জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বলা হত জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। তার একটি সাক্ষাতকারের কিছু অংশ ৷ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এই সাক্ষাতকারটিি গ্রহন করেন ৷
সৌজন্য -
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী
বাংলাদেশ
, ০২-১২-
১৯৮৪ তে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস
আবদুর রাজ্জাকের, আজ
শুধু সেই সাক্ষাত কারের কিছু অংশ ৷
হুমায়ুন
আজাদ
– পাকিস্তান বলতে এখন আমরা ইসলামি পাকিস্তান বুঝি। আপনারাও
কি ইসলামি পাকিস্তান চেয়েছিলেন?
আবদুর
রাজ্জাক -
মোটেই না। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পরবর্তী ঘটনা। মুহম্মদ আলি
জিন্নাহকে ধার্মিক লোক বলা যায় না, ইসলামের জন্য তাঁর
বিশেষ মাথাব্যথা ছিলো না। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসব
অনুষ্ঠানটি আর ১৫ই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি তুলনা করলেই ব্যাপারটা
বোঝা যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসবের প্রোগ্রামে ধর্মের কোনো নামগন্ধও ছিলো না।
মওলানা আকরাম খাঁ, শাব্বির আহমদ ওসমানি, লিয়াকত আলিকে দিয়ে
জিন্নাকে অনুরোধ জানান অনুষ্ঠানে কিছু ধর্মকর্ম রাখতে। অনুষ্ঠান শুরু হ’লে দেখা যায় জিন্না
সরদার আওরঙ্গজেব খানকে ডাকেন কোরান থেকে কিছু আবৃত্তির জন্যে। আওরঙ্গজেব খান
ধর্মের ধার ধারতেন না। তিনি মঞ্চে এসে দু-একটা সুরাকলমা প’ড়েই বিদায় নেন।
অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা অনুষ্ঠান হয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুবিধিমতে।
পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পাকিস্তান হওয়ার পরের ঘটনা।
হুমায়ুন
আজাদ –
আপনি কি ‘জাতির পিতা’ ধারণায় বিশ্বাস করেন ?
আবদুর
রাজ্জাক
– ‘জাতির পিতা’ ধারণাটি দিয়ে বোঝানো
হয়ে থাকে যে একটি লোকের মধ্যেই জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা মুর্ত হয়ে ওঠে।
একটি জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা ও আরো বহু ব্যাপার সংক্ষেপে জড়ো হয় ওই একটি শব্দবন্ধে। ওয়াশিংটনকে যখন বলা হয় আমেরিকার জাতির পিতা,গান্ধিকে ভারতের, জিন্নাকে পাকিস্তানের,তখন শুধু এটাই বোঝানো হয় যে ওই কয়েকজন মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশেষ ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই অর্থে বাংলা দেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
একটি জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা ও আরো বহু ব্যাপার সংক্ষেপে জড়ো হয় ওই একটি শব্দবন্ধে। ওয়াশিংটনকে যখন বলা হয় আমেরিকার জাতির পিতা,গান্ধিকে ভারতের, জিন্নাকে পাকিস্তানের,তখন শুধু এটাই বোঝানো হয় যে ওই কয়েকজন মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য বিশেষ ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই অর্থে বাংলা দেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
হুমায়ুন
আজাদ –
শেখ মুজিব যেভাবে দেশ শাসন করছিলেন তাতে কি তাঁর
রক্তাক্ত পরিণতি অনিবার্য ছিলো?
আবদুর
রাজ্জাক – বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে দেশ শাসনের অনিবার্য পরিণতিরূপে
হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেওয়া যায় না। ব্যাপারটি বোঝার জন্যে জানতে ও বুঝতে হবে
হত্যাকারী কারা? কী এমন ঘটেছিলো যাতে তারা এতোটা বিক্ষুদ্ধ হলো যে তাদের
হত্যার পথ বেছে নিতে হলো? তিনি কীভাবে দেশ শাসন করতেন সে-ব্যাপারটি এই হত্যার
ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিক দর্শন ঠিক কি
ভ্রান্ত আমি সে-বিবেচনায় যেতে যাই না, শুধু এটুকুই বুঝতে পারি
যে তিনি একটা ব্যাপার বিশেষভাবে স্পষ্ট ক’রে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন
যে সামরিক বাহিনীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রে
যে-গুরুত্ব দাবি করে শেখ মুজিব তাদের তা দিতে রাজী ছিলেন না। তাদের মতে তাদের
যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হয় নি। তাদের ক্ষুণ্ণ করার জন্যেই এমন ঘটে।
হুমায়ুন
আজাদ
– গত এক দশকের বাঙলাদেশি রাজনীতির প্রধান লক্ষণ কী ব’লে আপনার মনে হয়?
আবদুর
রাজ্জাক – প্রশ্নটা এতো নির্বিশেষ ভাষায় করা হয়েছে যে উত্তরটাও
নির্বিশেষই হবে। এটা ঠিক যে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ – রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসীরা শেখ
মুজিবুর রহমানের সময় একটু বেশি সোজাভাবে দাঁড়াতো, একটু বেশি শক্তিশালী
বোধ করতো। তাঁর পরে যে তারা খুব খারাপ আর্থিক অবস্থায় পড়ে গেছে, বা তাঁর সময়ে
যে খুব ভালো আর্থিক অবস্থায় ছিলো, তা না। তবে এটা আমি খুব স্পষ্ট ভাবেই বুঝি যে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ অনেকটা অসহায় বোধ করে, আগে এমন অসহায় বোধ করতো না। সমাজের যত বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও সমাজের জন্যে অপরিহার্য, ততোই ভালো। গান্ধি বা জিন্না জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের অংশ ছিলেন না, কিন্তু মুজিবের সময় জনগণ এমন বোধ করতে থাকে যে শেখ মুজিব তাদেরই অংশ। বর্তমানে এ-অবস্থাটা নাই।
যে খুব ভালো আর্থিক অবস্থায় ছিলো, তা না। তবে এটা আমি খুব স্পষ্ট ভাবেই বুঝি যে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ অনেকটা অসহায় বোধ করে, আগে এমন অসহায় বোধ করতো না। সমাজের যত বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও সমাজের জন্যে অপরিহার্য, ততোই ভালো। গান্ধি বা জিন্না জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের অংশ ছিলেন না, কিন্তু মুজিবের সময় জনগণ এমন বোধ করতে থাকে যে শেখ মুজিব তাদেরই অংশ। বর্তমানে এ-অবস্থাটা নাই।
হুমায়ুন
আজাদ
– ক্লাসে বক্তৃতা দিতে কেমন লাগতো আপনার?
আবদুর
রাজ্জাক
– খুব খারাপ। ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো।
মনে হতো আহা, ওদের কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নাই। আমার কথায় তো নয়ই।
দু-একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিলো আমি নাকি এক আধটি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে
তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। পুরোনো কলাভবনে আমার ক্লাসের পাশেই ছিলো একটি পুকুর।
সেই পুকুরে হাঁস ভাসতো অনেকগুলো। আমি জানলার বাইরে পুকুরের হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে
বক্তৃতা দিয়ে ঘন্টা শেষ করতাম।
হুমায়ুন
আজাদ
– বিশ্বব্যাপী এখন রাজনীতিতে মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন
ঘটছে। আপনার কি মনে হয় আগামী পঞ্চাশ বছরে সারা গ্রহ ভ’রে বিভিন্ন রকম
ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
আবদুর
রাজ্জাক
– ধর্মের মূল কথা হচ্ছে এই জীবন মৃত্যুপরবর্তী এক অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ মহান জীবনের একটি অত্যন্ত গৌণ উপাংশ মাত্র। এ ছাড়া ধর্মের আর কোনো
সংজ্ঞা নাই। আমার মনে হয় না যে এমন বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের কোনো
যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে। এখন মানুষ নানান কথা কয়ে তাকে ধর্ম বলে চালানোর চেষ্টা
করছে।
ওই বিশ্বাস যে এ-জীবন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, পরলোকই সব, এমন বিশ্বাস ফিরে আসে নাই। পাঁচ-ছশো বছর আগে মানুষেরা সত্যিই বিশ্বাস করতো যে এ-জীবন নশ্বর, আসল জীবন প’ড়ে আছে সামনে মৃত্যুর পর। এখন ধর্ম বলতে যা বলা হয় তা আমি বুঝি না।
ওই বিশ্বাস যে এ-জীবন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, পরলোকই সব, এমন বিশ্বাস ফিরে আসে নাই। পাঁচ-ছশো বছর আগে মানুষেরা সত্যিই বিশ্বাস করতো যে এ-জীবন নশ্বর, আসল জীবন প’ড়ে আছে সামনে মৃত্যুর পর। এখন ধর্ম বলতে যা বলা হয় তা আমি বুঝি না।
হুমায়ুন
আজাদ
- প্রথাগত ব্যাপার ও চিন্তার প্রতি কি আপনি শ্রদ্ধাশীল?
আবদুর
রাজ্জাক
– শুধু প্রথাগত ব’লেই কোনো কিছুকে উড়িয়ে
দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, আবার প্রথাগত ব’লেই মেনে নেয়ার
প্রয়োজনও বোধ করি না।
হুমায়ুন
আজাদ
– আপনি কি প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী?
আবদুর
রাজ্জাক
– বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথাটা ওঠে না। কারণ ধর্ম সম্পর্কে
কথাবার্তা বলার আগ্রহ আমি কখনো বোধ করি নাই।
হুমায়ুন
আজাদ
– মৃত্যু সম্পর্কে ভাবেন?
আবদুর
রাজ্জাক
– বিশেষ না। তবে মরতে হবে এই পর্যন্ত নিশ্চিত।
হুমায়ুন
আজাদ
– জ্ঞানের কোন শাখাগুলো আপনাকে আকর্ষণ করে?
আবদুর
রাজ্জাক
– মানুষ সম্পর্কে যা তার সবই।
হুমায়ুন
আজাদ
– আমার কাছে বাঙলাদেশের সমাজকে নষ্ট সমাজ ব’লে মনে হয়। আপনার কেমন
মনে হয়?
আবদুর
রাজ্জাক
– আমি এর সঙ্গে একেবারেই একমত নই। বরং আমার কাছে এই
এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা ব’লে মনে হয়। বাঙলাদেশে
ছোটো থেকে বড় হওয়ার, তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে-সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশের আর
কোথাও নাই। শুধু উপমহাদেশে কেনো, সারা পৃথিবীতেও নাই।
------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন