নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ
আবুল কাসেম
ফজলুল হক
এক.
চেতনা ও
নৈতিক চেতনা
প্রাণীমাত্রই চেতনার অধিকারী। চেতনা হল চেতন বস্ত্তর আপন সত্তায় বাহ্যজগৎকে ও অন্তর্জগৎকে অনুভব করার এবং কোনো কিছুর স্পর্শে বা প্রভাবে সাড়া দেওয়ার শক্তি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, অনুভূতি-উপলব্ধি, আবেগ-উত্তেজনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছাশক্তি ও সঙ্কল্প ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চেতনার প্রকাশ ঘটে।
পৃথিবীতে চেতন বস্ত্ত (living matter) আছে, আর আছে অচেতন বস্ত্ত (nonliving matter)। পৃথিবীর সবকিছুই এই দুই বর্গের (category) অন্তর্গত। এই দুই বর্গের বাইরে পৃথিবীতে আর কোনো কিছু যে আছে, তার প্রমাণ আমরা পাই না। বস্ত্তবহির্ভূত, দেহহীন, কায়াহীন, নিরবলম্ব কোনো চেতনার সন্ধান পাওয়া যায় না। আর চেতনা স্বয়ংপ্রকাশ নয়, বাহ্যবস্ত্তর স্পর্শে কিংবা প্রভাবে চেতন বস্ত্ততে অর্থাৎ প্রাণীদেহে চেতনা অস্তিমান ও সক্রিয় হয় - বাহ্যবস্ত্ত চেতন বা অচেতন যাই হোক।
ভূত-প্রেত, দেও-দানব, রাক্ষস-খোক্কস ইত্যাদিরও উৎপত্তি পরিবেশের প্রভাবে মানুষের মনে।
মানুষ সবচেয়ে উন্নত প্রাণী এবং মানুষের চেতনাও অন্য যে-কোনো প্রাণীর চেতনার চেয়ে উন্নত ও উৎকর্ষমন্ডিত। মানুষ ইচ্ছা করলে সজ্ঞানে, সচেতন প্রয়াস দ্বারা নিজের কামনা-বাসনার, আশা-আকাঙ্ক্ষার, চিন্তা-ভাবনার ও চেতনার উৎকর্ষ ঘটাতে পারে। অন্যদের সঙ্গে মিলে যৌথ প্রয়াসে সে তার সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারে, আর নিজের অনুকূলে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ প্রকৃতির ওপর আপন প্রভাব ও কর্তৃত্ব বিস্তার করে চলেছে। প্রকৃতিকে সে ব্যবহার করছে নিজের স্বার্থে। প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে গিয়ে সে নিজেও পরিবর্তিত হচ্ছে।
মানুষের চেতনায় কেবল অনুভবশক্তি নয়, বিচারশক্তি, সৌন্দর্যবোধ ও ইচ্ছাশক্তিও আছে। মানুষ সুন্দর-কুৎসিত, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভুল-শুদ্ধ ইত্যাদি বিচার করার, কিছু পরিমাণে হলেও নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার, এবং আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সামর্থ্যের অধিকারী। মানুষের এই সামর্থ্যের ও ইচ্ছাশক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার নৈতিক চেতনার পরিচয়। মানুষের সত্তায় নৈতিক উপাদান আছে। নৈতিক উপাদানের পরিচয় পাওয়া যায় তার বিচারশক্তির এবং বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তগ্রহণের ও সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী কাজ করার সামর্থ্যের মধ্যে।
ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্য ও ভুল-শুদ্ধ সম্পর্কিত যে-বিচারবোধ মানুষের মধ্যে দেখা যায় এবং বাহ্য প্রভাবে নিজের মধ্যে জাগ্রত যে-চেতনার দ্বারা মানুষের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়, তাকেই বলা হয় নৈতিক চেতনা। নৈতিক কথাটি এসেছে নীতি থেকে। নীতি কথার অর্থ নিয়ম বা সাধনপ্রণালি। নীতিবিজ্ঞানে নীতি কথাটির অর্থ হলো, মানুষের জন্য উৎকৃষ্ট নিয়ম বা সাধনপ্রণালি যা অবলম্বন করে মানুষের কাজ করা উচিত। নীতিবিজ্ঞানের নীতি প্রাকৃতিক নয়, সাংস্কৃতিক। সকল মানুষের নৈতিক চেতনার বৈশিষ্ট্য একরকম নয়। নৈতিক চেতনার স্বরূপ বা প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে গেলে মানবস্বভাবের হাজারো জটিল রহস্যের মুখোমুখি হতে হয়। তা এক অন্তহীন আলোচনার ও তর্ক-বিতর্কের বিষয়। পশ্চিমা জাতিসমূহের মধ্যে মানুষের স্বরূপ, the nature of man, the concept of man, human nature দর্শনের সমস্যারূপে স্বীকৃত। তাছাড়া নীতিবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আছে মনোবিজ্ঞান।
বাহ্যজগতের স্পর্শেই মানুষের চেতনা জাগ্রত হয়, এবং বাইরের প্রভাবে আর আপন চেতনার ও ইচ্ছাশক্তির বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী মানুষের আচরণ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। নৈতিক শক্তি মানুষের সমগ্র চেতনার এক অংশমাত্র। মানুষের চেতনায় পাশবিক শক্তিও আছে। সাধারণভাবে মানুষের নৈতিক চেতনাকে আজো মোটেই শক্তিশালী দেখা যায় না। আর নৈতিক প্রশ্নে প্রকৃতি উদাসীন; যা-কিছু ঘটা উচিত নয়, তেমন-সব ব্যাপার প্রকৃতিতে অবাধে ঘটে চলেছে। বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে খাচ্ছে, বাঘ ও সিংহের থাবায় হরিণের প্রাণ যাচ্ছে, মানুষের সমাজে প্রবলদের দ্বারা দুর্বলরা নির্জিত ও শোষিত হচ্ছে। জোর যার মুল্লুক তার - এই তো প্রকৃতিতে ঘটছে। প্রকৃতির ন্যায় মাৎস্যন্যায়।
নৈতিক চেতনা, নৈতিক বিচার, নৈতিক সিদ্ধান্ত ও নৈতিক অনুশীলন মানবীয় ব্যাপার। মানুষ প্রকৃতির অংশ হওয়ার ফলে মানুষের নৈতিক চেতনাও প্রকৃতিরই অন্তর্গত। অস্তিত্বের প্রয়োজনে, নৈতিক চেতনার তাগিদে, ভালো জীবন এবং তার অনুকূল উন্নত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির আগ্রহে মানুষ আইন তৈরি করে। তবে আইন তৈরির বেলায় হীনস্বার্থন্বেষীদের ও সুবিধাবাদীদের উদ্দেশ্য আর সর্বজনীন কল্যাণাভিলাষীদের উদ্দেশ্য এক হয় না। যারা দুর্বল ও দরিদ্র তাদের নৈতিক চেতনার প্রকৃতি আর যারা প্রবল ও ধনী তাদের নৈতিক চেতনার প্রকৃতি একরকম নয়। নীতি, আইন ও আইনের শাসন মানবীয় ব্যাপার। অন্য প্রজাতির মধ্যে এসব দুর্লভ। মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলে। এসব মানুষের নৈতিক চেতনারই ফল। সর্বসাধারণের পর্যায়ে নৈতিক চেতনাকে দুর্বল দেখা গেলেও ধর্মপ্রবর্তক, সমাজসংগঠক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের - এক কথায় সৃষ্টিশীল প্রগতিশীল ব্যক্তিদের - নৈতিক চেতনা কোনো কোনো দিক দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। তারই ফলে তাঁরা সর্বজনীন কল্যাণে বিস্ময়কর সব কাজ করে থাকেন। সৃষ্টির ক্ষেত্রে যাঁরা শক্তিশালী, যুগে যুগে তাঁরা মানুষকে ভেঙে নতুন করে গঠন করেন। দুর্বলরা নিজেদের নৈতিক চেতনার বলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হতে পারে এবং প্রবলদের শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা থেকে মুক্ত হতে পারে। নৈতিক শক্তি ও নীতি ছাড়া ঐক্য সম্ভব হয় না।
বিশেষ বিশেষ পরিবেশে, বাহ্যপ্রভাবে মানুষের মধ্যে জাগ্রত ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধির পরিচালনায় এবং আবেগের বশে, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক চেতনার ‘বিকাশ’ কিংবা ‘বিকার’ ঘটে। পরিবেশের অনুকূল প্রভাবে নৈতিক চেতনার যেমন স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে পারে, তেমনি প্রতিকূল প্রভাবে তা বিপর্যস্ত, বিকারপ্রাপ্ত, পঙ্গু, কিংবা রুগ্ণ হয়ে যেতে পারে। উন্নতিশীল সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের নৈতিক চেতনার যে-ধরনের প্রকাশ দেখা যায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে যেসব প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, ক্ষয়িষ্ণু অধোগামী পতনশীল সমাজে সে-ধরনের বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। সকল ক্ষেত্রেই বৈচিত্র্য ও ব্যতিক্রম থাকে। নৈতিক চেতনার বিকাশ ও বিকারের পেছনে একদিকে পরিবেশ, অন্যদিকে মানুষের অন্তর্গত ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা কাজ করে। সবটাই মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, তবে কিছুটা অবশ্যই করে। আর, এক প্রজন্মের পক্ষে যা সম্ভব হয় না, বহু প্রজন্মের পারম্পর্যশীল চেষ্টার মধ্যে দিয়ে তা সম্ভব হয়। যখন কোনো ব্যক্তির নৈতিক চেতনা বিকারপ্রাপ্ত হতে থাকে, তখন সেই ব্যক্তি ক্রমে ন্যায়স্বার্থের পথ পরিহার করে হীনস্বার্থের পথ অবলম্বন করে, এবং একসময়ে সে সর্বজনীন কল্যাণের পথ, স্বাভাবিক অগ্রগতির পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সে-অবস্থায় ক্রমে তার আত্মশক্তির মানবিক দিক দুর্বল হতে থাকে এবং পাশবিক দিক প্রবল হতে থাকে। আরও লক্ষণীয় যে, গুণগত দিক দিয়ে সব মানুষের নৈতিক শক্তিকে একরকম মনে হয় না : একই পরিবেশে কারো প্রবণতা গণমুখী, কারো প্রবণতা গণবিরোধী - যদিও সকলেই সর্বজনীন কল্যাণের কথাই বলে থাকেন। মানুষের নৈতিক সত্তার স্বরূপ কেবল শ্রেণিগত পরিচয় দিয়ে বোঝা যায় না, প্রত্যেকের আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যর বিচারও অপরিহার্য। মানুষের আচরণ নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বিস্ময়কর সব রহস্যের সম্মুখীন হন।
ব্যক্তিমানুষের নৈতিক চেতনাই যৌথ জীবনে - সামাজিক, সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের মধ্যে - বিভিন্ন রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়। ব্যক্তির জীবনে যেমন সমষ্টির জীবনেও তেমনি, কখনো কখনো নৈতিক চেতনার বিকারপ্রাপ্তি ঘটে। কখনো কখনো গোটা জাতি বিপথগামী হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনে ও যুদ্ধবিগ্রহে পক্ষ ও প্রতিপক্ষের নৈতিক আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য থাকে। প্রত্যেক পক্ষই প্রতিপক্ষের পরাজয় ও স্বপক্ষের বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুক্তি, কৌশল ও কর্মসূচি অবলম্বন করে। অবস্থা সবসময়ে একরকম যায় না। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই কোনো কোনো সময়কে ‘স্বর্ণযুগ’ আর কোনো কোনো সময়কে ‘অন্ধকার যুগ’ রূপে নির্দেশ করা যায়। কোনো জাতির বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের স্বর্ণযুগের নৈতিক চেতনা আর অন্ধকার যুগের নৈতিক চেতনা একরকম হয় না। কোনো জাতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সেই জাতির নৈতিক চেতনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকে। সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে কোনো কোনো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি তা দেখিয়েছেন : যেমন স্প্রেংলার, সুইট্জার, টয়েনবি, রাসেল, রাধাকৃষ্ণন, এরিখ ফ্রোম প্রমুখ।
মানুষ ছাড়া অন্য কোনো কোনো প্রাণীর মধ্যেও সৌন্দর্যবোধ ও বিচারশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তবে মানুষের তুলনায় তা একেবারেই নগণ্য।
দুই.
নৈতিক
সত্তায় অন্তর্দ্বন্দ্ব
মানুষের সত্তায় দ্বৈধ আছে। বাহ্যজগতের সংস্পর্শে মানুষের চেতনার যে অভিব্যক্তি, তা দ্বন্দ্বময়। যে ব্যক্তি পাষন্ড বলে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়, তারও অন্তর নির্দ্বন্দ্ব থাকে না। যিনি মহামানবরূপে নন্দিত ও বন্দিত হন, তাঁর চেতনায়ও দ্বন্দ্ব থাকে। প্রতিটি মানবীয় তাড়নাই প্রকৃতপক্ষে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির অন্বয় ও দ্বন্দ্ব (unity and struggle)। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য নামক যে ছয়টি মানবীয় তাড়না ষড়রিপু নামে অভিহিত হয়ে আসছে, সেগুলোর মধ্যেও রয়েছে বিপরীতের অন্বয়-দ্বন্দ্ব - প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান। কামনা জাগ্রত হলেই সে-কামনাকে চরিতার্থ করা যায় না, কামনার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর থেকে একটা নিষেধের বাধা ক্ষণকালের জন্য হলেও মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেও স্থিতি নেই, উত্তরণের তাগিদ দ্বন্দ্বপীড়িত মানুষকে অস্থির, চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন রাখে।
মানুষ নিজের প্রবৃত্তির ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির জন্য যেসব জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে, প্রকৃতিতে সেগুলো তৈরি অবস্থায় থাকে না; আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি খাটিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান অবলম্বন করে মানুষকেই সেগুলো তৈরি করে নিতে হয়। প্রবৃত্তিই আপন পরিতৃপ্তির জন্য মানুষকে কাজে তাড়িত করে। প্রবৃত্তির ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তিই স্বার্থ। সমাজে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে স্বার্থঘটিত নানা বিরোধ দেখা দেয়, এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট জনসমষ্টি নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো না কোনোভাবে বিরোধের মীমাংসা করে। এভাবে স্বার্থের সংঘাত ও স্বার্থঘটিত সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে মানুষের ইতিহাস বিকাশমান। এই প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ যেমন হয়, তেমনি হয়ে থাকে সংঘাতপূর্ণও। সর্বজনীন কল্যাণের দিক দিয়ে বিচার করলে, স্বার্থ ন্যায়সঙ্গত হতে পারে, ন্যায়বিরোধীও হতে পারে।
প্রকৃতি ও সমাজ নিরন্তর বিকশিত হয়ে চলছে। এই বিকাশধারায় মানুষ নিতান্তই পরিবেশের ও আপন প্রবৃত্তির দাস নয়, সে তার ইচ্ছা-অনুযায়ী কাজ করে প্রকৃতি ও সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে, সেইসঙ্গে আত্মশক্তিকেও ইচ্ছানুযায়ী পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও উন্নত করতে পারে। প্রত্যেক জাতির অভ্যন্তরেই জনগণের মধ্যে স্বার্থঘটিত নানা বিরোধ থাকে। সেইসব বিরোধ মীমাংসা করে জাতিকে এগোতে হয়। মানুষ কিছু পরিমাণে হলেও আপন প্রবৃত্তি ও পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যের অধিকারী। যত মন্থর গতিতেই হোক, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক চেতনা বিকশিত হয়ে চলছে। মানুষের নৈতিক চেতনা প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। দেশভেদে এবং শ্রেণিভেদেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এক অবস্থায় নেই - এক স্বরূপেও নেই। গত দুই দশকের মধ্যে মন-মানসিকতার দিক দিয়ে মানুষ অনেক বদলে গেছে।
নৃবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা নানাভাবে মানুষের সত্তার ও ব্যক্তিত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ফ্রয়েডের তত্ত্ব স্মরণ করা যেতে পারে। একজন মনোবিজ্ঞানবিদ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ফ্রয়েডের তত্ত্বের সারসংকলন করেছেন এভাবে :
ফ্রয়েড মানুষের ব্যক্তিত্বে তিনটি সত্তার অস্তিত্ব কল্পনা করেছেন : একটি হল ব্যক্তির আদিসত্তা, একটি বাস্তব সত্তা, আর শেষটি হলো নৈতিকসত্তা। মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় এগুলো হলো, অদস্ (id), অহম্ (ego) এবং অতিঅহম্ (super-ego)। মানুষের জীবনে এই তিনটি সত্তার প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। অদস্ বা আদিসত্তার প্রভাবে মানুষ সর্বদা সুখ ভোগ করতে চায়, সব রকম জৈবিক কামনা চরিতার্থ করতে চায়। এই সত্তার মূলনীতি হলো সুখ পাওয়া ও দুঃখ এড়িয়ে চলা। এর কোনো সম্ভব-অসম্ভব বিচার নেই - নীতিজ্ঞান নেই। ব্যক্তির বাস্তবসত্তা বা অহম্-এর কাজ হলো আদি বা জৈবিক সত্তার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির সমন্বয়সাধন। আদিসত্তার বাসনাকে সে বাস্তবের নিরিখে বিচার করে দেখে, দেখে এগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব কি অসম্ভব। আমাদের ঐচ্ছিক ক্রিয়াকলাপের ওপর অহম্-এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। তাই অদস্-এর চাহিদা প্রকাশ মাত্র তা কার্যকর হয় না। অহম্ যদি মনে করে, পরিস্থিতি অনুকূল আছে, তাহলে কামনাগুলো প্রকাশ করে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, আর পরিবেশ প্রতিকূল হলে কামনাগুলোকে দাবিয়ে রাখে কিংবা মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি সম্পর্কে অহম্-এর এই বোধ আসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে যে-সমস্ত বিষয় প্রত্যক্ষ করছে, উচ্চতর মানসিক প্রক্রিয়াসমূহের দ্বারা এগুলোর যেভাবে মূল্যায়ন করে, সেই প্রেক্ষাপট থেকেই সে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেয়। অহম্-এর ওপর একটি গুরুদায়িত্ব হলো, সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করা। তাই যে-সমস্ত কামনা চরিতার্থ করতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অহম্ সচেষ্ট থাকে।
জন্মের সময়ে মানুষের কোনো নীতি থাকে না, শিশু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, এবং বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, শুভাকাঙ্ক্ষী, ধর্মগুরু এবং বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সংস্রবের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে ক্রমে ন্যায়-অন্যায়বোধ বা নীতিবোধ বিকশিত হয়। এই নীতিবোধের বিকাশ ব্যক্তিসত্তায় একটি নবতর সংযোজন। কোনো কিছু করা না-করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অহম্ পূর্বের স্তরে শুধু পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কথা ভাবে, এখন তার সাথে আর একটি জিনিস যোগ হয়, সেটি হলো নীতিবোধ। এই তৃতীয় সত্তাটিই হল অতিঅহম্ বা নৈতিকসত্তা। ব্যক্তির এই সত্তা যদিও বয়সে অন্যগুলোর তুলনায় নবীন কিন্তু আচরণে সে প্রবীণ। এর দায়িত্ব হলো ন্যায়পালের। সে অহম্কে সব সময় উপদেশ দেয় ভালো কাজ করতে আর মন্দ কাজ না-করতে। সাধারণভাবে এই তৃতীয় সত্তাকে আমরা বিবেকের আধার বলে মনে করতে পারি। যা হোক, এই অতিঅহম্-এর প্রভাবে অহম্ মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। তবে জীবনে সব সময় যে নৈতিক সত্তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা হয়, তা নয়; এর নির্দেশ মানতে অহম্ বাধ্য নয়। অহম্ কখনো জৈবিক সত্তার আবদার রক্ষা করে, কখনো নৈতিক সত্তার নির্দেশ মেনে চলে, আবার কখনো দুয়ের মধ্যে আপসরফা করে চলে। ব্যক্তিত্বের কাঠামো বিষয়ে ফ্রয়েডের মতবাদের মোটামুটি এই হলো মূল কথা। (মুহম্মদ নুরুল্লাহ, ‘দুর্নীতির উৎস সন্ধানে’, লোকায়ত, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ঢাকা, মে ১৯৮৫)
ফ্রয়েডের এই উদ্ভাবনের আগেও জ্ঞানের কোনো কোনো শাখায় এবং গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে ও কাব্যে মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায় স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসা রূপকথা-উপকথাতে এবং রামায়ণ-মহাভারত ও ইলিয়াড-অডিসিতে কোনো না কোনোভাবে মানবসত্তার দ্বৈধ, মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত উপলব্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে রোহিণীর অন্তর্দ্বন্দ্ব বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন : ‘সুমতি নামে দেবকন্যা এবং কুমতি নামে রাক্ষসী, এই দুইজন সর্বদা মনুষ্যের হৃদয়ক্ষেত্রে বিচরণ করে এবং সর্বদা পরস্পরের সহিত যুদ্ধ করে : যেমন দুই শৃগালী মৃত নরদেহ লইয়া বিবাদ করে, ইহারা জীবন্ত মনুষ্য লইয়া সেইরূপ করে।’ ইসলামে নফ্স্-এর কথা আছে এবং নফ্স্-এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নফ্সে আম্মরা, নফ্সে লাউয়ামা ও নফ্সে মোৎমায়েন্নার কথা বলা হয়েছে। নফ্সের সঙ্গে পরিবেশকেও বিবেচনায় ধরা হয়েছে। ইসলামের মতে, নফ্স্ পরিশোধনযোগ্য এবং মুসলমানের কর্তব্য নফ্স্কে পরিশোধিত করে পরিতৃপ্ত করা। সেই সঙ্গে পরিবেশকে উন্নত করাও মুসলমানের কর্তব্য।
ফ্রয়েড মানুষের চেতনার অন্তর্গত বিভিন্ন প্রবণতার ওপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করে মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের নৈতিক সত্তাকে বোঝার পক্ষে তাঁর এই ব্যাখ্যা সহায়ক। ভারতীয় ঐতিহ্য-অনুযায়ী যে-ব্যাপারটিকে সরলীকৃত করে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির কিংবা সু ও কুর দ্বন্দ্বরূপে দেখানো হয়, তাকেই ফ্রয়েড id, ego, superego দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যে আছে আহ্রিমান ও অহুদমাজদার কথা। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাকে কিংবা বঙ্কিম প্রমুখের বক্তব্যকে পরীক্ষাগারে যান্ত্রিক উপায়ে প্রমাণ করার উপায় নেই। তবে আমরা নিজেদের অন্তর্জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এসব বক্তব্যকে নাকচ করে দিতে পারি কি? মানুষ কি কখনো এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে পারে যে, তার অন্তরে দ্বিধার কোনো স্থান বা সম্ভাবনাই থাকে না? মানুষ কি কখনো এমন অপরাধী হতে পারে যে, তার অন্তরে অনুশোচনার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না? ফ্রয়েডের কিংবা বঙ্কিম প্রমুখের এসব চিন্তাকে বাস্তব ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
বাইরের জগৎ ইন্দ্রিয় ও স্নায়ুতন্ত্রীর মধ্য দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে, তার ফলে মানুষের চেতনা জেগে ওঠে। এই জেগে-ওঠা চেতনায় দ্বৈধের প্রকাশ ঘটে : পরস্পরবিরোধী প্রবণতার সহাবস্থান ও সংগ্রাম দেখা দেয়। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের মনে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় - শেক্সপিয়রের নাটকে কিংবা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, ডিকেন্স, হার্ডি, হুগোর উপন্যাসে নর-নারীর অন্তর্দ্বন্দ্বের যে ঘনীভূত প্রতিফলন দেখা যায় - তা এই দ্বৈধেরই প্রকাশ। প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে এই দ্বৈধ অনুভব করে। অন্তর্জীবনে মানুষ যেমন শক্তিশালী, তেমনি আবার দুর্বলও হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রিক সকল কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই মানুষের শক্তি ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
তিন.
যুক্তির
ধারা : আবেগ ও বিবেক
মানুষের চেতনায় আরেকটি শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় যাকে বলা হয় বিবেক। বিবেক হলো মানুষের চেতনার অন্তর্গত সেই শক্তি যা মানুষকে তাড়িত করে অন্যায়, অকল্যাণ, অপ্রেম, নিষ্ঠুরতা ও কুৎসিতের পথ পরিহার করে ন্যায়, কল্যাণ, সম্প্রীতি ও সুন্দরের পথে চলতে। বিবেকচালিত বিচারবোধকেই বলা হয় নৈতিক চেতনা।
বাস্তবের স্পর্শে আপন সত্তায় জাগ্রত প্রবৃত্তি, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, ক্ষোভ, ক্রোধ, লোভ, ভয় ইত্যাদি দ্বারা তাড়িত হয়ে যখন মানুষ কোনো কর্মে ধাবিত হয়, তখন সেই কর্মের ঔচিত্য-অনৌচিত্য, শুভাশুভ ও ফলাফল সম্পর্কে এবং উদ্দেশ্য সাধনের প্রকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে তার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্নের পর উত্তর, উত্তরের পর প্রশ্ন, আবার উত্তর, আবার প্রশ্ন - এই ধারায় চলতে চলতে একসময়ে মীমাংসা। এই ধরনের প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন ও উত্তর-প্রত্যুত্তরই হলো যুক্তি। যুক্তির মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটতে পারে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে নানা পরিস্থিতিতে নানাভাবে মানুষকে যুক্তি অবলম্বন করে চলতে হয়। সমাজে অপশক্তির যুক্তি ও শুভশক্তির যুক্তি ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সিদ্ধান্তে অটল থেকে মানুষকে কাজ করতে হয়। তবে মানুষ যখন বদ্ধ, অচল, অন্ধ, বিকাশহীন বিশ্বাসে স্থিত হয়, তখন সে তার বিবেক ও যুক্তিবোধকে সচেতন চেষ্টা দ্বারা বিশ্বাসের অনুকূলে একমুখী করে তোলে, স্থান-কাল-পাত্রের পার্থক্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তাতে তার নৈতিক চেতনা বিকারপ্রাপ্ত হয় - জগৎ বিকাশমান থাকলেও তার নৈতিক চেতনা গতিহীন বিশ্বাসে বন্দি ও বিকাশহীন থাকে। ধর্মের, মতাদর্শের ও দলের অন্ধ অনুসারীদের মধ্যে এটা দেখা যায়। এ-সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। কেবল মুক্তবুদ্ধির চর্চা (nihilism?) দ্বারা এ-সমস্যার সমাধান হয় না। হীনস্বার্থ হাসিলের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উদ্দেশ্যেও যুক্তিপ্রয়োগ হয়ে থাকে। সার্বিক কল্যাণের জন্য যুক্তির পরিচালকরূপে বিবেক অপরিহার্য। বিবেকহীন যুক্তি বিপথগামী হয়ে থাকে।
পর্যবেক্ষণ করতে গেলে দেখা যায়, যুক্তি নিতান্তই তাৎক্ষণিক ব্যাপার নয় - দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যুক্তির প্রক্রিয়াকে অপেক্ষাকৃত সহজে বোঝা যায় যদি বুদ্ধি, আবেগ, বিবেক, যুক্তি ইত্যাদিতে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে প্রক্রিয়াটিকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। এখানে এগুলোতে ব্যক্তিত্ব আরোপ করেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
মানুষের চেতনায় বুদ্ধি আবেগের নিয়ন্ত্রক বা পরিচালক হিসেবে কাজ করতে চায়, আর আবেগ চায় বুদ্ধিকে অগ্রাহ্য করে, পরিণাম বিচার না করে, আপাতস্বার্থের জন্য বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে যেতে। ফলে মানুষের মনে আবেগ ও বুদ্ধির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বে আবেগ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলে পরিণাম একরকম হয়, আর আবেগ বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে পরিণাম অন্যরকম হয়।
যুক্তি মানুষকে চালিত করে প্রথমে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে ও তর্ক করতে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের সঙ্গে নিজে তর্ক-বিতর্ক করে ন্যায়, সুন্দর, শুভ, শ্রেয় ও কর্তব্য নির্ধারণের, কিংবা কোনো ব্যাপারে মীমাংসায় পৌঁছার প্রচেষ্টা হলো যুক্তিপ্রয়োগের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায় ঠিকমতো অতিক্রম করার পর অন্যের মতামত সন্ধান করতে হয়, এবং অন্যের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে নিজের মতের শুদ্ধতা বিচার করতে হয়। সেই সঙ্গে ইতিহাসের আলোকে মানবজাতির অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজের মত বিবেচনা করতে হয়। এভাবে যতদূর সম্ভব - বর্তমান অবস্থা, চারপাশের বাস্তবতা, অতীত পটভূমি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা - সবদিক বিবেচনায় ধরে এবং সকল পক্ষের মতামত বিচার করে মীমাংসায় বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়। তারপর সেই সিদ্ধান্ত অবলম্বন করে উদ্দেশ্যসাধনের বাস্তব কর্মে অগ্রসর হতে হয়। বাস্তব কর্মের এই পর্যায় হলো যৌক্তিক অনুশীলনের পর্যায়। এই পর্যায়ে পূর্ববর্তী চিন্তাগত সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা কর্মের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। কর্মে অগ্রসর হয়ে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তকে অপরিবর্তনীয় রূপে ধরে রাখা যায় না, অনুশীলনের ধারায় পূর্ববর্তী চিন্তাগত মীমাংসায় কমবেশি অপূর্ণতা কিংবা ত্রুটি ধরা পড়ে। তখন সিদ্ধান্তের পরিমার্জন কিংবা সংশোধন করে কর্ম সম্পাদন করতে হয়। এভাবে যুক্তিপ্রয়োগের এক-একটি প্রক্রিয়া প্রথম থেকে শেষ পর্যায়ে পৌঁছায় আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোষ্ঠীগত, দলীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এভাবে বিবেককে যথাসম্ভব পরিচালকের ভূমিকায় রেখে যুক্তির দ্বারা আবেগকে পরিচালিত করে চিন্তা ও কাজ করার পদ্ধতিই নৈতিক অনুশীলন। ব্যক্তিজীবনের মতো যৌথ বা সম্মিলিত জীবনেও নৈতিক অনুশীলন অপরিহার্য। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সকল কাজেই নৈতিক অনুশীলন অপরিহার্য।
উদ্দেশ্যসচেতনতা, উদ্দেশ্যনির্ণয়ের চেষ্টা এবং উদ্দেশ্যনিষ্ঠা নৈতিক অনুশীলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মনে রাখতে হবে যে, কর্ম ছাড়া নৈতিক অনুশীলনের আর কোনো অবলম্বন নেই। প্রকৃত নৈতিক চিন্তা কর্মমুখী। কর্মের প্রশ্ন বাদ দিয়ে যাঁরা নৈতিক বিষয় বিবেচনা করেন, তাঁদের চিন্তা মূল্যহীন।
যুক্তিপ্রয়োগের উদ্দেশ্য কোনো অন্ধ বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করা কিংবা অন্যকে পরাজিত করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা নয়; যুক্তি প্রয়োগের উদ্দেশ্য হলো, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রয়াসে ন্যায়, সুন্দর, শুভ ও কর্তব্য নির্ধারণ করা; প্রকৃষ্ট সাধনপদ্ধতি উদ্ভাবন করা এবং তা অবলম্বন করে কর্তব্য সম্পাদন করা।
মানুষের জেগে-ওঠা চেতনায় বিবেক নামক যে প্রবণতা প্রকাশ পায় তাই মানুষকে চালিত করে ন্যায়, সুন্দর, শুভ ও কর্তব্যের পথে। স্বাভাবিক অবস্থায় বিবেক যুক্তিপ্রয়োগের প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। সামাজিক, সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, দলীয় ইত্যাদি সমষ্টিগত কর্মকান্ডে ক্রিয়াশীল থাকে সংশ্লিষ্ট জনসমষ্টির যৌথ বিবেক।
নানা কারণে মানুষের বিবেক বিকারপ্রাপ্ত কিংবা দুর্বল হতে পারে। বিবেক বিকারপ্রাপ্ত বা দুর্বল হলে যুক্তি দিকভ্রষ্ট ও বিপথগামী হয়। সে-অবস্থায় মানুষ কুযুক্তি ও কুতর্ক অবলম্বন করে, কিংবা অবিমৃষ্যকারিতা, অদূরদর্শিতা ও ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেয় - জীবনের স্বাভাবিকতা ও সুস্থতা হারিয়ে ফেলে। তখন সে নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণও রাখতে পারে না। কোনো কোনো সময়ে এক-একটি গোটা সমাজের বা জাতির বিবেককে দুর্বল হয়ে পড়তে কিংবা বিকারপ্রাপ্ত হতে এবং যুক্তি-প্রবণতাকে দিকভ্রষ্ট ও বিপথগামী হতে দেখা যায়। তবে কালক্রমে প্রগতিশীল শক্তির প্রচেষ্টায় নৈতিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে দুর্বল, বিকারপ্রাপ্ত, বিপথগামী বিবেক সুস্থ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, এবং বিপথ ত্যাগ করে পথে আসতে পারে। ব্যক্তিগত, কিংবা সামাজিক, অথবা জাতীয় জীবনে যখন বুদ্ধিবিভ্রাট দেখা দেয়, আধি-ব্যাধি, বিকার-বিপর্যয়, বিক্ষোভ-সন্ত্রাস-উন্মাদনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সুস্থতার অনুকূলে নিজেদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করে সকল কর্মের মুহূর্তে অন্তর্গত বিবেক ও যুক্তিবোধের শরণাপন্ন হলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে পুনরায় নতুন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা লাভ করা সম্ভব হয়। তবে তার জন্য অপক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে প্রগতিশীল শক্তিকে সংগ্রাম করতে হয়।
মানুষ যেমন লক্ষ লক্ষ বছরের সাধনা ও সংগ্রামে আজকের অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তেমনি মানুষের স্নায়ুমন্ডলী, মস্তিষ্ক, চেতনা, বিবেক ও যুক্তিবোধও লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থা লাভ করেছে। মানুষের বিকাশের সম্ভাবনা অফুরন্ত। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী : ‘শেষ অবধি ধবংসের মুখোমুখি আমরা নই, সব প্রতিকূলতাকে ঠেলে, সব সাময়িক অধঃপতন সত্ত্বেও ‘মানবযাত্রী’ এগিয়ে চলছে মঙ্গলের দিকে, সুন্দরের দিকে, অতি মন্থর গতিতে...।’ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মানবযাত্রী’ হলো চির-বিকাশমান মানুষ - প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্য দিয়ে বিকাশমান। ধর্মবিষয়ে লিখিত The Future of an Illusion গ্রন্থের শেষে ফ্রয়েডের মন্তব্য :
We may insist as often as we like that man’s intellect is powerless in comparison with his instinctual life, and we may be right in this. Nevertheless, there is something peculiar about this weakness. The voice of the intellect is a soft one, but it does not rest till it has gained a hearing. Finally, after a countless succession of rebuffs, it succeeds. This is one of the few points on which one may be optimistic about the future of mankind, and it is in itself a point of no small importance. From it one can derive yet other hopes. The primacy of the intellect lies, it is true, in a distant, distant future, but probably not in an infinitely distant one.
চার.
নৈতিক
অনুশীলন ও সুখ-সমৃদ্ধি
নৈতিক চেতনা মানুষকে আত্মপীড়নের অনুশীলনে তাড়িত করে না, তাড়িত করে উন্নততর আনন্দ, সমৃদ্ধতর সুখ, দীর্ঘস্থায়ী জীবনীশক্তি ও মহত্তর জীবনের সাধনায়। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের বৈষয়িক ও মানসিক সমৃদ্ধিই নৈতিক বিবেচনার ও নৈতিক অনুশীলনের উদ্দেশ্য।
আনন্দ, সুখ, আরাম - এসবের প্রকারভেদ আছে। সব আনন্দ সমান গভীর নয়, সব সুখের ফল সমান হয় না, সব আরামে একরকম তৃপ্তি হয় না। আপাতমধুর কিন্তু পরিণাম ভয়াবহ - এমন অভিজ্ঞতা মানুষের আছে; আবার আপাতকঠিন কিন্তু পরিণাম সুখকর - এমন অভিজ্ঞতাও মানুষের হয়। ভাঁড়ামি ও রঙ্গ-ব্যঙ্গের আনন্দই একমাত্র আনন্দ নয়। ক্ষমতা প্রদর্শনের ও অন্যের ওপর প্রভুত্ব করার আনন্দ কোনো আনন্দই নয়, বর্বরতা ও মানসিক বিকার মাত্র। সর্বক্ষণ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকার ও আলোচনার বিষয়বস্ত্ত হওয়ার চেষ্টার মধ্যেও মানসিক বিকারেরই প্রকাশ দেখা যায়। নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের জীবনেও আনন্দ ছিল। গ্যেটে এবং রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত জীবনই যাপন করেছেন। বিটোফেন ও মোজার্টের আনন্দচর্চা অপসংস্কৃতির উপাদান থেকে বহুদূরে। ধনলিপ্সু ও জ্ঞানলিপ্সুদের আনন্দ এক প্রকৃতির নয়। সরল জীবনযাত্রায়ও আনন্দ আছে। সুন্দর-কুৎসিতের পার্থক্যজ্ঞান এবং আনন্দের প্রকারভেদ সম্পর্কে ধারণা মানুষের নৈতিক চেতনার সুস্থতা-অসুস্থতার পরিচয়জ্ঞাপক। যারা সর্বজনীন কল্যাণ ও প্রগতির প্রশ্ন পরিহার করে ভোগবাদী নীতি নিয়ে চলে তাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেজন্য তাদের মোকাবিলায় জনগণের নৈতিক শক্তির জাগরণ অপরিহার্য।
যে-অবস্থায় নৈতিক চেতনার অভিব্যক্তি আত্মপীড়নের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ঘটে, সে অবস্থা হয় নিতান্তই এক বিকৃত অস্বাভাবিক অবস্থা, না-হয় জীবন-জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার ফলে সৃষ্ট অবস্থা। হীনস্বার্থ ত্যাগ করে ন্যায়স্বার্থ সাধন, ক্ষুদ্রস্বার্থ ত্যাগ করে বৃহৎস্বার্থ অর্জন, চর্মসর্বস্ব সুখে আবদ্ধ না থেকে গভীর মর্মগত সুখ অর্জন হলো নৈতিক অনুশীলনের লক্ষ। অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বিকাশমান সুস্থ নৈতিক চেতনা মানুষকে ন্যায়স্বার্থ ও হীনস্বার্থের পার্থক্য সম্পর্কে সজাগ করে এবং বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ন্যায়ের পথে চলতে তাড়িত করে। কেবল নিজের সুখ নয়, সকলকে নিয়ে সুখী হতে হয়, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এদেশে ধর্মপন্থী, গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী - চিন্তা ও কর্মের তিনটি ধারাই - দীর্ঘকাল যাবৎ বিকারপ্রাপ্ত। যে-দেশে সমাজের স্তরে স্তরে জীবন-জগৎবিমুখ ত্যাগের আদর্শকে মহিমান্বিত করা হয়, যে-দেশে বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক আদর্শের বিবেচনা ও অনুশীলন নেই, গণতন্ত্রের নামে অপব্যবস্থা ও দুঃশাসন বিরাজমান, সে-দেশের সংবিধানে ভালো ভালো কথা লেখা থাকলেও সেগুলো কার্যকরতা পায় না। এদেশে সেক্যুলারিজমের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। সেক্যুলারিজমের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো, নৈতিক বিচারের বিষয়গুলোকে ধর্ম থেকে আলাদা করে নিয়ে জনজীবনের জন্য সেগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেওয়া। সেক্যুলারিজমের সঙ্গে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের অনুশীলন যুক্ত না থাকলে তা যেমন বিভ্রান্তিকর হয়, তেমনি ক্ষতিকর হয়। জনস্বার্থনিরপেক্ষ বির্মূত ভাব রূপে সেক্যুলারিজম মূল্যহীন - nihilism-এর তুল্য।
যেসব রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার দিক দিয়ে দেখলে স্বীকার করতে হবে, সেসব রাষ্ট্রের রাজনীতি অবক্ষয়ক্লিষ্ট, সরকার ও প্রশাসনব্যবস্থা অবক্ষয়কিলষ্ট, অর্থনীতি পরনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক শিথিল, সমাজ অসংহত - মানুষ একত্রে বসবাস করলেও বালুর কণার মতো ধুলার কণার মতো একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্র দুর্বল, এ-অবস্থায় বাইরে থেকে নানা পরিকল্পনা চাপিয়ে দিয়ে মোট জাতীয় আয় ও মাথাপিছু গড় আয় কিছু বাড়ানোর ব্যবস্থা করে তাকে উন্নয়ন নাম দিলে তাতে অবক্ষয়ের প্রতিকার হয় না। নয়া উপনিবেশবাদী dominance and dependence নীতি অনুযায়ী এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অবক্ষয়ক্লিষ্ট রাষ্ট্রে জাতীয় উন্নতির পথ খুঁজতে হলে পড়তির ও অবক্ষয়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে - বুঝতে হবে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উঠতি-পড়তির কারণ-কার্য সম্পর্ককে, তারপর প্রতিকার খুঁজতে হবে। ইতিহাসের ধারায় রেনেসাঁসের ও অবক্ষয়কালের কারণ-কার্য অনুসন্ধান করলে মহৎ উত্তরণের সম্ভাবনা বোঝা যায়। সামাজিক সংহতির ও বিচ্ছিন্নতার বৈষয়িক ও মানসিক সব ধরনের কারণই খোঁজ করা দরকার।
পাঁচ.
মানুষের
মধ্যে পশুত্ব ও মনুষ্যতব
সাড়ে তিনশো বছর আগে ব্রিটিশ দার্শনিক টমাস হব্স্ মানুষের কল্যাণের চিন্তা করতে গিয়ে মানুষকে দেখেছিলেন ‘nasty, solitary, poor, brute and short’ রূপে। পরবর্তীকালে সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্নতি সাধনের তাগিদে ব্রিটেনে লক, হিউম, স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন ও হার্বার্ট স্পেন্সার মানুষের স্বরূপ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে মানুষের সমাজে বিরাজিত struggle for existence-এর, natural selection-এর এবং survival of the fittest-এর নানা রূপ ধরা পড়েছে। হব্স্ যে-চেহারায় মানুষকে দেখে গিয়েছেন, বিভিন্নকালে বিভিন্ন দেশে আরও অনেক মনীষী মানুষকে দেখে গিয়েছেন সেই চেহারাতেই। সপ্তদশ শতাব্দীর লকের দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ মিলিয়ে মানুষ। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক রুশোর দৃষ্টিতে ‘মানুষ মূলত সৎ’। মানুষের অন্তরকে তিনি দেখেছেন মহত্তম সব সম্ভাবনার অফুরন্ত ভান্ডাররূপে। তিনি অনুভব করেছেন যে, সম্ভাবনাসমূহকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব। কার্ল মার্কসের দৃষ্টিতেও মানুষের ব্যক্তিত্বের মহত্তর দিকই বড় হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। মানবসত্তার কুৎসিত কদর্য দিকও তিনি দেখেছেন। মানুষের সমাজে তিনি দেখেছেন মানুষ ও অমানুষ। বস্ত্তবাদী দ্বন্দ্বদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে তিনি মানুষকে দ্বান্দ্বিক স্বরূপে বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্মের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষ পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করার সামর্থ্য রাখে। সমাজে dehumanization of man তিনি দেখেছেন এবং humanization of man in society সম্পর্কে চিন্তা করেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি মানব-পরিস্থিতির - আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিভিন্নকালে পৃথিবীর দেশে দেশে আরও অনেক মনীষীর দৃষ্টিতে মানুষের ব্যক্তিত্বের মহত্তর দিক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ-কালের ধারণা-অনুযায়ী, মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মে না, মনুষ্যত্ব সে অর্জন করে। মানুষ যুক্তি কিংবা ধর্ম নিয়ে জন্মে না, জৈবিক সামর্থ্য কিংবা অন্তর্গত সম্ভাবনা অবলম্বন করে যুক্তি কিংবা ধর্ম তাকে অর্জন করতে হয়। মানুষকে মানুষ হতে হয় মানবিকীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, মনুষ্যত্ব অর্জন করে। এই অর্জনে মানুষের অন্তর্গত ইচ্ছাশক্তির, চিন্তাশক্তির, শ্রমশক্তির ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। মানুষ শুধুই প্রাকৃতিক নিয়মের, সামাজিক প্রথা-পদ্ধতির ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের শৃঙ্খলে বাঁধা অবস্থার দাস নয়; সে আপন প্রবৃত্তির দাসও নয়; তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সেই শক্তিও যার বলে সে অবস্থার এবং আপন সত্তার প্রভুও হয়ে উঠতে পারে। অবস্থার প্রভু কিংবা নিয়তির নিয়ন্তা হওয়া এক জীবনে, এক প্রজন্মে সম্ভব না হলেও বহু জীবনে, বহু প্রজন্মের পারম্পর্যশীল সাধনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্ভব হতে পারে। জাতীয় উন্নতি-অবনতির প্রশ্নে মানুষের স্বরূপ সংক্রান্ত সমস্যা বিবেচনায় আনতে হবে, মানুষের শক্তি ও দুর্বলতার, মানবস্বভাবের দৃঢ়তা ও দোদুল্যমানতার প্রশ্ন বিবেচনায় ধরতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের স্থলে সহজ-সরল-স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে ভাবতে হবে - প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত-সংঘর্ষের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সম্প্রীতিকে। তা না করে, শ্রমজীবী মানুষকে কীভাবে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি খাটানো যাবে, আর মোট জাতীয় আয় ও মাথাপিছু গড় আয় বাড়ানো যাবে, সে-ধরনের চিন্তা ও পরিকল্পনা নিয়ে যথার্থ জাতীয় উন্নতির কোনো পথ পাওয়া যাবে না। উন্নত জীবন, উন্নত সমাজ, উন্নত জাতি, উন্নত রাষ্ট্র ও উন্নত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে তার ভিত্তিভূমি হিসেবে মানসিক ও বৈষয়িক এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে মানুষের নৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটতে পারে, কিংবা আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক উন্নতি ঘটতে পারে।
আমাদের দেশে অনেক ভাগ্যান্বেষী দুর্নীতির বিরুদ্ধে হইচই করে, ভাঁওতা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিত্তশালী ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে থাকে। কিন্তু নৈতিক প্রশ্ন যিনি আন্তরিকভাবে তোলেন, তাঁর ওপর সামাজিক নিগ্রহ নেমে আসে, এবং তিনি আপস করতে না চাইলে হয়তো সমাজে তাঁর ভাতও জোটে না। এদেশে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য বিশেষ সাহসের দরকার হয় বলে মনে হয় না, সরকারের বিরুদ্ধে অনেকেই চিৎকার করে কথা বলেন, অনেক-কিছু লেখেন ও প্রকাশ করেন এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। কিন্তু এটা উপলব্ধি করি যে, এদেশে নৈতিক বিষয়ে বাস্তবসম্মত কার্যকর কোনো কথা বলার জন্য যথার্থই সাহসের দরকার হয় - বিপদের ঝুঁকি নিতে হয়; কারণ যিনিই নৈতিক বিষয়ে কার্যকরভাবে কিছু লিখতে কিংবা বলতে চেষ্টা করেন, তাঁরই চতুষ্পার্শ্বে বহু লোক সক্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর ত্রুটি অন্বেষণে এবং তাঁকে খাদে নিক্ষেপ করার প্রয়াসে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা কার্যকর নৈতিক প্রশ্নকে নিজেদের জন্য বিপজ্জনক মনে করে। সমাজে বিবেক, বিচারপ্রবণতা ও যুক্তিপরায়ণতা বিকশিত হয়নি বলে সমস্যা অত্যন্ত জটিল। ক্ষমতাবান, প্রতিপত্তিশালী ও সক্রিয় লোকেরা ন্যায়স্বার্থের বিবেচনায় অগ্রসর না হয়ে হীনস্বার্থের চিন্তায় মনকে আচ্ছন্ন রাখেন বলে যে-কোনো নৈতিক প্রশ্নকেই ভয় পান এবং প্রশ্ন-উত্থাপনকারীকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। এ-সমাজে মানবশিশুর মানবিকীকরণের চেয়ে অমানবিকীকরণের সুযোগ অনেক বেশি। এ অবস্থায়, প্রচলিত ধারায় সুস্থ-স্বাভাবিক-সমৃদ্ধ জীবন সম্ভব নয়। সুস্থ-স্বাভাবিক-সমৃদ্ধ জীবনের এবং জাতীয় উত্থানের উপায় উদ্ভাবন করতে হলে জাতীয় ও সামাজিক জীবনের সকল কর্মকান্ডের মর্মমূলে চাই নৈতিক চেতনার পর্যাপ্ত জাগরণ ও সুস্থ নৈতিক অনুশীলন - রাজনীতিতে, প্রশাসনে, শিক্ষাব্যবস্থায়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ও পরিকল্পনায় - সর্বত্র। নীতিবিজ্ঞানে বা নীতিদর্শনে এবং যুক্তিবিজ্ঞানে যেসব সমস্যা আলোচিত হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অন্তত কিছু সময়ের জন্য গোটা জাতির শিক্ষিত লোকদের সেসব বিষয়ের চর্চায় পরিপূর্ণ মনোযোগ প্রদান দরকার। বলাই বাহুল্য, এ বিষয়ে চিন্তা হতে হবে কর্মমুখী, কাজ করার জন্য - কাজ করে জীবন পরিস্থিতির ও জীবনের উন্নতিসাধনের জন্য।
ছয়.
শোষিত-নির্জিত-বঞ্চিত মানুষদের উন্নতির
ধারায় ধর্ম ও
মতাদর্শ
পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় কী - এই নৈতিক প্রশ্ন যুগে যুগে মানুষের মনকে আলোড়িত করেছে। এ-প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়েই মানুষ উদ্ভাবন করেছে নীতি, পদ্ধতি, আদর্শ, জীবনদর্শন। ধর্মের মধ্যেও আমরা এ-প্রশ্নেরই উত্তর পাই। তাছাড়া সমাজে শোষিত-নির্জিত মানুষদের মুক্তির দাবি কখনো কখনো প্রবল হয়ে ওঠে। ধর্ম আত্মপ্রকাশ করে সেই মুক্তির ঘোষণা নিয়ে। বঞ্চিত-শোষিত-নির্জিত মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং সভ্যতার বিকাশে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
ধর্মবিশ্বাসী লোকেরা বলে থাকেন, ধর্ম দৈব, বা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত, ধর্মের বিধিবিধান, রীতিনীতি ও প্রথা-পদ্ধতি ঈশ্বর কর্তৃক ধর্মপ্রবর্তকদের কাছে মানুষের জন্য অলৌকিক উপায়ে প্রদত্ত। ঈশ্বর সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও ঈশ্বর-সম্পর্কিত উপলব্ধিতে তারতম্য আছে। আবার নিরীশ্বর ধর্মও আছে, যেমন বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম। তবে এগুলোতেও প্রচুর অলৌকিক বিষয় আছে। বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা দিয়ে কোনো অলৌকিক বিষয় প্রমাণ করা যায় না। নীতি ও আইনের উৎস ধর্ম বা ঈশ্বর - বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে এ-ধারণা প্রচলিত আছে। তবে পূর্বধারণামুক্ত, তথ্যভিত্তিক, বাস্তবসম্মত চিন্তা এবং নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস প্রমাণ করে যে, নৈতিক চেতনাই ধর্মের উৎস, ধর্ম নৈতিক চেতনার উৎস নয়। নীতি ও আইনের উৎসও নৈতিক চেতনা। তবে ধর্মে নীতি আছে, জীবনযাত্রা-প্রণালি নির্দেশিত আছে। নৈতিক চেতনা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, নিতান্তই মানবিক ব্যাপার - মানুষের মনোদৈহিক ও সামাজিক ব্যাপার। বিশেষ বিশেষ দেশ-কালে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় খুঁজে পাওয়ার আর মুক্তির তাগিদ থেকেই এক-একটি ধর্মের উদ্ভব।
ধর্মবিশ্বাসী ও ধর্মে আস্থাহীন, ঈশ্বরবিশ্বাসী ও নিরীশ্বর - সকল মানুষের মধ্যেই নৈতিক চেতনা আছে। আদিম মানুষের মধ্যেও নৈতিক চেতনা ছিল। আগে উল্লেখ করেছি, মানুষের নৈতিক চেতনা সুস্থ, স্বাভাবিক ও বলিষ্ঠ হতে পারে, আবার রুগ্ণ, দুর্বল ও বিকারপ্রাপ্তও হয়ে যেতে পারে। ধর্মবিশ্বাসীদের নৈতিক চেতনার বেলায়ও তা হতে পারে।
ধর্মে যেসব অলৌকিক ব্যাপার আছে - যেমন দৈবত্ব, অবতারত্ব, নবুয়ত, রিসালাত, ওহি, মিরাজ, দিব্যজ্ঞান, ঈশ্বর, দেবতা, জন্মান্তর, জাতিস্মরতা, নির্বাণ, কিয়ামত, আখেরাত, মৃত্যুপরবর্তী জীবন, বেহেশত, দোজখ, স্বর্গ, নরক, ধর্মগ্রন্থের অপৌরুষেয়তা ইত্যাদি -
সেগুলো বিশ্বাসের ব্যাপার, যুক্তিতর্কের বা প্রমাণের অতীত।
বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ আছে। তবে বিজ্ঞানের আবিষ্কার-উদ্ভাবনকে সব ধর্মের লোকেরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবনযাত্রার ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে সমন্বিত করে নেন। স্বার্থের কারণে বিরোধ জটিল রূপ নেয়।
ধর্মের মানবীয় জাগতিক বাস্তব ব্যাপারসমূহ এবং ধর্মনির্দেশিত জীবনযাত্রা-প্রণালি লক্ষ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় নির্দেশ করা এসবের উদ্দেশ্য। দেশকালের প্রয়োজনেই আত্মপ্রকাশ করেছেন এক-একজন ধর্মপ্রবর্তক। ধর্মপ্রবর্তকের জীবন ও দেশকালের বিবেচনা বাদ দিয়ে কোনো ধর্মকেই বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্মেই শোষিত-নির্জিত-মুক্তিকামী মানুষদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি আছে। মতাদর্শের উদ্ভবের ইতিহাস সন্ধান করতে গেলেও দেখা যায়, অন্যায়-অবিচার, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আনন্দময় সম্প্রীতিময় সমৃদ্ধ সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার তাগিদেই মতাদর্শ উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন মানববাদ, উপযোগবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি। যুগের বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন মহৎ চিন্তাসমূহের সমন্বয়ের পরিচয় আছে প্রত্যেক ধর্মে এবং প্রত্যেক মতাদর্শে।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মের এবং প্রত্যেক মতাদর্শের উদ্ভব ঘটেছে মানুষের, সমাজের, জাতির, রাষ্ট্রব্যবস্থার, সমাজব্যবস্থার দুঃসময়ে বা অন্ধকার যুগে। দুর্দিন অতিক্রম করে সুদিন প্রতিষ্ঠার, অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধ নবযুগ সৃষ্টির পথনির্দেশ ও অঙ্গীকার আছে প্রত্যেক ধর্মে ও প্রত্যেক মতাদর্শে। ধর্ম মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে ধর্ম-কথিত মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের দিকে - স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোজখ, নির্বাণ, মোক্ষ, পরমার্থ ইত্যাদির দিকে। আর মতাদর্শ মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে ভবিষ্যতের কল্পস্বর্গের দিকে কিংবা মানবজাতির জন্য পরিকল্পিত ভবিষ্যতের আদর্শ ব্যবস্থার দিকে। অবশ্য ধর্মের জাগতিক দিক পারলৌকিক দিকের চেয়ে গৌণ নয়।
ধর্মের সঙ্গে মতাদর্শের পার্থক্য যেমন আছে তেমনি মানবীয় ও জাগতিক ব্যাপারাদিতে মিলও আছে। ধর্মের ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক, অপার্থিব ব্যাপারগুলোকে আলাদা করে রেখে ধর্মের সঙ্গে মতাদর্শের তুলনা করলে, দেশ-কাল-ব্যক্তির পার্থক্য ছাড়া অন্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি যুগে বহু মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে, খন্ড খন্ড রূপে ভালো জীবন, সুন্দর জীবন, মহৎ জীবন, এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা ও উন্নত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব ধারণা, আকাঙ্ক্ষা ও অভীপ্সা বিরাজ করে, সেগুলোই একজন ধর্মপ্রবর্তকের কিংবা মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার কিংবা যুগমানবের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে পরিমার্জিত ও সংশ্লেষিত হয়ে সর্বজনীন, সর্বাঙ্গীণ রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়। ধর্মপ্রবর্তকের বা মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার বা যুগমানবের চিন্তাধারা তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে নানাভাবে ব্যাখ্যাত ও সম্প্রসারিত হয়, এবং নানাভাবে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করে বাস্তবায়িত হয়। ধর্মের অন্তর্গত অলৌকিক ধারণাগুলো সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে কোনো কল্যাণকর বা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তবে স্বর্গের লোভে কিংবা নরকের ভয়ে মানুষ হয়তো সভ্যতার পশ্চাৎবর্তী স্তরে কিছু পরিমাণে ধর্মনির্দেশিত উচিত কাজে অগ্রসর হয়েছে এবং অনুচিত কাজ থেকে বিরত থেকেছে। ধর্মের আলৌকিক ব্যাপারগুলোকে আলাদা করে নিলে ধর্ম ও মতাদর্শ সদৃশ। দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ধর্ম ও মতাদর্শ সমাজের ক্ষমতাসীন কায়েমি শক্তির - শোষক-পীড়ক-প্রতারকদের - উৎখাত ঘটিয়ে মুক্তিকামী ও ন্যায়কামী শোষিত-নির্জিত-বঞ্চিত মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রত্যেক ধর্মে এবং প্রত্যেক মতাদর্শেই সমকালীন ও পূর্ববর্তী কালের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার সংশ্লেষণের ভিত্তিতে মানুষের জীবনযাত্রার জন্য নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ণীত ও নির্দেশিত হয়। ধর্মপ্রবর্তকের ও মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার নির্ধারিত নীতি ও বাণীকে অনুসারীরা সাধারণত গ্রহণ করে থাকে সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শ এবং চিরন্তন বা শাশ্বত সত্য রূপে। তারা ভুলে যায় যে, প্রতিটি সাধারণীকরণই (generalization) নির্দিষ্ট অবস্থায় প্রাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যাবলির ভিত্তিতে করা হয়। সেই নির্দিষ্ট অবস্থা চিরকাল বজায় থাকে না, আর জ্ঞান ও তথ্যও এক পর্যায়ে থাকে না - নতুন নতুন ঘটনা ঘটে এবং নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয় - সবকিছুই বিকাশমান। এ অবস্থায় কোনো ধর্মের কিংবা কোনো মতাদর্শের নীতিই চিরকাল উপযোগী কিংবা কার্যকর থাকতে পারে না। নীতির, আদর্শের, ধর্মের এই আপেক্ষিক ভূমিকার কথা ভুলে গিয়ে যাঁরা এগুলোকে চিরন্তন বলে অাঁকড়ে ধরে থাকে, বাংলার লৌকিক ইসলামের পরিভাষায় তাঁদেরকে বলা হয় কাঠমোল্লা। ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যেমন, মতবাদের অনুসারীদের মধ্যেও তেমনি, কাঠমোল্লার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কোনো ধর্মের বা মতাদর্শের অগ্রগতির ধারায় যখন এই কাঠমোল্লাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অচিরেই সেই ধর্ম বা মতাদর্শ কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণের কারণ হয়। আর ধর্ম বা আদর্শের নামে সুবিধাবাদীরা কর্তৃত্ব দখল করলেও সর্বজনীন কল্যাণের লক্ষ বানচাল হয়ে যায়।
কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ যখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং তার অনুসারীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন এমন লোকেরাও স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে সেই ধর্মের বা মতাদর্শের অনুসারীদের সঙ্গে ভিড়ে যায় যারা সেই ধর্মে বা মতাদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে না। এই ধরনের স্বার্থবাদীরা ক্রমে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা করে। এরা যখন নেতৃত্ব দখল করে নেয়, তখন সেই ধর্ম বা মতাদর্শ আর মুক্তিকামী জনগণের অধিকারে থাকে না, তখন তা চলে যায় কায়েমি স্বার্থবাদী শাসক-শোষক-বঞ্চক-প্রতারকদের দখলে। মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে প্রচার চালালেই কিংবা ন্যায়নীতির কথা বললেই মুক্তির পক্ষে কিংবা ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা হয় না। সম্পূর্ণ দুরভিসন্ধিমূলকভাবেও ন্যায়, ধর্ম ও মতাদর্শের কথা প্রচারিত হতে দেখা যায়। এজন্যই নৈতিক সমস্যা এত জটিল।
কোনো মতাদর্শের চরিত্রকে বোঝার ক্ষেত্রে সেই মতাদর্শ নিয়ে কারা দাঁড়াচ্ছেন, নেতৃত্বের চরিত্র কেমন - সে-ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা শোষণ ও প্রতারণার কাজেও যুগে যুগে ধর্ম ও মতাদর্শ ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পিরপ্রথার যে-নবযুগ দেখা দিয়েছে, এবং রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে কোনো কোনো মহল থেকে যেভাবে ধর্মীয় বিষয়াদি প্রচার করা হচ্ছে, তার মর্মে ধর্ম অল্পই আছে; মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে শোষণ-পীড়ন-প্রতারণার ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেই এসব আয়োজন ।
ধর্মের এবং মতাদর্শের কল্যাণকর সম্ভাবনার সঙ্গেই কিন্তু অনিবার্যভাবে কাঠমোল্লাতন্ত্রের ও সুবিধাবাদের বিপদ অন্তর্নিহিত থাকে। আসলে মানুষের নৈতিক বৈশিষ্ট্যের এবং সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই এই বৈপরীত্যের ও সমস্যার উৎস নিহিত। মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ নৈতিক সত্তা জটিলতায় পূর্ণ। যৌথ জীবনের ঘটনাবলিকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে চান, যাঁরা প্রবলভাবে আকাঙ্ক্ষী, তাঁদের নৈতিক চেতনা অত্যন্ত জটিল। এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান ভাবা যায় না। তবে মানুষ বুদ্ধির ব্যবহারে যত যত্নবান হবে, অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হয়ে চিন্তা করতে যত অভ্যস্ত হবে, জনসাধারণের চেতনার মান যত উন্নত হবে - সর্বোপরি বিবেক যত শক্তিশালী হবে এবং নৈতিক দিক দিয়ে মানুষ যত উৎকর্ষ অর্জন করবে, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা হয়তো ততই জটিলতামুক্ত হবে। তবে অপশক্তির সঙ্গে শুভশক্তির বিরোধ কখনো শেষ হবে বলে মনে হয় না। এক অপশক্তির বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন আর এক অপশক্তি দেখা দেয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।
প্রত্যেক ধর্মের এবং প্রত্যেক আদর্শেরই উদ্ভব আছে, বিকাশ আছে, পরিণতি আছে। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যেক ধর্মের ভূমিকাও পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, এক ধর্মকে উৎখাত করে নতুন আর এক ধর্ম প্রচারিত হয়েছে, এক মতাদর্শের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে নতুন আর এক মতাদর্শ। ধর্ম ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে দেখা যায় - কাঠমোল্লাতন্ত্রের, সুবিধাবাদের ও প্রতারণার সমস্যা অতিক্রম করে কোনো ধর্মই, কোনো মতাদর্শই প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে উপলব্ধি করে নিজেকে বিকাশশীল রেখে স্থায়িত্বের উপায় করতে পারেনি। এই সমস্যারও উৎস মানুষের স্বভাবের ও তার সামাজিক পরিবেশের জটিলতার মধ্যে নিহিত। তবে মনে রাখতে হবে - মানবস্বভাব পরিবর্তনীয়, সীমাহীনরূপে শোধনীয়, আর মানুষ তার পরিবেশকেও ভেঙে নতুন করে গড়তে পারে। কাজেই যত সময়সাপেক্ষই হোক, এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আছে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ আছে। তবে বিজ্ঞানের আবিষ্কার-উদ্ভাবনকে সব ধর্মের লোকেরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবনযাত্রার ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে সমন্বিত করে নেন। স্বার্থের কারণে বিরোধ জটিল রূপ নেয়।
ধর্মের মানবীয় জাগতিক বাস্তব ব্যাপারসমূহ এবং ধর্মনির্দেশিত জীবনযাত্রা-প্রণালি লক্ষ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় নির্দেশ করা এসবের উদ্দেশ্য। দেশকালের প্রয়োজনেই আত্মপ্রকাশ করেছেন এক-একজন ধর্মপ্রবর্তক। ধর্মপ্রবর্তকের জীবন ও দেশকালের বিবেচনা বাদ দিয়ে কোনো ধর্মকেই বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্মেই শোষিত-নির্জিত-মুক্তিকামী মানুষদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি আছে। মতাদর্শের উদ্ভবের ইতিহাস সন্ধান করতে গেলেও দেখা যায়, অন্যায়-অবিচার, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আনন্দময় সম্প্রীতিময় সমৃদ্ধ সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার তাগিদেই মতাদর্শ উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন মানববাদ, উপযোগবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি। যুগের বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন মহৎ চিন্তাসমূহের সমন্বয়ের পরিচয় আছে প্রত্যেক ধর্মে এবং প্রত্যেক মতাদর্শে।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মের এবং প্রত্যেক মতাদর্শের উদ্ভব ঘটেছে মানুষের, সমাজের, জাতির, রাষ্ট্রব্যবস্থার, সমাজব্যবস্থার দুঃসময়ে বা অন্ধকার যুগে। দুর্দিন অতিক্রম করে সুদিন প্রতিষ্ঠার, অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধ নবযুগ সৃষ্টির পথনির্দেশ ও অঙ্গীকার আছে প্রত্যেক ধর্মে ও প্রত্যেক মতাদর্শে। ধর্ম মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে ধর্ম-কথিত মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের দিকে - স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোজখ, নির্বাণ, মোক্ষ, পরমার্থ ইত্যাদির দিকে। আর মতাদর্শ মানুষকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছে ভবিষ্যতের কল্পস্বর্গের দিকে কিংবা মানবজাতির জন্য পরিকল্পিত ভবিষ্যতের আদর্শ ব্যবস্থার দিকে। অবশ্য ধর্মের জাগতিক দিক পারলৌকিক দিকের চেয়ে গৌণ নয়।
ধর্মের সঙ্গে মতাদর্শের পার্থক্য যেমন আছে তেমনি মানবীয় ও জাগতিক ব্যাপারাদিতে মিলও আছে। ধর্মের ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত অলৌকিক, অপার্থিব ব্যাপারগুলোকে আলাদা করে রেখে ধর্মের সঙ্গে মতাদর্শের তুলনা করলে, দেশ-কাল-ব্যক্তির পার্থক্য ছাড়া অন্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি যুগে বহু মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে, খন্ড খন্ড রূপে ভালো জীবন, সুন্দর জীবন, মহৎ জীবন, এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা ও উন্নত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব ধারণা, আকাঙ্ক্ষা ও অভীপ্সা বিরাজ করে, সেগুলোই একজন ধর্মপ্রবর্তকের কিংবা মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার কিংবা যুগমানবের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে পরিমার্জিত ও সংশ্লেষিত হয়ে সর্বজনীন, সর্বাঙ্গীণ রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়। ধর্মপ্রবর্তকের বা মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার বা যুগমানবের চিন্তাধারা তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে নানাভাবে ব্যাখ্যাত ও সম্প্রসারিত হয়, এবং নানাভাবে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করে বাস্তবায়িত হয়। ধর্মের অন্তর্গত অলৌকিক ধারণাগুলো সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে কোনো কল্যাণকর বা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তবে স্বর্গের লোভে কিংবা নরকের ভয়ে মানুষ হয়তো সভ্যতার পশ্চাৎবর্তী স্তরে কিছু পরিমাণে ধর্মনির্দেশিত উচিত কাজে অগ্রসর হয়েছে এবং অনুচিত কাজ থেকে বিরত থেকেছে। ধর্মের আলৌকিক ব্যাপারগুলোকে আলাদা করে নিলে ধর্ম ও মতাদর্শ সদৃশ। দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ধর্ম ও মতাদর্শ সমাজের ক্ষমতাসীন কায়েমি শক্তির - শোষক-পীড়ক-প্রতারকদের - উৎখাত ঘটিয়ে মুক্তিকামী ও ন্যায়কামী শোষিত-নির্জিত-বঞ্চিত মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রত্যেক ধর্মে এবং প্রত্যেক মতাদর্শেই সমকালীন ও পূর্ববর্তী কালের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার সংশ্লেষণের ভিত্তিতে মানুষের জীবনযাত্রার জন্য নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ণীত ও নির্দেশিত হয়। ধর্মপ্রবর্তকের ও মতবাদ-প্রতিষ্ঠাতার নির্ধারিত নীতি ও বাণীকে অনুসারীরা সাধারণত গ্রহণ করে থাকে সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শ এবং চিরন্তন বা শাশ্বত সত্য রূপে। তারা ভুলে যায় যে, প্রতিটি সাধারণীকরণই (generalization) নির্দিষ্ট অবস্থায় প্রাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যাবলির ভিত্তিতে করা হয়। সেই নির্দিষ্ট অবস্থা চিরকাল বজায় থাকে না, আর জ্ঞান ও তথ্যও এক পর্যায়ে থাকে না - নতুন নতুন ঘটনা ঘটে এবং নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয় - সবকিছুই বিকাশমান। এ অবস্থায় কোনো ধর্মের কিংবা কোনো মতাদর্শের নীতিই চিরকাল উপযোগী কিংবা কার্যকর থাকতে পারে না। নীতির, আদর্শের, ধর্মের এই আপেক্ষিক ভূমিকার কথা ভুলে গিয়ে যাঁরা এগুলোকে চিরন্তন বলে অাঁকড়ে ধরে থাকে, বাংলার লৌকিক ইসলামের পরিভাষায় তাঁদেরকে বলা হয় কাঠমোল্লা। ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যেমন, মতবাদের অনুসারীদের মধ্যেও তেমনি, কাঠমোল্লার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কোনো ধর্মের বা মতাদর্শের অগ্রগতির ধারায় যখন এই কাঠমোল্লাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অচিরেই সেই ধর্ম বা মতাদর্শ কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণের কারণ হয়। আর ধর্ম বা আদর্শের নামে সুবিধাবাদীরা কর্তৃত্ব দখল করলেও সর্বজনীন কল্যাণের লক্ষ বানচাল হয়ে যায়।
কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ যখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং তার অনুসারীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন এমন লোকেরাও স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে সেই ধর্মের বা মতাদর্শের অনুসারীদের সঙ্গে ভিড়ে যায় যারা সেই ধর্মে বা মতাদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে না। এই ধরনের স্বার্থবাদীরা ক্রমে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা করে। এরা যখন নেতৃত্ব দখল করে নেয়, তখন সেই ধর্ম বা মতাদর্শ আর মুক্তিকামী জনগণের অধিকারে থাকে না, তখন তা চলে যায় কায়েমি স্বার্থবাদী শাসক-শোষক-বঞ্চক-প্রতারকদের দখলে। মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে প্রচার চালালেই কিংবা ন্যায়নীতির কথা বললেই মুক্তির পক্ষে কিংবা ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা হয় না। সম্পূর্ণ দুরভিসন্ধিমূলকভাবেও ন্যায়, ধর্ম ও মতাদর্শের কথা প্রচারিত হতে দেখা যায়। এজন্যই নৈতিক সমস্যা এত জটিল।
কোনো মতাদর্শের চরিত্রকে বোঝার ক্ষেত্রে সেই মতাদর্শ নিয়ে কারা দাঁড়াচ্ছেন, নেতৃত্বের চরিত্র কেমন - সে-ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা শোষণ ও প্রতারণার কাজেও যুগে যুগে ধর্ম ও মতাদর্শ ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পিরপ্রথার যে-নবযুগ দেখা দিয়েছে, এবং রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে কোনো কোনো মহল থেকে যেভাবে ধর্মীয় বিষয়াদি প্রচার করা হচ্ছে, তার মর্মে ধর্ম অল্পই আছে; মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে শোষণ-পীড়ন-প্রতারণার ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেই এসব আয়োজন ।
ধর্মের এবং মতাদর্শের কল্যাণকর সম্ভাবনার সঙ্গেই কিন্তু অনিবার্যভাবে কাঠমোল্লাতন্ত্রের ও সুবিধাবাদের বিপদ অন্তর্নিহিত থাকে। আসলে মানুষের নৈতিক বৈশিষ্ট্যের এবং সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই এই বৈপরীত্যের ও সমস্যার উৎস নিহিত। মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ নৈতিক সত্তা জটিলতায় পূর্ণ। যৌথ জীবনের ঘটনাবলিকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে চান, যাঁরা প্রবলভাবে আকাঙ্ক্ষী, তাঁদের নৈতিক চেতনা অত্যন্ত জটিল। এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান ভাবা যায় না। তবে মানুষ বুদ্ধির ব্যবহারে যত যত্নবান হবে, অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হয়ে চিন্তা করতে যত অভ্যস্ত হবে, জনসাধারণের চেতনার মান যত উন্নত হবে - সর্বোপরি বিবেক যত শক্তিশালী হবে এবং নৈতিক দিক দিয়ে মানুষ যত উৎকর্ষ অর্জন করবে, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা হয়তো ততই জটিলতামুক্ত হবে। তবে অপশক্তির সঙ্গে শুভশক্তির বিরোধ কখনো শেষ হবে বলে মনে হয় না। এক অপশক্তির বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন আর এক অপশক্তি দেখা দেয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।
প্রত্যেক ধর্মের এবং প্রত্যেক আদর্শেরই উদ্ভব আছে, বিকাশ আছে, পরিণতি আছে। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যেক ধর্মের ভূমিকাও পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, এক ধর্মকে উৎখাত করে নতুন আর এক ধর্ম প্রচারিত হয়েছে, এক মতাদর্শের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে নতুন আর এক মতাদর্শ। ধর্ম ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে দেখা যায় - কাঠমোল্লাতন্ত্রের, সুবিধাবাদের ও প্রতারণার সমস্যা অতিক্রম করে কোনো ধর্মই, কোনো মতাদর্শই প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে উপলব্ধি করে নিজেকে বিকাশশীল রেখে স্থায়িত্বের উপায় করতে পারেনি। এই সমস্যারও উৎস মানুষের স্বভাবের ও তার সামাজিক পরিবেশের জটিলতার মধ্যে নিহিত। তবে মনে রাখতে হবে - মানবস্বভাব পরিবর্তনীয়, সীমাহীনরূপে শোধনীয়, আর মানুষ তার পরিবেশকেও ভেঙে নতুন করে গড়তে পারে। কাজেই যত সময়সাপেক্ষই হোক, এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আছে।
সাত.
আদর্শের
দিন কি শেষ হয়ে গেছে?
ইউরোপের রেনেসাঁসের ও শিল্পবিপ্লবের পটভূমিতে উনিশ শতকে উদ্ভূত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মতাদর্শ মার্কসবাদ বিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই ইতিহাসের বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে গণতন্ত্রকেও পরিণত করা হয়েছে জনগণের কাছে আবেদনহীন এক মতাদর্শে। মতাদর্শগত দিক দিয়ে পৃথিবী এখন এক শূন্যতার কাল অতিক্রম করছে। এই শূন্যতার মধ্যে ধর্মের পুনরুজ্জীবন লক্ষ করা যাচ্ছে।
কল্পনা ও আদর্শ ছাড়াই কি মানুষ চলবে? মানবজাতি চলবে? মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের প্রবক্তারা আদর্শের প্রয়োজন অস্বীকার করেন। নানা কৌশলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁরা ধর্মের পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করছেন। সমাজের নিচের স্তরের ৯৫ ভাগ মানুষ কি আদর্শ ছাড়া চলতে পারবে? দুর্বল নির্জিত গরিব মানুষদের আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের জন্য দরকার আদর্শ, নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। অতীতের বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের এবং আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংশ্লেষণের ভিত্তিতে অবশ্যই জনগণের জন্য গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎ নবযুগের নতুন আদর্শ। আদর্শগত দিক দিয়ে এখন আমরা অতিক্রম করছি একটি সন্ধিৎসার ও নবনির্মাণের কাল। গোটা মানবজাতির জন্যই সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে এই কালটা সংকটকাল।
অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানবীয় কর্মকান্ড এখন এতটাই বিশ্ববিস্তৃত হয়ে পড়েছে যে, বিশ্বসরকার গঠনের প্রয়োজন দ্রুত অনিবার্য হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ এখনকার চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া জাতিসংঘ এখন বহুলাংশে ব্যবহৃত হয়েছে আধিপত্যবাদী, নয়া-উপনিবেশবাদী বৃহৎ শক্তিগুলোর হীনস্বার্থে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের সংঘে। কার্যক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকই এখন বিশ্বসরকারের ভূমিকা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, এবং এর কর্তৃত্বে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ গোটা পৃথিবীতে একচ্ছত্র অধিপতির অবস্থান নিয়ে আছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ক্রমেই তাদের রাষ্ট্রীয় সত্তা হারিয়ে চলছে। এই অবস্থা মোকাবিলার জন্য দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নৈতিক শক্তির জাগরণ, নৈতিক প্রশ্নাবলির পর্যাপ্ত বিবেচনা এবং গোষ্ঠীগত, দলীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ব্যাপারে পর্যাপ্ত নৈতিক সচেতনতা এবং কাজের মধ্য দিয়ে নৈতিক অনুশীলন দরকার। এই সচেতনতা ও অনুশীলন সাম্রাজ্যবাদী-বিশ্বায়নবাদী ধনিক-বণিকদের চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম থেকে ভিন্ন হবে।
পশ্চিমা উন্নতিশীল সমাজের সমস্যার সঙ্গে এশিয়া-আমেরিকার অবক্ষয়ক্লিষ্ট সমাজের সমস্যার গুণগত পার্থক্য আছে। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে নৈতিক উত্থানের আন্দোলনের বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণমূলক ও বিচারমূলক দৃষ্টিতে দেখলে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, উন্নতিশীল জাতিসমূহের নৈতিক চেতনা ও নৈতিক পরিস্থিতি তাদের নিজেদের জন্য তুলনামূলকভাবে উন্নত। অবক্ষয়ক্লিষ্ট সমাজের দুর্নীতির সমস্যা সমাধানের জন্য নৈতিক জাগরণ ও রাষ্ট্রীয় আইনকানুন উন্নত করার প্রয়োজন সর্বাধিক। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা উন্নত না করে কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারকার্য ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দ্বারা অবস্থার উন্নতি করা যায় না। আইনের দ্বারা ন্যায় বাড়াতে হবে, অন্যায় কমাতে হবে।
অনেকের ধারণা আছে যে, যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত, দরিদ্র, দুর্বল, তারা উন্নততর নৈতিক চেতনার অধিকারী। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ধনী, দরিদ্র, হিন্দু, মুসলমান, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, এশীয়, ইউরোপীয়, সাদা, কালো নির্বিশেষে সকলেরই নৈতিক চেতনাকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে হয় সজ্ঞান, সচেতন, সতর্ক, কষ্টসাধ্য অনুশীলনের মধ্য দিয়ে, বহু জটিল সমস্যার মোকাবিলা করে, প্রতিদিনের সকল কাজের মধ্য দিয়ে। যেমন ব্যক্তিগত অনুশীলন তেমনি সম্মিলিত অনুশীলন দরকার হয়। আগে উল্লেখ করেছি, নৈতিক অনুশীলনের কর্মনিরপেক্ষ কোনো উপায় নেই। শোষিত-বঞ্চিত-নির্জিত মুক্তিকামী মানুষ যদি দীর্ঘস্থায়ী ও স্থায়ী বিজয় অর্জন করতে চায়, তাহলে সকল কাজের মধ্যে নৈতিক অনুশীলন তাদের জন্য অপরিহার্য। শক্তিশালী হওয়ার জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। দুর্বল থাকলে কেবল মার খেতে হয়। ঐক্যের বন্ধনসূত্র হলো আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচি। নীতি ও কর্মসূচি ছাড়া ঐক্য হলেও সে ঐক্য টেকে না।
বাংলাদেশে আজ রাজনৈতিক দলসমূহের এবং বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন গ্রুপের অভ্যন্তরে নৈতিক চেতনা একেবারেই বিকৃত ও বিপর্যস্ত। ব্যতিক্রম আছে - আমি ব্যতিক্রমের কথা বলছি না, বলছি সাধারণ অবস্থাটার কথা। কায়েমি স্বার্থবাদী এবং নয়া-উপনিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের অনুসারীরা জনসাধারণের, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের, বুদ্ধিজীবীদের এবং তরুণ-সমাজের নৈতিক জাগরণকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এজন্য তারা এমন সব ব্যবস্থা করে রাখে যাতে সকলেই দুর্নীতিতে ডুবে থাকতে বাধ্য হয়, আর অদৃষ্টবাদ জনমনের প্রধান প্রবণতা রূপে বিরাজ করে। অদৃষ্টবাদকে জোরদার করার জন্য বাইরের আধিপত্যবাদী শক্তির মদদে আর দেশের শাসক শ্রেণির সুচতুর ভূমিকার কারণে দেশজুড়ে - গ্রামে-শহরে এখানে-সেখানে - গড়ে তোলা হয়েছে অজস্র কেন্দ্র। প্রচারমাধ্যমসমূহের ভূমিকাও অদৃষ্টবাদ-সৃষ্টির অনুকূল। তা ছাড়া সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে জাতীয় হীনতাবোধ। অদৃষ্টবাদ ও হীনতাবোধের বাস্তবতাকে অতিক্রম করার জন্য দরকার জনসাধারণের নৈতিক চেতনার মহৎ জাগরণ, শক্তিশালী নৈতিক আন্দোলন ও সংঘবদ্ধ নৈতিক অনুশীলন। বলা বাহুল্য নৈতিক আন্দোলন ও নৈতিক অনুশীলনকে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হবে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতির কর্মকান্ডের সঙ্গে। অরাজনৈতিক আয়োজন দিয়ে সুফল অল্পই হয়।
নৈতিক চেতনার সঙ্গে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার সম্পর্ক আছে। নৈতিক দিক দিয়ে জনসাধারণকে বিপর্যস্ত রাখতে পারলে জনগণ প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে, সমাজে হীনস্বার্থবাদীদের অনুচিত স্বার্থ নিশ্চিত হয়। তাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সম্পদ অল্পকিছু লোকের মালিকানায় রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু তাতে সমাজে ধনবৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে। আর প্রভুত্ববাদী বা কর্তৃত্ববাদীদের কদর্য প্রভুত্বলিপ্সা বা কর্তৃত্বলিপ্সা সফল হয়। বাংলাদেশে জনমনে আজ এই ধারণা বদ্ধমূল করে রাখা হয়েছে যে, দুর্নীতি অবলম্বন ছাড়া ধনী হওয়া - এমনকি সচ্ছল-জীবনযাত্রা-উপযোগী অর্থসম্পদ অর্জন অসম্ভব। বাস্তবে, এই মনোভাবের কারণে, দুর্নীতির পন্থা অবলম্বন করে ধনসম্পদ অর্জনের ক্রিয়াকলাপ বৈধতা না পেলেও, একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও দুর্নীতি দমন কমিশন দিয়ে দুর্নীতি ও অপব্যবস্থার প্রতিকার সামান্যই হয়। দুর্নীতি নিয়ে প্রতিকারহীন অতিপ্রচার জাতীয় হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে জাতীয় হীনমন্যতাবোধ সমগ্র জাতিকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মানুষের নৈতিক চেতনা ও মানবচরিত্রের জটিলতা সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও দুর্নীতি দমন কমিশনের লোকদের সম্পূর্ণ অনুৎসাহী ও অজ্ঞ মনে হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন