শতাব্দীর সেরা নৃশংস আই এস যুদ্ধা ও তাদের কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ ৷



        
     

         শতাব্দীর সেরা নৃশংস আই এস যুদ্ধা ও তাদের কার্যকলাপের  বিস্তারিত বিবরণ ৷

     ( লেখক- ১ .নাজনীন  আখতার , ২ . গাফ্ফার খাঁন চৌধুরী এবং ৩ .ইব্রাহিম  নোমান ৷ (সৌজন্য-দৈনিক জনকণ্ঠ এবং ঐ নিবন্ধের লেখকগণ  )

         (  শতাব্দীর নৃশংস যুদ্ধা আই এস এবং তাদের উৎপত্তি , লক্ষ্য , বিস্তৃতি সহ তাদের অর্থ ক্ষমতার উৎস , চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এই এস এর কৌশল সহ বাংলাদেশে এই এস এর প্রত্যক্ষ্ বা পরোক্ষ্য নীলনক্সা প্রসঙ্গ  এবং আই এস এর নারী নিগ্রহ ইত্যাদের একটি সম্মিলিত সংক্ষিপ্ত রূপরেখা ৷)
   


                       আইএস এর নৃশংসতার কিছু নমুনা   

         আয়লান কুর্দির পরিবার সিরিয়ার কোবান শহরে থাকতেন। সেখানে আইএস জঙ্গীদের সঙ্গে সরকারী বাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার পর তারা পালিয়ে তুরস্ক আসে। সেখানে থেকে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে কর্তৃপক্ষ তাদের শরণার্থী আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর তারা সমুদ্রপথে তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল। নৌকাডুবিতে মাসহ পরিবারের ১২ জনের সঙ্গে মৃত্যু ঘটে আয়লানের। এই ঘটনা বিশ্ববিবেক কে নাড়া দেয় ব্যাপকভাবে ৷

      যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে এভাবে আয়লানের পরিবারের মতো ছোট নৌকায় হাজার হাজার ডলারের বিনিময়ে গাদাগাদি করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে মৃত্যু ঘটে হাজারো মানুষের। স্থল সীমান্তেও মৃত্যুর মিছিল কম নয়। ইউরোপের দেশগুলোও লাখ লাখ শরণার্থীর চাপ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

         এরপরও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যদিও বা তারা নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থী ভাগাভাগি করে নিতে চাইছে তখনও মানবতা রক্ষার সুস্পষ্ট চিত্র অর্থাৎ শরণার্থীদের প্রতি তাদের মানবিক আচরণ পুরোপুরি অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ধনী দেশগুলোর কড়াকড়ি থাকায় তারা প্রাথমিকভাবে প্রবেশ করেন মাল্টা, ইতালি ও গ্রীসের মতো কম ধনী দেশগুলোতে। পরে তারা ইউরোপের অন্যান্য অংশের দিকে পাড়ি জমান।

         প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক। ৬৭ হাজার সিরীয় নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করেন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইরিত্রিয়া ৩৪ হাজার, আফগানিস্তান ১৩ হাজার এবং মালির ১০ হাজার নাগরিক ইউরোপে প্রবেশ করেন। এছাড়া বর্তমানে ৬ লাখ মানুষ লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কেন নিজ দেশ ছেড়ে ভিন দেশে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা এসব মানুষের এর উত্তর এখন কম বেশি প্রায় সকলের জানা। বিশেষ করে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের নাগরিকদের দেশত্যাগের পেছনে কাজ করছে একটি ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর উন্মুত্ত মাতম এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট বাধা কয়েকটি দেশ। যারা নিজেরাই প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মহাদানব সৃষ্টির জন্য দায়ী। 

         নৃশংস ও বর্বর জঙ্গী সংগঠনের আরেক নাম এখন ইসলামী স্টেট বা আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে সুন্নি আরব জঙ্গীদের এই সংগঠন। ধর্মভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলো চোরাগোপ্তা হামলা করে এলেও আইএস প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য যুদ্ধে জড়াচ্ছে। নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো স্থল অভিযানে অংশ নিয়ে এলাকাও দখল করছে তারা।
মূলত আল কায়েদা থেকে বের হয়ে আসা এই কালো দানবের নাম আইএসআইএস বা সংক্ষেপে আইএস। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। কিছুদিন আগেও সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব দি ইরাক এ্যান্ড দ্য লেভান্ট/সিরিয়া বা আইএসআইএল/আইএসআইএস।
ইরাকে রাজনৈতিক সংঘাতের সুযোগে প্রকাশ্যে চলে আসা এই জঙ্গীগোষ্ঠী অল্প কয়েক দিনেই আলোচনায় এসেছে তাদের বর্বরতার জন্য। জীবন্ত কবর দেয়া, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা, লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। এমনকি শিশুদের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে আইএস। জাতিসংঘ আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে । ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়- শুধু তারাই আইএসের নৃশংসতার শিকার হয় এমন নয়, ইসলামের সুন্নিপন্থায় যারা বিশ্বাসী নয় তাদের ওপরই চলে সংগঠনটির ভয়াবহতা। গুলি করে, ত্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয় তাদের। নৃশংসতার দিক দিয়ে আল কায়েদা, বোকো হারাম, লস্কর-ই-তায়েবা, জুমা ইসলামিয়া, ইসলামিক ফ্রন্ট, আল সাবাহ, তালেবানের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোও হার মানিয়েছে। সাধারণত ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো আকস্মিক বিমান হামলা বা অতর্কিত হামলা চালিয়ে থাকে। তবে আইএস প্রথমবারের মতো স্থল হামলা শুরু করেছে। জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) একের পর এক হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র-নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে। এসব হামলার পেছনে প্রধান দুটি কারণ কাজ করছে
Ñ এক. নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য তুলে ধরা এবং দুই. বিরোধীপক্ষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা। সম্প্রতি হামলার মাধ্যমে একটি বার্তা স্পষ্ট যে, বর্বর এ জঙ্গীগোষ্ঠীটি তাদের হামলার পরিধি ক্রমে বাড়াচ্ছে এবং একই সঙ্গে তাদের কৌশল বদলের আভাসও স্পষ্ট।

         ইরাক ও সিরিয়ার দখলকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন কার্যকর করেছে আইএস। ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে লেবাননেও তৎপর গোষ্ঠীটি। শরিয়া আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভিন্ন গোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের ধর্ষণ ও যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহারে আইএস যোদ্ধারা তাদের আরেক ভয়াবহ চেহারা তুলে ধরেছে। আইএস যোদ্ধাদের বাড়িতে ও ক্যাম্পে নারীদের নিভৃত কান্না হারিয়ে দিয়েছে সমস্ত মানবতা। এছাড়াও নিজ গোষ্ঠীর কম বয়সী মেধাবী নারীদের সংগঠনের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিচ্ছে আইএস। এযাবতকালের জঙ্গী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক, প্রশাসনিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে আইএসকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর ও শক্তিশালী। ধর্মের নামে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অপহরণ, গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণের মতো বিষয়গুলো যেখানে ঘটে চলেছে নিত্যদিন। বিশ্বব্যাপী ধর্মের নামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী এই জঙ্গী সংগঠনটির ভয়াবহতা ও নৃশংতার চিত্র তুলে ধরতে হলে এর নেপথ্য দেখাটাও জরুরী।
 
বলা হয়ে থাকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ইরাকের নেতা নূরী আল-মালিকি, সৌদি আরব, মিসর, লিবিয়াসহ অন্যান্য গালফ দেশ, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন, ইসরাইলের মতো তাদের মিত্র দেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সের মতো ন্যাটোভুক্ত দেশ এবং সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন-কেউই বাদ যায় না এই মহাদানব সৃষ্টির নেপথ্য কারিগর হিসেবে। আর এই দানব সৃষ্টির শেকড় সন্ধান করলে অবশ্যই যে নামটি ঘুরে ফিরে আসে তা হচ্ছে- আল কায়েদা। আরেকটু উৎস সন্ধানে পেছনে গেলে আসে আফগানিস্তানের নাম আর দানব সৃষ্টির নেপথ্য দেশগুলোর নাম।
-

   আইএসের লক্ষ্য ও বিস্তৃতি

আইএসের বিস্তৃতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা ধরনের আলোচনা, বিতর্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। সবকিছু ছাপিয়ে যে আলোচনাটা সবার সামনে চলে আসে তা হলো আইএসের বিস্তৃতি লাভে রয়েছে এর কৌশল ও সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব-অন্তর্দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা আইএসের অগ্রযাত্রা তথা সম্প্রসারণকে বিশ্ব নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে একে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কোন কোন মহল আইএসের এই অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখতে আগ্রহী। তবে রাজনীতির বিশ্লেষকরা আইএসের পুরো বিষয়টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করছেন। 
আইএস কিভাবে বিস্তৃতি লাভ করল- এরকম প্রশ্নের নানাবিধ উত্তর আছে। সরল সমীকরণ করলে দেখা যায় সিরিয়া গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সেই অঞ্চলে আইএসআইএসের অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে কীভাবে এর সৃষ্টি হলো? সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ (বাশার আল আসাদের বাবা) ১৯৯৩ সালে হামায় বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করার পর সিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ২০১১ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর উদ্যোগ নেন। বিষয়টিকে তিনি মোটাদাগে চিত্রিত করে গণতন্ত্রের জন্য পথ পরিষ্কার করারজন্য বাশারের প্রতি আহ্বান জানান। ঐ একই সময়ে বারাক ওবামার সঙ্গে গলা মেলান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেল এবং ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। তারা অভিন্ন কণ্ঠে বাশারের পদত্যাগের দাবিকে মূল ইস্যু বানিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে জটিল করে তোলেন। সে সময় জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতারাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সিরিয়া বিদ্রোহ ক্রমান্বয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে। সৌদি আরব বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপক সামরিক সাহায্য দিতে থাকে। আসাদ এবং সিরীয় বার্থপার্টির উঁচু স্তরের বেশ কয়েকজন নেতা ইসলাম শিয়াপন্থী হওয়াতে সৌদি আরব আগেই তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
 
সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। আইএস মূলত কয়েকটি শক্তিশালী দেশ ও কতিপয় বিশ্ব নেতাদের প্ররোচণায় বাশারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
 
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে বর্ষীয়ান সাংবাদিক প্যারিক ককবার্ন বেশ পরিচিত। তিনি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট : আইএস আইএস এ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভিউল্যুশনতে বিষয়টিকে বেশ তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ককবার্ন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্র দি ইনডিপেন্ডেন্টে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি ও সঙ্কট নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তার গ্রন্থে আইএস আইএসের ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন পাশাপাশি সুন্নী সন্ত্রাসী গ্রুপটির ভয়াবহ আতঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার নেপথ্য কারণ শনাক্ত করেছেন। ককবার্ন তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন দুটি মারাত্মক সমস্যা ইরাককে আবারও সঙ্কটের মধ্যে ফেলেছে। ইরাকী নেতৃত্বের সম্প্রদায়িক পন্থা এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার মতো আরব দেশগুলোতে গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের মার্চে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ফেটে পড়লে সিরিয়া সঙ্কটের সূচনা ঘটে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিক্ষোভ দমনে কঠোরতর ভূমিকা নিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করে। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। গৃহযুদ্ধের এই সুযোগকে কাজে লাগায় বহিরাগত শক্তি
Ñ বিশেষ করে সৌদি আরব। তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তেল। বিদ্রোহী শক্তিগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে আইএস। আর আইএসকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর কয়েকটি দেশ। আইএসের হয়ে বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এসব দেশ।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করলে আইএস তথা বিদ্রোহী বাহিনীকে এখনও বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করছে বাশার বাহিনী। ইরান এই অঞ্চলে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তেহরান ও লেবাননী শিয়া মিলিশিয়া-কাম-রাজনৈতিক আন্দোলন হিজবুল্লাহর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হলো সিরিয়া। সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলের বাইরে সিরিয়ার তার সঙ্গেই রয়েছে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অর্থ হলো ইরান ও রাশিয়াকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল করে ফেলা। সিরিয়াকে ধরাশায়ী করা গেলে নিশ্চিতভাবে পাশ্চাত্য ও সৌদি আরব লাভবান হবে। আইএস যোদ্ধারা যখন সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা তথা বাশার বিরোধীদের হাতে নগদ অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিতে শুরু করে তা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখে। জর্দান তার ভূখ-কে আইএসের প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। অন্যদিকে ইসলামী বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমিকায় ফিরতে থাকা তুরস্ক সিরিয়ার সঙ্গে তার ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তকে আইএসের যোদ্ধাদের সহজে আসা-যাওয়ার কাজে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। পাশ্চাত্য শক্তিও আইএসের পাশে এসে ছায়ার মতো দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে ইরান ও রাশিয়া সিরিয়ার প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থনদানের বিষয়টি জাতিসংঘসহ সব জায়গাই পুনর্ব্যক্ত করে। যার ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কেউই নিজেদের বিজয় দাবি করতে পারে না।
সিরিয়ায় আইএস তাদের শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শনের ব্যাপারে কৃতিত্ব দেখায়। আইএসের নেতা বাগদাদী বেশ উচ্চাকাক্সক্ষী। প্রখ্যাত সাংবাদিক ককবার্ন আইএস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, আল কায়েদাকে সংগঠনের চেয়ে একটি আইডিয়া বলাই ভালো। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখানে স্বেচ্ছায় ভর্তি হয় এবং যে কোন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বাগদাদী চান একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে যেটাকে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র। ২০১৩ সালে সিরীয় নগরী রাক্কা দখল করার পর আইএস আবার ইরাকে প্রভাব বিস্তারের কাজ শুরু করে।
 
আইএসের উত্থান বিষয়ক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বড় দাগে যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন কৃতিত্ব দিচ্ছেন আবার একই সঙ্গে দুষছেনও। যুক্তরাষ্ট্র্র দেশটির সম্প্রদায়গত বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে এই উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করেছিল যার পেছনে উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বাথ পার্টি নিষিদ্ধ করলে পরবর্তীতে এর লাখ লাখ যোদ্ধা ও বিপুলসংখ্যক জেনারেল বেকার হয়ে পড়ে। এরা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান তাদের সামনে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ খুলে দেয়। এদের বেশিরভাগই আল কায়েদা ধরনের সংগঠনে ভিড়ে যায়। এসব সুন্নি আধা সামরিক গ্রুপ ও উপজাতীয়দের মধ্যে বাথিস্ট নক্সবন্দী, আনসার আল ইসলাম, মুজাহিদিন আর্মি ইরাকে আইএস আইএসের অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
আফ্রিকার জঙ্গী সংগঠন বোকো হারামসহ কয়েকটি উগ্র গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আফ্রিকা জুড়ে হত্যা, নৃশংতা, ভিন্ন গোষ্ঠীর নারী ও শিশু অপহরণ ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার মতো জঘন্য অমানবিক কর্মকা-ে জড়িত। বোকো শব্দটি হাউসা ভাষার আর হারাম এসেছে আরবি থেকে। বোকো অর্থ পশ্চিমা শিক্ষা। বোকো হারাম মানে পশ্চিমা শিক্ষা পাপ। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম আল-কায়েদার মতো পশ্চিমা শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। আত্মঘাতী বোমা হামলা তাদের প্রধান যুদ্ধপদ্ধতি। আল কায়েদার মতো নিজস্ব মতবাদ বাস্তবায়নে চরমপন্থী। বোকো হারামের যোদ্ধারা প্রশিক্ষণের জন্য সোমালিয়া এমন কী আফগানিস্তান পর্যন্ত আসে। সংগঠরে মুখপাত্র আবু কাকা জানান, তারা যে কোন মূল্যে ইসলামী শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত করবেন। আল-কায়েদার ইসলামিক সদস্য, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যের কিছু গোষ্ঠী বোকো হারামের তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া আল মুনতাদা ট্রাস্টও তহবিল জুগিয়ে থাকে। দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়েন ওপর একের পর এক হামলার জন্য দায়ী এই উগ্র সংগঠনটি। দেশটিতে ২০১২ সালে ৬২০ জন ও ২০১১ সালে ৪৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য জঙ্গী দলটিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বোকো হারাম ৩ থেকে ১০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে।
       আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা অভিযান এবং মার্কিন আক্রমণ  যাকে বর্তমান  মূল ঘটনার সূত্রপাত বলে অনেকে অবিহিত করতে চান !
     
          ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ছিল বাদশাহ জহির শাহের সামান্ততান্ত্রিক শাসন। সামান্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রটি উৎখাত করেন বাদশাহ জহির শাহের ভগ্নিপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান জেনারেল দাউদ। তিনি আফগানিস্তানকে রিপাবলিক ঘোষণা করেন। বিলুপ্ত হলো রাজতন্ত্র। জেনারেল দাউদ অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার একটিও বাস্তবায়ন করেননি। বদল ঘটল শুধু বাদশাহ জহির শাহের পরিবর্তে শাসনকর্তা হলেন জেনারেল দাউদ। ফলে রিপাবলিকের সমর্থক গণসংগঠন, বুদ্ধিজীবী মহল, এমন কী সেনাবাহিনীর অফিসারদের অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে আকস্মিক এক অভ্যুত্থানে জেনারেল দাউদ হলেন পদচ্যুত এবং নূর মোহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ ক্ষমতা দখল করে। বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সংগঠন ও সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় এই বিপ্লবী পরিষদ। এই ক্ষমতা দখলকে বলা হতো সাউর বিপ্লব। সাউর আফগান ক্যালেন্ডারে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়কে বলা হয়। এই সময়টা আমাদের বৈশাখ মাসের শুরুর সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। বিপ্লবী পরিষদের নেতৃত্বে ছিল পিপলস্      ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।

          এই পার্টি আবার অলিখিতভাবে দুটি অংশে বিভক্ত ছিল- একটি পারচাম (পতাকা) এবং অন্যটি খাল্ক (জনগণ)। নিজেদের মতপার্থক্য ও বিভেদ সাময়িক অবদমিত করে তারা ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু কিছু কালের মধ্যেই তাদের বিরোধী মতপার্থক্য এমন পর্যায়ে যায় যে, দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের মহাসচিব হাফিজুল্লা আমিন (১৯৮০) ক্ষমতা দখল করে বসেন। শুধু তাই নয় প্রেসিডেন্ট তারাকিকেও হত্যা করা হয়। এটা ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। আর হাফিজুল্লা আমিন ডিসেম্বরেই পদচ্যুত হন দলের সশস্ত্র অংশের হাতে। ক্ষমতাসীন হলেন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত বারবাক কারমাল। ক্ষমতা গ্রহণের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই (১৯৮০ সালের ২৮ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জরুরী সামরিক সহায়তা চান। সোভিয়েত ইউনিয়নও দ্রুতবেগে এই আহ্বানে সাড়া দেয়। 

          এই প্রেক্ষাপটে পরাক্রমশালী পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তথা আফগানিস্তানের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আধুনিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা আর উপজাতীয় সরদারদের ছোট ছোট আফগান বিদ্রোহী গ্রুপ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে। পরবর্তীতে এদেরকে নিয়ে মুজাহিদীন বাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সৌদি আরব, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলো মুজাহিদিনদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছিল।
 
ওই সময় সুযোগটি গ্রহণ করে আমেরিকা। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করতে আফগান মুজাহিদিনদের সঙ্গে যুদ্ধ যেন দীর্ঘ হতে পারে সেজন্য মুজাহিদিনদের অস্ত্র সহায়তা দিতে শুরু করে আমেরিকা। চরম প্রতিক্রিয়াশীল মুজাহিদদের একমাত্র পুঁজি ছিল ইসলাম। ইসলাম রক্ষার নামে তারা জিহাদ চালু করে। তাদের উস্কে দিতে থাকে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহায়তার কারণে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অনেক সৈন্য মৃত্যুসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক ক্ষতি হজম করতে হয়েছিল আমেরিকাকে। ফলে মুজাহিদিনদের সাহায্য করার মাধ্যমে আমেরিকা প্রতিশোধ নিতে চাইছিল। ধর্মের বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়ায় এই যুদ্ধকে জিহাদনাম দিয়ে আফগানদের অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমরা এ যুদ্ধে অংশ নিতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আফগানিস্তানে আবির্ভাব ঘটে সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে থাকায় ওসামা বিন লাদেনকে প্রচ-ভাবে সমর্থন দিতে শুরু করে আমেরিকা।

          আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে মাদ্রাসা চালু করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্রদের বলা হয় তালেব বা তালেবান। সেই মাদ্রাসার এক শিক্ষক মোহাম্মদ ওমর পরবর্তীতে তালেবান নেতা হন। এই ছাত্রদের পাহাড়ে ও সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ মদদে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। আমেরিকা ওই সময় সবচেয়ে আধুনিক স্টিংগারনামক এ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল তুলে দেয় আফগান মুজাহিদদের হাতে। পতন হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের। দশ বছরের যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে বিশ্বজুড়ে। উত্থান ঘটতে থাকে মোল্লা ওমরের তালেবান রাষ্ট্রের। সঙ্গে আল কায়েদার। আফগান মুজাহিদদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রদেশ শাসন শুরু করল। এই দুরাচার শাসনে অতিষ্ঠ বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। পাকিস্তান ও আমেরিকার সহায়তায় ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া মোল্লা ওমরের তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় ওসামা বিন লাদেনের। তালেবানরা কাবুল দখল করে শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করে। আর লাদেন আল কায়েদা নামে নিজের একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। ওই সময় নারী অধিকার সম্পূর্ণভাবে শেষ করে ফেলা হয়। নারী হয়ে পড়ে গৃহবন্দী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটায় আমেরিকা সরে আসতে শুরু করে তালেবানদের সহায়তা করা থেকে। শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। লাদেন আমেরিকাকে মুসলমানদের শত্রু উল্লেখ করে কয়েকটি দেশে আমেরিকান দূতাবাসে হামলা শুরু করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়েদা নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালিয়ে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে চাপ দেন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু ওমর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ওই হামলা আল কায়েদার নয় বলে দাবি করেন। বিন লাদেনকে কেন্দ্র করে তালেবানদের সঙ্গে ২০০১ সালে ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকা। পতন হয় তালেবান শাসনের। আমেরিকার সমর্থন দিয়ে আফগানিস্তানে শুরু হয় হামিদ কারজাইয়ের শাসন। ওই সময় মোল্লা ওমর ও বিন লাদেন পালিয়ে যান। তবে পাহাড়ে ও পাকিস্তানে ছোট ছোট গ্রুপে তারা সংগঠিত হতে শুরু করে। ২০০৬ সাল থেকে ছোট ছোট হামলা চালানো শুরু করল আমেরিকার সামরিক বাহিনীর ওপর। পাঁচ বছর পর ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানে এ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হত্যা করে আমেরিকা। মোল্লা ওমরের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য। দুই বছর আগে তার মৃত্যুর ঘোষণা আসে। 

          ইরাকে মার্কিন হামলা পরবর্তী সময়ে এই মহাদানবের জন্ম হয়। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগে ইরাকে সামরিক অভিযান চালায়। ৯ এপ্রিল মার্কিন বাহিনী বাগদাদ দখল করে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করে। একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তাকে তার জন্মস্থান তিকরিত থেকে মার্কিন বাহিনী আটক করে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তার বিচার করে আমেরিকা তার ফাঁসি কার্যকর করে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সাদ্দাম হোসেনের পতন ও হত্যার পর গড়ে ওঠে আইএস। সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য আইএসে যোগদান করে
-   
   




    

      আইএস  এর  কার্যক্রম প্রসঙ্গে  কিছু তথ্যাদি -

     
          আইএস বিষয়ে সিএনএন একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছে। তাতে উগ্র জঙ্গী সংগঠনটির কর্মকা- ও ভয়াবহতা এক নজরে তুলে আনা হয়েছে। দীর্ঘ ওই টাইমলাইনে বলা হয়েছে, আল কায়েদার খ-াংশের একটি রূপ হিসাবে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আইএসের আবির্ভাব ঘটে। ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন বা খেলাফত প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য। অষ্টাদশ শতকের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ডজনের বেশি লোককে একই সঙ্গে হত্যার দৃশ্য ভিডিও করে তারা প্রচার শুরু করে। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও ধর্মীয় মৌলবাদীতাকে উস্কে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো আধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে আইএস। ২০১৪ সালে আইএস ভূমধ্যসাগর থেকে দক্ষিণ বাগদাদ পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকের ৩৪ হাজার বর্গমাইলেরও বেশি এলাকা দখল করে নেয়। তবে ২০১৫ সালের এপ্রিলে পেন্টাগন ঘোষণা দেয় যে, আইএস দখলকৃত স্থানের এক- চতুর্থাংশ উদ্ধার করা গেছে। তেল উত্তোলন, চোরাচালান, অপহরণের পর ক্ষতিপূরণ আদায়, চুরি করা হস্তশিল্প ও নৃতাত্ত্বিক সামগ্রী বিক্রি, চাঁদাবাজি এবং ফসল দখল করে আয় করে আইএস। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ও হত্যার পর তার সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য আইএসে যোগদান করে। 

          বর্তমানে আইএসের নেতা হচ্ছেন আবু বকর আল-বাগদাদী। যাকে আবু দুয়াও নামেও ডাকা হয়। বর্তমানে তিনি সিরিয়ায় তাদের দখলকৃত এলাকায় অবস্থান করছেন। ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী ২০০৪ সালে বাগদাদীকে আটক করে এবং ক্যাম্প বাক্কায় কয়েক মাস আটকে রাখে। ওই সময় তাকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবেনি যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৪ সালেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আইএসআইএস ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দেয়ার পর তিনি আল-খলিফা ইব্রাহিম নামে আত্মপ্রকাশ করেন এবং এ নামেই তাকেই অনুসরণ করেন তার অনুগতরা।
 

           এক নজরে এই এস এর বর্তমান কার্যক্রম-

           ২০০৪ : আবু মুসাব আল-জারকাওয়ি আল কায়েদা ইন ইরাক (আকি) প্রতিষ্ঠা করেন।

         ২০০৬ : জারকাওয়ির অধীনে আল কায়েদা ইরাকে শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করে।

       ২০০৬ সালের ৭ জুন : যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে জারকাওয়ি নিহত হন। তার জায়গায় আকির নতুন নেতৃত্ব নেন আবু আইয়ুব আল-মাসরি, যিনি আবু হামজা আল-মুহাজের নামেও পরিচিত।
 


        ২০০৬ সালের অক্টোবর : আকি নেতা মাসরি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) সৃষ্টি করেন এবং এর নেতা হিসাবে আবু ওমর আল-বাগদাদীর নাম ঘোষণা করেন।
 

        ২০১০ সালের এপ্রিল : যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের যৌথ অপারেশনে আবু ওমর ও মাসরি নিহত হওয়ার পর আইএসআইয়ের নতুন নেতা হন আবু বকর আল-বাগদাদী।
 

         ২০১৩ সালের এপ্রিল : আইএসআই ঘোষণা দেয় তারা সিরিয়ায় আল কায়েদা সমর্থিত জাবহাত আল-নুসরা বা আল নুসরা ফ্রন্টকে একত্রিত করে নিয়েছে। আল বাগদাদী বলে এই গ্রুপটি এখন থেকে ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এ্যান্ড দি লেভেন্ট (আইএসআইএস) নামে চলবে। তবে আল-নুসরা ফ্রন্ট নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জাওলানি তাদেরকে আইএসআইএসের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন।
 

         ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি : নুসরা ফ্রন্ট ও আইএসআইএসের মধ্যে অন্তর্যুদ্ধের পর আল কায়েদা আইএসআইএসের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।
 
        ২০১৪ সালের মে : সিরিয়া থেকে আইএসআইএস ১৪০ জন কুর্দি শিশুকে অপহরণ করে। তাদের উগ্রপন্থী ধর্মীয় মতবাদে দীক্ষা নিতে বাধ্য করে।

        ২০১৪ সালের জুন : ৯ থেকে ১০ জুন আইএসআইএস মসুল বিমানবন্দর, টিভি স্টেশন ও সরকারী অফিস দখলে নেয় এবং এক হাজার বন্দীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়।
         ১০ থেকে ১১ জনু মসুল ও তিরকিত পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেয়।
        ২০ জুন জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় যে, ১০ লাখেরও বেশি ইরাকীকে বাস্তুচ্যুত করেছে আইএসআইএস।

         ২১ জুন সিরিয়ার সীমান্ত শহর আল-কায়িমসহ তিনটি ইরাকী শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এই জঙ্গী সংগঠনটি।
        ২৮ জুন ইরাকের কুর্দিস্তান শরণার্থীদের সীমান্ত অতিক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
        ২৯ জুন আইএসআইএস সব রাষ্ট্রে ইসলামী শাসন বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ওইদিন আল-বাগদাদী নিজেকে বিশ্বের আনুমানিক ১৫০ কোটি মুসলিমদের শাসক বা কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা দেন। আইএসআইএসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইসলামিক স্টেট বা আইএস।
        ৩০ জুন জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় ১২ লাখ ইরাকী জোরপূর্বক তাদের ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পেন্টাগন ঘোষণা দেয়, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, বিমানবন্দর ও ইরাকী জনগণকে রক্ষায় আরও ৩শট্রুপ পাঠাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের মোট ট্রুপের সংখ্যা দাঁড়াল ৮শতে। 

           ২০১৪ সালের জুলাই : আইএসআইএস সিরিয়ার সবচেয়ে বড় তেলখনি দখলে নেয়। একটি হোম প্রদেশের একটি গ্যাসক্ষেত্রে ১২ জন কর্মীকে হত্যা করে তা দখলে নেয়। জঙ্গীরা সিরিয়াদের ইজর শহর থেকে ইরাকের সীমান্ত পর্যন্ত ৯০ মাইল এলাকা দখল করে নেয়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে মসুলে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় স্থাপনা জোনাহ টম্বকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
 


            ২০১৪ সালের আগস্ট : ৬ আগস্ট আইএসআইএস ইরাকে ক্ষুদ্র সম্প্রদায় ইয়াজিদি গোষ্ঠী অধ্যুষিত শহর সিনজার দখলে নেয়। তারা ওই সময় ৫শইয়াজিদি পুরুষকে হত্যা করে, ৭০ জন শিশু পিপাসায় মৃত্যুবরণ করে। আর নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয়। ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আইএসআইএসের ওপর বিমান হামলা করে। পাল্টা হামলা করে আইএসআইএসও।

           ১৯ আগস্ট আইএস ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করে। সেখানে দেখানো হয় মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলেকে কিভাবে শিরñেদ করা হচ্ছে। এই সাংবাদিক ২০১২ সালে সিরিয়া থেকে নিখোঁজ হন। তারা আরেক মার্কিন সাংবাদিককেও শিরñেদ করবে বলে হুমকি দেয়। অনুমান করা হয়েছিল তাদের হাতে হয়ত সাংবাদিক স্টিভেন সটলোফ বন্দী আছে। 


          ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর : ২ সেপ্টেম্বর আইএস আরেক ভিডিও প্রচার করে তাতে মাকিন সাংবাদিক স্টিভেন সটলোফের শির
ñেদ দেখানো হয়। যেই ব্যক্তি শিরñেদ করেছিল সে ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজী বলছিল।

         ১১ সেপ্টেম্বর সিআইএ ঘোষণা দেয়, আইএসের জন্য আগের তুলনায় তিনগুণ যোদ্ধা যুক্ত হয়েছে।

         ১৩ সেপ্টেম্বর আইএস নিজস্ব ওয়েবসাইটে ব্রিটিশ ত্রাণকর্মী ডেভিড হেইনেসের শিরোñেদের ভিডিও প্রদর্শন করে। এটা ছিল এক মাসে তিনজন পশ্চিমা ব্যক্তিকে হত্যা। ওই সময় ভিডিওতে অপর ব্রিটিশ নাগরিক অ্যালান হেনিংকে দেখানো হয় এবং হুমকি দেয়া হয় যে শীঘ্রই তাকেও হত্যা করা হবে।

      ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আইএসের ওপর আবারও বিমান হামলা চালায়। 
২০১৪ সালের ৩ অক্টোবর : আইএস এ্যালান হেনিংয়ের শিরোচ্ছেদের ভিডিও প্রচার করে এবং পরবর্তী হত্যার জন্য মার্কিন ত্রানকর্মী পিটার কাসিগ ডিন আবদুল-রহমান কাসিগ নামে পরিচিত তাকে ভিডিওতে দেখায়।
 


২০১৪ সালের নবেম্বর: ৩ নবেম্বর ইরাকী সরকার জানায়, ক্ষুদ্র সম্প্রদায় আলবু মিনরের ৩২২ জনকে হত্যা করেছে। ১৪ নবেম্বর জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন জানায় আইএস যুদ্ধাপরাধ করছে এবং তারা মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ১৬ নবেম্বর মার্কিন ত্রাণকর্মী পিটার কাসিগের শিরো
ñেদের ভিডিও প্রকাশ করে আইএস। 


২০১৫ সালের জানুয়ারি : ১৭ জানুয়ারি ইরাকের কুর্দিস্তানের এক কর্মকর্তা জানান, আইএস ২৫০ জন ইয়াজিদিকে ছেড়ে দিয়েছে যাদের বেশিরভাগই শিশু এবং বয়স্ক।
          ২০ জানুয়ারি আইএস অপহৃত দুই জাপানি নাগরিক কেনিজ গতো এবং হারুনা ইয়াকুয়ার মুক্তির বিনিময়ে জাপান সরকারের কাছে ২শমিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে।

        ২২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, এ পর্যন্ত তাদের বিমান হামলায় ৬ হাজার আইএস যোদ্ধা নিহত হয়েছে। এখনও আইএসের ৯ থেকে ১৮ হাজার যোদ্ধা রয়েছে এবং হাজার হাজার অনুসারী রয়েছে।

       ২৪ জানুয়ারি আইএস একটি অনলাইন ভিডিও প্রচার করে যাতে দেখানো হয়, দুই জাপানী নাগরিকের একজন কেনিজ গতো অপর নাগরিক হারুনা ইয়াকুয়ার শিরোñেদের ছবি ধরে আছে। ভিডিওতে বলা হয়, জর্দানে বন্দী শীর্ষ জঙ্গী সাজিদা আল-রিশায়িকে মুক্তি দিলে তারা কেনিজ গতোকে ছেড়ে দেবে।

      ৩১ জানুয়ারি কেনিজ গতোর শিরোñেদের ভিডিও প্রচার করা হয়। 
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি : ৩ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে আইএস ভিডিও ও স্থিরচিত্র প্রকাশ করে যাতে দেখানো হয়, জর্দানের সামরিক পাইলট মোয়াথ আল-কাসাবেহকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে।

       ৫ ফেব্রুয়ারি জর্দান সিরিয়ার ওপর বিমান হামলা চালায়। আইএসের রাজধানী রাক্কা, তাদের প্রশিক্ষণ স্থান ও অস্ত্র মজুদের জায়গার ওপর হামলা চালানো হয়।

       ৬ ফেব্রুয়ারি আইএস এক অনলাইন পোস্টে দাবি করে, জর্দানের বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবনে মার্কিন নাগরিক কায়লা জিন মুলার মারা গেছেন।
       ১০ ফেব্রুয়ারি কায়লার পরিবার আইএস থেকে পাওয়া মরদেহের ছবি দেখে নিশ্চিত করে যে তিনি নিহত হয়েছেন।
      ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আইএসআইএসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনী ব্যবহারের বিষয়টি কংগ্রেসে উত্থাপন করেন।
      ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার একটি সৈকতে ২১ জন মিসরীয় খ্রিস্টানকে শিরñেদের ভিডিও প্রচার করে আইএস।
       ১৬ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ায় আইএসের অবস্থানগুলোতে যুদ্ধ বিমান হামলা চালায় মিসর। ২০ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার গোব্বায় আত্মঘাতী গাড়ি বোমায় ৩০ জন নিহত ও ৪০ জনেরও বেশি আহত হয়। আইএসের লিবিয়া শাখা উইলায়াত আল-বারকা ওই হামলার দায় স্বীকার করে।

        ২২ ফেব্রুয়ারি ২১ জন কুর্দি যোদ্ধাকে খাঁচায় বন্দী অবস্থায় ইরাকের রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও প্রচার করে আইএস। ভিডিওর শেষ দৃশ্য পর্যন্ত কুর্দি যোদ্ধাদের জীবিত দেখা গেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমা অপহৃতদের শিরñেদকারী ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজী বলা ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ওই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ ইমওয়াজি। কুয়েতি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। ওইদিন আইএস মসুলের জাদুঘরে প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশনগুলো ধ্বংসের ভিডিও প্রচার করে। 

    
            ২০১৫ সালের মার্চ : ১ মার্চ আইএস উত্তর সিরিয়া থেকে অপহৃত ২২০ জনের মধ্যে ১৯ জন খ্রিস্টানকে মুক্তি দেয়। ৪ মার্চ আইএসআইএস একটি ছবি প্রকাশ করে যাতে দেখা যায় একজনকে উঁচু ভবন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। হোমোসেক্সের অভিযোগে নিজেদের ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে আইএস।

         ৭ মার্চ নাইজেরিয়াভিত্তিক উগ্র জঙ্গী সংগঠন বোকো হারামের নেতা আবু বকর শেকু এক অডিও বার্তায় আইএসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে একতা প্রকাশ করে।

           ১২ মার্চ আইএসের এক মুখপাত্র অডিও বার্তায় জানায়, খেলাফত পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। আইএসআইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদী বোকো হারামকে জোটে নিতে রাজি হয়েছেন। একই দিনে ইরাকী সেনারা তিরকিতের বেশিরভাগ আইএসের দখল থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আইএস রামাদির উত্তরে ইরাকের সেনাসদর বোমায় গুঁড়িয়ে দেয়। এতে কমপক্ষে ৪০ জন ইরাকী সেনা নিহত হয়। 
   
       ২০১৫ সালের এপ্রিল : ৮ এপ্রিল আইএসআইএস ২শইয়াজিদি নারী ও শিশুদের মুক্তি দেয় যাদের বেশিরভাগই অসুস্থ ও বয়স্ক। ১৯ এপ্রিল লিবিয়ার বিভিন্ন স্থানে ৩০ ইথিওপিয় নাগরিকের শির
ñেদের ভিডিও প্রকাশ করা হয়।
 
         ২০১৫ সালে মে : ১৬ মে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে আইএসের এক নেতা ও তার স্ত্রী নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ওই অভিযানে আইএসের অবকাঠামো ও যোগাযোগ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ১৭ মে আইএস ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর রামাদিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ আবার প্রতিষ্ঠা করে। ২১ মে সিরিয়ার মরুভূমিতে দুই হাজার বছরের পুরনো শহর পালমায়রাতে আইএস নিয়ন্ত্রণ নেয়।
 

           ২০১৫ সালের জুন : ১ জুন মার্কিন জেনারেল হক কারলিসলে জানান, মার্কিন সেনাবাহিনী জঙ্গীদের ধরতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। অনেক আইএস সদস্য সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছে। সেখান থেকে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে হামলা চালানো হয়েছে এবং বেশকিছু স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ১৪ জুন ইরাকে শিয়া সম্প্রদায়ের মিলিশিয়া গ্রুপের সদর দফতরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো কিশোর তালহা আসমলের পরিচয় বের করা হয়।

        ১৭ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক তালহা মার্চে ইংল্যান্ড থেকে আইএসে যোগ দেয়। ওই হামলায় ১১ জন নিহত হয়। হামলার আগে তালহার ছবি পোস্ট করে আইএস।

         ১৯ জুন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সন্ত্রাসবাদের ওপর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে আইএসকে আল কায়েদার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ, নৃশংস ও মানবতার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

       ২৬ জুন তিউনিশিয়ায় সমুদ্র উপকূলবর্তী এক হোটেলে একজন বন্দুকধারী ৩৮ জনকে হত্যা করে এবং একই দিনে কুয়েতের একটি মসজিদে বোমা হামলায় ২৭ জন নিহত হয়। দুটি হামলারই দায় স্বীকার করে আইএস। 

       ২০১৫ সালের জুলাই : ১ জুলাই আইএস মিসরের ৫টি সামরিক চেকপয়েন্টে একই সময়ে হামলা চালিয়ে ১৭ সেনাকে হত্যা করে। আহত হয় ৩০ জন। ওই হামলায় মিসরীয় সেনাদের হাতে আইএসের একশযোদ্ধা নিহত হয়। ইরাকী নাগরিকরা ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনের জন্য কেনাকাটা করছিলেন। সে সময় আইএস মার্কেটে বরফের ট্রাক তুলে দিয়ে ১২০ জনকে হত্যা করে। আহত হন ১৬০ জনেরও বেশি। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, বছরের প্রথম ছয়মাসে আইএস ৯ দশমিক ৪ শতাংশ স্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে প্রায় ৩২ হাজার বর্গমাইলের ওপর।
 
           ২০১৫ সালের আগস্ট : সিরিয়ার পালমায়ারায় দুই হাজার বছরের পুরনো মন্দির বালস্বামী পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে আইএস। ইউনেস্কো এটাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে।
 
২০১৫ সালের নবেম্বর : ১২ নবেম্বর পেন্টাগন ঘোষণা দেয় যে, সেই ব্রিটিশ উচ্চারণের ইংরেজী বলা জঙ্গী মোহাম্মদ ইমওয়াজি ওরফে জিহাদী জন রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে। ইমওয়াজি যে গাড়িতে ছিল সেই গাড়ির ওপর হামলা চালানো হয়। ওইদিন দক্ষিণ বৈরুতের বুর্জ আল-বারাজনেহ জেলাতে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন নিহত এবং শত শত আহত হয়। ওই হামলায় দায় স্বীকার করে আইএস জানায়, হামলার জন্য দুদিন আগে তারা সিরিয়া থেকে লেবাননে অবস্থান করছিল। ১৩ নবেম্বর দুদিন যুদ্ধের পর ইরাকের কুর্দিস সেনাবাহিনী আইএসআইএসের দখল থেকে সিনজার শহর মুক্ত করে বিজয় ঘোষণা করে। ওই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেয়। ওইদিন প্যারিসে ভয়াবহ হামলা চালায় আইএসআইএস। তিনটি সশস্ত্র দল একই সময়ে প্যারিসের ছয়টি স্থানে হামলা চালিয়ে ১২৯ জনকে হত্যা করে। আহত হন শত শত।

     
            মোহাম্মদ আল কিরাফাবি। পেশায় তিনি একজন ফেরিওয়ালা। ৩৮ বছর বয়সী কিরাফাবির প্রতিদিন ব্যবসার জন্য আইএসের চেকপোস্ট পার হতে হয়। আর চেকপোস্ট পার হতে গেলেই অর্থ দিতে হয় আইএসকে। তাদের দাবি অনুযায়ী অর্থ না দিলে তার ট্রাকগুলো আবার উল্টোপথে ফেরত পাঠাবে অথবা তাকে আটক করবে। তিনি ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের প্রতি মাসে গড়ে ৯শডলার দেন। স্বেচ্ছায় নয় বাধ্যতামূলকভাবে তিনি এ অর্থ প্রদান করেন। তিনি জর্দান থেকে আইসক্রিম এনে ইরাকের আইএস নিয়ন্ত্রিত অংশে বিক্রি করেন। ইন্টারন্যাশনাল হেলাল্ড ট্রিবিউন, দ্য হিন্দু, ডেইলি মেইলের বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে আইএস কিভাবে অর্থ উপার্জন করে, কারাই বা দেয় সে অর্থ। 

              সিরিয়ার রাকানগরী, যেটি এখন আইএসের ডি ফ্যাক্টো রাজধানী সেখানে তারা সম্প্রতি মার্কেটগুলোর ওপর পরিচ্ছন্ন কর বসিয়েছে। দোকানের সাইজ অনুযায়ী ৭ থেকে ১৪ ডলার করে দিতে হবে। এছাড়া কর বসানো হয়েছে পানি ও বিদ্যুতের ওপরও। এভাবে বার্ষিক প্রায় ৩০ হাজার ডলার আয় হবে। এছাড়া আইএসের ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর কর বসিয়েছে। গাড়ি নিবন্ধন এমনকি ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের ওপরও তারা শুল্ক বসিয়েছে। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে জরিমানা আদায় করতেই আইএস বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
 

           জর্দান থেকে ইরাকে ঢুকলে আমদানি শুল্ক বাবদ আইএসকে নগদ অর্থ প্রদান করতে হয়। অবশ্য আইএসের জঙ্গীরা মনে করে না যে, তারা ঘুষ বা দক্ষিণা হিসেবে কারও কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে। প্রাপ্ত অর্থের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা নিজেদের সরকারী সিলযুক্ত রসিদও দিয়ে থাকে। ইরাক ও সিরিয়ার বড় একটি অংশজুড়ে আইএস নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বা এখান দিয়ে অতিক্রমকারী সবাইকে অর্থের যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহার করছে আইএস। নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আমেরিকান ডলার, ইরাকী দিনার বা সিরিয়ান পাউন্ড যার কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই আদায় করে নিচ্ছে। আইএস সড়ক পথে যাতায়াতকারীদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করছে, সরকারী ভবনগুলো থেকে ভাড়া আদায় করছে, পানি ও বিদ্যুতের মতো পরিষেবা খাতে অর্থ আদায় করছে। ধূমপান বা তাদের বেঁধে দেয়া পোশাক বিধির বাইরে কাপড় পরিধান করলে জরিমানা আদায় করে ছাড়ছে। ধারণা হচ্ছে, আইএসের বার্ষিক আদায় প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন ইউনিভর্সিটির সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক অপরাধ ও দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক লুইস শেলি বলেন, ‘তারা (আইএস) সকালে যুদ্ধ করে আর বিকেলে কর আদায় করে

          আইএসের রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎসগুলো হলো- তেল পাচার, ব্যাংকের ভল্ট লুট করা, পুরাকীর্তি লুণ্ঠন ও বিদেশীদের পণবন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করা। এছাড়া তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর অঞ্চলের ধনীদের দান-দক্ষিণা আইএসের আয়ের আরেকটি বড় উৎস। নবেম্বরের শেষের দিকে সিরিয়ায় মার্কিন বিমানবাহিনী তেল বহনকারী আইএসের ১১৬টি যান ধ্বংস করেছে। এসব সত্ত্বেও আইএসের আর্থিক অবস্থা যে ভেঙ্গে পড়েছে তা মনে করার কোন উপায় নেই। র‌্যান্ড কর্পোরেশনের সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ সেথ জোন্সের মতে, আর্থিকভাবে তাদের চেপে ধরতে হলে রাজস্ব আদায়ের উৎস বন্ধ করে দিতে হবে। তারা সেসব জায়গা নিজেদের দখলে রেখেছে সেই ভূখ-গুলোই তাদের রাজস্ব আয়ের উৎস।
 

            ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় মসুলের পূর্বদিকে দজলা নদীর ওপারে বাব আল তুব এলাকায় অটোমান আমলে নির্মিত একটি পুলিশ চৌকিকে এখন মার্কেট বানিয়েছে আইএস। চৌকিটি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত। ৬০টি স্টল করে সেখানে এখন ফল ও শাক-সবজির বাজার বসানো হয়েছে। দোকানগুলো বার্ষিক ভাড়া প্রায় আড়াই হাজার ডলারের মতো। এসব তথ্য পাওয়া গেছে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আড়িপেতে এবং দলছুট আইএস সদস্যদের কাছ থেকে। আইএস নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার জটিল অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের পুরো চিত্রটি পাওয়া বেশ কঠিন।

আইএসের যত অর্থ

          এক সময় আইএসের অর্থের মূল যোগানদাতা ছিলেন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর ধনীদাতারা। তবে সংগঠনটির জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হলে তাঁদের অনেকেই সহায়তা বন্ধ করে দেন। তখন সংগঠনটি তেলভিত্তিক আয়ের উৎস গড়ে তোলে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ
øাদিমির পুতিনের মতে, সারাবিশ্বের ৪০টি দেশ থেকে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) অর্থ পাচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে জি-২০ভুক্ত দেশও রয়েছে।
অস্ত্র ও যানবাহন কেনা, দলের সদস্যদের খরচাপাতি, প্রচারণামূলক ভিডিও এবং কর্মীদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠাতে আইএসের অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে যত জঙ্গীগোষ্ঠী আছে, এর মধ্যে আইএস সবচেয়ে ধনী।


            ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৮ সালের শেষের দিকে আইএস প্রতি মাসে ১০ লাখ ডলার আয় করত। ২০০৯ সালে প্রথম দিক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আয় দৈনিক ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছায়। পত্রিকাটি আইএসের অর্থ উপার্জনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হচ্ছে
Ñ

       কর ও চাঁদাবাজি


          দিন দিন আইএস নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলের আয়তন বাড়ছে। এসব অঞ্চলে যারা বাস করে, তাদের ওপর করারোপ করে আইএস। আয়ের আরেকটি উপায় ছিল চাঁদাবাজি। পণ্য বিক্রি, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, ব্যাংকের হিসাব থেকে নগদ টাকা তোলা, বিভিন্ন কর্মচারীর বেতন, নিয়ন্ত্রিত এলাকার তল্লাশি চৌকি দিয়ে ট্রাক ঢুকলে, বিদ্যুত ও পানি ব্যবহারের জন্য আইএসকে কর দিতে হয়। ব্যবহারকারীরা অবশ্য দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত পান। সিরিয়ার বিখ্যাত প্রত
œতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি করে বিক্রি করা এবং অমুসলিমদের কাছ থেকে চাঁদা ও লুটপাট করে বেশ ভালই আয় করে এই জঙ্গী সংগঠনটি। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, এভাবে আইএস বছরে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজেদের পকেটে পুরেছে। যারা আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে, সেখানে ব্যবসা করে এবং বসবাস করে তাদের নিরাপত্তাদেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাঁদা আদায় করে আইএস। আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দুই ধরনের নিয়ম চালু আছে। যারা আইএস যোদ্ধা, তাদের পরিবার চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে বিনামূল্যে সেবা পায়। এর বাইরের যারা থাকে, তাদের কর দিয়েই থাকতে হয়।


ইরাকে ব্যাংক লুট

মার্কিন অর্থ বিভাগের হিসাবে, ২০১৪ সালে ইরাকের উত্তর ও পশ্চিম দিকে কয়েকটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে আইএস পাঁচ লাখ ডলার অর্থ নিজের তহবিলের জমা করে।

লুটের পণ্য বিক্রি

মার্কিন অর্থ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, আইএস ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মার্কিন যানবাহন ও অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ আয় করে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী, বৈদ্যুতিক তার, আসবাবপত্র বিক্রি, আবাসন খাত, কৃষি খাত, মানবপাচার ও বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পণ্য বিক্রি করে অর্থ আয় করে আইএস।

অপহরণ ও মুক্তিপণ

বিভিন্ন বিদেশী নাগরিকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এই জঙ্গীগোষ্ঠীটির আয়ের অন্যতম একটি বড় উৎস। জাতিসংঘের ২০১৪ সালের অক্টোবরে এক হিসাবে বলেছে, আইএস ২০১৪ সালে অপহরণের পর মুক্তিপণের মাধ্যমে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলার থেকে চার কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করে।

বিত্তশালী দাতা

আইএসের আয়ের অন্যতম উৎস ধনীদাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থ। আইএস প্রাথমিকভাবে ধনীদাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ পেয়ে থাকে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও সংযুক্ত আবর আমিরাতের বড়লোক ব্যবসায়ীরা এই জঙ্গী সংগঠনে অর্থ দান করে। কোন কোন হিসাবে বলা হয়ে, এসব দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা ২০১৩-১৪ সালে প্রায় চার কোটি ডলার আইএসকে দান করেন। খবরে বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ সরকার এবং ইরানের ভয় থেকে মুক্তি পেতে ধনী ও বিত্তশালীরা আইএসের তহবিলে অর্থ দান করেন।

প্রত
œতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি

বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে সিরিয়াও প্রত
œতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। এগুলো চুরি করে বিক্রি করে বহু অর্থ নিজেদের তহবিলে জমা করে। সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর পালমিরার মতো অন্য শহরের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বিক্রি করাও আইএসের অর্থের একটি উৎস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি করে আইএস বছরে ১০ কোটি ডলার আয় করে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ম্যাথু লেভিড ২০১৪ সালের নবেম্বর বলেছিলেন, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রির মাধ্যমে আইএস প্রচুর অর্থ আয় করে। এটা তাদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস।

        তেল

ইরাক ও সিরিয়ায় দখল করা তেলকূপগুলো এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম উৎস। এসব কূপ থেকে তেল তুলে তারা কালোবাজারে বিক্রি করে। এই বিকিকিনি চলে তুরস্ক সীমান্তে। তেল কিনতে সেখানে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকে কিছু ব্যবসায়ী। যেহেতু এগুলো চুরি বা অবৈধভাবে তোলা হয়, তাই দামেও বেশ কম। এসব তেল পরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বা বিক্রি হয়। যোগাযোগের জন্য হোয়াটসএ্যাপ ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। এভাবে তেল বিক্রি করে বেশ ভালই অর্থ পায় আইএস।
     
              পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও অস্থির রাজনৈতিক মেরুকরণে আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে অধিক হারে জঙ্গীবাদ জন্ম নিচ্ছে। তবে ধারণা করা হয়, যেসব দেশের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এশিয়া ও আফ্রিকায় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। জঙ্গীবাদের থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মূলত উগ্রবাদ থেকেই বীজ অঙ্কুরিত হয় জটিঙ্গবাদের। আইএস, আল কায়েদাসহ জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম এখন বহুধা ধারায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়।

  m          আইএস তাদের মতাদর্শ ও কার্যক্রম এদেশেও কার্যকর করতে চায়। জঙ্গীবাদের সদস্য নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ জেহাদি কর্মকা- সম্প্রসারিত হচ্ছে মানুষকে অসহিষ্ণু করে ফেলে
Ñ এ অজুহাতে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ এদের প্রবল বিরোধী।
দেশে জঙ্গীবাদের রাজনীতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ১৯৮০ সাল থেকে তাদের কর্মকা- প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রবিশ্যে চালিয়ে যেতে শুরু করে। ২০১১ সালে মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এবং মোহাম্মদ বিন কাসেম একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা ঢাকাবাসীখতমে নবুয়ত আন্দোলন’ (এই সংগঠন পাকিস্তানের অংশ ১৯৮০ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।


             সুইডেনের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বারটিন লিন্টনার ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা তাদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন রোহিঙ্গা প্যাট্রয়োকি ফ্রন্ট ভেঙ্গে মোহাম্মদ ইউসুফের (আরকান) নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামে একটি জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াত ইসলাম, আপগানিস্তানের গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজবি-ই-ইসলাম, কাশ্মীরের হিজবুল-মুজাহিদিনসহ বহু জঙ্গী সংগঠন থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা পেয়ে আসছে।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা যুদ্ধে অংশ নিতে দেশ থেকে অনেক বাংলাদেশী মুজাহিদিন আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে এরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণে পারদর্শী হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ সমাপ্তি হলে এসব মুজাহিদিন দেশে ফিরে আসে এবং বাংলাদেশে একটি শরিয়াভত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে। সুইডিশ সাংবাদিক লিন্টনার তার প্রতিবেদনে সরাসরি উল্লেখ করেছেন, তখনকার ডানপন্থী রাজনীতির আদর্শিক বন্ধু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আফগানিস্তান ফেরত এসব বাংলাদেশী মুজাহিদিনদের প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের এই মদদ দেয়ার নেপথ্যে কাজ করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত বলয়ের বিরোধী শক্তি আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করা।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এ দেশে মুজাহিদিনদের জঙ্গীবাদ কার্যক্রম শুরু হলেও এরশাদ শাসনামলে তারা স্তিমিত হয়ে যায়। এ সময় এরশাদবিরোধী কার্যক্রমে দেশের প্রধান দুই দল সোচ্চার ছিল। দুই দলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোও সমন্বয় সাধন করেছিল যার ফলে জঙ্গীবাদ কার্যক্রম তেমন একটা দানা বেধে উঠতে দেখা যায়নি।


           নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সময়কালকে দেশে জঙ্গীবাদের ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে উল্লেখ করছেন। তবে এসব হিসাব-নিকাশকে পেছনে ফেলে দিয়ে ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেশব্যাপী ৩৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আলোচনায় চলে আসে। বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে সরকার গঠন করলে ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ব্যাপকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তার শেকড় ছড়িয়ে দেয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সময় সরকারী তরফ থেকে জঙ্গীবাদকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে সে সময় জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো দেশব্যাপী অবাধে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় যে চারটি জঙ্গী সংগঠন নানাভাবে তৎপর ছিল তা হলো জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী ও হিজবুত তওহিদ। সে সময় দেশের জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান ও দেশী বিদেশী গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। মূলত বিএনপি-জামায়াতের কারণে সে সময় জঙ্গীবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছিল। এই সময়ে উত্থান ঘটে কুখ্যাত বাংলা ভাই ও আবদুর রহমানের। পরবর্তীতে যাদের ফাঁসিতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। অব্যাহত জঙ্গী হামলায় দেশের মানুষ এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। অনেকটা দায়ে পড়ে বা নিজেদের গা-বাঁচানোর জন্য ২০০৫ সালের শেষের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলা ভাইসহ কয়েকজন জঙ্গী নেতার ফাঁসি কার্যকর করেছিল। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ ওঠে।
দেশে প্রায় ৭০টি জঙ্গী সংগঠন তৎপর রয়েছে। কৌশলগত কারণে জঙ্গী সংগঠনগুলো কখনও কখনও তাদের চেহারা বদলায়, নাম বদলায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একই অবস্থানে রয়ে যায়। একটি বেসরকারী গবেষণায় জানা যায়, দেশে ১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯ থেকে ৪ নবেম্বর ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বোমা হামলায় ১৩৬ জন নিহত ও ২ হাজার ৪৮৮ জন আহত হয়েছেন।

         জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ওপর জঙ্গীরা বোমা হামলা করে। এই ঘটনায় ১৯ জন মারা যায়। আহত হয়েছেন ১০৬ জন। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়াদের মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন মারা যায় আহত হয় ৪০ জন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও একশরও বেশি আহত হয়েছেন। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরাতে শক্তিশালী দুটি বোমা হামলায় ৩ জন মারা যায় আহত হয় ১২৫ জনেরও বেশি। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর সিরিয়াল বোমা হামলা চালানো হয় ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে এতে ১৮ জন মারা যায়। আহত হয় ৩০০। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের দনিয়ায় এক মেলাতে বোমা হামলা চালিয়ে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগার শরীফে এক বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও আহত হয় ১৩৮ জন। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা করা হয় এতে তিনি রক্ষা পেলেও ২ জন মারা যান। একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত সিরিয়াল গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গী গোষ্ঠীরা এতে ২৩ জন নিহত হয় আহত হয় পাঁচ শতাধিক। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বোমা হামলায় ৩ জন মারা যায়। আহত হয় ৭০। একই মাসে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এসএম কিবরিয়াসহ ৫ জন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গীরা সারাদেশে একযোগে সব জেলায় বোমা হামলা চালায়। একই বছরের ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠিতে দুজন সহকারী জেলা জজকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। ২৯ নবেম্বর চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে এক সঙ্গে বোমা হামলা চালানো হয়। এই হামলায় ৮ জন নিহত হয়। ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হয়। আহত ৪৮। জঙ্গীদের ধারাবাহিক বোমা হামলায় ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বোমা হামলায় এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৭। বিএনপি জামায়াত জোটের সময় অর্থাৎ ২০০৩ সারের সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, সে সময় জেএমবি, হিজবুত তাহরির, হরকত-উল জিহাদ উল ইসলাম (হুজি) ও ইসলামিক বিপ্লবী পরিষদকে নিষিদ্ধ করার জন্য তৎকালীন সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু সে পরামর্শ সরকার আমলে নেননি। অধিকন্তু জঙ্গী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে উদার নীতি গ্রহণ করা হয়। ফলস্বরূপ দেশের মানুষ জঙ্গীবাদের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

             সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জঙ্গীবাদের লাগাম টেনে ধরার কৌশল গ্রহণ করে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে এ সময় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে জঙ্গীরা দেশব্যাপী কায়েম করে পেট্রোল সন্ত্রাসের। এ সময় জঙ্গীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটি বাংলাদেশ থেকে আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের মানুষরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা উগ্রবাদ তথা জঙ্গীবাদের রাজনীতিতে থেকে শত-সহস্র মাইল দূরত্বে অবস্থান করবে
Ñ এরকম বিশ্বাস সকল মহলের। 
দেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো আরও কঠোর রূপ নিয়ে মাঠে নামে। এ বিষয়ে জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, মানসিক আশ্বাস জোগায় বিএনপি জামায়াত। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে তৈরি হয় গণজাগরণ মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সকল পক্ষ একত্রিত হয়ে রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এতে করে জঙ্গীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্তদের ব্যাপারে। এরই ধারাবাহিকতায় জঙ্গীদের হাতে একের পর এক ব্লগার, মুক্তমনারা খুন হতে থাকেন। এসব খুনের ঘটনা সংঘটিত হবার পর জঙ্গী গ্রুপগুলো তার দায়ভার স্বীকার করে গণমাধ্যমে সেই কৃতিত্ব জাহিরও করে। প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিশিষ্ট লেখক, চিন্তাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, অধ্যাপকসহ বিভিন্ন মানুষজনদের তারা চিঠিও টেলিফোনে জীবননামের হুমকি দিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও এর ধারাকে ব্যাহত করতে চায়।
     
              ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা পেতেই সম্প্রতি জেএমবি কয়েকটি নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়েছে। আর বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা রয়েছে বলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রগুলো নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মূলত বাংলাদেশে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপ করার পথ সুগম করে দিতেই এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। জেএমবির চালানো নৃশংস এসব হত্যাকা-ের অর্থের যোগান এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত ইসলামী দল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণে থাকা বাংলাদেশী জেএমবি সদস্য ও দেশ দুইটির বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন এবং বাংলাদেশস্থ পাকিস্তান দূতাবাস ও পাকিস্তানের কিছু রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় বিপথগামী উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। সম্প্রতি আইএসের বেশ কয়েক বাংলাদেশী সমন্বয়ক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কয়েক পাকিস্তানী জেএমবি সদস্য ঢাকা থেকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। 
সম্প্রতি আইএস-যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার সময় গ্রেফতার হয় সিলেটের একটি সরকারী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জেএমবি সদস্য হিফজুর রহমান (২২), নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আসিফ আদনান (২৬) ও ফজলে এলাহী তানজিল (২৪)। আদনানের পিতা সুপ্রীমকোর্টের সাবেক বিচারক। আর তানজিলের মা ওএসডি থাকা যুগ্ম সচিব।
 
এদের দেয়া তথ্যের সূত্রধরে ঢাকা থেকে একে একে গ্রেফতার হয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান (২৪), আইএসের সমন্বয়ক সাখাওয়াতুল কবির (৩৫) ও নজরুল ইসলাম এবং আইএসের অনুসারী জেএমবি সদস্য আনোয়ার হোসেন বাতেন (৩২), রবিউল ইসলাম (৩৫), জেএমবির আঞ্চলিক সমন্বয়ক বহুজাতিক কোম্পানি কোকাকোলার প্রধান প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আইএসের সমন্বয়ক মোঃ আমিনুল ইসলাম বেগ (৪৫) ও ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক সাকিব বিন কামাল (৩৮)। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

            গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, গ্রেফতারকৃত সমন্বয়করা আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিলেন। ২০ তরুণকে সংগঠিত করেছিলেন তারা। যারা আইএসে যোগদানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হিফজুর, আদনান ও তানজিল গ্রেফতার হওয়ায় পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপরই থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে।
 

            গ্রেফতারকৃত ইবনে হামদান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আল কায়েদা ও আইএসের নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ করছিলেন। বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে গোপন তৎপরতার পাশাপাশি আইএসের সদস্য সংগ্রহে জড়িত ছিলেন তিনি। আইএসের সদস্য হিসেবে রিক্রুট করার ক্ষেত্রে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহ্রীরের প্রশিক্ষিত সদস্যদের বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো। কারণ তারা অতিমাত্রায় হিংস্র।
 

            সদস্যদের নতুন করে প্রশিক্ষণ ও সার্বিক তৎপরতা চালাতে ব্যয় হওয়া অর্থের যোগান দিত সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম। গাজীপুরের ছয়দানা নামক এলাকায় বহুতল ভবনের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত এ্যালুমিনিয়ামের মই তৈরির বিশাল কারখানা রয়েছে নজরুল ইসলামের। এছাড়া পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকা জেএমবি সদস্য ছাড়াও দেশ দুইটি বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ নজরুল ইসলামের কারখানার নামে ও সরাসরি তার নামে পাঠানো হতো। এসব অর্থ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় মুজাহিদীনদের হাত ঘুরে সীমান্ত পথে হুন্ডির মাধ্যমে নজরুল ইসলামের হাতে আসত।
 
           দেশ দুইটি থেকে অর্থ পাঠানোর মূল কাজটির তদারকি করতেন গ্রেফতারকৃত সাখাওয়াতুল কবির ও তার ভায়রা ইজাজ ওরফে কারগিল। ইজাজ ও কবির জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য জেএমবির কারাবন্দী আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই। ২০০৬ সালে মহাখালী তিতুমীর কলেজে পড়ার সময় ইজাজের সঙ্গে সাখাওয়াতুল কবিরের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তারা দুজন জেএমবি আমির সাইদুর রহমানের দুই মেয়েকে বিয়ে করেন।
 

       ২০০৯ সালে দুই ভায়রা জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানে যান। যোগদান করেন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদায়। মতবিরোধের কারণে সাখাওয়াতুল কবির আল কায়েদা ছেড়ে আইএসে যোগ দেন। আইএসের মতাদর্শ বিধর্মীদের দাওয়াত দেয়া। ইসলামের ছায়াতলে না এলে তাদের হত্যা করা।
 
         জঙ্গী প্রশিক্ষণকালে তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত ইসলামী দলটির সরাসরি ছত্রছায়ায় জেএমবির নেতৃত্বে কাজ চলছে। এর সঙ্গে অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলো কাজ করছে। তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপৎ বোমা হামলা চালিয়েছিল। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংস্থা তাদের কথায় এবং এ সংক্রান্ত তথ্যে সন্তুষ্ট হয়ে বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেয়া শুরু করে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অধিকাংশ জঙ্গী সংগঠন এবং বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে প্রচুর অর্থ দেয়। অর্থ পাওয়ার পথ সুগম করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত বাংলাদেশের ইসলাম দলটি এবং বাংলাদেশস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের কতিপয় বিপথগামী উর্ধতন কর্মকর্তা। ইজাজ ও সাখাতওয়াতুল কবির জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য এবং জেএমবির আমিরের মেয়ের জামাতার হওয়ার সুবাদে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। ইজাজ ও সাখাওয়াতুল কবির পাকিস্তানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং বাংলাদেশের জেএমবির কাছে নিয়মিত অর্থ পাঠানোর কাজটি করছিলেন।
 

             কিন্তু ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পাকিস্তানের পাখতুনখাওয়াব প্রদেশের পেশোয়ারের সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে ৬ জঙ্গী সশস্ত্র বোমা হামলা ও গুলি চালায়। এতে ১৪২ ক্ষুদে শিক্ষার্থী ও ৮ শিক্ষক নিহত হন। এক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে গায়ে আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ দৃশ্য দেখতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে জঙ্গীরা। ওই শিক্ষক মারা যাওয়ার পর ক্লাসে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর চালানো সাঁড়াশি অভিযানে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ওয়াজিরস্তানে একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বাংলাদেশের চার জেএমবি সদস্যসহ বহু জঙ্গী নিহত হন। নিহত চার বাংলাদেশী জঙ্গীর মধ্যে রয়েছেন গ্রেফতারকৃত জেএমবি আমির সাইদুর রহমানের মেয়ের জামাই ও সাখাওয়াতুল কবিরের ভায়রা সাজ্জাত ওরফে ইজাজ ওরফে কারগিল, সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নি জামাই অভি, ডিবির হাতে গ্রেফতারকৃত জেএমবির প্রশিক্ষিত সদস্য বাতেনের বোন জেএমবির মহিলা শাখার সদস্য পাকিস্তানে অবস্থিত ফাতেমার স্বামী জেএমবি সদস্য সায়েম ও সায়েমের দুলাভাই জেএমবির সক্রিয় সদস্য শামীম। ইজাজ মারা যাওয়ায় সার্বিক কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়ে সত্য। তবে থেমে থাকেনি। এমনকি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা ও জঙ্গী গোষ্ঠীর কাছ থেকে বাংলাদেশের জেএমবির কাছে অর্থ পাঠানোও বন্ধ হয়নি।
 

               তার প্রমাণ মিলেছে চলতি বছরের ২৯ নবেম্বর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস শেখ ও মোঃ মকবুল শরীফ এবং আটকেপড়া পাকিস্তানী মোঃ সালাম ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এ্যাসিসটেন্ট ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোস্তফা জামান গ্রেফতার হওয়ার পর। গ্রেফতারকৃতরা ভারতীয় ও পাকস্তানী জালমুদ্রা পাচারে জড়িত। ইদ্রিসের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বিশেষ স্পাই মোবাইল। যেটি সাধারণত কোন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে থাকে। স্পাই মোবাইল ফোনটি ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল।
 
ইদ্রিস ও মকবুল শরীফ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন। জবানীতে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারে ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাস এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনেক কর্মকর্তার জড়িত থাকা এবং অর্থায়ন করার বিষয়টি। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তার ও এ জন্য অর্থায়ন করার সঙ্গে ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের মহিলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার সরাসরি জড়িত বলেও জিজ্ঞাসাবাদে ইদ্রিস জানায়।
 

              ফারিনা আরশাদ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে সরাসরি ইদ্রিস আলীকে নগদ টাকা দিতেন। তিনি ফারিনা আরশাদের গাড়িতে চড়ে নানা গোপন তথ্য আদান-প্রদান করতেন। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিকদের কাজে লাগানো হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই এমন অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশে ইদ্রিসকে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে পাঠিয়ে জেএমবির কার্যক্রম বাড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে জেএমবি ও রোহিঙ্গাদের পাকিস্তানে পাঠানো, সেখানে উচ্চতর জঙ্গী প্রশিক্ষণ এবং আবার তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত করার সার্বিক কাজটি দেখভাল করত ইদ্রিস আলী, নিহত ইজাজ, সাখাওয়াতুল কবির, ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইবনে হামদানসহ পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অনেকেই। এই চক্রটির মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আর তাতে মদদ দিচ্ছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা। এ জন্য পাকিস্তান থেকে তৈরি হওয়া জালটাকা ও জালমুদ্রা বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করে দেয়ার পাশাপাশি জালরুপী সীমান্তপথে ভারতে পাচারের কারণে সেদেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর নীলনক্সা চলছে।
 
          র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জেএমবির প্রশিক্ষক শামীন মাহফুজ গ্রেফতারের পর তার তথ্যমতে, বান্দরবানের থানচিতে ১৫ একর জায়গার ওপর একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সন্ধান মেলে। সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গবেষণাগারও ছিল। সেখানে অন্তত ২শজঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যাদের অধিকাংশই নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। এছাড়াও ছাত্র শিবির থেকে হিযবুত তাহ্রীরে যোগদান করা বেশকিছু সদস্যও সেই ক্যাম্পে ট্রেনিং করেছে।

         প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অধিকাংশই এখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আল কায়েদা ও আইএসসহ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারি সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের অর্থায়ন করা হচ্ছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর তরফ থেকে। বিশ্বের একটি অন্যতম প্রভাবশালী দেশ পরোক্ষভাবে বেশ কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে তাদের অর্থায়ন করছে।
 
জঙ্গী কার্যক্রম ও অর্থায়নের বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়ন করার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

           একই বিষয়ে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী জঙ্গীদের বিষয়ে বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ সর্তকবার্তা দেয়া আছে। তারা যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে এবং দেশে প্রবেশ করা মাত্র তাদের যাতে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় এ জন্য সর্বক্ষণিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
 
জঙ্গীরা নিজেরাই মূলত চাঁদা দিয়ে ফান্ড গঠন করে থাকে। ইদানীং নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে অর্থ যোগাড় করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া বিদেশ থেকেও জঙ্গী অর্থায়ন হয়ে থাকে। তবে সেটি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে। অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন দেশে থেকে বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনকে অর্থায়ন করে থাকেন। এমন বেশ কিছু তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। থানচির ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য ব্যয় হওয়া প্রায় ৪ কোটি টাকার প্রকল্পের নেপথ্য কারিগরদের সন্ধান চলছে।
 

        যদিও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন দেশের তরফ থেকে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করার কোন তথ্য-প্রমাণাদি তারা পাননি। এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
     
-

       দক্ষিণ এশিয়ায় আইএস ॥ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় খোরাসান অঞ্চল ঘোষণা

     
              আগামী ৫ বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেছে আইএস। ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সি ক্রিস্টেইন ফেয়ারের গবেষণা প্রতিবেদন আল কায়েদার পুর্নভিবাব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আইএসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চিত্রটি উঠে এসেছে। এছাড়া বিবিসির প্রতিবেদক এ্যান্ড্রু হসকেন তার নতুন বই ভয়ের সাম্রাজ্য : ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেএ পৃথিবীতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে কিভাবে আইএস সাতটি ধাপে তাদের ভবিষ্যত কর্মসূচী নির্ধারণ করেছে তা উঠে এসেছে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়াকে আইএস খোরাসান অঞ্চল ঘোষণা করে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। 
সি ক্রিস্টেইন ফেয়ার তার গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেন তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় আল কায়েদার উপস্থিতি ও বিস্তার লাভের উচ্চাকাক্সক্ষা প্রকাশ করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় আল কায়েদার এই নতুন শাখার নাম হচ্ছে জামায়াত কায়দাত আল-জিহাদ ফি শিবাহ্ আল-কারা-আল হিন্দিয়া অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায়, আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা উপমহাদেশে আল কায়েদা সংক্ষেপে আকিস। আকিসের প্রধান নেতার নাম শেখ আসিম ওমর, যিনি পাকিস্তানের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, যার সঙ্গে আল কায়েদার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানে তিনি খুব স্বাধীনভাবেই তার কর্মকা- চালান। খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে উর্দুতে লেখা তার বেশকিছু বই রয়েছে। সেগুলো পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে- তিসরি জং-ই আজিম অর দাজ্জাল (দি থার্ড ওয়ার্ল্ড এ্যান্ড দি এন্টি-ক্রাইস্ট), দাজ্জাল কা লস্কর : ব্ল্যাকওয়াটার (ব্ল্যাকওয়াটার: দি আর্মি অব দি এন্টি-ক্রাইস্ট) এবং বারমুদা টাইকন অর দাজ্জাল (দি বারমুদা ট্রায়াঙ্গল এ্যান্ড দি এন্টি-ক্রাইস্ট)। বইগুলোর প্রাপ্তি আরও সহজ করতে অনলাইন ভার্সনে বুকস্টোরগুলোর নাম পর্যন্ত দেয়া আছে।
 

            জাওয়াহিরির বক্তব্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদী পতাকা উড়ানো হবে। তিনি এমনও আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে, তাদের এই সংগঠনকে বাংলাদেশ, বার্মা, আসাম, গুজরাট, আহমেদাবাদ এবং কাশ্মীরের মুসলমানরা স্বাগত জানাবে এবং সংগঠন দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের নির্যাতন ও অবিচার থেকে মুক্ত করবে।
 
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে আইএসের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে এবং এর জন্য উপযুক্ত সময়ও খোঁজা হচ্ছে। তবে দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে সাড়ম্বর ঘোষণার আগেই এ অঞ্চলকে ঘিরে আল কায়েদার উপস্থিতি ছিল। সেখানে দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়ার জন্য আল কায়েদার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে আফগানিস্তান। আল কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তুমুল আক্রমণের মুখে পড়ার পর আল কায়েদা পাকিস্তান, ইরানসহ আশপাশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ৯/১১ এ টুইন টাওয়ারে আক্রমণের পরিকল্পনায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলেই সবাই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী ওই ঘটনার পরই আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। আল কায়েদার নেতারা পাকিস্তান পালিয়ে যায়। পাকিস্তানে আল কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে আমেরিকার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান শেষ হয়।
             আফগান তালেবান নেতা মোল্লা ওমর দীর্ঘ সময় ধরেই বিন লাদেনকে লো প্রোফাইলে থাকতে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু বিন লাদেন ওমরের কথা শোনেননি। বরং ১৯৯৮ সালে তালেবানদের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি আফগানিস্তান থেকে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওপর হামলার মূল হোতা ছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব আফগানিস্তানে খোস্ট ও জালালাবাদের কাছে তালেবান ক্যাম্পে মিসাইল আক্রমণ করে। ওই ঘটনার পর আফগানিস্তানের স্বার্থ বিবেচনা করে ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রে ভবিষ্যতে কোন ধরনের আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে তালেবানরা অঙ্গীকার করায়। এমন কী বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে তারা কীভাবে বিন লাদেনকে ইসলামী আদালতে বিচারের জন্য তুলে দেয়া যায় সেই উপায়ও খুঁজছিল। তাকে আদালতে সোপর্দ করার চিন্তাভাবনাটা লাদেন একদমই পছন্দ করেননি। এটা তার কাছে মনে হয়েছিল ইসলামের শত্রুদের কাছে ভীরুতা প্রকাশের শামিল। তাই সব উপেক্ষা করেই তিনি একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছিলেন।
 

          ১৯৯০ সালে যখন মিসাইল আক্রমণে কোন আল কায়েদা সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি তখন পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ-ই-ইসলামী (হুজি) এবং হরকাত-উল-মুজাহিদিন (হুম)সহ কয়েকটি সংগঠন আল কায়েদার সঙ্গে যোগ দেয়। ওই সময় শিয়াবিরোধী আরও সংগঠন সিপাহ্-ই-সাহাবা-ই-পাকিস্তান (এসএসপি) এবং লস্কর-ই-জাংঘবি (লেজ) তালেবানদের সহায়তা করতে আফগানিস্তানে যায়। তালেবানদের সহযোগী হিসেবে পাকিস্তানের দেওবন্দি গ্রুপ হিসেবে হুজি, হুম, এসএসপি ও লেজের সঙ্গে আল কায়েদার সখ্য তৈরি হয়।
 
যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের পর আল কায়েদা ও তালেবান নেতারা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আসে ওইসব সংগঠনের যোদ্ধাদেরসহ। ২০০১ সালের পর থেকে পাকিস্তানের সহায়তায় সেখানে আল কায়েদার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে লোক দেখানো ধরা হয়। ব্রুস রেইডেলের মতো কয়েকজন লেখক যুক্তি দিয়ে লিখেছিলেন যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দা সংস্থা এবং দি ইন্টারসার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স ডিরেক্টরেট (আইএসআই) আল কায়েদার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ২০০১ সালের শেষ দিকে আল কায়েদা ও তাদের পাকিস্তানী জঙ্গী জোট দেশটিকে লক্ষ্যস্থলে পরিণত করতে শুরু করে। ২০০৩ সালের মধ্যে আল কায়েদা পাকিস্তানের তৎকালীন সেনা স্বৈরশাসক স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করে। তাকে বিশ্বাসঘাতক বলতে থাকে। ২০০৪ সালে আল কায়েদা পাকিস্তানী জনসাধারণকে পারভেজ মোশাররফের সরকারের পতন ঘটাতে উৎসাহ দেয়া শুরু করে। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন লাদেন।
 
২০০১ সালের পর থেকে পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। আল কায়েদার পরিকল্পনায় সেসব হামলা হলেও তা কার্যকর করে সহযোগী দেওবন্দি গ্রুপগুলো। সে সময় হুজি ও হুম থেকে বেশকিছু সদস্য বেরিয়ে জোস-ই-মোহাম্মদ (জেম) নামে আরেকটি দেওবন্দি জঙ্গী সংগঠন তৈরি করে। সংগঠনটি হয়ে ওঠে অন্যগুলোর চেয়ে ভয়ঙ্কর ও হিংস্র। ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে এই জেমই হামলা করে। ওই ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। এই দেওবন্দি গ্রুপ আল কায়েদাকে যোদ্ধা সরবরাহ করাসহ পাকিস্তানে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় সহায়তা দিয়ে যেতো। এই দেওবন্দি গ্রুপের বিপরীতে পাকিস্তানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আরও একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে ওঠে। তারা তালেবানদের সহযোগী হিসাবে নয়, নিজেরাই আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নেয়। আল কায়েদার সঙ্গে মিলিতভাবেও তারা হামলা করতো না। এককভাবেই চলতে শুরু করে ওই ভয়াবহ সংগঠনটি। যার নাম লস্কর-ই-তায়েবা।

           দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ অতীতকে পুঁজি করে আল কায়েদা নতুন করে এ অঞ্চলকে ঘিরে তাদের কর্মপন্থা সাজাচ্ছে। ষোড়শ শতাব্দিতে ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ১৫২৬ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোগল সাম্রাজ্য বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ অংশের বেশিরভাগ যুক্ত করে নেয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর সত্যিকার অর্থে ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু হওয়ার পর মোগল শাসনের অবসান ঘটে। সেই সঙ্গে মুসলিমদের প্রতিপত্তিও কমে যায়। জাওয়াহিরি মুসলিমদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যকে তুলে ধরে এ অঞ্চলের মুসলিমদের সমর্থন নিয়ে এক ভিন্ন ধরনের মুসলিম রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করতে চান। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস খেলাফত শাসন ব্যবস্থা চালুর যে ঘোষণা দিয়েছিল সেই প্রতিযোগিতায় দেরিতে হলেও যুক্ত হয়েছে জাওয়াহিরির আকিস। জাওয়াহিরি মনে করছেন আইএসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাকেন্দ্রিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেয়ে অতীতের গৌরবের কথা ভেবেই তার ভাবনার মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের মুসলিমরা বেশি আগ্রহী হবে।
 

           ভারতীয় মুসলিমদের ফুঁসলানোর জন্য আইএস নিজস্ব কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে। আইএসের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদী ২০১৪ সালের ৫ জুলাই প্রকাশ্যে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তার প্রথম বক্তৃতায় তিনবার ভারতের নাম উল্লেখ করেছেন। প্রথমত তিনি বলেছেন, তিনি কয়েকটি দেশের তালিকা তৈরি করেছেন যেখানে মুসলিমদের অধিকার বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভারত সেরকম একটি দেশ। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, ভারতের কাশ্মীরে মুসলিমদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন ও নাশকতা চালানো হচ্ছে। তৃতীয়ত তিনি স্স্পুষ্ট কর্মবিধি তুলে ধরে বলেছেন, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় তার নতুন খেলাফতে অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ভারতকে যুক্ত করা হয়েছে। তবে বাগদাদীর এ বক্তব্য ভারতের ইসলামী চিন্তাবিদরা কী চোখে দেখছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তারা একেকজন একেক রকম করে ব্যাখ্যা করেছেন বিষয়টি। যেমন- লক্ষে
èৗর দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা ইসলামিক ইনস্টিটিউটের মাওলানা সালমান নাদভি তাৎক্ষণিকভাবে বাগদাদীকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতে নাদভিকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন অল ইন্ডিয়া উলেমা কাউন্সিল এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড। তবে নাদভি একা নন, অনেকেই আইএসকে আলিঙ্গন করেছেন। কাশ্মীরের তরুণদের আইএসের কালো পতাকা বহন করতে দেখা গেছে। আইএস তরুণদের দলে টানতে নিয়োগ দিতে ভিডিও বার্তা হিন্দি, উর্দু ও তামিল ভাষাতেও প্রচার করছে। ভারতের অনেক মুসলিম আইএসে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অসংখ্য মুসলিম রয়েছেন যারা যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একদম প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছেন। এমন কী নানাভাবে সহিংসতারও শিকার হচ্ছেন। এই কারণে বৈশ্বিক জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর কাছে দক্ষিণ এশিয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মুসলিম। ১ কোটি ২০ লাখ। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর কাছে এটা একটি বিশাল অংক। এর ওপর আছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা। যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নন। আইএসের বাগদাদীর মতো আকিসের জাওয়াহিরির ভিডিও বক্তৃতাতেও ভারতের মুসলিমদের ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে চিহ্নিত করে উস্কানি দেয়া হয়েছে। তিনি কাশ্মীরের কথা বলেছেন, যেখানে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের প্রচারণার শিকার হচ্ছেন বাসিন্দারা। অপরদিকে তারা প্রায়ই ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরও নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন। ২০০২ সালে ভারতের রাজ্য গুজরাটের শহর আহমেদাবাদে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার ঘটনাও তুলে ধরেন জাওয়াহিরি। সেসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইন্ধন থাকার বিষয়টিও তুলে তাকে মুসলিম বিদ্বেষী উল্লেখ করে কঠোর সমালোচনা করেন। এর পাশাপাশি তিনি ভারতের অসমে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সম্প্রদায় বড়োর ওপর যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা সহিংসতার বিষয়টিও তুলে ধরেন। 


            তবে আকিস ও আইএস ভুক্তভোগী মুসলিমদের ফুঁসলানোর জন্য শুধু ভারতে শাখা খোলার লক্ষ্য রাখেনি। তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের কথা মাথায় রেখে মিয়ানমারকেও আরেকটি লক্ষ্যস্থল হিসেবে পরিকল্পনায় রেখেছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেশ মিয়ানমারে বহু সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও দেশটির উত্তরে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের তারা একেবারেই স্বীকৃতি দিতে চায় না। বাংলাদেশের নাগরিক উল্লেখ করে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর এতটাই সহিংস আচরণ করে যে বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দক্ষিণে চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশও তাদের স্বাগত জানায় না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের কোন দেশ নেই। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যেকোন অপরাধমূলক কাজের জন্য প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। বড় আকারে না হলেও বাংলাদেশে শিয়া মতবাদীদের হত্যা করেছে উগ্র জঙ্গীগোষ্ঠী। এছাড়া ভিন্ন মতবাদের মুক্তমনাদের ওপরও চলছে জঙ্গী হামলা। বিষয়গুলোকে পুঁজি করে জাওয়াহিরি তার ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশীদের তার সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহ দিয়েছে। আর মুসলিমপ্রধান দেশ পাকিস্তানে জাতিগত দাঙ্গারূপে ঘটছে ভয়াবহ সব জঙ্গী হামলা। জাওয়াহিরি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশগুলোও রক্তস্নাত হওয়ার পেছনে ভারত, পাকিস্তানের দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকক্ষমতালোভীরাজনীতিকদের দায়ী করেছেন। তবে মজার বিষয়, শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার এবং বৌদ্ধদের জঙ্গী সংগঠন বড় বালা সেনার হাতে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর সহিংসতা ঘটলেও দেশটিকে তার তালিকায় রাখেননি জাওয়াহিরি।

         লস্কর-ই-তায়েবার উত্থান

     
            দক্ষিণ এশিয়ায় আইএস ও আকিস ছাড়াও আরও একটি শক্ত প্রতিপক্ষ হচ্ছে আহলে হাদিস ঐতিহ্যের অনুসারী লস্কর-ই-তায়েবা (লেট)। এরা সহিংস হামলার জন্য মূলত ভারত ও আফগানিস্তানকেই বেছে নিয়েছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকায় এরা পাকিস্তানের দেওবন্দি গ্রুপের মতো নিজ দেশে কখনো হামলা করেনি। এমন কী লেট তাদের বিভিন্ন প্রকাশনায় পাকিস্তানের ওপর হামলাকারী অপর জঙ্গী সংগঠনগুলোকে প্রকাশ্যে নিন্দা জানায়। আল কায়েদা যেখানে কাশ্মিরসহ ভারতের মুসলিমদের এতোদিন দলে টানার বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেয়নি সেখানে লেট সহিংস হামলার জন্য শক্তি বৃদ্ধিতে এদেরই দলে টেনে নিয়েছে সবচেয়ে বেশি। এদেরকে নিয়েই ২০০৮ সালের নবেম্বরে ভারতের মুম্বাইয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিলো লেট। 

           দক্ষিণ এশিয়া এভাবেই বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন দি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস) বা আইএস আগামী ৫ বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা খেলাফত শাসন জারির পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০২০ সালের মধ্যে কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নেবে তা একটি মানচিত্রের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে সংগঠনটি। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে হাজার হাজার ভিন্ন ধর্ম ও মুক্তমনাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে ইতোমধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এই ধর্মান্ধ উগ্র সংগঠনটি।
 

           প্রভাবশালী গণমাধ্যম মিরর-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএসের পরিকল্পনা মানচিত্র অনুসারে আগামী ৫ বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় দেশ পশ্চিমের স্পেন থেকে শুরু করে পূর্বের চীন পর্যন্ত যে কোনভাবে আধিপত্য বিস্তার করা হবে। মানচিত্র অনুসারে স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সকে আরবী নাম আন্দুলাস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অস্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ওই তিনদেশের অঞ্চল বিশেষ আন্দুলাস নামে মুরদের শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো। ভারতীয় উপমহাদেশ মানচিত্রে চিহ্নিত হয়েছে খোরাসান নামে।
 
২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি আইএসের মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল আদনানি খোরাসান রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বেশিরভাগ এলাকা এবং ভারত ও চীনের বেশ কিছু অংশ এই খোরাসানে গুরুত্ব পাচ্ছে। এর সীমানা এখনও নির্দিষ্ট করা না হলেও ধারণা করা যাচ্ছে, ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশের প্রদেশগুলোকে নিয়ে আইএস কৌশল ঠিক করছে। কারণ ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশেই সুন্নি উপজাতিগুলো বাস করে। সেখানের পাহাড়ী এলাকাগুলি জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর কাছে খুবই নিরাপদ স্থান। আইএস নতুন কৌশল হিসাবে সুন্নি জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতভেদ দূর করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে। কারণ আইএসের চুলচেরা বিশ্লেষণে বার বার উঠে আসছে যে, আল কায়েদা ও তালেবানের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো প্রায় চার দশক ধরে ভয়াবহ সব হামলার ঘটনা ঘটালেও খেলাফত প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। তাই একতা প্রয়োজন সবার আগে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু জঙ্গী সংগঠন আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশও করেছে। পাকিস্তানের পেশাওয়ারে সেনা স্কুলে হামলা চালিয়ে শত শত শিশু হত্যাকারী তেহরিক তালেবান অব পাকিস্তানের (টিটিপি) মুখপাত্র শেখ মকবুল ২০১৩ সালে আইএসের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আইএস টিটিপির আবেদন মঞ্জুর করে। তালেবানদের উপরের স্তরের অনেক নেতা ২০১৩ সাল থেকেই তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের নেতৃত্ব থেকে সরে এসে আইএস প্রধান বাগদাদীর প্রতি সমর্থণ দিয়েছে। খোরাসানের উপরের স্তরের ১২টি পদে নিয়োগ দেয়া হয় টিটিপি নেতাদের। আইএস পাকিস্তানী তালেবান নেতা          হাফিজ সাইদ খানকে খোরাসানের প্রধান এবং মোল্লা আবদুল রউফ খাদিমকে তার ডেপুটি ঘোষণা করে আইএস। রউফের নেতৃত্বে আফগানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা, সদস্য সংগ্রহ, কৌশল নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর বিস্তৃতি ঘটানো হতো। তবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাটোর ড্রোন হামলায় নিহত হন রউফ। এরপর ৬ আগস্ট খোরাসানের আফগান অংশের আইএস আমির গুল জামান মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। বিবিসির প্রতিবেদক এ্যান্ড্রু হসকেন তার নতুন বই ভয়ের সাম্রাজ্য: ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেশীর্ষক বইয়ে আইএসআইএসের লক্ষ্য ও মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন, সংগঠনটি ইসলামী শাসন কায়েমের নামে পুরো বিশ্ব দখলে নিতে চায়। তারা বিশ্বকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। সাতটি ধাপে আইএসআইএস তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করেছে। যা প্রায় ২০ বছর আগে ১৯৯৬ সাল ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার মনোভাবের ভিত্তিতে করা হয়েছে।

            আইএসআইএসের প্রতিষ্ঠাতা আবু মুসাব আল-জারকাওয়ির স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে জয় ছিনিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে সাত ধাপের পরিকল্পনা বা কর্মসূচী। ২০০০ এবং ২০০৩ সালের মধ্যে ইরাকসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ এবং ২০১০ ও ২০১৩ সালের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণার বিষয়টিও ওই কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুমান করা হয়, আইএসের ৫০ থেকে ৮০ হাজার সদস্য রয়েছে। সংগঠনটির নগদ অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন পাউন্ড। ইরাক ও সিরিয়ার তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের ওপর রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও আইএসআইএসের কাছে দুটোই চরম শত্রু রাষ্ট্র। এমন ৬০টি দেশকে তারা বিরোধী বা চরম শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। হসকেন তার বইয়ে আরও বলেছেন, আইএসআইএসের ৮০ শতাংশ নেতাকে আটক বা হত্যার মধ্য দিয়ে একটি খ-ের মাত্র সমাপ্তি টানা হয়েছে। তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। তারা ফিরে এসেছে ক্যান্সারের মতো।
-   
           আইএস একদিকে নারীদের দলে টানছে অন্যদিকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করছে ভিন্ন গোষ্ঠীর নারীদের। পারিবারিক আবহে বীতশ্রদ্ধ, জীবন নিয়ে হতাশ, নতুন কিছু করার স্বপ্নে বিভোর পশ্চিমা বিশ্বের মেধাবী কিশোরীরা জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে। জিহাদী হিসেবে তারা আইএসের নতুন শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। মেধার দিক দিয়ে আইএসের অনেক পুরুষকর্মীদের চেয়েও অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ওই মেয়েরা। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় ভ্রমণ করা ৪ হাজার পশ্চিমা নাগরিকদের মধ্যে সাড়ে ৫শ’-এরও বেশি নারী ও কিশোরী জঙ্গী সংগঠন আইএসে যোগ দিয়েছে।
 
            ১৭ আগস্ট দি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বসনিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে লড়াইয়ে এতদিন পর্যন্ত শুধু পুরুষরাই যোদ্ধা হিসাবে আইএসে যোগ দিত। ওই যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রয়েছেন পশ্চিমা দেশের নাগরিক। নানাভাবে কিশোরীদের আইএস প্রলুব্ধ করে সংগঠনে যুক্ত করছে। বিশ্বদখলে আইএসের নৃশংসতায় যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে ওই নারীদের বেশিরভাগকে স্ত্রী, মা, নিয়োগকর্মী এবং কখনো কখনো অনলাইন সহিংসতার চিয়ারলিডার্সের ভূমিকাতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডন থেকে তিন কিশোরীর সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেয়ার ঘটনাও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। তিন কিশোরীর একজন খাদিজা সুলতানা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও তার মা জানতো না বিষয়টি। ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুলের ছুটিতে ১৬ বছরের খাদিজা তার এক বন্ধু ও ভাগ্নির সঙ্গে নাচানাচি, দুষ্টুমি করছিল। বাবা-মারা যাওয়ার পর খাদিজা তার মায়ের একদম বাধ্য মেয়েতে পরিণত হয়। বাসা ছেড়ে যাওয়ার আগের দিন নিজের রুম ছেড়ে রাতে মায়ের সঙ্গে শুয়েছিল খাদিজা। সকালে লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় ফেরার কথা থাকলেও সাড়ে ৫টার মধ্যেও যখন খাদিজা ফিরে আসেনি তখনই মায়ের দুশ্চিন্তা শুরু হয়। খাদিজার সেলফোনে তার বড় বোন হালিমা খানম মেসেজ পাঠিয়ে কোন জবাব পান না। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখেন সেখানে খাদিজা নেই। স্কুলেও নেই। পরে তাদের মা রুমে গিয়ে খাদিজার ওয়ার্ড্রোব খুলে দেখতে পান কাপড় নেই, প্রয়োজনীয় বেশকিছু জিনিস নেই, দুটো ব্যাগও নেই। তার বোঝার বাকি থাকে না ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে খাদিজা। পরদিন পুলিশে রিপোর্ট করেন মেয়ের নিরুদ্দেশের। পুলিশের ধারণা হয় খাদিজা দুই বান্ধবীর সঙ্গে তুরস্ক বেড়াতে গেছে। খাদিজার বোন জানায় তার মনে একবারও উঁকি দেয়নি সিরিয়ার কথা। পরে তারা নিউজে দেখে জানতে পারেন খাদিজা সিরিয়ায় চলে গেছে। নিউজে গ্রেইনি সিকিউরিটি ক্যামেরা ফুটেজে দেখানো হয়েছিল, খাদিজা তার ১৫ বছর বয়সী দুই বান্ধবী শামীমা বেগম ও আমিরা আবাসির সঙ্গে ধীরে ধীরে বিমানবন্দরের সিকিউরিটি পার হচ্ছে। তারা তুরস্কের একটি বিমানে করে প্রথমে ইস্তানবুল এবং পরে বাসে করে সিরিয়া পৌঁছায়। ওই তিন কিশোরী রীতিমতো পরিকল্পনা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাদেরই এক বন্ধু। যে ইতোমধ্যে ইসলামিক স্টেটের দখলে থাকা অঞ্চল ঘুরে গেছে। ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগের প্রতিবেদন ও ডেটাবেজ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন মেয়েদের নিয়ে আইএস একটি প্রোফাইল অনুমোদন করেছে। তাদের মুসলিম হিসেবে অন্য চোখে দেখা হয়। অমুসলিম আখ্যা দিয়ে যেভাবে ইয়াজিদি গোষ্ঠীর মেয়েদের ধর্ষণ করা হয় এবং যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ওই মেয়েদের তা থেকে ভিন্নভাবে দেখা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসা খাদিজাদের মতো মেয়েদের জন্য একটি ম্যারেজ ব্যুরোও পরিচালনা করা হয়। চলতি বছর আইএসের মিডিয়া শাখা একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছে যে, মেয়েরা ১৫ বছর বয়সে তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে পারবে। আর তারা ৯ বছর বয়স থেকেই বিয়ে করতে পারবে। পাশাপাশি আইএসে প্রবেশ করা নারীদের সম্মানিত হিসেবেও প্রশংসা করা হয়। আইএসের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদী ইরাকী বংশোদ্ভূত এক জার্মান তরুণীকে তার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করেছেন। ওই স্ত্রীকে খেলাফতের নারীবিষয়ক ইস্যু দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
 


আইএসে যৌনদাসত্ব
 

         ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সদস্যরা মেতে উঠেছে বিকৃত যৌনাচারে। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অগাধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি এখন শিশু-কিশোরী ধর্ষণের মাধ্যমে সংগঠনটির লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। সংগঠনটির ক্যাম্পগুলোতে ধর্মীয় পাঠ চর্চার পরিবর্তে নিয়মিত চলে অপহৃত নারীদের ধর্ষণ। তাদের বিক্রি করে দেয় যৌনদাসী হিসেবে। ভিন্ন ধর্মের নারী শিশুদের ধর্ষণ মানে আল্লাহকে সন্তষ্ট করাএমন উদ্ভট বিকৃত এবং ভয়াবহ মানসিকতা তারা নির্বিকারভাবে ছড়িয়ে তাদের অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চলেছে। ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমসে আইএস ক্যাম্পে অবাধ যৌনচারের শিকার শিশু-কিশোরী নিয়ে প্রকাশিত সচিত্র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ধর্মের দোহাই দিয়ে যৌন দাসত্বের ভয়াল দৃশ্য। ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা ২১ জন কিশোরী ও নারীর বয়ানে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের ওপর নিত্যদিন চলা নির্যাতনের তথ্য।
 
পালাতে সক্ষম হওয়া ১২ বছরের একটি কিশোরী ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমসে দেয়া সাক্ষাতকারে জানিয়েছে, তাকে ধর্ষণ করা ব্যক্তিটি ধর্ষণের আগে পরে প্রার্থনা করত। মেয়েটি এ কষ্ট থেকে তার কাছে মুক্তি চাইলে সে বলত ইসলাম ধর্ম অনুসারে সে ইসলামে অবিশ্বাসী অন্যের ধর্মের মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারে। বরং বিধর্মীকে ধর্ষণের মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করছে। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়েটি ১১ মাস আগে পালাতে সক্ষম হয়। বর্তমানে সে আন্তর্জাতিক শরণার্থী শিবিরে তার পরিবারের সঙ্গে রয়েছে।
 

          এক বছর আগে আইএসের হাতে অপহরণের শিকার হওয়া ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ১৫ বছর বয়সী আরেক কিশোরীও একই তথ্য দিয়েছে। তাকে এক ইরাকী যোদ্ধার কাছে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। গত এপ্রিল মাসে সে পালাতে সক্ষম হয়। ওই কিশোরী জানায়, তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করা হতো। আর প্রত্যেকবারই ওই ব্যক্তি নামাজের ভঙ্গিতে প্রার্থনা করত। লোকটি তাকে বলত এর মাধ্যমে সে ইবাদতকরছে। মেয়েটি তাকে বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে যা করছ তা অন্যায়। এসব করে তুমি ঈশ্বরের নৈকট্য পাবে না।জবাবে লোকটি তাকে বলে, ‘এটা স্বীকৃত। এটা হালাল।
 
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএস ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়েদের দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যৌন দাসের ব্যবসা প্রথমে শুরু করে ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট থেকে। ইরাকের উত্তরাঞ্চলে এই ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বসবাস। ৩৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ইরাক। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে ইয়াজিদি। আইএস ওই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের গ্রামগুলো দখল করে নেয়ার পরপরই সম্প্রদায়ের নারী পুরুষদের আলাদা করে ফেলে। নারীদের মধ্যে আবার আলাদা করে নেয়া হয় শিশু কিশোরী ও অবিবাহিতদের।
 

         যৌন ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ের লক্ষ্যে আইএস একটি শক্ত অবকাঠামো তৈরি করেছে। ইয়াজিদি মেয়েদের প্রথমে নেয়া হয় বন্দীশিবিরে। তারপর তাদের নেয়া হয় পরিদর্শন ঘরে। সেখান থেকেই চলে পণ্যের মতো নারীদের বাজারজাতকরণ। গত বছর ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মোট ৫ হাজার ২৭০ জনকে অপহরণ করা হয়। এদের মধ্যে ৩ হাজার ১৪৪ এখনও বন্দীশিবিরে। আইএস নিজেদের পরিচালিত ইসলামী আদালতের মাধ্যমে মেয়েদের বিক্রয় চুক্তিকে বৈধতা দিয়ে যৌনদাসত্বের ব্যাপারে বিস্তারিত নীতিমালা তৈরি করেছে। আইএসের গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগ গত মাসে যৌনদাসত্বের নির্দেশনা বিষয়ক ধর্মীয় একটি নীতিমালা তৈরি করে তা জারি করেছে। বারবারই আইএস নেতারা কোরআনের বাণীর একাংশকে তুলে ধরে নিজেদের মতো করে সংকীর্ণ ও অপব্যাখ্যা করে আসছে। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কোরআনের পবিত্র বাণীর নির্ধারিত কিছু অংশ তুলে ধরে তাদের সেইসব সহিংসতাকে বৈধতা দিয়েছে নীতিমালার মাধ্যমে। এমনকি তারা যৌন আকাক্সক্ষা চরিতার্থের জন্য এ ধরনের যৌনাচারকে আধাত্মিক লাভ ও পুণ্য অর্জনের অংশ বলে প্রচার চালাচ্ছে। ৩৪ পৃষ্ঠার ওই নীতিমালায় গর্ভবতী ছাড়া ভিন্ন ধর্মের সব বয়সী দাসীদের সঙ্গে যৌনাচারের বৈধতা দেয়া হয়েছে। ১৫ বছরের ওই কিশোরী জানায় কিভাবে তার পরিবার আইএস জঙ্গীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। সে বলে, ‘ পুরো পরিবার নিয়ে আমরা পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ভারি অস্ত্রে সজ্জিত আইএস যোদ্ধারা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমি, আমার মা, ১৪, ৭ ও ৪ বয়সী চার বোন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। প্রথমেই তারা পুরুষ ও নারীদের আলাদা করে ফেলে। আমাকে আমার মা ও বোনদের সঙ্গে একটি ট্রাকে তোলা হয় প্রথমে। মাউন্ট সিনজার শহরের কাছাকাছি আসার পর আমাকে মা ও বোনদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। একজনের কোলে আরেকজনকে গাদাগাদি করে ভরা হয় বাসে। সাদা রঙের বাসের গায়ে লেখা ছিল হাজীশব্দটি।
           প্রতিবছর মক্কায় হজ পালনের জন্য যাওয়া হাজীদের এই বাসে বহন করা হয়। কম বয়সী ও অবিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে আমাকে ওই বাসে জোর করে তোলা হয়। 
১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরীকে ৬ ঘণ্টা যাত্রার পর প্রথমে মসুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি মেয়েদের গ্রুপের সঙ্গে তাকে গ্যালাক্সি ওয়েডিং হলে রাখা হয়। অন্য গ্রুপের মেয়েদের নিয়ে তোলা হয় সাদ্দাম হোসেনের শাসন সময়ের বাদুশ জেলখানা, যুব ভবনে। তাছাড়া ইরাকের তাল আফার, সোলাহ, বাআজ, সিনজার শহরের এলিমেন্টারি স্কুল ও পৌর ভবনেও অনেক মেয়েদের বন্দী করে রাখা হয়। সেসব স্থানে তাদের কয়েকদিন, কয়েক মাস রাখার পর ছোট ছোট গ্রুপে বাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিরিয়া বা ইরাকের ভেতরেই অন্য কোন জায়গায়। এরপর যৌনদাসী হিসেবে মোটা অর্থের বিনিময়ে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়। মেয়েদের নাম, বয়স এবং বিয়ে হয়েছে কী না, বাচ্চা আছে কী না এসব তথ্য একটি নিবন্ধন বইয়ে তুলে নেয়া হতো। ছোট ছোট দলে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হতো অন্য কোথাও। যেই মেয়েরা যেতে চাইতো না তাদের চুল ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। কমবয়সী সুন্দর চেহারার মেয়েরা এক সপ্তাহের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যেত। আর বেশি বয়সী বিবাহিত মেয়েদের মাসের পর মাস বিক্রির জন্য সাবায়া মার্কেট বা দাসবাজারে উপযুক্ত ক্রেতার কাছে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হতো।
 

          কিশোরী মেয়েটি জানায়, তাকে দুই মাস পর একটি ছোট গ্রুপের সঙ্গে বাসে করে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেমে সে প্রথমে শুনতে পায় কয়েকজন যোদ্ধা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাকে ডাকছে সাবায়া নামে। প্রথমে সে জানতো না এর অর্থ। পরে এক আইএস যোদ্ধার কাছে জানতে পারে সাবায়া অর্থ দাসী। ওই যোদ্ধা তাকে জানায়, ইয়াজিদি সম্প্রদায় তাউস মালিকের (ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুসারে সাত দেবতার একজন) উপাসনা করে। ওই যোদ্ধার মতে, তাউস একজন শয়তান। তাই ওই শয়তানের অনুসারীরা তাদের দাসী। তারা এখন তাদের বিক্রি করতে পারে। যা খুশি তাই করতে পারে।
 
          অপহৃত মেয়েদের বিব্রতকর প্রশ্নও করা হতো। তাদের শেষ মাসিক কবে হয়েছিল তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করা হতো। তারা বুঝতে চাইতো মেয়েটি গর্ভবতী কী না। কারণ তারা বুঝতে চাইতো যোদ্ধারা মেয়েটির সঙ্গে তাৎক্ষণিক যৌনাচারে যেতে পারবে কী না। সেক্ষেত্রে তাদের তৈরি শরীয়াহ আইন উল্লেখ করে তারা বলতো, গর্ভবতী দাসীর সঙ্গে যৌনাচার করা যায় না। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ২১ জনের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি ওই সময়ে গর্ভবতী থাকার কারণে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। ৩৪ বছর বয়সী ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের আরেক নারী জানান, সিরিয়ার শাহাদাদি এলাকায় এক সৌদি যোদ্ধার দাসী ছিলেন তিনি। ওই লোক ১২ বছর বয়সী আরেক দাসী কিনে আনার পর তিনি ধর্ষণের হাত থেকে মুক্তি পান। ওই শিশুটি কম বয়সী হওয়ার কারণে ধর্ষণের ফলে ইনফেকশনের শিকার হয়। এরপরও শিশুটি নিস্তার পায়নি। ওই নারীর অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও শিশুটির চিকিৎসা না করে নিয়মিত ধর্ষণ করত লোকটি।

     
            সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আহত জঙ্গীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ইসরাইল। সিরিয়া সীমান্তবর্তী গোলান হাইটে ইসরাইল পরিচালিত হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক ডেইলি মেইলে একটি ভিডিও ফুটেজসহ তথ্যটি প্রকাশ করেছে। ডেইলি মেইল জানায়, রাতের আঁধারে ইসরাইলী সেনারা নিয়মিত গোপন অভিযান চালায় সিরিয়ায়। সেখান থেকে আহত যোদ্ধাদের নিয়ে ফেরত আসে গোলান হাইটের হাসপাতালে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই যোদ্ধা ইসরাইলী সৈন্য নয়, এরা ইসলামী জঙ্গী। তবে ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আইএসকে সেবা দিচ্ছে না। সিরিয়ায় ইরানের মিত্র সরকার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সুন্নী বিদ্রোহীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।

             এদিকে প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএস জঙ্গীদের সেবা দিচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আইএসকে সৃষ্টি করেছে বলে শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে। মোসাদ আইএস জঙ্গীদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। সুন্নী বিদ্রোহীরা আসাদবিরোধী হলেও ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি সরাসরি শত্রুতা পোষণ করে। ডেইলি মেইলকে এ কথা জানিয়েছে, খোদ ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইসরাইল সৈন্যরা কেন যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের উদ্ধারে গোপন অভিযান চালাবে?

           ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুই হাজার ইসলামী যোদ্ধার প্রাণ বাঁচিয়েছে ইসরাইলী সৈন্যরা। এতে ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এছাড়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই হাসপাতাল সফর করে আত্মঘাতী স্কোয়াডের এক জঙ্গী নেতার সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এ নিয়ে ইসরাইলের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ দৃঢ় হয়।
যোদ্ধা ॥ আইএসে প্রায় এক লাখ সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা। তবে আগস্টের শুরুর দিকে আইএসে প্রায় ৩০-৫০ হাজার যোদ্ধা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মতাদর্শগত যোদ্ধা। অন্যরা ভয়ে বা বাধ্য হয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে। তবে কারও কারও মতে, আইএসের প্রায় ৮০ হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা আছে। এর মধ্যে সিরিয়ায় আছে ৫০ হাজার এবং ইরাকে ৩০ হাজার।
আইএস যোদ্ধাদের একটা বড় অংশ ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে যুদ্ধ করছে। এই জঙ্গীগোষ্ঠীটিতে ৮১টি দেশেরও বেশি বিদেশী যোদ্ধা রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসেছেও এদের যোদ্ধা।
অস্ত্র ॥ আইএসের যোদ্ধারা হালকা থেকে ভারি সব ধরনের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। তারা ট্রাকে স্থাপিত মেশিনগান, রকেট লঞ্চার, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম। তাদের কাছে জঙ্গী হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র আছে। সিরিয়া ও ইরাকী বাহিনীর কাছ


     more information ;

          

আইএস মোসাদের সৃষ্টি

print
সোমবার জুলাই ০৪, ২০১৬, ০৫:১২ পিএম.

আইএস মোসাদের সৃষ্টি
বিডিলাইভ ডেস্ক: দুনিয়াব্যাপী ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের স্বঘোষিত খলিফা ও সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা খলিফা আবুবকর আল বাগদাদি মুসলমান নন। তিনি একজন ইহুদি। তার আসল নাম আকা ইলিয়ট শিমন। এর চেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামী শাসনব্যবস্থা’ কায়েমের আদর্শে মত্ত আইএস ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সৃষ্টি।

এ জঙ্গিগোষ্ঠীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রত্যেকেই মোসাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মোসাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতেই আইএস জঙ্গিদের ‘যুদ্ধকৌশল’ শেখানো হয়।

সুসংগঠিত এ জঙ্গিগোষ্ঠীটি ‘ইসলামিক স্টেট’ নামে আত্মপ্রকাশের আগে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের সিনিয়র সিনেটর ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী জন ম্যাককেইনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছে। গোড়ার দিকের ওই গোপন বৈঠকগুলোতে মোসাদের বেশ কয়েকজন সদস্য ও আইএসপ্রধান বাগদাদি উপস্থিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিবেদন ঘেঁটে বিশ্বব্যাপী আতংক সৃষ্টি করা ইসলামিক স্টেট ও এর প্রধান খলিফা আবুবকর আল বাগদাদির পরিচয় নিয়ে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) গোপন নথিতেও এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছে ‘আমেরিকান ফ্রি প্রেস’ নামের ওয়েবসাইট। সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী সংগঠন বলে পরিচিত আইএসের উত্থান হয় গত বছরের জুনে। ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ দখলে নিয়ে ইসলামিক স্টেট নাম দিয়ে খেলাফত ঘোষণা করেন বাগদাদি।

প্যারিসে ভয়াবহ হামলার পর একই কথা বলেছেন কিউবার সাবেক নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। সংবাদ সম্মেলন করে দু’জনই বলেছেন, আইএস ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী অস্ত্র। বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইএস নামের এ ভয়ানক কালসাপ মাঠে নামিয়েছে তারা।

ইসলামিক স্টেট সৃষ্টির এক বছর আগে ২০১৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন সিরিয়ায় আবুবকর আল বাগদাদিসহ অর্ধডজন শীর্ষ জঙ্গি নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। সম্প্রতি সেই বৈঠকের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউবে। মার্কিন প্রচারমাধ্যম এবিসি নিউজ ও সিএনএনের একটি ভিডিও স্নাপশটে এ ছবির ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আমেরিকান ফ্রি প্রেসের প্রতিবেদন জানায়, ইহুদি পিতা-মাতার কোলে জন্ম নেন বাগদাদি। এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যানুযায়ী, বাগদাদিকে টানা এক বছর সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে মোসাদ। একই সময়ে আরবি ভাষা ও ইসলামী শরিয়ার ওপর কোর্স করেছেন বাগদাদি। এ সময় তিনি ইব্রাহিম ইবনে আওয়াদ ইবনে ইব্রাহিম আল বদরি নাম ধারণ করেন।

তবে বাগদাদির পরিচয় সম্পর্কে ছড়ানো হয়েছে- তিনি ১৯৭১ সালের ২৮ জুলাই ইরাকের সামারায় জন্মগ্রহণ করেন। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের সময় সামারায় একটি মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেন বাগদাদি। পরে তিনি ‘আমিরে দায়েশ’ উপাধি গ্রহণ করেন।

এডওয়ার্ড স্নোডেন প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলের বাগদাদির তথ্য প্রথম প্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় ইন্টারনেট রেডিও আজিয়াল ডটকম। পরবর্তী সময়ে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে। ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার পর্যালোচনা নিয়ে এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আরবি পত্রিকা ইজিপ্রেসে। যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি নিউজ প্রচারিত একটি ভিডিওর বরাত দিয়ে সোশিও-ইকোনমিক হিস্ট্রি নামের একটি ওয়েবসাইট দাবি করেছে, মার্কিন প্রভাবশালী সিনেটর জন ম্যাককেইন আবুবকর আল বাগদাদিসহ কয়েকজন আইএস কর্মকর্তা ও সিরিয়ার বিদ্রোহী কয়েকজন নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। ২০১৩ সালের জুনে যখন এ বৈঠকটি হয়, তখন বাগদাদির মুখে লম্বা দাড়ি ছিল না। ওই বৈঠকে বাগদাদির সহযোগী আইএসের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদ নূরও উপস্থিত ছিলেন।

উইকিপিডিয়ায় প্রদর্শিত আবুবকর বাগদাদির ছবির সঙ্গে ওই ছবির মিল পাওয়া গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল আরাবিয়াও ওই ছবিটি প্রকাশ করেছে। সিএনএনের একটি ভিডিওতেও বাগদাদির সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে দেখা যায় জন ম্যাককেইনকে।

গ্লোবাল রিসার্চ নামের একটি গবেষণা ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে আবুবকর আল বাগদাদি। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বুস্কা কারাগারে ছিলেন তিনি।

পলিটিসাইট ডটকমের তথ্যানুযায়ী, সিআইএ’র তত্ত্বাবধানেও বাগদাদি সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ইরাকের উম কাসর এলাকায় মার্কিন কারাগারে সিআইএ তাকে নিয়ে আসে। সেখান থেকে ২০১২ সালে জর্ডানের একটি গোপন ক্যাম্পে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স কমান্ড বাগদাদিসহ তার সহযোগী অনেককে প্রশিক্ষণ দেয়। আইএসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে ইসরাইলের ভূখণ্ড বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে মোসাদের।

আল কায়দার সাবেক শীর্ষ কমান্ডার ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক জিহাদ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নাবিল নাইম বৈরুতের টিভি চ্যানেল আল মাইদিনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আল কায়দার বর্তমান নেতারা ও আইএস সিআইএ’র হয়ে কাজ করছে। এ উদ্দেশ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ তারাই উসকে দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।

সূত্র: যুগান্তর

ঢাকা, জুলাই ০৪(বিডিলাইভ২৪)// কে এইচ
 
  -

মন্তব্যসমূহ