মুনতাসীর মামুন
(সৌজন্য; জনকণ্ঠ )
যাঁরা নিজেদের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মনে করেন, এখন তাঁদের সময় এসেছে এটি উপলব্ধি করার যে, ইসলাম এখন আর রসুলের (দঃ) সময়কার একক ইসলাম নেই। ইসলাম বহুধাবিভক্ত। সুতরাং আমরা যখন ইসলাম বলি তখন বুঝতে হবে আমরা একক কোন ইসলামের কথা বলছি না, ৭২ ভাগে বিভক্ত এক অংশের ইসলামের কথা বলছি।
অন্যদিকে, সারা মুসলিম জাহানকে মোটা দাগে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারেÑ একটি ধর্মপ্রাণ অন্যটি ধর্মব্যবহারকারী। শেষোক্ত মুসলমানরা সব সময় ছিল, তবে বিশ শতকের শেষার্ধে এদের উত্থান লক্ষণীয়। ধর্ম ব্যবহারকারী মুসলমানদের উৎস সৌদি আরবের ওয়াহাবি ইসলাম। সৌদিরা সব সময় এদের লালন পালন করেছে। এখন লালিত পালিতরা তাদের থেকেও হিংস্র হয়ে উঠছে। সৌদিরা চায়, ধর্মীয় মৌলবাদ বা জঙ্গীরাজ থাকুক; কিন্তু তা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করবে না বরং তাকে মান্য করবে। উগ্র জঙ্গীবাদীদের অবস্থান ওই ধরনের রাজতন্ত্রের বিপক্ষে।
ধর্ম ব্যবহারকারীর কাছে যুক্তি গৌণ। তাদের ভিত্তি বিশ্বাস, সে বিশ্বাস নিজস্ব, তার সঙ্গে ইসলামের মৌল চরিত্রের পার্থক্য থাকতে পারে, তাতে কিছু আসে যায় না। সভ্যতা-সংস্কৃতি বা পারিবারিক বন্ধন কোন বিষয় নয়। গত পাঁচ হাজার বছরে অনেক ধর্ম এসেছে, গেছে। অনেক যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে; কিন্তু এ্যাসিরীয় বা ব্যবলনীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শনে কেউ হাত দেয়নি। আজ পরিকল্পিতভাবে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া যেখানে ধর্ম ব্যবহারকারী জঙ্গীরা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে সেখানে তা ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। সৌদিরা যেমন সৌদি আরবের সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ, তা থাকলে সৌদি রাজতন্ত্র সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে। পাকিস্তানেও ইতিহাস পাঠ্যসূচী থেকে অপসৃত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পাকিস্তানকে অনুসরণ করছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন আমাদের। এখানে যে জঙ্গী-মৌলবাদ তরুণদের মধ্যে আশ্রয় পেল এর একটি কারণ, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব পেয়েছে ধর্ম, দেশজ সংস্কৃতি বা ইতিহাস নয়। ক্ষমতাসীনরা তা না মানতে পারেন, ক্ষমতায় থাকলে অনেক কিছুই ক্ষমতাবানরা মানতে চান না, মৌল জঙ্গীবাদীদের মতো তাদের বিশ্বাসই অভ্রান্ত মনে করেন, যুক্তি নয়।
এখন প্রতিবছর মূল দল থেকে বহু দল হচ্ছে এবং একটি থেকে আরেকটি হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। রক্তবীজের মতো যেন সব বাড়ছে। এখন প্রধান হয়ে উঠছে খ্রীস্টান-মুসলমান বা ইহুদী খ্রীস্টান নয়, ইসলাম বনাম ইসলাম। ইসলাম নিয়ে যারা ভাবেন বা করে খান তারা যদি একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতেন, এসব বিবাদ ধর্ম কিনা তাহলে হয়ত অনেক কিছুর মীমাংসা সম্ভব ছিল।
‘ব্লগার’ শব্দটি এখন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আগে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। হেজাবিরা [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] ক্ষমতা দখলের চেষ্টার পর্বে প্রথমেই আক্রমণ করেছিল ইন্টারনেটকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য আহমদ শফী ও তার অনুসারীরা ‘আমার দেশ’-এ প্রথম যে বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন, সেখানে যদ্দুর মনে পড়ে চারজনকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিলÑ শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, অজয় রায় এবং আমাকে। শাহরিয়ার বা জাফর আজ পর্যন্ত ধর্ম সম্পর্কে বা ধর্ম পালন সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী তো আমাকে হাজী বানিয়েছেনই। [বলে রাখা ভাল, অনেকে বিশ্বাস করেন আল্লাহ কবুল না করলে হজ করা যায় না। আমি হজে যাওয়ার প্রাক্কালে এক জামায়াত কর্মী, আমি যে নাস্তিকতা পরিত্যাগ করে ধর্মের পথে ফিরেছি সে জন্য হেদায়েত করে এক চিঠিতে শেষ বাক্যে জানিয়েছিল, ‘যা হোক আল্লাহ আপনার হজ কবুল করিয়াছেন দেখিয়া আপনি যাইতেছেন। আপনি আমার জন্য দোয়া করিবেন]
শাহবাগ জাগরণ বিকশিত হতে থাকলে সংবাদ মাধ্যম ব্লগারদের ওপর আলো ফেলতে থাকে। এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। হেজাবিরা ঘোষণা করে ব্লগাররা নাস্তিক। এই শব্দটি ব্লগারদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়। এবং অনলাইন ও অন্যান্য মাধ্যমে তা গুরুত্ব পায়। ব্লগারদের মধ্যেও সমস্যা আছে। এদের একটা অংশ ধর্ম না বুঝে ধর্ম নিয়ে হয়ত গালাগালি করেছে যেটি হেজাবিদের সুযোগ দিয়েছে। যুক্তিবাদীরা এখানে হেরে গেছেন। ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চা ও বাস্তবের সঙ্গে যোগ না থাকলে এ ধরনের মতিভ্রম হতে পারে এবং তা মুক্তমনাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
সবশেষে একটি কথা বলবÑ শুরুতে ধর্ম যেভাবে প্রচারিত হয়েছে পরবর্তীকালে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে বিভক্তি হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, মুসলমান সব ধর্মেই।
ধর্ম মানুষের কল্যাণ বা আল্লাহ/ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণÑ এ বার্তা নিয়ে যারাই সরকারের কথা বলেছেন তারাই আক্রান্ত হয়েছেন। আব্বাসীয় যুগে যখন ইজতেহাদ প্রাধান্য পেয়েছিল, তখন তাকে বলা হয়েছে স্বর্ণযুগ।
ইসলামের ইতিহাসে সে আমলটিই এ্যাচিভমেন্টের যুগ।
পরবর্তীকালে ইজতেহাদের প্রভাব লুপ্ত হয়। সে থেকে উগ্রচিন্তাই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু লড়াইটা কি একতরফা হয়েছে? সভ্যতা সংস্কৃতির আরেক নাম যুক্তি। আজ আমরা যে অবস্থায় পৌঁছেছি তা যুক্তির কারণেই। যুক্তির ক্ষেত্র যদি একেবারে অবলুপ্ত হতো, তা হলে তো সভ্যতা সংস্কৃতি বিকশিত হতো না।
আমি বিশ্বাস করি না যে, বাংলাদেশের সমাজ থেকে যুক্তি একেবারে অপসৃত হবে। একাত্তর সালেও ছিল যুক্তি। কেননা যুক্তিকে অবলুপ্ত করা যায় না, যদি যেত তাহলে সভ্যতা-সমাজ কিছু থাকত না। থাকত ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ভরা এক সমাজ। ওই যুগ তো আমরা পেরিয়ে এসেছি।
সবচেয়ে বড় কথা, মানুষকে হত্যা করা যেতে পারে, তার চিন্তা ধ্বংস করা যায় না। অভিজিৎ খুন হতে পারেন, মুক্তমনের চিন্তা তো খুন করা যাবে না। যেমনটি বলেছে অভিজিৎ-বন্যা দম্পতির কিশোরী কন্যাÑ শব্দ হত্যা করা যায় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন