কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাস্তব জীবন ও সাহিত্য ও কবি জীবনের কিছু টুকিটাকি কথা "



                   কবি  কাজী  নজরুল  ইসলামের বাস্তব  জীবন  ও সাহিত্য  জীবনের  কিছু  টুকিটাকি  কথা :

নজরুল ও প্রমীলা। ছবি: সংগৃহীত
 ছবি - (তারিক মনজুর  এর  লেখা  থেকে  সংগ্রহিত )      
          
(  বিভিন্ন লেখকের  লেখা  থেকে সংকলন  করে  এই  লেখাটি  তৈরি          করা  হয়েছে )


সৌজন্যে - পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী ,   আহমদ ছফা ,   জাফর ওয়াজেদ ,   তারিক মনজুর ও 
   জোবায়ের আলী জুয়েল


নজরুল সত্য-সুন্দর ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন  তাই  তিনি
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে   বলতে  পেরেছেন  ;
         
    

 সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্মযে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে

দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈবআমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি তিনি সাম্যবাদী কবিতায় আরও লিখেছেন : 
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি
... ... ... ...
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীস্টান

         রাজবন্দীর জবানবন্দী-তে নজরুল লিখেছেন,

 আমি কবি
 আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য,
অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত
কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন
আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা
 ভগবানের বাণী
            



       “স্বাধীনতা হারাইয়া আমরা যখন আত্মশক্তিতে অবিশ্বাসী হইয়া পড়িলাম এবং আকাশমুখো হইয়া কোন অজানা পাষাণ দেবতাকে লক্ষ্য করিয়া কেবলি কান্না জুড়িয়া দিলাম; তখন কবির কণ্ঠে আকাশবাণী দৈববাণীর মতোই দিকে দিকে বিঘোষিত হইল, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ বাস্তুবিক আজ আমরা অধীন হইয়ছি বলিয়া চিরকালই যে অধীন হইয়া থাকিব, এরূপ কোন কথা নাইকাহাকেও কেহ কখনও চিরদিন অধীন করিয়া রাখিতে পারে নাই ইহা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ” (যুগবাণী : নজরুল)
                 কাজী নজরুল ইসলাম এক বাঁধভাঙা প্রতিভালেখালেখিতে যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমনি তাঁর জীবনও হাঁটেনি চেনা পথেলেখালেখি ও জীবনযাপন মিলিয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী
        


       
                   ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা সম্বলিত অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় যুগবাণী নামক প্রবন্ধগ্রন্থনবযুগ পত্রিকায় সাত মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও অন্য নিবন্ধগুলো থেকে বাছাই করে ২১টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করেন যুগবাণী সংকলন গ্রন্থতখননবযুগ  ঔপনিবেশীক  ব্রিটিশ  সরকারের  রাজরোষে পড়েছিলতাই  সেসব লেখার সংকলন প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যে তা সরকার নিষিদ্ধ করে, এই নিষেধাজ্ঞা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বহাল ছিল

             নজরুলের প্রথম গদ্যগ্রন্থটিই শুধু বাজেয়াপ্ত হয়নি, তাঁর আরও দুটি প্রবন্ধগ্রন্থও পরবর্তীকালে বাজেয়াপ্ত হয়েছেরুদ্রমঙ্গল (১৯২৬) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়এটিও দেশভাগের পর মুক্ত হয়১৯২৬ সালে প্রকাশিত অপর প্রবন্ধগ্রন্থ দুর্দিনের যাত্রী’কে    বাজেয়াপ্ত  করে  সরকার 
               
নজরুলের গ্রন্থ সংখ্যা ৫৩টিএর মধ্যে প্রবন্ধগ্রন্থ তিনটি ছাড়াও বাজেয়াপ্ত হয় চারটি কাব্যগ্রন্থ   সে  গুলো  হচ্ছে   বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙ্গার গান, প্রলয়শিখা (১৯৩০), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০)প্রথম দুটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এবং পরের দুটি এক বছর পর ১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয়এই গ্রন্থগুলোর একটিও নজরুলের অসুস্থতা  পর  আর প্রকাশিত হয়নি

              নজরুলের আরও কয়েকটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিলতবে তা করা না হলেও সেগুলোর বিক্রয় ও প্রচারে পুলিশি বাধা অক্ষুণ্য  ছিল

          যুগবাণী গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ নবযুগ,  পত্রিকার নামে  প্রকাশিত  হয়  তাতে নজরুল  লিখেন

              আজ নারায়ণ মানবতাহার হাতে স্বাধীনতার বাঁশিসে বাঁশির সুরে সুরে নিখিল মানবের অনুপরমাণু ক্ষিপ্ত হইয়া সাড়া দিয়াছেআজ রক্ত প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব নবপ্রভাত ধরিয়াছে  পোহাল পোহাল বিভাবরী, পূর্ব তোরণে শুনি বাঁশরি, এ সুর নবযুগেরসেই সর্বনাশা বাঁশির সুর রুশিয়া, আয়ার্ল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে এবং সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের হিন্দুস্তানজর্জরিত, নিপীড়িত, শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষ

          নজরুলের প্রথম গ্রন্থটি বেরিয়েছিল ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, এই  গল্পগ্রন্থটর  নাম  ছিল   ‘ব্যথার দান  তার  লেখা  প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা-কে   বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিলকিন্তু  তা করা হলো কবির প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশের ২৮ দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বরে
      
 আর তাদের ১৭৯৯ সালের ১৩ মে  সরকার  চালু করা প্রেস রেগুলেশন এ্যাক্ট বলবৎ করেরাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বহু বই-পুস্তক, নাটক, কবিতা, গান, লিফলেট, সাময়িকীপত্র, এমনকি গ্রামোফোন রেকর্ডও বাজেয়াপ্ত করা হয়বঙ্কিম, দীনবন্ধু, মুকুন্দ দাস, গিরীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের ধারায় কবি নজরুলের গ্রন্থও বাজেয়াপ্ত হয়তবে তাঁর গ্রন্থই সর্বাধিক বাজেয়াফত হয়৭টি পুরোপুরি আর ৫টির প্রচার ও বিক্রয়ে অলিখিত বাধা প্রদান করা হয়

এরপর বাজেয়াপ্ত করে যুগবাণী গ্রন্থটি
         ইংরেজ শাসক প্রথমে বাজেয়াপ্ত করে নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকাএই পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা প্রকাশের জন্যএরপর বাজেয়াপ্ত করে যুগবাণী গ্রন্থটি

     এর  পর   কবিকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়

       
      কলকাতায় বন্ধু মুজফফর আহমদের সাহচর্য তাঁকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক করে তোলেদেশমাতৃকার মুক্তির আকাক্সক্ষা হয়ে ওঠে তীব্রদুজনেই রাজনীতি করার ব্রত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সংবাদপত্র প্রকাশেরএবং তা সান্ধ্য দৈনিকশেরেবাংলা একে ফজলুল হকের অর্থায়নে নজরুল ও মুজফফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ বাজারে এলোপ্রথম সংখ্যা থেকেই তা পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে পত্রিকায় শিরোনাম দিতেন বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়েও
      
নবযুগ পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ নজরুলের রচনাস্বাধীনতার পক্ষে তাঁর কলম তখন জোরালোতাঁর লেখার জন্যই ব্রিটিশ সরকার নবযুগ প্রকাশক ফজলুল হককে সতর্ক করে দিয়েছিল বার তিনেককিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই যাঁদের লক্ষ্য, তাঁরা থেমে থাকবেন কেননজরুলের একটি জ্বালাময়ী প্রবন্ধের কারণে সরকার পত্রিকার জামানত এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিলনতুন করে অনুমতি পেতে ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে আবার নবযুগ প্রকাশ করা হলেও তাঁরা তা বেশিদিন চালাননি
সাত মাস পর ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁরা নিজেরাই পত্রিকা ছেড়ে দেনঅবশ্য পরে নতুন মালিকানায় নবুযগ প্রকাশ হলে নজরুল তাতে যোগ দিয়েও বেশিদিন থাকেননি নীতিগত কারণেনজরুল ততদিনে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন

      এক  সময় ক্ষুদিরামহয়ে উঠেছে নজরুলের মুক্তিকামী-চেতনার আদর্শ বা দৃষ্টান্ত:  কবি  তখন  লিখেন  ,  ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে’ (‘ক্ষুদিরামের মা’; রুদ্র-মঙ্গল)

         নজরুলনিজেকে সৈনিকহিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন: আমি দেবতা নই, আমি হিংস, বন্য, পশুআমি সুন্দর নই, বীভৎস।...আমি মঙ্গলের নয়, আমি মৃত্যুর।...যুগে যুগে পশু-আমার সৈনিক-আমার জয় হউক!!’ (‘আমি সৈনিক’; দুর্দিনের যাত্রী)নজরুল মনে করেছেন, ধ্বংসের মধ্য দিয়েই মঙ্গল ও সুন্দরের আগমন ঘটতে পারেতাই প্রলয়ের দেবতা শিব-ই তাঁর চালিকাশক্তি: রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনেরুদ্র।...আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে’ (রাজবন্দীর জবানবন্দী)নজরুল ঠিকই বুঝেছিলেন, ‘পরাধীনতার মত জীবন-হননকারী তীব্র হলাহল আর নাই’ (‘আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন?’; যুগবাণী)তিনি ভেবেছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য ভারতের হিন্দু-মুসলমানকে এক হতে হবেতাই প্রাসঙ্গিকভাবে তাঁর লেখায় এ বিষয়টিও প্রবল হয়ে উঠে এসেছেকিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রধান অন্তরায় ছোঁয়া-ছুঁয়ির জঘন্য ব্যাপারটাই’; যা কিনা কোনো ধর্মেরই অঙ্গ হইতে পারে না’ (‘ছুঁৎমার্গ’; যুগবাণী)বাহ্য-ধর্মের বিস্ফারে অন্তর্ধর্মকে সংকুচিত হতে দেখে নজরুল ক্ষুব্ধ হয়েছেন: হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অহস্য, কেননা ওই দুটোই মারামারি বাধায়’ (হিন্দু-মুসলমান’; রুদ্র-মঙ্গল)

           কাজী নজরুল ইসলাম        একদিন উল্কার মতো বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতজগতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেনকী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম, এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সেই বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ এবং আগ্রহব্যঞ্জক
আসলে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভা 

       
  • জাফর ওয়াজেদ
  •                      নজরুলের কাছে বাঙালী মসুলমান সমাজের অন্যতম প্রধান প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুল তাদের ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেনআর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালী সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেক দূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন (আহমদ ছফা )

         











      

 


     

               নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমাদ  বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন ষাট বছর   বয়সে  তার  জন্মের  তারিখ  জানা  যায়  নি   তিনি আরবি, ফারসি  বাংলা ও উর্দু ভাষা জানতেন, তবে তাঁর বাংলা ও উর্দু ভাষার ওপর রীতিমতো দখল ছিল

 তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দরচুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনিউচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তাঁর সুনাম ছিলকাজী  নজরুলের  দাদার নাম ছিল  কাজী আমিনুল্লাহ
         
কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেনপিতার ওয়ারিশ সূত্রে প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেনকিন্তু শেষ বয়সে এক বসতবাড়ি ছাড়া তাঁর বিষয় সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল নাতবে বিষয় সম্পত্তি হাত ছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশা খেলা    কাজী ফকির আহমদ তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়
কাজী ফকির আহমদের প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুনতিনি চুরুলিয়া গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেনতাঁর গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুনসৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুনকেতিনি চুরুলিয়ার পার্শ্ববর্তী ভুড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেনতিনি অতি দয়াবতী রমণী ছিলেনজাহেদা খাতুনের গর্ভে তিনপুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়কাজী সাহেবজান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুমকাজী সাহেব জান  কয়লা  খনিতে  কাজ  করতেন  এবং  অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।  তিনি  কম  বয়সে  মারা  যান  ৷


                      
কাজী আলি হোসেন পড়াশোনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবেপারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেনএলাকার কৃষক শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার, জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি নিজ গ্রামে প্রকাশ্যে খুন হন


                    
কাজী নজরুল কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে চুরুলিয়ায় গেলেসেখানে সপ্তাহ কাল ধরে অবস্থান করেন তিনিএই সময় মায়ের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয়ে অনেক আলাপ হয়  এবং  একপর্যায়ে  ভীষণ ঝগড়া বেধে যায় ছেলে  ও  মায়ের  মধ্যে   ঝগড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসেনএরপর তার মা যতদিন জীবিত ছিলেন   তাদের   আর  দেখা  হয়  নি   ইহকালে মায়ের ছেলে আর দেখা হয়নি


              
শোনা যায় নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরীসে সময় তাঁর বয়স ও ছিল কমএকজন কম বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমনী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণ পোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করতে   বাধ্য   হয়ে  ছিলেন     সম্ভবত নজরুল মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেননি

             এমনকি ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননিশেষবারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখেননি

  তবে   কবি   জীবদ্দশায়  কখনই এ সম্পর্কে মুখ খোলেননিফলে নজরুলের জীবনে এটি আজো অমীমাংসিত অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে

        তাই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে মা’ বলে সম্বোধন করেছেনতাঁদেরকে কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন তেমনি তাঁরাও তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেছেন 
             
নজরুলের ‘মা’ সম্বোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবরের খানের মেজোবোন নার্গিসের খালা আম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভবা দেবী, হুগলির মিসেস এম রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা

           নজরুল নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে যখন খাঁ পরিবারের সকলেই ছিলেন গররাজি তখন এই এখতারুন্নেসাই সকলেরও পরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস আক্তার খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে)এই এসময় এখতারুন্নেসা খানম মায়েরমতোই নজরুলের সকল আব্দার পূরণ করতেনতিনি ছিলেন নিঃসন্তান

              
বহু নারীর মাতৃস্নেহ-আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছেন কবিএমনি ধরনের আরেক বিপ্লবী অগ্নিকন্যা হেমপ্রভাকে নজরুল ‘মা’ বলে ডাকতেনএই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন ‘হেমপ্রভা’ কবিতাটি

               ১৩৩২ এর ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেনপ্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভা ও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেনকবি এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ১৯২৬ সালে রচনা করেন হেমপ্রভা কবিতাটি 

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলো আলোক জননী
প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হলো ধরণী


              
প্রমিলা নজরুলের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিলতাঁদের যখন বিয়ে হয় তখন প্রমীলার বয়স ১৪ আর নজরুলের ২৩মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা গ্রামে প্রমীলা  সেনগুপ্তার জন্ম 

             
প্রমীলার জ্যেঠী বিরজা সুন্দরী দেবীকে সে নজরুল ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন সে কথা তো সকলেরই জানাতিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ৩৯ দিনের অনশন ভঙ্গ করিয়েছিলেনসেদিন নজরুলের অনশন ভাঙ্গিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশ্যে বিরাজ সুন্দরী দেবী বলেছিলেন-“ খ্ইয়েছি পাগলকেকথা কি শোনে , বলে, না, অন্যায় আমি সইব নাশেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’মার আদেশ  সব ন্যায় অন্যায়   বোধের ওপরে। শেষে  লেবুর রস খাইয়ে এসেছি

                  ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় কবির বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ” সর্বহারা  ৷ 
করি এই গ্রন্থটি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন 

                হুগলীরত এক মহিয়সী নারী বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা এবং লেখিকা মিসেস এম রহমানকে ও নজরুল অপরিসীম শ্রদ্ধা ভক্তি করতেনতাঁকেও তিনি “মা” বলে ডাকতেনতাঁর প্রকৃত নাম মুসাম্মত মাসুদা খাতুনজন্ম ১৮৮৪ সালেহুগলির সরকারী উকিল খান বাহার্দুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম, রহমান নজরুল ইসলামকে বিশেষ স্নেহ করতেনতাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মজিবর রহমানসে কালে যা’ ছিল অস্বাভাবিক চিন্তা হিন্দু মেয়ে প্রমিলা ও মুসলমান ছেলে নজরুলের মধ্যে বিয়ে ।  বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে নজরুল প্রমীলার বিয়েটি  তিনি বাস্তবায়ন করেন 
            কলকাতায় নজরুল প্রমিলার বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিলবিয়ের পর নবদম্পতির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলিতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেনএই বিদ্যুষী মহিলা ১৯২৬ সারের ২০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন

            তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন মিসে এম রহমান” নামের বিখ্যাত কবিতাটি 


                  
এই সময় আরেকজন মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণভরে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেনতিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মিনী বাসন্তী দেবীতিনি ও তাকে সন্তানতূল্য স্নেহ করতেনদেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (জন্ম ১৮৭০ খ্রিঃ মৃত্যু ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রিঃ) বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন 
          
 চির ক্ষুব্ধ, চির অভিমানী খেয়ালী নজরুল নিজের মায়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে মাতৃস্নেহ পাবার জন্যে উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছেন এবং যার কাছেই সে স্নেহটুকু পেয়েছেন তাঁকেই হৃদয়ের সবটুকু শ্রুদ্ধা,ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রবল আবেগে আঁকড়ে ধরেছেনকিন্তু এতদসত্ত্বেও এই পাতানো নকল মায়েরা কি মাতৃস্নেহের কাঙাল কবির মায়ের অভাব সবটুকু পূরণ করতে পেয়েছেন কি?
  •   (জোবায়ের আলী জুয়েল )


 

    



                   ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু’

                         -বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবত নজরুলের ‘ধূমকেতু’ কবিতা পড়ে অথবা তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা দেখেই লিখেছিলেন-

                   
‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের ঐ দুর্র্গশীরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন 


                  সত্যি সত্যিই ভারতবর্ষের ঘন-কালো অন্ধকার আকাশে আলোকোজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ‘ধূমকেতুর মতো যাঁর আবির্ভাব তিনি আমাদের বাংলাসাহিত্যের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামতিনি একাধারে কবি, ছড়াশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, বংশীবাদক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, গল্পকার, দার্শনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও সৈনিক


              
তাঁর বৈশিষ্ট্য তিনি রাজনীতিবিদ, মানবপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী, অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের রূপকার, সজীব-প্রাণবন্ত, সহজ-সরল, সুন্দর ও মুক্তমনের মানুষলেখালেখির ক্ষেত্রে সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর কবিতা ও গান বাংলাসাহিত্যের এক বিশাল স্থান দখল করে নিয়েছে

                কবিতা ও গানে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ তাঁর সমকক্ষ নন বললেও অত্যুক্তি হবে না। 

তাঁর কবিতা ও গান হৃদয় অনুরণনের
তাঁর কবিতা ও গান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের। 
তাঁর কবিতা ও গান প্রেমের। 
তাঁর কবিতা ও গান ভাবের। 
তাঁর কবিতা ও গান বিদ্রোহের
তাঁর কবিতা ও গান ভক্তিতত্ত্বের
তাঁর কবিতা ও গান অসাম্প্রদায়িকতার 

           তাঁর কবিতা ও গান জালেম শাসক ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রচিত। 
তাঁর কবিতা ও গান পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার। 
তাঁর কবিতা ও গান স্বাধীনতার। 
তাঁর কবিতা ও গান মুক্তির
তাঁর কবিতা ও গানে নিরীহ, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত দুর্বল মানুষগুলো পায় শক্তি, সাহস ও বল

তাঁর কবিতা ও গান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে
তাঁর কবিতা ও গানে সৃষ্টি করে প্রেমানুভূতি। 
তাঁর কবিতা ও গান মনুষ্যত্ব বোধের। 
তাঁর কবিতা ও গান বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ও বিশ্বের সকল সুন্দরের, সকল মানুষের

          নজরুল কবিতা লেখেননি এমন কোন বিষয় নেইতবে তিনি সব বিষয়ে কবিতা লিখলেও বাংলাসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তিনি স্বীকৃততাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিই তাঁকে মূলত বিশ্বে পরিচিত করেছেতাঁর অসাধারণ এ কবিতাটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং আলোচিত ও সমালোচিত 



               
মুজফ্ফর আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন- ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে রচিত হয়েছিল ওই ঘরে নজরুল ও তিনি ভাড়া থাকতেননজরুল রাতে এই কবিতাটি লিখেছিলেনরাত ১০টার পর কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা মুজফ্ফর আহমদ

             ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (শুক্রবার, ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তৎকালীন ‘বিজলী’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর পত্রিকার চাহিদা এতই বেড়েছিল যে, ‘বিজলী’ কাগজ সপ্তাহে দু’বার ছাপা হয়েছিল। 

             পরবর্তীকালে ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও সে সময় এ কবিতাটি মুগ্ধ করেছিলতবে কবিতাটি বিশিষ্টজনের প্রশংসা লাভ করলেও সমালোচিতও কম হয়নি 
‘কাণ্ডারী   হুঁশিয়ার’ কবিতায় ভারতভূমির স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে কবি ঘোষণা করলেন ; -
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কাণ্ডারী  বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

          ‘কুলি মজুর’ কবিতায় অসাম্প্রদায়িক কবি সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেন এভাবে  ৷
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি

             অধ্যাপক আলী আশরাফ নজরুলের কাব্য মূল্যায়নে বলেন, ‘সঞ্চিতার সবগুলো কবিতা পড়ে দেখতে পাই যে, নজরুলের ভাষা ও ভাবধারায় হিন্দু প্রভাবই প্রবলসাধারণভাবে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করলেও নিজস্ব মনোভাব ও অনুভূতি প্রকাশের জন্য তিনি আশ্রয় খুঁজেছেন হিন্দু উপকথা থেকে সংগৃহীত উপমা ও চিত্রেতিনি সাহায্য নিয়েছেন সাধারণ হিন্দু সমাজের ও এই শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজের ভাষার... 
          ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে কবি তাঁর দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় লিখলেন  ৷  ‘এস ভাই হিন্দুএস মুসলমানএস বৌদ্ধএস ক্রিশ্চিয়ান

আজ আমরা সব কিছু  কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা,

সব মিথ্যা,
সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি

     আজ আমরা আর কলহ করিব না। 
চাহিয়া দেখ, পাশে তোমাদের মহাশয়নে শায়িত ঐ বরি ভ্রাতৃগণের শব

          ঐ গোরস্থান- ঐ শ্মশান ভূমিতে শোন শোন তাহাদের তরুণ আত্মার অতৃপ্ত ক্রন্দন 

            সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় সারা ভারতবর্ষের মানুষকে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাগিয়ে তোলাই ছিল তাঁর ওই বক্তব্যের মূল সুর ও উদ্দেশ্য। 

           মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, জাতিতে জাতিতে বিভেদ, সম্প্রদায়গত দাঙ্গা-সংঘাত বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম জাতিগত দ্বন্দ্বে নজরুল সংক্ষুব্ধ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেনতাই সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উঠে তিনি ঘোষণা করলেন-

      ‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি (মানুষ)


            তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মহামিলন এবং একতাআর তাই তিনি সব ধর্মের বিভেদ ঘুচিয়ে অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেনতাঁর ভাষায়- ‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান, 
যেখানে মিশেছে
হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান (সাম্যবাদী) 


               শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামী গজল-গান রচনার পাশাপাশি অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন ও দেবস্তুতিমূলক সঙ্গীত রচনা করে হিন্দু-মুসলিমের সমান ভালবাসায় সিক্ত হন 

               অন্যায়, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘোষণা করেছিলেন বলেই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বার বার জেলে পুরেছেকিন্তু জেল থেকেও তাঁর বিপ্লবী চেতনা দমে যায়নিবরং তাঁর কবিতা ও গান আরও বিদ্রোহের আগুনে জ্বালাময়ী হয়ে উঠেছিলব্রিটিশ সরকারের পোষা ও আজ্ঞাবহ কারারক্ষী নরপিশাচদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি অনশন শুরু করলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে অনুরোধ করে লিখলেন , 
‘এরাব টঢ় ঐঁহমবৎ ঝঃৎরশব.
ঙঁৎ খরঃবৎধঃঁৎব ঈষধরসং ুড়ঁ.’


           নজরুলের বিল্পবী চেতনা পরাধীন ভারতে স্বাধিকার চেতনার স্ফুরণ ঘটালোনজরুল ভারতবাসীকে জেগে ওঠার জাদুমন্ত্র কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপন করলেন  ৷

‘দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কখন সর্বনাশী!’ 

              বিদেশী, বিজাতি, বিভাষী ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল তাঁর কবিতার উদ্দেশ্যতাই তিনি ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য করে লিখলেন-

  ‘এদেশ ছাড়বি কি না বল?
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল

             অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম কুসংস্কারপূর্ণ কিছু ধর্মান্ধ মানুষের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেনতাই তিনি বললেন ,ু

‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নতুন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবনহারা অসুন্দরের করতে ছেদন

             ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে নজরুল বলেছেন,

       ‘আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছিজাতি-ধর্ম-ভেদ আমার কোন দিনও ছিল না,

    আজও নেই আমাকে কোন দিন তাই কোন হিন্দু ঘৃণা করেননি। 
           ব্রাহ্মণেরাও ঘরে ডেকে আমাকে পাশে বসিয়ে খেয়েছেন ও খাইয়েছেন 

              যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত সেখানে তাঁর ‘বিষের বাঁশি’ বেঁজে উঠেছে এবং মানবতার সুর তুলেছেব্রিটিশ শাসকের প্রতি কবির অভিশাপ এবং ক্ষুব্ধ উচ্চারণ , 

     ‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
        যেন লেখা হয়, আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ

         ‘ভাঙার গান’ কবিতায় কবির শৃঙ্খল মুক্তির প্রতিবাদ মুখর ঝাঁঝালো সেই  গান আমরা শুনতে পাই 
 ‘কারার ঐ লৌহ কপাট 
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল পূজার পাষাণ বেদী’

অন্যত্র বলেছেন 
 ‘মোদের প্রাপ্য আদায় করিব, কব্জি শক্ত কর
গড়ার হাতুড়ি ধরেছি, এবার ভাঙার হাতুড়ি ধর

              ‘ওঠরে চাষী’ শীর্ষক কবিতায় কবি সুবিধাবঞ্চিত ও লাঞ্ছিত চাষীদের শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে লিখলেনÑ তোর পাঁজরার ওই হাড় হবে ভাই যুদ্ধের তলোয়ার

         অন্যায্য, অসাম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চারণÑ ‘কেন রহি মোরা বস্তিতে, অস্বস্তিতে চিরদিন
কেন এ অভাব, রোগ, দারিদ্র্য, চিত্তগ্লানি-মলিন? 

                 দরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত ও সুবিধাবঞ্চিত জনসাধারণের কথাই এ কবিতাটিতে বিধৃত হয়েছে
শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর নিম্নোক্ত কবিতাটিতে , 

‘গাহি তাহাদের গান
ধরণীর হাতে দিল যারা
আনি ফসলের ফরমান
শ্রমকিনাক্সক কঠিন যাদের
নির্দয় মুঠি তলে
ত্রস্তা
ধরণী নজরানা দেয়
ডালি ভরা ফুলে-ফলে

নজরুল তাঁর লেখায় ভদ্র -ধর্মব্যবসায়ীদের আঘাত হেনেছেন তীব্রভাবে, 

‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা রয়েছি বসে 
বিবি তালাকের মাছলা খুঁজি হাদিস, কোরান চষে

              বিশ্বে নারীবাদী লেখকদের মধ্যে যাঁদের নাম স্থান পেয়েছে আমার ধারণা নজরুলের নাম তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যতবে নারীর মর্যাদার ব্যাপারে নজরুলসম কেউ আছে বলে মনে হয় নানারীর প্রতি এত শ্রদ্ধা, এত দরদী মন, এত ভালবাসা নজরুল ছাড়া দ্বিতীয়টি কেউ আছে বলে মনে হয় নাতাঁর ভাষায়, 

‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর
...
কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী (নারী)
সভ্যযুগে এসেও মধ্যযুগীয় আচরণ অহরহ হচ্ছে আমাদের মা-বোনের সঙ্গে
মানুষরূপী নরপশুদের লালসার শিকার এ সমাজের নারীরা
কিন্তু ভদ্র সমাজ না বুঝেই আমাদের এসব নারীকে কটাক্ষ করতে দ্বিধাবোধ করে না
বাঁকাচোখে দেখার তো একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে

          কিন্তু কবি নজরুল তাঁর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় লিখলেন ,

‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়েছে সীতাসম সতী মায়ে

            আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের পক্ষপাতমূলক লেখা একমাত্র নজরুলের পক্ষেই সম্ভবনজরুলই একমাত্র কবি যিনি নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে অর্থাৎ পুরুষের সমান মর্যাদায় নারীর আসন প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেননারী এবং পুরুষকে তিনি সমানভাবেই দেখেছেন‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন , 

‘সাম্যের গান গাই 
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী
কোন ভেদাভেদ নাই

            নজরুলের বিদ্রোহী ভাবের আড়ালে হৃদয়ে প্রবাহিত হতো প্রেমের ঝর্ণাধারাপ্রেম ও রোমান্সে নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন কাব্য ও সঙ্গীত জগতে নিজস্ব ধারারনজরুলের প্রেম ও বিরহের গান বাংলা সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে অতি দুর্লভ। 

         ‘মোর প্রিয়া হয়ে এস রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল’,

‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সে কি মোর অপরাধ’

, ‘রুমু-ঝুমু রুমু-ঝুমু নূপুর পায়ে

আসিল রে প্রিয় আসিল রে’,
‘প্রিয় এমন রাত, যেন যায় না বৃথা’
‘শাওনও রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে’,

‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া
মজনু গো আঁখি খোলো’

, ‘কে বিদেশী মন উদাসী, বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’
‘আমায় নহে গো, ভালোবাসো শুধু
 ভালোবাসো মোর গান’,
‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন’,
‘নয়ন ভরা জল গো তোমার
আঁচল ভরা ফুল’,

‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শোনে’,
‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি’

               এরূপ তাঁর অসংখ্য প্রেম ও বিরহগীতি, যা তাঁকে সঙ্গীত জগতে অমরত্ব দান করেছেপ্রেমের চিরন্তন পরিণতি যে বিরহ, তা নজরুলের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন সুরে ধরা পড়েছে। 

   যেমন কবি লিখেছেন

 ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ঘুম ভাঙিব না


              নজরুলের বিরহের কবিতা মানেই আমাদের নিজেদেরই প্রেমের আর্তনাদ মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠেকবি যখন বলেন
 ‘এক জ্বালা, এক ব্যথা নিয়া তুমি কাঁদো আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া
 তখন সবার মনেই হাহাকার জাগে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে

প্রেম ও বিরহের কবি হিসেবেই তিনি বাংলার মানুষের মন-মন্দিরে স্থান করে নিয়েছেনতাঁর বিরহের কবিতাগুলো অসাধারণ

‘নাইবা পেলাম আমার গলায়, তোমার গলার হার
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার

ছোটদের উপযোগী তাঁর একটি আকর্ষণীয় ছড়া ‘ঝিঙেফুল’-এর কয়েকটি পঙ্ক্তি
‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল 
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-
‘ঝিঙেফুল 
গুল্মে পর্ণে/ লতিকার কর্ণে/ঢল ঢল স্বর্ণে 
ঝলমল দোলো দুল/ঝিঙেফুল


‘শিশু-সওগাত’-এ অনাগত শিশুকে ধরণীতে আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে ,

‘তোর দিন অনাগত, শিশু তুই আয়,
জীবন-মরণ দোলে তোর রাঙা পায় 
‘নতুন খাবার’ তাঁর আরেকটি হাসির ছড়া
ছড়াটি হলো
 ‘কম্বলের অম্বল
কেরোসিনের চাটনি
চামচের আমচুর
খাইছ নি নাৎনি ?
আমড়া-দামড়ার
কান দিয়ে ঘষে খাও
চামড়ার বাটিতে
 চটকিয়ে কষে খাও।...
 
                এরকম আরও কত ছড়া-কবিতা তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য রেখে গেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না 
          সব ধরনের অন্যায়, অসত্য, গ্লানি ও জরা-জীর্ণতাকে নজরুল পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেনন্যায়, সততা, উদারতা ও ভালবাসা দিয়েই সাজাতে চেয়েছিলেন আমাদের সুন্দরী ধরিত্রীকেআর তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহীতবে নজরুল বিদ্রোহের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তাঁর ‘ধূমকেতুর পথ’ রচনায়তিনি বলেছেন,

         “বিদ্রোহ মানে কাউকে না মানা নয়, বিদ্রোহ মানে যেটা বুঝি না, সেটাকে মাথা উঁচু করে ‘বুঝি না’ বলা 
             নজরুলকে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছেমুসলমানরা তাঁকে কাফের বলেছে আর হিন্দুরা করেছে ভর্ৎসনামৌলবাদী মুসলিমরা তাঁকে বলত হিন্দু কবি। 

        এ বিষয়ে নজরুলের বক্তব্য , 
     ‘বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ। 
এ আমি একটুও বানিয়ে বলছিনে। 
মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে জড়িয়ে
আমি মুসলমান-
 কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির
কবিকে হিন্দু-কবি, মুসলমান-কবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি

(
চিঠি, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩২, আন্ওয়ার হোসেনকে লিখিত) 

            কবি এভাবে নিজেকে এবং তাঁর লেখনীকে কোন সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী, দল, দেশ, ধর্ম কোনকিছুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননিআর তাই তিনি হয়ে উঠেছেন সকল কালের, সকল জাতির, সকল দেশের, সকল মানুষের সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বেরব্যক্তি মানুষ হিসেবে উদার ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী নজরুল হয়েছিলেন সকল শ্রেণী ও জাতির মিলন দূতআর তাই তো কবি অন্নদা শংকর রায় নজরুলকে নিয়ে লিখেছেন ,
 
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
শুধু ভাগ হয়নি কো
 নজরুল

              কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কাজী 
বংশেতাঁর ডাকনাম ছিল দুখু মিঞাতাঁর বাবার নাম ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। 

                ১৯৪২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাকশক্তিহীন ও স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত মাত্র ২২-২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে নজরুল অনেক বই রচনা করেন

           তাঁরমধ্যে কবিতা ও গানের বই : ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘ছায়ানট’, ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘সুর-সাকী’, ‘জুলফিকার’, ‘বনগীতি’, ‘গুলবাগিচা’, ‘মরু ভাস্কর’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘বুলবুল’, ‘জিঞ্জীর’, ‘চক্রবাক’, ‘সন্ধ্যা’, ‘চোখের চাতক’, ‘নতুন চাঁদ’, ‘মহুয়ার গান’, ‘গানের মালা’, ‘গীতি শতদল’, ‘শেষ সওগাত’ ইত্যাদিগল্প-উপন্যাস : ‘বাঁধনহারা’, ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ ইত্যাদিপ্রবন্ধ-অভিভাষণ : ‘যুগবাণী’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’ ইত্যাদিছোটদের জন্য লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থ : ‘ঝিঙেফুল’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘সঞ্চয়ন’, ‘পিলে পটকা’, ‘ঘুম জাগানো পাখি’, ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি’ এবং নাটক : ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’ ও গল্প : ‘শিউলি মালা’ ইত্যাদি 
                বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে সপরিবারে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং সরকারীভাবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা এবং নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়১৯৭৫ সালে কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়

       কবি একটি গানে উল্লেখ করেছিলেন, 
 ‘মসজিদেরই পাশে আমায়
কবর দিও ভাই 

          আর তাই তো ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি সবাইকে কাঁদিয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করলে কবির ইচ্ছা পূরণের জন্য তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয় 

                 নজরুলের বিদ্রোহী ধাঁচের কবিতা, গান ও প্রবন্ধ এক সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এবং ভারতের স্বাধীনতা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল

            অপরদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর- ‘চল চল চল’ (যা বাংলাদেশের জাতীয় রণসঙ্গীত),
       ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’

, ‘এই শিকল পরা ছল’
, ‘ কাণ্ডারী  হুঁশিয়ার’,
‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’,
‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’,
       ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ 

              প্রভৃতি গান ও কবিতা এ দেশের মানুষের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলআর তাই কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি
  •   (পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী )




মন্তব্যসমূহ