বর্তমান উন্নতবিশ্বে মানৃয়ের ঈশ্বর বিশ্বাসে কী চিড় ধারা আরম্ভ হয়ে গেছে ? লেখক আরাফাত পারভেজ
ধর্ম কি টিকে থাকবে নাকি হারিয়ে যাবে?
( গ্যালপ ইন্টারন্যাশনাল এ ব্যাপারে একটি
জরিপ করেছিল বিশ্বের ৫৭টি দেশের ৫০ হাজার
মানুষের ওপরে। জরিপে দেখা যায়, ধর্মে
বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৭৭ শতাংশ থেকে কমে
দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। এদিকে যারা নিজেদেরকে নাস্তিক বলে দাবি করেন তাদের সংখ্যা
বেড়েছে ৩ শতাংশ। ফলে বর্তমান বিশ্বে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সব
মিলিয়ে ১৩ শতাংশ।)
·
·
·
·
মানুষ মরে যায়, কিন্তু মানুষের ধর্ম বিশ্বাস
বেঁচে থাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
তাই বলে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষ (নাস্তিক) যে নেই তা কিন্তু নয়। এই মুহূর্তে
পৃথিবীতে এরকম বহু নাস্তিক রয়েছেন এবং সংখ্যায় বাড়ছেই। এধরনের মানুষ বিশ্বাস করেন মৃত্যুর সাথে সাথেই জীবনের
সমাপ্তি- সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ নেই,
পরজন্ম
নেই এবং নেই কোনো স্বর্গীয় ব্যাপার-স্যাপার!
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে,
এই
নাস্তিকতা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাগত জানায় না, অথচ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীর অনেক
দেশে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মানুষ ভয়ে মুখ খুলছে না,
আবার
অনেক দেশে প্রকাশ্যে এটা জানান দেয়াটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ফ্যাশন অথবা কোথাও
জনপ্রিয় ব্যাপার। এই যখন অবস্থা তখন এ প্রশ্ন উঠে আসছে যে, ধর্ম কি শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে?
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লারমন্টের পিটজার কলেজের সমাজ ও ধর্ম
নিরপেক্ষ বিদ্যার অধ্যাপক ফিল জুকারমান ধর্ম ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সাথে সমাজের
সম্পর্ক নিয়ে ‘লিভিং দ্য সেকুলার লাইফ’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ নাস্তিক
রয়েছেন সেটা আগে কখনোই দেখা যায়নি।’
গ্যালপ ইন্টারন্যাশনাল এ ব্যাপারে একটি জরিপ করেছিল বিশ্বের ৫৭টি দেশের ৫০ হাজার মানুষের
ওপরে। জরিপে দেখা যায়, ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের
সংখ্যা ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৭৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে।
এদিকে যারা নিজেদেরকে নাস্তিক বলে দাবি করেন তাদের সংখ্যা বেড়েছে ৩ শতাংশ। ফলে
বর্তমান বিশ্বে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ১৩ শতাংশ।
কিন্তু নাস্তিকরা এখনো সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু এরকম কি হতে পারে যে, এই সংখ্যাটা অবশ্যম্ভাবী কোনো কিছুর
অগ্রদূত? বিশ্বব্যাপী নাস্তিক্যবাদের
যে চল চালু হয়েছে, তাতে কি ধর্ম চিরতরে হারিয়ে
যাবে?
ভবিষ্যতে কী হবে, বর্তমানে সেটার কেবল ধারণা করা যেতে পারে।
কিন্তু নির্ভুলভাবে বলা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ধর্ম সম্বন্ধে আমরা যা জানি, বিশেষ করে কেন এর সূচনা হয়েছিল এবং কেন
কিছু মানুষ এতে বিশ্বাস করেছিল এবং কেউ করেনি,
সেটার
বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের বছরগুলোতে সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্কটা আসলে কেমন
দাঁড়াবে- তার একটা সূত্র পাওয়া যাবে মাত্র।
কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কেন নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে সেটার অন্তর্নিহিত
কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিশেষজ্ঞরা এখনো চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু কারণগুলোর
মধ্যে মিল কম। ধর্মের একটা আবেদন হচ্ছে,
এটা
অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক জগতের থেকে একটা নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। কাজেই বিশ্বের
যে সমস্ত দেশে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং অস্তিত্বের
নিশ্চয়তা রয়েছে তাদের ভেতরে নাস্তিকতার হার বেশি। জুকেরমান দাবি করেন, সমাজে নিরাপত্তা বৃদ্ধির ফলে মানুষের
ধর্মীয় বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের কারণে প্রযুক্তি এবং শিক্ষার যে প্রসার
ঘটেছে, সেটা জনমানুষের মধ্যে ধর্মের
প্রভাবে ক্ষয় ধরিয়ে দিচ্ছে।’
অথচ মাত্র একশো বছর আগেও ছিল ভিন্ন অবস্থা। জাপান, যুক্তরাজ্য,
দক্ষিণ
কোরিয়া, নেদারল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া,
জার্মানি, ফ্রান্স এবং উরুগুয়ের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোতে মাত্র এক শতক আগেও ধর্ম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা
বিষয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এদেরই
বিশ্বাসের মাত্রা এখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। কেন?
কারণ
এই দেশগুলোতে খুব শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা,
সামাজিক
নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ধনসম্পদ রয়েছে। একইসাথে এদের ভেতরে বৈষম্যের মাত্রাও কম।
নিউজিল্যান্ডের ওকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী কুয়েনটিন
আটকিনসন বলেন, ‘মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, এই সমস্ত দেশের মানুষেরা ভবিতব্য বা নিয়তি
বা অজানা কোনো কিছুর আশঙ্কা নিয়ে
ভয় পায় না।’
তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বাসের
প্রতি এই বিমুখতা কিন্তু সব জায়গাতেই ঘটছে। এমনকি যেসব জায়গার মানুষেরা প্রচণ্ড
ধর্মভীরু তাদের মধ্যেও। যেমন ব্রাজিল,
জ্যামাইকা
এবং আয়ারল্যান্ড। জুকারমান বলেন, ‘৪০-৫০
বছর আগে খুব ধর্মভীরু ছিল এবং এখন আরও বেশি ধর্মভীরু হয়েছে- এরকম সমাজের সংখ্যা
খুবই কম। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম দেশ হতে পারে ইরান। কিন্তু যদিও এটা বিচার
করা খুবই জটিল। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এই বিশ্বাস গোপন
করেন।’
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটি, কিন্তু সেখানে এখনো পর্যন্ত ধর্ম
বিশ্বাসের মাত্রা খুবই বেশি। সাম্প্রতিক পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি জরিপে দেখা
গেছে, সেখানে নাস্তিকের সংখ্যা
২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১.৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
তবে সম্পদ ও সামাজিক নিশ্চয়তাই ধর্ম বিশ্বাস উঠে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকার
রাখছে এমন মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত করেন কানাডার
ভ্যানকুভারের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী আরা নরেঞ্জায়ান। তিনি
বলেন, ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করা আর
ধর্ম সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক জিনিস না।
মনোবিজ্ঞানী নরেঞ্জায়ান এই বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছেন ‘বিগ গডস’
নামে।
সেখানে তিনি বলেন, অস্তিত্বগত নিরাপত্তা কিন্তু
যতটা মনে করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ভ্রান্তিকর একটা ব্যপার। অর্থাৎ নিরাপত্তা
যতভাবেই নিশ্চিত করা হোক না কেন, এক
মুহূর্তের মধ্যেই সব বদলে যেতে পারে। মানুষ অনিশ্চয়তায় ভোগে দেখেই সে অনিশ্চয়তাকে
নিশ্চয়তায় পরিণত করতে চায়। নিশ্চয়তার এই প্রচেষ্টা অন্তহীন একটা ব্যাপার। এর কারণ
হচ্ছে, অনিশ্চয়তার সংজ্ঞা অনুসারে
এটাও অন্তহীন একটা ব্যাপার। সব কিছু নির্ভুল হিসেব করার পরেও চোখের নিমিষে সব
ভণ্ডুল হয়ে যায়।
একজন মাতাল ড্রাইভার গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে পারে আমাদের প্রিয়জনকে, একটি দানব ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিতে পারে
একটি শহর, একজন ডাক্তার পরীক্ষা
নিরীক্ষা করার পরে জানাতে পারেন মরণঘাতী রোগের কথা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে
প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে পাল্টা আক্রোশ চালাচ্ছে মানুষের উপর। সেই সাথে
প্রাকৃতিক সম্পদ যখন কমতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় দুর্ভোগ এবং যন্ত্রণা মানুষের
ভেতরে আবার উজ্জীবিত করতে পারে ধর্ম বিশ্বাস।
নরেঞ্জায়ান বলেন, ‘মানুষ বরাবরই কষ্ট থেকে
মুক্তি চায়। অথচ তারা যখন কিছুতেই মুক্তি পায় না,
তখন
একটা অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কোন একটা বিশেষ কারণে ধর্ম মানুষের এই
দুর্দশার একটা অর্থ প্রদান করে। যে কোনো ধরনের ধর্ম নিরপক্ষ আদর্শ কিংবা বিশ্বাসের
থেকে এটা বহুগুণে বেশি শক্তিশালী।’
এই বাস্তবতার অজস্র প্রমাণ রয়েছে। বড়
বিপদে বিপর্যয়ের পড়লেই বুঝা মানুষ কতোটা ভীতু আর মুষড়ে পড়ে।অনিশ্চিয়তা মানুষকে
কতোটা দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে তা তখনই বুঝা যায়। যেমন, ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ
শহরে ভয়ানক ভূমিকম্পের পর সেখানকার মানুষ হঠাৎ করে ধর্মপরায়ণ হয়ে যায়। অথচ শহরটি খুবই ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) ছিল।
তবে এটা ঘটেছে শুধু ঐ লোকগুলোর ক্ষেত্রেই যারা ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছে। বাকিরা
ঠিকই সেক্যুলার রয়ে গেছে।
অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের
ধর্মবিশ্বাসে পতন ঘটেছিল। জুকারমান বলেন,
‘তবে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রাইস্টচার্চের মত ঘটনা ঘটে। কারণ যদি ভয়ানক কোনো কিছুর
অভিজ্ঞতা মানুষকে নাস্তিক করে দিত তাহলে আমরা সবাই এতদিনে নাস্তিক বনে যেতাম!’
এতো বিতর্কের পরও বলা যায়, পৃথিবীর
সব সমস্যা অলৌকিকভাবে সমাধান করেও ফেলা গেলেও এবং আমরা সবাই যদি সাম্যের সাথে
শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করলেও খুব সম্ভবত ধর্ম ঠিকই টিকে থাকবে। The idea of God is not only exist, but also insist. অর্থাৎ
সৃষ্টিকর্তা শুধু পার্থিব জগতে অবস্থান করেন না,
তিনি
আমাদের অস্তিত্বের ভিতরেও অবস্থান করেন। বিবর্তনের নিয়মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষ
প্রজাতির মনস্তত্ত্বের (নিউরোসাইকোলজি) ভেতরে স্থায়ী
জায়গা করে নিয়েছে।
ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে ‘ডুয়াল
প্রসেস থিওরি’। এই তত্ত্ব মতে, মানুষের ভেতরে আষ্টেপৃষ্ঠে দুইটি মূল
চিন্তা পদ্ধতি কাজ করে। এদেরকে ধরা যাক : পদ্ধতি-১ এবং পদ্ধতি-২। পদ্ধতি-২
বিবর্তিত হয়েছে তুলনামূলক পরবর্তী সময়ে। এটা হচ্ছে আমাদের মাথার ভেতরের সেই একজন
যে, ক্রমাগত কথা বলে এবং যার
কারণে আমরা পরিকল্পনা করি কিংবা যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তাভাবনা করি। কিন্তু, পদ্ধতি-১ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়,
সহজাত
প্রবৃত্তিগত ব্যাপার। মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, পদ্ধতি-১ তার মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিপক্ব হয়।
এটা হচ্ছে তার টিকে থাকার ক্রিয়া কৌশল। পদ্ধতি-১ এর কারণেই আমরা পচা মাংসের ঘ্রাণে
বিতৃষ্ণ হই, এর কারণেই আমরা আমাদের
মাতৃভাষায় কথা বলি চিন্তাভাবনা ছাড়াই এবং এর কারণেই শিশুরা বুঝতে পারে কে তার
বাবা-মা আর কেই বা অপরিচিত মানুষ। এটাই আমাদের জীবন বোধে তীব্রতা বৃদ্ধি করে। এর
কারণেই আমরা কাকতালীয় ঘটনা কেন ঘটে সেটা খুঁজে বের করি এবং অর্থ দাঁড় করানোর
চেষ্টা করি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আঘাত পেয়ে কিংবা ভালোবাসার মানুষকে আচমকা হারিয়ে
ফেলে আমরা বারবার নিজেদের প্রশ্ন করি,
কেন
এটা ঘটলো?
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পৃথিবীর
অজানা সব বিপদের মোকাবেলা করার জন্য এবং একজন সঙ্গী খুঁজে বের করার জন্য পদ্ধতি-১
ই আসলে ধর্মের বিবর্তন এবং একে মানুষের মাঝে স্থায়ী জায়গা করে দিতে ভূমিকা রেখেছে।
যেমন পদ্ধতি-১ এর কারণেই আমরা যেখানেই যাই প্রাণের উৎস এবং শক্তি খুঁজে বের করার
চেষ্টা করি। প্রাণশক্তি থাকুক বা না থাকুক,
আমাদের
প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একে বলে হাইপারসেন্সিটিভ এনার্জি ডিটেকশন। সহস্র বছর আগে
হয়তো এই প্রবণতা আমাদেরকে লুকানো বিপদ এড়িয়ে যেতে সাহায্য করতো, যেমন : সিংহ লুকিয়ে থাকে বড় ঘাসের মধ্যে, বিষাক্ত সাপ লুকিয়ে থাকে লতাপাতার মধ্যে-
এই পূর্বভীতি আমাদের বাঁচিয়ে দিত ।
কিন্তু এই প্রবণতা একইসাথে আমাদের মধ্যে অদৃশ্য জিনিসের অস্তিত্ব তৈরি করেছে। যেমন
ঈশ্বর নামীয় অদৃশ্য কেউ একজন আমাদের ওপর নজর রাখছেন।
একইভাবে পদ্ধতি-১ আমাদেরকে যে কোনো জিনিসকে দুইভাবে দেখার জন্য উৎসাহিত
করে। অর্থাৎ মন এবং শরীরকে এক করে চিন্তার করার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই প্রবৃত্তি খুব অল্প বয়সে থেকেই মানুষের ভিতরে আবির্ভূত হয়। অল্প বয়স্ক
শিশুরা সে যে সংস্কৃতিতেই বেড়ে উঠুক না
কেন বিশ্বাস করে যে, জন্মের আগেও তাদের আত্মা জীবিত ছিল এবং
মরে গেলেও আত্মা অক্ষত থেকে যায়, আত্মা
অমর। এই প্রবণতা খুব সহজেই মিশে গেছে অনেক ধর্মের ভিতরে অথবা খানিকটা সৃষ্টিশীলতা
মিশিয়ে নিজেই সৃষ্টি করেছে ধর্মের কাঠামো।
ক্যালিফোর্নিয়ার থ্রাইভ সেন্টার ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক এবং ‘বর্ন বিলিভার্স’ গ্রন্থের লেখক জাস্টিন বেরেট বলেন, ‘আমার একজন স্ক্যানডানেভিয়ান মনোবিজ্ঞানী
বন্ধু আছে। তিনি নাস্তিক। তার ৩ বছরের মেয়ে সম্প্রতি তাকে বলেছে, ‘ঈশ্বর সবজায়গায় আছে এবং সবসময় আছে’। আমার বন্ধুটি এবং তার স্ত্রী বুঝে উঠতে
পারছিল না তাদের মেয়ে এই কথা কোথা থেকে শিখেছে। তবে মেয়েটির চিন্তায় ঈশ্বর হচ্ছেন
একজন বয়স্ক নারী। কাজেই কোনো গির্জা থেকে সে এটা শেখেনি এটা বোঝা যায়।’
এই সমস্ত কারণেই অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন,
ধর্মের
উৎপত্তি হয়েছিল আমাদের প্রবৃত্তি থেকে।
জর্জিয়া আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইন্ড,
ব্রেইন
এন্ড কালচার সেন্টারের পরিচালক রবার্ট ম্যাককুলে এই বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছেন, ‘হোয়াই রিলিজন ইজ ন্যাচারাল অ্যান্ড
সায়েন্স ইজ নট’ নামে। তিনি বলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে সংস্কৃতির একটা ব্যবস্থাপনা, যেটা কিনা বিবর্তিত হয়েছে মানুষের প্রাকৃতিক
ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য অথবা সুযোগ নেয়ার জন্য।’
একজন নাস্তিককে সংস্কৃতি এবং বিবর্তনের এই জাতীয় ঝক্কির বিরুদ্ধে লড়াই করতে
হয়। মানুষ সাধারণত বিশ্বাস করতে চায় যে,
তারা
অনেক বড় কোনো একটা কিছুর অংশ এবং জীবন মোটেও তুচ্ছ নয়। আমাদের মন খোঁজে উদ্দেশ্য
এবং ব্যাখ্যা। ।
অন্যদিকে অনেক নাস্তিক এবং অবিশ্বাসীরা বিজ্ঞানকে দেখেন প্রকৃতিকে বুঝতে
পারার একটি পদ্ধতি হিসেবে। কিন্তু কাজটা প্রবৃত্তির (instinct) কারণেই এতোটা সহজ নয়।
ম্যাককুলি বলেন, ‘বিজ্ঞান হচ্ছে পদ্ধতি-১ এর
প্রবণতাকে শুদ্ধ করার উপায়।’ আমাদেরকে
এটা মেনে নিতে হবে যে, আমরা বুঝতে না পারলেও পৃথিবী
ঠিকই ঘুরছে। আমাদেরকে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে যে,
বিবর্তন
সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ এবং আমাদের মহাবিশ্বের গঠনে কোনো চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নাই।
যদিও আমাদের প্রবৃত্তি বলছে ভিন্ন কথা। মানুষের
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, সে সহজে নিজের ভুল স্বীকার
করতে চায় না। বিশেষ করে নিজেদের পক্ষপাতকে ঢাকার জন্য এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে না
নেয়ার জন্য। ঠিক এখানেই বিজ্ঞানের আসল ভূমিকা।
গবেষক ম্যাককুলি বলেন, ‘বিজ্ঞান প্রবৃত্তিগত দিক দিয়ে অপ্রাকৃত এবং কঠিন। কিন্তু ধর্ম
আবার ঠিক উল্টো। কারণ এটা আমাদেরকে নতুন করে শিখতে হয় না। আমরা এমনিতেই এটা জানি।
প্রমাণে দেখা গেছে ধর্মীয় চিন্তায় প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে কম। ধর্মকে বাদ দিতে হলে
মানুষের ভিতরের একেবারে গোড়া থেকে কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া হবে না।’
২০ শতাংশ মার্কিনীর গির্জার সাথে সম্পৃক্ততা নেই, ৬৩ শতাংশ ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং ৩৭ শতাংশ
নিজেদেরকে ব্যাখ্যা করেন আধ্যাত্মিক বলে। মজার বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো সুগঠিত
ধর্ম ছাড়াই আধ্যাত্মিকরা বিশ্বাস করেন,
মহাশক্তিধর
কিছু একটা পৃথিবীকে নির্দেশনা দেন।
একইভাবে সারা বিশ্বে এরকম অনেক মানুষ রয়েছেন যারা প্রকাশ্যে বলেন তারা
ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রবৃত্তি লালন করেন ঠিকই। যেমন, ভূত বিশ্বাস, জ্যোতিষ শাস্ত্র, কারমা (কর্মফল), টেলিপ্যাথি (মনস্তাত্বিক যোগাযোগ) এবং আত্মার পুনর্জাগরণ ইত্যাদি।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্ক্যানডেনেভিয়া।
অবিশ্বাসীরা আবার জীবনের মূল্য খুঁজতে গিয়ে আরেকটি কাজ করে। তারা ধর্মের
বদলি হিসেবে ঝুঁকে পড়ে খেলাধুলা, যোগ
ব্যায়াম, প্রকৃতি এবং পেশাগত প্রতিষ্ঠানে।
প্রমাণ হিসেবে দেখা যাবে, উইচক্র্যাফট বা জাদুবিদ্যা
যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে এবং পেগান ধর্মের (বহু ঈশ্বরবাদ বা
সর্বেশ্বরবাদ) দ্রুত বৃদ্ধি ঘটছে যুক্তরাজ্যে।
অবিশ্বাসীদের ধর্ম অভিজ্ঞতা আবার ফুটে ওঠে অন্যান্য আরও অদ্ভুত উপায়ে।
ক্যালিফোর্নিয়ার থ্রাইভ সেন্টার ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের নৃবিজ্ঞানী রায়ান
হর্নবেক এরকম প্রমাণ দেখেছেন যে, এতদিন
মনের যে জায়গা পূর্ণ ছিল ধর্ম বিশ্বাসে,
হঠাৎ
সেই জায়গা শূন্য হয়ে পড়ায় সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে ডাকিনীবিদ্যার মতো উদ্ভট জিনিস।
ধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এটা দলগত যোগাযোগ ও সহযোগিতা
বৃদ্ধি করে। একজন মহা শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তা সবার উপর নজর রাখছেন এবং কেউ গোপনে
সামান্য বিপথে গেলেও তিনি শাস্তি দেবেন- এই ধারণাটা প্রাচীন সমাজে শৃঙ্খলা বজায়
রাখতো। ‘এটা হচ্ছে অতিপ্রাকৃত শাস্তি
তত্ত্ব। কেউ যদি মনে করে এই শাস্তি খুবই বাস্তব এবং অবশ্যই ঘটবে তাহলে সমাজ টিকে
থাকবে’। এবং এখানে অবশ্যই নিরাপত্তাহীনতা এবং
দুর্দশা একটা বড় ভূমিকা পালন করে।
নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জোসেফ বুলবুলিয়া এবং তার দল
দেখেছেন, দুর্গম অঞ্চলের বাসিন্দারা
মনে মনে একজন নৈতিক ঈশ্বর খুঁজে নেয়। কেন?
কারণ
ঐ জায়গায় একজন ভালো প্রতিবেশী জীবন মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। ধর্ম সেখানে
মূল্যবান নৈতিক হাতিয়ার।
জোসেফ বলেন, ‘যখন আমরা দেখি কোনো কিছুর
পরিব্যাপ্তি এতো বিশাল এবং এতো নাটকীয়ভাবে এটা সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে, তার থেকে বোঝা যায়, এটা নিশ্চয় কোনো যৌথ কাজ সম্পাদন করছে।’
সবশেষে ধর্মের বিস্তৃতির পেছনে আরও কিছু সহজ যোগ বিয়োগ রয়েছে। সমস্ত
সংস্কৃতিতেই দেখা যাবে, যারা বেশি ধর্মভীরু তারা
বেশি সন্তান উৎপাদন করে। এর পেছনে খুব শক্ত প্রমাণ রয়েছে। এমনকি দেখা গেছে, বেশি ধর্মভীরুরা প্রজননে বেশি উর্বর, স্বাধীনচেতাদের থেকে। এবং শিশুরা ধর্মীয়
দিক থেকে সাধারণত পিতামাতার আদেশ নির্দেশ অনুসরণ করে। যে কারণে একটি সম্পূর্ণ ধর্ম
নিরপেক্ষ পৃথিবী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এবার আমাদের প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই। ধর্ম কি হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে? মানুষ কি আস্তে আস্তে হয়ে পড়বে নাস্তিক? মানসিক,
স্নায়বিক, ঐতিহাসিক,
সাংস্কৃতিক
এবং যৌক্তিক- এই সমস্ত কারণের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ধর্ম কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না।
ধর্মকে ভয় কিংবা ভালোবাসা যেভাবেই মানা হোক না কেন,
নিজেকে
রক্ষা করতে ধর্ম খুব বেশি মাত্রায় সার্থক। কেন?
কারণ
ধর্মের সাথে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির যোগাযোগ রয়েছে। সহজাত প্রবৃত্তি যদি মানুষকে
টিকে থাকতে সাহায্য করে, তাহলে ধর্মও টিকে থাকবে। তা
যদি না হতো তাহলে, অনেক আগেই ধর্ম হারিয়ে যেত।
এমনকি পৃথিবী থেকে যদি, খ্রিস্টান, হিন্দু,
বৌদ্ধ
এবং মুসলিমরা হারিয়েও যায়, কুসংস্কার এবং আধ্যাত্মিকতা
ঠিকই টিকে থাকবে। পৃথিবীর সবচাইতে ধর্ম নিরপেক্ষ সরকারও তার নাগরিকদের সবকিছু থেকে
সুরক্ষা দিতে পারবে না। যখনই কোন পরিবেশগত বিপর্যয় হবে, অথবা শুরু হবে পারমাণবিক যুদ্ধ, কিংবা কোনো গ্রহাণু ছুটে এসে আঘাত করবে
প্রিয় পৃথিবীকে, মানুষের অস্তিত্ব হুমকির
মুখে পড়বে, তখনই মানুষ হিতাহিত জ্ঞান
হারাবে। মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়,
বেঁচে
থাকার জন্য সে করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। কিন্তু সেই মানুষ যখন বুঝতে পারে
তার হাতে বিপদ ঠেকানোর সাধ্য নেই, সে
শুধুই একজন সামান্য মানুষ, তখনই ঈশ্বর আবির্ভূত হয় তার
মনে। যে কারণে দুর্বল ঈশ্বর বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। ঈশ্বর বরাবরই সর্বশক্তিমান।
ঈশ্বর হচ্ছেন তিনি, যিনি ঠিক তাই করতে পারেন, যা মানুষ পারে না।
সূত্র : বিবিসি
বাংলামেইল২৪ডটকম/ এপি/ জেএ
( সৌজন্য আরাফাত পারভেজ, নিউজরুম এডিটর, বাংলামেইল২৪ডটকম )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন