যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন এর ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গ
:
( লেখক ; বী
রে ন্দ্র না থ অ ধি কা রী )
রবীন্দ্রনাথ
এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলো বিভিন্ন সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্, দ্য মডার্ন রিভিউ, দ্য আমেরিকান হিব্রু, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এশিয়া সাময়িকী, কলকাতার বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত
হয়। তবে সেগুলো ছিল অসম্পূর্ণ এবং সেসবের বেশ কিছুতেই আইনস্টাইনের আপত্তি ছিল।
সর্বশেষ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য কী রিভিউ’ নামক একটি প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথ এবং
আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলোর বিস্তৃততর সমন্বিত ভাষ্য প্রকাশ করে। এটি মূলত বাংলা
ভাষার অন্যতম বিখ্যাত কবি ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী এবং
জার্মানীর বিখ্যাত সাংবাদিক ও আইনস্টাইনের সৎ-কন্যা মার্গোর স্বামী দিমিত্রি
মারিয়ানফ্-এর সমন্বিত নোট এবং শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত আর্কাইভসের
উপর ভিত্তি করে গ্রন্থিত হয়।
প্রকাশিত এই গ্রন্থনায় ৩৩ বার রবীন্দ্রনাথের এবং ৩১ বার আইনস্টাইনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবে তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত সুক্ষ্ম কৌতুকসহ যে-মতবিনিময় হয়, তা বিশ্বইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈরথ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বলে বিবেচিত। সমন্বিত প্রকাশনার বাংলা তর্জমা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো।
প্রকাশিত এই গ্রন্থনায় ৩৩ বার রবীন্দ্রনাথের এবং ৩১ বার আইনস্টাইনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবে তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত সুক্ষ্ম কৌতুকসহ যে-মতবিনিময় হয়, তা বিশ্বইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈরথ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বলে বিবেচিত। সমন্বিত প্রকাশনার বাংলা তর্জমা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো।
বিংশ শতাব্দীর যুগসন্ধিক্ষণের দুই যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন। এই মহাপণ্ডিতদ্বয়ের লেখালেখি, গবেষণা, আবিস্কার এবং সৃষ্টিকর্ম বিশ্বকে যতটা আলোড়িত এবং আলোকিত করেছে, বা এখনো করে চলছে, অন্য কোনও কিছু কবে নাগাদ সেসবের অনুরণন ছাপিয়ে যাবে তা কেবল ভবিতব্যই বলে দিতে পারবে। তাই মহাপণ্ডিততো বটেই, তারও চেয়ে অধিক কোনও বিশেষণে আধুনিক এই যুগাবতারদ্বয়কে বিশেষায়িত করাও যথেষ্ট নয় বলে মনে হয়।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে একটা আত্মিক টান ছিল, যোগাযোগ বা সাক্ষাতের দুর্নিবার আক্ঙ্খা ছিল। সে কারণেই বয়সে অঠার বছরের ছোট-বড় দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, তাঁদের মধ্যে পত্র বিনিময় হয় বহুবার এবং সাক্ষাৎ ঘটে চারবার। রবীন্দ্রনাথকে জার্মান ভাষায় স্বহস্তে লেখা আইনস্টাইনের দু’টি চিঠি শান্তি-নিকেতনের রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার জার্মানীতে গেলেও সেবার আইনস্টাইনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কবিগুরুর দ্বিতীয়বার জার্মানী সফরের সময় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনকের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। মূলত এদিন সকালে রবীন্দ্রনাথের সম্মানে জার্মান সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বেকার এক চা-চক্রের আয়োজন করেন। আমন্ত্রিত অন্যান্য বিশিষ্টজনদের মধ্যে ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ছাড়াও জার্মানীর অনেক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। একই দিন বিকেলে ক্যাপুথে অবস্থিত নিজস্ব বাসভবন 'আইনস্টাইন ভিলায়' রবীন্দ্রনাথকে চা-চক্রে আপ্যায়িত করেন আইনস্টাইন। সেই সময়টাতে এই দুই মনীষী বিশ্বজোড়া খ্যাতির তুঙ্গে। কারণ, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বরীন্দ্রনাথ সাহিত্যে এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাই এই দুই মহারথীর সাক্ষাত নিয়ে দেশ-বিদেশে জনকৌতুহল থাকা সত্ত্বেও প্রথমবার সাক্ষাতে তাঁদের মধ্যে যে-কথাবার্তা হয়, তার অংশবিশেষ চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ফের জার্মানী সফরে গেলে ঐ বছর ১৪ জুলাই আইনস্টাইনের বাসভবনে তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ ঘটে। আইনস্টাইন তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং কাইজার ভিলহেলম ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বিশ্বকবি এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর মধ্যে সেদিন দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ইহুদী ও ফিলিস্তিনী সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তাঁদের মধ্যে চতুর্থ এবং শেষবার দেখা হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। সেবার রবীন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্কে এক চিত্রশিল্পীর বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন এবং আইনস্টাইন সেই বাসায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন।
রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলো বিভিন্ন সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্, দ্য মডার্ন রিভিউ, দ্য আমেরিকান হিব্রু, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এশিয়া সাময়িকী, কলকাতার বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে সেগুলো ছিল অসম্পূর্ণ এবং সেসবের বেশ কিছুতেই আইনস্টাইনের আপত্তি ছিল। সর্বশেষ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য কী রিভিউ’ নামক একটি প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলোর বিস্তৃততর সমন্বিত ভাষ্য প্রকাশ করে। এটি মূলত বাংলা ভাষার অন্যতম বিখ্যাত কবি ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী এবং জার্মানীর বিখ্যাত সাংবাদিক ও আইনস্টাইনের সৎ-কন্যা মার্গোর স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ্-এর সমন্বিত নোট এবং শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত আর্কাইভসের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থিত হয়।
প্রকাশিত এই গ্রন্থনায় ৩৩ বার রবীন্দ্রনাথের এবং ৩১ বার আইনস্টাইনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবে তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত সুক্ষ্ম কৌতুকসহ যে-মতবিনিময় হয়, তা বিশ্বইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈরথ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বলে বিবেচিত। সমন্বিত প্রকাশনার বাংলা তর্জমা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো।
রবীন্দ্রনাথ: আপনি অঙ্কশাস্ত্রের দুটো প্রাচীন সত্তা, স্থান এবং কাল-এর অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। আর আমি এদেশে পরমপুরুষের অনন্ত-শাশ্বত বিশ্ব-সত্যের জগৎ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘুরছি।
আইনস্টাইন: আপনি ঐশী শক্তিকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিশ্বাস করেন?
রবীন্দ্রনাথ: বিচ্ছিন্ন করে নয়। মানুষের অনন্ত ব্যক্তিসত্তা বিশ্বপ্রকৃতিকে অনুধাবন করে। এমন কিছুই নেই যা মানবসত্তা বুঝতে অপারগ হয়, এবং এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বজগতের সত্য মানবসত্তার সত্য।
আইনস্টাইন: মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্বন্ধে দুটো ধারণা রয়েছে− বিশ্বসত্তার ঐক্য মানবিকতার উপর নির্ভরশীল, এবং বিশ্বসত্তার বাস্তবতা মানবিক কার্যকারণের উপর স্বনির্ভর।
রবীন্দ্রনাথ: যখন আমাদের বিশ্বজগৎ মানুষের সাথে সুসমন্বিত হয়, তখন সেটা হয় শাশ্বত, তখন তাকে আমরা সত্য বলে জানি, তাকে সুন্দর হিসেবে অনুভব করি।
আইনস্টাইন: এটা বিশ্বজগতের সম্পর্কে পুরোপুরি মানবিক ধারণা।
রবীন্দ্রনাথ: এই জগৎ হচ্ছে মানবিক জগৎ, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরও জগৎ। অতএব আমাদের কাছ থেকে জগৎকে সরিয়ে রাখলে জগতের অস্তিত্ব থাকে না; এটা একটা আপেক্ষিক জগৎ এবং এর বাস্তবতা আমাদের চৈতন্যনির্ভর। কিছু আদর্শিক কারণ এবং আনন্দ আমাদের কাছে সত্যকে উপস্থাপিত করে। আদর্শ শাশ্বত মানুষ সেই, যার অভিজ্ঞতা সম্ভবপর হয়ে উঠে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
আইনস্টাইন: এটি মানবসত্তার উপলব্ধি।
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, এটি একটি অনন্তসত্তা। এটাকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আমাদের আবেগ এবং কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। আমরা উপলব্ধি করি এমন পরমপুরুষকে, আমাদের সীমাবদ্ধতার বিচারে যার কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। ব্যক্তির কাছে যা সীমাবদ্ধ নয়, বিজ্ঞান বিষয় সেটাই। এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্যের বিশ্বজগৎ। ধর্ম এসকল সত্যকে বাস্তবায়িত করে এবং আমাদের গভীরতর প্রয়োজনসমূহের সাথে সংযোগ ঘটায়। আমাদের ব্যক্তিগত সত্যের সজ্ঞানতা বিশ্বজনীন মূল্য লাভ করে। ধর্ম সত্যের মূল্যকে প্রয়োগ করে এবং আমরা এর সাথে নিজেদের মিলটাকে সুসমন্বিত করে সত্যকে মঙ্গলময় হিসেবে জানতে পারি।
আইনস্টাইন: সত্য, তারপর, বা সৌন্দর্য, এগুলো কি স্বনির্ভর মানুষের জন্য নয়?
রবীন্দ্রনাথ: না, আমি তা বলছি না।
আইনস্টাইন: যদি মানুষজাতির কেউ না থাকতো, তাহলে কি বেলভিডিয়ারের অ্যাপোলো সুন্দর বিবেচিত হতো না?
রবীন্দ্রনাথ: না।
আইনস্টাইন: সৌন্দর্যবোধের এই ধারণা সম্পর্কে আমি আপনার সাথে একমত, কিন্তু সত্য সম্পর্কে একমত নই।
রবীন্দ্রনাথ: কেন নয়? সত্য তো মানুষের মধ্যে উপলব্ধির যোগ্য হয়ে উঠে।
আইনস্টাইন: আমার ধারণা যে ঠিক, সে বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না। কিন্তু এটাই আমার ধর্মবিশ্বাস। আমরা তা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থাপন করি− আমাদের ভ্রান্তি এবং অন্ধ অনুকরণসমূহের দ্বারা, সৃষ্ট অভিজ্ঞতার দ্বারা, আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা।
রবীন্দ্রনাথ: সৌন্দর্য হলো যথার্থ সমন্বয়ের আদর্শ, যা বিশ্বচরাচরে বিদ্যামান। সত্য হলো বিশ্বসত্তার মননশীলতার যথার্থ উপলব্ধি। এ ছাড়া আমরা কি ভাবে সত্যকে চিনতে পারবো?
আইনস্টাইন: আমি প্রমাণ করতে পারবো না। কিন্তু আমি পিথাগোরাসের উপপাদ্যে বিশ্বাসী, যে সত্য মাননবসত্তার নির্ভরতামুক্ত। এটা অবিচ্ছন্ন যুক্তির সমস্যা।
রবীন্দ্রনাথ: সত্য বিশ্বসত্তার সাথে সম্পৃক্ত, অবশ্যই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হবে। অন্যথা আমারা প্রত্যেকে সত্যকে অনুভব করবো। আমরা কোনো তাকে সত্য বলতে পারবো না। অন্তত সত্য বর্ণিত হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে, এবং শুধু যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে পৌঁছাতে পারবো। অন্য কথায় তা হবে মানব তন্ত্রগত ভাবনা। ভারতীয় দর্শন অনুসারে ব্রহ্মই পরমসত্য। একে ব্যক্তিবিশেষের মনের বিচ্ছিন্ন কল্পনা হতে পারে না বা বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু এই সত্য উপলব্ধিতে আসতে পারে অনন্তসত্তার সাথে শুধু ব্যক্তিসত্তার মিলনেই। কিন্তু এই ধরনের সত্য বিজ্ঞানের জগতের নয়। আমরা যে প্রত্যক্ষতা নিয়ে আলোচনা করছি, তা হলো সত্যের প্রকৃতি; যাকে বলা যায়, মানুষের মনে যা সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। যেহেতু এটা মানিবিক। এবং একে মায়া বা বিভ্রম বলা যেতে পারে।
আইনস্টাইন: এটা ব্যক্তিবিশেষের বিভ্রম নয়, এটা মনুষ্য প্রজাতির বিভ্রম।
রবীন্দ্রনাথ: এই প্রজাতির ঐক্য এবং মানবতাকে ধারণ করে। সেই জন্য সমগ্র মানব মননসত্তা সত্যকে উপলব্ধি করে, ভারতীয়-ইউরোপীয় মননসত্তা একই অনন্য উপলব্ধিতে মিলিত হয়।
আইনস্টাইন: প্রজাতি শব্দটি জার্মান ভাষায় সকল মনুষ্যসত্তাকে বুঝায়; সত্যি কথা বলতে কি, বনমানুষ কিংবা ব্যাঙও এর ভিতরে পড়ে। সমস্যা হলো, সত্য সজ্ঞানতার স্বরনির্ভরতা কি না।
রবীন্দ্রনাথ: যাকে আমরা সত্য বলে জানি, তা বাস্তবতার বিষয়ীকেন্দ্রিক এবং বাস্তবভিত্তিক যৌক্তিক সমন্বয়ের মধ্যস্তরে। উভয়ই পরমপুরুষ ধারণ করে।
আইনস্টাইন: আমরা মনোজগতে যা ভাবি, এমনি কি প্রাত্যহিক জীবনে, এর জন্য আমরা দায়ী নই। এর উপর নির্ভর করে মন এর বাইরের বাস্তবতাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যখন বাড়ীতে কেউ নেই, তখনও টেবিলটা যেখানে ছিলো সেখানেই থাকে।
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, এটা ব্যক্তি মনের বাইরে থাকে, কিন্তু সর্বজনীন মনের বাইরে থাকে না। টেবিল হলো কোনো সজ্ঞানতার দ্বারা প্রত্যক্ষ করার বিষয়। যা চেতনায় থাকে।
আইনস্টাইন: কেউ যদি বাড়িতে নাও থাকে, তাহলেও টেবিলটির অস্তিত্ব কিন্তু থাকবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তা আপনার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। এই কারণে টেবিলটা যে আছ ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করতে পারবো না। বিষয়টা আমাদের দেখার উপর নির্ভর করে। মানবতানিরপেক্ষ সত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের স্বাভাবিক বোধ ব্যাখ্যা কিংবা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এই বিশ্বাস কেউ ত্যাগ করতে পারে না, এমন কি আদিবাসীরাও। সত্যকে আমরা পরমপুরুষ মূল্য দিই। অপরিহার্য এই বাস্তবতা যা আমাদের অস্তিত্ব, অভিজ্ঞতা এবং মানস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদিও আমরা পরিষ্কার বলতে পারি না তার অর্থ কী।
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, যদি কোনো সত্য থেকে থাকে যার সঙ্গে মানবিকতার সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন হয়, তবে আমাদের জন্য সেটা হবে সম্পূর্ণই অস্তিত্বহীনতা।
আইনস্টাইন: তা হলে আপনার চেয়ে আমি বেশি ধার্মিক।
রবীন্দ্রনাথ: আমার ধর্ম হচ্ছে পরমপুরুষের সাথে পুনর্মিলনে, সর্বজনীন পরমাত্মায়, আমার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তায়।
আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বারের কথপোকথন প্রকাশিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া নামক সাময়িকীর মার্চ ১৯৩১ সংখ্যায়। নিচে এই কথপোকথনের অনুবাদ তুলে ধরা হলো।
রবীন্দ্রনাথ: আমি আজ ডক্টর মেন্ডেলের সাথে গণিতের নব্য আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, যা বলছে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরমাণুরও কিছু করবার আছে; অস্তিত্বের নাটকীয়তা তার বৈশিষ্ট্যের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত নয়।
আইনস্টাইন: প্রকৃতপক্ষে এসব বিজ্ঞানকে এমনটি ভাবাচ্ছে, যা কার্যকারণবাদ ধারণাকে বাতিল করে না।
রবীন্দ্রনাথ: তা হয়ত করে না, দেখা যাচ্ছে যে, কার্যকারণবাদ উপাদানের মধ্যে নিহিত নয়, কিন্তু অন্য কোনো শক্তি এর মাধ্যমে একটি সুসমন্বিত মহাবিশ্বের সৃষ্টি করে।
আইনস্টাইন: যে কেউ এটা বুঝতে চেষ্টা করছে যে উচ্চতর স্তরে কীভাবে এ ক্রমধারা আছে। ক্রমধারাটি আছে; যেখানে বৃহৎ উপাদান একত্রিত করে এবং অস্তিত্বকে চালিত করে; কিন্তু সূক্ষ্মতর উপাদানে এ ক্রমধারা দৃশ্যমান নয়।
রবীন্দ্রনাথ: এই দ্বৈততা অস্তিত্বের গভীরে বিদ্যমান, মুক্ত আকাঙ্ক্ষা এবং নির্দেশিত ইচ্ছার স্ববিরোধীতা, যা এর উপর কাজ করছে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির উপর আবর্তিত হচ্ছে।
আইনস্টাইন: আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে না যে তারা স্ববিরোধী। মেঘ দূর থেকে এক রকম দেখায়, কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলে বিক্ষিপ্ত জলকণিকা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথ: আমি মানব-মনোবিদ্যায়ও প্রায় একই রকম দেখতে পাই। আমাদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো অনিয়ন্ত্রিত, কিন্তু আমাদের চরিত্র এগুলোকে পরিপূর্ণভাবে আয়ত্বে নিয়ে আসে। বস্তুজগতে কি এমনটি ঘটতে পারে? উপাদানগুলো স্বতন্ত্র আবেগ দ্বারা অসংযত, গতিশীল? এবং বস্তুজগতে এমন কি কোনো নীতি আছে যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে একটি ক্রমনির্দেশিত সংগঠন?
আইনস্টাইন: এমনকি মৌলিক উপাদানগুলোও পরিসাংখ্যিক নিয়মমুক্ত নয়; যেমন রেডিয়মের অনুগুলোও সর্বদা একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলছে এবং চলবে; যেমন করে তারা সর্বদা চলে আসছে। তাহলে অবশ্যই বস্তু উপাদানও নিয়ন্ত্রিত।
রবীন্দ্রনাথ: অন্যথায়, অস্তিত্বের ঘটনাপ্রবাহ উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাবে। এটা হলো সুযোগ ও লক্ষ্য এ দুয়ের একটা ধ্রুব সমন্বয়, যা চির-নতুন এবং সজীব করে রাখে।
আইনস্টাইন: আমি বিশ্বাস করি, যা আমরা করি কিংবা যা অস্তিত্বশীল তার সবকিছুরই কার্যকারণ রয়েছে; এটা ভাল, যদিও আমরা তার সবকিছু আগাগোড়া দেখতে পাই না।
রবীন্দ্রনাথ: মানুষের ক্ষেত্রে নমনীয়তার একটা বিষয় আছে, যার ছোট্ট পরিসরে কিছুটা স্বাধীনতা আছে, যেখানে সে তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে। এটা অনেকটা ভারতীয় সংগীতের মতো, যা পাশ্চাত্য সংগীতের মতো অতটা কঠিন নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। আমাদের সুরকারগণ এর একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা, সুরপদ্ধতি দিয়ে থাকেন এবং এর মধ্যে শিল্পী নিজেও কিছুটা স্বকীয়তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারেন। তাঁকে অবশ্যই সেই সুনির্দিষ্ট সুরের মধ্যে থাকতে হবে এবং এর মধ্যে থেকেই সে গায়কী-আবেগের স্বতস্ফুর্ত প্রকাশ ঘটাতে পারে। আমরা সুর সৃষ্টিতে সুরকারের মননশীলতার প্রশংসা করি, কিন্তু একই সাথে আমরা শিল্পীর কাছে তার গায়কী এবং সংগীতালংকারে নিজস্ব দক্ষতা প্রত্যাশা করি। এই সৃষ্টিতে আমরা অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় সূত্র মেনে চলি, কিন্তু আমরা যদি আমাদের এই দোদুল্যমনতা থেকে মুক্ত করতে না পারি - আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে থেকেও নিজের পরিপূর্ণ প্রকাশে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পাই।
আইনস্টাইন: তা তখনই সম্ভব যখন সঙ্গীতের প্রবল নান্দনিক ঐতিহ্য মানুষের মনকে উজ্জ্বীবিত করে। ইউরোপে সঙ্গীত মানুষের জনপ্রিয় শৈলী এবং গণ-মানুষের আবেগ থেকে অনেক দূরে এসে গেছে এবং তা মূলত স্বীয় প্রথা ও ঐতিহ্য প্রকাশের নিগূঢ় শিল্প হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ: আপনাকে অবশ্যই এ গূঢ় সঙ্গীতের কাছে অনুগত থাকতে হবে। ভারতবর্ষে নিজস্ব সৃজনশীল ব্যক্তিত্বই হলো একজন গায়কের স্বাধীনতার মাপকাঠি। সে একজন সুরকারের গান নিজস্ব ঢংএ গাইতে পারে যদি ঐ নির্দিষ্ট সঙ্গীতের জন্য তার নিজের গায়কীর মধ্যে নির্দিষ্ট সুরের সাধারণ নিয়মাবলী প্রকাশের সৃজনশীল সক্ষমতা থাকে।
আইনস্টাইন: প্রকৃত সঙ্গীতের মাহাত্ম অনুধাবন করার জন্য অত্যন্ত উঁচু দরের শিল্পের প্রয়োজন, যাতে করে কেউ এ ধরনের পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের পরিবর্তনও সুনির্দিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ: আমরা আমাদের আচরণে যদি মহত্মের সূত্রগুলো মেনে চলতে পারি তবেই আমরা আত্ম-প্রকাশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব। আচরণের নীতিটা সেখানেই, কিন্তু এই চরিত্র যা একে সত্য এবং স্বতন্ত্র হিসেবে তৈরি করে তা আমাদেরই সৃষ্টি। আমাদের সঙ্গীতে স্বাধীনতা এবং সুনির্দিষ্টতার দ্বৈততা রয়েছে।
আইনস্টাইন: সঙ্গীতের কথাগুলোও কি মুক্ত? আমি আসলে বোঝাতে চাইছি, সঙ্গীতের কথাগুলো, এবং যা সে গাইছে, তার সাথে একজন গায়ক কি সম্পূর্ণ একমত?
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। বাংলায় এক ধরণের সঙ্গীত রয়েছে, যাকে আমরা কীর্তন বলি, যেখানে গানের সাথে গায়ক তাঁর নিজস্ব ও পছন্দসই মতামত, কথা বা উক্তি জুড়ে দিতে পারেন। এগুলো আসলে প্রবল উৎসাহোদ্দীপক, গায়কের এ সকল সুন্দর স্বতস্ফুর্ত আবেগে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়।
আইনস্টাইন: এ ধরনের ছন্দোবদ্ধ গঠন কি খুবই কঠিন?
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি পদ্যরচনকৌশলের সীমাকে অতিক্রম করতে পারবেন না। একজন গায়ককে অবশ্যই তাঁর নির্দিষ্ট সুর ও সময়ের মধ্যে থেকেই পরিবর্তন করবেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতে সময়ের সাথে গায়কের তুলনামূলক স্বাধীনতা রয়েছে কিন্তু সুরের সাথে নয়।
আইনস্টাইন: বাণী ছাড়া কি ভারতীয় সঙ্গীত হতে পারে? কেউ কি বাণী ছাড়া সঙ্গীত বুঝতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, অর্থহীন শব্দ দিয়েও সঙ্গীত হতে পারে, এ শব্দগুলো কেবল কিছু সুনির্দিষ্ট সুরসঙ্কেত প্রকাশ করে। উত্তর ভারতে সঙ্গীত একটি স্বাধীন শিল্পকলা, বাংলার মতো শব্দ এবং ভাবের প্রকাশ নয়। এ সঙ্গীত অত্যন্ত দুর্বোধ্য এবং নিগূঢ়, এবং ইহা সম্পূর্ণরূপেই স্ব-ব্যাখ্যাত সুর।
আইনস্টাইন: ইহা কি বহু-স্বরিক নয়?
রবীন্দ্রনাথ: যন্ত্রসমূহ ঐক্যতানের জন্য ব্যবহৃত হয় না, সময়ের সাশ্রয় এবং মাত্রা ও গভীরতা বৃদ্ধির জন্য। ইউরোপীয় সুর কি আরোপিত ঐক্যতান দ্বারা আক্রান্ত?
আইনস্টাইন: কখনো খুব ভালোভাবেই আক্রান্ত। কখনো ঐক্যতান সম্পূর্ণ সুরকেই ছাপিয়ে ফেলে।
রবীন্দ্রনাথ: সুর ও ঐক্যতান হলো অনেকটা ছবির রেখা এবং রংশিল্পের মতো। একটি রৈখিক ছবি পরিপূর্ণ সুন্দর হতে পারে; যাতে রংয়ের ছোঁয়া ছবিটিকেই অস্পষ্ট ও গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে। তবে রং ও রেখার সমন্বয়ে ও একটি ভালো ছবির সৃষ্টি হতে পারে, এর মূল্য না ছাপিয়ে বা নষ্ট না করে।
আইনস্টাইন: এটা একটা চমৎকার উদাহরণ, রেখা আসলে রংয়ের চেয়ে অনেক বেশি গভীর। মনে হয় আপনাদের সুরের কাঠামোয় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। জাপানী সঙ্গীতও আমার কাছে তেমনি মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথ: আমাদের মানসিকতা দিয়ে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের প্রভাব অনুধাবন করা খুবই কঠিন। পাশ্চাত্য সঙ্গীত আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়; আমি মনে করি এটা মহান, এটা মহান এর গঠনে এবং এর সুরে। কিন্তু আমাদের সঙ্গীত এবং এর মৌলিক গীতিআবেদন আমাকে আরো বেশি স্পর্শ করে। ইউরোপীয় সঙ্গীত চরিত্রের দিক থেকে মহাকাব্যের মত; এর একটা বিশাল আবহ আছে এবং ইহা অনেকটা গথিক প্রকৃতির।
আইনস্টাইন: আমরা আমাদের সঙ্গীতের সাথে এতটাই অভ্যস্ত যে এ প্রশ্নে উত্তর আমরা ইউরোপীয়রা জানি না। আমরা জানতে চাই আমাদের সঙ্গীত ঐতিহ্যের না মৌলিক মানবীয় আবেগের, এ ঐক্য এবং অনৈক্যের আবেগ যা স্বাভাবিক, অথবা কেবল ঐতিহ্যের দ্বারা যা আমরা অর্জন করি।
রবীন্দ্রনাথ: যেকোনো উপায়ে পিয়ানো আমাকে বিস্মিত করে। বেহালা আমাকে অনেক বেশি আনন্দ দেয়।
আইনস্টাইন: এ গবেষণা খুবই আনন্দের হবে যে, একজন ভারতীয় যে যুবাকালে কখনোই ইউরোপীয় সঙ্গীত শোনে নি তার উপর এ সঙ্গীত কেমন প্রভাব ফেলে তা জানা।
রবীন্দ্রনাথ: একদা আমি একজন ইংলিশ সুরকারকে আমার জন্য কিছু ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত বিশ্লেষণ করতে বলেছিলাম, এবং এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে বলেছিলাম।
আইনস্টাইন: সমস্যা হল, প্রকৃত ভালো সঙ্গীত, তা প্রচ্যেরই হোক কিংবা পাশ্চাত্যেরই হোক, বিশ্লেষণ করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ: ঠিক, যা গভীরভাবে প্রভাবিত করে শ্রোতা আসলে তখন তার নিজের মধ্যে থাকে না।
আইনস্টাইন: একই ধরনের অনিশ্চয়তা আমাদের অভিজ্ঞতার প্রায় সকল মৌলিক বিষয়েই রয়েছে, শিল্পকলা সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া, তা হোক ইউরোপে কিংবা এশিয়ায়। এমনকি আপনার টেবিলের এই লাল ফুল যা আমি দেখছি তাও আপনার কাছে এবং আমার কাছে একই নাও হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ: অতএব, এ সবকিছুর মধ্যেই এক ধরণের মিলনক্রিয়া চলছে, ব্যক্তিবিশেষের রুচি সর্বদাই একটি সর্বজনীন আদর্শের অনুগত।
তর্জমাকৃত উপরোক্ত বর্ণনামতে গণিত শাস্ত্র ও বিজ্ঞানতত্ত্ব, মানবসত্তা, প্রকৃতি, অতীন্দ্রিয়বাদ, সঙ্গীতকলা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি গুরুসব বিষয়াদি নিয়ে দুই মহারথীকে আলোচনার যে-গভীরতায় নিবিষ্ট হতে দেখা যায় তার মর্মার্থ অনুধাবন এবং রসাস্বাদন করার বিষয়টি যে কারো জন্য হতে পারে পরম পাওয়া এবং বহুধা শিক্ষণীয় বিষয়াবলী। আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কবি এবং বিজ্ঞানী আলোচনার বিষয়বস্তুভেদে কখনো সহমত পোষণ, কখনোবা দ্বিতম পোষণ, আবার কখনোবা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে- দুইজন দুই জগতের জ্ঞানতাপস হওয়া সত্ত্বেও একজন কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়বস্তু অন্যজন খুব সহজেই রপ্ত করে অনায়াসে সমছন্দে যৌক্তিকভাবে মতামত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ, আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত প্রদানে কখনোই ছন্দপতন হতে দেখা যায়নি, সমানতালে তাঁরা মতবিনিময় করে গেছেন। এ যেন আলোচনার মহাদ্বৈরথে ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান’!
কেমন বা কী ছিল দুই মহাজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের ধর্মভাবনা, চিন্তা বা বিশ্বাস! পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবসহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের স্ব-স্ব যেসব মতামত প্রকাশিত হয়েছে সেসবের উপর কিয়দ আলোকপাত করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণালাভ করা যেতে পারে।
বিখ্যাত হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করেন। মূলত এই ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য "পরম ব্রহ্ম", অন্য কথায় "নিরাকার ব্রহ্ম"। "পরম ব্রহ্ম" হচ্ছে এক কথায় উপনিষদের মূল উপজীব্য বা বিষয়বস্তু । জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল এই ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু। সঙ্গত কারণে প্রথম জীবনে পারিবারিকভাবেই যে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভে সক্ষম হন তা বলাই বাহুল্য। অধিকন্তু বোধগম্য, যুবক রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ, বেদ, মনুসংহিতা এবং গীতাসহ হিন্দুধর্মের অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বা পৌরাণিক গ্রন্থসমূহ খুব ভালভাবেই রপ্ত করে ফেলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি নিষ্কাম কর্ম, পুরুষোত্তম, বৈষ্ণববাদ, বৌদ্ধধমের্র অহিংস মতবাদ, খ্রিস্টীয় মতবাদ এবং ইসলামের মর্মবাণী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করেন। এভাবে সর্বধর্ম জ্ঞানলাভকারী পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ভাবনা কোনও একটি বিশেষ ধর্মে সীমবদ্ধ থাকেনি। তিনি কালক্রমে হয়ে উঠেন বিশ্বমানবতাবাদী এবং মানবধর্মের প্রধান প্রবক্তা। এ কারণেই ১৯৩০-এর দশকের প্রথমভাগে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজে ধর্মের দোহাইয়ে প্রচলিত বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেন, অন্যদিকে তার এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে ঐ বছরই তিনি ধারাবাহিকভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারস’ শিরোনামে যে বক্তৃতামালা প্রদান করেন তা গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে। পরের বছর, ১৯৩১ সালে ‘হিবার্ট লেকচারস’-এর একত্রিত রূপ ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তা বাংলা তর্জমায় ‘মানুষের ধর্ম’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের প্রধান দর্শন হিসেবে তাঁর রচনাবলীর অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ অন্তর্ভূক্ত হয়।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবধর্ম মতবাদ সম্পর্কে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন।
ফলে
কলকতায় অনুষ্ঠিত ১৯৩৭ সালের ৩ মার্চ বিশ্বধর্ম সম্মেলনের তৃতীয় দিনের অধিবেশনের
সভাপতি হিসেবে জ্ঞানগর্ভ ভাষণে তিনি বলেন-
“সমগ্র
মানবজাতির একটিমাত্র ধর্ম থাকবে, একই বিশ্বজনীন পদ্ধতিতে
সকলে উপাসনা করবে এবং একই আদর্শে সকলের ধর্ম পিপাসা তৃপ্তি লাভ করবে, আমি
এমন কথা বলি না।
যে
রূঢ় সাম্প্রদায়িক মন বিনা কারণে নামমাত্র কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, সূক্ষ্ম
বা স্থূলভাবে অত্যাচার করে, তাকে
স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, কবিতার
ন্যায় ধর্মও কোনও আদর্শবাদ নয়,
উহা
অভিব্যক্তি মাত্র।
সৃষ্টির
বিচিত্রতার মধ্যেই ঈশ্বরের বহুমুখীন আত্মপ্রকাশ; অনন্ত
সম্পর্কে আমাদের আদর্শও তদ্রুপ ব্যক্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন এবং অনমনীয় বিচিত্রতার
মধ্যেই প্রকাশ করতে হবে।
কোনও
ধর্ম যখন সমগ্র মানবজাতির উপর তার শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তখন
উহা আর ধর্ম থাকে না, তখন
উহা হয়ে পড়ে স্বৈরাচার, ইহাও
একপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ। অধিকাংশ স্থানেই এ জন্যই দেখতে পাই, পৃথিবীর
ধর্মজগতেও চলছে ফ্যাসিজমের তাণ্ডব, অনুভূতিবিহীন
পদভারে উহা মানবাত্মাকে দলিত-মথিত করছে।”
কী ঔদার্য, কী সুদূরপ্রসারী বিশ্বজনীন ধর্মদর্শন বাণী!
তাঁর
এই অমৃতবাণীর দীর্ঘ প্রায় ৮ দশক পর আজও পৃথিবীতে ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক
ও গোষ্ঠীগত হানাহানি, যুদ্ধ, বিগ্রহ
নিত্যনৈমিত্তিক ঘটে চলছে। এ কারণেই চিন্তাচেতনা, মমনশীলতা, সৃষ্টিকর্ম, রচণাশৈলি
ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রজন্মান্তর অন্য সকলের চেয়ে আধুনিকতার
ধারক ও বাহক হিসেবে অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন।
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক আরেক যুগস্রষ্টা আইনস্টাইনের ধর্মভাবনা নিয়ে বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। মূলত, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে ধর্ম বিষয়ে আইনস্টাইনের চিন্তা-চেনতা বা ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কিনা এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের প্রশ্নের জবাবে তাঁর দেয়া উত্তরসমূহের প্রেক্ষিতে মতামতের এই ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। তবে স্রষ্টা ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাস ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি মা-বাবা কর্তৃক লালিত-পালিত হয়েছিলেন বলে ধর্মীয় ব্যাপারে আইনস্টাইন পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন। আর পরিণত বয়সে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজেকে অজ্ঞেয়বাদী, ব্যক্তিধর্মে অবিশ্বাসী, সর্বেশ্বরবাদী এবং দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা’র ঈশ্বরে বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেছেন। ‘আমার দৃষ্টিতে জগৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধে স্রষ্টা ও ধর্ম সম্পর্কে আইনস্টাইন সুনির্দিষ্টভাবে বেশ কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন- “রহস্য সন্ধানের কৌতূহল-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মধুরতম অনুভূতি লাভ করতে পারি। প্রকৃত শিল্পকলা এবং প্রকৃত বিজ্ঞানের সূচনাবিন্দুতে রহস্য উদঘাটনের তীব্র আগ্রহ থাকে। এ আগ্রহ যার শেষ হয়ে যায়, সে আর বিস্মিত হয় না, কৌতূহলের আনন্দে কর্মচঞ্চল হয় না, সে মৃত, তার দৃষ্টিশক্তি নির্বাপিত হয়ে যায়। রহস্য সন্ধানের এ অভিজ্ঞতাই ধর্মের জন্ম দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভয়ও যুক্ত থাকতে পারে। রহস্যময় অজানা কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর গভীরতম যুক্তিবোধ ও দীপ্তিময় সৌন্দর্যবোধভিত্তিক আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ তীব্র অনুভূতির আদি ও অবিকৃত রূপের মধ্যে আমরা আমাদের সত্তায় অনুভব করতে পারি । এ আগ্রহ ও অনুভূতি দ্বারাই গঠিত হয় প্রকৃত ধর্মবোধ। এ অর্থে এবং কেবলমাত্র এ অর্থেই আমি গভীর ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষ। আমি এমন কোনো ঈশ্বর কল্পনা করতে পারি না, যিনি তার সৃষ্ট জীবকে পুরস্কৃত করেন কিংবা শাস্তি দেন অথবা যিনি আমাদের ইচ্ছাশক্তির মতো কোনো প্রকার ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আমি কল্পনা করতে পারি না এবং কখনো কল্পনা করতে চাইও না যে, দৈহিক মৃত্যুর পরেও কোনো ব্যক্তির সত্তা বেঁচে থাকে। দুর্বল প্রকৃতির লোকেরা ভয় ও স্বার্থবোধ বশে এ ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারে।”
স্ববিবৃত এই উক্তির চেয়ে আর কোনও বর্ণনাই ধর্মবিষয়ে আইস্টাইনের বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনার যথার্থতা প্রমাণ করতে পারে না।
বিশ্বমানব কল্যাণে সকল মহামাবনই অভিন্ন চিন্তা-চেতনার ধারক- এই আপ্তবাক্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে উপরে বর্ণিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের আলাপচারিতা এবং ধর্মসম্পর্কিত তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা।
রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টানের জীবনের দু’টি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করে আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটানো যেতে পারে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ রচণাগুচ্ছের এক জায়গায় লিখেছেন- “মনে আছে, একবার ডালহৌসি পাহাড়ে পিতার সঙ্গে ছিলুম। সেখানে প্রচণ্ড শীত। সেই শীতে ভোরে আলো-হাতে এসে আমাকে শয্যা থেকে উঠিয়ে দিতেন। সেই ভোরে উঠে একদিন চৌরঙ্গির বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। তখন ওখানে ফ্রি ইস্কুল বলে একটা ইস্কুল ছিল। রাস্তাটা পেরিয়েই ইস্কুলের হাতাটা দেখা যেত। সে দিকে চেয়ে দেখলুম, গাছের আড়ালে সূর্য উঠছে। যেমনি সূর্যের আবির্ভাব হল গাছের অন্তরালের থেকে, অমনি মনের পর্দা খুলে গেল। মনে হল, মানুষ আজন্ম একটা আবরণ নিয়ে থাকে। সেটাতেই তার স্বাতন্ত্র্য। স্বাতন্ত্র্যের বেড়া লুপ্ত হলে সাংসারিক প্রয়োজনের অনেক অসুবিধা। কিন্তু, সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আবরণ খসে পড়ল। মনে হল, সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলুম। মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখলুম। দুজন মুটে কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলেছে। তাদের দেখে মনে হল, কী অনির্বচনীয় সুন্দর। মনে হল না, তারা মুটে। সেদিন তাদের অন্তরাত্মাকে দেখলুম, যেখানে আছে চিরকালের মানুষ”। অন্যদিকে, আইনস্টাইনের মেয়ের বিয়েতে সবাই চার্চে যাচ্ছিলেন তাঁরা। পথিমধ্যে তিনি মেয়েকে বললেন- ‘তুমি চার্চের দিকে যাও, আমি ল্যাবে আমার কলমটা রেখে আসছি’। মেয়ে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও আইনস্টাইন গেলেন, ৩০ মিনিটের কথা বলে তিনি যখন ফিরে এলেন না, তখন সবাই মিলে উনার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সাতদিন পর উনার মেয়ে বাসায় এসে মাকে তার বাবা কোথায় তা জিজ্ঞাস করলে তার মা বললেন ওই যে গেলেন আরতো আসেননি। মেয়ে তখন আইনস্টাইনের খোঁজে ল্যাবে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন তার বাবা একটা কলম নিয়ে বোর্ডের সামনে গিয়ে কী যেন চিন্তা করছেন মেয়ে বাবা কে বলল- ‘বাবা কি কর’। তখন আইনস্টাইন বললেন- ‘মা, তুমি চার্চে যাও, আমি এই কাজটা ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ করে আসছি’।
রবীন্দ্রনাথের ‘সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখা’ আর আইনস্টাইনের ‘কলম রেখে আসা’ যুগযুগান্তরেও শেষ হবার নয়। কারণ এঁরা কখনো কোনও অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাস করেন না।
বিজ্ঞানি আইনষ্টাইন ১৯৫৪ সালে এক চিঠিতে লিখেছেলেন ;
“ ঈশ্বর (GOD) শব্দটি আমার কাছে মানুষের দুর্বলতার বহির্প্রকাশ ও দুর্বলতা থেকে উৎপাদিত বস্ত্তর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না । বাইবেল গ্রন্থটি খুবই ন্যায়পরায়ন, তবে আদিম কিংবদন্তির বেশি কেছু নয় । তার চেয়ে বড় কথা , খুবই শিশুসুলভ এগোলো ।
Details of the main letter ( from internate )
In January of 1954, just a year before his death, Albert Einstein wrote the following letter to philosopher Erik Gutkind after reading his book, "Choose Life: The Biblical Call to Revolt," and made known his views on religion. Apparently Einstein had only read the book due to repeated recommendation by their mutual friend Luitzen Egbertus Jan Brouwer. The letter was bought at auction in May 2008, for £170,000; unsurprisingly, one of the unsuccessful bidders was Richard Dawkins.
Translated transcript follows.
(Source: David Victor; Image: Albert Einstein, via.)
Translated Transcript
Translated transcript follows.
(Source: David Victor; Image: Albert Einstein, via.)
Translated Transcript
Princeton, 3. 1. 1954
Dear Mr Gutkind,
Inspired by Brouwer's repeated suggestion, I read a great deal in your book, and thank you very much for lending it to me. What struck me was this: with regard to the factual attitude to life and to the human community we have a great deal in common. Your personal ideal with its striving for freedom from ego-oriented desires, for making life beautiful and noble, with an emphasis on the purely human element. This unites us as having an "unAmerican attitude."
Still, without Brouwer's suggestion I would never have gotten myself to engage intensively with your book because it is written in a language inaccessible to me. The word God is for me nothing more than the expression and product of human weakness, the Bible a collection of honorable, but still purely primitive, legends which are nevertheless pretty childish. No interpretation, no matter how subtle, can change this for me. For me the Jewish religion like all other religions is an incarnation of the most childish superstition. And the Jewish people to whom I gladly belong, and whose thinking I have a deep affinity for, have no different quality for me than all other people. As far as my experience goes, they are also no better than other human groups, although they are protected from the worst cancers by a lack of power. Otherwise I cannot see anything "chosen" about them.
In general I find it painful that you claim a privileged position and try to defend it by two walls of pride, an external one as a man and an internal one as a Jew. As a man you claim, so to speak, a dispensation from causality otherwise accepted, as a Jew the privilege of monotheism. But a limited causality is no longer a causality at all, as our wonderful Spinoza recognized with all incision, probably as the first one. And the animistic interpretations of the religions of nature are in principle not annulled by monopolization. With such walls we can only attain a certain self-deception, but our moral efforts are not furthered by them. On the contrary.
Now that I have quite openly stated our differences in intellectual convictions it is still clear to me that we are quite close to each other in essential things, i.e; in our evaluations of human behavior. What separates us are only intellectual "props" and "rationalization" in Freud's language. Therefore I think that we would understand each other quite well if we talked about concrete things.
With friendly thanks and best wishes,
Yours,
A. Einstein
সূত্র; ভোরের
কাগজ ৷
(সৌজন্য
ভোরের
কাগজ এবং
লেখক ও গবেষক -বী রে
ন্দ্র না থ অ ধি কা রী )
( more information from internate >>)
(
Tagore and Einstein - A Conversation
Introduction by Rajan P. Parrikar
Namashkar.
The summer of 1930 occasioned a meeting of
two extraordinary minds - Rabindranath Tagore and Albert Einstein - in Caputh,
Germany. Einstein reserved the highest admiration for Tagore as well as Mahatma
Gandhi, and they, in turn, recognized in him a kindred spirit. Despite the
disparate life-focus of the three, their ecumenical thinking lavished its
warmth and wisdom on humanity as a whole. They were profoundly united in their
concern for the world's indigent, the state of the human condition a continual
presence to their imagination. Of the values that fuelled his rich life
Einstein famously wrote: The ideals which have lighted my way, and time
after time have given me new courage to face life cheerfully have been
Kindness, Beauty and Truth. Gandhi and Tagore, too, took the road
illuminated by these very values.
The Tagore-Einstein dialogues of 1930 have
been reprinted in a delightful book, Einstein Lived Here, by
Professor Abraham Pais (Oxford University Press, 1994) in Chapter 9, "The
Indian Connection: Tagore and Gandhi." The warm, humane Tagore-Einstein
interchange on music is particularly engaging and is reproduced below with
permission of the publisher.
But first, let us survey some quotes from
the Chapter, words which cast a flavour of the regard these great sages held
one another in:
Tagore on Einstein:
Einstein
has often been called a lonely man. Insofar as the realm of the mathematical
vision helps to liberate the mind from the crowded trivialities of daily life,
I suppose he is a lonely man. His is what might be called transcendental
materialism, which reaches the frontiers of metaphysics, where there can be
utter detachment from the entangling world of self. To me both science and art
are expressions of our spiritual nature, above our biological necessities and
possessed of an ultimate value. Einstein is an excellent interrogator. We
talked long and earnestly about my "religion of man." He punctuated
my thoughts with terse remarks of his own, and by his questions I could measure
the trend of his own thinking.
Einstein to Tagore:
You
are aware of the struggle of creatures that spring forth out of need and dark
desires. You seek salvation in quiet contemplation and in the workings of
beauty. Nursing these you have served mankind by a long fruitful life,
spreading a mild spirit, as has been proclaimed by the wise men of your people.
Einstein on Tagore, co-written with Gandhi
and Rolland:
He
has been for us the living symbol of the Spirit, of Light, and of Harmony - the
great free bird which soars in the midst of tempests - the song of Eternity which
Ariel strikes on his golden harp, rising above the sea of unloosened passions.
But his art never remained indifferent to human misery and struggles. He is the
'Great Sentinel.' For all that we are and we have created have had their roots
and their branches in that Great Ganges of Poetry and Love.
Warm regards,
Rajan P. Parrikar
Rajan P. Parrikar
T: Rabindranath
Tagore; E: Albert Einstein
(Year: 1930)
(Year: 1930)
pp 105-107
<-- Rabindranath Tagore and Albert Einstein in Caputh, July 14, 1930
The second Einstein-Tagore dialogue, the
one held in Caputh, 'was taken down by a friend who was present'. This time
they began with a discussion of the nature of causality. On this subject the
two men talked past each other without any understanding as to what the other
was driving at. I do not consider it worthwhile reproducing here any of this.
On the other hand, their next theme, on music is quite appealing.
T: The musical
system in India...is not so rigidly fixed as is the western music. Our
composers give a certain definite outline, a system of melody and rhythmic
arrangement, and within a certain limit the player can improvise upon it. He
must be one with the law of that particular melody, and then he can give
spontaneous expression to his musical feeling with the prescribed regulation.
We praise the composer for his genius in creating a foundation along with a
superstructure of melodies, but we expect from the player his own skill in the
creation of variations of melodic flourish and ornamentation. In creation we
follow the central law of existence, but, if we do not cut ourselves adrift
from it, we can have sufficient freedom within the limits of our personality
for the fullest self-expression.
E: That is only
possible where there is a strong artistic tradition in music to guide the
people's mind. In Europe, music has come too far away from popular art and
popular feeling and has become something like a secret art with conventions and
traditions of its own.
T: So you have to
be absolutely obedient to this too complicated music. In India the measure of a
singer's freedom is in his own creative personality. He can sing the composer's
song as his own, if he has the power creatively to assert himself in his
interpretation of the general law of melody which he is given to interpret.
E: It requires a
very high standard of art fully to realize the great idea in the original
music, so that one can make variations upon it. In our country the variations
are often prescribed.
T: If in our
conduct we can follow the law of goodness, we can have real liberty of
self-expression. The principle of conduct is there, but the character which
makes it true and individual is our own creation. In our music there is a
duality of freedom and prescribed order.
E: Are the words
of a song also free? I mean to say, is the singer at liberty to add his own
words to the song which he is singing?
T: In Bengal
we have a kind of song - Kirtan, we call it - which gives freedom to the singer
to introduce parenthetical comments, phrases not in the original song. This
occasions great enthusiasm, since the audience is constantly thrilled by some
beautiful, spontaneous sentiment freshly added by the singer.
E: Is the metrical
form quite severe?
T: Yes, quite. You
cannot exceed the limits of versification; the singer in all his variations
must keep the rhythm and the time, which is fixed. In European music you have a
comparative liberty about time, but not about melody. But in India we have
freedom of melody with no freedom of time.
E: Can the Indian
music be sung without words? Can one understand a song without words?
T: Yes, we have
songs with unmeaning words, sounds which just help to act as carriers of the
notes. In North India music is an independent art, not the interpretation of
words and thoughts, as in Bengal. The music is very intricate and subtle and is
a complete world of melody by itself.
Cartoon by Herblock, published in Washington Post some days after Einstein's death -->
E: It is not
polyphonic?
T: Instruments are
used, not for harmony, but for keeping time and for adding to the volume and
depth. Has melody suffered in your music by the imposition of harmony?
E: Sometimes it
does suffer very much. Sometimes the harmony swallows up the melody altogether.
T: Melody and
harmony are like lines and colors in pictures. A simple linear picture may be
completely beautiful; the introduction of color may make it vague and
insignificant. Yet color may, by combination with lines, create great pictures,
so long as it does not smother and destroy their value.
E: It is a
beautiful comparison; line is also much older than color. It seems that your
melody is much richer in structure than ours. Japanese music seems to be so.
T: It is
difficult to analyze the effect of eastern and western music on our minds. I am
deeply moved by the western music - I feel that it is great, that it is vast in
its structure and grand in its composition. Our own music touches me more
deeply by its fundamental lyrical appeal. European music is epic in character;
it has a broad background and is Gothic in its structure.
E: Yes, yes, that
is very true. When did you first hear European music?
T: At seventeen,
when I first came to Europe. I came to know it intimately, but even before that
time I had heard European music in our own household. I had heard the music of
Chopin and others at an early age.
E: There is a
question we Europeans cannot properly answer, we are so used to our own music.
We want to know whether our own music is a conventional or a fundamental human
feeling, whether to feel consonance and dissonance is natural or a convention
which we accept.
T: Somehow the
piano confounds me. The violin pleases me much more.
E: It would be
interesting to study the effects of European music on an Indian who had never
heard it when he was young.
T: Once I asked an
English musician to analyze for me some classical music and explain to me what
are the elements that make for the beauty of a piece.
E: The difficulty
is that really good music, whether of the East or of the West, cannot be
analyzed.
T: Yes, and what
deeply affects the hearer is beyond himself.
E: The same
uncertainty will always be there about everything fundamental in our
experience, in our reaction to art, whether in Europe or Asia. Even the red
flower I see before me on your table may not be the same to you and me.
T: And yet there
is always going on the process of reconciliation between them, the individual
taste conforming to the universal standard.)
From: South Asian Women Forum
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন