এ কে খন্দকারের নতুন লেখা বই - ভেতরে বাইরে প্রসঙ্গে ;


ভূমিকা  

A.K. Khandaker




স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান
এম আমীর-উল ইসলাম

এঁরা কোন মেসেজের জন্য অপেক্ষা করেননি। তাঁদের সংকেতের জন্য ৭ মার্চের ভাষণই ছিল যথেষ্ট। সারাদেশের সাধারণ মানুষ কোন সবংংধমব বা ঘোষণা বা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন না। ২৫ মার্চের রাত্রে Operation Search Light-এর প্রথম কামানের আওয়াজটাকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণার সঠিক মুহূর্ত বলে দেশবাসী মনে করে। “আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে-আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।”

                       কিন্তু প্রথম দালিলিক প্রমাণ আমাদের হাতে এলো যখন সীমান্ত পার হবার পর আমাদেরকে গোলক মজুমদার অভ্যর্থনা জানাতে সীমান্তে এলেন তখন। তিনি জানালেন বিএসএফের কাছে বঙ্গবন্ধুর Wireless message তাদের Wireless-এ ধরা পড়ে। পরে তার একটা কপি আমাদেরকে দেন।

                    তখনই আমার মনে পড়ে ২৫ মার্চ বেলা গড়িয়ে দুইটা বা আড়াইটার সময় Wireless Engineer নূরুল হক সাহেবের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাত। আমি অনেক দেরি করে বাসায় এসেছি দুপুরের খাবার খেতে। আমি যখন গেট দিয়ে ঢুকছি তখন দেখি ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক আমার আগে তার গাড়ি নিয়ে আমার বাসায় ঢুকছেন। পূর্বের একটি আলোচনার সূত্র ধরে তিনি বললেন বঙ্গবন্ধু আমাকে একটি ট্রান্সমিটার আনতে বলেছিলেন। সেটি খুলনা থেকে আমি আনিয়ে রেখেছি। আমি এখন ওটা দিয়ে কি করব সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে নির্দেশনা চাই। আমি তাঁকে বললাম বঙ্গবন্ধু যা বলার তা ৭ মার্চেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আমার কাছে সংগঠন আছে আর কলম আছে। আমি এটা দিয়ে কাজ করব। আপনার কাছে ট্রান্সমিটার আছে- সেটা দিয়ে আপনি শত্রুর মোকাবিলা করবেন। আমি আপনাকে কি লিখে দিবো কি বলতে হবে? উনি বললেন তার প্রয়োজন হবে না। 

" এতেই হবে।  but that may cost my life ; yet it  may be worth doing and i will do it "  .

                    আমি  জানতে  পারলাম   ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। পরে  আরো  জানতে পেরেছি তিনি তাঁর    এ   প্রতিশ্রুতির মূল্য দিয়েছেন তাঁর জীবন দিয়ে।

                     কয়েকদিন তাঁকে সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে খুঁজে বের করতে বলেন যে, ট্রান্সমিটার কোথায় রেখেছেন। তাঁরা তাঁর বাড়িতেও তল্লাশি করান। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি আর ফিরে আসেননি।

                অনেকদিন পর হাজী গোলাম মোর্শেদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ত্যাগ করার পর বঙ্গবন্ধু ও গোলাম মোর্শেদকে বন্দী করার পূর্বে একটা টেলিফোন আসে। কণ্ঠটি খুব গভীর ও দৃঢ়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি বলেন, আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। আমার কাজ শেষ করেছি। আমি এখন কি করব। মুর্শেদি ভাই বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলে বঙ্গবন্ধু বলেন ওটা ভেঙ্গে চুরে দিয়ে চলে যেতে বলো। দিল্লীতে যখন এম আর সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তখন তিনিও ঐ Wireless  message -এর প্রিন্টটি দেখে Confirm করেন যে এটাই সেই মেসেজ যেটা তাঁরা চট্টগ্রামেও পেয়েছিলেন। 

        ৯ এপ্রিলে গভীর রাতে কলকাতায় বিএসএফের অতিথিশালায় বসে আমি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখতে শুরু করি। 

        
তখন ঐ একটি মাত্র দলিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা আমার সামনে ছিল। আর কোন দলিল বা বই আমার কাছে ছিল না। ঐ ঘোষণাটির ওপর নির্ভর করেই আমি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রচনা করি। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আমাদের স্বীকৃতি প্রাপ্তির যে চিঠিটি পড়ে আমি তৈরি করি তার সঙ্গে সংযুক্তি ছিল ঐ ঘোষণাটি। আমার তৈরি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর ইংরেজিতে লেখা বক্তৃতাটি যেটা ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে পাঠ করা হয় এবং সাংবাদিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও তাজউদ্দীন সাহেবের লিখিত ইংরেজি বক্তৃতাটি বিলি করা হয়। 

  (  সূত্র ;৬ নভেম্বরের  দৈনিক  জনকণ্ঠের  চতুরঙ্গ  পাতার  এম  আমীর-উল  ইসলামের  ধারাবাহিক  লেখার  একটি  অংশ  )     

 মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল। জনযুদ্ধ, সামরিক বিদ্রোহ নয়। অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পাক-হানাদার বাহিনীকে বিতারণ। তৎকালীন জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ছিল কোন রাষ্ট্রের অংশ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে কোন জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র স্বীকৃতি বা সহযোগিতা দেবে না। অথচ বিশ্বের জনমত ও প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া কোন রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে এমন কোন নজির নেই। বঙ্গবন্ধু এই বাস্তবতার আলোকে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পরেই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। যার ফলে বিশ্ববাসীর সমর্থন পাওয়া যায় এজন্য যে এটি মামুলি কোন বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন বা হঠকারিতা নয়। একটি নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং পাক জান্তা সেই দলের নেতাকর্মী এবং সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ বাঙালীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প ছিল না এটা বিশ্ববাসীর কাছে নিশ্চিত করতে পারলেই সমর্থন পাওয়া যায়। আর বঙ্গবন্ধু যদি ভারতে যেতেন তাহলেও এতটা ক্রিয়াশীল হতো না। বন্ধী হওয়ার ফলে তার মুক্তি ও স্বাধীনতা সমার্থক হলে বেগবান হয়েছিল (বঙ্গবন্ধুর জন্য রোজা রেখেছেন হাজারো বাঙালী)। বঙ্গবন্ধুর এই কৌশলটি যথাসময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গমতার একটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে বিশ্বে প্রশংসিত। 

           
        

     ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হন যে হয় তাঁকে বন্দী অথবা হত্যা করা হবেকিন্তু তার পূর্বে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রস্তুত করে ফেলেন এবং রাত বারোটা নাগাদ বন্দী হওয়ার পূর্বেই টিএন্ডটি/ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারের ব্যবস্থা নেনরাত ১০টার মধ্য বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ, যুবনেতা শেখ মনি, তোফায়েল আহম্মেদ, নুরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ বিশ্বস্তদের নিরাপদে চলে গিয়ে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন তা বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে দ্রুত বিদায় করে দেনস্বাধীনতার মূল ঘোষণাটি ছিল ইংরেজীতে যা নিম্নরূপ :
This may be may last message. From today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh Wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan Army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. JOY BANGLA.
(সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র ৩য় খন্ড পৃ. ১)
রাত বারোটা নাগাদ একদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকবাহিনী বন্দী করে অপরদিকে (২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রেকর্ডকৃত স্বাধীনতা ঘোষণা বাণী টিএন্ডটি/ইপিআর ওয়্যারলেস নেট ওয়ার্কে দেশব্যাপী প্রচার হতে থাকেচট্টগ্রামে ওয়্যারলেস বিভাগের মাধ্যমে রাত একটা নাগাদ জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাটি পান এবং তা এম এ হান্নান এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বঙ্গানুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল করে শহরে বিতরণের ব্যবস্থা করেনএছাড়া সে রাতেই মাইকযোগে প্রচার করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেনসমগ্র বাংলাদেশের জেলা/ মহকুমা শহরে সে রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে প্রচারিত হয়২৬মার্চ সকাল নাগাদ গ্রামাঞ্চলেও টিএন্ডটির মাধ্যমে টেলিগ্রাম আকারে এই খবর ছড়িয়ে পরেহানাদার বাহিনীর জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক উইটনেস টু সারেন্ডার নামক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সম্মিলিত যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাতে (পৃ. ৫) উল্লেখ রয়েছে যে, যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মনে হলো পূর্ব রেকর্ডকৃততাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করলেন তৎকালীন ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রভাবশালী ছাত্রনেতা কাজী আরেফ আহমেদ (পরবর্তীতে জাসদ সংগঠক-প্রয়াত) সাপ্তাহিক বিচিত্রা স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা/৯০ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, রাত ১০টার কিছু পর সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ইকবাল হলে এসে তাদের জানালেন, কিছু সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা ইপিআর-এর পিলখানাস্থ ওয়্যারলেস সেট থেকে প্রচার করা হবেকাজী আরেফ ও মেজর সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য থেকে ইহাই স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি টেপে ধারণ হয় ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের সন্ধ্যা এবং রাত ১০টার মধ্যে কোন এক সময় যা ইপিআর ও টিএন্ডটি বিভাগের মাধ্যমে রাত ১২টার পর প্রচার করার নির্দেশ দেয়া হয় 
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কালুরঘাটস্থ ট্রান্সমিটিং সেন্টার চালু করে স্বকণ্ঠে প্রচার করেন দুপুর দুটো নাগাদএকই দিন রাতে বিবিসির সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন, যা গোপন বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছেঅপর দিকে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, পূর্ব পাকিস্তানে তার সরকারের কর্তৃত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের উপর যুদ্ধ শুরু করেছেনএম এ হান্নানের কণ্ঠেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল বলে তৎকালীন ঘটনার প্রত্যক্ষকারী মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূইয়া প্রমুখ তাঁদের গ্রন্থে/ রচনায় উল্লেখ করেছেনমেজর মীর শওকত আলীর (পরে লে. জে. এবং বিএনপি নেতা-মন্ত্রী) ভাষায়, যদি বলা হয় প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল তা হলে আমি বলব, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র- নবম খণ্ড দ্রষ্টব্য)
মেজর জিয়াউর রহমান বেতার ভাষণ দেন ২৭ মার্চতিনি ২৬ মার্চ করইলডাঙ্গা গ্রামে ছিলেনস্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ তাঁর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গ্রন্থে (পৃ. ৫২) লিখেছেন, বেতার কেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য মেজর জিয়াকে করইলডাঙ্গা গ্রাম থেকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় এবং বেতার ভাষণ দেন

মেজর জিয়া ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলায় স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা (বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৯ম খণ্ড পৃ. ৪৪-এ সংযোজিত দলিল) এবং ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেনএই রচনায় মেজর জিয়া উল্লেখ করেছেন যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাঁর কাছে গ্রীন সিগন্যাল মনে হয়েছিলতিনি যে ২৫ মার্চ রাত ১১টায় সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন, তাও উল্লেখ রয়েছেউক্ত নিবন্ধে ২৭ মার্চ/ ৭১ তারিখ সন্ধ্যায় পরে জিয়াউর রহমান যে ভাষণ দেন তাঁর স্বকণ্ঠে বাণীবন্ধ টেপ থেকে নিম্নে তুলে দেয়া হলো :-
The Government of the Sovereign State of Bangladesh on behalf of our Great Leader, The supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, we hereby proclaim the independence of Bangladesh and the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of seventy Five Million People of Bangladesh, and the Government headed by him is the only legitimate government of the Independent Sovereign government of the people of the Independent Sovereign State of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed, and is worthy of being recognized by all the governments of the World. I therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the government of all the democratic countries of the world, specially the Big Power and the neighboring countries to recognize the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The guiding principle of a new state will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. JOY BANGLA.  ( সূত্র  -সরদার  সিরাজুল  ইসলাম , জনকণ্ঠে  প্রকাশিত )
 

                   এ কে  খন্দকারের  নতুন লেখা  বই  - ভেতরে  বাইরে  প্রসঙ্গে ;

          এ কে  খন্দকার  সাহেব  বোধহয়  আমাদের  দেশে  আবার  প্রমান  করলেন  যে , কোন  বিশেষ  এক  প্রফেশন্যাল  লাইনের  লোকেরা  কখনও  কোনও  একটি  বিষয়কে  এর  প্রেক্ষাপট  সহ  বিষয়টিকে  সামগ্রীক  ভাবে  বিবেচনা  করতে  ব্যর্থ     হয়  ৷  তাই  তিনি  সরাসরি  বা  বাস্তবভিক্তিক  প্রমান  ছাডা    বাঙালীর  আবেগের  একটি  বিষয়  বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধের  পটভূমির  উপর  এই  রকম  একটি  শোনা  কথার  ওপর  নির্ভর  করে  একটি  তথ্য  তার  বইয়ে  সংযুক্ত  করতে  পেরেছেন  ৷  এখন জানা  যাচ্ছে    বইটির  প্রকাশনা  সংস্থা  প্রথম  আলোর  প্রথমাতে তিনি  নাকি  বইটির  সম্পূর্ণ  পান্ডুলিপি  জমা  দেন  নাই  ৷ তার  নিজের  লেখা   পন্ডুলিপির  কিছু অংশ  প্রথমাকে  দিয়েছিলেন  ৷  বইয়ের  বাকিঅংশ  লেখকের  সঙ্গে  আলাপ  আলোচনা  করে  প্রকাশক   পরে  পুরো  বইটি  প্রস্তুত  করেন  এবং  পরে  বই  আকারে  প্রকাশ  করা  হয়েছে  ৷(সূত্র; মুহাম্মদ  জাফর  ইকবাল-ইতিহাসের  ইতিহাস , জনকণ্ঠ )

            তবে    সংশ্লিষ্টরা  জানিয়েছেন যে  মার্চের  ৩ তারিখে  বঙ্গবন্ধ  তাঁর  এক  সংক্ষিপ্ত  ভাষণে  জয়  বাংলা  বলার  পর  জয়  পাকিস্তান  বলেছিলেন ৷  তবে  ৭  মার্চের  ঐতিহাসিক  ভাষণে  শুধু  জয়  বাংলা  বলে  ভাষণ  শেষ  করেছেন  ৷  তবে  কেউ  কেউ  বলেন  কোনো  একটি  মহল  ৭ মার্চের  ভাষণকে  বিতর্কিত  করতে  বঙ্গবন্ধুর  ৩ মার্চের  ভাষণের সঙ্গে  জয়  পাকিস্তান  শব্দটি  যুক্ত  করে  একটি  নকল  ভাষণের  রেকর্ড  প্রচার  করার  ব্যবস্থা  করা  হয়েছিল  , সে  ভাষণটিও  অনেকে  শুনেছেন  এবং  যারা  ৭  মার্চের  ভাষণ  সরাসরি  মিটিংয়ে  উপস্থিত হয়ে  শুনেননি    ,    তাদের  অনেকে  এই  নকল  ভাষণটিকে  মূল  ভাষণ  মনে  করেছেন  ৷  আর  ভাষণটি  যেহেতু  সরাসরি  মিটিং  থেকে  প্রচার  করতে  অনুমতি  দেয়া  হয়  নি  এবং  বেতার  কর্মীদের  প্রতিবাদের  কারণে  রেডিও  থেকে  পরেরদিন  প্রচার  করা  হয়েছে  তাই  কোনটা  আসল  আর  কোনটা  নকল  ভাষণ  তা   অনেকের  কাছে   স্পষ্টভাবে  প্রকাশ  হয়  নি  ৷  কারণ  ভাষণ  নকলকারীরা  গোপনে  নকল  ভাষণ  প্রচার  করেছে  আর  বলেছে  তাদের  প্রচারিত  ভাষণই  আসল  ভাষণ  ৷  এর  ফলে  একটি  কনফিউশণের  সৃষ্টি  করতে  নকলকারীরা  সফল       হয়েছিল  ৷ জয়  পাকিস্তানের  ব্যাপারে  ডেইলী  স্টার  পত্রিকার  সংবাদিক  সৈয়দ  বদরুল  আহসান  আরো  একটি  বিশ্বাসযোগ্য  ব্যাখ্যা  দিয়েছেন  ৷  তিনি  বলেছেন  তার  এক  লেখায়  যে,   মার্চের  ৭ তারিখের  ভাষণটি  পশ্চিম  পাকিস্তানে  যখন  প্রচার  করা  হয়  তখন  স্থানীয়  পত্রিকাগুলো  তাদের  পশ্চিম  পাকিস্তানের  মানুষেরা  যাতে  বিচলিত  না  হয়  সেজন্যে  বক্তৃতার  শেষে  জিয়ে  পাকিস্তান  কথাটুকু  জুড়ে  দিয়েছিল  ৷  সেই  কথাগুলো  পরে  নানাজনের  মাধ্যমে বাংলাদেশে  প্রচারিত  হয়ে  একটি  বিশ্বাসযোগ্যতা  অর্জন  করেছিল  ৷ 

২৬  মার্চের  রাত্রের  স্বাধীনতা  ঘোষণা  করাটা  ও   সঙ্গত  কারণেই  অতী  গোপনে ঘোষণা  করার  ব্যবস্থা  করা  হয়েছিল  ৷  তাই  এসব  ব্যাপারে  মন্তব্য  করতে  হলে  অনেক  গবেষণা  করে  তথ্যাদি  সংগ্রহকরা  ছাড়াও  সামগ্রীকভাবে  পরিস্থিতি  বিবেচনা  করার  পরই  মন্তব্য  করা  বাঞ্জনীয়  ৷ কারণ  এই  ব্যাপারটা  নিয়ে  অনেক  গবেষণা  হয়েছে  এবং  অনেক  নির্ভরযোগ্য  প্রমাণাদি  ও  এখন  পাওয়া  যায়  ৷ খন্দকার সাহেব এর  কোনোটাকেই  গুরুত্ব  না  দিয়ে  নিজের  মধ্যে  লালনকরা  দীর্ঘদিনের  ভ্রান্ত  ধারণা  এবং  শোনা  কথার  ওপর  বেশি  গুরুত্ব  দিয়ে  ফেলেছেন ৷  যেটা  এক  আদর্শে  বিশ্বাসীদের  বেলায় প্রায়ই  ঘটে  থাকে  ৷  এ  ক্ষেত্রেও  এর  ব্যতিক্রম  হয়  নি  ৷ এই  ব্যাপারটি  নিয়ে  শরমিন  আহমেদ এর  রচিত  বইয়ের  কিছু  অংশ  সংযুক্ত  করা  হলো  যে  বই  নিয়ে  কেউ  কেউ  বিতর্কের  সৃষ্টি  করার  প্রয়াস  পাচ্ছেন ৷

         
         

  শারমিন আহমদ

স্বাধীনতার অখণ্ডিত ইতিহাস ভবিষ্যতের পাথেয়

 

  বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন তা তথ্য এবং সাক্ষাৎকারসহ আমার বইতে স্পষ্ট উল্লিখিত
[১৪৭-১৪৮২৭৪-২৯১৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা]


বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার একমাত্র জীবিত সাক্ষীবঙ্গবন্ধুর পারসোনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদযিনি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন হতে গ্রেফতার হনতাঁর এবং প্রকৌশলী শহীদ নুরুল হক যিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা হতে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন ঘোষণা দেবার জন্য, ওনার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার আমার বই
বইতে আরও উল্লিখিত যেবঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ২৬ মার্চ দুপুরে এবং সেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দেনতেই প্রথম ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে [

         ১৪৭ পৃষ্ঠা] এবং ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে পরবর্তী ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান
 [
৭১ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা] 

আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যা বইতে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকারে উদ্ধৃত হয়েছে তা হল
অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেনঅতএব ঐ দিন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকরী হবে’’

[২৬১ পৃষ্ঠা]

         গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতেপ্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ১০ এপ্রিলের বেতার ভাষণে উল্লেখ করেন

             “২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন

[বইয়ের ৩৯৭ পৃষ্ঠায় ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিতে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পূর্ণ ভাষণ উল্লিখিত হয়েছে]

           একটি জাতি তখনই সত্যিকারের অগ্রগতি লাভ করে যখন সে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ইতিহাস জানার আন্তরিক প্রয়াস নেয়, অখণ্ডিতভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করেসততা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে, নির্মোহ চিত্তে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস যাচাই বাছাই করে দেখার ক্ষমতাসম্পন্ন জাতির পক্ষেই সম্ভব ইতিহাসের সঙ্গে চলা; একটি সবল ও সুন্দর রাষ্ট্রের গর্বিত প্রতিনিধি হওয়া

শারমিন আহমদ: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা

            যেমন  আমরা  পূর্বেও  দেখেছি  বিশেষ   কোনো  আদর্শে  বিশ্বাসী  লোকেরা  নিরপেক্ষ  দূষ্টিভঙ্গি  গ্রহণে  সক্ষম  হয়  না  ৷

              প্রসঙ্গক্রমে  উল্লেখযোগ্য  যে ,  ইসলাম  ধর্ম  প্রতিষ্ঠার  প্রায়  ৭/ ৮  শত  বছর  পর  এবং  ইসলাম  ধর্ম   চর্তুদশ  শতাব্দীতে  পৌঁছার  পর  ইসলাম  ধর্মে  বিশ্বাসী  কিছু  লোক  অতীতের অপ্রমাণিত  ও শোনা  কথাকে  বিশ্বাস  করে  শুধু  আক্ষরিক  অর্থে  কোরানের  ব্যাখ্যা  দিতে   আরম্ভ  করে   দেন  ৷ তাই  তখন  থেকে  কোরান   এর  আয়াত  নাযিলের  কোন   পটভূমি  ব্যাখ্যা  না  করে      শুধু  আক্ষরিক  অর্থেই  কোরানের  আয়াতের  নির্দেশ  পালনের  রেয়াজ  শুরু  হয়ে  যায়  ৷ অথচ  বিশেষ  পরিস্থির  বিশেষ  প্রক্ষাপটে  কোরানের  আয়াত  নাযিল  হয়েছিল  বলে কোরানের  প্রকৃত  তফসিলকারীরা  বলে  থাকেন  ৷  

                এর  ফলে  দীর্ঘদিন  থেকে  প্রচলিত  ইসলামের  সেই  বিখ্যাত  রীতি  ইজতিহাদ  প্রথাকে  বাতিল  করে  দেয়া  হয়    ৷    তখন  থেকে  ইসলাম  ধর্মে ,  ইসলামধর্মের  ব্যাখ্যা  দিতে  সমর্থকারী   ব্যক্তিদের  ধর্ম  সম্পর্কে  তাদের  সুচিন্তিত  স্বাধীন  মতামত  প্রকাশের  অধিকার  খর্ব এবং  বাতিল  হয়ে  যায়  ৷  ইজতিহাদের  মাধ্যমে  ইসলামী  পণ্ডিতগণ  এরপূর্বে    তাদের  নিজস্ব  যুক্তিভিত্তিক  অন্তর্দৃষ্টির  সাহায্যে  ইসলামের  যে  কোনো  বিতর্কিত  বিষয়ের  মিমাংসা   করে  দিতেন  এবং  সকলে  তা  গ্রহণ  বাধ্য  থাকত   ৷  ফলে  অতীত   ইসলামে  বর্তমানের  মত  এত  মারামারী  ও  দলাদলি  ছিল  না  ৷ তখন  ইসলাম    শান্তির  ধর্ম ছিল  সত্যিকার  রূপে  এবং  অন্য ধর্মের  বিশ্বাসীদের  ওপর  ইসলাম  কোনও  রকম  বল  প্রযোগে  বিশ্বাসী  ছিল   না  ৷  
            তবে খন্দকার  সাহেবের   মত লোকেরা    যারা      নির্দিষ্ট  কিছু  বিশ্বাসে  আবদ্ধ  হয়ে  আছেন তারা  যদি  দিন  দিন    তাদের  কাজের  পরিধি আরো বাড়েয়ে  দেন  তবে  বর্তমান ইসলাম  ধর্মের  ভিন্ন  ভিন্ন  ব্যাখ্যার  মত  বাংলাদেশের  স্বাধীনতাও  এক সময়ে এর মূল অস্তত্ব  সংকটে  পড়তে  পারে  ৷  তাই  এ  ব্যাপারে  সংশ্লিষ্টরা  যুক্তির  মাধ্যমে  এবং  এর  প্রেক্ষাপট  তুলেধরে   এর  সমাধান  খুঁজে  বের  করতে  হবে  ৷  সবসময়  একজন  মানুষ  নিজে  একা  সব  কাজ  করতে  সমর্থ  নাও  হতে  পারেন  পারিপার্শ্বিক  অবস্থার  কোনো  কারণে  ৷  তখন  অন্য  এবং  বিশ্বস্থ  কাউকে  নিয়োগ  করে  তার  পূর্ব   নির্ধারিত কাজ  সমাপ্ত  করতে  সক্ষম  হলে  তো  এ  ক্ষেত্রে  কোরো  আপত্তি  থাকা  উচিত    নয়  ৷ স্বাধীনতা  ঘোষণার  ব্যাপারে  এই  যুক্তিটা  আমাদের  মানতেই  হবে  ৷  আর  প্রস্তুত  করা  বইয়ের  জবাব  যারা  বইটি  প্রস্তুত  করেছে  বলে  স্বীকার  করছে  তাদেরও  জবাবদিহী  করার  ব্যবস্থা  করা  উচিত  নয়  কী  ?


\









মন্তব্যসমূহ