যত ধর্ম তত মত কিন্তু রামাদানের ব্যাপারে মুসলমানদের সঙ্গে ইয়াহুদীদের সহমত !!!



       যত  ধর্ম  তত  মত  কিন্তু  রামাদানের  ব্যাপারে  ইয়াহুদীদের  সঙ্গে  মুসলমানদের       সহমত  !!! 

   (Zaad al-Ma‘aad fi Hadiy Khayr al-‘Ibaad, 2/66 
Al-Haafiz Ibn Hajar (may Allah have mercy on him) said: 
The apparent meaning of the report was problematic to some people, because it appears to mean that when the Prophet (blessings and peace of Allah be upon him) arrived in Madinah, he found the Jews fasting the day of ‘Aashoora’, but he arrived in Madinah in Rabee‘ al-Awwal. The answer to that is that what is meant is that his first knowing of that and asking about it happened after he came to Madinah; he had no knowledge of that before he came there. What the hadeeth implies is that the Prophet (blessings and peace of Allah be upon him) came to Madinah and stayed until the day of ‘Aashoora’, when he found the Jews fasting on that day.
Fath al-Baari, 4/247 )


        ( এ  লেখাটির  একটি  আলাদা  উদ্দেশ্য  ছিল  ৷  শুধু  সিয়াম  সাধনার  তথ্য  ও  বর্ণনা  দিতে  এ  লেখাটি  লিখতে  আরম্ভ  করা  হয়  নি  ৷  তবে  বর্তমান  সামগ্রীক  অবস্থা  বিবেচনা  করে  লেখার   ধারা  পরিবর্তন  করতে  হয়েছে  ৷  আমাদের  সমাজে  একটি  কথা  চালু  আছে  ৷  অনেক  সময়  বলা  হয়  বুদ্ধিমানদের  জন্যে  ইশারাই  কাঁফি  হায়  ৷  তবে  এ  লেখাতে  তেমন  কিছু  পাওয়া  যাবে  না  ৷  বিশ্বাসীরা সিয়ামের বিস্তারিত  কিছু  তথ্য  পাবেন  ৷  আর  যুক্তিবাদীরা  প্রশ্ন  করতে  পারবেন ,  কেন  ধর্ম  প্রচারের  শেষের  দিকে  সিয়াম  পালনের  নির্দেশ  আসল ?  কেন  নবীজীর  ১২  বছর  মক্কায়  অবস্থানরত  অবস্থায়  সিয়াম  পালনের  নির্দেশ  আসল  না  ?  কেন  নামাজ  বা  যাকাত  পালনের  নির্দেশের  সঙ্গে  সিয়ামের  বিধান  আসল  না  ? কেন  নবীজীর  মেরাজ  গমনের  পর  শুধু  ৩  বারের  সালাত  আদায়কে  পাঁচ  বারে  রূপান্তরের  সময়ও  এত  গুরুত্বপূর্ণ  এবাদত  সিয়ামের  আদেশ    পাওয়া  গেল  না  ? নবীজী মদীনাতে  হিযরতে  যাওয়ার  পর  ইয়াহুদীরা    দশই  মহর্ রম  কেন  রোজা  রাখে  আর  মহরম  মাসের  দশ কেন  ইয়াহুদীদের  কাছে  গুরুত্বপূর্ণ  তা কেন  নবীজীকে  প্রশ্ন  করে  জানতে  হল  ৷  তবে  কী  নবীজী  ইয়াহুদীদের  রোজা  রাখা    প্রত্যক্ষ্য  না  করতে  পারলে  মুসলমানদের  জন্যে  সিয়াম  ফরজ  হত  না  ?  ইত্যাদি  অনেক  প্রশ্নই  যুক্তিবাদীরা  তুলতে  পারবেন  ৷
              এ  জবাবে  বিশ্বাসীরা  বলবেন  এটা  পূর্ব  নির্ধারিত  ব্যাপার ৷  এনিয়ে  প্রশ্ন  করা  ঠিক  হবে  না  ৷  সবই তো আল্লাহ্ র  খুদরতী  ৷  তাঁর  ইচ্ছা  ছাড়া তো কিছুই  হয়  না , ভবিষ্যতেও  হবে  না  ৷  তাই  এর  উত্তর  খোঁজার   দায়ীত্ব  পাঠকদের  কাছে  ছেড়ে দিয়ে মূল  লেখাটি  আরম্ভ  করছি  ৷ )


            আমরা  জানি  ৬১০  খ্রিস্টাব্দে  আরবী  রামাদান  মাসে  মক্কার  হিরা  নামক  গুহায়  ধ্যানে  অবস্থানরত  হযরত  মুহাম্মদ  ( স: ) এর  নিকট  প্রথম  ওহী  বা  প্রাত্যদেশ   নাযিল  হয়  আল্লাহ্ র  কাছ  থেকে  ৷  আর  এর  মধ্যে  দিয়ে  ক্রমে  ক্রমে  তাঁর  নিকট  পবিত্র  কোরআন  নাযিলের  সূত্রপাত  ঘটে  ৷  তাঁর  নবুয়তির  পরবর্তী  দীর্ঘ  তেইশ  বছর  ধরে  পর্যায়ক্রমে তাঁর  মক্কা  ও  মদীনায়  অবস্থানরত  অবস্থায়  কোরআনের  আয়াতগুলো  নাযিল  হয়েছে   ৷  তাঁর  মক্কায়  অবস্থান  কালে  নাযিলকৃত  সূরার  সংখ্যা  ছিল  ৯২ টি  আর  মদীনায়  অবস্থান  কালে  নাযিলকৃত  সূরার  সংখ্যা ছিল  ২২ টি  ৷  সব  মিলিয়ে  মোট  ১১৪ টি  সূরা  নাযিল  হয়েছে  ৷ সংকলিত   কোরআনের  ঐ  ১১৪  টি  সূরাতে ,   মন্জিল    আছে    ৭ টি , পারা  আছে ৩০ টি ,   বিসমিল্লাহ্ র  উল্লেখ  আছে  ১১৩  বার  ,  আয়াতের  সংখ্যা  আছে  ৬৩৬৭  টি  এবং  শব্দের   সংখ্যা  হচ্ছে  ৩, ২২, ৬৭১ টি  বলে  জানা  যায়  ৷   হয়রত  মুহাম্মদ ( স: )  মক্কায়  অবস্থানরত  অবস্থায়  এবং  মদীনায়  হিযরতে  যাওয়ার  দুই  বছর  আগে  ৬২০ খ্রিস্টাব্দের    রজব  মাসের ২৭  তারিখে  মেরাজে  গমন  করেন  ৷   মেরাজ  থেকে  ফিরে  এসে  আল্লাহ্ র  নির্দেশে দৈনিক  তিন  বারের  পরিবর্তে  নবীজী  পাঁচ  বেলা  নামাজ  পড়তে  নির্দেশ প্রধান  করেন  ৷  কিছু  প্রচলিত  বিশ্বাস  আছে  এঅঞ্চলে   যে ,   নবীজী  মেরাজ  থেকে  এক  মাস  রোজা  বা  সিয়াম  পালনের  নির্দেশ  ও  প্রাপ্ত  হয়েছিলেন  ৷  কিন্তু  পরবর্তীকালে  তা  অসত্য  বলে  প্রমাণিত  হয়েছে ৷
          ( তবে  অনেকে  মনে  করেন   মেরাজ  নবীজীর  ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতাও  হতে  পারে  ৷  কারণ  কোরআনে  অন্তর্ভূক্তির  জন্যে  মেরাজে কোনো  প্রত্যাদেশ  ছিল  না  ৷  তাই  বোধহয়  শিয়ারা  এখনও  কোরআনের মেরাজের পূর্বের  প্রাত্যদেশ  অনুযায়ী দৈনিক তিন  বার  নামাজ  আদায়  করেন  )

           আর্থাৎ  মক্কায়  নবীজীর  অবস্থান  কালে  সালাত  আদায়  করা  এবং  যাকাত  দেয়ার   কথা  জোর  দিয়ে  বলা  হয়েছে  ৷  কিন্তু  সিয়াম  বা  রোজা  পালন  করতে  কোনো  নির্দেশ  দেয়া  হয়  নাই  ৷  অন্যদিকে  এই  সময়ে  মক্কায়  অবতীর্ন  ৮৬ টি  সূরার  কোনো আয়াতেও  রোজা  বা  সিয়াম  পালনের  কোনো  নির্দেশের  উল্লেখ  দেখা  যায়  না  ৷   এই  সময়ে  নাযিলকৃত  আয়াতগুলোতে  অসংখ্যবার  নামাজ  পড়তে এবং  যাকাত  আদায়  করতে  বলা  হয়েছে ,  আবার  মিথ্যা  না  বলতে ,  অন্যায়  ও  অশ্লীল কাজ  না  করতে  এবং  সৎপথে  চলতেও  নির্দেশ  দেয়া  হয়ছে  ৷  কিন্তু  রোজার  ব্যাপারে  কোনো উল্লেখ  পাওয়া  যায়  না  ৷  তখন পর্যন্ত  কী  সিয়াম  গুরুত্বপূর্ণ  এবাদতের  স্থান  লাভ  করতে  পারেনি  ? 

            ৬২২ খ্রিস্টাব্দের  রবিউল  আউয়াল  মাসে  নবীজী  মক্কা  থেকে  ২৯৬  মাইল  উত্তরে  অবস্থিত  মদীনায়  হিযরত  করেন  তাঁর  কিছু  অনুসারী  সহ  ৷

          ঐতিহাসিক  তথ্যমতে  এবং  কোরআনের সুরা  নাযিলের  ক্রম  অনুসারে  ৮৭  নং  এবং  সংকলিত  কোরআনের  ২ নং  সূরা ,  যে  সূরা  মদীনায়  অবতীর্ন হয়েছিল  , সে   সূরা  বাকারার  সানে  নযুল  থেকে  জানা  যায়  যে ,  নবীজী  মদীনায়  আসার  পর  দেখতে  পান  যে  ,  মদীনায়  অবস্থানরত  ইয়াহুদীরা  মহর্ রম  মাসের  দশ তারিখকে  আশুরা নাম  দিয়ে  একদিন  আশুরার   সিয়াম  পালন  করে  ৷   কি  কারণে  তারা ঐ  দিন  রোজা  পালন করে  তা  নবীজী  ইয়াহুদীদের  কাছে  জানতে  চান  ৷    তাঁর  প্রশ্নের  উত্তরে  ইয়াহুদীরা  জানায়  যে   ,  ইয়াহুদীদের  নবী  হযরত  মূসা (  আ: )  ঐ  দিন  ফেরাউনের  কারাগার  থেকে  কয়েক  হাজার   বনি  ঈসরাইলকে  উদ্ধার  করে  লোহিত  সাগর  পাড়ি দিয়ে ওপারে  নিরাপদে  পৌছেছিলেন  ৷  তারই  স্বরণে এবং এর  প্রতি কৃতজ্ঞতা  প্রকাশ করে   এবং    বনি  ঈসলাইলদের  মুক্তির  নিদর্শন  হিসেবে  ইয়াহুদীরা  মহর্ রম  মাসের  দশ  তারিখকে  আশুরার  দিন  বলে  এবং  ঐ  দিন  সিয়াম  বা  রোজা  পালন  করে  ৷ এটা  তারা  তাদের  ধর্মগ্রন্থের  কোনো  নির্দেশে  নয়  ,বরং  ইহা  তাদের  সম্প্রদায়ের  নিজস্ব  ইচ্ছায়  পালন  করে  থাকে  বলে  ও  তাকে  জানানো  হয় ৷

            ইয়াহুদীদের  কাছ  থেকে এই  কথা  শুনে  নবীজী  তাঁর  মতামত  প্রকাশ  করে  বলেন  যে ,  তোমাদের  চেয়ে  তো  হযরত  মূসা (আ:) এর  ওপর  আমার  অধিকার  বেশি ৷  একথা  বলে  নবীজী  ইয়াহুদীদের  একদিন  রোজা  পালনের  পরিবর্তে  তিনি  দু’দিন  রোজা  বা  সিয়াম  পালন  করেন  আশুরার  দিন  উপলক্ষ্যে  ৷

           এরই  ধারাবাহিকতায়  ৬২৪  খ্রিস্টাব্দে  রামাদান  মাসের  পূর্বের  মাস  শা’বান  মাসের  শেষ  দিন  বিকাল  বেলায়  কোরআনের  মদীনায়  নিযিল  হওয়া  ২নং  সূরা  বাকারার  ১৮৩  নং  আয়াত  নাযিল  হয়  ৷  এবং  ঐ  সময়  থেকে  ইসলাম  ধর্মে  বিশ্বাসী  মুসলমানদের  জন্যে  সিয়াম  বা  রোজা পালন কে  ফরজ্   ঘোষিত  হয়  ৷ 

             সূরা  বাকারার  ১৮৩ নং  আয়াত , ১৮৪ নং  আয়াত , ১৮৫ নং  আয়াত  এবং  ১৮৭  নং  আয়াত  ছাড়া  সমস্ত  কোরআনের    ৬৩৬৭টি  আয়াতের  মধ্যে  অন্য  কোন  আয়াতে  সিয়াম  বা  রোজা  পালনের  উল্লেখ  নাই  ৷  বর্তমানে  ঐ  চারটা  আয়াতের  বর্ণনার  বা  নির্দেশের  অতিরিক্ত  যা  বলা  হয়  তা  সম্ভবত  নবীজীর  ইন্তেকালের  প্রায়  ১৫০  থেকে  ২০০  বছর  পর  সংগ্রহীত  এবং  সংকলিত  বিভিন্ন  হাদিস গ্রন্থ  থেকে  বলা  হয়  ৷  আর  সূরা  বাকারার  ১৯৬  নং  আয়াতে  হজের  সময়  কোরবানির  কিছু  না  পেলে ,   হজের  সময়  তিন  দিন  ও  ঘরে  ফেরার  পর  সাতদিন  সহ  মোট  দশদিন  রোজা  করতে  হবে বলা  হয়েছে  ৷

          ঐ  সূরার  ১৮৯ নং  আয়াতে   নতুন  চাঁদ  এর  ব্যাপার  বলা  হয়েছে   “ লোকে  তোমাকে  হেলাল  ( নতুন চাঁদ ) সম্বন্ধে  জিজ্ঞাসা  করে  ৷  বলো , ‘  তা  মানুষের  সময়  ও  হজের  সময়  -নির্দেশ  করে ’ …………..( অসম্পূর্ণ  ) ৷
              তাই  নতুন  চাঁদকে  সময়  এবং  হজের  তারিখ  ইত্যাদির  প্রয়োজনে  ব্যবহারের  উল্লেখ  করা  হলে ও  রোজা  সময়  বা  দিন  নির্ধারণের  ব্যাপারে  নতুন  চাঁদের  কোনো  ভূমিকা  আছে কা  না  তা  বলা  হয় নাই  এই  আয়াতেও       ৷  তবে  এ  আয়াতটি  হয়তো  ১৮৩ নং  আয়াত  নিযিলের  পূর্বেই  নাযিল  হতে  পারে  ৷  নিম্নে  সূরা  বাকারার  সংশ্লিষ্ট  আয়াতগুলোর  অনুবাদ   উল্লেখ  করা  হল ৷         এই  সঙ্গে          ঐ  আয়াতগুলোর  তফসীরের  সার-সংক্ষেপ ও  উল্লেখিত  হলো ৷
         
            সূরা  বাকারা  - ১৮৩ নং  আয়াত ;- 
         “ হে  বিশ্বাসিগণ ; তোমাদের  জন্য  সিয়াম (রোজা ) র  বিধান  দেওয়া  হল , যেমন  তোমাদের  পূর্ববর্তীদেরকে  দেওয়া  হয়েছিল , যাতে  তোমরা  সাবধান  হয়ে  চলতে  পার  ৷

            ১৮৪ নং  আয়াত  ;- 
         নির্দিষ্ট  কয়েক  দিনের  জন্য  ৷ তোমাদের  মধ্যে  কেউ  অসুস্থ  হলে  বা  সফরে  থাকলে  অন্য  সময়ে  এ-সংখ্যা  পূরণ  ক’রে  নিতে  হবে  ৷  আর  যে-ব্যক্তির  পক্ষে  রোজা  রাখা  দুঃসাধ্য  তার  একজন  অভাবগ্রস্তকে  অনুদান  করা  কর্তব্য  ৷ তবু  যদি  কেউ  নিজের  খুশিতে  পুণ্য  কাজ  করে  তবে  তার  পক্ষে  বড়ই  কল্যাণকর  ৷  আর  যদি  তোমরা  উপলব্দি  করতে  পারতে  তবে  বুঝতে ,  রোজাপালনই  তোমাদের  জন্য  আরও  বেশি  কল্যাণকর  ৷

            ( তফসীরের  সার-সংক্ষেপ ;- হে  ঈমানদারগণ ! তোমাদের  উপর  রোজা  ফরয  করা  হয়েছে , যেরূপ  তোমাদের  পূর্ববর্তী  জাতিসমূহের  লোকদের  উপর  ফরয  করা  হয়েছিল , এই  আশায়  যেন  তোমরা  রোযার  কল্যাণে  ধীরে  ধীরে  পরহেযগার  হতে  পারে  ৷  কেননা , রোজা  রাখার  ফলে  নফস্ কে  তার  বিভিন্নমুখী  প্রবণতা  থেকে  সংঘত  রাখার  অভ্যাস  গড়ে  উঠবে  ,  আর  এ  অভ্যাসের   দৃঢতাই  হবে  পরহেযগারীর  ভিত্তি  ৷  সুতরাং  গণনার  কয়েকটা  দিন  রোজা  রাখ  ৷ ( এ  অল্প  কয়টি  দিনের  অর্থ - রমযান  মাস , যা  পরবর্তী  আয়াতে  বর্ণিত  হয়েছে ৷)    অতঃপর
  এর  মধ্যেও  এমন  সুযোগ  দেয়া  হয়েছে  যে  ,  তোমাদের  মধ্যে  যারা  এমন  অসুস্থ  হয় , যার  পক্ষে রোজা রাখা  কঠিন  কিংবা  ক্ষতিকর  হতে  পারে  অথবা  শরীয়তসম্মত  সফরে  থাকে , তার  পক্ষে  রমযান  মাসে  রোজা  না  রাখারও  অনুমতি  রয়েছে  এবং  রমযান মাস  ছাড়া  অন্যান্য  সময়ে  ততগুলি  দিন  গণনা  করে  রোজা  রাখা  তার  উপর  ওয়াজিব  ৷  আর  দ্বিতীয়  সহজ  পদ্ধতিটি  যা  পরে  রহিত  হয়ে  গেছে , তা  এরূপ  ছিল  যে , এ  রোজা  রাখা  যাদের  জন্য  অত্যান্ত  কঠিন  ও  কষ্ঠকর  মনে  হয়  তারা  রোজার  পরিবর্তে  ফিদইয়া  বা  বদলা  হিসেবে  একজন  দরিদ্রকে  খাদ্য  খাওয়াবে  বা  খাদ্যের  মূল্য  অথবা  খাদ্যদ্রব্য  দিয়ে  দিবে  ৷  তবে  যে  ব্যক্তি  খুশীর  সাথে  আরো  বেশি  ফিদ্ ইয়া  দেয়  তা  তার  জন্য  আরো  বেশি  মঙ্গলকর  হবে ৷   যদিও  এরূপ  অবস্থায়  রোজা  না  রাখার  অনুমতি  দেওয়া  হয়েছে , তবু  এ  অবস্থাতেও  কেউ  রোজা  রাখলে  তা  অনেক  বেশি  কল্যাণকর  হবে  ৷  শরীয়তের  পরিভাষায়  খাওয়া , পান  করা  এবং  স্ত্রী  সহবাস  থেকে  বিরত  থাকার  নাম  সিয়াম  ৷  তাই  সুবেহ্-সাদেক  উদয়  হওয়ার  পূর্ব  থেকে  শুরু  করে  সূর্যাস্ত  পর্যন্ত  রোজার  নিয়তে  একাধারে  এ  ভাবে  খাদ্য  ও  পানি  গ্রহণ  থেকে  বিরত  থাকলেই  তা  রোজা  বলে  গণ্য  হবে  ৷  স্ত্রী  সহবাসকে  পরবর্তী  আয়াতে  অনুমতি  দেওয়া  হয়েছে  , তবে  রোজার রাখার  সময়  ছাড়া  ৷  ) 

            সূরা  বাকারা - ১৮৫ নং  আয়াত  ;-
               “  রমজান  মাস , এতে  মানুষের  পথপ্রদর্শক  ও  সৎপথের  স্পষ্ট  নিদর্শন  এবং  ন্যায়  ও  অন্যায়ের  মীমাংসারূপে  কোরান  অবতীর্ণ  হয়েছিল  ৷  অতএব  তোমাদের  মধ্যে  যে-কেউ  এ- মাস  পাবে  সে  যেন  এ-মাসে  অবশ্যই  রোজা  রাখে  ৷  আর  যে  রোগী  বা  মুসাফির  তাকে  অন্য  দিনে  এ-সংখ্যা  পূরণ  করতে  হবে  ৷  আল্লাহ্  তোমাদের  জন্য  সহজ  করতে  চান , তোমাদেরকে  কষ্ট  দিতে  চান  না  ,  যাতে  তোমরা  নির্ধারিত  দিন  পূর্ণ  করতে  পার  ও  তোমাদেরকে  সৎপথে  পরিচালিত  করার  জন্য  আল্লাহ্ র  মহিমা  ঘোষণা  করতে  পার , আর  তোমরা  কূতজ্ঞ  হলেও  হতে  পার  ৷

            ( এই  আয়াতের  তফসীরের  সার-সংক্ষেপ  ; -   আগের  আয়াতে  বলা  হয়েছিল  নির্দিষ্ট  কয়েকদিন রোজা  রাখতে  হবে ,  যা  এই  আয়াতে  স্পষ্ট  করা  হয়েছে  ৷  আর  তা হল  সমস্ত  রমজান  মাস  ৷ আরো  বলা  হয়েছে যে   রমজান  মাস , যাতে  এমন    বরকত  বিদ্যমান  রয়েছে  যে , এরই  এক  বিশেষ  অংশে  অর্থাৎ  শবে-কদরে  কোরআন  লওহে  মাহ্ ফুয  থেকে  দুনিয়ার  আকাশে  পাঠানো  হয়েছে  ৷  তার  একটি  বৈশিষ্ট্য  আছে  যা  মানুষকে  হেদায়েতের  পন্থা  বাতলাবার  জন্যে  এর  প্রতিটি  অংশকে  প্রমানস্বরূপ  হিসেবেও  ব্যবহার  যোগ্য  ৷  আর  এই  দু’টি  বৈশিষ্ট্যের  প্রেক্ষিতে  এটাও  মূলতঃ  সেসব  আসমানী  কিতাবেরই  অনুরূপ , যেগুলো  এসব  বৈশিষ্ঠ্যে  মণ্ডিত  ৷ অর্থাৎ  হেদায়েত  সহ  তৎসঙ্গে  সত্য  ও  মিথ্যার  মাঝে  পার্থক্য  বিধানকারীও  ৷  তাই  তোমাদের  মধ্যে  যেসব  লোক  এমাসে  বিদ্যমান  থাকবে  তাদর  জন্যে  রোজা  রাখা  অপরিহার্য  কর্তব্য  ৷  এ  আয়াত   নাযিলের  সাথে  সাথে  কষ্টের  কারণে  নিজে  রোজা  না  রেখে  অন্যকে  ফিদ্ ইয়া  বা  খাদ্য  দিয়ে  বদলা  রোজা  রাখাবার  পূর্বেকার  বিধান  রহিত  করা  হয়ে  গেল  ৷  তবে  অসুস্থ  ও  মুসাফিরের  জন্যে  যে  আইন পূর্বে  ছিল  তা  এখনও  আগের  মত  তেমনিভাবে  তা  বলবৎ  রয়েছে  ৷   কাজেই  নির্ধারিত  সময়ে  রোজা  রখার  এবং  কোনো  বিশেষ  ওযর  আপত্তি  থাকলে  সে  রোজাগুলো  অন্য  দিনে  কাযা  করে  নেয়ার  হুকুমও  সে  ভিত্তিতে  দেয়া  হয়েছে  ৷ অন্যদকে  কাযা  করা রোজা  ওয়াজিব  হওয়ায়   কাযার  রোজারও  সওয়াব  অর্জন   হয়  ৷ তাই  ফরয  রোজা  না  করতে  পারায়  সওয়াব  না  পাওয়া  রোজাদারীরা  কাযাকরা  রোজা  রাখার সূযোগ  দিয়ে  তাদেরকে  আর  রোজার  বরকত  ও  ফল  লাভে  বঞ্চিত  করা  হয়  নাই  ৷ )


          সূরা  বাকারা  আয়াত  নং  ১৮৭ ;- 
             “ রোজার  রাত্রিতে    তোমাদের  জন্যে  স্ত্রী- সহবাস  বৈধ  করা  হয়েছে  ৷  তারা  তোমাদের  পোষাক  আর  তোমরা  তাদের  পোষাক  ৷  আল্লাহ্  জানতেন  যে , তোমরা  আত্মপ্রতারণা  করছ  ৷  তাই  তো  তিনি  তোমাদের  ওপর  দয়া  করেছেন  ও  তোমাদের  অপরাধ  ক্ষমা  করেছেন  ৷  অতএব  এখন  তোমরা  তোমাদের  স্ত্রীদের  সঙ্গে  সহবাস  করতে  পার  ও  আল্লাহ্  তোমাদের  জন্যে  যা  বিধিবদ্ধ  করেছেন  তা  কামনা  করো  ৷  আর  তোমরা  পানাহার  করো  যতক্ষণ  রাত্রির  কৃষ্ণরেখা  থকে  উষার  শুভ্ররেখা  স্পষ্টরূপে  তোমাদের  কাছে  প্রতিভাত  না  হয়  ৷  তার  পর  রাত্রি  পর্যন্ত  রোজা  পূর্ণ  করো  ৷  আর  যখন  তোমরা  মসজিদে  এ’তেকাফ এ  থাক  তখন  স্ত্রী-সহবাস  করো  না  ৷  এ  আল্লাহ্ র  সীমারেখা , সুতরাং  এর  ধারেকাছে  যেয়ো  না  ৷  এভাবেই   আল্লাহ্  মানুষের  জন্য  তাঁর  আয়াত  স্পষ্ট  ক’রে  ব্যক্ত  করেন , যাতে  তারা  সাবধান  হয়ে  চলতে  পারে  ৷

            ১৮৭  নং  আয়াতের  তফসিরের  সার- সংক্ষেপ ;-  এই আয়াতে  রোজার  অন্যান্য  আহ্ কামের  কিছুটা  বিশ্লেষণ  করে  বলা  হয়েছে  যে  ,   তোমাদের   জন্য  রোজার  রাতে  নিজেদের  স্ত্রী  সহবাসকে  হালাল  করে  দেয়া  হয়েছে  ৷  কারণ ইতিপূর্বে  যে  নিষেধাজ্ঞা  ছিল ,  তা  এখন  রহিত  হয়ে  গেছে  ৷  আল্লাহ্ তা’লা  জানতেন  যে  তোমরা  এই  খোদায়ী  হুকুমটির  খেয়ানত  করে  নিজেদেরকে  গোনাহে  লিপ্ত  করেছিলে  ৷  তবে  এরজন্যে  তোমরা  যখন  লজ্জিত  হয়েছ  তখন  আল্লাহ্  তোমাদের  প্রতি  অনুগ্রহ  করেছেন  এবং  তোমাদের  গোনাহ্  ধুইয়ে  দিয়েছেন  ৷  তবে  শুধু  এ’তেকাফের  সময়ে  স্ত্রীদের  দেহকে  নিজেদের  দেহের  সঙ্গে  কামভাবের  সাথে  একত্রিত  হতে  দিও  না  ৷  সাহাবী  ইবনে  আ’যেবের  বর্ণনায়  উল্লেখিত  হয়েছে  যে ,প্রথম  যখন  রমজানের  রোজা  ফরয  করা  হয়েছিল , তখন  ইফতারের  পর  থেকে  শয্যাগ্রহণের  পূর্ব  পর্যন্ত  খানা-পিনা  ও  স্ত্রী-সহবাসের  অনুমতি  ছিল  ৷  তবে  একবার  শয্যাগ্রহণ  করে  ঘুমিয়ে  পড়ার  সাথে  সাথেই  এ  সবকিছু  হারাম  হয়ে  যেতো  রাতের  পরের  অংশে   ৷  কোনো  কোন  সাহাবী  এ  ব্যাপারে  অসুবিধায়   পড়েন  ৷  কায়স  ইবনে-সারমাহ্ আনসারী  নামক  সাহাবী  একবার  সমগ্র  দিন  কঠোর  পরিশ্রম  করে  ইফতারের  সময়  ঘরে  ফিরে  এসে  দেখেন  ঘরে  খাওয়ার  মত  কিছু  নেই  ৷  যখন  স্ত্রী দেখলেন  স্বামী  কোনো  খাবার  নিয়ে    আসেন  নাই  ৷  তাই  স্ত্রী  কিছু  খাবার  সংগ্রহ  করতে  ঘরের  বাইরে চলে যান  ৷  স্ত্রী    খাবার  নিয়ে  ফিরে  এসে  দেখেন  রোজা  ও  সারা  দিনের  ক্লান্তিতে  তার  স্বামী  ঘুমিয়ে  পড়েছেন  ৷  আর  ইফতারের  পর  ঘুমিয়ে  পড়ার  দরুন  খানা-পিনা  তার  জন্যে  হারাম  হয়ে  গিয়েছে  বাকি  রাত্রিতে ৷  ফলে  পরদিন  তিনি  না  খেয়েই  রোজা  রাখেন  ৷  কিন্তু  দুপুর  বেলায়  শরীর  দুর্বল  হয়ে  তিনি  বেহুশ  হয়ে  মাটিতে  পড়ে  যান   ( ইবনে- কাসীর )

           অনুরূপভাবে  কোন  কোন  সাহাবী  গভীর  রাতে  ঘুম  ভাঙ্গার  পর  ভূলে  স্ত্রীদের  সাথে  সহবাসে  লিপ্ত  হয়ে  মানুসিক  কষ্ট  ভোগ  করতেন  ৷  এই  সব  ঘটনার  পর  সূরা  বাকারার  ১৮৭  নং  আয়াত  নাযিল  হয়  ৷  আর  বলা  হয যে  , এখন  থেকে  সূর্যাস্তের  পর  থেকে  শুরু  করে  সুবহে -সাদেক  উদিত  হওয়ার  পূর্ব  পর্যন্ত  সমগ্র  রাতেই  খানা-পানা  ও  স্ত্রী-সহবাস  বৈধ  করা  হয়েছে  এবং  পূর্বের  হুকুম  রহিত বা  মনসূখ  করা  হয়েছে  ৷  আর  হাদীস  অনুযায়ী  শেষরাত্রে  সেহ্ রী  খাওয়া  সুন্নত  সাব্যস্ত  করা  হয়েছে  ৷  প্রতিষ্ঠিত  সুন্নতকেও  কোরআনের  আয়াত  দ্বারা  মনসূখ  বা  রহিত  করা  যেতে  পারে  ৷ ( জাস্ সাস )
         (  ইসলামের   প্রবর্তনের  প্রাথমিক  সময়েই  যদি  নবীজীর  সাহাবীরা  এ  রকম  ভূল  করে  থাকেন  তবে  বর্তমানে  এর  প্রায়  ১৪৫০  বছর  পরের  আরবের  বাইরের  মুসলমানেরা  কতটুকু  নির্ভূলভাবে  ধর্ম কর্ম  পালন  করছেন ( !!) তা  এই  উদাহরণ  থেকেই  কল্পনা  করা  যায়  সহজেই  ৷ 

সূত্র ; ১ )  মূল  লেখার  তথ্যগুলো  ইসলামের  ইতিহাস  থেকে  সংগ্রহ  করা  হয়েছে  ৷ 
      ২ ) সূরা  বাকারার  আয়াতের  অনুবাদ  নেয়া  হয়ছে , মুহাম্মদ  হাবিবুর  রহমান       
          এর  বই  - কোরানশরিফ ,  সরল  বঙ্গানুবাদ  , থেকে  ৷ 
      ৩ ) তফসীরের  সার-সংক্ষেপ  নেয়া  হয়েছে -  তফসীরে  মা’আরেফুল-কোরআন  ( প্রথম      খণ্ড )    অনুবাদ  : মওলানা  মুহিউদ্দীন  খান  , ইসলামিক  ফাউণ্ডেশন  বাংলাদেশ  ,  (১৯৮৮ ,৪র্থ  সংস্করণ  )
    মূল গ্রন্থ রচিয়েতা , হযরত  মাওলানা   মুফতী  মুহাম্মদ  শফী :

মন্তব্যসমূহ