সিলেটের
উপভাষা ও জীবনধারা :
ড. শ্যামল কান্তি দত্ত
বাংলাদেশের
উত্তর-পূর্ব প্রান্তের বাঙালি অধিবাসীদের আঞ্চলিক ভাষা ও জীবনধারা বিষয়ে আলোচনা
করতে গিয়ে আমরা অনুভব করেছি- বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা অত্যন্ত শক্তিশালী
ও জীবন্ত। বৈচিত্র্যময় ভাষার প্রভাবে এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনধারাকেও করেছে
ব্যতিক্রমী ও প্রাণবন্ত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা
সে-অঞ্চলের বাঙালির মাতৃভাষা (সড়ঃযবৎ-ঃড়হমঁব),
প্রমিত
বাংলা (ংঃধহফধৎফ পড়ষষড়য়ঁরধষ নধহমষধ) তাঁদের জন্যে দ্বিতীয় ভাষা (ংবপড়হফ ষধহমঁধমব)।
ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ব্যবহারের সময়ও তাঁদের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব সক্রিয় থাকে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রান্তীয় উপভাষা সিলেটের উপভাষা এ প্রসঙ্গে অগ্রগণ্য। সিলেটের
জনগণ যেকোনো পরিবেশে আরেক জন সিলেটি পেলে শুধু নিঃসংকোচে নয় সগর্বে নিজেদের
আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। বহু আগে থেকে সিলেটের উপভাষার শব্দসম্ভার, বৈশিষ্ট্য,
বাংলার
সাথে এর সম্পর্ক-দূরত্ব নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলে আসছে; এমনকি এর একটি ব্যাকরণের কাঠামো তৈরি করার
চেষ্টাও করেছেন অনেকে; কিন্তু সম্পূর্ণ সফলতা আজও
আসেনি। এসব সমস্যার সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া বর্তমান আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।
আলোচ্য আঞ্চলিক ভাষার মাঠ পর্যায়ে উপাত্ত সংগ্রহ (ফধঃধ পড়ষষবপঃরড়হ) এবং তা
বিশ্লেষণ (ধহধষুংরং) করতে গিয়ে এই উপভাষা বিষয়ে অর্জিত ধারণা-অভিজ্ঞতার সাথে এ
অঞ্চলের মানুষের জীবনধারাও আমাদের মুগ্ধ করে। দেখা গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল
থেকে সিলেটে চাকরি করতে আসা লোকজন এ অঞ্চলের ভাষা ও জীবনধারার প্রেমে পড়ে দিব্যি এ
ভাষা রপ্ত করছেন। এখানকার সাতকরা তরকারি কিংবা চুঙ্গা পিঠা খাচ্ছেন। মণিপুরী ও
ত্রিপুরীদের বানানো পোশাক পরছেন। অবশ্য সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে পারঙ্গমতা ‘ননসিলেটি’দের
মধ্যে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে বেশি লক্ষ করা যায়। তবে বাংলাদেশের
অন্য অঞ্চলের এমনকি বাংলাদেশের বাইরের মানুষের মধ্যেও সুরেলা এই ভাষা-প্রীতি গড়ে
উঠছে। আর এ প্রবণতা অধুনা নয়, প্রাচীন-মধ্যযুগেও
ছিল। তার প্রমাণ পাই ষোড়শ শতাব্দীর কবি বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্য ভাগবতে :
সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
কহিলেন যেন মত আছিলেন বঙ্গে \
বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া \
বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া।
কদর্থেন সেই মত বচন বলিয়া\
অর্থাৎ শ্রী চৈতন্যকেও সিলেটি লোকের সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে হতো। মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, সৈয়দ মুর্তজা আলী প্রমুখ নিজেদের যুক্তি প্রমাণে দেখিয়েছেন চর্যাপদগুলোর সাথে সিলেটি ভাষার সাদৃশ্য। আর হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিম প্রমুখের বৈষ্ণব-সুফি ও বাউল সঙ্গীতের ভাষার কথা তো সবার জানা। সুতরাং স্থানগত বৈচিত্র্য থাকলেও বৃহত্তর সিলেটের ভাষাকে বাংলা ভাষার একটি সমৃদ্ধ উপভাষা বলে স্বীকার করে নেয়া সঙ্গত।
সিলেটের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এখানকার উপভাষার অবস্থান চট্টগ্রামের উপভাষার মতো একটি দূরবর্তী উপভাষিক অবস্থান গ্রহণের স্বরূপ অনুসন্ধান অত্যাবশ্যক। আমরা লক্ষ করেছি বিস্তীর্ণ হাওর-বিলের ব্যবধান এড়িয়ে নদীপথে বা জলপথে বাংলার সাথে ভৌগোলিক সংযোগ সিলেটের উপভাষাকে প্রমিত বাংলার সঙ্গে পরিপূরক অবস্থান তৈরি করেছে। আবার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী পাহাড়ি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর (খাসিয়া, ত্রিপুরী, অসমি, মণিপুরী ও কুকি বা লুসাই প্রভৃতি) ভাষা-প্রভাবও পুরোপুরি এড়াতে পারেনি। আদিবাসী সহজ-সরল জীবনধারার অনেক বৈশিষ্ট্যও এ অঞ্চলে সক্রিয়। খাসিয়াদের উৎপাদিত খাসিয়াপানের পাশাপাশি পান-সুপারি পরিবেশন সিলেটের যে কোনো অনুষ্ঠানে আজও আছে। ত্রিপুরীদের বাঁশের ভেতর ভাত রান্নার অনুকরণে বাঁশের ভেতর বিন্নিচাল দিয়ে তৈরি ‘চুঙগা পিঠা’ সিলেটে এখনও জনপ্রিয়। অসমি সংস্কৃতির গামছা, মণিপুরী সংস্কৃতির মণিপুরী নৃত্য আর মণিপুরী পোশাক ছাড়াও কুকি বা লুসাইগণের ব্যবহার্য তিন-চার ফুট উঁচু বাঁশের ওপর জুতোর মতো বানানো কুকিরখড়ম পায়ে দিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা- প্রাচীন জীবনধারার পরিচায়ক। কুকিগণ বাঁশ ও বাঁশের তৈরি বেত দিয়ে ঘর এবং বাঁশের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি তৈরি করতো। সিলেট অঞ্চলে বাঁশ ও বেতের বহুল ব্যবহার এবং খ্যাতি- কুকি (খযড়ংংধর) সংস্কৃতির স্মারক বলে আমাদের মনে হয়।
নৃতত্ত্ব-ভাষা এমনকি জীবনধারা অধ্যয়নের অংশ হিসেবে স্থাননাম গুরুত্বপূর্ণ। সিলেটের নামকরণ আলোচনায় আমরা পাই- মহাকাব্যে এ অঞ্চলটির নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষ, পুরাণে তা কামরূপ-কামাক্ষ্যা, পরবর্তীতে শ্রীহট্ট ও অসম, বর্তমানে সিলেট ও আসাম। আমাদের মনে হয়েছে, প্রাচীন চীনা-তিব্বতীয় ‘কিরাত’ জাতির বাসস্থান শতম ভাষাগোষ্ঠীর উচ্চারণে ‘সিরাত’, আর্যায়ণের ফলে ‘শ্রীহট্ট’ এবং ইংরেজদের হাতে সমান্তরাল নামায়ন বা নতুন নামকরণ হয় ‘সিলেট’।
সিলেটের ভাষাপরিস্থিতি অনুধাবনের লক্ষ্যে সিলেটের ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে জোরালো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও অনুমান করা যায় সিলেটে অনার্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দেরও আগে। আর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে বাংলায় আর্য-প্রবেশ শুরু হলেও প্রায় হাজার বছর পর- খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে সিলেটে আর্য-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পায়। এর প্রমাণ পাই মহাকাব্য থেকে- মহাভারত-এ অর্জুন-ভগদত্ত’র যুদ্ধ আমাদের কাছে আর্য-অনার্য’র যুদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। এ যুদ্ধে আর্যদের জয়ে সূচিত হয় আর্যভাষারও জয়।
এর পর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে সিলেটের ইতিহাস পাই বিভিন্ন তাম্রশাসন আর পরিভ্রাজকগণের ভ্রমণ-বিবরণী থেকে। সেখানে সিলেট অধিকাংশ সময় কামরূপের অধীন মাঝেমধ্যে ত্রিপুরা কিংবা বঙ্গ কর্তৃক বিজিত। ফলে শাসকগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে এ সময় কামরূপী, বাংলা ও ককবরক ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে স্বাভাবিকভাবেই। সিলেটে প্রথম মুসলিম শাসক মালিক ইয়াজবেগ (১২৫৩ খ্রি.); তবে তিনি মাত্র কয়েক বছর শাসনের পরই আসাম-অভিযানে নিহত হন। এ সময়ে সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ। এরপর হযরত শাহজালাল (রা.) এর সিলেট আগমন (১৩৫৪ খ্রি.) এবং তাঁর সহায়তায় সিকান্দর গাজি সিলেট জয় করেন। তবে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেইন শাহ’র সময়ে (১৪৯৬-১৫১৬) তাঁর সেনাপতি রুকুন খান সিলেটের শাসক হয়ে আসলে সিলেটে ইসলাম ধর্মান্তরের (ওংষধসরংবফ) জোয়ার ঘটে। এতে স্থানীয় ভাষারও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয় আরবি-ফারসির প্রভাবে। তবে শ্রীচৈতন্যের সিলেট আগমনে (১৫০৯ খ্রি.) এতে ভাটা পড়ে এবং আবার সংস্কৃতায়ন শুরু হয়। মধ্যযুগে আসাম-কোচবিহার-ত্রিপুরার পাশাপাশি স্বাধীন সামন্ত কিংবা বিদ্রোহী পাঠান সামন্ত কর্তৃক সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল শাসিত হয় এবং তাঁদের ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সিলেট ইংরেজ শাসনাধীন হয় ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তবে মোগল আমল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনামলের ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটে খাসিয়া ও কুকিদের আক্রমণ-হত্যা ও লুণ্ঠন-আতঙ্ক ছিল। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) পরেও সিলেট সুরমা উপত্যকা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত থাকে একই বিভাগে আরো ছিল- কাছাড়, খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া পাহাড়, নাগা পাহাড় ও লুসাই পাহাড়। আবার বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) হলেও সিলেট রয়ে যায় আসাম প্রদেশে। এই রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অপঘাত সম্বন্ধে মর্মাহত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীভূমি কবিতায় লিখেছেন :
‘মমতা বিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি
ভারতী আপন পুণ্য হাতে
বাঙালির হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া,
সে বাঁধন চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙালির আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’
১৯৪৭-এ রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলেও, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা জনগণের আবাসভূমি- করিমগঞ্জ, শিলচর, কাছাড় ও হালিয়াকান্দি ভারতের আসাম রাজ্যের চার জেলা হয়ে রয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসকগণকেও সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ কারণে বাংলার সাথে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাও প্রমিত বাংলার সাথে সিলেটের উপভাষার দূরত্বের প্রভাবক। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের আমল (১৯৯১-????) থেকে এই অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা বিস্তার, আধুনিকায়ন, নগরায়ন ও বিশ্বায়নের অভিঘাতে উপভাষার ব্যবধান ও ব্যাপ্তি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে।
সিলেটের মানব সমাজের ইতিহাস : সভ্যতা ও সংস্কৃতি আলোচনায় দেখা যায় সিলেটের সভ্যতা বিনির্মাণে ধারাবাহিকভাবে অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় ও আর্য (আলপীয় ও নর্ডিক) জাতির অবদান। আমাদের মনে হয় সিলেটের মানব সমাজে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণ বাংলার তুলনায় অধিক। এখানকার ‘নিষাদ’রা অস্ট্রিক-দ্রাবিড় আর ‘কিরাত’রা ছিল মঙ্গোল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে কামরূপ রাজ ভূতিবর্মার (৫১৮-৫৪২) ঔদার্যে ব্রাহ্মণরা নিষ্কর ভূমি লাভ করেন; সেন বংশের শাসনামলে (১১শতক) বৌদ্ধদের বিতাড়িত করতে শাসকগণ উত্তর ভারত থেকে পঞ্চগোত্রীয় ব্রাহ্মণদের সিলেটে অভিবাসিত করেন; মধ্যযুগের মোগল শাসক নিযুক্ত ফৌজদারবৃন্দও ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করেছিলেন। সিলেটে উচ্চবর্ণ হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের মূলে ছিল এই মৈথিল (উত্তর বিহার) ব্রাহ্মণদের অভিবাসন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক কিংবা আরো পূর্ব থেকেই আরবি, ইরানি, তুর্কি, আফগান, মোগল ও আবিসিনীয়- বণিক-সুফি-সাধক-পীর-আউলিয়া আগমন সিলেটের ভাষা শুধু নয়, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনেও এনেছে ব্যতিক্রম ও বৈচিত্র্য।
১৮৫৮ সালে সিলেটে চা আবাদ শুরু হলে ভারতের তামিলনাড়–, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে প্রচুর জনগোষ্ঠীকে চা-বাগানের শ্রমিক বা কুলি হিসেবে সিলেটে অভিবাসিত করা হয়। ১৯০১ সালে এসে শুধু সিলেট জেলায় চালানী কুলির সংখ্যা ছিল ১৫৩৮৫০ জন (অচ্যুতচরণ, ২০০৪: ৫৮০)। তৎকালীন মোট জনসংখ্যার প্রায় ০৭% ভাগ বিভিন্ন ভাষাভাষী এ বিরাট জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে এসে এখানকার ভাষা ও সমাজ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে (জরুার, ১৯৭০: ১৩৬)। নৃগোষ্ঠী হিসেবে সিলেটের চা-শ্রমিকরা উড়িয়া, র্যালি, কল, গড় ও মীর্দা প্রভৃতি বলে গবেষকগণ মনে করেন। এদের চেহারায় আদি-অস্ট্রাল জাতির দেহ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বর্তমানে চা-বাগানে কর্মরত নারী, পুরুষ, শিশু ও অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৭২২, ৩৮৭৭৭, ১০০৫৩ ও ১৭৭৪২ জন (আশ্রাফুল, ২০০৯ : ১৭৩)। অবশ্য তামিলনাড়– রাজ্য থেকে সিলেটে আসা তামিল চা শ্রমিকদের তামিল ভাষা- দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। এছাড়াও সিলেটের চা বাগানে অল্প কিছু ওঁরাও বাস করে। এদের কুডুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা। কুডুখ দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। নৃতাত্তি¡ক দিক থেকে ওঁরাওদের দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে (সৌরভ, ২০১১: ১৯৫)।
ইংরেজ আমলে বাঙালি ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী অভিবাসিত হলে সিলেটের সমাজ-সংস্কৃতি ও ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আর বিশ শতকের শুরুতেই সিলেট মুসলিমপ্রধান অঞ্চল হয়ে ওঠে। এই মুসলিম জন সম্পর্কে অজয় রায়’র মন্তব্য স্মরণীয় : ‘বাঙালি মুসলিম জন মূলত তিনটি উপাদানের সংকর জন : (১) বিদেশি বা আগন্তুক বিভিন্ন নৃজাতিরূপের মুসলিম উপাদান, (২) মিশ্র উপাদান ও (৩) ধর্মান্তরিত উপাদান। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ই বাংলার জনগণের সত্যিকার গড় প্রতিনিধি, কারণ ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত সর্বজনীন উদারতার কারণে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে জাতিভেদ প্রথার মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও কোমদের মধ্যে আন্তর্মিলনে কোনো দুস্তর ব্যবধান রচনা করেনি, বরং সমাজ সচেতনতা-বৃদ্ধির সঙ্গে সম্ভ্রান্ত-অসম্ভ্রান্ত, উপরতলা-নিচুতলার মানুষের মিলনের পথকে প্রশস্ততর করেছে। তাই মুসলিম জনগোষ্ঠীতে দ্রুত সমরূপীয় জাতিরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হতে চলেছে। … সুতরাং শুধু ভাষা-সংস্কৃতিতেই নয়, নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও মুসলিম জনগোষ্ঠী বাঙালিজনের সার্থক প্রতিনিধি।’ (অজয়, ২০০৮: ১১৪)। অনুমান করা যায় মুসলিম প্রাধান্যের সূত্রেই সিলেটে বাঙালি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন বাঙালি হিন্দু ছাড়াও- টিপরা, খাসিয়া, মণিপুরী, গারো ও কুকি প্রভৃতি নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী সিলেটের অধিবাসী ছিল। এরা কিছুটা নৃগোষ্ঠিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র ও মূল বঙ্গীয় সংস্কৃতির স্রোত থেকে পৃথক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক জনগোষ্ঠী। যদিও বর্তমানে ট্রাইব-সংগঠন বাংলাদেশের ভেতর কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেই বললে চলে (অজয়, ২০০৮ : ১১৫)। টিপরা বা ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষা আসাম-বর্মি শাখার বোড়ো গোষ্ঠীর অন্তর্গত। গবেষকগণ মনে করেন ত্রিপুরাগণ প্রাচীন কামরূপের কাম জনগোষ্ঠীরই একটি বিশেষ শাখা। খাসিয়া বা খাসিদের অবয়ব-বৈশিষ্ট্যে মঙ্গোলীয় লক্ষণ অধিক হলেও, এদের মধ্যে আদি অস্ট্রেলয়েড মিশ্রণ ঘটেছে। খাসিদের ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা- গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যা প্রমাণ করে যে খাসি জাতি একসময়ে শক্তিশালী কোনো আদি অস্ট্রেলয়েড কোনো জনগোষ্ঠী দ্বারা বিজিত হয়েছিল। মণিপুরীদের মধ্যে মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্য থাকলেও এরা সুন্দর দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী, এ থেকে অনুমিত হয় এদের সঙ্গে কোনো এক সময়ে ইন্দো-ভূমধ্য নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত কোনো নৃজাতিরূপের জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে। ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত- মৈতেয় মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতেয় মণিপুরী ভাষা আসাম-বর্মি উপশাখার কুকি-চিন গোষ্ঠীর অন্তর্গত। অন্যদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত (সৌরভ, ২০১১: ১৮)। গারোগণ আসাম-উপত্যকা থেকে আগত মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গারো ভাষা বড়ো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কুকিদের অন্য নাম হচ্ছে লুসাই, মিজো, লুসেই, হুয়ালাংগো ইত্যাদি। কুকি ভাষা মূলত সিনো-টিবোটিয়ান ভাষা-পরিবারভুক্ত কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত। বর্তমান সিলেটে কুকিদের পাওয়া না গেলেও সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতিতে এদের প্রবল প্রভাব রয়েছে।
সিলেটে অভিবাসিত ব্রাহ্মণদের হাতে যেমন সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা হয়েছে, তেমনি শিক্ষিত এই ব্রাহ্মণদের ধর্মান্তরিত মুসলিম হয়ে সিলেটি নাগরি লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টিতেও অবদান রাখতে দেখা যায়। চাকরি বা অভিবাসন সূত্রে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী কিংবা ইমিগ্রান্ট সিলেটি বংশোদ্ভব জনগোষ্ঠী সিলেটের উপভাষা ব্যবহারে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে দ্বিভাষিক (নরষরহমঁধষ) এই বিপুল জনগোষ্ঠীর কারণে সিলেটে প্রচুর বিদেশি সংস্কৃতি ও ভাষিক উপাদান প্রবেশ করছে।
ভাষাবিজ্ঞানীগণের আলোচিত বাংলা ভাষার উপভাষা ও সিলেটের উপভাষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত-মন্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় : বাংলা উপভাষা বিশ্লেষণে অধিকাংশ বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী গ্রিয়ার্সনের ‘উপাত্ত-খনি’ নির্ভর। অথচ গ্রিয়ার্সনের উপাদান বাংলাদেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক নয় (রফিকুল, ১৯৯৮: ৭৮); তাঁর সিলেটের উপভাষা সংগ্রহও সিলেটে অভিবাসিত ‘ননসিলেটি’ বাঙালি সংগ্রাহক কর্তৃক প্রভাবিত। আমরা মুনীর চৌধুরী ও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ প্রমুখ অনুসৃত সাংগঠনিক পদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলা ভাষার উপভাষার নতুন শ্রেণিকরণ প্রস্তাব করছি। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনেকটা বিচ্ছিন্ন। এ বিষয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার ও মহাম্মদ দানীউল হক প্রমুখের সমর্থন সূত্রও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আমরা তাই এ তিনটি আঞ্চলিক ভাষাকে একত্রে ‘প্রান্তবঙ্গীয়’ নাম প্রস্তাব করছি (শ্যামল, ২০১৩: ৬১)। জীবনধারার দিকে তাকালেও দেখা যায় : সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর শুকনো মাছ বা শুঁটকি এবং আতপ চাল প্রিয়তা এ অঞ্চলে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর প্রভাব-জাত আদিম জীবনধারার সাদৃশ্যের লক্ষণ। আমাদের মনে হয়েছে সিলেটের উপভাষা বাংলার একটি স্বতন্ত্র উপভাষা : যেখানে বঙ্গ ও কামরূপী’র মিশ্রণ প্রচুর। যেখানে চর্যাপদের কালেও বাংলা, ওড়িয়া ও কামরূপী অভিন্ন ভাষা ছিল। স্থানিক বৈচিত্র্য থাকলেও, বর্তমানে সিলেট শহরকেন্দ্রিক এর একটি মান্যরূপও পাওয়া যায়। সিলেটের উপভাষার প্রচলিত বিভিন্ন উপবিভাজন বিতর্ক পরিহার করে আমাদের ক্ষেত্র-কর্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নদী-অববাহিকা কেন্দ্রিক উপবিভাজন উদাহরণসহ উপস্থাপন করছি। উপবিভাজনে আমরা লক্ষ করেছি নদী-অববাহিকা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা জনবসতি কিংবা জন-অভিবাসন ও নদীপথে যোগাযোগ উপভাষায় বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে কার্যকর। অবশ্য নদীকেন্দ্রিক এই বিভাজন সব সময় সক্রিয় নয়; পাহাড়-টিলার যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা কিংবা নদী-সড়ক-রেলপথে যোগাযোগের সহজলভ্যতা এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে প্রায়শ। তবু আমরা দেখি সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু এই তিন নদীর মিলিত অববাহিকাতেই গড়ে উঠেছে সিলেটি বাংলার কেন্দ্রীয় উপভাষা। যদিও গ্রিয়ার্সনের দৃষ্টিতে, ঞযব ঃবৎস ড়ভ দঝুষযবঃরধদ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু সবধহং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঃড়হি ধহফ হড়ঃ ড়ভ ঃযব ফরংঃৎরপঃ ড়ভ ঝুষযবঃ’. (এৎরবৎংড়হ, ১৯০৩: ২২১)। তবু বর্তমান বাস্তবতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আর বৃহত্তর সিলেটবাসীর সিলেটি পরিচয়ের গর্ব শত বছর আগের শহরের উপভাষাকে এনে দিয়েছে মান উপভাষার মর্যাদা। আমাদের ব্যবহৃত শ্রেণিকরণের আলোকে অঞ্চলভেদে তথা নির্দিষ্ট সিলেটের মান-উপভাষার যে প্রকারভেদ বা বিভিন্নতা (াধৎরবঃু) বৃহত্তর সিলেটে পরিলক্ষিত হয় তার বর্ণালীটি (ংঢ়বপঃৎঁস) এ ভাবে দেখানো যায় :
প্রমিত বাংলা ভাষায় : আমি ভাত খাচ্ছি।
১. সিলেট জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. সুরমা-কুশিয়ারা নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খাইরাম।
খ. গোয়াইন নদী-অববাহিকায় : ময় ভাত খায়রাম।
গ. সুনাই নদী-অববাহিকায় : মুই ভাত খাইতরাম।
২. মৌলভীবাজার জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. মনু-ধলাই নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খারাম।
খ. জুড়ি নদী-অববাহিকায় : মুই ভাত খাইয়ার।
৩. হবিগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. খোয়াই-সুতাং নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খাইতাসি।
খ. বলভদ্র-সুনাই নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইত্যাসি।
গ. বরাক নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইতেসি।
৪. সুনামগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. সুরমা-বরাক নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খায়ার / খাইতেছি।
খ. বাউলি-সোমেশ্বরী নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইতাছি।
এভাবে বাংলাদেশের বাইরে বসবাসকারী সিলেটি বাংলা ভাষাভাষী তথা বহিঃস্থ সিলেটি উপভাষায়ও পার্থক্য রয়েছে। যেমনটা বার্মিংহাম ও লন্ডনের সিলেটি ভাষীদের মধ্যেও পার্থক্য থাকা সম্ভব (মনিরুজ্জামান, ১৯৯৪: ৪১১)। তবে এ ধরনের পার্থক্য-বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সমস্ত সিলেট ভূ-খণ্ডের উপভাষাকে যেমন মুহম্মদ আবদুল হাই সিলেটি বলে মানতে বাধ্য হন (হাই, ১৯৯৪: ৬২৩); তেমনি মনসুর মুসাও স্বীকার করেন : এমন না হলে একেবারে হবিগঞ্জের ভাষা, সুনামগঞ্জের ভাষা আর করিমগঞ্জের ভাষা হয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে। সুতরাং বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে সিলেটি ভাষার উপভাষিক অবস্থান স্থির থাকলে অন্যান্য বিভাজনগুলো উপবিভাজনের আওতায় আসতে পারে (মনসুর, ১৯৯৯: ৪৬৬)। আর তাই ‘প্রতি পাঁচ মাইল অন্তর ভাষা বদলে যায়’ ম্যাক্সমুলারের উক্তি স্মরণ রেখেও বলা যায়- বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বাংলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষা যা বাংলা ভাষার একটি দূরবর্তী উপভাষা। অবশ্য সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এ উপভাষাতেও নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, গ্রাম-শহর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও বিভিন্ন পেশাজীবীর পেশা ভেদে ভাষার পার্থক্য বিদ্যমান।
সিলেটের উপভাষার ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনায় চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরী (১৯৬০) অনুসরণে মূলধ্বনিতত্ত্বের (ঢ়যড়হবসরপ) দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেটের উপভাষার ধ্বনিমূলসমূহ এবং এদের সহধ্বনিসমূহ নির্দেশ করে, এ উপভাষার কোনো ধ্বনির জন্য বাংলা ভাষার কোনো প্রতীক বা বর্ণ বা লিপি ব্যবহৃত হতে পারে তার প্রস্তাব করছি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বৈয়াকরণ ও ভাষাতাত্তি¡কগণের মতামত পর্যালোচনা করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ড. রামেশ্বর শ’ (১৯৯২) অনুসরণে প্রলম্বিত ন্যূনতম শব্দজোড় (পযধরহবফ সরহরসধষ ঢ়ধরৎ) এর মাধ্যমে আমরা সিলেটের উপভাষায় (০৯) নয়টি স্বরধ্বনিমূল (যথা- ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ, ঁ এবং সুর/য) এবং (২৯) ঊনত্রিশটি ব্যঞ্জনধ্বনিমূল ( যথা- স্পর্শ ধ্বনি : ব, ভ, ত, থ, দ, ধ, ট, ঠ, ড, ঢ, ক, খ, গ, ঘ; নাসিক্য ধ্বনি: ম, ন, ঙ; উষ্ম ধ্বনি: প, ফ, চ’, ছ’, জ’, ঝ’, শ, স, হ; কম্পিত, পার্শ্বিক ও তাড়িত ধ্বনি: র, ল, ড়।)-এর অস্তিত্ব পেয়েছি। দেখা গেছে : প্রমিত বাংলা ভাষার বেশ কিছু স্পর্শধ্বনি সিলেটে কিছুটা উষ্মধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়, এমনকি /ক/ এর উচ্চারণ /ক/ ও /খ/-এর মাঝামাঝি এবং /প/ এর উচ্চারণ /প/ ও /ফ/-এর মাঝামাঝি হয়। এ কারণে অনেকে /ক/ ও /প/ ধ্বনি সিলেটের উপভাষায় ব্যবহার করেননি। অথচ আমরা দেখেছি এ দুটি ধ্বনিমূলের কিছু সহধ্বনি এমন হলেও, মূল বা অভিন্ন উচ্চারণও আছে। আমরা তাই সিলেটের উপভাষা লিখতে প্রমিত বাংলার সকল বর্ণই ব্যবহারের পক্ষপাতী। বাংলাতেও অনেক বর্ণের উচ্চারণ সব পরিবেশে এক নয়; বিশেষত তৎসম শব্দে সংস্কৃত বানান ব্যবহৃত হলেও উচ্চারণ বাংলা, যেমন- জ্ঞান, বিজ্ঞান, ক্ষুধা, পরীক্ষা ইত্যাদি। সুতরাং সিলেটেও ‘খ’-র উচ্চারণ-[ শ? ], [ স্ট ] বা [ ী ] যে সহধ্বনি রূপেই উচ্চারিত হোক আমরা ‘খ’ ব্যবহার করতে চাই, একই কথা ‘ক’-এর ক্ষেত্রেও। যেমন-‘ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর/ কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাজার’। এখানে করি [ স্টড়ৎর] আর কী [ শর:] শব্দ দুটিতে ক এর উচ্চারণ এক নয়। তবু আমরা উভয় স্থানে ক ব্যবহার করব; পাঠক ব্যাকরণসূত্রে জানবেন কখন ক-এর উচ্চারণ বদলায়। আমরা মনে করি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে- বিভেদ নয় ঐক্য; বৈচিত্র্যের সহাবস্থান নিয়ে সমৃদ্ধির অভিমুখে অগ্রসর হওয়া।
সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
কহিলেন যেন মত আছিলেন বঙ্গে \
বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া \
বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া।
কদর্থেন সেই মত বচন বলিয়া\
অর্থাৎ শ্রী চৈতন্যকেও সিলেটি লোকের সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে হতো। মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, সৈয়দ মুর্তজা আলী প্রমুখ নিজেদের যুক্তি প্রমাণে দেখিয়েছেন চর্যাপদগুলোর সাথে সিলেটি ভাষার সাদৃশ্য। আর হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিম প্রমুখের বৈষ্ণব-সুফি ও বাউল সঙ্গীতের ভাষার কথা তো সবার জানা। সুতরাং স্থানগত বৈচিত্র্য থাকলেও বৃহত্তর সিলেটের ভাষাকে বাংলা ভাষার একটি সমৃদ্ধ উপভাষা বলে স্বীকার করে নেয়া সঙ্গত।
সিলেটের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এখানকার উপভাষার অবস্থান চট্টগ্রামের উপভাষার মতো একটি দূরবর্তী উপভাষিক অবস্থান গ্রহণের স্বরূপ অনুসন্ধান অত্যাবশ্যক। আমরা লক্ষ করেছি বিস্তীর্ণ হাওর-বিলের ব্যবধান এড়িয়ে নদীপথে বা জলপথে বাংলার সাথে ভৌগোলিক সংযোগ সিলেটের উপভাষাকে প্রমিত বাংলার সঙ্গে পরিপূরক অবস্থান তৈরি করেছে। আবার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী পাহাড়ি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর (খাসিয়া, ত্রিপুরী, অসমি, মণিপুরী ও কুকি বা লুসাই প্রভৃতি) ভাষা-প্রভাবও পুরোপুরি এড়াতে পারেনি। আদিবাসী সহজ-সরল জীবনধারার অনেক বৈশিষ্ট্যও এ অঞ্চলে সক্রিয়। খাসিয়াদের উৎপাদিত খাসিয়াপানের পাশাপাশি পান-সুপারি পরিবেশন সিলেটের যে কোনো অনুষ্ঠানে আজও আছে। ত্রিপুরীদের বাঁশের ভেতর ভাত রান্নার অনুকরণে বাঁশের ভেতর বিন্নিচাল দিয়ে তৈরি ‘চুঙগা পিঠা’ সিলেটে এখনও জনপ্রিয়। অসমি সংস্কৃতির গামছা, মণিপুরী সংস্কৃতির মণিপুরী নৃত্য আর মণিপুরী পোশাক ছাড়াও কুকি বা লুসাইগণের ব্যবহার্য তিন-চার ফুট উঁচু বাঁশের ওপর জুতোর মতো বানানো কুকিরখড়ম পায়ে দিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা- প্রাচীন জীবনধারার পরিচায়ক। কুকিগণ বাঁশ ও বাঁশের তৈরি বেত দিয়ে ঘর এবং বাঁশের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি তৈরি করতো। সিলেট অঞ্চলে বাঁশ ও বেতের বহুল ব্যবহার এবং খ্যাতি- কুকি (খযড়ংংধর) সংস্কৃতির স্মারক বলে আমাদের মনে হয়।
নৃতত্ত্ব-ভাষা এমনকি জীবনধারা অধ্যয়নের অংশ হিসেবে স্থাননাম গুরুত্বপূর্ণ। সিলেটের নামকরণ আলোচনায় আমরা পাই- মহাকাব্যে এ অঞ্চলটির নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষ, পুরাণে তা কামরূপ-কামাক্ষ্যা, পরবর্তীতে শ্রীহট্ট ও অসম, বর্তমানে সিলেট ও আসাম। আমাদের মনে হয়েছে, প্রাচীন চীনা-তিব্বতীয় ‘কিরাত’ জাতির বাসস্থান শতম ভাষাগোষ্ঠীর উচ্চারণে ‘সিরাত’, আর্যায়ণের ফলে ‘শ্রীহট্ট’ এবং ইংরেজদের হাতে সমান্তরাল নামায়ন বা নতুন নামকরণ হয় ‘সিলেট’।
সিলেটের ভাষাপরিস্থিতি অনুধাবনের লক্ষ্যে সিলেটের ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে জোরালো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও অনুমান করা যায় সিলেটে অনার্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দেরও আগে। আর খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে বাংলায় আর্য-প্রবেশ শুরু হলেও প্রায় হাজার বছর পর- খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে সিলেটে আর্য-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পায়। এর প্রমাণ পাই মহাকাব্য থেকে- মহাভারত-এ অর্জুন-ভগদত্ত’র যুদ্ধ আমাদের কাছে আর্য-অনার্য’র যুদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। এ যুদ্ধে আর্যদের জয়ে সূচিত হয় আর্যভাষারও জয়।
এর পর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে সিলেটের ইতিহাস পাই বিভিন্ন তাম্রশাসন আর পরিভ্রাজকগণের ভ্রমণ-বিবরণী থেকে। সেখানে সিলেট অধিকাংশ সময় কামরূপের অধীন মাঝেমধ্যে ত্রিপুরা কিংবা বঙ্গ কর্তৃক বিজিত। ফলে শাসকগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে এ সময় কামরূপী, বাংলা ও ককবরক ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে স্বাভাবিকভাবেই। সিলেটে প্রথম মুসলিম শাসক মালিক ইয়াজবেগ (১২৫৩ খ্রি.); তবে তিনি মাত্র কয়েক বছর শাসনের পরই আসাম-অভিযানে নিহত হন। এ সময়ে সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ। এরপর হযরত শাহজালাল (রা.) এর সিলেট আগমন (১৩৫৪ খ্রি.) এবং তাঁর সহায়তায় সিকান্দর গাজি সিলেট জয় করেন। তবে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেইন শাহ’র সময়ে (১৪৯৬-১৫১৬) তাঁর সেনাপতি রুকুন খান সিলেটের শাসক হয়ে আসলে সিলেটে ইসলাম ধর্মান্তরের (ওংষধসরংবফ) জোয়ার ঘটে। এতে স্থানীয় ভাষারও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয় আরবি-ফারসির প্রভাবে। তবে শ্রীচৈতন্যের সিলেট আগমনে (১৫০৯ খ্রি.) এতে ভাটা পড়ে এবং আবার সংস্কৃতায়ন শুরু হয়। মধ্যযুগে আসাম-কোচবিহার-ত্রিপুরার পাশাপাশি স্বাধীন সামন্ত কিংবা বিদ্রোহী পাঠান সামন্ত কর্তৃক সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল শাসিত হয় এবং তাঁদের ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সিলেট ইংরেজ শাসনাধীন হয় ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তবে মোগল আমল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনামলের ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটে খাসিয়া ও কুকিদের আক্রমণ-হত্যা ও লুণ্ঠন-আতঙ্ক ছিল। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) পরেও সিলেট সুরমা উপত্যকা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত থাকে একই বিভাগে আরো ছিল- কাছাড়, খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া পাহাড়, নাগা পাহাড় ও লুসাই পাহাড়। আবার বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) হলেও সিলেট রয়ে যায় আসাম প্রদেশে। এই রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অপঘাত সম্বন্ধে মর্মাহত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীভূমি কবিতায় লিখেছেন :
‘মমতা বিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি
ভারতী আপন পুণ্য হাতে
বাঙালির হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া,
সে বাঁধন চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙালির আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’
১৯৪৭-এ রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলেও, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা জনগণের আবাসভূমি- করিমগঞ্জ, শিলচর, কাছাড় ও হালিয়াকান্দি ভারতের আসাম রাজ্যের চার জেলা হয়ে রয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসকগণকেও সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ কারণে বাংলার সাথে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাও প্রমিত বাংলার সাথে সিলেটের উপভাষার দূরত্বের প্রভাবক। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের আমল (১৯৯১-????) থেকে এই অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা বিস্তার, আধুনিকায়ন, নগরায়ন ও বিশ্বায়নের অভিঘাতে উপভাষার ব্যবধান ও ব্যাপ্তি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে।
সিলেটের মানব সমাজের ইতিহাস : সভ্যতা ও সংস্কৃতি আলোচনায় দেখা যায় সিলেটের সভ্যতা বিনির্মাণে ধারাবাহিকভাবে অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় ও আর্য (আলপীয় ও নর্ডিক) জাতির অবদান। আমাদের মনে হয় সিলেটের মানব সমাজে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণ বাংলার তুলনায় অধিক। এখানকার ‘নিষাদ’রা অস্ট্রিক-দ্রাবিড় আর ‘কিরাত’রা ছিল মঙ্গোল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে কামরূপ রাজ ভূতিবর্মার (৫১৮-৫৪২) ঔদার্যে ব্রাহ্মণরা নিষ্কর ভূমি লাভ করেন; সেন বংশের শাসনামলে (১১শতক) বৌদ্ধদের বিতাড়িত করতে শাসকগণ উত্তর ভারত থেকে পঞ্চগোত্রীয় ব্রাহ্মণদের সিলেটে অভিবাসিত করেন; মধ্যযুগের মোগল শাসক নিযুক্ত ফৌজদারবৃন্দও ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করেছিলেন। সিলেটে উচ্চবর্ণ হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের মূলে ছিল এই মৈথিল (উত্তর বিহার) ব্রাহ্মণদের অভিবাসন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক কিংবা আরো পূর্ব থেকেই আরবি, ইরানি, তুর্কি, আফগান, মোগল ও আবিসিনীয়- বণিক-সুফি-সাধক-পীর-আউলিয়া আগমন সিলেটের ভাষা শুধু নয়, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনেও এনেছে ব্যতিক্রম ও বৈচিত্র্য।
১৮৫৮ সালে সিলেটে চা আবাদ শুরু হলে ভারতের তামিলনাড়–, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে প্রচুর জনগোষ্ঠীকে চা-বাগানের শ্রমিক বা কুলি হিসেবে সিলেটে অভিবাসিত করা হয়। ১৯০১ সালে এসে শুধু সিলেট জেলায় চালানী কুলির সংখ্যা ছিল ১৫৩৮৫০ জন (অচ্যুতচরণ, ২০০৪: ৫৮০)। তৎকালীন মোট জনসংখ্যার প্রায় ০৭% ভাগ বিভিন্ন ভাষাভাষী এ বিরাট জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে এসে এখানকার ভাষা ও সমাজ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে (জরুার, ১৯৭০: ১৩৬)। নৃগোষ্ঠী হিসেবে সিলেটের চা-শ্রমিকরা উড়িয়া, র্যালি, কল, গড় ও মীর্দা প্রভৃতি বলে গবেষকগণ মনে করেন। এদের চেহারায় আদি-অস্ট্রাল জাতির দেহ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বর্তমানে চা-বাগানে কর্মরত নারী, পুরুষ, শিশু ও অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৭২২, ৩৮৭৭৭, ১০০৫৩ ও ১৭৭৪২ জন (আশ্রাফুল, ২০০৯ : ১৭৩)। অবশ্য তামিলনাড়– রাজ্য থেকে সিলেটে আসা তামিল চা শ্রমিকদের তামিল ভাষা- দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। এছাড়াও সিলেটের চা বাগানে অল্প কিছু ওঁরাও বাস করে। এদের কুডুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা। কুডুখ দ্রাবিড়ীয় ভাষা বংশের সদস্য। নৃতাত্তি¡ক দিক থেকে ওঁরাওদের দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে (সৌরভ, ২০১১: ১৯৫)।
ইংরেজ আমলে বাঙালি ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী অভিবাসিত হলে সিলেটের সমাজ-সংস্কৃতি ও ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আর বিশ শতকের শুরুতেই সিলেট মুসলিমপ্রধান অঞ্চল হয়ে ওঠে। এই মুসলিম জন সম্পর্কে অজয় রায়’র মন্তব্য স্মরণীয় : ‘বাঙালি মুসলিম জন মূলত তিনটি উপাদানের সংকর জন : (১) বিদেশি বা আগন্তুক বিভিন্ন নৃজাতিরূপের মুসলিম উপাদান, (২) মিশ্র উপাদান ও (৩) ধর্মান্তরিত উপাদান। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ই বাংলার জনগণের সত্যিকার গড় প্রতিনিধি, কারণ ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত সর্বজনীন উদারতার কারণে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে জাতিভেদ প্রথার মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও কোমদের মধ্যে আন্তর্মিলনে কোনো দুস্তর ব্যবধান রচনা করেনি, বরং সমাজ সচেতনতা-বৃদ্ধির সঙ্গে সম্ভ্রান্ত-অসম্ভ্রান্ত, উপরতলা-নিচুতলার মানুষের মিলনের পথকে প্রশস্ততর করেছে। তাই মুসলিম জনগোষ্ঠীতে দ্রুত সমরূপীয় জাতিরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হতে চলেছে। … সুতরাং শুধু ভাষা-সংস্কৃতিতেই নয়, নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও মুসলিম জনগোষ্ঠী বাঙালিজনের সার্থক প্রতিনিধি।’ (অজয়, ২০০৮: ১১৪)। অনুমান করা যায় মুসলিম প্রাধান্যের সূত্রেই সিলেটে বাঙালি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন বাঙালি হিন্দু ছাড়াও- টিপরা, খাসিয়া, মণিপুরী, গারো ও কুকি প্রভৃতি নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী সিলেটের অধিবাসী ছিল। এরা কিছুটা নৃগোষ্ঠিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র ও মূল বঙ্গীয় সংস্কৃতির স্রোত থেকে পৃথক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক জনগোষ্ঠী। যদিও বর্তমানে ট্রাইব-সংগঠন বাংলাদেশের ভেতর কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেই বললে চলে (অজয়, ২০০৮ : ১১৫)। টিপরা বা ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষা আসাম-বর্মি শাখার বোড়ো গোষ্ঠীর অন্তর্গত। গবেষকগণ মনে করেন ত্রিপুরাগণ প্রাচীন কামরূপের কাম জনগোষ্ঠীরই একটি বিশেষ শাখা। খাসিয়া বা খাসিদের অবয়ব-বৈশিষ্ট্যে মঙ্গোলীয় লক্ষণ অধিক হলেও, এদের মধ্যে আদি অস্ট্রেলয়েড মিশ্রণ ঘটেছে। খাসিদের ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা- গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যা প্রমাণ করে যে খাসি জাতি একসময়ে শক্তিশালী কোনো আদি অস্ট্রেলয়েড কোনো জনগোষ্ঠী দ্বারা বিজিত হয়েছিল। মণিপুরীদের মধ্যে মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্য থাকলেও এরা সুন্দর দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী, এ থেকে অনুমিত হয় এদের সঙ্গে কোনো এক সময়ে ইন্দো-ভূমধ্য নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত কোনো নৃজাতিরূপের জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে। ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত- মৈতেয় মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতেয় মণিপুরী ভাষা আসাম-বর্মি উপশাখার কুকি-চিন গোষ্ঠীর অন্তর্গত। অন্যদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত (সৌরভ, ২০১১: ১৮)। গারোগণ আসাম-উপত্যকা থেকে আগত মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গারো ভাষা বড়ো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কুকিদের অন্য নাম হচ্ছে লুসাই, মিজো, লুসেই, হুয়ালাংগো ইত্যাদি। কুকি ভাষা মূলত সিনো-টিবোটিয়ান ভাষা-পরিবারভুক্ত কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত। বর্তমান সিলেটে কুকিদের পাওয়া না গেলেও সিলেটি ভাষা ও সংস্কৃতিতে এদের প্রবল প্রভাব রয়েছে।
সিলেটে অভিবাসিত ব্রাহ্মণদের হাতে যেমন সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা হয়েছে, তেমনি শিক্ষিত এই ব্রাহ্মণদের ধর্মান্তরিত মুসলিম হয়ে সিলেটি নাগরি লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টিতেও অবদান রাখতে দেখা যায়। চাকরি বা অভিবাসন সূত্রে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী কিংবা ইমিগ্রান্ট সিলেটি বংশোদ্ভব জনগোষ্ঠী সিলেটের উপভাষা ব্যবহারে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে দ্বিভাষিক (নরষরহমঁধষ) এই বিপুল জনগোষ্ঠীর কারণে সিলেটে প্রচুর বিদেশি সংস্কৃতি ও ভাষিক উপাদান প্রবেশ করছে।
ভাষাবিজ্ঞানীগণের আলোচিত বাংলা ভাষার উপভাষা ও সিলেটের উপভাষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত-মন্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় : বাংলা উপভাষা বিশ্লেষণে অধিকাংশ বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী গ্রিয়ার্সনের ‘উপাত্ত-খনি’ নির্ভর। অথচ গ্রিয়ার্সনের উপাদান বাংলাদেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক নয় (রফিকুল, ১৯৯৮: ৭৮); তাঁর সিলেটের উপভাষা সংগ্রহও সিলেটে অভিবাসিত ‘ননসিলেটি’ বাঙালি সংগ্রাহক কর্তৃক প্রভাবিত। আমরা মুনীর চৌধুরী ও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ প্রমুখ অনুসৃত সাংগঠনিক পদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলা ভাষার উপভাষার নতুন শ্রেণিকরণ প্রস্তাব করছি। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনেকটা বিচ্ছিন্ন। এ বিষয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার ও মহাম্মদ দানীউল হক প্রমুখের সমর্থন সূত্রও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আমরা তাই এ তিনটি আঞ্চলিক ভাষাকে একত্রে ‘প্রান্তবঙ্গীয়’ নাম প্রস্তাব করছি (শ্যামল, ২০১৩: ৬১)। জীবনধারার দিকে তাকালেও দেখা যায় : সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর শুকনো মাছ বা শুঁটকি এবং আতপ চাল প্রিয়তা এ অঞ্চলে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর প্রভাব-জাত আদিম জীবনধারার সাদৃশ্যের লক্ষণ। আমাদের মনে হয়েছে সিলেটের উপভাষা বাংলার একটি স্বতন্ত্র উপভাষা : যেখানে বঙ্গ ও কামরূপী’র মিশ্রণ প্রচুর। যেখানে চর্যাপদের কালেও বাংলা, ওড়িয়া ও কামরূপী অভিন্ন ভাষা ছিল। স্থানিক বৈচিত্র্য থাকলেও, বর্তমানে সিলেট শহরকেন্দ্রিক এর একটি মান্যরূপও পাওয়া যায়। সিলেটের উপভাষার প্রচলিত বিভিন্ন উপবিভাজন বিতর্ক পরিহার করে আমাদের ক্ষেত্র-কর্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নদী-অববাহিকা কেন্দ্রিক উপবিভাজন উদাহরণসহ উপস্থাপন করছি। উপবিভাজনে আমরা লক্ষ করেছি নদী-অববাহিকা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা জনবসতি কিংবা জন-অভিবাসন ও নদীপথে যোগাযোগ উপভাষায় বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে কার্যকর। অবশ্য নদীকেন্দ্রিক এই বিভাজন সব সময় সক্রিয় নয়; পাহাড়-টিলার যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা কিংবা নদী-সড়ক-রেলপথে যোগাযোগের সহজলভ্যতা এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে প্রায়শ। তবু আমরা দেখি সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু এই তিন নদীর মিলিত অববাহিকাতেই গড়ে উঠেছে সিলেটি বাংলার কেন্দ্রীয় উপভাষা। যদিও গ্রিয়ার্সনের দৃষ্টিতে, ঞযব ঃবৎস ড়ভ দঝুষযবঃরধদ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু সবধহং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঃড়হি ধহফ হড়ঃ ড়ভ ঃযব ফরংঃৎরপঃ ড়ভ ঝুষযবঃ’. (এৎরবৎংড়হ, ১৯০৩: ২২১)। তবু বর্তমান বাস্তবতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আর বৃহত্তর সিলেটবাসীর সিলেটি পরিচয়ের গর্ব শত বছর আগের শহরের উপভাষাকে এনে দিয়েছে মান উপভাষার মর্যাদা। আমাদের ব্যবহৃত শ্রেণিকরণের আলোকে অঞ্চলভেদে তথা নির্দিষ্ট সিলেটের মান-উপভাষার যে প্রকারভেদ বা বিভিন্নতা (াধৎরবঃু) বৃহত্তর সিলেটে পরিলক্ষিত হয় তার বর্ণালীটি (ংঢ়বপঃৎঁস) এ ভাবে দেখানো যায় :
প্রমিত বাংলা ভাষায় : আমি ভাত খাচ্ছি।
১. সিলেট জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. সুরমা-কুশিয়ারা নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খাইরাম।
খ. গোয়াইন নদী-অববাহিকায় : ময় ভাত খায়রাম।
গ. সুনাই নদী-অববাহিকায় : মুই ভাত খাইতরাম।
২. মৌলভীবাজার জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. মনু-ধলাই নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খারাম।
খ. জুড়ি নদী-অববাহিকায় : মুই ভাত খাইয়ার।
৩. হবিগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. খোয়াই-সুতাং নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খাইতাসি।
খ. বলভদ্র-সুনাই নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইত্যাসি।
গ. বরাক নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইতেসি।
৪. সুনামগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষা-
ক. সুরমা-বরাক নদী-অববাহিকায় : আমি ভাত খায়ার / খাইতেছি।
খ. বাউলি-সোমেশ্বরী নদী-অববাহিকায় : আমি বা’ত খাইতাছি।
এভাবে বাংলাদেশের বাইরে বসবাসকারী সিলেটি বাংলা ভাষাভাষী তথা বহিঃস্থ সিলেটি উপভাষায়ও পার্থক্য রয়েছে। যেমনটা বার্মিংহাম ও লন্ডনের সিলেটি ভাষীদের মধ্যেও পার্থক্য থাকা সম্ভব (মনিরুজ্জামান, ১৯৯৪: ৪১১)। তবে এ ধরনের পার্থক্য-বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সমস্ত সিলেট ভূ-খণ্ডের উপভাষাকে যেমন মুহম্মদ আবদুল হাই সিলেটি বলে মানতে বাধ্য হন (হাই, ১৯৯৪: ৬২৩); তেমনি মনসুর মুসাও স্বীকার করেন : এমন না হলে একেবারে হবিগঞ্জের ভাষা, সুনামগঞ্জের ভাষা আর করিমগঞ্জের ভাষা হয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে। সুতরাং বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে সিলেটি ভাষার উপভাষিক অবস্থান স্থির থাকলে অন্যান্য বিভাজনগুলো উপবিভাজনের আওতায় আসতে পারে (মনসুর, ১৯৯৯: ৪৬৬)। আর তাই ‘প্রতি পাঁচ মাইল অন্তর ভাষা বদলে যায়’ ম্যাক্সমুলারের উক্তি স্মরণ রেখেও বলা যায়- বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বাংলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষা যা বাংলা ভাষার একটি দূরবর্তী উপভাষা। অবশ্য সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এ উপভাষাতেও নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, গ্রাম-শহর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও বিভিন্ন পেশাজীবীর পেশা ভেদে ভাষার পার্থক্য বিদ্যমান।
সিলেটের উপভাষার ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনায় চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরী (১৯৬০) অনুসরণে মূলধ্বনিতত্ত্বের (ঢ়যড়হবসরপ) দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেটের উপভাষার ধ্বনিমূলসমূহ এবং এদের সহধ্বনিসমূহ নির্দেশ করে, এ উপভাষার কোনো ধ্বনির জন্য বাংলা ভাষার কোনো প্রতীক বা বর্ণ বা লিপি ব্যবহৃত হতে পারে তার প্রস্তাব করছি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বৈয়াকরণ ও ভাষাতাত্তি¡কগণের মতামত পর্যালোচনা করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ড. রামেশ্বর শ’ (১৯৯২) অনুসরণে প্রলম্বিত ন্যূনতম শব্দজোড় (পযধরহবফ সরহরসধষ ঢ়ধরৎ) এর মাধ্যমে আমরা সিলেটের উপভাষায় (০৯) নয়টি স্বরধ্বনিমূল (যথা- ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ, ঁ এবং সুর/য) এবং (২৯) ঊনত্রিশটি ব্যঞ্জনধ্বনিমূল ( যথা- স্পর্শ ধ্বনি : ব, ভ, ত, থ, দ, ধ, ট, ঠ, ড, ঢ, ক, খ, গ, ঘ; নাসিক্য ধ্বনি: ম, ন, ঙ; উষ্ম ধ্বনি: প, ফ, চ’, ছ’, জ’, ঝ’, শ, স, হ; কম্পিত, পার্শ্বিক ও তাড়িত ধ্বনি: র, ল, ড়।)-এর অস্তিত্ব পেয়েছি। দেখা গেছে : প্রমিত বাংলা ভাষার বেশ কিছু স্পর্শধ্বনি সিলেটে কিছুটা উষ্মধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়, এমনকি /ক/ এর উচ্চারণ /ক/ ও /খ/-এর মাঝামাঝি এবং /প/ এর উচ্চারণ /প/ ও /ফ/-এর মাঝামাঝি হয়। এ কারণে অনেকে /ক/ ও /প/ ধ্বনি সিলেটের উপভাষায় ব্যবহার করেননি। অথচ আমরা দেখেছি এ দুটি ধ্বনিমূলের কিছু সহধ্বনি এমন হলেও, মূল বা অভিন্ন উচ্চারণও আছে। আমরা তাই সিলেটের উপভাষা লিখতে প্রমিত বাংলার সকল বর্ণই ব্যবহারের পক্ষপাতী। বাংলাতেও অনেক বর্ণের উচ্চারণ সব পরিবেশে এক নয়; বিশেষত তৎসম শব্দে সংস্কৃত বানান ব্যবহৃত হলেও উচ্চারণ বাংলা, যেমন- জ্ঞান, বিজ্ঞান, ক্ষুধা, পরীক্ষা ইত্যাদি। সুতরাং সিলেটেও ‘খ’-র উচ্চারণ-[ শ? ], [ স্ট ] বা [ ী ] যে সহধ্বনি রূপেই উচ্চারিত হোক আমরা ‘খ’ ব্যবহার করতে চাই, একই কথা ‘ক’-এর ক্ষেত্রেও। যেমন-‘ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর/ কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাজার’। এখানে করি [ স্টড়ৎর] আর কী [ শর:] শব্দ দুটিতে ক এর উচ্চারণ এক নয়। তবু আমরা উভয় স্থানে ক ব্যবহার করব; পাঠক ব্যাকরণসূত্রে জানবেন কখন ক-এর উচ্চারণ বদলায়। আমরা মনে করি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে- বিভেদ নয় ঐক্য; বৈচিত্র্যের সহাবস্থান নিয়ে সমৃদ্ধির অভিমুখে অগ্রসর হওয়া।
সিলেটের
উপভাষার রূপতত্ত্ব আলোচনায় দেখা গেছে প্রমিত বাংলায় না থাকলেও সিলেটের উপভাষায়
অতিরিক্ত বা খণ্ডাতিরিক্ত রূপমূল (ংঁঢ়ৎধ-ংবমসবহঃধষ সড়ৎঢ়যবসব)-এর বহুল উপস্থিতি
দূরবর্তী উপভাষা সৃষ্টিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। সিলেটের উপভাষার স্বতন্ত্র
বদ্ধরূপমূল (নড়ঁহফ সড়ৎঢ়যবসব)-এর বৈচিত্র্যও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক
রূপমূলতত্ত্বের এসব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও এখানে সিলেটের উপভাষায় প্রত্যয়, সর্বনামপদ,
ধাতু, বিভক্তি,
অনুসর্গ, উপসর্গ ও অনুকারশব্দ ইত্যাদির নির্মাণকৌশল
ও বৈচিত্র্য একে স্বতন্ত্র উপভাষা হিসেবে প্রমাণ করে। তবে আমাদের মনে হয়েছে এই
স্বাতন্ত্র্য ভাষার অন্তর্নিহিত কোনো জটিলতার কারণে নয়। বরং সিলেট বিভিন্ন সময়ে
রাজনৈতিকভাবে বৃহৎবঙ্গের বাইরে ছিটকে পড়েছিল,
তদুপরি
প্রাকৃতিক দুর্গমতার ফলে এ অঞ্চল প্রাকৃত এলাকা হিসেবে নিজস্ব পরিধি তৈরি করে তাতে
বিবর্তিত হয়েছে।
এ ভাবে আমরা জানি, সিলেটবাসীর ভাষা প্রমিত বাংলা থেকে দূরবর্তী। অর্থাৎ সিলেটের উপভাষার সাথে প্রমিত বাংলা ভাষার মিল বা বোধগম্যতার পরিমাণ অনেকটা অল্প। দূরবর্তী এমন উপভাষা নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হলে বাংলার সাথে এদের মিল-অমিলগুলো আবিষ্কৃত হবে। এতে এসব অঞ্চলের জনগণ আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন। পাশাপাশি একান্ত পরিবেশে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে হীনমন্যতা মুক্ত হবেন; আর সাধারণের মুখে স্বতঃস্ফ‚র্ত ব্যবহারের ফলে বাংলার বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক ভাষাগুলো বিশ্বায়নের জোয়ারে বিপন্ন (বহফধহমবৎবফ) হবে না। অবশ্য আমাদের মনে হয়েছে, এসব উপভাষাকে রক্ষা করতে- রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সার্বজনীন ভাষানীতি (ষধহমঁধমব ঢ়ড়ষরপু) গ্রহণপূর্বক ভাষা-পরিকল্পনা (ষধহমঁধমব ঢ়ষধহহরহম) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আশু আবশ্যক। তাই ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলার বিচিত্র উপভাষার ব্যাকরণ-সূত্র আবিষ্কৃত হলে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগরীতি সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব। সর্বোপরি চমস্কির ঁহরাবৎংধষ (ঈযড়সংশু: ১৯৬৫: ৪) তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো ভাষা বা উপভাষার ব্যাকরণ জানা অন্য ভাষার ব্যাকরণ জানার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং বলা যায় আঞ্চলিক ভাষার জ্ঞান অর্জন আমাদের মাতৃভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা, এভাবে আন্তর্জাতিক ভাষা অর্জনে বা ভাষা আয়ত্তীকরণে (ষধহমঁধমব ধপয়ঁরংরঃরড়হ) অবদান রাখবে। পাশাপাশি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবন-ধারা বা সংস্কৃতির অধ্যায়ন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে, বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে আমাদের মেলবন্ধন আরও দৃঢ়তর হবে।
এ ভাবে আমরা জানি, সিলেটবাসীর ভাষা প্রমিত বাংলা থেকে দূরবর্তী। অর্থাৎ সিলেটের উপভাষার সাথে প্রমিত বাংলা ভাষার মিল বা বোধগম্যতার পরিমাণ অনেকটা অল্প। দূরবর্তী এমন উপভাষা নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হলে বাংলার সাথে এদের মিল-অমিলগুলো আবিষ্কৃত হবে। এতে এসব অঞ্চলের জনগণ আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন। পাশাপাশি একান্ত পরিবেশে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে হীনমন্যতা মুক্ত হবেন; আর সাধারণের মুখে স্বতঃস্ফ‚র্ত ব্যবহারের ফলে বাংলার বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক ভাষাগুলো বিশ্বায়নের জোয়ারে বিপন্ন (বহফধহমবৎবফ) হবে না। অবশ্য আমাদের মনে হয়েছে, এসব উপভাষাকে রক্ষা করতে- রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সার্বজনীন ভাষানীতি (ষধহমঁধমব ঢ়ড়ষরপু) গ্রহণপূর্বক ভাষা-পরিকল্পনা (ষধহমঁধমব ঢ়ষধহহরহম) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আশু আবশ্যক। তাই ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলার বিচিত্র উপভাষার ব্যাকরণ-সূত্র আবিষ্কৃত হলে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগরীতি সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব। সর্বোপরি চমস্কির ঁহরাবৎংধষ (ঈযড়সংশু: ১৯৬৫: ৪) তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো ভাষা বা উপভাষার ব্যাকরণ জানা অন্য ভাষার ব্যাকরণ জানার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং বলা যায় আঞ্চলিক ভাষার জ্ঞান অর্জন আমাদের মাতৃভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা, এভাবে আন্তর্জাতিক ভাষা অর্জনে বা ভাষা আয়ত্তীকরণে (ষধহমঁধমব ধপয়ঁরংরঃরড়হ) অবদান রাখবে। পাশাপাশি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবন-ধারা বা সংস্কৃতির অধ্যায়ন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে, বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে আমাদের মেলবন্ধন আরও দৃঢ়তর হবে।
( সৌজন্য ; ভোরের কাগজ , ১৬ জুলাই /১৫ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন