আপন অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্মের ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত লেখক ও গবেষক ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর ঈশ্বর দর্শন ! (২য় পর্ব)


   


                  আপন অভিজ্ঞতার আলোকে   ধর্মের  ইতিহাস   নিয়ে  গবেষণাকারী  বিখ্যাত  লেখক ও     গবেষক  ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  এর  ঈশ্বর  দর্শন  !
                                                           (  ২য়  পর্ব  )

                   ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  তিনটি  পরস্পর  সম্পর্কিত  এবং  একেশ্বরবাদে  বিশ্বাসী   ইহুদি  ধর্ম  ,  খ্রিশ্চান  ধর্ম  এবং  ইসলাম  ধর্মের  প্রায়  বিগত   চার  হাজার  বছর  ব্যাপি  প্রচলিত  ঈশ্বর  সম্পর্কিত  বিশ্বাস  ও  ধারণা   এবং  অভিজ্ঞতার  আলোকে যে  ইতিহাসের  সৃষ্টি  হয়েছে  সেই   ইতিহাসের  পর্যালোচনা  করেছেন ৷   এবং  এই  সঙ্গে  তার  গবেষণাকার্যও   চালিয়েছেন  একটি  নিরপেক্ষ  এবং  পক্ষপাত  মুক্ত   দৃষ্টিভঙ্গি  নিয়ে  ৷  তার  প্রাপ্ত  অভিজ্ঞতাগুলোকে তার  রচিত  একটি  বইয়ে বিস্তারিত  ভাবে  প্রকাশ  করেছেন  ৷  এই  লেখাতে  তার  বইয়ের  সমস্ত  অভিজ্ঞতার  একটি  সংক্ষিপ্ত  বিবরণ  প্রকাশের  চেষ্টার  প্রয়াস  মাত্র  , যা  তিনি  তার  বইয়ের  সূচনা  পর্বে  উল্লেখ  করেছেন  ৷ প্রথম  পর্বে  যা  প্রকাশ  করা  হয়নি  শুধু  সেসব  গুলোই  এখানে  সংক্ষেপে  উল্লেখিত  হয়েছে  ৷ 

            তার  এই  ইতিহাস  পর্যালোচনা  ও  গবেষণায়  তিনি   দেখতে  পেয়েছেন    বলে  দাবী  করে  বলেছেন  যে  , আসলে  এই  তিন  ধর্মের  ঈশ্বরবিশ্বাসী  মানুষ  কেবল  নিজেদের  প্রয়োজনে  এবং  ইচ্ছায়  এবং  সময়ের  চাহিদা  পূর্ণ  করতে  ঈশ্বরকে  আবিষ্কার  করেছে, যার  অস্তিত্ব বাস্তবে  ছিল  কি  না  তা  নিয়ে  তার  সন্দেহের  সৃষ্টি  হয়েছে  ৷  তার  মতে      সমাজ  বিকাশের  বিভিন্ন  পর্যায়ে   কিছু  মানুষ   ধর্মের  আতঙ্ক  এবং  আকাঙ্ক্ষাকে  অন্য  মানুষ ও সমাজের  কাছে  তুলে  ধরেছে  এবং  মানুষও  অনায়াসে  তা  গ্রহণ  করেছে   ৷ ধর্মের ইতিহাস  পর্যালোচনা  ও   গবেষণার  একপর্যায়ে  তার  কাছে  মনে  হয়েছে  যে  , এই  তিন  সেমিটিক  ধর্মবিশ্বাসী  মানুষের  কাছে   গুরুত্বপূর্ণ  অর্থে   ধর্ম  ও  ঈশ্বরের  সৃষ্টি মানুষের  এক  সৃজনশীল  কল্পনার  সৃষ্টি ,  যা  অন্যান্য সামাজিকভাবে  অনুপ্রেরণাদায়ক  কবিতা  ও  সঙ্গিত সৃষ্টির   মতোই  অর্থাৎ  মানুষের   শিল্পকলা ইত্যাদি  সৃষ্টির    মতোই  ৷  প্রকৃতপক্ষে  মানুষের  প্রচলিত  বিশ্বাসের  ঈশ্বরের  বাস্তবভিত্তিক  কোন  অস্তিত্বই  নেই ,  কোনো  কালে  ছিল  না  ৷   তার  পরেও মানুষের  ঈশ্বর এবং  ধর্মে  বিশ্বাস  এই  বিশ্বের  সবচেয়ে  গুরুত্বপৃর্ণ  বাস্তবতা  ৷

           তবে  প্রসঙ্গক্রমে তিনি উল্লেখ  করেছেন  যে , এই  গবেষণা  তার  গতানুগতিক  ইতিহাসের  গবেষণার  বিষয়  শুধু  ছিল  না  ৷  তাই  তার  লেখায় এবং  গবেষণায়  ঈশ্বরের  বর্ণনাতীত  বাস্তবতার  উপাদান  খুঁজে  পাওয়া  যাবে  না  ৷  তিনি  তার  এই  গবেষণাকে  আব্রাহামের  কাল  থেকে  আজকের  দিন  পর্যন্ত  নারী  ও  পুরুষ  যে  ভাবে  ঈশ্বরকে  দেখেছে ,  কল্পনা  করেছে  ,  কি  জন্য  তা  করেছে  ,    তারা  এই  বিশ্বাস  থেকে কি অর্জন  করতে  পেরেছে  ইত্যাদি  বিষয়গুলোই  ছিল  তার  এই  গবেষণার  মূল  বিষয়বস্তু  ৷  ইহা  ঈর্শ্বরকে  সৃষ্ট  কে  করেছে  , কিভাবে  তাঁর  সৃষ্টি  হয়েছে  সে  কাহিনি  সরাসরি  তার  লেখায়  উঠে  আসে নি  ৷

                এই  গবেষণা  করতে  গিয়ে  তিনি  দেখেছেন  ঈশ্বর  সম্পর্কে  মানুষের  ধারণার  একটি অতীত  ইতিহাস  আছে  ৷  কিন্তু  কালের  বিবর্তনে  বিভিন্ন  পর্যায়ে  এই  ধারণার  ব্যবহাকারী  জনগোষ্ঠীর  কাছে  তা  বরাবরই  এক  পরিবর্তিত  অর্থ  ও  উদ্দেশ্য  বহন  করেছে  ৷ দুঃখজনক হলে  ও এই  কথাটিকে  অত্যান্ত  সত্য  মনে  করেন  ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  যে ,    ঈশ্বরের হাত মানুষের কাছে এক  পর্যায়ে  পৌঁছার  পর   তার  হাতের    আগের  ক্ষমতা  নিশ্চয়  পরাস্ত হয়ে  গেছে মানুষের  কর্মী  হাতের  কাছে      তার  কারণ  হিসেবে  তিনি  তার  গবেষণালব্ধ  জ্ঞান  থেকে  প্রাপ্ত    তথ্যাদি  বিশ্লেষণ  করে  তার  বইয়ে  দেখিয়াছেন  যে  , কোন  এক  প্রজন্মের  একদল  মানুষের  ঈশ্বর  সম্পর্কিত  প্রাপ্ত  ধারণা  অন্য  একদল  মানুষের  কাছে  অর্থহীন  হয়ে  দাঁড়াতে  পারে  ৷  অর্থাৎ  তার  মতে  কেউ  যদি    বলে  আমি  প্রকৃতপক্ষে   ঈশ্বরে  বিশ্বাস  করি  ,  তবে  বাস্তবে  তার  এই  কথাটির   তেমন  কোনো   অর্থ  বহন  করেনা  ,  কিন্তু  কোনো  নির্দিষ্ট  এক  জন  গোষ্ঠীর  মূখে  বিশেষ  কোনো  প্রেক্ষাপটে যখন এই  কথাটি  উচ্চারিত  হয়  তখন  অন্য  যে  কোনো  কথার  মতো  ঐ  নির্দিষ্ট  প্রেক্ষাপটে  এর   অর্থ এই  জনগোষ্ঠীর  মধ্যে  প্রতিষ্ঠিত  হয়ে  যায়  ৷  তাই  তার  মতে  ঈশ্বর  শব্দের  মাঝে  কোনো  এক  একক  অন্তর্নিহিত  এবং  অপরিবর্তনশীল  ধারণা  নেই  ,  বরং  তখন  এই  শব্দটি  এক  ব্যাপক  অর্থ  বহন  করে  যে  গুলো  আবার  অনেক  সময় পরস্পর  বিরোধী  এবং  এমনকি  তখন  একটি  অপরটিকে  বাতিলও  করে  দেয়  ক্ষেত্র  বিশেষে  ৷  তিনি  মনে  করেন   ঈশ্বরের    ধারণার  এই  পরিবর্তনশীলতা  সমাজে    না  থাকলে  তা  অন্যতম  মহান  মানবীয়  ধারণা  হবার  জন্যে  টিকে  থাকতে  পরত  না   ৷     তার  মতে  সম্ভবত  এই  কারণেই  মানুষ  যখনই  ঈশ্বর  সম্পর্কিত  একটি  ধারণার  অর্থ  হারিয়েছে  বা  ইহা  কোনো  সমাজে  অপ্রাসঙ্গিক  হয়ে  দাঁড়িয়েছে  ,  তখন  নীরবে   মানুষ  সে  ধারণা  পরিত্যাগ  করেছে  ৷  আর   এর  পরিবর্তে  নতুন  এক  ধারণা  গড়ে  তুলেছে  এবং  নতুন  ধারণাকে  পরিত্যাগ  করা পুরাতন  ধারণার  স্থলে  প্রতিস্থাপন  করেছে  ৷  কিন্তু  তিনি  মনে  করেন  একজন  মৌলবাদের  ধারণা  পোষণকারী  ব্যক্তি  কখনই  তার  এই  ঐতিহাসিক  এবং  গবেষণালব্ধ  প্রমাণিত  তথ্যাদি  গ্রহণ  না  করে  তা  প্রত্যাখ্যান  করবে  ৷  তার  অস্তিত্ব  রক্ষার  সার্থেই  তাকে  এটা  করতে  হবে  ৷ কারণ  মৌলবাদীরা  সবসময়ই  ইতিহাস  বিরোধী  হয়ে  থাকে  ৷ 

            তবে  এই  সেমিটিক  তিন  ধর্মের  বিশ্বাসীরা  এখনও  বিশ্বাস  করেন  যে  , আব্রাহাম   , মোসেজ  ও তাদের   পরবর্তিকালের  পয়গম্বরগণ  আজকের  দিনের  মানুষের  মতোই  তাদের  ঈশ্বর  বিশ্বাসের  অভিজ্ঞতা  লাভ  করেছিলেন   ৷  কিন্তু  আমাদের  এই  তিনটি  ধর্মের  বিগত  প্রায়  চার  হাজার  বছরের  ইতিহাসের  দিকে  নিরপেক্ষ  ভাবে  এবং  অনুসন্ধানী  দৃষ্টিভঙ্গি  নিয়ে  বিচার  বিবেচনা  করলে  দেখা  যাবে  যে  ,  আসলে  ঈশ্বরে  বিশ্বাসের  বা  ঈশ্বরের  কোনো  বস্তুনিষ্ঠ  ধারণা  নেই  ৷  প্রত্যেক  প্রজন্মকেই  তার  সময়ের    উপযোগী  করে  ঈশ্বর  ও    কাফের  ( অবিশ্বাসী )   বিশ্বাসের  ইমেজ  নির্মাণ  করে  নিতে  হয়েছে  ৷

             নাস্তক্যবাদের  ক্ষেত্রেও  এই  একই  কথা  সত্য  ৷  কারণ  নাস্তিকেরা  ঈশ্বরে  বিশ্বাস  করেনা  কথাটি  ইতিহাসের  বিভিন্ন  পর্যায়ে  কিন্তু  কিঞ্চিৎ  পরিবর্তিত  রূপে এর  অর্থ  প্রকাশ  করতে  হয়েছে  ৷  ফলে  বিভিন্ন  সময়ে  নাস্তিক  হিসেবে  আখ্যায়িত  ব্যক্তিরা  অলৌকিকতার  বিশেষ  একটি  ধারণাকে  প্রত্যাখ্যান  করেছে    যা  নাস্তিকদের  পূর্বের  ধারণা  থেকে  ভিন্নতর  ছিল  বলে  প্রমাণিত  হয়েছে  ইতিহাসে  ৷ 

            অতএব  আজকের  নাস্তিকদের  প্রত্যাখ্যাত  ঈশ্বর  কিন্তু  প্যাট্রয়ার্কদের  ঈশ্বর  নয়  ,  তেমনি  নয়  পয়গম্বরদের  ঈশ্বর  ,  আবার  দার্শনিক  বা  অতিন্দ্রীয়বাদীদের  ঈশ্বরও  নয়  ৷    তবে  কি  এই  ঈশ্বর  অষ্টাদশ  শতকের  ডেইষ্টীদের  ঈশ্বর  ?  কিন্তু  নাস্তিকরা   এর ও  কোনো সদউত্তর  দিতে  পারেন  না  ৷

                   তবে  বাস্তবে  এইসব  ঈশ্বর  বা  উপাস্যই  ইহুদি  ,  ক্রিশ্চান   ও  মুসলমানগণ  কর্তৃক  তাদের  ধর্মের   ইতিহাসের   বিভিন্ন  পর্যায়ে  বাইবেলের   ও  কোরানের  প্রকৃত  ঈশ্বর  হিসেবে  প্রতিষ্ঠিত  হয়েছেন  এবং  তাদের  দ্বারা   উপাসিত  হয়েছেন  ৷  এরপরও  তাঁরা  একজন  থেকে  অন্যজন    সম্পূর্ণ  আলাদা   হিসেবে  প্রতিষ্ঠা  পেয়েছেন     ৷  তাই  নাস্তিক্যবাদকে  ও  একটা  পরিবর্তনশীল  ধারণা  হিসেবে  বিবেচনা  করতে  হয়েছে  ইতিহাসের  পাতায়  ৷  অন্ততঃ  ইতিহাস  বিশ্লেষণে  নাস্তিকদের  ব্যাপারে  এই  তথ্য  উঠে  আসে  ৷  ঠিক  একই  ভাবে  কিন্তু  ইহুদি ,  ক্রিশ্চান  ও  মুসলিমরা  তাদের  সমসাময়িক  বা  পৌত্তলিক  প্রতিপক্ষকে  বা  তাদের  ধারণার  প্রতি  বিশ্বাসস্থাপনে  অক্ষমদেরকে  নাস্তিক  হিসেবে  আখ্যায়িত  করেছে  ৷  কেননা  তারা  সকলেই  কিন্তু  অলৌকিকত্ব  ও  পরম  সত্তা  সম্পর্কে  বিপ্লবাত্মক  ধারণা  অবলম্বন  করেছিল  ৷  আধুনিক  নাস্তিক্যবাদ  কি  একইভাবে  আমাদের  সময়ের  সমস্যাদির  প্রেক্ষিতে  অপর্যাপ্ত  ঈশ্বর  এর  প্রতি  একধরণের  আনাস্থা  প্রকাশ  করছে  ? এই  প্রশ্নও  করেছেন  আর্মস্ট্রং  নাস্তিক্যবাদে  বিশ্বাসীদেরকে  তার  এই  বইয়ে  ৷ 

            বিজ্ঞানী  ও  যুক্তিবাদীরা  অন্য  কথা  বললেও এবং  ব্যক্তিগতভাবে  ক্যারেন  আর্মস্টং  ধর্মে  বা  ঈশ্বরে  বিশ্বাস  না  করলেও  তিনি   মনে  করেন যে ,   বর্তমান  বিশ্বে  ধর্ম  দারুনভাবে  বাস্তবসম্মত  একটি  বিষয়ে  পরিণত  হয়েছে   ৷  তবে  এই  বিশেষ  বিশ্বাস  এবং  এই  ধারণা  আধুনিক  মানুষের  কাছে   অযৌক্তিক  এবং  বৈজ্ঞানিকভাবে   গ্রহণযোগ্য  না  হলেও  বাস্তবে  ধর্মবিশ্বাসের  বাস্তবকার্যকারিতাই  সমাজে  অনেক  বেশি  গুরুত্বপূর্ণ  হয়ে  উঠেছে  বলে  আর্মস্ট্রং  তার  গবেষণায়  পেয়েছেন  বলে  জানিয়েছেন  ৷  তাই  তিনি  মনে  করেন  কোনো  কারণে  মানুষের  বর্তমান  ধর্মবিশ্বাস  এর  প্রভাব  বা  এর  কার্যকারিতা  ব্যাহত  হলে  তখন  তার  বদলে  এই পুরাতন  বিশ্বাসই   আবার  তীব্রভাবে  এবং  ভিন্নরূপে  সমাজে  প্রকাশ  পাবে  ৷  প্রমাণ  হিসেবে  তিনি  বলেছেন  আমাদের  পূর্ববর্তী  একেশ্বরবাদীরা  এই  রকম  পরিস্থিতিতে  বিচলিত  হয়  নি  ৷  এর  কারণ  উল্লেখ  করতে  গিয়ে  তিনি  বলেছেন    তারা  অর্থাৎ  পূর্ববর্তীরা  ভালভাবেই  বুঝতে  পারতো  যে  তাদের  মাঝে  ঈশ্বর  সম্পর্কে  যে  ধারণা  জন্মেছে  তা  সর্বকালের  জন্যে  স্থির  বা  অপরবর্তনীয়  কোনো  বিশ্বাস  নয়  ,  বরং  তা  শুধু  সাময়িক  একটা  ব্যাপার  ৷  তারা  নাকি  আরো  মনে  করতো  এই  সব  বিশ্বাস  পুরোপুরি  মানুষের  সৃষ্টি  , সমাজের  বিকাশের  প্রয়োজনে  মানুষই  কোনো  এক  পর্যায়ে  এইসব বিশ্বাসের  সৃষ্টি  করেছিল ,  তবে  তারা  ইহাকে  অন্যভাবে  বর্ণনা  দিয়ে  বলত  যে ,  এগুলো  যে  বর্ণনাতীত  সত্তাকে  প্রতীকায়িত  করেছে  তার  থেকে  তাদের  বিশ্বাস  সম্পূর্ণ  আলাদা  ৷ 

           কিন্তু  পরবর্তিতে  কেউ  কেউ  এই  অত্যাবশ্যকীয়  পার্থক্যের  ওপর  বেশি  গুরুত্ব  আরোপ  করেছে  এবং  এর  ফলে  সমাজে  এক  অত্যান্ত  উগ্র  পন্থার  উদ্ভব  ঘটিয়েছে  ৷  আর্মস্ট্রং  বিগত  চার  হাজার  বছরের  ইতিহাস  পর্যালোচনা  করে  দেখিয়েছেন  যে ,  নারী  ও  পুরুষ  একসময়ে   জাগতিক  এই  বিশ্বের  অতীত  এই  রকম  একটি  ধারণাকে  ধারণ  করেছিল  যাকে  বর্তমানে  যে  ভাবেই  ব্যাখ্যা  করা  হউক  না  কেন  তা  ছিল  মানুষের  কাছে  এক  দুর্জ্ঞেয়র  অভিজ্ঞতা ,  যা  তার  জীবনে  যেন  চিরকালের  জন্যে  বাস্তব  হয়ে  রয়ে     গেছে  ৷  যাকে  অর্থাৎ  এই  উপলব্ধিমূলক    অভিজ্ঞতাকে  আবার  অনেকে  অলৌকিক  কিছু  বলে  বিশ্বাস  করেতে  পারেনি  ৷  যেমন  বৌদ্ধ  ধর্মে  বিশ্বাসীরা  ,  মানুষের  এই  ধর্ম  বা  ঈশ্বরে  বিশ্বাস  এবং  তাদের  ধর্মীয়  দর্শনকে   কোনো  অন্তর্দৃষ্টিমূলক    অতিপ্রাকৃতিক  উৎস  বা  ঈশ্বরিক  উংস  হতে  গৃহীত  হয়েছে  বলে  স্বীকার  করে  না বৌদ্ধ  ধর্ম  বিশ্বাসের অনুসরণকারীরা      ৷  বৌদ্ধরা  ঈশ্বরে  বিশ্বাসী  মানুষের  এই  অতিন্দ্রীয়তাকে  মানুষেরই  এক  স্বাভাবিক  ক্রিয়া  হিসেবে  দেখে  থাকে  ৷  যদিও  অন্যন্য  সকল  ধর্মবিশ্বাসীরা  বলে  যে , তাদের  বিশ্বাসের  এই  দুর্জ্ঞেয়কে  মানুষের  স্বাভাবিক  ধারণাগত  মানবীয়  ধারায়  বর্ণনা  করা  একটা  অসম্ভব  ব্যাপার  ৷

                এই  ক্ষেত্রে  আর্মস্ট্রং ইতিহাস  থেকে  কিছু  উদাহরণ  দিয়েছেন  ৷  তিনি  বলেছেন  ইহুদিদের  বলায়  ঈশ্বরের  পবিত্র  নাম  উচ্চারণকরাই  নিষিদ্ধ  ৷  আবার  মুসলিমদের  কাছে  প্রতিমার  মাধ্যমে   আল্লাহ্ র  অলৌকিকতার  মহিমা  উপস্থাপিত  করে  তা  প্রদর্শন  করা  নিষিদ্ধ  ৷  এই  সব  বিধান  পর্যালোচনা  করে  আর্মস্ট্রং  জেনেছেন  যে ,  বিশ্বাসীরা  যে  অলৌকিক 
সত্তাকে  ঈশ্বর  বলে  আখ্যায়িত করে  তা  তাদের  কাছে  সকল  প্রকার  মানবীয়  অভীব্যক্তির  অতীত  কোনো  ব্যাপার  ৷

            এতসবের  পরও  প্রকৃতপক্ষে  ঈশ্বর  বিশ্বাস  সম্পর্কে  ইহুদি  ,  ক্রিশ্চান  ও  মুসলিমদের  বিশ্বাসে  একটি  মিল  খুঁজে  পাওয়া  যায়  ৷  তবে  এটাও  লক্ষ্য  করা  যায়  যে , ইহুদি  ও  মুসলিমরা  ক্রিশ্চানদের  ট্রিনিটি  ও  ইনকারনেশনের  ধারণাকে  ভূল  বিশ্বাস  হিসেবে  অভিহিত  করে  ৷  তারা  এইসব  বিতর্কিত   ধর্মত্তত্ত্বের  ওপর  তাদের  নিজস্ব  একটি  ধরনও  সৃষ্টি  করেছে  ৷  তবে  এইসব  সার্বজনীন  ধারণার  প্রত্যেকটি  আবার  একটি  অপরটি  থেকে  সামান্য  ভিন্নতার  অধিকারী ,  যা  ঈশ্বর  এর  অভিব্যক্তি  প্রকাশের  ক্ষেত্রে  মানুষের  সৃজনশীলতা  ও  মেধার  পরিচয়  পাওয়া  যায়  ৷  এর  পরও  এই  তিন  ধর্মের  বিশ্বাসীরা  যে  সত্তার  অভিজ্ঞতা লাভ  করেছে  বলে  প্রকাশ  করে  তার  বিবরণ  দিতে  গিয়ে  তারা  কিন্তু  আবার  অর্থডক্স  ধর্মতত্ত্বের  সীমানায়  দাঁড়িয়ে  যাওয়া  এক  সাহসিকতাপূর্ণ  কল্পনার  আশ্রয়  নিতে  বাধ্য  হতে  হয়েছে  ৷

        যাকে  মিথলজি  হিসেবে  বর্তমানে  আখ্যায়িত  করছেন  যুক্তিবাদীরা  ৷  প্রয়াত  আমেরিকান  পণ্ডিত  ক্যাস্পবেলের   তিনি  মানুষের  চিরকালের  মিথলজি  নিয়ে  গবেষণা  করেছেন  এবং  প্রথাগত  সমাজে  এখনও  প্রচলিত  কিংবদন্তীসমূহের  সঙ্গে  মিথের  যোগসূত্র  আবিষ্কার  করেছেন  ) মতে প্রচলিত  তিনটি  ঈশ্বর  ঈশ্বাসী  ধর্ম  মিথলজি  কাব্যিকতার  প্রতীকধর্মীয়তা   মুক্ত  ছিল  ৷  কিন্তু  একেশ্বরবাদীরা  প্রথমে  বা  আদিতে  তাদের  পৌত্তলিক  প্রতিবেশীদের  মিথ  প্রত্যাখ্যান  করলেও  পরবর্তিকালে  সেগুলো  আবার  তাদের  অজানতেই  তাদের  মাঝে  ফিরিয়ে  এনেছে  ৷ যেমন  অতিন্দ্রীয়বাদীরা  ঈশ্বরকে  প্রথমে  নারী  হিসেব  প্রত্যক্ষ  করেছে  আবার  অ-অতিন্দ্রীয়বাদীরা  ঈশ্বরেকে  দেখেছে  পুরুয়ের  প্রতীক  হিসেবে  ৷  তবে  আর্মস্ট্রং  এর  মতে  ঈশ্বর  সম্পর্কিত  সকল  আলোচনা  অসম্ভব  সমস্যায়  আবর্তিত  হয়ে  ওঠেছে  এখন  ৷ এর  পরও    একথা  বলতে  হবে  যে  ,  একেশ্বরবাদীরা  ভাষার  মাধ্যমে  তাদের  ধারণাকে  ইতিবাচক  রূপে  প্রতিষ্ঠিত  করতে  সমর্থ  হয়েছে  ৷  এবং  একই  সময়ে  তারা  এক  দুর্জ্ঞয়েয়  সত্তার  প্রকাশে  ভাষার  ক্ষমতাহীনতাকেও  মেনে  নিয়েছে  ৷

          ইহুদি  ,  ক্রিশ্চান  ও  মুসলিমদের  বিশ্বাসের  ঈশ্বর  একজনই ,  যিনি  একই  অর্থে  একই  ধারায়  কথা  বলেন  ৷  তাই  এই  তিনটি  ধর্ম  বিশ্বাসীদের  ক্ষেত্রেই  ঈশ্বরের  বাণী  অত্যান্ত  গুরুত্বপূর্ণ  ৷  আর  ঈশ্বরের  বাণীই  আমাদের  ধর্মের  এবং  এই  সঙ্গে  আমাদের  সামাজিক  সংস্কৃতির  ইতিহাস  নির্মাণ  করেছে  ৷  তবে  আমাদের  অপেক্ষা  করতে  হবে  ঈশ্বর  শব্দটি  ভবিষতে  আমাদের  জন্যে  কোনো  পরিবর্তিত  অর্থ  বহন  করবে  কি  না  তা  দেখতে  ৷
             প্রায়  ৫০০  পৃষ্টার  বইয়ের মূল  বক্তব্যের এক  সংক্ষিপ্ত  রূপ  এই  লেখাটি  , তাই  বিস্তারিত  ভাবে  বিতর্কিত  বিষয়গুলোর  কোনো  ব্যাখ্যার   চেষ্টা  করা  হয়  নি  ৷  আগ্রহীরা  ইচ্ছা  করলে  সূত্রের  মূল  বইটি  অন লাইন  থেকে  পড়তে  পারবেন  ৷  এই  লেখার  সবগুলো  মতামতই  মূল  লেখক  ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  এর  ৷

  ( সূত্র; A History of God : The 4000- year  Quest  of   Judaism  ,  Christianity  and  Islam  by Karen Armstrong ,  translated  by Saokot   Hossain )




 






মন্তব্যসমূহ