আপন অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্ম ইতাহাস নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত লেখক ও গবেষক ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর ঈশ্বর দর্শন !
ধর্ম
নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত লেখক ও গবেষক ক্যারেন
আর্মস্ট্রং এর ঈশ্বর দর্শন প্রসঙ্গ : ( প্রথম পর্ব
)
ক্যারেন আর্মস্ট্রং
তার ছোটবেলার বর্ণনা
দিতে গিয়ে তার একলেখায় বলেছেন ,
ছোটবেলায় তিনি ধারুন ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন ৷ তিনি আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের
অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ রোমান ক্যাথলিক ক্যারেন
আর্মস্ট্রং বলেছেন তিনি ৮ বছর বয়সেই মূখস্ত
করেছেন “ ঈশ্বর হচ্ছেন পরম আত্মা , যার কোনো অংশীদার নেই এবং যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ
” ৷
কিন্তু তিনি লিখেছেন তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের তার মুখস্ত করা সংজ্ঞা তার কাছে
আর অর্থপূর্ণ মনে হত না ৷ তাই তখন থেকে ঈশ্বরের সংজ্ঞা
এবং ঈশ্বরবিষয়ক অভিজ্ঞতা
তার কাছে উদ্ধত বলে মনে হত ৷ তাই তখন থেকেই তিনি সাধুসন্ত , ভাববাদী কবিদের
জীবনী , টি এস এলিয়ট ও অতিন্দ্রীয়বাদীদের রচনা পাঠ করতে আরম্ভ করেন
, এবং
শাস্ত্রের সৌন্দর্যে আলোড়িত
হতে শুরু করেন ৷
তবে শাস্ত্রের সৌন্দর্য
ঈশ্বরকে তার কাছে টানতে পারেনি
৷ ঈশ্বর তার কাছ থেকে দূরেই রয়ে যান ৷ এরপরও তিনি মনে করেছেন
নিশ্চয় এক সময়ে ঈশ্বরের কাছে তার পৌঁছা সম্ভব হবে ৷ কারণ তিনি মনে করেছিলেন
তার
ঈশ্বর দর্শন হয়ত একসময়
তার মনে
সৃষ্ট সমগ্র বাস্তবতাকে ছাঁপিয়ে
যাবে ৷ এই উদ্দেশ্যে
তিনি ক্যাথলিক ধর্মীয়
সংগঠনে শিক্ষানবীশ নান হিসেবে যোগদান
করেন এবং ধর্মবিশ্বাস
সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানার আগ্রহ থেকেই তিনি নানের কাজে জড়িয়ে পড়েন ৷ তখন তিনি মঠের জীবনাচারের
বিশ্লেষণ করেন এবং এসবের অনেক কিছু কণ্ঠস্থ
করে ফেলেন ৷
কিন্তু এত কিছু করার পরও ঈশ্বরের
কোনো অস্তিত্ব তার কাছে অনুভূত হয় নি ৷ ফলে তখন তিনি শেষ চেষ্টা হিসেবে
প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেন এবং মনের ওপর ও জোর খাটান ৷
এরপরও ঈশ্বর তার থেকে দূরেই রয়ে যান ৷ পরবর্তীতে তিনি নিজেই সাধু সন্নাসীদের পরমানন্দ ( Rapture ) সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন এবং সেই আলোকে
ও ঈশ্বরের সান্নিধ্যে
পৌঁছার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে যান ৷
তখন তার মনে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা
পেয়ে যায় যে , তার বা মানষের সকল ধর্মীয় অভিজ্ঞতা
কেবল তার বা তাদের নিজস্ব
মস্তিষ্কসঞ্জাত ব্যাপার ৷ যা তার বা তাদের মনের এবং কল্পনার
উপরে অতিরিক্ত চাপ প্রযোগের ফলে এই অনুভূতির
সৃষ্টি হয়েছে যার যার মস্তিষ্কে ,
যা মোটেই বাস্তব
সম্মত কোনো ব্যাপার
নয় ৷ যা অনেকের হয়ে থাকতে পারে তা সম্ভবত
গ্রেগোরিয়ান চ্যান্ট বা শাস্ত্রের শল্পিক
সৌন্দের্যের প্রতি সহজাত সাড়া বিশেষ ৷ তাই কোনো সত্তার
অতীত তার মাঝে এমনকি অনেকের
মাঝে কখনো ঘটেনি বা তা কখনো ঘটেনা ৷ তাই হয়ত তিনি অনেক প্রচেষ্টার পরেও পয়গম্বর বা অতিন্দ্রীয়দের প্রচার
করা বা বর্ণনা
করা কোনো ঈশ্বরের
দেখা পান নি ৷ তখন থেকে এই ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু পারিপারশ্বিক বিষয় বিবেচনার পর তার মনে এক গভীর সন্দেহ
জাগতে
শুরু করে ৷
তখন তার মনে প্রশ্ন দেখা দেয় যে , মানুষ
জেসাস যে সত্যিকারের
ঈশ্বরের অবতার ছিলেন এর নিশ্চয়তা কি ? আর এমন বিশ্বাসের অর্থই বা কী
? কারণ বাস্তব
পর্যালোচনায় দেখা যায়- নিউ
টেষ্টামেণ্টে জেসাস আমাদেরকে
দারুণ ভাবে পরস্পর
বিরোধী ট্রিনিটি মতবাদের শিক্ষা দিয়েছেন ৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে
ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর মনে এই সন্দেহ জাগে যে
, বিভিন্ন ধর্মের অন্যান্য
বিভিন্ন বিষয়ের মতো জেসাসের এই ঘটনাও কি জেরুজালেমের ক্রাইস্টের
মৃত্যুর শত শত বছর পর ধর্মতাত্বিকদের তৈরি করা এক কল্পনা প্রসুত
বিষয় !
ক্যারেন আর্মস্ট্রং
তার আত্মকথামূলক লেখায় আরো লেখেছেন
যে , তার
মনের মধ্যে এই সব বিষয় নিয়ে যখন টানাপোড়ন
চলছিল তখন তার কাছে
তার নিজস্ব বিশ্বাস
এবং আত্মউপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ৷ ফলে তার কাছে
ধর্মীয়
জীবনের গুরুত্ব কমে যায় ৷ একপর্যায়ে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাস
ত্যাগ করেন এবং ঈশ্বরের বিশ্বাস
ও তার জীবন থেকে চিরতরে
নীরবে বিদায় নেয় বলে তিনি লিখেছেন
, যে ঈশ্বর তার জীবনে বাস্তবে
কোনো সময়েই কোনো প্রভাব রাখতে পারেন নি বলে তার মনে হয়েছে ৷ তবে ধর্মীয়
ব্যাপারে তার আগ্রহ ও কৌতুহল
অব্যাহত রয়ে যায় ৷
তখন
তার
মনে যে ধারণার
সৃষ্টি হয়েছিল , তা থেকে তার মনে হয়েছে ছোটবেলায় মানুষ বিনা প্রশ্নে
যে সব মতবাদ মেনে নেয় তা
আসলেই দীর্ঘ সময় জুড়ে মানুষেরই
গড়ে তুলা বিশ্বাস
মাত্র ৷ বর্তমানে
বিজ্ঞান যেমন স্রষ্টা
ঈশ্বরকে বাতিল করে দিয়েছে , তেমনি গোড়াতে
বাইবেলিয় পণ্ডিতগণ ও প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলেন যে
, জেসাস কখনও নিজেকে
স্বর্গীয় কোনো সত্তা দাবী করেন নি ৷
ক্যারেন আর্মস্ট্রং
তার এক ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা
করেছেন ৷ তিনি বলেছেন , তিনি একসময় এপিলেপটিক
ছিলেন ৷ তাই তিনি
তার এপিলেপটিক অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তগত উপলব্ধির
কথা বলতে গিয়ে বলেছেন-
এপিলেপটিক হিসেবে
একসময় তার কিছু দৃষ্টিবিভ্রমের অভিজ্ঞতা
হয়েছিল ৷ পরে এর
সঙ্গে সংশ্লিষ্টকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে জেনেছেন
যে , আসলে এগুলো ছিল তার স্রেফ একধরণের স্নায়ুবিক
দুর্বলতা ৷ এটা বাস্তবে সত্যিকারের
কিছুই ছিল না ৷ তার এই অভিজ্ঞতার
আলোকে তার মনে হয়েছে যে , সাধু ও
সন্ন্যাসীদের দিব্যদৃষ্টি ও পরমানন্দের অনুভূতি
বা উপলব্ধি কেবল তাদের পূর্ববিশ্বাসের এক মানসিক আলোড়নেরই
প্রকাশ ছাড়া অন্য বাস্তব কিছু নয় ৷
কারণ তার মনে হয়েছে দিনে দিনে ঈশ্বর যেন ক্রমবর্ধমান
হারে মানুষের মন থেকে স্থানচ্যুত
হয়ে পড়েছেন আর মানবজাতি ঈশ্বরকে
অতিক্রম করে ফেলেছে এই
সুযোগে ৷ এ ব্যাপারে তার ব্যক্তগত মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন- ঈশ্বরের ধারণাগুলো
গড়ে উঠে মানুষের
ছোটবেলায় যেমন তার নিজেরও এই বিশ্বাস ছোটবেলায়
গড়ে উঠেছিল ৷ কিন্তু বর্তমানে
অন্যান্য বিষয়ে তার মধ্যে
ক্রমবর্ধমানহারে অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলাতে না
পেরে আরো অনেকের
মত তার নিজের বিশ্বাস থেকে ও চিরদিনের
মতো ঈশ্বরের বিশ্বাস বিদায় নিয়েছে ৷
কিন্তু পরবর্তীকালে
ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস
নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ক্যারেন
আর্মস্ট্রং নাকি বুঝতে পেরেছেন মানুষ আসলে আধ্যাত্মিক
প্রাণী ৷ তিনি মনে করেন মানুষ প্রকৃতপক্ষে
হোমো-সেপিয়েন্স শুধু নয় , মানুষ হোমো-রিলিজিয়াস ও বটে ৷ কারণ ইতিহাস
থেকে তিনি জেনেছেন যে , নারী ও পুরুষ বড় হয়ে এবং মানুষ হয়ে ওঠার পর পরই দেব-দেবীর
উপাসনা শুরু করেছে আর অন্যান্য
শিল্প - কলা সৃষ্টির মতই একই সময়ে প্রাচীন ও আদিন মানুষ ধর্মকেও শিল্প-কলার
মতো সৃষ্টি করেছে ৷
তিনি মনে করেন মানুষ এটা কোনো সুপারনেচারেল
শক্তির ভয়ে করেছে আসলে তা
কিন্তু নয় ৷ এটা ঘটেছে মানুষের আদিবিশ্বাস
থেকে ৷ মানুষ তখন এক সুন্দর অথচ ভীতি জাগানো
জগৎ নিয়ে তার অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ
করেছে ৷ শরীর যে দুঃখ কষ্টের তা সত্তেও জীবনের
একটা অর্থ অনুসন্ধানে মানুষ শিল্প-কলার মত ধর্ম ও কর্মকে ও আবিস্কার করেছে ৷ তবে অন্য যে কোনো মানবীয়
কর্মকাণ্ডের মতো ধর্মকে
ও মানুষ সব সময়ে এর অপব্যবহার করেছে ৷ তাই শুধু মুষ্টিমেয়
কুচক্রী রাজ-রাজরা বা পুরোহিতগণ মানুষের
প্রাচীন এবং আদিম সেক্যুলার বিশ্বাস
ও স্বভাবের ওপর এই বিশ্বাস
এর অপব্যবহার চাপিয়ে
দেয়নি , বরং এটা মানুষেরই স্বভাবজাত
স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ৷ কারণ মানুষ শূন্যতা ও নৈঃসঙ্গ সহ্য করতে পারে না
; মানুষ
তখন অর্থবহতার নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি
করে এই শূন্যতাকে
পূরণ করে নেয় ৷ তাই হাজার
হাজার বছর থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস
ঠিকে আছে ৷ হয়ত রাজনৈতিক
ভাবে ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে এই বিশ্বাস
আরো কতকাল চলবে তার জবাব একমাত্র ভবিষ্যতের
ওপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় এখনও পরিলক্ষিত
হচ্ছে না বলে ক্যারেন আর্মস্ট্রং
মনে করেন ৷ তবে তিনি মনে করেন আমাদের
অনেকের বর্তমান নৈতিক সেক্যুলার
আদর্শের মনকে পরিচালিত
করার নিজস্ব নিয়ম-কানুন
রয়েছে যা মানুষকে
মানব জীবনের পরম অর্থ সন্ধানে
সাহায্য করে ৷ এক সময় যা প্রথাগত ধর্মগুলোর
কাজ ছিল ৷
প্রথম পর্ব সমাপ্ত
৷
( সূত্র;- ক্যারেন আর্মস্ট্রং
স্রষ্টার ইতিহাস ….
অনুবাদ- শওকত হোসেন .
সূচনা পর্বের
সংক্ষিপ্ত রূপ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন