নির্মূল কমিটি , যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শেখ হাসিনা
:
( শাহরিয়ার কবিরের
একটি লেখা থেকে
এই লেখাটি নেয়া
হয়েছে :)
শেখ
হাসিনার সঙ্গে জাহানারা ইমামের পরিচয় হয়েছিল নির্মূল কমিটি গঠনের প্রায় অর্ধ যুগ
আগে। ১৯৮৬
সালে জাহানারা ইমামের কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের পরই আলোচনা ও
প্রশংসার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। একদিন শেখ হাসিনা এই বইয়ে অটোগ্রাফের জন্য জাহানারা ইমামের
বাড়িতে গিয়েছিলেন বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর
কন্যাদের নিজের বাড়িতে দেখে জাহানারা ইমাম কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলেন পরে বহুবার
সে কথা তিনি আন্দোলনকারীদের
বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে খালাম্মা ডাকতেন। শহীদ
জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামালের প্রতি শেখ হাসিনার দুর্বলতা ও শ্রদ্ধা
নির্মূল কমিটির আন্দোলনে তাঁর সহযোগিতার ভিত নির্মাণ করেছে। সূচনাপর্বে
যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দৃঢ় সমর্থন আন্দোলনকারীদের সাহস যুগিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে
সেবারই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি এক মঞ্চে একত্রিত হয়েছিল নাগরিক সমাজের আন্দোলনের
সময়ে ৯১ সালে , গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতনের পর
৷
তখন
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে
বিএনপি সরকার গঠন করেছিল জামায়াতের সমর্থন নিয়ে।
আর
জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব
প্রদানের শর্তে।
যে কারণে বিএনপির
সরকার গঠনের পর পরই জামায়াত আত্মগোপনে থাকা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দলের আমির
ঘোষণা করে, যার
তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছিল না।
১৯৯২-এর মার্চে গণআদালতে
গোলাম আযমের বিচারের পক্ষে সারাদেশে যখন গণআন্দোলনে উত্তাল খালেদা জিয়ার সরকার
নিরাপত্তার কথা ভেবেই গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে।
অপর দিকে গণআদালতের
কর্মসূচীর বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
নির্মূল কমিটির ২৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচী ছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচার করা ।
নির্মূল কমিটির ২৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচী ছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিচার করা ।
কারণ ক্ষমতায় তখন খালেদা
জিয়ার জামায়াতবান্ধব বিএনপি সরকার। যদিও বিএনপির অনেক নেতা, সাংসদ এমনকি ছাত্র সংগঠনের
নেতারাও কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে এই
আন্দোলনের সমর্থন করেছিলেন কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল
যে কোন মূল্যে গণআদালত প্রতিহতকরণের।
২৬ মার্চের এক সপ্তাহ আগেই
বলা হলো গণআদালতের কর্মসূচী বেআইনী, সরকার এ ধরনের কোন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে দেবে না। গণআদালত
প্রতিহত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ২৫ মার্চ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ
সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। বলা হলো কেউ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।
২৫ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিরোধী দলের নেতার সরকারী ভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন । জাহানারা ইমাম বললেন, “ সরকার যে ভাবে আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে গণআদালত ও বিচার কিভাবে হবে ” ? এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের চেয়ে বেশি জানতেন শেখ হাসিনা। তিনি জাহানারা ইমামের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ গণআদালতে আপনারা কত মানুষ আশা করছেন ?’ জাহানারা ইমাম বললেন, ‘ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে, আমরা চার থেকে পাঁচ লাখ জনসমাগম আশা করছি।’
আমাদের সামনেই শেখ হাসিনা প্রথমে ফোন করলেন আদমজী জুট মিলের শ্রমিক নেতা রেহানকে এবং বললেন, খালাম্মা আমার সামনে বসে আছেন।
আগামীকাল আদমজী ও
নারায়ণগঞ্জ থেকে আপনারা পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক পাঠাবেন। এরপর
তিনি টঙ্গী, জয়দেবপুর
ও আরও কয়েকটি জায়গায় ফোন করে স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দিলেন। জাহানারা
ইমামকে তিনি বললেন, আমি
আপনাদের কর্মসূচীতে দু’লাখ লোকের দায়িত্ব নিচ্ছি।
বাকিটা
আপনারা অন্য দলগুলোকে বলুন যারা পূর্ব
থেকে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
জাহানারা ইমামের আন্দোলন
বহুধাবিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই
আন্দোলনের আগে কেউ ধারণা করতে পারেননি শেখ হাসিনা, নির্মল সেন, বদরুদ্দীন উমর কিংবা আহমদ
শরীফ, কবীর
চৌধুরী, গাজীউল
হক, সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী, এক
মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় একই ভাষায় কথা বলবেন।
জাহানারা ইমাম একটি কথা তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেন, ‘
আমাদের অনৈক্যের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা এত শক্তিশালী
হতে পেরেছে ’ ।
’
জাহানারা ইমামের আন্দোলনের গত ২৩ বছরে শেখ হাসিনা মাত্র তিনবার নির্মূল
কমিটির সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথমবার
তিনি এসেছিলেন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ’৯২-এর ৩ মার্চ জাতীয় সমন্বয় কমিটির
প্রথম সমাবেশে। অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। এই
ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন
হলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। দ্বিতীয়
ও শেষবার ও তিনি আন্দোলনের মঞ্চে
এসেছিলেন ’৯২-সালের ১৪
অক্টোবর ৷
এই সমাবেশে তাঁর আগমনকে
কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের নিজেদের ভেতর যে মতবিরোধ হয়েছে কিছুটা শাহরিয়ার
কবিরের ‘জাহানারা ইমাম ও গণআদালত’ বইয়ে লিখা
হয়েছে । এর
পর তিনি নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ১৯৯৮-এর মার্চে যখন আন্দোলনকারিরা ৭ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ মেলার আয়োজন করেছিলেন । এই মেলা উদ্বোধন করেছিলেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর আন্দোলনকারীরা দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে তাঁকে স্মারকপত্র দিয়েছিলেন।তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শেষ করে তিনি ’৭১-এর ঘাতকদের বিচার করবেন।
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর আন্দোলনকারীরা দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে তাঁকে স্মারকপত্র দিয়েছিলেন।তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শেষ করে তিনি ’৭১-এর ঘাতকদের বিচার করবেন।
২০০৯ সালের
আগে দ্বিতীয়বার২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপির জোট
সা-ল-সা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্মূল
কমিটির ওপর। সরকার গঠনের দেড় মাসের ভেতর শাহরিয়ার
কবিরকে গ্রেফতার করেছিল। শাহরিয়ার কবির
বলেছেন - “
আওয়ামি লীগ কর্মিদের
মৃত অবস্থায় কারাগারের সেলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতে। আর আমার ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে
জেল থেকে বেরিয়ে তা আমি উচ্চতর আদালতে জানিয়েছি। ঈদের
দিন সব বন্দীকে বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খেতে দেয়া হয়। আমার
স্ত্রী-পুত্র- কন্যা আমার জন্য খাবার এনে তিন ঘণ্টা জেল গেটে দাঁড়িয়েছিল তাদের
দেখা করতে দেয়নি। এ খবর সব দৈনিকে বেরিয়েছিল। ডেইলি
স্টারের প্রথম পাতায় এ নিয়ে সম্পাদক মাহফুজ আনাম বিশেষ সম্পাদকীয়ও লিখেছিলেন।
কারাগারে থাকার সেই দুঃসহ দিনগুলোতে কিছু স্বস্তি ও সুখের মুহূর্তের কথাও মনে আছে। ঈদের আগের রাতে মায়ার ছেলে দীপু একটা প্যাকেট এনে দিয়ে বলল, আঙ্কল এটা নেত্রী পাঠিয়েছেন, আপনার জন্য ঈদের উপহার। খুলে দেখি একটা সাদা নকশা করা পাঞ্জাবি। খালেদা জিয়ার নির্যাতন সেলে শেখ হাসিনার মমতাভরা উপহার পেয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। জেল থেকে বেরুবার পর তিনি সুধাসদনে ডেকেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকে আনা পিঠা খাওয়ার জন্য। শুনেছেন, কারাগারে কী ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে আমাদের ওপর। তখন তাঁকে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা মনে হয়নি। নিতান্তই একজন মমতাময়ী বোন, যে কোন মানুষের কষ্টের কথা জানলে যিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ” ৷
কারাগারে থাকার সেই দুঃসহ দিনগুলোতে কিছু স্বস্তি ও সুখের মুহূর্তের কথাও মনে আছে। ঈদের আগের রাতে মায়ার ছেলে দীপু একটা প্যাকেট এনে দিয়ে বলল, আঙ্কল এটা নেত্রী পাঠিয়েছেন, আপনার জন্য ঈদের উপহার। খুলে দেখি একটা সাদা নকশা করা পাঞ্জাবি। খালেদা জিয়ার নির্যাতন সেলে শেখ হাসিনার মমতাভরা উপহার পেয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। জেল থেকে বেরুবার পর তিনি সুধাসদনে ডেকেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকে আনা পিঠা খাওয়ার জন্য। শুনেছেন, কারাগারে কী ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে আমাদের ওপর। তখন তাঁকে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা মনে হয়নি। নিতান্তই একজন মমতাময়ী বোন, যে কোন মানুষের কষ্টের কথা জানলে যিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ” ৷
শেখ হাসিনার সহযোগিতা, উদ্যোগ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে শহীদ
জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বিজয়ের
এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। তিনি
বহুবার বলেছেন, জামায়াত
কোন রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী
সংগঠন। আমরা আশা করব তাঁর সরকার দ্রুত জামায়াত নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপ
গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, যদি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হতেন তাহলে কোন ক্রমেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না। এমনকি শেখ হাসিনা বাদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও এ ঘাতক দালালদের বিচার হতো না।
- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বক্তাদের অভিমত
একাত্তরের ঘাতক দালাল
নির্মূল কমিটির ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলেচনা সভায় বক্তারা বলেন, মহাজোট সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে
চলছে। মহাজোট সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানাই। জামায়াত-শিবিরের মূল লক্ষ্য ’৭১-এ পরাজয়ের
প্রতিশোধ নেয়া। তারা বাংলাদেশকে
ধ্বংস করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের
সপক্ষের সকল শক্তি এক না হলে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া তাদের জন্য সহজ হয়ে
যাবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবির নামক এই
অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াতে হবে। অবরোধ-হরতালের
নামে জামায়াত-বিএনপি দেশের সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তারা আক্রমণ করেছে। জামায়াত-বিএনপির এই জিহাদ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা
নয়। তরুণ প্রজন্ম গত বছর শাহবাগে জাগরণ
তৈরি করেছিল; মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তিকে সে রকম
জাগরণ তৈরি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করতে হবে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির
লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছতে হলে রাজনৈতিক শক্তির সহায়তা প্রয়োজন, তা আমরা জানতাম। এ
লক্ষ্যটি আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবচেয়ে বড় সংগঠন। তাদের
হাত ধরেই এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ অর্জিত হয়েছে। নির্মূল কমিটি গঠনের সময়
আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে।
তিনি বলেন, যদি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হতেন তাহলে কোন ক্রমেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না। এমনকি শেখ হাসিনা বাদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও এ ঘাতক দালালদের বিচার হতো না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন