দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ৯৮ বছর ব্যাপী জীবনের কিছু উপলব্দী এবং আশাবাদ প্রসঙ্গে :


      
                  ‘ অসত্য  জেনে  সুস্থ  মস্তিষ্কে  থাকার  চেয়ে  সত্যটা  জানতে  পেরে  পাগল    হওয়াটাই  আমি  বেশী পছন্দ  করি’ ৷

      ‘ সমুদ্র  তারকা , বিশাল  প্রান্তরের  রাত্রিকালীন  বাতাসের  কাছ  থেকে  আমি যা পাই , যে-মানুষকে  ভালবাসি  তার  কাছ  থেকে  তা  পাই  না ’ ৷

     ‘ স্বর্গের  কথা  বলতে  গেলে  নরককে  আগে  ভালভাবে  দেখতে হবে ’ ৷

     ‘ সামজিক  ন্যায়বিচার  হল-ক্ষমতার  সমীকরণ  যতবেশী  বাস্তবসম্মত  করা  যায়  তার  নিশ্চয়তা  বিধান করা ’  ৷

     ‘ আমি  কাঁচের  তৈরি  কোন  সাধুপুরুষ  নই যে- কাঁচ  মহত্ত্বের  রঙ  দিয়ে  রঞ্জিত  আর যা  রাখা  হয়  শুধু  মানুষকে  শিক্ষা  দেবার  জন্য ’ ৷  

      -বার্ট্রান্ড  রাসেল ;
      অনুবাদ- পান্না লাল চৌধুরী :       
                     

          দার্শনিক  বার্ট্রান্ড  রাসেলের  ৯৮ বছর ব্যাপী  জীবনের  কিছু  উপলব্দী  এবং  আশাবাদ  প্রসঙ্গে :

          দার্শনিক  রাসেল  তার  ব্যক্তিগত  বিশ্বাস  ও সমাজ দর্শন  এবং  মানুষের  জীবন  যাপন  নিয়ে প্রায় ৫০ বছর  পূর্বে  তার আত্মজীবনীমূলক  গ্রন্থে  কিছু  পর্যবেক্ষণমূলক  বক্তব্য  দিয়েছেন ৷ যা  বর্তমান  সংঘাতপূর্ণ  বিশ্বে  এখনও  গুরুত্বপূর্ণ  বলে  বিবেচনা  করা  হচ্ছে  ৷ ব্যক্তিগতভাবে  রাসেল  নিজকে  একজন  সংশয়বাদী  বলে  পরিচয়  দিয়েছেন ৷

          তার  দীর্ঘ  জীবনে  অর্জিত  কিছু  বিশ্বাস  এবং  কিছু  উপলব্দীগুলোকে  তিনি  তার  রচিত  আত্মজীবনীমূলক  বইয়ের  শেষ  পর্বে এবং পৃথক ভাবে  প্রকাশ  করেছেন ৷ *

          দার্শনিক  রাসেল তার  দীর্ঘ  জীবন  পথের  পদচারনায়  যে  অভিজ্ঞতা  অর্জন  করেছিলেন  তারই   প্রেক্ষাপটে তিনি  মানুষের  দুঃখ ও  দুর্দশার  কারণ  অনুসন্ধান  করেছেন এবং তার  সার কথা সংক্ষেপে এইভাবে   বলেছেন যে , মানবজাতির  নির্বুদ্ধিতা  ও  দুর্ভোগ  কোনোটাই  মানুষের  জন্যে  তার  অনিবার্য  নিয়তি  নয় ৷ মানুষ  তার  নিজের  বুদ্ধিমত্তা , ধৈর্যশীলতা  এবং  স্পষ্টবাদিতার  সুষ্ঠ  প্রয়োগের  মাধ্যমেই   এর  সমাধান  বের করতে পারবে বা বের করা  সম্ভব   ৷    যদি  মানবজাতি তার  নিজের  উপর  নিজের  আরোপিত  যন্ত্রণা  থেকে  মুক্তি  পেতে  চায় তবে  অবশ্যই  তাকে  তার  বুদ্ধিমত্তা  , ধৈর্যশীলতা  এবং স্পষ্টবাদিতার  আলোকে এবং এর সুষ্ট  প্রয়োগে  এর থেকে মুক্তি  অর্জন  করতে  পারবে ,  যদি  এর পূর্বেই  তারা  নিজেদেরকে  ধ্বংস  না  করে  ফেলে  ৷

          তিনি  তার  পর্যাবেক্ষণে  আরো  বলেছেন যে , মানুষের  মধ্যে  দারিদ্রতা  আছে , মহামারী  বা  মড়ক  আছে , দুর্ভিক্ষে  কবলিত  হওয়ার  সম্ভাবনা আছে , আছে প্রকৃতি পদত্ত বিভিন্ন  অত্যাচার ৷ এসবের  কারণ  তিনি  খুঁজে  বের  করেছেন ৷ তিনি  বলেছেন এসবের  মূলে রয়েছে যে কারণ তা  হচ্ছে  এখন পর্যন্ত  প্রকৃতির  উপর  মানুষের  যথেষ্ট  নিয়ন্ত্রন ও কর্তৃত্ব  প্রতিষ্ঠা  করতে  না  পারা  ৷  যখনই  মানুষ  প্রকৃতিকে  নিজেদের  নিয়ন্ত্রনে  রাখতে  সক্ষমতা  অর্জন  করবে তখন থেকে মানবজাতি  এসব  থেকে মুক্তি  পাবে ৷ আর এটা সুষ্ট  বিজ্ঞান  চর্চার  মাধ্যমেই  করা সম্ভব , কোনো অলৌকিক ক্ষমতার চর্চা ছাড়াই ৷  

        তিনি বলেছেন তিনি  আরো  বিশ্বাস  করেন যে ,   বর্তমান  বিশ্বে  যুদ্ধবিগ্রহ , মানুষের  উপর  মানুষের  অত্যাচার , নিপীড়ন ইত্যাদি  সবই  আছে  , যা  পূর্বেও  ছিল ৷ এগুলোর  প্রধান  কারণ  হল  মানুষের  প্রতি  মানুষের  শত্রুতাভাবাপন্নতা আর  আরো কিছু  কষ্টবোধের   অন্যতম  কারণ  হচ্ছে  মানুষের  ধর্মবিশ্বাস ৷ যেমন রোগ-শোক বা  পীড়িত হওয়া  জনিত  কষ্টভোগ  যা মানুষের বিষাদময়  ধর্মবিশ্বাসের  ফলে  সৃষ্টি  হয়েছে ৷ কারণ  ধর্মবিশ্বাস  মানুষের  অন্তরের  গভীরে  এক সংঘাতের  জন্ম  দিয়েছে যা  মানুষের  জাগতিক  উন্নতিকে  মূল্যহীন  করে  তুলেছে ৷

         তার মতে  আধুনিক  বিশ্বে  বিভিন্ন  সম্প্রদায়ের  মধ্যে  যে  অশান্তি  বিরাজ  করছে  তার  মূলে  রয়েছে  মানুষের  অজ্ঞতা , অভ্যাস এবং কুসংস্কারমূলক  অন্ধ ধর্মবিশ্বাস এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের অভাব এবং আবেগের  তাড়না  ( ধর্মীয় আবেগ ) যেগুলো  তাদের  কাছে  জাগতিক সুখ  বা নিজের জীবনের  চেয়েও  অধিক  প্রিয় ৷ তিনি  বলেছেন  এই  সব অন্ধবিশ্বাসী ও আবেগপ্রাণ  মানুষের  কার্যকলাপ  দেখে  বলতে  হয় যে ,  এখনও  সমাজে  অনেক মানুষই  আছে  যারা  জাগতিক  দুঃখকষ্ট  এবং  মৃত্যুকেই বেশী  ভালবাসে ৷ বিজ্ঞান ও সত্য এবং জ্ঞানের  কথা  এদেরকে  বলতে গেলে তারা  ক্রুদ্ধ  হয়ে  উঠে ৷ তাদের বিশ্বাস ,  বিশ্বাসহীনভাবে কোনো কিছু  আশা  করাই  একটি  যুক্তিহীনতা ৷ তারা আরো বিশ্বাস  করে যে , যদি  তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আকড়ে ধরে অলস হয়ে  বসেও থাকে ,  তবেও কোনো অলৌকিক শক্তি তাদেরকে  তাদের  বিপদ আপদ থেকে  রক্ষা  করবে ৷ এক্ষেত্রে  তাদের  নিজেদের  কিছুই  করাই  নেই ৷

      কিত্তু  দার্শনিক  রাসেল  তার  আত্মকথায়  বলেছেন বাস্তব  জীবনে বা  বাস্তব  জগতে  একজন  মানুষের  আশাবাদের প্রতি  আস্থাশীল  থাকতে  হবে ৷ আর  আশাবাদে আস্থাশীল হতে  হলে  দরকার  হয় প্রচুর  বুদ্ধিমত্তা ও প্রাণশক্তি  অর্জনের ৷ জীবন যুদ্ধে  যারা  হতাশাকেই  বড় করে দেখে তাদের  মধ্যে সর্বদাই  এই  প্রাণশক্তির  অভাব  পরিলক্ষিত  হয় ৷

          দার্শনিক  রাসেলের  মতে  বর্তমান  জগতকে  এই বিপদজনক  অবস্থা  থেকে মুক্ত  করতে হলে  প্রয়োজন  নিত্য  নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক  চিন্তা , নতুন  নতুন আবিস্কার এবং হৃদয়ে  আশাবাদ পোষণ  করা আর  নতুন  ধরনের  ব্যক্তি  স্বাধীনতা  অর্জন  করা  এবং কিছু  কিছু স্বাধীনতার  উপর সমাজের নিয়ন্ত্রন  প্রতিষ্ঠা  করা , যা  এখনই করা প্রয়োজন বলে তিনি বলেছেন ৷

          আশাবাদী  রাসেল এমন এক বিশ্বের স্বপ্ন  দেখেছেন যে বিশ্বে  মানুষ  একদিন  স্বাধীনভাবে বেড়ে ও গড়ে উঠতে  পারবে  ৷ যেখানে  হিংসা , ঘৃণা , লোভ আর ঈর্ষা  অস্তত্বহীন  হয়ে পড়বে কারণ এগুলোর  পরিপুষ্ট  করার মত কোনো পরিবেশ তখন এই  বিশ্বে আর অবশিষ্ট  থাকবে  না ৷ বিশ্বে  বর্তমানে এত  বীভৎসতা  থাকা  সত্ত্বেও তিনি  তার  এই স্বপ্নের  বিশ্বের   বিশ্বাসে  অটল থাকবেন   বলে  জানিছেন ৷

   (সূত্র; পান্না লাল চৌধুরী অনুদিত  বার্ট্রান্ড  রাসেল এর
     আত্মাকথা  গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডের শেষ কথা অংশ থেকে তথ্যাদি
     সংগ্রহ করে এবং তারই অনুবাদের কিছুটা অনুকরণ  করে
      এই লেখাটি প্রস্তুত  করা হয়েছে ৷ মূল সূত্র-* Portraits from Memory সংকলনে
       ‘ Reflections on my Eightieth Birthday’ শিরোনামে পৃথকভাবে প্রকাশিত ৷ )    

      
    






মন্তব্যসমূহ