বাংলাদেশে আনন্দের দুই ঈদ ও
রামাদান পালনের একাল
ও সেকাল : ( ইতিহাসের আলোকে )
- মুনতাসীর মামুন
সব কিছুরই একটা ইতিহাস আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে
ইতিহাস চর্চা করতে গেলেই বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।
যেমন, ধরুন, আমি যদি বলি দেড়শ’-দু’শ’ বছর আগে এখানে ঈদ তেমন কোন উৎসব হিসেবে পালিত হতো না, তা পড়ে অনেকে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। হয়ত তাদের ধারণা, এ ভূখণ্ডে সব সময়ই মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা ঈদ সম্পর্কে জানত না, এ কেমন কথা! কিন্তু বিষয়টা তো সত্যি। আজকের ঈদ পালন আর আগের ঈদ পালনে অনেক তফাৎ ছিল এবং সেটিই হচ্ছে ইতিহাস।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, বিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞাসা মেলে না। জ্ঞানের উৎস জিজ্ঞাসা। আর রসুল (দঃ) নিজেও বলেছেন জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীনেও যেতে। সুতরাং বর্তমান আলোচনা সে পরিপ্রেক্ষিতেই, কারও ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেয়ার জন্য নয়।
সম্প্রতি ইসলামী পার্বণের সামাজিক নৃতত্ত্ব নামক এক প্রবন্ধে বাহারউদ্দিন সামগ্রিকভাবে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন তিনি রমজান, হজ সম্পর্কেও, মূলত প্রাচীন লোকবিশ্বাসের, পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রবন্ধকার জানিয়েছেন, ‘ঈদ, সওম এবং রমজানের মূল অর্থ এবং তাদের উৎসভূমির ভিত্তিতেই অনুমান হয় রোজার উপবাস জন্ম নিয়েছে কৃষিনির্ভর সমাজে হয়তবা প্রাচীন সিরিয়ায়।’
রমজান মাস মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস এবং কোরানে একমাত্র এ মাসের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এ মাসেই নাজেল হয়েছিল কোরান, প্রথম অহী পেয়েছিলেন মুহম্মদ (দঃ), গিয়েছিলেন তিনি মেরাজে। বাহারউদ্দিনের মতে, মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার আগে রমজানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না মুসলমানদের। এর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল হিজরতের পরেই।
এ অনুমানের ভিত্তি “রমজান
শব্দটি আরবি ‘রমজ’ ধাতু থেকে আগত। ‘রমজ’ মানে দাহ, তাপ, পোড়ানো। আরবি শব্দ-তাত্ত্বিকদের ধারণা, চান্দ্র মাস চালু হওয়ার
[চান্দ্র বর্ষই নিয়ন্ত্রিত করে মুসলমানদের উৎসব]
অনেক আগে, প্রাচীনকালে গরমের মওসুমে এই মাস পড়ত বলে এর নাম হয় রমজান। রমজানের সঙ্গে উপবাসের আরবি প্রতিশব্দের
ধ্বনিগত কোন মিল নেই। উপবাসের আরবি
প্রতিশব্দ হচ্ছে সওম। এর অর্থের সঙ্গেও
উপবাস ব্রতের কোন মিল নেই। এর
অর্থ হলো আরাম বা বিশ্রামে থাকা।
...এবং হিজরতের পরেই সম্ভবত ইহুদি সিরিয়াক সূত্র
থেকে উপবাসের প্রতিশব্দ হিসেবে সওম শব্দটি গ্রহণ করেন মুহম্মদ। কোরানের ১৯ নং সুরা মরিয়মের ২৭ নং আয়াতে সওম
শব্দটির উল্লেখ আছে।”
দ্বিতীয় হিজরিতে নির্দেশ এসেছিল অবশ্য-কর্তব্য হিসেবে রমজান পালনের এবং এ উপবাসের সঙ্গে মিল আছে আবার পূর্বাঞ্চলীয় খ্রীস্টানদের, যারা নির্দিষ্ট সময়ে চল্লিশ দিন পালন করেন উপবাস। রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর। ঈদের অর্থ উৎসব। তবে, ‘আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বার বার ফিরে আসা।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান
জ্ঞাপক অধিকাংশ শব্দের মতো ঈদ শব্দটি মূলত সিরিয়াক।’ আরও লিখেছেন
বাহারউদ্দিন ‘ঈদ শব্দটির অর্থের সঙ্গে আজকের অর্থের কোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু সামাজিক উৎসবের প্রকৃতিকে অর্থবহ করে তোলে তার আদি অর্থ। সামাজিক উৎসব বার বার ফিরে আসে, আর ঈদ শব্দের আদি অর্থেও আছে তার ইঙ্গিত।
ঈদ শব্দটির আদি অর্থ ও
তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম খতিয়ে দেখে মনে হয়, হয়ত এককালে এই ধরনের
এক সামাজিক উৎসবের সঙ্গে পরিচিত ছিল সিরিয়ার জনগোষ্ঠী। হয়ত তার কৃষিজ আচারেই অন্তর্ভুক্ত ছিল এই উৎসব
এবং তাদের কাছ থেকে আচার-অনুষ্ঠান জ্ঞাপক শব্দের মতই আরবরা আমদানি করেছেন এই উৎসব
ও তার প্রকৃতিকে।’
একই কথা প্রযোজ্য ঈদ-উল-আজহা ও হজ সম্পর্কে যার সঙ্গে যোগ আছে ‘আরব কিংবা অন্য কোন সেমিটিক জনগোষ্ঠীর বনান্ন’ উৎসবের।
একই কথা প্রযোজ্য ঈদ-উল-আজহা ও হজ সম্পর্কে যার সঙ্গে যোগ আছে ‘আরব কিংবা অন্য কোন সেমিটিক জনগোষ্ঠীর বনান্ন’ উৎসবের।
বাংলাদেশে যেভাবে এ উৎসব দুটি পালিত হতো, তাতে আমরা দেখব সেখানে প্রভাব ফেলেছিল কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস। এবং সে লোকায়ত বিশ্বাস বিশ্লেষণ করলে সহজেই নস্যাৎ হয় সে মিথ্যের যে, এদেশে মুসলমানরা বহিরাগত। কারণ, যেভাবে পালিত হতো উৎসব দুটি তাতে লোকায়ত বিশ্বাস বা আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির প্রভাবই ছিল বেশি।
দুই
উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ঈদের দিনটি কিভাবে পালন করতেন সে সম্পর্কে অবশ্য খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এ ধরনের উৎসব সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল আত্মজীবনী, সাহিত্য বা সমসাময়িক সংবাদ-সাময়িক পত্রে। সাহিত্য, সংবাদ-সাময়িক পত্রে ঈদের তেমন কোনো বিবরণ পাই না। আর হিন্দু বা মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখে গেছেন তিনিই দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মুহররম, এমন কি রথযাত্রা বা বিভিন্ন পূজা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন; করেননি উল্লেখ শুধু ঈদ সম্পর্কে। অবশ্য এ শতাব্দীর প্রথম দু’তিন দশকে যাঁরা জন্মেছিলেন, তাঁদের আত্মজীবনীতে ঈদ-উল আজহা বা কোরবানী বা রমজান সম্পর্কে খানিকটা তথ্য আছে।
এ থেকে যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ঈদ-উল-ফিতর বাংলাদেশে তেমন বড় কোন উৎসব হিসেবে পালিত হয়নি, তাহলে কি ভুল হবে? মনে হয় না। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করি বা যে ঈদকে দেখি আমাদের একটি বড় উৎসব হিসেবে তা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র।
এর কয়েকটি কারণ থাকতে
পারে। ঔপনিবেশিক আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের
সঙ্গে পালিত হতো এবং যে ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল তা
ক্রিসমাস। হলো এর কারণ স্বাভাবিক। ইংরেজরা ছিল শাসক। সুতরাং তাদের উৎসব যে শুধু জাঁকালো হতো না নয়, এ নিয়ে মাতামাতিও কম হতো না। স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও যোগ দিতেন ক্রিসমাসে। তৎকালীন বাংলায় কলকাতা ছিল ক্রিসমাস উৎসব
পালনের প্রধান কেন্দ্র। কারণ কলকাতা ছিল
রাজধানী এবং শাসকগোষ্ঠী ও শহুরে সম্পন্ন ভদ্রলোকদের বেশিরভাগ সেখানেই থাকতেন। তবে গ্রামাঞ্চলের কথা দূরে থাক শহর বা মফস্বলের
সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ছিল না।
ঐ সময় বিত্ত, বিদ্যার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে মুসলমানদের থেকে হিন্দুরা সম্প্রদায় হিসেবে এগিয়ে ছিলেন অনেক। ফলে ক্রিসমাসের পর সরকারীভাবে তো বটেই, সম্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এ অঞ্চলে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। সরকারী ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল বেশি। পূজার ছুটিতে সম্পন্ন ভদ্রলোকরা বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে। আসতেন জমিদাররা শহর থেকে প্রজাদের খোঁজ খবর নিতে। বিত্ত ছিল তাঁদের, সুতরাং ধুমধামের সঙ্গে উৎসব পালনে বাধা ছিল না। পূজা চলত কয়েক দিন এবং সে উপলক্ষে হতো যাত্রা, কবিগান, নাচ। গ্রামের সাধারণ মানুষের। তো বিনোদন বলতে কিছু ছিল না [এখনও নেই], তাই ছেলে বুড়ো সবাই সাগ্রহে যোগ দিতেন উৎসবে। এসব কিছুর একটা ঝলমলে রঙিন দিক ছিল। তাই পূজার বর্ণনা আমরা প্রায় সব আত্মজীবনীতেই পাই। অন্যান্য নথিপত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্য।
পাকিস্তান হওয়ার আগে বাংলাদেশের মুসলমানরা আধিপত্য বিস্তারকারী সম্প্রদায় ছিল না। একশো বা দেড়শো বছর আগে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের অবস্থা অনুমেয়। শাসক ইংরেজরা স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব দেয়নি মুসলমানদের ঈদকে। এর জন্য সরকারী ছুটি বরাদ্দ ছিল কম। ঐ সময় অনেক মুসলমান চাকুরেদের আবেদনপত্রে দেখা যায়, তাঁরা আবেদন জানাচ্ছেন ছুটি বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি তাতে। আর ছুটি বৃদ্ধি করলেই বা কি হতো? বড় জোর গ্রামের বাড়িতে ফিরে পরিবার পরিজনদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে যেতে পারতেন। ঈদকে উৎসবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলমান ছিল বিত্তহীন।
মুহররমের বর্ণনা পাওয়া যায় অনেক জায়গায়, সংবাদপত্রেও। এটি পালিত হতো বেশ জাঁকজমক করে, বিশেষভাবে ঢাকায়। কারণ, নবাবী আমল থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা ছিল এর পেছনে। তাছাড়া মুহররম চলতও সপ্তাহখানেক ধরে জাঁকজমকের ব্যাপারটাও জড়িত ছিল এর সঙ্গে।
ঈদ মুসলমানদের প্রধান
উৎসব হিসেবে পালিত না হওয়ার আরেকটি কারণ, বিশুদ্ধ ইসলাম
সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। ফারায়েযী
আন্দোলনের আগে গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের কোন ধারণা ছিল না বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল বেশি।
[প্রায় ক্ষেত্রে হিন্দু
রীতিনীতির] ১৮৮৫-এর দিকে জেমস ওয়াইজ লিখেছিলেন, বাংলাদেশের
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সরল, অজ্ঞ কৃষক। তারা এখন ইসলাম ধর্মে যে সব বিজাতীয় রীতিনীতি
প্রবেশ করেছিল, তা উৎপাটন করতে চাইছে। কিন্তু, এরপর ওয়াইজ যে উদাহরণ
দিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে, কৃষকরা এর পথ খুঁজে
পাচ্ছে না। লক্ষ্যা নদীর তীরে, কোরবানী ঈদের সময় গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছে নামাজ পড়বেন বলে। কিন্তু জমায়েতের একজনও জানতেন না কিভাবে ঈদের
নামাজ পড়াতে হয়। তখন নৌকোয় ঢাকার এক
যুবক যাচ্ছিলেন। তাঁকে ধরে এনে পড়ানো
হয়েছিল নামাজ।
আমার এক সহকর্মীর পিতা যিনি ছিলেন একজন পীর, তাঁকে বলেছিলেন, মুসলমান ছিলেন বটে [তাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালে] কিন্তু ছেলেবেলায় রোজা বা ঈদ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না। মসজিদ ছিল হয়ত কয়েক গ্রাম মিলে একটি। উনিশ শতকে এবং গত শতকের প্রথম দিকে কৃষ্ণকুমার মিত্র ছিলেন বাংলার এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। সঞ্জীবনী পত্রিকার তিনি ছিলেন সম্পাদক। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন “তখন ফরায়েজী আন্দোলন আরম্ভ হয় নাই। মুসলমানেরা নামাজ পড়িত না। গ্রামে কোন মসজিদও ছিল না। স্থানে স্থানে দরগা ছিল। মুসলমানেরা তপন (তহবন্দ) বা লুঙ্গি পরিত না। কাছাকোঁচা দিয়া ধুতি পরিত। তাহাদের অনেকেরই হিন্দু নাম ছিল, যেমন গোপাল, সনাতন, ঈশান ইত্যাদি।
মুসলমানেরা দুর্গা
কালী প্রভৃতির পূজার ভোগের জন্য মানকচু, কুমড়া ও বলির জন্য
পাঁঠা দিত। তাহাদের দরগায় গরু
প্রভৃতি জন্তুর মূর্তি রাখা হইত। মাদার
বাঁশের অর্চনা হইত। এ কথা উল্লেখ করেছেন
আবুল মনসুর আহমদও। বাঁশের উপরে লম্বা চুল
বাঁধিয়া হিন্দু মুসলমান সকলের বাড়িতেই যাইত এবং চাউল পয়সা সংগ্রহ করিত। দরগাতে সিন্নি দেওয়া হইত। (অষ্ট নাগের পূজার জন্য) মুসলমানেরা বলির জন্য
হাঁস দিত। মুসলমানেরা সেকালে
কালী পুজার সময়েও বলির জন্য পাঁঠা দিত, দুর্গাপুজার সময়ে ডিম
দিত।
(অন্যদিকে) কাগমারীর হিন্দু জমিদারেরা বিবাহাদি
শুভ অনুষ্ঠানের পূর্বে বাদ্যভা-সহ দরগার নিকটে যাইতেন এবং নানা উপাচারে দরগার
অর্চনা করিয়া বাটীতে ফিরিতেন। দরগার
নিকটে বাদ্যভা- করিলে মুসলমানদের খুব আনন্দ হইত।”
আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনীতেও মোটামুটি একই চিত্র পাই। জানিয়েছেন তিনি সে সময় (উনিশ শতকের শেষার্ধেও) নামাজ রোজা চালু ছিল না। তাদের অঞ্চলে ছিল না কোন মসজিদ, গ্রামাঞ্চলে কিভাবে রোজা পালিত হতো তার বিবরণও দিয়েছেন তিনি।
“তরুণদের ত কথাই নাই, বয়স্কদেরও সকলে রোজা রাখিত না। তারাও দিনের বেলা পানি ও তামাক খাইত। শুধু ভাত খাওয়া হইতে বিরত থাকিত। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হইত না এই
বিশ্বাস তাদের ছিল। কারণ পানি তামাক
খাইবার সময় তারা রোজাটা একটা চোঙ্গার মধ্যে ভরিয়া রাখিত।
কায়দাটা ছিল এই একদিকে
গিরাওয়ালা মোটা বরাক বাঁশের দুই একটা চোঙ্গা গৃহস্থের বাড়িতে আজও আছে। আগেও থাকিত, তাতে সারা বছর পুরুষরা
তামাক রাখে। মেয়েরা রাখে লবণ সজ
গরম মসলা, লাউ কুমড়ার বিচি ইত্যাদি, রোজার মাসে মাঠে যাইবার সময় এই রকম এক একটা চোঙ্গা রোজাদাররা সঙ্গে
রাখিত। পানি তামাকের শখ হইলে
এই চোঙ্গার খোলামুখে মুখ লাগাইয়া খুব জোরে দম ছাড়া হইত। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা
নেকড়া বা পাটের ঢিপলা দিয়া চোঙ্গার মুখ কষিয়া বন্ধ করা হইত যাতে বাতাস বাহির হইয়া
না আসে। তারপর আবশ্যক মত পানি
তামাক খাইয়া চোঙ্গাটা আবার মুখের কাছে ধরা হইত। খুব ক্ষিপ্র হস্তে চোঙ্গা টিপলাটা খুলিয়া মুখ
লাগাইয়া মুখ চুষিয়া চোঙ্গার বন্ধ রোজা মুখে আনা হইত এবং ঢোক গিলিয়া একেবারে পেটের
মধ্যে ফেলিয়া দেয়া হইত। খুব ধার্মিক ভাল মানুষ
দু’একজন এমন করাটা পছন্দ করিতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে
এটাই চালু ছিল।”
তবে, এর চার দশকের মধ্যে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে মুসলমানরা সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই রাজনীতিতে ধর্ম ছিল একটি প্রধান উপাদান।
বাংলাদেশে মুঘলদের আগমন বা তার আগে ঈদের বর্ণনা তেমন একটা পাওয়া যায় না।
তবে, অভিজাতদের ঈদ পালন সম্পর্কে একটি চিত্র পাওয়া যায়।
‘তাবাকাৎ-ই-নাসিরী’র লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ জানিয়েছেন, সুলতানরা রমজান মাসে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। প্রচারক নিযুক্ত করতেন এ জন্য। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য নিয়োগ করতেন ইমাম। ‘শহরের বাইরের বিরাট উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এসব স্থানকে ঈদগাহ্ বলা হ’ত।’
‘তাবাকাৎ-ই-নাসিরী’র লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ জানিয়েছেন, সুলতানরা রমজান মাসে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। প্রচারক নিযুক্ত করতেন এ জন্য। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য নিয়োগ করতেন ইমাম। ‘শহরের বাইরের বিরাট উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এসব স্থানকে ঈদগাহ্ বলা হ’ত।’
বাংলাদেশে ঈদের সবচেয়ে পুরনো বর্ণনা পাওয়া যায় মির্জা নাথানের লেখায়। ঈদ-উল-ফিতরের সময় তিনি ছিলেন বোকাই নগরে। তিনি লিখেছেন
‘সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় যখন নতুন চাঁদ দেখা গেল তখন শিবিরে বেজে উঠল শাহী তূর্য এবং একের পর এক গোলন্দাজ বাহিনী ছুঁড়তে থাকে গুলি যেন তা আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলে এ আতশবাজি। শেষ রাতের দিকে বড় কামান দাগান হয়। তাতে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্পের অবস্থা।’
নবাবী আমলে ঈদ পালনের বর্ণনাও পাওয়া যায় কিছু। তবে, সেসব বর্ণনা বহিরাগতদের ঈদ পালনে। বাঙালি মুসলমান থেকে ঈদ বা ধর্ম সম্পর্কে তাদের জানাটা ছিল বেশি। তবে, মুঘলরা ঈদকে গুরুত্ব দিতেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনও মুঘল আমলে নির্মিত অনেক শাহী ঈদগাহর ধ্বংসাবশেষ দেখা যাবে।
ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে
মুঘল আমলে নির্মিত ঈদগাহটি এর উদাহরণ। ইংরেজ
আমলে জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ছিল ঈদগাহটি। তায়েশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তবুও উনিশ শতকে [খুব সম্ভব শেষের দিকে] শহরের মুসলমানরা ঈদের নামাজ
পড়তেন এই ঈদগাহে এবং এখানে আয়োজন করা হতো একটি মেলার।
অনুমান করে নিতে পারি, ঈদ উপলক্ষে এখানে হতো মেলা, সেখানে যোগ দিতেন শহর
ও আশপাশের এলাকার লোকজন।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, মুঘল আমলে ঈদের দিন ঈদগাহে যেতেন মুঘলরাই, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে ছিল না। তবে, তায়েশ উল্লেখিত মেলার বর্ণনা থেকে অনুমান করে নিতে পারি, উনিশ শতকের শেষে এবং এ শতকের গোড়ায় ঈদের দিন আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে সাধারণ মানুষ যোগ করেছিলেনও একটি লোকায়ত উপাদান মেলা। তায়েশের বর্ণনা ছাড়া [তাও সম্পূর্ণ নয়] মেলার কথা আত্মজীবনীতে অবশ্য তেমন পাওয়া যায় না।
তবে, বয়োবৃদ্ধদের কাছে শুনেছি, ছেলেবেলায় ঈদ উপলক্ষে
তাঁদের কোথাও কোথাও মেলা বসার কথা মনে পড়ে। সম্প্রতি আশরাফ-উজ-জামান তাঁর আত্মজীবনীমূলক এক নিবন্ধে এই মেলার কথা
উল্লেখ করেছেন। “ঈদের মেলা হতো
চকবাজারে এবং রমনা ময়দানে। বাঁশের
তৈরি খাঞ্চা, ডালা আসত নানা রকমের। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানায় খাবারের দোকান বসত সুন্দর করে সাজিয়ে। কাবলীর নাচ হ’ত বিকেল বেলা।” আশরাফ-উজ-জামান যে
সময়ের কথা লিখেছেন তা সম্ভবত ত্রিশ চল্লিশের দশক। চকবাজারে, কমলাপুরে এখনও হয়তো
সেই মেলার রেশ ধরে মেলা বসে। তবে
ঢাকা শহরেই নয়, ঢাকার বাইরেও ঈদ উপলক্ষে মেলা বসত। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা
বাংলাদেশের মেলার যে তালিকা প্রণয়ন করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, এখনও ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে বারোটি মেলার
আয়োজন করা হয়।
তিন
আগেই বলেছি, ঈদ সম্পর্কে যে স্বল্প বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকে ধরে নেয়া যায়, রমজান মাস থেকেই শুরু হ’ত ঈদের প্রস্তুতি। এ উৎসাহের শুরু হ’ত রমজানের চাঁদ দেখা থেকে। মনে হয় এটি মুঘল প্রভাবের কারণ এবং তা সীমাবদ্ধ ছিল শহুরে বিশেষ করে ঢাকার এবং মফস্বল বা গ্রামের সম্পন্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর তেমন যোগ ছিল বলে মনে হয় না। আর রোজা সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলের লোকদের ধারণা কি ছিল, তাতো আগেই উল্লেখ করেছি। উনিশ শতকের শেষের দিকে ময়মনসিংহে ঈদের কথা বলতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন-“এ অঞ্চলে কোন মসজিদ বা জুমার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জামাত হইত বটে কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইত। কাজেই জামাতে খুব অল্প লোক হইত। ঈদের মাঠে লোক না হইলেও বাড়ি বাড়ি আমোদ-সামুদ হইত খুব। সাধ্যমত নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান বাজনা করিত। সারা রাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।” আবুল মনসুর আহমদের এ তথ্যে নতুনত্ব আছে। কারণ আর কারো রচনায় এ ধরনের বর্ণনা পাইনি। হয়তো আরো অনেক জায়গায় গান বাজনা হ’ত। ঢাক-ঢোল গান বাজনা লোকায়ত উপাদানের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঐ সময়কার ঈদের জামাতের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তাতেও নতুনত্ব আছে- “ঈদের জামাতেও লোকেরা কাছাধূতি পরিয়াই যাইত। নামাযের সময় কাছা খুলিতেই হইত। সে কাছটাও নমাযে দাঁড়াইবার আগে তক করিত না। প্রথম প্রথম নমাযের কাতারে বসিবার পর অন্যের অগোচরে চুপিচুপি কাছা খুলিয়া নমায শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই কাছা দিয়া ফেলিত।”
এ শতকের প্রথম দিকে সিলেটে চাকরিজীবী
খান্দানী কিন্তু স্বল্পবিত্তের একটি পরিবারের ঈদ পালনের সাদামাটা একটি বর্ণনা
পাওয়া যায় সাহিত্যিক সৈয়দ মুর্তজা আলীর লেখায় “ঈদ শবেবরাতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে মা
সিমাই সমুসা পব [ময়দার আবরণে নারকেল কোরা ও চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি দ্রব্য], আজ ওয়াইন [ক্রোয়ান] রুটি তৈরি করতেন। রুটি তৈরি করা হ’ত ময়দা ও হলুদ গুলে। এগুলি দিয়েই সমুসা পব তৈরি হ’ত। কখনও কখনও রুটি তৈরি করা হ’ত চালের গুঁড়া দিয়ে
সমুসাতে দেওয়া হ’ত ভাজা মাছ বা মাংস।”
মুর্তজা আলীর বড় ভাই সৈয়দ মুস্তফা আলী তাঁর আত্মজীবনীতে আরেকটু বিশদ বর্ণনা রেখে গেছেন “শীতের দিনে রোযা শুরু হয়েছে। সমস্ত দিনের কর্মসূচি পালটিয়েছে। মা খুব ভোরে উঠে আমাদের খাইয়ে দাইয়ে রোদে বসেছেন। আমরা সকলে শিউলী ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে লাল বোঁটা একত্র করছি। মা পাশে বসে সেমাই তৈরি করছেন। ...সেমাই ডালার উপর রেখে মা রৌদ্রে শুকোতে দিলেন। শিউলির বোঁটাও রৌদ্রে দিলেন। তারপর মা কাপড় কেটে পাজামার মাপ নিলেন...সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গায়ের জামার মাপ। আমাদের কি আনন্দ। পয়লা রোযা হতে নিত্য চললো ঈদের প্রস্তুতি।
পঞ্চাশ বছর পূর্বের
(১৯১৮-এর দিকে) কথা বলছি।...সন্ধ্যার সময় শিউলির
বোঁটা উঠিয়ে মা একটি বোতলের ভেতর রাখলেন আর সেমাই ভর্তি করলেন বিস্কুটের টিনে। ...ঈদের দিন মা রাঁধবেন কোরমা পোলাও। আর জরদাতে দিবেন ঐ শিউলী ফুলের বোঁটার রং-
তাতে জরদার শুধু যে রং খোলতাই হবে তা নয়- চমৎকার ঘ্রাণও বেরুবে। আর সেমাই তৈরি হবে- যে সেমাই মা নিজের হাতে
সারা মাসভর করেছেন; আমাদের গায়ে উঠবে মার
নিজের হাতে সেলাই জামা পাজামা। মাকে
নিয়েই ঈদ আর ঈদের খুশীর সব, তাতে রয়েছে মার হাতের
স্নেহের পরশ। এ খুশী ভুলবার নয়।”
গত শতকের তৃতীয় চতুর্থ দশকের গ্রামাঞ্চলে ঈদ পালনের আরেকটি বর্ণনা পাই খন্দকার আবু তালিবের নিবন্ধ থেকে “রোজার পনেরো দিন যাওয়ার পর হতেই গৃহবধূরা নানা রকম নক্সী পিঠা তৈয়ার করতে আরম্ভ করত। এদের মধ্যে ফুল পিঠা, পাপর পিঠা, ঝুরি, হাতে টেপা সেমাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শবে কদরের রাতে মেয়েরা মেহদী এনে তা বেঁটে হাতে নানা রকম চিত্র আঁকত। ফুল পিঠা তৈয়ার করার সময় বউয়েরা ‘প্রিয় স্বামী’, আর অবিবাহিত মেয়েরা ‘বিবাহ’ ও ‘প্রজাপতি’ এঁকে রাখত। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী বন্ধু-বান্ধবীদের পাতে দেয়ার জন্য্ইে এ ধরনের ফুল পিঠা তৈয়ার করা হ’ত।... গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে ঈদের ‘মিলন’ ছিল একটা বড় রকমের উপলক্ষ।
গত শতকের তৃতীয় চতুর্থ দশকের গ্রামাঞ্চলে ঈদ পালনের আরেকটি বর্ণনা পাই খন্দকার আবু তালিবের নিবন্ধ থেকে “রোজার পনেরো দিন যাওয়ার পর হতেই গৃহবধূরা নানা রকম নক্সী পিঠা তৈয়ার করতে আরম্ভ করত। এদের মধ্যে ফুল পিঠা, পাপর পিঠা, ঝুরি, হাতে টেপা সেমাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শবে কদরের রাতে মেয়েরা মেহদী এনে তা বেঁটে হাতে নানা রকম চিত্র আঁকত। ফুল পিঠা তৈয়ার করার সময় বউয়েরা ‘প্রিয় স্বামী’, আর অবিবাহিত মেয়েরা ‘বিবাহ’ ও ‘প্রজাপতি’ এঁকে রাখত। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী বন্ধু-বান্ধবীদের পাতে দেয়ার জন্য্ইে এ ধরনের ফুল পিঠা তৈয়ার করা হ’ত।... গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে ঈদের ‘মিলন’ ছিল একটা বড় রকমের উপলক্ষ।
ঈদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে
তখনকার দিনে নানা সমস্যার হ’ত সমাধান। চিরশত্রুও
তার শত্রুতা ভুলে যেত।”
উপরে যে বর্ণনাগুলি দিলাম তাতে দেখা যায়, ঈদের একটি প্রধান আনন্দ খাওয়া- একটু বিশেষ ধরনের। চাকরিজীবী পরিবারে- মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে খাবারের মধ্যে থাকত কোরমা পোলাও, ঘরে প্রস্তুত নানা রকমের পিঠা, সেমাই ও শিউলি বোঁটার রংয়ে মাখানো জরদা। এখানে লক্ষণীয়, মুঘল খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় (লোকায়ত) উপাদান। অবিবাহিত মেয়েরা পিঠার ওপর প্রজাপতি আঁকতেন। এই প্রজাপতি, বহুকাল ধরে বাঙালীদের কাছে বিয়ের প্রতীক, একেবারে লোকজ উপাদান। এভাবে, ঈদের খাওয়া-দাওয়ার মুঘল ও দেশীয় উপাদান মিলে মিশে গিয়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই। তবে, শহরে এই দেশীয় উপাদানের ছিল অভাব। সে কথায় পরে আসছি। তবে, বলে রাখা ভাল, গ্রামাঞ্চলে একেবারে সাধারণ মানুষ কোরমা পোলাওর কথা কখনও চিন্তা করেনি, এখনও করে না। তাদের ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠত ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন।
আসলে, ঈদের পুরো ব্যাপারটার একদিকে ছিল খাওয়া-দাওয়া, অন্যদিকে নতুন কাপড়-চোপড়। ঈদের
দিন পরার জন্য মা চাচীরাই প্রধানত ঘরে বসে বাচ্চাদের নতুন কাপড় সেলাই করে দিতেন
যার বর্ণনা আগে আমরা পেয়েছি। কামরুদ্দীন
আহমেদ জানিয়েছেন, ঈদের দিন সম্পন্ন ঘরের লোকজন পরতেন
আচকান, পায়জামা ও জড়োয়া টুপি। ডাঃ আবদুল বাসেত লিখেছেন, বরিশালে, বাচ্চাদের জন্যই যেন
ছিল ঈদ। কারণ, সেদিন তারা নতুন কাপড় পরত। এবং
সে কাপড় ছিল পাঞ্জাবী, আচকান এবং টুপি। ঈদের দিন টুপির এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। আবু তালিব লিখেছেন, ‘আমার মনে পড়ে আমার জন্য একটি লাল কাগজের টুপি আনতে বড় ভাইকে চার পয়সা
দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে ঈদের
বাজারে রঙ-বেরঙের কাগজের টুপি প্রচুর পাওয়া যেত। এই টুপিগুলো শুধুমাত্র ঈদের দিনেই ব্যবহৃত হ’ত।’ নামাজে যাবার আগে বা
নামাজ থেকে ফিরে সবাই গুরুজনদের কদমবুসি করে যেত।
এই যে পাজামা-পাঞ্জাবি বা আচকান এগুলির ব্যবহার শুরু হয়েছিল খুব সম্ভব এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। এবং যারা শুরু করেছিলেন তাদের পরিবারের কর্তারা চাকরি করতেন মফস্বল শহরে। গ্রামাঞ্চলে, আবুল মনসুর যেমন জানিয়েছেন, ধুতির প্রচলনই ছিল ব্যাপক।
এই যে পাজামা-পাঞ্জাবি বা আচকান এগুলির ব্যবহার শুরু হয়েছিল খুব সম্ভব এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। এবং যারা শুরু করেছিলেন তাদের পরিবারের কর্তারা চাকরি করতেন মফস্বল শহরে। গ্রামাঞ্চলে, আবুল মনসুর যেমন জানিয়েছেন, ধুতির প্রচলনই ছিল ব্যাপক।
পরে অবশ্য ধুতির জায়গা করে নিয়েছিল লুঙ্গি।
ঈদের দিন জামাতে যাবার আগে বা জামাত থেকে ফিরে গুরুজনদের কদমবুসি করার ব্যাপারটা এই শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল ছিল। অপেক্ষাকৃত বয়োকনিষ্ঠরা গুরুজনদের এভাবে জানাতেন শ্রদ্ধা। বাচ্চারাও হুটোহুটি করে করত কদমবুসি। কারণ এর মধ্যে একটা মজা ছিল। যাকে কদমবুসি বা সালাম করা হ’ত তিনি যে সালাম করছে তার হাতেই কিছু ধরিয়ে দিতেন। এ প্রথা এখনও আছে ৷ তবে হাতে হয়ত এখন আর কিছু ধরিয়ে দেয়া হয় না। এটিই খুব সম্ভব চালু হয়েছিল হিন্দুদের প্রণামী দেয়া থেকে।
ঈদের দিন জামাতে যাবার আগে বা জামাত থেকে ফিরে গুরুজনদের কদমবুসি করার ব্যাপারটা এই শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল ছিল। অপেক্ষাকৃত বয়োকনিষ্ঠরা গুরুজনদের এভাবে জানাতেন শ্রদ্ধা। বাচ্চারাও হুটোহুটি করে করত কদমবুসি। কারণ এর মধ্যে একটা মজা ছিল। যাকে কদমবুসি বা সালাম করা হ’ত তিনি যে সালাম করছে তার হাতেই কিছু ধরিয়ে দিতেন। এ প্রথা এখনও আছে ৷ তবে হাতে হয়ত এখন আর কিছু ধরিয়ে দেয়া হয় না। এটিই খুব সম্ভব চালু হয়েছিল হিন্দুদের প্রণামী দেয়া থেকে।
ঈদের দিন, বিশেষ করে গ্রামে, জামাত যেখানে হ’ত তার চারদিকের সীমানা সাজানো হ’ত রঙিন কাগজের নিশান দিয়ে। মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে এ রেওয়াজ এখনও বর্তমান।
১৯৪৭-এর আগে, বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকা শহরেই ঈদ যা একটু ধুমধামের সঙ্গে পালিত হ’ত। ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান ও মুঘল শহর। তাই মুঘল ঈদের প্রভাব ছিল বেশি। তাছাড়া, এখানে থাকতেন নওয়াব ও অন্যান্য মুসলমান ধনাঢ্য ও শরীফ ব্যক্তিরা। ফলে ঈদ পেত পৃষ্ঠপোষকতা।
ঢাকার উপরের স্তরে যে রীতিনীতি চালু ছিল তা হ’ল খোসবাস বা সুখবাস সমাজ প্রভাবিত। হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘ঢাকার সমাজ ব্যবস্থা ও তখনকার তাহজীব-তমদ্দুন মূলত আগ্রারই সমাজ ব্যবস্থা ও তখনকার তাহজীব-তমদ্দুন। কিন্তু এই সমাজ কাঠামোতে ইরানীদের আধুনিক তমদ্দুন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। এদের মাধ্যমে শিয়া মত সংশ্লিষ্ট লোকদের মধ্যেও প্রবেশ লাভ করেছে। এই ধর্মীয় মতবাদটি অজ্ঞাতসারে উর্দুভাষী সুন্নীদেরকেও প্রভাবিত করেছে।’
উনিশ শতকের শেষার্ধ ও এ শতকের প্রথম দু’তিন
দশকের পরিপ্রেক্ষিতে এ মন্তব্য করেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। এর রেশ ঢাকা শহর থেকে এখনও মিলিয়ে যায়নি। খোসবাস সংস্কৃতির একটি উদাহরণ ছিল ঢাকার ঈদের
মিছিল। এ ধরনের মিছিল
বাংলাদেশের কোথাও বেরোত না। এ
সম্পর্কে জানা যায় আলম মুসাওয়ারের চিত্রমালা থেকে।
আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী, খুব সম্ভব উনিশ শতকের প্রথমার্ধে, ঢাকার ঈদ ও মুহররম মিছিলের ৩৯টি ছবি এঁকেছিলেন, যা রক্ষিত আছে জাতীয় জাদুঘরে। এ চিত্রমালা দেখলে বোঝা যায়, নবাবী আমলের ঢাকার মুহররম ও ঈদ মিছিলের বর্ণাঢ্য রূপ ও ব্যাপকতা। ছবিগুলি দেখে অনুমান করে নিতে পারি, নায়েব-নাজিমদের বাসস্থান নিমতলি প্রাসাদের ফটক থেকে [বর্তমান এশিয়াটিক সোসাইটির পেছনে] বিভিন্ন পথ ঘুরে, চক বাজার, হুসেনী দালান হয়ে সম্ভবত মিছিল আবার শেষ হ’ত মূল জায়গায় এসে। মিছিলে থাকত জমকালো হাওদায় সজ্জিত হাতি উট, পালকি। সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েব নাজিম। কিংখাবের ছাতি হাতে ছাতিবরদার। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছিল কাড়ানাকাড়া শিঙা। রঙবেরঙের নিশান মিছিলের রূপ দিত আরও খুলে। দর্শকরা সারি বেঁধে থাকতেন রাস্তার দু’পাশের ছাদে। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেশীয়। মুঘল [বহিরাগত], ইংরেজ সাহেব-মেম। রাস্তায় রাস্তায় ফকির যেমন ছিল তেমনি ছিল খেলা-দেখানেওয়ালা।
এ মিছিল কবে শুরু হয়েছিল তা জানা যায়নি। খুব সম্ভব নায়েব নাজিমরা নিমতলি প্রাসাদে এসে যখন বসবাস শুরু করেছিলেন [অষ্টাদশ শতকে], তখন থেকেই এই মিছিলের শুরু।
নওয়াবরা খুব সম্ভব এ
মিছিলের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ঢাকার বিখ্যাত জন্মাষ্টমী মিছিল থেকে এবং নিজেদের
আধিপত্য ও ঈদের জাঁকজমক দেখানোর জন্য শুরু করেছিলেন তাঁরা এ মিছিল। ঈদের মিছিল আবার কবে ঢাকা থেকে মিলিয়ে গিয়েছিল
তাও জানা যায় না। খুব সম্ভব উনিশ শতকের
মাঝামাঝি ঢাকার নায়েব নাজিমদের বংশ লুপ্ত হয়ে গেলে, সমাপ্তি ঘটেছিল এ মিছিলের। কারণ
ধনাঢ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এ ধরনের মিছিল সংগঠিত করা দুরূহ। এ শতকের বিশ ত্রিশের দশকে ঢাকায় রমজানের
শুরুতেই ঘরবাড়ি মসজিদ সব সাফ সুতরো করে রাখা হ’ত।
রমজানের চাঁদ দেখার
জন্য বিকাল থেকেই বড় কাটরা আহসান মঞ্জিল, হুসেনী দালানের ছাদে
ভিড় জমে যেত। ‘চাঁদ দেখা মাত্রই
চারিদিক হতে মোবারকবাদ, পরস্পর সালাম বিনিময়
এবং গোলাবাজি ও তোপের আওয়াজ হইতে থাকিত।’
ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল খাবার। রোজায় ঘরে অনেক রকম ইফতারি থাকলেও সবাই একবার চকে ছুটে যেতেন। চক সেই মুঘল আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য খাবার-দাবার আড্ডার কেন্দ্র। চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নুর আহমেদ। খাবারগুলি ছিল-শিরমলি, বাকেরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হান্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামী ও টিকা কাবাব, পরাটা, বোগদাদী রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল। চক এখনও প্রায় সে ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।
ঢাকার তোরাবন্দি খাবার ছিল বিখ্যাত। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এর ব্যবস্থা করা হ’ত। তার মানে ঈদের দিন রইস আদমীরা তোরাবন্দি খাবারের আয়োজন করতেন। এ ধরনের খাবারের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি আবু যোহা নুর আহমেদের লেখা থেকে ‘...রইসদের বাড়িতে এইসব খাবার প্রস্তুত হইত। নৌকা বানাইয়া লাল বনাতের নিচে সারি সারি বরতন ও পেয়ালা সাজাইয়া মেহমানদের সামনে এইসব খাবার রাখা হইত। এই খাবারের সারিতে থাকিত চারি প্রকারের রুটি, চারি রকমের পোলাও, চারি রকমের নানরুটি, চারি প্রকারের কাবাব, পনির, বোরানি, চাটনিÑ অর্থাৎ প্রত্যেক পদের খাবার চারি পদের থাকিত। মোট চব্বিশ পদের নিচে থাকিত না।’
চার
ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল খাবার। রোজায় ঘরে অনেক রকম ইফতারি থাকলেও সবাই একবার চকে ছুটে যেতেন। চক সেই মুঘল আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য খাবার-দাবার আড্ডার কেন্দ্র। চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নুর আহমেদ। খাবারগুলি ছিল-শিরমলি, বাকেরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হান্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামী ও টিকা কাবাব, পরাটা, বোগদাদী রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল। চক এখনও প্রায় সে ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।
ঢাকার তোরাবন্দি খাবার ছিল বিখ্যাত। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এর ব্যবস্থা করা হ’ত। তার মানে ঈদের দিন রইস আদমীরা তোরাবন্দি খাবারের আয়োজন করতেন। এ ধরনের খাবারের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি আবু যোহা নুর আহমেদের লেখা থেকে ‘...রইসদের বাড়িতে এইসব খাবার প্রস্তুত হইত। নৌকা বানাইয়া লাল বনাতের নিচে সারি সারি বরতন ও পেয়ালা সাজাইয়া মেহমানদের সামনে এইসব খাবার রাখা হইত। এই খাবারের সারিতে থাকিত চারি প্রকারের রুটি, চারি রকমের পোলাও, চারি রকমের নানরুটি, চারি প্রকারের কাবাব, পনির, বোরানি, চাটনিÑ অর্থাৎ প্রত্যেক পদের খাবার চারি পদের থাকিত। মোট চব্বিশ পদের নিচে থাকিত না।’
চার
উৎসবের সঙ্গে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক আছে এবং সেটি গভীর। বাংলাদেশে এখন মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের প্রসার হয়েছে। ঈদ পালনের মৌল বিষয়গুলি একই আছে কিন্তু তার জাঁকজমক বেড়েছে। ঈদের জামাত হয় বিশাল।
জাকাত প্রদানের পরিধি বেড়েছে।
উচ্চবিত্তরা ঈদকে
ভ্যাকেশন পালনের অজুহাত হিসেবে নিয়েছেন। উচ্চবিত্তদের একটি বড় অংশ এখন দেশের বাইরে চলে যান ঈদ পালনে। ঈদে একেবারে বঞ্চিত ছাড়া সবাই কিছু না কিছু
কেনাকাটা করেন। মধ্যবিত্তের জন্য ঈদ
ফ্যাশন চালু হয়েছে। ঈদ পর্যন্ত রমজানের
পুরো মাস কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় যা তিন দশক আগেও ছিল অভাবনীয়। মানুষ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদ উৎসব
হিসেবেই পালিত হচ্ছে।
আগে কিন্তু ছিল না, ঈদও তখন তেমন পালিত হতো না।
( সৌজন্যে; অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মানুন এবং দৈনিক জনকণ্ঠ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন