বাংলাদেশী মৌলবাদী সুশীলরা শেষ পর্যন্ত কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন কবিতাটিকে ও বির্তকিত এবং অবমূল্যায়ন করলেন !
বাংলাদেশী মৌলবাদী সুশীলরা শেষ পর্যন্ত কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন কবিতাটিকে ও বির্তকিত এবং অবমূল্যায়ন করলেন !
- সাদিক ইসলাম
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) রবীন্দ্র-উত্তর
যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি
বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র-জোয়ারের যুগে
পাশ্চাত্যের রোমান্টিকতার রূপকথা আর স্বাপ্নিক ভুবন নিয়ে সবাই যখন নিমগ্ন তখন তিনি
হাঁটলেন অন্য পথে;
রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক যুগের হাত ধরে তিনি ইম্প্রেশনিস্টিক
যুগে প্রবেশ করেন।
- জীবনানন্দ যেহেতু ইংরেজী সাহিত্য পড়াতেন তাই
দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন ইংরেজ সাহিত্যের বহুমাত্রিকতায়।
ইম্প্রেশন কাব্যের তিনটি ধারা
চিত্রকল্পবাদ (
Imagism ), প্রতীকীবাদ ( Symbolism
) এবং পরাবাস্তববাদ ( Surrealism ) এর প্রবর্তন একাই ঘটান বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ। বাংলার মায়াবী
বাস্তবতার শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন বাস্তবতার ( Dream Reality )এক অপরূপ জগত
সৃষ্টি করেন জীবনানন্দ।
তার কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া বোঝা যাবে
প্রতীক ব্যবহারের প্রবণতা দেখে।
উত্তর-আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যে জীবনানন্দ যেন নতুন করে আবার ফিরে এসেছেন আরও আধুনিক হয়ে। যেন পশ্চিমের কাছে ধার করা নান্দনিকতা আরও ফলবান করে তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ।
উত্তর-আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যে জীবনানন্দ যেন নতুন করে আবার ফিরে এসেছেন আরও আধুনিক হয়ে। যেন পশ্চিমের কাছে ধার করা নান্দনিকতা আরও ফলবান করে তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ।
যদিও রাজনৈতিক ব্যাপারে জীবনানন্দ তার কাব্যে এক ধরনের নিস্পৃহতা দেখিয়েছিলেন কিন্তু সমাজ সচেতনতা খুব গভীরভাবেই তার কাব্যে বিদ্যমান। চলমান যাপিত জীবনের সংকট, আশাহীন ভবিষ্যতের অমানিশা, মানবিক বিপর্যয়ের আভাস তার কবিতাগুলোতে অত্যন্ত জোরালোভাবেই উপস্থিত। কী ভীষণভাবেই না ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় জীবনানন্দ কবিতাটিতে অনেক বছর আগের কোনো মানবিকতার চরম সংকট নয় বরং এই আধুনিক জীবনের ভঙ্গুর রূপটাই এঁকেছেন। অগভীর চেতনার প্রাদুর্ভাব আর বর্তমান মূল্যবোধের দারুণ অবক্ষয় জীবনানন্দ বিদ্রƒপ ভরে বলে গেছেন এক শতাব্দী আগেই। আমরা আজও দেখি না-
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’
তাই, জীবনানন্দ আজও এতো আধুনিক এবং অনেক বর্তমান আধুনিক কবিদের চেয়েও। তিনি আধুনিক ইউরোপের কবিতার রূপ ও আকার গ্রহণ করে সর্বকালীন অমলিন সাহিত্য রচনা করেছেন। তাই, আজও জীবনানন্দ আমাদের পথ দেখায় আজও তার কাব্যের লালিত মণিমুক্তা আমাদের ঠুনকো ঐশ্বর্যকে ম্লান করে দেয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যের সংগ্রহ করা তার সীমাহীন রূপসী কাব্য সম্ভার আজও হৃদয় সচেতন করে ‘আলোর পৃথিবী’ গড়ে দিয়ে যায় আর মানবিকতার ‘মহাপৃথিবী’ জাগিয়ে তোলে।
-
(সৌজন্য ; সাদিক ইসলাম
ও জনকণ্ঠ )
-জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
কয়েকদিন আগে মৌলবাদী মিডিয়ায় সুশীল সমাজের একজনের মন্তব্য প্রকাশ করেছে ৷ ঐ সুশীল বলেছেন যে , কবি জীবনানন্দ দাশের রচিত বনলতা সেন কবিতার বনলতা সেন একজন বেশ্যা ছিলেন ৷ যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন ,
অন্ধকারে কে থাকে ? অন্ধকারে তো বেশ্যাই থাকে ?
কারণ, কবি জীবনান্দ দাশ তার কবিতার এক অংশে লিখেছেন ,
‘সব পাখি
ঘরে আসে-
সব
নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ;
থাকে
শুধু অন্ধকার ,
মুখোমুখি
বসিবার বনলতা সেন ’ ৷
একজন
কবিতার পাঠকের চিন্তা কী অত নিচে নামতে পারে ? একজন কবিতার পাঠক নিশ্চয় মনে করেন , ব্যস্ত
সমস্ত একটি দিনের সকল ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এসে দিনের শেষে ,
সন্ধ্যার
নীরবতার শান্তির মতো জীবনে ঘরের মধ্যে তো শুধু একজন
প্রিয়াই থাকতে
পার ! যে তার প্রীয়তমের সারা দিনের সূখ দুঃখের কথা শুনতে আসীম আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে ৷
আর সেই প্রিয়াকে আরও বাস্তব
করে তোলার জন্যে জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন কবিতায় এভাবে
উল্লেখ করেছেন আলোচিত বনলতা সেনকে ৷ আর কবি তার প্রিয়াকে
রক্ত মাংসের মানবিক বোধের বাস্তব নারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তার এই কবিতায় । অথচ
বনলতা সেন নামক কবির প্রিয়ার এই প্রতিকি রূপকে একজন বেশ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হল বর্তমান মৌলবাদী বাংলাদেশী ‘সুশীল’ দের একজনের চিন্তায় । বাংলাদেশে কোনো বিষয়কেই আর বির্তকের বাইরে রাখা যাচ্ছে না ৷
প্রসঙ্গত উল্লখযোগ্য যে মুক্তিযুদ্ধা ও সুশীল এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জনাব আকবর আলি খাঁন কবি জীবননান্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাকে ভিত্তি করে এবং এই কবিতার বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে এর মধ্যে আন্তর্জাতিকতা এবং বৈদ্ধ ধর্মের সুশ্লিষ্টতা আছে উল্লেখ করে একটি সম্পুন্ন বইই লিখে ফেলেছেন ৷ বর্তমান বাংলাদেশের দু-জন সুশীল মানুষের দূষ্টিভঙ্গির কত পার্থক্য !
এ প্রসঙ্গে জনাব আকবর আলি খাঁনের কালের কণ্ঠে (১৬/১০/ ১৫ ) দেয়া একটি সাক্ষাতকারের একটি অংশের উল্লেখ করা হলো ৷
এ প্রসঙ্গে জনাব আকবর আলি খাঁনের কালের কণ্ঠে (১৬/১০/ ১৫ ) দেয়া একটি সাক্ষাতকারের একটি অংশের উল্লেখ করা হলো ৷
' জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে বলি, আমার ধারণা, জীবনানন্দ দাশকে এখনোও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। 'হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি' এ বাক্যটি নিয়ে সমালোচকরা বলেন, তিনি হাজার বছর ধরে বনলতা সেন বা প্রেমিকার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত; ব্যাপারটি আসলে তো তা নয়। আপনি যদি প্রেমিকাকে বলেন, তোমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত; ও কিন্তু আপনাকে স্যান্ডেল মারবে। তাহলে কবি ক্লান্ত প্রাণ কেন বলেছেন? এটার মানে, তিনি এখানে জন্মান্তরবাদের কথা বলেছেন। এই অন্তহীন যাত্রার উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে গৌতম বুদ্ধের জাতক চক্রতত্ত্বে। নির্বাণ লাভ না করা পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে জন্ম-পুনর্জন্মের চক্রের ভেতর দিয়ে অতীতের পাপের বোঝা বহন করে অবিরাম চলতে হবে জীবনের পথে। বৌদ্ধ ধর্মে জন্মান্তরের বিরতি নেই। জাতকচক্র তাই নরকের চেয়েও ভয়াবহ। জন্ম-জন্মান্তরের এই পথচলা সত্যই ক্লান্তিদায়ক। 'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি/'-এখানে প্রথম প্রশ্ন হলো জন্ম থেকে জন্মান্তরে বিরামহীন যাত্রার সঙ্গে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে অনেক পরিভ্রমণের কথা আসছে কেন? একটি সহজ ব্যাখ্যা এই রকম যে, কবি এখানে সিংহল সমুদ্র ও মালয় সাগর আক্ষরিক অর্থে নয়, রূপক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ভূগোলে সিংহল সমুদ্র ও মালয় সাগর নামে কোনো সমুদ্র নেই। আরেক লাইনের 'নিশীথের অন্ধকারে' কথাটি যদি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে স্পষ্টতই জানব, হাজার বছর ধরে রাতের আঁধার থাকে না। অন্ধকার এখানে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এ অন্ধকারের উৎস খুঁজতে হবে বৌদ্ধ দর্শনে। অন্ধকার হলো বোধির বিপরীতার্থক শব্দ। এ অন্ধকার হলো, সত্যকে দেখতে না পারা বা চিনতে না পারা ও নিজের জীবনের প্রকৃতস্বরূপ অনুধাবনে ব্যর্থতা। -'
আকবর আলি খাঁন ( সূত্র ; দৈনিক কালের কণ্ঠ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন