আপন অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্মের ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত লেখক ও গবেষক ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর ঈশ্বর দর্শন : (৩য় পর্ব )


 

          আপন অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্মের ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত লেখক ও গবেষক ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর ঈশ্বর দর্শন !  ( ৩য়  পর্ব )

          ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  তার  লিখিত  গ্রন্থে  বিগত  প্রায়  চার  হাজার  বছরের  ধর্মীয়  ইতিহাসের  পর্যালোচনা  করেছেন  নিরপেক্ষ  দৃষ্টিভঙ্গি  নিয়ে  ৷   ধর্মীয়  ইতিহাস  পর্যালোচনায়  ব্যক্তিগতভাবে  তিনি  মানুষের  ধর্মবিশ্বাস  ও  ঈশ্বর  বিশ্বাসের  উপরে  যে  জ্ঞান  অর্জন  করেছেন  এবং  ধর্মবিশ্বাসের  যে  উপলব্ধি  ব্যক্তিগত  ভাবে তিনি লাভ  করেছেন  তার  একটি  বর্ণনা  দিয়েছেন  সংক্ষেপে তার  আলোচ্য  এই  বইয়ে  ৷  তবে সব  তার  নিজের  কথায়  নয়  ৷  এক্ষেত্রে  তিনি  সাহায্য  নিয়েছেন  ইতিহাসে  বিখ্যাত  কিছু  দার্শনিক  ও  বৈজ্ঞানিকদের  ৷  যারা  মানব  সভ্যতার  আলোকন  পর্বে  তাদের  বিশ্বাস ও  অভিজ্ঞতা  সমাজে  প্রতিষ্ঠা  করে  মানব  সমাজকে  বর্তমান  সভ্য  ও  আধুনিক  পর্যায়ে  উন্নিত  করতে  সমর্থন  হয়েছেন  ৷  তাদের  মধ্যের  একজনের  নাম - পল হেইনরিথ  ডিট্রিচ , ব্যারন  দে’হলব্যাখ  ৷  তিনি  ১৭৭০  সালে  “ দ্য  সিস্টেম  অভ  নেচার :  লজ  অব  দ্য  মোরাল  এন্ড  ফিজিক্যাল  ওয়ার্ড” নামে একটি  বই  প্রকাশ  করেন  ৷  ১৮৩৫  সালে  এইচ  . ডি . রবিনসন  এই  বইটির  অনুবাদ  প্রকাশ  করেন  দুই  খন্ডে  নিউ ইয়র্ক  থেকে  ৷  নিম্নে  সেই  অনুবাদ  গ্রন্থের  ২য়  খন্ডের  ২২ ও ২৩  পৃষ্টা  থেকে  কিছু  বর্ণনার  উল্লেখ  করা  হয়েছে ৷  এই  বইটিকে  তখন  নাস্তিক্যবাদী  বস্তুবাদের  বাইবেল  হিসেবে  পরিচিত  হয়ে  ওঠেছিল  ৷  ঐ  বইটির  লেখকের  মতে  প্রকৃতির  কোনও  অতিপ্রাকৃতিক  বিকল্প  নেই  , কারণ প্রাকৃতিক  ভাবে   সংঘটিত  কোনো  একটি  ঘটনার  কারণ  এবং   এর  ফলাফলের  এক  বিশাল  ধারা ,   যা  অবিরাম  একটি  থেকে  অন্যটিতে  প্রবাহিত  হয়  ৷  লেখকের  মতে  মানুষের  ঈশ্বরের  বিশ্বাস  একটি  অসততার  প্রকাশ   এবং  আমাদের  প্রকৃতিক  অস্তিত্বকে  অস্বীকার  করা ও  একটি  হতাশারও  পরিচায়ক  ৷ তার  মতে মানুষের  ধর্মই বিশ্বাসই  দেবতাদের  সৃষ্টি  করেছে ,  কারণ  এই  পৃথিবীর  জীবনের  দুঃখকষ্টে  সান্ত্বনা  পাওয়ার  জন্যে  মানুষ আর  কোনও  ব্যাখ্যা বা  অবলম্বন  খুঁজে  পায়নি ঈশ্বরে  বিশ্বাস করা  ছাড়া  ৷  আদিম  মানুষ নিজদের  নিয়ন্ত্রণের  এক  ভ্রান্ত  বোধ  সৃষ্টির  প্রয়াসে  ধর্ম  ও  দর্শনের  কাল্পনিক  সান্ত্বনার  আশ্রয়  নিয়েছে , আতঙ্ক  ও  বিপর্যয়  প্রতিরোধ  করার  জন্যে  নেপথ্যে  ক্রিয়াশীল  এক  কাল্পনিক  এজেন্সিকে  প্রসন্ন  করার প্রয়াস  পেয়েছে  ৷  লেখকের  মতে  এরিস্টটল  ভূল  করেছিলেন  ৷  তার  মতে  দর্শন  জ্ঞান  অর্জনের  মহৎ  আকাঙ্ক্ষার  ছিল  না ,  তা  ছিল  বরং  মানুষের  দুঃখ  কষ্ট  এড়ানোর  ভীরু  ইচ্ছার  প্রতিফলনের  পরিণতি  ৷  তার  মতে  ধর্মের  আশ্রয়  নেয়া  হচ্ছে  অজ্ঞতা  ও  আতঙ্ক , তাই  একজন  পরিণত  আলোকিত  মানুষকে  অবশ্যই  একে  অতিক্রম  করে  আসতে  হবে  ৷ 

          গবেষক  ও  দার্শনিক  হলবাথ  তার  প্রাপ্ত  অভিজ্ঞতার  বর্ণনা  দিতে  গিয়ে  স্পষ্টভাবে  বলেছেন  আদিম  মানুষ  প্রথমে  প্রকৃতির  বিভিন্ন  শক্তির  উপাসনা  আরম্ভ  করেছিল  ৷  কারণ  তাদের  কাছে  আদিম  আনিমিজম  গ্রহণযোগ্য  ছিল  ৷  তবে  আদিম  মানুষ  কখনও  এই  জগতের  ঊর্ধ্বে  যাওয়ার  কোনো  প্রচেষ্টা  করেনি  ৷  কিন্তু  মানুষ  যখন  নিজেদের  ইমেজ  ও  পছন্দের  আদলে  বায়বীয়  ঈশ্বর  সৃষ্টির  উদ্দেশ্যে  সূর্য , সাগর  ও  বাতাসকে  তাদের  পছন্দমত  ব্যক্তিরূপ  দিতে  শুরু  করে  তখন  থেকেই  আদিম  মানুষের প্রকৃতিক বিশ্বাস  ত্যাগের  সূচনা  ঘটা  আরম্ভ  হয় ৷  এর  পরিণতিতে  এসব  প্রাকৃতির  সৃষ্ট  উপাদান  যা  প্রকৃতির  ভারসাম্য  রক্ষার্তে  প্রকৃতিগতভাবেই  প্রস্তুত  হয়েছিল  সেগুলোকে  পর্যায়ক্রমে  দেবতায়  রূপান্তরিত  করে  এবং  এসবের  উপাসনা  আরম্ভ  করে  ৷ যা  আসলে  বিরাট  এক  ভূল  বিশ্বাসের  ওপর  ভিত্তি  করে  গড়ে  উঠেছিল  ৷  হুমায়ুন  আজাদ  যাকে    বলেছেন  আদিম  মানুষের  অবিকাশিত  মস্তিষ্কের  ভূল  সিন্ধান্তের  ফসল  ৷  হলবাথ  এর  মতে ,

 “  শত  শত  বছর  ধরে  কবি , দার্শনিক  ও  ধর্মবিদরা  কেবল  সুবিশাল  পরিবর্ধিত  মানুষ  তৈরি  করা  ছাড়া  আর  কিছু  করেননি  ৷  যাকে  তারা  বেমানান  সব  গুণাবলী  একত্রিত  করার  মাধ্যমে  অনন্য  সাধারণ  করেছেন  মানুষকে ৷  তাই  মানুষ  যা  ঈশ্বরের  মাঝে  কখনওই দেখবে না  ৷  তাকে  তারা  মানবজাতির  একটি  সত্তার  মাঝে  বিভিন্ন  অনুপাতে  বাড়িয়ে  তোলার  প্রয়াস  পেয়েছে , যতক্ষণ  না  দুর্বোধ্য  একটি  সত্তার  সৃষ্টি    হচ্ছে ”  ৷

         ক্যারেন  আর্মস্ট্রং  ইতিহাস  পর্যালোচনা  করে  তার  আলোচ্য  বইয়ে  দেখিয়েছেন  যে , ঈশ্বরের  তথাকথিত  মহানুভবতাকে  তাঁর  সর্বশক্তিমানতার  সঙ্গে  সমন্বিত  করা  অসম্ভব  এক  ব্যাপার  ৷ তার  মতে  এখানে  সঙ্গতির  অভাব  রয়েছে , তাই  ঈশ্বরের  ধারণা  একসময়ে  বিনষ্ট  হতে  বাধ্য  ৷  দার্শনিকরা  ও  বিজ্ঞানীরা  এঁকে  রক্ষা  করার  যথাসাধ্য  চেষ্টা  চালিয়েছেন ,  কিন্তু  তাঁরাও  কবি  ও  ধর্মতাত্ত্বিকদের  চেয়ে  ভাল  সাফল্য  দেখাতে  ব্যর্থ  হয়েছেন  ৷

          দার্শনিক  দেকার্তে  যে  hautes  perfections প্রমাণ  করার  দাবি  করেছিলেন  আর্মস্টং  মনে  করেন  সেটা  ছিল  তাঁর  কেবল  কল্পনাসঞ্জাত  ব্যাপার  ৷  তার  মূল্যায়নে  নিউটনও  তাঁর  ছোটবেলার  সামাজিক  সংস্কারের  দাস  ছিলেন  ৷  যদিও  নিউটন  পরম  শূন্যতা  আবিষ্কার  করেছিলেন  এবং  শূন্য  হতে  একজন  ঈশ্বর  সৃষ্টি  করেছেন  যিনি  স্রেফ ( un home puissant ) ; এক  স্বর্গীয়  শাসক  যিনি তাঁর  সৃষ্ট  মানুষকে  ভয়  দেখিয়ে  দাসের  পর্যায়ে  নামিয়ে  আনেন  ৷

          ক্যারেনের  বিশ্লেষণে আধুনিক  যুক্তিবাদ  ও  বৈজ্ঞানিক  আলোকন  পর্ব মানুষকে  সৌভাগ্যক্রমে  তাদের  এই  শিশু  অবস্থা  কাটিয়ে  উঠতে  সক্ষম  করে  তুলছে  আর  বিজ্ঞান  ধর্মের  স্থান  গ্রহণ  করছে !   প্রকৃতি  সম্পর্কে   অবিকাশিত   মানুষের  যে  অজ্ঞতা  এক  পর্যায়ে  মানুষের  মনে  ঈশ্বরের  জন্ম  দিয়েছিল  বলে  মনে  করা  হয়  তাঁকে  ধ্বংস  করতে  প্রাকৃতিক  জ্ঞান  আহোরণ  আরম্ভ  করা  হচ্ছে  ৷  বর্তমানে  বৈজ্ঞানিকদের  মতে  সর্বোচ্চ  সত্য  বা  গোপন  নকশা  বলে  কিছু  নেই , নেই  কোনো  বিশাল কোনো  মহাপরিকল্পনা  ৷  বিজ্ঞানের  মতে  জগতে  একমাত্র  প্রকৃতিই  অস্তিত্বমান  , অন্য  সব  কিছু  আদিম  মানুষের  আদিম  কল্পনা  এবং  পরবর্তীকালে  কিছু  স্বার্থবাদী  মানুষের  ষড়যন্ত্রের  ফসল  ৷

          বৈজ্ঞানিকদের  মতে -

“ প্রকৃতি  কোনও  সৃষ্টি  নয় ; আগাগোড়াই  স্বয়ং-অস্তিত্ববান , তার  মাঝেই  সমস্ত  কিছু  পরিচালিত  হয়  ;  সমস্ত  মালমসলাসহ  এক  বিশাল  পরীক্ষাগার  সে  ,  প্রয়োজন  অনুযায়ী  প্রকৃতি  নিজেই  সকল  যন্ত্রপাতি  প্রস্তুত  করে  ৷  তার  সকল  কাজ  আপন  শক্তির  ফলাফল  এবং  সেইসব  এজেন্ট  বা  কারণের  পরিণতি  যা  সে  সৃষ্টি  করে , ধারণ    ও  করে ”৷ 

          তাই  আধুনিক  যুক্তিবাদী  ও  বিজ্ঞানিকদের  মতে  ঈশ্বর  যে  কেবল  অপ্রয়োজনীয়  তাই  নয়  , বরং  নিশ্চিতভাবে  ক্ষতিকরও  ৷  প্রায়  দুইশত  বছর  আগেই  বিজ্ঞানী  পিয়েরে- সাইমন দে  লাপ্লেস ( ১৭৪৯-১৮২৭ ) পদার্থ  বিজ্ঞান  হতে  ঈশ্বরকে  উৎক্ষিপ্ত  করেন  এবং  বলেন  সৌরজগৎ  ক্রমশঃ  শীতল  হয়ে  আসা  সূর্যের  বিক্ষিপ্ত  অংশসমূহে  পরিণত  হয়েছিল  ৷ 

          শত  শত  বছর  ধরে  বিশ্বাসীদের  কাছে  ঈশ্বর  একটি  সত্তা  মাত্র  ছিলেন  না  ৷  তাদের  মতে  ঈশ্বর  মানুষের  অনুভূত  অন্যান্য  বস্তুর  মতো  অবস্থান  করেন  না ৷  আবার  ক্রিশ্চান  ধর্মবিদরা  মনে  করতেন  ঈশ্বর  অন্যান্য  প্রাকৃতিক  বস্তুর  মতোই  অস্তিত্বমান  ছিলেন  ৷ 

          কিন্তু  গবেষক  গণ  বিশেষ  করে  বৈজ্ঞানিক  দিদেরো , হলবাথ  ও  লাপ্লেস  এই  প্রয়াসকে  সম্পূর্ণ  উল্টে  দিয়েছেন  বিশ্বাসযোগ্য   তথ্য  প্রমাণের  সাহায্যে  ৷  আর  তারা  অধিকতর  চরম  অতিন্দ্রীয়বাদীর  মতো  একই  সিদ্ধান্তে  পৌছেছেন  যে  মহাশূন্যে  অতিপ্রাকৃতিক বলে  কিছু  নেই  ৷  তাই  এই  মতবাদে  বিশ্বাসী  অন্যান্য  বিজ্ঞানী  ও  দার্শনিকেরাও  সগর্বে  ঘোষণা  দিয়েছেন  যে এতদিনের মানুষের বিশ্বাসের  ঈশ্বরের  প্রয়াণ  ঘটেছে  , তবে  সত্যিই  কী  তাই ? আমাদের  সবার  জানতে  হবে ! না  হয়  এই  ঘোষণা  অর্থহীন  থেকে  যাবে  আরো  কত  কাল  কে  জানে  ?  

 

  ( সূত্র;   ইহুদি , ক্রিশ্চান  ও  ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের  স্রষ্টা  সন্ধানের  ৪০০০  বছরের  ইতিহাস ,

        স্রষ্টার  ইতিবৃত্ত

  ক্যারেন  আর্মস্ট্রং

   অনুবাদ ; শওকত  হোসেন ,

      আলোকন  অধ্যায়ের  শেষ  অংশের

         সংক্ষিপ্ত  রূপ  )

 

 



 

 

 

         

 

 

মন্তব্যসমূহ