বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমা
হতে নির্বাসিতা সুন্দরী
শ্রীভূমি শ্রীহট্র-কাছাড়ের প্রাচীন
ইতিহাস ৷
প্রথমে
বাংলা থেকে সিলেট
অঞ্চলের নির্বাসন ঘটে
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ
শাসন আমলে ৷ তখন ব্রিট্রিশরা
আসাম প্রদেশের প্রশাসনিক
ব্যয় কমাতে সিলেটকে
আসামের সঙ্গে যুক্তকরা
হয়েছিল ৷ তখন সিলেট
ও কাছাড় জেলাকে
নিয়ে সুরমা ভ্যালি
ডিভিশন তৈরি করা
হয় ৷ আবার
ভারত ভাগের ফলে সিলেটকে
আবার যুক্ত করা হয়
খণ্ডিত বঙ্গের সঙ্গে
গণভোটের মাধ্যমে ৷
তবে সিলেটের একটি ক্ষুদ্র
অংশ রয়ে যায়
আসামের সঙ্গে , তৈরি করা হয় করিমগন্জ
জেলার ৷ তাই সিলেট
ও কাছাড়ের হিন্দু - মুসলমানের সমাজিক
ও সংস্কৃতিক ভাবে
এমন কি অর্থনৈতিক
ও রাজনৈতিক ভাবে
ও ১৮৭৪ সালের
পূর্বতন বাংলার জেলাগুলোর
সঙ্গে লৌকিক ও
অর্থনৈতিক ভাবে একই
সূত্রে গাঁথা ৷
তুর্কি
আক্রমনে ভারতের সামাজিক
বিন্যাস ও রাষ্ট্রের
প্রকৃতি ও চরিত্রে
এক পরিবর্তন সাধিত হয় আর
সিলেট ও কাছাড়ের
পরিবর্তনের সূচনা হয়
দরবেশ শাহজালালের সিলেট
অভিযানের মধ্যে দিয়ে ৷
মেঘনা
উপত্যকার জেলা মৈমনসিংহ , ত্রিপুরা ও
ঢাকা জেলার উত্তরাংশে
বরাক ও সুরমা
নদীর উপত্যকার সিলেটের
অবস্থান ৷ ফলে এই
কয়টি জেলা বিশেষ
করে ত্রিপুরা ও
পূর্ব ময়মনসিংহ জেলার
সংস্কার ও সংস্কৃতির
সঙ্গে সিলেট ও
কাছাড়ের সংস্কার ও
সংস্কৃতির এত মিল
দেখা যায় ৷
অন্যদিকে সিলেট ও
কাছাড়ের হিন্দু ও
মুসলমানদের সমাজ ও
সংস্কৃতি , এমনকি লৌকিক
ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও
উল্লেখিত পূর্ববাংলার ঐ
জেলাগুলোর সঙ্গে এত
সামন্জস্য পাওয়া যায়
এখনও ৷ (
সূত্র;-আচার্য নীহার রঞ্জন
রায় )
নৃতত্ত্ব -বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের পর্যবেক্ষণে সিলেট
ও কাছাড়ের আলাদা
কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে
পাওয়া যায় না ৷ তবে
পূর্ববঙ্গের অনেক জনগোষ্ঠীর
দৈহিক গঠন ও
সাংস্কৃতির যে নৃতত্ত্ব
নেয়া হয়েছে বা
পর্যালোচিত হয়েছে তা
সিলেট ও কাছাড়ের
বেলায় একই মনে
করেন অনেক গবেষক
৷ কারণ পূর্বাঞ্চলের সমগ্র
বাংলাভাষী অঞ্চলে যাঁরা
বসবাস করেন , তাদের
সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের দৈহিক ও
মানসিক গঠনে কোনো অমিল
নেই ৷ ফলে ধরে নেয়া
হয় সাধারণ বাঙালী
জাতির মধ্যে যে
সমস্ত জনগোষ্ঠীর প্রভাব ছিল
বা বর্তমানে দেখা
যায় সেই একই
প্রভাব সিলেট ও
কাছাড় অঞ্চলে কার্যকর ছিল
বা এখন আছে ৷
বৈজ্ঞানিক নরতত্ত্বের
দিক দিয়ে বাংলার
জনসমষ্টিকে তিনটি গোষ্ঠী বা
race এ বিভক্ত করেছেন গবেষক ও
বিশ্লেষকেরা ৷
১
) দীর্ঘমুণ্ডু , প্রশস্তনাসা আছে যাদের
তাদেরকে আদি অস্ট্রলিয়
বা ‘ কোলিড ’ race বলা হয়েছে ৷
যারা আদি
অস্ট্রেলিয়া বা ‘ অস্ট্রিক ’ সংস্কৃতির
সঙ্গে যুক্ত ছিল ৷
২ )
দীর্ঘ ও মধ্যোন্নত- নাসা আছে
যাদের তাদেরকে মিশর-এশীয়
বা মেলানাড race এর
অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে
৷ যারা অর্থাৎ মেলানিডরা
দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতির সঙ্গে
যুক্ত বলে ধারনা
করা হয়েছে , তবে ইহা
নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় নি ৷
৩ ) বিশেষভাবে গোলমুণ্ড , উন্নতনাসা যাদের আছে
তাদের করে অ্যালপাইন
বা ‘ পূর্বব্রাকিড ’ race বলা হয়েছে
৷
অ্যাইপাইনরা
যুক্তছিল যজ্ঞ-বিবর্জিত ব্রাত্য
আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ( এটা ও বিতর্কিত ), আরো মঙ্গোলীয়রা
যুক্ত ছিল ভোটব্রক্ষ
সংস্কৃতির সঙ্গে এবং
আদি নর্ডিকরা আর্য
সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত
ছিল ৷
তবে
অনেক ক্ষেত্র দেখা
যায় যে , নৃতাত্ত্বিক জাতি
এবং সাংস্কৃতিক জাতি
এক হয় না
৷ কারণ অনেক
জাতি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
বজায় রেখেও অন্যজাতির
সংস্কৃতি গ্রহণ করে
থাকে ৷ উত্তর
ও পূর্বাঞ্চলের বঙ্গভাষীদের
উপর মঙ্গোলীয় প্রভাব
বেশি পড়েছিল ৷
তাই প্রতিবেশি সিলেট
ও কাছাড়ের উপর
এর সমান প্রভাব
পড়েছে ৷
ডিমাসা , টিপরা , মুচ ,হাজং , কোচ , রাভা প্রভৃতি
ইন্দো-মঙ্গোলীয়দের নামের গোত্রগুলোকেও
‘বোডো' ( Bodos ) ভাষাভাষী মঙ্গোলীয় হিসেবে
অবিহিত করেছেন গবেষকরা
৷
অন্যদিকে
দেখা যায় সিলেট
ও কাছাড়ের মত
পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলার
অধিবাসীদের মধ্যে ও ইন্দ্র-মঙ্গোলয়েডের প্রভাব
রয়েছে ৷ সুনীতিকুমারের মতে পরবর্তী কালে
এই বড়ো-জনগোষ্ঠীর মধ্যে
বহিরাগত আর্যভাষীদের আগমন
ঘটে , ফলে বোডো- জনগোষ্ঠীর মধ্যেও
আর্যভাষার প্রসার ঘটে ৷ অর্থাৎ
বোডো বা ইন্দো-মঙ্গোলয়েডরা এক
পর্যায়ে সুরমা-বরাক উপত্রকার
সমতলে বসতি বিস্তার
করেছে প্রথমে ৷ পরে এ অঞ্চলে যখন কৃষি ব্যবস্থার
প্রচলন হয়
তখন এই অঞ্চলে
আর্যভাষা ও আর্য
সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে
যায় ৷ গবেষকরা
মনে করেন উর্বর
সুরমা-বরাক উপত্যকায় ব্রাক্ষণ্য
নেতৃত্বে কৃষি বিপ্লব
ঘটে এবং এই
অঞ্চলে বিচরণশীল ইন্দো-মঙ্গলীয়রা ব্রাক্ষণ্য
হিন্দুধর্মদ্বারা নিয়ন্ত্রীত সমাজের
অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে ৷
লাঙলভিক্তক
কৃষির বিস্তার এ অঞ্চলে খাদ্য
উৎপাদনে নিশ্চয়তা এনেছে আর
এই সঙ্গে এনেছে
স্থায়ীভাবে বসতের ধারণা
৷
এই
অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ একটি
সম্প্রদায় ‘জুম’ পদ্ধতির চাষাবাদ
করত তাদের বড়ো
অংশটাই আর্যীকৃত হয় যায়
৷ তবে
কিছু সংখ্যক এই জীবনধারার
সঙ্গে মিলতে পারল
না ৷ পরবর্তীতে এই
গুষ্ঠীটিই শুধু নিকটবর্তী
পার্বত্য অঞ্চলে পুরানো
জীবনধারায় এবং পার্বত্য আশ্রয়ে পড়ে
রইল ৷
নীহাররঞ্জন
রায়ের মতে সুরমা-বরাক
উপত্যকায় বোডোরা ও ইন্দো-মঙ্গোলীয়দের আগেই প্রোটো-অস্ট্রলয়েড race গুষ্ঠী পূর্ব
ভারতে বিচরণকারী ছিল ৷
নৃতাত্ত্বিক বিচারের ভিত্তিতে
এবং নীহাররঞ্জন রায়ের
মতে নিম্নবর্ণের
বাঙালির মধ্যে এই
জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অনুপ্রবেশ
ঘটেছিল ৷ যাদেরকে
এখন অস্ট্রিক গুষ্ঠী
বলা হয় ৷
তবে
সুপ্রাচীনকালে সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলে
যে আদি অস্ট্রেলিয়
জাতির বসবাস ছিল
তার কোনো প্রমাণিত
তথ্য পাওয়া যাই
নাই এখনও ৷ কিত্তু
গবেষকরা বলেন এই
অঞ্চলে বসবাসকারীরা আদি- অস্ট্রেলিয় বা
অস্ট্রিক ভায়া ও সংস্কৃতির
সঙ্গে জড়িত ছিলেন
তা নিশ্চিত ৷ বোডোদের এ
অঞ্চলে প্রবেশের পূর্বেই
অস্ট্রিক ভাষা ও
সংস্কৃতির ধারক এক
বা একাদিক জনগোষ্ঠী
এ অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল ৷ সমতলীয় এই
উপত্যকায়ের সন্নিহিত পার্বত্য
অঞ্চলে যে খাসিয়া
জনগোষ্ঠী বা খাসি-সিন্টেংরা সুপ্রাচীন
কাল ধরে বসবাসরত
ছিল তার প্রমাণ পাওয়া
গেছে ৷ সে প্রমাণ থেকে উপরোক্ত
এই ধারণার জন্ম হয়েছে গবেষকদের মনে ৷ অন্যদিকে ভাষাতত্ত্ব
ও নৃতত্ত্বের বিচারেও
খাসিয়া জনজাতি একটি
বিশিষ্ট ব্যতিক্রম গোষ্ঠী
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ৷ প্রসঙ্গত
উল্লেখযোগ্য যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায়
সমস্ত জনজাতিই তাদের
আদিম বৈবাহিক বৈশিষ্ট্য
এবং নৃতাত্ত্বিক গঠন
এবং আদি ভাষা
দুটো একই সঙ্গে
বজায় রাখতে সক্ষম
হয়েছেন ৷
গবেষকরা বলেন এই জনজাতীয় গোষ্ঠীই
নৃতাত্ত্বিক বিচারে মঙ্গোলয়েড
এবং ভাষিক বিচারে
ভোটব্রক্ষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত
৷ কিত্তু খাসিয়ারা নৃতাত্ত্বিক ও দেহগঠনের বিচারে
মঙ্গোলয়েড আর ভাষিক পরিচয়ে
অস্ট্রিক ৷ কারণ
হিসেবে মনে করা
হয় খাসিয়ারা একটি
দলছুট মঙ্গোলীয় গোষ্ঠী
আর বোডোদের এই
অঞ্চলে প্রবেশের বহু
আগেই তারা বিচ্ছিন্নভাবে
এই অঞ্চলে প্রবেশ
করেছিল ৷ তাই খাসিয়ারা
এখনও তাদের ভাষিক
ও সংস্কৃতিক বৈশিষ্টগুলোর
উত্তরাধিকার বজায় রেখে চলেছে ৷
কিত্তু
আদি-অস্ট্রেলিয়
দেহ-বৈশিষ্টওয়ালা জনজাতি গোষ্ঠী
এই অঞ্চলের সমতলীয়
সমাজের সঙ্গে মিলে
মিশে একাকার হয়ে
গেছে ৷ তাই তাদেরকে
এখন আর স্বতন্ত্রভাবে
চিহ্নিত করা সম্ভব
হচ্ছে না ৷ এই সব
কারণে জাতপাত ও
বর্ণভেদের বেড়াজাল প্রান্তিক
এই অঞ্চলের বহুভাষী
সমাজে পশ্চিমবঙ্গের অংশের
মত এত প্রভাব
বিস্তার করতে পারেনি ৷ তবে
এদেরই একটি অংশ
উচ্ছবর্ণের মধ্যেও অনুপ্রবেশ
করতে পারে বলে
গবেষকরা অনুমান করে
থাকেন ৷
উপরের
আলোচনা থেকে সংক্ষেপে
বলা যায় যে
সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলের আদিমতম
অধিবাসী ছিলেন অস্ট্রিক
ভাষাভাষীরা এবং এই
অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক
বিচারে ও তারা
আদি-অস্ট্রলিয় ছিলেন ৷ আমরা এই
জনগোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত
হয়েছি ৷ তবে
অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষও
এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন কালে ছিল ৷ এর
পরে কোনো এক
পর্যায়ে এ অঞ্চলে
খাসিয়া-সিন্টেংরা প্রবেশ করেছে ৷ এরা প্রথমে
ছিল মঙ্গোলিয়েড গোষ্ঠীর
অন্তর্ভূক্ত ৷ পরে
তারা অস্ট্রিক ভাষা
ও সংস্কৃতি গ্রহণ
করে এবং এই
অঞ্চলের সমাজের অন্তর্ভূক্ত
হয়ে পড়ে পর্যায়ক্রমে
৷
সিলেট
জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে
এখন পর্যন্ত পাঁচখানা
তাম্রলিপি আবিস্কৃত হয়েছে
৷ এই তাম্রলিপিগুলো
সিলেট কাছাড় অঞ্চলের
ইতিহাস রচনায় এক
বিরাট ভূমিকা রেখেছে
৷
গবেষকদের ধারণা
প্রায় দুই হাজার থেকে দেড় হাজার বছর আগে
সুরমা
ভ্যালি অঞ্চলে নতুন
জনগোষ্ঠীর পদার্পণ ঘটেছে
এবং পরবর্তী শতাব্দী গুলোতে এই
জনগুষ্ঠী তাদের পরিক্রম
অব্যাহত রেখেছিল ৷ ৷
ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনগুষ্ঠীর
যে শাখাগুলো এই
পরিভ্রমরে অংশ নিয়েছে
তাদেরকে বোডো (Bodos ) হিসেবে
চিহ্নিত করা হয়েছে
৷ অস্ট্রিক ও
বোডোদের মানস-সংস্কৃতিতে কিছু
পার্থক্য দেখা গেলেও
বাস্তব সংস্কৃতিতে তাদের মধ্যে কোনো
পার্থক্য ছিল না ৷
কারণ উভয়
গুষ্ঠীই কৃয়িজীবী এবং শিকার
বৃত্তি ও খাদ্য
সংগ্যহে রীতি ইত্যাদি একই
ছিল ৷ তবে কৃয়িতে
অস্ট্রিকরা আর খাদ্য
সংগ্যহ ও শিকারে
বোডোরা অগ্রবর্তী ছিল ৷ আর
উভয় গোষ্ঠীর মধ্যের
সমন্বয় ও আত্তিকরণ
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘটেছে
৷ খাসিয়ারা লাঙ্গলের ব্যবহার
করত না ৷ তাই তাদের উৎপাদনের কোনো উদ্বৃত্ত্ব
থাকত না ৷ তাই বোধহয়
স্থায়ী রাষ্ট্র সংগঠন তাদের ছিল না
৷ ফলে এই
অঞ্চলে নতুন কৃয়িব্যবস্থা
ও এর অগ্রপথিকের আগমন
পর্যন্ত বোড়োদের অগ্রগতির
জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৷
খ্রিস্ট্রিয় পঞ্চম
শতকের শেষ দিকে এ
অঞ্চলে ব্রাম্মাণ্য সংস্কৃতির
আগমন ঘটে ৷ প্রাপ্ত তাম্রলিপি
অনুসারে রাজকীয় ভূমিদানের
ফলে এ অঞ্চলে
বহিরাগত ব্রাম্মণ্যদের আগমন
আরম্ভ হয় ৷ রাজকীয়ভাবে
এই ব্রাম্মণ্যদের দায়িত্ব
দেয়া হয় স্থানীয়
জনজাতীদের সঙ্গে নিয়ে সমতলভূমিতে লাঙলভিত্তিক
কৃয়ি চাষের প্রবর্তন
করা এবং প্রত্যন্ত
অনধিগম্য অঞ্চলকেও কৃয়ির
আওতায় এনে ঐসব অঞ্চলে রাজশক্তির
ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা ৷
অন্যদিকে এই ভূমি-প্রাপক
ব্রাম্মণরা ঐসব অঞ্চলে ব্রাম্মণ্য ধর্ম প্রচারের
মিশনারীর দায়িত্বও একই
সঙ্গে পালন করেছেন
৷ এই ব্রাম্মণরাই ভারতীয় অঞ্চলে
জনজাতীদের আর্যকরণের মাধ্যমে
বর্ণাশ্রমভিত্তিক সামাজিক সংগঠন
গড়ে তুলেছিলেন ৷
তাই
অস্ট্রিক ভাষী ও
অস্ট্রিক সংস্কৃতির ধারকদের
মধ্যের আদি অধিবাসীদের কিছু অংশ ব্রাম্মণ্য ধর্মে
ঢুকে পড়ে ৷
যারা এই প্রক্রিয়ার
বাইরে থেকে যায়
অর্থাৎ যারা তাদের আদি
সংস্কৃতির অনুসারী রয়ে
যায় এবং যারা ব্রাম্মাণ্যবাদ মেনে
নিতে পারে নাই
তারা ব্রাম্মণ্য ধর্মের
সঙ্গে আপোষ না
করে স্থান ত্যাগ
করে অন্যত্র চলে যায় ৷
তাদের এক বড় জন গোষ্ঠীই
হচ্ছে খাসিয়া-সিন্টিং সম্প্রদায়ভূক্ত বর্তমান
খাসিয়া জনগোষ্ঠী ৷
তাই
গবেষকরা বলেন পঞ্চম
শতক থেকে এ অঞ্চলে
আগন্ত্রক উচ্ছবর্ণের প্রয়াসে
সিলেট ও কাছাড়
অঞ্চলে যে ব্রাম্মাণ্য
ধর্মাশ্রিত হিন্দু সমাজ
গড়ে উঠেছিল তার
সংখ্যা গরিষ্ট অংশই এসেছে
অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী থেকে ৷ কিত্তু সিলেটে
পশ্চিমাগত ব্রাম্মণ্য ধর্মের যে রূপটি এ অঞ্চলে প্রথমে প্রবেশ করেছিল
তা ছিল প্রাক-চৈতন্য
বৈষ্ণব ধর্ম ৷
কিত্তু তাম্রলিপি অনুসারে
প্রায় ছয়শত বছর পর বৈষ্ণব
ধর্মে তার নিজস্ব
সজীবতা হারিয়ে ফেলে ৷ ফলে
সমাজে জন্ম নেয়
এক সম্পূর্ণ ভাগ্যবাদী
ও অন্ধবিশ্বাস সমর্থিত
এক নতুন ধর্মের
৷
তবে
নতুন জন গোষ্ঠীর সঙ্গে
এসেছিল নতুন সংস্কৃতি , এসেছিল নতুন
উৎপাদন ব্যবস্থা ৷
এই সঙ্গে আসলো নতুন
এক অর্থনীতি ও রাজনীতি
আর এর সঙ্গে
ধর্মও এক গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করেছে ৷ সেই সময় থেকে এ অঞ্চলে যে
ব্রাম্মাণ্য ভিত্তিক গ্রাম সমাজের
পত্তন হয়েছিল তা ষষ্ট-সপ্তম শতকে
ইংরেজের আগমনের পূর্ব
পর্যন্ত সেই সমাজ ব্যবস্থা মোটামোটি
অক্ষত ছিল এ
অঞ্চলে ৷
উপসংহারে এ কথাটি
বলা যায় যে , নৃতাত্ত্বিক বিচারে
সিলেটের মানুষেরা বাংলাদেশের
অন্য অংশের মানুষ থেকে ভিন্ন
কিছু নয় , তাদের উভয়ের মৌল
উপাদান একই ৷
বাঙালি
জাতিটিই আসলে একটি মিশ্র বা একটি
সংকর জাতি ৷ একাধিক
নৃতাত্ত্বিক ধারা বাঙালির
মধ্যে মিলেমিশে একাকার
হয়ে গেছে ৷ নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা
বিভিন্ন গবেষণার বিশ্লেষণ
করে একমত হয়েছেন
যে , বাঙালিদের মধ্যে প্রোটো
অস্ট্রলয়েড ধারাটির প্রভাব
অনেকটা বেশি , সংস্কৃতিক বিচারে
বাঙালিদেরকে অস্ট্রিক বলা
যায় ৷ এর পর বাঙালিদের
মধ্যের ধারাটি হচ্ছে
অ্যালপো-দীনারিয় ধারা ৷
এর পরের ধারাটি
ভূমধ্যসাগরীয় বা দ্রাবিড়ীয়
ধারা ৷ সংকর জাতি
বাঙালির সব শেষ ধারাটি হল
নর্ডিক বা আর্য
ধারা ৷ তবে মঙ্গোলীয়
মিশ্রণ উত্তরবঙ্গ ও
পূর্ববঙ্গের অত্যন্ত প্রান্থিক
অঞ্চলের বাঙালিদের মধ্যে বেশি ঘটেছে
৷
ইতিহাসবিদ সুনীতি
কুমার চট্রোপাধ্যায় বলেন সিলেট
অঞ্চলে মঙ্গোলয়েড সংমিশ্রন
বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি হয়েছে তাই এই অঞ্চলের
মানুষের ভাষাগত ও
সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অনেকটাই
মঙ্গোলীয় সংস্রবের অবদানে
হয়েছে ৷ কিত্তু সমাজের
নিম্নতম পর্যায়ের মঙ্গোলীয়
প্রভাব বাদ দিলে
সিলেটিদের মধ্যে অস্ট্রিক
প্রভাবই সমাধিক ৷
এর পর আছে অ্যালপো-দীনারিয় প্রভাব , যার
সঙ্গে কিছুটা দ্রাবিড়ীয়
প্রভাবের ধারাও যুক্ত
আছে ৷ আর
উচ্ছতম পর্যায়ে অস্ট্রিক
মৌল উপাদানের উপর
নর্ডিক আর অ্যালপো-দীনারিয় প্রভাবও
বিদ্যমান আছে
সিলেট-কাছাড় অঞ্চলের
প্রাচীন ইতিহাসের তিনটি
মৌলিক পর্যায় আবিস্কৃত
হয়েছে ৷ প্রথম সময়টিতে
এই অঞ্চলটি প্রাগৈতিহাসিক
স্তর থেকে ইতিহাসের
যুগে প্রবেশ করেছে
৷ মোটামোটি খ্রিস্টীয়
ষষ্ঠ অব্দে এই
যুগের সূচনা হয়েছিল
৷ এই যুগে লাঙলভিত্তিক
চায়াবাদ আরম্ভ হয়েছে
আর এরই ধারাবাহিকতায়
পশ্চিমাগত ব্রাম্মণদের অভিবাসনের
সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত
রাষ্ট্রযন্ত্রের আবির্ভাব এই
পর্যায়ে হয়েছে ৷
দ্বিতীয়
পর্যায়কে বিকাশপর্ব বলা হয়
, সপ্তম শতকে এই
পর্বের শুরু হয়ে দশম শতকে এই পর্ব
একটি পরিণতিতে পৌছে
যায় ৷ এই সময়ে
কৃয়িভিত্তিক উৎপাদনের চুড়ান্ত
বিকাশ হয়েছে আর
সমাজে বর্ণবাদী ব্রাম্মণ্যবাদ
পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং
বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির অধীনে মণ্ডল নামক
প্রশাসনিক ইউনিটের প্রবর্তন
হয়েছে এই সময় থেকে
৷
এর
পরের যুগটিকে বলা হয় অবক্ষয়ের
যুগ যার আরম্ভ
হয়েছে দ্বাদশ শতক
থেকে ৷ তখন কৃয়িভিত্তিক
অর্থনীতির সংকোচন শুরু
হয়ে যায় আর
সমাজে বিভাজিত বর্ণবাদ
প্রতিষ্ঠা পায় ৷ আর তখন অর্থাৎ এই
পর্যায় থেকে স্বতন্ত্র
শ্রীহট্র রাজ্যের অভ্যুদয়
ঘটে ৷
সূত্র;-নিহাররঞ্জন রায় ও সুনীতিকুমার
চট্রোপাধ্যায় )
‘ (মূল
সূত্র;-সুজিৎ চৌধুরীর লেখা -শ্রীহট্র-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ,
দুই হাজার ছয় সালে
শিলচরের দিনকাল প্রেস
লিমিটেড থেকে প্রকাশিত
গ্রন্থের
আলোকে এবং এই গ্রন্থের
অনুকরণে এই লেখাটি তৈরি
করা হয়েছে )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন