ইতিহাসের আলোকে কিংডম অব হেজাজ কিভাবে
কিংডম অব সৌদি আরবে পরিণত হয়েছে তার কাহিনী
:
আরব
, এশিয়া , ও আফ্রিকা
একত্রে যে অঞ্চলে মিলিত
হয়েছে সে অঞ্চলটিই
হচ্ছে আরবের প্রাচীন
বেদুইনদের বাসভূমি হেজাজ অঞ্চল ৷ তাই ইউরোপের
সঙ্গে এশিয়ার ব্যবসা - বানিজ্যের ক্ষেত্র্রে
এই হেজাজই একসময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে কাজ করেছে ৷ অন্যদিকে আরবজাহানের
বানিজ্যিক কাফেলাও
হেজাজের সেই বিখ্যাত
পথটি ব্যবহার করেছে ৷ যে পথের পার্শ্বে
অসংখ্য পানির কূপ বা কোয়া খনন করে রাখা ছিল যাত্রীদের সুবিধার্থে
৷
প্রাচীন
হেজাজের ভৌগলিক অবস্থান
হচ্ছে লোহিত সাগরের
তীরে ৷ হেজাজের
উত্তরে জর্দান , পূর্বে নেজদ আর দক্ষিণে
আসিব ৷ এক সময়ে হেজাজের
প্রধান নগরী ছিল জেদ্দা ৷ কিন্তু ইসলাম ধর্মের আবির্ভারবের
পর ইসলামের পবিত্র
নগরী মক্কা ও মদিনার জন্যে হেজাজ অঞ্চল ইতিহাসে সমাধিক
পরিচিতি পেয়েছে ৷ তবে ঐতিহাসিকভাবে
হেজাজ সবসময়ই সৌদি আরবের সবচেয়ে
বেশি গণঅধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত
ছিল ৷ কারণ এ অঞ্চলে
সৌদি আরবের প্রায় ৩৫ শতাংশ লোকের বসবাস ৷ তবে হেজাজের আরবী ভাষা আবার মিশরীয় আরবী ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যে বেশ মিল আছে ৷
এই
হেজাজ অঞ্চলের এক সময়ের অতি সাধারণ
এক লোকের
মাধ্যমে এই অঞ্চলে
আগ্নেয়শিলায় গঠিত এক পাহাড়ের গুহায় জন্ম হয়েছিল পবিত্র ইসলাম ধর্মের
৷
আর
এই হেজাজ অঞ্চলের
সঙ্গে প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল
ব্যবসা - বানিজ্য ৷ ফলে হেজাজ এলাকাটি
পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন
সাংস্কৃতির এক বৈচিত্রিক
কেন্দ্র হিসেবে ৷ তাই এই অঞ্চলের প্রতি নজর পড়েছিল
ইউরোপের একাদিক দেশের ৷ তবে প্রথম সফলতা অর্জন করেছিল ব্রিটিশরা ৷ তারা
ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা
অপিসার টিআই লরেন্সেকে
মিশনিরী রূপে এঅঞ্চলে প্রেরণ
করেছিল সাধারণ মানুষের সেবা
করার নামে ৷ লরেন্স তাঁর কাজে এতই সফল হয়েছিলেন
যে , তখন আরবের লোকেরা তাকে লরেন্স অব এরাবিয়া নামে অবিহিত করেছিল
৷
হেজাজের পূর্বদিকে
শিয়াদের সংখ্যাগত প্রাধান্য
ছিল আর দক্ষিণদিকে ছিল ইয়েমেনীদের প্রাধান্য
৷ ঊত্তর দিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয়
অঞ্চলের মানুষের সংখ্যাধিক্যতা
ছিল ব্যাপকভাবে ৷ আর মধ্যাঞ্চলটিতে
ছিল উপজাতীয় বেদুইইনদের
প্রধান ঘাঁটি এলাকা ৷
এই মধ্যাঞ্চল এলাকাটিতে
ছিল সোদি রাজবংশ
পরিবারের প্রধান শক্তির
উৎস ৷
পশ্চিমাঞ্চলের হেজাজ এলাকাটি পূর্বাঞ্চলের
নাজদ ভূখন্ডকে পশ্চিমের
তিহামা ভূখন্ড থেকে আলাদা করেছে ৷
এই জন্যেই এই এলাকাটির এমন নাম
হয়েছে বলা হয়ে থাকে ৷ হেজাজের উত্তর ভাগ একসময়ে
রোমান সাম্রাজ্যের এরাবিয়া
পেত্রিয়া প্রদেশের অংশ ছিল ৷ তবে হেজাজ পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকটি
সাম্রাজ্যের অধীনে চলে গিয়েছিল ৷ আরবে ইসলামের
আবির্ভাব এর পরে এবং ইসলামের
শাসনের প্রথম ভাগে খোলাফায়ে রাশেদিনের
রাজধানী দামেস্কাসে স্থানান্তরিত
হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত
হেজাজ ছিল ইসলামী
খিলাফতের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু
৷
কিন্তু পরবর্তীতে
হেজাজ যথাক্রমে প্রথমে
উমাইয়াদের শাসনে চলে যায় ৷ পরে চলে যায় আব্বাসীয়দের অধীনে ৷ এর পরে চলে যায় ফাতিমীদের
শাসনের অধীনে ৷ পরবর্তীতে চলে যায় আইয়ুবী
রাজবংশের অধীনে ৷ এরপর চলে যায় মামলুক
সুলতানদের শাসনের আওতায় ৷ তবে এরপর হেজাজ অঞ্চলটি অটোমান
সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়ে পড়ে ৷ এই সময়ে পূর্বে উল্লেখিত টিআই লরেন্স নামক এক ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা অপিসারকে
এ অঞ্চলে প্রেরণ
করা হয় মিশনারীর
বেশে ৷ তিনি এ অঞ্চলে
আগমন করে জনগণের
সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োজিত
করেন প্রকাশ্যে আর গোপনে হিজাজের
উপজাতিদেরকে অটোমান সাম্রাজ্যের দূর্নীতির
বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেন এবং বিদ্রোহের
কাজে ট্রেইনিং দিতে আরম্ভ করেন ৷ এরই এক পর্যায়ে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে
হেজাজ অঞ্চলটি অটোমান
সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে কিছুকালের জন্যে পুরাপুরি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র
পরিণত হয়ে যায় ৷ আর ১৯১৬ সাল
থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত
প্রায় ১০ বছর এটি স্বাধীন
রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে টিকে ছিল , কিংডম
অব হেজাজ নামে ৷
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য
যে , প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
অটোমান শাসকরা জার্মানদের পক্ষে যোগ দিয়েছিল
৷ সে হিসেবে
হেজাজও থাকার কথা ছিল
জার্মান পক্ষ ৷ কিন্তু পূর্বে
উল্লেখিত টিআই লরেন্সর
ইন্ধনে হেজাজের বিদুইন
উপজাতিগুলো অটোমান শাসকদের
এবং তাদের মিত্র জার্মানদের বিরুদ্ধে
চলে গিয়েছিল ৷ অনেকের মতে লরেন্স হয়ত চেয়েছিলেন যে আরবরা দুর্নীতিবাজ
অটোমান শাসকদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করুক ৷
তাই তিনি
তুর্কীবিরোধী লড়াইয়ে আরবদের
সংগঠিত করতে গিয়ে নিজকে এমনভাবে
আরবদের সঙ্গে মিলিয়ে
ফেলেন যাতে আরবরা তাকে তাদেরই
একজন বলে গণ্য করেছে ৷ তাই আরবরা তাকে নাম দিয়েছিল লরেন্স
আল আরব ৷ কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ
শেষে তুর্কী বাহিনীর
বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এই আরবদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে ইউরোপীয় শক্তিগুলো ৷ তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে স্বাধীনতার
স্বপ্ন দেখিয়ে আরবদের
ভূখন্ড নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত ৷
এরপর
ব্রিটিশদের সঙ্গে এক গোপন সমঝোতার
পরিণতিতে ১৯১৬ সালে শরিফ হোসেন ইবনে আলী নিজকে স্বাধীন
হেজাজ রাষ্ট্রের বাদশাহ্ হিসেবে নিজকে ঘোষণা করেন ৷ এরই ফলে তুর্কী অটোমান
শাসন শেষ পর্যন্ত
উৎখাত হয় হেজাজ অঞ্চল থেকে ৷
আর
স্বাধীন হেজাজ রাষ্ট্রে
কায়েম হয় হাশেমী
রাজবংশীয় শাসন ব্যবস্থা ৷
তবে ১৯২৪ সালে পার্শ্ববর্তী
সুলতান শাসিত রাজ্য নেজদের শাসক উপজাতীয় প্রধান
আল সৌদ হাশেমী
বাদশা ফয়সলকে পরাজিত
করে হেজাজ দখল করে নেন ৷ এর পর ( নিশ্চয়
ব্রিটিশ ও আমেরিকার
সঙ্গে নতুন করে কোনো সমঝোতায় )
হেজাজ ও নেজদকে
একীভূত করেন ৷ আর পরবর্তীকালে এটাই কিংডম অব সৌদি এরাবিয়া
বা বর্তমান সৌদি আরব নামে পরিচিতি পেয়েছে
৷ তবে হেজাজ সৌদি আরবের মধ্যে লীন হয়ে গেলেও এখনও হেজাজ গোটা আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে
বেশি কসমোপলিটান অঞ্চল ও উদার মনমানসিকতার এবং নানা বর্ণের
নানা গোত্র্রের নানা জাতের মানুষের
মিলিত স্থানের অংশই রয়ে গেছে ৷
( সূত্র; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের
ফেলো -পল সালোপেক এর লেখা ‘ হেজাজের
সেই কাফেলা
পথে ’ , যার অনুবাদ
করেছেন -এনামুল হক এবং যা
জনকণ্ঠে প্রকাশিত
হয়েছিল, সে লেখার অবলম্বনে এই লেখাটটি
লেখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে ৷
)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন