ্রের প্রবন্ধসাহিত্য এবং চিঠিপত্র পড়ে মনে হয়
সুকুমার সেন এ দিকটা খুঁজেও দেখেননি।
নীতিবাদীরা যখন অভিযোগ করছিলেন বাংলা সাহিত্যে
সীমাহীন দুর্নীতি ঢুকেছে, তখন সাহিত্যে শিল্পবস্তু
আর দুর্নীতির পার্থক্য আলোচনা করতে গিয়ে এবং আধুনিক সাহিত্য কেন উনিশ শতকীয় সাহিত্যাদর্শ
থেকে দূরে সরে গেছে তার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বারবার বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এক
অর্থে বঙ্কিমী আদর্শের বিরুদ্ধে তাঁকে একজন বিদ্রোহী বলেই মনে হয়। দু’টি
উদ্ধৃতিতে তাই প্রমাণিত হয়।
‘বঙ্কিমচন্দ্র
ও তাঁর চারিদিকের সাহিত্যমণ্ডলী একদিন বাংলার সাহিত্যাকাশ উদ্ভাসিত করে রেখেছিলেন। কিন্তু
মানুষ চিরজীবী নয়; তাঁদের কাজ শেষ করে তাঁরা
স্বর্গীয় হয়েচেন।
তাঁদের প্রদর্শিত পথ, তাদের নির্দিষ্ট
ধারার সঙ্গে নবীন সাহিত্যিকদের অনৈক্য ঘটেছে- ভাষা, ভাব ও
আদর্শে।
এমনকি প্রায় সকল বিষয়েই।’ (সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি)
দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি দেখা যাক,
‘সম্প্রতি
একটি কলরব উঠিয়াছে যে, আধুনিক উপন্যাস লেখকেরা বঙ্কিমসাহিত্যকে
ডুবাইয়া দিল।
বঙ্কিম সাহিত্য ডুবিবার নয় সুতরাং আশঙ্কা তাহাদের বৃথা। কিন্তু
আধুনিক ঔপন্যাসিকদের বিরুদ্ধে নালিশ এই যে, ইহারা বঙ্কিমের
ভাষা, ভাব, ধরন-ধারণ, চরিত্রসৃষ্টি কিছুই আর অনুসরণ করিতেছেনা, অতএব
অপরাধ ইহাদের অমার্জনীয়; ইহার জবাব দেওয়া একটা প্রয়োজন।… অভিযোগ ইহাদের সত্য আমি তাহা
অকপটে স্বীকার করিতেছি, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি ভক্তি
শ্রদ্ধা আমাদের কাহারো অপেক্ষা কম নয়, এবং সেই শ্রদ্ধার জোরেই
আমরা তাঁহার ভাষা, ভাব পরিত্যাগ করিয়া আগে চলিতে দ্বিধাবোধ
করি নাই।
মিথ্যা ভক্তির মোহে আমরা যদি তাঁহার সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার
বস্তুই শুধু ধরিয়া পড়িয়া থাকিতাম ত কেবলমাত্র গতির অভাবেই বাংলা সাহিত্য আজ মরিত।’ (আধুনিক সাহিত্যের কৈফিয়ত)
শরৎচন্দ্রের এই আত্মঘোষণার পরেও তাঁকে বঙ্কিমী
ভাবধারার সাহিত্যিক বলা কি সঙ্গত? তিনি মনে করতেন একনিষ্ঠ
প্রেমের মর্যাদা নবীন সাহিত্যিক বোঝে, এর প্রতি তাঁর সম্মান
ও শ্রদ্ধার অবধি নেই, কিন্তু সে যা সইতে পারে না তা হলো ফাঁকি। সাহিত্য
জাতীয় ঐশ্বর্য, এ ঐশ্বর্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত। বর্তমানের
দৈনন্দিন প্রয়োজনে তাকে ভাঙিয়ে খাওয়া চলে না।
তিনি তাঁর বহুল আলোচিত ও সমালোচিত উপন্যাস ‘চরিত্রহীন’-এর
প্রসঙ্গও বিভিন্ন প্রবন্ধে কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতে
আলোচনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি স্মরণীয় উক্তি আছে। কথাটা
তিনি শুরু করেছেন এভাবে, ‘পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব সতীত্বের
চেয়ে বড়; এই কথাটা একদিন আমি বলেছিলাম। কথাটা
যৎপরোনাস্তি নোংরা করে তুলে আমার বিরুদ্ধে গালিগালাজের আর সীমা রইল না।’
সাহিত্য যদি সত্য সত্যই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে
এজন্য তিনি সমালোচকদেরও দায়ী করেন।
তাঁর ভাষায়, ‘সংসারে
রাবিশ বই-ই কেবলমাত্র রাবিশ নয়, সমালোচনার ছলে দায়িত্বহীন
কটূক্তির রাবিশেও বাণীর মন্দির পথ একেবারে সমাচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে।’
আধুনিক তরুণ সাহিত্যিকদের পক্ষে শরৎচন্দ্র অনেক
কথাই লিখেছেন।
আধুনিক সাহিত্য আজ হয়তো অসুন্দর ও আনন্দহীন মনে হতে পারে,
কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় আধুনিক সাহিত্য সম্বন্ধে একথা সবার মনে রাখা
প্রয়োজন মনে করেন।
তিনি মনে করেন,
‘পূর্বের মতো রাজরাজড়া, জমিদারের দুঃখ-দৈন্য-দ্বন্দ্বহীন
জীবনেতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন ভরে না। তা
নিচের স্তরে নেমে গেছে।
এটা আপসোসের কথা নয়। বরং
এই অভিশপ্ত অশেষ দুঃখের দেশে, নিজের অভিমান বিসর্জন
নিয়ে রুশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে আরও সমাজের নিচের স্তরে গিয়ে তাদের সুখ, দুঃখ বেদনার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, সে দিন
এই সাহিত্য সাধনা কেবল স্বদেশ নয়, বিশ্বসাহিত্যেও স্থান করে
নিতে পারবে।
‘আধুনিক
সাহিত্যের কৈফিয়ত’ প্রবন্ধটি শেষ করেছেন সমালোচকদের অভিযোগটিকে একেবারে উল্টে দিয়ে
মানুষকে মানুষ ভেবেই হয়তো লেখকেরা দুর্নীতি করে ফেলেছেন।
তিনটি প্রবন্ধের বাইরে শরৎচন্দ্রের অগ্রন্থিত
প্রবন্ধের সংখ্যা অনেক।
নারী, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, রবীন্দ্রনাথ,
গান্ধী, চিত্তরঞ্জনসহ বিভিন্ন বিষয়ে। এর
মধ্যে বিষয়বস্তুর অভিন্নতার কারণে শুধু সাহিত্যের রীতি ও নীতি প্রবন্ধটি নিয়ে একটু
মন্তব্য করা যায়।
১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘সাহিত্য ধর্ম’
নামে একটি প্রবন্ধ লিখে অতি আধুনিক সাহিত্যিকদের নানাভাবে আক্রমণ করেন। এরপরে
প্রত্যাঘাতও আসতে থাকে।
নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রতিপক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ান। এ
সময় শরৎভক্তরা তাঁকে দিয়ে এ প্রবন্ধটি লিখিয়ে নেন। এটা
মূলত নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্বের প্রামাণ্য। এখানে শরৎচন্দ্র যথাযোগ্য শ্রদ্ধা
রেখেই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রভক্তদের
সবাই যে অকপট এটা সত্য নয়, এ কথাই শরৎচন্দ্র বোঝাতে
চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে।
তথ্যসূচি:
১.
রামবহাল তেওয়ারী।
‘হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাস’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী,
কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৪।
২.
খাজা আহমদ আব্বাস: ভূমিকা, কৃষণ চন্দর: ‘গাধার
আত্মকথা’ (অনুবাদ: মোস্তফা হারুন) মুক্তধারা, ঢাকা,
১৯৮২
৩.
সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম সম্পাদিত। ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’,
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭।
৪.
হুমায়ুন আজাদ।
‘লালনীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’, আগামী প্রকাশনী,
ঢাকা,
৫.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘উপন্যাস সমগ্র-১’, ঢাকা,
৬.
অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়।
‘কালের প্রতিমা’, কলকাতা, ১৯৭৪।
৭.
‘দেশ’- ২৫ জুন, কলকাতা-১৯৮৮।
৮.
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘লেখকের কথা’, কলকাতা,
৯.
ভীষ্মদেব চৌধুরী ও সৈয়দ আজিজুল হক সম্পাদিত। ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: শতবার্ষিক
স্মরণ’,
অবসর ঢাকা, ২০
১০.
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘গল্পসমগ্র’, (ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত), ঢাকা, ২০০
১১.
শরৎ রচনাবলী অষ্টমখণ্ড- ‘ঝিনুক পুস্তিকা’, ঢাকা।
‘ভারতী’র লেখক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে ৭. ১. ১৯১৪ তারিখে এক পত্রে শরৎচন্দ্র লিখেছেন,
‘‘… ঐ রকম করিয়া ‘ঠাকুর দেবতার মূল্য’, ‘হিন্দুশাস্ত্রের
মূল্য’ বলিয়া প্রবন্ধ শুরু করিব।
১২.
‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা-১৩৯৭, কলকাতা
১৩.
শরৎরচনাবলী অষ্টমখণ্ড-
১৪.
ঐ
১৫.
শরৎরচনাবলী পঞ্চমখণ্ড।
১৬.
বিশ্বজিৎ ঘোষ ঐ
১৭.
গ্রন্থপরিচয়।
শরৎরচনাবলী অষ্টমখণ্ড-
১৮.
সুনীল দাস: ‘নারায়ণ ও চিত্তরঞ্জন’। দেশ ঐ
১৯.
কাজী নজরুল ইসলাম।
‘তরুণের সাধনা’ রুদ্রমঙ্গল।
গ্রন্থলোক, কলকাতা
১৯৬৫
২০.
শরৎরচনাবলী অষ্টমখণ্ড।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন