সংস্কৃতি ও আমাদের সাংস্কৃতিক উল্টরাধিকার :
আবুল কাসেম ফজলুল হক
১. প্রস্তাবনা
এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার না বলে সংস্কৃতির ভিত্তিও বলা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় মনে করে প্রথমে সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে কিছু কথা বলব। ‘আমাদের’ বলে আমি ‘বাংলাদেশের জনগণের’ বুঝাচ্ছি। সহজেই বলা যায়, আমাদের সংস্কৃতি হলো আদিকাল থেকে বিকাশশীল এই ভূভাগের জনগণের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ আমাদের লক্ষ্য। আমি আলোচনা করব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে, জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে, জাতির অন্তর্গত সকল জনগোষ্ঠীর ও শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।
রাষ্ট্রীয় ভিন্নতার কারণে পশ্চিমবাংলার জনগণকে আমি এই বিবেচনার বাইরে রাখছি। তবে মনে রাখতে হবে, অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাষ্ট্রের পরিসর বিভিন্ন রকম ছিল। রাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে ছিল বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি ও নানা জনের কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রীয় অবস্থা যাই হোক, বাংলাভাষী গোটা ভূভাগজুড়ে, বাংলাভাষা সৃষ্টির পূর্ব থেকেই, মানুষের মধ্যে ছিল নানা রকম যোগাযোগ ও আদান-প্রদান। ক্রমে এই ভূভাগের জনগণের যাতায়াত এবং ভাবগত ও বস্তুগত আদান-প্রদান গোটা ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে পাহাড়, পর্বত ও সমুদ্র অতিক্রম করে ভারতবর্ষের বাইরে যাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। ভৌগোলিক বাস্তবতার ওপর গড়ে ওঠে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। মানবীয় সৃষ্টির অবলম্বন হয় প্রকৃতি। বিকাশশীল প্রকৃতির ওপর বিকাশমান আছে মানুষের সৃষ্টি। সেজন্য, অতীত সম্পর্কিত আলোচনায়, গোটা বাংলাভাষী ভূভাগের ও ভারতবর্ষের নানা কথা আসতে পারে। তা ছাড়াও আসতে পারে আরো নানা দেশের নানা জাতির কথা যাদের সঙ্গে এ জাতির মানুষের নানা রকম কর্মযোগ ও চিন্তাযোগ ছিল এবং আছে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান রাষ্ট্রিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থাও পরিবর্তনের মধ্যে আছে। কাল নিরবধি, পৃথ্বী বিপুলা, পরিবর্তন অনিবার্য।
কেবল বর্তমান ভেবে চলা যায় না, ভালোভাবে চলতে হলে অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হয়। কোনো বিষয়ের জ্ঞানই সে বিষয়ের ক্রমবিকাশের জ্ঞান ছাড়া পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। অধিকন্তু অতীত বর্তমানকে প্রভাবিত করে এবং ভবিষ্যতের গতি নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির প্রয়োজনে অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে পুনর্গঠিত করতে হয়। উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য সকল কাজের মধ্যে ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হয়।
উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শ্রমজীবী, বুদ্ধিজীবী, নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, রাখাইন, গারো, সাঁওতাল, গ্রামবাসী, শহরবাসী নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব) বা বাঙালি জাতি (হধঃরড়হ)। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ষোল কোটি। ভোটারের সংখ্যা সাড়ে নয় কোটি। বাংলাদেশের পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। হিন্দুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার আট শতাংশের মতো। জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধ শতাংশের কম। সকল পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে শহর ধরলে শহরবাসীর সংখ্যা চল্লিশ শতাংশের মতো এবং গ্রামবাসীর সংখ্যা ষাট শতাংশের মতো। নারী ও পুরুষের সংখ্যা মোটামুটি সমান। বিত্তভিত্তিক, শিক্ষাভিত্তিক ও ক্ষমতাভিত্তিক শ্রেণি ও শ্রেণিস্তরসমূহের জনসংখ্যা ও জনপ্রকৃতিও অনুসন্ধান করা যেতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমে মানুষের সৃষ্ট বৈষম্য ও অন্যায় কমাতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে ক্রমে এই সকল-জনগোষ্ঠীরই সংস্কৃতির সংশ্লেষণ (ংুহঃযবংরং) বাঞ্ছনীয়। জাতির ভেতরকার সকল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সংশ্লেষণ দ্বারা গঠিত হয় জাতির ব্যক্তিত্ব। জাতির অন্তর্গত প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যেখানে যা কিছু ভালো সেগুলোর প্রতি গ্রহিষ্ণু মনোভাব আর জাতীয় ঐক্যবোধ ও স্বদেশপ্রেম বাঞ্ছনীয়।
ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগিয়েছে প্রথমে সেভাবে দেখতে হবে, তারপর বিভিন্ন ঘটনার গুরুত্ব বিচারের প্রশ্ন। জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে সাধিত হয় জাতীয় উন্নতি। উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠী থেকে গ্রহণও করতে হয়।
এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার না বলে সংস্কৃতির ভিত্তিও বলা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় মনে করে প্রথমে সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে কিছু কথা বলব। ‘আমাদের’ বলে আমি ‘বাংলাদেশের জনগণের’ বুঝাচ্ছি। সহজেই বলা যায়, আমাদের সংস্কৃতি হলো আদিকাল থেকে বিকাশশীল এই ভূভাগের জনগণের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ আমাদের লক্ষ্য। আমি আলোচনা করব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে, জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে, জাতির অন্তর্গত সকল জনগোষ্ঠীর ও শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।
রাষ্ট্রীয় ভিন্নতার কারণে পশ্চিমবাংলার জনগণকে আমি এই বিবেচনার বাইরে রাখছি। তবে মনে রাখতে হবে, অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাষ্ট্রের পরিসর বিভিন্ন রকম ছিল। রাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে ছিল বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি ও নানা জনের কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রীয় অবস্থা যাই হোক, বাংলাভাষী গোটা ভূভাগজুড়ে, বাংলাভাষা সৃষ্টির পূর্ব থেকেই, মানুষের মধ্যে ছিল নানা রকম যোগাযোগ ও আদান-প্রদান। ক্রমে এই ভূভাগের জনগণের যাতায়াত এবং ভাবগত ও বস্তুগত আদান-প্রদান গোটা ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে পাহাড়, পর্বত ও সমুদ্র অতিক্রম করে ভারতবর্ষের বাইরে যাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। ভৌগোলিক বাস্তবতার ওপর গড়ে ওঠে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। মানবীয় সৃষ্টির অবলম্বন হয় প্রকৃতি। বিকাশশীল প্রকৃতির ওপর বিকাশমান আছে মানুষের সৃষ্টি। সেজন্য, অতীত সম্পর্কিত আলোচনায়, গোটা বাংলাভাষী ভূভাগের ও ভারতবর্ষের নানা কথা আসতে পারে। তা ছাড়াও আসতে পারে আরো নানা দেশের নানা জাতির কথা যাদের সঙ্গে এ জাতির মানুষের নানা রকম কর্মযোগ ও চিন্তাযোগ ছিল এবং আছে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান রাষ্ট্রিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থাও পরিবর্তনের মধ্যে আছে। কাল নিরবধি, পৃথ্বী বিপুলা, পরিবর্তন অনিবার্য।
কেবল বর্তমান ভেবে চলা যায় না, ভালোভাবে চলতে হলে অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হয়। কোনো বিষয়ের জ্ঞানই সে বিষয়ের ক্রমবিকাশের জ্ঞান ছাড়া পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। অধিকন্তু অতীত বর্তমানকে প্রভাবিত করে এবং ভবিষ্যতের গতি নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির প্রয়োজনে অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে পুনর্গঠিত করতে হয়। উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য সকল কাজের মধ্যে ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হয়।
উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শ্রমজীবী, বুদ্ধিজীবী, নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, রাখাইন, গারো, সাঁওতাল, গ্রামবাসী, শহরবাসী নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব) বা বাঙালি জাতি (হধঃরড়হ)। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ষোল কোটি। ভোটারের সংখ্যা সাড়ে নয় কোটি। বাংলাদেশের পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। হিন্দুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার আট শতাংশের মতো। জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধ শতাংশের কম। সকল পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে শহর ধরলে শহরবাসীর সংখ্যা চল্লিশ শতাংশের মতো এবং গ্রামবাসীর সংখ্যা ষাট শতাংশের মতো। নারী ও পুরুষের সংখ্যা মোটামুটি সমান। বিত্তভিত্তিক, শিক্ষাভিত্তিক ও ক্ষমতাভিত্তিক শ্রেণি ও শ্রেণিস্তরসমূহের জনসংখ্যা ও জনপ্রকৃতিও অনুসন্ধান করা যেতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমে মানুষের সৃষ্ট বৈষম্য ও অন্যায় কমাতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে ক্রমে এই সকল-জনগোষ্ঠীরই সংস্কৃতির সংশ্লেষণ (ংুহঃযবংরং) বাঞ্ছনীয়। জাতির ভেতরকার সকল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সংশ্লেষণ দ্বারা গঠিত হয় জাতির ব্যক্তিত্ব। জাতির অন্তর্গত প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যেখানে যা কিছু ভালো সেগুলোর প্রতি গ্রহিষ্ণু মনোভাব আর জাতীয় ঐক্যবোধ ও স্বদেশপ্রেম বাঞ্ছনীয়।
ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগিয়েছে প্রথমে সেভাবে দেখতে হবে, তারপর বিভিন্ন ঘটনার গুরুত্ব বিচারের প্রশ্ন। জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে সাধিত হয় জাতীয় উন্নতি। উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠী থেকে গ্রহণও করতে হয়।
২. জাতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ ও লক্ষ্য
ইংরেজি কালচারের ধারণা আত্মস্থ করে এবং নিজেদের জীবনধারা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে বাংলাভাষার সুধীব্যক্তিরা বাংলায় সংস্কৃতির ধারণাটি সৃষ্টি করেছেন। গত সোয়াশো বছর ধরে বাংলাভাষার চিন্তক ও আন্দোলনকারীরা (ধপঃরারংঃং) সংস্কৃতির ধারণাটিকে নানা ধারায় বিকশিত করে চলছেন। আমি সব ধারার আন্তরিক ও স্বচ্ছ চিন্তাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতিচিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী অরবিন্দ, গোপাল হালদার, নীহাররঞ্জন রায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের নাম সবার আগে সামনে আসে। স¤প্রতি প্রচার মাধ্যম সংস্কৃতির ধারণাটিকে বিনোদনের ধারণায় পর্যবসিত করেছে। সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। উক্ত মনীষীদের চিন্তাসমূহকে সমন্বিত করে সংস্কৃতির একটি ধারণা অর্জন করার চেষ্টা আমরা করতে পারি।
সংস্কৃতি মানবীয় ব্যাপার, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই সংস্কৃতি নেই। প্রকৃতিকে নিয়েই সংস্কৃতি, তবে প্রকৃতিই সংস্কৃতি নয়; সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রকৃতির অতিরিক্ত কিছুতে যা প্রকৃতিকে অবলম্বন করে মানুষে সৃষ্টি করে। বেঁচে থাকার ও উন্নতি করার জন্য মানুষকে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। সংস্কৃতির অস্তিত্ব মানুষের চিন্তার, কাজের ও জীবনযাত্রার মধ্যে শুদ্ধিমান, পরিশ্রæতিমান, উৎকর্ষমান, সৌন্দর্যমান, উত্তরণশীল, ঋদ্ধিমান, প্রগতিশীল, পূর্ণতাপ্রয়াসী সব প্রবণতায় ও প্রচেষ্টায়। জীবনযাত্রার ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত করার যে প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টা, তারই মধ্যে নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিগত জীবনের, তেমনি যৌথ বা সমষ্টিগত জীবনেরও ব্যাপার। জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, সেই সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও শিল্পকলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাংস্কৃতিক সামর্থ্যরে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। সংস্কৃতি ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক- সকল পর্যায়েরই ব্যাপার। জীবনযাত্রার এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কাজকর্মের ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের সুন্দর হওয়ার ও সুন্দর করার, সমৃদ্ধ হওয়ার ও সমৃদ্ধ করার এবং উন্নত হওয়ার ও উন্নত করার ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও চেষ্টার মধ্যেই বিরাজ করে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ও সমষ্টির কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, অন্তরিন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্কার, রূপান্তর ও নবজন্ম ঘটে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ও বুদ্ধিজীবীদের মহলে সংস্কৃতির চর্চা থাকলে তা দ্বারা সর্বসাধারণের জীবনে অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। নেতৃত্ব সংস্কৃতিমান হলে জনসাধারণও সংস্কৃতিমান হয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গ্রন্থে শ্রী অরবিন্দ লিখেছেন, “পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করাই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।” তিনি জোর দিয়েছেন মানুষের মনোদৈহিক উৎকর্ষ অর্জন ও আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার উন্নতিসাধন- দুটোতেই। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে সংস্কৃতি অবলম্বন করে মানুষ পর্যায়ক্রমে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে। পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করার সজ্ঞান প্রচেষ্টা দ্বারাই চলে সেই পূর্ণতার দিকে অভিযাত্রা।
যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পশ্চাৎবর্তী ও দরিদ্র, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়- তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সর্বজনীন কল্যাণবোধ, সৌন্দর্যবোধ ও শিক্ষার আগ্রহ আছে। ইচ্ছায় হোক, কিংবা বাধ্য হয়ে হোক, অগ্রসর সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যমে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। আত্মবিকাশের পথে তাদের অন্তরায় অনেক। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। যারা সৃষ্টিশীল নয়, তারা ঐতিহ্য ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সংস্কৃতি নিয়ে চলে।
ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে তার কাজে ও ব্যক্তিত্বে। জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় থাকে জাতির অন্তর্গত জনগণের কাজে ও সমষ্টিগত ব্যক্তিত্বে। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, ন্যায়-অন্যায়, আচার-অনাচার, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জাতির অন্তর্গত জনগণের স্বীকৃত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতি। তবে সর্বস্বীকৃত নয় এমন ধারণাও থাকে জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জীবনে। কোনো জাতির অন্তর্গত সকল মানুষের সকল চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই সেই জাতির সংস্কৃতির বাহন।
প্রাণিবিশেষ (ধঢ়ব) জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে করতে মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং সেই মানুষ আপন সংস্কৃতি চেতনার বলে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করে চলছে। গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই গধহ গধশবং ঐরসংবষভ. এতে মানুষকে তিনি দেখেছেন সংস্কৃতিমান বিকাশশীল প্রাণীরূপে। ব্যক্তিগত কিংবা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে কিংবা নিজেদের গড়ে তোলা, সৃষ্টি করা- জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে বিকশিত হয়ে ও বিকশিত করে চলা- এরই মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির সংস্কৃতি। ঞযব উবংপবহঃ ড়ভ গধহ গ্রন্থে ডারউইন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কী করে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষ জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতে নিজের জীবনযাত্রার ও কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করে চলছে। সংস্কৃতির বিবেচনায় হধঃঁৎধষ ংবষবপঃরড়হ ও ংঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ভরঃঃবংঃ কথা দুটোও অবশ্য বিবেচ্য। প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রাণিজগতের ও মানব সভ্যতার বিকাশ ধারায় সকল প্রজাতি ও জাতি সমভাবে টিকতে পারে না। মানুষের শক্তি তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি দুই-ই। গায়ের জোর ও মনের জোর দুটো দ্বারাই গঠিত হয় মানুষের শক্তি। মনের জোরের পরিচয় থাকে চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদিতে। মানুষ সেই জৈবিক সামর্থ্যরে অধিকারী যার বলে সে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রয়াসে ভাষা সৃষ্টি করেছি এবং সংস্কৃতির পরিচয় দিয়ে চলছে। মানুষের বিবর্তনে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ সংস্কৃতি চেতনাই কর্তা। সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। প্রত্যেক জাতির প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালের সংস্কৃতিচিন্তা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যেই প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা লক্ষ করা যায়। অপসংস্কৃতি কথাটাও তাৎপর্যহীন কিংবা গুরুত্বহীন নয়। সংস্কৃতি চেতনার বিকার ঘটলে অপসংস্কৃতি দেখা দেয়। জাতির জীবনে জাতীয় সংস্কৃতিই মূল। তাতে থাকে নানা প্রবণতা- বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। অপশক্তি সক্রিয় থাকে অপসংস্কৃতি নিয়ে। প্রত্যেক জাতিরই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে অপসংস্কৃতিকে পরাজিত করে করে।। এর কোনো বিকল্প ভাবা যায় না।
জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি চেতনা দুর্বল হলে, বিকৃত হলে, জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। ব্যক্তির বেলায়ও এমনটাই ঘটে। কোনো জাতির জীবনে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় (পঁষঃঁৎধষ ফবপষরহব) বা অপসংস্কৃতির প্রাধান্য চলতে থাকলে এক সময়ে জনগোষ্ঠীগত অবক্ষয় (বঃযহরপ ফবপষরহব) শুরু হয়। তবে প্রত্যেক জাতির মধ্যেই সাংস্কৃতিক অবক্ষয় দেখা দিলে তারই মধ্যে নতুন সৃষ্টির ও নবউত্থানের প্রচেষ্টাও দেখা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবীদের ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে- বৃহত্তর শিক্ষিতসমাজে- সংস্কৃতির এই ধারণা ও অনুশীলন এখন অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিনোদনের ধারণাকে সংস্কৃতির ধারণার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। এতদিনে সংস্কৃতি আমাদের এক হারানো প্রত্যয়। শব্দটি আমাদের ব্যবহারে আছে, কিন্তু মর্মহারা রূপে-ভিন্ন অর্থ নিয়ে।
বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে সংস্কৃতির জায়গায় ধর্ম পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে জেগে উঠেছে পুরাতন পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাস। দৃষ্টবাদী (ঢ়ড়ংরঃরারংঃ) মানুষ হয়ে পড়ছে অদৃষ্টবাদী (ভধঃধষরংঃ)। বিকারপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে রাজনীতি পতনশীল, গণতন্ত্রের ধারণা ও অনুশীলন সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির পরাজয় ও অপসংস্কৃতির বিজয়েই এমন হয়েছে। আমাদের উন্নতির জন্য সংস্কৃতির হারানো প্রত্যয়কে আমাদের উদ্ধার করতে হবে এবং জাতীয় জীবনে তাকে জয়ী করতে হবে।
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল যদি আন্তরিকতার সঙ্গে রাজনীতির মর্মে সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে, জনসাধারণকে সংস্কৃতি-সচেতন করে তোলে, তাহলে রাজনীতির চরিত্র অবশ্যই উন্নত হবে। এক দলের প্রভাব পড়বে অন্য সব দলে।
ইংরেজি কালচারের ধারণা আত্মস্থ করে এবং নিজেদের জীবনধারা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে বাংলাভাষার সুধীব্যক্তিরা বাংলায় সংস্কৃতির ধারণাটি সৃষ্টি করেছেন। গত সোয়াশো বছর ধরে বাংলাভাষার চিন্তক ও আন্দোলনকারীরা (ধপঃরারংঃং) সংস্কৃতির ধারণাটিকে নানা ধারায় বিকশিত করে চলছেন। আমি সব ধারার আন্তরিক ও স্বচ্ছ চিন্তাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতিচিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী অরবিন্দ, গোপাল হালদার, নীহাররঞ্জন রায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের নাম সবার আগে সামনে আসে। স¤প্রতি প্রচার মাধ্যম সংস্কৃতির ধারণাটিকে বিনোদনের ধারণায় পর্যবসিত করেছে। সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। উক্ত মনীষীদের চিন্তাসমূহকে সমন্বিত করে সংস্কৃতির একটি ধারণা অর্জন করার চেষ্টা আমরা করতে পারি।
সংস্কৃতি মানবীয় ব্যাপার, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই সংস্কৃতি নেই। প্রকৃতিকে নিয়েই সংস্কৃতি, তবে প্রকৃতিই সংস্কৃতি নয়; সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রকৃতির অতিরিক্ত কিছুতে যা প্রকৃতিকে অবলম্বন করে মানুষে সৃষ্টি করে। বেঁচে থাকার ও উন্নতি করার জন্য মানুষকে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। সংস্কৃতির অস্তিত্ব মানুষের চিন্তার, কাজের ও জীবনযাত্রার মধ্যে শুদ্ধিমান, পরিশ্রæতিমান, উৎকর্ষমান, সৌন্দর্যমান, উত্তরণশীল, ঋদ্ধিমান, প্রগতিশীল, পূর্ণতাপ্রয়াসী সব প্রবণতায় ও প্রচেষ্টায়। জীবনযাত্রার ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত করার যে প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টা, তারই মধ্যে নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিগত জীবনের, তেমনি যৌথ বা সমষ্টিগত জীবনেরও ব্যাপার। জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, সেই সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও শিল্পকলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাংস্কৃতিক সামর্থ্যরে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। সংস্কৃতি ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক- সকল পর্যায়েরই ব্যাপার। জীবনযাত্রার এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কাজকর্মের ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের সুন্দর হওয়ার ও সুন্দর করার, সমৃদ্ধ হওয়ার ও সমৃদ্ধ করার এবং উন্নত হওয়ার ও উন্নত করার ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও চেষ্টার মধ্যেই বিরাজ করে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ও সমষ্টির কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, অন্তরিন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্কার, রূপান্তর ও নবজন্ম ঘটে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ও বুদ্ধিজীবীদের মহলে সংস্কৃতির চর্চা থাকলে তা দ্বারা সর্বসাধারণের জীবনে অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। নেতৃত্ব সংস্কৃতিমান হলে জনসাধারণও সংস্কৃতিমান হয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গ্রন্থে শ্রী অরবিন্দ লিখেছেন, “পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করাই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।” তিনি জোর দিয়েছেন মানুষের মনোদৈহিক উৎকর্ষ অর্জন ও আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার উন্নতিসাধন- দুটোতেই। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে সংস্কৃতি অবলম্বন করে মানুষ পর্যায়ক্রমে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে। পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করার সজ্ঞান প্রচেষ্টা দ্বারাই চলে সেই পূর্ণতার দিকে অভিযাত্রা।
যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পশ্চাৎবর্তী ও দরিদ্র, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়- তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সর্বজনীন কল্যাণবোধ, সৌন্দর্যবোধ ও শিক্ষার আগ্রহ আছে। ইচ্ছায় হোক, কিংবা বাধ্য হয়ে হোক, অগ্রসর সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যমে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। আত্মবিকাশের পথে তাদের অন্তরায় অনেক। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। যারা সৃষ্টিশীল নয়, তারা ঐতিহ্য ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সংস্কৃতি নিয়ে চলে।
ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে তার কাজে ও ব্যক্তিত্বে। জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় থাকে জাতির অন্তর্গত জনগণের কাজে ও সমষ্টিগত ব্যক্তিত্বে। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, ন্যায়-অন্যায়, আচার-অনাচার, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জাতির অন্তর্গত জনগণের স্বীকৃত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতি। তবে সর্বস্বীকৃত নয় এমন ধারণাও থাকে জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জীবনে। কোনো জাতির অন্তর্গত সকল মানুষের সকল চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই সেই জাতির সংস্কৃতির বাহন।
প্রাণিবিশেষ (ধঢ়ব) জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে করতে মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং সেই মানুষ আপন সংস্কৃতি চেতনার বলে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করে চলছে। গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই গধহ গধশবং ঐরসংবষভ. এতে মানুষকে তিনি দেখেছেন সংস্কৃতিমান বিকাশশীল প্রাণীরূপে। ব্যক্তিগত কিংবা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে কিংবা নিজেদের গড়ে তোলা, সৃষ্টি করা- জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে বিকশিত হয়ে ও বিকশিত করে চলা- এরই মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির সংস্কৃতি। ঞযব উবংপবহঃ ড়ভ গধহ গ্রন্থে ডারউইন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কী করে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষ জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতে নিজের জীবনযাত্রার ও কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করে চলছে। সংস্কৃতির বিবেচনায় হধঃঁৎধষ ংবষবপঃরড়হ ও ংঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ভরঃঃবংঃ কথা দুটোও অবশ্য বিবেচ্য। প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রাণিজগতের ও মানব সভ্যতার বিকাশ ধারায় সকল প্রজাতি ও জাতি সমভাবে টিকতে পারে না। মানুষের শক্তি তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি দুই-ই। গায়ের জোর ও মনের জোর দুটো দ্বারাই গঠিত হয় মানুষের শক্তি। মনের জোরের পরিচয় থাকে চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদিতে। মানুষ সেই জৈবিক সামর্থ্যরে অধিকারী যার বলে সে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রয়াসে ভাষা সৃষ্টি করেছি এবং সংস্কৃতির পরিচয় দিয়ে চলছে। মানুষের বিবর্তনে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ সংস্কৃতি চেতনাই কর্তা। সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। প্রত্যেক জাতির প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালের সংস্কৃতিচিন্তা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যেই প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা লক্ষ করা যায়। অপসংস্কৃতি কথাটাও তাৎপর্যহীন কিংবা গুরুত্বহীন নয়। সংস্কৃতি চেতনার বিকার ঘটলে অপসংস্কৃতি দেখা দেয়। জাতির জীবনে জাতীয় সংস্কৃতিই মূল। তাতে থাকে নানা প্রবণতা- বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। অপশক্তি সক্রিয় থাকে অপসংস্কৃতি নিয়ে। প্রত্যেক জাতিরই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে অপসংস্কৃতিকে পরাজিত করে করে।। এর কোনো বিকল্প ভাবা যায় না।
জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি চেতনা দুর্বল হলে, বিকৃত হলে, জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। ব্যক্তির বেলায়ও এমনটাই ঘটে। কোনো জাতির জীবনে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় (পঁষঃঁৎধষ ফবপষরহব) বা অপসংস্কৃতির প্রাধান্য চলতে থাকলে এক সময়ে জনগোষ্ঠীগত অবক্ষয় (বঃযহরপ ফবপষরহব) শুরু হয়। তবে প্রত্যেক জাতির মধ্যেই সাংস্কৃতিক অবক্ষয় দেখা দিলে তারই মধ্যে নতুন সৃষ্টির ও নবউত্থানের প্রচেষ্টাও দেখা দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবীদের ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে- বৃহত্তর শিক্ষিতসমাজে- সংস্কৃতির এই ধারণা ও অনুশীলন এখন অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিনোদনের ধারণাকে সংস্কৃতির ধারণার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। এতদিনে সংস্কৃতি আমাদের এক হারানো প্রত্যয়। শব্দটি আমাদের ব্যবহারে আছে, কিন্তু মর্মহারা রূপে-ভিন্ন অর্থ নিয়ে।
বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে সংস্কৃতির জায়গায় ধর্ম পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে জেগে উঠেছে পুরাতন পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাস। দৃষ্টবাদী (ঢ়ড়ংরঃরারংঃ) মানুষ হয়ে পড়ছে অদৃষ্টবাদী (ভধঃধষরংঃ)। বিকারপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে রাজনীতি পতনশীল, গণতন্ত্রের ধারণা ও অনুশীলন সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির পরাজয় ও অপসংস্কৃতির বিজয়েই এমন হয়েছে। আমাদের উন্নতির জন্য সংস্কৃতির হারানো প্রত্যয়কে আমাদের উদ্ধার করতে হবে এবং জাতীয় জীবনে তাকে জয়ী করতে হবে।
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল যদি আন্তরিকতার সঙ্গে রাজনীতির মর্মে সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে, জনসাধারণকে সংস্কৃতি-সচেতন করে তোলে, তাহলে রাজনীতির চরিত্র অবশ্যই উন্নত হবে। এক দলের প্রভাব পড়বে অন্য সব দলে।
৩. আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে চলমান বিতর্ক
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিয়ে পরস্পর-প্রতিদ্ব›দ্বী একাধিক মতো দেখতে পাই। যাঁরা ভীষণভাবে সক্রিয়, ঘটনাপ্রবাহের গতিনির্ধারক ও নেতৃত্বকারী, তাঁদের ভূমিকা লক্ষ করা থাক।
লেখক, শিল্পী ও রাজনীতিবিদদের একাংশে দেখতে পাই ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের, সংস্কৃতির প্রতি অনুকরণের মনোভাব। এঁরা রবীন্দ্রনাথকে মনে করেন সংস্কৃতির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ (ধঁঃযড়ৎরঃু), আর
শান্তিনিকেতনকে মনে করেন সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। সৃজন ও মননের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনকে এঁরা একান্ত অনুসরণীয় মনে করেন। অপরদিক থেকে দেখলে দেখা যায়, এঁরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারারও অন্ধ অনুসারী। সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা থেকে পশ্চিমা প্রগতিশীল ভাবধারাকে আলাদা করে দেখার কোনো প্রবণতা এঁদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বকীয়তা, নতুন সৃষ্টির তাগিদ ও দূরদর্শিতা এঁদের মধ্যে অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। সৃজনপ্রয়াস ও প্রগতি প্রয়াসের চেয়ে ভোগবাদী প্রবণতা এ ধারার ভাবুক ও কর্মীদের মধ্যে প্রবল। ধর্মনিরপেক্ষতার সরব সমর্থক এঁরা। মনে হয়, কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা অবলম্বন করাকেই এঁরা প্রগতি মনে করেন। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটিকে এঁরা জনগণের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারেন না। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে বিবিসি রেডিও পরিচালিত মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনেও এঁরা সক্রিয়। কখনো কখনো এঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় অসা¤প্রদায়িকতা কথাটি ব্যবহার করেন এবং সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি রক্ষার জন্য সভা, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মানববন্ধন করে থাকেন। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ-যে বংশানুক্রমিকভাবে মুসলমান, তাদের জীবনধারা থেকে ইসলাম যে মোছে যায়নি, এ ব্যাপারটিতে এঁরা গুরুত্ব দেন না। এঁদের মধ্যে হিন্দু-সংস্কৃতির প্রতি কিছুটা কৌত‚হল দেখা গেলেও মুসলিম-সংস্কৃতির প্রতি কোনো কৌত‚হল দেখা যায় না। আঘাত পেলে, উসকানি পেলে, ধর্মীয় শক্তি সক্রিয় হয়। পূর্ববাংলার জনগণের সম্ভাবনাময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরেও, মনে হয়, এঁরা বাংলাদেশের জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারেন না। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির কথা এঁরা বলেন বটে, তবে এঁদের চিন্তা-ভাবনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলিতে সীমাবদ্ধ। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু বিষয় এঁরা মনের মতো করে প্রচার করছেন। প্রচারকার্যের দ্বারা সুবিধাজনক প্রতিপক্ষ এঁরা তৈরি করে নেন এবং প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার তৎপরতায় মত্ত থাকেন। গণতন্ত্রের কথা এঁরা সবসময় প্রচার করেন, কিন্তু এদের বলার ধরনে ও আচরণে গণতন্ত্র থাকে না। পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) ইতিহাসকে এঁরা এড়িয়ে যান। পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা বিচারের প্রশ্ন উঠলে এঁরা অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে এঁরা সম্পূর্ণরূপে এঁদের দলীয় ব্যাপার রূপে উপস্থাপন করেন এবং দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সব সময় সদম্ভে তা প্রচার করেন। ‘বঙ্গবন্ধু’কে এঁরা একান্তভাবে এঁদের দলীয় নেতা হিসেবে সংরক্ষণ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু’তে গোটা জাতির অধিকার এঁরা স্বীকার করেন না। এঁরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধকালের প্রথম বাংলাদেশ সরকারকে কোনো গুরুত্ব দেন না। জাতীয় বিবেচনার চেয়ে দলীয় ও উপদলীয় বিবেচনা এঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এঁরা যেভাবে প্রচার করেন, তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাংঘাতিক মিথ্যা স্থান করে নিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের গোটা ইতিহাসই বিকৃত হয়েছে।
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে এঁরা জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ বলে। অত্যন্ত জবরদস্তিমূলক ভাষায় সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এঁরা প্রচার চালান। কোনো রকম রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা জীবনদর্শন নিয়ে এঁদের কোনো অনুসন্ধিৎসা খুঁজে পাওয়া যায় না। পুনরুজ্জীবিত ইসলামি শক্তির চাপের মধ্যে এঁরা সুবিধাবাদী ভূমিকা নিয়ে ইসলামের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী ও রাজনীতিবিদদের অপর একটি অংশে দেখতে পাই ভারতের সংস্কৃতির প্রতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির প্রতি, বিরূপ মনোভাব। এঁদেরকেও দেখা যায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার অন্ধ অনুসারী। পশ্চিমা প্রগতিশীল ভাবধারার প্রতি এঁদেরও কোনো কৌত‚হল নেই। এঁদের মধ্যেও নতুন সৃষ্টির তাগিদ ও ভবিষ্যতদৃষ্টি দুর্লভ। প্রগতির কোনো বোধ এঁদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা এঁদেরও চালিকাশক্তি।
দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এঁরা বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে এঁরা অগ্রগতির এক অনিবার্য ধাপ মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এঁদের কোনো আবেগগত সংযোগ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধকালে ও তার আগে যেসব দল আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, তারা এ ধারায় আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ইতিহাসে এঁরা গুরুত্ব কম দেন। এ ধারার চিন্তক ও কর্মীরা দলীয় স্বার্থে জনগণের মধ্যকার মুসলমানত্ববোধকে জাগ্রত রাখতে ও কাজে লাগাতে তৎপর। এক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা সম্পূর্ণ সুবিধাবাদী।
১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। প্রতিপক্ষের প্রবল প্রচারের মুখে এঁরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা কম বলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিগুলোকে এঁরা সঙ্গে নিয়ে চলেন। এঁরা বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির আরম্ভ খোঁজেন মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইতিহাসে। এ দেশের মুসলিমপূর্ব কালের ইতিহাসের প্রতি এঁদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রতি এঁদের মনোভাব বিরূপ। এঁদের বক্তব্য হলো, গণতন্ত্র হলে আর ধর্মনিরপেক্ষতা লাগে না; সব মানুষকে চাপ দিয়ে নাস্তিক বানানো যাবে না। ইসলামকে এঁরা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন। ইসলামের প্রতি এঁদের আন্তরিক অনুরাগ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে এঁরা বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি দখলের (১২০৪) আগে যেতে চান না। এই ধারার লেখক-শিল্পীরা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরবে ইসলাম প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাংলার মুসলমান তুর্কি, পাঠান, মোগল শাসকদের শাসনকাল ধরে, ওহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের ধারা ধরে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে আসেন।
গ্রামের কৃষকদের মধ্যকার ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী ওহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের ধারা ধরে-যে মুসলিম লীগের উদ্ভব ও পাকিস্তান আন্দোলন হয়নি, পাকিস্তান আন্দোলন-যে ইসলামি আন্দোলন ছিল না, ছিল আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত সা¤প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলন, এটা এঁরা বুঝতে চান না। এই সেদিন, মনে হয় ২০০৪ সালে, বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি দখলের আটশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এই ধারার শীর্ষ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীরা ‘বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় স্মরণে’ সতেরোটি ঘোড়া নিয়ে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠান করেছেন, এবং প্রচারমাধ্যমে তা বেশ প্রচার পেয়েছে। নবাব সিরাজদুদ্দৌলা ও নবাব সলিমুল্লাকে এঁরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জাতীয় বীর রূপে সামনে আনেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে পলাশীর যুদ্ধকালের সার্বিক অবক্ষয়কে এঁরা বুঝতে চান না।
প্রতিপক্ষকে ভারতপন্থী বলে প্রচার করতে গিয়ে এঁরা ক্ষমতায় থাকাকালে (২০০১-২০০৬) ক্রমাগত প্রচার করেছেন যে, ভারতপন্থীরা ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে, মসজিদগুলোকে মন্দির বানিয়ে ফেলবে, মসজিদে আজান দেওয়া যাবে না- উলুধ্বনি দিতে হবে, পরে ভারতপন্থী বলে কথিত ধারা ক্ষমতায় এসে, এর প্রতিক্রিয়ায়, প্রচার করতে থাকে যে, এরা পাকিস্তানপন্থী, বাংলাদেশকে এরা পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে চায়। যাঁরা যখন ক্ষমতাসীন হন, প্রচার মাধ্যমের সুযোগ তাঁরা তখন বেশি গ্রহণ করতে পারেন।
১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রতিপক্ষের দ্বারা এঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলে তিরস্কৃত হয়ে আসছেন। রাজনৈতিক আদর্শ বা জীবনদর্শন নিয়ে এঁদেরও কোনো অনুসন্ধিৎসা দেখা যায় না। গণতন্ত্রের কথা এঁরা সব সময় প্রচার করেন বটে, তবে এঁদেরও বক্তব্যের মর্মে ও আচরণে গণতন্ত্র থাকে না।
কার্যক্ষেত্রে জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এজমালি বিষয় (পড়সসড়হ ঢ়ড়রহঃং) খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থানের ও সহিষ্ণুতার মনোভাব দুর্লভ- অসহিষ্ণুতা, হিংসা-প্রতিহিংসা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রবল। উভয় পক্ষই কেবল নিজেদের মতকে সম্পূর্ণ ঠিক এবং অপর পক্ষের মতকে সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রচার করে। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন কোনো পক্ষই বোধ করে না। আসলে দুই পক্ষের কোনোটিই নিজেদের বক্তব্যের সত্যাসত্য বিচার করে না। কোনো রকম সমালোচনাই কোনো পক্ষ সহ্য করে না, সমালোচনাকে মনে করে বিরোধিতা।
বাংলাদেশকে রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার তাগিদ নেই কোনো পক্ষের মধ্যেই। প্রশাসন এই ধারায় বিভক্ত। আইন-শৃঙ্খলা কোনো আমলেই ভালো থাকে না। বিশ্বায়নের ডামাডোলের মধ্যে দুই পক্ষের কোনোটিই জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব উপলব্ধিতে আগ্রহ কিংবা কৌত‚হল বোধ করে না।
কোনো পক্ষের মধ্যেই কোনো রকম আত্মজিজ্ঞাসা, কিংবা আত্মসমালোচনা, কিংবা আত্মাৎকর্ষের প্রবণতা নেই। দুই পক্ষেরই বিরোধের মূলে আছে কেবল ক্ষমতা উপভোগের ও অধিক থেকে অধিকতর সম্পত্তি অর্জনের মনোভাব। দুই পক্ষেরই রাজনীতি সম্পূর্ণ কলুষিত। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’ বলে যে পক্ষ আত্মপরিচয় দেয় তা বক্তব্যের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আর যে পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে নিয়ে চলে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ বলে অভিহিত হয় তা বক্তব্যের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে আছে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দ্বারা নীতির প্রশ্নে আপস বোঝায় না। জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতধারার ও সামাজিক শক্তির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পূর্বশর্ত হলো সকল পক্ষের সদিচ্ছা ও তথ্যনিষ্ঠা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জনগণের ওপর আস্থা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসন, সংস্কৃতির প্রতি সকল পক্ষের অনুরাগ, আর দুর্নীতি অপরাধ ও অন্যায়ের প্রতি অসহযোগ। সামাজিক ও জাতীয় অনুশীলনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে জাতিকে এগুলো অর্জন করতে হয়।
জাতীয় জীবনে এসবের অনুশীলন না থাকলে জনগণের পক্ষেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় না, অসহিষ্ণুতা সহিংসতা নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তির মধ্যে বসবাস করতে হয়। ক্রমে জাতি ও রাষ্ট্র ফোকলা হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি সাধারণভাবে বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজের সকলেই শ্রদ্ধাশীল। তা সত্ত্বেও দেখতে পাই, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ রবীন্দ্রভক্ত এবং অপর একটি অংশ নজরুলভক্ত। এই দুই ভক্ত-স¤প্রদায়ের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলমান আছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলসঙ্গীতের শিল্পমূল্য যেমন আছে, তেমনি আছে পণ্যমূল্য। সঙ্গীত নিয়ে বাজার ধরার প্রতিযোগিতা আছে। রবীন্দ্রভক্তরা নজরুলভক্তদের প্রতি এবং নজরুলভক্তরা রবীন্দ্রভক্তদের প্রতি প্রসন্ন মনোভাব পোষণ করেন না। এর মধ্যে সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে ভারতের সঙ্গে মিলে বিপুল প্রচার দিয়ে অন্তত দুবছর ধরে রবীন্দ্রনাথকে ক্রমাগত যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতিপক্ষের মধ্যে রবীন্দ্রবিরূপতা কিছুটা হলেও বেড়েছে।
নজরুলভক্তরা তাঁদের সংগঠনাদি থেকে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করেননি। রবীন্দ্রভক্তরা বাংলাভাষার মুসলিম লেখকদের যথোচিত গুরুত্ব দেন না। নজরুলভক্তরা বাংলাভাষার রক্ষণশীল ধারার মুসলিম লেখকদের বিশেষ গুরুত্ব দেন, প্রগতিশীল ধারা এড়িয়ে যান। নজরুলের কেবল মুসলমান পরিচয়কেই তাঁরা সামনে আনেন এবং প্রগতিশীল পরিচয় সম্পর্কে নীরব থাকেন। রবীন্দ্রভক্তরা বাংলাভাষার হিন্দু লেখকদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন, নজরুলভক্তরা হিন্দু লেখকদের এড়িয়ে চলতে চান।
দুই ধারার কোনোটিই রেনেসাঁসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে না, নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টির প্রয়োজনও বোধ করে না, এবং কোনোটির মধ্যেই জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আন্তর্জাতিকতাবাদকেও কোনো পক্ষই বুঝতে চায় না—বুঝতে চায় না জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পূরক সম্পর্ককে। দুই পক্ষই জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী মনে করে এবং বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে চলে।
জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজ্ঞাতে হোক, ঢ়ড়ংঃসড়ফবৎহরংস, হবড়ষরনবৎধষরংস, ঢ়ষঁৎধষরংস দুই পক্ষেরই চালিকাশক্তি। দুই পক্ষই বিশ্বায়নের নামে পরিচালিত পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার ও কার্যক্রমের অন্ধ অনুসারী। একে একে দুই পক্ষই দেশের রাজনীতিকে করে তুলেছেন পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী। ভারতের দূতাবাসের গুরুত্বও বেড়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলিম-বিদ্বেষী গণ্য করে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, এমন শিক্ষিত লোক বাংলাদেশে অনেক আছেন। ১৯৩৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সমর্থক লেখকরা কলকাতার গড়ের মাঠে জনসভায় মিলিত হয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আনন্দমঠ-এর বহ্নিউৎসব করেছিলেন। বাজার থেকে সব আনন্দমঠ কিনে এনে গড়ের মাঠে চিতা সাজিয়ে তাতে পুড়িয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ উপন্যাস পরিষদ একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন করেছিল। এর বিরুদ্ধে আজাদ, সংগ্রাম, ইনকিলাব, মিল্লাত, স্বাধীনতা, জনতা প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকা এবং সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা দুই-তিন বছর ধরে ক্রমাগত উপন্যাস পরিষদকে এবং উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তিরস্কার করে। ওই সময়ে তখনকার রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক শুক্রবারে সূত্রাপুর জামে মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে উপন্যাস পরিষদের উক্ত অনুষ্ঠানকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন এবং এ ধরনের অনুষ্ঠান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হতে পারল, তার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করেন।
তখন দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক পারাপার, মাসিক শিক্ষাবার্তা, লোকায়ত প্রভৃতি পত্রিকায় উপন্যাস পরিষদের উক্ত অনুষ্ঠানের সমর্থনেও কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে উপন্যাস পরিষদ থেকে প্রকাশ করা হয় বঙ্কিমচন্দ্র : সার্ধশত জন্মবর্ষে গ্রন্থটি। ওই সময়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক পর্যায়ে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফা লিখিত শতবর্ষের ফেরারী বঙ্কিমচন্দ্র। ছফার উদ্দেশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি মুসলমান পাঠকদের বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা হলেও, লিখতে গিয়ে তিনি বঙ্কিমপ্রতিভাকে অস্বীকার করতে পারেননি। আমার ধারণা, তাঁর লেখায় বঙ্কিমচন্দ্র ছোট হননি। তিনি অবশ্য ১৯৭২ সাল থেকেই তাঁর অনেক লেখায় কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু-সংস্কৃতির প্রতি প্রতিক‚ল মনোভাব ও ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রতিও তাঁর মনোভাব প্রসন্ন নয়। বঙ্কিমের লেখা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, এমন বিদ্বজ্জনও বাংলাদেশে আছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ও লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিপক্ষে সক্রিয়, আর অপর একটি অংশ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে সক্রিয়। কখনো কখনো দুই পক্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। তবে দুই পক্ষের কোনোটিকেই ধর্ম, কিংবা গণতন্ত্র, কিংবা সমাজতন্ত্র- কোনোটির প্রতিই বিশ্বস্ত মনে হয় না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন দ্বারা রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে।
অষ্টম সংশোধন দ্বারা রাষ্ট্রীয় আদর্শের জায়গায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধন (২০১১) অনুযায়ী সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেছে। এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা- দুটোই আছে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিতেও (২০১০) ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা- দুটোরই প্রতিফলন রয়েছে। তা সত্ত্বেও দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটিই সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজতন্ত্রকে কোনোভাবেই কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। ইসলামপন্থীরা সমাজতন্ত্রের সরাসরি বিরোধী।
উভয় পক্ষই চলছে মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও উদার গণতন্ত্র নিয়ে। অথচ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে অনেকটুকু জায়গাজুড়ে সমাজতন্ত্রের বর্ণনা আছে। জাতীয়তাবাদের বেলায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বলেন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ আর ধর্মপন্থীরা বলেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এক পক্ষের স্লোগান ‘জয় বাংলা’, অপর পক্ষের স্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। কার্যক্ষেত্রে দুই পক্ষের কোনোটিই জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করে কাজ করে না- জাতীয় রাজনীতি নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে ছোটাছুটি করে।
দুই পক্ষের রাজনীতিবিদদের মধ্যে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন থেকেই বিরাজ করছে চরম অসহিষ্ণু আচরণ। নির্বাচনের মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতাসীন হন তাঁদেরকে, যাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না তাঁরা সহ্যই করতে চান না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মনোভাব কোনো পক্ষের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না।।
১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় সংসদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভাষা ও আচরণ লক্ষ করলে বোঝা যায়, কী দারুণ অসহিষ্ণুতা দুই পক্ষের মধ্যে বিরাজমান। একটি পক্ষ অপর পক্ষকে শেষ করে দিতে চায়। জাতীয় সংসদের ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনের (প্রথম নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন) পর স্বাধীনতার ঘোষক কে, তা নিয়ে সংসদে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র অসহিষ্ণু বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তখন থেকে দুই পক্ষ এক সঙ্গে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কম সময়ই উপস্থিত থাকে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারেই তাদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায় না। সংসদের ভেতরে ও বাইরে রাজনীতির ভাষা কুৎসিৎ রূপ নেয়।
এক পক্ষ রাষ্ট্রের জনসাধারণকে ভাগ করে রেখেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি’ বলে। এর প্রতিক্রিয়ায় অপর পক্ষ জনসাধারণকে ভাগ করেছে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষশক্তি এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষশক্তি’ বলে।
এক পক্ষ নতুন প্রজন্মের মস্তিষ্কে তাদের ধারণাগুলোকে বদ্ধমূল করে দিতে বদ্ধপরিকর, অপর পক্ষ এ সম্পর্কে উদাসীন। ইসলামপন্থীরা ইসলামের নামে শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করার কাজে ভীষণভাবে সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেভাবে প্রচার করা হয় তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাংঘাতিক মিথ্যা স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য বিষয়গুলো ভীষণভাবে বিতর্কিত হয়ে আছে। পাঁচ বছর পর পর জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দুই পক্ষের মধ্যে দেখা দেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে প্রতিবার গড়ে দেড়শো লোকের প্রাণ যায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে নিয়ে এবার প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা অনেক বেশি হচ্ছে। এরই মধ্যে গত এক বছরে অন্তত চারশো লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এই প্রাণহানি বৃদ্ধির কারণ। নির্বাচন হতে এখনো পাঁচ/ছয় মাস বাকি। এর মধ্যে আরো কত লোকের প্রাণ যাবে, কে বলতে পারে? গণতন্ত্রকে যে রূপ দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়- গণতন্ত্র মানে নির্বাচন! নির্বাচন মানে গণতন্ত্র! গণতন্ত্রের নামে চলে রক্তপাত, জ্বালাও-পোড়াও, ধ্বংসলীলা! ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি, লুটপাট! রাজনীতিতে রাজনীতি নেই, আছে কেবল নগ্ন ক্ষমতার সহিংস লড়াই, আর সম্পত্তি দখলে নেওয়ার তৎপরতা।
সমকালীন ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই বিতর্ক লক্ষ করা যায়। বিতর্ক হয় ঐতিহাসিক ঘটনার তাৎপর্য নিয়ে। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কে তথ্যগত মিথ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে ফেলেছে এবং ক্রমেই মিথ্যাচার বাড়ছে। কোন পক্ষ সত্যনিষ্ঠ? কোন পক্ষ মিথ্যাচারী? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দুই পক্ষের একটিও কি সত্যনিষ্ঠ? প্রচার মাধ্যমও কি সত্যনিষ্ঠ? ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার চাপে দুই পক্ষ নির্দ্ব›দ্ব সহাবস্থানে ছিল বটে, কিন্তু জরুরি অবস্থা উঠে গেলেই দুই পক্ষ জরুরি অবস্থার আগেকার প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ফিরে যায়। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে বৈরীভাব বিদ্যমান, তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দুই পক্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থের বিরোধ। সংঘাত ও হিংসা-প্রতিহিংসা এত বেশি যে, কখনো কখনো মনে হয়, তাদের একটি পক্ষ অন্য পক্ষকে চিরকালের জন্য শেষ করে দিতে চায়। গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ও স¤প্রীতির যে মনোভাব দরকার, দুই পক্ষের কোনোটির মধ্যেই তা নেই।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিয়ে পরস্পর-প্রতিদ্ব›দ্বী একাধিক মতো দেখতে পাই। যাঁরা ভীষণভাবে সক্রিয়, ঘটনাপ্রবাহের গতিনির্ধারক ও নেতৃত্বকারী, তাঁদের ভূমিকা লক্ষ করা থাক।
লেখক, শিল্পী ও রাজনীতিবিদদের একাংশে দেখতে পাই ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের, সংস্কৃতির প্রতি অনুকরণের মনোভাব। এঁরা রবীন্দ্রনাথকে মনে করেন সংস্কৃতির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ (ধঁঃযড়ৎরঃু), আর
শান্তিনিকেতনকে মনে করেন সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। সৃজন ও মননের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনকে এঁরা একান্ত অনুসরণীয় মনে করেন। অপরদিক থেকে দেখলে দেখা যায়, এঁরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারারও অন্ধ অনুসারী। সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা থেকে পশ্চিমা প্রগতিশীল ভাবধারাকে আলাদা করে দেখার কোনো প্রবণতা এঁদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বকীয়তা, নতুন সৃষ্টির তাগিদ ও দূরদর্শিতা এঁদের মধ্যে অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। সৃজনপ্রয়াস ও প্রগতি প্রয়াসের চেয়ে ভোগবাদী প্রবণতা এ ধারার ভাবুক ও কর্মীদের মধ্যে প্রবল। ধর্মনিরপেক্ষতার সরব সমর্থক এঁরা। মনে হয়, কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা অবলম্বন করাকেই এঁরা প্রগতি মনে করেন। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটিকে এঁরা জনগণের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারেন না। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে বিবিসি রেডিও পরিচালিত মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনেও এঁরা সক্রিয়। কখনো কখনো এঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় অসা¤প্রদায়িকতা কথাটি ব্যবহার করেন এবং সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি রক্ষার জন্য সভা, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মানববন্ধন করে থাকেন। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ-যে বংশানুক্রমিকভাবে মুসলমান, তাদের জীবনধারা থেকে ইসলাম যে মোছে যায়নি, এ ব্যাপারটিতে এঁরা গুরুত্ব দেন না। এঁদের মধ্যে হিন্দু-সংস্কৃতির প্রতি কিছুটা কৌত‚হল দেখা গেলেও মুসলিম-সংস্কৃতির প্রতি কোনো কৌত‚হল দেখা যায় না। আঘাত পেলে, উসকানি পেলে, ধর্মীয় শক্তি সক্রিয় হয়। পূর্ববাংলার জনগণের সম্ভাবনাময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরেও, মনে হয়, এঁরা বাংলাদেশের জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারেন না। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির কথা এঁরা বলেন বটে, তবে এঁদের চিন্তা-ভাবনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলিতে সীমাবদ্ধ। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু বিষয় এঁরা মনের মতো করে প্রচার করছেন। প্রচারকার্যের দ্বারা সুবিধাজনক প্রতিপক্ষ এঁরা তৈরি করে নেন এবং প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার তৎপরতায় মত্ত থাকেন। গণতন্ত্রের কথা এঁরা সবসময় প্রচার করেন, কিন্তু এদের বলার ধরনে ও আচরণে গণতন্ত্র থাকে না। পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) ইতিহাসকে এঁরা এড়িয়ে যান। পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা বিচারের প্রশ্ন উঠলে এঁরা অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে এঁরা সম্পূর্ণরূপে এঁদের দলীয় ব্যাপার রূপে উপস্থাপন করেন এবং দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সব সময় সদম্ভে তা প্রচার করেন। ‘বঙ্গবন্ধু’কে এঁরা একান্তভাবে এঁদের দলীয় নেতা হিসেবে সংরক্ষণ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু’তে গোটা জাতির অধিকার এঁরা স্বীকার করেন না। এঁরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধকালের প্রথম বাংলাদেশ সরকারকে কোনো গুরুত্ব দেন না। জাতীয় বিবেচনার চেয়ে দলীয় ও উপদলীয় বিবেচনা এঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এঁরা যেভাবে প্রচার করেন, তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাংঘাতিক মিথ্যা স্থান করে নিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের গোটা ইতিহাসই বিকৃত হয়েছে।
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে এঁরা জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ বলে। অত্যন্ত জবরদস্তিমূলক ভাষায় সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এঁরা প্রচার চালান। কোনো রকম রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা জীবনদর্শন নিয়ে এঁদের কোনো অনুসন্ধিৎসা খুঁজে পাওয়া যায় না। পুনরুজ্জীবিত ইসলামি শক্তির চাপের মধ্যে এঁরা সুবিধাবাদী ভূমিকা নিয়ে ইসলামের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী ও রাজনীতিবিদদের অপর একটি অংশে দেখতে পাই ভারতের সংস্কৃতির প্রতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির প্রতি, বিরূপ মনোভাব। এঁদেরকেও দেখা যায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার অন্ধ অনুসারী। পশ্চিমা প্রগতিশীল ভাবধারার প্রতি এঁদেরও কোনো কৌত‚হল নেই। এঁদের মধ্যেও নতুন সৃষ্টির তাগিদ ও ভবিষ্যতদৃষ্টি দুর্লভ। প্রগতির কোনো বোধ এঁদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা এঁদেরও চালিকাশক্তি।
দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এঁরা বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে এঁরা অগ্রগতির এক অনিবার্য ধাপ মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এঁদের কোনো আবেগগত সংযোগ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধকালে ও তার আগে যেসব দল আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, তারা এ ধারায় আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ইতিহাসে এঁরা গুরুত্ব কম দেন। এ ধারার চিন্তক ও কর্মীরা দলীয় স্বার্থে জনগণের মধ্যকার মুসলমানত্ববোধকে জাগ্রত রাখতে ও কাজে লাগাতে তৎপর। এক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা সম্পূর্ণ সুবিধাবাদী।
১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। প্রতিপক্ষের প্রবল প্রচারের মুখে এঁরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কথা কম বলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিগুলোকে এঁরা সঙ্গে নিয়ে চলেন। এঁরা বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির আরম্ভ খোঁজেন মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইতিহাসে। এ দেশের মুসলিমপূর্ব কালের ইতিহাসের প্রতি এঁদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রতি এঁদের মনোভাব বিরূপ। এঁদের বক্তব্য হলো, গণতন্ত্র হলে আর ধর্মনিরপেক্ষতা লাগে না; সব মানুষকে চাপ দিয়ে নাস্তিক বানানো যাবে না। ইসলামকে এঁরা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন। ইসলামের প্রতি এঁদের আন্তরিক অনুরাগ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে এঁরা বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি দখলের (১২০৪) আগে যেতে চান না। এই ধারার লেখক-শিল্পীরা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরবে ইসলাম প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাংলার মুসলমান তুর্কি, পাঠান, মোগল শাসকদের শাসনকাল ধরে, ওহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের ধারা ধরে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে আসেন।
গ্রামের কৃষকদের মধ্যকার ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদী ওহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের ধারা ধরে-যে মুসলিম লীগের উদ্ভব ও পাকিস্তান আন্দোলন হয়নি, পাকিস্তান আন্দোলন-যে ইসলামি আন্দোলন ছিল না, ছিল আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত সা¤প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলন, এটা এঁরা বুঝতে চান না। এই সেদিন, মনে হয় ২০০৪ সালে, বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি দখলের আটশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এই ধারার শীর্ষ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীরা ‘বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় স্মরণে’ সতেরোটি ঘোড়া নিয়ে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠান করেছেন, এবং প্রচারমাধ্যমে তা বেশ প্রচার পেয়েছে। নবাব সিরাজদুদ্দৌলা ও নবাব সলিমুল্লাকে এঁরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জাতীয় বীর রূপে সামনে আনেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে পলাশীর যুদ্ধকালের সার্বিক অবক্ষয়কে এঁরা বুঝতে চান না।
প্রতিপক্ষকে ভারতপন্থী বলে প্রচার করতে গিয়ে এঁরা ক্ষমতায় থাকাকালে (২০০১-২০০৬) ক্রমাগত প্রচার করেছেন যে, ভারতপন্থীরা ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে, মসজিদগুলোকে মন্দির বানিয়ে ফেলবে, মসজিদে আজান দেওয়া যাবে না- উলুধ্বনি দিতে হবে, পরে ভারতপন্থী বলে কথিত ধারা ক্ষমতায় এসে, এর প্রতিক্রিয়ায়, প্রচার করতে থাকে যে, এরা পাকিস্তানপন্থী, বাংলাদেশকে এরা পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে চায়। যাঁরা যখন ক্ষমতাসীন হন, প্রচার মাধ্যমের সুযোগ তাঁরা তখন বেশি গ্রহণ করতে পারেন।
১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রতিপক্ষের দ্বারা এঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলে তিরস্কৃত হয়ে আসছেন। রাজনৈতিক আদর্শ বা জীবনদর্শন নিয়ে এঁদেরও কোনো অনুসন্ধিৎসা দেখা যায় না। গণতন্ত্রের কথা এঁরা সব সময় প্রচার করেন বটে, তবে এঁদেরও বক্তব্যের মর্মে ও আচরণে গণতন্ত্র থাকে না।
কার্যক্ষেত্রে জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এজমালি বিষয় (পড়সসড়হ ঢ়ড়রহঃং) খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থানের ও সহিষ্ণুতার মনোভাব দুর্লভ- অসহিষ্ণুতা, হিংসা-প্রতিহিংসা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রবল। উভয় পক্ষই কেবল নিজেদের মতকে সম্পূর্ণ ঠিক এবং অপর পক্ষের মতকে সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রচার করে। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন কোনো পক্ষই বোধ করে না। আসলে দুই পক্ষের কোনোটিই নিজেদের বক্তব্যের সত্যাসত্য বিচার করে না। কোনো রকম সমালোচনাই কোনো পক্ষ সহ্য করে না, সমালোচনাকে মনে করে বিরোধিতা।
বাংলাদেশকে রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার তাগিদ নেই কোনো পক্ষের মধ্যেই। প্রশাসন এই ধারায় বিভক্ত। আইন-শৃঙ্খলা কোনো আমলেই ভালো থাকে না। বিশ্বায়নের ডামাডোলের মধ্যে দুই পক্ষের কোনোটিই জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব উপলব্ধিতে আগ্রহ কিংবা কৌত‚হল বোধ করে না।
কোনো পক্ষের মধ্যেই কোনো রকম আত্মজিজ্ঞাসা, কিংবা আত্মসমালোচনা, কিংবা আত্মাৎকর্ষের প্রবণতা নেই। দুই পক্ষেরই বিরোধের মূলে আছে কেবল ক্ষমতা উপভোগের ও অধিক থেকে অধিকতর সম্পত্তি অর্জনের মনোভাব। দুই পক্ষেরই রাজনীতি সম্পূর্ণ কলুষিত। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’ বলে যে পক্ষ আত্মপরিচয় দেয় তা বক্তব্যের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আর যে পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে নিয়ে চলে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ বলে অভিহিত হয় তা বক্তব্যের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে আছে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দ্বারা নীতির প্রশ্নে আপস বোঝায় না। জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতধারার ও সামাজিক শক্তির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পূর্বশর্ত হলো সকল পক্ষের সদিচ্ছা ও তথ্যনিষ্ঠা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জনগণের ওপর আস্থা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসন, সংস্কৃতির প্রতি সকল পক্ষের অনুরাগ, আর দুর্নীতি অপরাধ ও অন্যায়ের প্রতি অসহযোগ। সামাজিক ও জাতীয় অনুশীলনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে জাতিকে এগুলো অর্জন করতে হয়।
জাতীয় জীবনে এসবের অনুশীলন না থাকলে জনগণের পক্ষেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় না, অসহিষ্ণুতা সহিংসতা নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তির মধ্যে বসবাস করতে হয়। ক্রমে জাতি ও রাষ্ট্র ফোকলা হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি সাধারণভাবে বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজের সকলেই শ্রদ্ধাশীল। তা সত্ত্বেও দেখতে পাই, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ রবীন্দ্রভক্ত এবং অপর একটি অংশ নজরুলভক্ত। এই দুই ভক্ত-স¤প্রদায়ের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলমান আছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলসঙ্গীতের শিল্পমূল্য যেমন আছে, তেমনি আছে পণ্যমূল্য। সঙ্গীত নিয়ে বাজার ধরার প্রতিযোগিতা আছে। রবীন্দ্রভক্তরা নজরুলভক্তদের প্রতি এবং নজরুলভক্তরা রবীন্দ্রভক্তদের প্রতি প্রসন্ন মনোভাব পোষণ করেন না। এর মধ্যে সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে ভারতের সঙ্গে মিলে বিপুল প্রচার দিয়ে অন্তত দুবছর ধরে রবীন্দ্রনাথকে ক্রমাগত যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতিপক্ষের মধ্যে রবীন্দ্রবিরূপতা কিছুটা হলেও বেড়েছে।
নজরুলভক্তরা তাঁদের সংগঠনাদি থেকে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করেননি। রবীন্দ্রভক্তরা বাংলাভাষার মুসলিম লেখকদের যথোচিত গুরুত্ব দেন না। নজরুলভক্তরা বাংলাভাষার রক্ষণশীল ধারার মুসলিম লেখকদের বিশেষ গুরুত্ব দেন, প্রগতিশীল ধারা এড়িয়ে যান। নজরুলের কেবল মুসলমান পরিচয়কেই তাঁরা সামনে আনেন এবং প্রগতিশীল পরিচয় সম্পর্কে নীরব থাকেন। রবীন্দ্রভক্তরা বাংলাভাষার হিন্দু লেখকদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন, নজরুলভক্তরা হিন্দু লেখকদের এড়িয়ে চলতে চান।
দুই ধারার কোনোটিই রেনেসাঁসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে না, নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টির প্রয়োজনও বোধ করে না, এবং কোনোটির মধ্যেই জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আন্তর্জাতিকতাবাদকেও কোনো পক্ষই বুঝতে চায় না—বুঝতে চায় না জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পূরক সম্পর্ককে। দুই পক্ষই জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী মনে করে এবং বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে চলে।
জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজ্ঞাতে হোক, ঢ়ড়ংঃসড়ফবৎহরংস, হবড়ষরনবৎধষরংস, ঢ়ষঁৎধষরংস দুই পক্ষেরই চালিকাশক্তি। দুই পক্ষই বিশ্বায়নের নামে পরিচালিত পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার ও কার্যক্রমের অন্ধ অনুসারী। একে একে দুই পক্ষই দেশের রাজনীতিকে করে তুলেছেন পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী। ভারতের দূতাবাসের গুরুত্বও বেড়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলিম-বিদ্বেষী গণ্য করে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, এমন শিক্ষিত লোক বাংলাদেশে অনেক আছেন। ১৯৩৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সমর্থক লেখকরা কলকাতার গড়ের মাঠে জনসভায় মিলিত হয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আনন্দমঠ-এর বহ্নিউৎসব করেছিলেন। বাজার থেকে সব আনন্দমঠ কিনে এনে গড়ের মাঠে চিতা সাজিয়ে তাতে পুড়িয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ উপন্যাস পরিষদ একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন করেছিল। এর বিরুদ্ধে আজাদ, সংগ্রাম, ইনকিলাব, মিল্লাত, স্বাধীনতা, জনতা প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকা এবং সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা দুই-তিন বছর ধরে ক্রমাগত উপন্যাস পরিষদকে এবং উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তিরস্কার করে। ওই সময়ে তখনকার রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক শুক্রবারে সূত্রাপুর জামে মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে উপন্যাস পরিষদের উক্ত অনুষ্ঠানকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন এবং এ ধরনের অনুষ্ঠান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হতে পারল, তার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করেন।
তখন দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক পারাপার, মাসিক শিক্ষাবার্তা, লোকায়ত প্রভৃতি পত্রিকায় উপন্যাস পরিষদের উক্ত অনুষ্ঠানের সমর্থনেও কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে উপন্যাস পরিষদ থেকে প্রকাশ করা হয় বঙ্কিমচন্দ্র : সার্ধশত জন্মবর্ষে গ্রন্থটি। ওই সময়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক পর্যায়ে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফা লিখিত শতবর্ষের ফেরারী বঙ্কিমচন্দ্র। ছফার উদ্দেশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি মুসলমান পাঠকদের বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা হলেও, লিখতে গিয়ে তিনি বঙ্কিমপ্রতিভাকে অস্বীকার করতে পারেননি। আমার ধারণা, তাঁর লেখায় বঙ্কিমচন্দ্র ছোট হননি। তিনি অবশ্য ১৯৭২ সাল থেকেই তাঁর অনেক লেখায় কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু-সংস্কৃতির প্রতি প্রতিক‚ল মনোভাব ও ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রতিও তাঁর মনোভাব প্রসন্ন নয়। বঙ্কিমের লেখা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, এমন বিদ্বজ্জনও বাংলাদেশে আছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ও লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিপক্ষে সক্রিয়, আর অপর একটি অংশ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে সক্রিয়। কখনো কখনো দুই পক্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। তবে দুই পক্ষের কোনোটিকেই ধর্ম, কিংবা গণতন্ত্র, কিংবা সমাজতন্ত্র- কোনোটির প্রতিই বিশ্বস্ত মনে হয় না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন দ্বারা রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে।
অষ্টম সংশোধন দ্বারা রাষ্ট্রীয় আদর্শের জায়গায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধন (২০১১) অনুযায়ী সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জায়গায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেছে। এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা- দুটোই আছে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিতেও (২০১০) ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা- দুটোরই প্রতিফলন রয়েছে। তা সত্ত্বেও দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটিই সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজতন্ত্রকে কোনোভাবেই কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। ইসলামপন্থীরা সমাজতন্ত্রের সরাসরি বিরোধী।
উভয় পক্ষই চলছে মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও উদার গণতন্ত্র নিয়ে। অথচ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে অনেকটুকু জায়গাজুড়ে সমাজতন্ত্রের বর্ণনা আছে। জাতীয়তাবাদের বেলায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বলেন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ আর ধর্মপন্থীরা বলেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এক পক্ষের স্লোগান ‘জয় বাংলা’, অপর পক্ষের স্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। কার্যক্ষেত্রে দুই পক্ষের কোনোটিই জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করে কাজ করে না- জাতীয় রাজনীতি নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে ছোটাছুটি করে।
দুই পক্ষের রাজনীতিবিদদের মধ্যে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন থেকেই বিরাজ করছে চরম অসহিষ্ণু আচরণ। নির্বাচনের মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতাসীন হন তাঁদেরকে, যাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না তাঁরা সহ্যই করতে চান না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মনোভাব কোনো পক্ষের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না।।
১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় সংসদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভাষা ও আচরণ লক্ষ করলে বোঝা যায়, কী দারুণ অসহিষ্ণুতা দুই পক্ষের মধ্যে বিরাজমান। একটি পক্ষ অপর পক্ষকে শেষ করে দিতে চায়। জাতীয় সংসদের ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনের (প্রথম নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন) পর স্বাধীনতার ঘোষক কে, তা নিয়ে সংসদে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র অসহিষ্ণু বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তখন থেকে দুই পক্ষ এক সঙ্গে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কম সময়ই উপস্থিত থাকে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারেই তাদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায় না। সংসদের ভেতরে ও বাইরে রাজনীতির ভাষা কুৎসিৎ রূপ নেয়।
এক পক্ষ রাষ্ট্রের জনসাধারণকে ভাগ করে রেখেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি’ বলে। এর প্রতিক্রিয়ায় অপর পক্ষ জনসাধারণকে ভাগ করেছে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষশক্তি এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষশক্তি’ বলে।
এক পক্ষ নতুন প্রজন্মের মস্তিষ্কে তাদের ধারণাগুলোকে বদ্ধমূল করে দিতে বদ্ধপরিকর, অপর পক্ষ এ সম্পর্কে উদাসীন। ইসলামপন্থীরা ইসলামের নামে শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করার কাজে ভীষণভাবে সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেভাবে প্রচার করা হয় তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাংঘাতিক মিথ্যা স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য বিষয়গুলো ভীষণভাবে বিতর্কিত হয়ে আছে। পাঁচ বছর পর পর জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দুই পক্ষের মধ্যে দেখা দেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে প্রতিবার গড়ে দেড়শো লোকের প্রাণ যায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে নিয়ে এবার প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা অনেক বেশি হচ্ছে। এরই মধ্যে গত এক বছরে অন্তত চারশো লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এই প্রাণহানি বৃদ্ধির কারণ। নির্বাচন হতে এখনো পাঁচ/ছয় মাস বাকি। এর মধ্যে আরো কত লোকের প্রাণ যাবে, কে বলতে পারে? গণতন্ত্রকে যে রূপ দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়- গণতন্ত্র মানে নির্বাচন! নির্বাচন মানে গণতন্ত্র! গণতন্ত্রের নামে চলে রক্তপাত, জ্বালাও-পোড়াও, ধ্বংসলীলা! ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি, লুটপাট! রাজনীতিতে রাজনীতি নেই, আছে কেবল নগ্ন ক্ষমতার সহিংস লড়াই, আর সম্পত্তি দখলে নেওয়ার তৎপরতা।
সমকালীন ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই বিতর্ক লক্ষ করা যায়। বিতর্ক হয় ঐতিহাসিক ঘটনার তাৎপর্য নিয়ে। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কে তথ্যগত মিথ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে ফেলেছে এবং ক্রমেই মিথ্যাচার বাড়ছে। কোন পক্ষ সত্যনিষ্ঠ? কোন পক্ষ মিথ্যাচারী? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দুই পক্ষের একটিও কি সত্যনিষ্ঠ? প্রচার মাধ্যমও কি সত্যনিষ্ঠ? ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার চাপে দুই পক্ষ নির্দ্ব›দ্ব সহাবস্থানে ছিল বটে, কিন্তু জরুরি অবস্থা উঠে গেলেই দুই পক্ষ জরুরি অবস্থার আগেকার প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ফিরে যায়। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে বৈরীভাব বিদ্যমান, তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দুই পক্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থের বিরোধ। সংঘাত ও হিংসা-প্রতিহিংসা এত বেশি যে, কখনো কখনো মনে হয়, তাদের একটি পক্ষ অন্য পক্ষকে চিরকালের জন্য শেষ করে দিতে চায়। গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ও স¤প্রীতির যে মনোভাব দরকার, দুই পক্ষের কোনোটির মধ্যেই তা নেই।
৪. তৃতীয় পক্ষ
১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে তৃতীয় একটি পক্ষ আত্মপ্রকাশ করেছে যা ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর এক রকম অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। এই তৃতীয় পক্ষ একান্ত পশ্চিমমুখী। এঁদের কেবলা মক্কা-মদিনায় নয়, আরো অনেক পশ্চিমে- ওয়াশিংটনে। এঁরা, বাংলাদেশের উন্নয়নকে ওয়াশিংটন-কেন্দ্রিক বিশ্বায়ন-পরিকল্পনার অংশ মনে করেন। বাংলাদেশের জন্য এঁদের উন্নয়নচিন্তা ঢাকাকেন্দ্রিক নয়; এঁদের কেন্দ্র ওয়াশিংটন- ঢাকা সুদূর প্রান্ত। এঁরা ইউরো মার্কিন ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’র অন্ধ অনুগামী। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদিকে এঁরা দাতাসংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী বলে বরণ করে নেন এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া পরিকল্পনা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই নিরঙ্কুশ আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে নেন।
এনজিওপতিরা ও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) সমূহের পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকরা এ ধারার অন্তর্গত। ইলেকশন ওয়াচ, ডেমোক্রেসি ওয়াচ, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং এলায়েন্স (ঋঊগঅ), জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, নারীবাদী সংগঠন, পরিবেশবাদী সংস্থা, সুজন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, এইডস বিরোধী সংস্থা, বিআইডিএস ইত্যাদি হলো এক একটি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ)। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাজে এঁদের অর্থ জোগান দেয় পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের বিভিন্ন অর্থসংস্থা। অর্থের এই জোগান বন্ধ হয়ে গেলে এঁদের স্বেচ্ছাসেবাও বন্ধ হয়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি আমলা, অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস, ব্যারিস্টার, সাংবাদিক, বিজনেস এলিট, ডক্টর, প্রফেসর- এ ধারায় আছেন। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার গবেষকরা ও কনসালট্যান্টরা এ ধারার অন্তর্গত। এঁদের চিন্তা-চেতনায় কোনো জাতীয়তাবোধ নেই, কোনো স্বকীয়তা নেই। এঁদের চিন্তা-ভাবনা একান্তভাবে পশ্চিমা পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের তথা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত অনুসারী এঁরা।
১৯৮০-র দশক থেকে এ ধারার বিশিষ্ট নাগরিকরা রাজনীতিতে ভীষণভাবে সক্রিয় আছেন। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এঁরা জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন। এঁদের যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের ধারার ২০০৭ সালে কায়েম হয়েছিল জরুরি অবস্থার সরকার। এখন ভারত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক‚ল নীতি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার ফলে অবস্থা ভিন্ন রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল তথা ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দ্রুত বেড়েছে এবং বাড়ছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারাকে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন প্রবর্তন করেছে। ক্রমে ইংলিশ ভার্সন বাড়ানো হচ্ছে। সব ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন নিয়ে চলছে। সরকারি স্কুল ও কলেজগুলোও বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন চালু করে চলছে।
প্রাইভেট স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন যারা এখনো চালু করতে পারেনি তারা এটা চালু করার চেষ্টায় আছে। সরকারের নীতি ও কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের অঘোষিত সমর্থন ইংলিশ ভার্সনের পক্ষে আছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে চলছে। এ ব্যাপারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো স্বচ্ছ নীতি নেই। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও ইংলিশ র্ভাসন ধারা শিক্ষার্থীদের কী দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে?
সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) ও এনজিও ধারার অনুসারী বিশিষ্ট নাগরিকরা মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের সমর্থনে অত্যন্ত উৎসাহী এবং বাংলাভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নির্লিপ্ত।
বাংলাদেশ কখনো স্বাধীনভাবে চলতে পারবে না, তাকে চলতে হবে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে- এই কথাটা ঘোষণা না দিয়ে প্রতিদিন নানা কৌশলে তাঁরা সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। বাংলা কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা থাকবে? বাংলা রাষ্ট্রভাষা না থাকলে বাংলাদেশ কি রাষ্ট্র রূপে অস্তিত্বশীল থাকবে? এখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের অবস্থা কী? ইংলিশ মিডিয়াম ও ইংলিশ ভার্সন ধারা থেকে যারা বের হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে কি আগ্রহী হচ্ছে?
১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার নানা আয়োজন দেখা যাচ্ছে, আর বাংলা ভাষার প্রতি দেখা যাচ্ছে দারুণ ঔদাসীন্য। বিলীয়মান মাতৃভাষা সমূহকে রক্ষা করার আয়োজন অবশ্যই সফল হবে না। আদিবাসীদের এবং প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে মানবজাতির মূল ধারায় আসতে দিতে হবে। তাদের অবস্থা উন্নত করতে হবে। বাংলাভাষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ঠিক হচ্ছে না।
১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি বহুলাংশে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) সমূহের পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। এই বিশিষ্ট নাগরিকরা ১৯৮০-র দশকের সরকার উৎখাতের আন্দোলনের সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নানা কৌশলে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন। জাতীয় সংসদের ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা- যাঁরা যখন বিরোধী দলে থাকেন- বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যভাবে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতবাসগুলোতে ছোটাছুটি করতে থাকেন এবং পশ্চিমা ক‚টনীতিকরাও প্রকাশ্যভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই ধারার কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে নিঃরাজনীতিকরণের (ফবঢ়ড়ষরঃরপরুধঃরড়হ) প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
নিঃরাজনীতিকরণের কথা ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে অনেকে বলছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই নিঃরাজনীতিকরণ ব্যাপারটাকে খোলাসা করার চেষ্টা করেননি। নিঃরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ায় পড়ে রাজনৈতিক দলগুলো উন্নতি করতে পারছে না। তারা রাজনীতি হারিয়ে নগ্ন ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত আছে।
মূল্যবোধ, যুক্তিবোধ, বিচার-বিবেচনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা- এসবের গুরুত্ব স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমেই অস্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি অত্যন্ত কুৎসিৎ রূপ লাভ করেছে। গণতন্ত্র বলে এখন বোঝানো হচ্ছে কেবল নির্বাচন। আর নির্বাচনকে বলা হচ্ছে উৎসব- জনজীবনের সর্ববৃহৎ উৎসব। গণতন্ত্রের নামে এই উৎসব তো জনগণের সঙ্গে প্রতারণা মাত্র! নির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতায় আসীন হয়ে যা কিছু করে সবই গণতন্ত্র বিরোধী।
১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে তৃতীয় একটি পক্ষ আত্মপ্রকাশ করেছে যা ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর এক রকম অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। এই তৃতীয় পক্ষ একান্ত পশ্চিমমুখী। এঁদের কেবলা মক্কা-মদিনায় নয়, আরো অনেক পশ্চিমে- ওয়াশিংটনে। এঁরা, বাংলাদেশের উন্নয়নকে ওয়াশিংটন-কেন্দ্রিক বিশ্বায়ন-পরিকল্পনার অংশ মনে করেন। বাংলাদেশের জন্য এঁদের উন্নয়নচিন্তা ঢাকাকেন্দ্রিক নয়; এঁদের কেন্দ্র ওয়াশিংটন- ঢাকা সুদূর প্রান্ত। এঁরা ইউরো মার্কিন ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’র অন্ধ অনুগামী। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদিকে এঁরা দাতাসংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী বলে বরণ করে নেন এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া পরিকল্পনা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই নিরঙ্কুশ আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে নেন।
এনজিওপতিরা ও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) সমূহের পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকরা এ ধারার অন্তর্গত। ইলেকশন ওয়াচ, ডেমোক্রেসি ওয়াচ, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং এলায়েন্স (ঋঊগঅ), জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, নারীবাদী সংগঠন, পরিবেশবাদী সংস্থা, সুজন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, এইডস বিরোধী সংস্থা, বিআইডিএস ইত্যাদি হলো এক একটি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ)। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাজে এঁদের অর্থ জোগান দেয় পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের বিভিন্ন অর্থসংস্থা। অর্থের এই জোগান বন্ধ হয়ে গেলে এঁদের স্বেচ্ছাসেবাও বন্ধ হয়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি আমলা, অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস, ব্যারিস্টার, সাংবাদিক, বিজনেস এলিট, ডক্টর, প্রফেসর- এ ধারায় আছেন। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার গবেষকরা ও কনসালট্যান্টরা এ ধারার অন্তর্গত। এঁদের চিন্তা-চেতনায় কোনো জাতীয়তাবোধ নেই, কোনো স্বকীয়তা নেই। এঁদের চিন্তা-ভাবনা একান্তভাবে পশ্চিমা পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের তথা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত অনুসারী এঁরা।
১৯৮০-র দশক থেকে এ ধারার বিশিষ্ট নাগরিকরা রাজনীতিতে ভীষণভাবে সক্রিয় আছেন। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এঁরা জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন। এঁদের যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের ধারার ২০০৭ সালে কায়েম হয়েছিল জরুরি অবস্থার সরকার। এখন ভারত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক‚ল নীতি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার ফলে অবস্থা ভিন্ন রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল তথা ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দ্রুত বেড়েছে এবং বাড়ছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারাকে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন প্রবর্তন করেছে। ক্রমে ইংলিশ ভার্সন বাড়ানো হচ্ছে। সব ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন নিয়ে চলছে। সরকারি স্কুল ও কলেজগুলোও বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সন চালু করে চলছে।
প্রাইভেট স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন যারা এখনো চালু করতে পারেনি তারা এটা চালু করার চেষ্টায় আছে। সরকারের নীতি ও কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের অঘোষিত সমর্থন ইংলিশ ভার্সনের পক্ষে আছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে চলছে। এ ব্যাপারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো স্বচ্ছ নীতি নেই। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও ইংলিশ র্ভাসন ধারা শিক্ষার্থীদের কী দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে?
সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) ও এনজিও ধারার অনুসারী বিশিষ্ট নাগরিকরা মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের সমর্থনে অত্যন্ত উৎসাহী এবং বাংলাভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নির্লিপ্ত।
বাংলাদেশ কখনো স্বাধীনভাবে চলতে পারবে না, তাকে চলতে হবে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে- এই কথাটা ঘোষণা না দিয়ে প্রতিদিন নানা কৌশলে তাঁরা সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। বাংলা কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা থাকবে? বাংলা রাষ্ট্রভাষা না থাকলে বাংলাদেশ কি রাষ্ট্র রূপে অস্তিত্বশীল থাকবে? এখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের অবস্থা কী? ইংলিশ মিডিয়াম ও ইংলিশ ভার্সন ধারা থেকে যারা বের হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে কি আগ্রহী হচ্ছে?
১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার নানা আয়োজন দেখা যাচ্ছে, আর বাংলা ভাষার প্রতি দেখা যাচ্ছে দারুণ ঔদাসীন্য। বিলীয়মান মাতৃভাষা সমূহকে রক্ষা করার আয়োজন অবশ্যই সফল হবে না। আদিবাসীদের এবং প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে মানবজাতির মূল ধারায় আসতে দিতে হবে। তাদের অবস্থা উন্নত করতে হবে। বাংলাভাষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ঠিক হচ্ছে না।
১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি বহুলাংশে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) সমূহের পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। এই বিশিষ্ট নাগরিকরা ১৯৮০-র দশকের সরকার উৎখাতের আন্দোলনের সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নানা কৌশলে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন। জাতীয় সংসদের ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা- যাঁরা যখন বিরোধী দলে থাকেন- বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যভাবে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতবাসগুলোতে ছোটাছুটি করতে থাকেন এবং পশ্চিমা ক‚টনীতিকরাও প্রকাশ্যভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই ধারার কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে নিঃরাজনীতিকরণের (ফবঢ়ড়ষরঃরপরুধঃরড়হ) প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
নিঃরাজনীতিকরণের কথা ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে অনেকে বলছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই নিঃরাজনীতিকরণ ব্যাপারটাকে খোলাসা করার চেষ্টা করেননি। নিঃরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ায় পড়ে রাজনৈতিক দলগুলো উন্নতি করতে পারছে না। তারা রাজনীতি হারিয়ে নগ্ন ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত আছে।
মূল্যবোধ, যুক্তিবোধ, বিচার-বিবেচনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা- এসবের গুরুত্ব স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমেই অস্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি অত্যন্ত কুৎসিৎ রূপ লাভ করেছে। গণতন্ত্র বলে এখন বোঝানো হচ্ছে কেবল নির্বাচন। আর নির্বাচনকে বলা হচ্ছে উৎসব- জনজীবনের সর্ববৃহৎ উৎসব। গণতন্ত্রের নামে এই উৎসব তো জনগণের সঙ্গে প্রতারণা মাত্র! নির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতায় আসীন হয়ে যা কিছু করে সবই গণতন্ত্র বিরোধী।
৫. রাজনীতিতে সংস্কৃতি
আমাদের রাজনীতির ধারা-উপধারাগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কৃতি সন্ধান করতে গেলে কোথাও সুস্থ স্বাভাবিক সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রধান দুই ধারার নেতারাই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করে নিজ নিজ ভাগ নিয়ে মত্ত আছেন। দুই ধারার কোনোটিই জাতির গোটা ইতিহাসকে ও সমগ্র জনগণকে বিবেচনায় ধরছে না। লক্ষ করলে দেখা যায়, জনগণকে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, তাতে প্রধান দুই ধারায়ই ভেদরেখার অবস্থান ঠিক এক জায়গায়- কেবল নাম ভিন্ন।
এক পক্ষের নেতৃস্থানীয়রা কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন এবং অপর পক্ষের নেতৃস্থানীয়রা কেবল দ্বিজাতিতত্ত্বের যৌক্তিকতার কথা বলেন এবং ভারত-বিদ্বেষ ও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেন। গোটা ইতিহাসকে কোনো পক্ষই বিবেচনায় ধরে না। দুটি পক্ষই জাতিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুটি জল-অচল খুপরিতে ভাগ করে কেবল নিজেদের ভাগকে শক্তিশালী করতে এবং অপর ভাগকে শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর। কেবল আজকের কথা নয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী গোটা সময়ের কথা। এক পক্ষ অন্য পক্ষের যে কোনো ভালো উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সব সময় ভীষণভাবে সক্রিয়। এ অবস্থায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, রাষ্ট্র গঠন করা, রাষ্ট্রীয় জীবনে বড় কিছু অর্জন করা অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে যেমন, তেমনি জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়েও তাদের মধ্যে সব সময় বিরাজ করে দারুণ অনৈক্য।
নির্বাচনের (২০০৮) মাধ্যমে ২০০৯ সালে গঠিত সরকারের আমলে ‘১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার’ যেভাবে করা হচ্ছে, তা নিয়েও তারা বিভক্ত। বিচারকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টাও সহজেই চোখে পড়ে। দরকার ন্যায় প্রতিষ্ঠা;- হিংসা-প্রতিহিংসা ক্ষতিকর। যারা অপরাধী তারা এবং তাদের দল বিচারের বিরোধিতা করবে, এটা স্বাভাবিক; তবে জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থক দেখা দিলে বিপদ। যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বেশি থাকবে- এটা স্বাভাবিক। যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম থেকেই কলাবরেটরদের প্রতি উদার মনোভাব লক্ষ করা গেছে।
বিচারের প্রশ্নে ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমা (এবহবৎধষ অসহবংঃু) ঘোষণার আগে সর্বসাধাণের যে মনোভাব ছিল, পরে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। দুই দলেরই অসহিষ্ণু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রজ্ঞার পরিচয় দূরের কথা, সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক চিন্তারও সন্ধান মেলে না। দুই দলই মুক্তবাজার অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান বিশ্বায়নের বিশ্বস্ত অনুগামী। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ অনুযায়ী। এনজিও ও সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন) সক্রিয় আছে।
আমাদের রাজনীতির ধারা-উপধারাগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কৃতি সন্ধান করতে গেলে কোথাও সুস্থ স্বাভাবিক সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রধান দুই ধারার নেতারাই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করে নিজ নিজ ভাগ নিয়ে মত্ত আছেন। দুই ধারার কোনোটিই জাতির গোটা ইতিহাসকে ও সমগ্র জনগণকে বিবেচনায় ধরছে না। লক্ষ করলে দেখা যায়, জনগণকে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, তাতে প্রধান দুই ধারায়ই ভেদরেখার অবস্থান ঠিক এক জায়গায়- কেবল নাম ভিন্ন।
এক পক্ষের নেতৃস্থানীয়রা কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন এবং অপর পক্ষের নেতৃস্থানীয়রা কেবল দ্বিজাতিতত্ত্বের যৌক্তিকতার কথা বলেন এবং ভারত-বিদ্বেষ ও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেন। গোটা ইতিহাসকে কোনো পক্ষই বিবেচনায় ধরে না। দুটি পক্ষই জাতিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুটি জল-অচল খুপরিতে ভাগ করে কেবল নিজেদের ভাগকে শক্তিশালী করতে এবং অপর ভাগকে শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর। কেবল আজকের কথা নয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী গোটা সময়ের কথা। এক পক্ষ অন্য পক্ষের যে কোনো ভালো উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সব সময় ভীষণভাবে সক্রিয়। এ অবস্থায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, রাষ্ট্র গঠন করা, রাষ্ট্রীয় জীবনে বড় কিছু অর্জন করা অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে যেমন, তেমনি জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়েও তাদের মধ্যে সব সময় বিরাজ করে দারুণ অনৈক্য।
নির্বাচনের (২০০৮) মাধ্যমে ২০০৯ সালে গঠিত সরকারের আমলে ‘১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার’ যেভাবে করা হচ্ছে, তা নিয়েও তারা বিভক্ত। বিচারকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টাও সহজেই চোখে পড়ে। দরকার ন্যায় প্রতিষ্ঠা;- হিংসা-প্রতিহিংসা ক্ষতিকর। যারা অপরাধী তারা এবং তাদের দল বিচারের বিরোধিতা করবে, এটা স্বাভাবিক; তবে জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থক দেখা দিলে বিপদ। যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বেশি থাকবে- এটা স্বাভাবিক। যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম থেকেই কলাবরেটরদের প্রতি উদার মনোভাব লক্ষ করা গেছে।
বিচারের প্রশ্নে ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমা (এবহবৎধষ অসহবংঃু) ঘোষণার আগে সর্বসাধাণের যে মনোভাব ছিল, পরে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। দুই দলেরই অসহিষ্ণু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রজ্ঞার পরিচয় দূরের কথা, সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক চিন্তারও সন্ধান মেলে না। দুই দলই মুক্তবাজার অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান বিশ্বায়নের বিশ্বস্ত অনুগামী। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ অনুযায়ী। এনজিও ও সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন) সক্রিয় আছে।
১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের ও নির্বাচিত সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের যে রাজনীতি আরম্ভ হয়েছে, তাতে দেখা যায়, প্রধান দুই দলের প্রতিটিরই স্থির (পড়হংঃধহঃ) ভোটারের সংখ্যা মোটামুটি সমান- ৩৪%-এর মতো। দুই দলের স্থির ভোটারদের বাইরে অন্য ভোটাররা হুজুগের বশবর্তী হয়ে কিংবা সুবিধা অনুযায়ী, কখনো এই দলকে কখনো ওই দলকে ভোট দেয়।
১৯৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুজুগ খুব বড় ব্যাপার। হীন-স্বার্থন্বেষীরা ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা হীন উপায়ে স্বার্থ হাসিল করে নেওয়ার জন্য প্রচারকার্যের দ্বারা জনসাধারণকে হুজুগে মাতায়। উল্লেখ করা দরকার যে, হুজুগ আর গণজাগরণ এক নয়। গণজাগরণে জনগণের মধ্যকার মহৎ সব মানবীয় গুণাবলি জাগ্রত হয়। হুজুগে তা হয় না। স্থির ভোটারদের সংখ্যা বিচারে দুই দলের কোনোটিকেই কম শক্তিশালী ভাবা যায় না। ১৯৯১, ১৯৯৬ (দ্বিতীয়), ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের চারটি নির্বাচনে এক দল মোট যত ভোট পেয়েছে, অপর দলও মোট তত ভোটই পেয়েছে- ব্যবধান নগণ্য।
১৯৮০-র দশকের সরকার-উৎখাতের ও ক্ষমতা দখলের আন্দোলনের সময় থেকে গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনে। ভোটাভুটিতে জিতে যে দলই সরকার গঠন করুক, সরকারের আচরণে গণতন্ত্রের মর্ম খুঁজে পাওয়া যায় না- গণবিরোধী কার্যকলাপের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেখা যায়। অনেকের আচরণ হয়ে ওঠে মধ্যযুগের রাজা-জমিদার-বরকন্দাজদের মতো। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর (ঈঝঙ) পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের সুশাসনের আহ্বান কোনো কাজে লাগে না। সম্পূর্ণ একনায়কত্ববাদী পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত অপব্যবস্থার মধ্যে সুশাসন কি সম্ভব?
মন্ত্রিপরিষদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা খুব বলা হয়, কিন্তু ক্ষমতা দখল করা হয় ছলে, বলে, কালে, কৌশলে- শক্তি প্রয়োগ করে, কালো টাকা ব্যয় করে, বৃহৎ শক্তিবর্গের সহায়তা নিয়ে। জনগণের জন্য এই ব্যবস্থা আগেকার রাজতান্ত্রিক-জমিদারতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই স্বৈরাচারমূলক, নির্যাতনমূলক, বঞ্চনামূলক রূপ নিয়েছে।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মসমালোচনার, আত্মগঠনের, আত্মোৎকর্ষের, সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক শৃঙ্খলা অর্জনের কোনো প্রবণতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির মান কোনোদিনই উন্নত হতে পারে না। বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বুদ্ধিতে, নিজেদের শক্তিতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে পারে না। প্রধান দুই দলই নির্বাচনে জেতার জন্য পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে যোগাযোগে লিপ্ত থাকে। একটি ধারাকে ভারতের ক‚টনীতিকদের কাছেও ধরনা দিতে দেখা যাচ্ছে। এসবের দ্বারা নেতারা নিজেদের দাসানুদাস প্রমাণ করেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেন, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেন- জনজীবনের দুর্দশা বৃদ্ধি করেন। এই নেতৃত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ বাংলাদেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়ায়ও একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলছে না।
৬. জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র : বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য
বা সমন্বয় ও প্রগতি
১৯৮০-র দশকের শুরুতে সূচিত মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন থেকে এ বছরের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ (২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মে) পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলির কালে রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় শক্তি বেড়েছে এবং বেপরোয়া হচ্ছে আর সমাজের গভীর থেকে পুরাতন পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাস ও রীতিনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়ে সামনে এসেছে। এই সময়ে ধর্মপন্থীদের থেকে জনগণের কাছে ধর্মীয় নীতি ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করা হয়েছে। বিবিসি রেডিও, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও দেশি-বিদেশি প্রচার মাধ্যম কথিত গণতন্ত্রীদের দুর্নীতির ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রচার চালিয়েছে, তার ফলাফল গিয়ে জমা হয়েছে ধর্মপন্থীদের খাতায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিবিসি রেডিও যে তৎপরতা চালিয়েছে তার ফলাফল কী হয়েছে? ধর্মপন্থী সংগঠনগুলো আত্মগঠনে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বাড়ছে। গণতন্ত্রীরা নীতি ও নৈতিক বিবেচনার কিংবা সংস্কৃতির ধার ধারছেন না, তাঁরা দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, প্রতারক, কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপি, জুলুমবাজ, দুর্বৃত্ত, স্বৈরাচারী, লুটেরা, আত্মবিক্রীত, ধান্ধাবাজ, প্রতারক, চালিয়াত, জালিয়াত ইত্যাদি বলে অভিহিত হচ্ছেন। এ দেশের গণতন্ত্রীরা নৈতিক সকল বিষয়কে সম্পূর্ণ ধর্মের অন্তর্গত বিষয় মনে করেন এবং নৈতিক বিবেচনা পরিহার করে চলেন। আত্মগঠন ও দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি তাঁদের দৃষ্টি নেই। তাঁদের অন্তর্গত চালিকাশক্তি সংস্কৃতি নয়, অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে উত্তীর্ণ হওয়ার কিংবা বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছা তাঁদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। জনজীবনের দুর্দশা কমানোর প্রশ্নেও তাঁরা সততার সঙ্গে কাজ করেন না। গণতন্ত্রের ধারণাকে তাঁরা ফোকলা করে ফেলেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যেভাবে তাঁরা প্রচার করছেন তাও ফোকলা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে যে বিরোধ, তা এখন আস্তিক-নাস্তিকের বিরোধ বলে অভিহিত হচ্ছে। গণতন্ত্রীদের ব্যর্থতাই ধর্মপন্থীদের উত্থানের মূল কারণ।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গণতন্ত্রের কথা যত উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করেই বলা হোক, জনগণ কথিত গণতন্ত্রে আস্থা হারাচ্ছে এবং ধর্মের দিকে ঝুঁকছে। কথিত গণতন্ত্র থেকে সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ইত্যাদি ধারণা হারিয়ে গেছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে মানুষ হয়ে চলছে অমানবিকীকৃত (ফবযঁসধযরুধঃরড়হ ড়ভ সধহ রহ ংড়পরবঃু)। অবস্থা এখন এমন যে, গণতন্ত্রীরা যত দিন দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ও দুঃশাসক বলে পরিচিত থাকবেন, ততদিন লোকে ধর্মের দিকে ঝুঁকতে থাকবেই। যখন নির্বাচন আসে তখন জনগণ কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য না ভেবে, এক দলের প্রতি বিরূপ হয়ে, অন্য দলকে ভোট দেয়। ভোটাভুটিতে ধর্মের আর ভোটাভুটি উপলক্ষে সৃষ্ট হুজুগেরও থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নির্বাচন উপলক্ষে এমনভাবে প্রচার চালানো হয় যে, মনে হয় জনগণের কাছে নির্বাচন যেন শুধু অকারণ পুলকের ক্ষণিক উল্লাস!
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সরকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে- জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদিতে- যে সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় তা সুস্থ স্বাভাবিক নয়, অপব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে বিকারপ্রাপ্ত। যে-কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্য সংস্কারের প্রশ্ন উঠলেই দুই ধারার মধ্যে দেখা দেয় মতপার্থক্য ও তীব্র বাদ-প্রতিবাদ। এতে উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সর্বজনীন কল্যাণের বিবেচনা যেখানে নেই সেখানে মতপার্থক্য ও বিবাদ রূপ নেয় নগ্ন স্বার্থের সংঘাতে।
দেশব্যাপী জনগণের সংস্কৃতিচেতনাও নিম্নগামী। সাধারণ মানুষের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব সুস্থ স্বাভাবিক নেই। বাংলাদেশে জনগণের মানসিকতাকে কে বা কারা কিভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তুলবেন? দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তি : যে জনগণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনগণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নানা ধারায় এতটাই বিভক্ত করে রাখা হয়েছে যে, তা জাতি গড়ে ওঠার কিংবা জনগণের ঐক্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সরকার ও এনজিওগুলো এই বিভক্তিকে বাড়িয়ে চলছে। সর্বত্র দেখা যাচ্ছে দলীয়করণ ও দলবাজি। দলীয়করণ ও দলবাজির কারণে শিক্ষাব্যবস্থাও বিকারপ্রাপ্ত। শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে চলছে নব্যউদারতাবাদের অন্ধ অনুসরণ। পশ্চিমের প্রগতিশীল ভাবধারার প্রতি কৌত‚হল খুঁজে পাওয়া যায় না, কৌত‚হল কেবল সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার প্রতি। প্রশাসনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা দারুণ দুর্গতির মধ্যে আছে। কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলছে না।
সিভিল সোসাইটিগুলো সংস্কৃতির বহুত্ববাদের কথা বলে জাতির বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার পরিপন্থী কর্মনীতি নিয়ে ভীষণভাবে সক্রিয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ যে সিভিল সোসাইটিসমূহের কার্যকলাপ দ্বারা উপকৃত হচ্ছে তা নয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে তারা জনপ্রবাহের মূলধারায় আসতে দিচ্ছে না। জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মানবজাতির মূলধারায় আসার পরিপন্থী নীতি। শত শত বৎসর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ও কানাডার রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকার যে নীতি অবলম্বন করে চলছে, পৃথিবীব্যাপী প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের বেলায় তাকেই পরিণত করা হয়েছে জাতিসংঘের নীতিতে।
নারীবাদী আন্দোলন ও মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন যেভাবে চালানো হচ্ছে, তাও সুস্থ রাজনৈতিক বিকাশের ও জনগণের ঐক্যের পরিপন্থী। কোনো কোনো মহল থেকে ধর্মের বিরুদ্ধে নানারকম দায়িত্বহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বেশি জটিল করে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্রকে উন্নত করার কোনো চেষ্টা নেই।
আমাদের দেশে জনজীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে বলা হতো ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’। তাতে ‘বৈচিত্র্য’ ও ‘ঐক্য’ দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দেওয়ার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও সমাজে মানুষের তৈরি কৃত্রিম বৈষম্য দূর করার কথা ভাবা হতো। স্বার্থের বিরোধের মধ্যে সবকিছু যে ঠিকমতো করা হতো কিংবা পারা যেত, তা নয়। বাংলাভাষার দেশে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে প্রায় চার দশক ধরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রক্তাক্ত কাল গিয়েছে।
সে অবস্থায়ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অপসারণ করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারি ব্যবস্থা। তারপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি- সরকারি দল, বিরোধী দল, পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সর্বজনীন কল্যাণের চেতনা বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ সুবিধাবাদী ও স্বেচ্ছাচারী নীতি নিয়ে চলছে। ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে জনগণের শক্তির প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেই নীতি রক্ষা করে সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতিসাধন করা হয়নি বলে, বিশেষ করে সারা দেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহকে বঞ্চিত করার ফলে, জনগণের ঐক্য বজায় থাকেনি। ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা কার্যকর করছে সংস্কৃতির বহুত্ববাদ (ঢ়ষঁৎধষরংস রহ পঁষঃঁৎব)। এর মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতির বহুত্ববাদ দিয়ে জাতির ভেতরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজিত বিরোধগুলোকে উসকে দিয়ে জাতীয় ঐক্য নষ্ট করা হয়েছে। বহুত্বমূলক সমন্বয়ের কথা কেউ ভাবছেন না। কেবল বৈচিত্র্য বাড়ানো হচ্ছে, ঐক্যের কথা ভাবাই হচ্ছে না। অদৃশ্য পরিকল্পনার দ্বারা বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় জাতি ও রাষ্ট্র ব্যর্থ না হয়ে সফল হবে কীভাবে?
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল সা¤প্রদায়িকতাবাদকে- একদিকে হিন্দু সা¤প্রদায়িকতাবাদ ও অপরদিকে মুসলিম সা¤প্রদায়িকতাবাদ। তখনকার রাজনীতিতে সা¤প্রদায়িকতাবাদ অবলম্বন করে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ ভারত-ভাগে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪০-এর দশকে বাংলা কংগ্রেস বহুলাংশে পরিচালিত হয়েছিল বাংলার হিন্দু মহাসভা দ্বারা। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় ও অসহযোগও হিন্দুত্ববাদের সীমা অতিক্রম করে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। তখন হিন্দু-মুসলিম বিরোধের উন্মাদনার মধ্যে দৈশিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতি গড়ে তোলার তৎপরতা চালানো হয়। উর্দুভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং বাংলাভাষাকে পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতির অনুক‚ল রূপ দেওয়ার কার্যক্রম চালানো হয়। পূর্ববাংলার শিক্ষিত সমাজে এই কর্মধারার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রায় রাতারাতি বাস্তবতা বদলে যায়। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতি সৃষ্টির তৎপরতার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। পাকিস্তানকালের ভিন্ন বাস্তবতায় পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশ।
জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রগঠনের আদর্শ রূপে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র অপরিহার্য। আমাদের দেশে এসব আদর্শের কথা প্রচার করা হলেও এবং সংবিধানে এগুলোকে স্থান দেওয়া হলেও, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কোনোটাকেই অবলম্বন করা হয়নি। অধিকন্তু জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের বিবেচনা বাদ দিয়ে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের প্ররোচনায় চালানো হয়েছে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন, সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে আন্দোলন ইত্যাদি। এসব আন্দোলনের উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র মার খেয়ে গেছে এবং জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস বিভ্রান্তিতে পড়েছে। নানাভাবে জনসাধারণকে বিভক্ত করে উত্তেজনা ও অনৈক্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে বুঝবার চেষ্টা করা হয়নি। সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়নি।
জাতীয়তাবোধ, জাতীয় চেতনা, জাতীয় ঐক্য ও জাতিরাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে বিকশিত না করার ফলে এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ না করার ফলে বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় সত্তা দুর্গতিতে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিথ্যাকে স্থান দেওয়ার ফলে, ইতিহাসকে বিকৃত করার ফলে, রেনেসাঁস ও প্রগতির ধারণা পরিহার করার ফলে, হীন উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র ও ধর্মকে ব্যবহার করার ফলে, গণতন্ত্রকে ভোটাভুটিতে পর্যবসিত করার ফলে, ধর্মীয় শক্তির পুনরুজ্জীবনের ফলে, অবস্থা এখন অত্যন্ত বেশি জটিল হয়ে পড়েছে। সমাজে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিযুক্তি (ধষরবহধঃরড়হ/ বংঃৎধহমবসবহঃ) কেবল বাড়ছে-সংহতির (রহঃবমৎধঃরড়হ) সম্ভাবনাকে কেবল বিনষ্ট করা হচ্ছে।
১৯৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুজুগ খুব বড় ব্যাপার। হীন-স্বার্থন্বেষীরা ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা হীন উপায়ে স্বার্থ হাসিল করে নেওয়ার জন্য প্রচারকার্যের দ্বারা জনসাধারণকে হুজুগে মাতায়। উল্লেখ করা দরকার যে, হুজুগ আর গণজাগরণ এক নয়। গণজাগরণে জনগণের মধ্যকার মহৎ সব মানবীয় গুণাবলি জাগ্রত হয়। হুজুগে তা হয় না। স্থির ভোটারদের সংখ্যা বিচারে দুই দলের কোনোটিকেই কম শক্তিশালী ভাবা যায় না। ১৯৯১, ১৯৯৬ (দ্বিতীয়), ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের চারটি নির্বাচনে এক দল মোট যত ভোট পেয়েছে, অপর দলও মোট তত ভোটই পেয়েছে- ব্যবধান নগণ্য।
১৯৮০-র দশকের সরকার-উৎখাতের ও ক্ষমতা দখলের আন্দোলনের সময় থেকে গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনে। ভোটাভুটিতে জিতে যে দলই সরকার গঠন করুক, সরকারের আচরণে গণতন্ত্রের মর্ম খুঁজে পাওয়া যায় না- গণবিরোধী কার্যকলাপের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেখা যায়। অনেকের আচরণ হয়ে ওঠে মধ্যযুগের রাজা-জমিদার-বরকন্দাজদের মতো। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর (ঈঝঙ) পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের সুশাসনের আহ্বান কোনো কাজে লাগে না। সম্পূর্ণ একনায়কত্ববাদী পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত অপব্যবস্থার মধ্যে সুশাসন কি সম্ভব?
মন্ত্রিপরিষদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা খুব বলা হয়, কিন্তু ক্ষমতা দখল করা হয় ছলে, বলে, কালে, কৌশলে- শক্তি প্রয়োগ করে, কালো টাকা ব্যয় করে, বৃহৎ শক্তিবর্গের সহায়তা নিয়ে। জনগণের জন্য এই ব্যবস্থা আগেকার রাজতান্ত্রিক-জমিদারতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই স্বৈরাচারমূলক, নির্যাতনমূলক, বঞ্চনামূলক রূপ নিয়েছে।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মসমালোচনার, আত্মগঠনের, আত্মোৎকর্ষের, সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক শৃঙ্খলা অর্জনের কোনো প্রবণতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির মান কোনোদিনই উন্নত হতে পারে না। বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বুদ্ধিতে, নিজেদের শক্তিতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে পারে না। প্রধান দুই দলই নির্বাচনে জেতার জন্য পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে যোগাযোগে লিপ্ত থাকে। একটি ধারাকে ভারতের ক‚টনীতিকদের কাছেও ধরনা দিতে দেখা যাচ্ছে। এসবের দ্বারা নেতারা নিজেদের দাসানুদাস প্রমাণ করেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেন, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেন- জনজীবনের দুর্দশা বৃদ্ধি করেন। এই নেতৃত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ বাংলাদেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়ায়ও একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলছে না।
৬. জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র : বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য
বা সমন্বয় ও প্রগতি
১৯৮০-র দশকের শুরুতে সূচিত মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন থেকে এ বছরের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ (২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মে) পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলির কালে রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় শক্তি বেড়েছে এবং বেপরোয়া হচ্ছে আর সমাজের গভীর থেকে পুরাতন পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাস ও রীতিনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়ে সামনে এসেছে। এই সময়ে ধর্মপন্থীদের থেকে জনগণের কাছে ধর্মীয় নীতি ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করা হয়েছে। বিবিসি রেডিও, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও দেশি-বিদেশি প্রচার মাধ্যম কথিত গণতন্ত্রীদের দুর্নীতির ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রচার চালিয়েছে, তার ফলাফল গিয়ে জমা হয়েছে ধর্মপন্থীদের খাতায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিবিসি রেডিও যে তৎপরতা চালিয়েছে তার ফলাফল কী হয়েছে? ধর্মপন্থী সংগঠনগুলো আত্মগঠনে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বাড়ছে। গণতন্ত্রীরা নীতি ও নৈতিক বিবেচনার কিংবা সংস্কৃতির ধার ধারছেন না, তাঁরা দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, প্রতারক, কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপি, জুলুমবাজ, দুর্বৃত্ত, স্বৈরাচারী, লুটেরা, আত্মবিক্রীত, ধান্ধাবাজ, প্রতারক, চালিয়াত, জালিয়াত ইত্যাদি বলে অভিহিত হচ্ছেন। এ দেশের গণতন্ত্রীরা নৈতিক সকল বিষয়কে সম্পূর্ণ ধর্মের অন্তর্গত বিষয় মনে করেন এবং নৈতিক বিবেচনা পরিহার করে চলেন। আত্মগঠন ও দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি তাঁদের দৃষ্টি নেই। তাঁদের অন্তর্গত চালিকাশক্তি সংস্কৃতি নয়, অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে উত্তীর্ণ হওয়ার কিংবা বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছা তাঁদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। জনজীবনের দুর্দশা কমানোর প্রশ্নেও তাঁরা সততার সঙ্গে কাজ করেন না। গণতন্ত্রের ধারণাকে তাঁরা ফোকলা করে ফেলেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যেভাবে তাঁরা প্রচার করছেন তাও ফোকলা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে যে বিরোধ, তা এখন আস্তিক-নাস্তিকের বিরোধ বলে অভিহিত হচ্ছে। গণতন্ত্রীদের ব্যর্থতাই ধর্মপন্থীদের উত্থানের মূল কারণ।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গণতন্ত্রের কথা যত উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করেই বলা হোক, জনগণ কথিত গণতন্ত্রে আস্থা হারাচ্ছে এবং ধর্মের দিকে ঝুঁকছে। কথিত গণতন্ত্র থেকে সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ইত্যাদি ধারণা হারিয়ে গেছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে মানুষ হয়ে চলছে অমানবিকীকৃত (ফবযঁসধযরুধঃরড়হ ড়ভ সধহ রহ ংড়পরবঃু)। অবস্থা এখন এমন যে, গণতন্ত্রীরা যত দিন দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ও দুঃশাসক বলে পরিচিত থাকবেন, ততদিন লোকে ধর্মের দিকে ঝুঁকতে থাকবেই। যখন নির্বাচন আসে তখন জনগণ কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য না ভেবে, এক দলের প্রতি বিরূপ হয়ে, অন্য দলকে ভোট দেয়। ভোটাভুটিতে ধর্মের আর ভোটাভুটি উপলক্ষে সৃষ্ট হুজুগেরও থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নির্বাচন উপলক্ষে এমনভাবে প্রচার চালানো হয় যে, মনে হয় জনগণের কাছে নির্বাচন যেন শুধু অকারণ পুলকের ক্ষণিক উল্লাস!
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সরকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে- জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদিতে- যে সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় তা সুস্থ স্বাভাবিক নয়, অপব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে বিকারপ্রাপ্ত। যে-কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্য সংস্কারের প্রশ্ন উঠলেই দুই ধারার মধ্যে দেখা দেয় মতপার্থক্য ও তীব্র বাদ-প্রতিবাদ। এতে উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সর্বজনীন কল্যাণের বিবেচনা যেখানে নেই সেখানে মতপার্থক্য ও বিবাদ রূপ নেয় নগ্ন স্বার্থের সংঘাতে।
দেশব্যাপী জনগণের সংস্কৃতিচেতনাও নিম্নগামী। সাধারণ মানুষের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব সুস্থ স্বাভাবিক নেই। বাংলাদেশে জনগণের মানসিকতাকে কে বা কারা কিভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তুলবেন? দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তি : যে জনগণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনগণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নানা ধারায় এতটাই বিভক্ত করে রাখা হয়েছে যে, তা জাতি গড়ে ওঠার কিংবা জনগণের ঐক্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সরকার ও এনজিওগুলো এই বিভক্তিকে বাড়িয়ে চলছে। সর্বত্র দেখা যাচ্ছে দলীয়করণ ও দলবাজি। দলীয়করণ ও দলবাজির কারণে শিক্ষাব্যবস্থাও বিকারপ্রাপ্ত। শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে চলছে নব্যউদারতাবাদের অন্ধ অনুসরণ। পশ্চিমের প্রগতিশীল ভাবধারার প্রতি কৌত‚হল খুঁজে পাওয়া যায় না, কৌত‚হল কেবল সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার প্রতি। প্রশাসনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা দারুণ দুর্গতির মধ্যে আছে। কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলছে না।
সিভিল সোসাইটিগুলো সংস্কৃতির বহুত্ববাদের কথা বলে জাতির বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার পরিপন্থী কর্মনীতি নিয়ে ভীষণভাবে সক্রিয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ যে সিভিল সোসাইটিসমূহের কার্যকলাপ দ্বারা উপকৃত হচ্ছে তা নয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে তারা জনপ্রবাহের মূলধারায় আসতে দিচ্ছে না। জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মানবজাতির মূলধারায় আসার পরিপন্থী নীতি। শত শত বৎসর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ও কানাডার রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকার যে নীতি অবলম্বন করে চলছে, পৃথিবীব্যাপী প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের বেলায় তাকেই পরিণত করা হয়েছে জাতিসংঘের নীতিতে।
নারীবাদী আন্দোলন ও মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন যেভাবে চালানো হচ্ছে, তাও সুস্থ রাজনৈতিক বিকাশের ও জনগণের ঐক্যের পরিপন্থী। কোনো কোনো মহল থেকে ধর্মের বিরুদ্ধে নানারকম দায়িত্বহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বেশি জটিল করে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্রকে উন্নত করার কোনো চেষ্টা নেই।
আমাদের দেশে জনজীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে বলা হতো ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’। তাতে ‘বৈচিত্র্য’ ও ‘ঐক্য’ দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দেওয়ার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও সমাজে মানুষের তৈরি কৃত্রিম বৈষম্য দূর করার কথা ভাবা হতো। স্বার্থের বিরোধের মধ্যে সবকিছু যে ঠিকমতো করা হতো কিংবা পারা যেত, তা নয়। বাংলাভাষার দেশে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে প্রায় চার দশক ধরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রক্তাক্ত কাল গিয়েছে।
সে অবস্থায়ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অপসারণ করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারি ব্যবস্থা। তারপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি- সরকারি দল, বিরোধী দল, পেশাদার বিশিষ্ট নাগরিকদের সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (ঈঝঙ) রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সর্বজনীন কল্যাণের চেতনা বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ সুবিধাবাদী ও স্বেচ্ছাচারী নীতি নিয়ে চলছে। ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে জনগণের শক্তির প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেই নীতি রক্ষা করে সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতিসাধন করা হয়নি বলে, বিশেষ করে সারা দেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহকে বঞ্চিত করার ফলে, জনগণের ঐক্য বজায় থাকেনি। ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা কার্যকর করছে সংস্কৃতির বহুত্ববাদ (ঢ়ষঁৎধষরংস রহ পঁষঃঁৎব)। এর মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতির বহুত্ববাদ দিয়ে জাতির ভেতরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজিত বিরোধগুলোকে উসকে দিয়ে জাতীয় ঐক্য নষ্ট করা হয়েছে। বহুত্বমূলক সমন্বয়ের কথা কেউ ভাবছেন না। কেবল বৈচিত্র্য বাড়ানো হচ্ছে, ঐক্যের কথা ভাবাই হচ্ছে না। অদৃশ্য পরিকল্পনার দ্বারা বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় জাতি ও রাষ্ট্র ব্যর্থ না হয়ে সফল হবে কীভাবে?
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল সা¤প্রদায়িকতাবাদকে- একদিকে হিন্দু সা¤প্রদায়িকতাবাদ ও অপরদিকে মুসলিম সা¤প্রদায়িকতাবাদ। তখনকার রাজনীতিতে সা¤প্রদায়িকতাবাদ অবলম্বন করে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ ভারত-ভাগে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪০-এর দশকে বাংলা কংগ্রেস বহুলাংশে পরিচালিত হয়েছিল বাংলার হিন্দু মহাসভা দ্বারা। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় ও অসহযোগও হিন্দুত্ববাদের সীমা অতিক্রম করে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। তখন হিন্দু-মুসলিম বিরোধের উন্মাদনার মধ্যে দৈশিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতি গড়ে তোলার তৎপরতা চালানো হয়। উর্দুভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং বাংলাভাষাকে পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতির অনুক‚ল রূপ দেওয়ার কার্যক্রম চালানো হয়। পূর্ববাংলার শিক্ষিত সমাজে এই কর্মধারার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রায় রাতারাতি বাস্তবতা বদলে যায়। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতি সৃষ্টির তৎপরতার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। পাকিস্তানকালের ভিন্ন বাস্তবতায় পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশ।
জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রগঠনের আদর্শ রূপে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র অপরিহার্য। আমাদের দেশে এসব আদর্শের কথা প্রচার করা হলেও এবং সংবিধানে এগুলোকে স্থান দেওয়া হলেও, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কোনোটাকেই অবলম্বন করা হয়নি। অধিকন্তু জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের বিবেচনা বাদ দিয়ে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের প্ররোচনায় চালানো হয়েছে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন, সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে আন্দোলন ইত্যাদি। এসব আন্দোলনের উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র মার খেয়ে গেছে এবং জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস বিভ্রান্তিতে পড়েছে। নানাভাবে জনসাধারণকে বিভক্ত করে উত্তেজনা ও অনৈক্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে বুঝবার চেষ্টা করা হয়নি। সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়নি।
জাতীয়তাবোধ, জাতীয় চেতনা, জাতীয় ঐক্য ও জাতিরাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে বিকশিত না করার ফলে এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ না করার ফলে বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় সত্তা দুর্গতিতে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিথ্যাকে স্থান দেওয়ার ফলে, ইতিহাসকে বিকৃত করার ফলে, রেনেসাঁস ও প্রগতির ধারণা পরিহার করার ফলে, হীন উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র ও ধর্মকে ব্যবহার করার ফলে, গণতন্ত্রকে ভোটাভুটিতে পর্যবসিত করার ফলে, ধর্মীয় শক্তির পুনরুজ্জীবনের ফলে, অবস্থা এখন অত্যন্ত বেশি জটিল হয়ে পড়েছে। সমাজে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিযুক্তি (ধষরবহধঃরড়হ/ বংঃৎধহমবসবহঃ) কেবল বাড়ছে-সংহতির (রহঃবমৎধঃরড়হ) সম্ভাবনাকে কেবল বিনষ্ট করা হচ্ছে।
৭. জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য চর্চায় সংস্কৃতি
কোনো জাতির প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালের সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে সেই জাতির রাষ্ট্রগঠন ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
আমরা রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলেও অনৈক্যের মধ্যে জনসমষ্টি রূপে অস্তিমান আছি। রাষ্ট্র গড়ে তোলা না হলেও আমাদের দেশ আছে। জাতি হয়ে ওঠার ও রাষ্ট্রগঠনের সম্ভাবনা ও সুযোগ আমাদের আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান দিক দিয়ে আমাদের আছে বিরাট অগ্রগতি। সকল বিষয়েই প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং অনেক অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন নতুন চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যেরও অন্ত নেই। আছে- সঙ্গীত, নাট্যকলা, সিনেমা, নৃত্যকলা। এসবের গুণগত দিক সম্পর্কে মন্তব্য করা দুঃসাধ্য।
কারণ সমালোচনা নেই, ভালো-মন্দের বিচার নেই- ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞানও যেন লোপ পেয়েছে। চিত্রকলা, সঙ্গীত, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদিতে যা কিছু উৎকৃষ্ট, সেগুলোর উৎকৃষ্টতা কোনো কোনো সুযোগ্য সমালোচকের মাধ্যমে চিহ্নিত হলে অনেক কিছু বোঝা যেত এবং তাতে উৎকৃষ্ট নতুন সৃষ্টির পথ সুগম হতো। পূর্বোক্ত দুই ধারার কোনোটিই এ কাজে অগ্রসর হয়নি। ঢাকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে বড় কোনো সমালোচক আত্মপ্রকাশ করেননি।
গবেষণার ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের অনুকরণ ও অনুসরণ। স্বাধীন বাংলাদেশে পাশ্চাত্য প্রগতিশীল মহান ভাবধারার প্রতি আগ্রহ দুর্লভ। শূন্যবাদী (হরযরষরংস) দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, এৎধহফ ঘধৎৎধঃরাব, গধংঃবৎ উরংপড়ঁৎংব ইত্যাদি বলে ক্লাসিকের ও আদর্শের প্রতি প্রদর্শন করা হয় অবজ্ঞা। সমগ্রের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল অংশের দিকে, সাধারণের (মবহবৎধষ) দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল বিশেষের (ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ) দিকে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
বাংলা সাহিত্যে ১৯২০-এর দশক থেকে আধুনিকতাবাদ (সড়ফবৎহরংস) ক্রমে কর্তৃত্বশীল অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তার ওপর ১৯৮০-র দশক থেকে অনুশীলিত হচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদ (ঢ়ড়ংঃসড়ফবৎহরংস)। আধুনিকতাবাদ সীমাবদ্ধ ছিল সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে, উত্তরাধুনিকতাবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সকল বিষয়কেই নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছে। আধুনিকতাবাদের কার্যকর সমালোচনা আছে আবু সয়ীদ আইয়ুবের চড়বঃৎু ধহফ ঞৎঁঃয এবং আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ দুটিতে। বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সেকালের অনেক লেখক ‘আধুনিকতাবাদ’কে অভিহিত করেছেন ‘আধুনিকতা’ বলে। বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার গবেষণায় এবং সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রতি বিচার-বিবেচনাহীন আগ্রহ ও নির্বিচার অনুগামিতা। বিচারমূলক প্রবণতা দুর্লভ। লক্ষ করা দরকার যে, আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ দেখা দিয়েছে কাউন্টার-রেনেসাঁস রূপে। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে উন্নত বিষয় কার্যকরভাবে গ্রহণ করার মধ্যেও সৃষ্টিশীলতা থাকে। অনুকরণ-অনুসরণ আর সৃষ্টিশীল উপায়ে গ্রহণ এক নয়।
যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে দরকার বিবেকবান চিন্তাশীল লেখক-শিল্পীদের ঐক্য। দরকার তাঁদের চিন্তার ও কর্মের স্বতন্ত্র কেন্দ্র ও সংগঠন। দরকার নতুন রেনেসাঁসের জন্য একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন। সত্যসন্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ, স্বাধীন চিন্তাশীলতা অবলম্বন করে প্রগতির ও সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কর্মতৎপর হওয়া দরকার। নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতায় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রগতি সম্পর্কে উপলব্ধির অমূল পুনর্গঠন দরকার। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে প্রগতির ধারণাকে সীমাবদ্ধ রাখা একটুও সমীচীন নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের জন্য দরকার নতুন রেনেসাঁসের স্পিরিট নিয়ে দূরদর্শী কার্যক্রম। বাইরের জগত থেকে গ্রহণ করতে হবে নিজেদের সত্তায় থেকে, আত্মসত্তা বিসর্জন দিয়ে নয়।
নিকৃষ্ট রাজনৈতিক দলের হীন-স্বার্থান্বেষী লেজুড়বৃত্তি দ্বারা লেখক-শিল্পীদের কোনো উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় প্রকাশ পায় না। দলীয় গণ্ডির বাইরে সর্বজনীন কল্যাণের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যেগুলোকে দলমতনির্বিশেষে সকলেরই সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া কর্তব্য। সেগুলোকে বুঝতে না পারলে, মূল্য না দিলে জাতির সংস্কৃতি বিকারপ্রাপ্ত হয়- প্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধ, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় স্বার্থ তেমনি একটি বিষয়। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দরকার জাতীয়তাবাদের সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। উপনিবেশিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকার।
নতুন রেনেসাঁস, নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রগতির প্রয়োজনে সকল গণবিরোধী মতবাদ ও সকল গণবিরোধী শক্তিকে দমন রাখতে হবে। জাতির অন্তর্গত সকল জনগোষ্ঠীর ও সকল স্তরের জনগণের স্বার্থকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে এবং জাতীয় ঐক্যকে নিশ্চিত করে জাতীয়তাবাদকে সফল করতে হবে। যাঁরা সততার সঙ্গে চলতে চান তাঁদের চলার সুযোগ আইন-কানুনের দ্বারা অবারিত রাখতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অনুসন্ধিৎসাকে এবং মানবিক গুণাবলিকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে। জনগণের ওপর অপশক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হলে, জাতিকে বিভক্ত করে অনৈক্যের মধ্যে রাখা হলে, জনগণ বিভক্ত থাকলে, রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের ওপর বিদেশি শক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হয়, রাষ্ট্র পরাধীন হয়ে যায়। জাতির ইতিহাসে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করা হলে, ইতিহাসকে বিকৃত করা হলে জাতির আত্মাই বিকৃত হয়ে যায়।
অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে যারা পিছিয়ে আছে, যারা মোট জনসংখ্যার শতকরা নব্বই ভাগ, যারা উৎপাদনশীল, সেই শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত কথিত উদার গণতন্ত্রে দারুণভাবে নির্জিত, বঞ্চিত, প্রতারিত। সব দিক দিয়েই তারা দুরবস্থায় আছে। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে তাদের খাওয়া-পরার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু শ্রমজীবীরা কঠোর শ্রমের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সামাজিক ন্যায় ও মানবিক দিক লক্ষ করলে দেখা যায় তাদের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর পৃথিবীর সর্বত্রই তারা আগের চেয়ে বেশি নির্জিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে। যারা শক্তিমান, বিত্তবান, বিদ্বান, সর্বসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক বৈষম্য ও বিযুক্তি (ধষরবহধঃরড়হ /বংঃৎধহমবসবহঃ) বাড়ছে। সাধারণ মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ও প্রতিকার চাওয়ার সাহস হারাচ্ছে। উদার গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষ শাসক শ্রেণির লোকদের উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্র হয়ে আছে।
বাংলাদেশে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে রাজধানীতে, গ্রাম নিদারুণ বঞ্চনার শিকার। প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে দূরে সরিয়ে, বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনের কালে দুর্নীতি ও নারীনির্যাতন কমছে না, বাড়ছে। মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় শক্তি প্রবল হচ্ছে এবং পরিত্যক্ত ও পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। দেখা দিয়েছে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড। জাতীয় পর্যায়ে জনগণের রুচি-পছন্দ ও চিন্তা-চেতনার মান উন্নত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ও তাদের দেশীয় অনুসারীদের স্বার্থসিদ্ধির অনুক‚ল। সামাজিক ন্যায় কমতির দিকে হওয়ার ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, নারীনির্যাতন বাড়ছে, হত্যা-আত্মহত্যা বাড়ছে, হিংসা-প্রতিহিংসা বাড়ছে, অনাস্থা ও হতাশা বাড়ছে, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে চলছে।
বাংলাদেশে ষোল কোটি মানুষের জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উন্নতির আকাক্সক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি, সামাজিক সংহতি ও বিযুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা, প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির যে পরিচয় প্রকাশ পায়, তা সুস্থ, স্বাভাবিক নয়; তা রুগ্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত, বিকারপ্রাপ্ত। এই সংস্কৃতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল করে তোলার জন্য জাতীয় জীবনে নতুন সংকল্প, নতুন চিন্তাধারা ও নতুন কর্মধারা দরকার। দরকার নতুন সাংগঠনিক আয়োজন ও নতুন নেতৃত্ব। দরকার বাংলাদেশের প্রতিটি নর-নারীর সংস্কৃতি-চেতনার কার্যকর সুষ্ঠু বিকাশ। যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে বর্তমান আমাদের অন্ধকার, ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকার। জাতীয় জীবনে আলোর সন্ধান পেতে হলে বিভেদকে পেছনে ফেলে সংশ্লেষণমূলক নতুন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরস্পর সম্পূূরক।
আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে, তা স্বাভাবিক। তবে সকল পক্ষকেই তথ্যনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ হতে হবে। মতপার্থক্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এবং জাতীয় ঐক্যের ও জাতীয় উন্নতির মনোভাবও অবশ্যই থাকতে হবে। এক পক্ষ সব সময় অন্য পক্ষকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় থাকলে শেষ পর্যন্ত তার ফল বিজয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে। জাতীয় জীবনে বিরোধের উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে সম্প্রীতির, ঐক্যের ও সংহতির উপাদানও। এ অবস্থায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি কার্যকর করতে হবে। সবাই এক রকম চিন্তা করবেন, তা ভাবা বাস্তবসম্মত নয়। প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল ধারা থাকবে। কিন্তু চলমান দুটি ধারার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে তাতে সুস্থতা নেই, স্বাভাবিকতা নেই, তথ্যনিষ্ঠা নেই, সত্যাগ্রহ নেই। প্রগতির প্রবণতা নেই দুই ধারার কোনোটির মধ্যেই। যাঁরা সততার সঙ্গে চিন্তা করবেন এবং সৎভাবে কাজ করতে চাইবেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য, অবস্থার উন্নতির জন্য জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে, জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে, জাতীয় সংহতির উপায় নিয়ে মোহমুক্ত, জেদাজেদিমুক্ত, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, ইতিহাসসম্মত, কর্মমুখী চিন্তায় অগ্রসর হওয়া। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধ কমলে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি এবং রাজনীতির উন্নতি হলে জাতি উন্নত হয়।
কোনো জাতির প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালের সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে সেই জাতির রাষ্ট্রগঠন ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
আমরা রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলেও অনৈক্যের মধ্যে জনসমষ্টি রূপে অস্তিমান আছি। রাষ্ট্র গড়ে তোলা না হলেও আমাদের দেশ আছে। জাতি হয়ে ওঠার ও রাষ্ট্রগঠনের সম্ভাবনা ও সুযোগ আমাদের আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান দিক দিয়ে আমাদের আছে বিরাট অগ্রগতি। সকল বিষয়েই প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং অনেক অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন নতুন চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যেরও অন্ত নেই। আছে- সঙ্গীত, নাট্যকলা, সিনেমা, নৃত্যকলা। এসবের গুণগত দিক সম্পর্কে মন্তব্য করা দুঃসাধ্য।
কারণ সমালোচনা নেই, ভালো-মন্দের বিচার নেই- ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞানও যেন লোপ পেয়েছে। চিত্রকলা, সঙ্গীত, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদিতে যা কিছু উৎকৃষ্ট, সেগুলোর উৎকৃষ্টতা কোনো কোনো সুযোগ্য সমালোচকের মাধ্যমে চিহ্নিত হলে অনেক কিছু বোঝা যেত এবং তাতে উৎকৃষ্ট নতুন সৃষ্টির পথ সুগম হতো। পূর্বোক্ত দুই ধারার কোনোটিই এ কাজে অগ্রসর হয়নি। ঢাকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে বড় কোনো সমালোচক আত্মপ্রকাশ করেননি।
গবেষণার ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের অনুকরণ ও অনুসরণ। স্বাধীন বাংলাদেশে পাশ্চাত্য প্রগতিশীল মহান ভাবধারার প্রতি আগ্রহ দুর্লভ। শূন্যবাদী (হরযরষরংস) দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, এৎধহফ ঘধৎৎধঃরাব, গধংঃবৎ উরংপড়ঁৎংব ইত্যাদি বলে ক্লাসিকের ও আদর্শের প্রতি প্রদর্শন করা হয় অবজ্ঞা। সমগ্রের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল অংশের দিকে, সাধারণের (মবহবৎধষ) দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল বিশেষের (ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ) দিকে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
বাংলা সাহিত্যে ১৯২০-এর দশক থেকে আধুনিকতাবাদ (সড়ফবৎহরংস) ক্রমে কর্তৃত্বশীল অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তার ওপর ১৯৮০-র দশক থেকে অনুশীলিত হচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদ (ঢ়ড়ংঃসড়ফবৎহরংস)। আধুনিকতাবাদ সীমাবদ্ধ ছিল সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে, উত্তরাধুনিকতাবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সকল বিষয়কেই নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছে। আধুনিকতাবাদের কার্যকর সমালোচনা আছে আবু সয়ীদ আইয়ুবের চড়বঃৎু ধহফ ঞৎঁঃয এবং আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ দুটিতে। বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সেকালের অনেক লেখক ‘আধুনিকতাবাদ’কে অভিহিত করেছেন ‘আধুনিকতা’ বলে। বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার গবেষণায় এবং সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রতি বিচার-বিবেচনাহীন আগ্রহ ও নির্বিচার অনুগামিতা। বিচারমূলক প্রবণতা দুর্লভ। লক্ষ করা দরকার যে, আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ দেখা দিয়েছে কাউন্টার-রেনেসাঁস রূপে। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে উন্নত বিষয় কার্যকরভাবে গ্রহণ করার মধ্যেও সৃষ্টিশীলতা থাকে। অনুকরণ-অনুসরণ আর সৃষ্টিশীল উপায়ে গ্রহণ এক নয়।
যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে দরকার বিবেকবান চিন্তাশীল লেখক-শিল্পীদের ঐক্য। দরকার তাঁদের চিন্তার ও কর্মের স্বতন্ত্র কেন্দ্র ও সংগঠন। দরকার নতুন রেনেসাঁসের জন্য একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন। সত্যসন্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ, স্বাধীন চিন্তাশীলতা অবলম্বন করে প্রগতির ও সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কর্মতৎপর হওয়া দরকার। নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতায় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রগতি সম্পর্কে উপলব্ধির অমূল পুনর্গঠন দরকার। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে প্রগতির ধারণাকে সীমাবদ্ধ রাখা একটুও সমীচীন নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের জন্য দরকার নতুন রেনেসাঁসের স্পিরিট নিয়ে দূরদর্শী কার্যক্রম। বাইরের জগত থেকে গ্রহণ করতে হবে নিজেদের সত্তায় থেকে, আত্মসত্তা বিসর্জন দিয়ে নয়।
নিকৃষ্ট রাজনৈতিক দলের হীন-স্বার্থান্বেষী লেজুড়বৃত্তি দ্বারা লেখক-শিল্পীদের কোনো উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় প্রকাশ পায় না। দলীয় গণ্ডির বাইরে সর্বজনীন কল্যাণের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যেগুলোকে দলমতনির্বিশেষে সকলেরই সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া কর্তব্য। সেগুলোকে বুঝতে না পারলে, মূল্য না দিলে জাতির সংস্কৃতি বিকারপ্রাপ্ত হয়- প্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধ, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় স্বার্থ তেমনি একটি বিষয়। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দরকার জাতীয়তাবাদের সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। উপনিবেশিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকার।
নতুন রেনেসাঁস, নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রগতির প্রয়োজনে সকল গণবিরোধী মতবাদ ও সকল গণবিরোধী শক্তিকে দমন রাখতে হবে। জাতির অন্তর্গত সকল জনগোষ্ঠীর ও সকল স্তরের জনগণের স্বার্থকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে এবং জাতীয় ঐক্যকে নিশ্চিত করে জাতীয়তাবাদকে সফল করতে হবে। যাঁরা সততার সঙ্গে চলতে চান তাঁদের চলার সুযোগ আইন-কানুনের দ্বারা অবারিত রাখতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অনুসন্ধিৎসাকে এবং মানবিক গুণাবলিকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে। জনগণের ওপর অপশক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হলে, জাতিকে বিভক্ত করে অনৈক্যের মধ্যে রাখা হলে, জনগণ বিভক্ত থাকলে, রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের ওপর বিদেশি শক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হয়, রাষ্ট্র পরাধীন হয়ে যায়। জাতির ইতিহাসে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করা হলে, ইতিহাসকে বিকৃত করা হলে জাতির আত্মাই বিকৃত হয়ে যায়।
অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে যারা পিছিয়ে আছে, যারা মোট জনসংখ্যার শতকরা নব্বই ভাগ, যারা উৎপাদনশীল, সেই শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত কথিত উদার গণতন্ত্রে দারুণভাবে নির্জিত, বঞ্চিত, প্রতারিত। সব দিক দিয়েই তারা দুরবস্থায় আছে। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে তাদের খাওয়া-পরার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু শ্রমজীবীরা কঠোর শ্রমের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সামাজিক ন্যায় ও মানবিক দিক লক্ষ করলে দেখা যায় তাদের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর পৃথিবীর সর্বত্রই তারা আগের চেয়ে বেশি নির্জিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে। যারা শক্তিমান, বিত্তবান, বিদ্বান, সর্বসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক বৈষম্য ও বিযুক্তি (ধষরবহধঃরড়হ /বংঃৎধহমবসবহঃ) বাড়ছে। সাধারণ মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ও প্রতিকার চাওয়ার সাহস হারাচ্ছে। উদার গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষ শাসক শ্রেণির লোকদের উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্র হয়ে আছে।
বাংলাদেশে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে রাজধানীতে, গ্রাম নিদারুণ বঞ্চনার শিকার। প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে দূরে সরিয়ে, বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনের কালে দুর্নীতি ও নারীনির্যাতন কমছে না, বাড়ছে। মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় শক্তি প্রবল হচ্ছে এবং পরিত্যক্ত ও পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। দেখা দিয়েছে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড। জাতীয় পর্যায়ে জনগণের রুচি-পছন্দ ও চিন্তা-চেতনার মান উন্নত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ও তাদের দেশীয় অনুসারীদের স্বার্থসিদ্ধির অনুক‚ল। সামাজিক ন্যায় কমতির দিকে হওয়ার ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, নারীনির্যাতন বাড়ছে, হত্যা-আত্মহত্যা বাড়ছে, হিংসা-প্রতিহিংসা বাড়ছে, অনাস্থা ও হতাশা বাড়ছে, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে চলছে।
বাংলাদেশে ষোল কোটি মানুষের জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উন্নতির আকাক্সক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি, সামাজিক সংহতি ও বিযুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা, প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির যে পরিচয় প্রকাশ পায়, তা সুস্থ, স্বাভাবিক নয়; তা রুগ্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত, বিকারপ্রাপ্ত। এই সংস্কৃতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল করে তোলার জন্য জাতীয় জীবনে নতুন সংকল্প, নতুন চিন্তাধারা ও নতুন কর্মধারা দরকার। দরকার নতুন সাংগঠনিক আয়োজন ও নতুন নেতৃত্ব। দরকার বাংলাদেশের প্রতিটি নর-নারীর সংস্কৃতি-চেতনার কার্যকর সুষ্ঠু বিকাশ। যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে বর্তমান আমাদের অন্ধকার, ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকার। জাতীয় জীবনে আলোর সন্ধান পেতে হলে বিভেদকে পেছনে ফেলে সংশ্লেষণমূলক নতুন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরস্পর সম্পূূরক।
আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে, তা স্বাভাবিক। তবে সকল পক্ষকেই তথ্যনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ হতে হবে। মতপার্থক্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এবং জাতীয় ঐক্যের ও জাতীয় উন্নতির মনোভাবও অবশ্যই থাকতে হবে। এক পক্ষ সব সময় অন্য পক্ষকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় থাকলে শেষ পর্যন্ত তার ফল বিজয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে। জাতীয় জীবনে বিরোধের উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে সম্প্রীতির, ঐক্যের ও সংহতির উপাদানও। এ অবস্থায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি কার্যকর করতে হবে। সবাই এক রকম চিন্তা করবেন, তা ভাবা বাস্তবসম্মত নয়। প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল ধারা থাকবে। কিন্তু চলমান দুটি ধারার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে তাতে সুস্থতা নেই, স্বাভাবিকতা নেই, তথ্যনিষ্ঠা নেই, সত্যাগ্রহ নেই। প্রগতির প্রবণতা নেই দুই ধারার কোনোটির মধ্যেই। যাঁরা সততার সঙ্গে চিন্তা করবেন এবং সৎভাবে কাজ করতে চাইবেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য, অবস্থার উন্নতির জন্য জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে, জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে, জাতীয় সংহতির উপায় নিয়ে মোহমুক্ত, জেদাজেদিমুক্ত, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, ইতিহাসসম্মত, কর্মমুখী চিন্তায় অগ্রসর হওয়া। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধ কমলে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি এবং রাজনীতির উন্নতি হলে জাতি উন্নত হয়।
৮. বাংলায় ইসলামপূর্ব কালের সংস্কৃতি ও ইসলাম প্রচার
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। ইতিহাসে কারণ-কার্য সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কারণ ছাড়া কিছুই ঘটতে দেখা যায় না। মানুষের ইতিহাস বিকশিত হয় কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে। কোনো জাতির পতনশীল অবস্থা থেকে উত্থানশীল অবস্থায় উত্তরণের জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ অপরিহার্য। ইতিহাসের শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে ইতিহাসের গতি নির্ধারণ কিংবা যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের আগেও, বখতিয়ার খিলজির লক্ষণবতি দখলের (১২০৪) আগেও, জনপ্রবাহ ছিল জীবনধারা ছিল এবং জনগণের মধ্যে জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্ম ছিল। তখনো সর্ববঙ্গীয় কিংবা সর্বভারতীয় হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠেনি। বাংলায় লোকে ওইসব ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। যারা মুসলমান হয়েছে তাদের মুসলমান হওয়ার আগের বংশানুক্রমিক ইতিহাস আছে। পরবর্তী ইতিহাস ও পূর্ববর্তী ইতিহাসের মধ্যে যোগসূত্র আছে। পরিবর্তন যুগান্তকারী হলেও, পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে পূর্ববর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহের যোগসূত্র আছে।
তুর্কি-পাঠান-মোগল শাসকদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অল্প লোকই এ দেশে এসেছে। আগরতরা ছিল মুসলমান। তারা ভাগ্যান্বেষী হিসেবে এসেছে, ইসলাম প্রচারের জন্য আসেনি। তাদের আগে ও পরে উত্তর ভারত থেকে কিছু সংখ্যক সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের ব্রত নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। উত্তর ভারতের আজমির ও আরো কোনো কোনো স্থানে ছিল তাঁদের আস্তানা। ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সমাজ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আশরাফ-আতরাফে বিভক্ত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে আগতরা আত্মপরিচয় দিত আশরাফ বা অভিজাত বলে, আর দেশীয় মুসলমানদের তারা বলত আতরাফ বা নিচুজাত। আশরাফরা মনে করত তারা শাসকের জাত। আশরাফদের সঙ্গে আতরাফদের, আতরাফদের সঙ্গে আশরাফদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আতরাফদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা উন্নত হয়নি। ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে সে পার্থক্য কমতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর্যায়ে এসে সে পার্থক্য প্রায় শেষ হয়ে যায়।
বাংলায় ইসলাম প্রচারের ও মুসলমান সমাজ গড়ে ওঠার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশপূর্ব কালে, ব্রিটিশ শাসনকালে এবং উত্তরকালে বৈষয়িক জীবন, মানসিক জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ ও আশা-আকাক্সক্ষা এক রকম থাকেনি। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে।
এতে কি কোনো সন্দেহ আছে যে, বখতিয়ার খিলজির আগেকার জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস বাদ দিলে আমাদের ইতিহাস ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে? পাল রাজাদের কাল, সেন রাজাদের কাল, পাল ও সেন রাজাদের বাইরে সে কালের ছোট ছোট সব রাজ্য, সেকালের জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদি বাদ দিলে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অপূর্ণ থাকে এবং তাতে আমাদের উন্মেষপর্ব ও বিকাশপর্বের ইতিহাসের এক বড় অংশ বাদ পড়ে যায়।
নালন্দা, উজ্জয়িনী, সীতাকুট, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, সাভার-ধামরাই-বিক্রমপুর, ময়নামতি-লালমাই-চান্দিনা, চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অবধি বিভিন্ন ¯নে বৌদ্ধযুগের যেসব প্রতœনিদর্শন আজো বিরাজ করছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে যে ইতিহাস, যে সভ্যতা, যে সংস্কৃতি, তা বাদ দিয়ে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা ভাবা আমাদের জন্য মারাত্মক ভুল। আমাদেরই পূর্বপুরুষের কৃতী ও কীর্তি সেগুলো। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কেবল আরব-ইরানের কিছু বিষয়কে ধরলে এবং বাংলার ইতিহাসের আদিপর্বকে বাদ দিলে আমরা ছিন্নমূল হয়ে যাই- আমাদের আত্মপরিচয়ের শুরুটাই বাদ পড়ে। প্রকৃত তথ্য এই যে, বাংলাভাষার দেশে জনগণের সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ইসলাম প্রচারের, মুসলমানদের আগমনের, সুফিদের ও বখতিয়ার খিলজির আগমনের অনেক আগেই।
পাল সাম্রাজ্যের বাইরে পূর্ব বাংলায় ছোট ছোট বৌদ্ধ রাজ্য ছিল। সে কালে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাংলার বৌদ্ধদের ছিল অসাধারণ উন্নত সব চর্চা। শীলভদ্র, দীপঙ্কর, জ্ঞানশ্রী-মিত্র, অভয়াকর-গুপ্ত, দিবাকর-চন্দ্র, বোধিভদ্র, প্রজ্ঞাবর্মা ও আরো কয়েকজন বৌদ্ধ মনীষীর গ্রন্থাদি তিব্বতে, মঙ্গোলিয়ায়, চিনে, ইন্দোচিনে, জাপানে অনুসন্ধান করলে এখনো আবিষ্কৃত হতে পারে। বৌদ্ধযুগ বাংলা-বিহারের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সময়।
শ্রীচৈতন্যের আত্মপ্রকাশ ইসলামের প্রভাবে। ইসলামের প্রভাবে ও শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম নতুন প্রাণশক্তি লাভ করে। চৈতন্যজীবন, বৈষ্ণবধর্ম ও বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের ধারায় যেসব জীবনীগ্রন্থ বা তত্ত্বগ্রন্থ ও পদাবলি রচিত হয়েছে, নিরপেক্ষ তুলনামূলক বিচারে গেলে দেখা যাবে, সেগুলো ইউরোপের খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের সৃষ্টিসম্ভার থেকে উন্নত। বাংলার মুসলমান সমাজে বৈষ্ণব ভাবধারার প্রভাব আছে।
আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, ইসলামের উদ্ভব তৎকালীন আরব-সমাজের, মক্কা-মদিনার বাস্তবতায়- সামাজিক চাহিদার মধ্যে। আরবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, ইসলামের উদ্ভব ও প্রসারের আগেও মানুষ ছিল, জীবনধারা ছিল- সেই মানুষরাই পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়েছে এবং ক্রমে মুসলমান সমাজ গঠন করেছে। ইসলামে ইসলামপূর্ব কালের আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, জেরুসালেম ও মিসরের বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে পুনর্গঠিত করে নবায়িত করে গ্রহণ করা হয়েছে। সেসব দেশের ইসলামপূর্ব কালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে ইসলামের কিংবা মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইলে ঠিকমতো বোঝা যায় না।
ইসলামকে বুঝতে হলে প্রথমেই তৎকালীন আরবে উন্নত নতুন ধর্মের ও নতুন নেতৃত্বের চাহিদা এবং হজরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবন ও নেতৃত্বকে বুঝতে হবে। কুরআন, হাদিস, হজরত মুহম্মদ (সা.) এর সাধনা ও সংগ্রাম সবই তৎকালীন মক্কা-মদিনার প্রত্যক্ষ পটভূমিতে বোধগম্য। কুরআনের তাফসির, হাদিসের ভাষ্য তারই প্রমাণ দেয়। বুঝতে হবে যে, হজরত মুহম্মদ (সা.) মদিনায় গিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারপর মক্কা জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রগঠনে, শাসনপদ্ধতিতে ও শাসনকার্যে তিনি আগের ঐতিহ্যকে নবায়িত করে বিকশিত করেছিলেন।
আমাদের সংস্কৃতির বিকাশধারায় ইসলামের ভূমিকাকে বুঝতে হলে বাংলার ইসলামপূর্ণ কালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভিত্তিভূমিতে ধরে তার সঙ্গে আরবের ইসলাম-প্রচারকালের ও পরবর্তী কালের মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পর্ককে বুঝতে হবে। বাংলার ইসলাম ও মুসলমানরা আরব, ইরান, মিসর, আবিসিনিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, তুরস্ক, তুর্কিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাকস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া কোনো জ্ঞানই পর্যাপ্ত হয় না- কার্যকর রূপ লাভ করে না।
ইতিহাসের ধারা ধরে চিন্তা করলে আমাদের আজকের সমস্যাবলির সমাধান কিছুটা হলেও জটিলতা মুক্ত হয়। বাঙালি মুসলমানদের ইসলামের উপলব্ধি জীবনধারা ও চিন্তাভাবনা বাংলাভাষী জনপ্রবাহের আবহমান কালের ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলা ভাষার উদ্ভবেরও অনেক আগে থেকে- স্মরণাতীত কাল থেকে- এদেশে মানুষ বসবাস করছে, মানুষের জীবনধারা বিকাশমান আছে। বাঙালি মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা প্রণালী পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশের মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা প্রণালী থেকে স্বতন্ত্র। এর মূলে আছে ভৌগোলিক, নৃগোষ্ঠীগত ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানদের মধ্যে এজমালি (পড়সসড়হ) উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে স্বতন্ত্র উপাদানও।
বাংলায় মুসলমান সমাজের গড়ে ওঠাকেও স্বাতন্ত্র্যকে বোঝার প্রয়োজনে এদেশে একদা যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল, তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাসকেও যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে বুঝতে হবে। পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের যোগসূত্রকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। পর্যায়ক্রমিক বিকাশের ধারাকে বুঝতে হবে কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে।
ভবিষ্যৎকে নতুন করে গড়তে হলে ভবিষ্যতের রূপকল্প দরকার, সেই সঙ্গে দরকার অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার পুনর্গঠন। অতীত সম্পর্কে মনকে পুরাতন ধারণায় আবদ্ধ রেখে গতানুগতিই সম্ভব, উন্নতি বা প্রগতি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে যাঁরা আজ ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির অন্ধ অনুসারী, তাঁদের বোঝা উচিত যে, তাঁদের আচরণ ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে যা আমরা ইউরোপ-আমেরিকার প্রগতিশীল মহান দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে জানব, বুঝব এবং আমাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করব। আমাদের বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্য লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য যা-কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তাই গ্রহণ করা আমাদের জন্য আত্মঘাতী।
আমাদের বুঝতে হবে যে, ইউরোপ-আমেরিকার প্রগতিশীল মহান দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস ও শিল্প-সাহিত্য থেকে তাদের ক‚টনীতি, গোয়েন্দানীতি, লগ্নিপুঁজি, প্রচারনীতি এবং ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’ আলাদা। পাশ্চাত্য প্রগতিশীল ভাবধারাকে আমাদের আত্মস্থ করতে হবে আমাদের ঐতিহাসিক পরম্পরার মধ্যে- সংশ্লেষণের মাধ্যমে। উপনিবেশবাদী, ফ্যাসিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা ও কর্মধারাকে অবশ্যই আমাদের পরিহার করে চলতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ইসলাম নিয়ে যাঁরা জাতিকে বিভক্ত করে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছেন, তাঁদের দুই পক্ষের মধ্যেই আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষের অনুশীলন দরকার। সংখ্যার শক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। যেসব উত্তেজনাকর বিতর্কে পড়ে আমরা ভুলপথগামী, সেগুলো থেকে আমরা রেহাই পাব যদি আমরা সুস্থ স্বাভাবিক উন্নত সংস্কৃতি চেতনায় উত্তীর্ণ হই এবং জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি বা উত্তরাধিকার সম্পর্কে ইতিহাসসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করি। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তার চলমান ধারাগুলোর কেবল একটিকে রক্ষা করার ও অপরটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চিন্তা ভুল। উভয় ধারারই আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎকর্ষ কাম্য। মিথ্যাচার ও ইতিহাস-বিকৃতি বর্জনীয়। জেদাজেদির অবসান ও ভুলের সংশোধন কাম্য। চিন্তা-চেতনার একাধিক ধারা থাকবেই- এটা স্বাভাবিক। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার পরিবর্তনও স্বাভাবিক।
দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্রের পরিবেশ ও সকল ধারার নিরন্তর আত্মোৎকর্ষ। সত্য সম্পর্কে ধারণা যাই হোক, সকল ধারার মধ্যেই সত্যাগ্রহ ও সত্যনিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়। কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা সমীচীন নয়, সত্যের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা সমীচীন। চিন্তা ও কর্মের চলমান ধারাগুলোর মধ্যে দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি, মিথ্যা পরিহার করার মনোবল ও সত্যাগ্রহ। অদূরদর্শী, অতীতমুখী, সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বদলে দরকার ভবিষ্যৎমুখী, দূরদর্শী, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রতিবার জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে আসলে নির্বাচনে জেতার ক‚টকৌশল হিসেবে হিন্দুবাড়ি, হিন্দুপাড়াও হিন্দুমন্দির ধ্বংস করার যে রেওয়াজ কায়েম হয়েছে, রাজনীতির মান উন্নত করা না গেলে তা বন্ধ হবে না। এবার নির্বাচন সামনে নিয়ে বৌদ্ধমন্দিরও ধ্বংস করা হয়েছে। ‘সা¤প্রদায়িকতা’, ‘সংখ্যালঘু’, ‘মানবাধিকার’ ইত্যাদি বিমূর্ত কথা বলে সিভিল সোসাইটি মহল থেকে যে আন্দোলন চালানো হয়, তা দ্বারা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সরকারের কর্তব্য অপরাধ দমন করা। কিন্তু রাজনীতির বর্তমান মান বজায় থাকা অবস্থায় কোনো দলের সরকারই তা করতে পারছে না। এ ব্যাপারে কোনো সরকারের ভূমিকাই স্বচ্ছ দেখা যায় না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও স্বচ্ছ নয়। প্রধান দলগুলোর প্রত্যেকটিই অন্য দলের ওপর দোষ চাপিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীগুলোরও কর্তব্য ধর্মীয় বিভিন্নতা নিয়েও জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে গোষ্ঠীগত ন্যায়স্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রগতিশীল জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি অবলম্বন করে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করা ও জাতি গড়ে তোলা সকলের কর্তব্য। প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নতির জন্য সরকারকে যথোচিত কর্মসূচি ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, আদান-প্রদানের ও স¤প্রীতির মনোভাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বহুত্ববাদ জাতিবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী। সাম্রাজ্যবাদীদের ও মুৎসুদ্দি ধনিকদের উরারফব ধহফ জঁষব চড়ষরপু বর্জন করে চলতে হবে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে এনজিওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সরকার জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে।
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। ইতিহাসে কারণ-কার্য সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কারণ ছাড়া কিছুই ঘটতে দেখা যায় না। মানুষের ইতিহাস বিকশিত হয় কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে। কোনো জাতির পতনশীল অবস্থা থেকে উত্থানশীল অবস্থায় উত্তরণের জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ অপরিহার্য। ইতিহাসের শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে ইতিহাসের গতি নির্ধারণ কিংবা যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের আগেও, বখতিয়ার খিলজির লক্ষণবতি দখলের (১২০৪) আগেও, জনপ্রবাহ ছিল জীবনধারা ছিল এবং জনগণের মধ্যে জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্ম ছিল। তখনো সর্ববঙ্গীয় কিংবা সর্বভারতীয় হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠেনি। বাংলায় লোকে ওইসব ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। যারা মুসলমান হয়েছে তাদের মুসলমান হওয়ার আগের বংশানুক্রমিক ইতিহাস আছে। পরবর্তী ইতিহাস ও পূর্ববর্তী ইতিহাসের মধ্যে যোগসূত্র আছে। পরিবর্তন যুগান্তকারী হলেও, পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে পূর্ববর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহের যোগসূত্র আছে।
তুর্কি-পাঠান-মোগল শাসকদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অল্প লোকই এ দেশে এসেছে। আগরতরা ছিল মুসলমান। তারা ভাগ্যান্বেষী হিসেবে এসেছে, ইসলাম প্রচারের জন্য আসেনি। তাদের আগে ও পরে উত্তর ভারত থেকে কিছু সংখ্যক সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের ব্রত নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। উত্তর ভারতের আজমির ও আরো কোনো কোনো স্থানে ছিল তাঁদের আস্তানা। ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সমাজ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আশরাফ-আতরাফে বিভক্ত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে আগতরা আত্মপরিচয় দিত আশরাফ বা অভিজাত বলে, আর দেশীয় মুসলমানদের তারা বলত আতরাফ বা নিচুজাত। আশরাফরা মনে করত তারা শাসকের জাত। আশরাফদের সঙ্গে আতরাফদের, আতরাফদের সঙ্গে আশরাফদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আতরাফদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা উন্নত হয়নি। ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে সে পার্থক্য কমতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর্যায়ে এসে সে পার্থক্য প্রায় শেষ হয়ে যায়।
বাংলায় ইসলাম প্রচারের ও মুসলমান সমাজ গড়ে ওঠার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশপূর্ব কালে, ব্রিটিশ শাসনকালে এবং উত্তরকালে বৈষয়িক জীবন, মানসিক জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ ও আশা-আকাক্সক্ষা এক রকম থাকেনি। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে।
এতে কি কোনো সন্দেহ আছে যে, বখতিয়ার খিলজির আগেকার জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস বাদ দিলে আমাদের ইতিহাস ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে? পাল রাজাদের কাল, সেন রাজাদের কাল, পাল ও সেন রাজাদের বাইরে সে কালের ছোট ছোট সব রাজ্য, সেকালের জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদি বাদ দিলে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অপূর্ণ থাকে এবং তাতে আমাদের উন্মেষপর্ব ও বিকাশপর্বের ইতিহাসের এক বড় অংশ বাদ পড়ে যায়।
নালন্দা, উজ্জয়িনী, সীতাকুট, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, সাভার-ধামরাই-বিক্রমপুর, ময়নামতি-লালমাই-চান্দিনা, চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অবধি বিভিন্ন ¯নে বৌদ্ধযুগের যেসব প্রতœনিদর্শন আজো বিরাজ করছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে যে ইতিহাস, যে সভ্যতা, যে সংস্কৃতি, তা বাদ দিয়ে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা ভাবা আমাদের জন্য মারাত্মক ভুল। আমাদেরই পূর্বপুরুষের কৃতী ও কীর্তি সেগুলো। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কেবল আরব-ইরানের কিছু বিষয়কে ধরলে এবং বাংলার ইতিহাসের আদিপর্বকে বাদ দিলে আমরা ছিন্নমূল হয়ে যাই- আমাদের আত্মপরিচয়ের শুরুটাই বাদ পড়ে। প্রকৃত তথ্য এই যে, বাংলাভাষার দেশে জনগণের সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ইসলাম প্রচারের, মুসলমানদের আগমনের, সুফিদের ও বখতিয়ার খিলজির আগমনের অনেক আগেই।
পাল সাম্রাজ্যের বাইরে পূর্ব বাংলায় ছোট ছোট বৌদ্ধ রাজ্য ছিল। সে কালে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাংলার বৌদ্ধদের ছিল অসাধারণ উন্নত সব চর্চা। শীলভদ্র, দীপঙ্কর, জ্ঞানশ্রী-মিত্র, অভয়াকর-গুপ্ত, দিবাকর-চন্দ্র, বোধিভদ্র, প্রজ্ঞাবর্মা ও আরো কয়েকজন বৌদ্ধ মনীষীর গ্রন্থাদি তিব্বতে, মঙ্গোলিয়ায়, চিনে, ইন্দোচিনে, জাপানে অনুসন্ধান করলে এখনো আবিষ্কৃত হতে পারে। বৌদ্ধযুগ বাংলা-বিহারের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সময়।
শ্রীচৈতন্যের আত্মপ্রকাশ ইসলামের প্রভাবে। ইসলামের প্রভাবে ও শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম নতুন প্রাণশক্তি লাভ করে। চৈতন্যজীবন, বৈষ্ণবধর্ম ও বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের ধারায় যেসব জীবনীগ্রন্থ বা তত্ত্বগ্রন্থ ও পদাবলি রচিত হয়েছে, নিরপেক্ষ তুলনামূলক বিচারে গেলে দেখা যাবে, সেগুলো ইউরোপের খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের সৃষ্টিসম্ভার থেকে উন্নত। বাংলার মুসলমান সমাজে বৈষ্ণব ভাবধারার প্রভাব আছে।
আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, ইসলামের উদ্ভব তৎকালীন আরব-সমাজের, মক্কা-মদিনার বাস্তবতায়- সামাজিক চাহিদার মধ্যে। আরবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, ইসলামের উদ্ভব ও প্রসারের আগেও মানুষ ছিল, জীবনধারা ছিল- সেই মানুষরাই পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়েছে এবং ক্রমে মুসলমান সমাজ গঠন করেছে। ইসলামে ইসলামপূর্ব কালের আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, জেরুসালেম ও মিসরের বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে পুনর্গঠিত করে নবায়িত করে গ্রহণ করা হয়েছে। সেসব দেশের ইসলামপূর্ব কালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে ইসলামের কিংবা মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইলে ঠিকমতো বোঝা যায় না।
ইসলামকে বুঝতে হলে প্রথমেই তৎকালীন আরবে উন্নত নতুন ধর্মের ও নতুন নেতৃত্বের চাহিদা এবং হজরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবন ও নেতৃত্বকে বুঝতে হবে। কুরআন, হাদিস, হজরত মুহম্মদ (সা.) এর সাধনা ও সংগ্রাম সবই তৎকালীন মক্কা-মদিনার প্রত্যক্ষ পটভূমিতে বোধগম্য। কুরআনের তাফসির, হাদিসের ভাষ্য তারই প্রমাণ দেয়। বুঝতে হবে যে, হজরত মুহম্মদ (সা.) মদিনায় গিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারপর মক্কা জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রগঠনে, শাসনপদ্ধতিতে ও শাসনকার্যে তিনি আগের ঐতিহ্যকে নবায়িত করে বিকশিত করেছিলেন।
আমাদের সংস্কৃতির বিকাশধারায় ইসলামের ভূমিকাকে বুঝতে হলে বাংলার ইসলামপূর্ণ কালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভিত্তিভূমিতে ধরে তার সঙ্গে আরবের ইসলাম-প্রচারকালের ও পরবর্তী কালের মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পর্ককে বুঝতে হবে। বাংলার ইসলাম ও মুসলমানরা আরব, ইরান, মিসর, আবিসিনিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, তুরস্ক, তুর্কিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাকস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া কোনো জ্ঞানই পর্যাপ্ত হয় না- কার্যকর রূপ লাভ করে না।
ইতিহাসের ধারা ধরে চিন্তা করলে আমাদের আজকের সমস্যাবলির সমাধান কিছুটা হলেও জটিলতা মুক্ত হয়। বাঙালি মুসলমানদের ইসলামের উপলব্ধি জীবনধারা ও চিন্তাভাবনা বাংলাভাষী জনপ্রবাহের আবহমান কালের ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলা ভাষার উদ্ভবেরও অনেক আগে থেকে- স্মরণাতীত কাল থেকে- এদেশে মানুষ বসবাস করছে, মানুষের জীবনধারা বিকাশমান আছে। বাঙালি মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা প্রণালী পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশের মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা প্রণালী থেকে স্বতন্ত্র। এর মূলে আছে ভৌগোলিক, নৃগোষ্ঠীগত ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানদের মধ্যে এজমালি (পড়সসড়হ) উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে স্বতন্ত্র উপাদানও।
বাংলায় মুসলমান সমাজের গড়ে ওঠাকেও স্বাতন্ত্র্যকে বোঝার প্রয়োজনে এদেশে একদা যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল, তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাসকেও যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে বুঝতে হবে। পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের যোগসূত্রকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। পর্যায়ক্রমিক বিকাশের ধারাকে বুঝতে হবে কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে।
ভবিষ্যৎকে নতুন করে গড়তে হলে ভবিষ্যতের রূপকল্প দরকার, সেই সঙ্গে দরকার অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার পুনর্গঠন। অতীত সম্পর্কে মনকে পুরাতন ধারণায় আবদ্ধ রেখে গতানুগতিই সম্ভব, উন্নতি বা প্রগতি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে যাঁরা আজ ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির অন্ধ অনুসারী, তাঁদের বোঝা উচিত যে, তাঁদের আচরণ ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে যা আমরা ইউরোপ-আমেরিকার প্রগতিশীল মহান দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে জানব, বুঝব এবং আমাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করব। আমাদের বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্য লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য যা-কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তাই গ্রহণ করা আমাদের জন্য আত্মঘাতী।
আমাদের বুঝতে হবে যে, ইউরোপ-আমেরিকার প্রগতিশীল মহান দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস ও শিল্প-সাহিত্য থেকে তাদের ক‚টনীতি, গোয়েন্দানীতি, লগ্নিপুঁজি, প্রচারনীতি এবং ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’ আলাদা। পাশ্চাত্য প্রগতিশীল ভাবধারাকে আমাদের আত্মস্থ করতে হবে আমাদের ঐতিহাসিক পরম্পরার মধ্যে- সংশ্লেষণের মাধ্যমে। উপনিবেশবাদী, ফ্যাসিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা ও কর্মধারাকে অবশ্যই আমাদের পরিহার করে চলতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ইসলাম নিয়ে যাঁরা জাতিকে বিভক্ত করে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছেন, তাঁদের দুই পক্ষের মধ্যেই আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষের অনুশীলন দরকার। সংখ্যার শক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। যেসব উত্তেজনাকর বিতর্কে পড়ে আমরা ভুলপথগামী, সেগুলো থেকে আমরা রেহাই পাব যদি আমরা সুস্থ স্বাভাবিক উন্নত সংস্কৃতি চেতনায় উত্তীর্ণ হই এবং জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি বা উত্তরাধিকার সম্পর্কে ইতিহাসসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করি। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তার চলমান ধারাগুলোর কেবল একটিকে রক্ষা করার ও অপরটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চিন্তা ভুল। উভয় ধারারই আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎকর্ষ কাম্য। মিথ্যাচার ও ইতিহাস-বিকৃতি বর্জনীয়। জেদাজেদির অবসান ও ভুলের সংশোধন কাম্য। চিন্তা-চেতনার একাধিক ধারা থাকবেই- এটা স্বাভাবিক। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার পরিবর্তনও স্বাভাবিক।
দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্রের পরিবেশ ও সকল ধারার নিরন্তর আত্মোৎকর্ষ। সত্য সম্পর্কে ধারণা যাই হোক, সকল ধারার মধ্যেই সত্যাগ্রহ ও সত্যনিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়। কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা সমীচীন নয়, সত্যের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা সমীচীন। চিন্তা ও কর্মের চলমান ধারাগুলোর মধ্যে দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি, মিথ্যা পরিহার করার মনোবল ও সত্যাগ্রহ। অদূরদর্শী, অতীতমুখী, সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বদলে দরকার ভবিষ্যৎমুখী, দূরদর্শী, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রতিবার জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে আসলে নির্বাচনে জেতার ক‚টকৌশল হিসেবে হিন্দুবাড়ি, হিন্দুপাড়াও হিন্দুমন্দির ধ্বংস করার যে রেওয়াজ কায়েম হয়েছে, রাজনীতির মান উন্নত করা না গেলে তা বন্ধ হবে না। এবার নির্বাচন সামনে নিয়ে বৌদ্ধমন্দিরও ধ্বংস করা হয়েছে। ‘সা¤প্রদায়িকতা’, ‘সংখ্যালঘু’, ‘মানবাধিকার’ ইত্যাদি বিমূর্ত কথা বলে সিভিল সোসাইটি মহল থেকে যে আন্দোলন চালানো হয়, তা দ্বারা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সরকারের কর্তব্য অপরাধ দমন করা। কিন্তু রাজনীতির বর্তমান মান বজায় থাকা অবস্থায় কোনো দলের সরকারই তা করতে পারছে না। এ ব্যাপারে কোনো সরকারের ভূমিকাই স্বচ্ছ দেখা যায় না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও স্বচ্ছ নয়। প্রধান দলগুলোর প্রত্যেকটিই অন্য দলের ওপর দোষ চাপিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীগুলোরও কর্তব্য ধর্মীয় বিভিন্নতা নিয়েও জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে গোষ্ঠীগত ন্যায়স্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রগতিশীল জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি অবলম্বন করে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করা ও জাতি গড়ে তোলা সকলের কর্তব্য। প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নতির জন্য সরকারকে যথোচিত কর্মসূচি ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, আদান-প্রদানের ও স¤প্রীতির মনোভাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বহুত্ববাদ জাতিবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী। সাম্রাজ্যবাদীদের ও মুৎসুদ্দি ধনিকদের উরারফব ধহফ জঁষব চড়ষরপু বর্জন করে চলতে হবে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে এনজিওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সরকার জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে।
৯. বাংলাদের সংস্কৃতির আদি ভিত্তি
ইতিহাসবিদদের মতে, আজকের বাংলাভাষার ভূভাগে আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। আর্যরা ভারতে আসে পশ্চিমের গিরিপথ দিয়ে, স্থানীয় প্রতিরোধ মোকাবেলা করে, বিজয়ী রূপে। পশ্চিম ও উত্তর ভারত আর্য-উপনিবেশে পরিণত হতে থাকে খ্রিস্টপূর্ব অন্তত দেড় হাজার বছর আগে থেকে। আর্যপ্রভাব পশ্চিম ও উত্তর ভারত থেকে ক্রমে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত হয়। আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর, আগরতলা, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে মধ্যযুগ পর্যন্ত আর্যপ্রভাব অল্পই বিস্তৃত হয়েছিল।
বাংলাভাষার ভূভাগে জনগণের জীবনযাত্রা প্রণালী ও জীবনধারা স্পষ্ট রূপ লাভ করছিল আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হওয়ার আগেই। বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষার রচনাবলিতে এবং প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনে এর প্রমাণ আছে। আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হওয়ায় আগেই এই ভূভাগে কথা বলার ও লেখার ভাষা, কৃষিনির্ভর জীবনধারা, বিবাহ ও পরিবার-জীবন, খাওয়া-পরার রীতি, ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা, পরজীবনের ধারণা, যোগসাধনা, কর্মবাদ, দেব-দেবী ও পূজা-পার্বণ ইত্যাদির উদ্ভব ঘটেছিল। পরে সেগুলো বিকশিত হয়েছে নিজের ঐতিহ্যের মধ্যে আর্যভাষা, আর্য ভাবধারা, আর্য রীতিনীতি ও আর্য ধর্মকে গ্রহণ করে- সংশ্লেষণের (ঃযবংরং-ধহঃরঃযবংরং-ংুহঃযবংরং) মধ্য দিয়ে। আর্যপূর্ব কালের জনগণ আর্যদের সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে, আর্যরাও তাদের সংস্কৃতি থেকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। আদিতে এভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি। এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে অনার্য ও আর্য দুই ধারারই উপাদান ছিল। কৌম সমাজ, গঁই বা গ্রাম, জনপদ, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, জনপদ রাজ্য, রাজ্য ইত্যাদির ক্রমবিকাশের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সংস্কৃতির বিবেচনায় জনজীবনের ভৌগোলিক ভিত্তিও মনে রাখতে হবে।
ঐতিহাসিক কালে যুগ-যুগান্তর ধরে আমাদের সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে পর্যায়ক্রমে বহিরাগত আর্য-প্রভাব, বহিরাগত মুসলিম-প্রভাব ও বহিরাগত ইউরোপীয় প্রভাব গ্রহণ করে। যুগে যুগে বৈদেশিক ধর্ম, আদর্শ, জ্ঞান, বিজ্ঞান, ভাষা ও আচরণকে নিজের মধ্যে সমন্বিত করে বাঙালি তার স্বকীয় সত্তা ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করেছে। আবার স্বাধীনতা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে।
মানবজাতির নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যায়, কালো মানুষ (প্রধানত আফ্রিকার), হলদে মানুষ (প্রধানত জাপান চীন কোরিয়া ও ইন্দোচিনের) ও সাদা মানুষ (প্রধানত ইউরোপের)- এই তিন বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর লোকদের নানা রকম মিলন-মিশ্রণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের নানা জনগোষ্ঠী বা এথনিক গ্রুপ। বাংলাদেশের মানুষ পূর্বোক্ত তিন বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশে মূলত দুটি বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর লোক মিলন-মিশ্রণের মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে- কালো মানুষ ও হলদে মানুষ। রামায়ণ-মহাভারতে নিষাদ (কালো মানুষ) ও কিরাত (হলদে মানুষ) জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে।
বাংলার জনপ্রবাহে সাদা মানুষদেরও সামান্য মিশ্রণ পরে ঘটেছে- যাকে বলা যায় সমুদ্রে বারিবিন্দুবৎ। বাংলার জনগণের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য যাঁরা সন্ধান করেছেন, তাঁরা সকলেই এই জনগোষ্ঠীকে মিশ্র বা শংকর বলে অভিহিত করেছেন। এই মিশ্রতা বা সাংকর্য এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মধ্যেই আছে। প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই মিশ্রতা নগণ্য। প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ নিজেদের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষাও গ্রহণ করছে এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসছে। তাদের চিরদিনের জন্য আদিবাসী করে রাখা অন্যায়। হিন্দুসমাজে জাতিভেদ প্রথা ছিল এবং আছে। মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ ব্যবধান ছিল, যদিও তা ধর্মের দ্বারা অনুমোদিত নয়।
এসব পার্থক্যের প্রভাব এই ভূভাগের জনগণের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যর মধ্যে পাওয়া যায় না। এর কারণ হয়তো এই যে, স্মরণাতীত কাল থেকে যে রক্তসাংকর্য ঘটে আসছে তাতে কেউই আর কোনো ধরনের রক্তবিশুদ্ধতা দাবি করতে পারে না। নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে কোনো পার্থক্য নেই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিবাহের রীতি না থাকার ফলে হয়তো হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে তাদের মধ্যে নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। তবে কালক্রমে আন্তঃধর্মীয় বিবাহের রীতি প্রচলিত হতে পারে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যেও প্রচলন হতে পারে আন্তঃগোষ্ঠী ও আন্তঃধর্মীয় বিবাহের এবং বদ্ধতার সংস্কার ত্যাগ করে তারাও শামিল হতে পারে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদে।
এসব কিছুর বিবেচনাই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিবেচনার সময় সামনে আসে। আমরা এসবের কোনোটিকেই বিবেচনা থেকে বাদ দিতে পারি না। পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর, দলীয়ভাবে তৎপর বুদ্ধিজীবীদের ও কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের ভূমিকা জনগণের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। নীতি বাস্তবায়িত করতে হলে নীতির সঙ্গে নমনীয়তা দরকার হয়। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছে, সেভাবে সেগুলোকে ধরে নিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার স্থির করতে হবে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, স¤প্রীতি ও সর্বজনীন কল্যাণের বোধ কাম্য। ইংরেজিতে লোকমুখে চালু আছে : ‘খরাব ধহফ ষবঃ ড়ঃযবৎং ষরাব.’ ‘খড়াব ধহফ নব ষড়াবফ.’ ‘ঐড়হবংঃু রং ঃযব নবংঃ ঢ়ড়ষরপু.’ ‘ঞড় শহড়ি ধষষ রং ঃড় ঢ়ধৎফড়হ ধষষ.’ জনগণের মধ্যে প্রচলিত এসব উক্তি অবশ্যই উন্নততর জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। তবে ইংরেজ ও আমেরিকানদের অভ্যন্তরীণ নীতি যাই হোক- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, যুদ্ধবাজ।
পৃথিবীর যেকোনো উন্নত জাতির মতোই আমাদেরও আছে প্রাক-ইতিহাস (ঢ়ৎবযরংঃড়ৎু), আদি-ইতিহাস (ঢ়ৎড়ঃড়যরংঃড়ৎু) ও ইতিহাস। তাতে বিধৃত আছে আমাদের প্রবহমান সংস্কৃতির ধারা-উপধারা- জনজীবনের গতিময় উত্থান-পতন। ভৌগোলিক বাস্তবতারও ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলি নিয়ে কিংবা কেবল পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন থেকে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলি নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ অসহিষ্ণু বিতর্কে মত্ত থাকা, প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, ইতিহাসকে বিকৃত করা, গণতন্ত্রকে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সব কিছুকে নির্মম দলীয়করণে সীমাবদ্ধ করে দলবাজি ও দুর্নীতিতে মত্ত থাকা, গণতন্ত্রের নামে কালো টাকা, পেশিশক্তি ও বিদেশি দূতাবাসকে প্রাধান্য দেওয়া, বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্রকে মেনে নেওয়া, হুজুগ সৃষ্টি করে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করা ইত্যাদি দ্বারা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে জাতীয় অপসংস্কৃতিতে পর্যবসিত করে রাখা হয়েছে। কোন পক্ষকে ভালো বলা যাবে?
গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করার ফলে এবং মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় গত তিন দশক ধরে পুরাতন পরাজিত সংস্কার-বিশ্বাস ও প্রথা-পদ্ধতির উত্থান যেভাবে ঘটে চলছে, তা দেখে বলা যায়, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে প্রগতি প্রমাণিত হয় না। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, সা¤প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি অবলম্বন করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ক্ষমতায় থাকার উপায় করছেন মাত্র- রাজনীতিতে উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা ভাবছেন না।
জাতীয় জীবনে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল অবস্থা সৃষ্টি ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিতে উত্তীর্ণ হওয়াই এখন আমাদের মূল কাজ। এ কাজে সবচেয়ে সহায়ক হবে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার হিন্দু-মুসলমান শ্রেষ্ঠ মনীষীদের এবং ইউরোপের চৌদ্দ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত কালের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা। তাঁদের চিন্তাধারা আমাদের উন্নততর নতুন চিন্তা অর্জনে ও নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করবে। সংস্কৃতির স্বরূপ ও লক্ষ্য প্রথমেই উল্লেখ করেছি। সেটা সব সময় মনে রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন কল্যাণের সর্ববৃহৎ অবলম্বন রূপে। তার জন্য জাতিগঠন করতে হবে এবং অবলম্বন করতে জনগণের গণতন্ত্র বা সর্বজনীন গণতন্ত্র- কথিত উদার গণতন্ত্র নয়। সার্বিক উত্থান যাঁরা কামনা করেন তাঁদের অবলম্বন করতে হবে অতীতের ও বর্তমানের ভালো সব কিছুর প্রতি ভবিষ্যৎমুখী সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। ক্লাসিকের চর্চার মধ্য দিয়ে প্রয়াসপর হতে হবে নতুন ক্লাসিক ও নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টিতে, তারপর নতুন গণজাগরণ সৃষ্টিতে। গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য দূরদর্শী সৎ প্রচেষ্টা দরকার।
কোনো অভিসন্ধি সফল করার জন্য হঠাৎ করে হুজুগ তৈরি করা যায়, গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় না। গণজাগরণে জনগণের ভেতরকার মহৎ মানবীয় গুণাবলির জাগরণ ও সক্রিয়তা থাকে। অতীতের রেনেসাঁস ও ক্লাসিকের চর্চা নতুন রেনেসাঁস ও নতুন ক্লাসিক সৃষ্টির জন্য প্রেরণাদায়ক হবে। জনগণের ভেতর থেকে বিবেকবান চিন্তাশীল সাহসী ব্যক্তিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করতে হবে। সাহস হচ্ছে সেই মানবিক গুণ যা অন্যসব মানবিক গুণকে রক্ষা করে। সাহসের মূলে থাকে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা। পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ।
সাধনা ও সংগ্রাম দুইই লাগবে। বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। জাতীয় জীবনে যথার্থ সাধনা ও সংগ্রাম দেখা দিলে উজ্জ্বল উত্থান অবশ্যই সম্ভব হবে। জনসাধারণকে জাগতে হবে, জনসাধারণ ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির সঙ্গে বিরোধের মধ্য দিয়েই চলতে হবে, মানবস্বভাব এমন যে, কোনো স্থায়ী মীমাংসার উপায় পাওয়া যায় না। নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির ওপর জয়ী রাখতে হবে। বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি কর্তৃত্বশীল, সংস্কৃতি নির্জিত। মানব প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে সংকটের উৎস। মানবস্বভাবকে উন্নত করার সব রকম উপায় সন্ধান করতে হবে। সাধনা ও সংগ্রামের বিকল্প নেই।
( সৌজন্য ভোরের কাগজ , ১৫ জুলাই/১৫ )
ইতিহাসবিদদের মতে, আজকের বাংলাভাষার ভূভাগে আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ/পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। আর্যরা ভারতে আসে পশ্চিমের গিরিপথ দিয়ে, স্থানীয় প্রতিরোধ মোকাবেলা করে, বিজয়ী রূপে। পশ্চিম ও উত্তর ভারত আর্য-উপনিবেশে পরিণত হতে থাকে খ্রিস্টপূর্ব অন্তত দেড় হাজার বছর আগে থেকে। আর্যপ্রভাব পশ্চিম ও উত্তর ভারত থেকে ক্রমে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত হয়। আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর, আগরতলা, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে মধ্যযুগ পর্যন্ত আর্যপ্রভাব অল্পই বিস্তৃত হয়েছিল।
বাংলাভাষার ভূভাগে জনগণের জীবনযাত্রা প্রণালী ও জীবনধারা স্পষ্ট রূপ লাভ করছিল আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হওয়ার আগেই। বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষার রচনাবলিতে এবং প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনে এর প্রমাণ আছে। আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হওয়ায় আগেই এই ভূভাগে কথা বলার ও লেখার ভাষা, কৃষিনির্ভর জীবনধারা, বিবাহ ও পরিবার-জীবন, খাওয়া-পরার রীতি, ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা, পরজীবনের ধারণা, যোগসাধনা, কর্মবাদ, দেব-দেবী ও পূজা-পার্বণ ইত্যাদির উদ্ভব ঘটেছিল। পরে সেগুলো বিকশিত হয়েছে নিজের ঐতিহ্যের মধ্যে আর্যভাষা, আর্য ভাবধারা, আর্য রীতিনীতি ও আর্য ধর্মকে গ্রহণ করে- সংশ্লেষণের (ঃযবংরং-ধহঃরঃযবংরং-ংুহঃযবংরং) মধ্য দিয়ে। আর্যপূর্ব কালের জনগণ আর্যদের সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে, আর্যরাও তাদের সংস্কৃতি থেকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। আদিতে এভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি। এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে অনার্য ও আর্য দুই ধারারই উপাদান ছিল। কৌম সমাজ, গঁই বা গ্রাম, জনপদ, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, জনপদ রাজ্য, রাজ্য ইত্যাদির ক্রমবিকাশের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সংস্কৃতির বিবেচনায় জনজীবনের ভৌগোলিক ভিত্তিও মনে রাখতে হবে।
ঐতিহাসিক কালে যুগ-যুগান্তর ধরে আমাদের সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে পর্যায়ক্রমে বহিরাগত আর্য-প্রভাব, বহিরাগত মুসলিম-প্রভাব ও বহিরাগত ইউরোপীয় প্রভাব গ্রহণ করে। যুগে যুগে বৈদেশিক ধর্ম, আদর্শ, জ্ঞান, বিজ্ঞান, ভাষা ও আচরণকে নিজের মধ্যে সমন্বিত করে বাঙালি তার স্বকীয় সত্তা ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করেছে। আবার স্বাধীনতা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে।
মানবজাতির নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যায়, কালো মানুষ (প্রধানত আফ্রিকার), হলদে মানুষ (প্রধানত জাপান চীন কোরিয়া ও ইন্দোচিনের) ও সাদা মানুষ (প্রধানত ইউরোপের)- এই তিন বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর লোকদের নানা রকম মিলন-মিশ্রণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের নানা জনগোষ্ঠী বা এথনিক গ্রুপ। বাংলাদেশের মানুষ পূর্বোক্ত তিন বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশে মূলত দুটি বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর লোক মিলন-মিশ্রণের মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে- কালো মানুষ ও হলদে মানুষ। রামায়ণ-মহাভারতে নিষাদ (কালো মানুষ) ও কিরাত (হলদে মানুষ) জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে।
বাংলার জনপ্রবাহে সাদা মানুষদেরও সামান্য মিশ্রণ পরে ঘটেছে- যাকে বলা যায় সমুদ্রে বারিবিন্দুবৎ। বাংলার জনগণের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য যাঁরা সন্ধান করেছেন, তাঁরা সকলেই এই জনগোষ্ঠীকে মিশ্র বা শংকর বলে অভিহিত করেছেন। এই মিশ্রতা বা সাংকর্য এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মধ্যেই আছে। প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই মিশ্রতা নগণ্য। প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ নিজেদের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষাও গ্রহণ করছে এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসছে। তাদের চিরদিনের জন্য আদিবাসী করে রাখা অন্যায়। হিন্দুসমাজে জাতিভেদ প্রথা ছিল এবং আছে। মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ ব্যবধান ছিল, যদিও তা ধর্মের দ্বারা অনুমোদিত নয়।
এসব পার্থক্যের প্রভাব এই ভূভাগের জনগণের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যর মধ্যে পাওয়া যায় না। এর কারণ হয়তো এই যে, স্মরণাতীত কাল থেকে যে রক্তসাংকর্য ঘটে আসছে তাতে কেউই আর কোনো ধরনের রক্তবিশুদ্ধতা দাবি করতে পারে না। নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে কোনো পার্থক্য নেই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিবাহের রীতি না থাকার ফলে হয়তো হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে তাদের মধ্যে নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। তবে কালক্রমে আন্তঃধর্মীয় বিবাহের রীতি প্রচলিত হতে পারে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যেও প্রচলন হতে পারে আন্তঃগোষ্ঠী ও আন্তঃধর্মীয় বিবাহের এবং বদ্ধতার সংস্কার ত্যাগ করে তারাও শামিল হতে পারে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদে।
এসব কিছুর বিবেচনাই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিবেচনার সময় সামনে আসে। আমরা এসবের কোনোটিকেই বিবেচনা থেকে বাদ দিতে পারি না। পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর, দলীয়ভাবে তৎপর বুদ্ধিজীবীদের ও কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের ভূমিকা জনগণের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। নীতি বাস্তবায়িত করতে হলে নীতির সঙ্গে নমনীয়তা দরকার হয়। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছে, সেভাবে সেগুলোকে ধরে নিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার স্থির করতে হবে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, স¤প্রীতি ও সর্বজনীন কল্যাণের বোধ কাম্য। ইংরেজিতে লোকমুখে চালু আছে : ‘খরাব ধহফ ষবঃ ড়ঃযবৎং ষরাব.’ ‘খড়াব ধহফ নব ষড়াবফ.’ ‘ঐড়হবংঃু রং ঃযব নবংঃ ঢ়ড়ষরপু.’ ‘ঞড় শহড়ি ধষষ রং ঃড় ঢ়ধৎফড়হ ধষষ.’ জনগণের মধ্যে প্রচলিত এসব উক্তি অবশ্যই উন্নততর জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। তবে ইংরেজ ও আমেরিকানদের অভ্যন্তরীণ নীতি যাই হোক- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, যুদ্ধবাজ।
পৃথিবীর যেকোনো উন্নত জাতির মতোই আমাদেরও আছে প্রাক-ইতিহাস (ঢ়ৎবযরংঃড়ৎু), আদি-ইতিহাস (ঢ়ৎড়ঃড়যরংঃড়ৎু) ও ইতিহাস। তাতে বিধৃত আছে আমাদের প্রবহমান সংস্কৃতির ধারা-উপধারা- জনজীবনের গতিময় উত্থান-পতন। ভৌগোলিক বাস্তবতারও ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলি নিয়ে কিংবা কেবল পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন থেকে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলি নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ অসহিষ্ণু বিতর্কে মত্ত থাকা, প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, ইতিহাসকে বিকৃত করা, গণতন্ত্রকে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সব কিছুকে নির্মম দলীয়করণে সীমাবদ্ধ করে দলবাজি ও দুর্নীতিতে মত্ত থাকা, গণতন্ত্রের নামে কালো টাকা, পেশিশক্তি ও বিদেশি দূতাবাসকে প্রাধান্য দেওয়া, বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্রকে মেনে নেওয়া, হুজুগ সৃষ্টি করে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করা ইত্যাদি দ্বারা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে জাতীয় অপসংস্কৃতিতে পর্যবসিত করে রাখা হয়েছে। কোন পক্ষকে ভালো বলা যাবে?
গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করার ফলে এবং মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় গত তিন দশক ধরে পুরাতন পরাজিত সংস্কার-বিশ্বাস ও প্রথা-পদ্ধতির উত্থান যেভাবে ঘটে চলছে, তা দেখে বলা যায়, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে প্রগতি প্রমাণিত হয় না। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, সা¤প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি অবলম্বন করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ক্ষমতায় থাকার উপায় করছেন মাত্র- রাজনীতিতে উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা ভাবছেন না।
জাতীয় জীবনে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল অবস্থা সৃষ্টি ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিতে উত্তীর্ণ হওয়াই এখন আমাদের মূল কাজ। এ কাজে সবচেয়ে সহায়ক হবে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার হিন্দু-মুসলমান শ্রেষ্ঠ মনীষীদের এবং ইউরোপের চৌদ্দ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত কালের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা। তাঁদের চিন্তাধারা আমাদের উন্নততর নতুন চিন্তা অর্জনে ও নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করবে। সংস্কৃতির স্বরূপ ও লক্ষ্য প্রথমেই উল্লেখ করেছি। সেটা সব সময় মনে রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন কল্যাণের সর্ববৃহৎ অবলম্বন রূপে। তার জন্য জাতিগঠন করতে হবে এবং অবলম্বন করতে জনগণের গণতন্ত্র বা সর্বজনীন গণতন্ত্র- কথিত উদার গণতন্ত্র নয়। সার্বিক উত্থান যাঁরা কামনা করেন তাঁদের অবলম্বন করতে হবে অতীতের ও বর্তমানের ভালো সব কিছুর প্রতি ভবিষ্যৎমুখী সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। ক্লাসিকের চর্চার মধ্য দিয়ে প্রয়াসপর হতে হবে নতুন ক্লাসিক ও নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টিতে, তারপর নতুন গণজাগরণ সৃষ্টিতে। গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য দূরদর্শী সৎ প্রচেষ্টা দরকার।
কোনো অভিসন্ধি সফল করার জন্য হঠাৎ করে হুজুগ তৈরি করা যায়, গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় না। গণজাগরণে জনগণের ভেতরকার মহৎ মানবীয় গুণাবলির জাগরণ ও সক্রিয়তা থাকে। অতীতের রেনেসাঁস ও ক্লাসিকের চর্চা নতুন রেনেসাঁস ও নতুন ক্লাসিক সৃষ্টির জন্য প্রেরণাদায়ক হবে। জনগণের ভেতর থেকে বিবেকবান চিন্তাশীল সাহসী ব্যক্তিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করতে হবে। সাহস হচ্ছে সেই মানবিক গুণ যা অন্যসব মানবিক গুণকে রক্ষা করে। সাহসের মূলে থাকে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা। পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ।
সাধনা ও সংগ্রাম দুইই লাগবে। বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। জাতীয় জীবনে যথার্থ সাধনা ও সংগ্রাম দেখা দিলে উজ্জ্বল উত্থান অবশ্যই সম্ভব হবে। জনসাধারণকে জাগতে হবে, জনসাধারণ ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির সঙ্গে বিরোধের মধ্য দিয়েই চলতে হবে, মানবস্বভাব এমন যে, কোনো স্থায়ী মীমাংসার উপায় পাওয়া যায় না। নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির ওপর জয়ী রাখতে হবে। বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি কর্তৃত্বশীল, সংস্কৃতি নির্জিত। মানব প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে সংকটের উৎস। মানবস্বভাবকে উন্নত করার সব রকম উপায় সন্ধান করতে হবে। সাধনা ও সংগ্রামের বিকল্প নেই।
( সৌজন্য ভোরের কাগজ , ১৫ জুলাই/১৫ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন