বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জেনারেল সফিউল্লার কিছু অজানা বয়ান ৷( সূত্র ) লেখক মুনতাসীর মানুনের জনকণ্ঠে প্রকাশিত ধারাবাহিক একটি লেখার ২টি পর্ব এবং ২০ জানুয়ারীর পরের ৭ম পর্ব ;
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান
- মুনতাসীর মামুন
রাষ্ট্রপতির কাছে অর্গানোগ্রাম বিষয়ে যেদিন আলোচনা করতে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি শফিউল্লাহকে জানালেন, জিয়াউর রহমানকে তিনি পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন শফিউল্লাহ। কারণ তিনি খবরটি জানতেন না। তাই বঙ্গবন্ধুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানালেন, বিভিন্নজনের মাধ্যমে জিয়া তাকে খবর পাঠাচ্ছিলেন শফিউল্লাহকে যেন আরেক টার্মের জন্য সেনাপ্রধান না করা হয় [শফিউল্লাহর টার্ম শেষ হয়েছিল ৭.৪.১৯৭৫ সালে]। সেনাপ্রধান যেন জিয়াকে করা হয়। এসব তদ্বিরে কাজ না হওয়ায় জিয়া নিজে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং একই অনুরোধ করেন। শুধু তাই নয়, এও জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালভাবে সার্ভ ( serve) করতে পারবেন।
( লেখাটির মূল সারাংশ -বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান -মুনতাসীর মামুন
(১২ ফেব্রুয়ারির পর)
জেনারেল শফিউল্লাহই দেখুন কী বলেছেন- “বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার (অব.) মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনই সশস্ত্র বাহিনীকে সম্মান করেনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন বাণিজ্য করে আমাকে অপমান করেছেন। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে নিজের ও দলের ক্ষতি করেছেন। দুর্নীতিমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা ও সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার খুবই দরকার। রাজনৈতিক দলে একনায়কতন্ত্রের অবসান জরুরি। আমাদের সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত। এই সেনাবাহিনীর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য বর্তমান সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা (অব.) মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ নয়াদিগন্তকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে দেশের সার্বিক বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়েও তিনি তার নিজের অবস্থান ও পরিবেশ-পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ যাবৎ যেসব তথ্য বই আকারে বা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছে তার অনেকগুলোতেই প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হয়েছে। ওই দিন কী ঘটেছিল, তিনি কী ভূমিকা পালন করেছেন সেগুলো নিয়ে তিনি শিগগিরই একটি বই প্রকাশ করবেন।
আপনি রাজনীতিতে এলেন কীভাবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমার এলাকা হলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। ঢাকার খুব কাছে অথচ এ এলাকাটি ছিল দীর্ঘদিন অবহেলিত। আমার অনুন্নত এলাকা ও এলাকার অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯৯৩ সালের কোনো একদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে খবর দিলেন। আমি গেলাম। তার সাথে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা আমার আলাপ হয়। সেই আলাপ পুরোটাই ছিল ১৫ আগস্টের কালো দিনটি নিয়ে। তিনি আমার কাছ থেকে সবকিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ... আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সেই দূরত্ব দূর করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগে আমার মূল্যায়ন হয়নি। আমি যখন আওয়ামী লীগে যোগদান করলাম এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলাম তখন আমার প্রত্যাশা ছিল হয়তো আমাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে আমার যারা শুভাকাক্সক্ষী তাদেরও এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূর্ণতা লাভ করেনি। এ নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে আমার কথাও হয়। তিনি আমাকে জানান, “১৫ আগস্টের ব্যাপারে আমি আপনাকে প্রটেক্ট করতে পারিনি।” [দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৬.৬.২০০৭]
আওয়ামী লীগ একবার তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি দেখে তার এই ক্ষোভ। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলে একনায়কতন্ত্রের অবসান [অর্থাৎ শেখ হাসিনার] জরুরি। আমাদের সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত। এই সেনাবাহিনীর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। জেনারেল শফিউল্লাহ ও অন্যদের বয়ান এর বিপরীত। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারাও এ ধরনের কথা প্রায়ই বলতেন। এবং এতদিন পরও জেনারেল শফিউল্লাহ কাকুল প্রশিক্ষিত ধারণা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সংসদ সদস্য হলেই মন্ত্রী করতে হবে কেন? আর তিনি রাজনীতি করেছেন কতদিন? অন্যরা কতদিন! এসব বিবেচনায় রাখতে হয়।
খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা আগে উদ্ধৃত করেছি। সবশেষে তিনি রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান আনোয়ার আলম শহীদের একটি চিঠি উদ্ধৃত করেছেন। ১৫ আগস্ট সকালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রক্ষীবাহিনীর দুই উপ-পরিচালক শহীদ ও সরোয়ার মোল্লাকে ডেকে পাঠান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় সম্পর্কে ব্রিফিং করার জন্য। তারপর তিনি যে মন্তব্য করেন তা আনোয়ার উল আলম শহীদ লিখেছেন যা আগে উল্লেখ করেছি-
“শহীদ, সরোয়ার,
আমি জানি তোমরা দেশপ্রেমিক, কিন্তু আমাদের এই কাজটি করতে হয়েছে। কারণ আমরা চাইনি এ দেশটি একটি রাজতন্ত্রে পরিণত হোক।
কে. এম।”
Shaheed, Sarwar
I know you are patriots, but we had to do it because we do not want this country to be a kingdom.
K. M]
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে শফিউল্লাহকে নিয়ে বিতর্ক হয়েছে আর এখন জিয়াউর রহমানকে একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। জিয়া ষড়যন্ত্রে ছিলেন এখন এটি আর অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শুধু তার কথা বললে অন্যদের আড়াল করা হয়। ১৯৭৫ সালের পর অন্য চার কর্মকর্তা তাহের, মনজুর, খালেদ ও শাফায়াত জামিলকে জিয়ার বিরুদ্ধচারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ‘দেশপ্রেম’ রাজনীতি ‘বৈপ্লবিক চিন্তাধারা’ ইত্যাদি দিয়ে মহিমান্বিত করা হয়। কিন্তু ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এ ধারণা ভুল। কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন ও জিয়াকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। জিয়া সে সুযোগ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী তাহেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি [হত্যা] দেন। মনজুর শেষতক জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন। এরশাদের পরিকল্পনায় তিনি এলিমিনেটেড হন। জিয়া ক্ষমতায় গিয়ে শাফায়াত জামিলকে বরখাস্ত করেন। সুতরাং ওই দিক থেকে দেখলে কেউই বিপ্লবী নন। সবাই বঙ্গবন্ধুর উৎখাতকারী বা উৎখাতে সহায়তাকারী।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিদ্রোহ দমন করা যেত। কিন্তু তাতে কেউ উৎসাহী ছিলেন না। এই বিদ্রোহ দমনে বিমানবাহিনী ভূমিকা রাখতে পারত, বিশেষ করে বিমান বাহিনীপ্রধান ছিলেন তখন একে খন্দকার। কারণ সেনাবাহিনীতে গোলাবর্ষণের দিক থেকে বিমানবাহিনীর স্থান প্রথম। লিয়াকত এবং আরেকজন বৈমানিক এ কারণে উড্ডয়নও করেছিলেন। কিন্তু তাদের নামিয়ে আনা হয়। আমি শুনেছি বিভিন্ন সূত্রে যে, তারা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যান। লিয়াকতের সঙ্গে খুব সম্ভব জাসদের এক নেতার যিনি এখন খুবই গণমান্য ব্যক্তি- তার যোগ ছিল। তার মাধ্যমে ‘কিছু হবে না’ এই আশ্বাসে তাদের ডেকে আনা হয়। সীমান্ত পেরুলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং সামরিক আইনে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এই কাহিনীর সত্যতা কাগজপত্রে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। যা হোক, একে খন্দকারও কোনো ব্যবস্থা নেননি যদিও জেনারেল শফিউল্লাহর মতো তার হাত-পা বাঁধা ছিল না। হয়তো আকস্মিক এই ঘটনায় সবাই হকচকিত হয়ে গিয়েছিলেন।
আরো মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগের একাংশ খুনিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিল, হাত মিলিয়েছিল। সেক্ষেত্রে শুধু জেনারেল শফিউল্লাহকে দোষারোপ করলে অন্যদের আড়াল করা হয়।
হ্যাঁ, শফিউল্লাহ তাদের অধীনে চাকরি গ্রহণ না করলে হয়তো বলা যেত তিনি তাদের সঙ্গে যাননি। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে তা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে জন্যই তাকে অভিযুক্ত করা হয় বারবার। সবাই তো আর বীরপুরুষ হন না জাতীয় চার নেতার মতো। বীর একবারই মরেন। কাপুরুষ বারবার। তবে সেনাপ্রধান হিসেবে তার একটি দায় থেকে যায়। তিনি কিন্তু সে দায় স্বীকার করেছেন। এখানে মূল বিষয় দুটি। এক. এ হত্যা শুধু সেনাবাহিনীর একটি চক্রই করেনি। এর পেছনে আন্তর্জাতিক মদদ ছিল। কোন দেশের মদদ ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়তো যাবে না তবে অনুমান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না যেসব দেশ তারাই এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ দিয়েছে। পাকিস্তান তো বটেই। বঙ্গবন্ধুর একজন খুনি কর্নেল রশীদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সে রকম যদি কিছু হতো তাহলে খারাপ হতো না। আফটার অল আমরা দুই ভাগেই ইস্ট পাকিস্তান অ্যান্ড ওয়েস্ট পাকিস্তান একটা মুসলমান দেশ এবং মুসলমানের মধ্যে একটা ভালো সহযোগিতা রাখা এবং কনফেডারেশন স্টেট হলে বাংলাদেশ এটা ডাইরেক্ট স্বাধীন না হলেও ইনডাইরেক্ট স্বাধীনতার মতোই।”
দুই. আজকাল খুনিদের বলা হয় ‘সেনাবাহিনীর বিপথগামী অংশ।’ এর অর্থ সেনাবাহিনী-এর দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না। কিন্তু অন্তিমে এটাও তো ঠিক সেনাবাহিনী এদের বাধা দেয়নি। এর অর্থ এ নয় যে, সেনাবাহিনীর সমস্ত সৈনিক বা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু হত্যা সমর্থন করেছিলেন বা চেয়েছিলেন। কয়েকজন বাধা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু খুনিদের বিদেশ চলে যেতে দেওয়া, তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া এবং সরকারি সাহায্য দেয়া এগুলোর প্রতিবাদ কোনো সেনা কর্মকর্তাই করেননি। ‘চেইন অব কমান্ড’ ‘ডিসিপ্লিন’ ইত্যাদি অনেক শব্দ ব্যবহার করে ওই সময়ের সেনা কর্মকর্তারা তাদের অক্ষমতার কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে মূল বিষয়টি এড়ানো যায় না। কারণ যারা ক্যু করছেন তারা সামরিক শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ডের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড ফেরাবার স্থানে তাদের অবশ্যই দমন করা যায়। তখন তো শৃঙ্খলার কথা আসে না। তখন তো সবাই শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীকেই স্যালুট করেন। আসলে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশের সায় ছিল এই হত্যাকাণ্ডে। এটি আজ পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায় সেনাবাহিনীরই।)
(সমাপ্ত)
-
মেজর রশীদ এসে বসলেন কাছে। শফিউল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমনটি কিভাবে করতে পারলে? রশীদ বললেন, ‘স্যার, সে এক বিরাট কাহিনী। শফিউল্লাহ বললেন, বলো আমার সময় আছে।
নিচে আমি রশীদের বয়ানের সংক্ষিপ্ত সার দিচ্ছি।
সাফল্য আসবে না জেনেও তারা ঘটনাটি ঘটাতে চেয়েছিলেন, এটি ছিল এক ধরনের জুয়া খেলা। যদি সফল না হতেন, ধরা পড়তেন এবং ফাঁসি হতো; তা হলে ফাঁসিতে ঝোলার আগে বলে যেতেন, সিনিয়র সব অফিসারই এর সঙ্গে যুক্ত [...ঃযধঃ ধষষ ঃযব ংবহরড়ৎ ড়ভভরপবৎং বিৎব নবযরহফ ঃযরং বভভড়ৎঃ] এবং সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশেই তারা কাজটি করেছেন। শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, সিনিয়র অফিসার মানে কারা?
‘ঢাকায় আপনি ছাড়া প্রায় সবাই।’ রশীদ জানালেন, শফিউল্লাহকেও তিনি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন জানাতে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননি।
তিনি লিখেছেন, বঙ্গভবন থেকে হতাশ হয়েই ফিরছিলেন। কারণ মোশতাকের চালে তিনি হেরে গেছেন এবং এসব ক্রিমিনালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি পারেননি .left Bangabhaban with regret that I had been out-manoeuvred by Khadaker Moshtaque and I was denied the pleasure of taking action against these criminals.]
-
(১৫ জানুয়ারির পর)
তার মতে, এই নামকরণ যদি না হতো তাহলে হয়ত এই গুজব বেশি রটত না। আর বলা হয়ে থাকে, এই গুজব বেশি ছড়িয়েছিল জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। বলা হয়ে থাকে, সেনাবাহিনীতে তারা তাদের এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছে। কর্নেল তাহের ছিলেন এ রকম একজন এজেন্ট। সেনাবাহিনীতে থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন জাসদের একজন সক্রিয় সদস্য।
কর্নেল তাহের ছিলেন এজি বা এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। সেনাবাহিনীর মানসিক বল উঁচুতে রাখা ছিল তার কাজ। কিন্তু তার কর্মকাণ্ড এই লক্ষ্যে ছিল না। তিনি প্রচলিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন। জিয়া তাহেরকে উৎসাহিত করছিলেন সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য। দুজনই ছিলেন উচ্চাকাক্সক্ষী। পরে তাদের বন্ধুত্ব পরিণত হয় শত্রুতায়। জিয়া তাহেরকে ফাঁসিতে লটকান।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে ১৯৭৪ সালে একটি বিল পাস করায়। এর মাধ্যমে ওয়ারেন্ট ছাড়া রক্ষীবাহিনীকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হলো। এর ফলে দুই বাহিনীর সম্পর্ক আরও খারাপ হলো।
অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা যারা আত্মজীবনী লিখেছেন তাদের গ্রন্থেও রক্ষীবাহিনীর বিষয়টি এসেছে। তারাও শফিউল্লাহর মতো বলেছেন, রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সে সময় যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার কোনটিরই সত্যতা ছিল না, এগুলো ছিল গুজব। আর এসব পল্লবিত হয়েছিল। ফলে সেনাবাহিনীর কাছে রক্ষীবাহিনী হয়ে উঠেছিল স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
৫. এর ওপর যুক্ত হয়েছিল আরেকটি ধারণা। সে ধারণাটি হলো, রাজনৈতিক নেতারা সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করতেন না। তারা দেখেছিল, রাজনৈতিক নেতারা সামরিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
এখানে দুটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এ ধরনের প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল কুমিল্লায়। সেনাবাহিনীর কাছে খবর ছিল সেখানকার মহিলা সংসদ সদস্য কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন যা তার করা উচিত ছিল না। সেনাবাহিনী তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গুঁড়োদুধ উদ্ধার করে। ত্রাণের জন্য একজন এমপির বাসায় গুঁড়োদুধের মজুদ থাকতে পারে কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র তো থাকার কথা নয়। শফিউল্লাহ নিজে ওই এমপির বাসায় যান এবং তল্লাশি প্রক্রিয়া খুঁটিয়ে দেখেন। তাতে কোন ত্রুটি ছিল না। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক বিষয়টি পছন্দ করেননি। বিশেষ করে তার এলাকায় সেনাবাহিনী যেভাবে কড়াকড়ি করছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, সেনাবাহিনী অন্যায় কাজ করেছে এবং জনগণের কাছে মহিলা ছোট হয়ে গেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করেন, সেনাপ্রধানকে যেন সরিয়ে দেয়া হয়।
শফিউল্লাহ পরে পুরো ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে বিবৃত করেন। তাজউদ্দীন আহমদও ছিলেন সেখানে। সব শুনে তিনি প্রস্তাব করলেন, একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে দেখা হোক সেনাবাহিনী তাদের সীমা লঙ্ঘন করেছে কিনা। তখন ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আর সেনাবাহিনীর বক্তব্য যদি ঠিক হয় তা হলে ওই মহিলাকে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তদন্ত কমিটি আর হয়নি। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘খন্দকার মোশতাকের মতো মানুষ ঘটনাটি ভোলেননি। যে কারণে ১৫ আগস্টের পর আমাকে বরখাস্ত করা হয়।’
কুমিল্লায় সেনা অভিযান চলাকালে ডালিম কিছু অঘটন সৃষ্টি করেন। ছাত্রজীবনে ডালিম ছিলেন ‘ডানপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের’ সদস্য। শফিউল্লাহ অবশ্য এখানে একটু ভুল করেছেন ডানপন্থী কখনও ‘প্রগ্রেসিভ’ হয় না। খুব সম্ভব শফিউল্লাহ এনএসএফের কথা বলছেন। সেই সংগঠনে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে ছিল। ডালিম সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে যুক্ত ছিলেন তাদের সঙ্গে। ওই সময় বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে তার কিছু দ্বন্দ্ব ছিল যার মীমাংসা হয়নি। ডালিম সে রকম প্রাক্তন কিছু ছাত্রকে তার দফতরে ডেকে পাঠান এবং নিপীড়ন করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক শফিউল্লাহকে জানালে তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন এবং অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ডালিমকে তিরস্কার করা হয় ও ওই ছাত্রদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। খুলনা, বরিশালেও ওই তল্লাশি নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। দুজন সেনা কর্মকর্তাকে শফিউল্লাহ প্রত্যাহার করেন। জিয়া এসব ব্যাপারে তাকে সাহায্য না করে বরং এসব বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেন। শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে সবই জানিয়েছিলেন। পরে ডালিম, নূর ও আরও কয়েক জনকে চাকরিচ্যুত করা হয় শফিউল্লাহকে না জানিয়ে। ফলে সেনাবাহিনীতে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘ডালিম উচ্ছৃঙ্খল ছিল কিন্তু তারা নয়, সে জন্য তাদের এত বড় শাস্তির প্রয়োজন ছিল না।’ শফিউল্লাহর মনে হয়েছে তারা [ডালিম ব্যতীত] মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাদের এই শাস্তি প্রাপ্য ছিল না। এটা অবিচার হয়েছে। সেনাদের আওয়ামী লীগবিরোধী হওয়ার এটি একটি কারণ।
শফিউল্লাহ এরপর ডালিমের সঙ্গে গাজী গোলাম মোস্তফার সংঘাতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনার নির্যাস সবার জানা। তাই এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না।
এ ঘটনার পর তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে ছিলেন জিয়া ও কর্নেল শাফায়াত। সেখানে তিনি পুরো ঘটনা যা তিনি জানতেন তা তুলে ধরেন।
ঘটনার দিন ডালিম ও তার স্ত্রী গাজী গোলাম মোস্তফার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ৩২ নম্বরে আসেন। গাজীও আসেন। কর্নেল শাফায়াত জামিলও ছিলেন। হয়ত তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সামনে ডালিম খুব রূঢ় ব্যবহার করেন যাতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন। মিলিটারি পুলিশ গাজীর বাসভবন ঘিরে আছে এ কথাও তখন এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল এরশাদকে জানানো হয়েছিল। শফিউল্লাহ এসব কিছুই জানতেন না। কারণ, শাফায়াত জামিল তাকে জানাননি যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন, এরশাদ পরের দিন শফিউল্লাহকে জানান।
দু’দিন পর ২৪ জুন সদর দফতরে এ জন্য বেশ উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছিল। তাদের আশা সরকার গাজী গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তারা আরও অপেক্ষা করছিল তাদের সেনাপ্রধান কী করেন তা দেখার জন্য। জিয়াও তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করছিলেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া ও শাফায়াতকে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তারা প্রায় এক ঘণ্টা ছিলেন। তাকে খুবই বিরক্ত দেখাচ্ছিল। তিনি জানতে চাইলেন, মিলিটারি পুলিশ কেন বেসামরিক এলাকায় গেল কোন রকম কর্তৃত্ব ছাড়া। শফিউল্লাহ জানালেন, তারা কোন অসৎ উদ্দেশে যায়নি। তারা গিয়েছিল আর্মির একজন অফিসারকে উদ্ধার করতে। বরং গাজী গোলাম মোস্তফা যা করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রপতি সে কথা শুনলেন না। তখন শফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার গাজী গোলাম মোস্তফা গুরুতর একটি অপরাধ করেছে এবং তার শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে সৈনিকদের ওপর এর অভিঘাত খারাপ হবে।’ এ কথা শুনে রাষ্ট্রপতি আরও বিরক্ত হলেন।
শফিউল্লাহ লিখেছেন, যেভাবে আমি উত্তর দিলাম তা ঠিক হয়নি। তবু তিনি বললেন, “স্যার, আমি জানি যে, আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু স্যার, আমি এখানে নিজের জন্য বলতে আসিনি, আমি এখানে আপনার জন্য বলতে এসেছি। গাজী গোলাম মোস্তফা শত শত লোকের সামনে যা করেছেন তা মেনে নেয়া যায় না। তিনি যা করেছেন তার জন্য শাস্তি হওয়া দরকার। তিনি একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন হয়তো হত্যার জন্য। গাজী গোলাম মোস্তফার এই আচরণ affecting the morale of the troops. আপনি কেন অন্যের কুকাণ্ডের দায়িত্ব নেবেন?” যা হোক, রাষ্ট্রপতি ঘটনার গভীরতা হয়ত অনুধাবন করেননি। লিখেছেন শফিউল্লাহ, ‘তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। আমি রাষ্ট্রপতির বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম গাজী গোলাম মোস্তফার শাস্তি চেয়ে।’
এর দু’দিন পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তৃতীয় দিন বিপর্যস্ত ডালিম শফিউল্লাহর দফতরে এসে জানতে চাইলেন, গাজীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন জানিয়ে বললেন, হয়ত শীঘ্রই কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডালিম এক পর্যায়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে টেবিলে চাপড়ে বললেন, “He while expressing his grief, at one stage became so emotional that he thumped on my table”. শফিউল্লাহ চিৎকার করে তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ডালিম বেরিয়ে গেলেন।
আরও দু’দিন পর বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে ডেকে পাঠালেন তার অফিসে এবং প্রায় অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডালিম যে তার টেবিল চাপড়ে গেল তার তিনি কী করেছেন?’ এ প্রশ্নে শফিউল্লাহ হকচকিয়ে গেলেন। উত্তর দিলেন, ‘স্যার, মেজর ডালিম যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমার অফিসে এসে সে ইমোশনাল হয়ে গেছে। যা হোক আমার অফিসে সে যা করেছে তা হলো- an outburst of that emotion.’ শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জিজ্ঞাসায়। তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার, আপনি বিষয়টি জানলেন কীভাবে?’ রাষ্ট্রপতি বললেন তাকে, ‘শফিউল্লাহ, তোমার সদর দফতরে অনেক কিছু ঘটে যা তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি।’ তারপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, তোমার কিছু অফিসার বৈঠকখানায় তাজা অ্যামুনিশন রাখে?”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার চিন্তায় ছিল শুধুই গাজী গোলাম মোস্তফার বিষয়টি। তার ভাষায়- “I was in some sort of aggressive mood, but with this type of question the President put me on the defensive. I did not expect this type of question from him! He caught me off guard and was on the offensive.”
গোলাম মোস্তফার সঙ্গে এসব প্রশ্নের কোন যোগসূত্র ছিল না। তবু শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে জানালেন তিনি বিষয়গুলো দেখবেন এবং যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতিকে আবারও অনুরোধ জানালেন, গাজীর বিষয়টি সুরাহা করার। তিনি জানালেন, বিষয়টির দ্রুত সুরাহা করা উচিত। কারণ তা “having a very bad impact on the morale of the entire army. গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে শফিউল্লাহর ভাষায় “It might be beyond my control.” তিনি জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে তিনি যখন বেরুচ্ছেন তখন তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না।
ফেরার পথে শফিউল্লাহ চিন্তা করছিলেন ডালিমের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু জানলেন কীভাবে? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, দুটি উৎস থেকে তিনি খবর পেয়েছেন। এক. তার ডেপুটি জিয়াউর রহমানের অফিস, দুই. ডিজিএফআই। যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিনই রাষ্ট্রপতি বিষয়টি জেনেছেন। ডিজিএফআই একদিন পর খবরটি জানায়। ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন, সেনাপ্রধানকে নয়।
তাজা অ্যামুনিশনের ব্যাপারটাও জানলেন। ক্যাপ্টেন মতিন মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে গুলিভর্তি একটি বেল্ট সাজিয়ে রেখেছিলেন বসার ঘরে। এটি এমন কোন ব্যাপার ছিল না। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ব্রিগেডিয়ার রউফ তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন এই ধরনের স্মারক রাখা যায় না। কিন্তু তিনি তা করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তান ফেরত।
শফিউল্লাহ আবার রাষ্ট্রপতির কাছে গেলেন বিষয়টি আরও খোলাসা করতে। এটিও বললেন, রউফের উচিত ছিল আগে তাকে ঘটনাটি জানানো। কারণ মতিনের উর্ধতন অফিসার তিনি। ফেরার আগে আবারও তিনি অনুরোধ করেন গাজীর ব্যাপারে কিছু করার জন্য।
গাজীর ব্যাপারে যখন তিনি সরকারী সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি পেলেন। সে চিঠিতে ডালিমকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি ফের গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে, যাতে তিনি সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। সিদ্ধান্ত বাতিল হয়নি। তার মনে হয়েছিল সেনাবাহিনীর সামনে তাকে ছোট করা হয়েছে। তার ভাষায়- “By this order my command had been completely shattered. This dismissal order made me small and I was belittled in the eyes of my subordinates.” তখন তিনি পদত্যাগের কথাও ভেবেছিলেন। করেননি। কারণ তাতে সামগ্রিক কোন লাভ হতো না। বরং ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য তিনি অপেক্ষা করা ভাল মনে করেছিলেন।
মেজর ডালিমকে তিনি নির্দেশটি জানান। ডালিম জানতে চান তিনি কী এমন করেছেন যার জন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া হলো। শফিউল্লাহ জবাব দিতে পারেননি। ডালিমের বরখাস্তের নির্দেশ জানাজানি হলে অগ্নিতে যেন ঘি ঢালা হলো। কিছু অফিসার সরকার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করলেন। এর মধ্যে সোচ্চার ছিলেন জিয়ার পিএস মেজর নূর। এই ঘটনা জানানো হলো রাষ্ট্রপতিকে। পরদিন নূরের বরখাস্তের নির্দেশ এলো। শফিউল্লাহ লিখেছেন, “দুর্ভাগ্য যে, আমি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলাম। আমার আর নৈতিক কোন অধিকার থাকল না বাহিনীকে আমার পাশে জড়ো করার। কারণ তাদের আশ্রয় দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ডেপুটি জিয়া এর পূর্ণ সুযোগ নিলেন এবং তখনই তাদের প্রবক্তা [চ্যাম্পিয়ন] হয়ে উঠলেন। অধস্তনরা আমার ওপর বিশ্বাস হারাল।” [ও ধিং ঃযঁং ৎিড়হমবফ ভড়ৎ হড় ভধঁষঃ ড়ভ সরহব.”]
শফিউল্লাহর মতে, ডালিম নূরদের প্রতি যে ‘অবিচার’ করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের এটি ছিল একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা এরপর ডালিমকে তাদের ষড়যন্ত্রে জড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৫ আগস্টের পর ডালিমদের যে প্রতিরোধ করা যায়নি তার জন্য কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে দায়ী করেন।
শাফায়াত সম্পর্কে তার অভিযোগ, ১৫ আগস্ট সকালে তিনি শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দেন, ডালিমদের প্রতিরোধ করার। তিনি তা করেননি। এমনকি ডালিমকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতেও বাধা দেননি। হয়ত শাফায়াত ডালিমের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যে কারণে শাফায়াত তাদের প্রতিরোধ করেননি। ডালিম শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয় সৈন্য নিয়ে শফিউল্লাহর অফিসেও যান।
অভিযোগ করে তিনি আরও লিখেছেন, “যাদের ওপর আমি নির্ভর করতে পারতাম তারাই নিজস্ব স্বার্থের কারণে আমার নির্দেশ মানেননি। যে কারণে আমি যে মন্তব্য করছি তা হলো, শাফায়াত ছিলেন আমার একমাত্র শক্তি কিন্তু তিনি আমার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। আমার নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেননি। নির্দেশ না মেনে তিনি বরং গেছেন জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে। অন্যদিকে সিজেএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ওপর আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তিনি যে কাজ করলেন, তা তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ১৫ আগস্ট দুপুরে তিনি বিদ্রোহী সৈন্যদের, ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টকে গোলাবারুদ ইস্যু করেন আমাকে না জানিয়ে। তার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস তারপর কীভাবে রাখি? সেই থেকে আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হয়ে গেলাম। মোশতাক আমার এই দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। অন্য কর্মকর্তা ও সৈন্যদের থেকে আলাদা করে এবং বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখেন বঙ্গভবনে।”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, শাফায়াত হয় তাদের সঙ্গে ছিলেন অথবা তাদের প্রতি সমব্যথী কোন কর্মকর্তার নির্দেশ শুনছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রতি সৈন্যদের সমবেদনা ছিল কিন্তু তারা যা করেছে তাতে সমবেদনা তাদের প্রাপ্য ছিল না। তার মতে “আমি যখন ৪৬ ব্রিগেডে গেলাম তখন দেখি সৈন্যরা স্থবির [আনমুভড]। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধে আমি সৈন্য সংগ্রহ করতে পারিনি।”
পাঁচ.
‘বঙ্গবন্ধু হত্যা’ শীর্ষক অধ্যায়ে শফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর খুঁটিনাটি অনেক বিষয় আলাপ করেছেন। ওইসব বিষয় বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। দু’-একটি বিষয়ের উল্লেখ করব।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কুমিল্লার এক এনসিওকে গ্রেফতার করে। তিনি আপত্তিজনক কিছু লিফলেট বিলি করছিলেন। লিফলেটে সেনা বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের বাইরে। শফিউল্লাহ জানতে পেরেছিলেন যে, এর জন্য দায়ী জাসদ। এ প্রসঙ্গে তিনি ডিএফআই-এর কথা আলোচনা করেছেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তা ছিল সেনাপ্রধানের অধীন। রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় তা চলে যায় রাষ্ট্রপতির অধীন। তখন তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চেয়েছিলেন এবং তার অর্গানোগ্রামও দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার রউফকেও দায়ী করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় রউফ পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন কুর্মিটোলায় বন্দী তখন যেভাবেই হোক রউফ তার আস্থায় আসেন। সে জন্য রউফকে বঙ্গবন্ধু ডিএফআইয়ের প্রধান করেছিলেন। শফিউল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলামও এ ষড়যন্ত্রে জড়িত। বঙ্গবন্ধু গোয়েন্দা সংস্থার সীমাবদ্ধতা জেনে নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন দ্রুত অর্গানোগ্রাম পাস করে দিতে। শফিউল্লাহর সামনেই নুরুল ইসলামকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম সে নির্দেশ মানেননি। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব জামিল আহমদকে পরে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ডিএফআইয়ের প্রধান হিসেবে। ১৫ আগস্ট তার দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কথা। সেদিনই তিনি নিহত হন।
এর দু’দিন পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তৃতীয় দিন বিপর্যস্ত ডালিম শফিউল্লাহর দফতরে এসে জানতে চাইলেন, গাজীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন জানিয়ে বললেন, হয়ত শীঘ্রই কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডালিম এক পর্যায়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে টেবিলে চাপড়ে বললেন, “He while expressing his grief, at one stage became so emotional that he thumped on my table”. শফিউল্লাহ চিৎকার করে তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ডালিম বেরিয়ে গেলেন।
আরও দু’দিন পর বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে ডেকে পাঠালেন তার অফিসে এবং প্রায় অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডালিম যে তার টেবিল চাপড়ে গেল তার তিনি কী করেছেন?’ এ প্রশ্নে শফিউল্লাহ হকচকিয়ে গেলেন। উত্তর দিলেন, ‘স্যার, মেজর ডালিম যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমার অফিসে এসে সে ইমোশনাল হয়ে গেছে। যা হোক আমার অফিসে সে যা করেছে তা হলো- an outburst of that emotion.’ শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জিজ্ঞাসায়। তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার, আপনি বিষয়টি জানলেন কীভাবে?’ রাষ্ট্রপতি বললেন তাকে, ‘শফিউল্লাহ, তোমার সদর দফতরে অনেক কিছু ঘটে যা তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি।’ তারপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, তোমার কিছু অফিসার বৈঠকখানায় তাজা অ্যামুনিশন রাখে?”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার চিন্তায় ছিল শুধুই গাজী গোলাম মোস্তফার বিষয়টি। তার ভাষায়- “I was in some sort of aggressive mood, but with this type of question the President put me on the defensive. I did not expect this type of question from him! He caught me off guard and was on the offensive.”
গোলাম মোস্তফার সঙ্গে এসব প্রশ্নের কোন যোগসূত্র ছিল না। তবু শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে জানালেন তিনি বিষয়গুলো দেখবেন এবং যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতিকে আবারও অনুরোধ জানালেন, গাজীর বিষয়টি সুরাহা করার। তিনি জানালেন, বিষয়টির দ্রুত সুরাহা করা উচিত। কারণ তা “having a very bad impact on the morale of the entire army. গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে শফিউল্লাহর ভাষায় “It might be beyond my control.” তিনি জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে তিনি যখন বেরুচ্ছেন তখন তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না।
ফেরার পথে শফিউল্লাহ চিন্তা করছিলেন ডালিমের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু জানলেন কীভাবে? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, দুটি উৎস থেকে তিনি খবর পেয়েছেন। এক. তার ডেপুটি জিয়াউর রহমানের অফিস, দুই. ডিজিএফআই। যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিনই রাষ্ট্রপতি বিষয়টি জেনেছেন। ডিজিএফআই একদিন পর খবরটি জানায়। ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। তিনি রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন, সেনাপ্রধানকে নয়।
তাজা অ্যামুনিশনের ব্যাপারটাও জানলেন। ক্যাপ্টেন মতিন মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে গুলিভর্তি একটি বেল্ট সাজিয়ে রেখেছিলেন বসার ঘরে। এটি এমন কোন ব্যাপার ছিল না। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ব্রিগেডিয়ার রউফ তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন এই ধরনের স্মারক রাখা যায় না। কিন্তু তিনি তা করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তান ফেরত।
শফিউল্লাহ আবার রাষ্ট্রপতির কাছে গেলেন বিষয়টি আরও খোলাসা করতে। এটিও বললেন, রউফের উচিত ছিল আগে তাকে ঘটনাটি জানানো। কারণ মতিনের উর্ধতন অফিসার তিনি। ফেরার আগে আবারও তিনি অনুরোধ করেন গাজীর ব্যাপারে কিছু করার জন্য।
গাজীর ব্যাপারে যখন তিনি সরকারী সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি পেলেন। সে চিঠিতে ডালিমকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি ফের গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে, যাতে তিনি সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। সিদ্ধান্ত বাতিল হয়নি। তার মনে হয়েছিল সেনাবাহিনীর সামনে তাকে ছোট করা হয়েছে। তার ভাষায়- “By this order my command had been completely shattered. This dismissal order made me small and I was belittled in the eyes of my subordinates.” তখন তিনি পদত্যাগের কথাও ভেবেছিলেন। করেননি। কারণ তাতে সামগ্রিক কোন লাভ হতো না। বরং ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য তিনি অপেক্ষা করা ভাল মনে করেছিলেন।
মেজর ডালিমকে তিনি নির্দেশটি জানান। ডালিম জানতে চান তিনি কী এমন করেছেন যার জন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া হলো। শফিউল্লাহ জবাব দিতে পারেননি। ডালিমের বরখাস্তের নির্দেশ জানাজানি হলে অগ্নিতে যেন ঘি ঢালা হলো। কিছু অফিসার সরকার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করলেন। এর মধ্যে সোচ্চার ছিলেন জিয়ার পিএস মেজর নূর। এই ঘটনা জানানো হলো রাষ্ট্রপতিকে। পরদিন নূরের বরখাস্তের নির্দেশ এলো। শফিউল্লাহ লিখেছেন, “দুর্ভাগ্য যে, আমি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলাম। আমার আর নৈতিক কোন অধিকার থাকল না বাহিনীকে আমার পাশে জড়ো করার। কারণ তাদের আশ্রয় দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ডেপুটি জিয়া এর পূর্ণ সুযোগ নিলেন এবং তখনই তাদের প্রবক্তা [চ্যাম্পিয়ন] হয়ে উঠলেন। অধস্তনরা আমার ওপর বিশ্বাস হারাল।” [ও ধিং ঃযঁং ৎিড়হমবফ ভড়ৎ হড় ভধঁষঃ ড়ভ সরহব.”]
শফিউল্লাহর মতে, ডালিম নূরদের প্রতি যে ‘অবিচার’ করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের এটি ছিল একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা এরপর ডালিমকে তাদের ষড়যন্ত্রে জড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৫ আগস্টের পর ডালিমদের যে প্রতিরোধ করা যায়নি তার জন্য কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে দায়ী করেন।
শাফায়াত সম্পর্কে তার অভিযোগ, ১৫ আগস্ট সকালে তিনি শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দেন, ডালিমদের প্রতিরোধ করার। তিনি তা করেননি। এমনকি ডালিমকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতেও বাধা দেননি। হয়ত শাফায়াত ডালিমের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যে কারণে শাফায়াত তাদের প্রতিরোধ করেননি। ডালিম শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয় সৈন্য নিয়ে শফিউল্লাহর অফিসেও যান।
অভিযোগ করে তিনি আরও লিখেছেন, “যাদের ওপর আমি নির্ভর করতে পারতাম তারাই নিজস্ব স্বার্থের কারণে আমার নির্দেশ মানেননি। যে কারণে আমি যে মন্তব্য করছি তা হলো, শাফায়াত ছিলেন আমার একমাত্র শক্তি কিন্তু তিনি আমার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। আমার নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেননি। নির্দেশ না মেনে তিনি বরং গেছেন জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে। অন্যদিকে সিজেএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ওপর আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তিনি যে কাজ করলেন, তা তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ১৫ আগস্ট দুপুরে তিনি বিদ্রোহী সৈন্যদের, ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টকে গোলাবারুদ ইস্যু করেন আমাকে না জানিয়ে। তার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস তারপর কীভাবে রাখি? সেই থেকে আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হয়ে গেলাম। মোশতাক আমার এই দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। অন্য কর্মকর্তা ও সৈন্যদের থেকে আলাদা করে এবং বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখেন বঙ্গভবনে।”
শফিউল্লাহ লিখেছেন, শাফায়াত হয় তাদের সঙ্গে ছিলেন অথবা তাদের প্রতি সমব্যথী কোন কর্মকর্তার নির্দেশ শুনছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রতি সৈন্যদের সমবেদনা ছিল কিন্তু তারা যা করেছে তাতে সমবেদনা তাদের প্রাপ্য ছিল না। তার মতে “আমি যখন ৪৬ ব্রিগেডে গেলাম তখন দেখি সৈন্যরা স্থবির [আনমুভড]। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধে আমি সৈন্য সংগ্রহ করতে পারিনি।”
পাঁচ.
‘বঙ্গবন্ধু হত্যা’ শীর্ষক অধ্যায়ে শফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর খুঁটিনাটি অনেক বিষয় আলাপ করেছেন। ওইসব বিষয় বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। দু’-একটি বিষয়ের উল্লেখ করব।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কুমিল্লার এক এনসিওকে গ্রেফতার করে। তিনি আপত্তিজনক কিছু লিফলেট বিলি করছিলেন। লিফলেটে সেনা বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের বাইরে। শফিউল্লাহ জানতে পেরেছিলেন যে, এর জন্য দায়ী জাসদ। এ প্রসঙ্গে তিনি ডিএফআই-এর কথা আলোচনা করেছেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তা ছিল সেনাপ্রধানের অধীন। রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় তা চলে যায় রাষ্ট্রপতির অধীন। তখন তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চেয়েছিলেন এবং তার অর্গানোগ্রামও দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার রউফকেও দায়ী করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় রউফ পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন কুর্মিটোলায় বন্দী তখন যেভাবেই হোক রউফ তার আস্থায় আসেন। সে জন্য রউফকে বঙ্গবন্ধু ডিএফআইয়ের প্রধান করেছিলেন। শফিউল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলামও এ ষড়যন্ত্রে জড়িত। বঙ্গবন্ধু গোয়েন্দা সংস্থার সীমাবদ্ধতা জেনে নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন দ্রুত অর্গানোগ্রাম পাস করে দিতে। শফিউল্লাহর সামনেই নুরুল ইসলামকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম সে নির্দেশ মানেননি। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব জামিল আহমদকে পরে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ডিএফআইয়ের প্রধান হিসেবে। ১৫ আগস্ট তার দায়িত্ব বুঝে নেয়ার কথা। সেদিনই তিনি নিহত হন।
রাষ্ট্রপতির কাছে অর্গানোগ্রাম বিষয়ে যেদিন আলোচনা করতে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি শফিউল্লাহকে জানালেন, জিয়াউর রহমানকে তিনি পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন শফিউল্লাহ। কারণ তিনি খবরটি জানতেন না। তাই বঙ্গবন্ধুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানালেন, বিভিন্নজনের মাধ্যমে জিয়া তাকে খবর পাঠাচ্ছিলেন শফিউল্লাহকে যেন আরেক টার্মের জন্য সেনাপ্রধান না করা হয় [শফিউল্লাহর টার্ম শেষ হয়েছিল ৭.৪.১৯৭৫ সালে]। সেনাপ্রধান যেন জিয়াকে করা হয়। এসব তদ্বিরে কাজ না হওয়ায় জিয়া নিজে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং একই অনুরোধ করেন। শুধু তাই নয়, এও জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালভাবে সার্ভ (ংবৎাব) করতে পারবেন।
সাত.
মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর জিয়া খালেদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অপস অর্ডার’ তৈরি হয়েছে কিনা। খালেদ জানালেন, এখনও তৈরি হয়নি। জিয়া তখন রূঢ়ভাবে তাকে বললেন, যেখানে তার এখন বসে ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করার কথা সেখানে তিনি বঙ্গভবনে বসে কী করছেন? তার সামনে খালেদের সঙ্গে জিয়ার এ রকম আচরণ শফিউল্লাহ পছন্দ করেননি। জিয়াকে তিনি জানালেন, একজন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে এ রকম আচরণ ঠিক নয়, তাও আবার তার সামনে। তার মনে হচ্ছিল, জিয়া চাচ্ছেন না, খালেদ শফিউল্লাহর কাছাকাছি থাকুক। তারা যখন ফিরবেন তখন মোশতাক জানালেন, তিনি রাতে তিন প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। শফিউল্লাহ যেন বঙ্গভবন ছেড়ে না যান।
রাতে বৈঠকে মোশতাক জিজ্ঞেস করলেন, সামরিক আইন জারির দরকার আছে কিনা? শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন এ প্রশ্ন আসছে কেন? সামরিক আইন তো ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে। এখন শুধু গেজেট নোটিফিকেশন করলেই চলে। মোশতাক জানতে চাইলেন, নোটিফিকেশন ইস্যু হবে কার নামে? শফিউল্লাহ বললেন, কেন রাষ্ট্রপতির নামে। মোশতাক চটে গিয়ে বললেন, সেনাবাহিনী সামরিক আইন ঘোষণা করেছে, এখন তা রাষ্ট্রপতির নামে ইস্যু হবে কেন? শফিউল্লাহ বললেন, একটি সরকার ক্ষমতায় থাকলে সামরিক বাহিনী মার্শাল ল’ ঘোষণা করতে পারে না। গলা চড়িয়ে মোশতাক বললেন, ‘তোমার বাহিনী যেহেতু ঘোষণা করেছে সেহেতু দায়িত্ব এখন তোমার।’
শফিউল্লাহ জানালেন, দায়িত্ব পালনে তিনি ভীত নন, সেনাবাহিনী যদি তার হতো তাহলে তার নামেই সামরিক আইন জারি হতো। কিন্তু তারা রাষ্ট্রপতির (মোশতাক) নামে ঘোষণা করেছে। মোশতাক এবার গলার স্বর নিচু করে বললেন, তিনি এতক্ষণ তর্ক করছিলেন আইনগত দিক সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা নেয়ার জন্য। এখন এ সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্যই আলোচনা।
শফিউল্লাহ লিখেছেন, ওই সময় তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বঙ্গভবন দখল করে রাখা ডালিমদের সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া। সে জন্য মোশতাকের সঙ্গে সব বিষয়ে তর্কের ইচ্ছা তার ছিল না। ১৬ আগস্ট বিকালে কনফারেন্সের আগে তিনি বঙ্গভবনে অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গভবন ছেড়ে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যেতে। এ নির্দেশ তাদের হকচকিত করেছিল। অনেকের চোখে পানি চলে এসেছিল। কারণ, এ ধরনের নির্দেশ তারা আশা করেনি। শফিউল্লাহ কনফারেন্স রুমে পৌঁছার আগেই এসব অফিসার মোশতাকের কাছে গিয়ে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে মোশতাক তাকে বললেন, এই অফিসারদের যেন আরো কয়েকদিন থাকতে দেয়া হয় বঙ্গভবনে। শফিউল্লাহ জানালেন, তিনি বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চান। মোশতাক ফের একই কথা বললেন।
১৭ আগস্ট খালেদ এসে শফিউল্লাহকে জানালেন, আর্মাড ইউনিট যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের কাছে গোলাবারুদ নেই। শফিউল্লাহর কাছে এটি ছিল সুসংবাদ। কারণ, তা হলে এই বাহিনীকে দমন করা যাবে। তিনি খালেদকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, খবরটা ঠিক কিনা? খালেদ বললেন, কথাটা সত্য; কিন্তু তিনি ১৫ আগস্ট তাদের গোলাবারুদ দিয়েছেন। শফিউল্লাহ বললেন, তার আদেশ ছাড়া খালেদ কিভাবে বিদ্রোহীদের গোলাবারুদ সরবরাহ করলেন। খালেদ বললেন, তিনি ভেবেছেন সব মীমাংসা হয়ে গেছে, গোলাবারুদ দিতে ক্ষতি কী? [ও ঃযড়ঁমযঃ বাবৎুঃযরহম ধিং ড়াবৎ ধহফ ঃযবৎব ধিং হড় যধৎস রহ রংংঁরহম ঃযবস ঃযব ধসসঁহরঃরড়হ ঃযবহ, ংড় ও ফরফ] খালেদের এই বিষয়টি শফিউল্লাহকে অবাক করেছিল। কারণ, এতক্ষণ ধরে খালেদকেই তিনি একমাত্র বিশ্বাস করছিলেন। এখন তাতে চিড় ধরল। তিনি এখন একা।
হতাশ হয়ে একা বসে গত দুদিনের ঘটনাবলী তিনি পর্যালোচনা করছিলেন এবং জিয়া, শাফায়াত, খালেদ সবার কথাবার্তা, আচরণে একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছিলেন। তবে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কিন্তু তাদের কথাবার্তায় আচরণে যেন একটি ঐকমত্য ফুটে উঠছিল। এর মধ্যে মেজর রশীদ এসে বসলেন কাছে। শফিউল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমনটি কিভাবে করতে পারলে? রশীদ বললেন, ‘স্যার, সে এক বিরাট কাহিনী। শফিউল্লাহ বললেন, বলো আমার সময় আছে।
নিচে আমি রশীদের বয়ানের সংক্ষিপ্ত সার দিচ্ছি।
সাফল্য আসবে না জেনেও তারা ঘটনাটি ঘটাতে চেয়েছিলেন, এটি ছিল এক ধরনের জুয়া খেলা। যদি সফল না হতেন, ধরা পড়তেন এবং ফাঁসি হতো; তা হলে ফাঁসিতে ঝোলার আগে বলে যেতেন, সিনিয়র সব অফিসারই এর সঙ্গে যুক্ত [...ঃযধঃ ধষষ ঃযব ংবহরড়ৎ ড়ভভরপবৎং বিৎব নবযরহফ ঃযরং বভভড়ৎঃ] এবং সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশেই তারা কাজটি করেছেন। শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, সিনিয়র অফিসার মানে কারা?
‘ঢাকায় আপনি ছাড়া প্রায় সবাই।’ রশীদ জানালেন, শফিউল্লাহকেও তিনি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন জানাতে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননি।
রশীদের মতে, প্রথমে তারা মেজর এবং লে. কর্নেলদের জানিয়েছিলেন, তারা এতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং বলেছেন যে, সিনিয়র অফিসারদেরও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সিনিয়রদের মধ্যে প্রথমেই খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। খালেদ অফিসে ছিলেন, সেখানে শাফায়াত জামিলও ছিলেন। দু’জনকেই প্রস্তাবটি জানানো হয়, খালেদ বিষয়টিকে সিরিয়াসলি তো নিলেনই না বরং বললেন, ‘ভাগো ছেলেমানুষি করো না।’ [এবঃ ধধিু ধহফ ফড়হ’ঃ নব পযরষফরংয]। তারপর রশীদ জেনারেল জিয়ার কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে যান। জিয়া জানালেন, সিনিয়র অফিসার হিসেবে তিনি এতে যোগ দিতে পারবেন না। তবে তারা যদি সফল হয় তাহলে তিনি সহায়তা করবেন। এরা কেউই শফিউল্লাহকে বিষয়টি জানাননি।
শফিউল্লাহ লিখেছেন, এরপর সবার আচরণ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এমনকি দিল্লী থেকে আসা জেনারেল মনজুরেরও।
১৭ তারিখ সারারাত আলোচনা চলল। ১৮ তারিখ ভোরে ফজরের নামাজের পর মোশতাক এলেন। তিনি সামরিক শাসনের একটি খসড়া শফিউল্লাহকে দিলেন। শফিউল্লাহ বললেন, রাষ্ট্রপতি এখন বিশ্রাম নিতে পারেন। ইতোমধ্যে তারা খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখবেন কোথাও ভুল আছে কিনা।
‘ভুল’ কথাটি শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মোশতাক। হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘জেনারেল শফিউল্লাহ, আমি গত তিন মাস ধরে এ নিয়ে কাজ করছি।’ এটি শুনে শফিউল্লাহ চমকে উঠলেন। কোনোমতে বললেন, ‘তা হলে মনে হয় সব ঠিকই আছে’, কী বলেছেন তার গুরুত্ব মোশতাক বুঝেছিলেন কিনা কে জানে। তবে মোশতাকের খসড়াই ২০ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
১৮ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা শফিউল্লাহকে নানা অজুহাতে আটকে রাখা হয়েছিল বঙ্গভবনে। শফিউল্লাহর মনে হয়েছে, মোশতাক ধারণা করেছিলেন ক্ষমতা তার সংহত হয়েছে, না হলে শফিউল্লাহকে ছাড়তেন না। ১৮ তারিখ যখন তিনি সেনাসদরে ফিরছেন তখন দেখলেন, ডালিমরা আর তার পশ্চাদ্ধাবন করছেন না। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরও নেই। অন্য সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তার সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতেন।
অফিসে ঢোকামাত্র তার এডিসি জানালেন, ৪৬ ব্রিগেডে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। আর্মার্ড আর্টিলারি গ্রুপই যে সমস্ত কিছু ঘটিয়েছে সেটি তারা নানাভাবে জাহির করছে। ৪৬-এর সৈন্যরা এখন বুঝতে পারছে এ বিদ্রোহ সেনাপ্রধানের নয়। সে থেকে তারা মুষড়ে পড়ছে।
১৮ তারিখ শফিউল্লাহ ঠিক করলেন সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করবেন। একে খন্দকার ও এমএইচ খানকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো। আলোচনার শুরুতেই ব্রিগেডিয়ার রউফ বললেন, যেহেতু এখানে গোপন বিষয় আলোচিত হবে সেজন্য সবার একবার গোপনীয়তার শপথ নিতে হবে। শফিউল্লাহ অবাক হলেন। এ ধরনের শপথ তো তাদের নেয়া আছে। তার ধারণা হলো, রউফ কাউকে সন্দেহ করছেন। সে জন্য শপথের কথা বলছেন। গোপনীয়তার শপথ নিতে সবাই রাজি হলেন। ওই সভায় সামগ্রিক বিষয় আলোচিত হয়। কয়েকজন ১৫ আগস্টের ঘটনার তীব্র নিন্দা করলেন। যে নৃশংসতা দেখানো হয়েছে সবাই তার নিন্দা করলেন এবং যারা আইন ভেঙেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হলো।
শফিউল্লাহ এরপর ১৯ আগস্ট ফরমেশন কমান্ডারদের বৈঠক ডাকলেন। বৈঠক শুরুর আগে শাফায়াত ও মেজর হাফিজ ঢুকলেন তার রুমে। শাফায়াত ইতস্তত করে জানালেন, ‘স্যার, আপনার ডেপুটি জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করবেন না। সমস্ত ষড়যন্ত্রের হোতা তিনি।’ হাফিজও একই কথা বললেন। শফিউল্লাহ শুনে গেলেন। কারণ কাউকেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ফরমেশন কমান্ডারদের সভায় শফিউল্লাহ সব খুলে বললেন এবং জানালেন এখন মূল কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বৈঠক শেষ হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ শাফায়াত জামিল মেজর রশীদ ও ফারুককে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললেন, এরা নরমাল চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গেছে সুতরাং এদের শাস্তি হওয়া দরকার। এবং তিনি দেখবেন তাদের যেন কোর্ট মার্শাল হয়। রশীদ আর ফারুক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। শফিউল্লাহ শাফায়াতকে থামালেন। চলবে...
তার মনে হলো তিনি যেভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন রক্তপাত ছাড়া, শাফায়াত তা স্যাবোটাজ করে দিলেন। তার ভাষায়, ’I immediately felt that colonel Shafaat had sabotaged my chance to consolidate my command without a bloodbath. I still wonder why colonel Shafaat had to act the way he did? Was that a guilty feeling or an intentional act to sabotage my effort? If so, who’s cause he was serving?Ó
॥ আট ॥
এরপর শফিউল্লাহ আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ট্যাঙ্কবহর যখন গঠিত হয় তখন সিজিএস-কে দায়িত্ব দেয়া হয় এর প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ে পরিকল্পনা করার। মেজর ফারুককে অস্থায়ীভাবে এর কমান্ডিং অফিসার করা হয়। ফারুক ছিলেন খালেদের দূরসম্পর্কের ভাতিজা। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে অন্যরা ফেরত এলে সিনিয়র হিসেবে মেজর মোমেনকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ফারুক এটি পছন্দ করেননি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি দু’বছরের জ্যেষ্ঠতা চেয়েছিলেন তাও তাকে দেয়া হয়নি। এতে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ফারুককে পাঠানো হয়েছিল আবুধাবি। সেখানে তিনি মৌজে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তাকে ডেকে পাঠানো হয় পাকিস্তানে। তখন তিনি ঠিক করেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। মুক্তিযুদ্ধ করার একটা সময়সীমা ছিল। সে সময়সীমা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে না থাকলে জ্যেষ্ঠতা দেয়া হতো না। ফারুক সে কারণে জ্যেষ্ঠতা পাননি। তিনি অনেক সময় কমান্ডারকে না মেনে সিজিএসের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, যা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করত। শফিউল্লাহ কয়েকবার খালেদকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন।
এরপর তিনি ৪৬ ব্রিগেড বা ঢাকা ব্রিগেড নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঢাকা রক্ষার জন্যই ছিল মূলত এই ব্রিগেড। সরকারের খুব আস্থাভাজনকে এর কমান্ডার নিযুক্ত করা হতো। তিনি ছিলেন এর প্রথম কমান্ডার। এপ্রিল, ১৯৭২ সালে তিনি সেনাপ্রধান হলে এরপর সিনিয়র ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন। এবং তিনি দক্ষও ছিলেন। তাকেই কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তিনি হঠাৎ হলিডে পত্রিকায় সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাকে বলা হয়েছিল ক্ষমা চাইতে। তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করায় চাকরিচ্যুত হন। এরপর যিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন লে. কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, তিনি কমান্ডার হন। মইনুল সোজাসুজি কথা বলতেন। তাকে অনেকেই অপছন্দ করতেন। শফিউল্লাহ কিন্তু এই একজনেরই প্রশংসা করেছেন। মইনুলের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচার শুরু হয় যা বঙ্গবন্ধুর কানেও পৌঁছানো হয়। তিনি তখন মইনুলকে বদলির কথা বলেন। এরপর কমান্ডার খোঁজা শুরু হয়।
শাফায়াত জামিল ১৯৭১ সালে খালেদ ও জিয়ার অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। তারা তাকে পছন্দ করতেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শফিউল্লাহকে না জানিয়ে তারাই শাফায়াতকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাফায়াত আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে নকশালদের দমনে সফল হয়েছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর নজরেও পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে নির্দেশ দিলেন শাফায়াত জামিলকে ৪৬-এর কমান্ডার নিযুক্ত করার। শফিউল্লাহ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু যে বিশ্বাস তার ওপর রেখেছিলেন, শাফায়াতের কর্মকাণ্ডে তা প্রতিফলিত হয়নি।
১৯ আগস্ট শফিউল্লাহ রশীদ ও ফারুককে নির্দেশ দেন বঙ্গভবন থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে। ২২ তারিখ পর্যন্ত তাদের কোনো সাড়া পেলেন না। তখন তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে অনুরোধ করলেন। মোশতাক বললেন, তারা আরো কয়েকদিন থাকবে।
মেজর রশীদকে ২২ আগস্ট বঙ্গভবনে পাননি শফিউল্লাহ। পরে জানলেন, জার্মানি থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াবকে আনার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে।
২৪ আগস্ট রেডিওতে শুনলেন, জেনারেল ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খবর শেষ হওয়ার মুহূর্তেই লাল টেলিফোনে ফোন এলো। অপর প্রান্তে মোশতাক। তাকে সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবনে দেখা করতে বললেন।
শফিউল্লাহ পৌঁছলেন বঙ্গভবনে। সামরিক সচিব বললেন, প্রথমে তাকে ওসমানীর কাছে যেতে হবে। ওসমানী আগে তার সঙ্গে কথা বলতে চান। বঙ্গভবনে ওসমানীকে একটি অফিস দেয়া হয়েছে। সেখানে যাওয়ার সময় দেখলেন জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খলিল বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরুচ্ছেন।
ওসমানীর রুমে ঢুকে দেখেন তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন। শফিউল্লাহ বসার পর বললেন, “এই সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে সেনাপ্রধান হিসেবে তোমার অবদান প্রভূত। শূন্য থেকে ইটের পর ইট বসিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছ। আমি তোমার হাতে ভার অর্পণ করেছিলাম আর তুমি চমৎকার এক বাহিনী গড়ে তুলেছ।”
“স্যার, আপনার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। স্যার, আমি শুধু গর্বিত নই, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমার অংশ হিসেবেও মনে করি।”
মনে হলো, ওসমানী একটি বিদায়ী ভাষণ দিচ্ছেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “মুক্তিযুদ্ধে তোমার অবদান স্মরণীয়, মুক্তিযুদ্ধের পরও। এখন বিদেশে তোমার সার্ভিস দেশের জন্য প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্রপতি চান তোমার পছন্দ মতো যে কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে যাও।”
শফিউল্লাহর জন্য এ সংবাদ ছিল আকস্মিক বজ্রপাতের মতো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন কে?’
‘জিয়া’, বললেন তিনি।
‘জিয়া, কি তা জানেন?’
‘হ্যাঁ, তাকে বলা হয়েছে।’
‘বদলটা কখন হবে।’
‘আজ, এই মুহূর্ত থেকে এ নির্দেশ কার্যকর হবে।’
‘খন্দকার মোশতাক আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।’
এ সময় একজন এসে জানাল, মোশতাক শফিউল্লাহর জন্য অপেক্ষা করছেন। ওসমানীও শফিউল্লাহর সঙ্গে মোশতাকের রুমে এলেন। মোশতাক বেশ ভালোভাবেই তাকে সৌজন্য দেখিয়ে পাশে বসালেন। তারপর তিনি ওসমানীর দিকে সাংকেতিক সংকেত দেখালেন যার মানে শফিউল্লাহকে বলা হয়েছে কিনা। ওসমানী মাথা নাড়লেন। মোশতাকও নানা কথা বলে ওসমানীর মতো মূল প্রসঙ্গে এলেন।
মোশতাকের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে শফিউল্লাহ জানালেন, তার বিদেশ যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। মোশতাক এ ধরনের উত্তর আশা করেননি। এ উত্তরে তিনি বেশ রূঢ়ভাবে বললেন, “তুমি কি তোমার ও তোমার পরিবারের নিরাপত্তা চাও না? শেখ মুজিব ও তার পরিবারের কী হয়েছে তা তুমি দেখোনি।” তারপর জানালেন শফিউল্লাহ ও তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি এ প্রস্তাব করেছেন। অন্যদিকে, এ ছিল শফিউল্লাহ ও তার পরিবারের প্রতি হুমকি।
শফিউল্লাহ লিখেছেন, তার বয়স তখন ছিল কম, ৪০ও হয়নি। তাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মোশতাককে জানালেন, তিনি আল্লাহ ও ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে ও তার পরিবারকে আল্লাহ দেখে রেখেছেন। এখনও তাই করবেন, অন্য কেউ নয়। এই বলে শফিউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। এবং বেরিয়ে গেলেন। তিনি লিখেছেন, বঙ্গভবন থেকে হতাশ হয়েই ফিরছিলেন। কারণ মোশতাকের চালে তিনি হেরে গেছেন এবং এসব ক্রিমিনালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি পারেননি .left Bangabhaban with regret that I had been out-manoeuvred by Khadaker Moshtaque and I was denied the pleasure of taking action against these criminals.]
॥ নয় ॥
বাসায় ফেরার পথেই শফিউল্লাহ জানতে পারলেন জিয়া ইতোমধ্যে নতুন পদে যোগ দিয়েছেন। এ কারণেই তিনি দ্রুত বঙ্গভবন থেকে ফিরছিলেন। শফিউল্লাহকে সুযোগও দেয়া হলো না সেনাদের বিদায় জানাবার। বাসায় ফিরে জানলেন, সেনাধ্যক্ষের বাসভবন ‘সেনাভবনেই’ আপাতত তিনি থাকবেন এবং বাসা থেকে বেরুতে পারবেন না। সে রাতেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তার বরখাস্তের চিঠি পেলেন। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৯ দিনের মাথায় একমাত্র তাকেই বরখাস্ত করা হয়। নতুন অনেককে প্রমোশন দেয়া হয়। যেমনÑ এরশাদ, গোলাম দস্তগীর প্রমুখকে।
২৫ আগস্ট ওসমানী শফিউল্লাহকে ফোন করে সান্ত¡না দিলেন এবং রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বললেন। তিনি বেশ আন্তরিকই ছিলেন। তারপরও শফিউল্লাহ রাজি হননি। ওসমানী বললেন ‘না’ বলার আগে একবার ভেবে দেখতে। এ রকম কিছুদিন চলার পর তিন নবেম্বর চার জাতীয় নেতার হত্যার খবর পাওয়ার পর রাজি হলেন।
শফিউল্লাহ রাজি হওয়ার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি নির্দেশ জারি করে। তার বরখাস্তের নির্দেশ প্রত্যাহার করে তাকে ওএসডি করে তার চাকরি বিদেশ মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় এবং ফরেন সার্ভিসে তাকে আত্তীকরণ করা হয়। এরপর মালয়েশিয়ায় তাকে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়। ৩ জানুয়ারি ১৯৭৬ থেকে ৯ জুলাই ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরেই ছিলেন।
চলবে...
(২৩ জানুয়ারির পর)
শফিউল্লাহ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে যখনই তিনি
বলতেন, “স্যার আপনার নিরাপত্তায় খামতি আছে”, তখনই বঙ্গবন্ধু বলতেন, “শফিউল্লাহ চিন্তা করো
না, বাঙালীরা আমাকে বা তোমাকে হত্যা করবে না। তার মানসিক
দৃঢ়তা এমনই ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হলো, তার বিশ্বস্ত
বন্ধু তার পাশে বসেই তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন।” তিনি
লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু আমাকে সেনাপ্রধান বানালেন কিন্তু
আমার পাশে এক ষড়যন্ত্রকারীকে রেখে আমার হাত বেঁধে দিলেন। যদি আমি মুক্ত হতাম এবং
জিয়াকে চাকরিতে না রাখা হতো তাহলে যে সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলাম তা বঙ্গবন্ধুর
বিরুদ্ধে যেত না।”
জেনারেল শফিউল্লাহর বইয়ের শেষ অধ্যায়টির নাম
‘অ্যান
অ্যানালাইসিস অব স্টেটমেন্টস অন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫’। এ
অধ্যায়ে ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা যে সব সাক্ষাৎকার/বিবৃতি দিয়েছেন তার
বিশ্লেষণ করেছেন। এসব সাক্ষাৎকার/বিবৃতির কেন্দ্রে অবশ্যই জেনারেল শফিউল্লাহ। এরা
হলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ওয়ারেসাত
হোসেন বেলাল। এ ছাড়া জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খালেদ মোশাররফের আচরণ বিশ্লেষণ
করেছেন। বস্তুত তারা তাকে দায়ী করতে চেয়েছেন, কিন্তু
তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যেসব ঘটনা বিধৃত করেছেন তাতে তাদের বক্তব্য
খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না।
শফিউল্লাহ শেষ পর্যায়ে চারজনের বিষয়ে
বিশ্লেষণ করেছেন। ধরে নেয়া যায় এ চার জনকেই তিনি অভিযুক্ত করছেন বঙ্গবন্ধু হত্যায়।
এ চারজন হলেন জেনারেল জিয়া,
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (খালেদকে তিনি তার ডান হাত ও সবচেয়ে
বিশ্বস্ত বলে মনে করতেন। পরে তিনি তার ওপর আস্থা হারান), কর্নেল
শাফায়াত জামিল এবং ব্রিগেডিয়ার রউফ।
॥ দশ ॥
সেনা অফিসাররা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বই
লিখেছিলেন। সেসব বইয়ের ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে একটি বই লিখেছিলাম বাংলাদেশি
জেনারেলদের মন। এদের অধিকাংশই কাকুল প্রশিক্ষিত। তাদের মনমানসিকতা কী ধরনের ছিল
তাই বিধৃত হয়েছে বইয়ে। তাদের কারো কারো রচনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জিয়াউর রহমানের
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বিষয়টি বিবৃত হয়েছে। ওই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টিও
এসেছে। আমি সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি বা বঙ্গবন্ধু
হত্যার ষড়যন্ত্র কিভাবে তারা দেখেছেন তাই উল্লেখ করব।
প্রথমে লে. কর্নেল আকবর হোসেন বীরপ্রতীকের
বইয়ের কথা উল্লেখ করব। নাম শহীদ জিয়া ও আমি। ২০০৩ সালে ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশ
করে ঢাকার দীপ্তি প্রকাশনী।
আকবর হোসেনদের মতো আরো অনেকে যে জিয়ার
প্রশ্রয়ে দেশকে ১৯৭৫ সালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার প্রমাণ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া
যাবে তার জবানিতে। তিনি লিখেছেন, শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলে তাদের ‘মনঃপূত’ হলো না।
জিয়াউর রহমান তখন কুমিল্লা ব্রিগেডে ব্রিগেড
কমান্ডার ছিলেন। “জিয়াউর রহমানকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আমার সঙ্গী যোদ্ধা
সালাহউদ্দিনকে নিয়ে লিফলেট বানিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর বিতরণ করলাম। বিষয় ছিল,
‘জিয়াউর রহমানকে কেন চিফ অব স্টাফ বানানো হলো না?’ আর ছিল দলীয়করণের কথা।
সামরিক বাহিনীতে তখন বেশ একটা দ্বন্দ্ব
চলছিল জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অনেকে যারা
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে মেনে নিতে পারছিল না এবং শেখ মুজিব স্বাধীনতার
ঘোষণা দিয়েছে এ রকম কাল্পনিক তথ্য প্রমাণ করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছিল, তারা জিয়াউর রহমানের প্রতি তুষ্ট ছিল না।” (পৃ.
২১-২২]
আকবর যখন লিফলেট বিতরণ করছেন তখন জিয়া
ব্রিগেড কমান্ডার। গোয়েন্দারা নিশ্চয় তাকে বিষয়টি জানিয়েছিল বা এমনও হতে পারে
আকবররাও তাকে লিফলেট পাঠিয়েছিলেন, সেটাই স্বাভাবিক। ডিএফআই-ও এ বিষয়ে নিশ্চয় রিপোর্ট
পেয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এ রকম একটা গুরুতর অপরাধের
বিরুদ্ধে জিয়া ব্যবস্থা নেননি। এবং ডিএফআই-ও ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ মুজিব হত্যা
ষড়যন্ত্র ও সিভিল শাসন বিনাশ প্রক্রিয়ায় তখনই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর
গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যক্তি হিসেবে জেনারেল জিয়া অবস্থান নিয়েছিলেন। আকবর লিখছেন,
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তখন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। এটি অতিরঞ্জন। কারণ ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার
পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো স্তরে কোনো বিতর্ক হয়নি। এর
প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেন না। বিতর্ক শুরু হয়েছিল যখন জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করে
নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাইলেন তখন।
আকবরের অতিরঞ্জন করার ক্ষমতা দেখলে অবাক হতে
হয়। জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করা হয়েছে সে জন্য তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে দিতে
চেয়েছিলেন যেটা জিয়া নিজেও চিন্তা করেননি। তখন থেকে তিনি জিয়াকে রাজনীতিতে আনার
জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। জিয়া সন্দিহান ছিলেন তার অবস্থান নিয়ে। আকবর তখন একটি
ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন। “আমি বললাম, যেদিন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে
এসেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে সেদিন আপনিও গিয়েছিলেন, আমিও
গিয়েছিলাম।
চলবে...
(২৪ জানুয়ারির পর)
মিটিংয়ে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে। এক ভদ্রলোক
আপনার পরিচয় দিয়ে বলেছিল,
‘এই হচ্ছে মেজর জিয়া’। আপনার মনে আছে
তারপর মানুষ কী ভালোবাসায় আর আনন্দে অভিভূত হয়ে আপনার সাথে করমর্দন করেছিল। সেখানে
লাখ লাখ মানুষ ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবকে ছেড়ে আপনার সাথেই করমর্দনে ব্যস্ত
ছিল। সেদিনই বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশের মানুষের কত আস্থা
আপনার ওপর।” [পৃ. ২২]
এত বড় একটা ঘটনা! ওই দিনের [অর্থাৎ পরদিন]
সংবাদপত্রগুলো আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো খবর চোখে পড়েনি।
ভাবছি, এত বড়
একটা ঘটনা সবার চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে?
এরপর তিনি, জিয়া ও নূরুল ইসলাম
[নূরুল ইসলাম শিশু] মিলে আকবরের ভাষায় “সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম আমি আগে গিয়ে একটা বেইজ ক্রিয়েট করবÑএকটা দল ক্রিয়েট করব যাতে
তারা পরবর্তীতে এসে সেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে পারেন এবং যাতে রাজনৈতিক পরিকল্পনা
বাস্তবায়িত করতে পারেন।”
[পৃ. ২৩] অর্থাৎ মুজিবকে অপসারণ, রাজনৈতিক
দল সৃষ্টি, রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের [সিভিল শাসন
উৎখাত] পরিকল্পনা অনেকদিন থেকেই এবং সেনাবাহিনীর আইন ভেঙ্গেই তারা এসব কাজ
করেছিলেন। মোশতাক ক্ষমতায় এসে জিয়াকে সেনাপ্রধান করার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়।
আকবর নিজেই লিখেছেন, মুজিব সরকার উৎখাতের
জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং জিয়া তা জানতেন। শফিউল্লাহও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে
লিফলেট বিতরণের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু বিশদ কিছু লেখেননি। আকবর হোসেন
স্বেচ্ছায় এই স্বীকারোক্তি না দিলে আমরাও বিষয়টি জানতাম না।
এগারো.
শফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিল সম্পর্কে
অভিযোগ করেছেন বারবার। তিনি বলতে চেয়েছেন, জামিল যদি সচেষ্ট হতেন তাহলে
ফারুক-রশীদ গংকে তখনই গ্রেফতার করা যেত। শফিউল্লাহর আগে ১৯৯৮ সালে জামিলের
গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। জামিলের অভিযোগ প্রধানত শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে, খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। জিয়ার বিরুদ্ধে ততটা নয়। জেনারেল ওসমানী ও
জেনারেল এরশাদকেও তিনি অভিযুক্ত করেছেন। তিনি যখন আত্মপক্ষ সমর্থনে সাক্ষাতকার
দিচ্ছেন বা বইটি লিখেছেন তখন শফিউল্লাহ বিদেশে। তার গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি জামিলের
বক্তব্য খণ্ডন করেছেন বিস্তারিতভাবে। আমি সে বিশ্লেষণে যাব না। আমি নিজের
পর্যবেক্ষণসহ এ বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরছি।
কর্নেল শাফায়াত জামিলের বইয়ের নাম একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ : রক্তাক্ত
মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সুমন
কায়সারের সহযোগিতায় বইটি প্রণীত। ১৯৯৮ সালে ১৫১ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করে সাহিত্য প্রকাশ।
বইয়ের দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে মুক্তিযুদ্ধে তার যোগদান, দ্বিতীয় পর্বে ১৯৭৫
সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর হত্যাবিষয়ক ঘটনাবলি।
আরও বহু বাঙালী অফিসারের মতো তিনিও
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উদ্দীপ্ত হন ও মার্চের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার
চিন্তা করতে থাকেন এবং যথাসময়ে পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসারকে বন্দী করে বাঙালী
সেনাদের নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিলিত হন। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত যেসব
যুদ্ধ করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। নবেম্বরে রাধানগরে আহত হন। অপারেশন থেকে সুস্থ
হলে আবার যুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মেজর হিসেবে। আগস্ট ১৯৭৫ সালের পর
কর্নেল হিসেবে তাকে অবসর দেয়া হয়। অবসর না হলে সাহসী এই যোদ্ধা নিশ্চয় জেনারেল
হতেন।
১৯৭৫ সালের আগস্টে তিনি ছিলেন ঢাকা
ব্রিগেডের অধিনায়ক। কৌশলগত কারণে পদটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর
রশীদ ছিলেন তার অধীনে গোলন্দাজ ইউনিটের অধিনায়ক। তার পোস্টিং ছিল রংপুরে।
সেনাপ্রধান তাকে বদলি করেন ঢাকায়।
১৫ আগস্ট সকালে এই মেজর প্রথম তার ঘুম
ভাঙায়। তাকে বিস্মিত করে ঘোষণা করে ‘উই হ্যাভ কিল্ড শেখ মুজিব’। লিখেছেন তিনি, “আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে রশীদ
বলে যেতে লাগল। উই হ্যাভ টেকেন ওভার দ্য কনট্রোল অব দি গভর্নমেন্ট আন্ডার দ্য
লিডারশিপ অব খন্দকার মোশতাক। আপনি এই মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশনে যাবেন
না। কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া মানেই গৃহযুদ্ধের উসকানি দেয়া।” [পৃ. ১০২]
মেজর রশীদ বেরিয়ে যেতে না যেতেই সেনাপ্রধান
শফিউল্লাহ তাকে ফোন করলেন। বললেন, “তুমি কি জানো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করেছে?
... উনি তো আমাকে বিশ্বাস করলেন না।” বিড়
বিড় করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন সেনাপ্রধান। তার কণ্ঠ বিপর্যস্ত।
টেলিফোনে তাকে বিধ্বস্ত মানুষ মনে হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘এ
ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, তবে এইমাত্র মেজর রশীদ এসে
আমাকে জানাল, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করছে। তারা সরকারের
নিয়ন্ত্রণভারও গ্রহণ করছে। রশীদ যে আমাকে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে
হুমকিও দিয়েছে সেনাপ্রধানকে তাও জানালাম। সেনাপ্রধান তখন বললেন, বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন যে, শেখ কামালকে
আক্রমণকারীরা সম্ভবত মেরে ফেলেছে। তবে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা শেষে তার অবস্থান কী
সে সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারলাম না। প্রতিরোধ উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ বা
নির্দেশ কিছুই পেলাম না।” [ওই]
জেনারেল শফিউল্লাহ কি এতই বিপর্যস্ত ও বিমূঢ়
হয়ে গিয়েছিলেন যে,
কর্নেল জামিলকে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার কোন নির্দেশ দিলেন না?
এ বিষয়ে শফিউল্লাহর বক্তব্য আগেই উল্লেখ করেছি।
মেজর রশীদ মেজর হাফিজ ও লে. কর্নেল আমিন
আহমেদ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন জামিলের বাসায়। জামিল হাফিজকে নিয়ে চললেন ডেপুটি
চীফ জিয়াউর রহমানের বাসায়। জিয়া তখন শেভ করছিলেন। জামিল তাকে জানালেন সব
বৃত্তান্ত। “মনে হলো জিয়া একটু হকচকিত হয়ে গেলেন। তবে বিচলিত হলেন না তিনি। নিজেকে
সামলে নিয়ে বললেন, 'So what, President is dead? Vice President is there,
Get your troops ready, uphold the constitution.' [পৃ. ১০৩]
বঙ্গবন্ধু শুধু রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন জাতির পিতাও। তার
নিহত হওয়ার সংবাদে তিনি বিচলিত না হয়ে বলেন, উপ-রাষ্ট্রপতি
দায়িত্ব নেবে। যেন এটি সাধারণ একটি ব্যাপার। জামিলকে তিনি ট্রুপস রেডি করার কথা
বলছেন। কিন্তু তা প্রতিরোধের জন্য নয়। সংবিধান রক্ষার জন্য। কয়েকদিন পর ক্ষমতা
পেয়ে এই জিয়াই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেন।
দুটি বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন জামিল। তিনি
লিখছেন, “এই
রেজিমেন্টের কর্মরত প্রায় ১৩শ’ সৈনিকের মধ্যে মাত্র শ’খানেক সৈন্যকে মিথ্যা কথা বলে ভাঁওতা দিয়ে ফারুক-রশীদরা ১৫ আগস্টের এ
অপকর্মটি সংঘটিত করে। কয়েকজন অফিসার দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর বাঁধানো ছবি নামিয়ে
ভাঙচুর করছিল।... সব কিছু দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। আমার অধীনস্থ একজন সিওকেই কেবল
বিমর্ষ মনে হলো।” [পৃ. ১০৮]
এর মধ্যে খালেদ মোশাররফ এসে তাকে জানালেন, সেনাপ্রধান তাকে ‘সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব’ দিয়েছেন।
জামিলের মনে হয়েছে সেনাপ্রধান তাকে বিশ্বাস করছেন না। সকাল সাড়ে আটটার দিকে
সেনাপ্রধান, জিয়া, একে খন্দকার,
এমএইচ খানসহ অভ্যুত্থানকারীরা প্রথম বেঙ্গল অফিসের সামনে জড়ো
হয়েছেন। তারপর তারা বাংলাদেশ বেতারের দিকে চলে গেলেন। জামিল লিখছেন, “এরই মধ্যে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছি আমরা। আমি
আশা করছিলাম বিমানবাহিনীর সহায়তায় সেনাসদরের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনে একটি
সমন্বিত আন্তঃবাহিনী অভিযান পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। ... অত্যন্ত দুঃখের
সঙ্গে লক্ষ করলাম, সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ
দমনের কোনো পরিকল্পনা করা হলো না, যদিও তিন বাহিনী
প্রধানই একসঙ্গে ছিলেন।” [পৃ. ১০৪]
অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে যে
অভিযোগ তুলেছেন সেটিও গুরুত্ববহ। তিনি লিখেছেন, “এরপর বঙ্গভবন থেকে আদিষ্ট হয়ে খালেদ
মোশাররফ দিনভর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সংস্থা, ইউনিট ও
সাব ইউনিটের প্রতি একের পর এক নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনকার মতো সব কিছুরই লক্ষ্য
ছিল বিদ্রোহের সাফল্যকে সংহত ও অবৈধ মোশতাক সরকারের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করা।
অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলো সম্পাদন
করা হয়েছিল সেদিন।” [পৃ. ১০৬]
জামিল লিখেছেন, বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি
সম্পন্ন করেছিলেন সেটি কাদের দ্বারা? সেই আমরা কারা?
এটি তিনি পরিষ্কার করেননি। ব্যাপারটি একটু ঘোলাটে রেখে গেছেন
তিনি। জামিল আরও লিখেছেন, দুপুরে জেনারেল শফিউল্লাহ
ট্যাংকগুলোতে গোলা সরবরাহ করার আদেশ দেন জামিলকে এবং তখন তারা জানতে পারেন
ট্যাংকগুলোতে গোলা ছিল না।
খালেদ মোশাররফ জামিলকে বারবার বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে
আওয়ামী লীগের যে অংশ ক্ষমতা দখল করেছে তাদের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করা অত্যন্ত
পীড়াদায়ক।... এই বেইমানগুলোকে যত শিগগির উৎখাত করা যাবে জাতির ততই মঙ্গল। সম্ভাব্য
স্বল্পতম সময়ে হত্যাকারী ও তাদের মদদদাতা রাজনীতিকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের
বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।”
[পৃ. ১০৯] তিনি আরও
বলেছিলেন, পক্ষ-বিপক্ষ বোঝা দুষ্কর। তাই কোন ভুল পদক্ষেপ
নেয়া ঠিক হবে না। ১৬ আগস্ট জামিলকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সেনাসদরে ফিরে
গেলেন।
জামিলের লেখায় আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
আছে যা প্রণিধানযোগ্য। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তাই তিনি তোফায়েলের
বাসায় গিয়েছিলেন। তেমন কোন কথাবার্তা হয়নি। এ কথা জানার পর রশীদ-ডালিমরা তোফায়েলকে
বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে। “আনুগত্য ও সমর্থন আদায়ের
জন্য তার ওপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। চলবে...
(২৫ জানুয়ারির পর)
তারা তোফায়েল আহমেদের এপিএস শফিকুল আলম
মিন্টুকেও ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তার ওপর।” [পৃ. ১০৯] “এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সাজেদ তাকে গুলি করে হত্যা করে। তাকে সরকারি
চাকরি দেয়া হয় এবং কেউ প্রতিবাদ করেনি। আরো অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়।
বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের আনুগত্য ও সমর্থন আদায় করা। কোনো কোনো
ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টাও ছিল।” [পৃ.
১১০] প্রয়াত এ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হককে নির্যাতন করা হয়। “কারণ এ দেশীয় সহযোগীদের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিশনের একজন বিশিষ্ট সদস্য
ছিলেন। নিষ্ঠার সাথে তদন্তের দায়িত্ব পালনকালে তিনি অভ্যুত্থানকারীদের দেশী-বিদেশী
প্রভুদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এরই পরিণতিতে বিদ্রোহীদের হাতে তাকে নিগৃহীত হতে হয়।
ডালিম, নূর, শাহরিয়ার ও
সাজেদ-এরা তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়।” [ওই]
১৮ তারিখে সেনাসদরের সভায় ডিএফআইয়ের প্রধান
ব্রিগেডিয়ার রউফ তোফায়েল আহমেদের বাসায় জামিলের যাওয়ার কথা জানান। দেখা যাচ্ছে
ডিএফআই-ও আইএসএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। শফিউল্লাহ ও জিয়া এ জন্য জামিলকে
তিরস্কার করেন।
১৯ তারিখে আরেকটি সভা ডাকা হয় সিনিয়র
অফিসারদের নিয়ে। সেনাপ্রধান রশীদ ও ফারুককে নিয়ে ঢুকলেন। জানালেন, তারা ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি
ব্যাখ্যা করবেন।
রশীদ তার বক্তব্য শুরু করল। সে বলল, সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র
অফিসার এই অভ্যুত্থানের কথা আগেই জানতেন। এমনকি ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারও (অর্থাৎ
আমি) এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। রশীদ আরো দাবি করল, প্রত্যেকের
সঙ্গে তাদের আলাদাভাবে সমঝোতা হয়েছে। উপস্থিত অফিসারদের কেউই এই সর্বৈব মিথ্যার
কোনো প্রতিবাদ করলেন না। একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেউ। কিন্তু আমি চুপ করে
থাকতে পারলাম না। নীরব থাকা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ফারুক-রশীদের মিথ্যা বক্তব্য
প্রত্যাখ্যান করে আমি সেদিন বলেছিলাম, ‘You are all liars, mutineers and
deserters. You are all murderers. Tell your Mushtaque that he is an usurper and
conspirator. He is not my President. In my first opportunity I shall dislodge
him and you all will be tried for your crimes.’ আমার কথা শুনে
তারা বাক্যহীন হয়ে পড়ে এবং বিষণœ মুখে বসে থাকে। পরবর্তী সময়ে জীবন
বাজি রেখে সে কথা রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমি।
যাই হোক, আমার তীব্র প্রতিবাদের মুখে মিটিং
শুরু হতে না হতেই ভেঙে গেল। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ উঠে গিয়ে তার কক্ষে ঢুকলেন।
উপপ্রধান জিয়া অনুসরণ করলেন তাকে। আমি তখন স্বভাবতই বেশ উত্তেজিত। তাদের দুজনের
প্রায় পেছনে পেছনেই গেলাম আমি। সেনাপ্রধানের কক্ষে ঢুকতেই জিয়া আমার কাঁধে হাত
দিয়ে বললেন, ‘শাফায়াত, একেবারে
ঠিক আচরণ করেছ ওদের সঙ্গে। একদম সঠিক কাজটা করেছ। কিপ ইট আপ। ওয়েল ডান!’ উৎসাহিত হয়ে আমি তাদের দুজনকেই উদ্দেশ করে বললাম, ‘Sir, the way
I treated the murderers you must talk to Mushtaque in the same language and get
the conspirator out of Bangabhaban.’
প্রসঙ্গত একটা কথা বলতে হয়, ১৫ আগস্ট থেকে মেজর
জেনারেল শফিউল্লাহ যতদিন সেনাপ্রধান ছিলেন (অর্থাৎ ২৪ আগস্ট পর্যন্ত) তাকে এবং
মেজর জেনারেল জিয়াকে প্রায় সর্বক্ষণ একসঙ্গে দেখা গেছে। একজন যেন আরেকজনের সঙ্গে
ছায়ার মতো লেগে ছিলেন”। [পৃ. ১১৩]
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে কারা জড়িত ছিলেন এবং তাদের আচরণের বিবরণ দিয়েছে কর্নেল জামিল। অন্য
অনেক অফিসারও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন কিন্তু জামিল সুনির্দিষ্টভাবে তথ্যপ্রমাণসহ বিবরণ
দিয়েছেন। কেউ এর প্রতিবাদ করেছেন বলে শুনিনি।
জামিল উল্লেখ করেছেন দ্বন্দ্বটা
মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের। হ্যাঁ, সেটি ছিল বটে, তবে জামিল যেভাবে সরলীকরণ করেছেন, ব্যাপারটা
অত সরল নয় বোধহয়। কারণ, অভ্যুত্থান যারা মেনে নিয়ে
রশীদ-ডালিমের আদেশ শুনেছিলেন তারাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তবে এটা ঠিক পাকিস্তানি
অফিসারদের মানবিক কারণে ফের বাহিনীকে ঢোকার যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল তা তারা
সদ্ব্যবহার করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের
ফাঁসানোর কাজ শুরু করেছিলেন পাকিস্তানিরা। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন জেনারেল এরশাদ, ব্রিগেডিয়ার রউফ।
একপর্যায়ে তারা বিচারপতি এবি সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার
দৌল্লা ও মেজর জেনারেল মাহমুদ হাসানকেও যুক্ত করে। এসবির অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের
একাংশও এতে যুক্ত ছিল।
তিনি এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা
তুলেছেন। খাঁটি পাকিস্তানি মন না হলে আইএসআই-তে কোনো বাঙালীকে নিয়োগ দেয়া হতো না।
এর খানিকটা সত্যতা আছে। কর্নেল মুস্তাফিজ বা জেনারেল জিয়া এর উদাহরণ। তেমনি
ডিএফআই-এ তখন পাকিস্তানী প্রত্যাগতদের নিয়োগ দেয়া ঠিক হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, যারা বাঙালীর আন্দোলন
মনেপ্রাণে মেনে নেইনি তাদেরই বিভিন্ন গোয়েন্দা পদে নিয়োগ দেয়া হতো। জামিল লিখেছেন,
অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ষড়যন্ত্রে তিনি ব্রিবত থাকতেন।
বঙ্গবন্ধু তাকে পছন্দ করতেন। তাকে এমএসপি-র দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। তিনি নেননি।
এরশাদের বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ
রেখেছেন কয়েকটি। গাজী গোলাম মোস্তফা ও ডালিমের দ্বন্দ্বে তিনি ডালিমের পক্ষ নিয়ে
জিয়াকে উসকানোর চেষ্টা করেন। জিয়া তাকে ভর্ৎসনা করেন। এরশাদ জিয়াকে বলেছিলেন
ডালিমদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে। শফিউল্লাহও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি “বরং তার প্রিয়ভাজন [হয়তো
ক্রোধবশত শব্দটি ব্যবহার করেছেন] এই কর্নেলকে কয়েকদিন পর দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন
উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। অল্প কয়েকদিন পরই নিয়মবহির্ভূতভাবে supernumery
establishment-এ থাকা অবস্থায় তার পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন।”
[পৃ. ১১৬] জিয়াদের ব্যাচমেট লে. কর্নেল হামিদও উল্লেখ করেছেন
এরশাদের সঙ্গে শফিউল্লাহর ভালো সম্পর্ক ছিল এবং পাকিস্তান থেকে ডলার-রুপি ভাঙানোর
জন্য তিনি শফিউল্লাহকেই পাঠাতেন।
জামিলের মনে হয়েছে এরশাদ আইএসআইয়ের ‘আশীবার্দপুষ্ট’দের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭২-৭৩ সালে তিনি অন্তত চারবার বিমানযোগে পাকিস্তান
থেকে মালপত্র তার রংপুরের বাড়িতে পাঠান। “অনিয়মিতভাবে চলাচলকারী
আইসিআরসি-এর ভাড়া করা প্লেনে এরশাদ সাহেবের সেসব জিনিসপত্র পাচার করার অপারেশন
চালানো হয়। পাক বন্দিশিবিরের তথাকথিত বন্দি এরশাদের পক্ষে ওঝও-এর প্রত্যক্ষ
তত্ত্বাবধান ও সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের কাজ করা কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না।
আমার জানা মতে, আটকে পড়া প্রায় বারো শ’ অফিসারের আর কারোরই তার মতো সুযোগ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এরশাদের ওইসব
অপারেশনে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ পুরো সহযোগিতা করেছেন।
শফিউল্লাহ সাহেব তার এডিসির মাধ্যমে হেলিকপ্টারে করে সেই সব মালামাল রংপুরে
পাঠাতেন এবং আমাকে সেগুলো বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হতো। আমি
তখন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার।” [পৃ. ১১৭]
পাকিস্তানে যারা ছিলেন, এপ্রিল-ডিসেম্বরের মধ্যে
অনেকে ছুটি কাটাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এসে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। এ রকম ৫০ জন অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এরশাদও এসেছিলেন কিন্তু তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। লিখেছেন জামিল, “একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও এরশাদ চাকরিচ্যুত তো হনইনি, বরং প্রমোশনসহ এজি (অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল) পদে অধিষ্ঠিত হন। এর পেছনে
তৎকালীন সেনাপ্রধান ও আওয়ামী যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। একই
বিষয়ে এ দুমুখো নীতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা খুবই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তখন।”
[ওই]
(২৬ জানুয়ারির পর)
ফারুক ১৯৭৩ সালে একবার অভ্যুত্থান করেছিলেন
বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর তিনটি ট্যাঙ্ক ছিল। এ তিনটিকেই কব্জা করে তিনি এগোতে
চেয়েছিলেন। উর্ধতন অফিসাররা তা জানতেন। তা সত্ত্বেও শফিউল্লাহ ৩২টি ট্যাঙ্কের
রেজিমেন্টের অধিনায়ক ফারুককেই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৫ আগস্টের দু’মাস আগে জামিলের ব্রিগেডের একমাত্র গোয়েন্দা ইউনিটটিকে প্রত্যাহার করে
নেন।
জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পরদিন এরশাদ দিল্লী
থেকে চলে আসেন জিয়াকে অভিনন্দন জানাতে। এতে জিয়া খুব ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে বঙ্গভবনে
যেতেও নিষেধ করেন। কারণ সেখানে তখনও অভ্যুত্থানকারীরা অবস্থান করছিল। এরশাদ ঠিক
ঠিকই রাতে সেখানে যান।
জিয়ার আমলের শেষের দিকে আগস্টের খুনীরা
আবারও একটি বৈঠক করেন জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। এরা সবাই বিদেশে অবস্থান
করছিলেন। তাদের ঢাকায় তলব করা হয়। তারা কেউ না এসে চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে
রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। ঢাকার দুজন অফিসার লে. কর্নেল দীদার ও লে. কর্নেল নুরুন্নবীর
একই কারণে বিচার হয় এবং কারাদণ্ড দেয়া হয়।
ক্ষমতায় এসে জেনারেল এরশাদ ওই খুনীদের
চাকরিতে পুনর্নিয়োগ করেন। ‘শুধু পুনর্বাসনই নয়, এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের
সঙ্গে জড়িত উল্লিখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনানুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন
বছরের পুরো বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করে দেন।” [পৃ. ১২১]
কিন্তু দেশে বন্দী থাকা দুজনকে মুক্তি দেননি। খালেদা জিয়াও এরশাদের সেই সিদ্ধান্ত
বহাল রাখেন।
জামিল উল্লেখ করেছেন সেই ‘ব্রিগেডিয়ার রউফ থেকে
এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ ছিলেন।’ মুক্তিযোদ্ধাদের
প্রতি বহুদিনের লালিত হিংসা-বিদ্বেষ আর ঘৃণার চরম প্রকাশ তারা ঘটিয়েছিলেন
পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি
অন্ধ বিদ্বেষের কারণে-
‘হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ করে
কতিপয় অমুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসার এরশাদের নেতৃত্বে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ
করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি, জেল ও
চাকরিচ্যুত করেই এরশাদ ও তার পোষ্য ওই অমুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসাররা সন্তুষ্ট হতে
পারেননি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এরশাদ এক অলিখিত নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও
নিকটাত্মীয়দের সেনাবাহিনীর অফিসার কোরে যোগদান নিষিদ্ধ করেছিলেন। অনেক
মুক্তিযোদ্ধার মতো কর্নেল (অব) শওকত আলী এমপির এবং আমার ছেলেও সামরিক বাহিনীতে
যোগদান করা থেকে বঞ্চিত হয়। পক্ষান্তরে একাত্তরে পরাজিত পাকবাহিনীর দোসরদের
সন্তানদের জন্য সেনাবাহিনীর দুয়ার অবারিত করা হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য,
এরশাদ বাংলাদেশে আগমনের পর আর্মি হেডকোয়ার্টারের প্রথম
কনফারেন্সে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।’ [পৃ. ১১৫]
গ্রন্থের তৃতীয় পর্ব ‘ষড়যন্ত্রময় নবেম্বরে’
৭ নবেম্বর ও চার নেতাকে হত্যার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন
খালেদ মোশাররফ, তিনি ও আরো কয়েক জুনিয়র অফিসার পরিস্থিতি
পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। পারেননি। ব্রিগেডিয়ার কিউ.জি. দস্তগীরের কথা উল্লেখ করেছেন
যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মেনে নিতে পারেননি। ওসমানী খুনীদের সমর্থন করেছিলেন।
অক্টোবরের মাঝামাঝি ওসমানী প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে বঙ্গভবনে সিনিয়র সেনা
কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক ডাকেন। সেখানে তিনি ‘পর্যায়ক্রমে
বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিনিয়র জেসিওদের কাছে ডেকে নিয়ে বলতে লাগলেন, যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ভারতীয় প্ররোচনাতেই তা করবে। তারা
সব ভারতীয় এজেন্ট। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থান বিরোধীদের ‘ভারতের দালাল’ লেবেল সেঁটে দেয়া হলো।’
[পৃ. ১৩১]
আগস্টেই শফিউল্লাহ, একে খন্দকার চাকরি নেন।
এমনকি আবু সাঈদ চৌধুরীর মতো মানুষও। জামিলও এই দুঃখ করেছেন। জামিলও চাকরিচ্যুত ও
গ্রেফতার হন।
শাফায়াত জামিলের বিবরণে, ক্রোধ আছে, ক্ষোভ আছে, ফাঁক-ফোকরও আছে।
মেজর রশীদ তার অধীনে গোলন্দাজ ইউনিটের
প্রধান ছিলেন,
তিনি ইঙ্গিত করেছেন সেনাপ্রধান তাকে এ ইউনিটে দিয়েছিলেন [যেন
তিনি ষড়যন্ত্র করতে পারেন]। শাফায়াত জামিলের নিশ্চয় জানা ছিল, এগুলো রুটিন পোস্টিং, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।
তিনি জিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এমনও তো হতে পারে তিনিই এ জন্য
জিয়াকে তদ্বির করেছিলেন। কিন্তু আমি তা বলব না। এটি রুটিন পোস্টিং বলেই মনে করব।
শফিউল্লাহ তাকে ফোন করেছিলেন এ কথা
শফিউল্লাহ বিস্তারিত লিখেছেন এবং আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘যা হোক তিনি অন্তত
স্বীকার করেছেন যে তিনি ফোন করেছিলেন।’ হ্যাঁ, এমন একটি ঘটনায় সেনাপ্রধান বিপর্যস্ত থাকতে পারেন কিন্তু নির্দেশ দেননি
এ ভাষ্যটি বোধহয় ঠিক নয়। শফিউল্লাহ তাকে বার বার ফোন করেছেন কিন্তু তিনি তা এড়িয়ে
গেছেন। তিনিই স্বীকার করেছেন জিয়ার সঙ্গে আগে দেখা করেছেন। কেন? শফিউল্লাহ নয় কেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী জিয়া তারপর শফিউল্লাহর বাসায়
গেছেন। কিন্তু জিয়া শাফায়াতের ব্যাপারে কিছুই জানাননি।
খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা
লিখেছেন। শফিউল্লাহ তো খালেদকে পাঠিয়েছিলেন নির্দেশ দিয়ে। খালেদ সেখান থেকে
শফিউল্লাহকে ফোন করেছেন কিন্তু জামিলকে পেয়েছেন তা তো বলেননি। তিনি এও লিখেছেন, তিন বাহিনীপ্রধান ৪৬ সদর
দফতরে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কি ছিলেন সেখানে? থাকলে তিন
বাহিনীপ্রধান তো তার সঙ্গে নিশ্চয় কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গটি তিনি এড়িয়ে গেছেন।
ট্যাঙ্ক-গোলা সরবরাহ নিয়ে শফিউল্লাহ
জানিয়েছেন তার সঙ্গে কথা হয় খালেদের। জামিলের সঙ্গে তো তার দেখাই হয়নি। মোশাররফ ১৫
আগস্ট কি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন? সেনা সদরে তিনি যা বলেছেন তা অন্যদের
ভাষ্যের সঙ্গেও মিলে যায়। এখানে একটি প্রশ্ন তোলা যায়। ১৯ তারিখে শাফায়াতের সঙ্গে
শফিউল্লাহর দেখা হয়, শফিউল্লাহ কি শাফায়াতকে জিজ্ঞেস
করেছিলেন কেন তার নির্দেশ মানা হয়নি? যদি না জিজ্ঞেস করে
থাকেন তাহলে কেন করেননি? শফিউল্লাহ এ ব্যাপারে কিছুই
লেখেননি।
তিনি পাকিস্তান ফেরত ও মুক্তিযোদ্ধাদের
দ্বন্দ্বের কথা লিখেছেন। সঠিক এ বিষয়টি প্রায় সব সেনা কর্মকর্তাই স্বীকার করেছেন।
রউফ ও এরশাদ সম্পর্কে যা বলেছেন তাও সঠিক বলে অনুমিত। এরশাদের সঙ্গে শফিউল্লাহর
অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল এ বিষয়টি শুধু লে. কর্নেল হামিদ এবং তিনি উল্লেখ করেছেন আর
কেউ নয়। হামিদ জিয়ার বন্ধু ছিলেন সে কারণে শফিউল্লাহকে হয়ত পছন্দ করতেন না। জামিলও
হয়ত শোনা কথা লিখেছেন। পরে প্রমাণিত হয়, এরশাদ জিয়ার অনুচর হিসেবেই কাজ
করেছেন। ওসমানীর বিষয়ে যত শ্রদ্ধাই পোষণ করেন না কেন, এটা
তো অসত্য নয় যে, তিনি খুনীদের, বঙ্গবন্ধুর
খুনীদের সহায়তা করেছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা দুরূহ।
জামিল সরাসরি যুক্ত ছিলেন এ কথা বলব না, কিন্তু তিনি যে ওই দিন
এসব বিষয় থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন তা তো ঠিক। পরবর্তীকালে নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে
খালেদ মোশাররফের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন কিন্তু নিজে দূরে থেকেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সমর্থক তিনি ছিলেন না তা কীভাবে বলা যায়?
॥ বারো ॥
লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমও দুটি
আত্মজৈবনিক গ্রন্থ রচনা করেছেন যা হয়ত অনেকেই জানেন না। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে
প্রথম বইটি যা দেখেছি যা বুঝেছি। ঢাকার নবজাগরণ প্রকাশনী গ্রন্থ দুটি প্রকাশ
করেছে। ডালিম যা দেখেছেন তা যে ঠিক দেখেননি এবং যা বুঝেছেন তা যে ‘কনফিউশন’ সেটি তার বই পড়লেই বোঝা যায়। অতিরঞ্জন আছে, বাগাড়ম্বর
আছে, তার চরম দক্ষিণপন্থী দর্শন আছে। এসব বিচার-বিশ্লেষণ
করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে। সেগুলো হলো- সেনাবাহিনীর এই
কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, জিয়াসহ সিনিয়র অনেক
কর্মকর্তা [শফিউল্লাহ ছাড়া] জানতেন। গাজী গোলাম মোস্তফার ঘটনাটি ছিল অজুহাত,
তৎক্ষণিক কারণ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় তারা কীভাবে কাজ করেছেন,
জিয়া কীভাবে প্ররোচনা দিয়েছেন, এসব
বিবরণে খানিকটা অতিরঞ্জন থাকতে পারে। কিন্তু মিথ্যা তথ্য হিসেবে তা নাকচ করা যায়
না।
আমি আমার আলোচনার জন্য তার গ্রন্থের
প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় মাত্র উল্লেখ করব।
গাজী গোলাম মোস্তফার ঘটনা ঘটে গেছে। ডালিম এ
বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন,
যার মধ্যে অতিরঞ্জন প্রচুর।
ডালিমের ভাষ্য অনুসারে পরদিনই তার ডাক পড়ল
সেনাসদর দফতরে। সেনাপ্রধানের দফতরে যাওয়ার আগেই জেনারেল জিয়া তাকে ডেকে পাঠালেন
এবং সব শুনে বললেন,
“This is incredible and ridiculous. This is simply not acceptable. ঠিক আছে দেখ চীফ কি বলে।” [পৃ. ৪৩৫]
মেজর হাফিজ তখন জিয়ার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে
কর্মরত ছিলেন। তিনি ডালিমকে বললেন, “গত রাতের বিষয়টা শুধু তোমার আর
ভাবির ব্যাপার নয়। সমস্ত আর্মির dignity, pride and honour are at stake. মানে আমরা সবাই এর সঙ্গে জড়িত। You got to understand this
clearly ok? অন্য সব ব্রিগেডের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারাও এ
ব্যাপারে সবাই একমত। ঞযরং যধং মড়ঃ ঃড় নব ংড়ৎঃবফ ড়ঁঃ ৎরমযঃ ধহফ ঢ়ৎড়ঢ়বৎ. দেখ মুজিব
কি বিচার করে? আমরা শফিউল্লাহর মাধ্যমে দাবি জানাব আর্মির
তরফ থেকে। প্রধানমন্ত্রীকে [আসলে রাষ্ট্রপতি। তাই তার ভাষ্যে রাষ্ট্রপতির স্থলে
প্রধানমন্ত্রী শব্দটি ব্যবহার করেছি] সে দাবি অবশ্যই মানতে হবে। দাবিগুলোও আমরা
ঠিক করে ফেলেছি। তুমি শফিউল্লাহ কী বলে শুনে আস। তারপর আমরা যা করার তা করব।”
[পৃ. ৪৩৫-৪৩৬]
শফিউল্লাহর সঙ্গে ডালিম কথা বললেন।
শফিউল্লাহ জানালেন,
রাষ্ট্রপতি ও তিনি সম্পূর্ণ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন
তা মিটমাট করে নেয়া উচিত। ডালিম তাতে রাজি নয়। মিটিং শেষ। ডালিম বাইরে এসে দেখেন
সেনাসদরের ‘প্রায় সব অফিসার একত্রিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
তারা জানতে চায় সেনাপ্রধান কী বললেন। ডালিম জানালেন, সবাই ক্ষুব্ধ। একজন এডিসিকে বললেন, সেনাপ্রধানকে
বাইরে আসতে বলতে, তারা কথা বলবেন। শফিউল্লাহ বাইরে এলেন।
একজন বললেন, গাজী যা করেছেন তা সম্পূর্ণ “বেআইনীই শুধু নয়; It has compromised the honour and the
dignity of the whole armed forces particularly army. We canÕt take it lying. It has got to be sorted
out right and proper.” [পৃ. ৫৩৭]
শফিউল্লাহ জানালেন, রাষ্ট্রপতি ঘটনার জন্য
দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তারা মানতে রাজি নন। তারা জানালেন,
তাদের তিনটি দাবি আছে। সেনাপ্রধানকে এই দাবি রাষ্ট্রপতির কাছে
তুলে ধরতে হবে-
“১. গাজীকে তার সংসদ পদ
এবং অন্যান্য সমস্ত সরকারী পদ থেকে এই মুহূর্তে অব্যাহতি দিয়ে তাকে এবং তার অবৈধ
অস্ত্রধারীদের অবিলম্বে আর্মির হাতে সোপর্দ করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে, যাতে করে আইনানুযায়ী তাদের সাজা হয়।
২. গত রাতের সমস্ত ঘটনা প্রচারমাধ্যমগুলোর
মাধ্যমে দেশের জনগণকে অবগত করার অনুমতি দিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে।
৩. যেহেতু আওয়ামী লীগের সদস্য সেই
পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে ব্যক্তিগতভাবে মেজর ডালিম এবং তার
স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চলবে...
(৩০ জানুয়ারির পর)
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ হয়েছিল। তাজউদ্দীন নিজেই নাকি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেনÑ এ তথ্য মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তাজউদ্দীনকে ডালিম বিস্তর লেকচার দিয়েছেন, প্রত্যুত্তরে দেখা যাবে তাজউদ্দীন তেমন ৎবংঢ়ড়হফ করছেন না। ডালিমের সন্দেহ হয়েছিল তিনি জাসদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু কর্নেল তাহের থেকে শাজাহান সিরাজ সবাই একবাক্যে তা অস্বীকার করেছেন। ডালিমের মতে, “তার সঙ্গে দুদিনের আলোচনায় একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা গেল ভারত সম্পর্কে তার একটা বিশেষ দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা রয়েছে যার বাইরে তিনি যেতে পারছেন না।” [পৃ. ৪৬৫] মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ‘এ কারণে’ ডালিমরা তাজউদ্দীনকে পছন্দ করেননি।
ভারত সোভিয়েতের প্রতি তাদের একটা শারীরিক ঘৃণা ছিল। সোভিয়েত নাবিকদের কর্ণফুলী থেকে মাইন অপসারণও তারা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র মনে করেছেন।
ডালিম একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন, সরকার তাদের ওপর নজর রাখছিল এবং ঢাকার এসপি মাহবুব তাকে এ বিষয়ে সতর্কও করে দেন। ডালিমকে তিনবার হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। ডালিমের মতে এটি ছিল সরকারী প্রচেষ্টা।
দেশের বিবরণীতে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন এবং সরকারী দলের দুর্নীতির কথা বলেছেন। সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। আওয়ামী শাসন সম্পর্কে যেসব বিষোদগার সাধারণত এখন বিএনপিরা করে থাকে সেসব বিষোদগার আছে। তবে এর মধ্যে চোখ এড়িয়ে যায় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো জেনারেল শফিউল্লাহর মন্তব্য। ১৯৮৭ সালে লন্ডনের জনমত পত্রিকায় জেনারেল এই সাক্ষাতকারটি দিয়েছিলেন।
সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল-
“শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক বাহিনীর উন্নতির পক্ষে ছিলেন না, এ কথা কি সত্য?”
উত্তর : “হ্যাঁ, আমি বলব এ কথা সত্য।” [পৃ. ৪৫২]
এ কথা কতখানি সত্য পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। কিন্তু মূল বিষয় যেটি বলতে চেয়েছি তা হলো, বাংলাদেশের সামরিক সদস্য তিনি বিভিন্ন দল বা মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন কিন্তু তাদের মনের গড়ন একই রকম। তারা মনের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করতে পারেন না।
ডালিম যে কারণে পরিচিতি অর্জন করেছেন অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড তার বিবরণ দিয়েছেন বিংশ অধ্যায়ে।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের পটভূমিটা ডালিম তার লেখায় এভাবে তৈরি করেছেন-
১. শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও জাতির পিতা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি মহল ‘বদ্ধপরিকর’ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর থেকেই। ’৭১ সালে তিনি সংগ্রামে ছিলেন না। সেই সময় “এক অখ্যাত মেজরের ডাকে সাড়া দিয়ে” বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। “এ সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করা কখনই সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাব ছিল শেখ মুজিবের। তারই ফলে জাতি যখন হয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল তখন শেখ মুজিব চরম সুবিধাবাদীর মতো আপস রফায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে। জনগণের সব আশাকে নস্যাত করে দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের সঙ্গে না থেকে কারাবরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন পাকিস্তানে।” [পৃ. ৪৮০] শুরু থেকেই এ অভিযোগ ডালিমরা করেছেন এবং এ বিষয়ে ইতোমধ্যে মতামত ব্যক্ত করেছি। ডালিমরা ইচ্ছে করে ভুলে যান বঙ্গবন্ধু উপাধিটি দেয়া হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৩ এপ্রিল। স্বাধীনতার ঘোষণায় তাকেই স্বাধীনতার জনক বলা হয়েছে এবং সেটা মেনেই ডালিমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
২.বঙ্গবন্ধু “বাকশাল গঠন করে একনায়কত্ব কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য রাজনীতি ও সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গেল।” [পৃ. ৪৭৮]
৩. “শিকড় গেড়ে বসার আগেই একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক মহল থেকে অনেকেই ইঙ্গিত দিলেন, সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক হলেই সম্ভব হবে এই একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জাতিকে মুক্ত করা। তাদের এ ধরনের ইঙ্গিতের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমরা।” ওসমানী মন্তব্য করেছিলেন, “মুজিবকে সরাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?” [পৃ. ৪৭৮-৭৯]
৪. “শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিপ্লব ঘটিয়ে শেখ মুজিবের একনায়কত্ব ও বাকশালের পতন ঘটাতে হবে।” [পৃ. ৪৮১]
পরিকল্পনা এগিয়ে চলে। সেনা পরিষদের সঙ্গে মিটিং হয় লে. কর্নেল রশীদ ও ফারুকের। “তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রশ্নে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।” [পৃ. ৪৮১] তারা সামরিক অভ্যুত্থানের প্রস্তাব দেয় এবং জানায় খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে তারা বিকল্প সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। আলাপ-আলোচনার পর স্থির হয় জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হবে। এবং একে খন্দকারের বদলে এমজি তোয়াবকে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হবে। খোন্দকার মোশতাক এসব বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন।
ডালিমদের মনে হয়েছিল, ওপরের দিকের অনেক নেতা মুজিব ও ভারতবিরোধী। মোশতাককে তাদের নেতা বলে মানতে আপত্তি নেই তবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব নেতা বলেছিলেন, “নেতৃত্বে যোগ্যতার বিচারে খোন্দকার মোশতাকের স্থান শেখ মুজিবুর রহমানেরও ওপরে।” [পৃ. ৪৮৩]
১২ আগস্ট তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান সম্পর্কে। গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়Ñশেখ মুজিব, শেখ ফজলুল হক মনি, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ, তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাককে। ডালিমের ভাষ্য অনুযায়ী শেখ মুজিব, শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসা থেকে প্রথম গুলি হয় এবং তিনজন বিপ্লবী শহীদ হলেন। এটি সর্বৈর মিথ্যা। তোফায়েল [তাকে গ্রেফতার করা হয়] ও রাজ্জাক পালিয়ে গেলেও পরে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল থেকে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতির কাছে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।
“অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কর্নেল তাহের, কর্নেল আকবর হোসেন, মেজর শাহজাহান ওমর, মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর রহমতউল্লাহ, ক্যাপ্টেন সাজেদ, ক্যাপ্টেন মোস্তাক ও সরাফত [সব অবসরপ্রাপ্ত] এসে হাজির হলো রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছে তারা। বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এলো পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী ইতোমধ্যেই সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পকে নিরস্ত্র করেন তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে।” [পৃ. ৪৯২] অর্থাৎ এরা সবাই কমবেশি জড়িত ছিলেন ষড়যন্ত্রে। শফিউল্লাহ অভ্যুত্থান প্রতিরোধের জন্য নির্দেশ দেন শাফায়াত জামিলকে। তিনি সাড়া দেননি। অনুরোধ করেন খালেদ মোশাররফকে। তিনি জবাব দেন- “ইধহমধনধহফযঁ রং ফবধফ. ঞযব ধৎসু যধং ৎবাড়ষঃবফ ধহফ যিড়ষব ধৎসু যধং পবষবনৎধঃবফ.”. [পৃ, ৪৯৩]
এর পরের ঘটনাবলি সবার জানা। পুনরুক্তি করলাম না। ডালিমের মন্তব্যÑ“১৫ আগস্টের বিপ্লব স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন পেয়ে একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।” [পৃ. ৪৯৮]
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ডালিমদের সাহায্যে জেনারেল জিয়া কিভাবে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করলেন তার বিবরণ আছে পরবর্তী অধ্যায়ে। ডালিমরা চেয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করতে এবং ‘প্রপার স্ক্রিনিং’-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করতে। “সেনাবাহিনী থেকে বাকশালিপনা, দুর্নীতিপরায়ণ এবং উচ্চাভিলাষীদের বের করে দিতে হবে।” ডালিম উল্লেখ করেছেন স্পষ্টভাবে-“সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থনদানকারী জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ করা হয় রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা।” [পৃ. ৫০০] এর আগের বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ ঘটনার কথা জানতেন। এই উক্তির পর ধরে নেয়া যেতে পারে ডালিমদের প্রতি জোরালো সমর্থন ছিল তার এবং জেনারেল ওসমানী ছিলেন তাদের প্রশ্রয়দাতা, পরোক্ষভাবে জড়িত। চলবে...
(৭ ফেব্রুয়ারির পর)
( সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মেজর জেনারেল মইনুল ইসলামের বক্তব্যের সার কথা )
আবদুর রাজ্জাক যিনি ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান, তিনিও আমাকে আলোচনায় জানিয়েছিলেন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। সাখাওয়াত লিখেছেন, পুরো পরিবেশে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। “মনে হচ্ছিল সমগ্র দেশ কয়েকজন মেজরের হাতে জিম্মি আর সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা বেমালুম সহাস্যে সহ্য করে যাচ্ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারিতা যার প্রতিবাদও করার সাহস কেউ করেননি। আমার মনে হলো সকলেই স্রোতের সাথে গা এলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। আবার অনেকে অভ্যুত্থানের নায়কদের চোখে পড়ার জন্য স্বউদ্যোগেই অনেক কিছু করার চেষ্টা করেন। অনেকে একমতও প্রকাশ করেন। মনে হচ্ছিল যেন একটা free for us পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।” [পৃ. ৪৭]
এ পরিপ্রেক্ষিতেই আসে জেনারেল জিয়ার কথা। সাখাওয়াত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন নিজের দেখাশোনার অভিজ্ঞতা ও যারা এ সম্পর্কে লিখেছেন তাদের তথ্য থেকে। ডালিম সাখাওয়াতকে জানিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। উচ্চপদস্থ অনেক অফিসারের সঙ্গে আলোচনা সূত্রে জেনেছি, জিয়া প্রায়ই তাদের কাছে সেনাপ্রধান হতে না পারার ক্ষোভ প্রকাশ করতেন এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখতে চাইতেন। সাখাওয়াত লিখেছেন, এ রকম একটা খবর শুনে জিয়া নির্বিকার ছিলেন কীভাবে? “How could remained so unnerved after hearing such as shocking news without any reaction.” [পৃ. ৫০]
‘র’ সম্পর্কে লেখা এক বইয়ে অলোক রায় লিখেছেন, অভ্যুত্থানের আগে সে বিষয়ে আলোচনার জন্য জিয়ার বাসায় ফারুক, রশীদ ও জেনারেল ওসমানী বৈঠক করেছিলেন। এ খবর পাওয়ার পর র-এর প্রধান কাও এসে কথা পর্যন্ত বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারো কথায়ই কর্ণপাত করেননি। আর সেনাবাহিনী মানসিকভাবে যে পাকিস্তানের প্রতি অনুরক্ত ছিল তার উদাহরণ সাখাওয়াত হোসেনের মন্তব্যÑ“এটা ঠিক যে, সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় বেশিরভাগ সদস্যই ২৫ বছরের চুক্তিকে সহজভাবে নিতে পারেননি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগকে ভারতঘেঁষা মনে করতেন। আর এও বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের কারণেই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে স্বাভাবিকভাবে গড়তে দেয়া হয়নি।” [পৃ. ৫৪]
কর্নেল তাহেরের ভূমিকারও উল্লেখ করেছেন সাখাওয়াত। দেখা যায়, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে সখ্য ছিল জিয়ার এবং সে কারণে তিনি জিয়ার সাহায্য চেয়েছিলেন। এখানে একটি প্রশ্ন অনুক্ত থেকে যায়, তাহলো কর্নেল তাহের যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিলেন তা তো বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেই ছিল। এবং তিনি জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বটে কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রুখে দাঁড়াননি বরং তার অনুগতরা খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেছে।
সাখাওয়াত হোসেন এরপর জিয়া হত্যার কথাও বর্ণনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরবর্তী সময় থেকে জিয়া পর্যন্ত সময়টুকুতে তিনি যা দেখেছেন স্মৃতিকথার আকারে তা লিখেছেন। এর নির্যাস ক্রমাগতই পাকিস্তান ফেরতরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এরশাদকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করে। রাজনীতিবিদদের ‘নিম্নমানের সংস্কৃতি’রও উল্লেখ করেছেন। আমাদের ধারণা, আসলে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী রাজনীতিবিদ ও পূর্ববর্তীদের মধ্যে চারিত্রিক গঠনেই পার্থক্য ছিল। পরবর্তীকালের রাজনীতিবিদরা যে সেনা শাসন বা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেননি, তা নয়, করেছেন কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর অগণতান্ত্রিক সেনাশক্তির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন, সেনা কর্তৃত্বকে সিভিল কর্তৃত্বের অধীনে আনার চেষ্টা করেননি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুদলের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।
১৬.
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী যে নীরব সাক্ষ্য দিয়েছেন তা চমকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ২০০০ সালে তার আত্মজীবনীটি মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে। এখনও আমরা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি সেসব বিষয় তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে কিন্তু সরলভাবে লিখে গেছেন। বাংলাদেশে সেনা রাজনীতির প্রথম দুই দশকের না জানা ইতিহাসের জন্য মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রমের এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদের কথা বাদ দিই। যে জেনারেল শফিউল্লাহর বই নিয়ে আলোচনা করছি তারও অনেক বিবরণ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তথ্য নিয়েও কথা উঠতে পারে কিন্তু মইনুলের বই নিয়ে উঠবে না। কেন এই মন্তব্য করছি? মইনুল ছিলেন ১৯৭৪-এ লে. কর্নেল এবং ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক। শফিউল্লাহ লিখেছেন, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে এত কথা বলা হয়েছিল যে, মইনুলকে এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তিনি নিজেও নিশ্চয় তা জানতেন। কিন্তু তার গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার সমস্ত সুখস্মৃতি বা সমবেদনার ছোঁয়া আছে। একটুও শ্লেষ নেই যা অন্যান্য সেনাকর্তার লেখার মধ্যে আছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, যেসব সেনাকর্তার বইয়ে তার উল্লেখ আছে সেখানে তার সম্পর্কে কোনো সমালোচনা নেই। জেনারেল শফিউল্লাহও তার গ্রন্থে মইনুল সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করেননি, কোনো সমালোচনা করেননি। হয়তো তার মধ্যে এক ধরনের সততা ছিল যে কারণে কেউ তাকে একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
মইনুল লিখেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নয়জন কর্মরত এবং পরে পাকিস্তান থেকে আগত তিনজন মোট ১২ জন মেজর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জিয়া ও শফিউল্লাহ একই ব্যাচের কিন্তু প্রশিক্ষণের ফলের ভিত্তিতে জিয়া ছিলেন জ্যেষ্ঠ। বঙ্গবন্ধু নিজ থেকেই শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। এজন্য বিশেষ কোনো সুপারিশ ছিল না। জিয়া এতে ক্ষুব্ধ হন। খালেদ মোশাররফের সঙ্গেও জিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ধারণা করা হতো শফিউল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। তারা দুজনই প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন এবং সিনিয়র অফিসাররা তা জেনে সুযোগ দিতেন। শফিউল্লাহ এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। মইনুল লিখেছেন, “মূলত গত ২৮ বছরে বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধানের কমান্ড ও কন্ট্রোল না থাকায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, তা পুরো জাতিকে বারবার বিপর্যস্ত করেছে। তবে এসব দুঃখজনক ঘটনার দায় সেনাপ্রধানের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ওপরও বর্তায়।” [পৃ.৪২]
মইনুল জানিয়েছেন, শফিউল্লাহ-জিয়া দ্বন্দ্বে শওকত, তাহের, জিয়াউদ্দিন ও মনজুর সমর্থন দিতেন জিয়াকে। পরে অবশ্য তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে মইনুল এসব থেকে সব সময় দূরে ছিলেন।
জিয়াউদ্দিন ৪৬ ব্রিগেডে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিলেন। মইনুল লিখেছেনÑ “তখন সেখানে প্রায় বিদ্রোহের মতো পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল এবং যে কোনো সময়ে গুরুতর সামরিক শ্ঙ্খৃলাভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেয়।” বঙ্গবন্ধু তখন বিদেশে ছিলেন। ফিরে এসে এসব জেনে মইনুলকে তিনি ৪৬ ব্রিগেডের প্রধান হিসেবে বদলি করেন। এতে আবার রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ ক্ষুণœ হন।
জিয়াউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে উত্তেজনাকর প্রবন্ধ লিখতেন। মইনুল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার প্রবন্ধের তথ্যাবলি কোথায় পান। “উত্তরে তিনি আমাকে জানান, জেনারেল ওসমানী তাকে এসব তথ্য সরবরাহ করেন এবং তিনি তা বিশ্বাসও করতেন।” [পৃ. ৮৬]
মইনুল কাজে যোগ দিয়ে ব্রিগেডে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি লিখেছেন, “শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম সামরিক বাহিনীর ভিত্তি। উচ্ছৃঙ্খল সামরিক বাহিনী রাস্তার দাঙ্গাবাজদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তারা একটা দেশকে যে কোনো সময় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।” [পৃ. ১৮] তার এই মন্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। কারণ, গত চার দশকের অভিজ্ঞতাই এর উদাহরণ বিশেষ করে ২০০৬-০৮-এর ঘটনাবলি।
১৯৭৩ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান থেকে বাঙালি অফিসাররা ফিরতে শুরু করেন। অনেক নিয়মনীতি তাদের ক্ষেত্রে ‘অনুসৃত’ হয়নি। পাকিস্তান ফেরত জেনারেল এরশাদ সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছিলেন। দুই বছরে লে. কর্নেল থেকে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। মইনুলের ভাষায়Ñ “শান্তিকালীন সময়ে এরকম পদোন্নতি নজিরবিহীন, তার ওপর এ সময়ে তিনি কোনো পর্যায়ে অধিনায়কত্বও করেননি। তবু পাকিস্তান ফেরত অনেক সামরিক অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি ও পদোন্নতি মনে-প্রাণে মেনে নেননি যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায়।” [পৃ. ৫৭]
এ সময় থেকেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা এতে হেরে যান। শুধু পরাজয়ই নয়, তাদের প্রাণও হারাতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেন জেনারেল জিয়া ও এরশাদ।
শেখ কামালের গুলিবিদ্ধের ঘটনাটিও তিনি লিখেছেন যা তার সম্পর্কিত গুজবের অবসান ঘটাবে।
মইনুলের মতে, শেখ কামাল তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ‘শহর টহলে’ বের হন। সিরাজ শিকদারের খোঁজে রত স্পেশাল পুলিশ ফোর্স এই মাইক্রোবাসটি দেখে এবং কোনো রকম সতর্কবাণী না দিয়ে গুলি চালায়। ফলে কামালসহ ছয়জন আহত হন। পুলিশই তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পরদিন ছিল বিজয় দিবসের প্যারেড। বঙ্গবন্ধু খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। মইনুলের সঙ্গে আগে দেখা হলে কথা বলতেন। মইনুল প্যারেড পরিচালনা করলেও শেখ মুজিব তার সঙ্গে কথা বলেননি। মইনুল লিখেছেনÑ “এত মর্মাহত হতে তাঁকে কখনো দেখিনি।” [পৃ. ৬৬] মইনুল তারপর হাসপাতালে কামালকে দেখতে যান। সেখানে শুধু বেগম মুজিব ছিলেন। “প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কামালের ওই রাতের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুণœ হন। প্রথমে তিনি তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানান। পরে অবশ্য বিকালের দিকে তিনি কামালকে দেখতে যান।” [পৃ. ৬৬]
তিনি আরও লিখেছেনÑ “এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিদ্বেষীরা এই ঘটানাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। ‘ব্যাংক ডাকাতি’ করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশে-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এমন প্রচারে সত্যের লেশমাত্র ছিল না।” [পৃ. ৬৬]
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, রাজনৈতিক নেতা ও তাদের পরিবারবর্গকে ক্ষমতায় থাকার সময় যতটা সতর্কভাবে সচেতন থাকতে হয় সেটি ছিলেন না, যার ফলে বিরূপ প্রচারের শিকার হতে হয়। পরবর্তীকালেও এ ধারা অব্যাহত ছিল এবং আছে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। মইনুল লিখছেন, বাকশাল সৃষ্টি এবং বিভিন্ন ঘটনার ফলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছিল। কিন্তু “শেখ মুজিবকে অবহিত করার মতো সৎসাহস তাঁর কোনো উপদেষ্টা, পারিষদবর্গ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ছিল না বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা।” [পৃ. ৬৮] এ ধারণা এখনও অব্যাহত। চলবে...
(৮ ফেব্রুয়ারির পর)
(৮ ফেব্রুয়ারির পর)
জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কীভাবে সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করে ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন এবং তার ফল কী হয়েছিল মইনুলের বিবরণে তার একটা চিত্র আমরা পাই।
জেনারেল শফিউল্লাহর সময় মইনুলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি লিখেছেন- “আর্মি শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য বিষয় দেখে অত্যন্ত বিচলিত হই এবং আর্মিতে ঐক্যের মারাত্মক অভাব অনুভব করি। অধিনায়কগণ আর্মির শৃঙ্খলা ও অন্য আইনকানুনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে আমার মনে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব তো ছিলই, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কোন্দল, দলাদলি ও পারস্পরিক রেষারেষিতে লিপ্ত ছিলেন।” [পৃ. ৬৯]
জেনারেল জিয়ার উল্টোদিকের বাসায় থাকতেন তিনি। একদিন জিয়ার বাসা থেকে বেরুবার সময় দেখেন, মেজর ফারুক সেখানে দাঁড়িয়ে। সেখানে তিনি কী করছেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, তিনি জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। জিয়াকে পরদিন মইনুল ফারুকের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, ফারুক এসেছিল এবং তিনি তার স্টাফদের জানিয়েছেন জুনিয়র অফিসারদের তার বাসায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে। মেজর রশীদও একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং ফটকের সামনেই সেনাবাহিনী, রাজনীতি, বাকশাল নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে থাকলে তিনি নিয়মানুযায়ী তা তার কমান্ডারকে জানাতে বলেন। অর্থাৎ এ চক্রটি সময় নিয়েই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় মইনুল অসুস্থ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও মুজিব মইনুলের স্ত্রীর কাছে তার খোঁজ-খবর নেন।
অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১২ আগস্ট বাসায় ফেরেন। ১৫ তারিখ সকালে জিয়া তাকে ফোনে জানান, ‘শেখ মুজিব হ্যাজবিন কিল্ড’ এবং তাড়াতাড়ি তাকে সদর দপ্তরে যেতে বলেছেন। তিনি তৈরি হতে হতেই জেনারেল রব ও চা বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোতাহারউদ্দিন গাড়িতে করে তার বাসায় উপস্থিত হয়ে জানান তারা তাকে নিয়ে জেনারেল ওসমানীর বাসায় যেতে চান যাতে ওসামানীকে খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখা যায়। মইনুল জানালেন, সেটি বোধহয় সম্ভব হবে না। কারণ, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকেই ওসমানী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।
এ কথা শোনার পর তারা দুজন চলে যান। মইনুল রওনা হন সদর দপ্তরের পথে। ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলের সঙ্গে তার দেখা হয়। মইনুল জিজ্ঞেস করেন, মুজিব হত্যায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়ার কথা তিনি ভেবেছেন? শাফায়াত জওয়াব দেন তাদের কয়েকজন তার সঙ্গে সকালে দেখা করেছেন এবং এখন “তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গেলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে।” এ উত্তর শুনে মইনুল অবাক হন। জামিলের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে খানিকটা ভিন্ন।
মইনুল জানাচ্ছেন, অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ফাইল এলে তা নাকচ করে দেন। কারণ ১২ ডিসেম্বর ফারুক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মইনুলের ভাষায়, এটি ছিল ‘জঘন্য কলঙ্কময়’ যার নজির বিরল, কিন্তু সদর দপ্তরে বিদ্রোহ দমনের উদ্যোগ ছিল না।
মোশতাক এসে ‘জয়বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রচলন করলেন। এই দুটি শব্দ পরিবর্তনই বুঝিয়ে দিল, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পূর্বতন আদর্শের পরিবর্তন হয়েছে। ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হলো। এরশাদকে মেজর জেনারেল। আরও কিছু পরিবর্তন হলো এবং মইনুল জানাচ্ছেন এসব পরিবর্তন ওসমানী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা করেছিলেন।
জিয়া সেনাপ্রধান হলেন এবং “মুজিব হত্যায় জড়িত অফিসার ও অন্যান্যকে আয়ত্তে আনার জন্য কোনোরূপ সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে অপারগ ছিলেন।” সম্ভবত তিনি নিজের অবস্থান যথোপযুক্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন। [পৃ. ৮১] অন্যদিকে সিজিএস খালেদ মোশাররফ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। কারণ তার সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। আবার ওসমানী জিয়াকে পছন্দ করতেন না।
এরই মধ্যে জিয়াকে বন্দি করা হয় তার বাসায়। বেগম জিয়া তাকে খবরটি জানান। দ্রুত তিনি সব বাধা উপেক্ষা করে জিয়ার বাসায় আসেন। খুব অবাক হন জিয়া। তিনি জিয়া ও তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে চলে আসেন। নানা নাটকের পর জিয়ার ইস্তফা আদায় করা হয় এবং খালেদ সেনাপ্রধান হন। শহরজুড়ে জানানো হয় খালেদ ভারতের ‘এজেন্ট’। এ গুজব খুব কার্যকর হয়েছিল। খালেদ নিহত হন। এসব ঘটনা সবার জানা। মইনুল লিখেছেন, “এ অভ্যুত্থানে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না এবং এই অভ্যুত্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাদের কোনো বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভ্যুত্থানকারী সিনিয়র অফিসারদের চিন্তাধারা সম্যক অবগত ছিলাম। এটা নিছক কাকতালীয় এবং সম্পূর্ণভাবে আর্মির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীতে ও দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, এটা ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের পক্ষে অভ্যুত্থান। আর এটাই পরে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।” [পৃ. ৯০]
অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান ইত্যাদির পর পরিস্থিতি ক্রমে শান্ত হয়। মইনুল অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে হত্যাকারী ও বিভিন্ন অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিচারের জন্য বলেন কিন্তু জিয়া “এতে উৎসাহী ছিলেন না।” [পৃ. ৯৭] বরং তাকে লন্ডন দূতাবাসে কাউন্সিলর করে পাঠানো হয়।
লন্ডনে তিনি লক্ষ্য করেন, “জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় স্বার্থরক্ষা করার চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে।”
[পৃ. ৯৯] মাসকারেনহাস সম্পর্কে জানান, তিনি লন্ডনের সোনালী ব্যাংক থেকে ২০ হাজার পাউন্ড ঋণ নেন যা শোধ করেননি এবং “তাকে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ওপর মহলের নির্দেশে ওই অর্থ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে।” [পৃ. ১০০] মইনুল তা পছন্দ করেননি ফলে মাসকারেনহাসের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইঙ্গিত করেছেন এ কারণেই মাসকারেনহাস জিয়াকে হেয় করে ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ লেখেন। ১৯৭৫-এ মুজিবের ছবি সংবলিত বিভিন্ন মানের ‘কোটি কোটি’ টাকা পোড়ানো হয়। এগুলো লন্ডনে ছাপাতে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া মওদুদ ও জাকারিয়া খানকে তখন লন্ডনে পাঠানো হয় জিয়ার জন্য রাজনৈতিক “প্ল্যাটফর্ম ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য।” [পৃ. ১০০]
১৯৭৭ সালের এপ্রিলে জিয়া মইনুলকে ঢাকায় আসতে বলেন। মইনুল তার বাসায় দেখা করেন। পরে একদিন অফিসেও। সেখানে জেনারেল এরশাদও ছিলেন। মইনুলের জায়গায় লন্ডনে কাকে পাঠানো যায়? জিয়ার এ প্রশ্নের উত্তরে মইনুল কর্নেল সাবিউদ্দিনের নাম করেন। এরশাদ তখনই বলেন, ‘হি ইজ নট আওয়ার ম্যান’। এটি শুনে মইনুল হতবাক হয়ে এর প্রতিবাদ করেন। জিয়া তারপর তাদের থামিয়ে দেন।
মইনুল লিখেছেন, “সেনাবাহিনীর অবস্থা তখনও ছিল বিশৃঙ্খল। নতুন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নূরুল ইসলাম জিয়ার রাজনৈতিক কাজ ও দল গঠন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনিই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণে উদ্যোগ নেন। মইনুল জিয়াকে বলেছিলেন এ প্রস্তাব নাকচ করতে। তিনি করেননি। পরে এরশাদ আমলে ও বেগম জিয়ার আমলে তিনি যখন ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে রাষ্ট্রদূত তখন খুনিদের সেসব জায়গায় পাঠানোর চেষ্টা হলে তিনি তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।” মইনুল আরো উল্লেখ করেছেন জেনারেল শওকত ও মনজুরের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল।
জিয়ার বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে এটি স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরিকল্পনা তিনি জানতেন, এতে প্রশ্রয়ও দিয়েছিলেন। বিনিময়ে খুনিদের যত রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া যায় দিয়েছিলেন।
-
-
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন